তৃতীয় বিভাগ — অনাপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-মূল্যের উৎপাদন
সপ্তম অধ্যায় — শ্ৰম–প্রক্রিয়া এবং উদ্বৃত্ত–মূল্যে উৎপাদনের প্রক্রিয়া
৩.১ শ্ৰম–প্রক্রিয়া তথা ব্যবহার–মূল্য উৎপাদনের প্রক্রিয়া
ধনিক শ্রমশক্তি ক্রয় করে তা ব্যবহার করার জন্য; এবং ব্যবহারে নিযুক্ত শ্রম শক্তিই হচ্ছে স্বয়ং শ্রম। শ্রমশক্তির বিক্রেতাকে কাজে নিযুক্ত করেই শ্রমশক্তির ক্রেতা তা পরিভোগ করে। আগে সে ছিল সম্ভাব্য শ্রমিক কিন্তু কাজ করার মাধ্যমে সে হয়ে ওঠে বস্তুতঃই সক্রিয় শ্রমশক্তি অর্থাৎ শ্রমিক। যাতে করে তার শ্রম একটি পণ্যে পুনরাবির্ভূত হতে পারে, সেই জন্য তাকে সবার আগে তার শ্রমশক্তিকে ব্যয় করতে হবে এমন কিছুর উপরে যার আছে উপযযাগিতা, যা কোন এক রকমের অভাব পূরণে সক্ষম। অতএব, ধনিক শ্রমিককে যা করবার জন্য প্রবৃত্ত করে, তা হল একটি বিশেষ ব্যবহার-মূল্য, একটি নির্দিষ্ট জিনিস। ব্যবহার-মূল্য তথা দ্রব্যসামগ্রীর উৎপাদন সম্পাদিত হয় কোন ধনিকের নিয়ন্ত্রণে বা তার পক্ষে-এই যে ঘটনা, তা উৎপাদনের সাধারণ চরিত্রকে পরিবর্তিত করে না। সুতরাং, বিশেষ বিশেষ সামাজিক অবস্থাবলীতে শ্রম-প্রক্রিয়া যে বিশেষ বিশেষ রূপ ধারণ করে, তা থেকে স্বতন্ত্রভাবে আমরা শ্ৰম-প্রক্রিয়া সম্পর্কে আলোচনা করব।
প্রথমত, শ্রম হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যাতে মানুষ এবং প্রকৃতি উভয়েই অংশ গ্রহণ করে, এবং যেখানে মানুষ স্বেচ্ছায় তার নিজের এবং প্রকৃতির মধ্যেকার বাস্তব প্রতিক্রিয়াগুলি সূচনা করে নির্ধারণ করে, নিয়ন্ত্রণ করে। প্রকৃতির উৎপাদন-সমূহকে তার বিবিধ অভাবের সঙ্গে উপযোজিত আকারে আত্মীকৃত করার উদ্দেশ্যে সে নিজেকে প্রকৃতির বিপরীতে স্থাপন করে প্রকৃতিরই অন্যতম শক্তি হিসাবে। এই ভাবে বাহ্ন জগতের উপরে কাজ করে এবং তাকে পরিবর্তিত করে, সে সেই সঙ্গে তার নিজের প্রকৃতিরও পরিবর্ন ঘটায়। সে তার সুপ্ত শক্তিগুলিকে বিকশিত করে এবং সেগুলিকে বাধ্য করে তার নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করতে। শ্রমের যেসব আদিম প্রবৃত্তিজাত রূপ আমাদের কেবল পশুর কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়, এখন আমরা সেগুলি নিয়ে আলোচনা করছি না। মনুষ্য-শ্ৰম যখন ছিল তার প্রবৃত্তিগত পর্যায়ে সেই অবস্থা যে-অবস্থায় মানুষ তার শ্রমশক্তিকে বাজারে নিয়ে আসে তা পণ্য হিসাবে বিক্রি করার জন্য—এই দুই অবস্থার মধ্যে রয়েছে অপরিমেয় কালের ব্যবধান। শমকে আমরা ধরে নিচ্ছি এমন একটি রূপে, যার উপরে একান্ত ভাবেই মনুষ্য-প্রমের অভিধা মুদ্রিত। একটা মাকড়সা এমন অনেক ক্রিয়া সম্পাদন করে, যেগুলি একজন তন্তুবায়ের দ্বারা সম্পাদিত বিবিধ ক্রিয়ার অনুরূপ, এবং মৌচাক নির্মাণের কাজে একটা মৌমাছি একজন স্থপতিকেও লজ্জা দেয়। কিন্তু সবচেয়ে খারাপ স্থপতি এবং সবচেয়ে ভাল মৌমাছির মধ্যে পার্থক্য এই যে, স্থপতি তার ইমারতটি বাস্তবে গড়ে তোলার আগে সেটাকে গড়ে তোলে তার কল্পনায়। প্রত্যেকটি শ্ৰম-প্রক্রিয়ার শেষে আমরা পাই এমন একটি ফল, যেটি ঐ প্রক্রিয়াটির শুরুতেই ছিল শ্রমিকটির কল্পনার। যে-সামগ্রীটির উপরে সে কাজ করে, সে কেবল তার রূপেরই পরিবর্তন ঘটায় না, সে তার মধ্যে রূপায়িত করে তার নিজেরই একটি উদ্দেশ্য, যা তার কর্ম-প্রণালীটিকে করে একটি নিয়মের অনুসারী, যে-নিয়মটির কাছে তার নিজের অভিপ্রায়ও বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য। এবং এই বশ্যতা কোন ক্ষণস্থায়ী ব্যাপার নয়। দৈহিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অনুশীলন ছাড়াও, সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াটি দাবি করে যে, সমগ্র কর্মকাণ্ডটি জুড়ে কর্মী-মানুষটির অভিপ্রায় তার উদ্দেশ্যের সঙ্গে অবিচল ভাবে সঙ্গতি রক্ষা করে চলবে। এর মানে হল ঘনিষ্ঠ মনঃসংযোগ। কাজের প্রকৃতি এবং যে-পদ্ধতিতে তা সম্পাদিত হয় সেই পদ্ধতি যত কম আকর্ষণীয় হয়, এবং, সেই কারণে, তার দৈহিক ও মানসিক শক্তিগুলির স্মৃতির পক্ষে তা যত কম উপভোগ্য হয়, ততই সে আরো বেশি ঘনিষ্ঠ মনঃসংযোগ করতে বাধ্য হয়।
এম-প্রক্রিয়ার প্রাথমিক উপাদানগুলি হচ্ছে : (১) মানুষের ব্যক্তিগত সক্রিয়তা, অর্থাৎ খোদ কাজ, (২) ঐ কাজটির বিষয় এবং (৩) তার উপকরণ।
ভূমি (এবং অর্থনীতিতে জলও তার অন্তভুক্ত), কুমারী অবস্থায় যা মানুষকে যোগায়[১] প্রাণ-ধারণের আবশ্যিক দ্রব্যসামগ্রী বা উপায়সমূহ—সেই ভূমির অস্তিত্ব মানুষের অস্তিত্ব-নিরপেক্ষ এবং তা মনুষ্য-শ্ৰম-প্ৰয়োগের সর্বজনীন বিষয়। সেই যাবতীয় সামগ্রী, যেগুলিকে এম কেবল পরিবেশের সঙ্গে তাদের প্রত্যক্ষ সংঘোগ থেকে বিচ্ছিন্ন করে-সেই যাবতীয় সামগ্রীই হচ্ছে প্রকৃতির দ্বারা স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে প্রদত্ত শ্রম-প্ৰয়োগের বিষয়। যেমন মাছ, যা আমরা ধরি এবং জল থেকে তুলে নিই; কাঠ, যা আমরা বন থেকে কেটে আনি এবং আকর, যা আমরা খনি থেকে তুলে আনি। অপর পক্ষে, প্রমের বিষয়টি যদি হয়, বলা যায়, পূর্ব-কৃত শ্রমের মাধ্যমে পরিত, তা হলে তাকে আমরা বলি কঁচামাল; যেমন, ইতিপুর্বে তুলে আনা আকর, যাকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে ধৌত করার জন্য। সমস্ত কাচামালই শ্রম-প্রয়োগের বিষয় কিন্তু প্রত্যেকটি শ্রম-প্রয়োগের বিষয়ই কাচামাল নয়; তা কাচামালে পরিণত হয় শ্রমের মাধ্যমে কিছুটা পরিবর্তিত হবার পরে।
শ্রমের উপকরণ হচ্ছে এমন একটি জিনিস বা একা ধক জিনিসের সংখ্যাবিন্যাস ( ‘কমপ্লেক্স’ ), যাকে শ্রমিক স্থাপন করে তার নিজের এবং তার শ্রম-প্রয়োগের বিষয়ের মধ্যস্থলে এবং যা কাজ করে তার সক্রিয়তার পরিবাহী হিসাবে। অন্যান্য বস্তুকে তার উদ্দেশ্যের বশবতী করার জন্য সে ব্যবহার করে কিছু বস্তুর যান্ত্রিক, দৈহিক ও রাসায়নিক গুণাবলীকে।[২] গাছের ফলের মত প্রাণ-ধারণের এমন তৈরি জিনিস ইত্যাদিকে, যেগুলি সংগ্রহ করতে মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই কাজ করে শ্রমের উপকরণ হিসাবে, সেগুলিকে আলোচনার বাইরে রাখলে, যে জিনিসটিকে মানুষ সর্বপ্রথম করায়ত্ত করে, সেটি তার শ্রমের বিষয় নয়, প্রমের উপকরণ। এই ভাবে প্রকৃতি পরিণত হয় তার একটি কর্মেন্দ্রিয়ে, যাকে সে তার দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলির সঙ্গে যুক্ত করে নেয় এবং এই ভাবে, বাইবেল-এর বাণী সত্ত্বেও, নিজের উচ্চতাকে বৃদ্ধি করে নেয়। যেমন পৃথিবীই হচ্ছে মানুষের প্রথম ভাড়ার ঘর, তেমনি পৃথিবীই হচ্ছে তার প্রথম হাতিয়ারখানা। দৃষ্টান্ত হিসাবে বলা যায়, পৃথিবী তাকে যোগায় পাথর, যা সে ব্যবহার করে ছোড়ার জন্য, পেষার জন্য, চাপ দেবার জন্য, কাটবার জন্য। পৃথিবী নিজেই শ্রমের একটি উপকরণ, কিন্তু যখন সে কৃষিকর্মে এই ভাবে ব্যবহৃত হয়, তখন প্রয়োজন হয় গোটা এক প্ৰস্ত উপকরণের এবং শ্রমের অপেক্ষাকৃত উচ্চ-বিকশিত মানের।[৩] শ্রমের ন্যূনতম বিকাশ ঘটলেই তার আবশ্যক হয় বিশেষ ভাবে তৈরি-করা উপকরণসমূহের। এই কারণেই প্রাচীনতম গুহাগুলির মধ্যে আমরা পাই পাথরের উপকরণ ও অস্ত্রশস্ত্র। মানুষের ইতিহাসের আদিতম যুগে গৃহপালিত জন্তুগুলি অর্থাৎ সেই উদ্দেশ্যেই যেগুলি প্রতিপালিত এবং শ্রমের মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়েছে, সেই জন্তুগুলি এবং তাদের সঙ্গে বিশেষ তৈরি-করা পাথর, কাঠ, হাড় ও খোলকগুলি শ্রমের উপকরণ হিসাবে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করে।[৪] শ্রমের উপকরণের ব্যবহার ও নির্মাণ, যদিও কোন কোন প্রজাতির জন্তুর মধ্যে বীজাকারে বর্তমান ছিল, তা হলেও সেগুলিই হচ্ছে মানুষের শ্রম প্রক্রিয়ার নির্দিষ্ট চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য, এবং সেই কারণেই ফ্র্যাংকলিন মানুষের সংজ্ঞা দিযেছেন হাতিয়ার নির্মাণকারী জন্তু হিসাবে। জন্তু-জানোয়ারের লুপ্ত প্রজাতিসমূহের নির্ধারণে জীবাশ্মের যে-গুরুত্ব সমাজের লুপ্ত অর্থনৈতিক রূপগুলির সন্ধানকার্যে অতীত কালের শ্রম-উপকরণগুলিরও সেই একই গুরুত্ব। কি কি জিনিস তৈরি হল, তা নয়, কিভাবে সেগুলি তৈরি হল, কোন্ কোন্ হাতিয়ার দিয়ে সেগুলি তৈরি হল, সেগুলিই আমাদের সক্ষম করে বিভিন্ন অর্থনৈতিক যুগকে নির্ণয় করতে।[৫] মনুষ্য-শ্রম বিকাশের কোন্ মাত্রায় পৌছেছে, তা বুঝাবার জন্য শ্রমের উপকরণসমূহ আমাদের কেবল একটা মানদণ্ডই যোগায় না, সেই সঙ্গে সেই শ্ৰম যে-সামাজিক অবস্থায় সম্পাদিত হয়েছিল, তার একটা নির্দেশক হিসাবেও কাজ করে। পাইপ, টব, ঝুড়ি, কলসী ইত্যাদি যেগুলি লাগে কেবল শ্রমের মাল-মশলা ধারণ করতে এবং যেগুলিকে আমরা সাধারণ ভাবে বলতে পারি উৎপাদনের সংবহন-প্রণালী’, সেগুলির তুলনায় শ্রমের উপকরণসমূহের মধ্যে যেগুলি যান্ত্রিক প্রকৃতির, যেগুলিকে আমরা বলতে পারি উৎপাদনের অস্থি ও পেশী সেগুলি আমাদের যোগায় উৎপাদনের একটি বিশেষ যুগের চরিত্র-নির্ণয়ের চের বেশি নিশ্চয়ত্মক বৈশিষ্ট্যসমূহ। পাইপ, টব ইত্যাদিগুলি প্রথমে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা নিতে শুরু করে রাসায়নিক শিল্পসমূহে।
যেসমস্ত জিনিস শ্রমকে তার বিষয়টিতে প্রত্যক্ষ ভাবে স্থানান্তরিত করতে ব্যবহৃত হয় এবং যেগুলি সেই কারণে কোন-না-কোন ভাবে সক্রিয়তার পরিবাহী হিসাবে কাজ করে, সেই সমস্ত জিনিস ছাড়াও, ব্যাপকতর অর্থে আমরা শ্রমের উপকরণসমূহের মধ্যে ধরতে পারি এমন যাবতীয় বিষয় শ্রম-প্রক্রিয়া সম্পাদনের জন্য যেগুলির প্রয়োজন হয়। এগুলি প্রত্যক্ষ ভাবে শ্রম-প্রক্রিয়ার মধ্যে প্রবেশ করে না, কিন্তু এগুলিকে বাদ দিয়ে শ্ৰম-প্রক্রিয়া আদৌ সম্পাদিত হওয়া অসম্ভব কিংবা যদি সম্ভবও হয়, তা হলেও কেবল আংশিক মাত্রায়। আরো একবার আমরা পৃথিবীকে দেখি এই ধরনের একটি সর্বজনীন উপকরণ হিসাবে, কেননা তা শ্রমিককে দেয় দাঁড়াবার ঠাই এবং তার কাজের জন্য নিয়োগ-ক্ষেত্র। যেসব উপকরণ পূর্ব-কৃত শ্রমের ফল এবং সেই সঙ্গে আবার এই শ্রেণীরও অন্তভুক্ত, সেগুলির মধ্যে আমরা দেখি কর্মশালা, খাল, সড়ক ইত্যাদি।
সুতরাং শ্রম-প্রক্রিয়ায় মানুষের সক্রিয়তা, শ্রম-উপকরণের সহায়তায়, শ্রমের সামগ্রীর উপরে সংঘটিত করে এমন একটি পরিবর্তন, যা শুরু থেকেই পরিকল্পনা করা হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াটি উৎপাদিত দ্রব্যটির মধ্যে অন্তর্হিত হয়ে যায়; দ্রব্যটি হয় একটি ব্যবহার-মূল্য-প্রকৃতির সামগ্রী, যাকে পরিবর্তনের মাধ্যমে উপযোজিত করা হয়েছে মানুষের প্রয়োজনের সঙ্গে। শ্রম নিজেকে তার বিষয়টির মধ্যে অঙ্গীভূত করেছে; এম হযেছে বাস্তবায়িত এবং বিষয়টি হয়েছে রূপান্তরিত। যা শ্রমিকদের মধ্যে দেখা গিয়েছিল গতিশীল সক্রিয় হিসাবে, উৎপাদিত দ্রব্যটিতে তাই এখন দেখা যায় গতিহীন অব্যয় গুণ হিসাবে। কর্মকার (গরম নরম লোহাকে ) কোন আকার দেবার জন্য। হাতুড়ি চালায়; যা উৎপন্ন হয়, তা একটি নির্দিষ্ট আকার ( আকার-প্রাপ্ত সামগ্রী)।
আমরা যদি গোটা প্রক্রিয়াটিকে তার ফলের দিক থেকে উৎপন্ন দ্রব্যটির দিক থেকে বিচার করি, তা হলে এটা পরিষ্কার হয়ে যায় শ্রমের উপকরণ এবং শ্রমের বিষয়—উভয়ই হল উৎপাদনের উপায়,[৬] এবং এম নিজেই হল উৎপাদনশীল শ্রম।[৭]
যদিও শ্রম-প্রক্রিয়া থেকে উৎপন্ন হয় একটি দ্রব্যের আকারে একটি ব্যবহার-মূল্য, তা হলেও পূর্ব-কৃত শ্রমের দ্বারা উৎপন্ন দ্রব্যসমূহ উৎপাদনের উপায় হিসাবে তার মধ্যে প্রবিষ্ট হয়। একই ব্যবহার-মূল্য একই সঙ্গে পূর্ববর্তী একটি প্রক্রিয়ার উৎপন্ন ফল এবং পরবর্তী একটি প্রক্রিয়ার উৎপাদনের উপায়। সুতরাং উৎপন্ন দ্রব্য কেবল ফুলই নয়, সেই সঙ্গে শ্রমের আবশ্যিক শর্তও বটে।
আহরণমূলক শিল্পগুলি ছাড়া, যেখানে প্রকৃতিই সাক্ষাৎভাবে শ্রমের সামগ্রী যোগায়, যেমন খনি-খনন, শিকার, মাছ-ধর। ও কৃষিকাজ, (যখন তা কুমারী মাটি চাষ করার ব্যাপার ),—এগুলি ছাড়া, শিল্পের বাকি সকল শাখাই কাজ করে কাঁচামাল নিয়ে, শ্রমের মাধ্যমে পরিশ্রুত সামগ্রী নিয়ে, শ্রম-জাত দ্রব্যাদি নিয়ে। কৃষিকার্যে যেমন বীজ। জীবজন্তু এবং গাছপালা, যেগুলিকে আমরা প্রকৃতির উৎপাদন বলে ভাবতে অভ্যস্ত, সেগুলি তাদের বর্তমান রূপে কেবল, ধরুন, গত বছরেরই শ্রমের ফল নয়, সেগুলি মানুষের তত্ত্বাবধানে এবং মানুষের শ্রমের মাধ্যমে বহু প্রজন্ম-ব্যাপী অব্যাহত ক্রমিক রূপান্তরের ফল। কিন্তু বিপুলতর সংখ্যক ক্ষেত্রেই এমনকি খুব ভাসা-ভাসা দর্শকের চোখেও শ্রমের উপকরণসমূহের মধ্যে ধরা পড়ে বিভিন্ন অতীত যুগের চিহ্ন।
কাচামাল গঠন করতে পারে কোন উৎপন্ন দ্রব্যের প্রধান উপাদান, নয়তো, তার গঠনে প্রবেশ করতে পারে একটি সহায়ক সামগ্রী হিসাবে। সহায়ক সামগ্রী পরিভুক্ত হতে পারে শ্রমের উপকরণসমূহের দ্বারা, যেমন বয়লার-এর নিচেকার কয়লা, তেল পরিভুক্ত হয় চাকার দ্বারা, খড় চাষের ঘোড়ার দ্বারা; কিংবা কোন কাচামালে কিছু পরিবর্তন ঘটাবার জন্য তাকে মেশানো যেতে পারে সেই কঁচামালটির সঙ্গে, যেমন কোরা কাপড়ে ক্লোরিন, লোহার সঙ্গে কয়লা, উলের সঙ্গে রঙ; কিংবা তা সাহায্য করতে পারে খোদ কাজটিকেই সম্পাদন করতে, যেমন কর্মশালায় তাপ ও আলোর ব্যবস্থা করবার জন্য জিনিসগুলি। প্রধান উপাদান এবং সহায়ক সামগ্রীর মধ্যেকার পার্থক্য খাঁটি রাসায়নিক শিল্পগুলিতে অন্তর্হিত হয়ে যায়, কেননা তার মূল গঠনে উৎপন্ন দ্রব্যটির সত্তায় কাঁচামালের কোনটিরই পুনরাবির্ভাব ঘটে না।[৮]
প্রত্যেক বিষয়েরই থাকে বিবিধ গুণ এবং সেই জন্য প্রয়োগ করা যায় বিভিন্ন ব্যবহারে। সুতরাং একই অভিন্ন উৎপন্ন দ্রব্য একেবারে ভিন্ন ভিন্ন প্রক্রিয়ায় কাঁচামাল হিসাবে কাজ করতে পারে। যেমন, দানাশস্য; ঘানি-ওয়ালা, শ্বেতসার-প্রস্তুতকারক, মদ-চোলাইকারী এবং গো-পালক -সকলের কাছেই তা কাচামাল। তা তার নিজের উৎপাদনেও বীজের আকারে কাঁচামাল হিসাবে প্রবেশ করে, কয়লাও কয়লা-খননের শিল্পের একই সঙ্গে উৎপন্ন দ্রব্য এবং উৎপাদনের উপকরণ।
আবার, একটি বিশেষ উৎপন্ন দ্রব্য একই অভিন্ন প্রক্রিয়ায় শ্রমের উপকরণ এবং কাচামাল উভয় ভাবেই ব্যবহৃত হতে পারে। যেমন ধরুন, গো-মেদ-বর্ধন, যেখানে জন্তুটি একই সঙ্গে কাঁচামাল এবং সার-উৎপাদনের একটি উপকরণ।
একটি উৎপন্ন দ্রব্য, পরিভোগর জন্য প্রস্তুত থাকা সত্ত্বেও, অন্য একটি দ্রব্য উৎপাদনের কাঁচামাল হতে পারে, যেমন আঙর ফল, যখন তা ব্যবহৃত হয় মদ তৈরি করার জন্য। অপর পক্ষে, এম তার উৎপন্ন দ্রব্য এমন এক রূপে আমাদের দিতে পারে, যাতে আমরা তাকে কেবল কঁচামাল হিসাবেই ব্যবহার করতে পারি, যেমন তুলে, সুতো ইত্যাদি। এমন একটি কাচামাল, যা নিজে একটি উৎপন্ন দ্রব্য হওয়া সত্ত্বেও, যেতে পারে গোটা এক প্রস্ত বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে : যে সব প্রক্রিয়ার প্রত্যেকটিতে আবার তা নিরন্তর পরিবর্তনশীল রূপে কাজ করে কাঁচামাল হিসাবে, যে পর্যন্ত ঐ প্রস্তটির সর্বশেষ প্রক্রিয়া সমাপ্ত হবার পরে তা পরিণত হয় একটি সর্বাব্দ সম্পূর্ণ উৎপন্ন দ্রব্যে ব্যক্তিগত পরিভোগর জন্যও প্রস্তুত, শ্রমের উপকরণ হিসাবে ব্যবহারের জঃ ও প্রস্তুত।
অতএব, আমরা দেখতে পাচ্ছি, একটি ব্যবহার মূল্য কিভাবে গণ্য হবে, কঁচামাল হিসাবে, না শ্রম-উপকণ হিসাবে, না উৎপন্ন দ্রব্য হিসাবে, তা সম্পূর্ণভাবে নির্ধারিত হয় ম-প্রক্রিয়ায় তার ভূমিকার দ্বারা, সেখানে তা অবস্থানে থাকে তার দ্বারা; তা যখন বদলে যায়, তার চরিত্রও তখন বদলে যায়।
সুতরাং যখনি একটি উৎপন্ন দ্রব্য একটি নোতুন শ্রম-প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করে উৎপাদনের উপায় হিসাবে, তখনি তা তার দ্বারা তার উৎপন্ন দ্রব্যের চরিত্রটি হারায় এবং সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াটিতে একটি উপাদান-মাত্রে পরিণত হয়। একজন সুতো-কাটুনী তার টাকুগুলিকে দেখে কেবল সুতো কাটার উপকরণ হিসাবে, শনকে দেখে কেবল সুতো কাটার কঁচামাল হিসাবে। অবশ্য, কাচামাল আর টাকু ছাড়া সুতো কাটা অসম্ভব। সুতরাং সুতো কাটার কাজটি আরম্ভ করার সময়ে উৎপন্ন দ্রব্য হিসাবে নিশ্চয়ই এই জিনিসগুলির অস্তিত্ব ধরে নিতে হবে। কিন্তু এই জিনিসগুলি যে পূর্বকৃত শ্রমের ফল, খোদ এই ঘটনা সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াটিতে সম্পূর্ণ ভাবেই গুরুত্বহীন ব্যাপার। যেমন রুটিটা কৃষকের, ঘনি-ওয়ালার, না যে সেটা সঁাকে তার পূর্বকৃত শ্রমের ফল পরিপাক-প্রক্রিয়ায় তার কোনো গুরুত্ব নেই। উলটো, সাধারণতঃ উৎপন্ন দ্রব্য। হিসাবে তাদের বিভিন্ন ত্রুটির দ্বারাই কোনো প্রক্রিয়ার অন্তর্গত উৎপাদন উপকরণ সমূহ নিজেদেরকে প্রকাশ করে তাদের উৎপন্ন দ্রব্যগুলির চরিত্রে। একটি ভোতা ছুরি কিংবা ভঙ্গুর সুতো জোর করেই আমাদের মনে পড়িয়ে দেয় ছুরি-নির্মাতা এ ক-এর কথা, সুতো-কাটুনী ঐ খ-এর কথা। তৈরি জিনিসটিতে, যে-শ্রমের মাধ্যমে সেটা তার উপযোগিতা পূর্ণ গুণগুলি পেয়েছে, সেই শ্রম দৃষ্টিগোচর নয়, বাহ্যত তা অন্তর্হিত হয়ে গিয়েছে।
যে মেশিন প্রমের উদ্দেশ্য সাধন করেনা, তা অকেজো। উপরন্তু, তা প্রাকৃতিক শক্তিসমূহের বিধ্বংসী প্রভাবের কবলে পড়ে। লোহায় মরচে ধরে, কাঠ পচে যায়। যে সুতো দিয়ে আমরা সেলাইও করি না, বয়নও করি না, তা তুলোর অপচয় মাত্র। জীবন্ত শ্রম এদেরকে আয়ত্তে আনবে, মরণ-ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলবে, নিছক সম্ভাব্য ব্যবহার ধুলা থেকে এদের পরিবতিত করবে বাস্তব ও কার্যকর ব্যবহার-মূল্যে। এমের নিলে তিৰিক্ত হয়ে, এমের দেহযন্ত্রের অঙ্গীভূত হয়ে এবং ফেন সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াটিতে মিলে কর্তব্য-কর্ম সম্পাদনের জন্য সঞ্জীবিত হয়ে এরা কান্তবিক পক্ষে পৰিভুক্ত হয় কিন্তু পরিভুক্ত হয় একটি উদ্দেশ্য অনুযায়ী—নোতুন নতুন ব্যবহার-মূল্যের নতুন নোতুন উৎপন্ন দ্রব্যের, বিবিধ প্রাথমিক উপাদান হিসাবে, যে-মূল্যগুলি তথা দ্রব্যগুলি প্রাণ-ধারণের উপায় হিসাবে ব্যক্তিগত পরিভোগর জন্য, উৎপাদনের উপায় হিসাবে কোন নোতুন শ্রম, প্রক্রিয়ার জন্য সদা-প্রস্তুত।
সুতরাং, একদিকে, তৈরি জিনিস সমূহ যদি শ্রম-প্রক্রিয়ার কেবল ফলই না হয়, সেই সঙ্গে শ্রম-প্রক্রিয়ার আবশ্যিক শর্তও হয়, তা হলে, অন্যদিকে, উক্ত প্রক্রিয়ায় তাদের অন্তভুক্তি তথা জীবন্ত শ্রমের সঙ্গে তাদের সংস্পর্শই হবে একমাত্র উপায়, যার দ্বারা ব্যবহার-মূল্য হিসাবে তাদের চরিত্র রক্ষা করা যায়, তাদেরকে কাজে লাগানো যায়।
শ্রম তার বস্তুগত উপাদানগুলিকে, তার বিষয়-সামগ্রীকে এবং তার উপকরণসমূহকে ব্যবহারে লাগায়, সেগুলিকে পরিভোগ করে এবং সেই কারণে শ্রম একটি পরিভোগেরও প্রক্রিয়া। ব্যক্তিগত পরিভোগ এবং এই ধরণের উংপাদনশীল পরিভোগের মধ্যে পার্থক্য এই যে, প্রথমটি উৎপন্ন-দ্রব্যকে ব্যবহারে লাগায় জীবিত ব্যক্তির প্রাণধারণের উপকরণ হিসাব; দ্বিতীয়টি তা ব্যবহারে লাগায় উপায় হিসাবে, একমাত্র যে-হিসাবে জীবিত ব্যক্তির শ্রমকে তথা শ্রমশক্তিকে সক্রিয় হতে সক্ষম করা যায়। সুতরাং ব্যক্তিগত পরিভোগর উৎপন্ন ফল হচ্ছে পরিভোক্তা নিজেই, অন্যদিকে, উৎপাদনশীল পরিভোগর ফল কিন্তু এমন একটি উৎপন্ন দ্রব্য সেটি পরিভোক্তা থেকে স্বতন্ত্র।
সুতরাং, শ্রমের উপকরণসমূহ ও বিষয়-সামগ্রী যে-পর্যন্ত নিজেরাই হচ্ছে উৎপন্ন দ্রব্য, সে পর্যন্ত দেখা যায়, শ্রম উৎপন্ন দ্রব্য পরিভোগ করে পুনরায় উৎপন্ন দ্রব্য সৃষ্টি করার জন্যই অর্থাৎ এক প্রস্ত দ্রব্য পরিভোগ করার মাধ্যমে সেগুলিকে পরিণত করে আরেক প্রস্তু দ্রব্যে। কিন্তু ঠিক যেমন শুরুতে শ্রম-প্রক্রিয়ার শরিক ছিল কেবল মানুষ এবং পৃথিবী, যার অস্তিত্ব মানুষের অস্তিত্ব-নিরপেক্ষ, ঠিক তেমন এখনো আমরা শ্ৰম-প্রক্রিয়ায় নিয়োগ করি উৎপাদনের এমন অনেক উপায়, যেগুলি পাওয়া যায় সরাসরি প্রকৃতির কাছ থেকে, যেগুলির মধ্যে প্রতিফলিত হয় না মানুষের শ্রমের সঙ্গে প্রাকৃতিক বস্তু-সামগ্রীর কোনো সম্মিলিন।
উপরে যেন করা হয়েছে, তেমনিভাবে শ্রম-প্রক্রিয়াকে যদি তার বিবিধ প্রাথমিক উপাদানে পর্যবসিত করা হয়, তা হলে সেটা হয় ব্যবহার মূল্য উৎপাদনের উদ্দেশ্যে মানুষের সক্রিয়তা, মানুষের প্রয়োজনের সঙ্গে প্রাকৃতিক বস্তু-সামগ্রীর উপযোজন, মানুষ এবং প্রকৃতির মধ্যে বস্তুর বিনিময় ঘটাবার জন্য এটা একটা আবশ্যিক শর্ত; মানুষের পক্ষে এটা হচ্ছে প্রকৃতি কর্তৃক আরোপিত একটা চিরন্তন শর্ত এবং স্বভাবতই সেই অস্তিত্বের প্রত্যেকটি সামাজিক পর্যায় থেকে নিরপেক্ষ অথবা, বরং বলা যায়, এমন প্রত্যেকটি পর্যায়ের ক্ষেত্রেই সমাপেক্ষ (কমন’ )। সুতরাং, অন্যান্য শ্রমিকের সঙ্গে সংঘোগে আমাদের শ্রমিককে উপস্থাপিত করার আবশ্যক হয়নি; একদিকে মানুষ আর তার প্রম এবং অন্যদিকে প্রকৃতি ও তার বস্তু-সামগ্রীই আমাদের পক্ষে যথেষ্ট ছিল। যেমন ‘পরিজ’-এর স্বাদ থেকে বোঝা যায় নাকে ওট উৎপাদন কয়েছিল, তেমনি এই সরল প্রক্রিয়াটি নিজে থেকে আপনাকে বলে দেয়না কি সেই সামাজিক অবস্থাবলী, যার অধীনে সেটি সংঘটিত হচ্ছে; দাস-মালিকের পাশবিক চাবুকের তলায় নাকি, ধনিকের ব্যগ্র চোখের নীচে, সিসিন্যাটাস তার ছোট্ট ক্ষেতটি চাষ করার সময়ে নাকি একজন বন্য মানুষ পাথর দিয়ে বুনো জানোয়ার মারার সময়ে। [৯]
এখন আমাদের ভাবী ধনিকটির কাছে ফিরে যাওয়া যাক। আমরা তাকে ছেড়ে এসেছিলাম ঠিক তখন, যখন সে সবে, খোল বাজারে, শ্রম-প্রক্রিয়ার যাবতীয় প্রয়োজনীয় উপাদানগুলি ক্রয় করেছিল—শ্রম-প্রক্রিয়ার বিষয়গত উপাদানগুলি অর্থাৎ উৎপাদনের উপায়সমূহ এবং সেই সঙ্গে তার বিষয়ীগত উপাদানগুলিও অর্থাৎ শ্রম শক্তিও। একজন বিশেষজ্ঞের তীক্ষ দৃষ্টিতে সে বাছাই করে নিয়েছে তার বিশেষ শিল্পটির পক্ষে সবচেয়ে বেশি উপযোগী উৎপাদনের উপায় এবং বিশেষ ধরণের শ্রমশক্তি -তা সেই শিল্প সুতো কাটাই হোক, জুতো তৈরিই হোক বা অন্য কিছুই হোক। তার পরে সে অগ্রসর হয় ঐ পণ্যটিকে, তার সদ্য-ক্রীত শ্রমশক্তিকে পরিভোগ করতে; তা করতে গিয়ে সে শ্রমিককে দিয়ে, শ্রমশক্তির ব্যক্তি-ঘূর্তিটিকে দিয়ে, তার শ্রমের মাধ্যমে উৎপাদনের উপায়গুলিকে পরিভোগ করায়। এটা স্পষ্ট যে শ্রম-প্রক্রিয়ার সাধারণ চরিত্রটি এই ঘটনার দ্বারা পরিবর্তিত হয় না যে, শ্রমিক তার নিজের জন্য কাজ না করে, কাজ করে ধনিকের জন্য, অধিকন্তু, জুতো-তৈরি বা সুতো-কাটায় যে যে বিশেষ পদ্ধতি ও প্রণালী নিয়োগ করা হয়, ধনিকের এই প্রবেশের ফলে তা সঙ্গে সঙ্গেই পরিবর্তিত হয়ে যায় না। বাজারে শ্রমশক্তি যে অবস্থায় পাওয়া যায়, সেই অবস্থাতেই তাকে নিয়ে ধনিককে কাজ শুরু করতে হয়। সুতরাং, ধনিকদের অভ্যুদয়ের অব্যবহিত প্রাক্কালে যে-ধরণের শ্রম পাওয়া যায়, তাই নিয়েই তাকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। মূলধনের কাছে শ্রমের বশ্যতা-প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে উৎপাদনের পদ্ধতিতে পরিবর্তন শুরু হতে পারে কেবল পরবর্তী এক কালে; সুতরাং তা নিয়ে আলোচনাও করা হবে পরবর্তী কোন পরিচ্ছেদে।
যে-প্রক্রিয়ায় ধনিক শ্রমশক্তিকে পরিভোগ করে, সেই প্রক্রিয়াতে পরিণত হলে শ্রম-প্রক্রিয়ায় দুটি বৈশিষ্ট্য-সূচক ব্যাপার সূচিত হয় প্রথমত, শ্রমিক কাজ করে তার শ্রমের যে মালিক, সেই ধনিকের নিয়ন্ত্রণে; যাতে করে কাজটি সঠিক ভাবে সম্পন্ন হয়, উৎপাদনের উপায়গুলি বুদ্ধির সঙ্গে ব্যবহৃত হয়, কোনো কাঁচামালের অপচয় না ঘটে, কাজ চলাকালে স্বাভাবিকভাবে যে ক্ষয়-ক্ষতি হয় তার চেয়ে বেশি যাতে না হয়, সেই সবের জন্য ধনিক ভাল রকম তদারকি করে।
দ্বিতীয়তঃ, উৎপন্ন দ্রব্যটি হয় ধনিকের সম্পত্তি, শ্রমিকের অর্থাৎ প্রত্যক্ষ উৎপাদন কারীর নয়। ধরুন, একজন ধনিক একদিনের এম-শক্তি তার মূল্য অনুযায়ী ক্রয় করল; তা হলে একদিনের জন্য সেই শ্রমশক্তি ব্যবহারের অধিকার সে আয়ত্ত করে যেমন এক দিনের জন্য একটি ঘোড়া ভাড়া করলে, সে দিনের জন্য সেটি ব্যবহারের অধিকার সে পায়; অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রেও যা হয়। শ্রমশক্তি ক্রয় করে ধনিক সেই শ্রমকে প্রাণের দ্যোতনা হিসাবে একীভূত করে উৎপাদ্য দ্রব্যটির নিষ্প্রাণ উপাদানগুলির সঙ্গে। তার দিক থেকে, শ্রম-প্রক্রিয়া তার ক্রীত পণ্যের তথা শ্রমশক্তির পরিভোগের চেয়ে বেশি কিছু নয়; কিন্তু উৎপাদনের উপায়সমূহ দিয়ে শ্রমশক্তিকে সমন্বিত না করে এই পরিভোগ সম্পন্ন করা যায় না। যে সমস্ত জিনিস ধনিক ক্রয় করেছে, যে সমস্ত জিনিস তার সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে, সেই সমস্ত জিনিসের মধ্যেকার প্রক্রিয়াটিই হচ্ছে শ্রম-প্রক্রিয়া। যেমন তার কুঠরির মধ্যে গজিয়ে তোলার প্রক্রিয়ার ফলে যে-মদ উৎপন্ন হয়, সেই মদের সে মালিক, ঠিক তেমনি উল্লিখিত শ্রম-প্রক্রিয়ার ফলে যে দ্রব্য উৎপন্ন হয়, সেই দ্রব্যেরও সে মালিক।[১০]
————
১. পৃথিবীর স্বতঃস্ফূর্ত উৎপাদনসমূহ পরিমাণে অল্প এক মানুষ থেকে সম্পূর্ণ তন্ত্র; এই কারণে মনে হয় যেমন কোন যুবককে কিছু অর্থ দেওয়া হয় যাতে সে কোন একরকমের এম-শিল্পে ব্যাপৃত হয়ে তার ভাগ্য গড়ে নিতে পারে যেন তেমন গবেই প্রতি একলিকে দিয়েছে।(James Stuart : Principles of polit. Econ* edit. Dablin, 1770,v. I. Pw116 )
২. যুক্তি-বুদ্ধি যেমন শক্তিশালী, তেমন সুকৌশল। তার এই সুকৌশলী দিকটি প্রকাশ পায় প্রধানত তার মধ্যস্থতার ভূমিকায়, যা বিভিন্ন জিনিসকে তাদের নিজ নিজ প্রকৃতি অনুযায়ী পরস্পরের উপরে ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া করার সুযোগ দিয়ে, এবং এইভাবে সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াটিতে কোনো প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ না করেই, যুক্তি বুদ্ধির অভিপ্রায়কে কার্যকরী করে।” ( Hegel : “Enzyklopadie, Erster Theil, Die Logik”, Berlin, 1840, p. 382 ).
৩. (Theorie de l Econ. Polit. Paris, 1815) নামক তার গ্রন্থটি অন্যদিক থেকে শোচনীয় হলেও, গ্যানিল ‘ফিজিওক্র্যাটদের বিরোধিতা করে এক দীর্ঘ তালিকা উপস্থিত করেছেন, যাতে তিনি আশ্চর্যজনক ভাবে দেখিয়েছেন, সঠিক ভাবে যাকে কৃষিকার্য বলা যায়, তার সুচনার জন্য কতগুলি প্রক্রিয়া পার হওয়া আবশ্যক
৪. তুর্গো তার “Reflexions sur la Formation et la Distribution des Richesses” (1766) নামক বইয়ে সভ্যতার শৈশবে গৃহপালিত জন্তু জানোয়ারের গুরুত্বের কথা বিবৃত করেছেন।
৫. উৎপাদনের বিভিন্ন যুগের মধ্যে কৃৎকৌশলগত তুলনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ পণ্য হচ্ছে যাকে যথাযথ ভাবে বলা যায় ‘বিলাস-দ্রব্য। সমগ্র সমাজ জীবনের, অতএব, সমগ্র বাস্তব জীবনের ভিত্তিই হচ্ছে বস্তুগত উৎপাদনের বিকাশ; এতাবৎকাল আমাদের লিখিত ইতিহাসগুলি বস্তুগত উৎপাদনের বিকাশ সম্পর্কে যত সামান্যই লিখুক না কেন, তবু প্রাগৈতিহাসিক আমলকে কিন্তু শ্রেণীবিভক্ত করা হয়েছে তথাকথিত ঐতিহাসিক অনুসন্ধানের ফলাফল অনুসারে নয়, বরং বস্তুগত অনুসন্ধানের ফলাফল অনুসারেই। যে যুগে সে সামগ্রী দিয়ে উপকরণ ও হাতিয়ার তৈরি হত, সেই অনুসারেই হয়েছে তার নামকরণ, যেমন প্রস্তরযুগ, বোগ-যুগ ও লৌহ-যুগ।
৬. এটা আপাত-বিরোধী বলে মনে হয় যে মাছ ধরা পড়েনা, তাই হল মৎস্য শিল্পে উৎপাদনের অন্যতম উপায়। কিন্তু যে জলে মাছ নেই, সেই জলে মাছ ধরার কৌশলটি কেউই আবিষ্কার করেনি।
৭. উৎপাদনশীল শ্ৰম কি একমাত্ৰ শ্ৰম-প্রক্রিয়া থেকেই তা নির্ধারণ করার পদ্ধতিটি কোন ক্রমেই উৎপাদনের ধনতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
৮. সত্যকার কাচামালকে এবং সহায়ক নামকে স্টর্চ অভিহিত করেন যথাক্রমে Matieres” এবং “Materiaux” বলে। সহায়ক সামীকে Cherbuliez বলেন “Matieres instrumentales”.
৯. যুক্তিবিদ্যার অদ্ভুত কেরামতি দেখিয়ে কনেল টরেন্স বন্য মানুষের এই পাথরের মধ্যে আবিষ্কার করেছেন মূলধনের উৎপত্তি। “বন্য মানুষে বন্য পশুকে তাড়া করে প্রথম যে-পাথরটি ছুড়ল, নাগালের বাইরে কোন ফল পাড়বার জন্য প্রথম যে-লগুড়টি হাতে নিল, তারি মধ্যে আমরা লক্ষ্য করি আরেকটি জিনিস সংগ্রহে সাহায্যের জন্য একটি জিনিসের ব্যবহার, তারি মধ্যে লক্ষ্য করি মূলধনের উৎপত্তি।” (R, Torrens : “An Essay on the production of Wealth. &c. pp. 70-71 )।
১০. উৎপন্ন দ্রব্যাদির মূলধনে রূপান্তরিত হবার আগেই দখলভুক্ত হয়, এই রূপান্তরণ তাদের এই দখলভুক্ত হওয়া থেকে নিরাপত্তা দেয়না।” (Cherbuliez: “Richesse ou pauvrete” edit. paris, 1841, p. 54 )। প্রাণ-ধারণের আবশ্যিক সামগ্রীর একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের বিনিময়ে তার শ্রম বিক্রি করে দিয়ে ‘প্রেলেতারিয়ান’ উৎপন্ন দ্রব্যে কোন অংশ প্রাপ্তির দাবি ছেড়ে দেয়। উৎপন্ন দ্রব্যাদির ভোগ-দখলের পদ্ধতি আগের মতই থেকে যায়; উল্লিখিত ক্রয়-বিক্রয়ের দরুণ তাতে কোনো রদ-বদল ঘটেনা। উৎপন্ন দ্রব্যসম্ভারের মালিকানা থাকে একান্ত ভাবেই সেই ধনিকের দখলভুক্ত, যে কাচামাল ও প্রাণ-ধারণের সামগ্রী সরবরাহ করে, এবং এটা হল ভোগ-দখলের (আত্মীকরণের) নিয়মটির-সুকঠোর পরিণাম; অথচ যে-নিয়মটির মৌল নীতিটি ছিল ঠিক বিপরীত : শ্রমিক যা উৎপাদন করে, তার মালিকানা একান্ত ভাবে তারই।” (1.c. p. 58 ) “যখন শ্রমিকেরা তাদের শ্রমের জন্য মজুরি পায়….. তখন ধনিক কেবল সেই মূলধনেরই মালিক থাকে না”, (তিনি বোঝাতে চাইছেন “উৎপাদনের উপায়-উপকরণ” ) শ্রমেরও মালিক হয়। যদি মজুরি হিসাবে যা দেওয়া হয়, তা মূলধনের মধ্যে ধরা হয়, যা সাধারণতঃ করা হয়, তা হলে মূলধন থেকে এমকে আলাদা বলে ধরা অসম্ভব। এই ভাবে ব্যবহৃত মূলধন’ শব্দটির মধ্যে দুটোই অভুক্ত—এম এবং মূলধন।” (James Mill : Elements of pol. Econ.* &c., Ed. 1821, pp. 70, 71 )।
.
.
৩.২ উদ্বৃত্ত–মূল্যের উৎপাদন
ধনিকের দ্বারা আত্মীকৃত উৎপন্ন দ্রব্যটি হল একটি ব্যবহার মূল্য, যেমন সুতো, বা জুতো। কিন্তু যদিও জুতো হচ্ছে এক অর্থে সমস্ত সামাজিক প্রগতির ভিত্তি, এবং আমাদের ধনিক-ব্যক্তিটি নিঃসংশয়ে একজন প্রগতিবাদী”, কিন্তু তা হলেও সে জুতোর জন্যই জুতো তৈরি করে না। পণ্যের উৎপাদনে ব্যবহার মূল্য কোনো ক্রমেই তার মূল্য লক্ষ্য নয়। ধনিক ব্যবহার-মূল্য উৎপাদন করে কেবল এই কারণে এবং ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ তা বিনিময়-মূল্যের বস্তুগত ভিত্তি, তার আধার। আমাদের ধনিক ব্যক্তিটির চোখের সামনে আছে দুটি উদ্দেশ্য : প্রথমত, সে চায় এমন একটি ব্যবহার মূল্য উৎপাদন করতে যার বিনিময়-মূল্যও আছে অর্থাৎ সে চায় এমন একটি জিনিস উৎপাদন করতে যেটি বিক্রির জন্য পূর্বনির্ধারিত, তার মানে একটি পণ্য; এবং, দ্বিতীয়ত, সে চায় এমন একটি পণ্য উৎপাদন করতে যার মূল্য হবে উক্ত পণ্যটি উৎপাদন করতে যে সব পণ্য ব্যবহার করা হয়েছে, সে সব পণ্যের মোট মূল্যের চেয়ে বেশি, অর্থাৎ খোলা বাজার থেকে তার সাধের টাকা দিয়ে সে যে-উৎপাদনের উপায় উপকরণ এবং শ্রমশক্তি ক্রয় করেছিল, সেগুলি মোট মূল্যের চেয়ে বেশি। তার লক্ষ্য কেবল ব্যবহার-মূল্যই উৎপাদন করা নয়, মূল্যও উৎপাদন করা; কেবল মূল্যই নয়, সেই সঙ্গে উদ্বৃত্ত-মূল্যও।
মনে রাখতে হবে যে আমরা এখন পণ্যোৎপাদন নিয়ে আলোচনা করছি এবং এই পর্যন্ত আমরা কেবল উক্ত প্রক্রিয়ার একটি মাত্র দিক নিয়ে বিবেচনা করেছি। ঠিক যেমন পণ্যদ্রব্যগুলি একই সঙ্গে ব্যবহার-মূল্য এবং মূল্য, তেমনি সেগুলির উৎপাদনের প্রক্রিয়াও অবশ্যই হবে একটি শ্রম-প্রক্রিয়া এবং সেই একই সঙ্গে আবার মূল্য-সৃজনের প্রক্রিয়াও।[১]
আমরা এখন উৎপাদনকে পরীক্ষা করব মূল্যের সৃজন হিসাবে।
আমরা জানি, প্রত্যেক পণ্যেরই মূল্য নির্ধারিত হয় তার উপরে ব্যয়িত এবং তার মধ্যে বাস্তবায়িত শ্রমের পরিমাণের দ্বারা, বিশেষ সামাজিক অবস্থার মধ্যে তার উৎপাদনের জন্য আবশ্যক কর্ম-কালের দ্বারা। আমাদের ধনিক ব্যক্তিটির জন্য সম্পাদিত শ্রম-প্রক্রিয়ার ফলে তার হাতে যে উৎপন্ন দ্রব্য আসে, সেই তার ক্ষেত্রেও এই নিয়মটি প্রযোজ্য। যদি ধরে নেওয়া যায়, এই উৎপন্ন দ্রব্যটি হল ১০ পাউণ্ড সুতো আমাদের পদক্ষেপ হবে তার মধ্যে রূপায়িত শ্রমের পরিমাণটি হিসাব করা।
সুতো কাটার জন্য কচিমাল লাগে; ধরা যাক, এ ক্ষেত্রে তা হচ্ছে ১০ পাউণ্ড তুলল। বর্তমানে আমাদের এই তুলোর মূল্য হিসাব করার কোনো দরকার নেই, কেননা আমরা ধরে নেব আমাদের ধনিক-ব্যক্তিটি তা ক্রয় করেছে তার পূর্ণ মূল্যে, ধর। যাক, দশ শিলিং মূল্যে। তুলোর উৎপাদনের জন্য যে-শ্ৰম লেগেছিল সেটা এই দামের মধ্যে সমাজের গড় শ্রমের হিসাবে প্রকাশিত হয়েছে। আমরা আরো ধরে নেব যে আমাদের টাকুর ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ, যে টাকু আমাদের উপস্থিত উদ্দেশ্য সাধনের জন্য প্রতিনিধিত্ব করছে বিনিয়োজিত সমস্ত শ্রম-উপকরণের, সেই টাকুর ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ হচ্ছে ২ শিলিং পরিমাণ মূল্য। তা হলে, যদি ২৪ ঘণ্টার শ্রম কিংবা দুটি শ্রম-দিবসের প্রয়োজন হয় ১২ শিলিং দ্বারা প্রকাশিত সোনার পরিমাণ উৎপাদন করতে, তা হলে আমরা শুরুতেই পাই ইতিমধ্যেই সুতোর মধ্যে অঙ্গীভূত দুদিনের শ্রম।
আমরা যেন এই ঘটনার দ্বারা বিভ্রান্ত না হই যে যখন টাকুটির উপাদান ব্যবহারের ফলে কিছু মাত্রায় ক্ষয় পেযেছে, তখন তুলেটা একটা নোতুন আকার ধারণ করেছে। মূল্যের সাধারণ নিয়ম অনুসারে, যদি ৪০ পাউণ্ড সুতোর মূল্য হয় = ৪ ০ পাউণ্ড তুলে+ একটি গোটা টাকুর মূল্য অর্থাৎ যদি এই সমীকরণের উভয় দিকের পণ্য-সমূহ উৎপাদন করতে একই কাজের সময়ের প্রয়োজন হয়, তা হলে ১০ পাউণ্ড সুতো হবে একটি টাকুর এক-চতুর্থাংশ সমেত ১০ পাউণ্ড তুলোর সমার্থ। আলোচ্য ক্ষেত্রটিতে একই কাজের সময় এক দিকে বাস্তবায়িত হয় ১০ পাউণ্ড সুতোয়, অন্য দিকে ১০ পাউণ্ড তুলল এবং একটি টাকুর ভগ্নাংশে। সুতরাং মুল্য তুলোয়, টাকুতে বা সুতোয় যাতেই আবির্ভূত হোক, তাতে মূল্যের পরিমাণে কোনো পার্থক্য ঘটেনা। টাকু এবং সুতো পাশাপাশি শান্তভাবে অবস্থান না করে, সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াটিতে এক সঙ্গে যুক্ত হয়, তাদের রূপ পালটে যায় এবং তারা পরিবর্তিত হয় সুতোয়; কিন্তু তারা যদি কেবল তাদের সমার্থ সুতোর সঙ্গে বিনিমিত হত তার তুলনায় এই ঘটনার দ্বারা তাদের মূল্য বেশি প্রভাবিত হয় না।
তুলোর উৎপাদনের জন্য যে শ্রমের প্রয়োজন হয়, সুতোর জন্য যে কাচামালের প্রয়োজন হয়, তা সুতো উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রমের অংশ এবং সেই কারণেই সুততার মধ্যে বিস্তৃত। এই একই কথা টাকুর মধ্যে বিধৃত শ্রমের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, যে-টাকুর ক্ষয়-ক্ষতি ছাড়া তুলো থেকে সুতো কাটা যেত না।
অতএব, সুতোর মূল্য বা তা উৎপাদনের জন্ত আবশ্যক এম-সময়ের মূল্য নির্ধারণের ব্যাপারে বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন স্থানে যত বিশেষ প্রক্রিয়া সম্পাদনের প্রয়োজন হয়েছে, যেমন, প্রথমতঃ তুলো এবং টাকুর অপচিত অংশটি উৎপাদনের জন্য সম্পাদিত প্রক্রিয়া এবং তারপরে ঐ তুলোও টাকু দিয়ে সুতো কাটার জন্য সম্পাদিত প্রক্রিয়া, এই সমস্ত প্রক্রিয়াগুলিকে একটি অভিন্ন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ও পরম্পরাগত পর্যায় হিসাবে গণ্য করা যায় সুতোর মধ্যে বিধৃত গোটা শ্রমটাই হল অতীত শ্রম; এবং এটা মোটেই কোনো গুরুত্বপুর্ণ ব্যাপার নয় যে, তার সংগঠনী উপাদানগুলি উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কর্মকাণ্ডগুলি সম্পাদিত হয়েছিল এমন এমন সময়ে, যা আজকের এই সুতো কাটার চুড়ান্ত কর্মকাণ্ডটির চেয়ে অনেক পূর্ববর্তী। যদি একটি বাড়ি নির্মাণ করতে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ শ্রম; ধরা যাক, ত্রিশ দিন লাগে তা হলে তার মধ্যে বিধৃত মোট শ্রমের পরিমাণ এই ঘটনার দ্বারা পরিবর্তিত হয় না যে, প্রথম দিনের চেয়ে উনত্রিশ দিন পরে সম্পাদিত হয়, শেষ দিনের কাজটি। সুতরাং কঁচামাল ও শ্রম-উপকরণ সমূহের মধ্যে বিধৃত শ্রমকে গণ্য করা যায় যেন তা এমন শ্রম যা ব্যয়িত হয়েছিল সুতো কাটার প্রক্রিয়ার গোড়ার দিকের একটি পর্যায়ে, যথার্থ অর্থে সুতো কাটার শ্রম যখন শুরু হয়নি।
উৎপাদনের উপায়সমূহের, অর্থাৎ তুলো ও টাকুর, মূল্যগুলি, যা প্রকাশিত হয় বারো শিলিং দামের মধ্যে সেগুলি স্বভাবতই সুতোর মূল্যের কিংবা, অন্যভাবে বলা যায়, উৎপন্ন দ্রব্যটির মূল্যের সংগঠনী উপাদান।
যাই হোক, দুটি শর্তকে অবশ্যই পূর্ণ করতে হবে। প্রথমত, ঐ তুলো ও সুতোক সংযুক্ত হয়ে অবশ্যই একটি ব্যবহার-মূল্য উৎপাদন করতে হবে। বর্তমান ক্ষেত্রে এই দুটিকে মিলিত হয়ে হতে হবে সুতো। যে-বিশেষ ব্যবহার মূল্যটি তাকে ধারণ করে, তা থেকে মূল্য সেটি থেকে নিরপেক্ষ, কিন্তু তাকে কোন-না-কোন প্রকারের ব্যবহার। মূল্যের মধ্যে অবশ্যই মুর্ত হতে হবে। দ্বিতীয়ত, উৎপাদনের কাজে শ্রম যে সময় লাগায় তা উপস্থিত সামাজিক অবস্থায় যতটা সময় বস্তুতই প্রয়োজন, তার চেয়ে কিছুতেই বেশি হওয়া চলবে না। সুতরাং, ১ পাউণ্ড সুতো কাটতে যদি ১ পাউণ্ডের চেয়ে বেশি তুলো না লাগে, তা হলে ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে ১ পাউণ্ড সুতো উৎপাদনে ১ পাউণ্ডের চেয়ে বেশি তুলো পরিভুক্ত না হয় অনুরূপ ভাবে, টাকু সম্পর্কেও ঐ একই কথা। যদি ধনিক-ব্যক্তিটির সখ থাকে এবং সে ইস্পাতের টাকুর বদলে সোনার টাকু ব্যবহার করে, তা হলেও সুতোর মূল্যের যে-কোনো ব্যাপারে একমাত্র যে-মূল্যটি গণ্য হয়, তা হল ইস্পাতের টাকু তৈরি করতে যে-শ্ৰম লাগে, কেবল সেই শ্রম, কেননা উপস্থিত সামাজিক অবস্থায় তার চেয়ে বিশি কিছুর প্রয়োজন নেই।
আমরা এখন জানি সুতোর মূল্যের কতটা অংশ তুলো এবং টাকু থেকে সঞ্জাত। তার পরিমাণ দাঁড়ায় বারো শিলিং কিংবা দু দিনের কাজ। আমাদের আলোচনার পরবর্তী বিষয়টি হল : সুতোর মূল্যের কতটা অংশ কাটুনীর শ্রমের দ্বারা তুলোয় সংযোতিত হয়।
এই শ্রমকে আমাদের এখন দেখতে হবে এমন একটি আকারে যা শ্রম-প্রক্রিয়া চলা কালে সে যে আকার নিয়েছিল; তা থেকে সম্পূর্ণ পৃথক; শ্রম-প্রক্রিয়ায় তাকে আমরা দেখেছিলাম একান্ত ভাবে মানুষের সক্রিয়তার এমন একটি বিশেষ আকারে যা তুলোকে পরিবতিত করে সুতোয়; সেখানে বাকি সব কিছু অপরিবর্তিত থাকলে শ্রম। যতই সেই কাজের পক্ষে উপযুক্ত হয় ততই সুতো উৎকৃষ্ট হয়। কাটুনীর শ্রমকে তখন দেখা হয়েছিল অন্যান্য প্রকারের উৎপাদনশীল শ্রম থেকে নির্দিষ্ট ভাবে পৃথক আকারে একদিকে পৃথক তার বিশেষ উদ্দেশ্যের বিচারে, যা ছিল সুতো কাটা; অন্য দিকে, পৃথক তার কর্মকাণ্ডের বিশেষ চরিত্রের, তার উৎপাদনী উপায় উপকরণের বিশেষ প্রকৃতির এবং তার উৎপন্ন দ্রব্যটির বিশেষ ব্যবহার মূল্যটির বিচারে। সুত কাটার কর্ম কাণ্ডটির জন্য তুলে এবং টাকু অপরিহার্য প্রয়োজন, কিন্তু কামান তৈরির কাজে সেগুলো কোনো কাজেই লাগে না। উলটো দিকে এখানে আমরা কাটুনীর শমকে দেখি কেবল মূল্য সৃজন কারী হিসাবে অর্থাৎ মূল্যের একটি উৎস হিসাবে এবং এই বিচারে তার শ্ৰম কোনো ভাবেই যে লোকটি কামানের নল ছেদা করে তার শ্রম থেকে কিংবা ( আরো কাছের উদাহরণ নিলে ‘ উৎপাদনের উপায় উপকরণের মধ্যে বিধৃত তুলে উৎপাদন কারী ও টাকু-প্রস্তুত কারীর যে শ্রম তা থেকে ভিন্ন নয়। একমাত্র এই অভিন্নতার কারণেই তুলো-আবাদ টাকু তৈরি এবং সুতো-কাটা একটি সমগ্রের অর্থাৎ সুতোর মূল্যের উপাদানগত বিবিধ অংশ হতে পারে, যে-অংশগুলি পরস্পর থেকে কেবল পরিমাণগত ভাবেই বিভিন্ন। এখানে শ্রমের গুণ, প্রকৃতি এবং বিশেষ চরিত্র নিয়ে আমাদের কোনো কিছু বিবেচ্য নেই আমাদের বিবেচ্য একমাত্র তার পরিমাণ। এবং সেটা সহজেই হিসাব করে ফেলা যায়। আমরা এটা ধরে নিচ্ছি যে সুতো কাটা হচ্ছে সরল অদক্ষ শ্রম, সমাজের নিদিষ্ট অবস্থার গড় শ্রম। এর পর আমরা দেখতে পাব, বিপরীত কিছু ধরে নিলেও কোনো পার্থক্য ঘটে না।
শ্রমিক যখন কাজে থাকে, তখন তার শ্রম নিরন্তর একটা রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যায় প্রথমে সে থাকে গতি পরে সে হয় গতিহীন একটা বিষয়; প্রথমে থাকে কর্মরত শ্রমিক, পরে হয় উৎপা দত জিনিস। এক ঘণ্টা সুতো কাটার শেষে, সেই কাজটি প্রতিফলিত হয় একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সুতোয়; অন্য ভাবে বলা যায়, একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ শ্রম যেমন এক মাসের শ্রম, মূর্তি পরিগ্রহ করেছে ঐ তুলোয়। আমরা বলি শ্রম অর্থাৎ কাটুনী কর্তৃক তার প্রাণশক্তির <্যয়; আমরা বলি না সুতো কাটার শ্রম কেননা সুতো কাটার জন্য যে বিশেষ ধরনের শ্রম তা এখানে গণ্য হয় কেবল ততটা পর্যন্তই যতটা তা নির্বিশেষ শ্রম শক্তির ব্যয়, কাটুনীর বিশেষ ধরনের কাজ হিসাবে নয়।
আমরা এখন যে প্রক্রিয়াটি নিয়ে আলোচনা করছি তাতে এটা চরম গুরুত্বপূর্ণ যে, নির্দিষ্ট সামাজিক অবস্থায় তুলোকে সুতোয় রূপান্তরিত করতে যতটা সময় আবশ্যক হয়, যাতে তার চেয়ে বেশি সময় পরিভুক্ত না হয়। স্বাভাবিক অর্থাৎ উপানের গড় অবস্থায় যদি ‘ক’ পাউণ্ড তুলোকে ‘খ’ পাউণ্ড সুতোয় রূপান্তরিত করতে লাগে, এক ঘন্টার শ্রম, তা হলে ১২ ‘ক’ পাউণ্ড তুলোকে ১২ ‘খ’ পাউণ্ড সুতোয় পরিণত না। করলে এক দিনের শ্রমকে ১২ ঘণ্টার শ্রম বলে গণ্য করা হয়না কেননা মূল্যর সৃজনের ক্ষেত্রে একমাত্র সামাজিক ভাবে আবশ্যিক শ্রমকেই হিসাবে ধরা হয়।
কেবল এমই নয়, সেই সঙ্গে কাচামাল এবং উৎপন্ন দ্রব্যটিও এখন প্রতিভাত হয় সম্পূর্ণ নোতুন আলোয়—সাদামাটা শ্রম প্রক্রিয়ায় আমরা তাদেরকে যে আলোয় দেখে ছিলাম, তা থেকে সম্পূর্ণই আলাদা এক আলোয়। কঁচামাল এখন কাজ করে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ শ্রমের নিছক বিশেষক হিসাবে। এই বিশেষণের মাধ্যমেই বস্তুত পক্ষে, কঁচামাল পরিবর্তিত হয়, কেননা তা দিয়ে সুতো কাটা হয়, কেননা সুতো কাটার রূপে শ্রম শক্তি তার সঙ্গে যুক্ত হয়; কিন্তু উৎপন্ন দ্রব্যটি অর্থাৎ ঐ সুতো এখন আর তুলোর দ্বারা বিশেষিত শ্রমের একটা পরিমাপ ছাড়া আর কিছু নয়। যদি এক ঘণ্টায় ১৪ পাউণ্ড তুলো দিয়ে ১৪ পাউণ্ড সুতো কাটা যায়, তা হলে ১০ পাউণ্ড সুতো নির্দেশ করে ৬ ঘণ্টা শ্রমের বিশেষণ। উৎপন্ন দ্রব্যের বিভিন্ন নির্দিষ্ট পরিমাণ—এই পরিমাণ গুলি নির্ধারিত হয় অভিজ্ঞতার দ্বারা -এখন প্রতিনিধিত্ব করে কেবল বিভিন্ন নির্দিষ্ট পরিমাণে শ্রমের, বিভিন্ন নির্দিষ্ট আয়তনের স্ফটিকায়িত শ্রম-সময়ের। সেগুলি আর এত ঘণ্টার শ্রমে র বা এত দিনের শ্রমের বাস্তবায়িত রূপ ছাড়া কিছু নয়।
বিষয়টি নিজেই হচ্ছে একটি উৎপন্ন দ্রব্য এবং সেই কারণেই একটি কাচামাল -এই যে ঘটনা তাতে আমাদের যতটা আগ্রহ তার চেয়ে আমরা ঘটনাবলীতে বেশি আগ্রহী নই যে, শ্রম হচ্ছে সুতো কাটার নিদিষ্ট কাজ, তার বিষয় হচ্ছে তুলো এবং তার উৎপন্ন দ্রব্য সুতো। যদি সুতেকাটুনী, সুতো না কেটে কাজ করত কোন কয়লা খনিতে, তা হলে তার শ্রমের বিষয়টি অর্থাৎ কয়লা হত প্রকৃতির সরবরাহ; তৎসত্ত্বেও, উত্তোলিত কয়লার একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ, ধরা যাক, এক হর, একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ বিশশাষিত শ্রমের প্রতিনিধিত্ব করত।
শ্রমশক্তির বিক্রয়ের কালে আমরা ধরে নিয়েছিলাম যে এক দিনের শ্রমশক্তির মূল্য হল তিন শিলিং এবং ঐ তিন শিলিং এর মধ্যে বিধৃত আছে ছয় ঘণ্টার এম; এবং কাজে কাজেই, শ্রমিকের প্রাণ-ধারণের জন্য গড়পড়তা দৈনিক প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী উৎপাদন করতে আবশ্যক হয় এই পরিমাণ শ্রম। যদি এখন আমাদের কাটুনী এক ঘণ্টা কাজ করে ১ পাউণ্ড তুলে রূপান্তরিত করতে পারে ১*২/৩ পাউণ্ড সুতোয়[২] তা হলে অনুসৃত হয় যে ছয় ঘণ্টায় সে ১০ পাউণ্ড তুলোকে রূপান্তরিত করতে পারে ১০ পাউণ্ড সুতোয়। অতএব সুতোকাটার প্রক্রিয়ায় তুলে। বিশোষণ করে ছয় ঘণ্টার শ্রম। একই পরিমাণ শ্রম বিধৃত হয় তিন শিলিং মূল্যের এক টুকরো সোনায়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে কেবল সুতো কাটার শ্রমের দ্বারাই তুলোয় সংযোজিত হচ্ছে তিন শিলিং পরিমাণ মূল্য।
এখন আমরা বিচার করব উৎপন্ন দ্রব্যটির ১০ পাউণ্ড সুতোর মোট মূল্য। এর মধ্যে মূর্তায়িত হয়েছে আড়াই দিনের শ্রম, যার মধ্যে দুদিনের শ্রম বিস্তৃত ছিল তুলে এবং টাকুটির ক্ষয় প্রাপ্ত অংশের মধ্যে আর আধ দিনের শ্রম বিশোষিত হয়েছিল সূতো কাটার প্রক্রিয়ায়। এই আড়াই দিনের শ্রমেরও প্রতিনিধিত্ব করে পনেরো শিলিং মূল্যের এক টুকরো সোনা। অতএব, ১০ পাউণ্ড সুতোর উপযুক্ত দাম হল পনের শিলিং অর্থাৎ এক পাউণ্ডের দাম হল আঠারো-পেন্স।।
আমাদের ধনিক-ব্যক্তিটি সবিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে তাকায়। উৎপন্ন দ্রব্যটিক মূল্য অগ্রিম প্রদত্ত মূলধনের ঠিক সমান। অগ্রিম প্রদত্ত ঐ মূল্যের কোন প্রসার ঘটেনি, কোনো উদ্ধৃত্ত মূল্যের সৃষ্টি হয়নি এবং স্বভাবতই অর্থ মূলধনে রূপান্তরিত হয়নি। সুতোর দাম পনেরো শিলিং, এবং পনেরো শিলিং ব্যয়িত হয়ে ছিল উৎপন্ন দ্রব্যটির সংগঠনী উপদানগুলির বাবদে, কিংবা অন্য ভাবে বলা যায়, শ্রম-প্রক্রিয়ার উপাদান গুলির বাবদে; দশ শিলিং দেওয়া হয়েছিল তুলোর বাবদে, দুই শিলিং টাকুর ক্ষয়প্রাপ্ত অংশটির বাবদে এবং তিন শিলিং, শ্রম শক্তির বাদে। সুতোর পরিস্ফীত মূল্যটি কোনো ব্যাপারই নয়, কেননা আগে যে মূল্যগুলি অবস্থান করত তুলোয়, টাকুতে এবং শ্রমশক্তিতে, সুতোর পরিস্ফীত মূল্যটি কেবল সেগুলিরই যোগফল; আগে থেকেই যে-মূল্যগুলি আছে, সেগুলির সরল যোগফলে কোন উদ্ব-মূল্যের উদ্ভব সম্ভব নয়।[৩] এই পৃথক পৃথক মূল্যগুলি এখন একটি মাত্র জিনিসে, কেন্দ্রীভূত হয়েছে, কিন্তু পণ্যগুলির ক্রয়ের মাধ্যমে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন অংশে পৃথগীভূত হবার আগে পর্যন্ত তারা তো পনেরো শিলিং এর মোট অঙ্কটির মধ্যে সেইভাবেই ছিল।
আসলে এই ফল দেখে বিস্মিত হবার কিছু নেই। এক পাউণ্ড সুতোর মূল্য আঠারো পেন্স; আমাদের ধনিক যদি বাজার থেকে ১০ পাউণ্ড সুতা কেনে, তা হলে তাকে দিতে হবে ১৫ শিলিং। এটা স্পষ্ট যে কোন লোক একটা তৈরী বাড়িই কিনুক কিংবা সেটা নিজের জন্য তৈরি করিয়েই নিক, কোনো ক্ষেত্রেই আয়ত্তী করণের পদ্ধতি বাড়িটির জন্য অর্থ বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধি করেন।
নিজের হাতুড়ে অর্থনীতির জ্ঞান নিয়ে আমাদের ধনিকটি চেঁচিয়ে ওঠে, কিন্তু আমি যে অর্থ আগাম দিয়েছিলাম আরো অর্থ পাবার প্রকাশ্য উদ্দেশ্যেই।” নরকের পথ অসদুদ্দেশ্য দিয়ে বাঁধানো, এবং তার সহজেই এই উদ্দেশ্য থাকতে পারে যে আদৌ কোন টাকা উৎপাদন না করেই সে সেই টাকা করবে।[৪] সে সব রকমের ভয় দেখায়। এমন অসতর্ক অবস্থায় আর কখনো সে ধরা দেবে না। ভবিষ্যতে নিজে উৎপাদন না করে সে বাজার থেকে পণ্যগুলি কিনে নেবে। কিন্তু যদি তার সব জাত ভাইয়েরা, বাকি সব ধনিকেরা একই কাজ করে তা হলে বাজারে কোথায় সে ঐ পণ্য পাবে? এবং তার টাকা সে খেতে পারে না। সে যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করে আমার ভোগ সংবরণের কথাটা বিবেচনা করে দেখুন; আমি ঐ ১৫ শিলিং দিয়ে যা খুশি তাই করতে পারতাম। কিন্তু তা না করে আমি তা উৎপাদন শীল ভাবে ব্যবহার করেছি এবং তা দিয়ে সুতো তৈরি করেছি।” তা বেশ, এবং তার পুরস্কার হিসাবে এখন সে খারাপ বিবেকের বদলে পেয়েছে ভাল সুতো; এবং কৃপণের মত টাকা ধরে রাখার কথাই যদি ভোলা হয়, সে কখনো এমন খারাপ পথে পা বাড়াবে না; আমরা আগেই দেখেছি এই ধরনের কৃচ্ছসাধন কোথায় নিয়ে যায়। তা ছাড়া, যেখানে রাজত্ব নেই সেখানে রাজার কোনো অধিকারও নেই, তার ভোগ-সংবরণের যা-ই গুণ থাক না কেন, তাকে বিশেষ ভাবে পুরস্কৃত করার মত কিছু নেই, কেননা উৎপন্ন দ্রব্যটির মূল্য হচ্ছে যে সব পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ায় নিক্ষিপ্ত হয়েছিল কেবল তাদের মূল্যগুলিরই যোগফল। সুতরাং এই কথা ভেবেই সে সান্ত্বনা পাক যে পুণ্য কর্ম নিজেই নিজের পুরস্কার। কিন্তু না, সে হয়ে ওঠে নাছোড়বান্দা। সে বলে, “তোটা আমার কোনো কাজেই লাগে না; আমি ওটা উৎপাদন করেছিলাম বিক্রি করার জন্য। সে ক্ষেত্রে, সে সেটা বিক্রি করে দিক কিংবা আরো ভালো হয়, সে যদি ভবিষ্যতে কেবল তার ব্যক্তিগত অভাব পুরণের জন্যই জিনিস পত্র উৎপাদন করে এমন একটা দাওয়াই, যা তার চিকিৎসক ম্যাককুলক অতি-উৎপাদনের মহামারীর বিরুদ্ধে আগেই অভ্রান্ত প্রতিকার হিসাবে সুপারিশ করেছিলেন। তখন সে হয়ে ওঠে একগুয়ে। সে প্রশ্ন তোলে, শ্রমিক কি কেবল তার হাত পা দিয়ে শূন্য থেকে পণ্য উৎপাদন করতে পারে? আমি কি তাকে সেই সব দ্রব্য সামগ্রী যোপাইনি যা দিয়ে এবং কেবল যার মধ্যে তার শ্রম মূর্ত হয়ে উঠতে পারে? আর যেহেতু সমাজের বেশির ভাগটাই এই ধরনের কর্মহীন মানুষ নিয়ে তৈরি সেই হেতু আমার উৎপাদনের উপকরণ, আমার তুলল, আমার মাকু ইত্যাদি দিয়ে আমি কি সমাজের অপরিমেয় উপকার করিনি; এবং কেবল সমাজকেই নয়, শ্রমিকেরও করিনি, যাকে তা ছাড়াও আমি যুগিয়েছি প্রাণধারণের দ্রব্য সামগ্রী? এবং এই সব সেবার প্রতিদান হিসাবে আমাকে কি কিছুই দেওয়া হবেনা?” তা বেশ, কিন্তু তার তুলে এবং মাকুকে সুতোয় রূপান্তরিত করে শ্রমিক কি তাকে সমান সেবা দান করে নি। তা ছাড়া, এখানে সেবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।[৫] একটি ব্যবহার মূল্যের ব্যবহার যোগ্য ফল ছাড়া সেবা আর বেশি কিছু নয়, তা সেই ব্যবহার মূল্যটি পণ্যেরই হোক বা শ্রমের হোক।[৬] কিন্তু এখানে আমরা আলোচনা করছি বিনিময় মূল্য নিয়ে। ধনিক শ্রমিককে দিয়ে ছিল ৩ শিলিং পরিমাণ মূল্য, এবং শ্রমিকও ঐ তুলোর সঙ্গে ৩ শিলিং সংযোজিত করে তাকে ফেরত দিয়েছিল ঠিক সমাৰ্ঘ এক বস্তু; দিয়ে ছিল মূল্যের বিনিময়ে মুল্য। আমাদের বন্ধুটি, এতক্ষণ যে ছিল টাকার গরমে এত গরম সে হঠাৎ ধারণ করল তার নিজেরই শ্রমিকের মত অত্যন্ত ঠাণ্ডা মেজাজ, এবং সরবে বলল : আমি নিজেও কি কাজ করিনি? আমি কি ব্যবস্থাপনা এবং কাটুনীকে তদারক করার কাজ করিনি? এবং এই শ্রমও কি মূল্য সৃষ্টি করে না? তার ম্যানেজার এবং সুপারিন্টেডেন্ট তখন তাদের হাসি লুকোতে চেষ্টা করে। ইতিমধ্যে একটা দিলখোলা অট্টহাসি হেসে সে আবার তার স্বাভাবিক চেহারা ধারণ করে। যদিও সে আমাদের কাছে আওড়ালে অর্থনীতিবিদদের গোটা তত্ত্বটা আসলে সে বলল, এর জন্য সে একটি কানাকড়িও দেবে না। এই সব কৌশল ও কথার মারপ্যাচ সে ছেড়ে দেয় অর্থনীতির অধ্যাপকদের উপরে, যারা তার জন্য টাকা পায়। সে নিজে হচ্ছে একজন কাজের লোক; এবং যদিও তার ব্যবসার বাইরে সে যা বলে তা নিয়ে সব সময়ে মাথা ঘামায় না, কিন্তু তার ব্যবসার ক্ষেত্রে সে জানে সে কি চায়।
ব্যাপারটাকে আরো ঘনিষ্ট ভাবে দেখা যাক। এক দিনের শ্রম শক্তির মূল্য দাঁড়ায় ৩ শিলিং কেননা আমরা ধরে নিয়েছি ঐ শ্রমশক্তির মধ্যে বিধৃত রয়েছে অর্ধ দিনের শ্রম, অর্থাৎ, কেননা শ্রমশক্তি উৎপাদনের জন্য দৈনিক যে-প্রাণ ধারণের উপকরণাদির প্রয়োজন হয় তাতে খরচ হয় অর্ধ-দিনের শ্রম। কিন্তু শ্রমশক্তির মধ্যে যে অতীত শ্রম বিবৃত থাকে এবং যে-জীবন্ত শ্রমকে সে সক্রিয় করে তুলতে পারে; শ্রমশক্তি কে পোষণ করার দৈনিক খরচ এবং কাজে তার দৈনিক ব্যয়-এই দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। প্রথমটি নির্ধারণ করে শ্রমশক্তির বিনিময় মূল্য এবং দ্বিতীয়টি নির্ধারণ করে তা ব্যবহার-মূল্য। ২৪ ঘণ্টা শ্রমিককে জীবিত রাখার জন্য যে আধ দিন শ্রমের প্রয়োজন হয়—এই ঘটনা তাকে একটি পুরো দিন কাজ করা থেকে নিবারণ করেনা। অতএব, শ্রমশক্তির মূল্য এবং ঐ শ্রমশক্তি শ্রম-প্রক্রিয়ায় যে মূল্য উৎপাদন করে—এই দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন রাশি; এবং দুটি মূল্যের মধ্যে এই যে পার্থক্য, সেটাই থাকে ধনিকের নজরে—যখন সে শ্রমশক্তি ক্রয় করে। শ্রমশক্তি যে প্রয়োজনপূর্ণ গুণগুলির অধিকারী এবং যার কল্যাণে সে সুতো বা জুতো তৈরি করে, সেগুলি তার কাছে অপরিহার্য শর্ত ( conditio sine qua non), কেননা, মূল্য সৃষ্টি করতে হলে শ্রমকে অবশ্যই প্রয়োজনপূর্ণ পদ্ধতিতে ব্যয় করতে হবে। যা তাকে বস্তুতই। প্রভাবিত করে, তা হল পণ্যটির বিশেষ ব্যবহার-মূল্যকে, যার সে অধিকারী—কেবল মূল্যের উৎস হবার জন্যই নয়। তার উপরে তার নিজের মুল্যের তুলনায় অধিকতর মূল্যের উৎস হবার জন্যই বটে। এটাই হচ্ছে সেই বিশেষ সেবা যা ধনিক শ্রমিকের কাছ থেকে প্রত্যাশা কবে, এবং এই লেনদেনে সে কাজ করে পণ্য-বিনিময়ের “চিরন্তন নিয়মাবলী” অনুযায়ী। অন্য যে-কোনো পণ্যের বিক্রেতার মত, শ্রমশক্তির বিক্রেতাও তার বিনিময় মূল্যকে আদায় করে এবং তার ব্যবহার-মূল্যকে হাতছাড়া করে। ওটাকে না দিয়ে সে এটাকে নিতে পারে না। শ্রমশক্তির ব্যবহার মূল্য, কিংবা ভাষান্তরে শ্রম, তার বিক্রেতার অধিকারে ততটুকুই থাকে। ঠিক যতটুকু থাকে তেলের ব্যবহার-মূল্য তার বিক্রয়কারী কারবারীর হাতে -তা বিক্রি হয়ে যাবার পৰে। টাকার মালিক এক দিনের শ্রমশক্তির দাম দিয়েছে; সুতরাং তার ব্যবহারের অধিকার এক দিনের জন্য তারই হাতে; এক দিনের শ্রমের সে-ই মালিক। এক দিকে, শ্রমশক্তির দৈনিক প্রাণ-ধারণের জন্য খরচ হয় মাত্র আধ দিনের এম, যখন, অন্য দিকে, সেই একই শ্রমশক্তি কাজ করতে পারে একটা পুরো দিন এবং ফল, এক দিন জুড়ে তার ব্যবহার সৃষ্টি করে যে-মূল্য, তা সে যা দেয় তার দ্বিগুণ-এই তা নিঃসন্দেহে ক্রেতার পক্ষে একটা সৌভাগ্য কিন্তু বিক্রেতার পক্ষে কোনক্রমেই তা ক্ষতিজনক নয়।
আমাদের ধনিক-ব্যক্তিটি আগে থেকেই সেটা দেখতে পেয়েছিল এবং সেটাই ছিল তার অট্টহাসির কারণ। সুতরাং শ্রমিক তার কর্মশালায় দেখতে পায় ছয় ঘণ্টা কাজ করার মত উৎপাদনের উপায়-উপকরণ নয়, পরন্তু বার ঘণ্টা কাজ করার উপায় উপকরণ। ঠিক যেমন ছয় ঘণ্টার প্রক্রিয়া চলাকালে আমাদের ১০ পাউণ্ড তুলো বিশোষণ করেছিল ছয় ঘণ্টার শ্রম এবং হয়েছিল ১০ পাউণ্ড সূতা, তেমনি এখন ২০ পাউণ্ড তুলো বিশোষণ করে বারো ঘণ্টার শ্রম এবং হয়ে দাঁড়ায় ২০ পাউণ্ড সুতো। এখন এই দীর্ঘায়িত প্রক্রিয়ার উৎপন্ন দ্রব্যটি বিচার করে দেখা যাক। এখন এই ২০ পাউণ্ড সুতোয় বাস্তবায়িত রয়েছে পাঁচ দিনের শ্রম, যার মধ্যে চার দিন তুলল এবং টাকুটির ক্ষয়প্রাপ্ত ইস্পাতের দরুণ এবং বাকি দিনটি সুতো কাটার প্রক্রিয়ায় আত্মীকৃত হয়েছে তুলোর দ্বারা। সোনায় প্রকাশ করলে, পাঁচ দিনের শ্রম দাড়ায় ত্রিশ শিলিং। সুতরাং, আগের মত পাউণ্ড-প্রতি আঠারো-পেন্স দাম ধরে নিলে, এই ত্রিশ শিলিং হয় ২০ পাউণ্ড সুতোর দাম। কিন্তু সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াটিতে যে-সব পণ্য প্রবেশ করেছিল, তাদের সকলের মূল্যের যোগফল দাঁড়ায় ২৭ শিলিং। সুতরাং, উৎপন্ন দ্রব্যটি উৎপাদনের জন্য যে-মূল্য আগাম দেওয়া হয়েছিল, তার চেয়ে তার মূল্য $ বেশি; ২৭ শিলিং পরিণত হয়েছে ৩০ শিলি-এ; সৃষ্টি হয়েছে ৩ শিলিং পরিমাণ একটি উদ্বৃত্ত-মূল্য। কৌশলটি শেষ পর্যন্ত সার্থক হয়েছে; অর্থ-রূপান্তরিত হয়েছে মূলধনে।
সমস্যার প্রতিটি শর্ত পূর্ণ হয়েছে সেই সঙ্গে যে নিয়মগুলি পণ্য-বিনিময়কে নিয়মিত করে সেগুলিও কোন ক্রমে লঙ্ঘিত হয়নি। বিনিময় হয়েছে সমানে সমানে। কারণ ক্রেতা হিসাবে ধনিক প্রত্যেকটি পণ্যের জন্য, তুলল, টাকু এবং শ্রমশক্তির জন্য পূরে মূল্য দিয়েছে। প্রত্যেক পণ্য-ক্রয়কারী যা করে থাকে, সে তখন তাই করে; সে ঐগুলির ব্যবহার-মূল্য পরিভোগ করে। শ্রমশক্তির পরিভোগ, যা আবার পণ্য। উৎপাদনেরও প্রক্রিয়া, পরিণত হয় ২০ পাউণ্ড সুতোয়, যার মূল্য ৩. শিলিং। আগে যে ছিল পণ্যের ক্রেতা, সেই ধনিক এখন বাজার ফিরে আসে পণ্যের বিক্রেতা হিসাবে। সে তার সুতো বিক্রয় করে পাউণ্ড-প্রতি আঠারো-পেন্স-এ, যা তার সঠিক মূল্য। কিন্তু সব কিছু সত্ত্বেও, সে গোড়ায় সঞ্চলনে যত টাকা ছুড়ে দিয়েছিল, তার চেয়ে ৩ শিলিং বেশি সে সঞ্চলন থেকে তুলে নেয়। এই রূপান্তরণ, অর্থের এই মূলধনে পরিবর্তন, সংঘটিত হয় সঞ্চলনের পরিধির ভিতরে এবং বাইরে, উভয় ক্ষেত্রেই; সঞ্চলনের ভিতরে, কেননা বাজার শ্রমশক্তি ক্রয়ের দ্বারা তা ব্যবস্থিত; সঞ্চলনের বাইরে, কেননা সঞ্চলনের ভিতরে যা করা হয়, তা হচ্ছে উদ্বৃত্ত-মূল্য উৎপাদনের পথে একটি সোপান মাত্ৰ-এমন একটি প্রক্রিয়া, যা সমগ্র ভাবে উৎপাদনের পরিধির মধ্যে নিবন্ধ। অতএব, “tout est pour le mieux dans le meilleur des mondes possibles.
অর্থকে বিভিন্ন পণ্যে রূপান্তরিত করে, যে-পণ্যগুলি কাজ করে নতুন একটি উৎপন্ন দ্রব্যের বিবিধ বস্তুগত উপাদান হিসাবে, সেই পণ্য সমূহের মৃত সত্তায় জীবন্ত শ্রম সঞ্চারিত করে, ধনিক একই সঙ্গে মূল্যকে অর্থাৎ অতীত, বাস্তবায়িত এবং মৃত শ্রমকে রূপান্তরিত করে মূলধনে, মূলে-সংযোজনের মাধ্যমে বৃহত্তর মূল্যে, একটা জীবন্ত দানবে, যা ফলপ্রসূ এবং বৃদ্ধিশীল।
এখন যদি আমরা মূল্য উৎপাদনের এবং উদ্ব-মূল্য সৃজনের দুটি প্রক্রিয়াকে তুলনা করি, আমরা দেখতে পাই যে দ্বিতীয়টি প্রথমটিরই একটি নির্দিষ্ট বিন্দুর বাইরে অনুবর্তন ছাড়া কিছু নয়। যদি একদিকে ঐ নির্দিষ্ট বিন্দুটির বাইরে—যে বিন্দুটিতে শ্রমশক্তির জন্য ধনিক যে-মূল্যটি দিয়েছে, তা একটি যথাযথ সমাৰ্ঘে বস্তুর দ্বারা প্রতি স্থাপিত হয়, সেই বিন্দুটির বাইরে—আর সম্পাদিত না হয়, তা হলে সেটা হবে কেবল মূল্য উৎপাদনেরই একটা প্রক্রিয়া; যদি, অন্য দিকে, তাকে ঐ বিন্দুটির বাইরেও অব্যাহত রাখা হয়, তাহা হলে সেটা পরিণত হয় উদ্বৃত্ত সৃজনের প্রক্রিয়ায়।
আমরা যদি আরো অগ্রসর হই এবং সহজ সরল শ্রম-প্রক্রিয়ার সঙ্গে মূল্য উৎপাদন প্রক্রিয়াটির তুলনা করি, আমরা দেখতে পাই যে প্রথমটি গঠিত হয় উপযোগিতাপূর্ণ শ্রমের দ্বারা, কাজের দ্বারা, যা উৎপাদন করে ব্যবহার-মূল্য। এখানে আমরা এমকে বিবেচনা করি একটি বিশেষ জিনিসের উৎপাদনকারী হিসাবে; আমরা তাকে দেখি
একমাত্র তার গুণগত চেহারায়—তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের পরিপ্রেক্ষিতে। কিন্তু তাকে। যদি আমরা দেখি একটি মূল্য সৃজনকারী প্রক্রিয়া হিসাবে, তা হলে ঐ একই শ্রম-প্রক্রিয়া আমাদের সামনে হাজির হয় একমাত্র তার পরিমানগত চেহারায়। এখানে প্রশ্নটা কেবল এই যে কাজটা করতে শ্রমিকের কত সময় লেগেছে, কতটা সময় ধরে শ্রমশক্তি উপযোগিতাপূর্ণ ভাবে ব্যয়িত হয়েছে। এখানে, যে-পণ্যগুলি ঐ প্রক্রিয়ায় অংশ গ্রহণ করে, সেগুলিকে আর একটি নির্দিষ্ট প্রয়োজনীয় দ্রব্য উৎপাদনে শ্রমশক্তির আবশ্যিক অনুষঙ্গ হিসাবে গণ্য করা হয় না। সেগুলিকে গণ্য করা হয় কেবল এতটা বিশেষিত বা বাস্থবায়িত শ্রমের আধার হিসাবে; সেই শ্রম, তা সে উৎপাদনের উপায়সমূহে আগে থেকেই বিধৃত থাক কিংবা প্রক্রিয়াটি চলাকালে শ্রমশক্তির সক্রিয়তার দ্বারা সেগুলির মধ্যে এই প্রথম সংযোজিত হোক, উভয় ক্ষেত্রেই তা পরিগণিত হয় কেবল তার স্থায়িত্বের সময়ের দ্বারা; তা দাঁড়ায় এতগুলি দিন বা এতগুলি ঘণ্টা– যেখানে যেমন।
অধিকন্তু, একটি জিনিস উৎপাদনে কেবল ততটা সময়ই পরিগণিত হবে, যা নির্দিষ্ট সামাজিক অবস্থায় কেবল আবশ্যিক। এর ফলাফল নানাবিধ। প্রথমত, এটা আবশ্যক যে এম সম্পাদিত হচ্ছে স্বাভাবিক অবস্থায়। যদি সুতো কাটার জন্য স্বয়ংক্রিয় ‘মিউল সাধারণ ভাবে প্রচলিত থাকে, তা হলে কাটুনীকে কাটিম আর চরকা যোগানো হবে একটা আজগুবি ব্যাপার। তুলোও এমন হলে চলবে না যে তা এত বাজে যে তা দিয়ে কাজ করতে গেলে বাড়তি অপচয় ঘটে; তাকে হতে হবে উপযুক্ত গুণমান-সমম্বিত। অন্যথা, সামাজিক ভাবে যতটা শ্ৰম আবশ্যিক, দেখা যাবে কাটুনীকে এক পাউণ্ড সুতো কাটতে তার চেয়ে বেশি সময় ব্যয় করতে হচ্ছে, যে-ক্ষেত্রে এই বাড়তি সময়টা মূল্যও উৎপাদন করবে না, অর্থও উৎপাদন করবে না। কিন্তু সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়ার বস্তুগত উপাদান গুলি স্বাভাবিক গুণমান-সমন্বিত কিনা, তা নির্ভর করে শ্রমিকের উপরে নয়, সমগ্র ভাবেই ধনিকের উপরে। তার পরে আবার স্বয়ং শ্রমশক্তিকেও হতে হবে গড় কর্ম ক্ষমতার অধিকারী। যে-শিল্পে তাকে নিযুক্ত করা হবে, তাকে তার গড় দক্ষতা, স্বপ্রতিভতা ও তৎপরতার অধিকারী হতে হবে এবং আমাদের ধনিককেই এই ধরনের স্বাভাবিক কুশলতা-সম্পন্ন শ্রমশক্তি ক্রয় করার জন্য উপযুক্ত যত্ন নিতে হবে। এই শক্তিকে প্রয়োগ করতে হবে গড পরিমাণ সক্রিয় এবং স্বাভাবিক মাত্রার তীব্রতা সহকারে; এবং ধনিক এ ব্যাপারে সমান ভাবে সতর্ক যাতে তার শ্রমিকের মুহূর্তের জন্যও অলস না থাকে এবং তাদের শ্রমশক্তি উল্লিখিত সক্রিয়তা ও তীব্রতা সহকারে প্রযুক্ত হয়। একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সে শ্রমশক্তির ব্যবহার ক্রয় করেছে এবং তার অধিকারগুলি সে প্রয়োগ করে। বঞ্চিত হবার কোনো ইচ্ছা তার নেই। সর্বশেষে, এবং এইজন্য আমাদের ধনিক বন্ধুটির একটি নিজস্ব দণ্ডবিধিও আছে, কাঁচামাল ও শ্রম উপকরণের যাবতীয় অপচয়পূর্ণ পরিভোগ কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ, কেননা এইভাবে যা বিনষ্ট হয়, তা হল বিনা-প্রয়োজনে ব্যয়িত শ্রম, যে-শ্ৰম উৎপন্ন দ্রব্যের মধ্যে গণ্য হয়না বা তার মূল্যের মধ্যে প্রবেশ করে না।[৭]
আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি, এমকে বিবেচনা করা যায়, একদিকে, উপযোগিতার উৎপাদনকারী হিসাবে, অন্যদিকে, মূল্যের সৃজনকারী হিসাবে; উপযোগিতার উৎপাদন কারী হিসাবে এবং মূল্যের সৃজনকারী হিসাবে এই যে পার্থক্য, যা আমরা আবিষ্কার করেছি পণ্যের বিশ্লেষণের মাধ্যমে, তা নিজেকে পর্যবসিত করে একই উৎপাদন-প্রক্রিয়ার দুটি দিকের মধ্যে পার্থক্য হিসাবে।
উৎপাদন-প্রক্রিয়াকে যখন বিবেচনা করা যায়, একদিকে, শ্রম-প্রক্রিয়া এবং মূল্য সৃজন-প্রক্রিয়ার ঐক্য হিসাবে, তখন তা হল পণ্যের উৎপাদন; অন্যদিকে, যখন তাকে বিবেচনা করা যায় শ্রম-প্রক্রিয়া এবং উদ্ব-মূল্য উৎপাদনের প্রক্রিয়া হিসাবে, তখন তা উৎপাদনের ধনতান্ত্রিক পদ্ধতি বা পণ্যের ধনতান্ত্রিক উৎপাদন।
আগে এক পৃষ্ঠায় আমরা বলেছি, উত্তমূল্যের-সৃজনে এতে এতটুকুও এসে যায়না যে, ধনিক যে-শ্রম আত্মীকৃত করে, তা সরল অদক্ষ গড়পড়তা গুণমানের শ্রম, নাকি জটিলতর সুদক্ষ শ্রম। গড়পড়তা শ্রমের তুলনায় উন্নততর ও জটিলতর চরিত্রের সমস্ত শ্রমই হচ্ছে অধিকতর মহার্ঘ ভ্ৰম-শক্তি ব্যয়—এমন শ্রমশক্তি, যা উৎপাদন করতে ব্যয় করতে হয় অধিকতর সময় ও শ্রম, এবং সেই কারণেই সরল ও অদক্ষ শ্রমশক্তির তুলনায় যার মূল্য হয় বেশি। এই শ্রমশক্তির মূল্য বেশি হওয়ায় তার পরিভোগও হচ্ছে উন্নততর শ্রেণীর এম, এমন শ্রম যা সমান সময়ে অদক্ষ শ্রমের তুলনায় আনুপাতিক ভাবে উচ্চতর মূল্য উৎপাদন করে। একজন সুতো-কাটুনীর শ্রম এবং একজন স্বর্ণকারের শ্রমের মধ্যে যে পার্থক্যই থাক না কেন, তার শ্রমের যে-অংশ দিয়ে স্বর্ণকার কেবল তার নিজের শ্রমশক্তির মূল্য প্রতিস্থাপিত করে, সেই অংশের সঙ্গে তার শ্রমের বাকি বাড়তি অংশ যা দিয়ে সে উদ্বৃত্ত-মূল্য সৃষ্টি করে, তার কোনো গুণমানগত পার্থক্য নেই। যেমন অলংকার তৈরিতে, তেমন সুতো কাটায়, উদ্ব-মূল্যের উদ্ভব ঘটে কেবল শ্রমের পরিমাণগত আধিক্য থেকে, একই অভিন্ন প্ৰম-প্রক্রিয়ার প্রসারণ থেকে—এক ক্ষেত্রে অলংকার তৈরির প্রক্রিয়ার প্রসারণ এবং অন্য ক্ষেত্রে সুতো তৈরির প্রক্রিয়ার প্রসারণ।[৮]
কিন্তু অন্য দিকে, মূল্য সৃজনের প্রত্যেকটি প্রক্রিয়ায় গড়পড়তা সামাজিক শ্রমে দক্ষ শ্রমের পর্যবসন, যথা ছয় দিনের অদক্ষ শ্রমে এক দিনের দক্ষ শ্রমের পর্যসন, অপরিহার্য।[৯] সুতরাং এমটা বাড়তি হিসাবে কাজ এড়াবার জন্য এবং আমাদের বিশ্লেষণকে সরলতর করার জন্য আমরা ধরে নিচ্ছি যে, ধনিকের দ্বারা নিযুক্ত শ্রমিকের শ্রম হচ্ছে অদক্ষ গড়পড়তা শ্রম।
————
১. যে কথা পূর্ববর্তী একটি টীকায় বলা হয়েছে শ্রমের এই দুটি ভিন্ন ভিন্ন দিকের জন্য দুটি ভিন্ন ভিন্ন শব্দ আছে : সরল এমপ্রক্রিয়ায়, ব্যবহার-মূল্য উৎপাদনের প্রক্রিয়ায়, তা হচ্ছে ‘ওয়ার্ক (কাজ); মূল্য সৃজনের প্রক্রিয়ায়, তা হচ্ছে ‘লেবর (এম)-কথাটিকে এখানে ধরা হচ্ছে তার যথাযথ অর্থনৈতিক অর্থে।
২. এই সংখ্যাগুলি ইচ্ছামত নেয়া হয়েছে।
৩. এটাই হচ্ছে মূল বক্তব্য যার উপরে ফিজিওক্র্যাটদের যে-তত্ত্ব, বলে কৃষি কার্য ছাড়া বাকি সব শ্রমই অনুৎপাদক, তার ভিত্তি; সনাতন পন্থী অর্থনীতিকদের কাছে এই যুক্তি অকাট্য। “Cette facon d’imputer a une seule chose la valeur de plusieurs autres” (par exemple au lin la consommation du tisserand), “d’appliquer, pour ainsidire, couche sur couche, plusieurs valcurs sur une seule, fait que celle-ci grossit d’autant… Le terme d’addition peint tres-bien la maniere dont se forme le prix des ouvrages de maind’oeuvre, ce prix n’est qu’un total de plusieurs valeurs consommees et additionnees ensemble’ or, additionner n’est pas multiplier”, (“Mercier de la Riviere”, 1,c, p, 599,)
৪. এইভাবে ১৮৪৪-৪৭ সাল থেকে সে তার মূলধনকে উৎপাদনশীল বিনিয়োগ থেকে তুলে নেয় যাতে করে রেলওয়ে ফটকাবাজিতে খাটাতে পারে; একই ভাবে, আমেরিকার গৃহযুদ্ধের মধ্যেও, সে তার কারখানা বন্ধ করে দেয় এবং শ্রমিকদের রাস্তায় বের করে দেয়, যাতে করে লিভারপুল কটন এক্সচেঞ্জ’-এ জুয়ো খেলতে পারে।
৫. নিজের মহিমা গাও, ভালো বেশ-ভূষা পরো, নিজেকে সাজাও কিন্তু যখনি কেউ, যা সে দেয়, তার চেয়ে বেশি বা ভাল কিছু নেয়, সেটাই কুসীদবৃত্তি, সেটা মোটেই সেবাকার্য নয়; চুরি করা বা লুঠ করার মত সেটাও প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে অন্যায়। যাকে প্রতিবেশীর প্রতি সেবা বা উপকার বলা হয়, তার সবটাই সেবা বা উপকার নয়। একজন ব্যাভিচারিণী একজন ব্যাভিচারী পরস্পরকে প্রভূত সেবা করে এবং আনন্দ দেয়। কোন ঘোড়-সওয়ার যখন কোন দুবৃত্তকে সাহায্য করে রাজপথে রাহাজানি করতে, জমি ও বাড়ি লুঠ করতে, তখন সে তার মস্ত সেবা করে। পোপের অনুচরেরা আমাদের বড় উপকার করে, কেননা তারা সকলকে ডুবিয়ে বা পুড়িয়ে মারেনা বা খুন করেনা বা জেলে পচিয়ে মারেনা; তাদের কাউকে কাউকে বাঁচতে দেয়; কেবল তাদের ঘর-ছাড়া করে এবং যথাসর্বস্ব নিয়ে নেয়। শয়তান নিজে তার সেবকদের অপরিসীম উপকার করে। “এক কথায়, এই জগৎ মহান, মহিমাময়, প্রাত্যহিক সেবা ও epostappies of I” ( Martin Luther : “An die pfarrherrn wider: den Wucher zu predigen”, Wittenberg 1540 ).
৬. Zur Kritik der Pol. Oek”, পৃঃ ১৪, দ্রষ্টব্য। সেখানে আমি এই প্রসঙ্গে নিম্নেধৃত মন্তব্যটি করেছি : “এটা বোঝা কঠিন নয়, সেবা এই শব্দটি জে. বি. সে এক এফ, বাস্তিয়াং-এর মত অর্থনীতিকদের কী সেবা করবে।”
৭. যেসব ঘটনা দাস-শ্রমকে একটি ব্যয়বহুল প্রক্রিয়ায় পরিণত করে, এটি সেগুলির মধ্যে একটি। প্রাচীনদের দ্বারা ব্যবহৃত একটি চমকপ্রদ বাচনভঙ্গি অনুসরণ করে বলা যায়, শ্রমিক, জন্তু এবং যন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য এই যে, শ্রমিক হল একটি সবাক যন্ত্র, জন্তু হল একটি অর্ধবাক যন্ত্র এবং যন্ত্র হল একটি অ-বা যন্ত্র। কিন্তু সে নিজেই যন্ত্র ও জন্তুকে বুঝিয়ে দেয় যে সে তাদের মধ্যে পড়েনা, সে মানুষ। জন্তুর প্রতি নির্মম আচরণ করে, যন্ত্রের দারুণ ক্ষতি সাধন করে সে পরম আত্মতৃপ্তি সহকারে নিজেকে বোঝায় যে সে ওদের চেয়ে আলাদা। এই জন্যই উৎপাদনের এই পদ্ধতিতে সর্বজনীন ভাবে অনুসৃত নীতি হচ্ছে সবচেয়ে স্কুল ও ভারি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা যাতে কেবল সেগুলির কিস্তুত আকারের জন্যই সেগুলির ক্ষতি করা দুঃসাধ্য হয়। মেক্সিকো উপসাগরের কূলে দাস রাষ্ট্রগুলিতে গৃহযুদ্ধের আমল পর্যন্ত কেবল দেখা যেত চীন-কায়দায় তৈরি লাঙল, যা মাটিকে ফালের মত না কেটে, শুয়োর বা দুচোর মত গর্ত-গর্ত করত। দ্রষ্টব্য : J. E. Cairnes, “The Slave Power”, London, 1862, p. 46 sqq. $17 “Sea-Bord Slave-States”-নামক বইয়ে ওমস্টেভ বলেন, আমাকে এখানে এমন সব যন্ত্রপাতি দেখানো হল, যেগুলিকে কোনো কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ, যে মজুরি দিয়ে লোক খাটায়, সে তার শ্রমিকদের উপরে চাপিয়ে দেবেনা; এই যন্ত্রপাতিগুলি এমন বেশি ভারি এবং বেঢপ যে আমার মনে হয় তার দরুণ মামুলি যন্ত্রপাতির তুলনায় কাজের চাপ অন্তত দশ শতাংশ বেশি হয়। এবং আমাকে সজোরে বলা হল যে, যেমন হেলাফেলা করে আনাড়ির মত দাসেরা সেগুলি ব্যবহার করে, তাতে অপেক্ষাকৃত হালকা ও মানানসই কিছু তাদের হাতে তুলে দেওয়া মানে অপচয় করা; এবং আমরা। আমাদের শ্রমিকদের যে-সব যন্ত্র দিয়ে কাজ করাই ও মূনাফা আয় করি, সেগুলি ভার্জিনিয়ার শস্যক্ষেত্রে একদিনও টিকবে না—যদিও আমাদের ক্ষেতগুলির চেয়ে মুড়িপাথর মুক্ত ও অনায়াস সাধ্য। ঠিক তেমনি, যখন আমি জিজ্ঞাসা করি কেন ক্ষেতের কাজে এমন ব্যাপক ভাবে ঘোড়ার বদলে খচ্চর ব্যবহার করা হচ্ছে, তখন সর্বপ্রথম যে যুক্তিটি দেওয়া হয়—এবং তাদের স্বীকৃতি অনুসারে এটাই চূড়ান্ত যুক্তি-তা এই যে, নিগ্রোরা যে-রকম ব্যবহার করে, ঘোড় তা সহ্য করতে পারেনা। তারা অচিরেই ঘোড়াগুলোকে পঙ্গু ও অকেজো করে ফেলে কিন্তু খচ্চরগুলি তাদের লাঠি-পেটা সহ্য করে অথবা এক-আধ দিন না খেতে পেলেও কাবু হয় না; এগুলির এমন শারীরিক ক্ষতি হয়না যে অকেজো হয়ে পড়ে; হেলাফেলা বা বাড়তি খাটুনির ফলে এগুলির ঠাণ্ডা লাগেনা বা অসুখ হয়না। কিন্তু বেশি দূরে না গিয়ে আমার ঘরের জানালা দিয়েই আমি সব সময়ে দেখতে পাই গোরু-ঘোড়া-খচ্চর ইত্যাদির উপরে কী আচরণ করা হচ্ছে আমাদের উত্তরাঞ্চলে কোন চালক এমন করলে যে-কোন খামার মালিক তাকে তৎক্ষণাৎ তাড়িয়ে দেবে।”
৮. কুশলী ও অকুশলী শ্রমের মধ্যেকার পার্থক্যটি অংশত দাড়িয়ে আছে নিছক একটি বিভ্রমের উপরে, কিংবা, বড় জোর বলা যায়, এমন সব পার্থক্যের উপরে যেগুলি বাস্তবে অনেক কাল আগেই অন্তর্হিত হয়ে গিয়েছে এবং যেগুলি আজও টিকে আছে কেবল চিরাচরিত প্রথা হিসাবে-আংশিক ভাবে কয়েক ধরনের শ্রমিকের এমন এক অসহায় অবস্থার উপরে, যে অবস্থার দরুন তারা বাকিদের মত তাদের শ্রমের মূল্য আদায় করে নিতে পারে না। আপতিক ঘটনাবলী এখানে এত বড় একটা ভূমিকা নেয় যে, অনেক সময় এই দু ধরনের শ্রম তাদের পরস্পরের মধ্যে স্থান-বিনিময় করে। দৃষ্টান্তম্বরূপ, যেখানে শ্রমিক-শ্রেণীর শারীরিক অবনতি ঘটেছে এবং তুলনামূলক ভাবে বলা যায়, অবসিত হয়ে পড়েছে-সমস্ত অগ্রসর ধনতান্ত্রিক দেশেই অবস্থা যা দাড়িয়েছে। সেখানে বিবিধ স্থূল রূপের শ্রম, যার জন্য ব্যয় করতে হয় অধিকতর পেশী শক্তি, তাকে, শ্রমের সূক্ষ্ম রূপগুলির তুলনায়, কুশলী শ্রম বলে গণ্য করা হয়। এই সূক্ষ্ম রূপগুলি অবনমিত হয় অকুশলী শ্রমের পর্যায়ে। যেমন, ইংল্যাণ্ডে একজন রাজমিস্ত্রীকে একজন নক্সা ভোলা বস্তু-বয়নকারীর তুলনায় উচ্চতর স্থান দেওয়া হয়। আবার, যদিও একজন মোটা-কাপড়-কাটিয়ের ( ‘ফাক্টিয়ান-কাটার’-এ) এম দাবি করে দারুণ শারীরিক বল প্রয়োগ এবং সেই সঙ্গে তা স্বাস্থ্যের পক্ষেও হানিকর, তবু কিন্তু তাকে ধরা হয় অকুশলী শ্রম হিসাবে। তা ছাড়া ভুললে চলবে না, যে তথা কথিত কুশলী শ্ৰম জাতির মোট শ্রমের ক্ষেত্রে একটা বড় অংশ নয়। ল্যাইং এর হিসাব করে দেখিয়েছেন, ইংল্যাণ্ডে (এবং ওয়েল-এ) ১,১৩,০০,০০০ মানুষের জীবিকা নির্ভর করে অকুশলী শ্রমের উপরে। যখন তিনি লিখেছিলেন, তখন ইংল্যাণ্ডের মোট জনসংখ্যা ছিল ১,৮০,০০,০০০; এ থেকে যদি আমরা বাদ দেই ১৩,৩,০০০ “অভিজাত”, ১৫,০০,০০০ ভিখারী, ভবঘুরে, দুবৃত্ত, বেশ্যা ইত্যাদি ৪৬,৫০,০০০ মধ্য-শ্রেণীর মানুষ, তা হলে থাকে উল্লিখিত ঐ ১,১৩,৩০,০০০ জন। কিন্তু তার মধ্য-শ্রেণীতে তিনি অন্তর্ভুক্ত করেছেন ক্ষুদ্র বিনিয়োগের আয়ের উপরে নির্ভরশীল লোকদের, সরকারি কর্মচারীদের, বিদ্বান শিল্পী, স্কুল-শিক্ষক প্রভৃতিদের এবং এদের সংখ্যা বাড়িয়ে দেখানোর জন্য তিনি এর মধ্যে ধরেছেন কারখানার উচ্চ বেতন-প্রাপ্ত ৪৬,৫০,০০০ কর্মীকেও ! এমনকি তাদের মধ্যে ধরা হয়েছে রাজ Taong 1 (S. Laing : “National Distress”, &c., London, 1844.). “সেই বিশাল শ্রেণী যাদের খাদ্য সংগ্রহ করার জন্য মামুলি শ্রম ছাড়া দেবার মত আর কিছু নেই, তারাই হল জনসংখ্যার বিপুল অংশ।” ( James Mill, in art. in “Colony” : Supplement to the, Encyclop. Brit.–1831. )
৯. “যেখানে মূল্যের পরিমাপ হিসাবে শ্রমের উল্লেখ করা হয়, সেখানে তা আবশ্যিক ভাবেই বোঝায় একটি বিশেষ ধরনের শ্রমকে….. তার সঙ্গে অন্যান্য ধরনের শ্রমের অনুপাত কি তা সহজেই বার করা যায়।” (“Outlines of pol. Econ.”, London, 1832, pp. 22, 23 )।