মাহবুব সাহেবের বাড়িতে আজ মামুনের রাতের খাবার দাওয়াত। মাহবুব সাহেব বলে দিয়েছেন, সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় চলে আসবেন গল্পগুজব করব। বাড়িতে টিভি আছে ব্যাটারীতে চলে। আজ আবার নাটক আছে। মজা করে নাটক দেখবেন।
মামুন বলল, আমি যথাসময়ে উপস্থিত হব। তবে নাটক দেখব না।
টিভির নাটকগুলিতো অতি উত্তম। দেখবেন না কেন?
ভাল লাগে না।
ভাল না লাগলে দেখবেন না। আমরা বারান্দায় বসে গল্প করব। একবার সাপের হাতে জীবন যেতে বসেছিল গল্পটা আপনাকে বলা হয় নাই। বিষধর সর্প।
জ্বি আচ্ছা আপনার বিষধর সর্পের গল্পও শুনব। দাওয়াত কি আমি একা যায়? ইরতাজউদ্দিন সাহেব যাবেন না? দুজন এক সঙ্গে থাকি এর মধ্যে আমি একা দাওয়াত খেতে যাওয়া ব্যাপারটা খারাপ দেখায় না?
আসুন উনাকেও নিয়ে আসুন। অসুবিধা কিছু নাই। খাওয়া দাওয়াতো কোন ব্যাপার না–গল্প গুজব করা।
ইরতাজউদ্দিন সাহেব আসতে রাজি হলেন না। মামুন একাই উপস্থিত হল। মাহবুব সাহেবের বাড়িটা সুন্দর। অনেকখানি জায়গা নিয়ে হাফ বিল্ডিং। উপরে টিনের ছুদি। বাড়ির সামনে দেশী গাছ গাছড়ার বাগান। মামুন মুগ্ধ হয়ে বলল, এটা দেখি ইন্দ্রপুরীর বাগান।
মাহবুব সাহেব নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন, কোন মতে বেঁচে থাকা। বাড়ির পেছনে পুকুর আছে। পুকুরটা সুন্দর। গত বছর ঘাট বাধিয়ে দিয়েছি। দেখাব আপনাকে। বর্শি বাওয়ার অভ্যাস আছে?
জ্বি-না?
অভ্যাস থাকলে বর্শি বাইতে বলতাম। দুবছর আগে রুই মাছের পোনা ছেড়ে ছিলাম বড় হয়েছে।
আপনিতো রাজার হালে আছেন মনে হয়।
আর রাজার হাল। পল্লীগ্রামে পড়ে আছি। নানা সমস্যা।
কি সমস্যা?
পল্লীগ্রামের সমস্যা একটা থাকে না। পল্লীগ্রামের সমস্যা থাকে এক হাজার একটা। স্কুল উঠে যাচ্ছে–এতদিনের পুরনো স্কুল। দীর্ঘদিন থেকে যুক্ত স্কুলের সঙ্গে এটাওতো বড় সমস্যা।
স্কুল উঠে যাচ্ছে না-কি?
জি। আপনি নতুন জয়েন করেছেন। আপনাকে বলা ঠিক না। তবে এইসবতো গোপন রাখার জিনিস না। আজ হোক, কাল হোক আপনি জানবেন।
স্কুল উঠে যাচ্ছে কেন?
নানান কারণ আছে। হেড মাস্টার সাহেবও একটা কারণ। স্কুলের হেড মাস্টার হল নৌকার কান্ডারীর মত। নৌকার কান্ডারি যদি ঠিক না থাকে তাহলে নৌকাতো ভুববেই।
হেড মাস্টার সাহেবের সমস্যাটা কি?
হুজুগে লোক আর কি? হুজুগে কি আর স্কুল টিকে? তাছাড়া বয়স হয়েছে। বয়স হলে ভীমরতি হয় বলে প্রবাদ আছে, উনারও তাই হয়েছে।
ভীমরতি হয়েছে বলতে চাচ্ছেন?
অনেকটা সে রকমই। উনার সম্পর্কে অনেক কেলেংকারী ধরণের কথা চালু আছে–সে সব কথা ঠিক হবে না। বাড়ির দাসির সঙ্গে সম্পর্ক।
বুঝলাম না কি বলতে চাচ্ছেন শারীরিক সম্পর্ক?
লোকে তো তাই বলে। একজন স্কুলের হেড মাস্টারের সম্পর্কে যদি এই জাতীয় গুজব চালু থাকে তাহলে কি আর স্কুল টিকে?
আপনারা উনাকে সরিয়ে নতুন কাউকে নিয়ে আসেন না কেন? আপনি নিজেওতো হেড মাস্টারের দায়িত্ব নিতে পারেন। আপনার সম্পর্কে নিশ্চয়ই
এই জাতীয় কোন জব নেই?
আরে ছিঃ ছিঃ কি বলেন?
স্কুল টিকিয়ে রাখতো অনেক জরুরী।
নতুন একটা স্কুল চালু হয়েছে। এইটাই আশার কথা। ভাল স্কুল। ষ্টাফ ভাল। আমাদের স্কুলের কিছু একসেলেন্ট ষ্টাফ ঐ স্কুলে চলে গেছেন। ভাল বেতন। ষ্টাফ কোয়ার্টার! কেন যাবে না বলুন।
আপনি যাচ্ছেন না?
আমাকে হেড মাষ্টারের দায়িত্ব নিতে বলছে।
নিচ্ছেন না কেন?
এতদিনের পুরনো একটা স্কুল। বললেইতো ছাড়া যায় না।
মায়ার কারণে এখনো লেগে আছেন?
তা বলতে পারেন। আপনার ক্ষিধে হলে বলবেন, খাওয়া গরম করতে বলব। আমি আবার ঠাণ্ডা কিছু খেতে পারি না।
আমি ঠাণ্ডা গরম সবই খেতে পারি। আপনার যখন ক্ষিধে হবে খাবার দিতে বলবেন।
মাছ ভাতের ব্যবস্থা করেছি। শহুরে মানুষ। মাছ ভাতটাই বেশী পছন্দ করে। গো মাংসের সন্ধান করেছিলাম। পাইনি। আমার স্ত্রী আবার গো মাংসের খুব ভাল পাক করেন। একদিন খাওয়াব আপনাকে। ছোট ছেলের এখনো আকীকা হয়নি। ভাবছি তার আকীকায় একটা গরু কোরবানী দেব।
বাংলাদেশে আপনিই সম্ভবত সবচে ধনবান এসিসটেন্ট হেডমাস্টার।
এই কথায় মাহবুব সাহেব আনন্দিত হলেন। আনন্দ তার চোখে মুখে ফুটে উঠল। মামুন বলল, আপনার মত এমন ক্ষমতাবান লোক থাকতে স্কুলটা জলে ভেসে যাবে এটা কেমন কথা-…..
হেড মাস্টার সাহেবের সন্যেই কিছু করা গেল না।
উনাকে বিদেয় করে দিন। স্কুল ইম্পর্টেন্ট। হেড মাস্টারতো ইম্পর্টেন্ট না।
বিদায় করে দিতে বললেইতো করা যায় না।
যায় না কেন? চরিত্রহীন একজন মানুষ……।
আসুন খেতে আসুন। খেতে খেতে গল্প করি। সাপের গল্পটা আপনাকে বলা হয় নাই…..।
খাবার আয়োজন প্রচুর। রুই মাছের ভাজা, বড় বড় পাবদা মাছের ঝোল, টাকি মাছের ভর্তা, সরপুটি। মাছ ভাতের কথা বলা হলেও বড় জামবাটি ভর্তি মুরগীর মাংসও দেখা যাচ্ছে। মামুন বিস্মিত হয়ে বলল, করেছেন কি আপনি?
সামান্য আয়োজন। পোলাও করার ইচ্ছা ছিল, পরে ভাবলাম মাছ দিয়ে পোলাও ভাল লাগবে না। রান্না কেমন হয়েছে কে জানে আমার স্ত্রীর অবশ্যি রান্নার সুনাম আছে।
রান্না অসাধারণ হয়েছে। আমি কোনদিন এত পদ নিয়ে খেতে বসেছি বলে মনে পড়ে না।
খান আরাম করে খান। কেউ তৃপ্তি করে খাচ্ছে দেখতেও ভাল লাগে। ঘরে পাতা টক দৈ আছে। খাওয়ার শেষে এক বাটি টক দৈ খাবেন দেখবেন সব হজম।
খাওয়ার সময় মাহবুব সাহেব অনবরত কথা বলে গেলেন। সাপের গল্প হল, জীনের গল্প হল। তাহাজ্জুদের নামাজ একা পড়তে গিয়েছেন নামাজ শেষ করে সালাম ফিরাতে গিয়ে দেখেন ডান দিকে লম্বা একজন নামাজ পড়ছে। মাথা দে ঠেকে গেছে পরনে সফেদ ড্রেস……..
খাবার পরও অনেকক্ষণ গল্প হল। সব গল্পই স্কুল নিয়ে! হেডমাস্টার সাহেব স্কুলের কি কি ক্ষতি করেছেন মাহবুব সাহেব তার বিষদ বর্ণনা দিলেন। উঠতে উঠতে রাত দশটা বেজে গেল। মামুন বলল, আজ উঠি? যাবার সময় হেড মাস্টার সাহেব সম্পর্কে একটা ভাল কিছু বলুনতো শুনে যাই। একটা কিছু ভাল গুণতো মানুষটার আছে। আছে না?
তা আছে, নীতিবান। তবে নীতিতে স্কুলের ক্ষতিই হয়েছে। লাভ কিছু হয়নি।
সেটা কি রকম।
ফুড ফর ওয়ার্ক প্রোগ্রাম স্কুল একবার ১০০ বস্তা গম পেল। এটাই শুধু সমস্যা দুশ বস্তা গম পেয়েছি লিখে দিয়ে একশ বস্তা গম নিতে হবে। হেড সাহেব নিলেন না। তাঁর একটা কথা স্কুল নীতি শিক্ষার জায়গা। দুর্নীতি দিয়ে স্কুলের উন্নতির দরকার নেই। নীতি নীতি করে উনার স্কুলের লাভটা কি হল?
তাতো বটেই।
যে যুগের সে বাতাস, সেই বাতাসে নৌকা চালাতে হবে না?
মামুন বলল ইঞ্জিনের নৌকা হলে অবশ্যি বাতাসের ধার ধারতে হয় না। নীতিবান মানুষ হল ইঞ্জিনের নৌকা।
ইঞ্জিন ঠিকই আছে। তেল নেই, ইঞ্জিন চলে না। আপনি যুবক মানুষ। মনে উৎসাহ আছে, চার মাস যখন বেতন পাবেন না তখন আর উৎসাহ থাকবে না।
না থাকারই কথা।
যাই হোক, আছেন যখন নিজের চোখে সব দেখবেন। সরকারী ডি এ আছে বলে কিছু শিক্ষক এখনো আছেন। ডি এ যখন থাকবে না তখন কি হবে?
ডি এ থাকবে না?
থাকবে কি জন্যে ছাত্র নেই স্কুলের আবার ডি এ কি?
ছাত্র কিছুতো আছে।
এও থাকবে না। দেখবেন ফাঁকা স্কুল ঘরে হেড মাস্টার সাহেব বসে থাকবেন। মাছি টাছি মারবেন।
কিছু করার উপায় নেই?
ধ্বস নামলে কিছু করার থাকে না। ধ্বস নেমে গেছে। আপনি বাইরে থেকে এসেছেন। কিছু বুঝতে পারছেন না। গত মাসের বেতন পেয়েছেন?
জি-না।
কোত্থেকে পাবেন? একটা ফুটা পয়সা স্কুলের নাই। হা হা হা।
মামুন বিস্মিত হয়ে বলল, আপনি এত আনন্দিত কেন? আপনিওতো স্কুলের একজন।
মাহবুব সাহেব শুকনো গলায় বললেন, হেসে ফেলেছি দেখে ভেবেছেন আনন্দিত। আসলে তা না, মনের দুঃখে হেসেছি। এক সময় এই স্কুলের কি রমরমা ছিল আর আজ কি অবস্থা। আফসোস। বিরাট আফসোস।