মধ্যবিত্তের বৈচিত্র্য
নবযুগের নতুন শহরের ঐতিহাসিক দান হল মধ্যবিত্তশ্রেণি! কলম্বাস, ভাস্কো-ডি-গামা ও অন্যান্য দুঃসাহসী অভিযাত্রীদের ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলে, চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতাব্দীতে, মধ্যযুগের সামাজিক পরিবেশ ধীরে ধীরে আধুনিক যুগে রূপান্তরিত হতে আরম্ভ করেছিল। কিন্তু ঐতিহাসিক পোলার্ড (A. F. Pollard) বলেছেন : They were external and obvious events, there were others less obvious, but no less important. These may almost be summed up in one phrase-the advent of the middle classes.’ বড় বড় ভৌগোলিক, ও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ঐতিহাসিক যুগান্তরে সাহায্য করেছে নিশ্চয়ই, কিন্তু আরও অনেক সামাজিক কারণ আছে যা আপাতদৃষ্টিতে কম গুরুত্বপূর্ণ মনে হলেও, পরিবর্তনকালে প্রভাব বিস্তার করেছে যথেষ্ট। এই কারণগুলিকে এককথায় ‘মধ্যবিত্তশ্রেণির’ আবির্ভাব বলা যায়। পোলার্ড বলেছেন, মধ্যযুগ ও আধুনিকযুগের সন্ধিক্ষণের নবজাগরণ বা ‘রেনেসাঁস’ সম্ভবই হত না, যদি না সমাজের রঙ্গমঞ্চে নতুন মধ্যবিত্তশ্রেণির আবির্ভাব হত। নতুন কলকাতা শহরে এই মধ্যবিত্তশ্রেণির আবির্ভাবের ফলেই বাংলার অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল।
শ্রেণিগতভাবে এই মধ্যবিত্তের সীমানা সমাজের বহুদূর স্তর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘কলিকাতা কমলালয়’ পুস্তকে ‘বিষয়ি ভদ্রলোকের ধারা’ ব্যাখ্যাকালে এই নতুন বাঙালি মধ্যবিত্তের অর্থনৈতিক স্তর নির্ণয়ের চেষ্টা করেছেন। যাঁহার প্রধান প্রধান কর্ম অর্থাৎ দেওয়ানি বা মুচ্ছদ্দিগিরি কর্ম করিয়া থাকেন, তাঁদের তিনি ‘ধনাঢ্য’ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত করেছেন। প্রসঙ্গত তাঁদের দৈনন্দিন জীবন সম্বন্ধে তিনি বলেছেন যে, সকালে গাত্রোত্থান করে মুখ-হাত-পা ধুয়ে, তাঁরা ‘বহুবিধ লোকের’ সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করেন। তারপর যাঁর যে তৈল মর্দন করলে ‘সুখানুভব হয়’ তিনি তাই মর্দন করে স্নানক্রিয়া সমাপন করেন। সমাপনান্তর ‘পূজাহোমদান বলিবৈশ্ব প্রভৃতি কর্ম করিয়া ভোজন করেন।’ ভোজনান্তে কিঞ্চিৎকাল বিশ্রাম করে ‘অপূর্ব পোশাক জামাজোড়া ইত্যাদি পরিধান করিয়া পালকি বা অপূর্ব শকটারোহণে’ কর্মস্থলে গমন করেন। কাজকর্ম শেষ হলে বাড়ি ফিরে পোশাক ছেড়ে, হাতমুখ ধুয়ে গঙ্গোদক স্পর্শে পবিত্র হয়ে সায়ংসন্ধ্যাবন্দনাদি শেষ করেন। অতঃপর কিছু জলযোগ করে পুনরায় বহুবিধ লোকের সঙ্গে হয় সান্ধ্য বৈঠকে বসেন, না হয় স্বজনবন্ধু বা সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বেরিয়ে যান। এই বাঙালি বেনিয়ান মুচ্ছুদ্দিরা আঠার শতকের মধ্যেই কনট্রাকটারি এজেন্সি-দালালি ও স্বাধীন ব্যবসাবাণিজ্য করে অগাধ ধনসঞ্চয় করেছিলেন। কলকাতা শহরের অধিকাংশ প্রাচীন বাঙালি বনেদি পরিবারের পূর্বপুরুষরা এইভাবেই অর্থসঞ্চয় করে সমাজে প্রতিষ্ঠালাভ করেন। ধনিকশ্রেণি বলতে যদি ‘ক্যাপিটালিস্টদের’ বোঝায়, তাহলে এই শ্রেণির বড়লোক বাঙালিদের তা না বলে ‘উচ্চ-মধ্যবিত্ত’ (upper-middle-class) বলাই শ্রেয়। ভবানীচরণ এদের শুধু ‘ধনাঢ্য’ বলেই ছেড়ে দিয়েছেন।
মধ্যবিত্তের যে সংজ্ঞা নির্দেশ করেছেন ভবনীচরণ, তা দেখলে সত্যই অবাক হতে হয়। খাঁটি সমাজবিজ্ঞানীর মতন তিনি বলেছেন : ‘মধ্যবিত্ত লোক অর্থাৎ যাঁহারা ধনাঢ্য নহেন কেবল অন্নযোগে আছেন তাঁহাদিগের প্রায় ঐ রীতি কেবল দান বৈঠকি আলাপের অল্পতা আর পরিশ্রমের বাহুল্য।’ মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রাও কতকটা পূর্বোক্ত ধনাঢ্যদের মতন। পার্থক্যের মধ্যে এই যে তাঁরা কেবল অন্নযোগে আছেন, বেনিয়ানবাবুদের মতন দানধ্যানের বা বৈঠকি আলাপের বিলাসিতা নেই, কারণ অর্থ উপার্জনের জন্য তাঁদের সকলকেই কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। ভবানীচরণ আরও একটু বিশদ ব্যাখ্যা করে বলেছেন : ‘দরিদ্র অথচ ভদ্রলোক তাহাদিগের অনেকের ঐ ধারা কেবল আহার ও দানাদি কর্মের লাঘব আছে আর শ্রমবিষয়ে প্রাবল্য বড়, কারণ কেহ মুহুরি কেহ মেট কেহবা বাজার-সরকার ইত্যাদি কর্ম করিয়া থাকেন বিস্তর পথ হাঁটিতে হয়, পরে প্রায় প্রতিদিন রাত্রে গিয়া দেওয়ানজির নিকট আজ্ঞা যে আজ্ঞা মহাশয় মহাশয় করিতে হয়, না করিলেও নয়, পোড়া উদরের জ্বালা।’ এ ব্যাখ্যাটি আরও বিজ্ঞান-সম্মত। ‘দ্ররিদ্র অথচ ভদ্রলোক’, এর চেয়ে সঠিক সংজ্ঞা মধ্যবিত্ত সম্বন্ধে আজও কেউ দিতে পারেনি। মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকের আর্থিক সংগ্রামের কঠোরতার কথা ভবানীচরণ বারংবার উল্লেখ করেছেন। দু-বেলা দু-মুঠো অন্নের জন্য, এবং বাইরের ভদ্রতার সামান্য আবরণটুকু রক্ষা করার জন্য, তাঁদের যে কতখানি দাসত্বের অপমান সহ্য করতে হয়, সেকথাও তিনি উল্লেখ করেছেন। বিস্তৃর পথ পায়ে হেঁটে গিয়ে তাঁদের প্রতিদিন কাজ করতে হয়। কেউ বাজার সরকার, কেউ মুহুরি, কেউ কেরানি, কেউ বা ছোট দোকানদার। তখন শহরে যাতায়াতের জন্য ট্রাম-বাস ছিল না, সাধারণ লোকের জন্য ছ্যাকরাগাড়ি ও পালকি ছিল। কয়েকজন মিলে শেয়ারে ছ্যাকরা ভাড়া করে তখন যাঁরা অফিস আদালতে যাতায়াত করতেন তাঁরা অবস্থাপন্ন মধ্যবিত্ত ও ছোটখাট অফিসারশ্রেণির লোক। দরিদ্রের জন্য ছিল পালকি। কিন্তু পালকির ভাড়া মাইলপিছু এক আনা হলেও, ‘দরিদ্র অথচ ভদ্রলোকদের’ পক্ষে কর্মস্থলে যাতায়াতের জন্য তা ব্যবহার করা সম্ভব হত না। অগত্যা পায়ে হেঁটেই তাঁদের শহরের মধ্যে বিস্তর পথ চলতে হত। কাজের শেষেও কেরানি মুহুরিদের নিস্তার ছিল না। প্রতিদিন রাত্রে গিয়ে মনিবের কাছে তাঁদের ‘আজ্ঞে যে আজ্ঞে, মশায়’ করতে হত।
আমরা এই সাধারণ মধ্যবিত্তের দু-একটা ‘টাইপ’ সম্বন্ধে দু-চার কথা বলব-সেদিনের বাজারসরকার, সদাগরি অফিসের কেরানি ও শহরের হাটবাজারের ছোট দোকানদারের কথা। বাঙালি মধ্যবিত্তের বিপুল অংশ এই ‘দরিদ্র অথচ ভদ্রলোকদের, নিয়ে গঠিত। ঐতিহাসিক পোলার্ড রেনেসাঁসের অগ্রদূত হিসেবে যে নতুন শহুরে মধ্যবিত্তের কথা বলেছেন, এই নিম্নবিত্ত ভদ্রলোকেরা তার সুবিস্তৃত ভিত্তিভূমি। কথিত রেনাসাঁস আন্দোলনের পুরোভাগে স্বনামধন্য নেতারূপে হয়ত তাঁরা কেউ দাঁড়াবার সুযোগ পাননি। তখনকার সমাজে প্রভাব-প্রতিপত্তিও তাঁদের বিশেষ কিছু ছিল না, কারণ সামাজিক মর্যাদার দু-টি নতুন মানদণ্ড, বিত্ত ও বিদ্যা, কোনোটাই তাঁরা সুযোগ অভাবে ভাল করে আয়ত্ত করতেপারেননি।
তাঁদের জীবনযাত্রার মধ্যে কোনো রোমান্স নেই, বিস্ময়কর ও আজগুবি উত্থান-পতনও নেই। সাধারণ একজন মুন্সী থেকে কেউ মহারাজ বা বড় তালুকদার হননি, মুদির ব্যবসা থেকে বিরাট জমিদারী তদারক করতে আরম্ভ করেননি; গোমস্তাগিরি ও দালালি করতে করতে কেউ লক্ষপতি হবারও সুযোগ পাননি। তাই তাঁদের জীবনের কাহিনির মধ্যে কোনো রঙের বাহার ও বৈচিত্র্য নেই, চমকিত করার মতন কোনো ঘটনার সমাবেশ নেই। তারা হলেন অকৃত্রিম কেরানীবাবু, সরকারবাবু, মুহুরিবাবু এবং নানারকমের পণ্যদ্রব্যের দোকানদার ও ব্যবসায়ী। ‘যে আজ্ঞা’ বা ‘মশাই, মশাই’ হয়ত তাঁরা এদেশি দেওয়ানজিদের কাছে করেছেন, সাহেবদের কাছে করতেও কুণ্ঠিত হননি। দাসত্বের এই গ্লানিটুকু ভদ্রতা ও জীবনধারণের জন্য তাঁদের সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁরা নিঃসন্দেহে গর্ব করতে পারেন এই বলে যে, ধনিক বাঙালি দেওয়ান-বেনিয়ানদের মতন তাঁরা অন্তত সাহেবদের কাছে নির্লজ্জ গোলামি করতে পারেননি। তাঁদের দাসত্বের ভাবভঙ্গিমার মধ্যে দারিদ্র্যের গ্লানিই প্রকাশ পেত বেশি, ধনিকদের মতন কেনাগোলামের কলঙ্ক প্রকাশ পেত না।
সরকারবাবু। এই দরিদ্র বাঙালি ভদ্রলোকদের ভিতর থেকে যে-ভদ্রলোকের তীক্ষ্নবুদ্ধিদীপ্ত অথচ করুণ ক্যাবলার মতন মুখখানি চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তিনি হলেন আমাদের সুপরিচিত সরকারবাবু। আমাদের দেশের সামাজিক ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথের ‘পুরাতন ভৃত্য’ কেষ্টার চেয়ে তিনি আরও অনেক বেশি পুরাতন। অথবা ইতিহাসের যে-কোনো অতীত পর্বে কেষ্টার অদ্ভ্যুদয় হোক না কেন, দেখা যাবে ‘সরকারবাবু’ তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন। জানি না, সারা পৃথিবীর সকল জাতের ভদ্রলোকদের মধ্যে আমাদের বাংলাদেশের সরকারবাবুর মতন এমন নিরীহ গোবেচারী শান্তশিষ্ট ভদ্রলোক আর কেউ কোথাও আছেন কী না! ডাক দিলেই হয়ত তিনি কেষ্টার মতন ‘হুঁকাটি বাড়ায়ে’ মনিবের কাছে হাজির হন না, কিন্তু তাঁর ক্যাশবাক্স ও জমাখরচের খাতাটি বগলে করে চোখের নিমেষে সামনে এসে উপস্থিত হন, এবং করজোড়ে ‘হুজুর’, ‘হুজুর’ করতে আরম্ভ করেন। সেদিনের কলকাতায় সাহেবদের বাড়ি এবং বাঙালি বড়লোকদের বাড়ি তার চাকরি বাঁধা ছিল। বড়বাবুদের খানসামা বা সর্দারবেয়ারা না হলে যেমন চলত না, তেমনি ‘সরকারবাবু’ না হলে কলকাতার মতন শহরে তাঁদের জীবনের রথ অচল হয়ে যেত। ‘আই হ্যাভ দি অনর টু বি স্যার’ বলে চাকুরির জন্য তাদের দরখাস্ত করতে হত না। ‘ত্রিভুবনের অধীশ্বর, দোর্দণ্ডপ্রতাপ ধর্মাবতার’ বলে বাংলায় দরখাস্ত লিখে নিয়ে গেলেই সাহেব বিলক্ষণ বুঝতে পারতেন, বাঙালি দেওয়ানজি-বেনিয়ানজিরা তো পারতেনই। ইংরেজি ভাষার দিক থেকে ডজন দুই শব্দের স্টক থাকলেই তাঁদের কাজ চলে যেত। বড় বড় দেওয়ান ও বেনিয়ানরা যদি ঐটুকু ইংরেজি বিদ্যা নিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন করে থাকেন, তাহলে সরকার মশায়ের পক্ষে কাজ চালাতে না পারার কোন কারণ ছিল না। এমা রবার্ট (Emma Roberts) লিখেছেন :
The circars, who may be styled agents of all descriptions are for the most part tolerably well acquainted with the English language; but these men are notorious for their knavery : they live by encouraging the extravagance of their employers, and the ruin of more than half of the Company’s servants may be traced to the facilities thrown in their way by the supple circar, who, in his pretended zeal for ‘master’ has obtained for him money on credit to any amount.
‘সরকারের’ ইংরেজিবিদ্যা সম্বন্ধেই এমা প্রশংসাই করেছেন বলা চলে। কিন্তু অন্যান্য গুণের কথা যা বলেছেন আদৌ প্রশংসনীয় নয়। সরকারের ধূর্তামির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন যে মনিবদের ব্যয়-বিলাসিতার ইন্ধন যোগানোই তাঁদের প্রধান কাজ। কোম্পানির প্রায় অর্ধেক কর্মচারী সরকারের কৃপায় উচ্ছন্নে গেছেন বলা চলে। এমনিতেই কলকাতা শহরে খরচপত্রের দিক থেকে তাঁরা বেহিসেবি ছিলেন, তার উপর সরকার মশায় তাদের পদে পদে খরচবৃদ্ধির জন্য উস্কানি দিতেন। টাকার অভাব হলে তাঁরা মহাজনদের কাছ থেকে টাকা ধার করে এনে দিতেন। অর্থাৎ এদেশের চার্বাকদর্শন, ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ, বিদেশি সাহেবরা আমাদের সরকার মশায়দের কাছ থেকে বেশ ভালোভাবেই শিক্ষা করেছিলেন। কোম্পানির কর্মচারীরা ঋণের ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছিলেন সরকারের উৎসাহে। কিন্তু প্রশ্ন হল, সরকার মশায় এত উৎসাহ দিতেন কেন? মনিবের খরচ বাড়িয়ে তাঁর লাভ কী?
শ্রীমতী এমা ‘সরকারের’ চরিত্রের কঠোর সমালোচনা করে অবশেষে বোধহয় একটু নারী সুলভ করুণা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, সরকার একটি ‘necessary evil’ হলেও তাকে ‘ঠিক ‘Rogue’ বলা যায় না-It would be unjust and ungrateful to withhold the praise honestly earned by many of these men, who have shewn the utmost gratitude and fidelity to employers from whom their gains have been exceedingly trifling, consisting merely of a small percentage upon the articles supplied…’ সরকার মশায়ের লাভের ও স্বার্থের ইঙ্গিত পাওয়া যায় এর মধ্যে। সেই লাভ হল, জিনিসপত্তর কেনাকাটার সময় শতকরা সামান্য কিছু দস্তুরি। এই দস্তুরিই সরকারের প্রধান আয়, কারণ বেতন তাঁর খুব সামান্য। কিন্তু এমার মতে, সরকারের অগাধ প্রভুভক্তি ও আন্তরিকতার সঙ্গে তুলনা করলে এই দস্তুরির লোভ বা স্বার্থ উপেক্ষণীয় বলে মনে হয়। তিনি বলতে চান, আর্থিক স্বার্থের তুলনায় সরকারের চারিত্রিক নিষ্ঠা অনেক বেশি। সুতরাং তাঁকে ঠিক দুষ্টপ্রকৃতির লোক বলা যায় না।
ফ্যানি পার্কস (Fanny Parks) কিন্তু সরকারের দস্তুরি ও লাভ সম্বন্ধে অন্যকথা বলেছেন। তিনি লিখেছেন : ‘A very useful but expensive person in an establishment is a sircar,….’ সরকার খুবই প্রয়োজনীয় কিন্তু অত্যন্ত ব্যয়-সাপেক্ষ কর্মচারী। প্রতিদিন সকালবেলা সরকার মশায় বাজারের কেনাকাটার ফর্দ নিয়ে উপস্থিত হন এবং মনিবকে দিয়ে তা অনুমোদন করিয়ে নেন। তারপর তিনি বাজারে গিয়ে সেগুলির কেনাকাটা করেন। সংসারের সামান্য জিনিসপত্র থেকে আরম্ভ করে ফার্নিচার, বই, পোষাকপরিচ্ছদ সব কেনার ভার তাঁর উপরেই থাকে, এবং দেশি-বিদেশি কোন দোকান থেকে কি দামে কিনলে সুবিধা হয় তা তিনিই ঠিক করেন। দস্তুরি সম্বন্ধে ফ্যানি বলেছেন, ‘his profit is a heavy percentage on all he purchases for the family, two annas in the rupee dustooric’ টাকায় দু-আনা দস্তুরি কম নয়। সেইজন্য শ্রীমতী ফ্যানি সরকার মশায়ের লাভ বেশ মোটা রকমের বলে উল্লেখ করেছেন।
এইবার মনিবের খরচ বাড়িয়ে সরকারের লাভ কি, তা বেশ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। লাভ হল দস্তুরি। মনিবের খরচ যত বাড়ত, তত তাঁর দস্তুরি বাড়ত, কারণ অধিকাংশ খরচেরই এজেণ্ট ছিলেন তিনি। ঘরের মালিক ও বাইরে দোকানপাটের মালিকদের মধ্যে অর্থনৈতিক ‘টানেল’ বা নানাস্বরূপ ছিলেন সরকারবাবু। তাঁর হাত দিয়ে বন্যার বেগে মনিবের টাকা বয়ে যেত বাজারে, এবং তিনি কেবল তার তলানিটুকু ভোগ করেই খুশি হতেন। সাহেব পাল্কি চড়তে চাইলে তিনি হয়ত ভাল টমটমে চড়ার লোভ দেখাতেন, কারণ যে-সব কোম্পানি গাড়ি ভাড়া দিত তাদের সঙ্গে তাঁর কমিশনের বন্দোবস্ত থাকত। সাহেবের পোশাক-পরিচ্ছদ, ফ্যাশান, স্টাইল ইত্যাদির তিনিই ছিলেন উপদেষ্টা। স্টাইলের দিক থেকে মনে হয় সাহেব-মনিবদের চেয়ে সরকারবাবুদের অনেক বেশি জ্ঞান ছিল, কারণ স্টাইল-প্রবর্তক বড় বড় টেলারদেরও তাঁরা এজেণ্ট ছিলেন। সাহেবকে নতুন স্টাইলের পোশাক ধরাতে পারলে সরকার বেশ দু’পয়সা দস্তুরি পেতেন পোশাক-ব্যবসায়ীর কাছ থেকে। সাহেবকে থিয়েটার দেখিয়ে হয়ত তিনি থিয়েটার মালিকের কাছ থেকে টিকিটের কমিশন আদায় করতেন। স্পেন্সেসের মতন হোটেল অথবা কোনো ভাল ট্যাভার্নে সাহেবকে ভুলিয়েভালিয়ে দু’একবার নিয়ে যেতে পারলেও, সরকার মশায় দু’পয়সা মালিকদের কাছ থেকে দালালি পেতেন, এইরকম নতুন স্টাইলের জুতো, নতুন নতুন ফার্নিচার, বই, ঘোড়া গাড়ি ইত্যাদি যে-কোনো ভোগ্য-দ্রব্যের প্রতি সাহেবকে নিত্য-নতুন আসক্তি জাগাতে পারলে, সরকারই লাভবান হতেন। মনিবের consumption pattern উন্নত করাই সরকারের অন্যতম লক্ষ্য ছিল। এই কারণেই কোম্পানির প্রায় অর্ধেক কর্মচারী আমাদের বাঙালি সরকারবাবুর কৃপায় ব্যয়বাহুল্যের জন্য একেবারে উচ্ছন্নে গিয়েছিলেন। শ্রীমতী এমা এবিষয়ে অত্যুক্তি করেছেন বলে মনে হয় না।
নতুন শহরে সাধারণ বাঙালি মধ্যবিত্তের মধ্যে সরকার মশায়ের এই চিত্রটি করুণ ও উপভোগ্য হলেও অনেক কারণে স্মরণীয়। দালালি-বৃত্তিটিকে সরকার মশায় এমন একটি স্তর পর্যন্ত টেনে নামিয়েছিলেন যে, তার ঐন্দ্রজালিক মোহ আজও যেন আমাদের অস্থিমজ্জায় ঢুকে রয়েছে মনে হয়। দেওয়ান-বেনিয়ান-মুচ্ছুদ্দি থেকে সরকার ও খানসামা পর্যন্ত সকলেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দালালিই করেছেন কিন্তু তারা ছিলেন অতি উচ্চ ও অতি নিম্নশ্রেণির দালাল। সরকার মশায় ছিলেন যথার্থ সাধারণ মধ্যশ্রেণির বুদ্ধিমান অথচ নিষ্ঠাবান দালাল। তাই দালালি করেও তার দারিদ্র্য শেষ পর্যন্ত ঘোচেনি। নিম্ন ও সাধারণ স্তর থেকে দালালির দৌলতে অনেক ভাগ্যবান লোক উচ্চবিত্তের চূড়ায় উঠেছেন। কিন্তু হতভাগ্য সরকার মশায়, ফ্যানির ভাষায় ‘heavy percentage’ দস্তুরি পাওয়া সত্ত্বেও, সমাজের সাধারণ ‘দরিদ্র অথচ ভদ্রলোকের’ স্তর অতিক্রম করতে পারেন নি। তার কৃতিত্ব হল অমিতব্যয়ের ইন্ধন যুগিয়ে, তিনি কিছু সাহেব ও এদেশি বড়লোক মনিবের সর্বনাশের পথ সুগম করেছেন।
কেরানিবাবু। কেরানিবাবু ঠিক একটি বড় চাকুরিজীবীগোষ্ঠী হিসাবে কোনো ঐতিহাসিক বিবরণের মধ্যে পাওয়া যায় না। অথচ সরকারি ও বেসরকারি সদাগরি অফিসের কেরানির সংখ্যা উনিশ শতকের গোড়া থেকেই কলকাতা শহরে ক্রমে বাড়তে আরম্ভ করেছিল মনে হয়। কোম্পানির আমলের সাহেব কেরানিদের যেমন ‘writer’ বলা হোত, এদেশের কেরানিরাও তেমনি দীর্ঘকাল ঐ নামে পরিচিত ছিলেন। কেবল ‘রাইটার’ কথার আগে ‘নেটিব’ কথটি যোগ করে দেশি কেরানিদের বলা হত ‘নেটিব রাইটার’ চাকরির ক্ষেত্রভেদে তখন কেরানিবাবুদের মধ্যে মর্যাদার পার্থক্যবোধ বেশ প্রখর ছিল। হয়ত এই বোধ এখনও তাঁদের মধ্যে আছে, কি থাকলেও তা অবচেতনার স্তরে আছে, এবং তার প্রখরতা তেমন নেই। একশো-দেড়শো বৎসর আগে তো ছিলই, পঞ্চাশ বছর আগে যথেষ্ট ছিল। কোম্পানির কেরানিরা নিশ্চয়ই নিজেদের পদমর্যাদার দিক থেকে একটি স্বতন্ত্র গোষ্ঠী বলে মনে করতেন। নেটিব রাইটারদের মধ্যে স্বভাবতঃই তাঁরা ছিলেন সর্বোচ্চ স্তরের। তারপরেই ছিলেন কলকাতার বড় বড় সদাগরি অফিসের কেরানিরা, বিশেষ করে বিদেশি ‘হৌসে’র কেরানিরা (Agency Houses)। অনেক সময় দেখা যেত, কোম্পানির কেরানিদের চেয়ে বিদেশি হৌসের কেরানিদের মর্যাদাবোধ বেশি। ককারেলের কেরানি, পামারের কেরানি, ব্যাজেট-কলভিনের কেরানি, টুলোর কেরানি, র্যালি ব্রাদার্সের কেরানি-এঁরা অনেক বেশি গর্বের সঙ্গে মাথা উঁচু করে চলতেন, অন্যান্য কেরানিদের তো দূরের কথা, কোম্পানির কেরানিদেরই বিশেষ আমল দিতেন না।
কলকাতা শহরে একশো বছর আগেও অন্যান্য সকলশ্রেণির চাকরিজীবীদের মধ্যে বাঙালি কেরানিদের সংখ্যই ছিল সবচেয়ে বেশি। ১৮৪০-এর দিকে ‘গ্রিফিন’ লিখেছেন : The native writers are a numerous class and always form the majority in mercantile officers. বিদেশি সদাগরি অফিসের কেরানিরা যদি সেদিনকার চাকুরে সমাজে বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে চলে থাকেন, তাহলে বোধহয় খুব অন্যায় করেননি। কোম্পানির কেরানিকুঠির (Writers Building) চেয়ে ককারেল, পামার, টুলো প্রভৃতি সদাগরি অফিসের ভিতর ও বাহিরের চেহারা অনেক বেশি জমকাল ছিল, ঘরের আসবাবপত্র ও কর্মচারীদের কাজকর্মের সুযোগ-সুবিধাও ছিল যথেষ্ট। গ্রিফিন লিখেছেন, কোনো কোনো সওদাগরি আফিসের ‘showy exteriors’ দেখলে রীতিমত তাক লেগে যেত। আফিসের ভিতরে সবচেয়ে বড় ও সুসজ্জিত হলঘরটিতে সাহেব-মালিক নিজে বসতেন। গ্রিফিন এটিকে ‘sanctum sanctorum of the merchant’ বলেছেন। তার পেছনে বিশেষ একটি ঘেরা-বারান্দা থাকত, যেখানে তিনি ও তাঁর বিদেশি সরকর্মীরা মধ্যে মধ্যে পথচারী করতে করতে ব্যবসাবাণিজ্য সম্বন্ধে আলাপ-পরামর্শ করতেন। গ্রীষ্মকালে মাথার উপর সর্বক্ষণের জন্য লম্বা লম্বা টানা পাখা চলত। চারিদিকে উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা থাকত আফিস, দেখে মনে হত ছোটখাট একটি দুর্গ।
এদেশি কেরানিদের বসবার ঘর ছিল আলাদা। সেই ঘরে আটজন থেকে বারজন বাঙালি কেরানি কাজ করতেন। অনেকে মেঝের উপর আসন পেতে বসতেন, এবং হাঁটুর উপর, অথবা সামনের একটি বাক্সের উপর খাতা রেখে লিখতেন। কেউ কেউ অবশ্য চেয়ারে বসে ডেস্কেও লিখতেন। বাঙালি কেরানিদের বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই লিখতে হত। তাঁদের মাসিক বেতন ছিল ৪ টাকা থেকে ১০ টাকা। অন্য একটি ঘরে পাঁচ-ছজন ফিরিঙ্গি কেরানি কাজ করতেন। তাঁদের বেতন ছিল ৬০ টাকা থেকে ১০০ টাকা। আরও জন বারো বাঙালি কেরানি ছিলেন যাঁরা একটু বেশি বেতন পেতেন, ৮ টাকা থেকে ২০ টাকা। দোতালার ঘরে সাহেবের পার্টনারদের এবং সাহেব কেরানিদের কাজ করবার ঘর থাকত। বাঙালি কেরানির সাদা কাপড় সুন্দর কাছাকোচা দিয়ে পরে, তার উপরে একটি ফতুয়ার মতন সাদা বেনিয়ান গায়ে দিয়ে আফিসে আসতেন-‘white muslim, flowing and graceful’ পার্ট-করা সুন্দর সাদা কাপড়কে মসলিন ভেবেছেন, এবং ‘flowing’, বলেছেন লম্বা কাছা-কোচাকে। বাঙালি কেরানিদের পোষাক ‘tasteful’, যা রুচিসম্পন্ন হলেও, তাঁরা ‘very slow in writing and they will not be pushed’ বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
একটি বিখ্যাত সদাগরি আফিসের কেরানিদের এই বিবরণ থেকে, আজ থেকে প্রায় একশো বৎসর আগে, মোটামুটি তাঁদের অবস্থা কি রকম ছিল, তা খানিকটা বোঝা যায়। মনে হয়, কেরানিগিরি চাকরির (বাঙালিদের) অন্তত দু’টি স্তর ছিল, আজকালকার ‘লোয়ার’ ও ‘আপার’ গ্রেডের মতন। যাঁরা লোয়ার গ্রেডের কেরানি ছিলেন তাঁরা বোধহয় ইংরেজি জানতেন না, এবং বাংলাতেই খাতাপত্র লেখার কাজ করতেন। তাঁদের বেতন ছিল মাসিক চার টাকা থেকে দশ টাকা। যাঁরা ‘আপার’ গ্রেডের কেরানি ছিলেন তাঁরা বোধ হয় কিছু ইংরেজি লেখাপড়া জানতেন, সাহেবের সঙ্গে দু’চারটি কথাও বলতে পারতেন, এবং ইংরেজি লেখার কাজ করতেন। তাঁদের মাসিক বেতন ছিল ৮ টাকা থেকে ২০ টাকা।
গ্রিফিনের বর্ণনা থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, ফিরিঙ্গি কেরানিদের মর্যাদা বাঙালিদের চেয়ে অনেক বেশি ছিল, এবং তাঁদের ‘স্টেটাস’ মাসিক বেতনেই বিলক্ষণ প্রতিফলিত হত। ‘আপার’ গ্রেড বাঙালি কেরানিদের চেয়ে তাঁরা চারপাঁচগুণ বেশি বেতন পেতেন, ৬০ টাকা থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত তাঁদের বেতন ছিল। বাঙালির সঙ্গে ফিরিঙ্গির এত পার্থক্য থাকলে, অবিমিশ্র সাহেব কেরানিদের সঙ্গে তাঁদের যে কি ভয়ঙ্কর ব্যবধান ছিল তা ভাবা যায় না। কেরানি জগতে ইংরেজরা first, ফিরিঙ্গিরা second, এবং বাঙালিরা third ছিলেন। তা থাকলেও, কাজের প্রতি তাঁদের কোনো বৈরাগ্য বা শৈথিল্য ছিল না। চাকরিক্ষেত্রে বাঙালি কেরানিরা তখন ছিলেন সততা ও নিষ্ঠার প্রতিমূর্তি। বড় বড় সদাগরি হৌস ও নিলামহৌসে সরকারের ও কেশিয়ারের চাকরি বাঙালিদের জন্য বরাদ্দ থাকত, কোনো টাঁসফিরিঙ্গি বা ইংরেজও সেই পদে নিযুক্ত হতেন না। বড় বড় বিদেশি নিলামহৌসগুলি তখন দর্শনীয় বস্তু ছিল। মুর কোম্পানি, বা হিকি অ্যাণ্ড কোম্পানি প্রভৃতির নিলামঘর দেখতে লোকের ভিড় জমত। সবার উপরে বসতেন ‘অকশনয়ার’ এবং তার একপাশে বসতেন ‘রিপিটার’, অর্থাৎ যিনি নিলামের ডাক আবৃত্তি করতেন। সাধারণত পর্তুগিজ খ্রীষ্টান বা ফিরিঙ্গিদেরই এই চাকরি দেওয়া হত। আর-একপাশে বসতেন বাঙালি সরকারবাবু, নিলামের খাতাপত্রের সর্বময় মালিক। তাঁর পাশে বসতেন একনিবিষ্টচিত্ত বাঙালি কেশিয়ারবাবু, নিলামের সমস্ত টাকাপয়সার বিশ্বস্ত প্রহরি। সুতরাং বাঙালি কেরানিদের যে কোনো মর্যাদাই ছিল না সাহেবদের কাছে, তা নয়। মর্যাদা তাঁদের ছিল, এবং বিশ্বাসভাজনও তাঁরা ছিলেন, কিন্তু তাঁদের একমাত্র অপরাধ ছিল এই যে তাঁরা ‘ব্লাক নেটিব’ হয়ে জন্মেছিলেন। তখনও সভ্য মানুষের সমাজে চামড়ার সাদা-কালো-হলদে রঙের বৈষম্যবোধ অত্যন্ত তীব্র ছিল। নব্যসভ্যতার অগ্রদূত ইউরোপীয়দের মধ্যে এই বোধ যতটা তীব্র ছিল ততটা বোধহয় আর কোনো জাতের মধ্যে ছিল না। হতভাগ্য বাঙালি কেরানিরা গাত্রবর্ণের ট্রপিকাল কৃষ্ণতার জন্য সেদিনের শহুরে সমাজে মর্যাদা ও বেতন দুইই কম পেয়েছেন, যোগ্যতার অভাবের জন্য নয়। তবু সেদিনের ৪-১০ টাকা ও ৮-২০ টাকা গ্রেডের বাঙালি কেরানিরা সমাজে যে আর্থিক প্রতিষ্ঠালাভ করেছেন, এবং যে রকম দাপট দেখিয়ে গেছেন, আজকের ‘অপার’ তো দূরের কথা, কোনো ‘সুপার’ গ্রেডের কেরানিও তা কল্পনা করতে পারেন না।
মুহুরি ও বুববুলিয়া। বুলবুলি পাখির কথা শোনা গেছে, কিন্তু এমন কোনো বৃত্তিজীবী লোকের কথা শোনা যায়নি কখনও, যাঁরা ‘বুববুলিয়া’ নামে লোকসমাজে পরিচিত। উনিশ শতকের প্রথম পর্বে C. M. নামে জনৈক অ্যাটর্নি বাঙালী মুহুরিদের কথা তো বলেছেনই, বুববুলিয়াদের কথাও বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। তার কথা দিয়েই আরম্ভ করছি :
Be it known, that in almost all the Attornies’ offices there are retained,–a Banian, a Sircar, a Head writer,–their numerous attendants–a seat also of the their dependant apprentices (who write or pretend to write without salaries)–and, to close the pack, the Bringers of business the lawbrokers, the Bubbulias, (or promoters of domestic broils)…” Observations etc, upon the Present State of the Practice in the Supreme Court of Judicature of Fort William in Bengal, Calcutta 1825.
অ্যাটর্নি সাহেব ‘who write or pretend to write’ বলে যাঁদের কথা বলতে চেয়েছেন, তাঁরাই হলেন বাঙালি মুহুরি এবং ‘without salaries’ কথাটি দেখে আরও পরিষ্কার তা বোঝা যায়। আদালতের মুহুরিরা বেতন পান না, বেতন চান না, কারণ বেতন তাঁদের প্রয়োজন হয় না। তাঁরা আরজি-দলিল-পত্রাদি নির্দিষ্ট ফি নিয়ে লেখেন, এবং তা থেকে যা তাঁদের আয় হত তাতে মোটামুটি বেশ চলে যায়। এই মুহুরিদের সকলেই বিশেষভাবে চেনেন। তাঁরা শতবর্ষ আগেও যা ছিলেন আজও ঠিক তাই আছেন, এমনকী চেহারায়, পোশাকে ও হাবভাবে পর্যন্ত। তারপর সমাজের উপর দিয়ে অনেক পরিবর্তনের স্রোত বয়ে গেছে, কিন্তু মুহুরিদের কোনো পরিবর্তন হয়নি। একমাত্র ভবিষ্যতের সমাজে যখন রাষ্ট্র উঠে যাবে, এবং তার সঙ্গে আইন-আদালতও উঠে যাবে, তখনই কেবল মুহুরিদের change নয়, mutation সম্ভব হবে।
মুহুরিদের নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই, কিন্তু ‘বুববুলিয়ারা’ কারা? ‘promoters of domestic broils’-খুব সাংঘাতিক বিশেষণ হলেও আটর্নি সাহেব বুববুলিয়াদের তাই বলেছেন। তাঁরা মামলা মোকদ্দমার দালাল, অ্যাটর্নিদের মামলা জুটিয়ে দিয়ে কমিশন পান। কিন্তু আদালতে বসে যদি তাঁরা ক্লায়েণ্টদের ফাঁদে ফেলবার চেষ্টা করতেন, তাহলে ভাবনার থাকত না কিছু। ক্লায়েণ্ট ও অ্যাটর্নি, বা উকিল-অ্যাডভোকেট, উভয়পক্ষের কাছ থেকে তাঁরা দালালি পেলেও কারও কিছু অভিযোগ করবার ছিল না। কিন্তু এই বুববুলিয়ারা কেবল ওঁৎ পেতে আদালতের উন্মুক্ত বটতলায় বসে থাকতেন না। বাড়ি বাড়ি ঘুরে তাঁরা মামলা বাধাবার চেষ্টা করতেন। নিশ্চয় দরিদ্র বা মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকদের বাড়ি তাঁরা ঘুরে বেড়াতেন না অথবা চোর-ডাকাত খুনিদেরও পশ্চাদ্ধাবন করতেন না। কারণ তাতে আর ক’পয়সা কমিশন পাওয়া যায়। অতএব তাঁরা ঘুরে বেড়াতেন কলকাতা শহরের বড় বড় ধনিক পরিবারে, লাহা-মল্লিক-শেঠ-বসাক ও অন্যান্য রাজা মহারাজার বাড়ি বাড়ি। বনেদি পরিবারের বংশধরদের তাঁরা উস্কানি দিতেন বিষয়সম্পত্তি নিয়ে মামলা করতে। অগ্রজ অনুজের প্রতি কিরকম অন্যায় করছে, পিতৃব্য ভ্রাতুস্পুত্রের সম্পত্তি কেমন করে ভোগদখল করেছেন, এই ধরনের সব উস্কানি দিয়ে বুববুলিয়ারা প্রচণ্ড গৃহবিবাদের সৃষ্টি করতেন। কলকতার অনেক বনেদি বাঙালি পরিবারের বিশাল যৌথসম্পত্তি ও প্রচুর ধনদৌলত তাঁদের প্ররোচনাতেই ধ্বংস হয়ে গেছে। সম্পত্তি গেছে টুকরো টুকরো হয়ে, আর চরম উচ্ছৃঙ্খল বিলাসিতার পরেও টাকাকড়ি যা মজুত ছিল, তা দীর্ঘস্থায়ী মামলা-মোকদ্দমার সুযোগে অ্যাটর্নি, উকিল ও দালাল বুববুলিয়ারা লুটেপুটে খেয়েছেন। হুতোম, ‘দালালি’ পেশাটিকে ‘নোপোর দই মারার’ সঙ্গে তুলনা করেছেন। কিন্তু বুববুলিয়ারাও দই ছাড়াও দুধ-ক্ষীর মারতেন বলে মনে হয়। অন্তত বাংলাদেশের এই নোপোবংশে বুববুলিয়াদের মতন আর কোনো বংশদণ্ডের উদ্ভব হয়নি কখনও। তাঁরা মামলার জন্য যা কমিশন পেতেন তা অনেক। C.M. বলেছেন ‘seldom less than ten percent’, বড় বড় দেওয়ানি মামলায় শতকরা দশভাগ কমিশন পাওয়া সহজ ব্যাপার নয়। অনেক সময় এই দালালরাই মামলা পরিচলানার জন্য ‘ম্যানেজার’ নিযুক্ত হতেন। মক্কেলদের উপর এই ম্যানেজার দালালদের এত বেশি প্রতিপত্তি ছিল যে তাঁরা এক-একটি মামলা, ইচ্ছা করলে, বংশ পরম্পরায় চালাতে পারতেন। তারপর মক্কেলের হাড় পর্যন্ত চুষে নিয়ে, তাকে একেবারে সর্বস্বান্ত অবস্থায় পথের ভিখিরি করে, তিনি তাঁকে মামলা থেকে রেহাই দিতেন। অনেক সময় দেখা যেত, দালাল-ম্যানেজারের অর্থ আত্মসাতের টেকনিক বুঝে ফেলে, মক্কেলরা নিজেদের মামলা ছেড়ে দিয়ে শেষে দালালদের মতন অন্যদের মামলা তদারক করার ভার নিতেন। C.M. লিখেছেন :
So great is the influence which these native managers have over their employers, that it is well-known that causes have been kept on foot by them in families for generations-in fact, fortunes, have been made by these people, and when a family estate has been exhausted by litigation, the remnant of the litigants have turned managers to other happy litigants.
বুববুলিয়াদের টানে বড় বড় বাঙালি বনেদি পরিবারের বংশধররা কেবল যে জাহান্নমেই গেছেন তা নয়, নিজেরাও বুববুলিয়াতে পরিণত হয়েছেন। দালালির এরকম দৃষ্টান্ত আর কোনো দেশের সামাজিক ইতিহাসে আছে কি না সন্দেহ।
দোকানদার। উনিশ শতকের প্রথমভাগের মধ্যেই কলকাতা শহরে বহুরকমের সব বাজার গড়ে উঠেছিল।* গ্রিফিন ৩৬টি বাজারের কথা বলেছেন, কিন্তু কোনো বাজারই তাঁর মতে পুরনো চীনাবাজারের মতন নয়। সাধারণ লোকে কলকাতা শহরে বাজার বলতে তখন চীনাবাজারই বুঝত, কারণ দোকান, দোকানদার, ও জিনিসপত্রের বৈচিত্র্য চীনাবাজারের মতন আর কোনো বাজারে ছিল না। টিরেটা ও ধর্মতলা বাজারে মাছ মাংস তরিতরকারি ফলমূল বিক্রি হত। এগুলি ছাড়া বাকি সব জিনিসই পাওয়া যেত নতুন ও পুরনো চীনাবাজারে। গ্রিফিন লিখেছেন।
The bazars are the places for shops, for stalls, and for business. Is their one European resident who would be at the trouble of counting how many native moneychangers, booksellers, stationers, cabinet-makers, umbrella makers, petty agents, leechesmen, idol-sellers, retailers, of saccharine dainties, and general dealers there are in these bazars and thoroughfares.
এককথায় চীনাবাজারকে তখন এদেশি ছোট ব্যবসায়ী ও দোকানদারদের সবচেয়ে বড় বাজার বলা হত, এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে বাঙালিদের সংখ্যাই ছিল তখন বেশি।
চীনাবাজারে হরেকরকম পণ্যদ্রব্যের মধ্যে বইয়ের আকর্ষণ কম ছিল না। বইয়ের দোকান অধিকাংশ ছিল বাঙালিদের, এবং তাতে তখনকার দিনের ভাল ভাল ইংরেজি সাহিত্য ও বিজ্ঞানের বই ঠাসা থাকত। সেক্সপীয়র, অ্যাডিসন, চামার্স, স্কট, মারিয়ট, বার্নস ও অন্যান্য খ্যাতনামা লেখকদের সমস্ত বই চীনাবাজারের দোকানে মজুত থাকত। এমন কি, বিলাতের যে-কোনো সদ্যপ্রকাশিত বই, সাহিত্যের বা বিজ্ঞানের, পাঠকরা খোঁজ করলেই পেতেন। বিদেশ থেকে আমদানি বই তখন নিলামেও বিক্রি হত। পুস্তক-ব্যবসায়ীরা নিলাম থেকে বই কিনে স্টক করতেন। এইভাবে বইয়ের ব্যবসা করে তখন অনেক বাঙালি দোকানদার খুব বড়লোক না হলেও, বেশ আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যেই জীবন কাটিয়েছেন।
চীনাবাজারের তখন আর-একটি বিশিষ্ট আকর্ষণ ছিল রেজকিওয়ালা (money-changer) গ্রিফিন জনৈক রেজকিওয়ালা বিপিনবিহারী রায়ের কথা এইভাবে বর্ণনা করেছেন :
There sits Bepeenbaharee Roy, the money-changer, his legs are placed in tailor fashion on the threshold of his little office, on a board, or on the ground before him, are small lots of gold mohurs an rupees, and heaps of pice.
বিপিনবিহারীদের তখনকার হাটে-বাজারে খুব বেশি সংখ্যায় দেখা যেত। বিশেষ করে যখন অর্থনৈতিক জীবনে মুদ্রার অটোক্রাসি প্রতিষ্ঠিত হয়নি, নানারকমের টাকাপয়সা বাজারে পাশাপাশি চলত, তখন বিপিনবিহারীরা রেজকি-বিনিময়ের ব্যবসা করে সহজেই জীবনধারণ করতে পারতেন।
রেজকিওয়ালার পাশে ছিল কুমোরের দোকান। তাঁর দোকানে ‘an image of the five-faced Shiva, the destroyer, of the blood-thirsty goddess Kali and of Durga’ দেখে গ্রিফিন রীতিমত চমকে গিয়েছিলেন। কুমোরের পাশে ছিল হুকোওয়ালা ভগবতীচরণ ঘোষের দোকান। হুকো-তামাকের পাশে ছিল মিষ্টান্ন। মিষ্টান্নের দোকান ছিল রামচন্দ্র দাসের, এবং রামচন্দ্রকে গ্রিফিন ‘dealer in sugary preparations’ বলেছেন। তিনি লিখেছেন যে রামচন্দ্রের দোকানের তাকগুলি টেরাসের মতন সাজানো। গোলাকার, লম্বা, ক্রিকোণ, চতুষ্কোণ প্রভৃতি নানা আকারের মিঠাইগুলিকে সাহেব ‘heaps of saccharine obeliskes, pyramids and balls’ বলেছেন। বোঝা যাচ্ছে, বাঙালির মিষ্টান্নের বিচিত্র রূপ বর্ণনা করতে গিয়ে সাহেব জ্যামিতির সাহায্য নিয়েও কূল পাননি।
রামচন্দ্রের পাশেই কাশীপ্রসাদ মুখুয্যের ক্যাবিনেটের দোকান। দোকানে কাশীপ্রসাদ সব সময় কিছু চেয়ার, কোচ, আলমারি ইত্যাদি বিক্রির জন্য মজুত রাখেন। তার পাশেই শিয়ারউড, কুরি প্রভৃতি বিখ্যাত ইউরোপীয় ক্যাবিনেট-মেকারদের দোকান, এবং সেই সব দোকানে ৬০০ থেকে ১০০০ জন মিস্ত্রি কাজ করে। ক্যাবিনেটের দোকানের পাশেই শ্রীকৃষ্ণ দত্তের সর্বজন-পরিচিত পাঞ্চহাউস। তার পাশেই কালাচাঁদ ঠাকুরের বিখ্যাত পোষাক-পরিচ্ছেদের দোকান, ‘a more interesting place to ladies than to sahibs.’ কালাচাঁদ সম্বন্ধে গ্রিফিন লিখেছেন, ‘he has a varied and fanciful stock of goods and is moreover, a most obliging pleasant person,’ সাহেবের কাছ থেকে একজন বাঙালি ব্যবসায়ীর পক্ষে দোকানদারি সম্বন্ধে এই প্রশংসা পাওয়া সহজ ব্যাপার নয়। চীনাবাজারের হ্যাবার ড্যাশার কালাচাঁদ এবং আরও অনেকে তা পেয়েছিলেন।
চীনাবাজারের দোকানদারদের কথা শেষ হল। বিপিনবিহারী, ভগবতীচরণ, কাশীপ্রসাদ, শ্রীকৃষ্ণ, কালাচাঁদ, পুস্তকব্যবসায়ী ও প্রতিমা শিল্পী, সকলেই ‘নেটিব’ বাঙালি ব্যবসায়ী। তাঁদের সংখ্যা যে কত তা হিসেব করা যায় না। একশো দেড়শো বছর আগেই এঁরা কলকাতা শহরের নতুন বাঙালি মধ্যবিত্তের একটা বেশ বড় স্তর অধিকার করে বসেছিলেন। কেবল দোকানদারিই এঁরা করতেন না, বাইরের সামাজিক জীবনের নতুন ধারার সঙ্গেও যোগাযোগ রাখতেন। এঁদের সঙ্গে ছিলেন অন্যান্য বাঙালি চাকুরিজীবীরা-সরকার, কেরানি, মুহুরি, এমন কি আদালতের বুববুলিয়ারা পর্যন্ত। নতুন শহরের নতুন মধ্যবিত্তের এই বিচিত্র স্তরটিকে সাধারণত ঐতিহাসিকরা উপেক্ষা করে থাকেন। তার কারণ, উনিশ শতকের মুষ্টিমেয় ভাগ্যবানদের যুগে, কেবল বিত্তবান ও বিদ্বান মধ্যবিত্তরাই সমাজে নতুন মর্যাদার অধিকারী ছিলেন, এবং সেই মর্যাদার জোরে সমাজে একচ্ছত্র প্রতিপত্তিও তাঁরা বিস্তার করেছিলেন। সাধারণ ও নিম্নমধ্যবিত্তের কোনো প্রভাবই সমাজে তখন বিশেষ ছিল না। কেরানি ও দোকানদারদের কথা তাই সেদিনের পুরনো বই ও কাগজপত্রে বিশেষ কোথাও স্থান পায়নি। এমনকী কুলিমজুর ও ক্রীতদাসদের কথা সেদিনের দলিলপত্রে কিছু কিছু পাওয়া যায়, কিন্তু ‘দরিদ্র অথচ ভদ্রলোকদের’ কথা একেবারেই পাওয়া যায় না। তাই তাঁদের সম্বন্ধে দু’চারকথা এখানে বলবার চেষ্টা করেছি।
* এই গ্রন্থের ‘কলকাতার ক্রমবিকাশ’ অংশ দ্রষ্টব্য।