সাইফুল ইসলাম সন্ধ্যার আগেই বাঁয়া-তবলা নিয়ে দবির মিয়ার বাড়ি উপস্থিত হল। তার কিছুক্ষণ পর ন-দশ বছরের একটা ছেলে মাথায় একটা সিঙ্গেল রীড হারমোনিয়াম নিয়ে ঘামতে ঘামতে এসে উপস্থিত। দবির মিয়া দুজনের কাউকে। কিছু বলল না। অতিরিক্ত গম্ভীর মুখ করে সে বসে রইল।
আজ টুনীকে দেখতে আসবে। বরপক্ষের কেউ যদি গান শুনতে চায়, সেজন্যই এ-ব্যবস্থা। দবির মিয়া কাল রাতেই জানতে পেরেছে টুনী বনের তাপস কুমারী আমি গো এই গানটি হারমোনিয়াম বাজিয়ে নিজে নিজে গাইতে পারে। শোনার পর থেকেই সে গম্ভীর হয়ে আছে। সিও সাহেবের মেয়ের সঙ্গে লুকিয়ে লুকিয়ে গান শেখার মানেটা কি? এত যদি গানের সখ, তাকে বললেই হত। অবশ্য বললেই যে সে গান শেখার ব্যবস্থা করত, তা নয়। নিতান্তই বাজে খরচ। হারমোনিয়াম সামনে নিয়ে মুখ বাঁকা করে চ্যাঁচ করার কোন মানে হয়? তাছাড়া শরিয়তেও গান-বাজনা নিষেধ আছে। কঠিন নিষেধ।
দবির মিয়া মুখ গম্ভীর করে থাকলেও আজকে গানের ব্যাপারে কোনো আপত্তি করে নি। এই মেয়েটি পার করা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। ইদানীং নতুন একটা টং হয়েছে, মেয়ে দেখতে এসে গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেস করা, তা গানটান কিছু জানে নাকি?
কি আমার গানের সমঝদার একেক জন। বিয়ের পরপরই ঢুকিয়ে দেবে রান্নাঘরে অথচ কথাবার্তা এ-রকম–যেন মিয়া তানসেন।
সাইফুল ইসলাম বলল, ইনারা দেরি করবেন নাকি?
দবির মিয়া জবাব দিল না। সাইফুল ইসলাম মুখে পাউডার মেখে এসেছে। সেন্ট-দেওয়া রুমাল দিয়ে ঘন ঘন নাক ঘষছে। মাগীমার্কা এই অপদার্থটাকে সহ্য করা মুশকিল। দেখলেই মনে হয় এই হারামজাদা গান শেখাবার ছলে সুযোগ পেলেই মেয়েছেলের গায়ে হাত দেয়।
দবির মিয়া লক্ষ করল অঞ্জু যত বার বাইরে আসছে, তত বারই এই শালা সাইফুল ইসলাম চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাকাচ্ছে। এক বার আবার বলল, এই খুকি, এক গ্রাস জল খাওয়াবে? জল খাওয়াবে কিরে হারামজাদা? পানি আবার জল হল কবে থেকে? দুই ঢোক পানি গিলেই চিকন স্বরে বলল, ধন্যবাদ। দবির মিয়া বহু কষ্টে রাগ সামলে মাগরেবের নামাজ পড়তে গেল।
বরপক্ষের লোকজন এসে পড়ল নামাজের মাঝামাঝি সময়ে। দবির মিয়া ইচ্ছা করে নামাজে দেরি করতে লাগল। মেয়ের বাপ ধৰ্মভীরু হলে দেখায় ভালো।
মেয়ে দেখতে এসেছে চার জন। মুরব্বি হল ছেলের চাচা, নেত্রকোণার সাবরেজিস্ট্রি অফিসে চাকরি করেন। ছেলে নিজেও এসেছে, সঙ্গে তার দু জন বন্ধু। ছেলে অতিরিক্ত লম্বা। মুখে বসন্তের দাগ। ধূর্ত চোখ। আসার পর থেকেই শেয়ালের মতো এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। কপালের কাছে বিরাট একটা আছিল–সেখান থেকে তিন-চারটা লম্বা কালো চুল ভুরু পর্যন্ত চলে এসেছে। অথচ প্রস্তাব যে এনেছে সে বলেছিল, রাজপুত্রের মতো গায়ের রঙ, খুব আদব লেহাজ। দবির মিয়া আদব-লেহাজের কিছুই দেখল না। আধা ঘন্টাও হয় নি এসেছে, এর মধ্যে বন্ধুদের নিয়ে তিন বার বারান্দায় গিয়ে সিগারেট টেনে এসেছে। অঙ্কুকে দেখে গলা খাকারি দিয়েছে। চড় দিয়ে এই হারামজাদার বিয়ের ইচ্ছা ঘুচিয়ে দিতে হয়।
দবির মিয়া অবশ্য ভদ্ৰভাবেই ওদের সঙ্গে কথাবার্তা বলল। ছেলের চাচার পাতে প্রবল আপত্তি সত্তেও দুটি সন্দেশ তুলে দিল। আয়োজন ছিল প্রচুর, তবু বেশ কয়েক বার বলল, যোগ্য সমাদর করতে পারলাম না। আমি খুবই শরমিন্দা ইত্যাদি। মেয়ের গান গাওয়ার সময় যখন এল তখন সে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। এইসব ছেলে-ছোকরার ব্যাপারে সে থাকতে চায় না। দবির মিয়া বারান্দায় এসে দেখে জহুর এসেছে। মোড়ায় বসে চা খাচ্ছে এক-একা।
জহুর, কোথায় ছিলে?
একটু বাইরে গিয়েছিলাম দুলাভাই।
লোকজন আসছে, ঘরে থাকলেই পারতে।
জহুর স্বাভাবিক স্বরেই বলল, দুলাভাই, আমি থাকলে নানা রকম জিজ্ঞাসাবাদ হবে। সেটা বিয়েটিয়ের জন্যে ভালো না।
দবির মিয়া চুপ করে গেল। জহুর বলল, যে বাড়িতে এক জন খুনী আসামী থাকে, সে বাড়ির মেয়ে বউ হিসেবে নিতে ভয়-ভয় লাগবে।
বলতে-বলতে জহুর মৃদু হাসল, আর ঠিক তখনি টুনীর গান শোনা গেল, আমি বন ফুল গো……। দবির মিয়া ঢোক গিলল। জহুর অবাক হয়ে বলল, টুনী গাইছে নাকি?
হুঁ?
গান শিখল কবে?
দবির মিয়া উত্তর দিল না। জহুর বলল, দুলাভাই, টুনী এত সুন্দর গান গায়। কী আশ্চর্য। আমি তো……
দবির মিয়া মিনমিন করে কী বলল ঠিক বোঝা গেল না। গান শেষে সাইফুল ইসলামের কথা শোনা গেল, মারাত্মক গলা। নিজের ছাত্রী বলে বলছিনা। হেঁ-হেঁ-হেঁ। খুব টনটনে গলা। খুব ধার।
ওরা মেয়ে পছন্দ করে গেল। মোটামুটিভাবে স্থির হল শ্রাবণ মাসে বিয়ে হবে। দেনা-পাওনা তেমন কিছু না। মেয়ের বাবা ইচ্ছে করে কিছু দিলে দেবেন–সেটা তাঁর মেয়েরই থাকবে। তবে ছেলের একটা মোটর সাইকেলের সখ। হোণ্ডা ফিফটি সিসি। তারা যাবার আগে টুনীকে ময়লা তেল চিটচিটে একটা এক শ টাকার নোট দিয়ে গেল।
দবির মিয়ার খুশি হওয়ার কথা, কিন্তু সে মনমরা হয়ে রইল। তার ওপর অনুফ যখন বলল, তার ছেলে পছন্দ হয় নি, তখন সে বেশ রেগে গেল। মেয়েছেলেরা ঝামেলা বাধার ওস্তাদ। পছন্দ না-হওয়ার আছে কী? ছেলের জমিজমা আছে। টুকটাক বিজনেস আছে। প্রাইমারি স্কুলের মাষ্টার, অসুবিধাটা কোথায়?
অনুফা মিনমিন করে বলল, ছেলেটা বেহায়া।
বেহায়া? বেহায়ার কী দেখলে? মেয়েমানুষ তো না যে ঘোমটা দিয়ে থাকবে।
অনুফা ঢক গিলে বলল, টুনীর পছন্দ হয় নাই।
টুনীর আবার পছন্দ-অপছন্দ কি? শুধু ফালতু বাত। একদম চুপ।
টুনী কানতাছে।
কান্দুক। তুই চুপ থাক।
তুইতকারি কর কেন?
বললাম চুপ।
দবির মিয়া দোকানে গেল মুখ কালো করে। যাবার পথে এক বার থানায় যাবে, এরকম পরিকল্পনা ছিল। মনসুরের ব্যাপারে কী হল জানা দরকার। কিন্তু থানায় যেতে আর ইচ্ছা করল না। যা ইচ্ছা করুক। মেরে তক্তা বানিয়ে দিক।
জুম্মাঘরের পাশ দিয়ে যাবার সময় চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। চৌধুরী সাহেব যেন দেখেও দেখলেন না। এর মানেটা কী? দবির মিয়া বলল, চৌধুরী সাহেব না? মালিকুম।
ও, তুমি। এত রাইতে কী কর?
রাত বেশি হয় নাই চৌধুরী সাব। দোকানের দিকে যাই।
চৌধুরী সাহেব দাঁড়িয়ে পড়লেন।
তোমার সঙ্গে কথা আছে দবির।
কী কথা, বলেন।
রাস্তার মধ্যে তো কথা হয় না। এক দিন বাড়িতে আস।
এখন যাব? এখন অবসর আছি।
না, এখন না।
কালকে আসব? সকালে?
দিন-তারিখ করবার দরকার নাই। অবসর মতো এক বার আস।
দবির মিয়া অত্যন্ত চিন্তিত মুখে বাড়ি ফিরে গেল।