০৭. মায়ের উকিল তালুকদার সাহেব

মায়ের উকিল তালুকদার সাহেবের পরামর্শে মা বাবার সঙ্গে একান্তে দেখা করতে রাজি হলেন। তবে মা একা কিছুতেই যাবেন না। সঙ্গে কাউকে না কাউকে যেতে হবে। ঠিক হলো আমি মাকে নিয়ে যাব। কোথায় যাব সেই জায়গাও ঠিক হলো। ধানমণ্ডিতে জিংলিং নামের একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্ট। দুপুরবেলা যাওয়া হবে, তখন লোকজন কম থাকে। উকিল সাহেব মাকে কী বলতে হবে না বলতে হবে সব শিখিয়ে দিলেন। আমার প্রতি নির্দেশ হলোতারা যখন কথা বলা শুরু করবেন, তখন আমি অন্য টেবিলে চলে যাব। একা একা কোক বা সেভেন আপ খাব।

উকিল সাহেব বললেন, কোন কোন পয়েন্টে কথা বলবেন এইগুলা আমি আলাদা কাগজে লিখে দেই।

মা বললেন, দরকার নেই, আমার মনে থাকবে।

দেখা হওয়ার মানসিক উত্তেজনায় পয়েন্ট বাই পয়েন্ট কথা মনে নাও আসতে পারে।

ঐ লোককে দেখে আমার মানসিক উত্তেজনা হবার কিছু নেই। যা হবে তার নাম রাগ।

রাগের সময় মানুষ বেশি ভুল করে।

আমি ভুল করব না।

চাইনিজ রেস্টুরেন্টের এক কোনায় বাবা বসেছিলেন। অসুখ থেকে উঠায় তাঁকে খুবই কাহিল লাগছে। পায়জামা-পাঞ্জাবি পরেছেন। পাঞ্জাবিটা কুঁচকানো। বাইরে বের হবার সময় বাবা কাপড়-চোপড়ে খুব সাবধান থাকেন। ইস্ত্রি ছাড়া কাপড় পরেন না। আজ মনে হয় ইচ্ছা করেই কুঁচকানো কাপড় পরেছেন। নিজের হতাশ চেহারাটা দেখাতে চাচ্ছেন।

বাবা সিগারেট টানছিলেন। মাকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন। আধখাওয়া সিগারেট অ্যাসট্রেতে গুঁজে দিলেন। আমার ধারণা, বাবা এই প্রথম তার স্ত্রীকে দেখে সম্মান করে উঠে দাঁড়ালেন।

বাবা বললেন, কেমন আছ?

মা জবাব দিলেন না। তিনি বসলেন বাবার মুখোমুখি। আমি বললাম, আ১ কি অন্য টেবিলে যাব?

মা বললেন, যেখানে বসে আছিস সেখানে বসে থাক।

বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, স্যুপের অর্ডার দেই? চাইনিজের আসল খাবার স্যুপ। এই একটা জিনিসই এরা বানাতে শিখেছে। বাকি সব অখাদ্য।

আমি বললাম, স্যুপ খাব না বাবা।

বাবা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, থাক তাহলে স্যুপ বাদ। পানি খেয়ে পেট ভরানোর মানে হয় না। আফিয়া, তুমি কী খাবে বলো? তুমি তো আবার সেভেন আপ ছাড়া কিছু খাও না। আমি এসেই খোঁজ নিয়েছি। এদের কাছে সেভেন আপ নেই। মিরিন্ডা আছে। জিনিস একই। দিতে বলি একটা মিরিন্ডা?

মা বললেন, বকবকানিটা বন্ধ করবে? সারাজীবনই তো বকবক করলে। এখন একটু কম কর।

বাবা চুপ করে গেলেন। মা বললেন, কবে আমি তোমাকে দ্বিতীয় বিয়ের অনুমতি দিয়েছিলাম? তোমার আদরের ছেলেকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি, তার মাথায় হাত রেখে বলো তো কবে দিয়েছি।

বাবা বিড়বিড় করে বললেন, আফিয়া, কাজটা করেছি জানে বাঁচার জন্য। এই বয়সে জেলে ঢুকতে হলে সমস্যা না? সাদা কাগজে তোমার সিগনেচার করা কয়েকটা পাতা ছিল। ঐটা ব্যবহার করেছি।

আমার দস্তখত করা এমন কাগজ তো তোমার কাছে আরো আছে। আছে না?

আরো দুটা আছে।

সেই দুই কাগজ দিয়ে নতুন কোনো প্যাঁচ খেলবে না?

না। My word of honour.

মা হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আচ্ছা যাই। বাবলু উঠ।

বাবা বললেন, সে-কী! কোনো কথাই তো হয় নি।

মা বললেন, যা হয়েছে যথেষ্ট। বাবলু, এখনো বসে আছিস কী জন্যে? আয়।

বাবা হড়বড় করে বললেন, এফডিআর একটা ম্যাচিউর হয়েছে। ঐ টাকাটা নিয়ে একটু কথা বলতাম। খুবই খারাপ অবস্থায় আছি। বাড়ি ভাড়া বাকি পড়েছে দুই মাসের… আফিয়া শোন…

বাবাকে হতাশ অবস্থায় রেখে আমরা মাতা-পুত্র বের হয়ে এলাম। রিকশা করে ফিরছি, মা চাপা গলায় বললেন, ঐ বদ এখন বুঝবে কত ধানে কত পোলাউয়ের চাল। তার প্রতিটি কথা ডিজিটাল রেকর্ডারে রেকর্ড করা হয়েছে। উকিল সাহেব আমাকে রেকর্ডার দিয়ে দিয়েছিলেন। তোর বাপ পরিষ্কার বলেছে সাদা কাগজে করা আমার সিগনেচার সে ব্যবহার করেছে। বলেছে না?

বলেছে।

বলেছে— সঙ্গে সঙ্গে রেকর্ড হয়ে গেছে। অতি চালাকের গলায় দড়ি পড়ে, জানিস তো? তোর বাপের গলায় দড়ি পড়েছে।

কাজটা কি ঠিক হয়েছে মা?

তোর বাবা যে কাজটা করেছে সেটা ঠিক, আর আমারটা ভুল? রিকশা থামতে বল তো।

কেন?

গলা শুকিয়ে গেছে, একটা সেভেন আপ খাব। ঠাণ্ডা দেখে আনবি। আমার কাছে ভাঙুতি টাকা নেই। তোর কাছে ভাঙতি আছে?

আছে।

ক্যানের সেভেন আপ আনবি। সঙ্গে স্ট্র আনবি।

আমি রিকশা থেকে নেমে গলির ভেতর ঢুকে হাঁটা দিলাম। মা থাকুন গরমের মধ্যে রিকশায় বসে। আমাকে ফেলে চলে যেতে পারবে না। ছেলে সেভেন আপ আনতে গিয়ে কোথায় গেল। তার কোনো বিপদ হলো কি-না। সবচে ভালো হয় যদি আজ রাত বাসায় না ফিরি। তাহলে বুঝবে টেনশন কত প্রকার ও কী কী। মার ওপর রাগ লাগছে। তাকে শাস্তি দিতে ইচ্ছা করছে। আমি ছোট্ট মানুষ, আমার শাস্তি দেয়ার ক্ষমতাও ছোট্ট।

কোনো রকম উদ্দেশ্য ছাড়া রাস্তায় হাঁটাহাটি করে সময় পার করা কঠিন ব্যাপার। তখন সময় আটকে যায়। নিজেকে ব্যস্ত রাখাও মুশকিল। দেখার অনেক কিছুই আছে, আবার কিছুই নেই। ঢাকার রাস্তার সব দৃশ্যই অনেকবার দেখা। ঝকঝকে প্রকাণ্ড সব নতুন বাস নেমেছে। এসি বাস। এই বাসের যাত্রীদের দিকে তাকালে মনে হয়, একদল সুখী মানুষ। আরাম করে কোথাও যাচ্ছে। আবার এই যাত্রীরাই যখন ভাঙাচোরা বাসে চড়ে, গরমে ঘামে, খুপড়ি জানালা দিয়ে মুখ বের করে রাখে, তাদেরকে মনে হয় ভয়ানক অসুখী। অতি ব্যস্ত রাস্তায় ঠেলাগাড়ি দেখতে ভালো লাগে। সব ঠেলার সঙ্গে ঠেলাওয়ালার অল্প বয়েসী একটা ছেলে থাকে। সে তার বাবার সাহায্যের জন্যে অতি ব্যস্ত। তার ব্যস্ততাও দেখতে ভালো লাগে। ঢাকার রাস্তায় সবসময় কিছু অতি বৃদ্ধ পাওয়া যায় যাদের একমাত্র কাজ রাস্তা পার হওয়া। রাস্তা খানিকটা পার হয়ে তারা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। ফিরে আসতে চায়, ফিরতে পারে না। হঠাৎ দৌড় দেয়ার মতো ভঙ্গি করে আবার দাঁড়িয়ে পড়ে। এমন কোনো বৃদ্ধের দেখা পেলে অনেকটা সময় পার করা যায়।

আজ আমার দিন খারাপ। ঠেলাগাড়ি নেই, বৃদ্ধ নেই। আষাঢ় মাসেও দিন ঝকঝক করছে। বৃষ্টির দেখা নেই। আকাশ ঘন নীল। শান্তির নীল রঙ না, উত্তাপের নীল। আষাঢ় মাসে রোদে হাঁটতে ভালো লাগে না। আষাঢ় মাসে মাথার ওপর মেঘ নিয়ে হাঁটতে ভালো লাগে।

রোদ মাথায় নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম রমজান মিয়ার কাছে। রমজান মিয়া রাস্তার এক কোনায় ছাতা মাথায় বসে আছে। তার ঝুড়িতে আম নেই। সে বসেছে ডালা নিয়ে, ডালা ভর্তি লটকন। ডালার দিকে তাকালে মনে হয় হলুদ ফুল ফুটে আছে।

রমজান মিয়া আমাকে দেখেই আনন্দিত গলায় বলল, আসেন ছাতির নিচে আসেন। আপনের দেখা যে আইজ পামু এইটা জানি।

কীভাবে জানেন?

মানুষের ভিতর ইশারা চলাচল করে। ইশারায় জানি।

আম পান নাই?

না। লটকন খান। বাজারের সেরা লটকন। লটকন কেমনে খাইতে হয় জানেন? রইদে বইসা খাইতে হয়। একেক ফল খাওয়ার একেক নিয়ম। কমলা খাইতে হয় ছেমায় বইসা, তেঁতুল খাইতে হয় গাছের নিচে।

তেঁতুল গাছের নিচে বসে খেতে হয়?

অবশ্যই। গাছের ছেমায় বইসা তেঁতুল খাওনের মজাই অন্যরকম।

ফল খাওয়ার এইসব নিয়ম আপনি বের করেছেন?

জি! ফল নিয়া বইসা থাকি। কাজ নাই কর্ম নাই। বইসা বইসা চিন্তার মাধ্যমে নানান জিনিস পাই।

কী পান?

আল্লাহপাকের কুদরতের দেখা পাই। ভালো কইরা চিন্তা করেন ছোট ভাই, গাছের বিষয়ে চিন্তা করেন। কোনো গাছ দেয় মধুর মতো মিষ্ট ফল, কোনো গাছ। দেয় বোম্বাইয়া মরিচের মতো ঝাল মরিচ। কোনো গাছ ফল দেয় মানুষের জন্যে, আবার কোনো গাছ ফল দেয় পাখিদের জন্যে। সেই ফল মানুষ খাইতে পারে না, তার তিতা লাগে। পাখিরা আনন্দ কইরা খায়।

কোন ফল পাখিরা আনন্দ করে খায়?

মাকাল ফল। বড়ই সৌন্দর্য ফল, কিন্তু মানুষের জন্য বিষ। ছোটভাই, শুকনা আলাপ শুইন্যা লাভ নাই। লটকন খান। আপনার উছিলায় আমিও দুইটা খাব। আমার সাথে লবণ আছে। তিনটা লটকনের দানা মুখে দিবেন আর এক চিমটি লবণ। দেখেন স্বাদ কারে বলে।

আমরা লটকন খাওয়া শুরু করলাম। আমাদের খাওয়া দেখে মুগ্ধ হয়েই হয়তো অতি দ্রুত ডালার সব লটকন বিক্রি হয়ে গেল। রমজান মিয়া ডালা গোছাতে গোছাতে বলল, ছোটভাই, দুপুরে তো আপনে খানা খান নাই। চলেন আমার সাথে, খানা খাব।

আমি বললাম, খানা যে খাই নি বুঝলেন কীভাবে? ইশারায়?

জি ইশারায়। ইশারা একটা মারাত্মক জিনিস, বুঝলেন ছোটভাই! ইশারা বুঝতে পারলে কথা বলার প্রয়োজন হয় না। আফসোস, আমরা বেতালা কথাই বলি— ইশারা বুঝি না। বুঝার চেষ্টাও নেই না।

 

রমজান মিয়া থাকে আগারগাঁওয়ের এক বস্তিতে। এক কামরার টিনের ঘর। বারান্দা আছে। বারান্দায় রান্নার ব্যবস্থা। সেখানে দড়ির একটা চারপাই পাতা আছে। চারপাইয়ের একটা পা সাইকেলের চেইন দিয়ে ঘরের খুঁটির সঙ্গে বাঁধা। চারপাই যাতে চুরি না হয় সেই ব্যবস্থা।

আমি বললাম, আপনি একা থাকেন?

ঢাকায় একলাই থাকি। পরিবার দেশে থাকে।

রমজান মিয়া অতি দ্রুত রান্না করে ফেলল। ভাত, শুকনামরিচের সঙ্গে রসুন পুড়িয়ে একটা ভর্তা আর ডাল।

আমি আগ্রহ করে খাচ্ছি। রমজান মিয়াও আগ্রহ করে খাচ্ছে।

ছোটভাই, খাইয়া মজা পাইতেছেন?

হুঁ। অতি সুখাদ্য।

ইশারায় বুঝেছি। আপনে মজা পাইছেন? পেটে ক্ষুধা ছিল এইজন্য মজা পাইতেছেন। পেটের ক্ষুধা আল্লাহপাকের আরেক কুদরত। পেটে ক্ষুধা না থাকলে বেহেশতি খানাতেও কোনো মজা নাই ছোটভাই, আপনে অনেক লোক দেখবেন— খাবার ঘরে খানাখাদ্য বেশুমার, কিন্তু তারার পেটে ক্ষুধা নাই বইল্যা খাইতে পারে না। আহা কী কষ্ট!

রমজান মিয়া চারপাইয়ে পাটি পেতে দিয়েছে। তার ঘরের সঙ্গে য়ে। রেন্টিগাছের ছায়া এসে পড়েছে চারপাইয়ে। আমি মাথার নিচে বালিশ দিয়ে শুয়ে আছি। আমার চোখ ভারী হয়ে আসছে। রমজান মিয়ার মতো আমিও ইশারা? বুঝতে পারছি, আজ আমার ফাটাফাটি ঘুম হবে। ঘুম ভাঙবে যখন গায়ে বৃষ্টির ফোঁটা পড়বে তখন। আকাশে মেঘের ছিটেফোঁটা নাই। তারপরেও বৃষ্টির কথাটা কেন মনে হলো কে জানে!

ঘুমের মধ্যে নীলা ফুপুকে স্বপ্নে দেখলাম। ফুপু শুটিং করছেন। মুকুল ভাই ডিরেক্টর। নায়ক ফুপুকে বলবে, আমি এখন আর তোমাকে ভালোবাসি না। তুমি বনের পংখি, তুমি বনে ফিরে যাও। নায়কের কথা শুনেই ফুপু কাঁদতে শুরু করবেন। ফুপু এই অংশটা করতে পারছেন না। নায়কের কথা শেষ হওয়া মাত্র ফুপু হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছেন। তিনবার এরকম হবার পর পরিচালক মুকুল ভাই রাগে কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে এলেন। ফুপু বললেন, মুকুল ভাই, আমার কোনো দোষ নেই। হিরোর ডায়ালগ শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে পেছন থেকে কাতুকুতু দিচ্ছে, এই জন্যে আমি হেসে ফেলছি। সরি।

মুকুল ভাই বললেন, কোন বদমাশটা তোমাকে কাতুকুতু দিচ্ছে?

বাবলু কাতুকুতু দিচ্ছে। ওকে কিছু বলবেন না প্লিজ। ও আমার ছোটভাই। বাচ্চা মানুষ। (স্বপ্নে সম্পর্ক খানিক উলটপালট হয়েছে। আমি রমজান মিয়ার ছোটভাই। ফুপুর না।)।

মুকুল ভাই বললেন, ঐ ছোকরাকে আমার কাছে ধরে নিয়ে এসো। টিপে আমি তার রস বের করে দেব।

ফুপু বললেন, ওকে শাস্তি দিলে আমি কিন্তু শট দেব না। আমার এক কথা।

মুকুল ভাই ফুপুর কথা শুনলেন না। তিনি আমার হাত ধরে বললেন, একে তো আমি চিনি। এই বদছেলে আমার কাছ থেকে পাঁচশ টাকা নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। তোমরা এই বদটার মাথায় পানি ঢালতে থাক। আমি না বলা পর্যন্ত থামবে না।

কয়েকজন মিলে আমার মাথায় পানি ঢালছে। বরফশীতল পানি। আমি ঠাণ্ডায় কাঁপছি।

এই পর্যায়ে আমার ঘুম ভেঙে গেল। জেগে দেখি প্রবল বর্ষণ হচ্ছে। আমার সমস্ত শরীর ভেজা। ঘরের ভেতর থেকে হাসি হাসি মুখে রমজান মিয়া আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সে মনে হয় খুব মজা পাচ্ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *