০৭. রাত এমন কিছু না

রাত এমন কিছু না। এগারোটাও বাজে নি। রাত শুরু হয় একটা থেকে। কাজেই রাত এখনো শুরুই হয় নি। বড় সাহেবের সঙ্গে কথা বলা হয়ে গেছে। তিনি নিশ্চয়ই রাত তিনটার সময় আবারো তার সঙ্গে কথা বলতে চাইবেন না। তাঁর কাছে ছুটি নেয়া আছে। দাদিজানকে দেখতে যাবার ছুটি। কাজেই মোবারক এখন ঘর থেকে বের হতে পারে। দুই বন্ধুকে খুঁজে বের করতে পারে। তিন বন্ধু মিলে রাস্তায় খানিকক্ষণ হেঁটে ছাতিম গাছের নিচে বসতে পারে। জহিরকে টাকা দিলে সে ম্যাজিসিয়ানদের মত শূন্য থেকেও জিনিসপত্র জোগাড় করে ফেলতে পারে। পঁচিশ হাজার টাকার পুরোটা খরচ হয়নি এখনো কিছু আছে। কত আছে সে জানে না। গোনা হয় নি। টাকা গুনলে টাকা কমে। তার কথা না, তার দাদিজান আকলিমা বেগমের কথা। টাকা নিয়ে তার একটা শ্লোকও আছে। সেই টাকা অবশ্যি কাগজের টাকা না, রূপার টাকা। তাঁর সময়কার টাকা।

চার মাসের নাতিন আমার ষোল মাসের পেট
একশত তার উপপতি স্বামী হল এক।
ধাতুতেই জন্ম কিন্তু নাই তার মা
এই শিল্পকে ভাঙ্গাইয়া দিয়া, নাতিন নিয়া যা।

টাকার ধাঁধাটা বন্ধুদের জিজ্ঞেস করতে হবে। যে পারবে সে একশ টাকা পাবে। একশ না পাঁচশ। টাকার পরিমাণ না বাড়ালে মজা জমে না। আশ্চর্যের ব্যাপার যে কোনো জিনিস জমার জন্যে টাকা লাগে।

মোবারক বেরুবার জন্যে তৈরি হল। তৈরি হওয়া মানে দাদিজানের জন্যে কেনা শালটা বগলের নিচে নিয়ে নেয়া। বাড়ি থেকে বের হবার সময় ঝামেলা হবে কি-না বুঝতে পারছে না। দারোয়ান হয়ত বলে বসবে— রাত এগারোটার পর বের হতে হলে পাশ লাগবে। পাশ থাকলে বের হবেন। পাশ না থাকলে নাই। পাশ আছে?

কুকুর ছেড়ে দিয়েছে কি-না কে জানে। দুটা ভয়ংকর কুকুর এ বাড়িতে আছে। দূর থেকে সে দেখেছে। রাতে বাড়ি পাহারা দেবার জন্যে কুকুর ছাড়া হয়। বড়লোকের বাড়ির কুকুর গায়ের গন্ধে বুঝে ফেলে কে বড়লোক কে গরীব লোক। তারপর ঝাঁপ দিয়ে গরীবের উপর পরে। পশুও গরীব ধনী চেনে।

কোনো রকম ঝামেলা ছাড়াই মোবারক গেট পার হল। দারোয়ান একটা কথাও জিজ্ঞেস করল না। কুকুর দুটাও ছাড়া ছিল। তারাও চোখ উঁচু করে তাকে দেখে চোখ নামিয়ে নিল। এরা কি টের পেয়ে গেছে যে মোবারক। সাধারণ কেউ না। সে হল Fruits and Flowers এর মালিক।

গেটের বাইরে এসে মোবারকের মনে পড়ল সে আসল জিনিস ফেলে গেছে। দুই বন্ধুর জন্যে দুটা স্যুয়েটার কিনেছিল, স্যুয়েটার সঙ্গে নেয়া হয় নি। থাক স্যুয়েটার। স্যুয়েটারের জন্যে ঢুকলে আর হয়ত বের হওয়া যাবে না।

আহ বড় আনন্দ লাগছে। শীষ দিয়ে গানের সুর তুলতে ইচ্ছা করছে। ইচ্ছা করলেও উপায় নেই। সে শীষ দিতে পারে না। পারে বজলু। শুধু যে পারে তা না অসম্ভব সুন্দর করে পারে। মনে হয় শীষ না যেন বাঁশি বাজছে। বজলুকে আজ ধরতে হবে। মুশকিল হচ্ছে হারামজাদার গায়ে চর্বি বেশি। তাকে কোনো অনুরোধ করলে চর্বির উপরও আরেক পরত চর্বি জমে যায়। জমলে জমবে আজ বজলুকে ধরতে হবে। অনেকদিন তার শীষ শোনা হয় না। বাচুপানকা দিন ভুলা না যা না গানটা বাজাতে বলতে হবে। তবে শুরুতে না। ভাবের জগতে উঠার পর। সাধারণ গান-বাজনা একরকম, ভাবের গানবাজনা অন্যরকম। ভাবের গান-বাজনায় মনটা উদাস হয় অনেক বেশি। বাচুপানকা দিন গানটা এম্নিতে শুনলে চোখে পানি আসবে না, কিন্তু ভাবের জগতে থাকার সময় শুনলে চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়বে।

মোবারক কুদ্দুসের চায়ের দোকানের দিকে রওনা হল। তার মন বলছে দুজনকে সেখানেই পাওয়া যাবে। আর না পাওয়া গেলে মোবারক যে ভাবেই হোক খুঁজে বের করবে।

বজলু এবং জহিরকে চায়ের দোকানেই পাওয়া গেল। দুজনই আরাম করে মালাই চা খাচ্ছিল। মোবারককে দেখে উঠে দাঁড়াল। যেন তারা জানত এক্ষুণী মোবারক জিনিসপত্র নিয়ে উপস্থিত হবে।

জাহিরের বগলে একটা ক্রাচ। সে ক্রাচ নিয়ে যে ভাবে হাঁটছে তাতে মনে হচ্ছে তার জন্মই হয়েছে বগলে ক্রাচ নিয়ে। এবং এতে সে মোটেই দুঃখিত না, বরং আনন্দিত। সে চোখ ছোট করে বলল, জিনিসটা উপকারী। ধর মারামারি লেগে গেল— বগল থেকে ক্রাচ নিয়ে ঝাঁপ দিয়ে পড়লি। হা হা হা।

বজলু ভুরু কুঁচকে তাকাল। জহিরের রসিকতায় সে মজা পাচ্ছে না। তবে মোবারক মজা পাচ্ছে। জহিরের কথা তার মনে ধরেছে। সে কল্পনায় দেখতে পাচ্ছে তারা তিন বন্ধু বগলে ক্রাচ নিয়ে ঘুরছে। কোনো একটা ঝামেলা বাধল বের হয়ে এল তিন অস্ত্র।

মোবারক বলল, তুই কি পুরোপুরি ল্যাংড়া হয়ে গেছিস?

জহির বলল, হ্যাঁ।

বলে দাঁত বের করে হাসল। পুরোপুরি ল্যাংড়া হওয়াতেও সে আনন্দিত। কিছু কিছু সময় মানুষের জীবনে আসে যখন সব কিছুতেই আনন্দ লাগে। ধাক্কা দিয়ে কেউ রাস্তায় ফেলে দিল, একটা দাঁত গেল ভেঙ্গে। তার মধ্যে আনন্দ। জহিরের এই সময় চলছে।

ছাতিম গাছের তলাটা বেদখল হয়ে আছে। এক বুড়োবুড়ি নীল পলিথিনের ছাউনি দিয়ে রাতারাতি সংসার পেতে বসেছে। ইটের চুলায় রান্না হচ্ছে। বুড়ি রান্না করছে। বুড়ো বটি পেতে কাটাকুটি করছে। রাত বাজে একটা। এই সময়ে কীসের রান্না কে জানে?

পলিথিনের নীল বাড়ির ভেতর থেকে গল্পগুজব এবং হাসাহাসির শব্দ আসছে। আনন্দময় সংসার যাত্রা।

বজলু বলল, লে হালুয়া।

বুড়ো সবৃজি কাটা বন্ধ করে শক্ত হাতে বটি ধরে আছে। বুড়ি নির্বিকার। সে আগের মতই রান্না করে যাচ্ছে। একবার শুধু চোখ সরু করে দেখল।

জহির বলল, জায়গা ক্লিয়ার করে দাও। দশ মিনিট সময়। এর মধ্যে জায়গা পরিষ্কার না করলে অসুবিধা আছে।

পলিথিনের ঘর থেকে দুটা মেয়ে উঁকি দিচ্ছে। দুজনের বয়সই আঠারো উনিশ। ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক। চুলে লাল ফিতা বাঁধা। এরা সাজগোজ করছিল। সাজ এখনো শেষ হয় নি। চোখে কাজল দেয়া হচ্ছে।

মোবারক বুড়োর দিকে তাকিয়ে বললো— এই দুই কন্যা কে? তোমার নাতনী?

বুড়ো বলল, তা দিয়া আপনার কি দরকার।

দরকার আছে।

হ আমার নাতনী।

এরা কি ভাড়া খাটে?

বুড়ো কিছু বলল না। মেয়ে দুটার একটা আফ্রাদী গলায় বলল, ঝামেলা কইরেন না ভাইজান।

মোবারক বলল, কোনো ঝামেলা নাই। তোমরা তোমাদের মত বাণিজ্য করবে। কিন্তু জায়গা ছাড়তে হবে। এটা আমাদের জায়গা। দশ মিনিট সময়। আমরা এখানে নেশা করব।

এমন কোনো হাসির কথা না, কিন্তু মেয়ে দুটি খিলখিল করে হাসছে। দুজনই মনে হয় খুব মজা পাচ্ছে। মেয়ে দুটির একটি বলল, আপনেরার লিশা আপনেরা করেন। আমরা না করছি?

জায়গা ছাড়বে না?

জায়গা কি আমার যে ছাড়ব? জায়গা আল্লাহ পাকের। হেতো কিলিয়ার কইরাই ধুইছে। হি হি হি।

মোবারকের মনে হল মেয়েটাকে সুন্দর লাগছে তো। একটু আগেওতো সুন্দর লাগছে না। এখন লাগছে কেন? হি হি করে হাসছে বলেই কি সুন্দর লাগছে? হাসলে মানুষকে সুন্দর দেখায়। তবে সেই হাসি আসল হাসি হতে হবে। নকল হাসিতে মানুষকে ভয়ংকর দেখায়। তবে হাসি এমন জিনিস যে তার নকল হয় খুব কম।

বজলু হঠাৎ উদার গলায় বলল, এরা থাকুক এদের মত। আয় আমরা এক কোণায় বসে পড়ি। মোবারকের মনে হল বজলু তার মনের কথাটা বলেছে। সবাই থাকবে সবার মত ঝগড়া ফ্যাসাদের দরকার কি? মেয়ে দুটা ইচ্ছা করলে তাদের সঙ্গে বসতে পারে। ইচ্ছা করলে কাস্টমারের খুঁজে যেতে পারে।

জহির মেয়ে দুটির দিকে তাকিয়ে বলল, এই তোদের নাম কি?

তুই তুকারি করেন ক্যান? ভাল মত জিগান নাম কমু।

তোমাদের নাম কি?

আমার নাম ছুইটি, এর নাম বিউটি।

নকল নাম?

হ নকল। আমরা মানুষও নকল আমরার নামও নকল আপনেরা কি লিশা করতে আইছেন?

হুঁ।

লিশা বড়ই খারাপ জিনিস গো লিশা কইরেন না।

চুপ থাক।

আইচ্ছা যান চুপ থাকলাম। চিল্লাইয়েন না।

ছাতিম গাছের অন্য দিকটায় তারা তিনজন বসল। মেয়ে দুটি বের হয়ে গেল খদ্দেরের খুঁজে। মেয়ে দুটি যাবার আগে জহির ধমকের গলায় বলল, খবর্দার কাস্টমার নিয়া এই দিকে আসবি না। আসলে বিপদ আছে। বিল্লি মে কাট দিবে।

ছুইটি অবাক হয়ে বলল, বিল্লি মে কাট দিবে কি গো?

জহির উদাস গলায় বলল, যখন কাট দিবে তখন বুঝবি কী। এখন বুঝবি atti

বিউটি বলল, আপনেরা ভদ্রলোকের ছেলে। আপনেরা তুই তুকারি করেন ক্যান।

বজলু বলল, আমরা ভদ্দরলোকের ছেলে তোদের কে বলল? আমরা বিল্লি কাট দিয়া মানুষ। আমাদেরকে বিল্লি কেটে দিয়েছে। বজলুর কথা শেষ হবার আগেই জহির এবং মোবারক হাসতে শুরু করল। বোতল খোলার আগেই তিনজন চলে যাচ্ছে ভাবের জগতে। আজকের ভাব হবে জটিল ভাব। রাতটা বড়ই আনন্দে কাটবে।

বুড়ো বুড়ির রান্না হয়ে গেছে। দুজনে গল্প করতে করতে খাওয়া দাওয়া করছে। তাদেরকে দেখে মনে হচ্ছে তারা বড়ই আনন্দে আছে। মোবারকরা তেমন আনন্দে নেই। বজলু শীষ দিয়ে কি একটা গান বাজাচ্ছে। গানের সুর এতই করুণ যে চোখে পানি এসে যাচ্ছে।

দুটি মেয়ের একটি (ছুইটি) ফিরে এসে তিন বন্ধুর পাশে বসেছে। মনে হচ্ছে তিন বন্ধুকে দেখে মেয়েটা খুব মজা পাচ্ছে।

বজলু শীষ বাজানো বন্ধ করতেই মোবারক বলল, দোস্ত একটা কথা বলি। ইচ্ছা হলে জবাব দিবি ইচ্ছা হলে দিবি না। তুই কি ছোট রফিকের দলে ঢুকেছিস?

বজলু বলল, হুঁ।

কাজটা কি ঠিক হয়েছে?

ঠিক হয় নাই। কিন্তু উপায় কী? আমার বাঁচা লাগবে না?

মোবারক বলল, দোস্ত তুই ছোট রফিকের কথা ভুলে যা। আমি আমাদের তিনজনের জন্যে ব্যবস্থা করেছি।

বজলু কঠিন গলায় বলল, তুই হলি ছিছকা চোর। থিফ অফ ঢাকা। তুই কি ব্যবস্থা করবি? চোরের দল করবি? চোরের দলের লীডার হবি। আমি চুরির মধ্যে নাই। আমি ভদ্দরলোকের ছেলে। আমার বাবা ছিলেন স্কুল টিচার।

ছোট রফিকের সাথে থেকে তুইতো মানুষ খুন করবি।

হুঁ করব। যার কপালে খুন লেখা থাকবে সে খুন হবে। আমার কি করার আছে। আমার কিছু করার নাই।

কঠিন তর্কাতর্কিতে নেশা কেটে যায়। আজ কাটছে না। বরং আজ নেশা আরো চেপে আসছে।

জহির বলল, আমি পিশাব করতে যাচ্ছি তোরা কেউ যাবি আমার সাথে? কাটাকুটি খেলবি? সঙ্গে সঙ্গেই তিনজন উঠে দাঁড়াল। জহির বরল, বুড়ো বুড়ির পলিথিনের বাড়িতে পিশাব করলে কেমন হয়। আমাদের জায়গা দখল করে আছে শাস্তি হওয়া দরকার না?

বজলু বলল অবশ্যই শাস্তি হওয়া দরকার। ওদের গায়েই পেশাব করা দরকার। তা না করে আমরা ওদের রাজপ্রাসাদ ভিজিয়ে দেব।

ছুইটি বিড় বিড় করে বলল, লিশা কি খারাপ জিনিসগো। কি খারাপ জিনিস।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *