সাত
লোকটা মূর্খ। এবং অতিবড় মূর্খ না হলে কেউ ওই বাংলোয় যায় না, গিয়ে টেলিফোন ধরে না। ভার্গিস বিড়বিড় করলেন। এখন মধ্যরাত। বিছানায় শুয়ে খবরটা পাওয়ামাত্র সোমের মুখটাকে মনে করলেন তিনি। লোকটার আর বাঁচার পথ খোলা রইল না। কিন্তু তিনি চাননি ও এত চটজলদি ধরা পড়ুক। অনেকসময় বোকারাও ফস্ করে ঠিকঠাক কাজ করে ফেলে। চিতাটাকে যদি সোম ধরতে পারত—! কিন্তু আর দেরি করা উচিত হবে না। খবরটা বোর্ডের কাছে পৌঁছাবেই। ভার্গিস তাঁর দ্বিতীয় সহকারী কমিশনারকে ফোন করলেন, ‘ঠিক এই মুহূর্তে তুমি কি করছ?’
সহকারী কমিশনার সন্ত্রস্ত হয়ে ঘুমন্ত স্ত্রীর দিকে তাকাল, ‘ইয়ে, কিছু না স্যার।’
‘গুড। বাবু বসন্তলালের বাংলোটার কথা মনে আছে? ম্যাডাম যেখানে বিশ্রাম নিতে যান!’
‘হ্যাঁ স্যার।’
‘সেখানে সোম গিয়েছে। ভোরের আগেই ওকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে এসো।’ লাইন কেটে দিলেন ভার্গিস। একটা ব্যাপার তাঁকে বেশ স্বস্তি দিচ্ছিল। তাঁর গোয়েন্দাবিভাগ যে যথেষ্ট সক্রিয় তা আর একবার প্রমাণিত হল। নানা জায়গায় ঢুঁ মারতে মারতে ওরা ওই বাংলোয় ফোন করেছিল। একটা গলা পায় অথচ গলাটা অশিক্ষিত কেয়ারটেকারের নয়। ওদের সন্দেহ হয়। কিছুক্ষণ পরে তারা অপারেটারকে ফোন করে জানতে পারে সোম ওখানে আছে। এই মূর্খ তাঁকে সরিয়ে সি পি হতে চেয়েছিল। নিজের পরিচয় কেউ অপারেটারকে দেয়!
ভার্গিসের খুব ইচ্ছে হচ্ছিল সোমকে যে ধরা যাচ্ছে তা মিনিস্টারকে ফোন করে জানিয়ে দিতে। কিন্তু এত রাত্রে সেটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তাঁর ঘুম আসছিল না। কালকের দিনটা হাতে আছে। উপায় না থাকলে তিনি সমস্ত শহরটাতে চিরুনি তল্লাশি করতেন। ভার্গিস বিছানা থেকে নেমে ওভারকোট পরে নিলেন। সার্ভিস রিভলভারটাকে একবার পরীক্ষা করে ইন্টারকমে হুকুম করলেন জিপ তৈরি রাখার জন্যে। তারপর জানলায় গিয়ে দাঁড়ালেন। ঘুমন্ত শহরের অনেকটাই এখান থেকে দেখা যাচ্ছে। অদ্ভুত শান্ত হয়ে আছে শহরটা। আসলে এটা ভান। কয়েকবছরে অজস্র গুলি চলেছে, বদমাসগুলোকে তিনি যেমন মেরেছেন তাঁর বাহিনীর লোকও কিছু মরেছে। এবার বেশ কিছুদিন ওরা চুপচাপ। ওই আকাশলাল আর তার তিন সঙ্গীকে ফাঁসিতে লটকালেই চিরকালের জন্যে ঠাণ্ডা হয়ে যাবে ওদের লড়াইয়ের চেষ্টা। অথচ এই ছোট্ট কাজটাই করা যাচ্ছে না।
ভার্গিস চুরুট ধরালেন। ওরা শাসনব্যবস্থা পাল্টাতে চায়। বোর্ড এবং তাঁদের নিয়োগ করা মন্ত্রিপরিষদের ওপর ওদের আস্থা নেই। স্বৈরাচারী শাসক বলে মনে করে জনগণবিপ্লবের ডাক দিয়েছে ওরা। ভার্গিসকে এসব করতে হচ্ছে যেহেতু তিনি নিজেকে একজন বিশ্বস্ত সৈনিক বলে মনে করেন। মাঝে মাঝে মনে প্রশ্ন আসে, কার প্রতি তিনি বিশ্বস্ত? যারা ক্ষমতায় আছে না এই দেশের প্রতি! উত্তরটা বড় গোলমেলে।
ভার্গিস বেরিয়ে এলেন। ফিনফিনে জ্যোৎস্নায় তাঁর জিপ সেপাইদের স্যালুট অবজ্ঞা। করে পথে নামল। এই মুহূর্তে ড্রাইভার গন্তব্য জানার জন্যে অপেক্ষা করছে বুঝে তিনি আদেশ দিলেন, ধীরে ধীরে শহরের সব রাস্তায় পাক খাও। কোথাও দাঁড়াবে না আমি না বললে।’
জিপের পেছনে তাঁর দুজন দেহরক্ষী অস্ত্র নিয়ে বসে। আর কাউকে সঙ্গে নেননি তিনি। মাঝরাতে এইরকম ঘুরে বেড়ানো পাগলামি হতে পারে কিন্তু তাঁর যে ঘুম আসছিল না। তাছাড়া কে বলতে পারে নির্জন রাজপথে ঘোরার সময় কোনও ক্লু তিনি পেয়েও যেতে পারেন।
ভার্গিস দেখলেন ফুটপাথে বেশ কিছু মানুষ মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে। উৎসবের জন্যে আগে ভাগে এসে পড়েছে এরা। পকেটে টাকা নেই যে হোটেলে থাকবে। এদের মধ্যে আকাশলাল যদি শুয়ে থাকে তাহলে তিনি ধরবেন কি করে! উৎসবটা আর হওয়ার সময় পেল না! তিনি বাঁ দিকের ফুটপাথ ঘেঁসে গাড়ি দাঁড় করাতে বললেন। জিপ দাঁড়াল। ভার্গিস দেহরক্ষীদের বললেন, ‘ওই আটজন ঘুমন্ত মানুষকে তুলে নিয়ে এসো এখানে।’
দেহরক্ষীরা কঠোরভাবে আদেশ পালন করল। আচমকা ঘুম ভাঙা আটজন দেহাতি মানুষ কাঁপতে কাঁপতে জিপের পাশে এসে দাঁড়াল। এদের অনেকেই চাদর মুড়ি দিয়ে থাকায় ভার্গিস আদেশ করলেন সেগুলো খুলে ফেলতে। তারপর জোরালো টর্চের আলোয় একে একে মুখগুলো পরীক্ষা করলেন। আটনম্বর লোকটার নজর তাঁর ভাল লাগল না। টর্চের আলো ওর মুখ থেকে না সরিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোর নাম?’
‘হুজুর।’
‘নাম বল?’
‘ফাগুলাল।’ চিঁচিঁ করে জবাব দিল লোকটা।
‘কোথায় থাকিস?’
‘ওরেগাঁও।’
‘আকাশলাল তোর কে হয়?’
‘কৌন?’
‘আকাশলালের নাম শুনিসনি?’
‘না। আমাদের গ্রামে কেউ নেই।’
ভার্গিস দেহরক্ষীকে হুকুম করল আকাশলালের ছবি দেখাতে। দেওয়ালে লটকানো পোস্টারটাকে দেহরক্ষী খুলে নিয়ে এসে লোকটার সামনে ধরল। ভার্গিস জিজ্ঞাসা করলেন, ‘চিনিস?’
বোকার মত মাথা নাড়ল লোকটা, না।
দেহরক্ষীদের উঠে আসতে ইশারা করে চালককে জিপ ছাড়ার নির্দেশ দিলেন তিনি। এই এক ঘটনা সব জায়গায় ঘটছে। কোনও শালা ওকে চেনে না। কথাটা যে মিথ্যে তা শিশুও বলে দেবে। কিন্তু মিথ্যেটা প্রমাণ করা যাচ্ছে না। জিপ চলছিল সাধারণ গতিতে এ পথ থেকে ও পথে। এত রাত্রে কোনও গাড়ি নজরে পড়ছিল না। পাহাড়ি শহরে সময় গাড়ি চলার কথাও নয়। ঘুরতে ঘুরতে তিনি চাঁদি হিলসের রাস্তায় চলে এলেন। এবং তখনই তাঁর নজরে পড়ল ফুটপাথে এক বৃদ্ধা চিৎকার করে কাঁদছে। বৃদ্ধার পাশে একটি শরীর শুয়ে আছে। হয়তো ওর কেউ মরে গেছে। এই ধরনের সাধারণ শোকের দৃশ্যে না যাওয়াই ভাল কিন্তু তাঁর কানে এল চিৎকারের মধ্যে পুলিশ শব্দটা বেশ কয়েকবার উচ্চারণ করল বৃদ্ধা। পুলিশকে গালিগালাজ করছে যেন। তিনি জিপ থামিয়ে নেমে পড়লেন। খানিকদূরে জনাচারেক মানুষ উবু হয়ে বসে শোক দেখছিল। পুলিশ দেখে তারা সরে পড়ার চেষ্টা করতেই ভার্গিস ধমকালেন, ‘কেউ যাবে না। দাঁড়াও!’
লোকগুলো দাঁড়িয়ে গেল। একদম চোখের সামনে পুলিশ দেখে বৃদ্ধা হকচকিয়ে চুপ মেরে গেল। ভার্গিস তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কে মরেছে?’
‘আমার ছেলে। একটাই ছেলেকে মেরে ফেলল।’ বৃদ্ধা ককিয়ে উঠল।
‘কে মেরেছে?’
বৃদ্ধা জবাব না দিয়ে ফোঁপাতে লাগল।
‘কে মেরেছে বল তার শাস্তি হবে।’
হাউহাউ করে কাঁদল বৃদ্ধা, ‘পুলিশ মেরেছে।’
‘পুলিশ!’ এটা আশা করেননি ভার্গিস। তাঁর কাছে তেমন কোনও রিপোর্টও নেই। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘পুলিশ তোমার ছেলেকে কেন মারল?’
‘ও টাকার লোভে পুলিশের কাছে গিয়েছিল। পুলিশ ওকে খুব পিটল। তবু ছেলে হাঁটতে হাঁটতে ফিরে এল। বললাম হাসপাতালে যেতে। গেল না। বলল, হাসপাতালে গেলে পুলিশ আবার মারবে। তারপর সন্ধেবেলায় শুয়ে শুয়ে হঠাৎ মুখ থেকে রক্ত তুলল। তুলতে তুলতে মরে গেল।’
‘কারা ওকে টাকার লোভ দেখিয়েছিল?’ ভার্গিস গন্ধ পেলেন।
‘জানি না হুজুর। বলেছিল পুলিশকে একটা খবর দিতে যেতে হবে।’
‘ওর মুখ থেকে চাদর সরাও।’
বৃদ্ধা কাঁপা হাতে চাদরটা সরালে ভার্গিস টর্চের আলো ফেললেন। হ্যাঁ, এই লোক। এই লোকটাকে খুঁজে বের করতে বলেছিলেন তিনি সোমকে। সোম গিয়ে বসে আছে বাবু বসন্তলালের বাংলোয় আর এই লোকটা ফুটপাথে মরে পড়ে আছে। নিশ্চয়ই ধোলাইয়ের সময় পেটের কিছু জখম হয়েছিল! এই লোকটার কাছ থেকে কোনও খবর পাওয়া যাবে না। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ও মরে যাওয়ার পর কেউ দেখতে এসেছিল?’
‘হুজুর, পুলিশের হাতে মার খেয়ে মরেছে শুনলে কেউ কাছে আসে?’
‘আঃ। পুলিশের হাতে মরেছে বলছ কেন? ও তো দিব্যি হেঁটে ফিরে এসেছিল। ঠিক আছে। আমার লোক আসছে। ওর মৃতদেহ ভাল করে সৎকার করে দেবে।’ ভার্গিস জিপের দিকে ফিরে চললেন। দেহরক্ষীরা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর ব্যাপারে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি ইশারায় তাদের ছেড়ে দিতে বললেন। তাঁর মনমেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। একটা ভাল ক্লু হাতছাড়া হয়ে গেল। ওয়ারলেসে তিনি মৃতদেহ সরাবার হুকুম জানিয়ে দিলেন।
ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে ছিল আকাশলাল। এই দুটো রাত তার পক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডাক্তার বলেছেন কোনও রকমে টেনসনের মধ্যে থাকা ওর স্বাস্থ্যের পক্ষে মারাত্মক হবে। কথাটা শুনে হেসেছিল সে। তারপর সহকর্মীদের অনুরোধে ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে ছিল।
সন্ধের পরেই খবরটা এসেছিল। যে মানুষটিকে ডেভিড পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে পাঠিয়েছিল সে মারা গিয়েছে। লোকটা সাধারণ মানুষ, খুব গরিব, ফুটপাথে বাস করত। কিন্তু তাকে যখন বলা হয়েছিল এটা আকাশলালের কাজ তখন সে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়েছিল যেতে। যদিও এখন অনেকে বলছে সে টাকার লোভে অতবড় ঝুঁকি নিয়েছিল কিন্তু কথাটা যে সত্যি নয় তা মানুষের জানা উচিত। কিন্তু এই খবরটা আকাশলালকে জানাতে গিয়েও জানাতে পারেনি ডেভিড। মানুষটার টেনসন আরও বাড়বে। সে এবং হায়দার আলোচনা করেছিল এই অবস্থায় লোকটির দেহ কোন্ মর্যাদায় সৎকার করা সম্ভব। ঠিক হয়েছিল ভোর রাত্রে কয়েকজন কর্মী যাবে শববাহক হিসেবে। কারণ মধ্যরাত্রে রাজপথ নিরাপদ নয়। অথচ মাঝরাতের পর খবরটা এল। স্বয়ং পুলিশ কমিশনার লোকটির মৃতদেহ আবিষ্কার করেছেন এবং তাঁর নির্দেশে পুলিশ সৎকারের ব্যবস্থা করেছে। ব্যাপারটা তাদের হতাশ করেছিল। মৃতদেহ দেখে সাধারণ মানুষ যাতে সরকারের ওপর আরও ক্রুদ্ধ না হতে পারে তার ব্যবস্থা করেছেন সি পি।
ডেভিড সিগারেট ধরাল। এখন চব্বিশ ঘন্টায় চার ঘন্টা ঘুমানো অভ্যেস হয়ে গেছে। কয়েকবছর ধরে এই জীবন। সে, হায়দার আকাশলাল অথবা যারা মরে গেছে ইতিমধ্যে তাদের প্রত্যেকের জীবনে এই শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার দগদগে ঘায়ের মত রস ঝরিয়েছে। এর বদলা নেবার জন্যে তিলতিল করে তারা তৈরি হয়েও শেষপর্যন্ত মুখ থুবড়ে পড়ছে বারংবার। এইবার শেষবার। কিন্তু লোকটাকে রক্ষা করার দায়িত্ব তার নেওয়া উচিত ছিল। এখনও এই ঘর থেকে না বেরিয়েও শহরের যে-কোনও জায়গায় যা কিছু করার ক্ষমতা তাদের আছে। আকাশলাল নিশ্চয়ই তার কাছে কৈফিয়ত চাইবে। নিজের কাছেও তো সে কোনও কৈফিয়ত দিতে পারছে না।
টেলিফোন বাজল। ডেভিড সময় দিল কিছুটা। এই রাত্রে কেউ চট করে রিসিভার তোলে না। টেলিফোনটা সাতবার আওয়াজ করার পর সে রিসিভার তুলল, ‘হ্যালো!’
‘বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক। তিননম্বর চেকপোস্ট থেকে বলছি। এইমাত্র লাল মারুতি চেকপোস্ট পার হয়ে গেল।’ লোকটা দ্রুত বলে ফেলল।
‘এত রাত্রে। ঠিক আছে।’ রিসিভার নামিয়ে রাখল ডেভিড। সে ঘড়ির দিকে তাকাল। আর আধ ঘন্টার মধ্যে গাড়িটা শহরে ঢুকছে। লোকটার সঙ্গে কথা বলার দায়িত্ব হায়দারের। ডেভিড উঠল। পাশের ঘরে হায়দার লম্বা কৌচে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। আকাশলালের একটা লাইন মনে পড়ল, ‘ঘুম, তুমি আমার খুব প্রিয়, কিন্তু আমার হাতে সময় নেই তোমায় সঙ্গ দেবার।’ ডেভিড হায়দারকে তুলল। যতই ঘুমে আচ্ছন্ন থাকুক এক ডাকে উঠে পড়ার অভ্যাস তৈরি হয়ে গেছে। ডেভিড তাকে টেলিফোনটার কথা বলল। হায়দার ঘড়ি দেখল। এখন রাত সাড়ে তিনটে। ভোর হতে বেশি দেরি নেই। তিন নম্বর চেকপোস্ট দিয়ে যখন আসছে তখন সহজেই ওদের খুঁজে নেওয়া যায়।
হায়দার বলল, ‘লোকটাকে আমাদের দরকার। এত রাত্রে শহরে ঢুকলে পুলিশের হাতে পড়বে।’
ডেভিড মাথা নাড়ল, ‘তা ঠিক, কিন্তু পুলিশ ওদের কি করবে?’
‘ওদের মানে?’
‘তোমার মনে নেই, ওর সঙ্গে একজন মহিলা আছে। যদি স্বামী স্ত্রী হয় তাহলে এক দিক দিয়ে ভালই। পুলিশ বিশ্বাস করবে ওরা নিরীহ আগন্তুক।’
‘তাছাড়া ওদের কাছে নিশ্চয়ই পরিচয়পত্র আছে। ওরা এই রাজ্যের নাগরিক নয়। অতএব কিছু করার আগে পুলিশ ভাববে কিন্তু আমি চাইছিলাম না ওরা একটুও নাজেহাল হোক। এইসব লোক বিগড়ে গেলে পরে কাজ করতে অসুবিধে হয়।’
‘কি করতে চাও? ওকে তো জানানো হয়েছে কোথায় ওর ঘর বুক করা হয়েছে। নিশ্চয়ই সেখানেই উঠবে এখন। আগামীকাল যোগাযোগ করলেই হয়।’
‘ঠিক তাই। কিন্তু তার আগে দেখা দরকার ও সেই ঘরে পৌঁছাচ্ছে কি না। আমি একটু ঘুরে আসছি।’ হায়দার দ্রুত সাজবদল করতে বসল। মিনিট তিনেকের মধ্যেই তার চেহারা একজন দেহাতি মানুষ যে শহরে উৎসব দেখতে এসেছে তেমন চেহারা নিয়ে নিল। ডেভিড আপত্তি করল না। এ ব্যাপারে তার নিজের ওপর আস্থা না থাকলেও হায়দারের ওপর ভালভাবে আছে।
এই বাড়িটা অদ্ভুত। নীচে গোটা তিনেক ডিপার্টমেন্টাল শপ। তাদের পাশ দিয়ে ওপরে ওঠার যে সিঁড়ি তা দিয়ে দোতলায় পৌঁছানো যায়। সেখানে তিনজন বৃদ্ধ যাজক থাকেন। এঁরা তেমন নড়াচড়া করতে পারেন না। চাকরই সব কাজ করে দেয়। মাঝে মাঝে জানলায় যাজকদের দেখা যায়। দোতলায় পাঁচটি ঘর। প্রতিবেশীরা কৌতূহলী হয়ে প্রথম প্রথম এখানে এসেছিল। কিন্তু বৃদ্ধদের একঘেয়ে বিরক্তিকর কথাবার্তায় আয় এদিকে আসার কথা ভাবেনি। এই তিনজন বৃদ্ধ মানুষকে সামনে রেখে ডেভিডদের আপাত আশ্রয়। বাড়িটার পেছন দিকে একটা ঘোরানো সিঁড়ি দিয়েই যাতায়াত। ওদিকে কারও নজর পড়ার উপায় নেই। কারণ সেখানে একটা সিনেমা হলের বিশাল পাঁচিল রয়েছে। এই তিন বৃদ্ধ আকাশলালকে স্নেহ করেন, তার জন্যে প্রার্থনা জানান কিন্তু একই বাড়িতে থেকেও কখনও দেখা করেন না।
হায়দার রাস্তায় নেমে দেখে নিল দুদিক। পুলিশের গাড়ির কোনও চিহ্ন নেই। মাইনে করা লোকেরা যতই টহল মারুক শেষরাত্রে হাই তুলবেই। সে দ্রুত পা চালাল। দলে তাকে এই হাঁটার ধরনের জন্যে খরগোস বলে ডাকে কেউ কেউ। শেষপর্যন্ত সে সেই রাস্তায় পৌঁছাল যেখানে মানুষজন ফুটপাথেই মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে। এখন চারপাশে বেশ কুয়াশা। দূরে জিপের আলো দেখতে পেয়ে সে চট করে ফুটপাথে অন্যান্যদের পাশে শুয়ে পড়ল। জিপটা খুব ধীরে ধীরে আসছে। এত ধীরে যে দরজা খুলে ওঠা যায়। কুয়াশা থাকায় আরোহীদের দেখা যাচ্ছে না। যদিও অনুমান করতে কোনও অসুবিধে হবার কথা নয়। জিপটা বাঁদিকে বাঁক নিতেই উল্টো দিক থেকে আর একটা গাড়ির আলো দেখা গেল। জিপটা সরে এল মাঝ রাস্তায়।
গাড়ির ব্যাপারস্যাপার স্বজনের চেয়ে সোম ভাল জানেন, প্রথম দিকে এমনটা মনে হয়েছিল। স্বজন গাড়ি চাল্লাচ্ছিল সাবধানে। পাশে সোম বসে, পেছনে পৃথা। গাড়িটা শব্দ করছে খুব কিন্তু অন্য কোনও ঝামেলা পাকাচ্ছে না। পেট্রলের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল না। যদিও দরজার চেহারা খুব হাস্যকর। সোম জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনারা উৎসব দেখতে যাচ্ছেন?’
‘উৎসব? কিসের উৎসব?’
‘ওঃ। আপনারা এমন সময়ে এখানে এসেছেন যে সময়টার জন্যে পাহাড়ের মানুষ উন্মুখ হয়ে থাকে। ছোট ছোট গ্রাম থেকেও মানুষ ছুটে আসে শহরে। দিনটা পরশু।’
‘কোনও ধর্মীয় ব্যাপার?’
‘ব্যাপারটা ধর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই এখন।’ সোম স্বজনকে ভাল করে দেখল, ‘তাহলে এমনি আসা হচ্ছে? টুরিস্ট?’
‘হ্যাঁ। বেড়াতে এসে কাজ করা আমি একদম পছন্দ করি না।’ ‘পেছন থেকে পৃথা বলল।
‘ভাল। খুব ভাল। কিন্তু উঠবেন কোথায় তা ঠিক করেছেন। এখন খুব ভিড় শহরে।’
‘ওরা ঠিক করে রেখেছে।’ স্বজন উত্তর দিল।
‘কারা?’
‘যাদের আমন্ত্রণে আমি এসেছি।’ স্বজন হাসল।
‘আমরা সেখানে উঠব না। উঠলেই ওরা তোমাকে দিয়ে কাজ করাবে।’ পৃথা প্রচণ্ড আপত্তি জানাল, আচ্ছা, আপনার জানাশোনা ভালো হোটেল আছে?’
সোম হাসল, ‘বিস্তর। আমি বললে ওরা নতজানু হয়ে ঘর দেবে, পয়সা নেবে না।’
‘সে কি? কেন?’ পৃথা অবাক।
‘এখানে পুলিশের বড়কর্তার গুডবুকে সবাই থাকতে চায়। অবশ্য আমি আর পুলিশের কোনও কর্তাই নই। খবরটা পেয়ে গেলে ওরা পাত্তা দেবে না বলেই মনে হয়।’
স্বজন তাকাল, ‘আলাপ হবার সময় এই কথাটা একবার বলেছিলেন। ব্যাপারটা কি?’
‘আমাকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। এই সরকারের বিরুদ্ধে একদল মানুষ দীর্ঘদিন ধরে বিদ্রোহ করতে চাইছে। অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও তাদের নেতাকে ধরা যাচ্ছে না। প্রচুর টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা সত্ত্বেও জনসাধারণ তাকে ধরিয়ে দিচ্ছে না। এই লোকটার পাতা ফাঁদে পা দিয়ে আমি বোকা বনেছি বলে আমাকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। একদিনের মধ্যে লোকটাকে খুঁজে বের না করতে পারলে আমার রক্ষে নেই।’ করুণ হয়ে গেল সোমের গলার স্বর।
‘ফাঁদটা কি ছিল?’
সোম অল্পকথায় ঘটনাটা বলল। শুধু নিজের টাকার প্রতি লোভপ্রসঙ্গ এড়িয়ে গেল।
পৃথা বলল, ‘এসব জানলে এখানে আসতাম না। যে-কোনও সময় গোলমাল হতে পারে।’
‘উৎসবের সময় কিছু হবে না।’ সোম বলল।
‘আপনি লোকটাকে খুঁজে পাবেন?’ স্বজন জিজ্ঞাসা করল।
‘খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার মত অবস্থা। আপনি কিসের ডাক্তার?’
‘কেন?’
‘এই যে বললেন কারা আপনাকে নেমন্তন্ন করে আনছে!’ কথা বলতে বলতে নাক টানল সোম, ‘পেট্রলের গন্ধ পাচ্ছি। দাঁড়ান তো একটু।’
দাঁড়াল স্বজন। ওপাশের দরজা দিয়ে নামা যাবে না। স্বজন নেমে দাঁড়ালে সেদিক দিয়ে নেমে এল সোম। পেট্রল আবার লিক করছে। পৃথাকে নামিয়ে সিট তুলে পেট্রল ট্যাঙ্কের তলায় হাত ঢুকিয়ে আরও কিছুক্ষণ মেরামতির চেষ্টা করল সোম। তারপর বলল, ‘যা তেল আছে আপনারা শহরে পৌঁছে যেতে পারবেন।’
‘আপনি?’ স্বজন জিজ্ঞাসা করল।
‘এরপর আপনার গাড়িতে গেলে ভার্গিস আমাকে ছিঁড়ে খাবে।’
‘ভার্গিস কে?’
‘যাকে কেউ কখনও হাসতে দ্যাখেনি। আমাদের কমিশনার।’
‘আপনি তো শহরেই ফিরবেন?’
‘হ্যাঁ। শহরে ঢুকতে হলেই একটা চেকপোস্ট পড়বে। ওরা দেখুক আমি চাই না।’
‘তাহলে আপনার সঙ্গে দেখা হচ্ছে না?’
‘শহরে যখন থাকছেন তখন দেখা হয়ে যাবেই।’
স্বজন গাড়ি চালু করে বলল, ‘লোকটা ভালই।’
‘ওপর-চালাক।’‘ পৃথা মন্তব্য করল।
এরপর ওরা তিন নম্বর চেকপোস্টে পৌঁছাল। পরিচয়পত্র দেখিয়ে ছাড়া পেয়ে জোরে গাড়ি ছুটাতে গিয়েও পারা যাচ্ছিল না কুয়াশার জন্যে। যত ওপর উঠছে তত কুয়াশা বাড়ছে। শেষপর্যন্ত শহরের আলো চোখে পড়ল। ঢোকার মুখেই পুলিশের একপ্রস্ত জেরার সামনে পড়তে হল। পৃথার কথা মনে রেখে স্বজন নিজেদের পরিচয় দিল টুরিস্ট হিসেবেই। পথে গাড়ি খারাপ হওয়ায় দেরি হয়ে গেছে।
শহরটা ঘুমাচ্ছে। দুপাশের ঘুমন্ত বাড়িঘরদোর মন্দ নয়। রাস্তায় একটা মানুষ দেখা যাচ্ছে না যাকে জিজ্ঞাসা করা যায়। হঠাৎ দূরে একটা জিপের আলো দেখা গেল। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে জিপটা হঠাৎ মাঝরাস্তায় চলে গেল আটকে দেওয়ার ভঙ্গিতে। স্বজন অবাক হল। সে ইঞ্জিন বন্ধ করতে ভরসা পাচ্ছিল না। যে-কোনও মুহূর্তেই গাড়ি অচল হয়ে যাবে। দরজা খুলে সে এগিয়ে গেল জিপের দিকে। কাছে আসতেই তার নজরে এল এক বিশালদেহী পুলিশ অফিসার তার বুক লক্ষ করে রিভলভার ধরে রেখেছে।