০৭. মানুষটার আজব কাজকর্ম

০৭.

আমার কাছ থেকে সবকিছু শোনার পর প্রথমে একুশ দাড়ির মানুষটার আজব কাজকর্ম নিয়ে সবাই একটু হাসাহাসি করলাম, তারপর মাহবুব প্রথমে আমাদেরকে নিয়ে কাছাকাছি একটা বাজারে রওনা দিল। জায়গাটা বেশ দূরে কিন্তু দেখা গেল হাঁটতে কারো আপত্তি নাই। আশে পাশে মানুষ নেই তাই আমরা লাফাতে লাফাতে কিংবা গান গাইতে গাইতে যেতে পারব কেউ কিছু বলতে আসবে না। হাতের গাইগার কাউন্টারটি কী সেটা একটু ব্যাখ্যা করতে হলো। আমি বানিয়ে বানিয়ে বললাম এটা বাতাসের মাঝে কার্বন ডাই অক্সাইড কতোটুকু সেটা মাপার যন্ত্র। তবে নামটা শুনে তারা আমার সাথে একমত হলো যে গাইগার বেচারার বাবা মায়ের তার জন্য আরেকটু ভালো নাম দেওয়া উচিত ছিল। টনি অবশ্য বলার চেষ্টা করল যে গাইগার নিশ্চয়ই পারিবারিক নাম, তার বাবা মায়ের নামও নিশ্চয়ই গাইগার। আমরা সেটা শুনেও না শোনার ভান করলাম, একটা মজার বিষয়কে কেউ কাঠখোট্টা সত্যি তথ্য দিয়ে পানসে করে দিতে কেউ চায় না।

আমরা যখন হাঁটছি তখন আমি টনির দিকে তাকালাম, তার মুখটা যথেষ্ট ভোলা। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি না আসতে চাইছিলে না, তাহলে আসলে কেন?”

টনি বলল, “আমি আসলেই আসতে চাই নাই। শুয়ে শুয়ে টিভি দেখব ভেবেছিলাম। কিন্তু

“কিন্তু কী?”

 “হঠাৎ করে কাদের মামা চলে এসেছে।”

 ‘কাদের মামাটা কে?”

 “আমার একজন মামা। খালি প্রশ্ন করে! খুবই যন্ত্রণা।”

আমি অবাক হয়ে বললাম, “খালি প্রশ্ন করে? কী প্রশ্ন?”

টনি তার ভোতা মুখটা আরো ভোতা করে বলল, “দেখা হতেই প্রশ্ন করল একটা বিল্ডিংয়ের তিন তলায় একজন দাঁড়িয়ে আছে। সে যদি মাটি থেকে তিরিশ ফুট উঁচুতে থাকে তাহলে যে সাত তলা আছে সে কত উপরে আছে।”

“তুমি কী বলেছ?”

“কী বলেছি মানে?” টনি একটু বিরক্ত হয়ে বলল “যেটা উত্তর সেটা বলেছি।”

এবারে মাহবুব জিজ্ঞেস করল, “উত্তরটা কী?”

টনি বলল, “কেন? সত্ত্বর ফুট।”

 আমি বললাম, “হয় নাই।”

 টনি অবাক হয়ে বলল, “হয় নাই?”

“না।”

“তাহলে ঠিক উত্তর কতো?”

“জানি না।”

টনি একটু অবাক হয়ে বলল, “জান না? তাহলে বুঝলে কেমন করে যে আমার উত্তরটা হয় নাই?”

‘যদি উত্তরটা এতো সহজ হতো তাহলে তোমার মামা জিজ্ঞেস করতো না। এর মাঝে নিশ্চয়ই প্যাঁচ আছে।”

ডোরিন মাথা নাড়ল, বলল, “আছে। প্যাঁচ আছে।”

 মাহবুবও মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ। প্যাঁচ আছে।”

আমি বললাম, “বড় মানুষেরা সব সময় ছোটদের প্যাঁচের মাঝে রাখে।”

টনি অবাক হয়ে বলল, “কিন্তু এতো সোজা একটা প্রশ্নের মাঝে প্যাঁচ থাকবে কেমন করে?”

আমি বললাম, “সোজা জিনিসের মাঝেই প্যাঁচ বেশি থাকে।”

কাজেই প্রশ্নটার মাঝে প্যাঁচটা কোনখানে সেটা চিন্তা করতে করতে আমরা হাঁটতে লাগলাম। মাহবুব সবার আগে প্যাঁচটা ধরতে পারল। আনন্দে চিৎকার করে বলল, ‘নব্বই ফুট, নব্বই ফুট!”

আমরা অবাক হয়ে বললাম, “নব্বই ফুট?”

“হ্যাঁ। সাত তলায় যে আছে সে নব্বই ফুট উপরে আছে। তারপর আমাদের বুঝিয়ে দিল সেটা কেমন করে বের করেছে। আমরা সবাই মাথা নাড়লাম, বুঝলাম মাহবুব সত্যিই প্যাঁচটা বুঝতে পেরেছে।

টনি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “মামাকে এর উত্তরটা বলে লাভ নাই। মামা তখন আরেকটা জিজ্ঞেস করবে। তারপর আরেকটা তারপর আরেকটা। যদি কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারি তাহলে হতাশ ভাব দেখিয়ে মাথা নাড়ে। খুবই যন্ত্রণা।”

আমরা সবাই স্বীকার করে নিলাম, বড় মানুষদের এই রকম ব্যবহারের জন্য ছোটদের জীবনে কোনো আনন্দ নাই। আমি বললাম, তুমি একটা কাজ করো না কেন?”

“কী কাজ?”

“তোমার মামা একটা প্রশ্ন করলে তুমি আরেকটা প্রশ্ন করবে।”

“আমি আরেকটা প্রশ্ন করব?”

“হ্যাঁ। বড় মানুষদের টাইট করার মতো প্রশ্ন আছে।”

 “আছে নাকি?”

“হ্যাঁ। যেমন তুমি জিজ্ঞেস করতে পার আপনি কী প্রত্যেকদিন আপনার কান ধরে টানেন?”

টনিকে কেমন জানি বিভ্রান্ত দেখা গেল। বলল, “এটা জিজ্ঞেস করলে কী হবে?”

তোমার মামা বলবে, ‘না। তখন তুমি বলবে ও আচ্ছা, তার মানে আপনি প্রত্যেকদিন টানেন না, শুধু মাঝে মাঝে কান ধরে টানেন। তারপর জোরে জোরে হা হা করে হাসবে।”

আমার বুদ্ধি শুনে সবাই এখনই জোরে জোরে হা হা করে হাসল। আমরা তখন আরো অনেকগুলো এরকম পিছলে ধরনের প্রশ্ন টনিকে শিখিয়ে দিলাম একটা নাপিতের দাড়ি কাটা নিয়ে প্রশ্ন, একটা কেক ভাগ করা নিয়ে প্রশ্ন, একটা শেয়ালের ঘুমানো নিয়ে প্রশ্ন, একটা ভালুকের গায়ের রং নিয়ে প্রশ্ন। তখন খুব ধীরে ধীরে টনির ভোতা মুখটা একটু সহজ হলো।

কথা বলতে বলতে আর হাঁটতে হাঁটতে আমরা একটা বাজারে হাজির হলাম। খুবই ছোট বাজার মাত্র তিন চারটা দোকান। একটা চায়ের দোকানের সামনে দুইটা বেঞ্চ সেখানে কয়েকজন মানুষ বসে চা খাচ্ছে তারা খুবই সন্দেহের চোখে আমাদের দিকে তাকালো। এটা হচ্ছে বড় মানুষদের সমস্যা। তারা কোনো কাজকর্ম না করে দুপুর বেলা বসে বসে চা খাচ্ছে। আমরা ইচ্ছা করলেই খুবই সন্দেহের ভঙ্গীতে মানুষগুলোর দিকে তাকাতে পারতাম। আমরা তো তাকাচ্ছি না তারা কেন তাকাচ্ছে?

যাই হোক মাহবুব আমাদের একটা দোকানে নিয়ে গেল, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি এইখান থেকে জিনিসপত্র কিনতে পারবে।”

ডোরিন জিজ্ঞেস করল, “কী কিনবে?”

 আমি বললাম, “ডেইলি সাপ্লাই।”

 “তার মাঝে কী আছে?”

 “আমি কেমন করে বলব?”

 ডোরিন অবাক হয়ে বলল, “তাহলে কে বলবে?”

“আমি তোমাদেরকে নিয়ে এসেছি কেন? তোমরা বল ডেইলি সাপ্লাইয়ে কী কী থাকে?”

তারা সবাই একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাল। তারপর ডোরিন বলল, “ডেইলি তোমরা কী কর?”

“সবাই যেটা করে আমরাও সেইটা করি।”

আবার সবাই একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাল। মাহবুব বলল, “বুঝেছি। টোপন কিছুই জানে না। সারাদিনে যা যা লাগে সেগুলো কিনে দেই।”

“ঠিক আছে।” ডোরিন বলল, “একেবারে সকাল থেকে শুরু করে। ঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ করার জন্য টুথপেস্ট, টুথব্রাশ। কুলি করার জন্য গ্লাস আর পানি। মুখ ধোওয়ার জন্য সাবান, মুখ মোছার জন্য তোয়ালে। ঘুমের কাপড় বদলে পরার জন্য শার্ট প্যান্ট জুতা মোজা। তারপর ব্রেকফাস্ট করার জন্য”

আমি হাত তুলে বললাম, “থামো থামো ঠাট্টা না করে আসলে যা যা দরকার সেগুলো কিনে দাও। খাবার দাবার হলেই হবে।”

“শুধু খাবার দাবার?”

 ‘হ্যাঁ।”

ডোরিন মুখ সূচালো করে বলল, “তাহলে তো সোজা। ব্রেকফাস্ট থেকে শুরু করি। ব্রেকফাস্ট লাগবে রুটি, মাখন, জেলি, ডিম, কলা এবং চা না হয় কফি।”

দোকানদার জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “কলা ছাড়া আর কিছু নাই।”

আমরা দোকানে ঝুলে থাকা রোগা রোগা কয়েকটা কলা দেখতে পেলাম। মাহবুব জিজ্ঞেস করল, “ডিম? ডিমও নাই?”

দোকানদার মাথা চুলকালো, বলল, “ডিম কয়েকটা জোগাড় করা যেতে পারে।”

ডোরিন বলল, “লাঞ্চে দরকার কোনো এক ধরনের সুপ, নুডলস এবং ভেজিটেবল। নুডলসে চিকেনের টুকরো দেওয়া যেতে পারে।”

আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, “তোমরা বুঝতে পারছ না। বেশি ভালো খাবার দাবারের দরকার নাই, শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য যেটা না হলেই না সেটা ছাড়া আর কিছু লাগবে না। যদি খুব ভালো করে বাজার করে নেই তাহলে অন্য সমস্যা হতে পারে।”

“অন্য কি সমস্যা?”

“তাহলে মামা সব সময় আমাকে পাঠাবে বাজার করতে।”

সবাই প্রথমে হাসল তারপর মাথা নাড়ল। বড়দের নিয়ে কী কী সমস্যা হতে পারে আমরা সবাই সেটা জানি। টনি চিন্তিত মুখে জিজ্ঞেস করল, কিন্তু তুমি যদি খুব খারাপ বাজার করে নিয়ে যাও তাহলে সমস্যা হবে না?”

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “নাহ্! তাহলে কোনো সমস্যা নাই।”

 “কেন?”

“কারণ বাজার যদি খুব খারাপ হয় আমি সব দোষ দিব তোমাদের। বলব তোমরা জোর করে আমাকে এগুলো কিনিয়েছ। আমি কিনতে চাই নাই।” বলে আমি দাঁত বের করে হাসলাম।

আমার কথা শুনে তিনজন প্রথমে চোখ পাকাল তারপর তিনজনই আমার মতো দাঁত বের করে হাসল। ডোরিন বলল, “তুমি আসলে একটা মিচকে শয়তান।”

আমি মাথা নেড়ে স্বীকার করে। নিলাম, “হ্যাঁ। আমি আসলেই একটা মিচকে শয়তান।”

সবাই মিলে আলাপ আলোচনা করে আমাকে ডেইলি সাপ্লাই কিনে দিল। আমি সেগুলো আমার ব্যাকপেকে ভরে নিলাম। ফিরে যাবার আগে মাহবুব বলল, “চল চা খাই।”

সাথে সাথে সবাই রাজী হয়ে গেল। চায়ের দোকানটার বাইরে রাখা বেঞ্চটা একটু খালি হয়েছে আমরা সেখানে বসে চায়ের অর্ডার দিলাম। যে ছেলেটা চা তৈরী করছে সে প্রায় আমাদের বয়সী। অনেক যত্ন করে সে আমাদের জন্য চা তৈরি করে দিল। চায়ে চুমুক দিয়েই ডোরিন বলল, এতো মজার চা সে জীবনেও খায় নাই।

টনি যতক্ষণ মুখ ভোলা করেছিল ততক্ষণ ডোরিনের একটা কথাও সে মেনে নেয় নাই কিন্তু তার কাদের মামাকে পিছলে প্রশ্ন করে টাইট করার বুদ্ধি দেওয়ার পর থেকে সে একটু সহজ হয়েছে। এখন মাঝে মাঝেই সে আমাদের কথাবার্তায় যোগ দিচ্ছে। ডোরিনের সাথে সাথে সেও স্বীকার করে নিল যে এই চা’টা অসাধারণ। তাদের মনি কাঞ্চনের চা এর তুলনায় বাসন ধোয়া পানি ছাড়া আর কিছু না!

চা খেয়ে আমরা রওনা দিলাম। মামা আমাকে তিনটা কাজ দিয়েছিল। একটা ছিল গাইগার কাউন্টার দিয়ে এই এলাকাটা ম্যাপিং করা, একুশ দাড়ি উৎপাত করার পরও সেটা অনেকখানি করেছি। আরেকটা ছিল ডেইলি সাপ্লাই কিনে আনা সেটাও কিনে ফেলেছি। এখন বাকী আছে মাটির সেম্পল নিয়ে আসা। যেহেতু আমরা চারজন আছি তাই চার জায়গায় সেম্পল নিতে পারব। আমি মামার জিপিএসটা বের করে মামা যেভাবে শিখিয়ে দিয়েছে সেভাবে লেটিচ্যুড লঙ্গিচ্যুড বের করে আমার নোট বইয়ে লিখে নিলাম। তারপর মাটি খুঁড়ে প্রায় দুই কেজি মাটি পলিথিনের ব্যাগে ভরে নিলাম।

দুই কেজি মাটি মোটেও বেশি না কিন্তু হাঁটা শুরু করার পর মাটির ওজন আস্তে আস্তে বাড়তে লাগল। আমাদের কাছে শুধু মাটি না; ডেইলি সাপ্লাই আছে, গাইগার কাউন্টারটাও আছে। কাজেই সব মিলিয়ে মোটামুটি পরিশ্রম হতে লাগল এবং আমরা মাঝে মাঝেই বসে বিশ্রাম নিতে লাগলাম।

আমি বললাম, “একটা রিকশা থাকলে খারাপ হতো না।”

মাহবুব বলল, “রিকশা চালানোর জন্য রাস্তা দরকার হয়। এখানে রাস্তা নাই, রিকশা চালাবে কোথায়?”

আমরা নদীর তীর ঘেঁষে হাঁটছিলাম, তখন ডোরিন বলল, “ঠিক আছে রিকশার বদলে নৌকা হলেও খারাপ হতো না।”

ঠিক তখন দেখলাম দূর থেকে একটা নৌকা আসছে। মাহবুব বলল, “দেখি এই নৌকাটাকে রাজি করাতে পারি কিনা।”

নৌকাটা কাছে আসতেই মাহবুব গলা উঁচিয়ে বলল, “মামা, যাত্রী নেবেন?”

“কই যাবা?”

“ঐ তো সামনে। হাওড়ের মুখে।”

 “নাও ওঠো।”

মানুষটা নৌকাটাকে তীরের কাছে নিয়ে এলো, তখন আমরা সাবধানে উঠে গেলাম। এই নৌকাটা মাহবুবের নৌকার মতো ছোট নৌকা না তাই উঠতে কোনো ঝামেলা হলো না।

নৌকায় আরো দুইজন মানুষ বসেছিল তারা একটুখানি কৌতূহল নিয়ে আমাদের দিকে তাকালো। মাঝি জিজ্ঞেস করল, “তোমাদের বাড়ি কোনখানে?”

মাহবুব আমাদের হয়ে কথা বলল, “আমার বাড়ি এইখানে কাজী বাড়ি। এরা বাইরের। দুইজন মনি কাঞ্চন থাকে। আরেকজন তার মামার সাথে গাড়িতে থাকে।”

মনি কাঞ্চন নিয়ে মাঝির খুব কৌতূহল। সে নানা ধরনের প্রশ্ন করল। অনেকগুলো প্রশ্ন বিদেশি সাহেবদের নিয়ে। এইখানে এতো বিদেশি সাহেব কেন আসে, তারা কী করে। তারা কী খায়। মদ খায় নাকি ইত্যাদি ইত্যাদি নানা প্রশ্ন। ডোরিন আর টনি যেটুকু পারল সেটুকু উত্তর দিল।

নৌকায় বসে থাকা দুজন মানুষের একজন আমাকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি গাড়িতে থাকো?”

আমি মাথা নাড়লাম।

“কেন? গাড়িতে কেন থাকো?”

আমি কিছু বলার আগে মাহবুব উত্তর দিল, “ওর মামা সায়েন্টিস্ট। গাড়িতে অনেক বড় ল্যাবরেটরি। গবেষণা করে সেইজন্য গাড়িতে থাকে।”

মানুষটা ঠিক বুঝল কি না কে জানে। আমার হাতের গাইগার কাউন্টারটা দেখে জিজ্ঞেস করল, “তোমার হাতে ঐটা কী যন্ত্র?”

আমি বললাম, “এইটার নাম গাইগার কাউন্টার।”

 “এইটা দিয়ে কী করে?”

আবার আমি উত্তর দেবার আগে মাহবুব উত্তর দিল। “বাতাসের দূষিত পদার্থ মাপে।”

মানুষটার যথেষ্ট কৌতূহল, সে হাত বাড়িয়ে বলল, “দেখি যন্ত্রটা।”

আমি কী আর করি, তার হাতে গাইগার কাউন্টারটা দিলাম। সে এটা হাতে নিয়ে দেখল, তার টুকরির উপর রেখে মাথা ঘুরিয়ে পরীক্ষা করল তখন হঠাৎ আমি লক্ষ করলাম গাইনার কাউন্টারটার কট কট শব্দটা একটু বেড়ে গেছে। একটু ঘন ঘন শব্দ করছে। আমি ছাড়া আর কেউ ব্যাপারটা লক্ষ করল না।

মানুষটা একটু পরে আমার হাতে গাইগার কাউন্টারটা ফিরিয়ে দিল এবং আমি লক্ষ করলাম তখন কট কট শব্দটা আবার কমে গেল। কী আশ্চর্য!

কিন্তু আসলেই সত্যি সত্যি হচ্ছে নাকি এটা আমার মনের ভুল কে জানে। ব্যাপারটা আমার একটু পরীক্ষা করা দরকার। তাই আমি মানুষটাকে বললাম, এই যন্ত্রটা টানতে টানতে আমার হাত ব্যথা হয়ে গেছে। আপনার টুকরির উপর যন্ত্রটা একটু রাখি?”

মানুষটা বলল, “রাখ।”

আমি আবার টুকরির উপর রাখলাম এবং স্পষ্ট শুনতে পেলাম কট কট শব্দটা বেড়ে গেছে। কী রহস্যময় ব্যাপার।

আমি কয়েক মিনিট অপেক্ষা করলাম, তারপর জিজ্ঞেস করলাম, “আপনার টুকরির ভিতর কী?”

মানুষটা হাসার ভঙ্গী করল, “কিছু না। হাওড়ের পাড় গিয়েছিলাম সেইখানে একটা যষ্ঠিমধু গাছের চারা পেয়েছি। নিয়া যাচ্ছি বাড়িতে লাগব।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “যষ্ঠি মধু গাছের চারা দেখতে কেমন?”

মানুষটা তার টুকরির ঢাকনা খুলল, আমি দেখলাম ভিতরে লতানো একটা গাছের চারা। গাছের নিচে খানিকটা মাটি। মনে হয় এই মাটিটা রেডিও একটিভ। একটু পরীক্ষা করে দেখতে পারলে হতো।

আমি আমার পিছলে বুদ্ধি ব্যবহার করার চেষ্টা করলাম, বললাম, “আমার গাছ খুব ভালো লাগে। এই গাছটা একটু দেখি?”

মানুষটা মনে হয় একটু অবাক হলো, কিন্তু স্বাভাবিক গলায় বলল, “দেখো।”

আমি এবারে হাত বাড়িয়ে তলায় লাগানো মাটিসহ গাছের চারাটাকে তুলে নিয়ে এসে চোখের সামনে ধরে দেখার ভান করলাম তারপর একেবারে গাইগার কাউন্টারের টিউবটার কাছে নিয়ে গেলাম। কটকট শব্দটা সত্যি সত্যি অনেক বেড়ে গেল। আমি আবার সরিয়ে নিলাম, শব্দটা সাথে সাথে কমে গেল। এবারে আর কোনো সন্দেহ নেই।

আমি যষ্ঠি মধু গাছটা আবার সাবধানে টুকরির মাঝে রেখে বললাম, ‘আপনি আমাকে ঠিক করে বলবেন এই চারাটা কোথায় পেয়েছেন?”

“কেন?”

“আমি যষ্ঠি মধু গাছের চারা অনেক দিন থেকে খুঁজছি কিন্তু পাচ্ছি না। ঐ জায়গায় দেখতাম আরো আছে কিনা।”

মানুষটা না সূচকভাবে মাথা নেড়ে বলল, “তোমারে যেতে দিবে না।”

 “যেতে দিবে না?”

“না।”

 “কে যেতে দিবে না।”

“কোম্পানির দারোয়ান।”

“কিসের কোম্পানি?”

‘মনে হয় সিমেন্ট কোম্পানি। কাউকে যেতে দেয় না। দারোয়ানরা বন্দুক নিয়ে পাহাড়া দেয়।”

আমি বেশ অবাক হলাম। যে সিমেন্ট কোম্পানি এখনো তৈরি হয়নি সেটা বন্দুক দিয়ে পাহাড়া দিতে হয়? তারপরও বললাম, “জায়গাটা একটু চিনিয়ে দেবেন? বলে দেখব যেতে দেয় কি না।”

মানুষটা তখন জায়গাটা চিনিয়ে দিল, আমি ঠিক চিনতে পারলাম না, মাহবুব সহজেই চিনতে পারল। জায়গাটাতে গিয়ে আমার মাটি পরীক্ষা করতে হবে। হাওড়ের কাছাকাছি এসে আমরা নৌকা থেকে নেমে গেলাম। সবাই মিলে আমরা মামার মাইক্রোবাসের দিকে হাঁটতে থাকি। মাহবুব, ডোরিন আর টনি নিজেদের ভিতরে কথা বলছে। আমি একটু অন্যমনস্ক হয়ে থাকলাম। যষ্ঠি মধু গাছের গোড়ার মাটি থেকে গাইগার কাউন্টারে অনেক বেশি সিগন্যাল দেয়, তার মানে এই মাটিতে রেডিওএকটিভিটি আছে। কী আশ্চর্য। মামা যখন জানবে তখন কী অবাক হয়ে যাবে। আমি মাহবুব, ডোরিন আর টনিকে সত্যি কথাটা বলতে পারছি না তাই মনটা খুঁত খুঁত করতে লাগল। সবকিছু জানলে তারা কতো উত্তেজিত হতে পারতো। মামাকে জিজ্ঞেস করতে হবে এই তিনজনকে আসল কথাটা বলা যায় কি না। এরা যেহেতু কাজকর্মে সাহায্য করছে তাদের নিশ্চয়ই সত্যি কথাটা জানার অধিকার আছে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *