০৭. মিতু বলল, বাবা তোমার টেলিফোন

মিতু বলল, বাবা তোমার টেলিফোন। মতিন সাহেব বললেন, বলে দে আমি বাসায়। নেই। তিনি দোতলার বারান্দায় রাখা ইজি চেয়ারে আধশোয়া হয়ে শুয়ে আছেন। একটার পর একটা সিগারেট খেয়ে যাচ্ছেন। দুঘণ্টায় নটি সিগারেট খাওয়া হয়েছে। কোন কিছুতেই তার মন বসছে না। সাবেরের অসুখের এতটা যে বাড়াবাড়ি তা তিনি বুঝতেই পারেননি। ছেলের সঙ্গে ইদানীং তার যোগাযোগ নেই বললেই হয়। সাবের তাঁর ভয়ে অস্থির হয়ে থাকে। এটা জানেন বলেই তিনি নিজেকে দূরে দূরে রাখেন। তার মানে এটা না যে সাবের অসুস্থ হলেও তিনি জানবেন না। ডাক্তারের কথা শুনে তিনি বেশ বিচলিত বোধ করছেন। দুজন ডাক্তারই বললেন, ছেলেকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিন।

তিনি বললেন, কেন?

বেটার কেয়ার হবে।

এইখানে কি বেটার কেয়ার হবে না বলতে চাচ্ছেন?

তা-না। হবে নিশ্চয়ই তবে হাসপাতালে সব সময় হাতের কাছে ডাক্তার থাকবে।

প্রয়োজন হলে এখানেও হাতের কাছে ডাক্তার রাখব। তাছাড়া আমার ছেলে নিজেও একজন ডাক্তার। রেকর্ড নম্বর পেয়ে এম.বি.বি.এস. পাশ করেছে।

কোন ইমার্জেন্সি হলে হাতের কাছে সবকিছু থাকবে। এই জন্যেই হাসপাতালের কথা বলা। অন্য কোন কারণ না।

ইমার্জেন্সি হবে এ রকম আশংকা কি করছেন?

হ্যাঁ করছি। অবস্থা ভাল না।

মতিন সাহেব ছেলেকে হাসপাতালে পাঠাননি। সার্বক্ষণিক সেবার জন্যে একজন নার্স এনেছেন। ডাক্তার একজনও রাখতে চেয়েছিলেন, সাবের রাজি হয়নি। আগ্রহ এবং আনন্দের সঙ্গে বলেছে–ডাক্তার লাগবে কেন বাবা? আমি নিজেই তো ডাক্তার। আগে সব ভুলে গিয়েছিলাম–এখন সব মনে পড়ছে। ফার্মাকোলজির বইটা হাতে নিয়ে যে কোন প্রশ্ন কর–আমি বলে দেব।

সাবেরের কথাবার্তা ঠিক সুস্থ মানুষের কথাবার্তা নয়। যে ছেলে বাবার ভয়ে অস্থির থাকতো আজ সে বাবার সঙ্গে বন্ধুর মত গলায় কথা বলছে। স্বাভাবিক অবস্থায় এভাবে কথা বলা সম্ভব নয়।

বাবা, আমার সমস্যাটা কি ডাক্তাররা তোমাকে বলেছে–?

না।

আমাকেও বলেনি–তবে তারা সন্দেহ করছেন–চিকেন পক্স দূষিত হয়ে গ্যাংগ্রীনের মত হয়ে গেছে। তুমি কি আমার গা থেকে পচা গন্ধ পাচ্ছ?

না।

পচা গন্ধ পেলে বুঝতে হবে গ্যাংগ্রীন। গ্যাংগ্রীনের Causative Agents কি, বলব?

বলতে ইচ্ছে হলে বল।

Clostrodium welchii, gram positive, anaerobic bacilli … বাবা আমি কিন্তু সব মুখস্থ বলে যাচ্ছি।

তাই তো দেখছি।

একজন ভাল ডাক্তারের যে জিনিসটা সবচে বেশী দরকার তা হচ্ছে তীক্ষ্ণ স্মরণশক্তি।

কথা না বলে চুপচাপ শুয়ে থেকে রেস্ট নেয়াটা বোধ হয় ভাল।

মতিন সাহেব ছেলের কাছ থেকে সরে এসে বারান্দায় বসেছেন। সাবেরের পাশে তার মা এবং নার্স মেয়েটি আছে। সুরমা অসম্ভব ভয় পেয়েছেন। নার্স মেয়েটিও ভয় পেয়েছে।

মিতু আবার এসে বলল, বাবা তোমার টেলিফোন।

মতিন সাহেব বললেন, বল বাসায় নেই।

এক মিথ্যা দুবার বলা যায় না বাবা। মিস্টার আগস্ট বলেছেন।

তোমাকে যা বলতে বলেছি বল।

বড় আপা টেলিফোন করেছে–নিশা আপু।

মতিন সাহেব যন্ত্রের মত উঠে গিয়ে টেলিফোন ধরলেন।

বাবা, কেমন আছ?

ভাল।

বাসার সবাই ভাল?

হ্যাঁ।

মিথ্যা কথা বলছ কেন বাবা? সাবেরের তো খুব অসুখ।

হ্যাঁ ওর শরীরটা ভাল নেই।

এই খবর তোমরা আমাকে জানাওনি।

ভুল হয়ে গেছে।

এ রকম ভুল ইদানীং তোমাদের খুব ঘন ঘন হচ্ছে। তুমি একটা এ্যাকসিডেন্ট করেছিলে। একটা লোককে প্রায় মেরেই ফেলেছিলে–তাকে তুলে এনেছ। এখন সে আমাদের বাসাতেই আছে–এই খবরও দাওনি।

এটা তেমন কোন খবর না।

অবশ্যই বড় খবর। লোকটা অদ্ভুত অদ্ভুত সব কাণ্ড করে বেড়াচ্ছে …

কোনই অদ্ভুত কাণ্ড করছে না।

মিতু বলল করছে, মন্টু মামাকে নাকি বটগাছ বানিয়ে দিয়েছে …

মিতু কি বলছে–তাই বিশ্বাস করে বসে আছিস?

মিতু তো বাবা কখনো মিথ্যা কথা বলে না।

বেশ, বাসায় এসে তাহলে তোর বটগাছ মন্টু মামাকে দেখে যা। বটগাছের নীচে বসে খানিকক্ষণ হাওয়া খেয়ে যা।

তুমি এমন রেগে রেগে কথা বলছ কেন বাবা?

রাগ হচ্ছে বলেই রেগে রেগে কথা বলছি।

তুমি কি গাড়িটা পাঠাতে পারবে?

না। গাড়ি নিয়ে এষা সকালে বের হয়েছে, এখনও ফেরেনি।

মতিন সাহেব টেলিফোন রেখে আগের জায়গায় এসে বসলেন। বুঝতে পারছেন নিশার সঙ্গে কঠিন ব্যবহার করা হয়েছে। এ ধরনের ব্যবহার তিনি তার মেয়েদের সঙ্গে কখনো করেন না। সকাল থেকেই মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। বেলা যতই বাড়ছে মেজাজ ততই খারাপ হচ্ছে। এখন দুপুর।

মিতু ঢুকলো, বাবা আবার টেলিফোন। নিশা আপা ফোন করেছে। তুমি নাকি তাকে বকা দিয়েছ? সে কাঁদছে।

কাঁদুক।

মিতু ফিরে গেল। নিশাকে বলল, বাবাকে বলেছিলাম তুমি কাঁদছ। বাবা বললেন–কাঁদুক।

 

সুরমা অফিসে হাজিরা দিতে গেছেন।

ব্যাংকের চাকরিতে হুট করে এ্যাবসেন্ট করা যায় না। এ.জি.এম-কে জানাতে হবে। আজকের দিন ছাড়াও আরো দুদিন ছুটি নেবেন। তাঁর মাথায় যন্ত্রণা অন্যদিন সন্ধ্যার পর হয়, আজ শুরু হয়েছে দুপুর থেকে। সাবের তার ঘরে একা। নার্স মেয়েটি ঘরের বাইরে বারান্দায় চেয়ারে উদ্বিগ্ন মুখে বসে আছে। মেয়েটি অসম্ভব রোগা–শ্যামলা চেহারা। সরল মুখ। চোখ দেখে মনে হয় কোন কারণে ভয়ে অস্থির হয়ে আছে। বাইশ তেইশ বছর বয়স, রোগা বলেই বোধ হয় আরো কম দেখা যায়। নার্স এর পেশায় মেয়েটি দুবছর কাটিয়েছে–এর মধ্যেই রোগ এবং রোগী সম্পর্কে নির্বিকার ভাব চলে আসা উচিত ছিল, তা আসেনি।

মেয়েটি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। রুগীকে এন্টিবায়োটিক খাওয়ানোর সময় হয়ে গেছে। রুগী এখন ঘুমুচ্ছে। ঘুম ভাঙ্গিয়ে হলেও অষুধ খাওয়াতে হবে। এক মিনিট এদিক-ওদিক হতে দেয়া যাবে না।

সাবেরের গায়ে হাত দেয়া মাত্র সে চোখ মেলল।

স্যার, আপনার অষুধ খাওয়ার সময় হয়েছে।

সাবের বিস্মিত হয়ে বলল, আপনি আমাকে স্যার বলছেন কেন? আগেও বলব ভাবছিলাম। মনে থাকে না–আপনি নাম ধরে ডাকবেন। ভাল কথা–আপনার নাম কি?

হৈমন্তী।

বাহ, চমৎকার। হেমন্ত ঋতুতে জন্ম বলেই কি হৈমন্তী?

জী।

আমাদের এখানে একজন আছেন তার নাম মিঃ আগস্ট। তাঁর সঙ্গে কি কথা বলেছেন?

জি-না।

কথা বলে দেখবেন। চমৎকার মানুষ।

জ্বি–আচ্ছা, কথা বলব। নিন, অষুধটা খান।

আমি অষুধ খাব না বলে ঠিক করেছি।

কখন ঠিক করলেন?

কিছুক্ষণ আগে। চোখ বন্ধ করে এই ব্যাপারটাই ভাবছিলাম। আমি ভেবে দেখলাম কি জানেন? আমি চিন্তা করে দেখলাম–এই মুহূর্তে আমার শরীরে আছে লক্ষ কোটি জীবাণু। অষুধ খাওয়া মানে এদের ধবংস করা। সেটা ঠিক হবে না। আমাদের যেমন জীবন আছে, ওদেরও জীবন আছে–সুখ-দুঃখ আছে। একটি জীবনের জন্যে লক্ষ কোটি জীবন নষ্ট করার কোন কারণ দেখি না।

ছেলেমানুষি করবেন না–অষুধ খান।

না। অষুধ থাক–আপনি বরং একটা কবিতা শুনুন।

আগে অষুধ খান–তারপর শুনব। তার আগে না।

বললাম তো অষুধ খাব না।

হৈমন্তী মতিন সাহেবকে ডেকে নিয়ে এল। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, তুমি নাকি অষুধ খেতে চাচ্ছ না?

না। অষুধ খাওয়া মানে লক্ষ কোটি জীবাণুর মৃত্যুর কারণ হওয়া।

অষুধ না খেলে তুমি নিজে মারা যাবে। তোমার শরীরেও লক্ষ কোটি জীবন্ত কোষ আছে। ওদেরও মৃত্যু হবে।

তোমার কথা খুবই ঠিক বাবা। তবে যুক্তিতে ভুল আছে। আমাদের শরীরে লক্ষ কোটি জীবকোষ থাকলেও আমাদের একটি মাত্র চেতনা। কিন্তু জীবাণুগুলির স্বাধীন সত্তা আছে। এরা প্রত্যেকেই আলাদা।

তোমাকে কে বলেছে? জীবাণুগুলির সঙ্গে তোমার কি কথা হয়েছে?

জ্বি হয়েছে।

কখন কথা হল?

পরশু রাতে প্রথম কথা হয়েছে। তারপরেও কয়েকবার কথা হয়েছে। দীর্ঘ সময় তাদের সঙ্গে কথা বলা একটা সমস্যা–সবাই এক সঙ্গে কথা বলতে চায়–আর কথা বলে খুব দ্রুত …।

তুমি বোধ হয় বুঝতে পারছ না যে তোমার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে।

আমার কিন্তু তা মনে হয় না, বাবা।

জীবাণুদের সঙ্গে কথা বলার এই কায়দা তোমাকে কে শিখিয়েছেন? মিস্টার আগস্ট??

কথা বলছ না কেন? মিস্টার আগস্ট শিখিয়েছেন?

কেউ শেখায়নি। আমি নিজে নিজেই শিখেছি।

মতিন সাহেব কিছু না বলে বারান্দায় নিজের জায়গায় ফিরে গেলেন। সিগারেট শেষ হয়ে গিয়েছিল–সিগারেট আনতে পাঠালেন। দারোয়ানকে বলে দিলেন–মিস্টার আগস্ট আসামাত্র যেন তাকে খবর দেয়া হয়।

মিতু এসে বলল, এষা আপু এসেছে।

মতিন সাহেব বললেন, আমার কাছে আসতে বল।

ও আসবে না। দরজা বন্ধ করে কাঁদছে।

কাঁদছে বুঝলে কি করে?

শব্দ শোনা যাচ্ছে।

আচ্ছা, ঠিক আছে যাও।

কোথায় যাব?

কোথায় যাবে আমি জানি না। আপাতত আমার সামনে থেকে যাও।

তুমি আমার উপর রাগ করছ কেন? আমি কি করলাম?

যাও আমার সামনে থেকে। যাও বলছি।

মিতুর চোখে পানি এসে গেল। সে চোখ মুছতে মুছতে বাবার সামনে থেকে চলে গেল এবং পর মুহূর্তেই ফিরে এসে বলল, বাবা নিশা আপু এসেছে।

 

মিস্টার আগস্ট এলেন সন্ধ্যার পর।

বাসায় তখন তুমুল উত্তেজনা। এম্বুলেন্স এসেছে–সাবেরকে হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে। সুরমা ব্যাকুল হয়ে কঁদছেন। নিশা এবং এষা কাঁদছে না, তবে পুরোপুরি হকচকিয়ে গেছে। মিস্টার আগস্টের বাড়িতে ঢােকা কেউ লক্ষ্য করল না–সে চলে গেল কাঁঠাল গাছের দিকে। সেখানে আগে থেকেই কে যেন বসে আছে। মোটাসোটা একজন মানুষ।

আগস্ট বলল, কে?

লোকটি দারুণ চমকে গেল। একজন বয়স্ক মানুষ এতটা চমকায় না।

আগস্ট আবার বলল, ভাই, আপনি কে?

আমি সিরাজুল ইসলাম।

ও আচ্ছা চিনেছি–আপনি মিতুর সবচেয়ে বড় বোনের হাসব্যাণ্ড?

জি।

এখানে বসে আছেন কেন?

বাসায় কান্নাকাটি হচ্ছে–আমি ভাবলাম একটু দূরেই থাকি। জামাইরা কখনো বাড়ির মেইন স্ট্রীমের সঙ্গে মিশতে পারে না। তাছাড়া বাড়ির কেউ চায়ও না জামাইরা তাদের সঙ্গে মিশে যাক। ভাল কথা, আপনি কে?

আমার নাম আগস্ট।

ও আচ্ছা, আপনি আগস্ট?

জি।

মাই গড। আমি ভেবেছিলাম অদ্ভুত একজন কাউকে দেখব। ঋষিদের মত চুল, দাড়ি–লম্বা, ফর্সা। আপনাকে তো খুবই নরম্যাল একজন মানুষ বলে মনে হচ্ছে।

খুব নরম্যাল না। আমি পুরোনো কথা কিছুই মনে করতে পারছি না।

এ্যামনেশিয়া?

ডাক্তার তাই বলেছে।

আপনার সম্পর্কে এত সব অদ্ভুত কথা কেন রটছে বলুন তো? মন্টুকে নাকি গাছ বানিয়ে দিয়েছেন?

আগস্ট বসতে বসতে বলল, ঠিক বানাইনি, বানানোর কৌশল ব্যাখ্যা করলাম।

সিরাজুল ইসলাম বিস্মিত হয়ে বললেন, গাছ বানানোর কৌশল আবার কি?

আগস্ট কোন জবাব দিল না। সিরাজুল ইসলাম সাহেব একটু সরে বসলেন। লোকটা উন্মাদ হতে পারে। কিছু কিছু উন্মাদ সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে চলাফেরা করে। তাদের পাগলামি হঠাৎ হঠাৎ চোখে পড়ে। এ-ও মনে হচ্ছে সে রকম কেউ। দীর্ঘদিন একে এ বাড়িতে পোষা হচ্ছে কেন সেও এক রহস্য।

সিরাজুল ইসলাম উঠে দাঁড়ালেন।

আগস্ট বলল, চলে যাচ্ছেন?

সিরাজুল ইসলাম জবাব দিলেন না। পাগল মানুষের প্রতিটি কথার জবাব দেয়ার কোনই প্রয়োজন নেই। আগস্ট বলল, আপনার কাছে সিগারেট থাকলে দয়া করে একটা দিয়ে যান।

সিরাজুল ইসলাম আবার ভাবলেন, বলবেন, আমি সিগারেট খাই না। মিথ্যা, কথাটা চট করে মুখে এল না। তিনি সিগারেটের প্যাকেট বের করলেন–দুটা মাত্র সিগারেট। তিনি প্যাকেটটাই কাঁঠাল গাছের দিকে ছুঁড়ে দিলেন।

আগস্ট বলল, দিয়াশলাই? দিয়াশলাই না দিয়ে চলে যাচ্ছেন। তিনি দিয়াশলাইও ছুঁড়ে ফেললেন।

 

সাবেরকে হাসপাতালে নেয়ার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। একমাত্র উপায় ছিল জোর করে এম্বুলেন্সে তোলা–মতিন সাহেব নিষেধ করলেন। অবোধ শিশুদের উপর জোর খাটানো যায়। সাবের শিশু নয়, অবোধও নয়। তাছাড়া যে চিকিৎসা এখানে করা সম্ভব হচ্ছে না সে চিকিৎসা হাসপাতালে কিভাবে করা হবে? মতিন সাহেব কঠিন গলায় বললেন, সাবের, তুমি যে মারা যাচ্ছ তা কি বুঝতে পারছ?

পারছি–জীবাণুরা আমাকে বলেছে।

ওদের সঙ্গে তোমার কথাবার্তা তাহলে এখনো হচ্ছে?

হ্যাঁ, হচ্ছে।

তুমি যে নিতান্তই পাগলের মত কথা বলছ তা কি বুঝতে পারছ?

পারছি–কিন্তু আমি যা বলছি তা সত্য। জীবাণুরা যে কোন ভাবেই হোক আমার সঙ্গে কম্যুনিকেট করতে পারছে। তোমাদের ব্যাপারটা আমি বোঝাতে পারছি না, কারণ কোন অস্বাভাবিক ব্যাপার গ্রহণ করার মত মানসিক প্রস্তুতি তোমাদের নেই।

তুমি তো আমাদেরই একজন। তোমার ভেতর সেই মানসিক প্রস্তুতি কি করে হয়ে গেল?

মিস্টার আগস্ট আমাকে সাহায্য করেছেন।

মতিন সাহেব থমথমে গলায় বললেন, সে তোমাকে জীবাণুর সঙ্গে কথা বলা শিখিয়েছে?

তা–না, ব্যাপারটা কি হয়েছে আমি তোমাকে বলি–মানুষের অসুখ কি করে হয় ঐ ব্যাপারটা মিস্টার আগস্ট জানতেন না। আমি একদিন তাঁকে বুঝিয়ে বললাম, পুরো ব্যাপারটা হয় জীবাণুঘটিত নয় ভাইরাসঘটিত। তখন তিনি খুব আগ্রহ করে জানতে চাইলেন–আচ্ছা ঐ জীবাণুদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায় না? ওদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে পারলে খুব সুবিধা হত। তারপর থেকে আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি …।

তুমি তাহলে প্রথম ব্যক্তি যে জীবাণুদের সঙ্গে কথা বলল?

এর আগেও হয়ত কেউ কেউ করেছে–এটা তেমন কঠিন কিছু না।

এর আগে কেউ যদি করে থাকে তাহলে এতদিনে আমরা কি তা জানতে পারতাম না?

না। যাদের এই সৌভাগ্য হয়েছে তারা ভেবেছে এটা এক ধরনের স্বপ্ন। এক ধরনের ভ্রান্তি। তারা নিজেরাও ঠিক বিশ্বাস করেনি, কাজেই কাউকে বলেনি।

তোমার ধারণা এটা স্বপ্ন বা ভ্রান্তি নয়?

আমার তাই ধারণা।

তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে সাবের। তোমার ব্রেইন এখন ননফাংশানিং।

সাবের চোখ বন্ধ করে ফেলল। দীর্ঘ সময় কথা বলার কারণে সে ক্লান্তিতে ভেঙ্গে পড়েছে। তার শ্বাসকষ্ট শুরু হল। মতিন সাহেব সুরমার দিকে তাকালেন। সুরমা তার ছেলের মাথার কাছে মূর্তির মত বসে আছেন। তাঁর পেছনে খাট ধরে দাঁড়িয়ে আছে নিশা। সে পুরোপুরি হতভম্ব হয়ে গেছে। মতিন সাহেব মিস্টার আগস্টের খোঁজে বের হলেন। আগস্ট ফিরে এসেছে এবং কাঁঠাল গাছের নিচে বসে আছে এই খবর তিনি পেয়েছেন।

 

মতিন সাহেবকে দেখে আগস্ট উঠে দাঁড়াল।

মতিন সাহেব তীব্র গলায় বললেন, আপনি কে ঠিক করে বলুন তো?

আগস্ট শান্ত গলায় বলল, আমি কে তা আমি জানি না। জানলে অবশ্যই বলতাম।

আপনি জানেন না আপনি কে?

জ্বি না। এবং মজার ব্যাপার কি জানেন–আপনি নিজেও জানেন না আপনি কে? এই পৃথিবীর কোন মানুষ জানে না সে কে? সে কোথা থেকে এসেছে–সে কোথায় যাবে।

আপনি আমার পরিবারে যে ভয়াবহ সমস্যার সৃষ্টি করেছেন তা কি আপনি জানেন?

পুরোপুরি না জানলেও আঁচ করতে পারছি।

কাল সকালে সূর্য ওঠার পর এই বাড়িতে আমি আপনাকে দেখতে চাই না।

আমি কি বলছি বুঝতে পারছেন?

পারছি। আপনি চাইলে আমি এখনো চলে যেতে পারি!

এত রাতে কোথায় যাবেন?

হাঁটতে শুরু করব, তারপর আপনার মত একজন কেউ আমাকে পাবে… তাঁর বাসায় কিছুদিন থাকব। তারপর …

আপনার জীবন কি এই ভাবেই কাটছে?

আমি জানি না। সত্যি জানি না–জানলে আপনাকে জানাতাম। কাঁঠাল গাছের নিচে বসে আমি প্রায়ই ভাবি–আমি কে? পুরানো স্মৃতি বলে আমার কিছু নেই। আমি বাস করি বর্তমানে।

মতিন সাহেব কঠিন গলায় বললেন, আপনি আমাকে কনফিউজ করার চেষ্টা করবেন না, আমি মন্টু না যে আপনার কথা শুনে গাছ হবার জন্য মাঠে দাঁড়িয়ে থাকব বা জীবাণুদের সঙ্গে বাক্যালাপ শুরু করব …

আপনি শুধু শুধু রাগ করছেন।

মতিন সাহেব শান্ত গলায় বললেন, আপনি কি দয়া করে আমার ছেলের সঙ্গে কথা বলবেন? ওকে বুঝাবেন যে জীবাণুদের সঙ্গে বাক্যালাপ করা যায় না। সে যা করছে তা নেহায়েত পাগলামী …

পাগলামী তো না-ও হতে পারে।

তার মানে?

হয়ত সে সত্যি ওদের সঙ্গে কথা বলার ক্ষমতা আয়ত্ত করেছে।

মতিন সাহেব রাগে কাঁপছেন। তীব্র রাগে তিনি কয়েক মুহূর্ত চোখে অন্ধকার দেখলেন–একবার ইচ্ছে হল পাগলটার উপর ঝাপিয়ে পড়েন। নিজেকে সামলালেন। বাগান থেকে ঘরের দিকে রওনা হলেন। ক্লান্তিতে পা ভেঙ্গে আসছে।

 

মিতু এসে আগস্টকে বলল, আপনাকে খেতে ডাকছে।

আগস্ট উঠে দাঁড়াল। মিতু বলল, ডাইনিং ঘরে খাবার দিয়েছে।

আগস্ট কিছু বলল না। কাজের মেয়ে তার খাবার ঘরে দিয়ে যায়। আজ প্রথম ডাইনিং ঘরে ডাক পড়ল। শেষ খাবার বলেই বোধ হয়। আগস্ট ভেবেছিল ডাইনিং হলে অনেকেই থাকবে। দেখা গেল শুধু সে আর মিতু। এষা খাবার এগিয়ে দিচ্ছে। এষার চোখ মুখ কঠিন হয়ে আছে। সে খাবারদাবার টেবিলে রাখছে যন্ত্রের মত।

আগস্ট বলল, আমি কাল ভোরে চলে যাচ্ছি। আপনাদের অনেক বিরক্ত করলাম–কিছু মনে করবেন না।

এষা উত্তর দিল না। মিতু বলল, আর আসবেন না? আগস্ট ভাত মাখতে মাখতে বলল, ভবিষ্যতের কথা তো আমি বলতে পারি না। আসতেও পারি। হয়ত

কুড়ি, পঁচিশ বা ত্রিশ বছর পর আবার দেখা হবে।

মিতু বলল, তখন কি আপনি আমাকে চিনতে পারবেন?

চিনতে না পারারই কথা। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে চেহারা পাল্টে যায়। তবে তুমি তোমার নাম যদি বল–আমি চিনতে পারব। মানুষের চেহারা পাল্টালেও নাম পাল্টায় না।

খাওয়া এগুচ্ছে নিঃশব্দে। মিতু টেবিল ছেড়ে চলে যাওয়ার পর এষা আগস্টের মুখোমুখি বসল। কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না। চুপ করে গেল। শুধু তাকিয়ে রইল এক দৃষ্টিতে।

আগস্ট বলল, আপনি কি কিছু বলতে চাচ্ছেন? বলতে চাইলে বলে ফেলুন। আর সুযোগ পাবেন না।

এষা নীচু গলায় বলল, আপনি কে আমি জানি না। জানতেও চাই না–হয়ত আপনি কেউ না, সাধারণ একজন মানুষ–কিংবা হয়ত বিশেষ ধরনের একজন মানুষ … আপনি যেই হোন, আমি হাত জোর করে আপনার কাছে একটা অনুরোধ করব।

করুন।

ভাইয়ার মাথায় যে পাগলামীটা ঢুকেছে তা আপনি দূর করে দিন।

যাবার আগে আমি অবশ্যই তার সঙ্গে কথা বলব। তবে তাতে লাভ হবে কিনা জানি না। সে যা করেছে তা যদি পাগলামী না হয় তাহলে তা দূর করা তো অসম্ভব।

এষা শান্ত গলায় বলল, আমার একটি ব্যক্তিগত সমস্যাও আপনাকে বলতে চাই। বলতে ইচ্ছা করছে বলেই বলছি। আমার কোন লাভ হবে বলে বলছি না–

বলুন। আমি খুব মন দিয়ে শুনছি।

এষা নরম গলায় বলল, একটা ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। আমার ধারণা ছিল ছেলেটাকে আমি পাগলের মত ভালবাসি। এখন মনে হচ্ছে বাসি না। আবার মনে হচ্ছে বাসি। আপনি তো অদ্ভুত অদ্ভুত সব কথাবার্তা বলেন–আপনি কি এমন কিছু জানেন যা আমার মনের দ্বিধা দূর করতে পারবে?

আগস্ট শব্দ করে হাসল।

এষা আহত গলায় বলল, হাসছেন কেন?

হাসছি–কারণ একটি মেয়ে প্রেমে পড়েছে কি পড়েনি তা জানা খুব সহজ। কোন মেয়ে যদি প্রেমে পড়ে তাহলে তার মধ্যে কিছু অলৌকিক ক্ষমতা চলে আসে। সেই মেয়ে যদি কোন কাচের পাত্রে হাত রাখে সেই পাত্র গাঢ় নীল বর্ণ ধারণ করে। আপনি একটি কাচের পাত্রে হাত দিয়ে দেখুন–পাত্রটি নীল হচ্ছে কিনা।

এষা চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে বলল, শুধু শুধুই আপনার সঙ্গে কথা বললাম–আপনি উদি। এর বেশী কিছু না। আমার মনে হয় আপনাকে কোন একটা ঘরে দীর্ঘদিন আটকে রাখা হয়েছিল। দরজা খুলে চলে এসেছেন।

হতে পারে। বিচিত্র কিছু না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *