৭
মতিঝিল পাড়ার অফিস। নাম আলফা ট্রান্সপোর্ট। নাম থেকে কিছু বোঝা যাচ্ছে না, তবে কাজকর্ম পাঁচমিশালি–অটোমোবাইল ইন্স্যুরেন্স, ট্রাভেল এজেন্সি এবং ইণ্ডেনটিং।
বৃহস্পতিবার অর্ধেক দিন অফিস। মুনিরের হাতে তেমন কাজ নেই। সে বসেছে এ্যাসিসটেন্ট ক্যাশিয়ার নিজামুদ্দিন সাহেবের পাশে। নিজামুদ্দিন সাহেবের ব্যালেন্স শীটে সতের টাকার গণ্ডগোল। হিসাব মিলছে না। তিনি মুনিরকে ডেকে নিয়ে গেছেন, যাতে সে ঠাণ্ডা মাথায় ফিগারগুলি চেক করতে পারে।
নিজামুদ্দিন সাহেবের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। এল ডি ক্লার্ক হয়ে ঢুকেছিলেন। দুটো প্রমোশন পেয়ে এ্যাসিস্ট্যান্ট ক্যাশিয়ার হয়েছেন। গত বছর একটা গুজব উঠেছিল, তিনি অফিসার্স গ্রেড পাচ্ছেন। তা পান নি। তাঁর পাঁচ বছরের জুনিয়র শমসের সাহেব পেয়েছেন। এই নিয়ে নিজামুদ্দিন সাহেবের মনে কোনো ক্ষোভ নেই। দিনের শেষে ক্যাশের হিসাব পুরোপুরি মিটে গেলেই তিনি মহাসুখী। এই হিসাব তাঁর প্রায়ই মেলে না। তখন তাঁকে দেখে মনে হয়, তাঁর মাথা খারাপ হতে বেশি বাকি নেই।
এই মানুষটিকে মুনিরের খুব পছন্দ। ভদ্রলোক সব কিছুই অত্যন্ত দ্রুত করেন। দ্রুত কথা বলেন। দ্রুত লেখেন এবং দ্রুত রেগে যান। অতি দ্রুত রাগ চলেও যায়। তখন ধরা গলায় বলেন, ‘মিসটেক’ হয়েছে। মনের মধ্যে কিছু রাখবেন না, তাহলে কষ্ট পাব।’এক্সকিউজ’ করে দেন।’
জুনিয়র কর্মচারীদের কেউ তাঁকে স্যার বললে তিনি শীতল গলায় বলেন, ‘আমাকে স্যার ডাকবেন না। স্যার ডাকলে নিজেকে মাস্টার-মাস্টার মনে হয়। বরং ভাই ডাকবেন।’ব্রাদারের’ উপর কোনো ডাক হয় না।’
মুনির নিজেও সতের টাকার কোনো সমাধান করতে পারল না। দেখা যাচ্ছে ক্যাশে সতের টাকা আসলেই কম। নিজামুদ্দিন সাহেবের মুখ অন্ধকার। নিঃশ্বাস পড়ছে ঘন-ঘন।
মুনির বলল, ‘নিজাম ভাই, আপনি আজ চলে যান। শনিবার না হয় আরেক বার দেখব।’
‘শনিবার দেখলে তো হবে না। দিনের হিসাব মেটাতে হয় দিনে। তিনি নিজের পকেট থেকে সতেরো টাকা রাখলেন আয়রন সেফে। কাগজপত্র সই করলেন। মুনিরের খুব মন খারাপ হল।
বেচারার সতের টাকা চলে গেল, এই জন্যে নয়, যে-হিসাবের জন্য ভদ্রলোকের এত মমতা সেই হিসাব মিলছে না দেখে। মুনিরের মনে হচ্ছে এই সরল-সহজ মানুষটা হয়তো কেঁদে ফেলবে।
‘নিজাম ভাই।’
‘কি?’
‘আসুন, আরেক বার আমরা দু’ জন মিলে বসি। চেক এবং কাউন্টার চেক। ভাউচারগুলিও দেখেন। কোনোটা হয়তো ইংরেজিতে লেখা, তুলেছেন বাংলায়।
নিজামুদ্দিন সাহেবের চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি অত্যন্ত উৎসাহে কাগজপত্র বের করলেন। মুনির কাগজপত্র নিয়ে বসতে পারল না। এজিএম কাদের সাহেব ডেকে পাঠালেন। নরম গলায় বললেন, ‘আমাকে কয়েকটা জিনিস টাইপ করে দিতে পারবে?’
প্রশ্ন থেকেই বোঝা যায় অফিসের কোনো কাজ নয়। অফিসের কাজ হলে বলতেন, ‘খুব জরুরি। টাইপ রাইটার নিয়ে বসে যাও। মিসটেক যেন না-হয়। স্পেসিং ঠিক রাখবে।’
এখন তা বলছেন না। নরম স্বরে কথা বলছেন। এজিএম ধরনের কেউ নরম স্বরে কথা বলে–এটাও এক অভিজ্ঞতা।
‘একটু এক্সট্রা টাইম কাজ করতে হবে, পারবে?
‘পারব স্যার।’
‘গুড।’
কাদের সাহেব মানিব্যাগ খুলে অনেক চিন্তা-ভাবনা করে একটা দশ টাকার নোট বের করলেন।
‘নাও দুপুরে কিছু খেয়ে নিও।’
‘কিছু লাগবে না স্যার।’
‘আরে নাও নাও।’
মুনির হাত বাড়িয়ে টাকা নিল। নিজেকে তার ভিখিরির মতো মনে হচ্ছে। অথচ না নিয়েও উপায় নেই। কাদের সাহেব টাকা না নেয়ার অন্য অর্থ করে বসতে পারেন।
‘কতক্ষণ লাগবে?’
‘ঘন্টাখানিক।’
‘গুড। আমি একটু বেরুচ্ছি। একঘন্টা পরে এসে নিয়ে যাব। ঠিক আছে?’
‘জ্বি আচ্ছা স্যার।’
একটার মধ্যেই কাজ শেষ–এজিএম সাহেবের দেখা নেই। অফিস খালি হয়ে গেল দেড়টার মধ্যে। দারোয়ান তালাচাবি লাগিয়ে দিল। নিজাম সাহেব বললেন, ‘তুমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি?’
‘এ ছাড়া আর কি করব?’
‘একা একা কতক্ষণ দাঁড়াবে? আমিও অপেক্ষা করি?’
‘আপনি চলে যান নিজাম ভাই। স্যার এসে পড়বেন। জরুরি কাজ।’
‘জরুরি কাজ না হাতি। জরুরি কাজ হলে চলে যেত না। পাশে বসে থাকত।’
‘আপনি চলে যান নিজাম ভাই।’
‘একা তোমাকে রেখে চলে যেতে খারাপ লাগছে।’
‘আমি বেশিক্ষণ থাকব না। এই ঘন্টাখানিক।’
ঘন্টাখানিক নয়, মুনির সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করল। কাগজগুলো হয়তো জরুরি। আগামীকাল ছুটি। কাদের সাহেব এই ছুটির মধ্যে তাকে খুঁজে পাবেন না। সেও কাদের সাহেবের বাসার ঠিকানা জানে না।
মুনিরের রীতিমতো কান্না পেতে লাগল। বারান্দায় ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকা খুবই কষ্টের। সময় কাটতেই চায় না। দুপুরে কিছু খাওয়া হয় নি। প্রচণ্ড খিদে লেগেছে। অফিসের পাশেই চায়ের দোকান আছে একটা। টোষ্ট, কলা এইসব পাওয়া যায়। কিন্তু যেতে ইচ্ছে করছে না। বরং নিজেকে কোনো-না-কোনোভাবে কষ্ট দিতে ইচ্ছে করছে। মুনির ঠিক করল, রাতেও সে কিছু খাবে না। দু’গ্লাস পানি খেয়ে শুয়ে থাকবে। মাঝে-মাঝে সে এ-রকম করে।
সন্ধ্যা মেলাবার আগেই আকাশ অন্ধকার করে বৃষ্টি নামল।
শ্রাবণ মাসের বৃষ্টি একবার শুরু হলে থামবে না। বৃষ্টির ছাঁট গায়ে লাগছে। তা লাগুক। কাগজগুলো না-ভিজলেই হয়। মুনির সদর দরজা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। পা টাটাচ্ছে। বসে পড়তে ইচ্ছে করছে। বৃষ্টির জন্যেই বেশ কয়েকজন ভিখিরিণী আশ্রয় নিয়েছে। খুব অল্প সময়েই এরা কেমন গুছিয়ে নিয়েছে। পা ছড়িয়ে গল্পগুজব করছে। এক জন আবার রাস্তা আড়াল করে বসে বিড়ি ধরিয়েছে। মুনিরকে দেখে একটু লজ্জা-লজ্জা পাচ্ছে। অন্য এক জনের কোলে ছোট্ট একটা বাচ্চা। সে বাচ্চাটির সঙ্গে নিচুগলায় কী সব গল্প করছে। এ-রকম ছোট তিন-চার বছরের শিশুর কোনো গল্প বোঝার কথা নয়। কিন্তু শিশুটি মনে হয় বুঝতে পারছে।
বৃষ্টি কমার কোনো লক্ষণ নেই। রাস্তায় একহাঁটু পানি। এই পানি ভেঙে এজিএম সাহেবের গাড়ি আসবে না। তিনি নতুন গাড়ি কিনেছেন। গাড়ির গায়ে এক ফোঁটা পানি পড়লে আঁৎকে ওঠেন।
বৃষ্টির বেগ ক্রমেই বাড়ছে। শ্রাবণ মাসে ঝড় হবার কথা শোনা যায় না, বাতাসের গতিক দেখে মনে হচ্ছে ঝড় হবে। পাশের চায়ের দোকান ঝাঁপ বন্ধ করছে।
‘মুনির, এই মুনির।’
মুনির চমকে উঠল। নিজামুদ্দিন সাহেব। পায়জামা হাঁটু পর্যন্ত তোলা। মাথায় ছাতা থাকা সত্ত্বেও ভিজে জবজব করছেন। পাঞ্জাবি লেপ্টে গায়ের সঙ্গে মিশে আছে।’
‘আমার তাই সন্দেহ হচ্ছিল। এই জন্যই এলাম, তুমি আছ এখনো?’
‘বৃষ্টিতে আটকা পড়েছি।’
‘বৃষ্টি তো শুরু হল সন্ধ্যাবেলায়। কোন আক্কেলে তুমি সন্ধ্যা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে রইলে! তুমি কি বায়েজিদ বোস্তামী? আবার হাসছ? এর মধ্যে হাসির কী হল!’
‘আপনি আমার খোঁজে আবার এলেন?’
‘আসব না তো কী করব? বৃষ্টি নামার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হল তুমি এখনো আছ। এর নাম হচ্ছে ইনট্যুশন। এখন চল আমার সঙ্গে। নাকি সারারাত দাঁড়িয়ে থাকবে?’
‘কোথায় যাব?
‘আমার বাসায়। আমার সঙ্গে আজ খাবে। তুমি মহা মূর্খ। মহা-মহা মূর্খ।’
.
নিজাম সাহেবের বাসা ভূতের গলিতে। দু’-কামরার টিনের ঘর। কাঁচা রাস্তা পার হয়ে যেতে হয়। জায়গায় জায়গায় খানাখন্দ। স্ট্রীট লাইট নেই। ইলেকট্রিসিটি না থাকায় সমস্ত অঞ্চলটাই অন্ধকারে ডুবে আছে। নিজাম সাহেব হাত ধরে ধরে মুনিরকে নিয়ে যাচ্ছেন। কাদায় পানিতে দু’ জনই মাখামাখি। নিজাম সাহেব সারা পথ গালাগালি করতে-করতে আসছেন। কিছুক্ষণ পর-পর বলছেন, ‘তুমি মহা মূর্খ।’
মুনিরের বড় ভালো লাগছে। অনেক দিন পর সে কোনো মানুষের মধ্যে এমন গাঢ় মমতার পরিচয় পেল। এই ঝড়-বৃষ্টির রাতে ভদ্রলোক একা-একা গিয়েছেন খোঁজ নিতে।
বাড়ি পৌছামাত্র গরম পানির ব্যবস্থা হল। নিজাম সাহেব ঠেলে তাকে বাথরুমে ঢুকিয়ে দিলেন। বাথরুম অন্ধকার। সারা বাড়িতে একটামাত্র হারিকেন।
‘মুনির।’
‘জ্বি?’
‘তাকে সাবান আছে।’
‘কিছু তো দেখতে পাচ্ছি না।’
‘দরজা বন্ধ করার দরকার কী? খোলা রাখ।’
মুনির দরজা অল্প একটু ফাঁক করল। ভেতরবাড়ির সবটা দেখা যাচ্ছে। ফ্রক-পরা কিশোরী একটি মেয়ে বারান্দায় কেরোসিন কুকারে রান্না চড়িয়েছে। মেয়েটির পাশে ভেজা-কাপড়ে নিজাম সাহেব। কি যেন বলছেন মেয়েকে, আর মেয়ে বারবার হেসে উঠছে। অন্ধকারে এই হাসির শব্দ এত মধুর লাগছে।
বাড়িতে আর কোনো লোকজন নেই। নিজাম সাহেবের স্ত্রী মারা গেছেন অল্প কিছুদিন আগে। দেশের বাড়িতে গিয়ে জ্বরে পড়েছিলেন। জ্বরের সঙ্গে ধীরে-ধীরে আরো সব উপসর্গ যুক্ত হল। খবর পেয়ে নিজাম সাহেব গেলেন দেশে। তিন দিনের আর্নড লীভ নিয়ে গিয়েছিলেন। দু’ দিনের দিন ফিরে এসে যথারীতি হিসাবের খাতা নিয়ে বসলেন। বিকেলে অফিসের ছুটির পরও বসে রইলেন। মুনির এসে বলল, ‘নিজাম ভাই বাসায় যাবেন না? নাকি আজও হিসাবের গণ্ডগোল আছে?’
নিজাম সাহেব শান্ত গলায় বললেন, ‘অন্যের হিসাব মিলিয়ে দিয়েছি। নিজেরটা মেলে না। আমার স্ত্রী মারা গেছে। বাড়ি গিয়ে দেখি দশ মিনিট আগে ডেডবডি কবর দিয়ে ফেলেছে। অনেকেই বলেছিল কবর থেকে আবার তোলা হোক। শেষ দেখা। আমি নিষেধ করলাম।’
নিজাম সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। তার চেহারায় বা আচার-আচরণে শোকের কোনো ছাপ নেই। অফিসের হিসাব না মিললে এই মানুষটি অনেক বেশি বিচলিত হয়।
.
পাটি বিছিয়ে খাওয়ার আয়োজন। উচ্ছে ভাজা, চিংড়ি মাছ, ডাল এবং একটা শব্জি। কিশোরী মেয়েটি খাবার তুলে তুলে দিচ্ছে। মেয়েটির মুখ গোলাকার, নাক ঈষৎ চাপা তবু ভারি মিষ্টি লাগছে মেয়েটিকে। মেয়েটির কথাবার্তায় কোনো আড়ষ্টতা নেই, যেন মুনিরকে সে অনেক দিন থেকে চেনে। মেয়েটি মিষ্টি রিনরিনে গলায় কথা বলছে এবং খুব কৌতূহলী চোখে মুনিরকে দেখছে।
‘বাবা প্রায়ই বাসায় এসে বলেন, আপনি নাকি বাবার হিসাব মিলিয়ে দিয়েছেন। প্রতি বৃহস্পতিবার অফিসে যাবার সময় বলেন–ছেলেটিকে দাওয়াত করব। আপনাকে বোধহয় আর বলেন না। নাকি বলেন, আপনি আসেন না?’
মুনিরের কেন জানি লজ্জা করছে। চোদ্দ-পনের বছরের বাচ্চা একটি মেয়ে, তবু কেন মুনির সহজ হতে পারছে না।
‘নিজাম ভাই, আপনার কি একটিই মেয়ে?
‘হ্যাঁ, বিনুর বড় একটা ভাই ছিল। জন্মের পরপর মারা গেছে।’
‘আপনার মেয়ে কী পড়ে?’
বিনু হেসে ফেলে বলল, ‘আপনি বাবাকে জিজ্ঞেস করছেন কেন? আমাকে জিজ্ঞেস করুন। আপনি এত লজ্জা পাচ্ছেন কেন?’
‘কী পড় তুমি?’
‘আইএ পড়ি।’
নিজাম সাহেব বললেন, ‘আর পড়াশোনা হবে না। বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। এ দেশে বিয়ের পর মেয়েদের পড়াশোনা হয় না।’
মুনির বিনুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কোথায় বিয়ে ঠিক হয়েছে?’
বিনু আবার হেসে ফেলল। হাসিমুখে বলল, ‘যে-সব প্রশ্ন বাবাকে করা দরকার, সে-সব প্রশ্ন আপনি করছেন আমাকে। আর যে-সব প্রশ্ন আমাকে করা দরকার, সে-সব করছেন বাবাকে। আপনি মানুষ এত অদ্ভুত কেন?’
‘তুমি কিছু মনে করো না।’
‘না, কিছু মনে করছি না। আপনার কি পরম লাগছে?
‘গরম লাগবে কেন? গরম লাগছে না।’
‘ঘামছেন কেন?’
বিনুর প্রশ্নের সঙ্গে-সঙ্গেই ব্যাপারটা ঘটল। চোখের সামনের জগৎ হঠাৎ কেমন ঘোলাটে হয়ে গেল। শব্দ অস্পষ্ট। ঘোলাটে আলোর তীব্রতা দ্রুত কমছে—কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না। মুনির তলিয়ে যাচ্ছে শব্দহীন আলোহীন এক জগতে। শরীরের কোনো ইন্দ্রিয় কাজ করছে না। এই অবস্থা কতক্ষণ ছিল মুনিরের মনে নেই। ঘোর কাটল। কিছু-কিছু আলো সে দেখতে পাচ্ছে। দু’একটা শব্দ কানে আসছে। মুনির ক্লান্ত গলায় বলল, ‘পানি খাব।’
‘এইমাত্র না পানি খেলে! আবার পানি কেন? সত্যি খেতে চাও?’
মুনির স্পষ্ট করে তাকাল। সে একটা অচেনা বাড়ির অচেনা বারান্দায় বসে আছে। তার সামনে বিনু। তার গায়ে ঘরোয়া ভঙ্গিতে পরা হাল্কা নীল রঙের একটা সুতির শাড়ি। বারান্দায় একটা পাটি পাতা। বিনু বসেছে পাটিতে। সে একটা চেয়ারে বসে আছে। রাত। বারান্দায় চাঁদের আলো আছে।
‘এই, সত্যি সত্যি পানি চাও?’
‘চাই।’
বিনু উঠে গেল। এই বাড়ি কার? এই মেয়েটির সঙ্গে তার কী সম্পর্ক, জায়গাটা কোথায়? সে কিছুই জানে না। বছরখানিক আগে প্রথম যা হয়েছিল, এও কি তাই? তার কি দুটো জীবন? এই দুটো জীবন কি পাশাপাশি চলছে?
‘নাও, পানি নাও।’
মুনির যন্ত্রের মতো হাত বাড়াল। ঠাণ্ডা কনকনে পানি।
‘ও কি, গ্লাস হাতে বসে আছ কেন?’
‘এটা কোন জায়গা?’
‘এ আবার কি রকম কথা? কোন জায়গা মানে?’
‘এম্নি বললাম।’
‘চল, শুয়ে পড়ি। আর কতক্ষণ বারান্দায় বসে থাকবে?’
মুনির যন্ত্রের মতোই একটা ঘরে ঢুকল। এটাই বোধহয় শোবার ঘর। বেশ বড়লোকের বাড়ি মনে হচ্ছে। সুন্দর করে সাজান। দেয়ালে তিন-চার বছরের একটা ফুটফুটে শিশুর ছবি। মেয়েটি বলল, ‘শোন, চট করে ঘুমিয়ে পড়বে না। বাবার চিঠির জবাব দিয়ে তারপর ঘুমুবে। আমার তো মনে হয় তুমি তাঁর চিঠি পড় নি এখনো। নাকি পড়েছ?’
‘না।’
‘পড়ে শোনাব?’
‘শোনাও।’
মেয়েটি ড্রয়ার খুলে চিঠি বের করল–গলার স্বর বুড়ো মানুষের মতো করে পড়তে শুরু করল—টুনু, তুমি দীর্ঘদিন যাবত আমার পত্রের জবাব দিতেছ না। ইহার কারণ বুঝিতে আমি অক্ষম। এক জন বৃদ্ধ মানুষের পত্রের জবাব দেওয়া সাধারণ ভদ্রতা। চাকরি এবং সংসার নিয়া তুমি ব্যস্ত আমি জানি। দুনিয়ার সকলেই ব্যস্ত। কেহ বসিয়া নাই। তোমার মা বাতে আক্রান্ত। আয়ুর্বেদীয় চিকিৎসা চলিতেছে। তবে আমার ইচ্ছা তাহাকে ঢাকায় আনিয়া কোনো বড় ডাক্তারকে দিয়া দেখান। ঢাকায় বাত রোগের জন্য নামী ডাক্তারদের সন্ধান লইও।
বৌমাকে আদর ও স্নেহচুম্বন দিবে। তাহাকে অতি শীঘ্রই পৃথক পত্র দিব। ইতি
চিঠি পড়া শেষ করে মেয়েটি বলল, ‘দেখলে, তোমার ওপর কি রকম রাগ করেছেন? একটা চিঠি লিখতে কতক্ষণ লাগে বল তো? কাগজ-কলম এনে দিই।’
মুনির সেই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে দেয়ালে টাঙান ছবিটির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এটা কার ছবি?’
মেয়েটি দীর্ঘ সময় মুনিরের দিকে তাকিয়ে রইল। তার চোখ ছলছল করছে। এই শিশুটি সম্ভবত তাদেরই। এবং খুব সম্ভব শিশুটি বেঁচে নেই। তার জন্যে মুনিরের কোনো দুঃখ বোধ হচ্ছে না। কারণ এই শিশুটিকে সে চেনে না। অতীতের কিছুই তার মনে পড়ছে না। সে দেখছে শুধু বর্তমান। এবং অদ্ভূত কোনো বর্তমান। এই বর্তমানের কোনো ব্যাখ্যা নেই। মুনির আবার বলল, ‘ছবিটা কার?’
মেয়েটি তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, ‘তোমার কী হয়েছে! ছবি কার জিজ্ঞেস করছ কেন? তুমি জান না ছবি কার?
বলতে-বলতে মেয়েটি ফুঁপিয়ে উঠল। মুনিরের ঘোর কেটে গেল। সে আগের জায়গাতেই আছে। ভাত-মাছ খাচ্ছে। বিনু মেয়েটি পাতে এক চামচ ডাল দিল। নিজাম সাহেব বললেন, ‘দৈ আছে। টক দৈ। ডালের সঙ্গে মিশিয়ে খাও। ভালো লাগবে।’
বিনু বলল, ‘দৈ কিন্তু বাবা নেই। বেড়াল মুখ দিয়েছিল, ফেলে দিয়েছি। ইস্, আপনার বোধহয় খাওয়ায় খুব কষ্ট হল।’
‘না, কষ্ট হয় নি।’
‘এমন দিনে বাবা আপনাকে নিয়ে এসেছে যে, কোনো বাজার নেই। একটা যে ডিম ভেজে দেব সে উপায়ও নেই। ঘরে ডিমও ছিল না।’
‘আমার কিচ্ছু লাগবে না।’
‘আরেকদিন কিন্তু আপনি আসবেন। আসবেন তো?’
‘হ্যাঁ, আসব।’
‘খবর দিয়ে আসবেন।’
‘আচ্ছা, খবর দিয়ে আসব।’
‘আপনি কি পান খান?’
‘না।’
মুনির বারান্দায় হাত ধুতে গেল। বিনু সঙ্গে করে পানি নিয়ে এসেছে। এখন আর বৃষ্টি নেই। মেঘ কাটতে শুরু করেছে। হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই চাঁদ উঠবে। শ্রাবণ মাসের চাঁদ অপূর্ব হয়, কে জানে আজ কেমন হবে?