লেদু প্রশ্ন করা বাদ দিয়া কলা খায়া খুশি হয় এবং সে যখন জুলি ফ্লোরেন্সের কথা চানমিঞাকে বলে, মেরি টিচারের মাইয়া জুলি তর কথা জিগাস করে, তখন কি চানমিঞার মনের জানালায় তার শৈশব এসে খাড়ায়? অবাস্তব এক শিশুকালের জীবন ছিল তার, খডের কাকতাড়ুয়া পুতুলের মত ছিল ভেঙ্গে পড়ার, বাতাসে উড়ায়া নিয়া যাওয়ার শঙ্কা এবং ভয়—তখন তার কি অতীতের কুয়াশার ভিতর থেকে জুলিকে মনে পড়ে? সে লেদুর কথা শুনে বলে, কি জিগায়? ফলে বোঝা যায় যে, জুলিকে তার মনে আছে; কিন্তু তখন লেদু কি বলবে? জুলি বলেছিল, মাঙ্কিবয় কোথায়? কিন্তু লেদুতে আর চানমিঞার মুখের উপরে তা বলতে পারে না, মোটা হলেও তারতো বিবেচনাবোধ অনেক এবং সেই কারণেই হয়তো তাদের পাশের বাসার শেপালি আপা তাকে একদিন ডেকে বলে, দেখতো লেদু বন্দরে আমার বডিসটা ছাদের উপরে নিয়া গেছে নিকি, শেপালিদের ১৮নম্বর বাড়ির একতলা দালানের ছাদে যাওয়ার সিঁড়ি ছিল না, তখন লেদু আর কি করে, সে তার ভারি শরীর নিয়া দালানের দেওয়াল বায়া ছাদে উঠে দেখে যে ঠিকই একটা সাদা রঙের ব্রা ছাদের এক কিনারে পড়ে আছে। লেদু হয়তো ছাদে উঠে ক্লান্ত হয়া পড়ে, সে শেপালির ব্রাটা তার প্যান্টের পকেটে রেখে কিছুক্ষণ জিরায়, এদিকে শেপালি নিচে খাড়ায়া উপর দিকে হা করে থাকে, অনেক্ষণ যায় লেদুর কোন সাড়া শব্দ নাই, সে চোখ কুঁচকায়া ফালায়, কি করে ভোন্দা বদমাইশটা এবং তখন সে তার নাম ধরে ডাকে, লেদু, এই লেদু, কৈ গেলি তুই? তখন লেদু আবার ইটা বের হয়া যাওয়া দেওয়াল বায়া নেমে আসে, শেলি তার ব্রাটা নেয়, এবং বলে, কি করলি এতক্ষণ? লেদু বলে যে, সে কিছুই করে নাই, কিন্তু শেপালি মাইয়া মানুষ। সে এই কথা মানবে কেন, তারতো মনে সন্দেহ, সে বলে, বয়া বুয়া এইটা শুছচ, বদমাইশ! কিন্তু লেদু এইকাজ করে নাই, এইটা তার মাথায় আসে নাই, সে বলে, এইসব কাম আমি করি না, এবং শেপালি তখন উল্টা ক্ষেপে, সে সদ্য বিবাহিতা সুন্দরী মাইয়ালোক, প্রোষিতভর্তৃকা, তার জামাই আব্দুর রহমান তাকে বিয়া করার একমাস পর কাতার চলে যায়, এখন সে ক্যাসেটে ইনায়াবিয়া কথা টেপ করে বৌয়ের কাছে পাঠায়-কেমন আছ তুমি, অনেকদিন তুমার চিঠিপত্র কিছু পাই না—এবং তখন বান্দর ব্রা নিয়া গেলে শেপালি যখন লেদুকে দেখে, সে ভাবে যে, এই মোটকাটারে খাটাই; কিন্তু লেদুর কথা শুনে সে বলে, এইসব কাম করছ না, কি করচ, আহারে ফেরেস্তা! লেদু তখন কি বলবে? সে কিছু বলে না, এবং তারপর একদিন শেপালি লেদুকে ডাকে, তাদের বাড়ির ভিতরে ছিল একটা গয়াম গাছ, গাছটার ডাল ছাতির মত বেঁকা হয়া ঝুলে ছিল নিচের দিকে, তখন একটা ডালে একদিন একটা পাকা গয়াম দেখা যায় এবং দেওয়ালের উপর দিয়া শেপালি লেদুকে দেখে এবং বলে, এই লেদু গয়ামটা পাইড়া দিয়া তো। লেদু লম্বাচওড়া পোলা, কি তারপরেও দেখা যায় যে, গয়ামের ডালটা তার নাগালের ভিতরে না, সে লাফ দিয়াও ধরতে পারে না, তখন শেপালি বলে, আমারে উঁচা কইরা ধর আমি পাড়ি এবং লেদু নিচা হয়া তার হাঁটুর কাছে চেপে ধরে তাকে উঁচা করে, লেদুর মুখটা শেপালির গোল পুরু নিতম্বের উপরে চেপে বসে থাকে। শেপালি সেদিন একটা ডাল টেনে নামায়া গয়ামটা বোঁটা থেকে ছিঁড়া নেয়, তারপর তার নামা দরকার, কিন্তু মনে হয় যেন, লেদু তাকে ছেড়ে দিতে ভুলে যায়, তখন শেলি বলে, কিরে ছাড়স না ক্যাল? এবং তখন লেদু তাকে মাটিতে নামীয়া দেয়। আরেক দিন আরেকটা ডালে আরেকটা গয়াম পাকে এবং শেপালি তাদের বাসার মানুষজনের চোখ ফাকি দিয়া গায়মি পাড়ার জন্য লেটুকে ডাকে, পাইড়া দিয়া যাতে গায়ামটা; গাছের এই ডালটা হয়তো বেশি উঁচা ছিল না, নাগালের কাছেই ছিল, কিন্তু দেখা যায় যে, লেদু ধরেও ভালটা ধরতে পারে না, হয়তো লাফ দিলেই সে ধরতে পারবে, কিন্তু তার পায়ে ব্যথা হওয়ায় সে লাফও দিতে পারে না, তখন শেপলিকেই উঁচা করে ধরা লাগে, এইবার লেদু তাকে সামনে থেকে হাঁটুর নিচে চেপে ধরে উঠায়, শেপালির দুই উরুর মাঝখানে সে তার মুখ কাইত করে রাখে; তখন সে হয়তো প্রতিদিন শেপালিদের গয়াম পাড়ার প্রতীক্ষায় থাকে, এবং একদিন দেখে যে, গাছে একটা গয়াম পেকে ঝুলে আছে, কিন্তু শেপালি আপাতো তাকে ডাকে না, পাকনা গয়াম রাইতের বেলা বাদুড়ে খায়া যায়, হয়তো আন্দরেও খায় দিনে, তারপর আরো একটা পাকে, আরো একটা, কিন্তু শেপালির খবর নাই। তখন লেদু শেপালিদের বাড়িতে যায় তার মাকে বলে, খালাম্মা শেলি আশায় কৈ, এবং তখন শেলির মা তাকে বলে, শেপালিতো ওর হৌরের বাইতে গেছে, অয়তো কাতার যাইব গা; এই গয়াম পাড়ার গল্প লেদু হয়তো মামুনকে বলে, এবং মামুন জিগাস করে, আর কি করহচ? কিন্তু লেদুতে আর কিছু করে নাই, কারণ সে মোটকা পোলা, তার বিবেচনাবোধ বেশি, সে জন্যই শেলি তাকে নিয়া এইসব করে, ভাবে যে, ঝামেলা হওয়ার সম্ভাবনা নাই এবং একদিন সে মহাআনন্দের সঙ্গে শশুর বাড়ি চলে যায়। তাই মোটকা লেদুর বিবেচনাবোধ বেশি হতে পারে, সে ভাল পোলাই, যদিও শেপালির উরু এবং নিতম্বে মুখ ঘষার জন্য তার মন কিছুদিন আকুপাকু করে, কিন্তু শেপালির সঙ্গে তার আর দেখাই হয় না, তবুও সে চানমিঞাকে বলে যে, জুলি হয়তো এমনি তার কথা জিগাস করে, ছুটুকালের কথা হয়তো মনে পড়ে, ভাই জিগায়!
: খামাখা!
: ক্যালা?
: আমারে কয় মাঙ্কিবয়!
ফখরুল আলম লেদু তখন মানব জীবনের গভীর তাৎপর্য অনুধাবন করার চেষ্টা করে, বস্তুত স্মৃতির বাইরে মানুষের জীবন নাই, স্মৃতি তাকে বাচায় এবং মারে, সে চানমিঞাকে দেখে এবং নারীশিক্ষা মন্দিরের গলিতে সূর্য ডুবে যেতে থাকলে জুলি ফ্লোরেন্স সুইচ টিপা টিউব লাইট জ্বালায়া তার মার জন্য স্টিভ আর্নল্ডের আনা মাদাম বোভারি পড়ে-এই লোকটা তার মার জন্য এমন একটা বই আনলো। সে তার মাকে জিগাস করে, মা তুমি ড্যাভের বসের আনা বইটা পড়ছো?
মিসেস ক্লার্ক পড়ে নাই, স্কুলের পরীক্ষার খাতা নিয়াই সে ব্যস্ত হয়া আছে, সে বলে, পড়ি নাই, কেন?
: মাদাম বোভারিটা পইড়ো।
: কেন?
: ইটস এ স্যাড টেল অব এ ম্যারিড ওম্যান, ইন ডেসপারেট এডালট্রাস লাভ।
: আ, ইউ আর বিকামিং ভেরি পজেসিভ জুলি, আমি যথেষ্ট বুড়া হইছি।
বয়স হয়তো মিসেস ক্লার্ককে কষ্ট দেয়, পুরান হিসাবের খাতায় অনেক শূন্য, ভুল, কাটাকাটি নতুন করে হিসাবের খাতা খোলার সময় নাই, চুল সাদা হয়া গেছে, চামড়া কুঁচকায় যেতে শুরু করেছে। মেরির মন খারাপ হয়া থাকে, কারণ রবার্ট ক্লার্কের অসুখ হয়তো সাধারণ অসুখ ছিল না, রবার্ট হঠাৎ একদিন শিমুল তুলার বৈজ্ঞানিক নাম ভুলে যায় এবং ববের কারণে মেরি জয়েস কতদিন পর কেন্দে ফেলে, তার প্রৌঢ় ফরসা গালের উপর দিয়া তপ্ত ধরণিতে বহুদিন পরে আসা বৃষ্টির মত পানি গড়ায়া নামে; সে ববকে বলে, তুমি মনে করার চেষ্টা করে দেখ। কিন্তু রবার্ট পারে না, শিমুল তুলা গাছের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম সে ভুলেই গেছে, এবং এই কথা বুঝতে পারার পর মনে হয় ববের জীবন অবলম্বনহীন হয়া পড়ে; সে রবিবার সকালে মেরি এবং জুলির সঙ্গে প্রার্থনার জন্য যায়া পবিত্র জপমালার গির্জার গেট দিয়া ঢুকে প্রথম বুঝতে পারে গাছটার নাম তার মনে নাই, সে মেরিকে বলে, মেরি আই ফরগট দা নেম!
: হোয়াট নেম?।
: এই গাছটার।
: শিমুল!
: নো, দি আদার নেম!
মেরি যখন ব্যাপারটা বোঝে, সে বিশ্বাস করতে পারে না এটা কিভাবে সম্ভব, তুমি শিমুলের বোটানিক্যাল নামটাই ভুলে গেলা, শিমুল গাছের এই বৈজ্ঞানিক নামটা বলতে পারার জনাই কি তোমাকে আমি বিয়া করি নাই বব, পৃথিবীকে পিছনে রেখে তোমার কাছে আসি নাই? হায় যিশু, সে চার্চের প্রার্থনায় বিচলিত হয়া থাকে, প্রভুর কাছে কান্দে, প্রভু যিশু আমাকে দয়া কর, আমি জেনেশুনে কোন পাপ করি নাই প্রভু, আমাদেরকে দয়া কর; তখন গির্জার যাজক উপাসনা পরিচালনা করে।
যাজক : পিতা ও পুত্র ও পবিত্র আত্মার নামে।
সকলে : আমেন।
মেরি দুই হাতের দশ আঙ্গুল পরস্পর যুক্ত করে মাথা নত করে রাখে, জুলি হয়তো তার মায়ের অস্থিরতার কারণ বুঝতে পারে না, একটা বাজে কুৎসিত-গায়ে কাঁটা ভর্তি-গাছের নাম ভুলে গেলে কি হয়, তার বাপ বুড়া হচ্ছে স্মৃতি শক্তি কমে যাচ্ছে, হয়তো ডিমেনশিয়া, এরকম হতেই পারে; কিন্তু তার মা মনে হয় বেশি জানে, তার মা, মেরি জয়েসের বিষণ্ণতা যায় না, তার মন হাহাকার করে, গাছের নামই যদি ভুলে যায়া থাকে তাহলে ববের জীবনে আর অবশিষ্ট কিছু নাই, এবং সে তার মেয়েকে বলে, হি উইল নট লিভ লং!
স্টিভেন আর্নল্ডও খুবই উদ্বিগ্ন হয়, ববেরতো এই রকম হওয়ার কথা, সে ববকে ছুটি দেয়, কিছুদিন ছুটি কাটাও, বিশ্রাম নেও, দেখো সব ঠিক হয়া যাবে; কিন্তু বব বাঁচে না, লাঙ ক্যানসারের জন্য তাকে বিসমুতে ভর্তি করা হয়, তখন একদিন জুলিকে বাপের বিছানার পাশে রেখে মেরি শাহবাগ মার্কেটে যায় পেথিড্রিন ইঞ্জেকশন কেনার জন্য এবং তখন সে জাতীয় যাদুঘরের দিকে তাকায়া দেখে যে, তার ব্যক্তিগত বিপর্যয় নিয়া পৃথিবীর কোন ভ্রুক্ষেপ নাই, রাস্তায় মানুষ এবং গাড়ির স্রোত বয়া যায়, এবং যাদুঘর প্রাঙ্গণে পতািহীন শিমুল গছি ছেয়ে আছে লাল ফুলে। মেরি তখন যাদুঘরের প্রাঙ্গণের ভিতরে যায় বহুদিন পর মাটির উপর থেকে আর একটা লাল শিমুল ফুল কুড়ায় নেয় এবং সে শিমুল ফুল গাছের বোটানিক্যাল নামের খোঁজে পাবলিক লাইব্রেরিতে যায়া ঢোকে; কিন্তু শিমুলের ইংরেজি নামটাই সে ঠিকমত বের করতে পারে না, এইটা কি সিল্ক কটন ট্রি? কিন্তু এই নামে কোন ভুক্তি কোথাও নাই, এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকায় কিছু নাই, এনসাইক্লোপিডিয়া অব বোটানিক্যাল নেমস-এও কিছু নাই, অবশেষে সে বাংলাপিডিয়ায় শিমুলের বোটানিক্যাল নাম পায়, বোম্বাক্স..। একটা কাগজের টুকরায় সে নামটা লিখা আনে, ববের বেডের পাশে ফিরা এসে বলে, দেখ বব শিমুল ফুল, এবং ব্যাগ থেকে চিরকুট বের করে শিমুলের বৈজ্ঞানিক নাম পড়ে শোনায়, জুলির মনে হয় যে, মারাত্মক যন্ত্রণার ভিতরেও তার বাপের মুখে তখন একটা হাসি ছড়ায়া যায়, কিন্তু সে আর পনের দিনের বেশি বাঁচে না, তাকে নিয়া যায়া টিপুসুলতান রোডের মাথায় খ্রিষ্টানদের গোরস্থানে মাটি দেওয়া হয় এবং মেরির মাথায় দুশ্চিন্তার আকাশ ভেঙ্গে পড়ে; তখন স্টিভ আর্নল্ড একদিন আসে নারীশিক্ষা মন্দিরের গল্লির মধ্যে এবং কোন কথা খুঁজে না পায়া মেরিকে বলে, ডিড ইউ লাইক মাদাম বোভারি?
তখন মাথায় কালো স্কার্ফ জাড়ায় শোকার্ত পীড়িত মেরি চুপ করে থাকে, সে মাদাম বোভারি পড়েই নাই, সে স্টিভেন আর্নল্ডকে বলে, ক্যান। ইউ হেলপ মাই সান টু গো এব্রভ, সামহোয়্যার? এবং মেরির এই উদ্যোগের ফলে যোসেফ ইউজিনের জন্য এক সঙ্কট তৈরি হয়, কারণ শাকিলা বানুকে সে বিজি প্রেসের জব সেকশনে বসে বলে যে, তার এইসব আর ভাল লাগে না, এবং তার দিকে তাকায়া নাখালপাড়ার শাকিলা বানু অফিসের টেবিলের কাঠের উপরে নখ দিয়া সরু দাগ কেটে একটা এক্কাদোক্কা খেলার ঘর বানায়-শেষ পর্যন্ত খ্রিষ্টান পোলা যোসেফ মিস্ত্রির সঙ্গে, এইটা কিভাবে শুরু হইলো? বিজি প্রেসের জব সেকশনে শাকিলা বানুর সহকর্মীদের মনে হয় যে, এইগুলি কিছু না, খামাখা; শাকিলার বাপ ফারুক হোসেন যখন চাকরি থেকে অবসরে যায় তখন সিবিএ-র নেতাদের চাপে পড়ে তার বড় মেয়ে বিএ পাশ শাকিলাকে জব সেকশনে চাকরি দেওয়া হয়, সারাদিন শাকিলা চেয়ার টেবিল নিয়া বসে থাকে, কাজের রিকুইজিশন যখন তার টেবিলে এসে পৌছায়, সে একটা লেজার বইয়ে তার বিবরণ লিখে একটা নাম্বার লাগায়া নির্দিষ্ট সেকশনে পাঠায়া দেয়। সারাদিন সে এই কাজ করে, তার সহকর্মীরা তাকে দেখে, সে কালা না, ফরসাও না, শরীর স্বাস্থ্যও খারাপ না, কিন্তু তার উপরের দাঁতের পাটি দোতলার ব্যালকোনির বারান্দার মত ঝুলে থাকে, ফলে সে হাসে না, দাঁত ঢেকে রাখার জন্য উপরের ঠোট লম্বা করে মুখটা কাপটি মেরে রাখে এবং তাকে নিয়া বিজি প্রেসের অবিবাহিত কর্মচারিদের কোন আগ্রহ হয় না, বাইন্ডিং সেকশনের এক আইএ ফেল দপ্তরিকে শাকিলার বস, সেকশন ইন চার্জ, প্রস্তাব দিয়েছিল, কাজ হয় নাই। তখন কিভাবে যোসেফের সঙ্গে তার দেখা হয়, কিভাবে হয় সেটা এক রহস্য, তবে যোসেফ একদিন দুপুর বেলা কালিমোবিল মাখা অবস্থায় শাকিলার টেবিলে এসে বসে এবং বলে, তাহইলে খাওয়ান, এবং তার এই কথা শুনে জব সেকশনের লোকেরা শিহরিত হয়, বলে কি লোকটা, এই দেশে নারীকে খাওয়াইতে বলাটা সাংঘাতিক এক ব্যাপার, কারণ এই দেশে নারীকেও খাদ্য দ্রব্যের মত খাওয়া হয়, কি খাওয়াবে শাকিলা, কি খাইতে চায় এই খ্রিষ্টানের পোলা খ্রিষ্টান-ব্যাপার কি? এটা বোঝা মুশকিল হয় যে, ব্যাপার কি, কিন্তু মনে হয় মেয়েটা হয়তো ভাবে নাই যে, যোসেফ মিস্ত্রি সত্যি এতগুলা লোকের সামনে এসে তার টেবিলে বসে পড়বে, তখন শাকিলা তাকে তাড়াতে পারে না, ফলে সে টিফিন বক্সে করে আনা হাতে বেলা রুটি আর ডিম ভাজি বের করে সকলের চোখের সামনে ভাগ করে খায়; যোসেফ ইউজিন দেড়খান রুটি এবং পিয়াজকাচা মরিচ দিয়া ভাজা ডিমের আদ্দেকটা খায়া একটা ঢেকুর উঠায়া বলে, পেট ভইরা খাইলাম, ফলে তখন ঠোটের প্রতিরোধ ভেঙ্গে শাকিলার দাঁতের সারি বের হয়া পড়ে এবং সে তার হাত ব্যাগ খুলে এক টুকরা টিসু কাগজ বের করে যোসেফের দিকে আগায়া দেয়, যোসেফ সেটা নিতে যায়া শাকিলার আঙ্গুল স্পর্শ করে। শাকিলা হয়তো ঘরে বসে দুই দিন কাপে, তার জব সেকশনের সহকর্মীরা ভাবে মাইয়ালোকগুলা খালি ফাঁকি দেয়, অপিসে না আসতে পারলেই খুশি, কিন্তু তার পর দিন কিংবা আরো ২/৩ দিন পরে সে ফেরে, এবং হাতে করে তিন ডিব্বার একটা ছোট টিফিন ক্যারিয়ার নিয়া আসে, জব সেকশনের কেরানিরা চোখ গোল করে দেখে দুপুর বেলা শাকিলা তাদের সেকশনের পিয়নকে পাঠায় যোসেফ মিস্ত্রিকে খুঁজে আনার জন্য, এবং যোসেফ ইউজিন আসার পর সে তার টিফিন ক্যারিয়ার খোলে, এক বাটিতে ছিল পোলাও, একটায় মুরগির তরকারি এবং অন্য একটার মধ্যে চাইরটা টিক্কা কাবাব জাতীয় কিছু যোসেফ হয়তো বিব্রত হয়, তারপর তারা পোলাও ভাগ করে মুরগির ঝোল ঢেলে নিয়া খায়, এবং এইভাবে যোসেফ মিস্ত্রি ভূয়া যেতে থাকে। হয়তো আবার দিন দুই যায়, তারপর আবার তাকে শাকিলা খাওয়ায়, হয়তো আবার রুটি এবং ডিম ভাজি, তখন বিজি প্রেসের লোকেরা বুঝতে পারে যোসেফ মিস্ত্রিকে জব সেকশনের শাকিলা বানু কি খাওয়ায়, ডিমরুটিপোলাও/মুরগির গোস এইসব, তখন হয়তো তাদের মনে হয় যে, এইগুলি খাওয়াইলে দোষ নাই, খাওয়ার জন্য যোসেফের পাতে নিজেকে ভুলে না দিলেই হল, অথবা দোষ কি সত্যি নাই? কারণ, এইসব আচরণ কি মানুষকে বিপথে নিয়া যাওয়ার জন্য খোঁচায় না? অবশ্যই খোঁচায়, প্ররোচিত করে, এবং এই ব্যাপারে কোন সন্দেহ থাকে না যে, শাকিলা এবং যোসে ইউজিন এই খেচানিতে পড়ে, যোসেফ নাখালপাড়ায় শাকিলাদের বাসায় পর্যন্ত যায় হাজির হয়, শাকিলার মা ফিরোজা বানকে, খালাম্মা খালাম্মা করে আল্লাদ দেখায়, শক্ত খটখটা পাকন পিঠা দিয়া চা খায়া বিদায় নেওয়ার সময় বলে, যাই খালাম্মা, আসসালামালেকুম; এবং যোসেফ মিস্ত্রির এই আচরণে শাকিলা বানু খুশি হয়, তার বুকের উপর থেকে একটা ভার নেমে যায়, শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়া আসে, এবং তার মা যখন বলে, অরে মুসলমান হইতে ক, সে বলে, কমু!
কিন্তু শাকিলা কি যোসেফকে সত্যি মুসলমান হতে বলে? হয়তো বলে; হয়তো বলে যে, তার মা চায় তারা বিয়া করুক, কিন্তু সমাজ সংসার ধর্ম আছে, আছে না? এবং তখন যোসেফ মিস্ত্রি কি বলে? হয়তো সে তোতলায়, হয়তো রাগ করে, হয়তো কিছুই না বলে চুপ করে থাকে, এবং শাকিলা বানু তার মৌন মুখের দিকে তাকায়া এলোমেলোভাবে কিসব বলে, সে হয়তো তার এই সম্ভাবনার দুয়ার বন্ধ করতে চায় না। ফলে তখন হয়তো আরো ২/৪ কিংবা ১০ মাস যায়, ঢাকার আকাশে মেঘ গুরুগুরু করে বৃষ্টি হয়, বৃষ্টির পর শীত আসে এবং শাকিলার তখন খুব ঠাখ লাগে বলে সে পায়ে মুজা পরে অফিসে যাতায়াত করে, যোসেফ মিস্ত্রি তা দেখে হাসে, স্যান্ডেলের সঙ্গে মুজা পর, তুমি একটা খ্যাত, সে বলে এবং শাকিলার দন্ত রাজি মুক্ত এবং তার মুখ আরক্তিম হয়, কিন্তু তখন শাকিলার মায়ের অস্থিরতা চরম অবস্থায় যায় ঠেকে, তার ভাইদের ফাইটা পড়ার দশা হয় এবং পূর্ব নাখালপাড়ার মাস্তান পোলাপান একদিন শাকিলাদের বাসা থেকে ফেরার সময় যোসেফ ইউজিনকে এমপি হোস্টেলের কাছে থামায়, তারা তাকে চড় থাপ্পড় ঘুসি মেরে রক্তাক্ত করে ফেলে, সে তখন দৌড় দেয়, হোস্টেলের গেট পার হয় ভিতরে যায় ঢোকে-গেটের পুলিশ দেখে মাস্ত নিরা ফিরা যায়। নাখালপাড়ার পোলাপানদের হাতে মাইর খায়া, চিবুকে থুতনিতে কাটা দাগ নিয়া যোসেফ ইউজিন পরদিন কাজে যায়, সে বলে যে, সে রিকসা থেকে পড়ে যায় আহত হয়েছে, কিন্তু মহল্লায় যোসেফকে মারার ঘটনার কথা শাকিলা বানু শোনে, সে তাদের বাসায় ঘরের ভিতরে সুখ লুকায়া কান্দে। তখন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান কল্যাণ সমিতি-এর বিজি প্রেস শাখার সদস্য নিমচন্দ্র বনিকের সঙ্গে যোসেফের দেখা হয়, নিমচন্দ্র লাইনো মেশিনে টাইপ সেটিংয়ের কাজ করে এবং তেজগাও সাতরাস্তার মোড়ে বিজি প্রেস কলোনিতে থাকে, যোসেফের সঙ্গে তার খাতির আছে, ফলে যতই যোসেফ বলুক রিক্সা থেকে পড়ে যায় তার মুখ ফাটছে, নিমচন্দ্রের বিশ্বাস করা কঠিন হয়, সে তাকে বলে, যোসেফ দাদা কি হইছে? কিন্তু যোসেফলতা কিছু বলে না, অথবা হয়তো সে বলে, এবং নিমচন্দ্র সব কিছু শুনে যোসেফকে জিগাস করে, ভুমি শাকিলারে ভালবাস?
: কি জানি।
: বিয়া করবা?
: মুসলমান হইতে বলে!
যোসেফ ইউজিন হয়তো ভেবে দেখার চেষ্টা করে যে, কিভাবে এত কিছু হয়া গেল, শাকিলার মত একটা মেয়ের জন্য সে এতকিছু করলো, কেন? প্রেম হয় নাই কি? তখন নিমচন্দ্র বনিক বলে, শাকিলারে খাইছো?
নারীকে খাওয়ার কথা আবার উচ্চারিত হয় এবং যোসেফ মিস্ত্রি চুপ করে থাকে।
: খাইতে চাইলে খায়া দেও, জায়গা লাগলে আমারে বইলো!
ফলে যোসেফের জন্য মেরি চিন্তিত হয়, সে রবার্টের মৃত্যুর পর তাদের নারীশিক্ষা মন্দিরের গল্লির বাসায় বসে স্টিভেন আর্নল্ডের দিকে তাকায়া যখন বলে, ক্যান ইউ হেল হিম, মাই সান? আই ওয়ান্ট টু সেল্ড হিম এওয়ে কুইকলি, তখন স্টিভেন আর্নল্ড বোঝে, সন্তানের বাইরে নারীর জীবন নাই, এবং সে বলে যে, সে চেষ্টা করে দেখবে; এবং এর ফলে মেরি জয়েসের জীবনে নতুন বিপর্যয় নেমে আসে। কারণ স্টিভেন দ্রুতই যোসেফ ইউজিনের ইংল্যান্ড যাওয়ার ভিসা যোগাড় করে দেয়, যোসেফ লন্ডনের উত্তরে মিডকান্ট্রি শহর বার্মিংহামে যায় বসতি গাড়ে, মার্কল এন্ড স্পেনসর-এর দোকানে সেলসম্যানের কাজ নেয়, সে টেসকো সুপার স্টোরে বাজার করে, তামাক এবং পত্রিকার দোকানে সাদা বুড়ি মহিলাদের সঙ্গে খাড়ায়া এক পাউন্ডে লোটোর বাজি খেলে, রান্নার আলসিতে বার্গার কিংয়ের চিকেন বার্গার খায়া কাটায়, তার জীবনে হয়তো একটা পরিবর্তন এসে যেতে থাকে, কিন্তু গায়ের রঙের কারণে তার যোসেফ ইউজিন হয়া ওঠা কঠিন হতে থাকে, ডাউন টাউনে তার দোকান থেকে ক্যানেলের পাশ দিয়া একদিন হেঁটে বাসার দিকে ফেরার সময় বার্মিংহাম সী একুইরিয়ামএর কাছে কয়েকজন মধ্যবয়স্ক শেতাঙ্গ তার মুখের দিকে তাকায়া নির্লিপ্তভাবে তাকে পাকি বলে গাল দেয়। তখন ম্যানচেস্টার এবং বার্মিংহামে দক্ষিণ এশীয় ও ক্যারেবীয় অঞ্চলের অভিবাসী তরুণদের সঙ্গে স্থানীয় শ্বেতাঙ্গ তরুণদের দাঙ্গা চলছিল, যোসেফ ইউজিনের ভয় লাগে, এ কোথায় আমি আইসা পড়লাম ঈশ্বর, এবং প্রভু যিশু হয়তো তার জন্য কান্দে, কারণ সেই উইকএন্ডে একটা পেচপেটা বৃষ্টি নামে এবং সে তার জীবনের প্রান্তে এসে খাড়ায়। সেই কারণে উইকএতে কাজ করলে পয়সা বেশি জেনেও যোসেফের মনে হয়, আমার ভাল লাগতেছে না-তখন সিটি কনভেনশন সেন্টারের থিয়েটার হলে স্যার এন্ড্রু ওয়েবার লয়েডের মিউজিক্যাল দা ফ্যান্টম অব দা অপরা চলছিল-যোসেফ ইউজিন ভাবে, যাই দেইখা আসি গা এবং তখন বার্মিংহাম সিটি কনভেনশন সেন্টারের বিশাল খোলা চত্বরের একপাশে গুড়িগুড়ি বৃষ্টির ভিতরে দুবৃত্তরা তাকে ছুরি মারে এবং তার পেটের নাড়িভুড়ি বের হয়া গেলে হাল্কা বাদামি সিরামিকের ইট বিছানো ভিজা চত্বরের উপরে সে পড়ে যায়।
মৃত যোসেফ ইউজিনকে তার মা বাংলাদেশে ফিরায়া আনে, কোনভাবেই সে তাকে ইংল্যান্ডে সমাহিত করতে রাজি হয় না, বার্মিংহামে বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনারের দপ্তরের মাধ্যমে সে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে, হাইকমিশনের তত্ত্বাবধানে পুলিশ যোসেফের কফিন একটা ভ্যানে করে লন্ডন নিয়া যায়া হিথ্রোতে বৃটিশ এয়ারওয়েজের বিমানে তুলে দেয়। ঢাকায় মেরি ছেলের কফিন খুলে দেখে, সে চোখ বুজে শুয়ে আছে, সার্টের নিচে পেট জুড়ে ব্যান্ডেজ বান্ধা তাতে রক্তের শুকনা দাগ, তখন মেরি জয়েস ছেলের ক্ষতের ব্যান্ডেজের উপরে হাত বুলায়; যোসেফ ইউজিনকে রবার্টের পাশে কবর দেওয়া হয়, এবং নারীশিক্ষা মন্দিরের গল্লিতে যায় মামুনুল হাই দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করার পর একটা ছায়ার মত জুলি যখন বসার ঘরে আসে মামুন কেন্দে ফেলে, জুলি হয়তো তাকে বলে, আপনে কান্দেন কেন ভোলা পোলা, এবং জুলির বুকের ভিতর আবেগ হয়তো উচ্ছ্বসিত হয় ওঠে, প্রবল ব্যক্তিগত শোকের মধ্যেও জীবনে এই একবার তার মনে হয় যে, পোলাটার দিকে একটু গভীর করে তাকায়া মাথার চুলের মধ্যে আঙ্গুল দিয়া একটু আদর করে দেয়; তখন মামুন তার চোখের পানি মুছে নিয়া বলে যে, সে জানে না তার কেন কান্দা আসে, নাথিং ইজ গোয়িং আওয়ার ওয়ে, মাই ওয়ে জুলি, হোয়াই? কিন্তু জুলি ফ্লোরেন্সের বয়সতো ক্রমাগত বাড়ে, এবং তার সামনে অবশ্যম্ভাবী এসে খাড়ায়, কি করবে সে এখন? তার মা প্রতিদিন নিজেকে টেনে নিয়া সকালে স্কুলে যায়, দুপুরে ফিরা আসে, তারপর বিছানায় পড়ে থাকে, সে বাসায় থাকলে হয়তো পাশে যায়া বসে এবং বলে, মম লেবুর শরবত খাবা একগ্লাস, বানায়া দেব? তার মনে হয় তার মা মেরি জয়েস তলায়া যাচ্ছে, শি ইজ দ্রাউনিং, তাকে হাত বাড়ায়া ধরা দরকার; তখন সে গ্রিনহেরাল্ড স্কুলে চাকরি নেয় এবং তাদের বাইরের ঘরে বসে মামুনুল হাই এবং ফখরুল আলম লেদু বলে, টিচারের শরীর এখন কেমন? মামুনুল হাই সম্প্রতি ইস্টার্ন ব্যাংকের চাকরিতে যোগ দেয়, এভিপি, জুলি তাকে বলে, আমাদেরকে খাওয়াবেন না? তখন মামুনুল হাইয়ের হয়তো তেষ্টা পায়, জুলি ভিতরে মায়া কাচের জগে করে পানি নিয়া আসে, গ্লাসে ঢেলে মামুনকে দেয়, লেদুকে জিগাস করে, আপনেকে দেব লেদু ভাই? তখন লেদু বলে, জালো জুলি চানমিঞার সঙ্গে দেখা হইছিল, সে তোমার উপরে খুব ক্ষেপা, তুমি নাকি ছুটু বেলায় ওরে মাঙ্কিবয় বলছিলা, সে সেইটা ভোলে নাই; এবং তখন দেখা যায় যে, মাবিয়ের কথায় জুলির নিরুত্তাপ বিষ জীবনে উত্তেজনা বাড়ে, সে বলে, কোথায় পাইনে তাকে, আমি তাকে মাঙ্কিয় কেন বলব, আশ্চর্য! কিন্তু চানমিঞার তখন অন্যরকম অবস্থা, সে তখন দা কার থিফ অফ ঢাকা, তার সঙ্গে হয়তো লেদুর দেখা হয়, চাঁনমিঞা কোন এক ব্র্যান্ডের গাড়ির উপরে দুইচাইর দশটা বান্দর নিয়া মহল্লার গল্লির মধ্যে খাড়ায়া আছে, গাড়ির পিছনের সিটের উপরে রেখে দেওয়া আছে একটা আস্তা কলার ছড়া এবং বান্দরেরা এই কল ছিঁড়া খায়, হয়তো তারা চানমিঞাকেও দেয় এবং তখন লেদু যায় হাজির হয় এবং বলে, একদিন ল টিচারের বাইতে যাই, জুলি তরে খুব লাইক করে; কিন্তু নারীশিক্ষা মন্দিরের গল্লির বাসায় তখন মামুনুল হাই জুলিকে বলে, আমি কি তোমার যিশুকে একটা চুমা দিতে পারি?
জুলি বলে, ওই যে দেওয়ালের সঙ্গে ঝুলান আছে, যায়া দিয়া আসেন!
: তোমার গলারটাকে।
জুলি তার গলার দীর্ঘ দিনের পুরান স্টার্লিং সিলভারের চেনটা খুলে দেয়, মামুন মিঞা সেটা তার ডাইন হাতের মুঠার ভিতরে পুরে রেখে বলে, আমি এইটা নেই?
: কেন? না।
: আমাকে খ্রিষ্টান বানাও জুলি?
থে লাগবে হরে জন্মওর ওয়ার প
: দরকার কি!
শৈশবের দিনতো অবশিষ্ট থাকে না কিছুই, আয়নার উপরকার ছবির মত হারায়া যায়-যায় না কি? যাইহোক, মামুন মিঞাকে ফলে জুলির গলার চেন এবং সিফিকসটা ফিরায়া দেওয়া লাগে, জুলি হাত বাড়ায়া চেনটা নেয়, তখন মামুন তার হাত দিয়া জুলির হাত ধরে রাখে, জুলি কি কিছু বোঝে না? এইটা কি সম্ভব? জুলি হয়তো তাকে খেলায়, অথবা দ্রতা করে—এইসব ভদ্রতাও কি জীবনবিদারক হতে পারে না এবং মামুন মিঞা একটা তস্য ফকিরের মত তাকে বলে, তুমি জান আমি তোমাকে কতটা চাইছি, ক্যান আই কিস ইউ ওয়ান্স?
: মনে হয় না-আই উইল বি এভেইলএবল টু মাই হাজবেন্ড।
: কোথায় তিনি, তোমার সেই হাজবেন্ড দেবতা?
: আছে, আই এ্যাম গোয়িং টু মারি হিম সুন।
: বানায়া মিছা কথা বল তুমি খামাখা!
: বানায়া বলব কেন-আপনে তাকে চেনেন!
: কে সে-কেউগা?
: আপনাদের মিজ ডি কস্তা টিচারের ছেলে।
: পিউস? ও মাই গড, হায় খোদা!
জানালার পর্দার ফাঁক দিয়া তখন পুনরায় বিকালের আলো এসে জুলি ফ্লোরেন্সের মুখে বিম্বিত হয় এবং মামুন মিঞার মনে হয় যে, নারীর মন খার জন্য না, তার জন্য কখনোই না; তাহলে জুলি হবে মিজ রোজালিন ডি কস্তু রি ছেলের বৌ? এইটা কিভাবে সব-শি ইজ সো প্রাউড এন্ড বিউটিফুল-এইটা হইতে পারে না, কারণ তখন চট্টগ্রাম থেকে আসমানতারার খরকোস এসে ভূতের গলিতে খাড়া হয় এবং মিসেস জোবেদা তার কথা শোনার পর তাকে দ্রুত ঘরের ভিতরে নিয়া যায়া বসায়, বাপজান তুমি বহ, এই কতা তুমি রাস্তায় যায় কইয়ো না, হুনো আমার পোলা হারায় নাইকা, এবং খরকোল মিঞা মিসেস জৈাবেদার কথা শোনে এবং তার ঘরে বসে নাস্তাপানি খায়।
: আমাগোতো মামুন একটা আছে, তুমার আর কুনো নাম নাইকা?
: আমারে কুতুবউদ্দিন কইয়েরে ডাকিত্ পারন, আইবেকও ডাকি পারন, খরকোসও ডাকি পারন।
: তুমার নাম খরকোস?
: জি।
: আমি তুমারে আইবেক কমু!
খরকোসের মনে হয় যে, সে যদি মামুন নাই হয়, তাহলে সে কে? এই প্রশ্নের উত্তরতো তাকে জানতে হবে, সে কত পথ পাড়ি দিয়া কোনখান থেকে কোনখানে এসে পৌঁছেছে, তাকেতো তার জীবনের উদ্দেশ্য সাধন করা লাগবে, সন্ধান করে বের করতে হবে-কে সে, আঁই খন? কিন্তু আসমানতারা হুরে জান্নাত আব্দুল ওদুদ চৌং এর খেয়ালি এবং জেদি মাইয়া, ডলি আক্তার তার ছুটুকালের আচরণের কথা ভোলে না, ফলে তারা খরকোসের গলায় দড়ি দেওয়ার পর লোহার শিক দিয়া খরকোসের জন্য খাঁচা বানায়া দেয়, এবং খরকোস মামুন তাদের শোয়ার ঘরের এককোনায় খাঁচার ভিতরে চাকরদের দেওয়া ভাত সালুল খায়া আসমানতারার আদর সোহাগের মধ্যে বড় হয়, আসমানতারা যখন স্কুলে যেতে শুরু করে তখন দেখা যায় যে, খরকোস মামুন খাঁচার চেয়ে লম্বা হয়া গেছে, ডলি আক্তার শিল কড়ইয়ের নতুন ধাচা বানায়, তারপর এই খাঁচায়ও যখন খরকোসটা আটে না, বেঁকা হয়া শোয়, তখন আব্দুল ওদুদ হয়তো তার মেয়েকে বলে যে, খরকোসটাকে আর খাঁচায় রাখার দরকার নাই, ডলি আক্তার হয়তো বলে, ন চলে না, ইবতো শরকোস নয়, মানুষ, আই তুয়ারে আসল খরকোস আনি দিইয়ুম, ইবারে ছাড়ি দজও! আসমানতারা রাজি হয় না, সে কান্দে, আঁতুথে ন লাগিব, আঁই ন চাই, আঁই ইবারে ন ছাইড়গম!
তখন খরকোসের খাঁচার জীবন দীর্ঘায়িত হয়, সে আরো বড় এবং বেঁকা হয়, এবং খাঁচার প্রাণীর মত তৈরি হয় তার ভয়, উৎকণ্ঠা এবং আবেগ; তার আচরণে হয়তো আসমানতারা নিজেই তাজ্জব হয়া যায়, সে সতীপাড়া প্রাইমারি স্কুল থেকে ফিরা দেখে যে, খরকোস খাঁচার ভিতরে গোল ইয়া ঘুমায়, তখন আসমানতারা কাঠের স্কেল দিয়া তাকে একটা খোঁচা দেয়, চও ঘুমাচ্ছে, সে বলে, এবং একটা খোঁচাই যথেষ্ট হয়, খরকোসটা বনবিলাইয়ের মত গরগর করে ওঠে, তার উঁত বের হয়া যায় এবং চোখে হিংস্র আলো খেলা করে; হয়তো কখনো ডলি আক্তারও খরকোসের আচরণ বদলায় যেতে দেখে, কিন্তু মেয়ের মুখের দিকে তাকায়া সে এবং আব্দুল ওদুদ চৌধুরি ঘরের ভিতরে খরকোসের বসবাসের বিষয়টা পুনরায় মেনে নেয়। তখন আসমানভারী ক্লাস ফোরে ওঠে এবং একদিন রাইতের বেলা লুঙ্গির ভিতরে খোরকোসের বীর্যপাত হয়, হয়তো একটা স্বপ্নের ভিতরে এই কাজটা হয়, সে হয়তো দেখে কতগুলা ছবির পোস্টার, সাবনুর এবং পপির, হয়তো দেখে আগ্রার তাজমহল এবং দীল্লির কুতুব মিনার, স্বপ্নের ভিতরে সে কুতুব মিনারের উপর থেকে হয়তো পড়ে যায় এবং সে পিছলায়া নেমে যেতে থাকে, তখন তার দুই উরুর মধ্যেখানে জোয়ারের পানির মত উদ্বেলতা ফুলে ওঠে ভয় এবং আতঙ্ক এবং উত্তেজনায় যখন সে ফেটে পড়ে, ঘুমের ভিতরে তার মনে হয় যে, তার লুঙ্গি ভিজা গেছে। ঘুম ভেঙ্গে গেলে হাত দিয়া পিছলা এই পদার্থ—তার নিজ দেহের এই কষলে ছুঁয়ে দেখে, তার নাকে বীর্যের প্রথম সোঁদা ঘ্রাণ আসে, এবং ডিম লাইট জ্বালানো আধো অন্ধকারের ভিতরে সে পাগল হয়া যায়, এ কেমন গন্ধ, এ কেমন গন্ধের মেজাজ, তার ইচ্ছা করে খাঁচা থেকে বের হয় দুই হাত উর্ধমুখী করে ডলু নদীর পাড় দিয়া দৌড়ায়-গাছ এবং বনের ভিতরে, দূরের নীল পাহাড়ের ভিতরে চলে যায়, যেতেই থাকে-সে তার হাতে মুখে গলায় নিজের এই যৌনরস মেখে নেয় এবং খাঁচার শিক আঁকায়া চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তোলে। সেদিন আব্দুল আলি চৌধুরির বাড়ির সকলে খরকোসের কাণ্ড দেখে এবং এই কথা বোয়ালিয়া পাড়ার সকলে শোনে, হয়তো সাতকানিয়া শহরের সকলেও; কারণ খরকোসের ভয়াবহ চিঙ্কারে ছুটে এসে বাড়ির লেকেরা দেখে যে, গলায় লুঙ্গি পঁাচাইনা ন্যাংটা খরকোস খাঁচার ভিতরে হাঁটু গেড়ে বসে দাপাদাপি করে, ডলি আক্তার তখন ভয় পায়া যায়, কামড়ায়া দেবে নাকি? আব্দুল ওদুদ চৌধুরি হতভম্ব হয়া পড়ে, ভেবে পায় না কি হইলো পোলাটার, তখন হয়তো বাড়ির চাকর আবুইল্যা কিংবা দারোগার মসজিদের ইমাম-যে আব্দুল আলি চৌধুরির বাড়িতে স্থায়ীভাবে জাইগির থাকে-বড় এক বালতি পানি এনে খাঁচার কাছে যায়া চিড়িয়াখানার গরিলার মত বিচি ঝুলায়া দুই পায়ের পাতার উপরে বসে থাকা খরকোস মামুনের দিকে ছুড়ে দেয়, পানির ধাক্কায় উত্তেজিত খরকোস ধরাশায়ী হয় এবং কেউ হয়তো বলে, ও খুরকোস, ইন কান করদ্দে ওডা!
: আঁই খাঁচার ভিতরে ন থাইক্কম, আঁত্থে গম ন লার, আঁরে বাইর গরণ।
তখন হাল্কা হাওয়ায় জানালা দিয়া উড়ে আসা ছাতিম মঞ্জরির ঘ্রাণের মত খরকোসের বীর্যের অস্পষ্ট গন্ধ ঘরের ভিতরে ভেসে বেড়ায় এবং তখন হয়তো কেউ এই গন্ধ সনাক্ত করে, হয়তো আব্দুল ওদুদ করে, হয়তো ডলি আক্তারই করে, হয়তো করে দারোগার মসজিদের ইমাম; এবং তখন মসজিদের ইমাম বলে, ফোয়া ইবা বালেগ হইয়্যেদে, আলহামদু লিল্লাহ, ইবারে ছাড়ি দঅন! কিন্তু তখন আসমানতারা কৈ? দেখা যায় যে, সে ঘরে নাই, বিছানা খালি; তাকে সারা বাড়ি খোঁজা হয়, সে নাই, তারপর তাকে তার নিজের খাটের তলা থেকে বের করা হয় এবং যখন জিগাস করা হয়, অডে ক্যান করদ্দে তুই ওডি? সে বলে, আম্মা খরকোস দেখিয়েরে আঁই ডরাইয়্যি!
সকালবেলা খাঁচা খুলে খরকোসকে ছেড়ে দেওয়া হয়, আসমানতারা কান্দে কিন্তু রাইতের কথা সে ভোলে না, ফলে তার ভয় যায় না, এবং তখন খরকোস মিঞা একা একা হাঁটে, ডলু নদীর পাড় দিয়া যায়, পাকা ব্রিজের গোড়ায় বসে থাকে, তার গলায় দড়ি নাই, দড়ি ধরে পিছনে আসমানতারাও নাই; সে অবলম্বনহীন হয়া পড়ে, বিকালে বাড়ি ফেরার পর হয়তো আবুইল্যা তাকে আবিষ্কার করে, পুকুর পাড়ে বসে খরকোস একা একা কান্দে, তখন আব্দুল ওদুদ মিল্লার বাড়ির সকলে জানতে পারে যে, খরকোসের মন ভাল না এবং তখন ডলি আক্তার এসে খরকোসকে হাত ধরে ঘরে নিয়া যায় মাদুর পেতে ভাত দেয়, বলে, খান্দস কিয়া ওড? তুই মরণ ফোয়া নয় না? ন হান্দিস!
ফলে খরকোস মিঞা আরো কান্দে, জায়েজার হয়া কান্দে, তার কান্দনে বাড়ির পরিবেশ ভারি হয়া ওঠে, এবং শ্বাসনালিতে ভাতের টুকরা ঢুকে গেলে তার কাশি শুরু হয়, দম বন্ধ হয়া মরার দশা হয়, তখন ডুলি আক্তার অথবা আবুইল্যা তার পিঠে দুই/চাইরটা মৃদু চাপড় দেয়, গ্লাস তুলে ধরে পানি খাওয়ায়, মাদুরের উপরে লম্বা করে শোয়ায়া রাখে এবং হয়তো তখন ডলি আক্তারের ঘাড়ের পিছন থেকে আসমানতারা উঁকি দিলে খরকোস তা দেখে, এবং সে যখন বলে, আঁরে ডরাইয়ো না তুই? মনে হয় বালিকা আসমানতারা রাইতের কথা ভুলে যায়, সে বলে, অয়, ন ডরাই; কিন্তু ডলি আক্তার এবং ওদুদ চৌধুরি আসমানতারার ঘরে খরকৌসকে আর থাকতে দেয় না, আবুইল্যার সঙ্গে বাড়ির পিছনে পুকুর পাড়ের টিনের ঘরে তার থাকার জায়গা হয়। টিনের ঘরে শুয়ে তার আবার কান্দা আসে, এবং পুরান চাকর আবুল যখন বলে, ওড়া তুই এান করদ্দে কিয়া? তখন খরকোস মামুন বলে, আঁথে গম ন লার, আঁই ফানলার ন বাইচ্চম আবুল কাকা!
খরকোস শেষ পর্যন্ত মরে না, সে আবুলের সঙ্গে টিনের ঘরে আরামে থাকে এবং তখন, অথবা পরে কখনো, সে কুতুবউদ্দিন আইবেক সম্পর্কে জানতে পারে, কুতুব মিনারের উপর থেকে পড়ে যাওয়ার সময় বীর্যপাতের কথা হয়তো সে কাউকে বলে, বয়সে অনেক বড় হলেও আবুলকেই হয়তো বলে, আবুল হয়তো তাকে খোঁচায় এবং হয়তো তার গোয়া মারতে চায়। ডলি আক্তার এবং আব্দুল ওদুদ নিশ্চয়ই এই বিপদের কথা ভাবে নাই, ভাবলে হয়তো আবুইল্যাকে সাবধান করতো, খবরদার মারিয়েরে হাড়ি ভাঙ্গি দিইয়্যম; তখন খরকোস হয়তো আবুইল্যাকে কুতুব মিনার থেকে পড়ে যাওয়ার গল্পটা বলে, এবং তার মনের ভিতর পিছলায়া পড়ে যাওয়ার দৃশ্যটা যখন ভেসে ওঠে লুঙ্গির তলায় লিঙ্গ খাড়ায়া যায়, এবং তখন লিঙ্গের আগা দিয়া ধাতু বের হয়া লুঙ্গি ভিজায়া দিলে বাটপার চাকর আবুলের কিছু করার থাকে না, খরকোস উল্টা তাকে উপ্তা করে চেপে ধরে লুঙ্গি উঠায়া গোয়া মেরে দেয়। তখন আবুইল্যা ঘরের দরজা খুলে রাইতের অন্ধকারের ভিতর হারায়া যায়, পরদিন সে খরকোসের কুতুবমিনার দেখার গল্প প্রচার করে দেয় এবং সে আব্দুল ওদুদ এবং উলি আক্তারকে বলে যে, সে খরকোসের সঙ্গে থাকবে না, খরকোস রাইতে তাকে খুবই বিরক্ত করে, ঘুমাইতে দেয় না! তখন খরকোসের নাম কুতুবমিনার হয়া যায় এবং ওদুদ মিঞা ঠিক করে যে, কুতুবমিনারকে সে তার মাছ ধরার ট্রলারে নিয়া কাজে লাগাবে, সে জন্য দুই/চাইর দিন আবুইল্যাকে অপেক্ষা করতে হবে; কিন্তু রাইতের বেলা খরকোসের পুরুষাঙ্গ খাড়ায়া গেলে আবুইল্যার গলা শুকায়া যায়, সে বলে, তিয়া তিয়া ভাতিজা, এ্যান ন করিছ! কিন্তু খরকোসের অপেক্ষা করার সময় নাই, তখন আবুল ভিতরে যায় বাড়ির চাকরানি আসিয়া বুয়াকে ডেকে আনে, আসিয়া গরিবের বৌ, কিন্তু শরীরে তার যৌবন, ঝোপে ঝাড়ে নষ্ট হয়, তবে সে হয়তো বোঝে না আবুইল্যার উদ্দেশ্য কি, কারণ আবুল ভাঁকে কখনো বিরক্ত করে নাই, তাই সে অত চিন্তাভাবনা না করে আসে, চাইরচালা টিনের ঘর অন্ধকার হলেও ঘরে যায়া ঢোকে, আবুইল্যা তখন বলে যে, কুতুবমিনারের শরীর ভাল না, ফলে আসিয়া চৌকির উপরে কাইত হয় শুয়ে থাকা খরকোসের দিকে যায়, কি হইলো পোলাটার, সে ভাবে, এবং তখন খরকোস ওরফে কতুবমিনার অপেক্ষা করে; আসিয়া যখন অন্ধকারে হাত বাড়ায় সে তার হাতের ভিতরে খরকোসের গরম উখিত দটা পায়। বহুবছর পর সেইদিন রাইতে খরকোস মিঞা নারীর বুকের মধ্যে শরীর জড়ায় ঘুমায়, তখন আবুল লাপাত্তা হয়, কিন্তু পরদিন ভোরে দারোগার মসজিদে ফজরের আযান দেওয়ারও আগে অন্ধকার থাকতে সে ওদুদ মিঞা এবং ডলি আক্তারকে ডেকে আনে; ফলে আসিয়ার চাকরি যায় এবং কুতুবমিনারকে আনোয়ারা থানার গহিরা নিয়া যায়া ওদুদ চৌং বার্মায় ইউরিয়া সার চোরাচালান এবং অবসর সময়ে মাছ ধরার কাজে ব্যবহৃত কাঠের বড়ির ট্রলার এম ভি মায়ের দোয়া-য় নবিসিতে লাগায়া দেয়। এম ভি মায়ের দোয়া-য় খরকোস বড় সমস্যায় পড়ে, ট্রলারে আছে তিনজন, জানেআলম, শমসু এবং জাকির; এই তিনজনকে নিয়া। খরকোসের পশ্চাদ্দেশের ফুটা বাঁচানো মুশকিল হয়, প্রথম রাইতেই তারা ঝামেলা করে, সে মোচড়ামুচড়ি করে বাঁচে, এবং তিন নাবিক ভাবে, তিয়া ওডা, দরিয়ায় যাই লৈ। পরদিন ট্রলার রওনা হয়, উদ্দেশ্য সাগরে মাছ ধরা, এম ভি মায়ের দোয়া নোঙ্গর তুলে ভটভট শব্দে ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়া বঙ্গোপসাগরের ঘন ঘোলা পানির ভিতর দিয়া ছোটে, ১২x৩০ আকারের কাঠের বডির এই ট্রলার সাগরের ঢেউয়ে মাতাল হয়া ওঠে; হয়তো অনেকক্ষণ সময় পার হয়, ওস্তাদ জানেআলম ঝানু সারেঙ, সে সর্বোচ্চ গতিতে দক্ষিণ দিকের লইট্টা মাছের ঝাঁকের আবাসস্থলের দিকে ট্রলার নিয়া যায়, দুই/আড়াই ঘন্টা চলার পর তারা হয়তো মাছের ঝাকটার কাছেই চলে আসে, জাকির এবং শমসু ট্রলারের পাটাতনের উপর তূপ করে রাখা বড় ফুটবল সাইজের গোল প্লাস্টিকের ফ্লোট বান্ধা জাল পানিতে ফেলে দেয়ার আয়োজন করে, তখন জাহাজের হোল্ডের ভিতর থেকে ওয়াক ওয়াক শব্দ করে সিড়ি বায়া একটা মেয়ে উঠে আসে এবং পাটাতনের উপরে বমি করে ভাসায়া দিয়া কাইত তুয়া পড়ে যায়। ব্যাপার দেখেতো জানেআলমের চোখ লাল হয়া ওঠে, জাকির এবং শমসু মুখ বেঁকা করে রাখে, জানেআলম বলে, জাহাজোত রাঞ্জি আইনে কন?
: আঁই আইন্নিদেরি, কিয়া?
তখন মাঝ দরিয়ায় জানেআলম, শমসু এবং জাকিরের কিছু করার থাকে না, কিন্তু তারা এই বিষয়টা মনে রাখে, মেয়েটার কাছ থেকে জানা যায় যে, তার নাম আরতি জলদাস, রাধাশ্যাম জলদাসের বিধবা বৌ সে, বাড়ি গহিরার কাছেই খরদা-গহিরা গ্রামে, সে বলে যে, তার বয়স ছাব্বিশ বচ্ছর, চৌদ্দ বছর বয়সের খরকোস তাকে পঞ্চাশ টাকা দিয়া ভাড়া করে আনে, কিন্তু সে রাঙি না, তার ঘরে রাধাশ্যামের তিনটা বাচ্চা; জানে আলম অবাক হয়, এই পোলাতো মহা চারে বাবা, কখন সে সময় পাইলো আর কখন এই কাম করলো? তখন জানেআলম বমি দমনের জন্য টিনের ডিব্বা থেকে স্টিমিটিল জাতীয় টেবলেট বের করে আরতিকে দেয়, আরতি গলার ভিতরে দুইটা টেবলেট দিয়া কাইত হয়া থাকে; ফলে রাইতে মেয়েলোক নিয়া থাকায় খরকোসের ইজ্জত বাঁচে, কিন্তু জানেআলম, জাকির এবং শমসু এই আনচারের কথা ভোলে না, এইটা তাদের জীবিকার নাই, এই নাউয়ে মপ্নের ফোয়া খরকোস একটা গণিকা এনে তুলেছে, ফলে একটা সংঘর্ষ অনিবার্য হয়া ওঠে। জানেআলম হয়তো বিষয়টা আব্দুল ওদুদ চৌধুরিকে বলে, আব্দুল ওদুদ শুনে খুবই দুঃখিত হয়, তার অনেক কষ্টে বানানো এইসব ট্রলার কুতুবমিনার খরকোস এইভাবে কলুষিত করছে, সে হয়তো ডলি আক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে, কিন্তু তারা কোন সমাধান খুঁজে পায় না, পোলাটার কেউ নাই, কোথায় যাবে সে? ফলে আব্দুল ওদুদ চৌং জানেআলমকে বলে যে, পোলাটা তাদের ছেলের মত, ছুটুকাল থেকে আছে, সে তাকে বকে দেবে; কিন্তু খরকোসকে বকে দিয়া লাভ হয় না, সে ট্রলারে উঠলেই সঙ্গে আরতি থাকে, জানেআলম এবং তার দুই সঙ্গির জন্য এক মহা জ্বালা হয়, তারা চায় না যে সাগর এবং মাছের সঙ্গে পাছড়াপাছড়ির এই রকম একটা কাজের মধ্যে একটা ভেজাইলা মাইয়া ফোয়া ঢুকে বসে থাকুক। তবে তখন বার্মা যাওয়ার একটা ক্ষেপ আসে, চট্টগ্রাম থেকে উপকূল ধরে পাঁচ/ছয়টা সাম্পান রাইতের অন্ধকারে এসে গহিরায় সাঙ্গু নদীর মোহনায় মায়ের দোয়া ট্রলারে মাল তুলে দেয়, ড্রামে করে আনে অকটেন এবং বস্তায় নাইট্রোজেন ইউরিয়া সার, আব্দুল ওদুদের সঙ্গে জানেআলমের জিপিটুজিপি-তে কথা হয়, ওড়া জানেআলম, মাল পাইয়োছ দে না? জানেআলম মাল বুঝে পেয়েছে, কিন্তু সাম্পান থেকে নামায়া ট্রলারে উঠাতে রাইত কাবার হয়া যায়, ফলে সে রওনা দেওয়া স্থগিত করে, মাল যাবে আকিয়াবের কাছে, হয়তো মংদুতে, জানেআলম দিনের বেলা রওনা দিতে চায় না, দিনে নানা রকমের চোখ ঘুরে বেড়ায়, রাইতে রওনা হয়া একটানে অনেক দূর আগায়া যাওয়া যাবে, সে ওদুদ চৌধুরিকে বলে যে, সব ঠিক আছে, রাইত হলেই সে রওনা হবে, তার সঙ্গে শমসু, জাকির এবং খরকোসও আছে। কিন্তু তখন সে খরকোসের বিষয়টা আবার ওদুদ চৌংকে বলে, অনে ইবারে মানা গরি দঅন; ফলে ওদুদ চৌধুরির কড়া নির্দেশের কারণে খরকোসের প্রথম পাচার অভিযান শুরু হয় আরতি জলদাসকে ছাড়া, আরতির সঙ্গে হয়তো তার দেখা হয়, খরকোসেরর উপরের ঠোটের ঘনায়মান মোচের দিকে তাকায়া আরতি বলে, আঁরে ইত্তার ন লইবা?
: লইয়্যম, পরে!
কিন্তু গহিরায় থাকার এই সময় হয়তো কুতুবউদ্দিন আইবেক সম্পর্কে খরকোল মিঞা আরো কথা জানতে পারে, হয়তো অন্য কোন জেলে নৌকার কোন সারেঙ কিংবা মাঝির কথাটা জানা ছিল, হয়তো সে খরকোসকে কুতুবউদ্দিন আইবেক সম্পর্কে বলে, অথবা হয়তো আরতির বড় মেয়ে প্রতিমার সঙ্গে তার দেখা হয়, খরকোস একদিন যখন আরতির বাড়িতে আসে হয়তো আরতি তখন অন্য বাড়িতে কিছু করে, কিংবা মাঠে যায় কিছু টোকাইতে, ফলে প্রতিমা তার একমাত্র ফ্রক এবং ইজার ধুয়ে দেওয়ায় মায়ের একটা পেটিকোট পরে গামছা দিয়া বুক ঢেকে খরকেসের কাছে এসে খাড়ায়, বাপ মরা অরক্ষিত মেয়ে সে, এবং খরকোল তার সঙ্গে ভাব করে; প্রতিমা হয়তো খরদা-গহিরা গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে পড়ে, সে খরকোসের নাম কুতুবমিনার শুনে খুব মজা পায় এবং সে হয়তো খরকোসকে বলে যে, কুতুবমিনারতো কুতুবউদ্দিন আইবেক বানাইছে, প্রতিমা হয়তো সমাজপাঠ বইয়ে এইসব পড়ে, সুলতান মোহাম্মদ ঘুরির মৃত্যুর পর ১২০৬ খ্রিষ্টাব্দে তাহার সেনাপতি কুতুবউদ্দিক আইবেক নিজেকে দীল্লির সম্রাট বলিয়া ঘোষণা দেন। এইসব কথা শোনার পর খরকোস পাতলা গামছার তলায় প্রতিমার নবীন স্তনের দিকে তাকায়া বিহ্বল হয়া যায়, সে বলে, আঁই তুয়ারে লই ভাগি যাইয়াম গৈ!
তখন আরতি ফিরা আসে এবং খরকোস তাকে বোঝায় যে, এইবার তারা মাছ ধরতে অনেক দূরে যাবে, ফলে আরতিকে সে নিয়া যেতে পারবে না, পরের বার নিয়া যাবে; পঞ্চাশ টাকা উপার্জন করতে না পারায় আরতির মন খারাপ হয়া যায়, কিন্তু খরকোস এই প্রথম কুতুবউদ্দিন আইবেকের নাম জানতে পারায় এবং তার মনে তখনো বালিকা প্রতিমার স্মৃতি জেগে থাকায় সে আরতির মুখের দিকে তাকায়া একটা নোট আগায়া দেয়। জানেআলম এবং তার মাঝিদের জানা ছিল যে, খরকোসের আরেক নাম কুতুবমিনার, কিন্তু তাদের কুতুবউদ্দিন আইবেক সম্পর্কে কোন ধারণা ছিল না, থাকার কোন কারণ নাই, ফলে তারা দুর্ভাগ্যক্রমে খরকোসের বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র পাকায়; সেদিন আরতি এবং প্রতিমার কাছ থেকে বিদায় নিয়া খরকোস ফিরা আসার পর তারা রাইত একটু গভীর হলে নোঙ্গর উঠায়, হোল্ডের ভিতরে সারের বস্তা এবং পাটাতনের উপরে অকটেন তেলের তিনটা ড্রামের ওজনে ট্রলার টলমল করে, তার উপরে সামনের দিক ছাড়া পুরা ট্রলার ধূসর রঙ্গের তিরুপল দিয়া ঢেকে বেন্ধে দেওয়া হয় কেমোফ্লেজ হিসাবে, বাইনোকুলার লাগায়া দেখলেও বুঝতে পারা কঠিন হবে যে, পানির উপরে একটা জ্যান আছে, তিরপলের কারণে র্যাডারও ব্যর্থ হবে। জানেআলমের ভয় কোস্টগার্ড এবং নৌবাহিনীকে, তবে আল্লার দরিয়া বিরাট বিশাল আর নৌবাহিনীর ছটফটানি মাত্র দুই/চাইরখান জাহাজ নিয়া, ফাইট তেমন হয় না, জানেআলম দুই/চাইর বার পাওয়া খায় নাই তা না, খাইছে, কিন্তু সে এম ভি মায়ের দোয়া-কে পানির সঙ্গে মিশায়া দিয়া বাংলাদেশের জলসীমার ভিতর থেকে বার্মার এলাকায় বের করে নিয়া গেছে, ফলে নৌবাহিনীর জাহাজকে খাড়ায়া পড়তে হয়েছে, জানেআলম, শমসু এবং জাকির তখন ছাদে চড়ে হাত নাড়ায় বলেছে, বাই বাই, টাটা! ফলে জানেআলমের মনে বেশি ভয় ছিল না, তবুও সব সতর্কতামূলক প্রস্তুতি নিয়া তারা রওনা হয়, এবং খরকোস তিরপল দিয়া চাইরদিক ঢাকা একটা অন্ধ গুহার মত ট্রলারের ভিতরে জাকির এবং শমসুর সঙ্গে বসে থাকে। হয়তো ট্রলার সারা রাইত চলার পর তারা বাংলাদেশের পানিসীমার প্রান্তের কাছে যায়া পৌছায়, এবং তখন সারা রাইতের পেশাব পেটে জমে খরকোসের ঘুম ভেঙ্গে যায়, এবং সে শোনে যে, জানেআলম এবং দুইজন মাঝি জেগে আছে, তারা নিচু গলায় কথা বলে, এবং এভাবেই খরকোস ভাগ্যের জোরে তাদের ষড়যন্ত্রের কথা জেনে যায়; এই তিনজন ট্রলারে মেয়ে মানুষ ওঠানোর কথা ভোলে না, তারা ঠিক করে যে, খরকোসের হাত পাও বেন্ধে পানিতে ফেলে দেবে এবং ফিরা যায় আব্দুল ওদুদ চৌধুরিকে বলবে যে, খরকোস পা ফসকায়া পানিতে পড়ে গেছে। কিন্তু খরকোসতো ঘুমের ভান করে সব শুনে ফেলে, তখন সে দ্রুত অন্ধকারের মধ্যে শুয়ে থেকে দুই/তিনটা কাজ করে, প্রথমে সে পা লম্বা করে পায়ের কাছে পড়ে থাকা এক বান্ডিল দড়ি পায়, সেটা সে হাতের কাছে টেনে আনে এবং কাছেই শুয়ে থাকা শমসু এবং জাকিরের কাছে গড়ায়া যায় তাদেরকে এমনভাবে জড়ায়া ধরে যেন সে ঘুমের ভিতরে তলায়া আছে, কি সে এই জাপ্টাজাল্টির সময় দড়ি তাদের প্যান্টের বেল্টের লুপের ভিতরে ঢুকায়া বের করে অনে এবং কাছের একটা খুঁটার সঙ্গে বান্ধে, সে আবার গড়ায়া ট্রলারের একপ্রান্তেযায়, শমসু এবং জাকির কিছুই খেয়াল করে না, জানেআলমতো হাল ধরে রাখাতেই ব্যস্ত থাকে তখন খরকোস ট্রলারের ইয়ানমার ডিজেল ইঞ্জন স্টার্ট দেওয়ার তিন বেঁকা লোহার ডাণ্ডা অন্ধকারের ভিতর উঠায়া নিয়া এক বাড়িতে জানেআলমের খুলি ফাটায়া ফাঁক করে দেয়, শমসু এবং জাকিরও জানে বাঁচে না, বিপদ বুঝতে পেরে উঠে দৌড় দিতে যায়া দেখে যে তারা এক জোড়া ছাগলের মত বান্ধা পড়ে আছে এবং তারা দড়িতে বান্ধা ছাগলের মত মারা পরে, খরকোস তাদের পিটায়া মারে। তখন সাগরের বুকে ভোর হয়া আসে এবং এম ডি মায়ের দোয়া যখন। টেকনাফের কাছ দিয়া পার হয় তখন আব্দুল ওদুদ শেষবারের মত নেটওয়ার্ক পায়, মরে ভেটকায়া থাকা জানেআলমের পকেটের ভিতরে মোবাইল বাজে কিন্তু খরকোস ভয়ে ধরে না, তারপর আবার বাজে কিন্তু খরকোসতে জানে ওদুদ চৌং-এর ফোন এটা, সে আবার ভয়ে ধরে না, তারপর আবার যখন ফোন বাজে মরা জানেআলমের পকেট থেকে মোবাইল বের করে খরকোস খবর দেয় যে, নেভির আক্রমণে তিনজনই খতম, সে। একা বেঁচে আছে, ট্রলার এবং মাল তার হেফাজতে নিরাপদে আছে, অই চালাই লই যাইত পাইরগম, সে বলে। তখন আব্দুল ওদুদ চৌং-কে অনেক কিছু করতে হয়, সে আকিয়াবে আইএসড়ি ফোন করে কথা বলে, এবং তারপর পুনরায় মোবাইলে খরকোসকে বলে যে, তার ভয় নাই, তার রাস্তা চেনা লাগবে না, হুইলটা ধরে রেখে ট্রলার সোজা পুবদিকে চালালেই হবে, আব্দুল ওদুদ তাকে ট্রলারের মাথায় একটা কিছুর সঙ্গে একটা পতাকা বেন্ধে দিতেও বলে, বার্মার পাট্টি তাকে চিনে বের করে নেবে; খরকোস এই সবকিছুই ঠিকঠাক মত করে। ফলে মাল বুঝে পাওয়ার পর ওদুদ চৌংয়ের আকিয়াবের বন্ধুরা পাকা বার্মিজ মাঝিমাল্লা দিয়া ট্রলার গহিরায় পৌছায়া দেয়, এবং আব্দুল ওদুদ চৌধুরি নিজে উপস্থিত থেকে এম ভি মায়ের দোয়ার প্রত্যাগমন প্রত্যক্ষ করে, ট্রলার বঙ্গোপসাগরের পানি থেকে সাঙ্গু নদীর ভিতরে ঢুকে স্পিড কমায়া দিয়া ভটভট করতে করতে এসে পাড়ে ভেড়ে, বড় একটা জানালা দিয়া যখন খরকোস মাটিতে লাফায়া নামে, আব্দুল ওদুদ যায় তাকে জড়ায়া ধরে এবং সে ঘোষণা করে যে, এম ভি মায়ের দোয়ার সারেঙ হবে কুতুবমিনার খরকোস, এবং তার দ্রুত নৌচালনা বিদ্যার্জনে সহায়তার জন্য আব্দুল ওদুদ তার তিন ট্রলারের সবচাইতে অভিজ্ঞ মাল্লা আজিজাকে নিয়োগ করে, ফলে সাড়ে চৌদ্দ কিংবা পনের বছর বয়সে তার দখলে চলে আসে এক রাজত্ব, এবং দুইটা নারী-আসিয়া এবং আরতি। তবে আজিজ্যা হয়তো খরকোসকে চিনতে পারে না, কিংবা হয়তো চিনেও না চেনার ভান করে, সে জিগাস করে, ইবা খন? তখন কুতুবউদ্দিন আইবেক বলে যে, সে আইবেক, সে আজিজার কাছে জাহাজ
চালনা বিদ্যা শিক্ষা করতে চায়, অনে আঁর উস্তাদ, এবং আজিজার প্রশিক্ষণে সহসাই মামুন ওরফে খরকোস ওরফে কুতুবমিনার ওরফে কুতুবউদ্দিন আইবেক পাকা নাবিক হয়া ওঠে; সে চাইর বছর গহিরায় পড়ে থাকে, সাতকানিয়া যাওয়ার নাম করে না, এর মধ্যে পেটের অসুখে আরতি দাসী মরে যায়, প্রতিমার বিয়া হয় বাঁশখালির জলদি গ্রামে, এবং তখন সে ছুতার মিস্ত্রি ডেকে একটা কাঠের সিংহাসন বানায়, পিছনটা উঁচা করে সেখানে বানানো হয় তিনটা তারা—একটা উপরে, দুইটা দুই সাইডে-এবং দুই হাতলের মাখায় দুইটা হাঁ করা সিংহের মুণ্ডু, হাতল এবং মাথার পিছনে সোনালি রঙতার পাত বসায়া মোড়ায়া দিয়া মিস্ত্রি সিংহাসন বানানোর কাজ শেষ করে। জিনিসটা খরকোসের খুব পছন্দ হয়, খরকোস সিংহাসনটা মায়ের দোয়া-র সামনের ছোট্ট খোলা ডেকের উপরে নিয়া পাতে এবং এর পায়া দড়ি দিয়া পাটাতনের সঙ্গে বেন্ধে দেয়, জাহাজ যখন বঙ্গোপসাগরে সুন্দরবনের দক্ষিণ বরাবর সোয়াচ অব নোল্যান্ড-এর দিকে ছোটে কিংবা যায় কক্সবাজার থেকে সামান্য দূরে দক্ষিণের মৎস ক্ষেত্র-এর দিকে, খরকোস কখনো ট্রলারের হুইল তার সহকারী মোজাফফরের হাতে ছেড়ে দিয়া ডেকের উপরে রাঙতা লাগাইনা সিংহাসনে যায়া বসে, বাতাস তার কানের পাশ দিয়া হুহু করে বয়, চুল নিয়া বাইড়াবাইড়ি করে, খরকোস দূরে কোথাও কোন মাছের ঝাঁকের খোঁজে দিগন্ত রেখার দিকে তাকায়, তারপর সে যখন দেখে যে, কোথাও সাগরের বুকের উপরে অনেক গাঙচিল ওড়াউড়ি করে এবং বুঝতে পারে এইখানে মাছ আছে, তখন এম ভি মায়ের দোয়া-র মাঝিরা লম্বা জাল পানিতে ফালায়া দেয়, জাহাজের সাইড দিয়া প্লাস্টিকের ফ্লোটগুলা একটা বিরাট মোতির মালার মত লম্বা হয় পানির উপরে ছড়ায়া যায়, এবং জাহাজ যায়া পড়ে মাছের আঁকের মধ্যে, তখন একদিন সে সাতকানিয়া ফিরা আসে, ডলি আক্তারের পা ছুঁয়ে কদমবুসি করে, অলে ক্যান আছন আম্মা? তাকে পুকুর পাড়ের টিনের ঘরে আবুইল্যার সঙ্গে থাকতে দেওয়া হয় এবং তখন বিকাল বেলা আসমানতারা সাতকানিয়া বালিকা বিদ্যালয় থেকে ফিরা আসলে তার সঙ্গে দেখা হয়, মোচঅলা লোকটাকে দেখে আসমানতারা প্রথমে চেনেই না, ইবা খন?
: আঁই কুতুবউদ্দিন আইবেক।
কিন্তু এই নামে আসমানতারা কাউকে চিনতে পারে না, পারার কোন কারণ নাই, সে বলে, কুতুবউদ্দিন আইবক, ইবা খন?
: আঁই খরকেসি!