০৭. রহিমা

‘তোমার নাম রহিমা?’

‘জ্বি।’

‘ভালো আছ রহিমা?’

‘জ্বি, আল্লাহুতালা যেমুন রাখছে।’

রহিমা লম্বা একটা ঘোমটা টানল। এই লোকটি তার কাছে কী জানতে চায়, তা সে বুঝতে পারছে না। সে তো কিছুই জানে না, তাকে কিসের এত জিজ্ঞাসাবাদ! তিন্নির আব্বা বলে দিয়েছেন–উনি যা জানতে চান, সব বলবে। কিছুই গোপন করবে না। এও এক সমস্যা। গোপন করার কী আছে?

‘রহিমা।’

‘জ্বি?’

‘দেশের বাড়িতে তোমার কে কে আছেন?’

‘এক মাইয়া আছে।’

‘মেয়েকে দেখতে যাও না?’

‘জ্বি, যাই।’

‘শেষ বার কবে গিয়েছিলে?’

‘তিন বছর আগে।’

‘এই তিন বছর যাও নি কেন?’

রহিমা চমকে উঠল। তাকিয়ে রইল ফ্যালফ্যাল করে। যেন সে নিজেই গভীর চিন্তায় পড়ে গেছে, কেন যায় নি।

মেয়ে যাবার জন্যে বলে না?’

‘জ্বি, বলে।’

‘তবু যেতে ইচ্ছে করে না, তাই না?’

রহিমা চুপ করে রইল। মিসির আলি বললেন, ‘তিন্নির মাকে তো তুমি দেখেছ, তাই না?’

‘জ্বি।’

কেমন মহিলা ছিলেন?’

‘খুব ভালো। এমুন মানুষ দেখি নাই। খুব সুন্দর আছিল। কী রকম ব্যবহার! কাউরে রাগ হয়ে কথা কয় নাই।’

‘ঐ ভদ্রমহিলার মধ্যে তিন্নির মতো কোনো কিছু ছিল কি?’

‘জ্বি-না। বড় ভালোমানুষ ছিল। ইনার কথা মনে হইলেই চউক্ষে পানি আসে।’

রহিমা সত্যি-সত্যি চোখ মুছল। মিসির আলির আর কিছু জিজ্ঞেস করার ছিল না।

অন্যদের কাছ থেকে তেমন কিছু জানা গেল না। বাড়ির দারোয়ানের একটি কথা অবশ্যি বেশ গুরুত্বপূর্ণ, সে বলছে, তিন্নি ছোটবেলায় খুব ছোটাছুটি করত। বাগানে দৌড়াত। যতই সে বড় হচ্ছে, ততই তার ছোটাছুটি কমে যাচ্ছে। এখন বেশির ভাগ সময় সে ছাদে হাঁটাহাঁটি করে কিংবা চুপচাপ বসে থাকে।

‘তুমি ক’দিন ধরে এ বাড়িতে আছ?’

‘জ্বি, অনেক দিন।’

‘ছুটিছাটায় দেশের বাড়িতে যাও না?’

‘জ্বি, যাই।’

‘শেষ কবে গিয়েছিলে?’

অনেক হিসাব-নিকাশ করে দারোয়ান বলল, ‘তিন বছর আগে একবার গিয়েছিলাম।’

‘গত তিন বছরে যাও নি?’

‘জ্বি না।’

.

তিন্নির মার পুরোনো চিঠিপত্র বা ডায়েরি, কিছুই পাওয়া গেল না। বরকত সাহেব বললেন, ‘এ-দেশের মেয়েদের কি আর ডায়েরি লেখার অভ্যাস আছে? এরা ঘরের কাজকর্ম শেষ করেই সময় পায় না। ডায়েরি কখন লিখবে?’

‘চিঠিপত্র? পুরোনো চিঠিপত্র?’

‘পুরোনো চিঠিপত্র কি কেউ জমা করে রাখে, বলুন? চিঠি আসে, চিঠি পড়ে ফেলে দিই। ব্যস। তা ছাড়া ও চিঠি লিখবে কাকে? বাপ-মা-মরা মেয়ে ছিল। মামার কাছে মানুষ হয়েছে। বিয়ের পর সেই মামা মারা গেলেন। সে একা হয়ে গেল। চিঠিপত্র লেখার বা যোগাযোগের কেউ ছিল না।’

‘আপনার স্ত্রী কি খুব বিষণ্ন প্রকৃতির ছিলেন?’

‘না মনে হয়। হাসিখুশিই তো ছিল।’

‘কোনোরকম অসুখ-বিসুখ ছিল কি?’

‘বলার মতো তেমন কিছু না, সর্দিকাশি—এইসবে খুব ভুগত। এটা নিশ্চয়ই তেমন কিছু না।’

‘তিন্নি যখন তাঁর পেটে, সে-সময় কি তাঁর জার্মান মিজেলস হয়েছিল?‘

‘এটা কেন জিজ্ঞেস করছেন?’

‘জার্মান মিজেলস একটা ভাইরাসঘটিত অসুখ। এতে বাচ্চার অনেক ধরনের ক্ষতি হবার কথা বলা হয়। “জীনে” কিছু ওলটপালট হয়।‘

‘না, এ-ধরনের কোনো অসুখবিসুখ হয় নি।’

‘মামস? মামস হয়েছিল কি?’

‘না, তাও না।’

মিসির আলি বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘সেই সময় তিনি কি কোনো অদ্ভুত স্বপ্নটপ্ন দেখতেন?’

বরকত সাহেব ভূ কুঁচকে বললেন, ‘কেন জিজ্ঞেস করছেন?’

‘মানসিক অবস্থাটা জানবার জন্যে। দেখতেন কি কোনো স্বপ্ন?’

‘হ্যাঁ, দেখতেন।’

‘কী ধরনের স্বপ্ন, আপনার মনে আছে?’

‘ঠিক মনে নেই। প্রায়ই দেখতাম জেগে বসে আছে। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করলে বলত, দুঃস্বপ্ন দেখেছি।’

‘কী দুঃস্বপ্ন, সেটা জিজ্ঞেস করেন নি?’

‘জ্বি-না, জিজ্ঞেস করি নি। স্বপ্নটপুর ব্যাপারে আমার তেমন উৎসাহ নেই। তবে সে নিজে থেকে কয়েক বার আমাকে বলতে চেষ্টা করেছে, আমি তেমন গুরুত্ব দিই নি।’

‘আপনার কি কিছুই মনে নেই?’

‘ও বলত, তার দুঃস্বপ্নগুলি সব গাছপালা নিয়ে। এর বেশি আমার কিছু মনে নেই।’

মিসির আলি বললেন, ‘আমি আজ সন্ধ্যায় ঢাকা যাব। এখানকার কাজ আমার আপাতত শেষ হয়েছে। ঢাকায় আমি কিছু পড়াশোনা করব। খোঁজখবর করব, তারপর ফিরে আসব।’

‘আজই যাবেন?’

‘হ্যাঁ, আজই যাব। হাতে সময় বেশি নেই। কিছু একটা করতে হলে দ্রুত করতে হবে।’

‘এ-কথা কেন বলছেন?’

‘ইনসটিংক্ট থেকে বলছি। আমার মনে হচ্ছে এ-রকম।’

‘আপনি কিন্তু আমার মেয়ের সঙ্গে এক বারই কথা বলেছেন। আমি চাচ্ছিলাম আপনি তার সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা করবেন।’

‘আমি আবার ফিরে আসছি। তখন করব।’

‘কবে ফিরবেন?’

‘চেষ্টা করব খুব তাড়াতাড়ি ফিরতে।’

‘আমার মেয়েটিকে কেমন দেখলেন, বলুন।’

‘এখনো বলবার মতো তেমন কিছু পাচ্ছি না।’

‘পাবেন কি?’

‘পাব, নিশ্চয়ই পাব। কেন পাব না?’

বরকত সাহেব একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। মনে হল তিনি খুব আশাবাদী নন।

.

তিন্নি প্রায় সারাদিনই ছাদে বসে ছিল। মিসির আলি তার কাছ থেকে বিদায় নিতে গেলেন বিকেলে।

‘তিন্নি, আমি চলে যাচ্ছি।’

মেয়েটি বলল, ‘আমি জানি।’

‘আমি তোমার ছবিগুলি সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছি।’

‘তাও জানি।’

‘কিছু দিনের মধ্যে আমি আবার আসব। তখন দেখবে, সব ঝামেলা মিটে গেছে।’

তিন্নি কিছু বলল না। মিসির আলি বললেন, ‘গাছপালা তুমি খুব ভালবাস, তাই না?’

‘মাঝে মাঝে বাসি, মাঝে-মাঝে বাসি না।’

‘তুমি কি ওদের সঙ্গে কথা বলতে পার?’

‘এখানে যে-সব গাছপালা আছে, তাদের সঙ্গে পারি না।’

‘তাহলে কাদের সঙ্গে পার?’

মেয়েটি জবাব দিল না। মাথা নিচু করে বসে রইল। মিসির আলি বললেন, ‘তুমি আমার অনেক প্রশ্নের জবাব দাও না। কেন দাও না বল তো? কোনো বাধা আছে কি?’

তিন্নি সে-প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘আপনি আমাকে ভালো করে দিন। অসুখ সারিয়ে দিন।’

মিসির আলির খুবই মন-খারাপ হয়ে গেল। বাচ্চা একটি মেয়ে বাস করছে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি জগতে—যে-জগতের সঙ্গে আশেপাশের চেনা জগতের কোনো মিল নেই। মেয়েটি কষ্ট পাচ্ছে। তার কষ্টের ব্যাপারটি কাউকে বলতে পারছে না। সে নিজেও হয়তো জানে না পুরোপুরি।

‘তিন্নি, আমি যাই?’

মেয়েটি কিছু বলল না। মিসির আলি লক্ষ করলেন, তিন্নি নিঃশব্দে কাঁদছে।

ঢাকায় ফেরার ট্রেনে উঠবার পর মিসির আলির মনে পড়ল, তিন কাপ চায়ের দাম তিনি দিয়ে আসেন নি। রশিদ নামের বুড়ো মানুষটি আগামীকাল ভোরবেলায় যখন দেখবে, কেউ আসছে না, তখন না-জানি কি ভাববে। মিসির আলির মন গ্লানিতে ভরে গেল। কিন্তু কিছুই করার নেই। ঢাকা মেইল ছুটে চলেছে। পেছনে পড়ে আছে নদীর ধারে গড়ে—ওঠা চমৎকার একটি শহর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *