সন্ধ্যার পর রাত্রির প্রথম প্রহরে বসন্তদাস মন্দিরের চত্বরে এসে দাঁড়ায়। অধিকক্ষণ দাঁড়াতে হয় না–একটি ছায়ামূর্তি নিঃশব্দে পশ্চাতে এসে বলে, আপনি আমার সঙ্গে আসুন।
মন্দিরের পার্শ্বে সংকীর্ণ পথ। সেই পথ দিয়ে যেতে হয় মন্দিরের পশ্চাদ্ভাগে। দেখা যায়, মন্দিরের পশ্চাতেও বিস্তৃত প্রাঙ্গণ। সেখানেও একটি ক্ষুদ্র কুসুমিত উদ্যান–এবং ঐ উদ্যান সংলগ্ন পাশাপাশি কয়েকটি প্রকোষ্ঠ। এক প্রকোষ্ঠে ঘৃতদীপ জ্বলছিলো। কক্ষটির দ্বার উন্মুক্ত করে লোকটি বললো, ভিতরে যান, ছায়াবতীর আসতে বিলম্ব হবে, আপনি এখানেই বিশ্রাম নিন।
লোকটি অন্য কেউ নয়, দীপের আলোয় দেখা গেলো, সে অংশুমান। প্রকোষ্ঠের চারিদিক দৃষ্টিপাত করে নিলো বসন্তদাস। প্রকোষ্ঠটি ক্ষুদ্র, কিন্তু সুন্দর। দেওয়ালগাত্রে দীপস্থান, শয়নবেদীটি সামান্য নীচু, এক কোণে একখানি কাষ্ঠাসন, তাতে একখানি অজিন পাতা। দেখে মনে হয়, এ প্রকোষ্ঠে সম্মানিত ব্যক্তিরাই অবস্থান করেন। অংশুমান বললো, রাত্রে আপনি এখানেই আহার করবেন, ছায়াবতীর অনুরোধ।
অংশুমান ঐ কথাটি জানিয়ে প্রস্থান করে। বসন্তদাসের অদ্ভুত লাগছিলো সমস্ত ব্যাপারটি। আজই পরিচয় এবং ঐ স্বল্প পরিচয়েই ছায়াবতী তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে মন্দিরে রাত্রিযাপনের জন্য। সে কিছুই অনুমান করতে পারে না। সত্যই কি কোনো সংবাদ দিতে পারবে ছায়াবতী? নাকি শুধুই রাত্রিযাপনের সঙ্গী হবার আমন্ত্রণ? তার জীবনে যে কত অদ্ভুত ঘটনা ঘটবে, ঈশ্বর জানেন।
রাত্রির প্রথম প্রহর অতিক্রান্ত হয় দেখতে দেখতে। এক সময় অংশুমান ফলাহারাদি সম্মুখে এনে রাখে। বলে, আপনি আহার করে বিশ্রাম নিন। ছায়াবতী সম্ভবত প্রত্যুষে আপনার সঙ্গে কথা বলবে।
এ যে অতিথিকে আমন্ত্রণ করে এনে তার মুখের উপর সশব্দে দ্বার বন্ধ করে দেওয়ার মতো ঘটনা! হাসি পায় বসন্তদাসের। ছায়াবতীর সম্ভবত এটি এক প্রকারের রসিকতা। পুরুষকে চঞ্চল করে কৌতুক উপভোগ করার যে একটি সহজাত প্রবণতা ছলনাময়ী নারীর থাকে, সম্ভবত সেই প্রবণতার বশেই ছায়াবতী তাকে আমন্ত্রণ করে এনেছে এবং অন্তরাল থেকে দারুণ কৌতুক উপভোগ করছে। উত্তম কথা ছায়াবতী, সে মনে মনে বলে, তোমার ক্রীড়নক হতে আমার আপত্তি নেই, দেখি, তোমার কতক্ষণ এবং কতো প্রকারে ক্রীড়ামত্তা থাকতে পারে। সে ঘৃতদীপটি ফুৎকারে নির্বাপিত করে শয্যায় দেহ স্থাপন করে।
কিন্তু নিদ্রা আসে না। আজ সে নিকটবর্তী গ্রামগুলিতে সন্ধান করে এসেছে। প্রকাশ্যে তো কিছুই বলা যায় না। পান্থশালায়, নয়তো মন্দিরপ্রাঙ্গণে অথবা বটবৃক্ষতলে অপেক্ষা করতে হয়। যদি কোনো মানুষকে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়, তখন সন্তর্পণে তার কাছে প্রশ্নটি করতে হয়। তবে একটি বিষয়ে সে কিঞ্চিৎ আশ্বস্ত হয়েছে–আর তা হলো এই যে, পূর্বতীরে যোগীদের দুএকজনকে যদি বা দেখা গেছে–ভিক্ষু একজনকেও নয়। ভিক্ষুদের উপর কোনো রাজকীয় নির্দেশ আছে কি না কে জানে। যদি ফল্পগ্রাম অথবা বালিগ্রামের মতো অবস্থা এখানেও হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে চিন্তার কথা। চিন্তা নিজের জন্য নয়। চিন্তা ছায়াবতী এবং অংশুমানের জন্য।
শুনে এসেছে, বিল্বগ্রামের সামন্তপতি সুধীমিত্র পরম বৈষ্ণব এমন একটি আকাশচুম্বী বিষ্ণুমন্দির নির্মাণ করেছেন, যে না দেখলে বিশ্বাস হওয়া কঠিন। তিনি প্রজাবৎসল, সনাতন ধর্মীরা এতো সুখে জীবনযাপন করে যে ধর্মদ্বেষী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দেখলেই তাদের দূর দূর শব্দে বিতাড়ন করে।
হঠাৎ মনে হয়, বাহিরে কার যেন পদশব্দ। সে উৎকর্ণ হয়। এ কি সেই বালিগ্রামে অবলোকিতেশ্বর মন্দিরের মতো অবস্থা হলো না কি? হঠাৎ যদি এখন সেইরূপ কোনো গ্রন্থিছেদকের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়? সে অপেক্ষা করতে লাগলো।
না, পদশব্দ আর শোনা যাচ্ছে না। বোধ হয় আদৌ পদশব্দই নয়। রাত্রির কোনো মার্জার সম্ভবত অলিন্দে পতিত হয়েছিলো।
আবার শব্দ হয়। এবার রুদ্ধদ্বারে মৃদু করাঘাত। অগত্যা বসন্তদাসকে উঠতে হলো। দ্বার উন্মোচন করবে কি না দুমুহূর্ত চিন্তা করলো। শেষে অনুচ্চ কণ্ঠে বললো, বাহিরে কে?
মহাশয় কি নিদ্রিত? নারীকণ্ঠের মৃদু ডাক। প্রথমে সে উত্তর দিলো না। দ্বিতীয়বার। যখন ডাকটি পুনরায় শোনা গেলো, তখন সে জানতে চাইলো, কে আপনি?
আমি ছায়াবতী, দ্বার খুলুন।
বসন্তদাস দ্বার উন্মোচন করলে ছায়াবতী কক্ষে প্রবেশ করে। অন্ধকারে বার দুই দুজনের শরীর স্পৃষ্ট হয়। কিন্তু বসন্তদাস সংযম ত্যাগ করে না। ছায়াবতাঁকে মনে হয় পরিশ্রান্ত, ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছিলো সে। বসন্তদাস বললো, আমি দীপ জ্বালি, আপনি বসুন।
কেন দীপ জ্বালাবার কি প্রয়োজন? কথা তো অন্ধকারেই হতে পারে।
বসন্তদাস আমূল কম্পিত হয়। সত্যই কি এই নারী তার প্রতি প্রণয়াসক্তা হয়েছে? সে বললো, ভদ্রে অন্ধকারে তো কিছুই বোধগম্য হয় না, যার সঙ্গে কথা বলছি, তার মুখ না দেখলে কি নিশ্চিন্তে কথা বলা যায়, বলুন?
ছায়াবতী হাসে মৃদু। অন্ধকারে দেখা যায় না, কিন্তু শোনা যায় হাসিটি। বলে, দীপ জ্বালবেন না–বরং দ্বার মুক্ত করুন, বাহিরে চন্দ্রালোক আছে, তাতে কাজ হবে।
দ্বার সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করতেই বাহিরের চন্দ্রালোক ভিতরে প্রবেশ করে। কৃষ্ণপক্ষের ভগ্নচন্দ্রের মলিন জ্যোৎস্না। কিন্তু তাতেও ছায়াবতাঁকে দেখা যায়। তার দেহে বাসকসজ্জার বেশ। সে মনে মনে প্রমাদ গণনা করে। বলে, বসন্তদাস, তোমার ললাটলিপি খণ্ডাবে কেমন করে?
শয্যায় আসন নিয়েছিলো ছায়াবতী। সে ডাকলো, এখানে এসো, পাশে বসো আর অনুগ্রহ করে গ্রাম্য ষণ্ডের মতো গাঁক গাঁক করে চিৎকার করো না, মৃদু স্বরে কথা বলল।
বসন্তদাসের ইতস্তত বোধ হচ্ছিলো। ছায়াবতী তার ইতস্তত ভাব দেখে তিরস্কার করে। বলে, তুমি যে দেখছি অনভ্যস্ত বালকের মতো আড়ষ্ট হয়ে রইলে। ভয় পেয়ো না হে সাধুপুরুষ, তোমার সংযমের প্রাচীর ভঙ্গ করার কোনো ইচ্ছাই আমার নেই–আমি এমনিতেই বড় ক্লান্ত–আর এ বাসকসজ্জাও তোমার জন্য নয়। এটি ইতোমধ্যেই উচ্ছিষ্ট হয়ে রয়েছে। তুমি অতিথি, দেবতাতুল্য, উচ্ছিষ্ট দিয়ে তোমার পূজা করবো, এ কি হয়?
শোনো, বসন্তদাস পার্শ্বে উপবেশন করলে ছায়াবতী পুনরায় বলতে আরম্ভ করে, সংবাদ পেয়েছি, তোমার আত্মীয়রা সুনন্দগ্রামে অবস্থান করছেন। বৃদ্ধ শুকদেব, তাঁর স্ত্রী ও কন্যা এবং অপর একজন প্রৌঢ় একত্রে আছেন। আশ্রয়দাতা এক ক্ষেত্রকর গৃহস্থ। প্রত্যেকেই সুস্থ। চিন্তার কোনো কারণ নেই। ওদিকে উজুবটের অবস্থা এখন শান্ত, হরিসেন এখন রাজধানীতে। তবে মনে করো না যে তুমি নিরাপদ। তোমার নাম গূঢ় পুরুষেরা জানে। তোমাকে যদি পায়, তাহলে অবশ্যই বন্দী করবে। তোমার ঐ স্থানে গমন নিষিদ্ধ।
বিস্ময়ে বসন্তদাসের বিমূঢ়াবস্থা হয়–এ নারী কি দৈবজ্ঞ নাকি। এতো সংবাদ সে কীভাবে সংগ্রহ করলো? একেবারে মায়াবতীর পিতার নাম পর্যন্ত বলে দিচ্ছে। সে বললো, ভদ্রে, কী বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ জানাবো জানি না–আপনি আমাকে স্বস্থ ও নিশ্চিন্ত করলেন, ভগবান আপনার মঙ্গল করুন।
ভগবান ইতোমধ্যে আমার প্রচুর মঙ্গল করেছেন, ছায়াবতী হাসে। বলে, এতো মঙ্গল করেছেন যে তা রাখবার মতো আমার স্থান নেই–এখন তুমি আমাকে কিছু সংবাদ দাও দেখি, বলল, যবনেরা কি সত্য সত্যই গ্রাম লুণ্ঠন করছে?
কেন, আপনি কি যবনদের ত্রাতা এবং দয়ালু জ্ঞান করেন?
না, তা নয়, ছায়াবতী বলে, আক্রমণকারী বহিরাগত সৈন্যদলের আচরণ সর্বত্রই এবং সর্বদাই একরূপ হওয়ার কথা, এক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় হয়নি বলেই আমার ধারণা। কিন্তু কেউ কেউ যে বলছিলেন, যবন জাতি এলে প্রকৃতিপুঞ্জ রক্ষা পাবে, সামন্তপতিদের অত্যাচার দূর হবে, রাজানুচরদের প্রতাপ দমিত থাকবে–সেই জন্যই কিঞ্চিৎ আশা হচ্ছিলো, হয়তো বা এই যবন জাতির আচরণ অন্যরূপ হবে–এখন দেখছি, আমার পূর্বধারণাই সত্য, আমি যাই।
ছায়াবতী উঠে দাঁড়ালে বসন্তদাস বললো, আমার একটি কৌতূহল আছে।
বলো।
আপনি কেন এই গোপনতা অবলম্বন করেছেন–প্রকাশ্যে কি এসব কথা বলা যেতো না?
না হে নাগর, তা বলা যেতো না, হঠাৎ উচ্ছ্বসিত হাসিতে বেপথু হয় ছায়াবতী। বলে, প্রণয় ভাষণ কি প্রকাশ্যে সম্ভব? না তাতে আনন্দ আছে? আমি যে তোমার প্রণয় প্রার্থিনী হে, তা কি বোঝোনি?
হাসির উচ্ছ্বাস দমন করে যখন স্বাভাবিক হলো ছায়াবতী তখন সে আবার অন্য রমণী। বললো, বসন্তদাস, একটা কাজ করে দেবে?
বলুন, কী কাজ?
পুন্ড্রনগরীর একটি সংবাদ চাই। নিরঞ্জন আমার ভ্রাতা, বাল্যকাল থেকে নিরুদ্দেশ শুনেছি, সে সদ্ধর্মীদের সঙ্গে থাকে এবং প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেছে, যদি পারো, সংবাদটি আমাকে এনে দিও।
ছায়াবতীর কথা শুনে বসন্তদাসের মনে একইসঙ্গে নানান প্রশ্নের উদয় হয়। মন্দিরদাসীরও তাহলে ভ্রাতা থাকে, এবং সেই ভ্রাতার জন্য আবার উৎকণ্ঠাও থাকে? ওমন তো কখনও শোনেনি সে। উপরন্তু সংবাদ সংগ্রহের জন্য সে কি উপযুক্ত ব্যক্তি?
বললো, আপনি নিজেই তো সংবাদ সংগ্রহ করতে পারেন–আপনার মতো কি আমি পারবো?
ছায়াবতী নীরব থাকে কয়েকমুহূর্ত। তারপর বলে, তার সংবাদ তো আমি পেয়েছি কিন্তু সে আমার সংবাদ পাচ্ছে কি না, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত হতে পারছি না।
বসন্তদাস স্বীকৃতি দান করে। বলে, যদি আমি তার সাক্ষাৎ পাই, তাহলে নিশ্চয়ই তাকে আপনার কথা বলবো।
ছায়াবতী আরও কিছুক্ষণ নীরব থাকে। তারপর বলে, আমি যাই এবার, রাত্রি হয়েছে।
আর হ্যাঁ, শোনো, ছায়াবতী পুনর্বার স্মরণ করিয়ে দেয়। বলে, কাল প্রভাতে যখন পূজারম্ভে লোকসমাগম হবে, তখন মন্দির ত্যাগ করো, পূর্বে বা পরে নয়। আমার দুই প্রেমিক প্রায় সর্বক্ষণই মন্দিরের উপর দৃষ্টি রাখে।
ছায়াবতী অন্ধকারে ছায়ার মতোই অদৃশ্য হলো। বসন্তদাস দ্বারের বাইরে অন্ধকারের দিকে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তার অবাক লাগছিল, অদ্ভুত রহস্যময়ী এই নারী। কেন যে অমন কৌতুক করে, বোধগম্য হয় না। তবে অস্পষ্ট অনুমান হয়, তার জীবনে কোথাও একটি গভীর বেদনা রয়েছে। সে যখন হাসে, তখন মনে হয়, সে হাসি কান্নারও অধিক। আর কি মমতাময়ী! বসন্তদাস তার কেউ নয়, অথচ তার নিরাপত্তার জন্য কতই না চিন্তিত। সে ছায়াবতীর উদ্দেশে মনে মনে প্রণতি জানালো।
কৃষ্ণার কথা মনে পড়লো ঐ অন্ধকারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। সেও এক মন্দিরদাসী, মাত্র এক রজনীর জন্য এসেছিলো তার জীবনে। কিন্তু ঐ একটি রজনী দুরপনেয়ভাবে মুদ্রিত হয়ে রয়েছে তার স্মৃতিতে। কৃষ্ণার সঙ্গে কি আর কোনোদিন দেখা হবে না? তাকে। কি প্রাণ দিতে হয়েছে শেষাবধি? সে জানে না, প্রকৃত সংবাদ কেউ দিতে পারেনি। মিত্রানন্দকে সে বহুবার জিজ্ঞাসা করেছে–যেদিন শেষ সাক্ষাৎ হলো উজুবটে, সেদিনও। কিন্তু না, মিত্রানন্দ কোনো সংবাদই জানে না।
সে আর এক কাহিনী–যে কাহিনী তাকে মিত্রানন্দের সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছে, যে কাহিনীর মধ্য দিয়ে, বলা যায়, তার জন্মান্তর হয়েছে। সে নিজেকে প্রশ্ন করে, বসন্তদাস, তুমি কি এমন ছিলে?