মৌলবী ইজাবুদ্দিন সাহেব, (এম.এ. এল-এল.বি) খবর পাঠিয়েছেন–আমি যেন অবশ্যি তাঁর সঙ্গে দেখা করি, বিশেষ প্রয়োজন। দু বার গিয়ে তাঁকে পেলাম না। তিনি আজকাল ভীষণ ব্যস্ত। বাসায় টেলিফোন এসেছে। সন্ধ্যার পর দু জন আনসার তাঁর বাড়ি পাহারা দেয়। আগে তাঁর বাড়ির বারান্দায় কোনো আলো ছিল না। এখন তিন দিকে এক শ পাওয়ারের তিনটি বাতি জ্বলে।
কোনো মানুষকে দু বার গিয়ে না পাওয়া গেলে তৃতীয় বার যাওয়ার উৎসাহ থাকে না। তাছাড়া আমি ভেবে দেখলাম, আমাকে তাঁর বিশেষ প্রয়োজন হওয়ার কোনোই কারণ নেই। আমি আর না যাওয়াই ঠিক করলাম। তৃতীয় দিন ইজাবুদ্দিন সাহেব আমাকে নেওয়ার জন্যে গাড়ি পাঠালেন। গাড়িতে অসম্ভব রোগা এবং অসম্ভব লম্বা একটি লোক বসে ছিল। সে কড়া গলায় বলল, আপনাকে ডাকা হয়েছে, তবু আপনি আসেন নাই কেন?
আমার সঙ্গে কেউ কড়া গলায় কথা বললে আমি সাধারণত কড়া গলায় জবাব দিই। কিন্তু দিনকাল ভালো নয়, কাজেই সহজ ভঙ্গিতে বললাম, আপনি কে?
তা দিয়ে আপনার দরকার কী?
আপনি কি ইজাবুদ্দিন সাহেবের সঙ্গে কাজ করেন? আপনাকে তো দেখি নি।
আপনি বেশি কথা বলেন। বেশি কথা বলা ঠিক না।
ঠিক না কেন বলেন তো?
লোকটি কঠিন মুখে চুপ করে রইল।
ইজাবুদ্দিন সাহেব কিন্তু এমন ভাব করলেন, যেন আমি এক জন মহ? সম্মানিত ব্যক্তি। গাড়ি থামামাত্র ঘর থেকে বেরিয়ে এসে নরম স্বরে বললেন, আসতে কোনো তোকলিফা হয় নাই তো?
না, কোনো তোকলিফা হয় নি। ব্যাপারটা কী?
আরে না ভাই, কিছু না। কথাবার্তা বলার জন্যে ডাকলাম। আসেন, ভেতরে গিয়ে বসি।
ভেতরে অনেক লোকজন বসে ছিল। এদের মধ্যে এক জনের মাথায় একটি ঝলমলে ঝুটিওয়ালা টুপি। লোকজন এখনো এই জাতীয় টুপি পরে, আমার জানা ছিল না। গাড়ির সেই শুকনো লোকটিকে দেখলাম আলাদা একটা টেবিলে। টেবিলে ফাইলপত্রও আছে। ইজাবুদ্দিন সাহেব বললেন, আপনার এইখানে এক জন লোক মারা গেছে শুনলাম। কীভাবে মারা গেল, কী সমাচার?
আমি বেশ স্পষ্ট স্বরেই বললাম, মিলিটারিরা পিটিয়ে মেরে ফেলেছে।
বলেন কী সাহেব!
ইজাবুদ্দিন সাহেব এমন ভাব করলেন, যেন অকল্পনীয় একটি ঘটনা শুনলেন। সেই শুকনো লোকটি সরু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তুর্কি টুপি-পরা ভদ্রলোক বিড়বিড় করে কী যেন বললেন। তিনি এক সময় গলার স্বর উঁচু করে বললেন, লোকটি কে?
আমার এক জন ভাড়াটে। পরাহেজগার লোক। সাত বছর বয়স থেকে নামাজ কাজ করে নি।
ইজাবুদ্দিন সাহেব থেমে থেমে বললেন, বড়োই আফসোসের কথা। সিপাইদের হাতে দু-একটা এই রকম ঘটনা ঘটেছে। দশ জন মন্দের সাথে এক জন ভালোও শাস্তি পায়। দুনিয়ার নিয়মই এই। আমি ব্রিগেডিয়ার সাহেবকে নিজে বলব ব্যাপারটা। ভবিষ্যতে এই রকম যেন না হয়।
আমি চুপ করে রইলাম। তুর্কি টুপি-পরা ভদ্রলোক বললেন, মৃত্যু স্বয়ং আল্লাহপাকের হাতে। আল্লাহপাক যদি ঐ লোকের মৃত্যু মিলিটারির হাতে লিখে থাকেন, তা হলে হবেই। আপনি আমি কিছুই করতে পারব না। কি বলেন ইজাবুদ্দিন সাহেব?
ইজাবুদ্দিন সাহেব কোনো উত্তর দিলেন না।
আমি বললাম, আপনি কি এইটার জন্যেই ডেকেছেন?
জ্বি না, আমি ডেকেছি। অন্য ব্যাপারে। স্থানীয় কিছু গণ্যমান্য লোকদের নিয়ে একটা শান্তিসভা হবে, যাতে মানুষের মন থেকে ভয়-ভীতি দূর হয়। সবারই এখন মিলেমিশে থাকা দরকার। আপনার বাবা ছিলেন এই অঞ্চলের এক জন বিশিষ্ট ভদ্রলোক! পাকিস্তান হাসেলের জন্যে তিনি যে কী করেছেন তা তো আপনি জানেন না, জানি আমি। জিন্নাহ সাহেবের সাথে তাঁর চিঠিপত্রের যোগাযোগ ছিল। তাঁর ছেলে হিসাবে আপনার শান্তি সভাতে থাকা দরকার।
আমি থাকব।
তা তো থাকবেনই। না থাকলে কি আর আমি ডাকতাম আপনাকে? মানুষ চিনি তো। আপনার দুলাভাইয়ের সঙ্গে দেখা হল সেদিন। তিনি আবার ব্রিগেডিয়ার তোফাজ্জল সাহেবের বিশিষ্ট বন্ধু। ইংল্যাণ্ডে উনার সঙ্গে ব্রিগেডিয়ার সাহেবের পরিচয়। জানি তো সব, হা-হা-হা।
ইজাবুদ্দিন সাহেব আমাকে গাড়িতে করে ফেরত পাঠালেন! সেই শুকনো লোকটা এবারে। খাচ্ছে আমার সঙ্গে। তার ভাবভঙ্গি এখন আর আগের মতো নয়। খুব বিনীত অবস্থা। গাড়ি ছাড়ামাত্র বলল, কোনো রকম অসুবিধা হলে বলবেন আমাকে।
আপনাকে বলব কেন?
না, আমি মানে খোঁজখবর রাখি। অনেক রকম কানেকশন আছে, ইয়ে কি যেন বলে…
লোকটি থাতমত খেয়ে চুপ করে গেল।
বাসায় এসে দেখি বড়ো আপা চিঠি পাঠিয়েছে, তাতে লেখা–আগামী কাল দুপুরে আমরা নীলগঞ্জে চলে যাচ্ছি। তুমি অবশ্যই তোমার জিনিসপত্র নিয়ে চলে আসবে। তোমার দুলাভাইয়ের ধারণা, অবস্থা খুব খারাপ।
আমি অবস্থা খারাপের তেমন কোনো লক্ষণ দেখলাম না। সব কিছুই বেশ স্বাভাবিক। মুক্তিবাহিনীটাহিনী বলে কিছু নেই বলেই মনে হচ্ছে। বড়ো আপার ধারণা, মুক্তিবাহিনীর সমস্ত ব্যাপারটাই আকাশবাণী কলকাতার দেবদুলাল বাবুর কল্পনায়। বড়ো আপাকে ঠিক দোষও দেওয়া যায় না, কলকাতার খবরগুলির প্রায় বার আনাই মিথ্যা। তাদের খবর অনুসারে যেদিন মুক্তিবাহিনীর বোমায় মগবাজার বিদ্যুৎ ট্রান্সমিশন কেন্দ্র সম্পূর্ণ বিকল বলা হল, তার পরদিনই বড়ো আপার বাসায় যাবার সময় দেখি সব ঠিকঠাক আছে। আরেক দিন বলা হল–মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখসমরের ফল হিসেবে ঢাকার রাজপথ আজ জনশূন্য। আমি দেখলাম দিব্যি লোকজন চলাচল করছে।
আমার জানামতে দু জন লোককেই পাওয়া গেল, যাদের স্বাধীন বাংলা বেতার এবং কলকাতা বেতারের খবরের উপর পূর্ণ আস্থা। এক জন আমাদের আজিজ সাহেব, অন্য জন কাদের মিয়া। কাদের মিয়া আবার যা শোনে, তার তিন গুণ বলে। রাতে শোবার আগে সে ইদানীং নিচু গলায় বলছে, ছোড ভাই, মিলিটারির পাতলা পায়খানা শুরু হইছে।
আমি এই জাতীয় আলোচনায় বিশেষ উৎসাহ দেখাই না, কিন্তু কাঁদেরের কোনো উৎসাহর প্রয়োজন হয় না।
বিবিসির খবর ছোড ভাই, চিটাগাং-এ পুরা ফাইট। ঢাকা শহরেও শুরু হইছে। খেইল জমতাছে ছোড়া ভাই।
কই, আমি তো কোনো খেইল দেখি না। ছোড ভাই, এইসব তো দেখনের জিনিস না। ভিতরের ব্যাপার। ইসকুরু টাইট হইতাছে, ছোড ভাই।
টাইট দেওয়া হলে তো ভালোই।
কাদেরের আগের ভাব এখন নেই। আগে সে বাড়িঘর ছেড়ে বড়ো আপার বাসায় গিয়ে ওঠার জন্যে ব্যস্ত ছিল, এখন সে-ব্যস্ততা নেই। তবে তার কাজ অনেক বেড়েছে। প্রতিদিনই এক বার মতিনউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে তার বৈঠক বসে। সেই বৈঠক রাত দশটা–এগারটা পর্যন্ত চলে। এক দিন দেখি–সে মতিনউদ্দিন সাহেবের প্যাকেট থেকে সিগারেট নিচ্ছে। মতিনউদ্দিন সাহেব লাইটার এগিয়ে দিলেন। সকালবেলা নীলু। যখন খবরের কাগজ পড়ে তার বাবাকে শোনায়, কাদের মিয়া সেখানেও হাজির থাকে। এবং পড়া শেষ হলে গম্ভীর হয়ে বলে, একটাও সত্যি খবর নাই। এ ব্যাপারে। আজিজ সাহেবও তার সঙ্গে পুরোপুরি একমত।
মগবাজারে বড়ো আপার বাসায় গিয়ে দেখি তাদের যাওয়া বাতিল হয়ে গেছে। বড়ো আপা মহাখুশি। কাপড়াচোপড় সুটকেস থেকে নামান হচ্ছে। বেশ একটা খুশি খুশি ব্যস্ততা।
তোমাদের যাওয়ার কী হল?
তোর দুলাভাইকে জিজ্ঞেস কর, আমি কিছু জানি না।
দুলাভাই ঠিক পরিষ্কার করে কিছু বলেন না। তার হাবভাবে মনে হল অবস্থা যতটা খারাপ মনে করেছিলেন, ততট, খারাপ নয়। এক দিনে অবস্থা হঠাৎ করে কীভাবে ভালো হয়ে গেল, তা ঠিক বুঝতে পারলাম না।
এক ফাঁকে বড়ো আপা বললেন–তাঁরা তাজমহল রোডের বিজলী মহল্লায় একটা চারতলা বাড়ি কিনবেন। পঁচানব্বই হাজার টাকা দিলেই পাওয়া যায়। যে-অবাঙালীর বাড়ি, সে পাকিস্তান চলে যাবে।–কাজেই জলের দরে সব কিছু বিক্রি করে দিচ্ছে। দেশের অবস্থা ভালো হলে ঐ লোককে জলের দরে সব কিছু বিক্রি করে চলে যেতে হচ্ছে কেন, তাও পরিষ্কার বোঝা গেল না।
দুলাভাই আমাকে গাড়ি করে পৌঁছে দিলেন। অপ্রাসঙ্গিক ভাবেই বললেন, এখানের এক জন ব্রিগেডিয়ারের সঙ্গে আমার খুব জানাশোনা আছে। তোফাজ্জাল নাম। বেলুচ রেজিমেন্টের লোক। খুবই ভালো মানুষ।
আমি জানি, ইজাবুদ্দিন সাহেব বলেছেন।
দুলাভাই হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বললেন, আর কী বলেছে ইজাবুদ্দিন?
নাহ, আর কিছু বলে নি।
দুলাভাই খুব ঠাণ্ডা গলায় বললেন, আমি এদের সঙ্গে মেলামেশা করি না। তোফাজলকে বাসায় পর্যন্ত আসতে বলি না। আমাকে প্রায়ই টেলিফোন করে। কয়েক দিন আগে রাজশাহীর এক ঝড়ি আম পাঠিয়েছে।
আমি চুপ করে রইলাম। দুলাভাই ক্লান্ত স্বরে বললেন, এদের সাথে বেশি। মাখামাখি করা ঠিক না। শীলার বন্ধু লুনাকে তো চেন? ঐ যে খুব সুন্দর দেখতে?
হ্যাঁ চিনেছি।
ওদের বাড়িতে খুব যাতায়ত ছিল মিলিটারিদের লুনার বাবা প্রায়ই পার্টিফার্টি দিতেন। এখন শুনলাম, এক মেজর নাকি লুনাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। ক্লাস নাইনে পড়ে মেয়ে, চিন্তা করে দেখ অবস্থাটা।
বিয়ে হচ্ছে?
দুলাভাই দীর্ঘ সময় চুপ থেকে বললেন, না হয়ে উপায় আছে? তবে আমি লুনার বাবাকে বলেছি সবাইকে নিয়ে সরে পড়তে। লোকটা ঘাবড়ে গেছে।
নীলুর সঙ্গে মতিনউদ্দিন সাহেবের বিয়ে সম্পর্কে যা শুনেছিলাম, তা বোধ হয় ঠিক নয়। বিলুকে এক দিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, সে কোধ ঝাঁকিয়ে বলেছে, দূর, কী যে বলেন। আপনিও কি মতিন ভাইয়ের মতো পাগলা নাকি?
বিলুর কথা অবশ্যি ধর্তব্য নয়। সে কখন কী বলে, তার ঠিক নেই। কখন সে রেগে আছে আর কখন শরিফ মেজাজে আছে, তাও বোঝা মুশকিল। এক দিন জিজ্ঞেস করলাম, বিলু, মতিন সাহেব শুনলাম আমেরিকা ফিরে যাবেন, সত্যি নাকি?
বিলুসঙ্গে সঙ্গে রেগে গেল। চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, যেতে চাইলে যাক, আমরা কি তাকে ধরে রেখেছি?
রাগ করছ কেন বিলু? আমি বিব্রত হয়ে বললাম।
রাগ করলাম কোথায়? রাগের কী দেখলেন? আমি কি আপনাকে বকেছি, না কিছু বলেছি?
বিলু মেয়েটিকে আমার বড়োই দুর্বোধ্য মনে হয়। পনের-ষোল বছরের একটি মেয়ের মধ্যে এতটা দুর্বোধ্যতার কারণ আমি ঠিক বুঝতে পারি না।
এক দিন দুপুরবেলা আমাকে এসে বলল, শফিক ভাই, নীপা শব্দের অর্থ জানা আছে আপনার?
আমি অবাক হয়ে বললাম, না তো? কী জন্যে?
জানিবার জন্যে? এসো নীপবনে এসো ছায়াবীথি তলে। এই গানটি শোনেন নি আপনি?
শুনেছি।
ঐ জায়গায় তো নীপ শব্দটি আছে–এর মনে কী? নীলু আপা জানতে চেয়েছে?
জানি না। আমি। চলন্তিকা দেখে বলতে হবে।
কখন বলবেন?
আমার কাছে চলন্তিকা নেই। খুঁজে দেখতে হবে, রফিকের হয়তো আছে। তার ছোট ভাই বইপত্রের পোকা।
বেশ, তাহলে আজকে সন্ধ্যার আগে বলবেন, খুব জরুরী।
সন্ধ্যাবেলা নীপ শব্দের মানে জেনে ঘরে ফিরছি, গেটের কাছ দেখা নীলুর সঙ্গে। আমি বেশ উৎসাহের সঙ্গে বললাম, নীপ শব্দের মানে হচ্ছে কদম্ব। নীপবন হচ্ছে কদম্ববন।
নীলু মনে হল খুবই অবাক হল। আমি বললাম, বিলু বলছিল তুমি এর মানে মানে জানতে চাও?
নীলু ইতস্তত করে বলল, বিলু প্রায়ই আসে আপনার কাছে, তাই না?
তা আসে।
শফিক ভাই, ওকে আপনি প্রশ্রয় দেবেন না। বিলুর বয়স কম। এই বয়সে মেয়েরা অনেক মন-গড়া জিনিসকে সত্যি মনে করে।
আমি অবাক হয়ে বেশ খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম নীলুর দিকে। নীলু হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, জলিল সাহেবের স্ত্রীকে কি আপনি খবর পাঠিয়েছেন?
না। তার ভাইকে চিঠি দিয়েছি।
উত্তর এসেছে কোনো?
না।
আসলে আমাকে জানাবেন।