আমি হেসে বললাম–বেশি ভাববার কিছু নেই। নিলে এটাই নিন—
ভূষণ রায় স্পষ্টই কিঞ্চিৎ ইতঃস্তত করছেন, একবার আমার দিকে আর একবার মুখুজ্যেমশাইয়ের দিকে তাকাচ্ছেন। পুরনো আমলের জমিদার খদ্দের, আমার কথায় তো কেবল হবে না।
দেবদর্শন দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে বললেন—ঠিক আছে, ঠাকুরমশাই যেখানা বলছেন সেখানাই দাও। নিজের পছন্দে তো অনেক দেখলাম, এবার ঠাকুরমশাইয়ের পছন্দের ফলটা দেখি–
ভূষণ রায় বললেন—তাহলে তাই দিই রাজাবাবু?।
–দাও।
গোছা থেকে টিকিটখানা ছিঁড়ে দেবদর্শনকে দিলেন ভূষণ রায়। কী একটা ফর্মে নাম ঠিকানা আর নো-ডি-প্লাম লিখে নিলেন। যে টিকিট কিনছে সে তার পছন্দ আর ইচ্ছেমত একটা সাঙ্কেতিক শব্দ ঠিক করে, সেটাকে বলে নো-ডি-প্লাম। এর ফলে কে পুরস্কারের প্রাপক তা নিয়ে কোনও সংশয় থাকে না। একই নামে একাধিক লোক থাকতে পারে, কিন্তু গোপনে নির্বাচন করা সাঙ্কেতিক শব্দ কখনও এক হবে না।
ভূষণ রায় বললেন—নোম্-ডি-প্লাম কী লিখব?
দেবদর্শন বললেন—ওটা লেখোইয়ে, গতবার যেন কী ছিল? মা কালী, না? এবার বরং লেখো—
আমি বললাম-অমরজীবন।
দেবদর্শন শুধু জন্মসূত্রে বনেদি এমন নয়, তার অত্বরিত, সংযত আচরণের মধ্যে দিয়ে একটা সহজ আভিজাত্য প্রকাশ পায়। আমার কথা শুনে তিনি অবাক হলেন ঠিকই, কিন্তু বাইরে তা কিছুই দেখালেন না। বললেন—ঠিক আছে, লেখো অমরজীবন—
ভূষণ রায় সবকিছু লিখে নিয়ে ফর্মখানা কাগজের দপ্তরের মধ্যে যথাস্থানে খুঁজে রাখলেন। বললেন–তাহলে আজ আসি রাজাবাবু? প্রণাম
-নমস্কার। রঘু, এই রঘু! যা, রায়মশাইকে নিয়ে কাছারিঘরে যা। খাজাঞ্চিকে আমার নাম করে বল ওঁর টিকিটের দামটা দিয়ে দিতে। আচ্ছা এসো
ভূষণ রায় চলে গেলে দেবদর্শন কিছুক্ষণ চুপ করে গড়গড়ার নলে টান দিলেন, তারপর বললেন—ঠাকুরমশাই, জানি কিছু প্রশ্ন আছে যা করতে নেই। তবু কিছুতেই কৌতূহল নিবৃত্ত করতে পারছি না বলে মার্জনা করবেন। টিকিটটা বদলে দিলেন কেন?
বললাম-এর উত্তর দেওয়া মুশকিল। বিশেষ কোনও যে কারণ আছে এমন বলতে পারি না, তবে অমরজীবনের বলা ছড়াটা একটা ছোটখাটো কারণ হলেও হতে পারে
দেবদর্শন সোজা হয়ে বসে তীক্ষ্ণ চোখে আমার দিকে তাকালেন।
—আপনি কি ওই কবিতার মানে বুঝতে পেরেছেন?
—জানি না। বিলিতি লটারি খেলার ফল বেরুলে সেটা বোঝা যাবে। মুখুজ্যেমশাই, আপনি প্রবীণ এবং বুদ্ধিমান মানুষ, আপনাকে আগে থেকে মিথ্যা আশা দিয়ে ভোলাতে চাই না। একটা কিছু আন্দাজ করেই নিশ্চয় টিকিটটা বদলেছি। কিন্তু তা বলবার সময় এখনও আসেনি। ক খানিকক্ষণ কী ভেবে দেবদর্শন বললেন—ঠাকুরমশাই, আপনি কিছুদিন আমার কাছে থাকবেন তো? প্রয়োজনে কীভাবে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ হবে নইলে?
—সে নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না। প্রয়োজন ঘটলে আমি নিজেই ঠিক যোগাযোগ করে নেব। আমি বেশিদিন কোথাও একজায়গায় থাকি না মুখুজ্যেমশাই, কিছু মনে করবেন না। বাড়িতেও মন বসেনি বলেই বেরিয়েছিলাম—
মুখুজ্যেমশাই সংযত ব্যক্তিত্বের মানুষ, এ নিয়ে বারবার অনুরোধ করে আমাকে বিব্রত করলেন না। আমার অন্য গল্প আরম্ভ করলাম। উনি আমার জীবনের অভিজ্ঞতার কাহিনী শুনতে চাইলেন। তোমরা তো জানো, সেসব পুরোনো দিনের প্রসঙ্গ একবার উঠলে আর শেষ হতে চায় না। মানুষ আগ্রহ করে শোনে, আমারও বলতে ভাল লাগে। দুপুরে খাওয়ার সময় বাদ দিয়ে সেদিনটা পুরোই গল্পে গল্পে কেটে গেল। বৈষয়িক কাজকর্ম সেদিন আর কিছুই হল না। কাছারি থেকে আমলারা ডেকে ডেকে ফিরে গেল। একসময় দেবদর্শন নায়েবমশাইকে ডেকে বললেন—আজ আর কাছারিতে বসব না। কাল ঠাকুরমশাই চলে যাবেন, আজকের দিনটা ওঁর সঙ্গে একটু গল্প করে নিচ্ছি। আপনি আজ একাই চালিয়ে নিন, আর ওদের বলে দিন বারবার যেন ডেকে বিরক্ত না করে–
তোমরা ভাবছ একই কথা এতবার বলছি কেন, কিন্তু সত্যিই এমন চমৎকার আর হৃদয়বান, উদার অতিথিপরায়ণ মানুষ আমি কমই দেখেছি। বেশিদিন তো নয়, আজ থেকে বড় জোর পঁচিশ কী তিরিশ বছর আগেকার কথা। তবু মনে হয় যেন স্বপ্নের কাহিনী, এই তিরিশ বছরে পৃথিবী ততটাই বদলে গিয়েছে। বাংলার গ্রামে আজকাল আর সেই আতিথেয়তা পাবে না।
কিশোরী বলল—গ্রামের মানুষকে দোষ দিয়ে কী হবে? এই ভয়ানক যুগের কথা ভেবে দেখুন। আপনি যে সময়ের কথা বলছেন তখন সরু পাটনাই বালাম চালের দাম সাড়ে চার কী পাঁচ টাকা, সরষের তেল পাঁচআনা সের, খাঁটি দুধ টাকায় কুড়ি সের, বড় মাপের জোড়া ইলিশ ছ-আনা। এগুলোর দাম এখন কী দাঁড়িয়েছে ভেবে দেখুন। জনসংখ্যা বাড়ছে হু হু করে, মানুষ কি ইচ্ছে করলেও আগেকার দিনের মত অতিথিপরায়ণ হতে পারে?
তারানাথ হেসে বলল—এ যুক্তি আমি অনেক শুনেছি। বাজে যুক্তি—
কিশোরী একটু রেগে বলল—বাজে যুক্তি? কোনটায় ভুল বলেছি দেখান তো–
–উত্তেজিত হচ্ছ কেন? উত্তেজিত হওয়া তর্কে পরাজয়ের লক্ষণ।
—বেশ তো, আমার যুক্তির ফাঁক দেখান
তারানাথ বলল দেখ, দিনকাল খারাপ পড়েছে ঠিকই, দ্রব্যমূল্যও আগের চেয়ে বহুগুণ বেড়ে গিয়েছে সে কথাও ঠিক। কিন্তু সবচেয়ে যা প্রয়োজনীয় তা হল মানুষের সদিচ্ছা। ভালবাসা আর সদিচ্ছা থাকলে অনেক সমস্যা পার হওয়া সম্ভব। আমাদের শাস্ত্রে গৃহস্থের প্রতি নির্দেশ আছে কেবলমাত্র পরিবারের সদস্যদের জন্য রান্না না করে অন্তত বাড়তি একজনের জন্য আহার্য প্রস্তুত রাখার। নিজে রান্না করে শুধু নিজে খেলে তাকে পামর বলে। ভাব তো, দিনকাল যতই কঠোর হোক, দ্রব্যমূল্য যতই বেড়ে থাকুক, একজনমাত্র মানুষকে খাওয়াতে কি খুব বেশি খরচ পড়ে? চার-পাঁচজনের সংসারে একজন অতিথির জন্য আলাদা ব্যবস্থা করতে হয় না, ওর মধ্যেই হয়ে যায়। তা নয়, আসলে আমরা ক্ষুদ্রচেতা হয়ে পড়েছি। এটাকে যুগধর্মও বলতে পারো। কলিযুগে অন্নময় শরীর-কেবল আমি খাব, আমি পরব এই মানসিকতা। মহাভারত ভাল করে পড়েছ? দ্বৈপায়নের তীরে ভীম যখন দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ করলেন, তখন অন্যায়যুদ্ধ করেছেন বলে ভীমকে হত্যা করবার জন্য বলরাম ক্রুদ্ধ হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁকে শান্ত করে কৃষ্ণ বললেন—দাদা, আপনি অকারণে ভীমের প্রতি ক্রোধ প্রকাশ করছেন। গ্রহবিপ্রদের ডেকে গণনা করে দেখুন, আজ থেকে দশদিন আগেই দ্বাপর শেষ হয়ে কলি শুরু হয়েছে। কলিতে নিয়ম হচ্ছে—যেমন করে হোক যুদ্ধ জয় করো, যা চাও তা ছিনিয়ে নাও, দয়ামায়া-উদারতা যেন তোমার আকাঙক্ষার বাধা না হয়। সেদিক দিয়ে ভীমসেন যুগধর্ম পালন করেছেন মাত্র, সেজন্য তাঁকে দায়ী করা যায় না। যুগপুরুষ কৃষ্ণের কথাই সত্য, আমিও একালের মানুষকে দায়ী করছি না। কিন্তু একথা ঠিক যে, মানুষ ক্ষুদ্রচেতা হয়ে পড়েছে, তা সে যে কারণেই হোক।
সেদিনটা দেবদর্শনের সঙ্গে গল্প করেই কাটল। ভদ্রলোক কলেজের ছাপমারা ছাত্র নন বটে, কিন্তু সাহিত্য আর ইতিহাসের খবর রাখেন প্রচুর, সেসব শুনতে আরম্ভ করলে আর থামা যায় না।
বোধহয় পরের দিন চলে যাব বলেই দুপুরে দেবদর্শন খাওয়াদাওয়ার বিপুল আয়োজন করেছেন। ওঁর আর আমার একসঙ্গেই আহারের আয়োজন করা হয়েছে ভেতরবাড়িতে রান্নাঘরের বারান্দায়। খেতে বসে আমার চক্ষুস্থির! পূজোর পরাতের মত বিশাল কাসার পদ্মকাটা বগিথালায় চূড়ো করা সাদা ধপধপে তুলাইপাঞ্জি চালের ভাত। ভাতের চূড়ায় ছোট্ট কাঁসার বাটিতে গাওয়া ঘি, জমবে না—ভাতের গরমে তরল থাকবে। আলাদা রেকাবিতে নুন-লেবু-লঙ্কা। জিরে জিরে করে কাটা আলুভাজা, এঁচোড়ের ডালনা, নারকেলের কুচি দেওয়া ঘন মুগের ডাল, বাঁশসলা ধানের চিড়ে দিয়ে রান্না পাকা রুইমাছের মুড়িঘন্ট, একহাত লম্বা চিতলমাছের পেটির তেলঝাল—সে পেটির লম্বা কাঁটা দিয়ে উলবোনা যায়। তারপর এল তেলকই, এক একখানা কই একবিঘত লম্বা, তেমনটি তোমরা আজকাল আর শহরবাজারে দেখবে না। কারুকে বিশ্বাস করতে বলছি না, কিন্তু এ সমস্ত পদই আমি বেশ ভাল পরিমাণে খেয়ে ফেললাম। ভাত নিলাম দুবার। তুলাইপাঞ্জি চালের ভাত খেয়েছ কখনও? তাহলে বুঝতে, এখানে রান্না করলে গলির মোড়ের লোক জানতে পারে। এই পর্ব চুকলে এল ঘনদুধের সর, ক্ষীর আর পাকা মর্তমান কলা। তাও খেয়ে ফেললাম অনেক অনেক।
মধ্যাহ্নভোজনের পর বৈঠকখানায় বসে তামাক খেতে খেতে বললাম—লোকে আপনাকে রাজাবাবু বলে সে মিথ্যে কথা নয়। রাজবাড়ি ছাড়া এমন রান্নাবান্না হয় নাকি?
দেবদর্শন বললেন—এবার তো কিছু করতে পারলাম না ঠাকুরমশাই, একটু হঠাৎ হয়ে গেল কিনা। সত্যি যদি আবার আসেন, তখন আমাদের এই অঞ্চলের কিছু ভাল রান্না আপনাকে খাওয়াব। কত রান্না তো আমরা ভুলেই গিয়েছি, বাড়ির মেয়েরা অত ঝামেলা আর করতে চায় না। পদ্মচিনি খেয়েছেন কখনও? গয়নাবড়ি ভাজা? কিম্বা তিলজাউ? সব খাওয়াব, আমার বাড়ির মেয়েরা পারে—
দু-চারবার জোরে জোরে গড়গড়ার নলে টান দিয়ে দেবদর্শন বললেন—যদি পারেন তো পূজোর সময় আসবেন। এখন অবশ্য আর সেই পুরনো দিনের জাঁকজমক কিছুই নেই, তবু নয় নয় করেও মুখুজ্যেবাড়ির দুর্গোৎসব আজ পর্যন্ত এ অঞ্চলে বিখ্যাত। বংশানুক্রমে আজ দুশো বছর ধরে একই কুমোর ঠাকুর তৈরি করে, একই পুরোহিতবংশ পূজো করে, একই ঢাকিরা ঢাক বাজায়। প্রতিমার সামনে অষ্টমীর দিন রাত্তির থেকে কবির গান, যাত্রা—এসব হয়। যদি ভাগ্য ভাল থাকে, তাহলে সন্ধিপূজোর সময় গড়ের তোপও শুনতে পাবেন–
অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম—গড়ের তোপ কী জিনিস?
মুখুজ্যেমশাই বললেন—এটা আমাদের পরিবারে প্রচলিত একটা পুরোনো প্রবাদ। এখান থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে মুকুটশিলা গ্রামে আমার মামাবাড়ি। আমার প্রপিতামহীও ওই গ্রামেরই মেয়ে ছিলেন। তার বাপেরও ছিল বিশাল ভূসম্পত্তি, নদীর ধারে চওড়া উঁচু পাঁচিল দেওয়া এতবড় বাড়ি যে লোকে বলত ‘গড়’। সে বাড়িতে বিখ্যাত দুর্গোৎসব হত, দীয়তাং ভুজ্যতাং চলত পনেরোদিন ধরে। সন্ধিপূজোর সময়ে চারদিক কাঁপিয়ে কামান দাগা হত। লোকে বলত গড়ের তোপ। বিয়ের পর আমার প্রপিতামহী বাপেরবাড়ি যাওয়ার খুব একটা সুযোগ পেতেন না, সেকালে যেমন হত আর কি। একবার সকলকে বলে রাজি করিয়ে পূজোর সময় তিনি মুকুটশিলা যাবেন স্থির হল, কিন্তু পূজোর দশবারোদিন আগে বিষম সান্নিপাতিক জুরে প্রপিতামহী একেবারে শয্যাগত হয়ে পড়লেন। সঙ্কটাপন্ন অবস্থা, এখন যান তখন যান। কিন্তু সেই বিকারের মধ্যেও একটু জ্ঞান ফিরলেই বলতেন—আমার বাপেরবাড়ি যাওয়া হল না, পূজো দেখা হল না।
দীনদয়াল ভট্টাচার্য ছিলেন সে সময় আমাদের কুলগুরু। প্রপিতামহীর আক্ষেপ শুনে তিনি বলেছিলেন—মা, তোমাকে কোথাও যেতে হবে না, এইখান থেকেই তুমি সন্ধিপূজোর দিন মুকুটশিলা গ্রামের গড়ের তোপ শুনতে পাবে। এইখান থেকেই তুমি প্রণাম জানিও।
সবাই ভেবেছিল দীনদয়াল মুমূর্ষ রোগীকে সান্ত্বনা দিলেন মাত্র, কিন্তু প্রপিতামহ কথাটা আক্ষরিক অর্থেই বিশ্বাস করেছিলেন। সন্ধিপূজোর সময় তিনি বসে রইলেন স্ত্রীর রোগশয্যার পাশে। গভীর রাত্রিতে ঠিক সন্ধিলগ্নে বহুদূর থেকে মাঠ বন খাল বিল পেরিয়ে ভেসে এল গড়ের তোপের শব্দ। গ্রামাঞ্চল তো, তারপর সেকালের ব্যাপার, হুহু করে ঘটনাটা রটে গেল চারদিকে। এখন জিনিসটা কিংবদন্তীর পর্যায়ে পৌঁচেছে। প্রতি বছরেই নাকি কেউ কেউ শুনতে পায় গড়ের তোপের আওয়াজ–
বললাম—তাতে অবাক হওয়ার কী আছে? শোনাই তো যেতে পারে–
দেবদর্শন আমার দিকে কয়েকমুহূর্ত তাকিয়ে থাকলেন, তারপর বললেন—না, তা যেতে পারে না। আগে বলিনি বোধহয়, জয়তলা থেকে মুকুটশিলার দূরত্ব চল্লিশ মাইল।
চুপ করে রইলাম। সত্যিই তো, যতই নির্জন আর শান্ত পরিবেশ হোক, চল্লিশ মাইল দূর থেকে কামানের আওয়াজ শুনতে পাওয়া সম্ভব নয়।
জিজ্ঞাসা করলাম–আপনি কখনো শুনেছেন?
মুখুজ্যেমশাই বললেন—বাল্যে দু-একবার শুনতে পেয়েছি বোধহয়, পরিষ্কার স্মৃতি কিছু নেই। বড় হবার পর তেমনভাবে কখনও নয়—
—তেমনভাবে নয় বলতে কী বোঝাচ্ছেন?
–সেভাবে কানখাড়া করে কখনও বসে থাকিনি তো। বড় হতে আরম্ভ করলে কিছু কিছু বিশ্বাসের ভিত্তি নড়ে যায়। তবে দু-একবার যেমন আমার বিয়ের বছর-হঠাৎই শুনতে পেয়েছিলাম তোপের শব্দ। অন্যমনস্ক ছিলাম, নইলে হয়ত আরও স্পষ্ট শুনতে পেতাম। গ্রামের লোকেদের মধ্যে কিন্তু এ প্রসঙ্গে গভীর বিশ্বাস আছে, তারা অনেকেই শুনেছে গড়ের তোপ। তবে তাদের কথা আমি ধরি না, অতিরিক্ত বিশ্বাসে আর ভক্তিতে মানুষ অনেক কিছু দেখে বা শোনে যার কোনও বাস্তব মূল্য নেই।
দেবদর্শন প্রবীণ জমিদার বটে, কিন্তু সেকেলে কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ নন, তাঁর মনের মধ্যে বেশ উদার আলোহাওয়া খেলে।
গল্পে গল্পে সেদিনটা ভালই কেটে গেল। পরের দিন আবার বেরিয়ে পড়লাম পথে।
পথটাই আমার ঠিক জায়গা, ঠিকঠাক খাপ খেয়ে যায়। চিন্তাহীন, মুক্ত আনন্দে ভরা দিনগুলো। কখনও ঝড়-বৃষ্টি, কখনও নীল আকাশে ডানা ছড়ানো চিলের ওড়াউড়ি। পড়ন্ত বেলায় রাস্তার ধারের লতাপাতার ঝোপ থেকে মন-কেমন-করা কটু গন্ধ ওঠা। গ্রামের মুদিখানা থেকে মুড়ি আর মুড়কি কিম্বা বাতাসা কিনে খাওয়া, যেখানে-সেখানে রাত্তিরের আশ্রয় নিয়ে ঘুমিয়ে পড়া। তোমরা যারা সংসারী মানুষ তারা এ জীবনটাকে ঠিক উপলব্ধি করতে পারবে না। তবে আবার বলছি—মনে বল আর সাহস থাকা চাই, দুর্বল পুতুপুতু মনের লোক এ আনন্দ পাবার যোগ্য নয়।
কয়েকমাস ঘুরে বেড়ালাম বহু জায়গায়, অনেক অদ্ভুত অভিজ্ঞতাও হল। তার মধ্যে একটা তো জমিয়ে গল্প বলার মত। কিন্তু সেটা আজ বলব না, আজ বরং মুখুজ্যেবাড়ির গল্পটা শেষ করি।
শরৎকাল এসে গেল। কিছুদিনের মধ্যেই দুর্গাপুজো আসছে। একটা কালীবাড়ির নাটমন্দিরে আশ্রয় নিয়েছিলাম সে রাত্তিরে। বেশ পরিচ্ছন্ন জায়গা, মশাটশা বিশেষ নেই, কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুম ঘুম ভাব ঘনিয়ে এল। সারাদিন পথশ্রমের পর ঘুম আসার অনুভূতি ভারি আরামের।
হঠাৎ সেই অন্ধকারের ভেতর থেকে কানের কাছে কে যেন বলল কাল সকালেই রওনা হও। মুখুজ্যেবাড়ির পূজোয় এবার তোমার থাকা দরকার।
চমকে উঠে বসলাম–কে? কে বলল কথাটা? তারার আলোয় আবছা দেখা যাচ্ছে নাটমন্দির। কই, জনপ্রাণীও তো নেই কোথাও! অথচ আমি পরিষ্কার শুনেছি–
উঠে একবার চারপাশটা ঘুরে দেখে এলাম। না, সত্যিই কেউ কোথাও নেই। তাহলে?
তারপরেই হঠাৎ একটা ধাক্কার মত মনে হল—এই গলার স্বরের অধিকারীকে আমি চিনি! তার নাম অমর। অমরজীবন। আমাদের পারিবারিক ইতিহাসের পর্বে পর্বে সে জড়িয়ে গিয়েছে। রহস্যের কুয়াশায় ঢাকা তার পরিচয়, আকাশের নক্ষত্রদের মত সে প্রাচীন। তার নির্দেশ আমাকে মানতেই হবে।
অনেক রাত্তির অবধি নাটমন্দিরের মেঝেতে থু হয়ে বসে রইলাম। গলাটা শুনতে পেয়ে মনে কোনও ভয় বা আশঙ্কা হল না, বরং মৃদু তৃপ্তি আর শান্তিতে মন ভরে গেল। যেন কয়েকবার হারিয়ে যাওয়া কোন বন্ধুকে খুঁজে পেয়েছি। ঠিক করলাম পরের দিনই রওনা দেব জয়তলায়।
ঘুরতে ঘুরতে দেড়খানা জেলা পার হয়ে চলে এসেছিলাম, কাজেই ফিরতে বেশ সময় লাগল। খুব প্রাণপণ হেঁটেও পূজো আরম্ভ হবার আগে মুখুজ্যেবাড়ি পৌঁছতে পারলাম না। সপ্তমীর দিন সন্ধেবেলা পৌঁছলাম দানাবাড়ি নামে একটা গ্রামে, সেখান থেকে জয়তলা বারো মাইল পথ। খুব ভোরে উঠে বেরিয়ে পড়লে দুপুরের মধ্যেই পৌঁছে যাব।
পরের দিন মহাষ্টমী। অন্ধকার থাকতেই ঘুম ভেঙে উঠে মুখহাত ধুয়ে বেরিয়ে পড়লাম। যে গোয়ালবাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম সে বাড়ির কর্তাও আমাকে এগিয়ে। দেবার জন্য গল্প করতে করতে অনেক দূর এল। শরৎকালের ভোর, বাতাসে সামান্য হিমের স্পর্শ। গ্রামের সীমানায় একটা বাড়ির উঠোনে গাছের তলায় আলো করে ছড়িয়ে। আছে শিউলি ফুল। তার পবিত্র গন্ধ সে জায়গার বাতাসকে আমোদিত করে রেখেছে। এখান থেকেই আমার সঙ্গী উদ্ধব ঘোষ প্রণাম করে বিদায় নিল। আমিও জোরে পা চালালাম।
পথে বারদুই সামান্য বিশ্রাম করে ঠিক বেলা দুপুরে জয়তলা পৌঁছলাম। দূরে মুখুজ্যেবাড়ির পূজোর ঢাক বাজছে। গ্রামের রাস্তাতেও খুব বেশি লোক নেই, দল বেঁধে সবাই জমিদারবাড়ি পূজো দেখতে গিয়েছে। পথের বাঁক ঘুরেই সামনে মুখুজ্যেমশাইয়ের। বাড়ি। কাছারি আর অন্দরমহলের মাঝখানে বিরাট উঠোনে সামিয়ানা টাঙানো হয়েছে, তার নিচে অন্তত শ-তিনেক লোক হাতজোড় করে প্রতিমার দিকে তাকিয়ে বসে। আমি মণ্ডপে ঢুকতেই সমস্ত কোলাহল থেমে গিয়ে অতবড় আসরে স্তব্ধতা নেমে এল। সন্ধিপূজা সমাগত।
আসরের একেবারে অপর প্রান্তে ঠাকুরদালানে প্রতিমার সামনে একশো আটখানা পেতলের প্রদীপ ধকধক করে জ্বলছে। পুরোহিত একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন লোহার বেড়ের ওপর বসানো নতুন জলভরা মাটির হাঁড়ির দিকে। তার তলার ফুটো দিয়ে জল বেরিয়ে যাচ্ছে। সমস্তটা জল বেরিয়ে গেলে সন্ধিপূজো শুরু হবে। ভাল সময়ে পৌঁছলাম মুখুজ্যেমশাইয়ের বাড়িতে।
ওপাশ দিয়ে ক-খানা বারকোশ হাতে করে রঘু কোথাও যাচ্ছিল, সে আমাকে দেখতে পেয়ে একগাল হাসল, তারপর আসরের সামনে যেখানে দেবদর্শন বসে আছেন সেখানে গিয়ে নিচু হয়ে বাধহয় আমার কথা বলল। দেবদর্শন চমকে উঠে মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালেন।
তাঁর সঙ্গে আমার চোখাচোখি হওয়ামাত্র দূর থেকে ভেসে আসা মৃদু, কিন্তু স্পষ্ট কামানের গর্জন শুনতে পেলাম। আসরের সব মানুষই নিশ্চয় শুনতে পেয়েছিল, জয়ধ্বনি দিয়ে তারা একসঙ্গে উঠে দাঁড়াল সামিয়ানার তলায়। গড়ের তোপ! গড়ের তোপ শোনা গিয়েছে!
কেবল পুরোহিতমশায় অবিচল। হাঁড়ির জল শেষ হওয়ামাত্র তিনি হাত তুললেন। মেঘের গর্জনের মত গুড়গুড় করে বেজে উঠল ঢাক।
সন্ধিপূজো শুরু হল।