রহমান সাহেব রিকশায় বসে আছেন। তার হাতে বাজারের ব্যাগ। লাউ এর মাথা ব্যাগ থেকে বের হয়ে আছে। তিনি তাকিয়ে আছেন লাউটার দিকে। তার পরিষ্কার মনে আছে কেনার সময় লাউটা ছিল ধবধবে শাদা। এখন কেমন কালচে দেখাচ্ছে। এর মানে কি? লাউ বদল হবার তো কোনো সম্ভাবনা নেই। এমন না যে তিনি শাদা লাউ কিনেছেন আর দোকানি ভুলে তার ব্যাগে কালো রঙের একটা লাউ ঢুকিয়ে দিয়েছে। তার স্পষ্ট মনে আছে তিনি নিজের হাতে লাউটা ঢুকিয়েছেন। লাউটার রঙ বদলে গেল কি ভাবে? রহমান সাহেব খুবই দুঃশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন।
রিকশাওয়ালা বলল, চাচামিয়া কোনদিকে যাব?
রহমান সাহেব চমকে উঠলেন। কোন দিকে যাবেন তিনি মনে করতে পারছেন। সব এলোমেলো লাগছে। অতি দ্রুত তার বাসায় যাওয়া উচিত। চিত্রার বিয়ে। লোকজন আসবে। কিন্তু তার বাসাটা কোথায়? বাড়ি দেখলে তিনি অবশ্যই নিতে পারবেন। বাড়ির সামনে জোড়া বাগানবিলাস। একটার ফুল শাদা আরেকটা নীলচে ধরনের লাল। বাইরের উঠোনে চৌবাচ্চা আছে। চৌবাচ্চায় চিত্রার মা মাছ ছেড়েছে। এই মাছগুলির একটা আবার তার সঙ্গে কথা বলেছে। রিকশাওয়ালা আবার বলল, চাচামিয়া কোন দিকে যাব?
রহমান সাহেব হতাশ গলায় বললেন, মনে পড়ছে না। একটু পরেই মনে পড়বে। ভাই, দুটা মিনিট সবুর কর।
রিকশাওয়ালা রিকশা থামিয়ে ফেলল। তার চোখে মুখে স্পষ্ট বিরক্তি। রহমান সাহেব রিকশার সীটে বসে আছেন। বাসার ঠিকানা মনে করতে চাচ্ছেন। যতই মনে করতে চাচ্ছেন ততই সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। বাড়ির সামনের রাস্তায় বড় একটা ডিসপেনসারি আছে। ডিসপেনসারির নাম আরোগ্য। তারপর মনে হল এই ডিসপেনসারিটা তার বাড়ির সামনের রাস্তায় না। অন্য কোথাও। খুব সম্ভব তার অফিসের রাস্তায়। ডিসপেনসারিতে একজন কর্মচারী বসে থাকে। তার গায়ে হলুদ কোট। সে খুবই পান খায়। তার থুতনীতে ছাগলাদাড়ির মতো কিছু দাড়ি। পান খাবার সময় দাড়ি নড়ে। দেখতে মজা লাগে। তিনি অফিসের ঠিকানা মনে করতে চেষ্টা করলেন। সেই ঠিকানা ও মনে পড়ছে না। তার প্রচণ্ড পানির পিপাসা হচ্ছে। তিনি রিকশাওয়ালার দিকে তাকিয়ে করুণ গলায় বললেন, এক গ্লাস পানি খাব।
রিকশাওয়ালা বলল, চাচামিয়া আপনে নামেন। অন্য রিকশায় যান। আমি অখন ভাড়া যামু না।
রহমান সাহেব নেমে পড়লেন। যেদিন থেকে এসেছিলেন সেদিকে হাঁটা নিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের গাড়ির কাছে এসে পড়লেন। গাড়ির ড্রাইভার তাকে দেখে কঠিন গলায় বলল–গিয়েছিলেন কোথায়? চল্লিশ মিনিট ধরে বসে আছি।
রহমান সাহেব অবাক হয়ে দেখলেন ডিসপেনসারিতে হলুদ কোট গায়ে যে কর্মচারীর কথা তিনি ভাবছিলেন আসলে ঘটনা অন্য। এই গাড়ির ড্রাইভারের গায়ে হলুদ কোট। থুতনীতে ছাগলাদাড়ি। আতর মেখেছে বলে ড্রাইভারের গা থেকে কড়া গন্ধ আসছে। এই গন্ধটা আগে পাওয়া যাচ্ছিল না। এখন আতরের গন্ধের জন্যে পাশে দাঁড়ানো যাচ্ছে না।
ড্রাইভার বিরক্ত মুখে বলল, উঠেন গাড়িতে উঠেন।
রহমান সাহেব বললেন, ভাইসাহেব আমার একটা সমস্যা হয়েছে। আমার কিছু মনে আসছে না। কোথায় যাব বুঝতে পারছি না।
ড্রাইভার অবাক হয়ে বলল, এইসব কি বলেন?
রহমান সাহেব ক্লান্ত গলায় বললেন, ভাইসাব আমি কি করব আপনি একটু বলে দেন। মনে হয় আমি পাগল হয়ে গেছি। পাগলদের কোনো ঠিকানা মনে থাকে না।
আপনার কোনো ঠিকানা মনে নাই?
জ্বি না।
গাড়িতে যে লাশ, সে আপনার কে হয়?
আমা বোন হয় তার নাম ফরিদা। তার নাম মনে আছে।
বোনের লামা কোথায়?
মনে আসছে না ভাই সাহেব।
ড্রাইভার বলল, আসুন আমার সঙ্গে আপনার মাথায় পানি ঢালি। দুঃখ ধান্ধায় মাথা গরম হয়ে গেছে আর কিছু না। পানি ঢাললে ঠিক হয়ে যাবে। তিন চার লালতি পানি ঢালতে হবে। এই জিনিস আগেও দেখেছি।
রহমান সাহেব বাধ্য ছেলের মতো ড্রাইভারের পেছনে পেছনে একটা চায়ের দোকানে যাচ্ছেন।