ভালুক জ্বর বলে একটা কথা আছে। হঠাৎ হঠাৎ কোনো কারণ ছাড়াই সারা শরীর কাঁপিয়ে ভালুকের জ্বর আসে। সে কুকড়ি-মুকড়ি হয়ে পড়ে থাকে। জুরের তড়াসে তার শরীর কাঁপতে থাকে। দেখতে দেখতে হুট করে জ্বর চলে যায়। সে গা ঝাড়া দিয়ে দুপায়ে উঠে দাঁড়ায়।
শুভ্রর জ্বর সম্ভবত ভালুকগোত্রীয়। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সে বিছানায় উঠে বসল। খুশি খুশি গলায় সকিনাকে ডেকে চা দিতে বলল। তার কাছে মনে হচ্ছে জ্বর এসে চলে যাওয়ায় ভালো হয়েছে। মাথাটা পরিষ্কার লাগছে। এখন ঠাণ্ডা মাথায় সফটওয়্যারটা নিয়ে বসা যায়। যুক্তাক্ষরের সমস্যাটার সমাধান করা যায়। তৃতীয় কোনো ব্যক্তিকে উপস্থিত রাখতে পারলে ভালো হতো। সে শব্দ শুনে বলতে পারত কোন শব্দটা কানে শুনতে ভালো লাগে। রুনু মেয়েটাকে খবর দিয়ে নিয়ে আসতে পারলে ভালো হতো। সেটা তো সম্ভব না।
জাহানারা বাড়িতে ফিরে দেখেন, শুভ্র কম্পিউটারের সামনে উবু হয়ে বসে আছে। কী-বোর্ডে চাপ দিচ্ছে। পো পি শব্দ হচ্ছে। শুভ্ৰ শব্দ শুনছে। চোখ বন্ধ করে। তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, এই তোর না জ্বর? শুভ্ৰ হাসিমুখে বলল, জ্বর নেই মা। কপালে হাত দিয়ে দেখ।
জাহানারা ছেলের কপালে হাত দিলেন। আসলেই জ্বর নেই। শরীর ঠাণ্ডা। শুভ্র বলল, তুমিই বলো জ্বর কি আছে?
জাহানারা বললেন, জ্বর নেই। তবে তোর জ্বর কীভাবে চলে গেছে সেটা শুনলে তুই চমকে উঠবি।
শুভ্র বলল, বলো তো শুনি।
জাহানারা বললেন, তোর জ্বর শোনার পর আমি পীর সাহেবকে বললাম। উনি চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ দোয়া পড়লেন। তারপর চোখ মেলে আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। তখনি বুঝেছি। কাজ হয়েছে। তুই হাসছিস কেন? আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না? তোকে একদিন আমি হুজুরের কাছে নিয়ে যাব।
আচ্ছা।
আজকের বেড়ানো কেমন হয়েছে?
খুবই ভালো হয়েছে। ঝমোঝম করে বৃষ্টি হচ্ছিল। ভিজে দারুন মজা পেয়েছি।
জাহানারা ছেলের কাঁধে হাত রাখতে রাখতে বললেন, এখন থেকে তুই যখন বাইরে কোথাও যাবি- আমি সঙ্গে যাব।
বেশ তো যাবে। আগামীকাল আমি যাব অচিনবৃক্ষ দেখতে। তুমি তোমার ব্যাগ গুছিয়ে নাও। তুমি যাবে, সকিনা মেয়েটিও যাবে। সকিনা পথ-ঘাট দেখিয়ে নিয়ে যাবে।
জাহানারার মুখ শক্ত হয়ে গেল। ঘাড় ব্যথা করতে লাগল। প্রেসারের লক্ষণ। চট করে প্রেসার বেড়েছে। প্রেসার বাড়লেই তার ঘাড় ব্যথা করতে থাকে। হাতের তালু ঘামে। হাতের তালু ঘামা এখনো শুরু হয় নি, তবে শুরু হবে। আজ ভোরে প্রেসারের ওষুধ খেয়েছেন কি-না। তিনি মনে করতে পারলেন না। নাশতা খাবার পর পর প্রেসারের ওষুধ তার হাতে তুলে দেয়ার দায়িত্ব সকিনার। সে কি দিয়েছে?
শুভ্র বলল, কী হয়েছে মা?
জাহানারা বললেন, কাল যেতে পারবি না। কাল তোর জন্মদিনের উৎসব করব। আমি নিজের হাতে পোলাও রান্না করব।
শুভ্র বলল, কাল আমার জন্মদিন না-কি?
কাল জন্মদিন না, কিন্তু আমি উৎসবটা কাল করব। সন্ধ্যার পর তোকে আমি পীর সাহেবের কাছে নিয়ে যাব। উনি তোর মাথায় ফুঁ দিয়ে দেবেন।
শুভ্র বলল, একটা খালি বোতল নিয়ে যাও মা। বোতলে করে উনার ফু নিয়ে এসো। তারপর সেই ফু আমার মাথায় ঢেলে দিও।
উনাকে নিয়ে ঠাট্টা ফাজলামি করবি না।
আচ্ছা যাও করব না।
জাহানারা উঠে দাঁড়ালেন। তিনি চলে যাবার জন্যে পা বাড়িয়েছেন, শুভ্ৰ খাপ করে তার হাত ধরে তাকে টেনে বসিয়ে দিল। জাহানারার মন ভারী হয়েছিল, শুভ্রর এই কাণ্ডে হঠাৎ করে মন ভালো হয়ে গেল। ঘাড়ের ব্যথা কমে গেল।
শুভ্র বলল, তোমাকে একটা জরুরি কথা জিজ্ঞেস করা হয় নি। ছোটবেলায় একবার আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলাম, তোমার মনে আছে? তখন আমাকে উদ্ধারের জন্যে এক লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হলো। তোমার মনে আছে মা?
জাহানারা বললেন, মনে থাকবে না কেন?
শুভ্র বলল, ঐ পুরস্কারের টাকাটা কে পেয়েছিল?
সেটা জেনে কী করবি?
শুভ্র বলল, রুনুকে খবরটা দিতে হবে। রুনু জানতে চাচ্ছিল।
জাহানারা বিস্মিত হয়ে বললেন, রুনু কে?
শুভ্র বলল, রুনু হচ্ছে মনজুর বোন। অসম্ভব বুদ্ধিমতি একটা মেয়ে।
জাহানারা বললেন, ওর সঙ্গে দেখা হলো কোথায়?
শুভ্র আগ্রহের সঙ্গে বলল, ও তো সারাদিন নৌকায় আমাদের সঙ্গেই ছিল। একসঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজলাম।
জাহানারা একদৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি কিছুই বুঝতে পারছেন না। রুনু নামের একটা মেয়ে আবার কোথেকে উদয় হলো। শুভ্ৰ কি তার সঙ্গে ঠাট্টা করছে? মার সঙ্গে ঠাট্টা করার অভ্যাস অবশ্যি শুভ্রর আছে।
শুভ্র বলল, মা, তুমি এমন রাগ রাগ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে কেন? মেয়েটাকে দেখলে তোমার ভালো লাগবে। তার গলার স্বর মিষ্টি। ভাইব্রফোনের আওয়াজের সঙ্গে মিল আছে।
জাহানারা বললেন, মেয়েটাকে কে নিয়ে গিয়েছিল, মনজু?
শুভ্র বলল, না, আমিই মেয়ের মাকে বলে সঙ্গে নিয়ে গেছি। মা শোন, আমরা কিন্তু মূল প্রসঙ্গ থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছি- এক লাখ টাকা কে পেয়েছিল?
আমি জানি না কে পেয়েছিল।
কে জানে? বাবা জানেন?
জানি না তোর বাবা জানে কি-না।
শুভ্র বলল, বাবা না জানলেও একজন অবশ্যই জানবে। সুলেমান চাচা। মা, তাকে খবর পাঠাও তো।
জাহানারা কঠিন মুখে বললেন, এত রাতে তাকে খবর পাঠানো যাবে না। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে অস্থির হবার কিছু নাই।
কোনো বিষয়ই তুচ্ছ না মা।
জাহানারা উঠে দাঁড়ালেন। তার ঘাড়ের ব্যাথা আবার শুরু হয়েছে। হাতের তালু ঘামছে। তার উচিত ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থাকা। সেটা সম্ভব না। আগে তাকে দুটা জরুরি কাজ করতে হবে। মনজু নামের বদমাশটাকে বিদায় করতে হবে। সকিনাকে দেশের বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে হবে। কাজটা করতে হবে। আজ রাতেই। শুভ্রর বাবার সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করতে পারলে ভালো হতো। তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। জাপানি কোনো এক কোম্পানির ডিরেক্টরের সঙ্গে আজ তার ডিনার আছে। ফিরতে অনেক রাত হবে।
মনজু বিছানায় শুয়ে আছে। তার হাতে মায়ের চিঠি। চিঠিটা আজ দুপুরে এসেছে। এখনো পড়া হয় নি। মায়ের চিঠি এমন কোনো ব্যাপার না যে বিছানায় শুয়ে আয়েশ করে পড়তে হবে। মনজুর খুবই ক্লান্তি লাগছে- বসে থাকতে পারছে না। আজ সারা দিন তার উপর ভালো ধকল গিয়েছে। রুনুকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া বড় রকমের ভুল হয়েছে। মেয়েটা ফেরার পথে একটু পরপর চোখ মুছছিল। চোখের পানি ফেলার মতো কোনো ঘটনা তো ঘটে নি। শুভ্ৰ ভাইজান তার স্বভাবমতো রুনুর সঙ্গে অতি ভদ্র ব্যবহার করেছেন। রুনু কি তার অতি ভদ্র ব্যবহারকেই অন্য কিছু ভেবেছে? এত বোকা মেয়ে তো রুনু না।
মনজু ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে মার চিঠি পড়তে শুরু করল। চিঠি পড়ার আগেই তার মন ভারী হয়ে গেল। দীর্ঘ চিঠিতে আনন্দ পাওয়ার মতো কিছুই থাকবে না। মার চিঠি মানেই ধারাবাহিক ঘ্যানঘ্যাননি।
বাবা মনজু,
দোয়া পরসমাচার তোমার পাঠানো টাকা পাইয়াছি। মাত্র চার হাজার টাকা পাঠাইয়াছ কেন বুঝিলাম না। তুমি জানাইয়াছিলে তোমার বেতন ছয় হাজার টাকা। থাকা-খাওয়া ফ্রি। সেই ক্ষেত্রে ইচ্ছা করিলেই তুমি আরো কিছু পাঠাইতে পারিতে। সংসারের অবস্থা অতি শোচনীয়। বাবা, তুমি যেভাবেই পার প্রয়োজনে ঋণ করিয়া হইলেও দুই একদিনের ভিতর আরো দুই হাজার টাকা পাঠাও। নিতান্তই অপারগ। হইয়া তোমাকে জানাইতেছি।
মূল ঘটনা না জানিলে তুমি বিপদের মাত্রা বুঝিতে পরিবে না। তোমার সৎবাবার সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস আছে। তিনি আবার ভালো সিগারেট ছাড়া খাইতে পারেন না। পুরানা দিনের অভ্যাস। তিনি একটা দোকান থেকে বাকিতে সিগারেট নিতেন। সেখানে একুশ শ টাকা বাকি পড়িয়া গেল। দোকানদারের এক ভাই আছে মাস্তান। নাম জহিরুল। অঞ্চলে হাতকাটা জহিরুল নামে তার পরিচয়। সকলেই তার ভয়ে অস্থির থাকে। থানায় তার নামে কয়েকটি মামলা আছে। তারপরও থানাওয়ালারা তাহাকে কিছুই বলে না। উল্টা খাতির করে। চা-সিগ্রেট খাওয়ায়। ঐ বদমায়েশ হাতকাটা জহিরুল অনেক লোকজনের সামনে তোমার সৎবাবার শার্টের কলার চাপিয়া ধরিয়াছে। চড়-থাপ্নড় দিয়াছে। সে তোমার সৎবাবাকে বলিয়াছে— এক সপ্তাহের মধ্যে দোকানের বাকি শোধ না করিলে সে তোমার সৎবাবার বাম হাতের কজি কাটিয়া ফেলিবে।
বাবা মনজু, হাতকাটা জহিরুলের পক্ষে সবই সম্ভব। তোমার সৎবাবা ভয়ে দিনরাত এখন ঘরে থাকেন। তাহার রাতে ঘুম হয় না। বাবা, এই বিপদ থেকে উদ্ধারের ব্যবস্থা তোমাকে যেভাবেই হউক। করিতে হইবে।
তোমার বোনের হাতে কিছু টাকা আছে। পরিমাণ কত আমি জানি না। সে এই বিষয়ে কিছুই বলে না। গত মঙ্গলবার চায়ের পাতা কিনিবার জন্যে তাহার নিকট পঞ্চাশটা টাকা চাহিয়াছি। সে বলিল, টাকা নাই। অথচ সেই দিনই সন্ধ্যায় সে জিলাপি কিনিয়া আনিয়া তাহার দুই পুত্রকে খাওয়াইছে। আমার মনে খুবই দুঃখ হইয়াছে। আমি কেমন সন্তান গর্ভে ধারণা করিয়াছি যে আমার সহিত মিথ্যাচার করে?
আরেক দিনের ঘটনা শুনিলে তুমি অবাক হইবে। তোমার সৎবাবা বাজার হইতে শখ করিয়া একটা কালো বাউস মাছ কিনিয়া আনিয়াছেন। দুপুরে খাইতে তাহার বিলম্ব হয়। কারণ তিনি এই সময় স্থানীয় পাবলিক লাইব্রেরিতে পত্রিকা পড়িতে যান। দুপুরের দিকে লাইব্রেরিতে ভিড় থাকে না। সব পত্রিকা হাতের কাছে পাওয়া যায়। উনার ফিরিতে বিলম্ব হইবে জানি বলিয়া আমি একটা বাটিতে কয়েক পিস মাছ তুলিয়া মিটাসেফে রাখিয়া গোসল করিতে ঢুকিয়াছি, এই ফাকে তোমার ভগ্নি বাটির সবগুলি মাছ তাহার দুই পুত্রকে খাওয়াইয়া দিয়াছে। যে শাখা করিয়া মাছ কিনিয়াছে তাহার ভাগ্যে মাছের একটা ভালো পিস জুটে নাই। ইহাকে শক্ৰতা ছাড়া আর কী বলা যায়! নিজের পেটের সন্তান যদি শত্রু হয় তখন বুঝিতে হইবে কিয়ামতের আর দেরি নাই।
বাবাগো, সংসারের এইসব বিষয় নিয়া মন খারাপ করিও না। সবই আমার কপাল। এখন তুমি শুধু তোমার সৎবাবাকে বিপদ হইতে উদ্ধার করা। তুমি জানো না যে তিনি তোমাকে কী পরিমাণ স্নেহ করেন। প্রায়শই তোমার কথা বলেন। বাবাগো, পত্রপাঠ শেষ হইবা মাত্ৰ তুমি মানি অর্ডার যোগে টাকা পাঠাইবার ব্যবস্থা কর।
ইতি
তোমার মা
চিঠি পড়তে গিয়ে মনজুর মাথা ধরে গেছে। মাথা ধরা সারানোর উপায় হলো, গরম পানি নিয়ে হেভি গোসল দেয়া। গোসলের পর কড়া এক কাপ চা। সঙ্গে মামা-ভাগ্নে সিগারেট। বাড়িতে টাকা পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারলে মাথা ধরা সঙ্গে সঙ্গে কমে যেত। এই সিদ্ধান্ত নেয়া যাচ্ছে না। হাতে টাকা আছে মোট চারশ এগারো। এক জোড়া জুতা আর একটা হালকা সবুজ রঙের। হাফ শার্ট কিনে সে টাকা নষ্ট করেছে। জুতা জোড়া কিনতেই হতো। শার্টটা না। কিনলেও চলত। শার্টটা কেনা হয়েছে লোভে পড়ে। শার্টটা এখনো পরা হয় নি। দোকানে নিয়ে গেলে টাকা ফেরত দেবে বলে মনে হয় না। টাকা। এমন জিনিস যে হাত থেকে বের হলে আর ফেরত আসে না।
মনজু বালিশের নিচ থেকে সিগারেট ধরাল। খালি পেটে সিগারেট ধরালে মাথা ধরা আরো বাড়বে। বাড়ুক। মাথার যন্ত্রণায় সে ছটফট করুক। মাথা যন্ত্রণা নিয়ে মার চিঠির জবাব দিতে পারলে ভালো হতো। মনজু সিগারেটে টান দিয়ে মনে মনে চিঠির জবাব দিতে শুরু করল–
মা, তোমার চিঠি পেয়েছি। সন্ত্রাসী হাতকাটা জহিরুলকে আমার অভিনন্দন পৌছে দেবার ব্যবস্থা করবে। সে যে আমার সৎপিতার বাম হাতের কজি কাটার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এতে আমি আনন্দিত। বাম হাতের কজি না কেটে ডান হাতেরটা কাটা কি সম্ভব? এই বিষয়ে তুমি তার সঙ্গে আলোচনা করে দেখতে পার। আমার ধারণা অনুরোধ করলে সে রাখবে। তোমার অনুরোধ তো সে ফেলবেই না। তোমার মতো মিষ্টি করে অনুরোধ কেউ করতে পারে বলে আমি মনে করি না। একটাই শুধু আফসোস— আমার আসল বাবার সঙ্গে তোমার মিষ্টি গলা কখনো বের কর নি।
মা, তোমার কি মনে আছে বাবা তার কোনো এক বন্ধুর মেয়ের বিয়েতে গিয়ে দেরি করে ফিরেছিল বলে তুমি তাকে শাস্তি দিয়েছিলে? পৌষ মাসের প্রচণ্ড শীতে তুমি দরজা খুলো নি। বেচারাকে সারারাত বাইরে বসে থাকতে হয়েছে। যাই হোক, কী আর করা! প্রত্যেকেই প্ৰত্যেকের কপাল নিয়ে আসে। আমার সৎবাবা ভালো কপাল নিয়ে এসেছেন।
মা, উনার কব্জি কাটা নিয়ে তুমি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হইও না। প্রতিটি খারাপ জিনিসের মধ্যেও ভালো কিছু থাকে। উনার কজি কাটায় নিশ্চয়ই কোনো মঙ্গল নিহিত আছে। আমরা সেটা ধরতে পারছি না।
এই মুহূর্তে আমার যেটা মাথায় আসছে তা হলো— ভিক্ষাবৃত্তিতে সুবিধা। শেষ জীবনে উনাকে যদি ভিক্ষা করে খেতে হয় তাহলে কজি কাটা খুবই কাজে আসবে। মানুষের দয়া আকর্ষণের জন্যে কাটা কজি কাজে আসবে। রোজ সকালে একটা থালা হাতে তুমি উনাকে মসজিদের পাশে বসিয়ে দিয়ে আসবে। এশার নামাজের পর নিয়ে আসবে। বুদ্ধিটা ভালো না?
আমার খবর হচ্ছে- আমি ভালো আছি। চাকরিতে অতি দ্রুত একটা প্রমোশন হয়েছে। এখন আমি একটা সেকশনের ইনচার্জ। বেতন সব মিলিয়ে পনের হাজার পাচ্ছি। তারপরেও আমার পক্ষে তোমাদের কোনো টাকা-পয়সা পাঠানো সম্ভব না। কারণ আমি বিয়ে করছি। বিয়ের খরচ তো আমাকে কেউ দিবে না। নিজেকেই জোগাড় করতে হবে। মেয়ের নাম রুনু। তুমি চিনতেও পার— ইকবাল মামার মেয়ে। বিয়ের পর হানিমুন করতে নেপাল যাব। সেখানেও টাকা দরকার। আগামী এক-দুই বছর একটা টাকাও তোমাদের পাঠাতে পারব না।
আসলে তোমার গর্ভই খারাপ। গর্ভে যেমন বিছু-মেয়ে ধারণ করেছ, সে-রকম কুলাঙ্গার ছেলেও ধারণ করেছ। কজিকাটা মানুষটাকে নিয়ে সুখে দিন কাটাও— এই তোমার প্রতি আমার শুভকামনা।
ইতি
তোমার কুপুত্র মনজু
মনে মনে চিঠিটা লিখে মনজু আরাম পেয়েছে। এরকম আরেকটা চিঠি সৎবাবাকে লিখতে পারলে আরামটা আরো প্রবল হতো। চিঠির শুরু হবে এইভাবে–
ঐ ব্যাটা কব্জিকাটা, ….
শুরুটাতে কবিতার ছন্দের মতো ছন্দ আছে। মিলও আছে। ব্যাটার সঙ্গে কাটার মিল।
চিঠিটা শুরু করা গেল না।
রহমতুল্লাহ এসে ঢুকল। তার পরনে ইস্ত্রি করা পায়জামা-পাঞ্জাবি। চুল আঁচড়ানো। মুখ দিয়ে মিষ্টি গন্ধ বের হচ্ছে। আজ তার বিশেষ দিন। মদ্যপান করেছেন। যেদিন এই কাজটা করেন সেদিন তার সাজগোজ ভালো থাকে। মেজাজও ভালো থাকে। তিনি মনজুর দিকে তাকিয়ে বললেন, আছ কেমন?
মনজু বলল, ভালো।
খাওয়া-দাওয়া করেছি?
জি-না।
খাওয়া-দাওয়া করে নাও। আজ ভালো খাওয়া আছে। মেজবানির গরুর মাংস। হেড অফিসে রান্না হয়েছে। চিটাগাং থেকে বাবুর্চি এসেছে। মেজবানির মাংস গরম গরম খাওয়া ভালো।
মনজু বলল, আজ কি কোনো উপলক্ষ?
রহমতুল্লাহ হাই তুলতে তুলতে বললেন, আছে নিশ্চয়ই কিছু। হেড অফিসের সব খবর তো পাই না। আমি পচা আদার ব্যাপারি। জাহাজের খবর কী রাখব? হেড অফিস হলো জাহাজ। এইটাই ভাবতেছিলাম– আমাদের বড় সাহেব ঢাকা শহরে এসেছিলেন এক জোড়া স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরে। তার কাঁধে একটা কাপড়ের ব্যাগ ছিল। সেই ব্যাগে ছিল একটা লুঙি আর একটা পাঞ্জাবি। সঙ্গে ছিল ক্যাশ আটশ পচিশ টাকা। টাকাটা এনেছিলেন মায়ের গলার চেইন বিক্রি করে। আর দেখ আজ তার অবস্থা। শুনেছি বড় সাহেব না-কি আস্ত একটা দ্বীপ কিনবেন। একটা কেন, চার-পাঁচটা দ্বীপ কেনাও তার কাছে কোনো বিষয় না।
মনজু ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। রহমতুল্লাহ বললেন, পাক কোরান মজিদে একটা আয়াত আছে, সেখানে আল্লাহপাক বলেছেন– আমি যাহাকে দেই তাহাকে কোনো হিসাব ছাড়াই দেই। আবার যাহাকে দেই না। তাহাকে কিছুই দেই না। ইহা আমার ইচ্ছা। নাপাক মুখে কোরান মজিদের আয়াত বলেছি, বিরাট গুনাহর কাজ করেছি। আল্লাহগো, বান্দাকে মাফ করা। মনজু, তোমার কাছে সিগারেট আছে? থাকলে একটা সিগারেট দাও। নেশার সময় সিগারেটটা ভালো লাগে।
মনজু সিগারেট দিল। রহমতুল্লাহ আয়েশ করে সিগারেটে টান দিয়ে বললেন- আল্লাহপাক যে বলেছেন যাহাকে দেই না তাহাকে কিছুই দেই না— এটা অতি সত্যি কথা। তোমার আমার কথাই বিবেচনা কর। সত্যি না?
মনজু বলল, জ্বি সত্যি।
মাতালের জ্ঞানী জ্ঞানী কথা শুনতে ভালো লাগছে না। তারপরেও শুনতে হবে। মাতালরা অন্যের কথা শুনতে চায় না। নিজের কথা বলতে চায়। মনজু!
জি।
তোমার জন্যে একটা সংবাদ আছে। সংবাদটা ভালো না মন্দ বুঝতে পারছি না। অনেক মন্দ সংবাদও সূক্ষ্মভাবে বিবেচনা করলে দেখা যায় সংবাদটা আসলে মন্দ না, ভালো। আবার অনেক ভালো সংবাদ ঠিকমতো বিবেচনা…।
সংবাদটা কী বলেন।
রহমতুল্লাহ সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন— ম্যাডাম তোমাকে আজ রাতেই চলে যেতে বলেছেন। খাওয়া-দাওয়া কর, তারপর চলে যাও। তোমার কয়েক দিনের পাওনা বেতন আমার কাছ থেকে নিয়ে যাবে। তাড়াহুড়ার কিছু নাই। রাত এগারোটার সময় গোট বন্ধ হবে। গোট বন্ধ হবার আগে আগে চলে যাবে।
মনজু বিড়বিড় করে বলল, ভাইজানের সঙ্গে কি একবার দেখা করা যাবে?
রহমতুল্লাহ সিগারেটের ছাই টোকা দিয়ে ফেলতে ফেলতে কঠিন গলায় বললেন, না।
রুনুদের বাসায় রাতের খাবার নটার আগেই শেষ হয়ে যায়। ইকবাল সাহেব রাত সাড়ে দশটায় একটা ঘুমের ট্যাবলেট খান। ঘুমের ট্যাবলেট খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিছানায় যেতে নেই। ত্ৰিশ মিনিট অপেক্ষা করার নিয়ম। এই ত্ৰিশ মিনিট তিনি মেয়ের সঙ্গে গল্প করেন। গল্প করতে খুব ভালো লাগে। মেয়েটা মাঝে মাঝে মাথা ঝাকায়, তখন বেণী করা চুল মুখের উপর এসে পড়ে। এই দৃশ্যও দেখতে ভালো লাগে।
আজও রুনুর সঙ্গে গল্প করতে এসেছেন। গল্প জমছে না। রুনু চোখ-মুখ শক্ত করে বসে আছে। প্রশ্ন করলে কাটা কাটা জবাব দিচ্ছে। ইকবাল সাহেব চিন্তিত গলায় বললেন, তোর শরীর খারাপ না-কি রে?
রুনু বলল, না।
ইকবাল সাহেব বললেন, দেখে তো মনে হচ্ছে শরীর খারাপ। চোখ লাল। দেখি কাছে আয়, কপালে হাত দিয়ে জ্বরটা দেখি।
রুনু বলল, জ্বর দেখতে হবে না। আমার জ্বর আসে নি। শরীর ঠিক আছে।
তাহলে কি মন খারাপ?
মনও ঠিক আছে। আমার তোমাদের মতো হুটহাট করে মন খারাপ হয় না।
তোদের বেড়ানো কেমন হলো শুনি। মনজুর বসের ছেলে না-কি নিজেই আমাদের বাসায় এসেছিলেন? তোর মার কাছে শুনলাম ছেলে অসম্ভব ভদ্ৰ, অসম্ভব বিনয়ী। আবার না-কি খুবই সুন্দর?
রুনু বলল, বাবা, উনি ভদ্র হলেও আমাদের কিছু যায় আসে না। অভদ্র হলেও আমাদের কিছু যায় আসে না।
ইকবাল সাহেব চিন্তিত চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। সে এরকম করছে কেন বুঝতে পারছেন না। তিনি আলাপ চালিয়ে যাবার জন্যে বললেন, তোরা সারাদিন কী করলি?
রুনু বলল, নৌকায় করে বুড়িগঙ্গায় ঘুরলাম। যেখানে নৌকাড়ুবি হয়ে ঘসেটি বেগম মারা গিয়েছিলেন, উনি সেই জায়গাটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করলেন। খুঁজে পাওয়া গেল না।
ইকবাল সাহেব বললেন, ঘসেটি বেগমটা কে?
নবাব সিরাজদ্দৌলার খালা। বাবা শোন, আমার কথা বলতে ভালো লাগছে। না। তোমার আধাঘণ্টা নিশ্চয় পার হয়েছে। ঘুমুতে যাও।
তুই কী করবি?
আমি পড়াশোনা করব। আজ সারারাত পড়ব। দিনে বেড়াতে গিয়ে যে সময়টা নষ্ট করেছি, সেটা কাভার করব।
ভোরে উঠে পড়াশোনা করা ভালো। রাতের ঘুমের পর ব্রেইন রেষ্টে থাকে। সকালবেলার পড়াটা মনে থাকে। আমি সারাজীবন এইভাবে পড়েছি।
রুনু বিরক্ত গলায় বলল, তুমি সারাজীবন এইভাবে পড়ে তেমন কিছু করতে পার নি বাবা। মেট্রিকে সেকেন্ড ডিভিশন, ইন্টারমিডিয়েটে সেকেন্ড ডিভিশন, বিএতে থার্ড ক্লাস। আর আমাকে দেখা- আমি আমার মতো পড়াশোনা করে মেট্রিকে ছেলেমেয়ে সবার মধ্যে থার্ড হয়েছি। ইন্টারমিডিয়েটে আরো ভালো করব।
ইকবাল সাহেব দুঃখিত গলায় বললেন, অহঙ্কার করা ঠিক না মা। আল্লাহপাক যে অহঙ্কার করে তাকে পছন্দ করেন না। এই বিষয়ে রসুলুল্লাহর একটা হাদিস আছে। নবী-এ-করিম বলেছেন…
রুনু বাবাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, আমার এখন হাদিস শুনতে ইচ্ছা করছে। না। আর আমি অহঙ্কার করেও কিছু বলি নি। তোমার কথাবার্তা শুনে রাগ করে বলেছি।
রাগ করার মতো কী বললাম?
বাবা তুমি ঘুমুতে যাও। প্লিজ। আমি এখন পড়াশোনা শুরু করব।
ইকবাল সাহেব মন খারাপ করে উঠে পড়লেন। মেয়ের সঙ্গে ত্ৰিশ মিনিট সময় তার খুব ভালো কাটে। আজ রুনুর কী হয়েছে কে জানে! একবার মাথা পর্যন্ত ঝাকায় নি।
শায়লা ফ্রাক্স ভর্তি চা এনে মেয়ের টেবিলে রাখলেন। আইসক্রিমের খালি প্লাস্টিকের বাক্সে কয়েকটা পাতলা রুটি। রুনুর স্বভাব হচ্ছে, রাত জেগে বই হাতে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পড়বে। মাঝে মাঝে চায়ে ভিজিয়ে রুটি খাবে। রাত জেগে পড়লে তার খুব ক্ষিধে পায়।
ভালো না? তোর বাবা বলছিলেন।
রুনু বলল, মেজাজ ঠিক আছে।
শায়লা বললেন, নৌকাভ্রমণে আজ তোরা কী কী করলি শুনি।
রুনু বলল, কয়েকবার তো শুনেছ।
শায়লা বললেন, আমি কই শুনলাম?
রুনু বলল, কী শুনতে চাও জিজ্ঞেস করো, আমি এক এক করে বলছি।
দুপুরে খাওয়া-দাওয়া কোথায় করলি?
মনজু ভাই প্যাকেটে করে খাওয়া নিয়ে গিয়েছিলেন।
কী খাওয়া?
জানি না। কী খাওয়া। মনে নেই।
শায়লা মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। মেয়ে চোখ-মুখ শক্ত করে বসে जा6छ।
শায়লা বললেন, তুই রেগে আছিস কেন রে মা?
রুনু হতাশ গলায় বলল, আমি কেন রেগে আছি নিজেও জানি না।
শায়লা বললেন, তোর তো অনেক বুদ্ধি। তুই না জানলে কে জানবে?
রুনু বলল, আমার রাগ উঠেছে মনজু ভাইয়ের উপর।
শায়লা বিস্মিত হয়ে বললেন, সে কী করেছে?
রুনু বলল, তার বসের ছেলের দিকে তাকিয়ে সারাক্ষণ তেলতেলা হাসি দিয়েছে। চাকরটাইপ হাসি। চাকরি নিয়ে সে বড় বড় কথা বলে, আমার ধারণা তার আসল চাকরি হলো, সে বসের ছেলের অ্যাসিসটেন্ট। জুতা ব্রাশ করে দেয়। ব্যাগে করে তার জন্যে পানির বোতল নিয়ে পেছনে পেছনে হাটে। রোদে বের হলে মাথায় ছাতা ধরে।
শায়লা বললেন, চুপ কর তো!
রুনু বলল, আচ্ছা যাও, চুপ করলাম। মা শোন, মনজু ভাইয়ের সঙ্গে তুমি আমার বিয়ে দেবার পায়তারা করছি— এটা দয়া করে করবে না। আমি চাকর শ্রেণীর কাউকে বিয়ে করব না। বিয়ে যে করতেই হবে এমন তো কথা না। আমি ঠিক করেছি। বিয়েই করব না।
শায়লা খানিকটা ভীত গলায় বললেন, রুনু, তোর শুভ্ৰ নামের ছেলেটাকে খুব মনে ধরেছে। তাই না?
রুনু মার দিকে কঠিন চোখে তাকাল। হয়তো কঠিন কোনো কথাও বলত, তার আগেই দরজার কলিংবেলের শব্দ হলো। রুনু সহজ গলায় বলল, আমার ধারণা মনজু ভাই এসেছে। আমি উঠতে পারব না। মা, তুমি দরজা খুলে দাও।
মনজুই এসেছে। তার গায়ে নতুন কেনা হালকা সবুজ রঙের হাফশার্ট। পায়ে নতুন জুতা। সঙ্গে সুটকেস। তার মুখ হাসি হাসি। রুনু বলল, আপনি কোত্থেকে?
মনজু আনন্দিত ভঙ্গিতে বলল, আছে ঘটনা আছে। বিস্তারিত বলব। তার আগে চা খেতে হবে। কড়া চা। ডাবল পাত্তি। হেভি সুগার।
শায়লা খুশি মনে চা বানাতে গেলেন। মনজুকে দেখে হঠাৎ তার মন ভালো হয়ে গেছে। বুড়িগঙ্গায় কী কী ঘটনা ঘটেছে এখন বিস্তারিত শোনা যাবে। মনজু রুনুর দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি আছ কেমন?
রুনু বলল, আমি ভালোই আছি। আপনি মনে হয় ভালো নেই। সারাক্ষণ নকল হাসি হাসছেন।
মনজু বলল, নকল হাসি হাসব কেন? দুঃখের হাসি হাসছি। বড় সাহেব বঙ্গোপসাগরে একটা দ্বীপ কিনেছেন। আমার পোস্টিং হয়েছে সেখানে। দ্বীপে বাড়িঘর করা, গাছ লাগানো- সব ব্যবস্থা করতে হবে। অন্য কাউকে পুরো দায়িত্ব দিতে স্যার ভরসা পাচ্ছেন না। যেতে হচ্ছে আমাকেই। সমুদ্র পার হতে হবে, ভয়ে কলিজা পানি হয়ে যাচ্ছে। ভয়ের চোটে আসল হাসি নকল হয়ে গেছে।
রুনু বলল, পুরো দায়িত্ব আপনার একার?
আরে না, আমার সঙ্গে ষোলজন স্টাফ। আমরা প্রথম দল। পরে আরো লোকজন যাবে। তুমি এইভাবে কেন হাসছ? আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না?
রুনু সহজ গলায় বলল, না।
মনজু আহত গলায় বলল, তোমার ধারণা আমি যা বলছি সবই ভুয়া?
রুনু বলল, হ্যাঁ। আমার ধারণা আপনার চাকরি নট হয়ে গেছে। ওরা আপনাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। আপনার কোথাও যাবার জায়গা নেই বলে আপনি আমাদের এখানে বিছানা বালিশ নিয়ে উঠেছেন।
মনজু বলল, তুমি আমার একটা সত্যি কথাও বিশ্বাস কর না- এটা খুবই আশ্চর্যজনক ব্যাপার। তোমাদের সঙ্গে শেষ দেখা করতে এসেছি। আজ রাত একটার সময় আমাদের লঞ্চ ছাড়বে ভোলার দিকে। সকাল দশটায় লঞ্চ ভোলায় পৌঁছবে। সেখান থেকে সমুদ্রের অবস্থা বিবেচনা করে আমরা রওনা হবো মনপুরার দিকে।
রুনু বলল, আজ রাতেই রওনা হবেন?
মনজু বলল, অবশ্যই। আমার পুরো স্টাফ চলে গেছে। আমি চা-টা খেয়েই রওনা দেব।
চা শেষ করে মনজু সত্যি সত্যি উঠে দাঁড়াল। রুনু বলল, বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির মধ্যে যাবার দরকার কী! সকালে যান। রাতটা থেকে যান।
মনজুকে দেখে মনে হচ্ছে কথাটা তার মনে ধরেছে। সে তাকাল শায়লার দিকে। শায়লা বললেন, থেকে যাও না। মনজু তাকাল রুনুর দিকে। রুনুর মুখে চাপা হাসি। মনজু বলল, লঞ্চ একটার সময় ছাড়বে। সব দায়িত্ব আমার উপর। আমি থাকি কীভাবে? ঝড় হোক বৃষ্টি হোক আমাকে যেতেই হবে। রুনু শোন, দ্বীপের ভেতর পড়ে থাকব, এক দুই বৎসর তোমাদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকবে না। দ্বীপে তো পোস্টাপিস নেই যে চিঠিপত্র লিখব। ভালো থেকে। তবে দ্বীপে থাকতে যদি অসহ্য লাগে সব ছেড়ে-ছুড়ে চলে আসতে পারি।
বাইরে ভালোই বৃষ্টি হচ্ছে। রাস্তায় পানি জমে গেছে। মনজু পানিতে ছপছপ শব্দ করে এগুচ্ছে। তার সুটকেসটা হালকা। সুৰ্যটকেসে তেমন কিছুই নেই। সেই হালকা সুটকেসটা এখন হাতে খুব ভারী লাগছে। ইচ্ছা করছে সুটকেসটা রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দিতে। ঝাড়া হাত-পা হলে হাঁটতে সুবিধা।
চল্লিশ মিনিটের মাথায় মনজু কাকভেজা হয়ে ফিরে এসে জানাল দুৰ্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার জন্যে লঞ্চ আজ রাতে ছাড়বে না বলে সে চলে এসেছে। রুনু খিলখিল করে হাসছে। শায়লা বিরক্ত গলায় বললেন, তুই এরকম হাসছিস কেন? এই আবহাওয়ায় লঞ্চ ছাড়বে কেন? হাসি থামা। রুনু হেসেই যাচ্ছে। চেষ্টা করেও হাসি থামাতে পারছে না।
রাত প্ৰায় বারোটা। কিছুক্ষণ আগেই মোতাহার হোসেন ফিরেছেন। তার মন অস্বাভাবিক ভালো। জাপানি কোম্পানি টাকাশিবোর সঙ্গে পাঁচ বছর মেয়াদি একটা কন্ট্রাক্টে তিনি সাইন করেছেন। টাকাশিবোর তিনজন ডিরেক্টরের একজন এই উপলক্ষে ঢাকায় এসেছিলেন। মোতাহার হোসেন তাকে আজকের শুভদিন মনে রাখার জন্যে কিছু উপহার দিয়েছেন। মি. সামা ওহারার উপহার খুবই পছন্দ হয়েছে। তিনি উচ্ছসিত গলায় বলেছেন, তিনি তার জীবনে এত সুন্দর উপহার পান নি। তিনি চিন্তিত এত সুন্দর উপহার দেশে কীভাবে নিয়ে যাবেন। এয়ারপোটেই আটকে দেবে।
মোতাহার হোসেন হাসতে হাসতে বলেছেন, উপহার দেশে নিয়ে যাবার ব্যাপারে আপনার চিন্তা করতে হবে না। যে উপহার দিয়েছে তারই দায়িত্ব উপহার পৌছে দেয়া। জাপানি ভদ্রলোক আনন্দে অভিভূত হয়ে দুবার কুর্নিশের মতো মাথা নিচু করলেন। জাপানিরা জাতি হিসেবেই ভদ্র।
উপহার দুটির একটি হলো কষ্টিপাথরের শিবমূর্তি। আরেকটি হচ্ছে, মাথাসহ রয়েল বেঙ্গল টাইগারের চামড়া।
মোতাহার হোসেন রাত জাগেন না। আজ তার মনটা ভালো। জাপানের এই ডিলটা হবার কথা ছিল না। সরকারের এক মন্ত্রী পুরোটাই গুছিয়ে ফেলেছিলেন। শেষের দিকে এসে সেই মন্ত্রী মোতাহার হোসেনের প্যাচে ধরাশায়ী হয়েছেন। এমনই ধরাশায়ী যে তার মন্ত্রিত্ব থাকে কি-না তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। দেশের তিনটি প্রধান সংবাদপত্রে মন্ত্রীর দুনীতিবিষয়ক এমন কিছু সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে- যা পাশ কাটানো সম্ভব না। সেই মন্ত্রী আজ সন্ধ্যাবেলায় মোতাহার হোসেনের কাছে লোক পাঠিয়েছেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে আজ রাতেই তার সঙ্গে দেখা করতে চান। যত রােতই হোক, তার কোনো সমস্যা নেই। মোতাহার হোসেন যেখানে বলবেন, তিনি সেখানেই দেখা করবেন।
মোতাহার হোসেন জানিয়েছেন, তার শরীর খুবই খারাপ। ডাক্তারের নির্দেশে তিনি বিছানাতেই বন্দি। একটু সুস্থ হলে তিনি নিজেই দেখা করবেন।
শুভ্রর ঘরে বাতি জুলছিল। মোতাহার হোসেন ধোয়াঘর থেকে সিগারেট শেষ করে ছেলের ঘরে উঁকি দিলেন। ছেলের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করতে ইচ্ছা করছে।
শুভ্ৰ বিছানায় পদ্মাসন হয়ে বসে আছে। তার চোখ বন্ধ। মোতাহার হোসেন আনন্দিত গলায় বললেন, Hello young man.
শুভ্র চোখ মেলতে মেলতে বলল, Hello oldman and the sea.
মোতাহার হোসেন বললেন, ধ্যান করছিস না-কি?
শুভ্র বলল, হ্যাঁ। আজ আষাঢ়ি পূর্ণিমা তো…
আষাঢ়ি পূর্ণিমায় ধ্যান করতে হয় না-কি?
এই দিন গৌতম বুদ্ধ গৃহত্যাগ করেছিলেন, কাজেই ভাবলাম তাঁর স্টাইলে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকি। উনি বোধিবৃক্ষের নিচে পদ্মাসনের ভঙ্গিতে বসতেন। আমি কম্পিউটারের নিচে পদ্মাসনে বসেছি।
মোতাহার হোসেন ছেলের পাশে বসতে বসতে বললেন, গৌতম বুদ্ধ ঝড়বৃষ্টির রাতে ঘর ছাড়লেন?
শুভ্র বলল, উনি ফকফকা জোছনায় ঘর ছেড়েছিলেন। সমস্যা হচ্ছে আমাদের দেশে। এই দেশে আষাঢ় মাসের পূর্ণিমাতে বৃষ্টি হবেই। বাবা, কফি খাবে? কফি বানিয়ে দেই?
দে।
কীভাবে কফি বানাব একটু দেখ বাবা। চোখ বন্ধ করে কফি বানোব। যাতে অন্ধ হয়ে যাবার পর আমার আর কোনো সমস্যা না হয়।
মোতাহার হোসেন কিছু বললেন না। তীক্ষ্ণ চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার চোখ বন্ধ। সে খুব স্বাভাবিকভাবেই কফি বানাচ্ছে। শুভ্র বলল, বাবা, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে- তুমি খুব আনন্দিত। কোনো কারণ আছে?
মোতাহার হোসেন বললেন, কারণ আছে। বুদ্ধির খেলায় একজনকে হারিয়ে দিয়েছি। বুদ্ধিমান কাউকে বুদ্ধির খেলায় হারাতে পারলে সবার আনন্দ হয়। আমার একটু বেশি হয়।
শুভ্র বলল, বুদ্ধির খেলায় আমাকে হারাতে পারবে?
মোতাহার হোসেন কফিতে চুমুক দিতে দিতে বললেন, চেষ্টা করে দেখতে পারি।
শুভ্র বলল, তোমার সঙ্গে বুদ্ধির খেলা খেলতে যাওয়া ঠিক হবে না। তুমি হেরে গিয়ে মনে কষ্ট পাবে। কাউকে কষ্ট দিতে আমার ভালো লাগে না।
মোতাহার হোসেন বললেন, তুই এত নিশ্চিত কীভাবে হচ্ছিস যে আমি হেরে যাব?
শুভ্র বাবার গায়ে হাত রেখে শান্ত গলায় বলল, বাবা, আমার অনেক বুদ্ধি।
অনেক বুদ্ধি?
হ্যাঁ। বাবা, তুমি শুধু শুধু কফি খেয়ে আরাম পাচ্ছ না। এক কাজ কর সিগারেট ধরাও। সিগারেটের সঙ্গে কফি খাও।
মোতাহার হোসেন বললেন, তোর মা যদি দেখে তোর ঘরে বসে সিগারেট খেয়ে ঘর গান্ধা করে ফেলেছি, তাহলে খুব রাগ করবে।
শুভ্র বলল, মা দেখতে আসবে না। তাঁর মাথা ধরেছে। মা দরজা-জানালা বন্ধ করে শুয়ে আছে।
মোতাহার হোসেন সিগারেট ধরালেন। তিনি ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাকে হঠাৎ সামান্য চিন্তিত মনে হচ্ছে। অথচ চিন্তিত হবার মতো কিছু ঘটে নি।
জাহানারার ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ। এতক্ষণ এসি চলছিল। এসির শব্দে তার মাথার যন্ত্রণা আরো বেড়ে যাচ্ছে দেখে এসি বন্ধ করা হয়েছে। ঘর অন্ধকার। বাথরুমে বাতি জ্বলিয়ে রাখা হয়েছে। দরজার ফাঁক দিয়ে সেই আলো খানিকটা ঘরে আসছে। জাহানারা কড়া ঘুমের ওষুধ খেয়েছেন। তাতে কোনো লাভ হচ্ছে না। ঘুম আসছে না। জাহানারার মাথার কাছে সকিনা বসে আছে। সকিনার সামনে বড় একটা বাটিতে বরফ মেশানো পানি। সকিনা নিজের হাত সেই পানিতে ড়ুবিয়ে হাত ঠাণ্ডা করছে। সেই ঠাণ্ডা হাত দিয়ে জাহানারার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। জাহানারা পাশ ফিরলেন। বাথরুম থেকে আসা আলো তাকে কষ্ট দিচ্ছে। ঘর পুরোপুরি অন্ধকার করলে হয়তো একটু আরাম লাগত। কিন্তু তিনি অন্ধকার সহ্য করতে পারেন না। ঘর অন্ধকার করলেই তার কাছে মনে হয় তিনি কবরে চলে গেছেন।
সকিনা!
জি মা।
শুভ্ৰ কি এখনো তার বাবার সঙ্গে গল্প করছে?
জি মা।
থাপ্পড় খাবে। তুমি তো আমার ঘরে বসে আছ। এখান থেকে বুঝলে কীভাবে? তুমি কি পীর-ফকির হয়ে গেছ? যাও দেখে এসে বলে।
সকিনা দেখে এসে বলল, এখন দুজন গল্প করছে।
জাহানারা বললেন, কী নিয়ে গল্প করছে?
সকিনা বলল, আমি শুনি নি মা। দেখেই চলে এসেছি। আড়াল থেকে শুনে আসব?
জাহানারা বললেন, দরকার নেই। তুমি আরো বেশিক্ষণ হাত পানিতে ড়ুবিয়ে রাখবে। হাত ঠাণ্ডা হচ্ছে না। গরম হাতে মাথা হাতীচ্ছ কেন?
সকিনা বলল, জ্বি আচ্ছা মা।
জাহানারা বললেন, তুমি কি জানো আমার ছেলে আমাকে পছন্দ করে না?
সকিনা বলল, এটা ঠিক না মা।
জাহানারা বললেন, মুখের উপর কথা বলবে না। আমি কী বলছি আগে শুনবে। হুটহাট কথা আমার পছন্দ না।
জি আচ্ছা।
আমার ছেলে যে আমাকে পছন্দ করে না- এটা আমার আজকের আবিষ্কার না। আমি টের পাই এক যুগ আগে। এক যুগ কী জানো?
জানি।
বলো এক যুগ কী?
বারো বছরে এক যুগ।
আমি বারো বছর আগে প্রথম টের পাই। শুভ্রর কাছে একটা কাক আসত। কাকটা হঠাৎ একদিন আসা বন্ধ করল। এতে শুভ্রর মন খুব খারাপ হয়ে গেল। আমি তখন শুভ্রর মন ভালো করার জন্যে তাকে একটা ময়না পাখি হালুয়াঘাট থেকে আনিয়ে দিলাম। ময়না পাখিটাকে আগেই কথা শেখানো হয়েছিল। সে বলত— এই শুভ্ৰ! এই। সুন্দর একটা খাঁচায় করে পাখিটা তাকে দিলাম। শুভ্র সেই দিনই সন্ধ্যাবেলা পাখিটা ছেড়ে দিল।
সকিনা নিচু গলায় বলল, পাখিটাকে খাঁচায় বন্দি দেখে ভাইজান মনে কষ্ট পেয়েছিলেন।
জাহানারা বললেন, যা বোঝা না তা নিয়ে কথা বলবে না। পাখিটা আমি তাকে দিয়েছি বলেই সে ছেড়ে দিয়েছে। পাখিটা যদি তার বাবা দিত, তাহলে সে যত্ন করে রাখত।
সকিনা বলল, মা, কাঁদবেন না।
জাহানারা রাগী গলায় বললেন, আমি কাঁদছি, তোমাকে কে বলল ফাজিল মেয়ে?
জাহানারা শব্দ করেই কাঁদছেন। কাঁদতে কাঁদতেই বললেন, সকিনা, তুমি দেখে এসো, এখনো তারা গল্প করছে কি-না।
মোতাহার হোসেন এতক্ষণ চেয়ারে বসেছিলেন। এখন চেয়ার ছেড়ে খাটে উঠে এসেছেন। পিতা-পুত্র দুজনই খাটে। শুভ্ৰ আগের মতোই পদ্মাসনের ভঙ্গিতে বসেছে। মোতাহার হোসেন খাটের মাথায় হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসেছেন। বাইরে ঝুমঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে ছেলের সঙ্গে গল্প করতে তার বেশ ভালো লাগছে। মোতাহার হোসেন বললেন, তোর মা কাল তোকে নিয়ে কী একটা উৎসব না-কি করবে?
শুভ্র বলল, হ্যাঁ কাল উৎসব। জন্মদিন পালন করা হবে।
মোতাহার হোসেন বললেন, জন্মদিনে তোকে কী উপহার দেয়া হবে তুই কি জানিস?
শুভ্র বলল, জানি না, তবে অনুমান করতে পারি।
অনুমান কর।
আমি একবার মাকে আমার স্বপ্নের কথা বলছিলাম। একা রবিনসন ক্রুশোর মতো একটা দ্বীপে থাকব। তখন লক্ষ করেছি। মার চোখ চকচক করে উঠেছে। সেখান থেকে ধারণা করছি, মা হয়তো আমাকে একটা দ্বীপ দেবে। মনে হয় দ্বীপটিা কেনা হয়েছে। যে কারণে তাড়াহুড়া করে মা জন্মদিনের উৎসব করছে। বাবা, দ্বীপ কি তুমি কিনেছ?
মোতাহার হোসেন বললেন, তোর বুদ্ধি ভালো। শুধু বুদ্ধি বলা ঠিক হবে না। বুদ্ধি এবং চিন্তা করার ক্ষমতা ভালো। অনেকের বুদ্ধি থাকে। সেই বুদ্ধি কাজে খাটিয়ে চিন্তা করার ক্ষমতা থাকে না।
শুভ্র বলল, আমার তো তেমন কোনো কােজ নেই বাবা। আমি বেশিরভাগ সময় কাটাই বিছানায় শুয়ে শুয়ে। অন্ধ হবার জন্যে অপেক্ষা করা। অপেক্ষা করতে করতে নানান বিষয় নিয়ে ভাবি। গুছিয়ে চিন্তা করার ক্ষমতা হয়তো এইভাবেই ডেভেলপ করেছে। একটা বিশেষ ভাবনার কথা তোমাকে বলল?
বল।
শুভ্ৰ শান্ত গলায় বলল, মা যে আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে— এটা নিয়ে আমি প্রায়ই ভাবি। কোনো মা তার সন্তানকে এত ভালোবাসবে না। কারণ সে জানে এই সন্তানটি তার। সে তারই অংশ। তাকে এত ভালোবাসার কিছু নেই। যখন কোনো মা উন্মাদের মতো তার সন্তানকে ভালোবাসবে, তখন বুঝতে হবে এই সন্তানটি আসলে তার না। সে প্ৰাণপণ চেষ্টা করছে সন্তানটিকে নিজের করে নিতে। আমার কী মনে হয় জানো বাবা?
মোতাহার হোসেন বললেন, কী মনে হয়?
শুভ্র আগ্রহের সঙ্গে বলল, আমার মনে হয় প্রথম ছেলেটি জন্মের পরপর মারা যাওয়ায় মা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরেরটির মৃত্যুর পর তাঁর অসুস্থতা প্রচণ্ড বেড়ে গেল, তখন তুমি কোনো জায়গা থেকে আমাকে যোগাড় করে মার কাছে দিয়েছিলে।
মোতাহার হোসেন শান্ত গলায় বললেন, তোর এরকম মনে হয়?
শুভ্র বলল, হ্যাঁ। বাবা, আমি যা বলছি তা কি ঠিক?
মোতাহার হোসেন জবাব দিলেন না। তীক্ষ্ণ চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
শুভ্র বলল, তোমাদের দুজনের সঙ্গে আমার কোনোরকম মিল নেই। চিন্তায় ভাবনায় কোনো কিছুতেই না। আমি জেনেটিকেলি তোমাদের চেয়ে আলাদা। কফি খাবে? আরেক কাপ কফি বানিয়ে দেই?
মোতাহার হোসেন ক্লান্ত গলায় বললেন, না।
শুভ্র বলল, গল্প থাক। এখন এসো বুদ্ধির খেলা খেলি। বাবা, তুমি খেলবে?
মোতাহার হোসেন বললেন, না।
শুভ্র বলল, তোমার বোধহয় ঘুম পাচ্ছে। ঘুমিয়ে পড়। রাত অনেক হয়েছে।
মোতাহার হোসেন জবাব দিলেন না, আরেকটা সিগারেট ধরালেন।
শুভ্র বলল, বাবা, আমার কথা শুনে তোমার কি মনে হচ্ছে। আমি খুব কষ্টে আছি?
মোতাহার হোসেন বললেন, মনে হচ্ছে না।
শুভ্র বলল, আমি কষ্টে নেই। নিজের ব্যাপারটা নিয়ে আমি যখন ভাবি তখন আমার কাছে খুব ইন্টারেস্টিং লাগে।
ইন্টারেস্টিং কোন অৰ্থে?
শুভ্র বাবার কাছে এগিয়ে এলো। আগ্রহ নিয়ে বলল, প্রকৃতি নানান পরীক্ষানিরীক্ষা করে অনেক চড়াই-উৎরাই পার করে মানুষ নামক ভয়ঙ্কর বুদ্ধিমান একদল প্রাণী তৈরি করেছে। প্রকৃতি কেন এই কাজটা করেছে অতি বুদ্ধিমান মানুষ কিন্তু এখনো তা বের করতে পারে নি। মানবজ্জাত তার অস্তিত্বের কারণ না জেনেই এতদূর এসেছে, আরো অনেক দূর যাবে। তাকে ঘিরে থাকবে প্রচণ্ড সংশয়। সে কে? সে কোথা থেকে এসেছে? সে কোথায় যাচ্ছে? এই সংশয়ের তুলনায় আমার ব্যক্তিগত সংশয়টা কি খুবই তুচ্ছ না?
মোতাহার হোসেন বললেন, তোর মতো চিন্তা করলে হয়তো তুচ্ছ।
শুভ্র বলল, নিজের কথা ভেবে আমার মানসিকতায় কিছু পজেটিভ পরিবর্তন হয়েছে। উদাহরণ দিয়ে বুঝাই। আমি যখন সকিনাকে দেখি তখন তার উপর খুব মায়া লাগে। তাকে খুবই আপন লাগে। আমার মনে হয় সুলেমান চাচা যেমন অতি দরিদ্র কোনো ঘর থেকে সকিনাকে নিয়ে এসেছিলেন, আমাকেও নিশ্চয়ই সেরকম কোনো পরিবার থেকে এনেছেন। বাবা, মানুষের প্রতি আমার মমতা যে কী পরিমাণ বেড়েছে সেটা আমি জানি। আমি তোমাদের সত্যি ছেলে হলে এই মমতা তৈরি হতো না।
শুভ্ৰ চুপ করল। মোতাহার হোসেন ক্লান্ত গলায় বললেন, কথা শেষ, না আরো কিছু বলবি?
শুভ্র বলল, আমার মধ্যে আরেকটা পরিবর্তন হয়েছে, সেটাও বলি- গৌতম বুদ্ধের মতো সবকিছু ছেড়ে-ছুড়ে গৃহত্যাগ করতে আমার যেমন একটুও খারাপ লাগবে না, আবার আস্ত একটা দ্বীপ নিয়ে বাস করতেও খারাপ লাগবে না। বাবা তুমি বলো, মানসিকতার এই ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং না?
মোতাহার হোসেন ছেলের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে শুভ্ৰকে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন, Do you want to know about your parents?
শুভ্র সঙ্গে সঙ্গে বলল, না।
মোতাহার হোসেন বললেন, না কেন?
শুভ্র বলল, তোমরা দুজন যে ভালোবাসা আমাকে দিয়েছ সেটা তোমাদের ফেরত দিতে চাই। আমি যে তোমাকে কী পরিমাণে ভালোবাসি সেটা তুমি জানো?
মোতাহার হোসেন বললেন, জানি।
শুভ্র বলল, মা জানে না। অবশ্যি এখানে আমার কিছু ত্রুটি আছে। মার প্রতি আমি এক ধরনের অবহেলা দেখাই। মা তখন দিশাহারা হয়ে যান। তার দিশাহারা ভাব দেখতে ভালো লাগে। বাবা যাও, ঘুমুতে যাও।
মোতাহার হোসেন বললেন, তুই একটু কাছে আয় তো!
শুভ্র বলল, কেন?
তোর হাত ধরে কিছুক্ষণ বসে থাকব। কোনো সমস্যা আছে Young man?
শুভ্র বাবার হাত ধরতে ধরতে বলল, কোনো সমস্যা নেই Old man and the sea.. বাবা, তুমি একটু হাস তো। অনেকক্ষণ হয়ে গেছে তুমি মুখ ভোঁতা করে আছে।
মোতাহার হোসেন হাসলেন। শুভ্র বলল, তুমি এখন নিজের ঘরে ঘুমুতে যাবে। আমি যাব মার ঘরে। মার অভিমান ভাঙাব।
আমাকে সঙ্গে নিয়ে চল। দেখি তোর অভিমান ভাঙাবার টেকনিক।
শুভ্র বলল, তোমাকে নেয়া যাবে না। আমার টেকনিক, গোপন টেকনিক।
রাত দুটার সময় জাহানারা বিছানায় উঠে বসলেন। সকিনার দিকে তাকিয়ে বললেন, যাও ঘুমুতে যাও।
সকিনা বলল, মা আমি থাকি, কোনো অসুবিধা নেই।
জাহানারা বললেন, তোমাকে যেতে বলছি তুমি যাও। সুবিধা অসুবিধা তোমাকে দেখতে হবে না।
সকিনা বলল, আপনার মাথার যন্ত্রণা কি একটু কমেছে?
জাহানারা বললেন, আমার মাথার যন্ত্রণা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। তোমাকে চলে যেতে বলেছি তুমি চলে যাও।
সকিনা ঘর থেকে বের হবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তার ঘরের দরজায় টোকা পড়ল। জাহানারা বললেন, কে?
শুভ্র বলল, মা আমি। ভেতরে আসি?
জাহানারা বললেন, ভেতরে আসি আবার কী! আমার ঘরে ঢুকতে তোর অনুমতি লাগবে?
শুভ্র বলল, বাতি জ্বালাই মা।
জাহানারা বললেন, জ্বালা।
শুভ্র বাতি জ্বালাল। মার সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বলল, মা, আমি কি আজ রাতে তোমার ঘরে তোমার সঙ্গে ঘুমাতে পারি?
জাহানারা উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, কী হয়েছে?
কেন জানি হঠাৎ করে ভয় লাগছে। ভূতের ভয়। ঘরের বাতি নেভানোর সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো ঘরের ভেতর কে যেন হাঁটছে।
জাহানারা বললেন, আয় শো আমার পাশে। বলতে বলতে আনন্দে জাহানারার চোখে পানি এসে গেল। শুভ্র বলল, মা তোমার মাথাব্যথাটা কি গেছে?
জাহানারা বললেন, আমার মাথাব্যথা নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। তুই শো। একটা বালিশে হবে? না-কি আরেকটা বালিশ এনে দেব?
শুভ্র বলল, মা তুমি শুয়ে থাক। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে ব্যথা কমিয়ে দিচ্ছি। জাহানারা বললেন, তোর এইসব পাগলামি আমার অসহ্য লাগে। তুই ছেলেমানুষ, তুই মাথায় হাত বুলাবি?
দেখ না পারি কি-না। মা, শোও তো।
জাহানারা সঙ্গে সঙ্গে শুয়ে পড়লেন। শুভ্ৰ মার কপালে হাত রাখতে রাখতে বলল, মা, তুমি মনজু ছেলেটাকে বিদায় করে দিয়েছ। এখন আমার দ্বীপ কে দেখবে? আমি মনে মনে ঠিক করেছিলাম দ্বীপের দায়িত্ব মনজুকে দেব। চালাক ছেলে আছে।
জাহানারা বললেন, সুলেমানকে বলে কালকে নিয়ে আসিস।
শুভ্র বলল, কাঁদছ কেন মা?
জাহানারা এতক্ষণ নিঃশব্দে কাঁদছিলেন, এবার শব্দ করে কেঁদে উঠলেন।
শুভ্র বলল, মা, তুমি আমাকে এত ভালোবাস কেন? জাহানারা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললেন, তুই পাগলের মতো কথা বলিস কেন? নিজের ছেলেকে আমি ভালোবাসব না?
শুভ্ৰ চোখ বন্ধ করল। হঠাৎ তার কাছে মনে হলো রহস্যময় প্রকৃতি কেন হোমোসেপিয়ানস তৈরি করেছে তা সে যেন অস্পষ্টভাবে বুঝতে পারছে।
ভালো একটা বই,
সেই!
Best.
শেষটায় এসে কেদেঁ ফেল্লাম কেনো কে জানে