শিখার আবিষ্কার
এক – পত্রাঘাত
লালবাজারে ডিটেকটিভ ডিপার্টমেণ্টের ডেপুটি—কমিশনারের খাস—কামরায় ডেপুটি বসন্ত গুপ্ত, ইনস্পেক্টর বিমলেন্দু এবং শিখা। তিনজনে একটা কেসের সম্বন্ধে আলোচনা করছেন। জাল—নোট সহরে চলেছে অজস্র রকম। এ কাজে যে দু’—চারজন আসামীর নাম পুলিশের খাতায় দাগী বলে রেকর্ড করা আছে, তাদের পিছনে গোপনে এবং প্রকাশ্যে বহু সন্ধান করেও জাল নোটের কোন পাত্তা পাওয়া যাচ্ছে না। এখন তাহলে কোন পথে সন্ধান করা যায়।
এই নিয়ে নানা পরামর্শ চলছে, এমন সময় আর্দ্দালী কার্ড নিয়ে কামরায় ঢুকল। ডেপুটি কমিশনার কার্ড নিয়ে দেখেন, নন্দলাল সিঙ্গীর নাম। তিনি চমকে উঠলেন! বিমলেন্দুর দিকে চেয়ে বললেন—”নন্দ সিঙ্গী! তিনি হঠাৎ লালবাজারে!”
বিমলেন্দু খুব আশ্চর্য্য হলো—”তাঁর আবার কিসের মামলা?”
বিমলেন্দু তাকালো শিখার দিকে, বললে—”নন্দ সিঙ্গীর নাম নিশ্চয় শুনেছেন মিস্ রায়?”
শিখা বললে—”ইষ্টার্ণ ট্রেডার্স—এর নন্দ সিঙ্গী? তাঁর নাম কে না জানে? কি প্রকাণ্ড ওঁর কারবার।”
বিমলেন্দু বললে—”ভাগ্যবান পুরুষ!”
আর্দ্দালীকে ডেপুটি বললেন—”বাবুকে নিয়ে এসো।”
আর্দ্দালী চলে গেল এবং তার চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে কামরায় প্রবেশ করলেন এক ভদ্রলোক।
বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। বেশ বলিষ্ঠ গড়ন—বেশে—ভূষায় বিলাসের নাম—গন্ধ নেই। পরণে কাঁচি ধুতি—গায়ে গরদের কোট, পায়ে মোজা এবং লেস—বাঁধা জুতা! ভদ্রলোকের মুখ অত্যন্ত মলিন। দেখলে মনে হয়, চিন্তায় তিনি আকুল।
সামনের চেয়ারে তাঁকে বসতে বলে ডেপুটি প্রশ্ন করলেন—”ব্যাপার কি মিষ্টার সিঙ্গী? আপনি এখানে?”
বেশ বড় একটা নিশ্বাস ফেলে নন্দ সিঙ্গী বললেন—”বিপদে পড়েছি। আপনাদের শরণ নিতে এসেছি তাই।”
”বিপদ! ক্যাশ ভেঙ্গেছে কেউ? না—?”
”না, কারবারের সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই। একান্ত ব্যক্তিগত—পারিবারিক ব্যাপার।”
নন্দবাবুর কথায় ওঁরা তিনজনেই তাকালেন তাঁর দিকে, সবারই চোখে প্রশ্ন, ”কি ব্যাপার?”
কোটের পকেট থেকে নন্দবাবু একখানা লেফাফা বার করে ডেপুটির হাতে দিলেন, বললেন—”আজকের ডাকে এই চিঠিখানা পেয়েছি। অফিসে আসবো বলে বেরুচ্ছি, ডাক এলো। না পড়েই চিঠিখানা পকেটে ফেলে গাড়ীতে উঠলুম। তারপর অফিসে এসে ক’টা জরুরি কাজ অবসর ছিল না—ক’টা বড় পেমেণ্ট করবার ছিল। ক’খানা চেক সহি করে, তারপর খাম ছিঁড়ে এ চিঠি পড়ে আমি স্তম্ভিত! আপনি পড়ে দেখুন। আমি এর মানে কিছু বুঝতে পারছি না!”
ডেপুটি খাম থেকে চিঠি বার করে পড়লেন। এমনি সাধারণ ফুলস্ক্যাপ কাগজে ইংরেজীতে টাইপ করা চিঠি :
প্রিয় মহাশয়,
আমাদের আগেকার চিঠির কোন জবাব পাইনি। তাই আবার জানাচ্ছি—আজ থেকে দশ দিনের দিন—অর্থাৎ ২১শে জুন বিশ হাজার টাকা চাই। টাকা যা পাঠাবেন, একশো টাকার নোটে। এ টাকা ঐ ২২ তারিখে সন্ধ্যা সাতটার পূর্ব্বে এনে রাখতে হবে ভবানীপুর বির্জি—তলার গির্জা (সেণ্টপলস কাথিড্রাল) আছে, সেই গির্জার পশ্চিম—দক্ষিণে যে ফটক, সেই ফটকের দক্ষিণে একটা গর্ত্ত দেখবেন—লোহার চাকতি ঢাকা, সেই গর্ত্তের মধ্যে। যদি ধরিয়ে দেবার ব্যবস্থা করেন, আমাদের লোক নজর রাখবে, তাহলে আপনার জান যাবে, জানবেন। এ টাকা যদি না পাই, তাহলে ঐ তারিখে রাত ঠিক বারোটায় আপনার পাঁচ বছর বয়সের ঐ একটি ছেলে ব্রজদুলাল—তাকে আমরা নিয়ে আসবো—এনে আটক রাখবো। তখন সে ছেলেকে ফেরত নিতে হলে আপনাকে দিতে হবে ত্রিশ হাজার টাকা। তার একটি পয়সা কম হলে ছেলে পাবেন না।
ইতি
চণ্ডী ঠাকুর
চিঠি পড়ে ডেপুটি সে চিঠি দিলেন বিমলেন্দুর হাতে, বললেন—”পড়ো। নতুন রকমের চিঠি। এদেশে ছেলে কিডনাপ করবে বলে ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়—এতদিন পুলিশে চাকরি করছি, কখনও দেখিনি, শুনিনি।”
এ কথা শুনে শিখা বললে—”ও চিঠি আমি দেখতে পারি?”
”নিশ্চয়।”
বিমলেন্দু এবং শিখা—দুজনে একসঙ্গে চিঠি পড়লো। পড়া শেষ হলে দুজনেই চাইলো ডেপুটির পানে। ডেপুটির ললাট কুঞ্চিত। তিনি যেন কি ভাবছেন!
নন্দবাবু আবার নিশ্বাস ফেলে বললেন—”পড়লেন?”
ডেপুটি বললেন—”হ্যাঁ। ইংরেজী চিঠি। হাতের অক্ষর নয়, টাইপ করা। টাইপ করা হয়েছে দেখছি, পুরোনো মেশিনে—অনেকগুলো অক্ষর ভাঙ্গা ভাঙ্গা। তার উপর আনাড়ি হাতে টাইপ করা! বানান ভুলও আছে!”
বিমলেন্দু বললে—”বানান ভুল থাকলেও গ্রামার ঠিক আছে, স্যর। গ্রামারের ভুল নেই! চিঠি যে লিখেছে, সে ইংরেজী লেখাপড়া জানে। আমার মনে হয়, বানান—ভুল যা করেছে, সেটা ইচ্ছা করে।” এই পর্য্যন্ত বলে বিমলেন্দু তাকালো নন্দবাবুর দিকে, বললে—”আপনার কি মনে হয়?”
নন্দবাবুর মুখ মলিন। তিনি কোনমতে বললেন—”আপনি যা বলছেন, তা ঠিক বটে! গ্রামার ভুল করেনি!”
ডেপুটি বললেন—”আপনি খুব নার্ভাস হয়ে পড়েছেন!”
”হবো না? আমার ঐ এক ছেলে। দুটি ছেলে, একটি মেয়ে মারা গেছে। সে শোকে আমার স্ত্রী একেবারে—”
নন্দবাবুর কথা শেষ হলো না, নিশ্বাসের বাষ্পে তাঁর কণ্ঠ রুদ্ধ হলো।
শিখা বললে—”আমি কিছু বলতে পারি?”
ডেপুটি বলে উঠলেন—”নিশ্চয়।”
”এ চিঠিতে দেখছি, আগের চিঠির জবাব পায়নি বলে লিখেছে। তাহলে আগে এমনি একখানা চিঠি নন্দবাবু পেয়েছিলেন নিশ্চয়ই? সে চিঠিখানা কোথায়?” এ কথা বলে শিখা তাকালো নন্দবাবুর দিকে।
নন্দবাবু সে কথার জবাব দিলেন না। তিনি তাকালেন ডেপুটির দিকে। যেভাবে তাকালেন, মনে হলো, এ কথার মধ্যে শিখার মত এক বালিকার কথা যেন প্রগলভতা! তিনি সে কথার যেন আমলই দিতে চান না!
নন্দবাবুর মনের ভাব বুঝে ডেপুটি নিজেই জিজ্ঞাসা করলেন—”মিস্ রায় ঠিক কথাই বলেছেন, আগের সে চিঠিখানা এনেছেন কি?”
ডেপুটির কথায় নন্দবাবুর ভ্রূ কুঞ্চিত হলো। তিনি বিরক্ত ভাবে একবার শিখার দিকে তাকিয়ে পরক্ষণেই তাকালেন ডেপুটির দিকে।
ডেপুটি এ দৃষ্টির অর্থ বুঝলেন। তিনি বললেন—”উনি আমাদেরই একজন। পুলিশে চাকরি করেন না, কিন্তু ওঁর বুদ্ধিতে আর সামর্থ্যে আমরা অনেক জটিল কেসে আশ্চর্য্য ফল পেয়েছি। ওঁর কাছে স্বচ্ছন্দে আপনি সব কথা বলতে পারেন।”
”ও!” বলে নন্দবাবু একটা নিশ্বাস ফেললেন, বেশ স্বস্তির নিশ্বাস। তারপর বললেন—”ঠিক সাত দিন আগে এমনি আর একখানা চিঠি পেয়েছিলুম—বাড়ীর ঠিকানাতেই। ইংরেজীতে এমনি টাইপ করা চিঠি। তামাসা, না হয়, আস্পর্দ্ধা ভেবে আমি গ্রাহ্য করিনি। গ্রাহ্য না করার মানে—কলকাতার মত সহরে বাস করছি—আইন—পুলিশের রাজ্য, এখানে অমনি পলাশীর যুদ্ধের আমলের মতন ছেলেধরা এসে শাসিয়ে টাকা আদায় করবে আর টাকা না দিলে ছেলে চুরি করে নিয়ে যাবে! ছেলেধরায় ছেলে নিয়ে যায়, মানি। তা বলে এমন করে? যেন সেই গল্পের বিশে ডাকাতের মতন! সে চিঠি আমি ছিঁড়ে ওয়েষ্ট—পেপারের ঝুড়িতে ফেলে দিয়েছি। কিন্তু আজ আবার এই সেকেণ্ড চিঠি পেয়ে ভাবছি—না, অগ্রাহ্য করা উচিত নয়! তাই আপনাদের কাছে ছুটে এসেছি।”
নন্দবাবুর কথা শুনে ডেপুটি কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন—”আপনার কর্ম্মচারীদের মধ্যে কাকেও আপনার সন্দেহ হয়? ইতিমধ্যে কাকেও বরখাস্ত করেছেন?”
”না। অফিসে কারো এতটুকু অসন্তাোষ নেই। কাকেও ডিসমিস্ করা হয়নি। তাছাড়া আমার স্ত্রী নিজে কারবার সম্বন্ধে সব কিছু করেন কি না! ছেলেমেয়ের শোকে তিনি এমন যে, কারো মনে কষ্ট হবে, এমন কিছু করবার উপায় নেই। তিনি বলেন, কার নিশ্বাসে কি অনিষ্ট বা বিপদ হয়, কে বলতে পারে! বছরে দুবার সকলকে বোনাস দেওয়া হয়, জানেন? আমার স্ত্রীর ইচ্ছায়। একবার পূজার সময়, আর একবার চৈত—সংক্রান্তিতে।”
”আপনার কোন শত্রু—টত্রু আছে কি?” জিজ্ঞাসা করেন তিনি।
”না। তেমন কোন শত্রুর কথা তো মনে পড়ে না। তাছাড়া শত্রুতা সৃষ্টি হয় এরকম কোন কাজ আমরা কখনও করি না।”
নন্দবাবুর কথা শুনে বিমলেন্দু নিজের মনেই বলে উঠলো—”চণ্ডী ঠাকুর নামে কোন ক্রিমিন্যালের নাম তো আজ পর্যন্ত শুনিনি। তাছাড়া কে এমন ওস্তাদ লোক এই চণ্ডী ঠাকুর, যে পুলিশের সাহায্য প্রার্থনা করলেও তারিখ এবং সময় দিয়ে বাড়ী থেকে ছেলে চুরি করে নেবার সাহস রাখে!”
নিজের মনে এই কথাগুলি বলে শিখার দিকে তাকিয়ে বিমলেন্দু জিজ্ঞাসা করে—”আপনার কি মনে হয় দিদি?”
শিখা বললো—”এখন আমার কিছুই মনে হয় না। আপনি ঠিক জানেন ‘চণ্ডী ঠাকুর’ ছদ্মনামে কোন ক্রিমিন্যাল নেই?”
বিমলেন্দু বলে—”আমার তো তাই ধারণা, কারণ ‘ক্রিমিন্যাল—ইনডেক্স’—এ ওরকম নামের কোন মহাত্মার পরিচয় আছে বলে তো মনে হয় না।”
বিমলেন্দুর এই কথায় ডেপুটি তৎক্ষণাৎ আর্দ্দালী ডাকিয়ে ‘ক্রিমিন্যাল—ইনডেক্স’ বইখানা আনিয়ে তার ‘সি’ এই ইংরেজী অক্ষরটার পৃষ্ঠাখানা দেখে যেতে লাগলেন।
অনেকক্ষণ পরীক্ষা করবার পর ডেপুটি সেই বই থেকে মুখ তুলে বললেন—”তুমি ঠিকই বলেছো বিমল। সত্যিই চণ্ডী ঠাকুর নামে কোন অপরাধীর কথা লেখা নেই ‘ইনডেক্স’—এ। এখন তাহলে কোন পথে সন্ধান করা যায়, এ বিষয়ে তুমি কি পরামর্শ দাও?”
বিমলেন্দু বললে—”একটু ভাবতে দিন স্যর, ভেবে বলবো।”
দুই – পরিচয়
বিমলেন্দু ও শিখা দু’জনেই চিন্তা করতে লাগলো। হঠাৎ কি মনে হওয়ায় নন্দবাবুর দিকে তাকিয়ে শিখা বললে—”মাপ করবেন, বয়সে আপনি আমার বাপের তুল্য, যদি অপরাধ না নেন একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই!”
”কি?” প্রশ্নটা নন্দবাবু করলেন বেশ একটু জোর গলায়—এবং স্বরে একটু তাচ্ছিল্যের ভাব! অর্থাৎ হাতী—ঘোড়া যেখানে তল পায় না, সেখানে এই একটা পুঁচকে মেয়ে!
এ ভাব শিখা যে বুঝলো না, তা নয়, কিন্তু বুঝেও সে গ্রাহ্য করলো না! সে জানে, যে—ব্রত নিয়ে সে এ কাজে নেমেছে, তাতে এ সেণ্টিমেণ্ট রাখা চলে না! শিখা তাই একটু জোরের সঙ্গেই আবার জিজ্ঞাসা করলো—”আপনি দু—খানা এমন চিঠি পেলেন—আপনার স্ত্রীকে এ সম্বন্ধে আপনি কিছু বলেছেন?”
একটা ঢোক গিলে নন্দবাবু বললেন—”প্রথম চিঠি আসতে তাঁকে সে চিঠি দেখিয়ে চিঠির ভাবার্থ বলেছিলুম বৈ কি। আমার স্ত্রী ইংরেজী জানেন না।”
”শুনে তিনি কি বললেন?”
নন্দবাবু বললেন—”তিনি খুব ভয় পেয়েছিলেন। বললেন—’এ কি বিপদ!’ পরে বললেন—’ছেলেকে নিয়ে আমি বরং কোথাও চলে যাই চুপি—চুপি—কেউ জানবে না!’ আমি বললুম—’কোথায় যাবে! যদি তামাসা না হয়ে সত্যি হয়, তাহলে কি ভাবো, তারা নজর রাখবে না? যদি সত্যি হয়, তারা এখন থেকেই নজর রাখছে।”
বিমলেন্দু বললে—”টাকা দেবার সম্বন্ধে তিনি কি বললেন?”
একটু চুপ করে থেকে নন্দবাবু বললেন—”টাকাকড়ির সম্বন্ধে তিনি মানে, একটু—অর্থাৎ যা ন্যায্য বলে নিজে বোঝেন, তার জন্য তিনি দশ—বিশ হাজার টাকা ব্যয় করতে পারেন। কিন্তু এ ব্যাপারে টাকা ব্যয় করতে অর্থাৎ চণ্ডী ঠাকুরকে টাকা দিতে তিনি চান না। আমি অবশ্য বলেছিলুম, ‘কাজ কি এ সব হাঙ্গামায়, যদি সত্যি হয়, দিই না হয় টাকাটা পাঠিয়ে!’ তাতে তিনি বললেন—’না, এতগুলো টাকা—চোখ রাঙিয়ে লুঠে নেবে!’ এ তিনি দিতে রাজী নন।”
একটু চুপ করে থেকে নন্দবাবু আবার বললেন—”একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। আগের চিঠিতে লিখেছিল—সে চিঠির জবাবে আমি যেন পরের রবিবারে যুগান্তর পত্রিকায় দু—লাইন বিজ্ঞাপন দিই—’চণ্ডী ঠাকুরের পূজা দেবো!’ শুধু এই কয়টি কথা। তাহলে তারা বুঝবে, ব্যাপার ঠিক আছে।”
”আপনি তা করেননি নিশ্চয়ই?” প্রশ্ন করে বিমলেন্দু।
”না।”
শিখা বললে—”আপনার স্ত্রীর কথাটা আগে দয়া করে শেষ করুন। তিনি শেষ পর্য্যন্ত কি বললেন বলুন?”
নন্দবাবু বললেন—”তিনি রীতিমত উতলা হয়ে উঠলেন। তবু—টাকা দিতে রাজী নন। বলেন, ছেলেকে নিয়ে বরং ষ্টীমারে করে বেরিয়ে পড়ি—বর্মায় হোক, চীন—জাপানে হোক—না হয় বিলাত। ষ্টীমার থেকে তো আর ছেলে চুরি করতে পারবে না কেউ?”
এই পর্য্যন্ত বলে নন্দবাবু চুপ করলেন।
”তার পর?”
”তারপর তাঁকে বুঝিয়ে—সুঝিয়ে ঠাণ্ডা করলুম। চিঠিখানা ছিঁড়ে ফেলে দিলুম। আর চাকর—বাকরের সঙ্গে ছেলে কাছের পার্কে দুবেলা বেড়াতে যেত—তার সে—বেড়ানো সেই থেকে বন্ধ রেখেছি। তারপর এ—কথা প্রায় ভুলে গিয়েছিলুম। হঠাৎ আজ আবার এই ফ্যাশাদ! তাই চিঠি পড়ে এক মিনিট দেরী করিনি, সোজা আসছি আপনাদের কাছে। এখন এ সম্বন্ধে যা হয়, বিহিত করুন!”
শিখা বললে—”যে জায়গায় টাকা রাখতে বলেছে, সেখানে পুলিশ ওয়াচ করতে পারে—অবশ্য যথাসম্ভব গা ঢেকে।”
বাধা দিয়ে নন্দবাবু বললেন—”তাহলে বিশ হাজার টাকা সেখানে পাঠাতে হবে তো। আমার স্ত্রী তার জন্য এক পয়সাও দেবেন না। কাল কথায় কথায় তিনি এমন কথাও বলেছেন—ওদের ভয়ে বিশ হাজার টাকা জলে দেবো কেন? দশ হাজার টাকা দিয়ে স্পেশাল প্লেন হায়ার করে সেই প্লেনে ছেলেকে নিয়ে সুইজারল্যাণ্ডে কি বিলেতে গিয়ে থাকবো।”
বিমলেন্দু তাচ্ছিল্যভরে বললে—”চুপচাপ বসে থাকুন। ২২ তারিখের তো এখনো ঢের দেরী। আজ হলো মাসের ১৪ তারিখ। এখনো সাত দিন সময় আছে। দেখুন, এর মধ্যে আর কোন চিঠি পান কি না।”
শিখা বললে—”এ চিঠিতে কৈ সে কথা লেখা নেই তো যে জবাবে রবিবারের যুগান্তরে চণ্ডী ঠাকুরের পূজার কথা দু—লাইন ছাপাবেন আপনি!”
একটা নিশ্বাস ফেলে নন্দবাবু বললেন—”না, এতে তা নেই বটে।”
ডেপুটি বললেন—”আমি বলি, এখন চুপ করে বসে থাকুন। দেখা যাক, আর কোন চিঠি আসে কি না। হয়তো কোন রসিক বন্ধু তামাসা করেছে মজা দেখবার জন্যে! অবশ্য ছেলের সম্বন্ধে বেশ সাবধান থাকবেন। চাকর—বাকরদের সঙ্গে বাইরে যেতে দেবেন না—মোটরে যদি ছেলে বেরোয়, তাহলে আপনার বা আপনার স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়া যেন না বেরোয়।”
এ কথা বলে তিনি তাকালেন বিমলেন্দু এবং শিখার দিকে।
”তোমরা কি বলো?”
বিমলেন্দু বললে—”এ ছাড়া আর কি!”
শিখা নন্দবাবুকে জিজ্ঞাসা করলো—”আপনার চাকর—বাকর ক’জন বাড়ীতে?”
”চাকর তিনজন। একজন খানসামা বাহিরে কাজ করে, একজন ভিতর—বাড়ীতে, একজন ঝি আছে বাসন মাজে; ছেলের জন্য একটা ছোকরা চাকর আছে; আমার স্ত্রীর একজন খাস দাসী আছে, বামুন আছে, দরোয়ান আছে। আর দুখানা গাড়ী; দুখানা গাড়ীর দুজন ড্রাইভার। তাছাড়া অফিসের দুজন বেয়ারা আমার বাড়ীতে খায় আর থাকে।”
”তাদের কাকেও সন্দেহ হয়?”
”না।”
”অফিসের কোন কর্ম্মচারী,—এমন কেউ আছে—ফন্দীবাজ?”
”না। আমার জ্ঞানতঃ নয়, অন্ততঃ।”
ডেপুটি বললেন—”আমি বলি, চুপচাপ থাকুন। চিঠিখানা ছিঁড়বেন না, রেখে দেবেন।”
”আপনারা একটু নজর রাখবেন।”
ডেপুটি বললেন—”আপনার বাড়ী হলো—”
”বালিগঞ্জে।”
”তাহলে বালিগঞ্জ থানায় আমি ফোন করে দিচ্ছি—আপনার বাড়ীর উপর বিশেষ নজর রাখবে’খন।”
”তাহলে আসি। সত্য কথা বলতে কি, প্রথম চিঠি আসতে মোটে কেয়ার করিনি। কিন্তু এই সেকেণ্ড চিঠিখানা আসতে কেমন একটু নার্ভাস হয়েছি বৈ কি। কাজ—কারবার করছি নিশ্চিন্ত মনে—তার মধ্যে এ কি ঝঞ্ঝাট, বলুন তো!”
”ঠিক কথা।”
নন্দবাবু বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই শিখা বললে ডেপুটিকে উদ্দেশ করে—”চিঠিখানা আপনি রেখে দিলেন না কেন?”
”রেখে দেবো?”
”আমি বলি, তাই রাখুন।”
”বেশ!” বলে ডেপুটি বেল টিপলেন—আর্দ্দালী এলো। ডেপুটি বললেন—”যে বাবু এসেছিলেন, তাঁকে ডেকে আনো…জলদি।”
আর্দ্দালী বেরিয়ে গেল এবং কিছুক্ষণ পরেই নন্দবাবু আবার ফিরে এলেন। ডেপুটি বললেন—”চিঠিখানা আপনি রেখে যান বরং। আমি ফাইল তৈরী করিয়ে একটু সন্ধান—”
”ও, তা বেশ।” বলে নন্দবাবু খাম—সমেত চিঠিখানা দিলেন ডেপুটির হাতে।
চিঠি নিয়ে ডেপুটি বললেন—”আচ্ছা…নমস্কার।”
”নমস্কার।”
নন্দবাবু চলে গেলেন।
তিনি চলে যাবার পর শিখা বললে—”মানুষটি কেমন—কিছু জানেন?”
ডেপুটি বললেন—”ভালো বলেই জানি। আমাদের পুলিশ—ক্লাব থেকে যখনি ছেলেরা গিয়ে টাকা চেয়েছে, যা চেয়েছে, হাসিমুখে দিয়েছেন। ক্লাবের স্পোর্টসে, থিয়েটারে আসেন। কমিশনার সাহেবের সঙ্গেও জানাশুনা আছে।”
বিমলেন্দু বললে—”ওঁর স্ত্রী পর্দ্দা মানেন? না, তিনিও বাহিরে আসেন ওঁর সঙ্গে?”
”না। স্ত্রীকে কখনো দেখিনি।”
শিখা কি ভাবছিল, বললে—”একটা কথা আমার মনে হচ্ছে। ওঁদের ঐ এক ছেলে—ছেলেটি মারা যায় যদি, তাহলে নন্দবাবুর অবর্ত্তমানে ওঁর বিষয়—সম্পত্তি পাবে কে? কোন ভাইপো, ভাগনে কিংবা অন্য কোন জ্ঞাতি?”
”হুঁ!” ডেপুটি বললেন—”এ—কথাটা মনে হয়নি তো!”
বিমলেন্দু বললে—”কিন্তু শুনেছি, এ সব সম্পত্তি নন্দবাবুর শ্বশুরের—ওঁর পৈত্রিক সম্পত্তি নয়। শ্বশুরের নাম ছিল গোপাল বোস। গোপাল বোসের ঐ এক মেয়ে—নন্দবাবুর সঙ্গে বিয়ে হয়েছে।”
এই সব কথার মধ্যে কামরায় ঢুকলো ইনস্পেক্টর মাখন দত্ত।
ডেপুটি বললেন—”এই যে মাখন! তুমি তো প্রায় দু—বছর ছিলে বালিগঞ্জের থানায়—নন্দবাবুকে জানো, নিশ্চয়?”
মাখন বললে—”জানি, স্যর।”
”কি রকম মানুষ?”
”মানুষ ভালো। ঘর—জামাই। শ্বশুর গোপালবাবু আগে সামান্য কাজ করতেন। এক সাহেবের নজরে পড়ে ছোটখাট কারবার সুরু করেন। অদ্ভুত পরিশ্রমী। মাটির মানুষ। যাকে বলে, অজাতশত্রু ছিলেন। খুব অনেষ্ট। এত বড় কারবার তিনিই গড়ে তোলেন। নন্দবাবু ওঁর অফিসে কাজ করতেন—ওঁর খাস কেরাণী—চিঠিপত্র লিখতেন—বি—এ পাশ। নন্দবাবুকে তাঁর খুব পছন্দ হয়। কারবার গোপালবাবুর হাতে তৈরী। একমাত্র মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে নন্দবাবুকে ঘর—জামাই করে ঘরে রাখেন। কিন্তু পয়সাকড়ি সম্বন্ধে যা—কিছু করেন, ওঁর স্ত্রী। স্ত্রীর ব্যবসা—বুদ্ধি বেশ ভালো। বাপের কাছে শিক্ষা। পয়সাকড়ির ব্যাপারে শুনতে পাই, নন্দবাবু পান মাসিক এ্যালাউয়ান্স। একবার একটা জমির ব্যাপারে আমায় এনকোয়ারি করতে হয়েছিল। সেই সময় দেখেছি, স্ত্রী পাওয়ার—অব—এ্যাটর্ণি দিয়েছেন স্বামীর নামে। তা দিলেও স্ত্রীর কথা ছাড়া কোন কাজ হয় না—সামান্য পেমেণ্ট বা নতুন কোন কন্ট্র্যাক্ট—কিছু না।”
মাখন দত্ত সম্প্রতি ডিটেকটিভ ডিপার্টমেণ্টে এসেছে—কি কাগজ সহি করিয়ে মাখন দত্ত চলে গেল।
শিখা বললে—”এখন তাহলে ওঠা যাক। জাল নোটের ব্যাপারে ইনফর্ম্মার খবর আনবে বলেছে তো সে—খবর পেলে বিমলদা আমাকে বলবেন।” এই পর্য্যন্ত বলে একটু পরিহাসের লোভ হলো। শিখা বললে—”বিমলদার পপি কুকুরটা পারে না নন্দবাবুর ব্যাপারে কোন সাহায্য করতে? ঐ চিঠির গন্ধ শুঁকে—কে এ চিঠি লিখেছে?”
ডেপুটি হো—হো করে হেসে উঠলেন।
বিমলেন্দু একটু বিরক্ত হলো শিখার উপর, বললে—”ঠাট্টা নয়। এ—ব্যাপারে কেউ যদি কিছু করতে পারে তো পপিই পারে—তা কিন্তু বলে দিচ্ছি।”
”বেশ! যদি এ ব্যাপার ডেপুটি সাহেব হাতে নেন, তাহলে আপনার পপিকেই তিনি এ কেসের ভার দেবেন।”
ডেপুটি আবার খানিকটা হাসলেন, তারপর শিখা চলে এলো ঘর থেকে।
তিন – বার-বার তিন বার
এর ছ’দিন পরে—বেলা তখন নটা বাজে—শিখা কলেজের বইগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করছে—গ্রীষ্মের ছুটি চলেছে, ছুটিতে একটি দিন বই খুলে বসেনি। মনে কেমন চাঞ্চল্য—যে কাজ নিয়ে মেতে উঠেছে, সে কাজের সঙ্গে কলেজের পড়া চালানোর কোন অর্থ হয় না। একে লেকচার কামাই, তার উপর বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক নেই! এ অবস্থায়—
কি করবে কিছু ঠিক করতে পারে না। দু—নৌকায় পা দিয়ে চলার মানে নৌকা—যাত্রা মিথ্যা হয়। জলে ডোবা ছাড়া উপায় থাকে না। হঠাৎ ফোন বাজল। লাফিয়ে গিয়ে ফোন ধরল—ওদিক থেকে শোনা যায় বিমলেন্দুর গলা।
”বিমলদা—ও—হ্যাঁ, কি খবর?”
ফোনে বিমলেন্দু দিলে জবাব, ”আজ সকালে ডেপুটি—সাহেব এইমাত্র ফোন করেছিলেন, নন্দবাবু কাল রাত প্রায় আটটার সময় তাঁর কোয়ার্টার্সে গিয়ে হাজির। তিনি আর একখানা চিঠি পেয়েছেন, ঠিক ঐ একই মর্ম্মে। তাই তিনি আমাকে বলেছেন—বেলা দশটায় আমি যেন লালবাজার অফিসে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করি। নন্দবাবুকে তিনি ঐ সময়ে লালবাজারে আসতে বলেছেন।”
শিখা বললে—”তার জন্য আমাকে ফোন করছেন কেন?”
বিমলেন্দু বললে—”বুঝছো তো দিদি, এ ব্যাপারে তোমার সাহায্য আমি চাই। নন্দবাবুর যে—পরিচয় সেদিন পেয়েছি, তার উপর আরো কিছু জেনেছি। ভদ্রলোক এদিকে নিরীহ, ভালো এবং সৎ। তাহলেও আমার যেন কেমন লাগছে। পয়সাওয়ালা স্ত্রী—এ ক্ষেত্রে সাধারণতঃ যেমন হয়ে থাকে, স্বামীকে দেখেন একটু বেচারা গোছের জীব! অর্থাৎ স্বামী স্ত্রীর পয়সার অধীন থাকলে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে যা হয়ে থাকে, তাই। আমার মনে হয়, তোমার বুদ্ধির দরকার হতে পারে—যদি এ—কেসে তদন্তের ভার পড়ে! তাই তোমাকে জানাচ্ছি, দিদি, বলতে লজ্জা হচ্ছে, সব কাজ ফেলে তুমি যদি দশটার সময় লালবাজারে আসতে পারো, খুব ভাল হয়! আমি যাবার পথে তোমাকে তুলে নিয়ে যাব।”
নন্দবাবু তৃতীয় পত্র পেয়েছেন শুনে শিখার মনে কৌতূহল বেশ বেড়ে উঠলো! মনে হচ্ছে, কোন রহস্য আছে যেন! দেশে ধনী তো আরো অনেক আছেন, তাঁদের ঘরে ছেলে—মেয়েও আছে। তাদের কারো কাছ থেকে টাকা চেয়ে এমন শাসানো—চিঠির কথা শোনা যায় না! হঠাৎ নন্দবাবুর নামে এমন চিঠি!
শিখা বললে—”আপনার ঐ মোটর—বাইকের সীটে বসে ভ্যাট ভ্যাট করতে—করতে যাওয়া—না বিমলদা, মাপ করুন, ওটি আমি পারব না!”
বিমলেন্দু বললে—”আহা! না, না, আমার কি জ্ঞান—বুদ্ধি নেই, তোমাকে মোটর—বাইকের সীটে বসিয়ে লালবাজারে নিয়ে যাবো দিদি! আমি ট্যাক্সি নিয়ে যাবো।”
”বেশ, আসবেন। আমি তৈরী থাকব। সত্যি বলতে কি, আমার কেমন মজা লাগছে! এমন কেস শোনা যায় না বড় এদেশে! নতুন রকমের কেস। আমি যাব আপনার সঙ্গে।”
”কথা তাহলে পাকা?”
”হ্যাঁ, হ্যাঁ।”
ফোন ছেড়ে দেয় বিমলেন্দু।
রিসিভার রেখে শিখা এসে চেয়ারে বসলো। মনে—মনে হাসল, না, মা—সরস্বতী রাগ করেছেন। কিছুতে তিনি আর শিখার উপর সদয় হবেন না! শিখা ডাকল—”রতন!”
রতনের সাড়া পাওয়া গেল। সে যাচ্ছিল বাজারে—শিখার ডাকে বাজারের ধামাসমেত এসে হাজির হলো। বললে—”কি? কোন জিনিস আনবার ফরমাস আছে?”
শিখা বললে—”মা কি করছে রে?”
”মা স্নান করতে গেলেন আমাকে বাজারের ফর্দ্দ দিয়ে।”
”একটু শীগগির—শীগগির এসো। আমি দশটার মধ্যে নেয়ে—খেয়ে বেরুব।”
মৃদু হেসে রতন বললে—”বুঝেছি, ডিটেকটিভগিরি করতে বেরুবে। ফোন করতে শুনলুম কি না, আমি ঠিক বুঝে নিয়েছি। মাও শুনেছেন, বললেন—’শিখাকে ডেকে দে রতন। কে ফোন করছে!’ আমি বললুম—”আপনাকে ভাবতে হবে না, মা। যার ফোন সে ঠিক কান খাড়া করে বসে আছে।’ ভাবি, আট দিন দিদিমণি ঘরে বসে আছে চুপচাপ, পুলিশ থেকে ডাক আসে না! তা যা বলেছি, ঠিক তাই!”
কৃত্রিম কোপের ভাবে শিখা বললে—”হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুই ভারী জ্যোতিষী হয়েছিস! মোদ্দা, আমার খাবার চাই পৌণে দশটায়। দশটার আগেই বিমলদা আসবেন—ফোন করেছেন।”
”শোন একবার কথা! আমি বাজারে যাচ্ছি, কেনা—কাটা করব, তবে তো! হুট বলতেই তুমি যদি খেতে চাও—”
শিখা বললে—”না দিতে পারিস, বেশ, না খেয়েই যাব। তারপর ফিরতে সেই বেলা তিনটে বাজুক, কি চারটে বাজুক, কি আজ না ফিরি কাল ফিরি, আমার খাওয়া হবে না! তোর কি!”
রতন বেতনভোগী। তাহলেও এ—বাড়ীতে যে স্নেহ—মায়া পায়, তাতে সে এ—বাড়ীর আপন—জনের সামিল হয়ে উঠেছে। শিখার এ—কথায় সে বেশ ভাবিত হলো। বললে—”রোসো, মাকে বলে আসি, ঠাকুরকে বলে মা চটপট যা হয় ব্যবস্থা করে দেবেন। না—খেয়ে তোমার যাওয়া হবে না, দিদিমণি! তুমি যাও, স্নান করোগে, তোমার খাবার ঠিক সময়ে পাবে। তুমি নিশ্চিন্ত থাক।”
কথাটা বলে রতন তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল।
শিখা হাসলো, হেসে বইগুলো শেলফে রেখে স্নান করতে গেল।
চার – প্রথম মুখে
বিমলেন্দুর সঙ্গে শিখা যখন লালবাজারে পৌঁছুল, তখন দশটা বেজে পনেরো মিনিট। ডেপুটি কমিশনার মিঃ গুপ্ত কি একটা ফাইল দেখছেন তন্ময় হয়ে—তাঁর সামনে বসে নন্দবাবু। মলিন মুখ। বেশ চিন্তাকুল ভাব!
বিমলেন্দু আর শিখা আসতেই ডেপুটি ফাইল রেখে বললেন—”মিস্ রায়ও এসেছেন! ভালো! আপনার কথা আমার মনে হচ্ছিল! কিন্তু বলতে ভরসা পাইনি।”
বিমলেন্দু বললে—”আমি ওঁকে ফোন করে এ খবর জানাতেই উনি যে—রকম আগ্রহ দেখালেন, আমি বললুম—চলুন না আমার সঙ্গে! উনিও রাজী হলেন।”
ডেপুটি বললেন—”ভালো হয়েছে। আপনার কথা আরো আমার মনে হচ্ছিল কেন, জানেন? নতুন—রকম কেস। আমরা পুলিশ—সাধারণতঃ যে—সব জাল—জুচ্চুরি, নোট জাল, খুনের মামলা ঘাঁটাঘাঁটি করি, তাতে আমাদের মনে এমন কতকগুলো ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে, যে—কেসই হাতে আসুক, সেই ধারণা নিয়ে তদন্ত সুরু করি। তার ফলে, অনেক সময় যেমন অনেকখানি সময় মিথ্যা নষ্ট হয়, তেমনি আবার ভুল—পথে চলি! আর সেই ফাঁকে আসামী সুযোগ পায়—অনেক প্রমাণ বেমালুম নষ্ট করে দেবার সুযোগ পায়। তাই আর কি! কিন্তু ভূমিকা থাক, নন্দবাবু আবার একখানা ঐ রকম চিঠি পেয়েছেন কাল সন্ধ্যার সময় অফিস থেকে বাড়ী ফিরে। রাত্রে আমার কোয়ার্টার্সে গিয়েছিলেন। আমি ওঁকে বলি, আজ বেলা দশটায় এখানে আসবার জন্যে। বারে—বারে এমন চিঠি! না, তামাসা নয়! ব্যাপার সিরিয়াস, মনে হয়।”
বিমলেন্দু এবং শিখা চেয়ারে বসে সব কথা শুনল। শিখা বললে—”এ চিঠিখানা দেখতে পারি?”
”নিশ্চয়। নন্দবাবুর কাছেই সে—চিঠি আছে। দিন তো মশায়।”
নন্দবাবু পকেট থেকে খামশুদ্ধ চিঠি বার করে শিখার হাতে দিলেন।
শিখা দেখলো—ঠিক সেই খাম—এক কাগজ, এক মাপ। ডাকঘরের ছাপ দেখলো—জি. পি. ও, ক্যালকাটা। সে—চিঠির উপরও ডাকের ছাপ ছিল জি. পি. ও.। খাম থেকে চিঠি বার করে শিখা পড়তে লাগল।
বিমলেন্দুও ঝুঁকে পড়লো চিঠিখানার ওপর।
চিঠিতে সেই এক কথা—তবে কয়েকটা নতুন কথার অবতারণা করা হয়েছে এবারকার চিঠিতে, তা হল এই : ”বার—বার তিনবার আপনাকে জানানো হলো। আপনি ভাবছেন, তামাসা! কিন্তু এ—তামাসা কি সাংঘাতিক হবে, ২২ তারিখে রাত বারোটায় তা মর্ম্মে—মর্ম্মে বুঝবেন; আর তার পরদিন ২৩ তারিখে ছেলের জন্য বার করতে হবে ত্রিশ হাজার! তখন আর বিশ হাজারে কাজ হবে না! যদি ভেবে থাকেন পুলিশের সাহায্য নেবেন—তাতেও ছেলে রক্ষা পাবে না! পুলিশের কেরামতি কে না জানে? খুন হলে তারা লম্ফঝম্ফ করে—চুরির পর তাদের তোড়জোড় চলে। এ—পর্য্যন্ত পুলিশ ক’টা খুন আটকাতে পেরেছে? ক’টা চুরি বন্ধ করতে পেরেছে? ইত্যাদি।”
পড়া শেষ হলে শিখা চিঠিখানা পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা করতে লাগল। তারপর ডেপুটিকে বললে—”দ্বিতীয় চিঠিখানা একবার দেখতে পারি?”
”নিশ্চয়। এই নিন।” বলে তাঁর টেবিলের ড্রয়ার থেকে সেই চিঠিখানা বার করে দিলেন।
দুটো চিঠি শিখা বেশ করে মিলিয়ে দেখতে লাগল। ডেপুটি, বিমলেন্দু এবং নন্দবাবু—তিনজনে চেয়ে আছেন শিখার দিকে।
প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে চিঠি দুটো মিলিয়ে দেখে শিখা বললে—”কায়দা ঠিক আছে। এক কাগজ…এক টাইপ—মেশিন, মাঝে—মাঝে ভাঙ্গা অক্ষর! তবে তফাৎও আছে, মিষ্টার গুপ্ত! বানান—ভুলে তফাৎ! দ্বিতীয় চিঠিতে—সেণ্ট পলস কাথিড্রাল…এতে ‘পল’ বানান করা হয়েছে PALL; এ—চিঠিতে ‘পল’ হয়েছে POLL, এই হলো নাম্বার ওয়ান। তারপর প্রথম—লাইনে ‘চিঠির জবাব পাইনি’, কথাটা দেখুন—আগের চিঠিতে রিসিভ কথার বানান—RESEEVE; এ—চিঠিতে বানান—RESIVE. তারপর নাম্বার থ্রী—এই দেখুন, যদি ধরিয়ে দেবার ব্যবস্থা করেন কথাগুলোয় ‘ব্যবস্থা করেন’ আগের চিঠিতে ARRANGE কথার বানান ARANGE, এ—চিঠিতে বানান হয়েছে AREINGE”.
সকলে দেখলেন বানান—ভুলগুলো—তিনজনেই। শিখা চেয়ে আছে নন্দবাবুর দিকে। শিখার মনে হলো, নন্দবাবুর যেন কেমন একটু ভাবান্তর! কিন্তু কেন? কেন? দু’—একবার নিজের মনকে প্রশ্ন করেও শিখা এর কোন জবাব পেল না।
ডেপুটি বললেন—”ঠিক! যে—লোক বানান ভুল করে, তার ভুল একই রকম হবে সব সময়ে—আজ এক—রকম, কাল আর—এক—রকম বানান ভুল—এমন কখনো হয় বলে জানি না!”
ডেপুটির কথা শেষ হবার আগেই নন্দবাবু বললেন—”এতে আপনার কি মনে হয়?”
শিখা বললে—”বানান ভুল ইচ্ছা করে করা হয়েছে। এ—থেকে বোঝা যাচ্ছে, চিঠি যে লিখেছে, ঠিক বানান সে জানে! ভুল করে লিখেছে, যাতে আপনি ভাববেন, তেমন ইংরেজী জানে না, এমন কোন লোক এ—চিঠি লিখেছে। কিন্তু তা যে নয়, তা বোঝা যাচ্ছে গ্রামারের কোন ভুল নেই দেখে। অর্থাৎ আসল কথাটা পাছে পরিষ্কার করে না বলা হয়—এইজন্য ইচ্ছা করে গ্রামারের ভুল করেনি।”
নন্দবাবু একাগ্র দৃষ্টিতে শিখার দিকে চেয়ে এ—কথা শুনলেন। তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে তিনি বললেন—”কিন্তু যে টাইপ করেছে, সেও তো ভুল করতে পারে!”
একটু হেসে শিখা বললে—”সে তাহলে বানানে একই রকম ভুল করে যাবে বরাবর। ধরুন ‘ক্রীচার’ কথাটা আমি ভুল বানান করি, লিখি CRICHAR. তাই যদি, তাহলে ক্রীচার কথাটা আমি সব সময়ে ঐ ভাবেই বানান করবো। আজ CRICHAR লিখবো, তারপর কাল লিখবো CREECHER—এমন কখনো হবে না।”
ডেপুটি আর বিমলেন্দু প্রায় সমস্বরে বলে উঠলেন—”ঠিক।”
নন্দবাবু আর—একটা নিশ্বাস ফেললেন, বললেন—”বানান জাহান্নমে যাক! এ—চিঠি পেয়ে কাল আমার স্ত্রীকে দেখিয়েছি। তিনি ভয়ানক ভয় পেয়েছেন! বলেন—আজই প্লেনে সিট রিজার্ভ করে এসো। দিল্লী হোক, বোম্বাই হোক, নাগপুর—মাদ্রাজ—যেখানে হোক, ছেলেকে নিয়ে আমি চলে যাব। আমি বললুম—পুলিশে খবর দিয়ে টাকাটা রাখা যাক! তারপর নজর রাখা। তাতে বেশ রেগে তিনি বললেন—না, টাকা খোলামকুচি নয় যে, হুমকি দিয়ে যে—সে তা লুঠ করবে! তিনি বলেন—তাছাড়া, আজ ছেলে চুরি করে নিয়ে যাবার ভয় দেখিয়ে যদি বিশ হাজার পায়—তাহলে ছ’মাস বাদে আবার ঐ ভয় দেখিয়েই ত্রিশ হাজার চাইবে না—তার কি মানে আছে?”
ডেপুটি বললেন—”তিনি ঠিক কথাই বলেছেন!”
নন্দবাবু বললেন—”আমি তাঁকে বুঝিয়ে এসেছি, প্লেনে যেতে হয়, যেয়ো—আজ, না হয় কাল। লালবাজারে গিয়ে ডেপুটি সাহেবকে আমি সব কথা বলি, শুনে তিনি কি বলেন, দ্যাখো। তাই আমার অনুরোধ, যদি কোন পাকা অফিসার একবার আমার ওখানে গিয়ে তাঁকে—মানে, তিনি নিজে এ—সম্বন্ধে আপনাদের সঙ্গে কথা কইতে চান—বলেছেন। তা—”
ডেপুটি তাকালেন বিমলেন্দুর দিকে; বললেন—”তোমাকে আমি পাঠাতে চাই, বিমল। আর তোমার সঙ্গে মিস্ রায় যদি—মানে, মিসেস্ সিঙ্গীর সঙ্গে দেখা করলে হয়তো তাতে সুবিধা হবে। মিস্ রায় মেয়ের মত তাঁর সঙ্গে কথা কইতে পারবেন! কি বলেন, মিস্ রায়?”
”বেশ। আপনি যখন বলছেন, নিশ্চয়ই যাবো আমি।”
ডেপুটি তাকালেন নন্দবাবুর দিকে। বললেন—”এঁদের নিয়ে আপনি বাড়ী যান। মিস্ রায় খুব বুদ্ধিমতী—আপনার স্ত্রীকে উনি ঠিক বোঝাতে পারবেন।”
”কিন্তু কি বোঝাবেন? তিনি প্লেনে করে কলকাতা ছেড়ে যেতে চান!”
ডেপুটি বললেন—”তার দরকার হবে না। আমাদের সম্বন্ধে যে যে—কথাই বলুক, সময়ে খবর পেলে আমরা সব অন্যায় বন্ধ করতে পারি, সে সামর্থ্য কলকাতা—পুলিশের অবশ্যই আছে। মিস্ রায় আপনার স্ত্রীকে ঠিক বোঝাতে পারবেন। ওঁর কথায় পুলিশের উপর আপনার স্ত্রীর আস্থা হবে বলেই আমার বিশ্বাস।”
নিশ্বাস ফেলে নন্দবাবু বললেন—”কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, কি দরকার এত ফ্যাসাদে? ছেলের জীবনের দাম বিশ—হাজার টাকার অনেক বেশী। সে টাকা দিলে যদি—”
বাধা দিয়ে ডেপুটি বললেন—”না, না, বিশ—হাজার টাকা কম নয়! সারা জীবন খেটে চাকরি করে বিশ—হাজার জমাতে পারবো কি—না, ভগবান জানেন! আর একটা হুমকিতে—দিন না মশায়, আমাকে বিশ—হাজার টাকা, আমি আমার এই কামরায় আপনার ছেলের পাহারাদারী করবো’খন চব্বিশ ঘণ্টা!”
কথাটা বলে তিনি উচ্চ হাস্য করলেন।
শিখা বললে—”সেই কথামালায় পড়েছিলুম, একজন লোককে কুকুরে কামড়েছিল। তাতে তার বন্ধু বলেছিল—ঐ রক্তে মাংস ভিজিয়ে কুকুরটাকে খেতে দাও, সেরে যাবে। সে—কথায় লোকটা বলেছিল—ক্ষেপেছো! তাহলে আমার রক্ত—মাখানো মাংস খাবার লোভে রাজ্যের কুকুর এসে আমাকে কামড়ে শেষ করে দেবে!”
পাঁচ – কাত্যায়নী দেবী
নন্দবাবুর বাড়ী বালিগঞ্জ প্লেসে। ঢাকুরিয়া রেল—লাইনের গা—ঘেঁষে মস্ত কম্পাউণ্ড। ফটক থেকে অর্দ্ধচন্দ্রাকারে পথ গিয়েছে বাড়ীর গাড়ী—বারান্দায়। এ—পথের মাঝখানে ফুলের বাগান—অযত্নে আগাছায় ভরে আছে। বাড়ীর দু—দিকে ফলের বাগান, পিছন—দিকে চাকর—বাকরদের ঘর, তার পরেই পাঁচিল, পাঁচিলের ও—দিকে রেল—লাইন।
বাড়ী আসতেই এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক এসে সামনে দাঁড়ালেন। নন্দবাবু তাঁকে প্রশ্ন করলেন—”অফিসে যাননি?”
ভদ্রলোক বললেন—”না। মা বললেন, আপনি না—আসা পর্য্যন্ত অপেক্ষা করতে।”
নন্দবাবু যেন একটু বিরক্ত হলেন। বললেন—”কিন্তু আজ সে বড় অর্ডারটা পাঠানো দরকার—আপনি না গেলে তার কি হবে?”
ভদ্রলোক বললেন—”আমি সব ঠিক করে রেখেছি। দশটা বাজতেই অফিসে ফোন করে দিয়েছি সারদাকে—বলেছি, সে যেন মাল রেডি রাখে, আমি গিয়েই চালান সহি করে পাঠিয়ে দেবো।”
নন্দবাবু বললেন—”আমি তো এসেছি! আপনাদের গিন্নীমাকে বলে তাঁর হুকুম নিয়ে এখন বেরিয়ে পড়বার ব্যবস্থা করুন।”
”যে আজ্ঞে!” বলে ভদ্রলোক তখনি অন্দরের দিকে গেলেন।
নন্দবাবু তখন বিমলেন্দু এবং শিখাকে নিয়ে অফিস—কামরায় ঢুকলেন। বড় ঘর। মাঝখানে বড় একটা সেক্রেটারিয়েট টেবিল। টেবিলের ও—পাশে একখানা হাইব্যাক চেয়ার, টেবিলের এদিকে দুখানা চেয়ার। তাছাড়া দেয়ালের ধারে আরো ক’খানা চেয়ার। টেবিলের উপর টেলিফোন। ক’টা সেলফ আছে—সেলফের উপরে একরাশ মোটা খাতা। খাতাগুলোর গায়ে লাল ফিতা—বাঁধা টিকিট ঝুলছে—টিকিটে বছরের সংখ্যা লেখা।
তিনজনে বসলেন। বিমলেন্দু বললে—”বাড়ীর মধ্যে খবর দিন, মিস্—রায় গিয়ে আপনার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করবেন!”
”হ্যাঁ, ব্যবস্থা করছি।” এ—কথা বলে নন্দবাবু ডাকলেন—”ভজা।”
সঙ্গে সঙ্গে একজন ভৃত্য এসে সামনে দাঁড়াল।
নন্দবাবু তাকে বললেন—”তোর মা—ঠাকরুণকে খবর দে, লালবাজার থেকে ডেপুটি—সাহেব একজন মেয়েছেলেকে পাঠিয়েছেন। তিনি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চান। দেরী করা চলবে না। ওঁরা সরকারী লোক। অনেক কাজ ওঁদের।”
আদেশ পেয়ে ভজা চলে গেল।
বিমলেন্দু বললে—”প্রথমে যে ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হল, উনি কে?”
”ও, শশধরবাবুর কথা বলছেন! অফিসে উনিই সব। আমি শুধু নামেই বাবু! আমার শ্বশুরের আমলের লোক—কি একটা সম্পর্কও নাকি আছে! ওঁর নাম শশধর মিত্তির। আমার শ্বশুরের ব্যবসা সুরু হওয়ার সময় থেকে উনি আছেন। ওঁর স্ত্রী, ছেলে—মেয়ে—এই বাড়ীতেই সব থাকে। বাড়ীর মধ্যে একতলার একটা দিক ওদের জন্য রিজার্ভ করা একেবারে!”
কথাগুলা শিখার যেন কেমন লাগল। ভদ্রলোকের উপরে নন্দবাবুর একটু যেন বিরাগ আর আক্রোশ! মনে হলো, উনি জামাই হলেও অফিসে এই শশধরবাবুই সব! কাজেই এ—আক্রোশ স্বাভাবিক!
বিমলেন্দু বললে—”এ—ভদ্রলোক চিঠির কথা জানেন?”
”নিশ্চয়। আমার স্ত্রী ওঁকে ভয়ানক মানেন। ওঁকে কাকা বলেন। আজ সকালে তিনিই ওঁকে বলেছেন।”
”শুনে উনি কি বললেন?”
”উনি বললেন, ছেলেকে নিয়ে কোথায় যাবে মা? কত কাল বাইরে থাকবে? বদমায়েসরা যদি পেছনে লেগে থাকে, তাহলে কি মনে কর, চট করে ছেড়ে দেবে? দু—বছর পাঁচ—বছর এমনি লেগে থাকতে পারে তো!”
শিখা বলে উঠলো—”ঠিক কথা। আমারো তাই মনে হয়েছে। আপনার স্ত্রীকে আমিও ঠিক এই কথা বলবো, ঠিক করেছি। কিন্তু আপনার ছেলেটি কোথায়? তাকে তো দেখতে পাচ্ছি না!”
নন্দবাবু বললেন—”তাকে দোতলা থেকে একতলাতে আর নামতে দিচ্ছি না! দোতলায় বড় বারান্দা আছে, ছাদ আছে—সেইখানে সে খেলা করে।”
বিমলেন্দু বললে—”শশধরবাবু ছাড়া বাড়ীর আর কেউ জানে চিঠির কথা?”
নন্দবাবু বললেন—”আমি কাকেও বলিনি, তবে আমার স্ত্রী যদি বলে থাকেন! মানে, বোঝেন তো, মেয়েদের পয়সার জোর থাকলে তাঁরা নিজেদের বুদ্ধিকে খুব বড় করে দেখেন! আমার স্ত্রী ভয়ানক জেদী। তার কারণ, বাপের এক মেয়ে, আদর পেয়েছেন খুব—আর টাকা—কড়ি সব ওঁর হাতে।”
শিখা একাগ্র—দৃষ্টিতে চেয়ে আছে নন্দবাবুর দিকে। তার মনে হলো, কর্ত্তাগিন্নীতে তেমন মনের মিল নেই হয়তো!
এই সময় ভজা ফিরে এসে বললে—”মা বললেন এঁকে নিয়ে যেতে।”
”বেশ। তাহলে আপনি এর সঙ্গে—” বলে নন্দবাবু তাকালেন শিখার দিকে।
শিখা উঠে ভজার সঙ্গে অন্দরের দিকে গেল।
নন্দবাবুর স্ত্রী কাত্যায়নী দেবী রূপসী নন। মোটা—সোটা মানুষ, রঙ ময়লা, গায়ে অনেক গহনা, হাতে ভারী—ভারী ক’গাছা চুড়ি, কানে সোনার মাকড়ি, নাকে দুটো বড় মুক্তা—দেওয়া নথ। দোতলার বারান্দায় একটি চেয়ারে বসে আছেন, মাথার চুল এলানো, একজন দাসী ঘষে—ঘষে মাথায় তেল মাখাচ্ছে। তাঁর স্নানের উদ্যোগ চলছে।
শিখাকে দেখে তিনি চমকে উঠলেন! বললেন—”ওমা, তুমি তো দেখছি বাচ্ছা মেয়ে! তা এমন ফুটফুটে চেহারা, এই বয়স—পুলিশে চাকরি করতে ঢুকেছ কেন? এ কি দুর্বুদ্ধি! তা যাই হোক, বসো, বসো।” বলে সামনের চেয়ার দেখিয়ে দিলেন।
লজ্জায় শিখার মুখখানা লাল হয়ে উঠলো। সে চেয়ারে বসে বললে—”আমি পুলিশে চাকরি করি না। এমনি সখ—পুলিশের সঙ্গে দু—একটা কাজ করি। আমি কলেজে পড়ি।”
”ওমা! তাই নাকি? তা বিয়ে হয়েছে?”
সলজ্জভাবে শিখা বললে—”না।”
”মা—বাপ আছেন?”
শিখা বললে—”মা আছেন। বাবা মারা গেছেন—আমি তখন খুব ছোট।”
”আর কে আছেন? ভাই—বোন ক’টি?”
শিখা বললে—”ভাই—বোন নেই। কাকা আছেন, কাকীমা আছেন। তাঁদেরও ছেলে—মেয়ে নেই। আমার কাকা মিলিটারীতে কাজ করতেন। তাঁর নাম মেজর অতুলকৃষ্ণ রায়।”
”বড় ঘরের মেয়ে! তা, ধন্যি সখ মা, তোমার! এমন সুন্দরী, বড়লোকের মেয়ে, কোথায় বিয়ে—থা করে ঘর—সংসার করবে, তা নয়—”
এ—কথা চাপা দেবার অভিপ্রায়ে শিখা বললে—”এ—সব কথা থাক! যেজন্য আমি এসেছি, চিঠি আপনি দেখেছেন তো! আপনার কি মনে হয়, কে এমন শত্রু থাকতে পারে?”
বাধা দিয়ে কাত্যায়নী দেবী বললেন—”শত্তুরের কি অভাব আছে, মা! বড় হলে কত লোকের চোখ টাটায়! আমার ঐ একটি মাত্র ছেলে—আমার সব। মরে—হেজে ঐ একটু সম্বল মা, শুধু ভগবানের দয়ায়! তার উপর এ কি নজর, বলো তো মা! আমি বলছিলুম, ছেলেকে নিয়ে কোথাও চলে যাই। তা কাকা বারণ করলেন। বললেন, কতকাল বাইরে—বাইরে থাকবে? দু—বছর পাঁচ—বছর পরে ফিরতে হবে তো! তখন আবার যদি এমন—”
শিখা বললে—”আমিও ঠিক সেই কথাই বলতে এসেছি আপনাকে। পুলিশে যখন খবর গেছে তখন আর আপনার ভয় কি? ছেলেকে শুধু সাবধানে রাখবেন। ২১ তারিখের কথা বলেছে তো! পুলিশের ডেপুটি—সাহেব বলেছেন, তিনি নিজে ঐ তারিখে অনেক লোকজন নিয়ে এখানে এসে ছেলের পাহারাদারী করবেন। টাকা আপনি পাঠাবেন না তো?”
”না, না। টাকা পাঠাবো কি! উনি বলেন, দাও না হয় টাকা! আমি বলি, ককখনো না! দায়ে পড়ে হাত পেতে চাইতো, তাহলে না হয় বিবেচনা করতুম। তা নয়, হুমকি দিয়ে টাকা নেবে! তাও যা—তা হুমকি নয়, বলে, ছেলে চুরি করবে! আস্পর্দ্ধার কথা শোনো একবার! ওঁর কি—এ—টাকা তো ওঁকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোজগার করতে হয়নি! টাকার দাম উনি কি জানবেন! তাই উনি বলেন টাকা দিয়ে দাও।”
”আপনি বললেন—শত্তুর থাকা সম্ভব। তাই জিজ্ঞাসা করি, কাকেও সন্দেহ হয় আপনার?”
”তা যদি বলো বাছা, আমার সন্দ হয় সক্কলকে! টাকা—টাকা করেই মানুষ যেন পাগল! তা খেটেখুটে টাকা রোজগার কর, বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করে টাকা রোজগার কর, তা নয়, রাহাজানি করে? যুদ্ধ হয়ে কি যে হয়ে গেল সব! তাই ভাবি, চুরি—চামারি করতে বাধে না কারো! যে করে কাজ—কারবার চলেছে, আমি নেহাৎ শক্ত বলেই না—”
এই কথা শুনেই শিখার মনের কৌতূহল আরো বেড়ে গেল। শিখা বললে—”আপনার স্বামী তো সব কাজ—কারবার দেখেন?”
”স্বামী! স্বামীর মান রাখতে হয়, মা! নাহলে, ওঁর বিষয়—বুদ্ধি—”
এই পর্য্যন্ত বলে তিনি তাকালেন দাসীর দিকে, বললেন—”পঞ্চী, তুই একবার যা তো, খোকাকে নিয়ে আয়।”
পঞ্চী দাসী চলে গেল।
কাত্যায়নী দেবী তখন চারিদিকে চেয়ে বললেন—”উনি যদি তেমন হতেন, ভাবনা ছিল কি! সব—তাতে ভয় পান। কাজ—কারবার দেখা বলতে বাবার আমলের লোক আছেন—শশধর মিত্তির—আমি কাকা বলি। তিনিই সব। যে যা বলে, উনি তাতে মেতে ওঠেন। কাকা মানা করেন, আমি মানা করি—বলি, যা নিয়ে চিরকাল চলছে, তাতে যখন টাকা আসছে, সেই ভালো। নতুন কারবারে—বিশেষ যার কিছু জানি না, তা নিয়ে ছিনিমিনি খেলা ঠিক নয়! শেষে অতি—লোভে সব যাবে!—হ্যাঁ, যা বলছিলাম, উনি তো চিঠি পেয়ে ভয়ে কাঁটা! বলেন, টাকাটা দিয়ে দাও, নির্ঝঞ্ঝাট হবো ছেলের সম্বন্ধে। আমি বলি, না, দেশে কি পুলিশ নেই? তাছাড়া কলকাতা সহর! পথ থেকে নয়, বাড়ী থেকে ছেলে নিয়ে যাবে? এ কি একটা কথা! আমিই তো ঠেলেঠুলে ওঁকে পুলিশে পাঠালুম। উনি ভয়ে একেবারে যেন চোর!”
কথায়—কথায় শিখা যা জানলো, ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যাপারে কাত্যায়নী দেবী পরামর্শ নেন শশধরবাবুর। বাড়ীর চাকর—বাকরদের সম্বন্ধে তিনি বললেন, সন্দেহ যদি কাকেও হয় তো, কর্ত্তার খানসামা ঐ ভজাকে! ভয়ানক বাবু হয়ে উঠেছে! এত তার চাল কিসের—করিস তো চাকরের কাজ! ওঁর প্রশ্রয় শুধু!
কাত্যায়নী দেবীকে আশ্বাস দিয়ে শিখা বাহিরে এলো।
বিমলেন্দু ততক্ষণে বাড়ী—বাগান—ঘর সব দেখে এসেছে। শুধু দেখা নয়, নক্সা এঁকে নিয়েছে, বেশ পুঙ্খানুপুঙ্খ রকমে।
বেলা বারোটা বাজলে বিমলেন্দু বললে—”আসি তাহলে এখন? আপনাদের শশধরবাবু অফিসে গেছেন?”
”হ্যাঁ।”
”আচ্ছা নন্দবাবু, ওঁকে কি আপনার সন্দেহ হয়?”
ললাট কুঞ্চিত করে নন্দবাবু বললেন—”কোন দিন হয়নি। তবে তিন—তিনখানা চিঠি পেয়ে—বলতে কি, সকলকেই এখন সন্দেহ হচ্ছে!”
”ছেলেকে যেমন সাবধানে রেখেছেন, তেমনি রাখুন। তারপর দেখা যাক, এখনো ক’দিন সময় আছে তো! আমরা সকলেই ওয়াচ করি। এ ছাড়া এখন করবার কিছু নেই যখন—”
ছয় – অঘটন
তারপর পরামর্শে ঠিক হলো, নন্দবাবু বাড়ীতে আর অফিসে লোকজনদের উপর নজর রাখবেন; শিখা রোজ একবার করে ওঁর বাড়ীতে গিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে আসবে—অমনি বাড়ীর চারিদিক ঘুরে দেখে—শুনে আসা—যদি ঘুণাক্ষরে কোন হদিশ মেলে! বিমলেন্দু দু—চারবার করে ছদ্মবেশে ও—তল্লাটে পায়চারি করে দেখবে।
এমনি ভাবেই চললো ক’দিন। তারপর এসে গেল সেই বাইশে জুন। পুলিশের উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করেই টাকা দেওয়া হয়নি চণ্ডী ঠাকুরকে। বাইশ তারিখের সকালে নন্দবাবু আবার একখানা চিঠি পেলেন! এ—চিঠিতে লেখা—
নন্দ সিঙ্গি!
তুমি যদি ভেবে থাক যে পুলিশের সাহায্য নিয়ে আমাদের উদ্দেশ্য ব্যর্থ করতে পারবে, তাহলে মহাভুল করবে তুমি। এখনও সময় আছে। আজ সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে যদি আমাদের নির্দ্দেশমত টাকা তুমি না দাও তাহলে তোমার ছেলেকে আমরা অপহরণ করবো। শত পুলিশের সাহায্য নিয়েও তুমি আমাদের বাধা দিতে পারবে না।
এই শেষবার তোমাকে চিঠি লেখা হচ্ছে। আশা করি আমাদের নির্দ্দেশ তুমি পালন করবে। মনে রেখো, আমাদের নির্দ্দেশ অবহেলা করলে আজই রাত্রি বারোটার মধ্যে তুমি তোমার ছেলেকে হারাবে।
চিঠিখানা পেয়েই নন্দবাবু সোজা লালবাজারে চলে গেলেন।
ডেপুটি কমিশনারের ঘরে যেতেই বিমলেন্দুর সঙ্গেও দেখা হয়ে গেল তাঁর। বিমলেন্দু তখন সেখানেই ছিল। চিঠি দেখে তাঁরা যেন পাথর বনে গেলেন! এমন স্পর্দ্ধা! কি করে এ—কথা বলে! মন্ত্র জানে না কি?
নন্দবাবুর অবস্থা তখন প্রায় পাগলের মত! তিনি বললেন—”এ—চিঠি আমার স্ত্রীকে দেখিয়েছি! তাঁকে অনেক করে বুঝিয়ে বললুম, এত বড় বিপদ মাথায় নিয়ে বসে থেকে কাজ নেই, তার চেয়ে বরং দাও টাকাগুলো ফেলে! কিন্তু তিনি ভয়ানক জেদী। তিনি বলেন—না তা হবে না! লালবাজার থেকে ওঁরা যে—ব্যবস্থা করেছেন, সে—ব্যবস্থায় আমার বিশ্বাস আছে। দেখি, ওঁরা কি করেন!”
এই পর্য্যন্ত বলে নন্দবাবু মস্ত একটা নিশ্বাস ফেললেন!
ডেপুটি বললেন—”ঠিক আছে। বালিগঞ্জ থানার অফিসারকে বলা আছে, তিনি একদল পুলিশ নিয়ে সন্ধ্যা সাতটায় ওখানে হাজির হবেন। পুলিশ যা থাকবে, উর্দ্দিপরা নয়, প্লেন পোশাকপরা, পাড়ার কোন লোক পুলিশ বলে তাদের সন্দেহই করতে পারবে না। তারপর রাত এগারোটায় বিমল যাবে আর বিমলের সঙ্গে যাবে আর—একজন অফিসার সমর সেন। এছাড়া রাত ন’টা নাগাদ মিস্ রায় যাবেন—তিনি থাকবেন আপনার স্ত্রীর কাছে!”
নন্দবাবু কেমন ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছেন—সব কথা শুনলেন! তিনি বললেন—”আমি ঠিক করেছি, চাকরগুলোকে আজ বার করে দেব, কোন ছুতোয়! কে জানে, কারো সঙ্গে যদি ওদের ষড় থাকে!”
ডেপুটি বললেন—”না, না, অমন কাজও করবেন না। দেখছেন না, এরা সময় সম্বন্ধেও নোটিশ দিয়েছে—রাত বারোটা, তার আগেও নয়, পরেও নয়! তাহলে ঐ বারোটা বাজবার সময় আমাদের সতর্ক থাকলেই হবে। তাছাড়া আপনার ছেলে যে—ঘরে ঘুমোবে, আমরা সে—ঘরেও কড়া পাহারার ব্যবস্থা করবো। এত কড়া পাহারার মধ্যে থাকবে, কোথা দিয়ে ওরা নিয়ে যাবে? আপনি নিশ্চিন্ত মনে চলে যান, এ বিষয় কিছু ভাবতে হবে না আপনাকে!”
নন্দবাবু বাড়ী ফিরলেন, ফিরেই শোনেন, তাঁর স্ত্রীর অসুখ! সকাল থেকে ভেদ—বমি হচ্ছে। অবসন্নের মত বিছানায় শুয়ে আছেন। দোতলার দক্ষিণদিকে তাঁর ঘর—সেই ঘরে। বাড়ীর ডাক্তার ধর্ম্মদাসবাবুকে ফোন করা হয়েছিল। তিনি এসে দেখে ঔষধ দিয়ে গেছেন, আবার বেলা বারোটায় আসবেন বলে গেছেন।
খবর শুনে নন্দবাবুর দু—চোখ যেন কপালে উঠলো! সর্ব্বনাশ! বেছে বেছে ঠিক এই দিনটিতেই ওঁর এমন শক্ত রোগ! কোন দিক সামলাবেন? শশধরবাবু অফিসে যাননি—তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন—”ভয়ের কিছু নেই তো? ধর্ম্মদাসবাবু কি বললেন?”
”বললেন, খাওয়ার গোলযোগ। ফুড—পয়জনিং হয়তো!”
”ফুড—পয়জনিং! কিন্তু তা কি করে হবে? আমরা সকলেই এক খাবার খেয়েছি রাত্রে!”
এই বলে একটা নিশ্বাস ফেলে তিনি আবার বললেন—”কলেরা নয় তো?”
শশধরবাবু বললেন—”না, কলেরা নয়। তবে ডাক্তারবাবু বলে গেলেন যে, রোগটি সহজ নয়! তিনি একজন নার্স পাঠিয়ে দেবেন, একথাও বলে গেছেন!”
”নার্স! কেন ওঁর যে দাসী আছে—পঞ্চী?”
”গিন্নী মা বললেন, সে খোকাকে নিয়ে থাকবে।”
ওঁদের মধ্যে যখন এইসব কথাবার্তা হচ্ছে, ঠিক সেই সময় শিখা এসে উপস্থিত হলো সেখানে।
শিখাকে দেখে নন্দবাবু হতাশায় ভেঙ্গে পড়লেন, বললেন—”আবার এক বিপদ! আমার স্ত্রীর খুব অসুখ। সিরিয়াস টাইপের ডায়েরিয়া!”
শিখা চমকে উঠলো! বললে—”ডায়েরিয়া! ডাক্তার এসেছিলেন?”
শশধরবাবু জবাব দিলেন—”হ্যাঁ। দেখে ওষুধ দিয়ে গেছেন।”
শিখার দু—চোখে রীতিমত উদ্বেগ!
নন্দবাবু বললেন—”আমি আর অফিসে যাবো না শশধরবাবু, বাড়ীতেই থাকব। আপনি বেরিয়ে পড়ুন। আমার মনের যে—রকম অবস্থা—”
শশধরবাবু বললেন—”হ্যাঁ, আপনি বাড়ীতেই থাকুন।”
শিখা বললে—”আমি একবার দেখতে যেতে পারি ওঁকে?”
শশধরবাবু বললেন—”হ্যাঁ, যান। তবে ঘুমোচ্ছেন, বোধ হয়।”
শিখা বললে—”আমি একবার শুধু দেখে আসবো। হ্যাঁ ভাল কথা, ছেলে কোথায়?”
”খেতে বসেছে বোধ হয়।”
”কোথায়? নীচে?”
”না।” শশধরবাবু বললেন—”ওঁর ঘরের পাশে যে—ঘর, সেই ঘরে! সেখানে ঝি আছে, বামুন—ঠাকুর আছে—তারাই খাওয়াচ্ছে।”
ভজা এসে খবর দিলে—”ডাক্তারবাবু যে নার্স পাঠিয়েছেন, তিনি এসেছেন।”
নন্দবাবু আর শশধরবাবু চললেন নার্সের কাছে।
সাত – ঘরোয়া খবর
কাত্যায়নী দেবীর ঘরে উঁকি দিয়ে শিখা দেখলো, চুপচাপ! ঘুমোচ্ছেন, মনে হয়। পাশের ঘরে খোকার গলা শোনা গেল। শিখা সেই ঘরে এলো। খোকা খাচ্ছে—আসনে বসে খাচ্ছে। তাকে খাওয়াচ্ছে বাড়ীর বামুন—ঠাকুর। তারা নামে একজন দাসীও আছে সেখানে। বামুন গল্প বলতে বলতে খাওয়াচ্ছে। খোকা ব্রজদুলাল গল্প শুনছে আর খাচ্ছে।
খোকাকে শিখা এই প্রথম দেখল। এ ক’দিন এসেছে গেছে—খোকাকে দেখেনি—দেখবার ইচ্ছাও প্রকাশ করেনি। এসে দাসী তারা আর গৃহিণীর সঙ্গে নানা কথা কয়েছে, বেশ কৌশলে। নানা প্রশ্ন করে কর্ত্তা—গৃহিণী, চাকর—বাকর সকলের পরিচয় যতখানি সম্ভব, সংগ্রহ করেছে। আর ঘুরে ঘুরে বাড়ীর চারিধার, বাগান—সব দেখেছে।
শশধরবাবুর দিকটায় শশধরবাবু নিজে থাকেন। তাঁর পরিচয় নিয়েছে—স্ত্রী বাতে পঙ্গু—নড়তে—চড়তে পারেন না। শশধরবাবুর একটি ছেলে, একটি মেয়ে। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। শ্বশুর—বাড়ী খিদিরপুরে, সেইখানে আছে। মাঝে—মাঝে আসে; দুদিন থাকে আবার শ্বশুর—বাড়ী চলে যায়। ছেলে বড়—বি—এ পড়ছে। তার বিয়ে হয়নি। একটি দাসী আছে, অন্নদা; আর একজন বামুন—রান্না—বান্না করে। শশধরবাবু মানুষটির বিলাস নেই, কোন রকম চাল নেই—কাত্যায়নী দেবীর বাপের আমল থেকেই বিনীত অনুগৃহীতের মত আছেন। কাত্যায়নী দেবীকে নিজের মেয়ের মত দেখেন। এদের উপর যেমন মায়া—মমতা, কারবারের উপরেও ঠিক তেমনি। শশধরবাবুর স্ত্রীও মানুষ মন্দ নন। তাঁর সঙ্গে আলাপ করে এ ক’দিনে শিখা জেনেছে,—কাত্যায়নী দেবী একটু মেজাজী। স্বামীর উপর অভক্তি বা অশ্রদ্ধা নেই, অবনিবনাও নেই। তবে কোন ব্যাপারে দুজনের যদি মতের অমিল হয়, তাহলে কতকটা জেদ করেই কাত্যায়নী দেবী নিজের মত বজায় রাখেন। নন্দবাবু হাজার হোক—শশধরবাবুর স্ত্রী বলেন—কাত্যায়নী দেবীর বাপের কারবারে মাইনে—করা কেরাণী ছিল, কাজেই তাকে স্বামী বলে মেনে নিলেও আর পাঁচজন মেয়ের মত ঠিক স্বামীর মর্যাদা দিতে পারেননি। শিখা জিজ্ঞাসা করেছিল—দুজনে ছেলেকে নিয়ে সন্ধ্যার দিকে বেড়াতে বেরোন কি না, যেমন বড়লোকদের বাড়ীতে সাধারণতঃ হয়? তাতে শশধরবাবুর স্ত্রী বলেন—গিন্নী মাঝে মাঝে বেরোন ছেলেকে নিয়ে। নন্দবাবু অফিস থেকে ফিরে এসে কাপড়—চোপড় ছেড়ে কে ওঁর গুরু আছে বেহালার দিকে, সেইখানে যান। সেখানে কি নাকি সাধন—ভজন হয়। সেখান থেকে ফেরেন কোনোদিন রাত সাড়ে দশটায়, কোনোদিন এগারোটায়। সাড়ে দশটার আগে নয়। ট্রামে—বাসে যান, বাড়ীর মোটরে নয়। অকারণে মোটর চালিয়ে পেট্রোল খরচ, কাত্যায়নী দেবী তা দিতে রাজী নন। অর্থাৎ টাকাকড়ি সব কাত্যায়নী দেবীর হাতে। নন্দবাবু পান হাতখরচার জন্য মাসে তিনশো করে টাকা। এ ব্যবস্থা কর্ত্তা অর্থাৎ কাত্যায়নী দেবীর বাবাই করে গিয়েছেন।
এ সব পরিচয় পেয়ে শিখা ভাবে,—কত রকমেরই হয় মানুষের মন! এই কাত্যায়নী দেবী—সংসারে স্বামী আর ঐ এক ছেলে। তবু স্বামীর এই ট্রামে—বাসে যাতায়াতের কষ্ট তাঁর মনে এতটুকু দাগ টানে না! অথচ নিজেও সৌখীন নন। এ যুগের বড় মানুষের মেয়েদের মত বিলাস—প্রসাধন নেই, সৌখিনতা নেই। চাল—চলনে, কথাবার্তায় মনে হয়, যেন সেই পঞ্চাশ বছর আগেকার বড়লোকের বাড়ীর গৃহিণী। ক’টা ছেলেমেয়ে রোগে মারা গিয়ে এখন এই একটি আছে। বড়লোকের বাড়ীতে ছেলেকে মা যেমন আদরে—সোহাগে নাড়াচাড়া করে, তার প্রতিটি বায়না মিটিয়ে তাকে চরিতার্থ দেখে নিজে চরিতার্থ হয়, এখানে তা নয়। ছেলের হাতে, গলায় শুধু একরাশ মাদুলি আর তাগা। পোশাক—আশাকে বাহুল্য নেই। ছেলের পরণে হাফপ্যাণ্ট আর গায়ে একটা সাদা লংক্লথের হাফসার্ট।
পাচক বাঙালী। সে তখন গল্প বলছে—
”তারপর শেয়াল খুব রেগে বললে—আমার টোপর দিবি তো দে, নাহলে তোর কনেকে দে! বরের খুব ভয় হলো। শেয়াল ক্ষেপেছে! ক্ষ্যাপা শেয়াল যদি আঁচড়ে—কামড়ে দেয়? আঃ, নাও, নাও বাবু…ও গালটা খেয়ে নাও, মুখে করে বসে রইলে কেন? তাহলে আর গল্প বলবো না আমি।”
খোকা তখন নতুন মানুষ শিখাকে দেখে তার পানে চেয়ে আছে, মুখের মধ্যে ভাতের গ্রাস।
শিখা দেখল,—ছেলেটি বেশ কাহিল—পানা। দু—চোখে স্বাভাবিক দৃষ্টি। শিখা তার দিকে চেয়ে হাসলো, বললে—”খাও খোকা, ঠাকুর না হলে গল্প বলবে না।”
হঠাৎ ও—ঘর থেকে গিন্নী ডাকলেন—”তারা।”
এ—ঘর থেকে দাসীটি বলে উঠলো—”কেন মা?”
কাত্যায়নী দেবী বললেন—”কে কথা কইছে রে?”
তারা তাকালো শিখার দিকে, বললে—”শিখা দিদি এসেছেন।”
শিখা তখনি গেল কাত্যায়নী দেবীর ঘরে। বললে—”কেমন আছেন এখন?”
”ভালো নয়, মা! সারা শরীর যেন গুলিয়ে—গুলিয়ে উঠছে, মাথা তুলতে পারছি না—কেবলি ঘুম পাচ্ছে। অথচ ঘুমই বা কতক্ষণ! দ্যাখো দিকিনি, আজকের রাত্তিরে ভয়, আর—”
বাধা দিয়ে শিখা বললে—”না, না, কোন ভয় নেই! আমরা সকলে আছি—ফুসমন্তরে ছেলেকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে না তো! তুলো নয়, কাগজ নয়—সুস্থ ছেলে!”
”কে জানে, মা! ডাকাত হয়ে আসে দিদি?”
”তার ব্যবস্থা পুলিশ করেছে। আপনি ভাববেন না। ঘুমোন একটু।”
”ঘুম হচ্ছে কৈ! আবার চোখ চেয়েও থাকতে পারছি না। তাই—”
শিখা বললে—”আপনার নার্স এসেছেন। আপনি ঘুমোন, আমি ও—ঘরে যাচ্ছি খোকার কাছে।”
বেলা বারোটায় ডাক্তার এলেন। শিখা তাঁর জন্যই অপেক্ষা করছে। ডাক্তার এসে রোগী দেখলেন—ব্যবস্থা হলো, পরামর্শ দিলেন। তারপর বারান্দায় নন্দবাবুর সঙ্গে কথা—”ফুড—পয়জনিং, তাতে কোন সন্দেহ নেই। এই যে অবসন্ন ভাব, এ একটা মস্ত বড় লক্ষণ। কেউ মতলব করেই কিছু খাইয়েছে। অবশ্য ডোজ বেশী দিতে সাহস করেনি, কিংবা বেশী ডোজ হয়তো পায়নি! যাক, ভেদ—বমিতে বিষটা বেরিয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। নাড়ী স্বাভাবিক হয়ে আসছে। সুস্থ হতে দু—তিন দিন লাগবে। শুধু বিশ্রাম চাই এখন—নিশ্চিন্ত বিশ্রাম।”
ডাক্তার চলে গেলেন। শিখা দেখল, নন্দবাবুর মুখ যেন কাগজের মত সাদা। মনে হলো, একে অত বড় খাঁড়া ঝুলছে মাথায়—তার উপর স্ত্রীর এই অবস্থা। বিষ? মতলব করে? ভাগ্যে অল্প ডোজ—
শিখা বললে—”আমি এখন যাই। সন্ধ্যা নাগাদ আবার আসবো।”
নন্দবাবু কোনমতে বললেন—”ওঁ—হ্যাঁ।”
শিখা যাবার জন্য উদ্যত, নার্স এসে বললে—”আপনাকে উনি ডাকছেন।”
শিখা এলো কাত্যায়নী দেবীর কাছে। কাত্যায়নী বললেন—”সকাল সকাল এসো মা। আজ রাত্রে এ—বাড়ীতেই খাওয়া—দাওয়া করবে। বাড়ীতে বলে এসো।”
শিখা বললে—”না, না, সেজন্য ব্যস্ত হবেন না। আপনি সুস্থ থাকতেন, তাহলে খাওয়া—দাওয়া হতে পারত। আপনার অসুখ—খাবার উপদ্রব আর করা কেন? আপনি সেজন্য মনে মনে অধীর থাকবেন তো! আমি সন্ধ্যার সময় আসবো—তারপর একবার বাড়ী গিয়ে খেয়ে আসবো।”
এ—কথা বলে শিখা চলে গেল। কাত্যায়নী দেবী আবার পাশ ফিরে চোখ বুজলেন।
আট – দুর্লক্ষণ
সন্ধ্যার সময় শিখা আবার এল নন্দবাবুর বাড়ীতে। কাত্যায়নী দেবীর খবর নিয়ে জানল—তাঁর শরীরে আর কোন উপসর্গ ঘটেনি। তবে খুব ঘুমোচ্ছেন। অঘোরে ঘুম। এক একবার চমকে জেগে ওঠেন—জেগেই বলেন—”খোকা?” খোকাকে পাশের ঘর থেকে তার দাসী নিয়ে আসে। কাত্যায়নী দেবী ছেলেকে দেখেন, দেখেই আবার ঘুমিয়ে পড়েন।
ডাক্তার একবার এসে দেখে গেছেন। কাত্যায়নী দেবী ঘুমোচ্ছেন দেখে শুধু নাড়ী টিপে বলে গেছেন—”পালস বেশ ইমপ্রুভ করছে।”
নার্স সকাল থেকেই রয়েছে। এ—নার্স যাবে রাত দশটায়—তারপর আসবে নতুন নার্স। নতুন নার্সের নাম জয়ন্তী। এ পাড়ায় থাকে, আগেও দু—একবার এ বাড়ীতে কাজ করেছে। গৃহিণীর অসুখের খবর পেয়ে নিজে এসে নন্দবাবুর সঙ্গে, শশধরবাবুর সঙ্গে দেখা করে বলে গেছে—সে থাকতে নতুন নার্স আসতে দেবে না, রাতের কাজ সে করবে। টাকা না দেন, না দেবেন। এ কথায় তাকে না রেখে উপায় নেই! তাছাড়া মেয়েটি বড় ভালো—যত্ন জানে। এ—বাড়ীর সঙ্গে পরিচয় আছে—বেশ বাড়ীর মেয়ের মত নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে।
শিখা আসবার আগে বিমলেন্দুকে সে বলেছে—”আপনার পপি কুকুরকে নিয়ে যাবেন, বিমলদা। স্কটল্যাণ্ড—ইয়ার্ডে তার জন্ম—আপনি বলেন, আপনার পপির ক্ষমতা নাকি ভয়ানক আশ্চর্য্য রকম!”
বিমলেন্দু এ কথায় একটু রাগ করেই জবাব দিয়েছে—”না জেনে ঠাট্টা করা মেয়েদের স্বভাব! সকলে যে বলে, মেয়েদের হিংসা খুব বেশী, এবং সে হিংসা সব বিষয়ে—সে কথা ভয়ানক সত্য।”
শিখা এসে দোতলায় খোকার ঘরে আশ্রয় নিয়েছে। খোকার ঝি তারা নেই। তারার নাকি দেশ থেকে টেলিগ্রাম এসেছিল বিকেল চারটের সময়—তারার ডাগর ছেলেকে সাপে কামড়েছে বলে! এ টেলিগ্রাম পেয়ে সে তখনি চলে গেছে। তার দেশ উলুবেড়েয়—সে সেখানেই গেছে। খোকাকে চৌকিদারী করছে এখন পঞ্চী—কাত্যায়নী দেবীর খাস দাসী।
শিখা ভাবল, এ কি ব্যাপার! আজই ঝির বাড়ী থেকে এলো টেলিগ্রাম! যাই হোক, দেখা যাক শেষ পর্য্যন্ত কি হয়! শশধরবাবুকে এক সময়ে শিখা জিজ্ঞাসা করল—”নন্দবাবু বেহালায় যাবেন না? শুনেছি সেখানে ওঁর কে গুরু আছেন, সাধন—ভজন হয়।”
শশধর বললেন—”না। বলছিলেন, আজ আর বেহালায় যাবো না।”
”নন্দবাবু কোথায়?”
”তিনি চঞ্চল হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কখনো নীচে অফিস—কামরায় বসছেন, কখনো দোতলায় কাতু—মার ঘরে, কখনো খোকার ঘরে, আবার কখনো ছাদে গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন। দশ—পনেরো মিনিট ছাদে থেকে নীচে কম্পাউণ্ডে উঁকি—ঝুঁকি মেরে বেড়াচ্ছেন। যেন পাগল! সদর—ফটক চাবি বন্ধ করে রাখতে বলেছেন। বলেছেন—রাত আটটা বাজলেই সদর বন্ধ করে দেওয়া চাই—তারপর খুব সতর্ক দৃষ্টি নিয়ে ভজা থাকবে ফটকে।”
শিখা বললে—”বালিগঞ্জ থানা থেকে কেউ এসেছিল?”
”হ্যাঁ, থানার বড়বাবু সন্ধ্যার আগে এসেছিলেন—ধুতি জামা পরে। বলে গেছেন, দুজন সেপাই এখনি আসবে। এখানে ডিউটি ঠিক করে দিয়েছেন। তারা ঘুরে ঘুরে বেড়াবে, সব দিকে নজর রাখবে। তাছাড়া দুজন রিভলভারধারী সার্জ্জেণ্টকেও ডিউটিতে রেখেছেন।”
শিখা জিজ্ঞাসা করলে—”তারা ঝি কি তার মাইনের টাকা চুকিয়ে নিয়ে গেছে?”
”না। মাইনে যা পায়, কাতু—মার কাছে জমা রাখে। সে টাকাতো নিতে পারল না। তাই বাবুর পায়ে কেঁদে পড়ে পঞ্চাশটা টাকা নিয়ে গেছে।”
”সে টেলিগ্রাম আপনি দেখেছিলেন?”
”হ্যাঁ। আমিই রিসিভ করি পিয়নের কাছ থেকে সই দিয়ে। আমিই তাকে পড়ে শোনাই। সেটা সে নিয়ে গেছে।”
”কে টেলিগ্রাম করেছে?”
”একজন ডাক্তারের নাম দেখলুম। অবিনাশ ডাক্তার। তারা বললে, চেনে। কলেজের পাশ—করা ডাক্তার—বয়স হয়েছে। নাম—ডাক আছে উলুবেড়েয়।”
”এ ঝি কাজ করছে কত দিন?”
”তা চার—পাঁচ বছর হবে। কেন বলুন তো, এত কথা জিজ্ঞাসা করছেন?”
”না, আমি ভাবছি, চিঠি যারা লিখেছে, তাদের সঙ্গে খোকার ঝি তারার কোনো যোগ নেই তো?”
”না, না। এ অসম্ভব, তার ছেলেমেয়ে আছে, ঘর—সংসার আছে। তা ছাড়া খোকাকেও খুব ভালোবাসে। এই তিন মাস আগে খোকার নিউমোনিয়া হয়েছিল—বেচারী একেবারে অন্ন—জল ত্যাগ করেছিল। দশ—বারো দিন ঠায় খোকার কাছে বসে—নড়তে চায় না সে ঘর থেকে।”
শিখা কি ভাবল, তারপর বললে—”চিঠি যে বা যারা লিখেছে, তলায় নাম দিয়েছে চণ্ডী ঠাকুর! চণ্ডী ঠাকুর বলে কাকেও জানেন?”
শশধরবাবু বললেন—”চণ্ডী ঠাকুর বলে কাকেও জানি না। তবে চণ্ডী বলতে বাড়ীতে আছে—মা মঙ্গলচণ্ডীর ঘট। ভটচায্যি—মশায় এসে রোজ পূজা করে যান। আর প্রতি মঙ্গলবার পূজার একটু আড়ম্বর হয়—ভালো করে নৈবিদ্যি, ভটচায্যির দক্ষিণা মঙ্গলবারের জন্য এক টাকা করে। মঙ্গলবারে পূজা শেষ না হলে কাতু—মা জল অবধি মুখে দেন না।”
হঠাৎ মোটর—বাইকের শব্দ শুনতে পাওয়া গেল। মনে হ’ল বাইকখানা ফটকের মধ্যে ঢুকল। শিখা বেরিয়ে এসে দেখে, বিমলেন্দু।
শিখা বললে—”পপিকে আনেননি?”
”না, মুস্কিল! আমাকে যেতে হচ্ছে খিদিরপুর ডকে। বেলা পাঁচটা নাগাদ এ—বাড়ীর চারিদিকে ফুলবাবু সেজে চক্র দিয়ে গেছি পায়ে হেঁটে। তারপর সাড়ে পাঁচটায় অফিসে ফিরি। হাতে ছিল ব্যাঙ্কের মোটা টাকা তছরূপ—এর একটা কেস—তার প্রকাণ্ড রিপোর্ট লিখে শেষ করে প্ল্যান ভেবে ফিরেছি, তখন সাড়ে ছটা। ফিরে আসতেই আমার ছোট ভাই অমল বললে—ডেপুটি সাহেব এর মধ্যে ফোন করেছিলেন, এখনি যেতে হবে খিদিরপুর ডকে—কয়েক মণ আফিম চালান এসেছে। সে ব্যাপারে আমার যাওয়া দরকার। ডেপুটি সাহেব ফোন করেছেন ক্যালকাটা ক্লাব থেকে। বলেছেন—তিনি এক মিনিট অপেক্ষা করতে পারবেন না—সেখানে যাচ্ছেন—বিমলেন্দু যেন এখনি ডকে যায়।”
শিখা বললে—”তারপর?”
বিমলেন্দু বললে—”তাই ভাবলুম, এসে তোমাকে চুপি চুপি বলে যাই, খবরটা। ফোন করলুম না—এ কথা শুনলে নন্দবাবু পাছে ভড়কে যান! তা আমি দশটার মধ্যে নিশ্চয়ই আসবো। লালবাজারে এ—খবর জানিয়েছি ফোনে। জগদ্দল সিং জমাদার যথাসময়ে তার লোকজন নিয়ে এখানে হাজির হবে—যেমন কথা আছে।”
শিখা চিন্তিতভাবে বললে—”তাই তো, আপনি, ডেপুটি সাহেব—দুজনেই হঠাৎ এখন অন্য কাজে ব্যস্ত হলেন?”
”ভয় হচ্ছে না কি দিদি?”
”না, ভয় নয়। তবে আমার একটা মাথা—বিপদে—আপদে তিন মাথা এক হলে যেমন বল পাওয়া যায়।”
”তার জন্যে তুমি কিছু ভেবো না দিদি! দশটার মধ্যে আসবই—ডেপুটি সাহেবকেও নিয়ে আসব। সেখানে অন্য অফিসার লাগিয়েও অন্ততঃ—যদি চটপট ওখানকার কাজ না চুকে!”
মোটর—বাইক ভট—ভট শব্দে বেরিয়ে গেল। শশধরবাবু বললেন—”উনি এসেই চলে গেলেন যে?”
”একটু কাজ আছে,—সে কাজ সেরে এখনি আসবেন।”
শশধরবাবু বললেন—”ও!”
শিখার মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেল। মনে হলো, এ ঘটনা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত! কে জানে, এর জন্য চণ্ডী ঠাকুরের হয়তো কিছু সুবিধা হবে! তাইত, এমন দুর্লক্ষণ!
নয় – ব্যূহ চক্র
রাত প্রায় এগারোটা—দোতলায় কাত্যায়নী দেবী ঘুমোচ্ছেন। গাঢ় ঘুম। তাঁর ঘরের পাশের ঘরে খোকা ঘুমোচ্ছে তার ছোট খাটে। খাটের মশারি ফেলা। সে ঘরে আছে শিখা ও পঞ্চী ঝি। এ দুটি ঘরের সামনে চওড়া টানা বারান্দা—সে বারান্দায় ক’খানা চেয়ার। চেয়ারে বসে বালিগঞ্জ থানার বড়বাবু—নিরুপম মুখার্জ্জী, ডি—ডি ইনস্পেক্টর গগনবাবু, পুলিশ অফিসার যতীন্দ্রনাথ, শশধর এবং অফিসের কেশিয়ার আর এ্যাকাউণ্ট—বিভাগের দুটি বাবু। তাছাড়া বারান্দায় খাড়া আছে অফিসের এক দরোয়ান আর থানার বেশ জোয়ান—গোছের দুজন জমাদার ও একজন সার্জ্জেণ্ট। নন্দবাবু অস্থির হয়ে ছুটোছুটি করছেন—কখনো এ—ঘরে, কখনো ও—ঘরে, কখনো নীচে, কখনো বা ছাদে যাচ্ছেন। যখনি আসছেন, ব্যাকুল নয়নে বারান্দার দেয়ালে যে বড় ঘড়ি, সেই ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছেন! এগারোটা বেজে বিশ মিনিট—তিনি বললেন—”এঁরা এখনো এলেন না, তাই তো!” বলে উত্তরের অপেক্ষা না করে তিনি ছুটলেন নীচে।
নীচে থেকে আবার বারান্দায় এসে বসলেন, বললেন—”আমার স্ত্রী ভয়ানক ঘুমোচ্ছেন—ক’বার ডাকলুম, সাড়া নেই! ভয় হয়। ডাক্তারবাবুকে একবার খবর দেব কি না, ভাবছি!”
নিরুপমবাবু বললেন—”ঘুমোন যদি একরকম ভালো। কেননা, বারোটা যখন বাজবে—ভয়ে হয়তো অস্থির হবেন! মেণ্টাল ডিপ্রেশনের ভয় আছে তো! এক কাজ করুন বরং, মিস্ রায়কে বলুন, মাঝে মাঝে ওঁর খবরাখবর নেবেন।”
নন্দবাবু বললেন—”তাহলে মন্দ হয় না! কিন্তু আমি তো ওঁকে বলতে পারি না—যদি কিছু মনে করেন!”
”বেশ, আমি গিয়ে বলছি! আপনি এখানে বসুন।” বলে নিরুপমবাবু গেলেন খোকার ঘরে। শিখাকে কথাটা বললেন, আরো বললেন—”খোকার ঘরের ওদিককার দরজা ভিতর দিক থেকে তো বন্ধ আছে—এদিকে বারান্দায় আমরা—যথেষ্ট পাহারা আছে। আপনি দুটো ঘরের ভার নিন মিস্ রায়। নন্দবাবুও তাই বলছিলেন। তাহলে উনি—”
তাঁর কথা শেষ হবার আগেই শিখা বললে—”বেশ! কিন্তু খোকার ঘরে পঞ্চী ঝি আছে—ও খুব হুঁশিয়ার মানুষ। ওরা কেউ জানত না, কি ব্যাপার! নন্দবাবুর স্ত্রীর কাছে পঞ্চী আজই শুনেছে। আমাকে বলছিল—আমি জেগে পাহারা দেব—আমার কাছ থেকে কে নেবে ছেলেকে সরিয়ে, তাকে একবার দেখতে পেলে হয়!”
শিখা এলো খোকার ঘরে। খোকা ঘুমোচ্ছে, পঞ্চী ঝি দাঁড়িয়ে আছে খোকার খাটের পাশে। শিখা বললে—”এখন রাত এগারোটা—তুমি ঠায় এমন দাঁড়িয়ে থাকবে এখন থেকে?”
পঞ্চী বললে—”কে জানে দিদিমণি, আমার গা কেমন ছমছম করছে! অন্ধকার—অমাবস্যার দু’দিন বাকী—এই অন্ধকার পক্ষ বুঝেই হতভাগারা—”
পঞ্চীর কথা নিশ্বাসের কম্পে শেষ হতে পারল না।
শিখা বললে—”তুমি বরং মেঝেয় বসো—পৌণে বারোটা হলে তখন থেকে চৌকি দিয়ো।”
পঞ্চী বসল।
শিখা একখানা বই হাতে নিয়ে বসল টেবিলের সামনে। ঘরে সবুজ—বালবের বাতি জ্বলছে—ক্ষীণ আলো—সে—আলোয় কষ্ট করে বই পড়তে হয়।
বাইরের রেল—লাইনে মালগাড়ীর শাণ্টিং—এর শব্দ শোনা যাচ্ছে। অনেকটা দূরে বালিগঞ্জ ষ্টেশন। একটা ট্রেন বাঁশী—বাঁজিয়ে ষ্টেশন ছাড়ল। ট্রেনখানা চলেছে ওদিকে—ডায়মণ্ড—হারবার কিংবা বজবজ। লাইনে শাণ্টিংয়ের জন্য মালগাড়ীর ঘড়ঘড়ানি তাছাড়া আর কোন শব্দ নেই।
শিখা বললে—”তোমাদের পাড়া এর মধ্যে নিঝুম নিস্তব্ধ হয়—আশ্চর্য্য।”
একটা হাই তুলে পঞ্চী বললে—”হ্যাঁ দিদিমণি—এ—দিকটা এমনি নিঝুমপানা।”
তার কথা শুনে শিখা বুঝল, মুখে যত কথা বলুক, পঞ্চীর ঘুম এসেছে!
মিনিটের পর মিনিট চলেছে বয়ে—বইয়ের পাতায় শিখার মন যেন একটু তন্ময়। হঠাৎ ও—ঘর থেকে নন্দবাবুর ডাক—”পঞ্চী!”
শিখা বললে—”কর্ত্তাবাবু তোমায় ডাকছেন পঞ্চী।”
”যাই বাবা” বলে পঞ্চী উঠে পাশের ঘরে গেল।
নন্দবাবুর কণ্ঠ শোনা গেল। নন্দবাবু বললেন—”পুলিশ থেকে যে দিদিমণি এসেছেন, তিনি ও—ঘরে আছেন—তুই এ—ঘরে একটু থাক। ইনি একলা না থাকেন—আমি ওদিকে যাচ্ছি।”
পঞ্চী এ—ঘরে ফিরল না। শিখা বই পড়ছে। একবার ঘড়ির দিকে তাকাল—পৌণে বারোটা! কি মনে হলো, উঠে কাত্যায়নী দেবীর ঘরে শিখা এল। দেখে, পঞ্চী মেঝেয় শুয়ে ঘুমোচ্ছে। শিখা হাসল—সজাগ পাহারা বটে!
কাত্যায়নী দেবীর ঘরের খড়খড়ি খোলা—বাহিরে বাগানের ক’টা গাছ—লাইনে মালগাড়ীর শাণ্টিংয়ের বিরাম নেই, ঘড়ঘড় ঘড়ং ঘড়াৎ শব্দ।
বারান্দার ঘড়িতে পৌণে—বারোটা বাজতে গল্প থামলো। সকলে হুঁশিয়ার হলেন! এবার যেন শত্রু আসবে দুর্গ আক্রমণ করতে—তেমনি সজাগ হলেন সকলে। কিন্তু নন্দবাবু? নন্দবাবু কোথা গেলেন?
যতীন্দ্রনাথ বললেন—”বাপের মন—স্থির হয়ে তিনি বসতে পারছেন না!”
এমনি কথার মধ্যে বিমলেন্দু এসে হাজির।
যতীন্দ্রনাথ বললেন—”ডেপুটি—সাহেব?”
”তিনি লালবাজারে একটা খবর দিয়ে এখনি আসছেন! খুব গোপনীয় খবর।”
নন্দবাবু এলেন। তিনি ছিলেন খোকার ঘরে। তাঁর মুখ দেখলে শিউরে উঠতে হয়! সে—মুখে ভয়ানক আতঙ্ক! মুখে কে যেন কালির তুলি বুলিয়ে দিয়েছে! এসে তিনি বললেন—”আপনি এলেন! কিন্তু ডেপুটি—সাহেব?”
”এখনি আসবেন!”
”বারোটার আর দেরী নেই তো! আমার বুকের মধ্যে যা হচ্ছে—” বলে তিনি অবসন্নের মত একখানা চেয়ারে বসে পড়লেন।
বিমলেন্দু বললে—”আমি চারিদিক দেখে উপরে আসছি—পাহারা ঠিক আছে। যে—সব ঘাঁটি আমরা ঠিক করে রেখেছি, তার প্রত্যেকটিতে বেশ হুঁশিয়ার পাহারা।”
সকলে বারান্দার বড় ঘড়ির দিকে তাকালেন। বড় কাঁটাটা মনে হচ্ছে, যেন আজ একটু তাড়াতাড়ি চলছে!
সকলে চুপ! চারিদিক নিস্তব্ধ। দূরে কোন বাড়ীতে গ্রামোফোনে রেকর্ড বাজছে, ”বিশ্ব যখন নিদ্রাগমন, গগন অন্ধকার!”
এত রাত্রে গ্রামোফোনে রেকর্ড বাজিয়ে রবীন্দ্র—সঙ্গীত শোনার সখ কার?
শিখা এলো ঘর থেকে বেরিয়ে, বললে—”উনি জেগেছেন। বললেন, রাত ক’টা বাজলো?”
”জেগেছেন!” বলে নন্দবাবু যেন চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠলেন! উঠেই তিনি গিয়ে ঢুকলেন তাঁর স্ত্রীর ঘরে।
বিমলেন্দু বললে—”তাই তো, ঠিক মোক্ষম সময়ে ওঁর ঘুম ভাঙলো! হিষ্টিরিয়ায় যদি কিছু—”
তাচ্ছিল্যভরে যতীন্দ্রনাথ বললেন—”আপনি ভাবছেন, বারোটায় কিছু হবে! অসম্ভব! আমরা পাহারা দিচ্ছি সব ছদ্মবেশে—কত হুঁশিয়ার হয়ে—আপনি ভাবেন, তারা খোঁজ রাখেনি? হুঁঃ!”
এ—কথার সঙ্গে—সঙ্গে নীচে কম্পাউণ্ডে মহা সোরগোল। ভজার গলা বাহিরের সব কলরব ছাড়িয়ে উঁচু পর্দ্দায় উঠেছে—”শালা বদমাস!” সঙ্গে সঙ্গে পথে দুটো রিভলভারের আওয়াজ—তারপর যেন ছুটোছুটি—এদিকেও অমনি দ্রুত পায়ে ছুটোছুটির শব্দ, চীৎকার! এখানে সকলে কাঠ! পথে আবার রিভলভারের শব্দ। ব্যাপার কি!
নন্দবাবু এলেন ঘর থেকে বেরিয়ে, বললেন—”ঐ বুঝি এসেছে। মিস্ রায়, আপনি ওঁর কাছে যান। উনি আবার চোখ বুজেছেন!”
বিমলেন্দু বললে—”নীচে কি হলো?”
শিখা গেল কাত্যায়নী দেবীর ঘরে।
নিরুপম বললেন—”দেখতে হলো।”
বারান্দার ঘড়িতে, খোকার ঘরের এবং কাত্যায়নী দেবীর ঘরের ঘড়িতে—তিনটে ঘড়িতে একসঙ্গে বাজলো বারোটা। নীচে গোলমাল ওদিকে বেশ বেড়ে উঠেছে, বকাবকি চীৎকার! পথে কিন্তু কৈ, কোন শব্দ নেই আর।
বিমলেন্দু বললে—”ধরা পড়েছে তাহলে!”
নন্দবাবু বলে উঠলেন—”এ্যাঁ!”
তখনি সার্জ্জেণ্টকে এবং দুজন জমাদারকে বারান্দায় রেখে সকলে দুড়—দুড় করে নীচে নেমে এলেন। নন্দবাবুও এলেন।
গাড়ী—বারান্দায় বেশ ভিড়! চন্দন সিং জমাদার একটা লোককে পাকড়াও করেছে, ভজা খানসামা চ্যাঁচাচ্ছে—”রজনীগন্ধার ঝাড়ের নীচে হঠাৎ একটা শব্দ! গিয়ে দেখি, এ। আমায় দেখে পালাবার চেষ্টা করছিল! শালা!” বলেই তাকে চড় আর ঘুষি!
সকলে এসে দেখেন, এক শীর্ণ—চেহারার মানুষ—জুলজুল করে তাকাচ্ছে। মাথায় ঝাঁকড়া চুল, ছিন্ন—মলিন বেশ। তার কাছে পাওয়া গেল একটা রিভলভার আর একটা জীর্ণ চামড়ার ব্যাগ। ব্যাগের মধ্যে এক প্যাকেট তুলো আর একটা চিঠি—টাইপ করা চিঠি—তেমনি কাগজে। চিঠিতে লেখা—”টাকাটা দিলেই ভালো করতেন। না দেবার জন্য আজ ২২ তারিখে রাত বারোটায় ছেলেকে আমরা নিয়ে চললুম!”
রাগে লোকটার গালে নিরুপমবাবু মারলেন ঠাস করে এক চড়। চড় খেয়ে লোকটা ঘুরে পড়ছিল, জমাদার গুঁতো দিয়ে তাকে খাড়া রাখল। রিভলভারটা নেড়ে—চেড়ে যতীন্দ্রনাথ দেখেন—বাজে জিনিস—খেলার রিভলভার—থিয়েটারের অভিনয়ে যে বাজে রিভলভার ব্যবহার হয়, তাই। শ্রেফ ভুয়ো!
তাকে ধমক দিয়ে, চড়—চাপড় গুঁতো দিয়ে বহু কষ্টে খবর মিললো—লোকটা ভিক্ষে করে খায়। পথের মোড়ে ঐ বড় গাছটার তলায় বসে ভিক্ষে করে। গাছের পিছনে সরু গলি—সেই গলিতে একটা ভাঙ্গা কুঁড়েয় সে থাকে। আজ সন্ধ্যার সময়—যখন সে গাছতলায় বসে—একজন লোক গিয়ে তার হাতে দুটো টাকা দিয়ে বলে, রাত দশটায় এ—বাড়ীতে আসতে হবে—কাজ আছে। সে—কাজ করলে আরো তিনটে টাকা পাবে। সে আসে রাত দশটায়—তখন তার হাতে এই বন্দুক আর ব্যাগটা দিয়ে সে—লোক বলে ঘড়িতে ঠিক বারোটা বাজছে যেমন শুনবি, অমনি ঐ রজনীগন্ধার ঝোপ থেকে মাথা তুলে দাঁড়াবি। এ ছাড়া আর কিছু করতে হবে না! সে তাই করেছে।
”বাকী তিন টাকা পেয়েছিস?”
”আজ্ঞে, হ্যাঁ।”
”যে—লোক টাকা দিয়েছে, এ সব দিয়েছে, তাকে দেখলে চিনতে পারবি?”
সে চারিদিকে তাকাল, সকলকে বেশ ভালো করে দেখল। তারপর কনষ্টেবল দুর্জ্জন সিংকে দেখিয়ে বললে—”এই লোক হুজুর।”
”হুঁ! বেটা পাজী!” নিরুপমবাবু দিলেন তাকে গুঁতো! ”ও হলো পুলিশের লোক। ও দিয়েছে! বটে!”
গুঁতো খেয়ে লোকটার কেমন থতমত ভাব! সে বললে—”আমার ভুল হয়েছে।” এ—কথা বলে আবার সকলের দিকে তাকাল। ভজা ধরেছিল তার একখানা হাত, তাকে দেখিয়ে বললে—”এ—এই লোক।”
”তবে রে—পাজী।” বলে ভজা দিলে তাকে গুঁতো।
লোকটা বললে—”না, না, ভুল হয়েছে।”
বিমলেন্দু বললে—”ওকে থানার হাজতে পুরুন, তারপর তদন্ত করে কাল তখন—”
লোকটার নাম—সে বললে, কেনারাম মাইতি। কেনারামকে এক জমাদারের সঙ্গে থানায় পাঠানো হলো। তারপর সকলে দোতলায় এলেন। হঠাৎ কোথায় পেটা ঘড়িতে ঢং—ঢং করে বারোটা বাজল। সকলে চমকে উঠলেন! এখন বারোটা বাজছে! বাড়ীর দোতলার ঘড়িতে কখন বারোটা বেজে গেছে! বিমলেন্দু তার কব্জিতে—আঁটা হাত—ঘড়ির পানে তাকাল, তার হাত—ঘড়িতে ঠিক বারোটা! তবে?
সকলে বারান্দার ঘড়িতে দেখেন, বারোটা বেজে বিশ—মিনিট! তাইতো—এ—ঘড়ি তাহলে কুড়ি—মিনিট ফাষ্ট। কিন্তু শুধু বারান্দার ঘড়ি নয়—ঘরের দু—দুটো ঘড়িতেও এ—ঘড়ির সঙ্গে বারোটা বেজেছে—সকলে শুনেছেন! ঘড়িগুলো কেউ ফাষ্ট করে দিয়েছিল তাহলে?
হঠাৎ ওদিককার ঘর থেকে পঞ্চীর চীৎকার—”খোকা! খোকা কোথা গেল? ও মা গো, খোকা?”
সকলে ছুটে খোকার ঘরে গেলেন। দেখেন, খাটের বিছানায় খোকা নেই! একটা ছোট বালিশের গায়ে খোকার কোট জড়ানো! বিছানায় খোকা নেই!
শিখা বললে—”এ—ঘর থেকে যাবার সময় তখনও আমি দেখে গিয়েছি, খাটে ঘুমোচ্ছে!”
তারপর পঞ্চীর দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলে—”হঠাৎ তোমার এখন খেয়াল হলো যে! এর মানে?”
পঞ্চী বললে—”বারোটা বাজলেই খোকাকে তোলা হয়—নইলে বিছানা নোংরা করে ফেলে যদি! নিয়ম করে রোজ রাত্রে তাই তোলা হয়।”
সকলের দেহের মধ্যে দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহ বয়ে গেল যেন!
নন্দবাবু বলে উঠলেন—”এত করেও শেষে—”
এ—কথা বলে তিনি মেঝেয় বসে পড়ে ছোট ছেলের মত হাউ—হাউ করে কেঁদে উঠলেন!
দশ – লাগে তুক, না লাগে তাক!
একি ম্যাজিক, না মন্ত্র?
পরের দিন লালবাজারে বসে কথা হচ্ছিল—ডেপুটি, বিমলেন্দু, গগনবাবু, যতীন্দ্রনাথ আর শিখার মধ্যে।
শিখা বললে—”ছেলেকে যে নিয়ে গেছে, বাড়ীর লোকজনদের সাহায্য ছিল তাতে, নিশ্চয়। ক’টা ব্যাপারে আমার মনে খটকা লাগছে!”
”কি ব্যাপার, শুনি?” ডেপুটি বললেন।
শিখা বললে—”ঠিক ঐদিনে কাত্যায়নী দেবীর অসুখ! ডাক্তার বললেন, কোন—রকম ফুড—পয়জনিং! চব্বিশ ঘণ্টা ঘুমে আচ্ছন্ন ভাব! তারপর শুধু দোতলার ঘড়িগুলো নয়, নীচের অফিস—ঘরের ঘড়ি পর্য্যন্ত বিশ মিনিট ফাষ্ট! তারা ঝির নামে টেলিগ্রাম! এ যেন মতলব করে করা!”
ডেপুটি বললেন—”কাকে আপনি সন্দেহ করেন এ—ব্যাপারে হাত আছে বলে?”
শিখার ভ্রূ কুঞ্চিত হলো। শিখা বললে—”বিশেষ করে কাকেও নয়—তবু সকলকেই সন্দেহ হয়! শুধু নন্দবাবুর স্ত্রীকে নয়!”
”নন্দবাবুকে? শশধরবাবুকে?”
শিখা বললে—”আমাকে ভাবতে দিন।”
”নন্দবাবুর স্ত্রী সেরে উঠেছেন?”
”না। এখনো কেমন আচ্ছন্ন ভাব! ডাক্তার বলেছেন, দু—তিনদিন এখনো—”
”নন্দবাবুর কি খবর? আপনি তো ওঁদের ওখানেই প্রায় বাস করছেন।”
শিখা বললে—”হ্যাঁ, আমার খুব ইণ্টারেষ্টিং লাগছে। ছুরি—ছোরা নেই, রিভলভারের খেলা নেই, গুণ্ডা নেই—অথচ এত—বড় ব্যাপার হয়ে গেল! নন্দবাবু ভয়ানক ভেঙে পড়েছেন—দিন—রাত শুয়ে আছেন, অফিস—টফিস একেবারে বন্ধ।”
”শশধরবাবু?”
”তিনি কেমন হকচকিয়ে আছেন! খুব উদ্বিগ্ন!—তবু অফিসে যেতে হয়। বলেন, না গেলে চলবে না।”
শিখাকে ডেপুটি বললেন—”আপনি রোজ হাজিরা দিচ্ছেন?”
বিমলেন্দু জবাব দিলে, বললে—”সকালে জলখাবার খেয়েই শিখা নন্দবাবুর ওখানে যায়! তারপর দুপুরে বাড়ী এসে স্নান—আহার। আহার সেরে আবার যাওয়া! বিকেলে ঐখানেই চা খাওয়া—রাত দশটার সময় বাড়ী এসে খাওয়া আর ঘুম।”
ডেপুটি কমিশনার হেসে বললেন—”রীতিমত কৃচ্ছ্বসাধন।”
শিখা বললে—”একটা থিওরী খাড়া করেছি। দেখা যাক, কি করতে পারি। তবে, এখন আর অন্য কেস দেবেন না আমাকে। এর কিনারা না করা ইস্তক আমার আর কোন দিকে মাথা খেলবে না।”
”বেশ, তাই করুন। আপনি মেয়ে বলেই এ ঘরোয়া কেসের ভার আপনার হাতে দেওয়া আরো উচিত মনে হচ্ছে।”
সন্ধ্যার আগে তারা ঝি ফিরল। ফিরেই হাউ—হাউ চীৎকার। বলে—”সব মিথ্যা গো, সব মিথ্যা! ছেলে ভালো আছে—সাপে কামড়ায়নি। যে এ ফন্দী করেছে, তাকে সাপে খাক—আমি মা মনসার পুজো দেবো পাঁচ—সিকে মানত করেছি। মা গো মা, এ—কি অনাছিষ্টি!”
শিখা শুনল, কোন কথা বললে না। আরো একটা জিনিস লক্ষ্য করল শিখা! নন্দবাবু অমন ভেঙে পড়েছেন—শিখাকে ডেকে নন্দবাবু বার বার বলছেন, ‘পাবে তো মা আমার ছেলেকে খুঁজে?’ কখনো বলছেন, ‘বার—বার ওঁকে বললুম, বিশ—হাজার ওরা চাইছে—দাও। তা কিছুতে না! যা বলেছিল, এত ব্যবস্থার মধ্যেও ঠিক নিয়ে গেল তো। এখন ঐ ত্রিশ—হাজার ঠিক আদায় করবে, তবে ছেলে দেবে!’ কখন তিনি ফোন করছেন লালবাজারে। পাগলের মত ভাব। অথচ সন্ধ্যার পর তিনি বেরুবার উদ্যোগ করছেন।
দেখে শিখা বললে—”কোথায় যাচ্ছেন? আপনার মনের এই অবস্থা—শেষে একটা অ্যাকসিডেণ্ট—”
এ—কথায় তাঁর মুখ যেন বিবর্ণ হলো। নন্দবাবু বললেন—”একজন জ্যোতিষী আছেন। ভাবছি, তাঁর কাছে একবার—”
শিখা আর—কিছু বললে না। নন্দবাবু বেরিয়ে গেলেন।
রাত দশটায় শিখা বাড়ী যাবে, তখনো নন্দবাবুর দেখা নেই! শশধরবাবু বললেন—”বোধ হয় ওঁর সেই গুরুর কাছে গেছেন, বেহালায়। মনটা যদি একটু—”
কথাটা শিখার কেমন ভালো লাগলো না। মন ঠিক করতে গুরুর কাছে চলেছেন, অথচ এই একই ব্যথা স্ত্রীর মনে! তাঁর সঙ্গে কৈ—
শিখা বাড়ী এলো।
এর পর তিন—চার দিন—দিনের বেলায় নন্দবাবুর সেই এক ভাব। কখনো চুপচাপ পড়ে থাকেন, কখনো লালবাজারে ছোটেন, কখনো শিখাকে ধরে আকুল প্রশ্ন! সন্ধ্যার পর কিন্তু বেরুনো চাইই! দশটার পরে ফেরেন।
শিখার কেমন কৌতূহল হলো—বেহালায় কে গুরু,—কেমন গুরু, দেখতে হবে!
পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে শিখা বিমলেন্দুকে ফোন করে বললে—”এখনি আমাদের এখানে আসুন বিমলদা, এইখানেই চা খাবেন। একটা জরুরি পরামর্শ আছে আপনার সঙ্গে।”
বিমলেন্দু এলো।
সে এলে শিখা বললে—”নন্দবাবু রোজ সন্ধ্যার পর ট্রামে, না হয় বাসে করে বেহালায় কোথায় যান আপনাকে দেখে আসতে হবে। বেশী কিছু না, শুধু ফলো করে গিয়ে দেখবেন, কোথায় কোন বাড়ীতে যান? তারপর আমাকে সে বাড়ী দেখিয়ে দেবেন। এর বেশী আর কিছু করতে হবে না। ট্রামে—বাসে আমি ওঁকে ফলো করতে পারি না তো। উনি দেখে ফেলবেন! তাই আপনাকে ধরেছি বিমলদা, আপনি একটু মেক—আপ করে নিলেই সহজে এ কাজ হবে এবং এ—ব্যাপারে উনি জানবেন না।”
মৃদু হেসে বিমলেন্দু বললে—”বেশ। আজই তাহলে?”
”হ্যাঁ। আপনি ছ’টা নাগাদ নন্দবাবুর বাড়ীতে আসবেন মেক—আপ করে। যেন আমার কাছে এসেছেন বাড়ী থেকে ঠিকানা জেনে। তারপর উনি বেরুলে আপনিও—”
”বেশ। যা বলছ, তাই হবে! আমি মেক—আপ করে আসব।”
সেদিন সন্ধ্যায় তাই হলো। নন্দবাবুকে ফলো করে বিমলেন্দু চলল। এবং দেখেশুনে ফিরে সে এল শিখার বাড়ীতে।
রাত তখন এগারোটা বেজেছে।
বিমলেন্দু বললে—”বেহালার ট্রাম যেখানে শেষ হয়েছে, তার একটু আগে গিয়ে ডান দিকে গলি—গলিটা অর্দ্ধচন্দ্রের মত ঘুরে ভিতরে চলে গিয়েছে। সেই গলিতে কখানা বস্তী—বাড়ীর পর বাঁ—হাতী দোতলা ছোট বাড়ী। সেই বাড়ীতে উনি ঢুকলেন। পাড়ায় আমি খবর নিলুম, ও—বাড়ীতে থাকে একটি ছোকরা, বয়স বারো—তেরো বছর; তার এক দিদি, বয়স পনেরো—ষোল বছর; আর তাদের মা। ছোকরার নাম অমর রায়, ওখানকার ইস্কুলে পড়ে। ছেলে ভালো। দিদির এখনো বিয়ে হয়নি! ওরা লোক ভালো। কে এক মামা আছে, খরচপত্র দেয়। বাপ নাকি নিরুদ্দেশ!”
শিখা বললে—”আমাকে নিয়ে গিয়ে বাড়ীটা দেখিয়ে দেবেন।”
”কিন্তু কি তুমি ভাবছ, বলো তো?”
শিখা বললে—”বিশেষ কিছু ভাবছি না। তবে গুরু নয়, সাধন—ভজনও নয়! ছোট একটা ফ্যামিলি—আপনি শুনে এসেছেন—সেখানে রোজ নিয়ম করে নন্দবাবু যান—কেন?”
এগারো – ভোটারের লিষ্ট
গলির মোড়ে ট্যাক্সি থামল। বিমলেন্দু ট্যাক্সিতে বসে রইল। শিখা একা এলো ছোট দোতলা বাড়ীর সন্ধানে।
বড় বস্তী। খানকতক খোলার ঘর। মাঝে—মাঝে দু—একখানা ইটের বাড়ী—বহুকালের পুরানো বাড়ী—দেওয়ালে নোনা—ধরা। সেগুলোর পর এই একখানি মাত্র দোতলা বাড়ী। দরজা ভিতর থেকে বন্ধ।
দরজায় ঘা দিতে এক কিশোরী মেয়ে এসে দরজা খুলে দিলে, বললে—”কাকে চান?”
মেয়েটি সুশ্রী।
শিখা বললে—”আমি এসেছি—সামনে ইলেকসন আসছে কি—না, মেয়েদেরও ভোট আছে এখন—তাই মানুষ দেখে ভোটারের লিষ্ট তৈরী করবো—সেই জন্যে। তা ভিতরে আসতে পারি?”
”আসুন।”
মেয়েটির সঙ্গে শিখা বাড়ীতে ঢুকল। ঢুকেই উঠান—উঠানের গায়ে শাণ—বাঁধানো রোয়াক, রোয়াকে বালতি—ভরা জল। প্রায় পঞ্চাশ বৎসর বয়সের এক মহিলা ছোট একটি ছেলেকে স্নান করিয়ে দিচ্ছেন। ছোট ছেলেটিকে দেখে শিখা চমকে উঠলো! নন্দবাবুর হারানো খোকা ব্রজদুলালের মতই না? সে—ছেলে শিখাকে চেনে—মা তাকে শিখিয়েছিলেন ‘দিদি’ বলতে! যদি সেই ছেলে হয়, তাহলে এখনি দিদি বলে ডেকে বসে যদি? শিখা সরে আড়ালে গেল, ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটা ছোট নোট—বুক নিয়ে বললে—”আপনার নাম?”
”মালতী রায়।”
”বিয়ে হয়নি, দেখছি। বাপের নাম?”
মালতী বললে—”হরনাথ রায়।”
”বেঁচে আছেন?”
”জানি না। তিনি আজ দশ বছর নিরুদ্দেশ। কেউ বলে, টেররিষ্ট—দলে ছিলেন, পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন! আমরা তাঁর কোন খবর পাইনি।”
”বাড়ীতে আপনারা ক’জন থাকেন?”
”তিনজন। মা, আমি আর আমার ছোট ভাই। একজন ঝি আছে। সে সকালে এসে কাজ করে, বেলা দুটোয় চলে যায়—তারপর বেলা পাঁচটায় আসে—এসে কাজকর্ম্ম চুকলে রাত দশটায় বাড়ী যায়।”
”এ খোকাটি?”
মালতী একটা ঢোক গিলল। তারপর বললে—”আমার মামাতো ভাই। বেড়াতে এসেছে।”
”এখানে থাকে না?”
”না।”
”কবে এসেছে?”
মালতী তারিখ বললে—”২২শে।”
শিখা কৌতূহল দমন করতে পারল না, বললে—”এতটুকু ছেলে—মা—বাপ ছেড়ে বেশ আছে তো! মা—বাপ নেই বুঝি?”
মালতী বললে—”মা—বাপ আছেন। আমার মামীর খুব অসুখ—পাছে ছোঁয়াচ লাগে, তাই—”
”মামা নিজে রেখে গেছেন বুঝি?”
”না। মামা চিঠি লিখে লোক দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।”
শিখা আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করল না, শুধু বললে—”আপনার মার নাম?”
মালতী বললে—”অন্নপূর্ণা দেবী।”
”আপনি কতদূর লেখা—পড়া করেছেন?”
”ম্যাট্রিক দেব এবার।”
”প্রাইভেট?”
”হ্যাঁ।”
”আচ্ছা, আমি আসি। আচ্ছা, আপনার মামা দেখতে আসেন না ছেলেকে?”
”আসেন সন্ধ্যার পর। ছেলে মার খুব ন্যাওটা হয়েছে। ছোট ছেলে—মেয়েদের মা বেশ বশ করতে পারেন।”
”তাই দেখছি।”
শিখা বেরিয়ে এলো—এসে বসলো ট্যাক্সিতে।
বিমলেন্দু বললে—”কি হলো?”
শিখার হাসিখুশী হাবভাব। বললে—”বাড়ী চলুন, সব বলব।”
বাড়ীতে এসে শিখা বললে সব কথা। যা দেখেছে, যা বুঝেছে, সব কিছুই খোলাখুলি ভাবে জানালো বিমলেন্দুকে। শুনে বিমলেন্দু বললে—”তাহলে বেহালার থানায়…”
বাধা দিয়ে শিখা বললে—”না, না—আপনি পাগল হয়েছেন বিমলদা! নিশ্চয় এর মধ্যে পারিবারিক কোন রহস্য আছে! কাকেও ঘুণাক্ষরে এ কথা এখন বলবেন না। কে জানে, জানাজানি হলে যদি তেমন কিছু অঘটন ঘটে! আমি ভাবছি, আজ সন্ধ্যার পর—সাতটা সাড়ে—সাতটা নাগাদ আপনাকে আবার একবার কষ্ট দেব। এখানে আমি আসব ঐ সময়ে—আপনাকেও সঙ্গে আসতে হবে। কিন্তু খবর্দ্দার, লালবাজারে বা কারো কাছে আভাসে—ইঙ্গিতেও এ—কথা বলবেন না যেন!”
”না, না। আমার কিন্তু ভারী মিষ্টিরিয়স লাগছে, দিদি!”
”সবুর করুন, এ—মিষ্ট্রী আজই ফাঁস হবে।”
বারো – করুণ নাটক
প্রায় রাত নটা। বিমলেন্দুর সঙ্গে ট্যাক্সি করে শিখা এলো বেহালায়। বিমলেন্দুকে ট্যাক্সিতে বসিয়ে রেখে শিখা এলো সেই বাড়ীতে। দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। কড়া নাড়তে দরজা খুলে দিল—মালতী নয়, বারো—তেরো বছরের একটি ছেলে। শিখা বুঝল, মালতীর ভাই অমর।
শিখা বললে—”কথা আছে। ভিতরে চলো, বলবো।”
ছেলেমানুষ অমর। নিঃশব্দে সে শিখাকে নিয়ে এলো বাড়ীর মধ্যে। সেই উঠান…উঠানে মোড়ায় বসে নন্দবাবু।
শিখাকে দেখে তিনি চমকে উঠলেন!
শিখা বললে—”আপনার সঙ্গে কথা আছে।”
মন্ত্রমুগ্ধের মত নন্দবাবু বললেন—”দোতলায় চলুন, দয়া করে। এখানে কোন কথা নয়।”
শিখা বললে—”বেশ।”
শিখাকে নিয়ে নন্দবাবু দোতলায় উঠলেন। দোতলায় পাশাপাশি দুখানি ঘর। নন্দবাবু তার একটায় শিখাকে নিয়ে ঢুকলেন। ঘরে একখানা তক্তাপোষ, তক্তাপোষে বিছানা, কোণে একটা ছোট টেবিল, টেবিলে কতকগুলো স্কুলের পাঠ্য বই।
নন্দবাবুর মূর্ত্তি চোরের মত। তিনি বললেন—”পুলিশ নিয়ে এসেছেন নাকি?”
”না। কিন্তু কি ব্যাপার, বলুন তো?”
কম্পিত স্খলিত কণ্ঠে নন্দবাবু যে—কথা বললেন, তার মর্ম্ম—অন্নপূর্ণা দেবী তাঁর দিদি। এই দিদি ছাড়া পিতৃকুলে তাঁর আর কেউ নেই! ভগ্নীপতি কখনো সংসারের পানে চেয়ে দেখেননি। তিনি ছিলেন টেররিষ্টদের দলে—দিদি আর দিদির ছেলে—মেয়েদের দেখাশুনা নন্দবাবুই করে আসছেন। ভগ্নীপতি টেররিষ্ট ছিলেন বলে কাত্যায়নী দেবী এঁদের সঙ্গে নন্দবাবুকে কোন সম্পর্ক রাখতে দিতে চান না! নন্দবাবু মাসিক তিনশো টাকা করে বাঁধা এ্যালাউয়ান্স পান। তাঁর নিজের খরচের মধ্যে মোটা টাকার ইনসিওর আছে, তাতে দিতে হয় মাসে সাতানব্বই টাকা। এদিকে ভাগনেটি ভারী ভালো ছেলে, স্কুলে ফার্ষ্ট হয়। ভাগনী ডাগর, তার বিয়ে দিতে হবে তো! টাকা কোথায়? এ—বাড়ীর ভাড়া দিতে হয় মাসে চব্বিশ টাকা। ঐ ভাড়া ছাড়া দিদির সংসারের জন্য তিনি দেন মাসে একশো টাকা। নন্দবাবুর হাত—পা এমন বাঁধা যে, সে আর বলবার নয়! এখানে রোজ তিনি আসেন সন্ধ্যার পর—ভাগনে—ভাগনীর পড়াশুনা বলে দেন। দিদির মনের যে অবস্থা, তাঁকে ধরেই দিদি দাঁড়িয়ে আছেন। স্বামী টেররিষ্ট ছিলেন বলে কেউ ওঁর সঙ্গে সম্পর্ক রাখে না। নন্দবাবুর দারুণ ভাবনা, তিনি যদি মারা যান, এদের কি হবে? তাই অমনি ফন্দীতে বিশ—হাজার টাকা আদায় করে যদি এঁদের সম্বন্ধে পাকা ব্যবস্থা করতে পারেন!
তিনি আরও বললেন—কাত্যায়নী দেবী ঝগড়া—বিবাদ করেন না। কিন্তু ভয়ানক জেদী মানুষ। আর টাকার বড় গরম। বিশেষ নন্দবাবু ওঁর বাপের আমলের কর্ম্মচারী ছিলেন বলে স্বামী হয়েও কাত্যায়নীর চোখে তিনি সেই কর্ম্মচারীই রয়ে গেছেন। লোকে শুনলে আশ্চর্য্য হবে, কিন্তু সত্যই তাই। বড়লোকের যেমন ম্যানেজার থাকে, নায়েব—গোমস্তা থাকে, দরোয়ান থাকে, ড্রাইভার থাকে—স্বামীও তেমনি কাত্যায়নী দেবীর কর্ম্মচারীর সামিল! স্বামী হয়ে নন্দবাবুর নিজের সাধ—আশা বাসনা—কামনা নেই—স্ত্রীর বাসনা—কামনার দাস্য করে তাঁকে বাস করতে হয়! এ যে কতবড় ট্রাজেডি, তা বলে বোঝানো যায় না।
নন্দবাবু নিশ্বাস ফেললেন।
শিখা বললে—”কিন্তু ছেলেকে অত পাহারার ভিতর থেকে কি করে সরিয়ে আনলেন?”
নন্দবাবু বললেন—”ভজা আমার সহায় ছিল। সব ঘড়িগুলোর সময় আমি বিশ—মিনিট ফার্ষ্ট করে রেখেছিলুম। যে—লোকটাকে ভজা ধরেছিল, তাকে সেই তৈরী করেছিল—কথা ছিল, বাড়ীর ঘড়িতে বারটা বাজবার সঙ্গে সঙ্গে লোকটা গোলমাল তুলবে—তুললেই সকলে সেদিকে যাবে, সেই অবসরে খোকার ঘরের খাটের পিছন দিকে বাথ—রুম—সেখানে অন্য লোক ছিল, খোকাকে সে সরিয়ে বাথ—রুমের সঙ্গে যে ঘোরানো সিঁড়ি, সেই সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসবে। এই প্ল্যান মতই কাজ করা হয়। ঘুমন্ত ছেলে—তাকে এনে বাড়ীর পিছনদিকে পাঁচিলে ক’খানা ইট সরানো ছিল, সেই ফাঁকে বেরিয়ে সে—লোক যায় রেললাইনে। তারপর লাইন পার হয়ে ওদিকে যে রাস্তা, সেই রাস্তায় ছিল ট্যাক্সি, তাতে করে ঘুমন্ত ছেলেকে নিয়ে বেহালায় আসে।—কিন্তু আপনি কি করে জানলেন?”
শিখা বললে—”বেহালায় গুরুর বাড়ীতে আপনি আসেন, শুনেছিলুম। ছেলে যেদিন চুরি গেল, তার পরের দিন অমন শোক—তবু আপনি বেরুলেন! এতে আমার মনে খটকা লাগে! তখন বিমলেন্দুবাবুকে বলি। পরের দিন তিনি আপনাকে ফলো করে এই বাড়ীখানা দেখে যান। তারপর আমি আজ সকালে এসে দেখি, খোকা এখানে!”
নন্দবাবুর দু—চোখে জল। ভয়ে তিনি আকুল! পাগলের মত শিখার দু—হাত চেপে ধরলেন, ধরে বললেন—”তোমাকে আমি ‘মা’ বলছি। আমাকে এ—দায়ে বাঁচাও তুমি। নাহলে আমি যাই, ক্ষতি নেই—দিদির সংসারটা ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে! এরা জানে, আমি—আমি—”
শিখা বললে—”ভয় নেই। আপনার কথা আমি বুঝেছি। এ ব্যাপার আমি কাকেও বলিনি, কেউ জানে না। যাক, এখন আমি বলি, এক কাজ করা যাক। ছেলে আজ রাত্রে এ—বাড়ীতে থাকবে। কাল সকালে আমি গিয়ে আপনাকে আর আপনার স্ত্রীকে বলব, ছেলের সন্ধান পেয়েছি। এ কথা বলে আপনাকে নিয়ে বেরুব—বলব, চুপি—চুপি এ কাজ করতে হবে! ছেলে যে—আশ্রয়ে আছে, গোলমাল হলে তারা ছেলেকে সেখান থেকে সরাতে পারে। এই কথা বলে আমরা দুজনে এসে ছেলে নিয়ে ফিরব। কিন্তু ছেলে আপনাকে এখানে দেখেছে তো?”
”না। এখানে ছেলের সামনে আমি কখনো বেরুইনি। এখানে সে আমাকে দেখেনি।”
”ছেলে এখানে কান্নাকাটি করেনি?”
”না। দিদির যত্ন—আদর। তাছাড়া যে—সব খেলনা সে ভালোবাসে, তার জন্য সে—সব একসেট করে এনে দিয়েছি। তাছাড়া বুঝেছেন তো, বড়লোকের বাড়ীতে যেমন হয়, দাসী—চাকরকেই ছেলে বেশী করে জানে মা—বাপের চেয়ে! কাজেই—”
”তাহলে এই কথা রইলো।”
নন্দবাবু বললেন—”তা বুঝলাম, কিন্তু লালবাজার?”
”কেউ জানবে না।”
”তুমি আমার মা, আমাকে রক্ষা কর মা—ভগবান তোমাকে চিরসুখী করবেন!”
শিখা চলে আসছিল, হঠাৎ থামলো! থেমে হেসে সে বললে—”একটা কাজ করতে পারি—বিশ—হাজার নয়, আপনার স্ত্রীকে বলে পাঁচ—সাত হাজার টাকা অন্ততঃ আদায় করে দেব। সে—টাকায় ভাগনীর বিয়ে খুব হতে পারবে।”
নন্দবাবু কোন কথা বললেন না। তাঁর দু—চোখে জল এলো ঠেলে।
পরের দিন ছেলে পাওয়া গেল। যা বলেছিল, শিখা পরের দিন সকালে নন্দবাবুকে আর কাত্যায়নী দেবীকে বলে নন্দবাবুকে নিয়ে বেরুলো—বেরিয়ে ছেলে নিয়ে বাড়ী ফিরল। কাত্যায়নী দেবী যেন স্বর্গের চাঁদ হাতে পেলেন! শিখাকে তিনি রাজ্য দেন যেন!
শিখা বললে—”আমার কিছু চাই না, মা। তবে যে গরীব গৃহস্থরা নিজেদের বিপদ তুচ্ছ করে ছেলেকে পাইয়ে দিয়েছে, তাদের যদি কিছু—”
কাত্যায়নী নিজে থেকে বললেন—”ছেলেধরারা চেয়েছিল বিশ—হাজার। বেশ, তাদের আমি দশ—হাজার টাকা দেব।”
”তাহলে ব্যাঙ্ক থেকে টাকাটা আনিয়ে রাখবেন। নন্দবাবুকে নিয়ে দুপুরেই আমি যাব—আপনার নাম করে নন্দবাবু নিজের হাতে সে—টাকা তাদের দিয়ে আসবেন।”
”বেশ মা, আজই আমি ব্যাঙ্ক থেকে টাকা আনিয়ে রাখব। তুমি দুপুরে গিয়ে—”
”হ্যাঁ, তাই হবে।”
লালবাজারে ডেপুটির কাছে এ—কথা শিখা গোপন রাখতে পারল না। শুনে ডেপুটির দু—চোখ বিস্ফারিত হলো! তিনি বললেন—”নন্দবাবুর জীবন তাহলে দেখছি, জীবন্ত ট্রাজেডি! তাই না মিস্ রায়?”
নিশ্বাস ফেলে শিখা বললে—”হুঁ। বেচারী নন্দবাবু!”
***