০৭. মানুষ জন্মায় ক্ষুধা লইয়া

মানুষ জন্মায় ক্ষুধা লইয়া, সে ক্ষুধা তাহার মরণ অবধি মেটে না; মরণেও তাহার লয় নাই; মানুষ মরে, অতৃপ্ত ক্ষুধা তাহার ধরণীর বুকে হা-হা করিয়া বেড়ায়, তাহার পর পুরুষের বুকে আশ্ৰয় লয়। এমনই করিয়া মানুষের ক্ষুধার আজ অন্ত নাই। দিনে দিনে সে অসহ লোলুপ তীক্ষ হইয়া উঠিতেছে।

আদি যুগে উদরের ক্ষুধায় মানুষে মানুষের মাংস খাইয়াছে, আজ ভোগের অতৃপ্ত ক্ষুধায়। একটি জাতি অপর জাতির বুকের রক্ত অদৃশ্য শোষণে হরণ করে, আজ একটা মানুষেরই ক্ষুধা বোধ করি সমগ্র দুনিয়া গ্রাস করিয়াও মেটে না। ক্ষুধার তাড়নায় একের অপরের প্রতি দৃষ্টিপাত করিবার অবকাশ নাই; মানুষের ক্ষুধার তাড়নায় যীশুর সাধনা আজ ধর্মযাজকের কোমরে বাঁধা লোহার কুসে নিস্পন্দ, ব্যর্থ; বুদ্ধের বাণী আজ পাষাণের গায়ে আখরের রেখায় মূক।

দিন দুই পর, তখনও গোষ্ঠর চোখের কোল হইতে অশ্রুর রেখা মোছে নাই, তাহার দুয়ারের সম্মুখ দিয়া ঢোল পিটিয়া দত্ত গোষ্ঠর জমি দখল করিতে চলিল।

অপরিসীম শোকের রুতায় বুকটা হু-হু করিতেছিল।

তাহার উপর বঞ্চনার, প্রতারণার ক্ষোভে সেথা জাগিয়া ওঠে বিপুল ক্রোধ, সে যেন একটা ঘূর্ণি।

আগুনের শিখা যেন পাক খাইয়া মাথার দিকে ছোটে, জ্ঞানবিবেচনার অবসর থাকে না। গা-ঝাড়া দিয়া গোষ্ঠ সোজা হইয়া দাঁড়াইয়া ওঠে, এস্ত পদক্ষেপে এদিক ওদিক কি সন্ধান করিয়া ফেরে। চায় সে লাঠি; মেলে না।

সে ছুটিয়া গিয়া ওঠে পাশের গায়ের ভাল্লাপাড়ায় রাম ভাল্লার বাড়ি।

রাম লাঠিখেলার ওস্তাদ; সে জেলখাটা দাগী, ভাল লোকে বলে, সে ডাকাত। রাম বলে, বলুক, ভদ্রলোককে না মানলেই সে ডাকাত। তা ডাকাত আমি।

ঝড়ের মত গোষ্ঠ আসিয়া কহে, ওহে ওস্তাদ, একগাছা লাঠি—

কথা শেষ করিতে পারে না, বুকের মোটা মোটা পাঁজরগুলা লাফাইতে থাকে।

পাঁচ হাত লম্বা মানুষটি, দেহে ভোগালো মাংস নাই, সব যেন হাড়, কিন্তু সেগুলো বাঁশের মত মোটা, বোধ করি লোহার মত শক্ত।

রাম বসিয়া তামাক খাইতেছিল।

সে জিজ্ঞাসাও করে না, কেন, কি বৃত্তান্ত। নির্বিকারভাবে আঙুল দেখাইয়া বলে, ওই মাচায় দেখ।

গোষ্ঠ মাচায় উঠিয়া লাঠি লইতে লইতে কহে, শালা দত্ত ফাঁকি দিয়ে ডিগ্রি করে আমার জমি দখল করছে ওস্তাদ।

রাম সেইরূপ নির্বিকারভাবে বলে, দুনিয়াসুদ্ধ ওই হাল গোষ্ঠ, সব যে যার পারে কেড়ে নেয়; সব ওই। একা আর ওর দোষ কি, আর দোষই বা কার; তুই আমি সবাই তো ওই চাই, তবে নিই না পয়সা নাই বলে, পারি না বলে।

সত্যিই বুঝি ইহার জন্য মানুষকে দায়ী করা যায় না।

এ বুভুক্ষা যে তাহার সহজাত, এ ক্ষুধা তাহার জীবনের ধর্ম। তবে দায়ী কে?

রাম বলে, আমি দোষ দিই ভগবানের, চন্দ্রসূর্যির মত বড় বড় চোখ নিয়ে সে দেখছে কি? তার রাজ্যিতে এমন হয় কেন?

সত্য কথা, ইহার জন্য দায়ী জীব-জগতের জীব-ধর্মের স্রষ্টা যদি কেহ থাকে, সে। শিল্পের খুঁতের জন্য শিল্পী দায়ী, শিল্প নয়। সে শুধু অঙ্গহীন।

রামের মেয়ে হিমি গোষ্ঠর সমবয়সী, সে পাশের বাড়ি হইতে আসিয়া পিছন হইতে কহে, লাঠি হাতে যে? লাঠি কি করবে মোড়লদা?

তিক্তস্বরে রাম কহে, তোর মাথায় মারবে, লাঠি নিয়ে বেটাছেলে কি করবে!

কৌতুকে খিলখিল শব্দে হাসির কলরোল হিমির কণ্ঠে ধ্বনিয়া উঠিল, কিন্তু মুহূর্তেই সে হাসি নীরব হইয়া গেল, যেন ঝরনা ঝরিতে ঝরিতে শুকাইয়া গেল।

গোষ্ঠ হিমির পানে মুখ ফিরাইয়া দাঁড়াইয়া ছিল, তাহার সে রুক্ষ মুখ, চোখের কোলের ওই কালো রেখা দেখিয়া হিমির হাসির ঝরনা শুকাইয়া গেল; সে শিহরিয়া কহিল, ও কি মোড়ল ভাই, এ কি চেহারা?

গোষ্ঠ লাঠিগাছটা মাটিতে ঠুকিয়া দৃঢ়তা পরীক্ষা করিতে করিতে কহিল, ছেলেটা পরশু রেতে গেল।

হিমি আর্তম্বরে কহিল, আঁ! খোকা!

রাম ধমক দিয়া কহিল, হিমি, প্যানপ্যান এখন নয়, পরে করবি; মরদ লাঠি হাতে করলে কাঁদতে নাই। যা গোষ্ঠ, বেরিয়ে পড়, দেখ, সঙ্গে যাব?

উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে গোষ্ঠ কহিল, ওস্তাদ, বড় ভাল হয়।

আর একগাছা লাঠি টানিয়া লইয়া রাম দাঁড়াইয়া কহিল, চ।

রসিক দত্ত বাঁশের লগির মাথায় লাল পতাকা বধিয়া গোষ্ঠর জমিতে পুঁতিয়া দখল লইতেছিল, বাঁশগাড়ি করিতেছিল। সঙ্গে জমিদারের নগদী, আদালতের পেয়াদা, নিজের রাখাল আর ঢুলী।

দত্ত মনে করে, এই বাহিনীই তাহার বিশ্বজয় করিবে; সে বলেও, জোর কি আমার রে, জোর আদালতের।

খাতকে কিছু বলে না, কিন্তু ছেলের দল ছাড়ে না, উত্তর দেয়, আর আদালত টাকার, তবে আর দত্তকে ঠেকায় কে?

শুধু টাকায় হয় না ধন, মামলায় মাথা চাই। সঙ্গে সঙ্গে তাহার বকের মত লম্বা গলার পরে ছোট্ট টেকো মাথাটি টিকটিকির মত নড়ে।

তা তোমার খুব আছে, বেড়ালের মত চোরা বুদ্ধি মার খুব; কঁকুড়চুরি করা করে চাকলার জমিটা নিলে বাবা। মরে যে কি হবে তুমি

আর একজন বলে, বেনে মরে জোনাক পোকা, করে টিপির টিপ।

কেউ বলে, যখযখ হয়ে মাটির তলায় বসে টাকা গুনবে।

কেউ বলে, বাদুড়, বাদুড়–উল্টোমুখ করে গাছে ঝুলবে।

কেউ বলে, সে তো ফিরে জন্মালে? যমপুরীর কথা বল, সেই গরম তেলে, ছাক কলকল। তবে তো চামড়া উঠবে।

দত্তের ভয় এইখানে—গরম তেলের নামে লম্বা লিকলিকে শরীরখানা আহত সরীসৃপের মত আঁকিয়া বাঁকিয়া ওঠে, গায়ে কাঁটা দেয়, সে তাড়াতাড়ি বলে, ও হাসি-তাশা নয়, বাবা, হাসিতাশা নয়; ছাড়ান দাও, ছাড়ান দাও।

কেউ বলে, নয়ই তো, এ তো শাস্ত্রের কথা, খোদ বেদব্যাস।

দত্ত তাড়াতাড়ি পথ ধরিয়া কহে, যাস যাস, তামাক খাওয়াব, ভাল তামাক খাওয়াব কাষ্ঠগড়ার, আট আনা সের।

একটা ছেলে পেছন হইতে এক আঁজলা জল দত্তর গায়ে ছিটাইয়া দিয়া কহে, ছাক কলকল।

দত্ত আতঙ্কে লাফাইয়া ওঠে, ইরেঃ, বাবাঃ!

দুত্তর মন দমে, কিন্তু ক্ষুধা কমে না, সে বাড়িয়াই চলে।

আদালতের পেয়াদা কহে, কই দত্ত, নিশেন দেবে কে?

খোদ জমিদারের নগদী। কই রে, কত দূর আর?

নগদী কহে, হুই–ওঃ, বেঁকী লম্বা ফালিখানার উতোর মাথায়, হুই আঠার কাঠা বাকুড়ি, কসকসে কালো ধান।

ঢুলীটা ঢোল পিটিয়ে ওঠে, ড়ুগড়ুগ।

দত্ত তাড়া দেয়, মল রে বেটা মুচির ডিম, ঢোল পিটতে লাগলি যে? ঢোল গলায় ঝুলিয়ে এসেছিস ঝুলিয়ে চল, আসবার সময় গাঁয়ে একবার পিটেমিস, যাবার সময় একবার দু ঘা, বাস, আইন রক্ষে।

গোপনের একটা অজ্ঞাত প্রয়াস কেমন আপনি আসে; মানুষের মন তো, বুকে একটু অপহরণের লজ্জাও জাগে, তারই তরে উচ্চধ্বনিতে অধিকার ঘোষণা করিতে বোধ করি কেমন কেমন লাগে।

দত্ত বলে, হ্যাঁরে গোবিন্দে, জোলের সেই চার বিঘে বাকুড়ি, সেথায় চ না আগে।

নগদী বলে, চার বিঘে বাকুড়ি তো গোষ্ঠর নয়, ও তো দেবেন্দ্র পালের, তারই ওপরে গোষ্ঠর বার কাটা একখানা।

আঁ, ওটা গোষ্ঠর নয়? ওই বাকুড়ির তরেই তো আমার এত আটুটু; বলিস কি? না না, তুই জানি না, ও গোষ্ঠরই বটে।

তবে দাও গো তুমি ওই জমিতেই বাঁশ গেড়ে, তোমার তো কাজই ওই।

দত্ত চিাইয়া ওঠে, উঃ, বেটা আমার ধম্মপুত্তুর যুধিষ্ঠির রে!

সহসা একটা ভীষণ রুদ্ৰ গৰ্জনে সব কয়টা লোক চমকিয়া ওঠে। উঠিবারই কথা, এমন হক মানুষের কণ্ঠনালী দিয়া বাহির হয় না।

সব চারিদিকে তাকায়, দুইটা লোক তীরের মত মাঠের পথে ছুটিয়া আসিতেছে, হাতে লাঠি, আর কণ্ঠে ওই হাঁক। ঢোলটা বগলে চাপিয়া মুচিটা উর্ধ্বশ্বাসে ছোটে, সঙ্গে সঙ্গে দত্তর রাখালটা, তাহার পিছনে পিছনে জমিদারের নগদী।

সে বলিয়া যায়, পালাও দত্ত পালাও, গোষ্ঠ আর রাম ভাল্লা, দাগী ডাকাত, পালাও।

আর সে কি বলে, শুনিতে পাওয়া যায় না।

দত্তর সম্মুখের পথ রুদ্ধ করিয়া দাঁড়াইয়া ছিল আদালতের পেয়াদা, ঝপ করিয়া পাশের। জমিতে লাফাইয়া পড়িয়া কাদায় কাদায় ছোটে। বকের মত লম্বা পায়ে থানের পাতা জড়াইয়া জমির কাদার জলে দত্ত পড়িয়া গেল। উঠিবার অবকাশ হইল না, পকে জলে পাকাল মাছের মতই বেচারি হাঁপা মারিয়া চলিতে চায়। বহু ব্যগ্রতায় উঠিয়া আবার ছোটে; মুখের একপাশে কাদা লেপিয়া গিয়াছে, চোখে কাদা, দেখিতে পায় না, মুখে কাদা, থুথু করিয়া ফেলিতে ফেলিতে ছোটে, দেখব শালাকে, থু, এমন কাণ্ড থু, আদালতের হুকুম, অ্যাঃ থু-থু গোবর, না। কি আর কিছু অ্যাঃ হ্যা-হ্যাঁ থু-থু। যাঃ শালা, খোট খুলে গেল।

বিপদের উপর বিপদ। জলে কাদায় ভারি কাপড় লিকলিকে কোমরে থাকে না, কাছা খুলিয়া যায়, বেচারি দুই হাতে কোমরের কাপড় চাপিয়া ধরিয়া ছোটে, ওদিকে ভিজা কাপড়ে পায়ে পা জড়ায়, শেষে দত্ত কাপড় বগলে পুরিয়া ছোটে।

রাম ভাল্লা হা-হা করিয়া হাসিয়া সারা; পুত্ৰশোকের মাঝেও গোষ্ঠর হাসি পায়।

ওস্তাদ কহিল, তারপর, এইবার জমিদারের পালা, পারবি সামলাতে? না পারিস তো সরে যা কোথাও।

গোষ্ঠ কহে, তুমি?

আমার কথা ছাড়, আমি ভিন গায়ের; তার ওপর লোকে শুধু আমাদিগে ঘেন্নাই করে না, ভয়ও করে। তা হলেও আমিও দুদিন সরব, হিমিকে নিয়ে জামাইয়ের বাড়ি যাব।

তাই দেখি। কণ্ঠটা কেমন হতাশায় হিম, তাহার উত্তেজনা শীতল হইয়া আসে। আকাশপাতাল ভাবে, যাইবে কোথায়?

রাম কহে, ভাবছিস কি? না হয় গা থেকে চলে যাবি। বলে না সেই, সমুদ্দে পাতিয়া শয্যা শিশিরে হল ভয়; তোর হল সেই বৃত্তান্ত।

গোষ্ঠ তবু নীরব, সে ভাবে।

রাম কহে, আর কি নিয়েই বা থাকবি গাঁয়ে, মেমতাই বা কিসের রে? জমি তো তোর যাবেই, যমে ছুঁলে আঠার ঘা—তা এ তো মহাযম।

তবু ওস্তাদ, গায়ে মায়ে সমান কথা।

তা হলে বাবা, আমার মত হতে হবে, বুকের পাটা আর লাঠি এই আশ্রয়, এই ছাড়া উপায় নাই।

তাই, তাই হবে ওস্তাদ।

গ্রাম প্রবেশমুখে ও পাড়ার নবীন মোড়ল কহে, গোষ্ঠ, পঞ্চাশ টাকা।

কি?

জরিমানা, গোমস্তা করেছে। আবার শেয়াল বেটা জমিদারের বাড়ি তাকাত যাবে।

তা দিলি দিলি, বেটার বগের মত ঠং দুটো সেরে দিতে নারলি? উই, উই যে বেটা, আড়ে আড়ে সরছে। ও দত্ত! দত্ত! দত্ত!

আবার বুকটা কেমন দমিয়া যায়, গোষ্ঠ বাড়ি আসিয়া সদর দরজায় খিল আঁটে।

চৈত্রের ঘূর্ণি ক্ষীণজীবী যে; আকাশ বাতাস ধরণী সব আগুন না হইলে ঝড় পরমায়ু পাইবে কোথা?

 

শ্রাবণ-গগনে মেঘ যেন পাগল হইয়া উঠিল।

বর্ষণমুখর মেঘলা দিনে মন আরও উদাস হইয়া ওঠে, শোকাহত দুইটি প্রাণীর দিন নীরবে অতি দীর্ঘ হইয়া কাটে।

দামিনী ঘরের মাঝে, গোষ্ঠ দাওয়ায়; খাওয়ার উদ্যোগ পর্যন্ত নাই, বুভুক্ষা পর্যন্ত যেন মূক হইয়া গিয়াছে।

তারাহীন মেঘাচ্ছন্ন তামসী রাতি, দীপহীন গৃহ, সেও অমনই ধারায় কাটে।

তন্দ্ৰাচ্ছন্নতার মাঝে মেঘ ডাকে, গোষ্ঠ চমকিয়া ওঠে।

দুয়ারে কে ঘা মারে না? ভ্ৰম ভাঙিলে একটা স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া বাচে।

দুয়ারে ঘা পড়িল; প্ৰভাত না হইতে জীর্ণ দ্বার সবল দম্ভ-ভরা আঘাতে ঝনঝন করিয়া উঠিল, মোটা গলায় হাক আসে, গোটা, আরে গোটা, হারামজাদা বদমাশ!

প্রভাতের তন্দ্ৰা, সদ্য-যাওয়া ছেলেটার স্মৃতি, স্বপ্নে-দেখা তাঁহার কচি মুখ, শোক, শক্তি সব যেন ঝড়ো হাওয়ায় ফুল-ঝরার মত ঝরিয়া পড়িল, গোষ্ঠ বিহ্বলের মত বলিয়া উঠিল, জমিদারের প্যায়দা, আমাকে ধরতে এসেছে।

দামিনী নড়িয়া-চড়িয়া উঠিল, কিন্তু কথা কহিল না, ছেলে যাওয়ার চেয়েও যেন বড় বিপদের আশঙ্কায় বুকটা ধড়ফড় করিয়া উঠিল।

দুয়ারে আরও জোরে ঘা পড়িল, শুয়ারকি বাচ্চা, খোল্ কেঁয়ারি।

গোষ্ঠ অস্থির হইয়া উঠিল, মনে পড়িল, হাতের উপর ইট, নালমারা জুতা, বুকের পরে কাঠ, ওঃ, নিশ্বাস বন্ধ হইয়া আসে যে!

আবার খাজনা, তাহাও বাকি; মনে পড়ে খাজনা, মামুলি চাঁদা, সেস, সুদ, চেকের দাম, নজরানা, তলবানা, তহুরী, আমলা-খরচ, থিয়েটারবৃত্তি।

বাবের আর অন্ত নাই, সে বাবের এক কানাকড়িও মাফ নাই। সব লোলুপ গ্রাসে হাঁ করিয়া বসিয়া আছে, অনন্ত ক্ষুধায় শ্মশানের কুকুরগুলার মতই জিভগুলা ঝুলিয়া পড়িয়াছে, লালসায় উষ্ণ বিষের মত লালা গড়াইতেছে।

গোষ্ঠর দেহের হাড়গুলা অবধি কনকন করিয়া উঠিল, উঃ! এতগুলা তীক্ষ হিংস্র দন্তপাটিতে এই জীৰ্ণ হাড় কয়খানা পিষিয়া ফেলিবে যে!

সে ত্বরিত পদে খিড়কির দুয়ার পানে ছুটিল, মৃদুকণ্ঠে কহিল, বল, ঘরে নাই, কোথা জানি না।

মায়ের বুকেও সন্তান যাওয়ার বিপুল বেদনা উবিয়া গিয়া আশঙ্কার মেঘ গুরুগুরু করিয়া ডাকিয়া উঠিল।

দামিনী ধড়ফড় করিয়া উঠিয়া বসিল, ততক্ষণে অতি সন্তৰ্পণে খিড়কির দুয়ার খোলার শব্দ উঠিল।

দামিনী চিৎকার করিয়া ডাকিতে যাইতেছিল, ওগো!

কিন্তু ঠিক সেইমুহূর্তে জীর্ণ দুয়ারখানা মড়মড় শব্দে ভাঙিয়া পড়িল, সঙ্গে সঙ্গে দরজা মাড়াইয়া ঘরে ঢুকিল জমিদারের খোট্টা চাপরাসী।

বিভীষণ হিংস্র চেহারা, মুখখানা হইতে দেহের কাঠামো পর্যন্ত হিংস্র বুলডগের মত, মুখখানা থ্যাবড়া, দেহখানা বেঁটে-বেটে, গিট-গিট পায়ের বাশি দুই পাশে বাঁকাবঁকা। গলার আওয়াজ পর্যন্ত ওই কুকুরগুলার মত বীভৎস।

সে বলিতেছিল, লুইয়ে রহবি, লুকইয়ে বাঁচবি শালা, হাঁড়ি পাকড়কে লুকইয়ে বাচবি, মতলব তৈরি?—বলিতে বলিতে সে সটান ঘরে ঢুকিয়া চারিদিকে দেখে।

কথা বিছানা বালিশ উল্টাইয়া দেয়, মাচার জিনিসগুলা টানিয়া নিচে ফেলে, লাঠির ডগায় হাঁড়ি উল্টাইয়া ভাঙিয়া ঘরখানাকে তছনছ করিয়া ফেলে।

আরে, এ শালা তব গেইললা কথা? ভাগলো না কা?

কণ্ঠে তাহার যেন লুকোচুরি-খেলার কৌতুক ঝরিতেছিল।

দামিনী এই অবসরে উঠানে নামিয়া কোথায় যাইবে ভাবিতেছিল, সহসা পিছন হইতে খোট্টাটা অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিয়া উঠিল, তুহভি ভাগবি মতলব, তোক্রাকে হামি লিয়ে যাবে কচহারি, চ!

বলিয়া হাসিতে হাসিতে জিভ বাহির করিয়া আগাইয়া আসে, শ্মশানের কুকুরগুলা ঠিক অমনই ভাবেই লোল জিহ্বায় কোলাহল করিতে করিতে শবগুলার পানে আগাইয়া যায়।

কঙ্কালের মধ্যে যেটুকু জীবনের অবশেষ অশেষ কষ্টে বাঁচিয়া থাকে, সেইটুকুই চিৎকার করিয়া ওঠে, যতটুকু শক্তি তাহার থাকে, নিঃশেষে প্রয়োগ করিয়া ছোটে।

কোথায়? কোন্ দিকে।

পথহারা নারী, গোষ্ঠর পদরেখা ধরিয়া খিড়কির পানেই ছুটিল।

দুর্বলা, আত্মহারা নারী, তার গতি কতটুকু, ওই হিংস্ৰ জানোয়ারটার সলঙ্ক অনুসরণের কাছে কতক্ষণ?

খিড়কির ঘাটের কাছেই খোট্টার বীভৎস হাসিটা ঠিক কানের কাছেই বাজিয়া উঠিল; উপায়হীনা দামিনী সুবলের ঘরেই ঢুকিয়া পড়িল।

প্রাণের দায়ে মানের জ্ঞান হাজার-করা একটা লোকেরও থাকে কি না সন্দেহ।

সকল সংসার ড়ুবিয়া যায়; জীব জীবধর্ম লইয়া জাগে সেখানে।

খোট্টার ভয়ে দামিনী মানমর্যাদা সব ভুলিয়া সুবলকে সবলে জড়াইয়া কাঁদিয়া উঠিল, মহান্ত, আমাকে বাঁচাও। সুবল সকল হিয়া উজাড় করিয়া দিল, ভয় কি, ভয় কি?

ওদিকে খোট্টাটা দাঁড়াইয়া হি-হি করিয়া হাসিতেছিল আর কহিতেছিল, হামরাকে ধর গো হামরাকে ধর, ঐসিন করকে হামরাকে ছাত্তি পর আ যাও, ডর কুছ রহবে না।

ওই একটা কথায় স্থান কাল পাত্ৰ সমস্তটার রূপ পাল্টাইয়া যায়; শুধু বাহিরের নয়, অন্তরের মাঝেও আর একটা পরা খুলিয়া যায়; হৃদয়ের সমস্ত কদর্যতা অস্থির হইয়া ওঠে।

দামিনী সুবলকে ছাড়িয়া দিয়া সরিয়া দাঁড়ায়; সুবলের বুকের ভিতরটা একটা উদ্দাম ক্ষুধায় তোলপাড় করিয়া ওঠে।

দামিনীর অঙ্গের ওই কোমল স্পর্শ শিরায় শিরায় আগুন ধরাইয়া দেয়, সে খোট্রাকে কহে, মেয়েমানুষকে

আর মেইয়ামানুষ, ওাকে হামি জরুর লিয়ে যাবে, ওকা ভাতারকে জমানা কৌন। দিবে? উ শালা ভাগিয়েসে তো এাকে হামি লিয়ে যাবে।

দামিনী অস্থির হইয়া ওঠে।

সুবলও জরিমানার টাকা কয়টা দিবার জন্য অস্থির হইয়া ওঠে।

এ যেন দামিনীকে কিনিবার একটা সুযোগ।

খোট্টাকে একটা টাকা দিয়া সে কহিল, চল সিংজী, ওর কাছ থেকে টাকা নিয়ে আমি দিয়ে। আসছি। কত জরিমানা?

টাকাটা বাজাতে বাজাতে খোট্টা কহে, পচাশ-পচাশ রূপিয়া, কৌড়ি না কম। আউর খাজনা, উ ভি পচিশ তিশ হোগা।

আর সে তাগিদ করে না, হাসিমুখে চলিয়া যায়। ঠিক যেমন চিৎকাররত কুকুরকে এক টুকরা হাড় ছুঁড়িয়া দিলে সকল রব বন্ধ করিয়া হাড়-মুখে রাস্তা ছাড়িয়া সে চলিয়া যায়, তেমনই ভাবে।

দামিনী কহিল, টাকা তো নাই মহান্ত।

সুবল সলজ্জ অস্থিরভাবে কহিল, তার জন্যে তু—তুমি ভেবো না।

তা—তা সে কথা কি কাউকে বলে? বলিয়া সে লজ্জায় রাঙা হইয়া টাকা লইয়া চলিয়া গেল।

পাপ, সাপের মতই তাহার প্রকৃতি, গোপনতার মধ্যে তাহার বাস, তাই মানুষ গোপনতার আড়ালে যে ক্রিয়া দেখে, তাহাকেই পাপ বলিয়া সন্দেহ করে।

দামিনীও সুবলের এই টাকা দেওয়ার সত্য গোপনতার প্রয়াসে পাপের ছাপই দেখিতে পাইল, দুনিয়ার দয়াধর্ম সব যেন বীভৎস কুৎসিত কালিতে কালো হইয়া গেল।

বুকখানা কেমন অস্থির হইয়া ওঠে, বিনিময়ে সে যে দিবার কিছু খুঁজিয়া পায় না।

তবে?

নিরুপায় মন বলিয়া ওঠে, তবে আর কি, এ তো ঋণ লওয়া হইল না, সেদিনের মত দুইটি টাকার দাদন? এ নয়-এ দাম, দাম, তোমার দাম, বিকাইলে, তুমি বিকাইলে।

দামিনী যেন উন্মাদ হইয়া উঠিল, চিৎকার করিয়া উঠিল, না না না, মহান্ত, না।

কিন্তু কোথায় মহান্ত, সে তখন চলিয়া গিয়াছে।

দামিনী ছুটিল, না না, মহান্ত, না। খিড়কির ঘাটে আসিয়াও দেখিল, সুবল নাই; দামিনীর ইচ্ছা হইল, ওই আকণ্ঠ ভরা ডোবাটার বুকে লুকায়।

কিন্তু কে যেন পিছন হইতে টান দিয়া কহিল, বিকাইয়াছ যে!

দামিনী বিহ্বলার মত ফিরিতেই দেখিল, আঁচল টানিয়া সাতু।

ছিঃ, বউ!

দামিনীর বুকখানা গুরগুর করিয়া উঠিল।

সাতু ছিছিকার করে কেন? তবে কি এই বিকিকিনির কাহিনী—

দামিনীর বাক্য ফুটিল না, সাতুর মুখপানে চাহিয়া রহিল–বিহ্বল দৃষ্টি।

সাতু কহিল, ছি বউ, দাদার কি সৰ্বনাশই করবি, হাতে দড়িই দিবি? গাছের সব ফল কটাই কি থাকে? ভাগ্যে আমি গলা শুনে এসেছিলাম, নইলে কি হত বল্ দেখি? ভগবান রক্ষে করেন, কাল থেকে আমি ওপাড়ায় মাসির বাড়িতে ছিলাম, এসে কেবল বাড়িতে পা দিয়েছি, আর শুনি মা মা বলে তুই চেঁচাচ্ছিস। সব্বনাশ সব্বনাশ। আয়, ঘরে আয়, বুক বাঁধ, সব হবে, আবার হবে।

দামিনী সাতুর গলা জড়াইয়া ধরিয়া কাঁদিল, কি হবে ঠাকুরঝি?

মাথায় হাত বুলাইয়া সাতু কহিল, হবে আবার কি, সব হবে, একবার যখন কেক ফলেছে, তখন আবার হবে, খোকা তোর বেড়াতে গিয়েছে। নে, বুক বধূ, সব হবে। ও মা, চুলে যে জট পড়েছে লো, আয় দেখি, চুল কুঁড়, লে দি, বস্।

চুলের ভিতর আঙুল চালাইয়া ফঁস ভাঙিতে ভাঙিতে সাতু গল্প করে, দামিনীর কিন্তু কানে যায় না, সে যেন ক্ষণে ক্ষণে চমকিয়া ওঠে।

সাতু যাইবার সময় কহে, এই নে, এ দুগাছা রাখ, ভাল কাজে দিস, তার ভাল হবে, না। হয় মা ষষ্ঠীকে নোটন গড়িয়ে দিস, সেদিন আমি নিয়ে রেখেছিলাম। ছেলেটার সেই জীর্ণ বালা দুইগাছা। সাতু দামিনীর আঁচলে বাঁধিয়া দিয়া যায়।

এদিকে আকাশে বুঝি ভাঙন ধরে ঝরঝর অবিরাম ধারা।

দামিনী আশ্বাসে বুক বাঁধিতে চায়, কিন্তু বাধা যায় না। উপায়ের বাঁধ পাইলে তো নিরুপায়ের ভাঙন বাঁধা যায়, কিন্তু উপায় যে দামিনী পায় না। মনে হয়, স্বামী শোধ দিবে।

পরক্ষণেই মনে পড়ে, কাবুলীর ভয়ে ঘরে খিল দেওয়া, সন্তানের চিকিৎসার সম্বল মহাজনের হাতে সঁপিয়া দেওয়া, জমিদারের ভয়ে পালানো হতাশের ভাঙন দ্বিগুণ বাড়িয়া যায়।

মনে হয়, সুবল আসিয়া হয়ত–। দামিনীর সর্বাঙ্গ শিহরিয়া উঠিতে চায়, কিন্তু সে শক্তিও যেন লুপ্ত হইয়া গেছে।

খুটখুট।

বুকের স্পন্দন বুঝি নিস্পন্দ হইয়া গেল, বুঝি সে আসিল।

অতিকষ্টে ফিরিয়া দেখে, কাকটা ঘর-নিকানো পেলেটার কানায় বসিয়া সেটা উল্টাইয়া দিল।

স্বস্তির একটা নিশ্বাস বুকখানাকে হালকা করিয়া দেয়। আঃ! চিন্তায় চিন্তায় বস্তু হারাইয়া যায়, লক্ষ্যশূন্য একাগ্র দৃষ্টিতে শুধু চাহিয়া থাকে।

আবার শব্দ হয়, দামিনী চমকিয়া যেন জাগিয়া ওঠে, এবার রোয়া-ওঠা শীর্ণ কুকুরটা ঘরে ঢুকিয়া গিন্নিপনা করিতেছে দেখা যায়। মর্মদাহী চিন্তার গুমটের মাঝে স্বস্তির বাধা পাইয়া দামিনী যেন বাঁচিয়া যায়, যতক্ষণ পারে অবসরটুকু ধরিয়া রাখিতে চায়।

কুকুরটাকে তাড়ায়, দূর দূর।

পরমুহূর্তেই আবার চিন্তায় ড়ুবিয়া যায়; কুকুরটা বাহির হইল কি না, সে খেয়াল আর থাকে না।

ওই বাধার ক্ষণটুকু জলমপ্লের প্রাণপণে মাথা তুলিয়া নিশ্বাস লওয়ার মত ক্ষীণ ও ক্ষণস্থায়ী। ক্ষণের পাখায় সময় চলে, সে বোধও নারীটির থাকে না।

আবার শব্দ হয়, এবার সত্যই সুবল আসিয়া দাঁড়ায়; অস্থির ভঙ্গি, দৃষ্টি কেমন!

সমস্ত শরীর দামিনীর কেমন করিয়া ওঠে।

সুবল কহিল, দিয়ে এলাম।

উত্তর যোগায় না, কণ্ঠ যেন রুদ্ধ, একটা কাজ পাইবার তরে দামিনী ব্যাকুল হইয়া ওঠে।

এই রসিদ—একখানা কাগজ সুবল নামাইয়া দেয়।

দামিনীর হাত যেন অবশ, কাগজখানা পড়িয়াই রহিল।

তবুও যে সুবল যায় না।

তবে?

বিনিময় চাহিবে, দাম দিয়াছে, দেহ চাহিবে!

বউ!–এবার সুবলেরও কথা যোগায় না, কানের পাশ দিয়া আগুন ছোটে, বুকের ভিতরটা টগবগ করিয়া ফোটে।

বউ!–এবার সুবল দামিনীর হাতখানা চাপিয়া ধরে, সুবলের হাতে যেন আগুন ছুটিতেছে, আর এ যেন হিম, অহল্যার দেহ বুঝি পাষাণ হইতে শুরু করিয়াছে।

তবু দামিনী অস্থির চঞ্চল কণ্ঠে কহিল, তোমার পায়ে পড়ি, এখন যাও।

সুবল বোহতের মত পলাইয়া গেল।

সুবল গেল, কিন্তু সুবলের অস্তিত্বের আভাস গেল না; ও-বাড়িতে খুট শব্দ হয়, অস্থির পদশব্দে তার বুকের কথা দামিনীর কানে বাজে।

সে শব্দ খিড়কির দুয়ার পর্যন্ত আগাইয়া আসে, কখনও গোষ্ঠর বাড়ির দুয়ার পর্যন্ত আবার ফিরিয়া যায়।

এমনই সারাটা দিন, সন্ধ্যায়ও তাহার বিরাম নাই।

গ্রাম নিশুতি হইয়া আসিল, পদশব্দ আরও আগাইয়া আসে, রাত্ৰি অন্ধকারে, দামিনী কাঠের মত বসিয়া।

নীরবে দুইখানা হাত দামিনীর হিমানী-শীতল দেহখানা জড়াইয়া ধরিল, সর্বশরীরে সে যেন ক্লেদাক্ত সরীসৃপের স্পর্শ। নারী-দেহখানা আঁকিয়া বাঁকিয়া উঠিল।

***

রাত্রি শেষ হইয়া আসে, দামিনী তেমনই নিস্পন্দ বসিয়া।

কিন্তু অন্ধকার যত তরল হইয়া আসে, দামিনী তত অস্থির হইয়া ওঠে, মাটির বুকে লুকাইতে সাপের গর্তের মত একটা গৰ্ত খোঁজে, সঁ্যাতসেঁতে ময়লা, ঘোট। কিংবা এই রাত্রিটা যদি প্রভাত না হয়, এই অন্ধকার যদি বৎসর, যুগ, না প্রলয়াব্যাপী হয়।

আঃ, তাহা হইলে ব্যাচে সে।

সম্মুখেই সেই কাগজখানা পড়িয়া, সুবলের দেওয়া সেই রসিদটা, সেটা সে স্পর্শ করিতে পারে না। একদৃষ্টে দেখে।

মনে হয়, ওই কালো কালো গুটি গুটি দাগের মধ্যে তাহার ওই ইতিহাস লেখা আছে।

শরীর মন শিহরিয়া ওঠে।

আবার কাহার টিপিয়া টিপিয়া পা ফেলার শব্দ হয়; দামিনীর বুকে আর উদ্বেগ জাগে না।

বাবা, যে বান! কে?

শ্বেতবস্ত্রাবৃত দামিনীকে দেখিয়া গোষ্ঠ চমকিয়া ওঠে; তারপর চিনিয়া কয়, ও, তুমি! খোট্টা আর আসে নাই?

দামিনী কথা কয় না।

একবার মনে হয়, ওই রসিদখানা আগাইয়া দেয়, চিৎকার করিয়া অভয় দেয়, ভয় নাই। ভীরু, ভয় নাই।

আবার নিজেরই ভয় হয়, অতি যত্নে কাগজখানাও লুকাইয়া ফেলিতে ব্যগ্রতা জাগে। কিন্তু দুইটার একটাও হয় না, কাগজখানা স্পৰ্শ করিতে পারে না; অন্তরের অহল্যা বুঝি পাষাণই হইয়া গিয়াছে।

গোষ্ঠ বলে, যে বান, গায়ে ঢুকল বলে। ক্ষণপরে আবার কহে, আর গায়ের পিতুল নাই, বানের আগে শ্মশান এসে গায়ে ঢুকছে।

ব্যগ্রভাবে দামিনী প্রশ্ন করে, আর কত দেরি?

প্রশ্নটার তাৎপর্য গোষ্ঠ বুঝিতে পারে না, দামিনীর মুখপানে চাহিয়া থাকে।

আবার বর্ষণ প্রবল হইয়া ওঠে, সঙ্গে সঙ্গে এলোমেলো ক্ষ্যাপা হাওয়া।

পশ্চিমের দিগন্তে বুঝি কোনো ঘুমন্ত সুবিশাল অজগর সদ্য জাগিয়া ধরণীগ্রাসে আগাইয়া আসিতেছে।

কালো মেঘের বুক চিরিয়া তাহার রক্তজিহ্বা ঘন ঘন লকলক করে; সমস্ত সৃষ্টিটা থরথর করিয়া কাঁপিয়া ওঠে; আকাশস্পর্শী বৃক্ষশীর্ষ, তাহার বিষনিশ্বাসে মাথা আছড়াইয়া মরে; উচ্চ গৃহচূড়ের পাশ দিয়া সে নিশ্বাস গর্জিয়া যায়–গো-গোঁ, পাষাণপুরীর অন্তস্তল পর্যন্ত চাড় খাইয়া চড়চড় করিয়া ওঠে। বৃষ্টির ছাট-হাওয়ার দাপটে অসহ তীক্ষ্ণ, সে যেন বিষের ছিটা, মৃত্যুর হিমানী মাখা।

দাওয়ার উপর এমনই একটা দাপটে গোষ্ঠ ব্যতিব্যস্ত হইয়া বলে, ঘরে এস গো, ঘরে এস।

দামিনীর এ প্রলয়তাণ্ডবে কেমন একটা উল্লাস জাগে, সে কথা কহিল না, শুধু সমস্ত অন্তর উনুখ করিয়া ওই প্রলয়লীলার উন্মত্ত আলিঙ্গনের মাঝে নিজের অস্তিত্ব লুপ্ত করিয়া দিতে চাহিতেছিল।

ঘরখানার চালের পাশ দিয়া আবার একটা প্রবাহ বহিয়া যায়, সে বিষনিশ্বাসে ঘরখানার হাড়-পাঁজর মড়মড় করিয়া আর্তনাদ করিয়া ওঠে, চাল করিয়া ওঠে মচমচ।

গোষ্ঠ শিহরিয়া ত্রস্তভাবে কহে, পিঁড়েখানটা কই গো, পিঁড়েখানটা, পবন-দেবতাকে বসতে পেতে দি উঠোনে।

পিঁড়িখানা গোষ্ঠ উঠানে পাতিয়া দেয়, শান্ত হয়ে বস ঠাকুর, শান্ত হয়ে বস। দেবতা শান্ত হয় না; আবার ঝড় গোঙায়, দামিনীর পাশ হইতে রসিদখানা ঝড়ে উড়িয়া যায়।

দামিনীর বুকখানা কত হালকা হইয়া ওঠে।

গোষ্ঠ আৰ্তকণ্ঠে ডাকে, হে ভগবান, রক্ষে কর প্রভু, রক্ষে কর। আবার কহে, ডাক গো, ভগবানকে ডাক এ সঙ্কটে।

না।—অতি স্পষ্ট দৃঢ় কণ্ঠস্বর।

গোষ্ঠ হতভম্বর মত দামিনীর পানে তাকাইয়া কহে, ক্যানে?

কি হবে ডেকে?

প্রশ্নের উত্তর নাই, নির্বাক বিস্মিত নেত্রে গোষ্ঠ দামিনীর পানে চায়; বৃষ্টির দাপট স্বামী। স্ত্রীকে ভিজাইয়া, দাওয়ার দেওয়াল পর্যন্ত ভিজাইয়া দেয়, গোষ্ঠ ত্রস্ত শিশুর মত ঘরের দরজা খুলিয়া ভিতরে ঢুকিয়া বসে, দামিনীকেও ডাকে, এস, এস, ঘরকে এস গো।

দামিনী কথাও কহিল না, উঠিলও না, বসিয়াই রহিল।

গোষ্ঠ এবার বিরক্ত হইয়া কহিল, তোমার হল কি বল দেখি? দুঃখ কি আমার হয় নাই, না। কি তোমার একারই হয়েছে?

দামিনী উন্মাদের মত কহে, কত দুঃখ-কত দুঃখ তোমার হয়েছে? মরতে মনে হয় তোমারঃ হয়?

হা-হা করিয়া হাসিতে ইচ্ছা করে তাহার; ওপাশ হইতে একটা বিপুল আৰ্তনাদ, সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ভয়ার্ত চিৎকার; ওই চিৎকারে তাহার সংবিৎ আবার ফিরিয়া আসে।

বুকের মানুষটি একেবারে মরে না।

দেহের কষ্টে, মরণের ভয়ে যে গোষ্ঠ শিশুর মত চারিখানা দেওয়ালের ভিতর মাটিমায়ের কোল খুঁজিতেছিল, সেও ওই বিপুল আৰ্তনাদে ছুটিয়া গিয়া বাহিরদুয়ারে দাঁড়ায়।

বৃষ্টির আবরণ ভেদিয়া সকল শক্তিপ্রয়োগে তীব্র বিস্ফারিত দৃষ্টি হানে; সব আবরিত করিয়া বর্ষার শুভ্র ধারা, কিছু দেখা যায় না।

আন্দাজ করিয়া বলে, কার ঘর উড়ল, টিনের শব্দ, টিনের ঘর! কণ্ঠস্বরে, ভঙ্গিতে আর সে কাতরতা নাই, পরের অবস্থা দেখিয়া সেও যেন প্রস্তুত হইয়া উঠিল।

সে নিজের ঘরের পানে তাকায়, ঘরখানা এক-একবার ঝড়ের বেগে দেওয়াল ছাড়িয়া ওঠে।

বাহিরপথ হইতে হাক আসে, এ গুষ্টা, গুষ্টা!

জমিদারের খোট্টা চাপরাসী।

মুহূর্ত পরেই ভাঙা দুয়ার দিয়া খোট্টা আসিয়া গোষ্ঠের হাত ধরিয়া টানে বলে, আও, কোদারি লেকে আও, কচহারিমে বান উঠিয়েছে।

জমিদারের ভয়ের চেয়ে ভীষণতর ভয় গোষ্ঠের সম্মুখে, সে তাহারই জন্য বুক বাঁধিতেছিল।

আজ খোট্টার রক্ত-আঁখি তাহার তুচ্ছ ঠেকিল, সে হাত টানিয়া মুক্ত করিয়া লইয়া কহিল, আর আমার ঘর উড়, ক, ঘর-সংসার ড়ুবে মরুক; পারব না যেতে আমি।

গালি দিয়া খোট্টা দরিদ্রের ঘাড়ে ধাক্কা মারে, চল শালা চত্।

রিক্ততা শুধু বঞ্চনাই করে না, সর্বপ্রকার সঙ্কোচ হইতে মুক্ত করে মানুষকে; উলঙ্গ শক্তি লইয়া রিক্ত জন মরিয়া হইয়া জাগে।

বুকের মাঝে আবার ঘূর্ণি জাগে, সমস্ত শরীরে রক্ত ঝঝিয়া ওঠে, গোষ্ঠ ঘুরিয়া খোট্টাকে নিঃসঙ্কোচে সজোরে ধাক্কা মারে; পিছল মাটিতে ধাক্কার বেগে সে মাটিতে আছাড় খাইয়া পড়ে।

বিপুল ক্রোধে খোট্টা উঠিয়া বসিতে না বসিতেই হাতের লাঠি হানিল। বেকায়দায় হানা দুর্বল লাঠি গোষ্ঠ সহজেই ধরিয়া লইল, বিদ্ৰোহী ঝড়ের ছোঁয়াচে মরিয়া মস্তিষ্কে তাহার যেন খুন। চাপিয়া যায়, সজোরে সেই লাঠি খোট্টার মাথায় বসাইয়া দিল।

বৃষ্টির জল লালচে হইয়া গেল, ফিনকি-দেওয়া রক্তের ধারায় মাটির খানিকটা উপরের বৃষ্টির ফোঁটা কয়টা পর্যন্ত।

রক্ত দেখিয়া গোষ্ঠ শিহরে না, স্থির দৃষ্টিতে দেখে। দামিনীরও ভয় হয় না, মনে তৃপ্তি যেন জাগে, লাঞ্ছিতা নারীর বুকে দুঃশাসনের রক্তে পাঞ্চালীর উল্লাস জাগিয়া ওঠে।

আইনে অত্যাচারীকে হত্যার অধিকার নাই। গোষ্ঠ বসিয়া ভাবে।

ক্ষণপরে আপন মনেই বলে, সেই ভাল, কিসের তরে থাকব, জমি গেল, ছেলে গেল; দুটো পেট, যেখানে খাটব, সেইখানে ভাত। এখানেও খাটা, বাইরেও খাটা। ঘর? গাছতলা তো আছে।

আবার ঝড় গোঙায়।

উঠানের ওপাশের বড় আমগাছটি শিকড়সুদ্ধ উপড়াইয়া পড়িল। সে কি শব্দ! গাছটার মরণের আর্তনাদ যেন!

তলার আগাছার দল, হাওয়ায় জলে, মেঘলা দিনের ম্লান আলোকে উন্মত্ত পুলকে লুটাপুটি খাইয়া মরে।

উঠানে জল ঢোকে, গোষ্ঠ কহে, বান।

খোট্টার দেহটা টানিয়া ওপাশের সার-ডোবায় ফেলিয়া দিয়া দামিনীর হাত ধরিয়া বলে, এস।

নিঃসঙ্কোচে স্বামীর হাত চাপিয়া ধরিয়া দামিনী উঠিয়া দাঁড়ায়, প্রশ্ন পর্যন্ত করে না, কেন, কোথায়?

পাতানো ঘরসংসারের পানে ফিরিয়া তাকায় না পর্যন্ত; গোষ্ঠও না।

মুক্তির কামনায় মায়া টুটে।

দামিনী আগে পা বাড়াইয়া কহে, চল।

উন্মত্ত ঝড়বৃষ্টির মাঝে ওই আগাছগুলার মত লুটাপুটি খাইতে খাইতে পথে বাহির হয়, নূতন আশ্রয়ের তরে।

কোথায় সে আশ্ৰয়? বন-জঙ্গল হয়ত।

চলিতে চলিতে গোষ্ঠ বলে, এস, ওই বটতলাতে দাঁড়াই, এমন করে ঝড়ে জলে মরার চেয়ে গাছ চাপা একবারে, সে ভাল।

আবার ক্ষণপরে কহে, ঠিক বলেছ, কি হবে ভগবানকে ডেকে? ভগবান নাই, নইলে একজন অট্টালিকায় ঘুমোয় আর দশজন রোদে পোড়ে, ঝড়ে, বাদলে মরে?

দামিনী কথা কয় না, পঁতে দাঁতে তাহার একটা শব্দ হয়; সে শীতের কম্পন, না আক্রোশের ঘর্ষণ, কে জানে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *