এবার বোধহয় মেঘ কাটতে শুরু করেছে। একখানা দরখাস্তের জবাব এসেছে। লিখিত পরীক্ষা হবে। নির্দিষ্ট সময়ে পরীক্ষা-ফি বাবদ দশ টাকা নগদ সহ চাকুরি-প্রার্থীকে হল-এ দেখা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
পরের দিন ভোরবেলাতেই সুকুমার খবর নিতে এলো। সুকুমারের আর তর সয় না। বউদিকে দেখেই জিজ্ঞেস করলো, “সোমটা কোথায়?” সুকুমারও পরীক্ষার চিঠি পেয়েছে। সে বেজায় খুশী।
ঠোঁট উল্টে সুকুমার বললো, “দেখলি তো তদ্বিরে ফল হয় কি না? আমাদের পাড়ার অনেকেই অ্যাপ্লাই করেছিল, কিন্তু কেউ চিঠি পায়নি। সাধে কি আর মিনিস্টারের সি-একে পাকড়েছি! কেন মিথ্যে কথা বলবো, সি-এ বলেছিলেন, আমরা দুজনেই যাতে চান্স পাই তাঁর ব্যবস্থা করবেন।”
আবার বউদির খোঁজ করলো সুকুমার। আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে কমলাকে বললো, “সি-এ তাঁর কাজ করেছেন, এখন আশীর্বাদ করুন আমরা যেন ভালো করতে পারি।”
“নিশ্চয় ভালো পারবে,” বউদি আশীর্বাদ করলেন।
সুকুমারের একটা বদ অভ্যাস আছে। উত্তেজিত হলেই দুটো হাত এক সঙ্গে দ্রুত ঘষতে থাকে। ঐভাবে হাত ঘষতে ঘষতে সুকুমার বললো, “বউদি, এক ঢিলে যদি দুই পাখী মারা যায়, গ্র্যান্ড হয়। একই অফিসে দুজনে চাকরিতে বেরবো।”
সুকুমার বললো, “বিরাট পরীক্ষা। ইংরেজি, অঙ্ক, জেনারেল নলেজ সব বাজিয়ে নেবে। সুতরাং আজ থেকে পরীক্ষার দিন পর্যন্ত আমার টিকিটি দেখতে পাবেন না। মিনিস্টারের সি-এ আমাদের চান্স দিতে পারেন। কিন্তু পরীক্ষায় পাসটা আমাদেরই করতে হবে।”
সুকুমার সত্যিই সোমনাথকে ভালোবাসে। যাবার আগে বললো, “মন দিয়ে পড় এই ক’দিন। তোর তো আবার পরীক্ষাতেই বিশ্বাস নেই। শেষে আমার সিকে ছিড়লো আর তুই চান্স পেলি না, তখন খুব খারাপ লাগবে।”
নির্দিষ্ট দিনে কপালে বিরাট দই-এর ফোঁটা লাগিয়ে সুকুমার এগজামিনেশন হল-এ হাজির হয়েছিল। সোমনাথ ওসব বাড়াবাড়ি করেনি। তবে বউদি জোর করে ওর পকেটে কালীঘাটের জবাফল গুঁজে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “রাখো সঙ্গে। মায়ের ফল থাকলে পথে-ঘাটে বিপদ আসবে না।”
সোমনাথ এসব বিশ্বাস করে না। কিন্তু বউদির সঙ্গে তর্ক করতে ইচ্ছে হয়নি।
হল-এর কাছাকাছি এসেই সোমনাথ কিন্তু আশা ছেড়ে দিয়েছিল। এ-যে স্কুল ফাইন্যাল পরীক্ষার বাড়া। হাজার-হাজার ছেলে আসছে। এবং তাও নাকি দফে-দফে কদিন ধরে পরীক্ষা। রোল নম্বরের দিকে নজর দিয়েই ব্যাপারটা বোঝা উচিত ছিল সোমনাথের। চব্বিশ হাজার কত নম্বর তার। আরও কত আছে কে জানে? হিন্দুস্থানী ফেরিওয়ালারা খবর পেয়েছে। তারা মুড়ি, বাদাম, পাঁউরটি, চা ইত্যাদির বাজার বসিয়েছে।
দিনের শেষে মুখ শুকনো করে সোমনাথ বাড়ি ফিরলো। বউদি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন, জিজ্ঞেস করবেন কেমন পরীক্ষা হলো। কিন্তু সোমনাথের ক্লান্ত মখ-চোখ দেখে কিছুই জানতে চাইলেন না। কাজের অছিলায় বাবাও নেমে এলেন। কায়দা করে জিজ্ঞেস করলেন, “ফেরবার সময় বাস পেতে অসুবিধে হয়নি তো?”
সোমনাথ সব বুঝতে পারছে। বাবা কেন নেমে এসেছেন তাও সে জানে। সে গভীরভাবে বললো, “এইভাবে লোককে কষ্ট না দিয়ে চাকরিগুলো লটারি করতে পারে। ন’টা পোস্টের জন্যে ‘সাতাশ হাজার ছেলেমেয়ে পরীক্ষা দিচ্ছে। এর থেকে কে যোগ্য কীভাবে ঠিক করবে?”
বাবা ব্যাপারটা বুঝলেন। আর কথা না বাড়িয়ে আবার ওপরে উঠে গেলেন, যদিও প্রশ্নগুলো তাঁর দেখবার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু কোশ্চেন পেপার নিয়ে আসতে দেয়নি, পরীক্ষা হল-এই ফেরত নিয়েছে।
পরের দিন সকালে সুকুমার আবার এসেছে। ওর মুখ-চোখের অবস্থা দেখে বউদি পর্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়লেন। জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে তোমার? রাত্রে ঘুমোওনি?”
সুকুমার কষ্ট করে হাসলো। তারপর সোমনাথের খোঁজ নিলো। “কীরে? তোর পরীক্ষা কেমন হলো?”
সোমনাথ বিছানাতেই শুয়ে ছিল। উঠে বললো, “যা হবার তাই হয়েছে।”
সুকুমার বললো, “ইংরাজী রচনায় কোনো অলটারনেটিভ ছিল না। এম-এল-এ-দার কাছে শুনে গেলাম ‘গরিবী হটাও পড়বে। ওই প্রবন্ধটা এমন মুখস্থ করে গিয়েছিলাম যে চান্স পেলে ফাটিয়ে দিতাম। জীবেন মুখজ্যে গোল্ড মেডালিস্টের লেখা।”
সোমনাথ চুপচাপ সুকুমারের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। সুকুমার বললো, “আনএমপ্লয়মেন্ট সম্বন্ধেও একটা রচনা খেটেখটে তৈরি করেছিলাম। বেকার সমস্যা দূর করবার জন্যে অডিনারি বইতে মাত্র ছ’টা কর্মসূচী থাকে তার জায়গায় আমি সতেরটা দফা, ঢুকিয়েছিলাম। পড়লে ফাটিয়ে দিতাম। কিন্তু এমনই পোড়া কপাল যে রচনা এলো ‘ভারতীয় সভ্যতায় অরণ্যের দান’।”
মুখ কাঁচুমাচু করে সুকুমার জিজ্ঞেস করলো, “তুই কি লিখলি রে? তোর নিশ্চয় বিষয়টা তৈরি ছিল!”
“মুণ্ডু ছিল,” সোমনাথ রেগে উত্তর দিলো।
“আমারও রাগ হচ্ছিল, কিন্তু চাকরি খুঁজতে এসে রাগ করলে চলবে না। তাই ফেনিয়ে ফেনিয়ে লিখে দিলুম, অরণ্য না থাকলে ভারতীয় সভ্যতা গোল্লায় যেতে-কেউ তাকে বাঁচাতে পারতো না।” সুকুমার অসহায়ভাবে বললো।
তুই তো তব লিখেছিস, আমি ছেড়ে দিয়ে এসেছি।”
সুকুমার সমস্ত বিষয়টাকে ভীষণ গুরত্ব দিয়েছে। এবার মুখ কাঁচুমাচু করে বললো, “ভাই সোম, লাস্ট পেপারে এসে ড়ুবলাম। জেনারেল নলেজে ভীষণ খারাপ করেছি।”
সোমনাথের এসব বিষয় আলোচনা করতেই ভালো লাগছিল না। কিন্তু সুকুমার। নাছোড়বান্দা।
সুকুমার বললো, “একটা মাত্র প্রশ্ন পেরেছি—ভারতে বেকারের সংখ্যা কত? মুখস্থ ছিল—পাঁচ কোটি। দু নম্বর কোনো বেটা আটকাতে পারবে না।”
“একশ’র মধ্যে দু নম্বর মন্দ কী?” ব্যঙ্গ করলো সোমনাথ।
সুকুমারের মাথায় ওসব সক্ষম ইঙ্গিত ঢাকলো না। সে বললো, “আরেকটা কোশ্চেনে দু নম্বর দিতেও পারে, নাও দিতে পারে। সেইটে নিয়ে চিcীয় পড়ে গেছি। নীলগিরি’ সম্বন্ধে আমি ভাই লিখে দিয়েছি-দাক্ষিণাত্যের পর্বত। কিন্তু অন্য ছেলেরা বললো, আমাকে নম্বর দেবে না। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার চাকরি তো! লিখতে হবে ভারতের নতুন ফ্রিগেট।”
খুব দুঃখ করতে লাগলো সুকুমার। “আমার মাথায় সত্যিই গোবর। কাগজে বেরিয়েছিল প্রধানমন্ত্রী নিজে নীলগিরি জলে ভাসালেন—আর আমি কিনা ছাই লিখে ফেললাম নীলগিরি পর্বত।”
বউদি চা দিতে এসে ব্যাপারটা শুনলেন। বললেন, “আমার তো মনে হয় তুমিই ঠিক লিখেছো। নীলগিরি পর্বত তো চিরকাল থাকবে, যুদ্ধ জাহাজ নীলগিরির পরমায়, ক’বছর?”
সুকুমার আশ্বস্ত হলো না। আপনি ভুল করছেন বউদি। ফ্রিগেট নীলগিরি যে গভরমেণ্টের। গভরমেন্টের কোম্পানিতে চাকরির চেষ্টা করবে আর গভরমেন্টের জিনিস সম্বন্ধে লিখবে না, এটা কেন চলবে? নেহাত আমাকে যদি বাঁচাতে চায়, এগজামিনার হয়তো দ-এর মধ্যে এক নম্বর দেবে।”
“ওসব ভেবে কী হবে?” সোমনাথ এবার বন্ধুকে বোঝাবার চেষ্টা করে। কিন্তু সুকুমার নিজের খেয়ালেই রয়েছে। বললো, “যা দুঃখ হচ্ছে না, মাইরি। পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট প্রজাতন্ত্রের নামটা জেনে যাইনি।”
‘ডজন ডজন দেশ যখন রয়েছে, তখন তার মধ্যে একটা বৃহত্তম এবং একটা ক্ষুদ্রতম হবেই,” সোমনাথের কথায় এবার বেশ শ্লেষ ছিল।
সুকুমার কিন্তু এসব চিন্তা ঝেড়ে ফেলতে পারছে না। বললো, “খবরের কাগজ অফিসের নকুল চ্যাটার্জির সঙ্গে বাসে দেখা হলো। উনি বলে দিলেন, উত্তর হবে, স্যান মেরিনো রাজ্য, ইটালির কাছে। দেশটার সাইজ কলকাতার মতো, মাত্র পনেরো হাজার লোক থাকে।” খুব দুঃখ করতে লাগলো সুকুমার। “আগে থেকে জেনে রাখলে আরও দু নম্বর পেতুম।”
সোমনাথ এবার রাগে ফেটে পড়লো। “আপিসের জেনারেল ম্যানেজার এইসব প্রশ্নের উত্তর জানে?”
সুকুমার এমনই বোকা যে ভাবছে ওরা নিশ্চয়ই অনেক কিছু জানে, না হলে বড় বড় পোস্টে কী ভাবে বসলো?
সুকুমার বললো, “পরের কোশ্চেনটায় অবশ্য অনেকেই মার খাবে—পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাণীর নাম। আমি তো ভাই সরল মনে হাতির নাম লিখে বসে আছি। নকুলবাবু বললেন, সঠিক উত্তর হবে ব্লু হোয়েল। এক-একটার ওজন দেড়শ’ টন। হাতি সে তুলনায় শিশ!”
“চুলোয় যাক ওসব।” আবার তেড়ে উঠলো সোমনাথ। “করবি তো কেরানির চাকরি। তার জন্যে হাতির ডাক্তার হয়ে লাভ কী?”
বেচারা সুকুমার একটু মুষড়ে পড়লো। বললো, “তোর তো আমার মতো অবস্থা না। তুই এসব কথা বলতে পারিস। তুই মজাসে বাবা-দাদার হোটেলে আছিস। যে কোনো কোশ্চেন তুই ছেড়ে দিতে পারিস। আমার বাবাকে রিটায়ারের বিপিত্তর শুকিয়ে দিয়েছে। সামনের মাস থেকে বাবার চাকরি থাকবে না। পরের মাস থেকে মাইনে পাবে না। প্রতি সপ্তাহে আটটা লোকের রেশন তুলতে হবে আমাদের। বাড়ি ভাড়া আছে। মায়ের অসুখ। সুতরাং সমস্ত কোশ্চেনের উত্তর আমাকে দিতে হবে। আমার যে একটা চাকরি চাই-ই।”