০৭. মীনা বলল, ভাইয়া তুমি কি দুপুরে খাবে

মীনা বলল, ভাইয়া তুমি কি দুপুরে খাবে?

জহির বলল, না।

রাতে কখন ফিরবে? দেরি হবে?

দশটার মধ্যে ফিরব।

মীনা বলল, ভাইয়া একটা ফ্রিজ কিনতে পার না। ফ্রিজ থাকলে খাবার নষ্ট হতো না। গরমের সময় ফ্রিজের ঠাণ্ডা পানি খেতে কত ভালো লাগে।

জহির কিছু বলল না। মীনার অতি স্বাভাবিক আচরণ মাঝে মাঝে তার কাছে বিস্ময়কর লাগে। সবুজের প্রসঙ্গ একবারও সে তুলে না! যেন সবুজ নামের কেউ তার জীবনে আসে নি।

ভাইয়া টুনটুনি আজ কী করেছে শোন! আঙুল কেটে ফেলেছে। টুনটুনি মামাকে কাটা আঙুল দেখাও।

টুনটুনি ভয়ে-ভয়ে একটা আঙুল উঁচু করে দেখাল। মীনা বলল, এখন মামার কাছে নিয়ে যাও মামা আঙুলে উম্মা দিয়ে দিবে।

জহির বলল, উম্মা কী?

মীনা বলল, উম্মা হলো চুমু। টুনটুনি নিজে নিজে অনেক অদ্ভুত শব্দ বানিয়েছে। যেমন তুলতা। তুলতা শব্দটার মানে কী ভাইয়া আন্দাজ করতো।

আন্দাজ করতে পারছি না।

মীনা বলল, তুলতা হলো বিড়াল। দুটা শব্দের মধ্যে কোনো মিল আছে বল? কোথায় তুলতা আর কোথায় বিড়াল। টুনটুনি যাও মামার কাছে। মামা তোমাকে উম্মা দিবে। মামাকে ভয় পাও কেন? যাও যাও।

জহির বলল, জোর করে পাঠাতে হবে না। ভয় আস্তে আস্তে ভাঙাই ভালো। তোর বাজার-টাজার কিছু লাগবে?

মীনা বলল, বাজার আছে। ভাইয়া একটা টেলিভিন কিনে দাও না। সারদিন ঘরে থাকি। টেলিভিশন থাকলে সময় কাটত। কতদিন নাটক দেখি না।

জহির বের হয়ে গেল। প্রথমে গেল হাসপাতাল, ফজলুর সঙ্গে কিছু সময় কাটালো। সেখান থেকে সাভারে আলিমুর রহমান সাহেবের খামারবাড়ি। পোট্রেটের কাজ প্রায় শেষপর্যায়ে দু-একদিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা।

 

ফজলুর অবস্থা কয়েক দিনে আরো খারাপ হয়েছে। সে এখন একনাগারে বেশিক্ষণ তাকিয়েও থাকতে পারে না। আপনাতেই চোখ বন্ধ হয়ে আসে। তবে গলার স্বর এখনও সতেজ। সে পাশ ফিরে শুয়েছে। জহিরের দিকে তাকিয়ে আগ্রহের সঙ্গে গল্প করছে।

এক লোক লটারিতে জিতে ফাস্ট প্রাইজ পেয়েছে। ফার্স্ট প্রাইজ হচ্ছে সারা পৃথিবী ভ্রমণের প্লেনের টিকিট। ফ্রী হোটেল। ফ্রী খাওয়া-দাওয়া। এত বড় লটারি জিতেও লোকটার মুখে হাসি নেই। একজন জিজ্ঞেস করল, কী হলো ভাই খুশি হন নাই? লোকটি মাথা চুলকে বলল, খুশি হয়েছি তবে অন্য কোথাও যেতে পারলে ভালো হতো।

প্রশ্নকর্তা বললেন, অন্য কোথাও মানে কী?

সেই লোক ব্ৰিত ভঙ্গিতে বলল, মানে গ্রামের কোনো বাঁশবন। মেঠোপথ। এইসব আর কি…?

জহির বলল, এই গল্পের মানে কী?

ফজলু বলল, মানে হচ্ছে এই মুহূর্তে আমার গ্রামের বাঁশবন, মেঠোপথ এই সব দেখতে ইচ্ছা করছে। দশ বছরের বেশি হয়েছে গ্রাম দেখি না।

জহির বলল, শরীর ঠিক হোক গ্রাম দেখিয়ে আনব।

শরীর ঠিক হবে না। সস্তা দেশী মদ খেয়ে লিভার তো আগেই নষ্ট ছিল, এখন ধরেছে ভাইরাস বাবাজি। শক্ত জিনিস।

জহির বলল, তোর শরীর একটু সারলেই তোকে আমি আমার কাছে এনে রাখব। আমার বোন আছে সে যত্ন করবে।

ফজলু বলল, এই দফায় টিকে গেলে বাঁশবনের ছবি আঁকব। বাঁশবনের ভিতর দিয়ে রোদে এসে পড়েছে। শুধুই আলোছায়ার খেলা। লেমন ইয়োলো আর কোবাল্ট ব্লু। তোর পোট্রেট আঁকা কেমন চলছে?

ভালো।

কয়েকদিন থেকে কেন জানি ছবি আঁকতে ইচ্ছা করছে। ওয়াটার কালার। হালকা ওয়াসে দুই-একটা গাঢ় রঙের টান।

জহির বলল, কাগজ, রঙ দিয়ে যাব?

ফজলু বলল, পাগল হয়েছিস! জেনারেল ওয়ার্ডের এক মরণাপন্ন রোগী জীবনের শেষ ছবি আঁকছে। এই সব সিনেমায় সম্ভব, বাস্তবে সম্ভব না। তুই এখন চলে যা। কতক্ষণ আর রোগীর পাশে বসে থাকবি।

জহির বলল, বইটই কিছু দিয়ে যাব? সময় কাটানোর জন্য?

একটা খাবনামা দিয়ে যাবি। বিকট স্বপ্ন দেখি। খাবনামায় স্বপ্নের অর্থ পড়লে মজা লাগবে।

কী রকম স্বপ্ন?

একটা স্বপ্নে দেখলাম আমার হাতে আঙুলের সংখ্যা বেড়ে গেছে। অনেকগুলি করে আঙুল কিলবিল করছে। মাথাটাথা নষ্ট হয়ে গেলে মানুষ এরকম স্বপ্ন দেখে। নানান হাইপোথিসিস নিয়ে চিন্তা করে করে আমার মাথা গেছে।

জহির উঠে পড়ল। বাস ধরে সাভার যেতে হবে। আলিমুর রহমান সাহেব যদিও বলে দিয়েছিলেন, ম্যানেজারকে বললেই ম্যানেজার গাড়ি পাঠাবে। কী দরকার? মানুষের কাছ থেকে উপকার নিতে হয় না, উপকার করতেও হয় না।

 

সেই আগের দৃশ্য।

আলিমুর রহমান পা তুলে চেয়ারে বসে আছেন। জহির ব্রাশ ঘষছে। জহিরের ঠোঁটে সিগারেট।

আলিমুর রহমান বললেন, ছবি কী আজ শেষ হবে?

জহির বলল, না।

কবে শেষ হবে?

জানি না।

ঠিক আছে তাড়াহুড়া নাই। আঁকতে থাক। মীনা ভালো আছে? তোমার বোন মীনা।

জি স্যার! ভালো আছে।

তোমার বোনের যে মেয়ে সে ভালো আছে?

জি ভালো আছে।

তার নাম কী?

তার নাম টুনটুনি।

জহির একটা কাজ কর। একদিন মীনা আর টুনটুনিকে এখানে নিয়ে এসো।

এটা ভালো হবে না স্যার।

ভালো হবে না কেন?

আমার বোন অংহ্লাদী ধরনের মেয়ে। আপনার সঙ্গে নানান আহ্লাদী করবে। আপনি রেগে যাবেন।

রেগে যাব কেন?

ওর আহ্লাদী সহ্য করার মতো না।

আলিমুর রহমান আগ্রহ নিয়ে বললেন, একটা উদাহরণ দাও তো।

উদাহরণ মনে আসছে না স্যার। তবে সে যে কোনো মানুষকে আহ্লাদী করে অতি দ্রুত রাগিয়ে দিতে পারে।

আলিমুর রহমান গলা উঁচিয়ে ডাকলেন, কালাম! কালাম!

ছবি আঁকার সময় কালাম বড় সাহেবের দৃষ্টির বাইরে থাকে, তবে সারাক্ষণ কানখাড়া করে রাখে। যেন ডাক শোনামাত্র ছুটে আসতে পারে। কালাম এসে সামনে দাঁড়াল। আলিমুর রহমান বললেন, তুমি এক্ষুনি গাড়ি নিয়ে ঢাকায় যাও। জহিরের বোন আর বোনের মেয়েকে নিয়ে আসবে। জহিরের কাছ থেকে একটা চিঠি লিখিয়ে নিয়ে যাও।

জহির ছবি আঁকা বন্ধ করে তাকিয়ে আছে। আলিমুর রহমান হুকুমের গলায় বললেন, জহির তোমার বাসার ঠিকানা ম্যানেজারকে ভালো করে বুঝিয়ে দাও। অনেক দিন কোনো আহ্লাদী মেয়ে দেখি না। একটা দেখতে ইচ্ছা করছে।

আলিমুর রহমান সিগারেট ধরালেন। লম্বা লম্বা টান দিয়ে মুখ গোল করে ধোয়া ছাড়ছেন। তাকে আনন্দিত মনে হচ্ছে।

জহির।

জি স্যার!

আমার মহাজ্ঞানী পুত্র ছবি আঁকার জন্যে তোমাকে কত টাকা দেবে বলে ঠিক করেছে?

উনি কিছু বলেন নি।

তুমি কিছুই পাবে না।

সে তোমাকে এক টাকার একটা ময়লা ছেঁড়া নোটও দিবে না। কারণ তার ব্যাংকে টাকা নেই। আমি খবর নিয়েছি। তার মাথা এখন ফোটি নাইন। ফোটি নাইন শব্দের অর্থ জান?

জি জানি।

আমার পুত্রের মাথা এখন ফোটি নাইন। সাত গুণন সতি। হা হা হা। আচ্ছা জহির শোন তোমার আহ্লাদী বোন কী খেতে পছন্দ করে? তার পছন্দের সব খাবার বাবুর্চিকে রান্না করতে বলব।

 

মীনা চলে এসেছে এবং মেয়ে নিয়ে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ঘোরাঘুরি করছে। ম্যানেজার তাকে আলিমুর রহমানের কাছে নিয়ে গেল। মাঝখানে গলা নামিয়ে বলল, স্যারের সঙ্গে কোনো বেয়াদবী করবেন না।

মীনা বিরক্ত হয়ে বলল, বেয়াদবী কেন করব! আমাকে দেখে কি আপনার মনে হয় আমি বেয়াদব মেয়ে?

এমি বললাম। আমাদের স্যার খুব রাগী মনি তো।

মীনা বলল, আমরাও খুব রাগী। আমাদের টাকাপয়সা আপনাদের চেয়ে কম এটা মানি। আমাদের রাগ কম এটা মানি না।

আলিমুর রহমান মাছ মারতে বসেছেন। মীনা তাঁকে পা ছুঁয়ে সালাম করল। টুনটুনিকে দিয়েও করাল। টুনটুনিকে সে সালাম করা শিখিয়েছে।

আলিমুর রহমান বললেন, মেয়ে তো খুব সুন্দর!

মীনা বলল, ওর বাবার মতো হয়েছে। তবে ওর বাবার রঙ আরো ভালো। তাই না কি?

জি। সে আপনার চেয়েও ফর্সা। ঢাকায় থাকলে আপনাকে এনে দেখাতাম। সে আছে বিদেশে। মিডিল ইস্টে। বড় চাকরি করে।

ও আচ্ছা!

কোয়ার্টার পেয়েছে। চার রুমের বিরাট বাড়ি। সার্ভেন্টর জন্যে আলাদা ঘর। ওদের পেশাব-পায়খানার জন্য আলাদা বাথরুম। চিঠি লিখেছে আমাদের চলে যাবার জন্যে।

যাচ্ছ না কেন?

ভাইয়াকে একা ফেলে কীভাবে যাব বলেন? ভাইয়াকে কে দেখবে? আমরা দুই ভাই-বোন ছাড়া আর কেউ নাই। মা আমার জন্মের সময় মারা গেছেন। বাবা মারা গেছেন আমার যখন আট বছর বয়স। মা-বাবা না থাকার জন্যে আমাদের দুই ভাই-বোনের মধ্যে মিল খুব বেশি। তাই ঠিক করেছি ভাইয়াকে বিয়ে দিয়ে তারপর যাব। তাকে একা ফেলে যাব না। এটা ভালো না?

হ্যাঁ ভালো।

ভাইবোনের মধ্যে আমাদের মতো মিল আপনি কোথাও দেখবেন না। আপনার সঙ্গে এই নিয়ে লক্ষ টাকা বাজি রাখতে পারি। এই যে দেখুন, আপনার এখানে ভাইয়া ছবি আঁকতে এসেছে, এটাই তো তার কাজ। এর মধ্যে জরুরি চিঠি দিয়ে আমাকে আনিয়েছে। টুনটুনিও ভাইয়ার চোখের মণি। বেশিক্ষণ টুনটুনিকে না দেখলে ভাইয়া থাকতে পারে না। টুনটুনিকে নিয়ে বিদেশে চলে গেলে ভাইয়ার অবস্থা কী হবে চিন্তা করে আমার ঘুম হয় না।

আলিমুর রহমান বললেন, তুমি তো ভালো সমস্যাতেই আছ।

জি! বিরাট সমস্যায় আছি। আপনার এখানে ক্যামেরা আছে?

কেন বল তো?

নতুন জায়গায় এসেছি, কিছু ছবি তুলতাম। টিয়াকে পাঠাতাম। টুনটুনির বাবার নাম সবুজ। ও আমাকে ডাকে ময়না, আমি তাকে ডাকি টিয়া।

আলিমুর রহমান বললেন, তোমরা তা হলে পাখি বংশ? টুনটুনি, ময়না, টিয়া।

মীনা আনন্দিত গলায় বলল, জি! আমরা পাখি বংশ। টুনটুনির একটা ভাই যখন হবে তার নাম রাখব তিতির। তিতিরপাখির নাম আপনি শুনেছেন না?

শুনেছি।

তিতির নাম সুন্দর না?

হ্যাঁ সুন্দর।

আলিমুর রহমান ম্যানেজারকে পাঠালেন ক্যামেরা আনতে।

মীনা বলল, আপনার মাছ মারার শখ, তাই না?

হ্যাঁ।

টুনটুনির বাবারও মাছ মারার খুব শখ। ওদের নিজস্ব বিরাট পুকুর আছে। পুকুর ভর্তি মাছ। আপনি যেমন মাছ মারার জন্যে আলাদা ঘাটলা বানিয়েছেন ওদেরও সে-রকম আছে। ছুটির দিনে সকালে সে মাছ মারতে বসে। আমাকে সব কাজ ফেলে পাশে বসে থাকতে হয়। কাজ-কর্মের অবশ্য কোনো অসুবিধা হয় না। ওদের অনেকলি কাজের লোক।

আলিমুর রহমান মুগ্ধ হয়ে মেয়েটার কথা শুনছেন। কী গুছিয়েই না এই

মেয়ে অনর্গল মিথ্যা বলে যাচ্ছে!

আলিমুর রহমান বললেন, তোমার স্বামী মাছ মারে তুমি পাশে বসে থেকে কী কর?

কী আর করব! কখনও কুরশি কাটা দিয়ে সেলাই করি আবার কখনও গানটান গাই।

তুমি গনি জান না-কি?

রেডিও-টিভি থেকে শুনে শুনে শিখেছি। টুনটুনির বাবা অবশ্য অনেকবার বলেছে গানের টিচার রেখে দেই। গান শেখ। আমি বলেছি, না।

না বললে কেন?

আমার শ্বশুরবাড়ির সবাই খুব ইসলামিক মাইন্ডেট। গান-বাজনা পছন্দ করেন না। আপনি কি আমার একটা গান শুনবেন?

অবশ্যই শুনব।

সিনেমার গান। সিনেমা থেকে শিখেছি।

মীনা গান ধরল—একটা ছিল সোনার কন্যা।

ম্যানেজার কালাম ক্যামেরা নিয়ে এসে অদ্ভুত দৃশ্য দেখে থমকে দাড়াল। বড় সাহেবের কোলে টুনটুনি নামের মেয়েটা বসে আছে। মেয়েটার মা সামনে বসে গান গাইছে।

 

আলিমুর রহমান তাঁর লইয়ারকে নিয়ে বসেছেন। তিনি উইলে আরো কিছু পরিবর্তন করবেন। মীনা এবং টুনটুনির জন্য এমন কিছু ব্যবস্থা করবেন যেন বাকি জীবন তারা নিশ্চিন্ত মনে থাকতে পারে।

উকিল বললেন, দানপত্র করাই ভালো। দানপত্রে লিখতে হবে যে মেয়েটার সেবায় তুষ্ট হইয়া তাহাকে দান করিলাম।

আলিমুর রহমান বললেন, সেবায় তুষ্ট হই নাই। তার মিথ্যা কথা শুনে তুষ্ট হয়েছি। যদি লেখা হয় তাহার মিথ্যা কথা শুনিয়া তুষ্ট হইয়া অমুক অমুক জিনিস দান করিয়াছি। তাতে অসুবিধা আছে?

উকিল তাকিয়ে রইল।

আলিমুর রহমান বললেন, আমার তুষ্ট হওয়া দিয়ে কথা। তুষ্ট কীভাবে হয়েছি সেটা বিষয় না। তুমি কাগজপত্র তৈরি কর।

আপনি আপনার ছেলেকে সত্যি কিছু দেবেন না?

না।

কাজটা ঠিক হচ্ছে না।

আলিমুর রহমান বললেন, তোমাকে টাকা দিয়ে আমি এনেছি আমার কাজের সমালোচনার জন্য না। আমার কাজ করে দেবার জন্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *