০৭. লাব্যণকে তার বাবা নিয়ে গেছে

লাব্যণকে তার বাবা নিয়ে গেছে। এক ঘণ্টার মধ্যে ফেরত দিয়ে যাবার কথা। ফেরত দেয়নি। চার ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। দুপুর একটার সময় নিয়েছে–এখন বাজছে পাঁচটা। শীতের সময় পাঁচটাতেই চারদিক অন্ধকার। মুনিয়ার মাথা খারাপের মত হয়ে গেছে। আমি বললাম, চোর ডাকাত তো মেয়েকে নেয়নি। মেয়ের বাবা নিয়ে গেছে। ফিরতে দেরি হচ্ছে। হয়ত ট্রাফিক জ্যামে আটকা পড়েছে।

মুনিয়া তীক্ষ্ণ গলায় বলল, ট্রাফিক জ্যামে আটকা পড়লে তিন ঘণ্টা লাগবে?

তাহলে অন্য কোন ব্যাপার। তারা হয়ত ঠিক করেছে রাতে এক সঙ্গে ডিনার করবে। কোন একটা চায়নিজ রেস্টুরেন্টে …

চুপ কর। আমাকে না বলে চায়নিজ রেস্টুরেন্টে নেবে? মেয়ে তার না আমার?

দু জনেরই, ফিফটি ফিফটি।

আমি নমাস পেটে ধরলাম আর মেয়ে দুজনের ফিফটি ফিফটি?

অনুচিত ধরনের ভাগভাগি তো বটেই। অনুচিত হলেও কিছু করার নেই–সমাজ ঠিক করে দিয়েছে।

মুনিয়া এমন ভাবে তাকাচ্ছে যেন আমিই সেই সমাজ। এক্ষুণি সে ঝাপিয়ে পড়বে আমার উপর। তাকে দেখাচ্ছে বাঘিনীর মত। আমি বললাম, তুই আমার দিকে এভাবে তাকাচ্ছিস কেন? সমাজের নিয়ম কানুন তো আমার তৈরি না।

দাদা, তুই ওর খোঁজ নিয়ে আয়।

কোখেকে খোঁজ আনব? বাসায় যাব? তুই যেভাবে তাকাচ্ছিস তাতে মনে হয় বাসায় যাওয়াই উচিত। ঠিকানা দে; যাচ্ছি।

ঠিকানা জানি না।

টেলিফোন নাম্বার?

মুনিয়া কোন কথা বলল না। দেখা গেল সে টেলিফোন নাম্বারও জানে না। আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, টেলিফোন নাম্বার, ঠিকানা তুই কিছুই জানিস না?

ঐ পিশাচটার ঠিকানা আমি রাখব কেন?

তা তো বটেই। তার কোন আত্মীয়স্বজনের ঠিকানা আছে? সেখান থেকে পিশাচ সাহেবের ঠিকানা বের করার একটা চেষ্টা চালানো যেতে পারে।

কারো ঠিকানাই আমি জানি না। ওর এক মামা থাকে নারায়ণগঞ্জে। কোথায় জানি না। মোজা কারখানার ম্যানেজার।

আমি বললাম, এই ক্ষেত্রে কিছুই করার নেই। রাত আটটা পর্যন্ত অপেক্ষা কর। এর মধ্যে এসে পড়বে। পিশাচ সাহেব নতুন সংসার পেতেছেন। এর মধ্যে একটা মেয়ে নিয়ে ঢুকাবেন না। ঢুকালে তাঁরই যন্ত্রণা। মেয়েকে তোর কাছেই দিয়ে যাবেন। অপেক্ষা করতে থাক।

মুনিয়া উঠে চলে গেল।

আমি অলস ভঙ্গিতে সফিকের উপন্যাসের পাতা উল্টাচ্ছি। আমারো কিছু করার নেই। রূপা খুব ভোরবেলায় সেজেগুজে বের হয়ে গেছে। কোথায় যাচ্ছে জিজ্ঞেস করি নি। সেও কিছু বলেনি। শুধু ঘর থেকে বেরুবার সময় বলল, দুদিন ধরে তুমি দাড়ি গোফ কামাচ্ছ না। তোমাকে দেখাচ্ছে ব্যর্থ প্রেমিকের মত। আজ ফিরে এসে যেন তোমাকে ক্লীন শেভড় দেখতে পাই।

এই পর্যায়ে আমি খুব সহজেই বলতে পারতাম, কখন ফিরবে?

বলিনি। বলতে ইচ্ছা করল না।

রূপা যখন ঘরে থাকে না তখন আমারো ঘরে থাকতে ইচ্ছা করে না। তারপরেও আজ সারাদিন ঘরেই ছিলাম। এখন আর ঘরে থাকতে ইচ্ছা করছে না। সফিকের উপন্যাসের নায়কের মত রাস্তায় নেমে পড়তে ইচ্ছা করছে। সাইকেল থাকলে ভাল হত। সাইকেলে করে ঘুরতাম। সফিকের উপন্যাসের নায়ক লোকমান রাতের বেলা সাইকেলে করে ঘুরে এবং মাঝে মাঝে সাইকেলের সঙ্গে গল্প করে। সাধারণত সাইকেলের সঙ্গে আলাপ আলোচনা খুব দার্শনিক ধরনের হয়। যেমন নায়ক বলল, পথের শেষ কোথায়?

সাইকেল টুনটুন করে ঘণ্টা বাজিয়ে ঘণ্টাতেই উত্তর দিল, পথের শুরুতেই হচ্ছে পথের শেষ।

তার মানে কি?

মানে খুব সহজ। শুরুই শেষ। আবার শেষই শুরু।

বুঝতে পারছি না।

বুঝতে না পারার কিছু নেই। পথ হচ্ছে জীবনের মত। জীবনের শেষ হচ্ছে জীবনের শুরুতে। পথের বেলাতেও তাই।

তাহলে ভালবাসার শেষ কোথায়?

ভালবাসার শেষ হচ্ছে ঘৃণার শুরুতে …।

লোকমান সাহেব এবং সাইকেলের কথাবার্তার এই হচ্ছে সামান্য নমুনা। উপন্যাস যত এগুতে থাকে কথাবার্তা ততই জটিল হতে থাকে। এমন দার্শনিক ধরনের সাইকেল লোকমান কোথায় পেয়েছে কে জানে।

আমি কাপড় পাল্টালাম। ঠিক করলাম রাত এগারোটা পর্যন্ত বাইরে থাকব। বাসায় ফিরে এসে যেন দেখি লাবণ্য ফিরেছে, রূপাও ফিরেছে। মুনিয়া শান্ত হয়েছে।

বাড়ি থেকে বের হবার আগে বাবার ঘরে উঁকি দিলাম। বাবা অবেলায় বিছনায় শুয়ে আছেন। তিনি আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন, কে?

বাবা আমি রঞ্জু।

কি ব্যাপার?

আপনার কাছে কি হাজার তিনেক টাকা হবে?

কি জন্যে? আমার একটু দরকার ছিল, ব্যক্তিগত প্রয়োজন।

আমার টাকা তোমার ব্যক্তিগত প্রয়োজন মেটানোর জন্যে তা মনে করার কোন। কারণ দেখছি না।

ও আচ্ছা, তাহলে থাক।

প্রয়োজনটা কি?

ভাবছি একটা সাইকেল কিনব।

বাবা বিছানায় উঠে বসলেন। তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, কি বললে?

একটা সাইকেল কিনব।

হোয়াই?

রাতে রাস্তায় ট্রাফিক কম থাকে। তখন সাইকেলে করে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরব।

কেন?

রাতের বেলা সাইকেলে করে ঘুরে বেড়ানো খুন ইন্টারেস্টিং।

তোমাকে কে বলেছে?

লোকমান।

লোকমানটা কে?

সফিক একটা উপন্যাস লিখেছে তার নায়ক।

তুমি সামনের চেয়ারটায় বস।

আমি বসলাম। বুঝতে পারছি বাবা নিজেকে গুছিয়ে নিতে সময় নিচ্ছেন। কি বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না।

রঞ্জু।

জ্বি।

তোমার ব্যাপার আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। এইসব কি বলছ? বাবুর কাণ্ডকারখানারও কোন আগা মাথা পাচ্ছি না–সে দেখি বারান্দায় ক্যাম্পখাটে ঘুমুচ্ছে। তাকে বললাম, কি ব্যাপার? সে বলল, চিলেকোঠার ঘরে তার নাকি একা ঘুমুতে ভয় লাগে। ভূতের উপদ্রপ।

আমি সহজ গলায় বললাম, একটা ভূত তাকে খুব বিরক্ত করছে। ঘুমুলেই কড়া নেড়ে ঘুম ভাঙ্গিয়ে দেয়। এ জন্যেই বারান্দায় ঘুমুচ্ছে। বারান্দায় তো আর কড়া নাড়ার কোন ব্যবস্থা নেই।

বাবা অনেকক্ষণ এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, আচ্ছা তুমি যাও। তিন হাজার টাকা আমি তোমাকে দেব। এখন দিতে পারছি না। ব্যাংক থেকে তুলতে হবে। লোকমানের মত রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়।

লোকমানের মত আমি ঘণ্টাখানিক রাস্তায় হাঁটলাম। তারপর গেলাম সফিকের খোঁজে।

যথারীতি সফিক নেই। তার বোন সুমি বিস্মিত হয়ে বললো, আপনি? আপনি কোখেকে?

আমি বললাম, যাচ্ছিলাম এইদিক দিয়ে। ভাবলাম, দেখি সফিক আছে কি-না। তার বইটা পড়া ধরেছি। দশপাতা পড়েছি।

এক সপ্তাহে মাত্র দশপাতা?

ধীরে ধীরে পড়ছি। আমি তোদের মতো দ্রুত পড়তে পারি না। চা খাওয়াতে পারিস? বিকেলে চা খাওয়া হয়নি।

এখন তো চা খাওয়াতে পারবো না। আমরা সব বিয়েবাড়িতে যাচ্ছি। এম্নিতেই আমাদের দেরি হয়ে গেছে।

ও আচ্ছা। আমি ভেবেছিলাম খানিকক্ষণ তোর সঙ্গে গল্প করবো।

সুমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কি একটা বলতে গিয়েও বলল না। সে বিয়েবাড়ি উপলক্ষে সাজসজ্জা করেছে। কিছু কিছু মেয়ে আছে যাদের সাজলে খারাপ দেখায়। সুমি তাদের একজন। তাকে রীতিমতো কুৎসিত দেখাচ্ছে।

সুমি বলল, আপনি কি বিশেষ কোনো প্রসঙ্গে আলাপ করতে চান?

হ্যাঁ।

আজ না। অন্য আরেকদিন আসুন। অবশ্যি আমার মনে হয় না আপনি আলাপ করতে চান। আপনি কথার কথা বলেছেন। কেউ যখন কথার কথা বলে তখন সেটা বোঝা যায়। আচ্ছা আপনার কি কোনো কারণে মনটন খারাপ?

না তো।

আপনাকে কেমন যেন অসুস্থ অসুস্থ লাগছে। আপনি বাসায় চলে যান। বাসায় গিয়ে আরাম করে ঘুমান। ভাবী কেমন আছেন?

ভালো।

ভাবী সিনেমা করছেন এটা কি সত্যি?

হ্যাঁ সত্যি।

আচ্ছা, উনি না-কি অসম্ভব রূপবতী। ভাইয়া বলছিল হেলেন অব ট্রয় তাঁকে দেখলে অপমানে গলায় দড়ি দিত। সত্যি?

সেটা হেলেন অব ট্রয়কে জিজ্ঞেস করাটাই কি উচিত না?

উনাকে তো পাচ্ছি না। তাই আপনাকে জিজ্ঞেস করছি।

হেলেন অব ট্রয় খুব সম্ভব ভুরু কুঁচকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকবে। মেয়েরা সহজে গলায় দড়ি দেয় না।

ভাবীর সংগে আমার খুব কথা বলার শখ। একদিন যদি কথা বলার জন্যে আপনাদের বাসায় যাই উনি কি রাগ করবেন?

ও রাগ করতে পারে না। তবে মানুষদের খুব সহজে রাগিয়ে দিতে পারে। আচ্ছা সুমি যাই। তোর মনে হয় দেরি হয়ে যাচ্ছে।

আবার কবে আসবেন?

দেখি। এমন খারাপ করে সেজেছিস কেন? কুৎসিত লাগছে। তোকে তেলাপোকার মতো লাগছে।

সুমি রাগ করল না। হাসল। সুমির সংগে এই একটা দিকে রূপার মিল আছে। রূপার মতো সেও রাগ করে না। আমি অনেকবার চেষ্টা করে দেখেছি। রাগাতে গেলে হাসে।

যাই সুমি?

আচ্ছা যান। চা খাওয়াতে পারলাম না, কিছু মনে করবেন না।

তোকে কুৎসিত লাগছে এটা ঠিক না, ভালোই লাগছে। ঠাট্টা করে বলেছিলাম।

সুমি চুপ করে রইল। আর অপেক্ষা করার কোনো মানে হয় না। নাটকীয় ভঙ্গিতে অবশ্যি বলতে পারি, বিয়ে কোথায় হচ্ছে আমাকেও নিয়ে চল। বিয়ে বাড়িতে যতো বেশি লোক নিয়ে যাওয়া যায় ততোই ভাল। একজনকে দাওয়াত করলে পুরো ফ্যামিলী নিয়ে যেতে হয়। যিনি দাওয়াত করেছেন তাঁর যেন আক্কেল গুড়ুম হয়ে যায়। আমি সিগারেট ধরাতে ধরতে বললাম, সুমি।

জ্বি।

আমাকেও সংগে নিয়ে চল্। অনেকদিন বিয়ে খাওয়া হচ্ছে না।

আপনার কি মাথাটা খারাপ হয়ে গেল? বাসায় যান তো।

আচ্ছা যাচ্ছি, কথা বলে যতো সময় নষ্ট করলি এর মধ্যে এক কাপ চা খাইয়ে ফেলতে পারতিস।

বসুন তা হলে। দেখি ব্যবস্থা করা যায় কি-না। আমাদের অবশ্যি এম্নিতেও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। বাবা এখনো ফিরেন নি। উনি ফিরলেই রওনা হব।

আমি বসলাম।

বসার ঘরটাকে এরা মোটামুটি আস্তাবল বানিয়ে রেখেছে। বিশাল এক খাট পাতা। খাটের উপর ময়লা তোষক। কোন চাদর নেই। কেউ বোধহয় সকালে মুড়ি খেয়েছে। তোষকে এবং মেঝেতে মুড়ি পড়ে আছে। মেঝেতে তিন জায়গায় খবরের কাগজের তিনটা পাতা। টেবিল একটা আছে। সেই টেবিলে আধ খাওয়া চায়ের কাপে ভন ভন করে মাছি উড়ছে। রাতের বেলা মাছি উড়ার কথা না, কিন্তু এ বাড়িতে উড়ছে।

চায়ের জন্যে অপেক্ষা করতে করতেই সুমির বাবা এসে পড়লেন। এই কয়েকদিনে তিনি আরো বুড়ো হয়ে পড়েছেন। তাঁর আরেকটা দাঁত পড়ে গেছে। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত গলায় বললেন, কে?

জ্বি আমি, আমার নাম রঞ্জু।

কোন রঞ্জু?

সফিকের বন্ধু।

ও আচ্ছ, সফিকের বন্ধু। হারামজাদা আছে কোথায় তুমি জান?

জ্বি-না।

দেখা হবে তার সাথে?

বুঝতে পারছি না।

দেখা হলে বলবে বাসায় যেন না আসে। বাসায় এলে জুতিয়ে হারামজাদার আমি …

সফিক কি নতুন কিছু করেছে?

বই লিখেছে জান না?

শুনেছি।

সেই মহান সাহিত্য আবার আমাকে উৎসর্গ করা হয়েছে। লেখা—আমার পরম পূজনীয় বাবাকে … আরে ছাগল, বাপের উপর ভক্তিতে গলে যাচ্ছিস। বাপ সংসার টানতে টানতে ভারবাহী পশু হয়ে গেছে সেদিকে খেয়াল নেই? তোকে ডাক্তার বানাতে গিয়ে যে পথের ফকির হয়েছি সেদিকে খেয়াল আছে রে হারামজাদা? চাকরি পেয়েছে, চাকরি করবে না। সাহিত্য করবে। করাচ্ছি তোমাকে সাহিত্য। জুতিয়ে আমি তোমার হাড়ি ভেঙ্গে দেব। সাহিত্য কত প্রকার ও কি কি হাড়ে হাড়ে বুঝবে।

উনি ভেতরে ঢুকে গেলেন। সুমি চায়ের কাপ হাতে ঢুকল এবং বলল, খুব তাড়াতাড়ি চা খেয়ে চলে যান। বাবার মেজাজ আকাশে উঠে গেছে। বিয়ের উপহার কিনতে গিয়েছিলেন, পকেটমার হয়েছে।

তোদের তাহলে আর বিয়েতে যাওয়া হচ্ছে না।

মনে হয় না।

 

বাসায় ফিরলাম রাত সাড়ে এগারোটায়। রূপা ফেরেনি। লাবণ্যও ফেরে নি। মুনিয়া একবার ফিট হয়েছে। তার মাথায় বর্তমানে পানি ঢালা হচ্ছে।

লাবণ্যর বাবার মামা, যিনি নারায়নগঞ্জের মোজা কারখানার ম্যানেজার তাঁর ঠিকানা পাওয়া গেছে। বাবুকে বলা হচ্ছে সেখানে গিয়ে লাবণ্যর বাবার ঠিকানা জোগাড় করতে। বাবু বিস্মিত। এরকম অদ্ভুত প্রস্তাব কেউ যে তাকে করতে পারে তাই সে ভাবতে পারছে না।

আমাকে নারায়ণগঞ্জে যেতে বলছ?

মুনিয়া ক্ষীণ স্বরে বলল, হ্যাঁ।

দশ দিন পর আমার পরীক্ষা শুরু হচ্ছে, এখন আমি যাব নারায়ণগঞ্জ?

হ্যাঁ।

ফাজলামী কথা আমার সঙ্গে না বললে ভাল হয়।

মুনিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমার মেয়ের কোন খোঁজ নেই এটা কি কোন ফাজলামী কথা?

আমাকে যে নারায়ণগঞ্জ যেতে বলা হচ্ছে এটাই ফাজলামী কথা, কারণ। নারয়ণগঞ্জ কোথায় তাই আমি জানি না।

আমি বললাম, কোন সমস্যা নেই, আমি যাব নারায়ণগঞ্জ। মুনিয়া, তুই কান্নাকাটি বন্ধ কর তো। যা ভাত আন। আমি ভাত খেয়েই রওনা হব।

ভাত খেতে গেলে দেরি হয়ে যাবে।

আচ্ছা, ভাত খাব না, ভাল করে এক কাপ চা বানিয়ে আন। চা খেয়ে রওনা দি।

নারায়ণগঞ্জ যেতে হল না। লাবণ্যর বাবা টেলিফোন করলেন। জানা গেল বিশেষ কাজে আটকা পড়েছেন বলে তিনি লাবণ্যকে দিয়ে যেতে পারেন নি। ভোরবেলা নিয়ে আসবেন। মুনিয়ার মুখে হাসি ফিরে এল।

রাত একটার মতো বাজে।

আমি বারান্দায় অলস ভঙ্গিতে হাঁটাহাঁটি করছি। ভাব করছি যেন কিছুই হয়নি। ভাবুক ধরনের একজন মানুষ ঘুমুবার আগে নৈশ ভ্রমণের একটা অংশ সারছেন। ভঙ্গিটাকে আরো জোরদার করার জন্য গুনগুন করে গান গাওয়া যায় কিংবা শিস দেয়া যায়–অবশ্যি তার এখন প্রয়োজন নেই। কেউ আমাকে লক্ষ্য করছে না। বাড়ি নিঝুম। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে।

কোনো কিছু চিন্তা না করে মানুষ কি হাঁটাহাঁটি করতে পারে? একটা মানুষ হেঁটে যাবে কিছুই ভাববে না। তার মাথা থাকবে ফাঁকা, আমার মনে হয় এটা খুবই অসম্ভব একটা ব্যাপার। মানুষ সারাক্ষণই ভাবে। তার মস্তিষ্ক কখনো বিশ্রাম নেয়। না। মস্তিষ্কের বিশ্রাম গ্রহণের কোনো ক্ষমতা নেই।

আমি হাঁটছি আর ভাবছি–কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করবে না। পৃথিবী রসাতলে যাক কিছুই যায় আসে না। বাস্তবে তা হচ্ছে না, মাথার ভেতরে রূপা ঘুরপাক খাচ্ছে। সে ফেরেনি। কোথায় গিয়েছে তাও জানি না। মাথায় বেশ কয়েকটা সম্ভাবনা খেলা করছে। কোনোটাই খুব স্পষ্ট নয়। স্বপ্ন দৃশ্যের মতো অস্পষ্ট এবং দুর্বল যুক্তির সম্ভাবনা। মাথার ভেতর এক সংগে অনেকগুলো ভাবনা। একটা অন্যটার ভেতর জড়িয়ে জট লেগে গেছে। খণ্ড খণ্ড দৃশ্য চোখের সামনে ভাসছে, ভেসেই মিলিয়ে যাচ্ছে। কয়েকটি দৃশ্যের উল্লেখ করা যাক।

দৃশ্য-১ সময় : রাত ৩টা

পুলিশের গাড়ি এসে থামল। দরজায় নক। বুটের লাথি। পুলিশ কখনো কলিং বেল বাজায় না। কলিং বেল খুঁজে বের করার মতো ধৈর্য এদের নেই। আমি দরজা খুলে দিলাম। পুলিশ অফিসার বললেন, আপনি কি রূপার স্বামী? (এইখানে লজিক খুব দুর্বল। আমাকে দেখেই পুলিশ অফিসার কি করে বুঝবেন আমি রূপার স্বামী? শার্লক হোমসেরও এটা বোঝার জন্যে সময় লাগার কথা। তবে অলস চিন্তায় দূর্বল লজিকও চলে যায়।) আমি পুলিশ অফিসারের দিকে তাকিয়ে শীতল গলায় বললাম, হ্যাঁ। আপনারা কি চান?

আপনাকে একটু আমাদের সংগে থানায় যেতে হচ্ছে।

কেন বলুন তো?

থানায় গিয়েই বলব।

আমি তাদের সংগে জীপে উঠে বসলাম, জীপ উড়ে চলল। পথ ফুরাচ্ছেই না। আমি ঝিম ধরে বসে আছি।

 

দৃশ্য ২

সময় : ভোর ৯টা

আমি চা খাচ্ছি। মুনিয়া খবরের কাগজটা আমার কোলে ফেলে দিয়ে বলল, এই নে কাগজ। আমি চায়ে চুমুক দিতে দিতে চোখ বুলাচ্ছি। হেডিং পড়বার পর কোনো খবরই বিস্তারিত পড়তে ইচ্ছা করছে না। একটা খবরে হঠাৎ চোখ আটকে গেল। অনিন্দ্য সুন্দরী যুবতীর লাশ উদ্ধার। যুবতীর বর্ণনা পড়ে মনে হচ্ছে–এ রূপা। রূপা ছাড়া আর কেউ নয় …

 

দৃশ্য-৩

সময় : দুপুর

আমি ঘুমুচ্ছি। টেলিফোন এল। টেলিফোন ধরলাম। ওপাশ থেকে রূপা বলল, কে? তুমি?

হ্যাঁ।

ভালো আছ?

আছি।

তোমাকে একটা জরুরী বিষয় বলার জন্যে টেলিফোন করেছি।

বল।

তোমার সংগে আর জীবন-যাপন করতে পরাছি না। আমি দূরে সরে গেলাম। কিছু মনে করো না।

আচ্ছা। টেলিফোন রাখি, কেমন?

খট করে টেলিফোন নামিয়ে রাখার শব্দ। দৃশ্যের সমাপ্তি। আমি আবার এসে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। ভাঙা ঘুম জোড়া লাগাবার চেষ্টা করছি।

যে তিনটি খণ্ড দৃশ্যের কথা উল্লেখ করলাম তা থেকে কি আমার মানসিক অবস্থা বোঝা যাচ্ছে? আমাকে কি খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মনে হচ্ছে? আমি জানি, তা মনে হচ্ছে না। আমি প্রচণ্ড রকম দুশ্চিন্তা ভোগ করছি না। এক ধরনের শূন্যতা বোধ করছি।

আমাদের বাসার অন্য সবাইও নিশ্চিন্ত মনে ঘুমুচ্ছে। যে বাড়ির বৌ কাউকে কিছু না বলে চলে গেছে–রাত একটা বেজে গেছে এখনো ফিরছে না, তাদের এতো নিশ্চিন্তে ঘুমানোর প্রশ্ন উঠে না। তারা তা করতে পারছে, কারণ আমি তাদের দুশ্চিন্তা দূর করেছি। খুব ভালোভাবেই দূর করেছি।

লাবণ্যর সমস্যা মিটে যাবার পর মা যখন অত্যন্ত চিন্তিত গলায় বললেন, কি রে বউমা আসছে না কেন? তখন আমি বিস্মিত গলায় বললাম, আসবে কেন? বান্ধবীর জন্মদিনে গেছে, সেখান থেকে বাপের বাড়িতে চলে যাবে। তার কোনো এক মামাতো বোন এসেছে সিঙ্গাপুর থেকে। তার সংগে সারারাত গল্প বলার প্ল্যান।

তোকে নিয়ে গেল না কেন?

দুবোন গল্প করবে, সেখানে শুধু শুধু আমাকে নিয়ে যাবে কেন?

মা পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হয়ে চলে গেলেন। মানুষের দুশ্চিন্তা কতো সহজেই না দূর করা যায়! এখন যদি কেউ টেলিফোন করে আমাকে শুধু বলে, রূপা বিয়েবাড়িতে গিয়ে আটকা পড়েছে, ভোরবেলা ফিরবে। আমি নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমুতে যাবো। আমার সুনিদ্রা হবে। সুন্দর কিছু স্বপ্নও দেখে ফেলতে পারি।

রাত দুইটার দিকে ঘুমুতে গেলাম। ভালো ঘুম হল। আশ্চর্যের ব্যাপার, স্বপ্নও দেখলাম। স্বপ্নে দাড়িওয়ালা এক লোকের সংগে খুব গল্প হচ্ছে–কিছুক্ষণ পরপর সে বলছে, ভাইজান, ভাইজান। বলেই আবার খানিকক্ষণ পর পর হাসছে–সেই হাসি মেয়েলী গলার হাসি। গলাটও চেনা চেনা, রূপার গলার সংগে মিল আছে। ঘুম ভেঙে জেগে উঠে দেখি হাসছে রূপা। রূপ লাবণ্যকে কাতুকুতু দিচ্ছে, লাবণ্য হাসছে, রূপাও হাসছে। দুজনই আমার বিছানায়। রূপা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, বাবুর ঘুম ভাঙল?

আমি কিছু বললাম না। রূপা বলল, আমরা দুজন আধ ঘণ্টা ধরে তোমার বিছানার পাশে হাসাহাসি করছি তারপরেও তোমার ঘুম ভাঙছে না, আশ্চর্য ঘুম তো তোমার! আমি হাই তুলে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। প্রায় জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম, কখন এসেছো? শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিলাম। থাক। ছাড়া ছাড়া ভাবটাই ভালো। রূপা আমার গায়ে ধাক্কা দিয়ে বললো, এই শুনছো?

শুনছি।

কাল যা বিপদে পড়েছিলাম–মাই গড!

তাই নাকি?

হ্যাঁ, ডেমরার কাছে আমাদের জীপ একটা ভিখিরীকে হিট করল। বেচারার মাথা ফেটে রক্তারক্তি। পাবলিক ফিউরিয়াস। কেলেংকারি হয়ে যাবার অবস্থা। আমাদের সঙ্গে আকবর ছিল। আকবর যে কোনো সিচুয়েশন ম্যানেজ করতে পারে। সে সিচুয়েশন ম্যানেজ করে ফেলল। আমরা ভিখিরীকে হাসপাতালে নিয়ে এলাম। থানা পুলিশ। ভিখিরী এই মরে, সেই মরে। আমরা চলে আসতে পারতাম। আমার কাছে ব্যাপারটা খুব ইনহিউম্যান মনে হল। আমি আর আকবর দুজন রয়ে গেলাম। তিনবার টেলিফোন করলাম, কেউ টেলিফোন ধরে না।

ভিখিরীর অবস্থা কেমন?

এখন একটু স্টেবল। ডাক্তাররা বলছেন আউট অব ডেনজার। চা খাবে?

খেতে পারি।

মুখ ধুয়ে এসো। চা আসছে। মুনিয়াকে চা দিতে বলে এসেছি। সে এক্ষুণি আনবে।

রূপা আবার লাবণ্যকে হাসাতে লাগল। তাদের দুজনের মধ্যে কিছু কথাবার্তাও হচ্ছে। কথাবার্তা হচ্ছে সাংকেতিক ভাষায় যার মাথামুণ্ডু আমি কিছুই বুঝলাম না। কথা-বার্তা এ রকম,

রূপা : কিটেমন ইটাছ?

লাবণ্য : ভিটাল ইটাছি।

রূপা : তিটুমি ইটামাকিটে ভিটাল বিটাস?

লাবণ্য : বিটাসি।

আমি ওদের অদ্ভুত ভাষার কথাবার্তা শুনছি। মজাই লাগছে। এই ভাষার ওপর মনে হয় এদের দুজনেরই বেশ দখল। দ্রুত কথা বলে যাচ্ছে। এমন মজার কথাবার্তর মাঝখানে হাসপাতাল থেকে খবর এল ভিখিরী মারা গেছে। রূপা কঁদিতে শুরু করল। হৈচৈ ধরনের কান্না। মা বিস্মিত হয়ে বললেন, বৌমা কাঁদছে কেন?

আমি বললাম, একজন ভিখিরী মারা গেছে তাই কাঁদছে।

তামাশা করছিস নাকি?

না, তামাশা করছি না। শুধু শুধু তামাশা করব কেন?

মা কঠিন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *