০৭. মা


আজাদ একটু একটু করে বড় হতে থাকে, আর ধীরে ধীরে হয়ে উঠতে থাকে দুষ্টের শিরোমণি ৷ সিনেমা দেখার পোকা যেন সে ৷ নাজ সিনেমা হলে ইংরেজি ছবি বেশি চলে ৷ দেখতে যায় বন্ধুবান্ধব মিলে ৷ ছুটির দিনের মর্নিং শো প্রায় কোনোটাই বাদ যায় না ৷ সম্প্রতি তারা একটা ছবি দেখেছে ৷ তাতে পাত্রপাত্রীরা চোখ ঢেকে রাখে চামড়ার মুখোশে ৷ ঢাকার একটা দোকানে সেই মুখোশ পাওয়া যাচ্ছে ৷ বন্ধুবান্ধব মিলে বেরিয়ে পড়ে সেই মুখোশ কিনতে ৷ দোকানে গিয়ে এক ঢিলে দু পাখি শিকার ৷ স্মোকগান পাওয়া যায় ৷ বন্দুক, গুলি করলে ধোঁয়া বের হয় নল দিয়ে ৷ বন্দুক আর মুখোশ কিনে ফেলে তারা ৷ চলে আসে বাসায় ৷ দরজা লাগিয়ে চলে খেলা ৷ স্মোকগান খেলা ৷ চোখে মুখোশ ৷ তারপর এ ওকে ঘুসি মারে, ও একে ৷ ঘুসি খেয়ে কেউ পড়ে যায় ৷ কেউবা পড়তে চায় না ৷ চালাও গুলি ৷ বন্দুকের মুখ দিয়ে ধোঁয়া বেরুচ্ছে ৷ ‘এই তু্ই মরা, মরা, তোকে তো আমি গুলি করেছি ৷’ ‘কিসের ৷ তার আগেই তোকে না আমি ফায়ার করলাম ৷ না, আমি মরা না ৷’ খেলার নিয়মকানুন কেউ মানতে চায় না ৷ গুলি খেয়েও উঠে পড়ে ৷ একটা রেফারি থাকলে ভালো হতো ৷ তবু খেলা চলে ৷ হৈচৈয়ে ঘরের আশপাশে কারো তিষ্ঠানো দায় ৷ এরই মধ্যে আজাদের খালাতো ভাই ছোট্ট জায়েদ আসে ৷ দরজায় নক করে ৷
‘কে ?’ আজাদ বলে ৷
‘আমি জায়েদ ৷’
‘কী চাস ?’
‘আমাকেও খেলায় ন্যাও ৷’
‘যা যা, এটা বড়দের খেলা ৷’
‘আমিও বড় হইছি ৷’
‘হি-হি-হি-হি ৷ আরো বড়ো হ ৷ তুই তো মার ইনফরমার ৷’
‘না, আমি আম্মারে কিছু কই না ৷’
‘আমি আম্মারে কিছু কই না ৷ কস ৷ সেদিন যে স্কুল পালিয়ে স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে গিয়েছিলাম, তুই ছাড়া মারে কে লাগিয়েছে ?’
‘আমি না ৷’
‘যা ভাগ, ডোন্ট ডিস্টার্ব ৷ গেট লস্ট ৷’
জায়েদ বুঝতে পারে, এরা শুধু স্মোকগান খেলে না ৷ অন্য কোনো ব্যাপার আছে ৷ জানালার পর্দা তুলে দেখে, হ্যাঁ, স্মোকগানের আড়ালে বেশ চলছে সিগারেট খাওয়া ৷ দাদা একটা করে টান দেয়, আর কাশে ৷
কামাল বলে, ‘তুই তো ফল্স টান দিচ্ছিস ৷ জেনুইন টান দে ৷’
আজাদ বলে, ‘সুয়ের আপঅন, জেনুইন টান দিচ্ছি ৷’
‘নাক দিয়ে স্মোক ছাড় তো!’
আজাদ নাক দিয়ে ধোঁয়া বের করার চেষ্টা করে ৷ কাশি দিতে দিতে তার চোখ দিয়ে পানি এসে যায় ৷
জায়েদ দৌড় ধরে ৷ আম্মাকে এই গুরুত্বপূর্ণ ইনফরমেশনটা জানানো জরুরি ৷ খালাকে আম্মা বলে ডাকে সে ৷ সমস্যা হলো, দাদা সহজেই ধরে ফেলে ইনফরমারটা কে! তা ধরে ফেলুক ৷ দৌড়ে সাফিয়া বেগমের কাছে পেঁৗছে যায় জায়েদ ৷ হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, ‘আম্মা, আম্মা, দেইখা যান ৷’
‘কী ?’
‘আরে চলেন না ওই ঘরে ৷ দাদায় কী করে ?’
‘কী করে ?’
‘সিগারেট খায় ৷’
‘তুই কেমন করে বুঝলি!’
‘আমি দেখছি ৷’
‘আরে ওরা স্মোকগান খেলে ৷ তার ধোঁয়া ৷ যা তো ৷ আমার কাজ আছে ৷’
‘আরে না, আমি নিজ চোখে দেইখা আইলাম ৷ বগা সিগারেট খাইতেছে ৷ আয়েন না ৷’
সাফিয়া বেগম ভাগ্নের হাত ধরে যান ৷ জানালার কাছে যেতেই নাকে পান সিগারেটের গন্ধ ৷ তিনি দরজায় ধাক্কা দেন-’এই, দরজা খোল ৷’
সর্বনাশ ৷ মা এসে গেছে ৷ মুহূর্তে স্থির হয়ে যায় কর্তব্য ৷ তারা লুকিয়ে ফেলে যে যার সিগারেট ৷ তারপর ভেজা বেড়ালের মতো মুখটি করে খোলে দরজা ৷
‘ঘরে ধোঁয়া কিসের ?’ মা বলেন ৷
‘স্মোকগান খেলছি না!’ আজাদ জবাব দেয় ৷
‘গন্ধ কিসের!’
‘স্মোকগানের স্মোকের!’
‘স্মোকগানের স্মোকের মধ্যে কি ওরা তামাক দিয়েছে ?’
মা সিগারেট খোঁজেন ৷ গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে ৷ মনে হয় এখনও ধোঁয়া উঠছে ৷ কিন্তু জিনিসটা ওরা লুকিয়ে রেখেছে কোথায় ? খোঁজ খোঁজ ৷ শেষে পাওয়া যায় এক দুর্গম এলাকায় ৷ হুঁকার নল ধরে যাত্রা শুরু করে অন্তিমে হুঁকার মধ্য থেকে বেরোয় সিগারেট ৷
কিন্তু সেদিনও আজাদের মা মারেননি আজাদকে ৷ কঠিন মহিলা ছিলেন তিনি ৷ খুবই কঠিন ৷ তা সত্ত্বেও নিজের ছেলের গায়ে কোনোদিন হাত তোলেননি সাফিয়া বেগম ৷ বাচ্চাদের মারধর করা তাঁর নীতিবিরুদ্ধ ছিল ৷
কত কথা, কত স্মৃতি ৷ হাতের তালু আবার ঘামতে থাকে জায়েদের ৷ সমস্ত শরীর যেন পুড়ে যাচ্ছে, এত দাহ ৷ আম্মাকে কবরে নামিয়ে রেখে এসে সে যেন আর শান্তি পাচ্ছে না একটুও ৷ মোটরের গ্যারাজের কাজে যাওয়া হয় না তার ইদানীং ৷ কিছুই ভালো লাগে না ৷ শুধুই উত্তাপ! শুধুই উত্তাপ! বারবার মনে হয় একাত্তরের আগস্টের সেই দৃশ্যটা, আজাদ দাদা দরজার চৌকাঠ ধরে দাঁড়িয়ে আছে, মগবাজারের বাড়িতে, ঘরভরা আজাদের খালাতো ভাইবোন, মা তাদের পাতে ভাত তুলে দিচ্ছে, রাত্রিবেলা, ইলেকট্রিসিটির হলুদ আলোয় পুরোটা ঘরের সব কটা মানুষ যেন ভিজছে, কোনো প্রসঙ্গ ছাড়াই আজাদ বলে, ‘মা, তুমি কিন্তু মা আমাকে কোনো দিনও মারো নাই…’
স্মোকগানের ঘটনাটা মনে হয় ফরাশগঞ্জের বাড়ির ৷ তিনতলায় আজাদ দাদার একটা আলাদা ঘর ছিল ৷ সেই ঘরেই ঘটে থাকবে এই ছেলেবেলাকার ছেলেখেলা ৷
ফরিদাবাদে এক চাচার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল আজাদ আর জায়েদরা ৷ আজাদ তখন হয়তো সদ্যতরুণ, আর জায়েদ নিতান্তই বালক ৷ ঠিক কোন সময়ের কথা, এতদিন পরে জায়েদ সেটা হুবহু মনে করতে পারে না ৷ গ্রামে গিয়ে তারা বেরিয়ে পড়ে মাঠে-ঘাটে-প্রান্তরে ৷ পুকুরপাড়, শ্মশানঘাট, বাজে পোড়া জামগাছতলা ৷ একটা শীর্ণ নদীও বয়ে যাচ্ছে গ্রামের একপাশ দিয়ে ৷ আজাদের পায়ে জুতা ৷ জায়েদেরও ৷
নদীতীরে দাঁড়িয়ে আজাদ বলে, ‘দেখবি, আমার জুতার কী রকম পাওয়ার!’ পকেট থেকে দিয়াশলাইয়ের কাঠি বের করে জুতায় ঘষতেই আগুন জ্বলে ওঠে ৷ ঠোঁটের সিগারেটে আগুন ধরিয়ে টানতে থাকে আজাদ ৷ তারপর সিগারেটটা হাতে নিয়ে এক পশলা ধোঁয়া সে ছেড়ে দেয় জায়েদের মুখ বরাবর ৷
জায়েদ বলে, ‘আমারে একটা কাঠি দ্যাও ৷ আমিও পারুম ৷’
‘কী পারবি ?’
‘আমার জুতা থাইকা আগুন জ্বালাইতে!’
‘পারবি না!’
‘পারুম ৷’
‘আরে এটা জ্বালাতে শরীরে পাওয়ার লাগে ৷ তাহলে জুতায় এই পাওয়ার আসে ৷’
‘দ্যাও না দাদা একটা কাঠি ৷’
‘নে ৷’
আজাদ দিয়াশলাইয়ের অনেক কটা কাঠি তুলে দেয় জায়েদের হাতে ৷ জায়েদ নিজের জুতার গায়ে কাঠি ঘষে ৷ আগুন জ্বলে না ৷ কাঠির মুখের বারুদ ক্ষয়ে যায় ৷ কাঠি ভেঙে যায় ৷ একটার পর একটা ৷ না, কাঠি আর জ্বলে না ৷
‘দাদা, ঘটনা কী ? কও দেখি ৷’
‘পাওয়ার রে ৷ পাওয়ার ৷ সিনেমায় দেখিস না ৷ হিরোরা কেমনে পারে ৷ একটা হিরো কয়েকটা ভিলেনকে একাই মেরে ছাতু বানায় ৷ কেমন করে ? শরীরে পাওয়ার থাকে তো তাই ৷ আমার শরীরে সেই রকম পাওয়ার আছে ৷’
নাজ সিনেমা হলের শিক্ষা এসব ৷ মর্নিং শোর ৷
জায়েদের মনে পড়ে, ফরাশগঞ্জের বাসাতেও তো জাহানারা ইমাম আসতেন ৷ রুমী আসত ৷ জামী আসত ৷ প্রথম দিন যেদিন জাহানারা ইমামকে দেখল জায়েদ, সেদিনটার কথা তার খুব মনে আছে ৷ হারানো সুর নামে একটা ছবি দেখতে সে ঢুকেছিল গুলিস্তান হলে ৷ তাতে অভিনয় করেছেন সুচিত্রা সেন ৷ ছবি দেখে কেবল সে ফিরে আসছে ফরাশগঞ্জের বাসায় ৷ হলের মধ্যে অন্ধকার ৷ আবার বৃষ্টির দৃশ্যও ছিল ৷ জায়েদের ধারণা, বাইরেও খুব অন্ধকার নেমে এসেছে আর বৃষ্টি হচ্ছে ৷ মেটিনি শোর ছবি ভাঙলে গ্রীষ্মের এই দিনে সে দেখতে পায় বাইরে এখনও সূর্যের আলো ৷ পুরো ব্যাপারটায় কেমন ধন্দ লাগে তার ৷ আর ছবিটাও বড় আবেগজাগানিয়া ৷ সবটা মিলে একটা ঘোরের মধ্যে ছিল জায়েদ ৷ নবাবপুর রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে দুপাশের রিকশার ঘন্টির আওয়াজ মাথার মধ্যে যেন ঝিঁঝিপোকার ডাকের মতো অবিশ্রান্ত বলে মনে হয় ৷ ফরাশগঞ্জের বাসায় ফেরে সে ৷ কনে-দেখা হলুদ আলো পড়েছে বাড়ির দোতলা তিনতলায় ৷ জায়েদের পুরো ব্যাপারটা অবাস্তব লাগছে ৷ সদর দরজা পেরিয়ে বৈঠকখানায় যেতেই তার চক্ষুস্থির ৷ আরে আরে, হারানো সুর ছবির নায়িকা এখানে বসে আছে কেন ? সে চোখ ডলে ৷ না, সুচিত্রা সেনই তো ৷ সে কলতলায় যায় ৷ চোখ ধোয় ৷ আবার উঁকি দেয় বৈঠকখানায় ৷ না তো, কোনো ভুল নাই ৷ সুচিত্রা সেন তাদের বাসায় ৷ আসা অসম্ভব নয় ৷ এদের বাসায় নানা রকমের বড় বড় মানুষেরা আসে ৷
তখন সে পাশের ঘরে মামা-চাচাদের ফিসফাস শুনতে পায় ৷ সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলের হেড মিস্ট্রেস এসেছেন তাঁর দুই ছেলে নিয়ে ৷ আজাদ দাদার তিনতলার ঘরে যায় জায়েদ ৷ দেখতে পায় হেড মিস্ট্রেসের দুই ছেলেকে ৷ বড়টা রুমী ৷ আজাদ দাদার চেয়ে লম্বায় একটু ছোট ৷ আরেকটা জামী ৷ সে তার (জায়েদের) চেয়ে একটু ছোট হতে পারে ৷
কিছুক্ষণের ভেতরেই তারা ছাদে গিয়ে খেলতে আরম্ভ করে ৷ বাড়ির আরো ছেলেমেয়েরা তাদের সঙ্গে যোগ দেয় ৷
ওপেনটি বায়োস্কোপ,
নাইন টেন তেইশকোপ,
সুলতানা বিবিয়ানা,
সাহেব বাবুর বৈঠকখানা,
মেম বলেছেন যেতে…
পান সুপারি খেতে
আমার নাম রেণুবালা,
গলায় আমার মুক্তার মালা ৷
আজাদ আর রুমী পরস্পরের হাত ধরে তোরণের মতো দাঁড়িয়ে আছে ৷ আজাদ দাদা করে কি, পুরো ছড়াটা বলে না, যেই মেয়েকে পছন্দ হয়, তার গলাতেই মুক্তার মালা না হলেও তার হাতের মালা পরিয়ে দেয় ৷ তখন মেয়েরা ‘হয় নাই, চোট্টামি করছে’ বলে চেঁচাতে থাকে ৷ রুমী বলে, ‘এই আজাদ, বারবার তুমি ছড়াটা ভুলে যাচ্ছ কেন ? নাও, এবার পুরোটা ঠিকমতো বলো ৷’
‘ওপেনটি বায়োস্কোপ
নাইন টেন টুয়েন্টিথ্রি কোপ…’ আজাদ বলতে শুরু করে ৷
‘এই, কী বলো ?’ রুমী বলে, ‘তেইশ কোপ তো ৷’
‘নাইন টেনের পরে টুয়েন্টিথ্রি হওয়া উচিত না ? ইংরেজির সাথে আবার বাংলা আসে কী করে ?’ আজাদ হাসে ৷
কাজী কামালের মনে সেন্ট গ্রেগরি স্কুলের সহপাঠী হিসাবে আজাদের স্মৃতি উদিত হয় কেমন ছাড়া-ছাড়া ভাবে ৷ হয়তো স্মৃতি মাত্রই তাই ৷ আজকে কে বলতে পারবে গতকাল ২৪ ঘন্টায় প্রতিটা মিনিটে সে কী করেছে, কী ভেবেছে ? কী করেছে গত এক বছরে, রোজ ? আজাদের সঙ্গে একই স্কুলে একই সঙ্গে পড়বার স্মৃতির সবই যে নিখাঁদ ভালোবাসা আর বন্ধুত্বের, তাও কিন্তু নয় ৷ আজাদ যে ভয়াবহ বড়লোকের ছেলে ছিল, একেক দিন একেকটা পোশাক পরে আসত, আসত ভীষণ দামি গাড়ি চড়ে, তার পকেটে সব সময় টাকা-পয়সা থাকত, এসব নিয়ে কাজী কামালের ছোটবেলায় একটা অব্যাখ্যাত শ্রেণীহিংসাও হয়তো ছিল ৷ তবুও আজাদকে পছন্দ না করেও তাদের নিম্নমধ্যবিত্ত দলের কোনো উপায় ছিল না ৷ কারণ আজাদ তাদের সিনেমা দেখাত ৷ সিনেমা দেখার একটা প্রবল ঝোঁক ছিল আজাদের ৷ আর বন্ধুদের দেখানোর বেলাতেও তার কোনো কার্পণ্য ছিল না ৷ আজাদের সঙ্গেই সে দেখেছিল মৌলভীবাজারের ভেতরে তাজমহল সিনেমা হলে দি ওল্ডম্যান অ্যান্ড সি ৷ বুড়ো জেলে একটা বিরাটকায় মাছ ধরার জন্যে সংগ্রাম করছে, এই সংগ্রামে সে কিছুতেই হার মানবে না-দেখে ভালোই লেগেছিল কামালের ৷ তখন টিকেটের দাম ছিল কম, মর্নিং শোতে বারো আনা হলেই ডিসিতে ছবি দেখা যেত ৷ কামালরা ছবি দেখলে কোন ক্লাসে দেখত, সেটা বড় ব্যাপার ছিল না ৷ কিন্তু আজাদের কাছে এগুলো অনেক বড় ব্যাপার ছিল ৷ সে কখনও থার্ড ক্লাসে ছবি দেখেওনি, দেখায়ওনি ৷ লায়ন, রূপমহল, মুকুল, মায়া-এসব সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখা চলত ৷ তবে নাজে আসত ভালো ভালো ইংরেজি ছবি ৷
আজাদদের বাসায় যাওয়াটাও একটা আনন্দের ব্যাপার ছিল তার সহপাঠীদের জন্যে ৷ কারণ তার মা খাওয়াতে খুব পছন্দ করতেন ৷ খালাম্মা সেধে সেধে একদম পেটপুরে খাওয়াতেন ৷ নানা পদের খাবার ৷ সেই লোভেও অনেক সময় যাওয়া চলত আজাদদের বাড়িতে ৷ সে ফরাশগঞ্জের বাড়ি হোক, আর নিউ ইস্কাটনের বাড়িই হোক ৷
আজাদ যে পড়াশোনায় খুব ভালো ছিল, তা নয় ৷ তবে খারাপ সে ছিল না ৷ পরীক্ষায় কখনও ফেইল করেনি ৷ আবার ফার্স্ট সেকেন্ডও হয়নি ৷ কিন্তু আশ্চর্য ভালো করেছিল রহমতউল্লা স্যারের ক্লাসে ৷ তিনি নিতেন আজাদদের হাতের লেখা ভালো করার ক্লাস-পেনম্যানশিপ ক্লাস ৷ একটা চার্ট ঝোলানো থাকত এই ক্লাসে, আমেরিকান স্টাইলে বাঁকা বাঁকা হরফে তাতে ইংরেজি বর্ণমালা লেখা ৷ কলম না তুলে তেরছা করে অ থেকে ত পর্যন্ত লিখতে হতো ৷ কোনো অক্ষরের সময়ই কলম তোলা যাবে না ৷ রহমতউল্লা স্যারের নিজের হাতের লেখা ছিল অতি চমৎকার ৷ দেখে মনে হতো সার্টিফিকেটের লেখা নিশ্চয় এই স্যারের কাছ থেকে লিখিয়ে নেওয়া হয় ৷ হাতের লেখার এই ক্লাসে আজাদ খুব ভালো করত ৷ প্রায়ই ভেরি গুড পেত আজাদ, তার কপিতে ৷
আজাদের এই ভালো ইংরেজি লেখাটা শেষ পর্যন্ত কাজে লেগেছিল তার ধরা পড়ার মাত্র দিন সাতেক আগে ৷ সে জর্জ হ্যারিসনের বাংলাদেশ গানটা কপি করে নিয়েছিল নিজের জন্যে, আর তখন রুমী, জুয়েল, কামাল, বদি তাকে অনুরোধ করেছিল তাদেরকেও একটা করে কপি দেওয়ার জন্যে ৷ আজাদ ছবিও ভালো আঁকত ৷ মধু মোল্লা নামের এক আর্টের শিক্ষক তাকে ছবি আঁকা শেখাতে আসতেন বাসায় ৷ তাঁর কাছে শিখে শিখে আজাদ একটা ছোটখাটো আর্টিস্ট হয়ে গিয়েছিল ৷ বিজি চৌধুরী স্যার শুক্রবার স্কুল ছুটির পর আলাদাভাবে বসাতেন ড্রয়িংয়ের ক্লাস ৷ এই ক্লাস করতে চাইলে স্যারের কাছে গিয়ে নাম লেখাতে হতো ৷ আজাদও নাম লিখিয়েছিল ৷ কিন্তু সে ক্লাস করতে চাইত না ৷ বলত, ‘আরে রাখ রাখ, এ সময়টা ক্রিকেট মাঠে না-হলে সিনেমা হলে কাটিয়ে আসাটাই তো বেশি লাভের ব্যাপার ৷’ বিজি চৌধুরী স্যার বছরে দুবার ছবি আঁকার প্রতিযোগিতার আয়োজন করতেন ৷ পুরস্কার থাকত খুবই আকর্ষণীয় ৷ সেই পুরস্কারের লোভে হোক, অথবা নিজের প্রতিভা যাচাই করে নেওয়ার খাতিরে হোক, আজাদ ছবি আঁকা প্রতিযোগিতায় একবার অংশ নিয়েছিল ৷ ওর ছবিটা ভালো হয়েছিল ৷ আর ও পেয়েছিল ৮০-তে ৭৫ ৷ আর প্রতিদ্বন্দ্বী কাশেম পেয়েছিল ৮০-তে ৬০ ৷ কিন্তু স্যার প্রথম পুরস্কার দিলেন কাশেমকে, তার কারণ হিসেবে স্যার বলেছিলেন বাকি ২০ মার্কস হলো উপস্থিতির জন্যে ৷ এতে কাশেম ২০-এ ২০ পেয়েছে ৷ আজাদ পেয়েছে ০ ৷ দ্বিতীয় পুরস্কার পেয়ে আজাদ বেশি খুশি হয়েছিল, কারণ প্রথম পুরস্কারটা ছিল রঙের বাঙ্, আর দ্বিতীয়টা ছিল একটা খেলনা গাড়ি ৷ ও ঠোঁট উল্টে বলেছিল, ‘আরে কালার বঙ্ আমার বহুত আছে ৷’
আজাদের আরেক সহপাঠী কামরান আলী বেগের মনে পড়ে যায়, ক্লাসে সূত্রধর স্যার একদিন জিজ্ঞেস করেছিলেন, এয়ার-বাস কী ? ঢাকা টু ঈশ্বরদী তখন এয়ার-বাস চলতে শুরু করেছে ৷ স্যার এই ব্যাপারটাই বোঝাচ্ছিলেন ৷ আজাদ স্যারের কথা শুনছিল না ৷ সে ব্যস্ত ছিল পাশর্্ববর্তী সহপাঠীর সঙ্গে কাটাকুটি খেলায় ৷ স্যারের নজরে পড়ে যায় সে ৷ স্যার জিজ্ঞেস করেন, ‘আজাদ, ওঠো ৷ কী করছিলে ?’
‘কিছু না স্যার ৷’
‘আমি কী পড়াচ্ছি, শুনছিলে ?’
‘জি স্যার ৷’
‘আচ্ছা বলো তো এয়ার-বাস কী ?’
আজাদ উসখুস করে ৷ ঠিক এই সময় পিয়ন আসে কী একটা নোটিস নিয়ে ৷ স্যার সে-নোটিসটা পড়ে তাতে স্বাক্ষর করে পিয়নকে বিদায় করেন ৷ ইত্যবসরে আজাদ পেছনে বসা বেগকে জিজ্ঞেস করে ফিসফিসিয়ে, ‘এই, এয়ার-বাস কী রে ?’
বেগ বলে, ‘আরে এয়ার-বাস বুঝলি না ? আকাশ দিয়ে বাস ওড়ে ৷ তার দরজায় থাকে কন্ডাক্টর ৷ সে বাসের গায়ে চাপড় মেরে বলে, আইসা পড়েন ডাইরেক্ট সদরঘাট ৷ তার দরজায় ঝোলানো থাকে দড়ির সিঁড়ি ৷ প্যাসেঞ্জাররা সেই সিঁড়ি দিয়ে তাতে উঠে পড়ে ৷’
পিয়নকে বিদায় করে সূত্রধর স্যার আবার গর্জন করে ওঠেন, ‘হ্যাঁ আজাদ, বলো, এয়ার-বাস কী ?’
আজাদ বলতে শুরু করে, ‘আকাশ দিয়া বাস যায় স্যার, দরজায় থাকে দড়ির সিঁড়ি, সেই সিঁড়ি দিয়া প্যাসেঞ্জার উঠিয়া থাকে…’
পুরো ক্লাস হেসে গড়িয়ে পড়ছে ৷ স্যার হাসবেন না কাঁদবেন, বুঝতে পারছেন না ৷ শেষে হাসি চেপে বলেন, ‘দাঁড়িয়ে থাকো ৷ ঘন্টা না বাজা পর্যন্ত বসবে না ৷’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *