মণ্ডল দুই বেটাকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে গেলো, বেলা তখন অনেক। সকালের পান্তা সব ঘাম হয়ে, হাওয়া হয়ে বেরিয়ে যাওয়ায় তমিজের পেটটা চুপসে গেছে। কিন্তু হলে কী হয়, নিজগিরিরডাঙায় দুই বিঘা সাত শতাংশ জমিটা এক পাক ঘুরে আসার জন্যে চোপসানো পেটশুদ্ধ সারাটা শরীর তার ছটফট ছটফট করে। বিলের ধারে বিলের পাহারায় নিয়োজিবুলুর বেটাকে বলে তমিজ চেয়ে নেয় মণ্ডলের কোষা নৌকাটা।
পানিতে টান ধরেছে, দক্ষিণে বাড়ির কাছে মাছ আটকে রাখার ব্যবস্থাও করে রেখেছে মণ্ডল। বিলে এখন মাছ ধরার জুত। বিল তো এখন ভরা পোয়াতি, গর্ভে তার রুই কালা থেকে শুরু করে পাবদা ট্যাংরা, কৈ মাগুর শিঙি আর খলসে পুঁটি। বিলের ভেতর, অনেক ভেতরে কোথায় মাছ রান্না হচ্ছে, তার ধোঁয়ায় তমিজের চোখমুখ ঝাপসা। হয়ে আসে। অবশ্য মাথার ওপর রোদের ভ্যাপসা তেজও তার চোখ ঝাপসা ঠেকার কারণ হতে পারে। আকাশে এদিক-ওদিক ছড়ানো মেঘ, সূর্যের তাপে সেগুলো এখন শুকাচ্ছে বলে পানিতে ময়লা মেঘের নিংড়ানো ধোয়া। পানি এখন তাই ঘোলা। আশ্বিনে। পানি আরো সরে গেলে বিল সাফসুতরো হবে। তা ঘোলা হোক আর সাফ হোক, বিল তো মণ্ডলের দখলে। রুই কি কালার কয়েকটা বাচ্চা বৈঠায় দুষ্টুমি করে ঠোকর দিয়ে যায় : মণ্ডলের বর্গাচাষী হওয়ায় কালাহারের মাছেরা কি তমিজকে বিদায় জানিয়ে গেলো?
কোষাটা বিলের পুব তীরে ভেড়ার আগেই দ্যাখা যায়, অল্প দূরে জমির আলে নামাজ পড়ছে হুরমতুল্লা পরামাণিক। কোষা থেকে লাফিয়ে নেমে, সেটা একটু টেনে ডাঙায় রেখে তমিজ গিয়ে দাঁড়ালো তার জমির পাশে। বিলের ঢালের একটু ওপরে এক দাগে শরাফতের সাড়ে চার বিঘা জমি। এর মাঝামাঝি আল, আলটা একটু চওড়াই। আলের পশ্চিম ভাগটা বর্গা করে হুরমতুল্লা, পুবেরটা এখন থেকে করবে তমিজ। খানিকটা তফাতে উত্তরে মোষের দিঘি, মস্ত গোল দিঘির উত্তর পূর্ব কোণে দিঘি থেকে অন্তত পাঁচ ছয় বিঘা জমি পেরিয়ে হুরমতুল্লার বাড়ি, দিঘির খুব উঁচু পাড়ের জন্যে এখান থেকে সম্পূর্ণ দ্যাখা যায় না। চার পাশটা ভালো করে দেখে বহুবার দ্যাখা জায়গাটা। তমিজ জরিপ করে। না, মণ্ডল তাকে জমি দিয়েছে চমৎকার। সমান ডাঙা জমি, একেবারে খিয়ার এলাকার মতো। মাঝখানের আলটাও সমান। কুলগাছের নিচে সবুজ জমিতে গামছার ওপর বসে নামাজের শেষে হাত দুটো জোড়া লাগিয়ে হুরমতুল্লা এখন মোনাজাত করছে। মাঝিপাড়া জুম্মঘরে নামাজের পর কুদুস মৌলবি একদিন বয়ান করেছিলো, রফাদানিদের এটাও একটা দোষ, মোনাজাতের সময় হাত এক সাথে করে। তারা শয়তানকে বসার সুযোগ করে দেয়। জোড়াহাতের পেছনে এবং এলোমেলো ছড়ানো দাড়ির ভেতরে হুরমতুল্লার কালো ঠোঁটজোড়া বিড়বিড় করে। মোনাজাত শেষ হলে হাত নামাবার পরেও দোয়া পড়া তার থামে না, তবে তার গলা চড়লে তমিজ শোনে, হুরমতুল্লার লক্ষ এখন আল্লাতালা নয়, তমিজ নিজে। কী রকম?-ক্যা রে মাঝির ব্যাটা, মণ্ডল তালে জমি তোকই দিলো? মণ্ডলেক কয়া হামাকও এটি থ্যাকা বিদায় দে। মাঝির সাথে জমিত কাম করবার পারমু না বাপু!
এরপর শুরু হয় তার একটানা আক্ষেপ, কততদিন সে গোটা সাড়ে চার বিঘা জমিতে মণ্ডলের কামলা খাটলো। তার আগে এই জমিতে কামলা খেটেছে হুরমতুল্লার। ভাই। তারপর গত বছর পাঁচেক হলো জমির আর্ধেকটা বর্গা করছে হুরমতুল্লা। পুরো। জমিটাই তো সে চেয়েছিলো, তখন মণ্ডল গলা নিচু করে বলেছিলো, বুঝিস তো, বেটারা যতোই কোক, ব্যামাক জমি বর্গা দাও; হাজার হলেও হামি চাষার বেটা। লিজের হাতোত নাঙল ধরি না, আবার কামলাকিষাণ দিয়াও যদি এক আধটা জমি আবাদ না করি তো জমি ব্যাজার হবি। এই জমিটা হামারই থাক, তুই এটি আগের লাকান কামলা খাট। তা ছেলেদের সঙ্গে যখন পারলোই না তখন এটা হুরমতুল্লাকে বর্গা দিলে মণ্ডলের লোকসানটা কী হতো? আবদুল আজিজ তো তার হয়ে বাপকে বলতেও চেয়েছিলো, বললো কি-না কে জানে? তাকে বর্গা দিলে তার আগের বর্গার জমিটার পাট না হয় সে। একটু আগেই কাটতো। পরে গোটা জমি জুড়ে আমন করে দেখিয়ে দিতো আবাদ করা কাকে বলে! তার মুশকিল হলো, সে নিজেও চাষার ঘরের ছেলে, দুই পুরুষ আগেও শরাফতের সঙ্গে তাদের আত্মীয়তা পর্যন্ত ছিলো। সে তো আর চামার কি কামার কি কুমার কি কলু কি মাঝির ঘরে জন্ম নেয়নি যে জমি বর্গা নেওয়ার জন্যে মণ্ডলের ছেলেদের পায়ে ধরবে। মণ্ডলেক খালি একবার কছিলাম। তার ছোটো বেটা কয়, এই জমি দেওয়া লাগবি তমিজেক। কিসক?-না, মাঝির বেটা জমিত সোনা ফলাবার পারবি। হঠাৎ কাশতে শুরু করলে হুরমতুল্লার শেষ কয়েকটি কথায় আবদুল কাদেরের মুখ ভ্যাংচাবার চেষ্টা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সফল হয়।
জবাব না দিয়ে তমিজ হাঁটু মুড়ে বসে নিজের বর্গা জমির মাটি তুলে দ্যাখে। আউশ কাটা হয়েছে জমি চেঁছে, নাড়ার গোড়া যেন কালচে হলুদ চুলের কদমছাট হয়ে ছড়িয়ে রয়েছে মাঠ জুড়ে। নাড়ার গোড়ায় হাত দিয়ে একটু ডলতে তার খড়খড়ে আঙুলে নরম ছোয়া লাগে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে জমিতে আস্তে আস্তে হাঁটলে পায়ের নিচে বৃষ্টির পানিতে ভেজা মাটি ও নাড়ার ছপছপ বোল ওঠে। কাল খুব ভোরে রাত থাকতে উঠে হুরমতুল্লার গোয়ালে রাখা মণ্ডলের জোড়া বলদ জোয়ালে জুতে লাঙল চালিয়ে দেবে এই নরম মাটিতে। মাঝির বেটা হলে কী হবে, তমিজ ঠিক বুঝে ফেলেছে, শরীরে লাঙলের ফলা লুফে নেওয়ার জন্যে জমি অস্থির হয়ে উঠেছে। জমিতে এটা কি বৃষ্টির পানি? চুতরের সামনে পানি ভাঙছে? প্রথম দিনেই যতোটা সম্ভব জায়গা জুড়ে চাষ দিয়ে জমির আশটা মেটানো চাই। পর দিন ফের চাষ দাও, তারপর পর দিন ফের চষো। সবটা জমিতে যতোবার পারে চাষ দিয়ে ফেলবে তমিজ। নাড়ার মোতাগুলো সব মাটির সঙ্গে মিশে যাবে, মিশতে মিশতে মাটির রঙ নেবে। জমি। কাদাকাদা করে তাতে রুয়ে দেবে কচি কচি ধানের চারা। মণ্ডলের বাড়ির পালানে বুলু বীজতলা করে গেছে। আজকেও দেখে এসেছে তমিজ। কী শোভা! কলাপাতা রঙের একটা নতুন কাঁথা যেন পেতে দিচ্ছে, পেতেই দিচ্ছে। কে পেতে দেয় গো? কাঁথা পাততে উপুড় হয়েছে ঐ মানুষটা কে? একটু নিচের দিকে তাকানো মুখটি কুলসুমের বলে বুঝতে পারলে তার মাথাটা ঘুরে যায় এবং এক্ষুনি বাড়ি ফিরতে ইচ্ছা করে। তার খিদে পেটে মোচড় দিতে থাকে নতুন করে। কিন্তু এসব কেবল কয়েক পলকের জন্যে। জমিতে লাঙল দিতে হবে;—একটা হাল, দুটো হাল, তিনটে হাল। জমির মাটি তুলতুলে নরম না হলে ধানের চারা কষ্ট পাবে। চারা বুনতে হবে একটু ফাঁক করে করে। তবেই না চারা বাড়বে, কলকল করে বাড়বে। চারা বাড়তে বাড়তে বাড়তে গাছ হবে, কাদায় পানিতে আরো বাড়বে। অগ্রহায়ণে পানি শুকায়, শুকনা জমিতে রসের খোঁজ করতে গাছ শিকড় নামায়, ওপরেও বাড়ে। কার্তিকে পানি না হলে এই জমিই খটখট করবে। তখন পানি সেঁচো রে, নিড়ানি দাও রে, গাছের গোড়ালি একটু আলগা করে দাও রে—এইসব খেদমত কোনো কালানুক্রমিক বা অন্য কোনোরকম বিন্যাসে না আসায় তমিজের মাথার উত্তেজনা কেবলি বাড়তে থাকে। মাথা থেকে পা পর্যন্ত তার। শিরশির করে, আবার সেখানে ফুরফুরে হাওয়াও একটু বয় বৈ কি! শিরশির-করা ফুরফুরে উত্তেজনায় শরাফত মণ্ডলের জমিকে নিজের জমি ভাববার সুখ ছিলো, এই প্রথম সম্পূর্ণ নিজের দায়িত্বে আবাদ করার উদ্বেগ ছিলো, আর ছিলো আবদুল কাদেরের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ, সেটা চড়ে গিয়েছিলো আনুগত্যে। এই অবস্থায় ছটফট করতে করতে তাকে একবার বসে পড়তে হয়েছে হুরমতুল্লার পাশে, তার হুঁকা নিয়ে লম্বা লম্বা টান দিলে খালি পেটে ধোয়া ঢোকে, খিদেটাকে বেশ ভোতা করা যায়। তার হাতে হুঁকা। রেখে হুরমতুল্লা ফের পাট কাটে। বুড়া পাট কাটে একা একা। প্রথমে আড়চোখে, পরে ভরা চোখে এবং আরো পরে শুধু তার দিকে দেখতে দেখতে তমিজ উঁকায় টান দিতে ভুলে যায়।—বুড়া হোক আর হিংসুটে হোক, মানুষটা খাটতে পারে বটে। এই চড়া। বেলায়, এইতো দিঘির ওপারে বাড়ি, তবু বাড়িতে গিয়ে কথায় পিঠটা ঠেকায়নি একবারও। একটা কামলা নেয়নি। বেশির ভাগ পাট সে একলাই কেটে ফেলেছে। বুড়া কি একাই সব করে? জিন পোষে নাকি?
জিনের কথা তার সম্বন্ধে শোনা যায় না। তবে বদনাম আছে অন্যরকম। কামলা রাখলেও মোটা কাজগুলো সারা হলেই কামলাপাট বিদায় দিয়ে জমিতে সে খাটায় তার মেয়েদের। হুরমতুল্লার মেয়ে তিন জন। বড়োটার বিয়ে হয়েছিলো, স্বামীর ভাত খায় না দুই বছরের ওপর। বাপের বাড়িতেই পড়ে আছে। তার পরেরটাও বিয়ের বয়েসি, ছোটোটা বোধহয় একেবারেই ছোটো। দুটো বিয়ে করেও হুরমতের ছেলের ভাগ্য হয়নি। আকালের সময় দুই নম্বর বৌকে সে পাঠিয়ে দিয়েছিলো বাপের বাড়ি, আকালেই সেটা মরে গেছে। তা ছেলে না হোক, লোকে বলে, মেয়েরাই তার একেকটা মদ্দা মানুষের মতো। নিজেদের ভিটার জমিতে সব কাম তো করেই, দিঘির দক্ষিণে এই বর্গা জমিতেও বাপের কামলাগিরি করে তারাই। বাপের সাথে সাথে তারা থাকে। এই যে পাট কাটছে বুড়া, কাটা পাটগাছ দাঁড় করিয়ে সাজিয়ে রাখার পটুত্ব তাদের কোনো কামলার চেয়ে কম নয়। তমিজ অনুমান করে, দুটো মেয়ে তার সঙ্গেই কাজ করছিলো, তমিজকে দেখে বাড়ির দিকে চলে গেছে। হুরমতুল্লা হঠাৎ করে ডাকে, মাঝির বেটা, একটু আসো তো। বস্যাই তো আছো, ধরো।
কাটা পাটগাছগুলো তমিজ ধরলে সদ্য-ফাঁকা-হওয়া জায়গায় সেগুলো দাঁড় করিয়ে রাখতে হুরমতুল্লার সুবিধা হয়। বুড়ার পাট হয়েছে ভারি সুন্দর। অতি চমৎকার। একটু দেরিতেই কাটলো, কিন্তু পাট নষ্ট হয়নি। গাছ একেকটা পুরুষ্টু কী! পাকা ছাল ছুঁড়ে আঁশের সোনালি আভা উঁকি দিচ্ছে এখন থেকেই। তমিজের মুগ্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে হুরমতুল্লা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, পাট তো আল্লা দিলে ভালোই হছে। লাভ কী? সোগলি বুঝি মণ্ডলের বাড়িতই ভোলা লাগে গো। পাঁচ বছর তার জমি বর্গা করি, খন্দ উঠলে হামার ঘরত যা তুলি কামলা দিলেও মনে হয় ততোকোনাই তুলতাম। কখন ধান করজ করি, কিবা কিবা হিসাব কয়, ফসল হামি কিছুই পাই না।
তমিজ বলে, তুমি আঁটিটা ধরো, আমি বাড়িত যাই।
আর এক ঘড়ি বাপু! এই কয়টা কোষ্টা কাটা হলেই আজ উঠমু।
না গো। যাই। হামার খিদা নাগিছে। তমিজ আল পেরিয়ে নিজের জমিতে উঠে দাঁড়ায়। এই বুড়া তো ভারি বজ্জাত। মণ্ডলের জমি বর্গা করে, ওর বাপের ভাগ্যি। কার্তিক মাসে মঙার সময় মণ্ডল ধান করজ না দিলে বুড়াকে তো যেতে হয় জগদীশ সাহার মোকামে। হিন্দু মহাজন যে ওর কী সর্বনাশ করতো সেটা সে এখনো টের পায়নি। জমির মালিককে তার ভাগের ফসল দিতে বুড়ার বুক টনটন করে। নিমকহারাম! নিমকহারাম! কথাটা কাদেরের কানে তোলা দরকার। না, কাদের মানুষটা নরম, তাকে দিয়ে কাজ হবে না। মণ্ডলকে সব খুলে বললে এখানে হুরমতুল্লাকে মণ্ডল জমিই দেবে না। হুরমতুল্লাকে উচ্ছেদ করতে হলে মণ্ডলকে চেতিয়ে দেওয়া দরকার। কাদেরকে লাগাবে এর পর। ওকে ধরে তমিজ এই জমিটা বর্গা পায় তো আল উঠিয়ে এক সঙ্গে সাড়ে চার বিঘা জমিতে সে মনের সুখে আবাদ করতে পারে। নিমকহারাম বুড়া হুরমতুল্লার বেইমানি তমিজের আর সহ্য হয় না।
কিন্তু শরাফত মণ্ডল কি তার কোনো ছেলের কানে তমিজ কথাটা আর তুলতে পারে। সময় কোথায় তার? সূর্য ওঠার অনেকটা আগে অন্ধকার থাকতেই লাঙল গোরু জোয়াল নিতে তমিজকে যেতে হয় হুরমতুল্লার বাড়ি। প্রায় রোজই ঐ সময়টাতে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ে। মাথাল মাথায় মোষের দিঘির উত্তরে যখন সে পেঁৗছয় বৃষ্টি তখনো পড়তেই থাকে। এর মধ্যে একবার ঝমঝম বৃষ্টি হয়ে যায় তো ভালো, এর মানে বৃষ্টির পর বিকাল পর্যন্ত আসমান সাফ থাকবে। যতো তাড়াতাড়িই করুক, হুরমতের বাড়ি গিয়ে তমিজ তাকে একদিনও দেখতে পায় না। তমিজ পৌঁছুবার অনেক আগেই বুড়া জমিতে গিয়ে হাজির। তমিজ লাঙল গোরু নিয়ে জমিতে পৌঁছতেই বুড়ার বড়ো মেয়েটা মুখের ওপর লম্বা ঘোমটা টেনে দৌড় দেয় বাড়ির দিকে। তখন হয়তো বেলা কেবল উঠছে। বৃষ্টির মধ্যে কাশতে কাশতে পাট কাটতে দেখে তমিজের মেজাজটা খিচড়ে যায়, বাপবেটির চোখে এদের নিন্দ নাই নাকি? বুড়ার বেটির তাকে দেখে ওভাবে পালাবার দরকার কী?
পাট কাটা কি পাটের গাছ গোছাবার কাজের ফাঁকে ফাঁকে হুরমতুল্লা কখনো কখনো হুঁকাটা হাতে নিয়ে চলে আসে তমিজের জমিতে। তমিজ হঠাৎ করে তার কথা শুনতে পায়, এ মাঝির বেটা, ইংকা করা নাঙল ধরলে মাটির মদ্যে ঠেলতে কষ্ট হয় গো। গোরু ক্যাংকা হাপস্যা যাচ্ছে দ্যাখো না? বলতে বলতে হুরমতুল্লা তার হাত থেকে লাঙল নিয়ে ভিজে মাটিতে লাঙল চষার যথাযথ কায়দাটি দেখিয়ে দেয়।
তা এই কয়েক দিনে তমিজ জমিটাকে একেবারে মাখনের মতো করে ফেলেছে। সকালবেলার দিকে কয়েক পশলা বৃষ্টি হয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত পানি প্রায় পড়েই না। বিকালের দিকে আলের ওপর বসে দুই হাতে কাদা ছানতে ছানতে বৃষ্টির গন্ধে, কাদার গন্ধে, একটুখানি আভাস-দিয়ে-যাওয়া রোদের গন্ধে এবং হাতের সঞ্চালনে তমিজের ঘুম ঘুম পায়, এই সময় জমিতে একেবারে উপুড় হয়ে শোবার তাগিদে তার সারা শরীর এলিয়ে এলিয়ে পড়ে। হয়তো সত্যি সত্যি সে শুয়েই পড়তো, কিন্তু বেছে বেছে ঐ মুহূর্তেই শালার বুড়ার বেটা চিৎকার করে বলে, ক্যা রে মাঝির বেটা, মাটি কি মাগীমানষের দুধ? ওংকা করা টিপিচ্ছো কিসক?—এই ধমকে তমিজের চোখের সামনে জমি যেন উদাম মেয়েমানুষ হয়ে শুয়ে থাকে। শুধু স্তন নয়, তার গোটা গতরে সাঁতার কাটার জন্যে তার নিজের শরীরেই ভয়ানক কোলাহল শুরু হয়। হুরমতুল্লার ওপর রাগ করার সুযোগও তার হয় না। আবার তার শরীরের কোলাহল চাপা পড়ে হুরমতুল্লার উপদেশে, হাত দিয়া মাটি ছানা হয় না। জমি চায় নাঙলের ফলা, বুঝলু জমি হলো শালার মাগীমানুষের অধম, শালী বড়ো লটিমাগী রে, ছিনালের একশ্যাষ। নাঙলের চোদন না খালে মাগীর সুখ হয় না। হাত দিয়া তুই উগলান কী করিস?
বলতে বলতে হুরমতুল্লা গম্ভীর হয়ে যায় এবং কাশির দমক অগ্রাহ্য করে সে জানায়, হাত দিয়ে ছানলে রোদ একটু চড়া হলেই মাটি শক্ত হয়ে যায়। ভেতরে শক্ত হলে সেই মাটিতে ধানের চারা আরাম পায় না।
জমির বুক থেকে হাত প্রত্যাহার করে নিয়ে তমিজ উঠে দাঁড়ায়। হুরমত কাশতে কাশতে দলা দলা থুথু ফেলে এবং এর ফাঁকে ফাঁকে বকেই চলে, মাঝির বেটা জমির খেদমত করবে কী করে? এ কী জাল ফেললো আর ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ উঠলো? মাছের প্রতি তারা যেমন নিষ্ঠুর, জমিও তাদের কাছে শুধু ভোগের বস্তু ছাড়া আর কী? চাষার ঘরে না জন্মালে কি আর জমির দরদ বোঝা যায়? আরে হুরমতুল্লা তো পুরুষমানুষ, তার বেটিরা পর্যন্ত জমির যে তদারকি করতে পারে, নতুন চাষা হওয়ার হাউস-করা মাঝি কি তার ধারে কাছেও যেতে পারবে?—মেয়েছেলের সাথে এরকম তুলনায় তমিজের গা জ্বলে যায়। একটু আগে তার দুই বিঘা সাত শতাংশ জমি জুড়ে উদাস হয়ে শুয়েছিলো যে লম্বা চওড়া মেয়েমানুষ সে হারিয়ে যায় জমির ভেতরে, তাকে আর দ্যাখা যায় না।
এই হুরমতুল্লাকে সহ্য করা দিনদিন তমিজের অসহ্য হয়ে উঠছে। কিন্তু কিছু বলাও মুশকিল। চাষবাসের সবই সে জানে খুব ভালো। তাকে দেখে সরে-যাওয়া বুড়ার বেটির কাজের যে নমুনা সে দ্যাখে তাও একেবারে নিখুঁত। বাপবেটির কাজে মুগ্ধ চোখজোড়া তমিজ কখনোই সরাসরি ফেলতে পারে না বুড়ার চোখে। কিন্তু পাট কাটুক আর কাটা পাটের গোছা সরাতে থাকুক আর কাশতে কাশতে মাঝির গুষ্টি উদ্ধার করুক, বুড়ার ঘোলাটে চোখজোড়ার একটা সবসময় নিয়োগ করা থাকে তমিজের দিকে।