সপ্তম অধ্যায় – ব্রহ্মা ও কামের কথোপকথন
শিবকে মোহিত করিতে প্রযত্নসম্পন্ন ব্রহ্মা এইরূপে মহামায়া-স্বরূপ বর্ণন করিয়া মদনকে পুনরায় বলিলেন,–ইতিপূৰ্বে বিষ্ণুমায়া, মহাদেব যাহাতে দারপরিগ্রহ করেন, তাহা করিতে স্বীকার করিয়াছেন। ১-২
স্মর! তিনি নিশ্চয়ই দাক্ষায়ণীরূপে জন্মগ্রহণ করিয়া মহাত্মা শম্ভুর সহ চারিণী হইবেন, একথা তিনি নিজেই বলিয়াছেন। ৩
শঙ্কর, যাহাতে দারপরিগ্রহ করিতে অভিলাষী হন, এই নিজদলবল, রতি এবং বসন্তের সহিত মিলিত হইয়া তুমিও তাহা করিতে থাক। ৪
মদন! শিব দারপরিগ্রহ করিলে আমরা কৃতকার্য হই, কেননা, তাহা হইলে এই সৃষ্টি নিশ্চয়ই অবিচ্ছিন্নভাবে চলে। ৫
মার্কণ্ডেয় বলিলেন,–হে দ্বিজশ্রেষ্ঠগণ! অনন্তর, মনোভব, মহাদেবকে মোহিত করিতে তিনি যে ভাবে চেষ্টা করিতেছিলেন, তাহা ব্রহ্মার নিকট বলিতে লাগিলেন। ৬
ব্ৰহ্মন্! আমরা শিবকে মোহিত করিতে তাহার সাক্ষাতে বা অসাক্ষাতে যে সকল কার্য করিতেছি, তাহা বলি, শ্রবণ করুন। ৭।
যখন শিব সংযতচিত্তে সমাধি অবলম্বন করিয়া থাকেন, হে লোকেশ! তখন আমি মোহকর মৃদুমন্দ সুগন্ধ শীতল পবন দ্বারা তাহাকে নিরন্তর বীজন করি। ৮
আমি স্বীয় পঞ্চবাণ এবং শরাসন গ্রহণ করিয়া তদীয়গণকে মোহিত করত তাহার সমীপ ভ্রমণ করি। ৯
তথায় আমি নিরন্তর, সিদ্ধমিথুনগণকে সুরত কার্যে ব্যাপৃত করিতেছি, সেই সমস্ত হাবভাবগণ, ক্রমে সেই সিদ্ধনরনারীগণে প্রবেশ করিতেছে। ১০
হে পিতামহ! আমি শিবসমীপে গমন করিলে তত্ৰত্য কোন্ প্রাণী, বারং বার মিথুনভাব না করিয়া থাকিতে পারে? ১১।
আমি প্রবিষ্ট হইবামাত্র তথাকার সকল প্রাণিবৃন্দই মুগ্ধ হইয়া থাকে, কেবল মহাদেব ও তাহার বৃষ মনোবিকার প্রাপ্ত হন না। ১২
যখন প্রমথপতি, হিমালয়প্রস্থে গমন করেন, বিধাতঃ! তখন আমিও রতি এবং বসন্ত সমভিব্যাহারে তথায় গমন করি। ১৩।
যখন তিনি সুমেরু পৰ্বতে মন্দরপ্রস্থে বা কৈলাস পর্বতে গমন করেন, আমিও তখন তথায় গমন করি। ১৪
যখন শিব, ক্ষণকালের জন্য সমাধি ত্যাগ করিয়া অবস্থিতি করেন, তখন আমি তাহার সম্মুখে চক্রবাক-মিথুনকে মোহিত করি। ১৫
ব্ৰহ্মন্! সেই চক্রবাক-মিথুন, হাবভাব-সম্পন্ন হইয়া অনবরত নানারঙ্গে উত্তম দাম্পত্যপরিপাটি করিতে থাকে। ১৬
হে বিধাতঃ! আমি ময়ুর-ময়ূরীবৃন্দ এবং অন্যান্য সস্ত্রীক পক্ষীদিগকেও তাহার সম্মুখে সম্মোহিত করিয়া থাকি। ১৭
যখন ময়ূরমিথুন, বিচিত্রভাবে ক্রীড়া করিতে প্রবৃত্ত হয়, তখন তাহা দেখিয়া কাহার মনে না উৎকণ্ঠা জন্মে?
তখন তাহার সম্মুখবর্তী মৃগগণ তাহার পার্শ্বে ও সম্মুখে উৎসুক ভাবে স্ব স্ব রমণীসহ উপযুক্ত ভাব প্রকাশ করিতে থাকে। ১৮
হে সৰ্ব্বলোককৃৎ! কিন্তু তাহার এমন ছিদ্র আমি কখন দেখিতে পাই না যে, তদীয় শরীরে শরক্ষেপ করিব। ২০
আমি অনেক দেখিয়া স্থির করিয়াছি; রমণীসঙ্গ ব্যতীত মহাদেবকে মোহিত করিতে সসহায়ে চেষ্টা করিয়াও সমর্থ হইব না। ২১
হে মহাভাগ! আবার বসন্ত তাঁহাকে মোহিত করিবার জন্য আপনার অনুরূপ যে কাৰ্য্য নিত্য করিতেছেন অথচ ফলদায়ক হইতেছে না; তাহা শ্রবণ করুন! ২২
যেখানে মহাদেব অবস্থিতি করেন, বসন্ত,-তথাকার চম্পক, বকুল, আম্র, বরুণ, পাটল, নাগকেশর, পুন্নাগ, কেতক, কিংশুক, বক, মল্লিকা, মাধবী, পর্ণধারা ও কুরুবকশ্রেণীকে প্রফুল্ল কুসুমে ভূষিত করেন। ২৩-২৪।
ফুল্লকমলময় সরোবরে মলয় পবন বহাইয়া শঙ্করনিকেতন যত্নসহকারে অতিশয় সদ্গন্ধযুক্ত করিয়া থাকেন। ২৫
তথায় লতা সকল ফুল্ল কুসুমশালিনী ও নবদলাঙ্কুরে মণ্ডিত হইয়া মনোহর ভাবে তরুগণকে বেষ্টন করিয়া থাকে। ২৬
সেই সুগন্ধ সমীরণ বিকম্পিত সুন্দর-কুসুমময় পাদপবৃন্দ অবলোকন করিয়া কামবশ হয় নাই, এমন মুনিও তথায় নাই। ২৭
হে লোকেশ! মহাদেবের গণ (দলবল), অমরবৃন্দ, সিদ্ধসঙ্ঘ, এবং যাহারা অত্যন্ত তপোনিষ্ঠ, তাহারাও নানাভাবে সুশোভন ক্রীড়া করিতে থাকেন। ২৮
কিন্ত শঙ্করের মোহকারণ আমরা কিছুমাত্র দেখি নাই। অণুমাত্র কাম ভাবও তাহার হয় না। ২৯
আমি এই সব দেখিয়া এবং শিবের চিত্তবৃত্তি বুঝিয়া মায়া ব্যতীত তাহাকে মোহিত করিবার চেষ্টা হইতে সম্পূর্ণরূপে নিবৃত্ত হইয়াছি। ৩০
আমি এখন আবার আপনার মুখে যোগনিদ্রার উক্তি ও তাহার প্রভাব শ্রবণ করিয়া এবং এই সকল গণ দর্শন করিয়া বোধ করিতেছি, সহায়সম্পন্ন হইলাম। আমি শম্ভুকে মোহিত করিতে আবার উদ্যম করিতেছি। ৩১
হে ত্রিলোকনাথ! যোগনিদ্রা যাহাতে শীঘ্র শিবের পত্নী হন, আপনি তদ্বিষয়ে সম্পূর্ণ যত্ন করুন। ৩২
মহেশ্বরের নিত্যসঙ্গী যম, নিয়ম, প্রাণায়াম, আসন, প্রত্যাহার, ধ্যান, ধারণা, সমাধির বিঘ্ন, এইরূপ শত শত মারগণ দ্বারাও হইবে না, ইহা আমি বুঝি। ৩৩-৩৪
তথাপি এই মারগণ যতটুকুই পারে, ততটুকু মহাদেবের যোগাঙ্গ বিঘ্ন সম্পাদন করুক। অপরের সমক্ষে ক্ষমতা প্রকাশ করিতে পারুক না পারুক তাহাতে ক্ষতি-বৃদ্ধি নাই। * ৩৫ [* ‘সমক্ষমন্যস্য ন কর্ত্তু মোজঃ” এই পাঠ বহুসম্মত। মূলের অনুবাদ এতদনুসারে হইয়াছে। “সমক্ষমপ্যস্য এই পাঠের অনুবাদ,–“অথবা ইহাঁর সমক্ষে ইহারা ক্ষমতা প্রকাশ করিতে পারিবে না।”]
সপ্তম অধ্যায় সমাপ্ত ॥ ৭