তাঁর সহপাঠী, বোর্ডিঙে পাশের সিটের ছাত্র, এরা তাঁকে সাবধান করে দিয়েছিল। কিন্তু একটু দেরি হয়ে গিয়েছে তখন। দোষ তাদেরও ছিল না, কিশোর জীবনেরও ছিল না।
সহপাঠীরা জানত না যে জীবন বুকে মঞ্জরীর ধাক্কা খেয়েছে এবং ধাক্কা খেয়েও সেইদিকেই ছুটেছে। এবং জীবনও জানত না যে, ভূপী বোস-রূপী ব্যাঘাটি মঞ্জরীর প্রত্যাশায় ওত পেতে বসে আছে। সে সময়ে সামান্য একটা কারণে অভিজাত-কুলপ্ৰদীপ ভূপী বোস মঞ্জরী ও মঞ্জরীর মায়ের উপর রাগ করে ওদিক দিয়ে যাওয়া-আসা বন্ধের ভান করে বসে ছিল। এরই মধ্যে বরাহ প্রবেশ করল।
ভূপী জীবন থেকে বয়সে বেশ ক-বছরের বড়। কিন্তু ফেল করেও জীবনের এক ক্লাস উপরে পড়ে। কাঁদী স্কুলের সর্বজনপরিচিত ভূপী। কাঁদী স্কুলে সেকালে যারাই পড়েছে তারা স্কুলে ভর্তি হওয়ার পাঁচ দিন বা সাত দিনের মধ্যেই তাকে চিনেছে। প্রথমেই চোখে পড়ত তার হেলেদুলে চলন। তারপর শুনত তার বিচিত্র বাগবিন্যাস।
—কোথায় বাড়ি রে ব্যাটাচ্ছেলে? দরিদ্র অবস্থার পাড়াগেঁয়ে ছেলেদের প্রতি এইটিই ছিল তার প্রথম প্রশ্ন।
তার চেহারা বেশভূষা এবং বাগভঙ্গিতে আগন্তুক দরিদ্র সন্তানেরা শঙ্কিত হত, একালের মত বিদ্রোহ করা তাদের পক্ষে সম্ভবপর ছিল না। কাল ছিল বিরূপ। তারা সসম্ভ্ৰমেই বলত গ্রামের নাম। তারপরই ভূপী প্রশ্ন করত—অ! কোন্ থানা র্যা? কোন্ পরগনা? কত নম্বর লাট?
তারপর বলতওইখানে আমাদের একটা লাট আছে ৫০৭ কি ৭০৫ একটা নম্বর তাতে সে লাগিয়ে দিত।
জীবন দত্তের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতে কিন্তু এই ভঙ্গিতে প্রশ্ন করে নাই ভূপী; একটু খাতির করে বলেছিল—কোথায় বাড়ি হে ছোকরা? জীবনের বলিষ্ঠ দেহ এবং বেশ ফিটফাট পোশাক দেখেই তাকে র্যা এবং ব্যাটা না বলে বলেছিল হে এবং ছোকরা।
প্রথম দিন জীবন ভড়কে গিয়েছিল, সঙ্গে সঙ্গে বিরক্তও হয়েছিল। কিন্তু সে বিরক্তি গোপন করেই বলেছিল—নবগ্রাম।
বলেই সে চলে গিয়েছিল। দন্তী নখী, শৃঙ্গীদের সান্নিধ্য পরিত্যাগই শ্ৰেয়,এই বাক্যটি স্মরণ করেছিল এবং ভূপীকে ওই দলেই ফেলেছিল। কিন্তু ভূপী ছাড়ে নাই। সে নিজেই এসেছিল এগিয়ে, দু-চার দিন পরেই একদিন বোর্ডিঙে জীবনের ঘরে এসে বলেছিল—শুনলাম নাকি ছোকরা, তুমি তামাক খাও ভাল। কই খাওয়াও দেখি! দেখি কী তামাক তুমি খাও! ভূপীর কণ্ঠস্বর রীতিমত পৃষ্ঠপোষকের কণ্ঠস্বর।
জীবন দুর্দান্ত ছিল, কিন্তু অভদ্র ছিল না। এবং জমিদারি যত কালের পুরনো হলে জমিদার বংশে পচ ধরে তাদের একখানা জমিদারি ততকালেরও পুরনো হয় নি। এবং সত্য বলতে কি, সেদিন একটু গোপন খাতিরও মনে মনে অনুভব করেছিল সে ভূপী বোসের প্রতি। বড় বংশের ছেলে, ভাল চেহারা, এমন বোলচাল, তার ওপর জীবন বিদেশী, ভূপী এখানকারই লোক, সুতরাং ওটা স্বাভাবিক ছিল। জীবন সেদিন তামাকও খাইয়েছিল। সেদিন যাবার সময় ভূপীর হঠাৎ নজর পড়েছিল জীবনের মুগুর দুটোর ওপর। একটু নেড়েচেড়ে দেখেও গিয়েছিল। হেসে নামও দিয়ে গিয়েছিল—মুদ্গর সিংহ।
ঝগড়াটা লাগল হঠাৎ।
ভূপী বোস নবকৃষ্ণ সিংহের বাড়ি থেকে বের হচ্ছে, জীবন ঢুকছে। ভূপী পান চিবুচ্ছিল, সঙ্গে বঙ্কিম, পিছনে বঙ্কিমের মা। জীবনের অনুপস্থিতিতে গরমের ছুটির মধ্যে ভূপীর সঙ্গে ওদের ঝগড়া মিটে গেছে।
জীবনের সঙ্গে একজন মুটে। তার দেশের লোক; গরমের ছুটির পর দেশ থেকে ফিরেছে। স্কুলে, আসবার সময় মস্ত আঁকায় বাগানের আম, ক্ষেতের ফুটি, কিছু তরকারি এবং খড় দিয়ে মুড়ে একটা মাছও এনেছে।
ভূপী থমকে দাঁড়িয়ে ভুরু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর হেসে বললে, কী রকম? মুদ্গর সিংহ এখানে? এ বাড়িতে।
পিছন থেকে তীক্ষ্ণ কণ্ঠের কথা ভেসে এল—উনি আমাদের সইয়ের বউয়ের বকুলফুলের বোন-পো বউয়ের বোনঝি-জামাই, আপনার লোক, সম্পর্কে আমার দাদামশাই! কী এনেছ গা দাদামশাই?
সকলের পিছন থেকে মঞ্জরী মুখে কাপড় চাপা দিয়ে হেসে সামনে এসে দাঁড়াল।
ভূপীও সঙ্গে সঙ্গে ফিরল। বললে—চল–চল—দেখে যাই দাদামশাই মুদ্গর সিংহ কী এনেছেন? নামা ঝুড়িটা।
জিনিসপত্রগুলি দেখে মুখ বেঁকিয়ে একটা আম তুলে নিয়ে দাঁতে কেটে একটু রসাস্বাদ করেই থুথু করে ফেলে দিয়ে বললে—আমড়া! আমি ভেবেছিলাম আম! কাল আমি আম পাঠিয়ে দেব। গোলাপখাস, আর কি বলে, কিষণভোগ। আমের গায়ে কাগজের টিকিটে লেখা থাকবে-কবে কখন খেতে হবে। ঠিক সেই সময়ে খাবেন কিন্তু। না হলে ঠিক স্বাদ বুঝবেন না।
ভূপী চলে গেল। মঞ্জরীর মা বললেন–এস বাবা। ভাল তো সব?
–হ্যাঁ ভাল। আমি কিন্তু চলি এখন। এই তো আসছি। বোর্ডিঙের বারান্দায় জিনিসপত্র পড়ে আছে। গাড়োয়ানকে রেখে এগুলি দিতে এসেছিলাম আমি। সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না, ভূপীর কথাগুলিতে রীতিমত ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল।
–একটু জল খেয়ে যাবে না?
–না। গাড়োয়ানটা অজ পাড়াগেঁয়ে। ভয় পাবে, আমি যাই।
কিশোর জীবন দত্ত সেদিনই ভূপীর অ্যাঁচটা অনুভব করেছিল। এবং সেই হেতুই সেদিন তার সহপাঠী বোর্ডিঙের পাশের সিটের বন্ধুটিকে সব কথা বলেছিল বাধ্য হয়ে। না বলে উপায়ও ছিল না। এত বড় মাছটা এবং এতগুলি আম ও ফুটির ওপর ছেলেদের লোভ হয়েছিল দুর্দান্ত। কোথায় কোন্ বাড়িতে এগুলি গেল জানতে তাদেরও কৌতূহলের অন্ত ছিল না। কাজেই প্রশ্নেরও বিরাম ছিল না। অবশেষে বলতে হল নাম।
বন্ধুরা শুনে শিউরে উঠল।—ওরে বাবা, গেছিস কোথায় তুই? বাঘের ঘরে ঘোঘের বাসা বাঁধতে গেছি! ও যে ভূপী বোসের মঞ্জরী।
–ভূপী বোসের মঞ্জরী?
–হ্যাঁ বাবা। ওদিকে হাত বাড়িয়ো না মানিক। হাত কেটে নেবে।
জীবন দত্ত কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে থেকে প্রশ্ন করেছিল—কথা পাকা হয়েছে কি না জান?
–না। তবে
–ব্যস। তবে দেখা যাক মঞ্জরী কার মঞ্জরী তো এখনও বাপরূপী গাছে ফুটে আছে রে। যার মুরদ থাকবে সেই পেড়ে মালা গেঁথে গলায় পরবে। আমিও জীবন দত্ত।
গাড়োয়ানের হাতেই সে মাকে একখানি গোপন পত্র পাঠালে—অবিলম্বে পঞ্চাশটি টাকা চাই। সেদিনের পঞ্চাশ টাকা আজ উনিশ শো পঞ্চাশ সালে অন্তত দু হাজার টাকা।
লাগল সংঘর্ষ।
প্রথমটা ভূপী বোস গ্রাহ্যই করে নাই। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ওই বরাহটা! বঙ্কিম অথবা মঞ্জরী দুজনের মধ্যে একজনের কাছে নিশ্চয় সেই প্রথম দিনের বরাহ-সম্বোধন-বৃত্তান্তটা শুনেছিল। এবং মনে মনে নিশ্চয়ই প্রচণ্ড কৌতুক ও পরম পরিতৃপ্তি অনুভব করেছিল। মঞ্জুরী জীবন দত্তকে দেখে বুনো শুয়োর বলেছিল বলে ভূপীও তার নামকরণ করেছিল বরাহ। আরও বলত মুদ্গর সিংহ। ওইসব নামে সে তাকে অভিহিত করত। অবশ্য আড়ালে। আর আমড়ার-স্বাদবিশিষ্ট আমের টুকরি বা কতকগুলো ফুটি কি একটা মাছকে সে মূল্যই দিত না। ওর বদলে কলমের গাছের অল্প গোটাকয়েক ল্যাংড়া কি বোম্বাই কি কিষণভোগ নামবিশিষ্ট আম এবং গণ্ডাকয়েক লিচু কি গোলাপজাম বা জামরুলের মূল্য যে বেশি এটা সে জানত। তার ওপর তার রূপ-গৌরব সম্পর্কে সে ছিল পূর্ণমাত্রায় সচেতন। কাজেই সে গ্রাহ্য করে নাই।
এদিকে জীবন নিজের পেলবরূপের অভাব পূরণ করতে হয়ে উঠল বিলাসী। বাড়িতে তার টাকার চাহিদার অঙ্ক বাড়তে লাগল। জগদ্বন্ধু মশায় বেশ একটু চিন্তিত হলেন। তবুও একমাত্র ছেলের দাবি সহজে অগ্রাহ্য করলেন না। বাপের কাছ ছাড়াও মায়ের কাছ থেকে টাকা আনাত জীবন। পুরো দাবিটা বাবাকে জানাতে সাহস করত না।
তার জন্য জীবন কখনও আক্ষেপ করেন নি। আজও করেন না।
কী আক্ষেপ? যৌবনের স্বপ্ন, নারীপ্রেমের প্রতিদ্বন্দিতা, এর চেয়ে মাদকতাময়, এর চেয়ে জীবনের কাম্য কৈশোরে আর কী আছে? শুধু কি কৈশোরে যৌবনে? সমস্ত জীবনে কোনো নারীকে যে সম্পূর্ণভাবে জয় করে জীবন ভরে পেয়েছে তার চেয়ে ভাগ্যবান কে আছে? মঞ্জরীর প্রেমের প্রতিযোগিতায় যদি জমিদারির এক আনা ছ-গঙা দু-কড়া দু-ক্রান্তি বিক্রি হয়েই যেত—তাতেই বা কী হত! তাতেও আক্ষেপ হত না তার।
তাই হয়ত যেত। বাবার কাছে টাকা না পেলে সে ধার করত। তখন তার হালচালে সেখানে রটে গিয়েছিল জীবন দত্ত ধনী বলে নয়—নামজাদা ধনীর ছেলে! সুতরাং টাকা ধার পেতে সেই আমলে তাকে কষ্ট পেতে হত না। বঙ্কিমদের বাড়িতে নিত্যনূতন মনোহারী উপঢৌকন পাঠাতে লাগল সে।
কাদীর বাজারে তখন তার নাম ছুটে গেল বাবুজী বলে। জীবন বাজারের রাস্তায় বের হলে দোকানিরা বলত-কী বাবুজী? কোনদিকে যাবেন?
খাস লালবাগের ছোঁয়াচ-লাগা কাঁদীতে আমীরি আমলের জী শব্দটা তখনও বেঁচে ছিল। কোম্পানির আমলের বাবু শব্দের সঙ্গে ওটিকে লাগিয়ে বাবুজীই ছিল ওখানকার সম্মানের আহ্বান।
জীবন বাবুজী হাসত।
ওসমান শেখ ওখানকার সব থেকে বড় মনোহারী দোকানের মালিক, তার সঙ্গে ব্যাপারটা আরও অনেকটা অগ্রসর হয়েছে। জীবন ওসমানকে বলত-চাচাজান। ওসমান বলত বাপজান। ওসমান শেখের মস্ত দোকান, দু-তিনটে শাখা। মনোহারী, জুতো, তামাক। বাকি খাতার পাতায় সসম্ভ্ৰমে জীবন বাপজানের নামপত্তন করে নিয়েছিল ওসমান চাচা। চাচা মানুষ চিনত। জীবনের প্রয়োজন না থাকলেও চাচা তাকে ডেকে বলত—বাপজান! আরে, শুনো শুনো!
–কী চাচাজান?
–আরে বাপজান আজ চার-পাঁচ রোজ তুমাকে টুড়ছি। নতুন খোশবয় এনেছি। শহরে (অর্থাৎ মুরশিদাবাদ) গেলাম, মহাজন দেখালে—দেখ ওসমান, খোশবয় দেখ। আতর ছোট হয়ে গেল। নিয়ে যাও-রাজবাড়িতে দিবা। রাজবাড়ির জন্যে নিলাম, আর তিন জমিদারবাড়ির জন্যে নিলাম, হাকিমদের জন্যে নিলাম। পরেতে বললাম আর দু শিশি! তুমার তো দু শিশি চাই আমি জানি। নিজের জন্য এক শিশি; আর
হেসে চাচা বলত—আর ই বাড়ির জন্য এক শিশি! নিয়ে যাও।
সঙ্গে সঙ্গে কাগজে মুড়ে তার হাতে তুলে দিত।
—দাম?
—সে হবে। নিয়া যাও তুমি। আর আমি রাখতে পারব নাই। ইয়ার মধ্যে ভূপী চাচা এসেছে দুদিন। ওই উকিল সাহেবের বাড়িতে দেখেছেন ই খোশবয়। বলে আমার চাই দু শিশি। দাও। আমি বলি নাই। সে বলে–জরুর আছে। আমি দোকান তল্লাশ করব। তুমি লুকায়ে রেখেছ, জীবনটারে দিবে। অনেক কষ্টে রেখেছি। নিয়া যাও তুমি। দাম সে খাতায় লিখে রাখব। তার তরে তোমার ভাবনা কী?
ওই গন্ধ রুমালে মেখে জীবন ভূপী বোসের সান্নিধ্যে এসে রুমালখানা পকেট থেকে বের করে মুখ মুছতে শুরু করত। ভূপী চকিত হয়ে উঠত। তার দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাত। জীবন। বুঝত এবং হাসত। প্রশ্নটা ভূপীর এই—মঞ্জরীর কাপড়ে এবং এই বরাহটার রুমালে একই মিষ্টি গন্ধ কী করে এল?
ভূপী অবশ্য হটবার ছেলে নয়, ঠিক পরদিনই সেই গন্ধ সে রুমালে মেখে আসত। জীবন ভাবতেন—ভূপী বোস তো যে-সে নয়, ওসমান চাচার দোকানে না পেয়ে নিশ্চয় মুরশিদাবাদ থেকে আনিয়েছে।
হায়তখন কি জানতেন যে, মঞ্জরীকে পাঠানো উপঢৌকনটি ভূপীর কাছে এসেছে বিচিত্রভাবে!
থাক সে কথা। ও নিয়ে আক্ষেপ কেন? কোনো কিছু নিয়েই আক্ষেপ জীবন দত্ত আর আজ করেন না। পরিহাস করেন। প্রেম এক প্রকারের সাময়িক উন্মাদ রোগ। সেই রোগে সদ্যযুবক। জীবন দত্ত সেদিন আক্রান্ত হয়েছিল।
ভূপী বোসের সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধে হার মানবার চরম মুহূর্তটির আগেকার মুহূর্তে পর্যন্ত ভেবেছিল সে জিতেছে। জয় তার অনিবার্য। মনে করেছিল, পরাজয় আশঙ্কায় ভূপীর মুখ বিবর্ণ হয়ে উঠেছে।
ভূপী বোস তখন জীবন দত্তের অর্থব্যয়ের প্রাচুর্য দেখে বেশ খানিকটা শঙ্কিত হয়ে উঠেছে। মধ্যে মধ্যে ছুতোনাতায় কথা-কাটাকাটি করত। জীবন আমোদ অনুভব করত। সঙ্গে সঙ্গে দুচার বার ডাম্বল ভঁজার ভঙ্গিতে হাত ভঁজত ভূপীর সামনেই। নিত্য মুগুর ভাজাটা সে বজায় রেখেছিল। এবং বোর্ডিঙে সহপাঠীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সে রুটি খেত পঁচিশ থেকে তিরিশখানা। ভূপী তার দেহ দেখেও ভয় পেত। জীবন হাসত। জয় তার অনিবার্য। সম্পদের প্রতিযোগিতায় তার জয় হয়েছে, বীর্যের প্রতিযোগিতায় সে শ্ৰেষ্ঠ; স্বয়ংবরে আর চাই কী?
হায় রে হায়! হায় রে মানুষের দম্ভ! আর বিচিত্র মানুষের মন! বিশেষ করে নারীর মন! ও যে কিসে পাওয়া যায়, এ কেউ বলতে পারে না।
হঠাৎ একদিন জীবন দত্তের ভুল ভেঙে গেল। ভূপী বোসের সঙ্গে হয়ে গেল চরম সংঘর্ষ। এবং সম্পদ ও শক্তিতে শ্ৰেষ্ঠতা সত্ত্বেও সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল।
সেদিন দোলের দিন।
বেশ একটি মূল্যবান উপঢৌকনের ডালা সাজিয়ে জীবন দত্ত মঞ্জরীদের বাড়িতে গিয়েছিলেন। তখনও মঞ্জরীর সারা অঙ্গের কোথাও এক ফোঁটা আবীরের চিহ্ন ছিল না। জীবনের অভিপ্রায় ছিল সে-ই তার শ্যামল সুন্দর মুখখানিকে প্রথম আবীর দিয়ে রাঙিয়ে দেবে। প্রথমেই দেখা হল মঞ্জরীর মায়ের সঙ্গে। সে উপঢৌকনের ডালাটি তার সামনেই নামিয়ে দিয়ে বললে–মা পাঠিয়ে দিয়েছেন। আমার কাছে আপনাদের কথা শুনেছেন কিনা।
মঞ্জরীর মা গম্ভীর মানুষ, জীবন তাকে ঠিক বুঝতে পারত না। একটু কেমন ভয় করত। যেন ভালও লাগত না লোকটিকে।
তিনি মুখে বললেনো না, এসব ঠিক নয় জীবন। বলে ডালাটি হাতে করে উঠে গেলেন উপরতলায়। নিচে রইল মঞ্জরী মঞ্জরীর মুখে চোখে নিষ্ঠুর কৌতুক। এ নিষ্ঠুর কৌতুক জীবনের যেন ভালই লাগত এবং এই নিষ্ঠুরতার জন্যেই তার কৌতুক যেন বেশি মধুর মনে হত, বেশি। করে টানত তাকে।
একলা পেয়ে জীবন পকেট থেকে আবীর বের করে বললে–নাতনীক আজ মাখাব কিন্তু।
মঞ্জরী হেসে বললে–আমিও মাখাব। রঙ গুলে রেখেছি। দাঁড়াও দাঁড়াও। সে ছুটে গেল ঘরের মধ্যে। বেরিয়ে এল হাত দুটি পিছনে রেখে। জীবনের তখন শ ছিল না। সে সঙ্গে সঙ্গে মঞ্জরীর মুখে মাথায় মাখিয়ে দিলে আবীর। এদিকে মঞ্জরীর দুখানি হাত মুখের সামনে উদ্যত হল, দুই হাতে মাখানো আলকাতরা।
জীবন সভয়ে পিছু হটল। সঙ্গে সঙ্গে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে বাহির দরজার দিকে ছুটল, বন্য বরাহের মত।
বাহির দরজার মুখেই তখন ব্যাঘ্ৰ। ব্যাঘ্রের পশ্চাতে প্রজাপতি চতুরানন বঙ্কিম।
বন্য বরাহে এবং ব্যাঘ্রে প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়ে গেল। দ্রুত ধাবমান সবল দেহে জীবন দত্তের সঙ্গে ধাক্কা লাগল ভূপী বোসের; বঙ্কিম তখন রাস্তার উপর থেকে লাফ দিয়ে উঠেছে মঞ্জরীর দাওয়ায়। জীবন দত্তের ধাক্কা সহ্য করতে পারলে না ভূপী। একেবারে চিৎ হয়ে উল্টে যাকে বলে সশব্দে-ধরাশায়ী-হওয়া তাই হল ভূপী বোস। জীবন ধাক্কা খেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। আঘাত তাকেও কম লাগে নি, কিন্তু সে সহ্য করবার শক্তি তার ছিল। এবং একটু সামলে নিয়েই সে সত্য সত্য সহানুভূতির সঙ্গে হাত ধরে তুলতে গেল ভূপী বোসকে। ইচ্ছাকৃত না হোক, অনিচ্ছাকৃত হলেও ত্রুটিটা তারই বলে মনে হল তার। শুধু সে তাকে হাত ধরে তুলেই নিরস্ত হল না। ভূপীর শরীরে কোথাও আঘাত লেগেছে কি না দেখতে চেষ্টা করলে, ধুলো ঝেড়ে দিলে অপরাধীর মত।
এই অবসরে ভূপী ছিটকে যাওয়া পায়ের জুতোপাটিটা কুড়িয়ে নিয়ে তার মাথায় মুখে পিঠে আথালিপাথালি মারতে শুরু করলে। গাল দিলে—শুয়ার কি বাচ্চা। হারামজাদা! উল্লুক!
ব্যস। উত্তের মত জীবন হুঙ্কার দিয়ে পড়ল ভূপী বোসের উপর। সেদিন নেশাও করেছিল জীবন। সিদ্ধি খেয়েছিল। ভূপীর সঙ্গে যে যুদ্ধ কেমন করে হয়েছিল, সে তার মনে নাই; কিন্তু বুকে বসে ভূপীর নাকে তার প্রকাণ্ড হাতের প্রচণ্ড মুঠির একটা কিল সে মেরেছিল। মারতেই মনে হল নাকটা যেন বসে গেল। সঙ্গে সঙ্গে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে এসে এাসিয়ে দিলে ভূপী বোসের মুখ, রক্তাক্ত হয়ে গেল জীবনের হাত—জামায়-কাপড়েও রক্ত লাগল। বঙ্কিম চিৎকার করে উঠল—করলি কী? আরও একটা আর্তকণ্ঠ তার কানে এ মঞ্জরীর কণ্ঠস্বরও মা গো! খুনে ডাকাত, খুন করলে মা গো!
চকিতে উন্মত্ত জীবন আত্মস্থ হয়ে গেল।
তাই তো! এ কী করল সে? ভূপী বোসের জ্ঞান নাই, বুকে চেপে বসে তার স্পর্শ থেকে সে তা বুঝতে পেরেছে। বিপদের কথাও সঙ্গে সঙ্গে মনে হল। ভূপীর দেশ। দেউলিয়া জমিদার ঘরের ছেলে। ওরা ভয়ঙ্কর। দাত-নখ-ভাঙা বাঘই হয় নরখাদক। আর মঞ্জরীর কান্না শুনেও আজ তার স্বপ্ন ভেঙেছে। মুহূর্তে সে লাফ দিয়ে উঠে ছুটল। ছুটল একেবারে নিজের গ্রামের অভিমুখে। পথ দশ ক্রোশ। কিন্তু সে পথ ধরে ফিরল না, ফিরল অপথে অপথে, ময়ূরাক্ষী নদীর তীর ধরে। বোধহয় তের-চোদ্দ ক্ৰোশ পথ হেঁটে বাড়ি এসে পৌঁছেছিল। জামাকাপড় নদীতে কেচে, কাদা মাখিয়ে, রক্তচিহ্নের আভাস গোপন করে বাড়ি এল।
মেডিক্যাল কলেজে পড়ার স্বপ্ন তার শেষ হল।
মঞ্জরীর মোহে পড়ে ঘুচে গেল। মঞ্জরীই দিলে ঘুচিয়ে।
সেদিন জগদ্বন্ধু মশায় ও তাঁর স্ত্রী ছেলের অবস্থা দেখে শিউরে উঠে প্রশ্ন করলেন-কী হয়েছে? এমন করে কেন তুমি ফিরলে? কী হয়েছে?
জীবন মাথা হেঁটে করে দাঁড়িয়ে রইল। কোনো উত্তর দিলে না।
জগদ্বন্ধু মশায়ের মত দৃঢ়চিত্ত প্রকৃতির মানুষের সামনেও সে অটল রইল। মঞ্জরীর নাম সে কিছুতেই প্রকাশ করবে না। শেষ পর্যন্ত বললে–একজন বড়লোকের ছেলে তাকে জুতো মেরেছিল, সে তার শোধ নিয়েছে। আঘাত অবশ্য বেশি হয়েছে, রক্তপাত হয়েছে খানিকটা, সেই জন্যই ওখান থেকে পালিয়ে এসেছে। ওখানে থাকলে সে হয়ত খুন করবার চেষ্টা করবে। ওখানে সে আর ফিরবে না। সে অন্য জায়গায় পড়বে। সিউড়ি বা বর্ধমান সরকারি হাই স্কুলে পড়বে সে।
–না! আর না!
জগদ্বন্ধু মশায় বললেন–আর না। বাইরে পড়তে আর আমি তোমাকে পাঠাব না। আমার আমাদের কৌলিক বিদ্যা শেখ তুমি।
জগদ্বন্ধু মশায়ের কণ্ঠস্বর কঠিন, কিন্তু মৃদু। এ কণ্ঠস্বর শুনে জীবনের সর্বদেহ যেন হিম হয়ে গিয়েছিল। মনে পড়েছিল, এ সেই কণ্ঠস্বর, এ কণ্ঠস্বরে যে কথা বলেন জগদ্বন্ধু মশায় তার আর লঙ্ন হয় না। জীবনের মনে পড়ল, একদিন নবগ্রামের বাবুদের বাড়ির এক অনাচারী, ব্যভিচারী প্রৌঢ়ের অসুখে চিকিৎসা হাতে নিয়ে হঠাৎ একদিন ঠিক এই কণ্ঠস্বরে চিকিৎসায় জবাব দিয়েছিলেন। বাবুটি ছিলেন মদ্যপায়ী; জগদ্বন্ধু মশায় তাকে মদ্যপান করতে নিষেধ করেছিলেন; কিন্তু তিনি নিষেধ লঙ্ন করেছিলেন। জগদ্বন্ধু মশায় ঘরে ঢুকে সেই কথা জানতে পেরেই ফিরে এসেছিলেন। রোগীর আত্মীয়েরা অনুনয় করে তাকে ফেরাতে এসেছিল—মশায় এমনি কঠিন মৃদুস্বরে বলেছিলেন না। ওই ছোট একটি না শব্দ শুনে জমিদার পক্ষ থমকে গিয়েছিল। এবং সে না-এর আর পরিবর্তন কোনো দিন হয় নাই। আজকের নাও সেই না। এবং এর সঙ্গে। জগদ্বন্ধু যে কথাগুলি বললেন– তার মধ্যেও কণ্ঠস্বরের সেই মৃদুতা এবং সেই কাঠিন্যই রনরন। করছিল।
জীবন দত্ত সচকিত হয়ে মুহূর্তের জন্য বাপের মুখের দিকে তাকিয়ে পরমুহূর্তেই মাথা নামিয়েছিল। বুঝতে আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকে নি—এ না-এর আর পরিবর্তন নাই।
জগদ্বন্ধু মশায় পঞ্জিকা খুলে বসলেন, বিদ্যা আরম্ভের দিন ঠিক করবেন।