বেলা দুটা চল্লিশ। ভাদ্র মাসের কঠিন ঝাঁঝালো রোদ উঠেছে। ফ্যানের বাতাসও গরম।
বঙ্গবন্ধু পাইপ হাতে তাঁর প্রিয় আরামকেদারায় এসে শোয়ামাত্র মাথার ওপরের ফ্যান বন্ধ হয়ে গেল। তিনি বিরক্ত মুখে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করলেন। ভেবেছিলেন কিছুক্ষণ বিশ্রাম করবেন। শরীর ক্লান্ত, মনও ক্লান্ত। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের শত সমস্যা। সবই সমাধানের দায়িত্ব তার। এটা কি সম্ভব? তিনি আলাদিনের চেরাগ নিয়ে আসেন নি। দেশের সব পত্রপত্রিকার ধারণা, তার কাছে চার-পাঁচটা আলাদিনের চেরাগ আছে। চেরাগগুলি তিনি রিলিফের কম্বলের নিচে লুকিয়ে রেখেছেন। এই যে কারেন্ট চলে গেল, এই নিয়ে কোনো-না-কোনো পত্রিকায় লেখা হবে–মুজিবের লোকদের দুর্নীতিতে ইলেকট্রিসিটির বেহাল অবস্থা। তাঁকে সাহায্য করার কেউ নেই। সবাই আছে খাল কাটায়। নিতান্ত ঘনিষ্ঠজনরাও এখন খাল কাটতে শুরু করেছে। খাল কাটছে আর দাঁতাল কুমির ছেড়ে দিচ্ছে। সবচেয়ে বড় খাল কাটা ধরেছে আবদুর রব। বলতে গেলে সে ছিল তার হাতের পাঁচ আঙুলের এক আঙুল। সেই আবদুর রবের এত সাহস—পল্টনের মাঠে তার সমালোচনা করে বক্তৃতা দেয়! এই কাজ তো মাওলানা ভাসানীও এখনো করেন নি। আবদুর রব পল্টনের বক্তৃতায় প্রমাণ করার চেষ্টা করে শেখ মুজিব ব্যর্থ রাষ্ট্রনায়ক। তিনি এখন পা-চাটাদের প্রধান। তার সব মমতা এখন পা-চাটাদের জন্যে, দেশের মানুষের জন্যে না।
আরে ব্যাটা! তুই সেদিনের ছেলে। হা করলে এখনো তোর মুখ থেকে দুধের গন্ধ বের হয়। তুই রাষ্ট্রপরিচালনার বুঝিস কী? গলা ফাটিয়ে বক্তৃতা দিতে পারা মানেই রাষ্ট্রপরিচালনা না। তুই মনে রাখিস, এক চোপড় দিয়ে তোকে ঠিক করতে পারি। হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল! তুই তো মশারও অধম।
বঙ্গবন্ধু পাইপে টান দিলেন। পাইপ নিভে গেছে। পাইপ থেকে কোনো ধোয়া বের হলো না। নতুন করে পাইপ ধরাবার ইচ্ছেও হচ্ছে না। কয়েক মিনিটের জন্যে চোখ বন্ধ করতে পারলে হতো। গরমে তাও সম্ভব না। তিনি মাথার ওপরের ফ্যানের দিকে তাকাতেই ফ্যান ঘুরতে শুরু করল। তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গেই চোখের পাতা ভারী হয়ে গেল। হাত থেকে পাইপ মেঝেতে পড়ে গেল।
ঠিক ঘুম না, গাঢ় তন্দ্রার মতো এসেছে। তার এই অংশ থাকে দুঃস্বপ্নে ভরা। তিনি ছটফট করছেন। চোখের সামনে এখন আজরাইলকে দেখছেন। আজরাইল দেখতে মানুষের মতো, তবে শরীরভর্তি লাল লোম। সাইজেও ছোট, বামনদের মতো। মুখে চার পাটি করে দাঁত। হাসলে ভেতরের পাটির দাঁত দেখা যায়।
পাকিস্তানের জেলখানায় তিনি বন্দি। তার চোখের সামনে তার জন্যে কবর খোড়া হচ্ছে। কবর খুঁড়ছে মিলিটারিরা। একজন জেনারেল নির্দেশ দিচ্ছেন— Deep, Deep. জেয়াদা Deep. আজরাইলটা আছে জেনারেলের সঙ্গে। সে জেনারেলের প্রতিটি কথায় সায় দিচ্ছে। চার পাটি দাত বের করে হাসছে।
এর মধ্যে একজন আবার চিৎকার করছে-ভাত চাই, ভাত দাও। কাপড় চাই, কাপড় দাও।’ যে চিৎকার করছে তার গলা পরিচিত। ছাত্রনেতা আবদুর রব। এ আবার পাকিস্তানে এসেছে কবে! পাকিস্তানিদের কাছে সে ভাত চাচ্ছে কেন? পাকিস্তানিরা তাকে ভাত দেবে?
বঙ্গবন্ধুর তন্দ্রা কেটে গেল। তার বাড়ির উঠানে সত্যি সত্যি ভাত-কাপড় চেয়ে স্লোগান দেওয়া হচ্ছে। নেতৃত্বে আছে আবদুর রব। বঙ্গবন্ধু মেঝে থেকে পাইপ কুড়িয়ে নিয়ে পাইপ ধরালেন। তিনি মহাবিরক্ত। তার নিজের লোকজন কোথায়? বাড়ির ভেতর ভাত-কাপড়ের মিছিল হতে দেওয়া যায় না। ভাবমূর্তির ব্যাপার আছে। বিদেশি সাংবাদিকদের কেউ-না-কেউ আছেই। বসার ঘরে নিশ্চয়ই আছেন কূটনীতিকদের কেউ। একষট্টি জেলায় গভর্নর নিয়োগ প্রায় চূড়ান্ত। এরা সারাক্ষণই তাকে ঘিরে আছে। সবার ধারণা, চোখের আড়াল হলেই তারা বাদ পড়বে।
গভর্নরদের বিপক্ষের লোকজনও আছে। তাদের চেষ্টা ভাংচি দেওয়া। এরচেয়ে বড় সমস্যা দেনদরবারের লোকজন। বেশির ভাগই আসে মিলিটারির হাত থেকে আত্মীয়স্বজন ছাড় করানোর জন্যে।
দুষ্কৃতিকারীদের ধরার দায়িত্ব মিলিটারিদের হাতে দেওয়া মনে হয় ভুল হয়েছে। আসল দুষ্কৃতি ধরার নাম নেই, বেছে বেছে এরা ধরছে আওয়ামী লীগের নিবেদিত কর্মীদের। সর্বহারা কেউ তো মিলিটারির হাতে ধরা পড়ছে না। সিরাজ শিকদারকে কি মিলিটারি ধরেছে? ধরেছে পুলিশ। মিলিটারি নামেই মিলিটারি। কাজে লবডংকা।
যতই দিন যাচ্ছে মিলিটারির ওপর বঙ্গবন্ধু ততই বিরক্ত হচ্ছেন। মিলিটারি হচ্ছে দানববিশেষ। পাকিস্তানি মিলিটারি যেমন দানব, বাংলাদেশি মিলিটারিও তা-ই। সেন্টমার্টিন আইল্যান্ড যদি কোনো কারণে স্বাধীন হয়, তাদের মিলিটারি হয়, তারাও হবে দানব।
বঙ্গবন্ধু পঁচিশ বছরের জন্যে ভারতের সঙ্গে দেশরক্ষা চুক্তি করেছেন। এখন আর মিলিটারির প্রয়োজন নেই। ধীরে ধীরে মিলিটারিদের ক্ষমতা খর্ব করতে হবে। এমনভাবে করতে হবে যেন এরা বুঝতে না পারে। এক ভোরবেলা ঘুম ভেঙে এরা দেখবে, তাদের বুটের নিচে মাটি নেই। বুটের নিচে চোরাবালি। তারা ধীরে ধীরে চোরাবালিতে ডুবতে থাকবে। দানবকে মানব বানানোর এই একটাই উপায়।
পাইপ হাতে বঙ্গবন্ধু উঠে দাঁড়ালেন। এখন এক এক করে দর্শনার্থী বিদায় করার পালা। সেদিন তিনি যাদের সঙ্গে দেখা করলেন এবং যে ব্যবস্থা নিলেন তার তালিকা দেওয়া হলো—
১. নিবেদিতপ্রাণ আওয়ামী লীগার মোজাম্মেলের আত্মীয়স্বজন
মোজাম্মেল ধরা পড়েছে মেজর নাসেরের হাতে। স্থান : টঙ্গি।
বঙ্গবন্ধু ঘরে ঢোকামাত্র মোজাম্মেলের বাবা ও দুই ভাই কেঁদে বঙ্গবন্ধুর পায়ে পড়ল। টঙ্গী আওয়ামী লীগের সভাপতিও পায়ে ধরার চেষ্টা করলেন। পা খুঁজে পেলেন না। পা মোজাম্মেলের আত্মীয়স্বজনের দখলে।
বঙ্গবন্ধু বললেন, ঘটনা কী বলে?
টঙ্গি আওয়ামী লীগের সভাপতি বললেন, আমাদের মোজাম্মেল মিথ্যা মামলায় জড়িয়েছে। মেজর নাসের তাকে ধরেছে। নাসের বলেছে, তিন লাখ টাকা দিলে ছেড়ে দিবে।
মিথ্যা মামলাটা কী?
মোজাম্মেলের বাবা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, খুনের মামলা লাগায়ে দিয়েছে।
টঙ্গী আওয়ামী লীগের সভাপতি বললেন, এই মেজর আওয়ামী লীগ শুনলেই তারাবাতির মতো জ্বলে ওঠে। সে প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছে—টঙ্গিতে আমি কোনো আওয়ামী লীগের বদ রাখব না।
বঙ্গবন্ধু! আমি নিজেও এখন ভয়ে অস্থির। টঙ্গিতে থাকি না। ঢাকায় চলে এসেছি। (ক্রন্দন)।
বঙ্গবন্ধু বললেন, কান্দিস না। কান্দার মতো কিছু ঘটে নাই। আমি এখনো বেঁচে আছি। মরে যাই নাই। ব্যবস্থা নিচ্ছি।
তিনি মোজাম্মেলকে তাৎক্ষণিকভাবে ছেড়ে দেওয়ার আদেশ দিলেন। মেজর নাসেরকে টঙ্গি থেকে সরিয়ে দেওয়ার জরুরি নির্দেশ দেওয়া হলো।
মূল ঘটনা (সূত্র : Bangladesh Legacy of Blood, Anthony Mascarenhaas) এক নবদম্পতি গাড়িতে করে যাচ্ছিল। দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী মোজাম্মেল দলবলসহ গাড়ি আটক করে। গাড়ির ড্রাইভার ও নববিবাহিত তরুণীর স্বামীকে হত্যা করে। মেয়েটিকে সবাই মিলে ধর্ষণ করে। মেয়েটির রক্তাক্ত ডেড বডি তিন দিন পর টঙ্গি ব্রিজের নিচে পাওয়া যায়।
মেজর নাসেরের হাতে মোজাম্মেল ধরা পড়ার পর মোজাম্মেল বলল, ঝামেলা করে আমাকে ছেড়ে দিন। আমি আপনাকে তিন লাখ টাকা দেব। বিষয়টা সরকারি পর্যায়ে নেবেন না। স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আমি ছাড়া পাব। আপনি পড়বেন বিপদে। আমি তুচ্ছ বিষয়ে বঙ্গবন্ধুকে জড়াতে চাই না।
মেজর নাসের বললেন, এটা তুচ্ছ বিষয়?
মোজাম্মেল জবাব দিল না। উদাস চোখে তাকাল।
মেজর নাসের বললেন, আমি অবশ্যই তোমাকে ফাঁসিতে ঝোলাবার ব্যবস্থা করব। তোমার তিন লাখ টাকা তুমি তোমার গুহ্যদ্বারে ঢুকিয়ে রাখো।
মোজাম্মেল বলল, দেখা যাক।
মোজাম্মেল ছাড়া পেয়ে মেজর নাসেরকে তার বাসায় পাকা কাঁঠাল খাওয়ার নিমন্ত্রণ করেছিল।
২. উজবেক তরুণী ডোরা রাসনা
এই অসম্ভব রূপবতী তরুণী রুবাব নামের এক বাদ্যযন্ত্র নিয়ে এসেছে। সে একজন গায়িকা ও গীতিকার। সে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি গান রচনা করেছে। গানটি শোনাতে চায়।
বঙ্গবন্ধু আগ্রহ নিয়ে গান শুনলেন। গান শুনে তার চোখ অশ্রুসিক্ত হলো। তিনি রুমালে চোখ মুছলেন। ডোরা রাসনা বঙ্গবন্ধুর পায়ের কাছে বসে বেশ কিছু ছবি তুলল। বঙ্গবন্ধু ডোরা রাসনাকে উপহার হিসেবে রুপার একটি নৌকা দিলেন। উজবেক তরুণীর গানের কয়েকটি চরণ—
তুমি বঙ্গের বন্ধু শুধু নও
পৃথিবীর সব নিপীড়িত জনতার বন্ধুও হও।
হে বন্ধু। তোমার বিশাল হৃদয়ে আমাদের স্থান দাও
যাতে আমরা দুঃখ-কষ্ট ভুলে মনের আনন্দে
নৃত্যগীত করতে পারি।
৩. ছানু ভাই
ছানুর বাড়ি ময়মনসিংহের সোহাগীতে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার একবারই দেখা হয়েছিল। সে প্রায় দশ মিনিট বঙ্গবন্ধুর পা ধরে বসে ছিল। বঙ্গবন্ধু অনেক চেষ্টা করেও ছানুর হাত থেকে পা উদ্ধার করতে পারেন নি। ছানু ভাইয়ের আপন লোক আবু বক্কর তিন ঘণ্টা হলো হলঘরে বসে আছে। একসময় বঙ্গবন্ধু তার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই কে?
আমি আবু বক্কর।
কুষ্টিয়ার আবু বক্কর?
জে-না। মইমনসিংহের।
তোর সঙ্গে আগে কি আমার দেখা হয়েছে?
জে-না। তয় আমার ওস্তাদের সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছে। ওস্তাদের নাম ছানু ভাই।
সোহাগীর ছানু?
জে।
কেরোসিনের দুই টিন নিয়ে বসে আছিস, কেরোসিনের টিনে আছে কী? কেরোসিন? আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারবি?
টিনে করে আপনার জন্যে কই মাছ এনেছি।
সাইজ কী?
এক বিঘৎ সাইজ।
সাইজ খারাপ না। এক বিঘৎ কই মাছ অনেক দিন খাই না। ছানু চায় কী আমার কাছে?
কিছু চায় না।
সবাই কিছু-না-কিছু চায়। ছানু চায় না?
জে-না।
সে করে কী এখন?
আপনারে নিয়া আছেন। মুজিব সেন্টার করেছেন।
বঙ্গবন্ধু বেশ কিছুক্ষণ ঠা ঠা করে হাসলেন। হাসি থামিয়ে বললেন, ছানু বিরাট ধড়িবাজ। মতলব ছাড়া সে কিছু করে না। কই মাছেও তার মতলব আছে। যা, কই মাছ ভেতরের বাড়িতে দিয়ে আয়। সবগুলা যেন ভাজে। আজ উপস্থিত যারা আছে সবাই এক পিস কই মাছ খাবে। শুধু তুই খাবি না। তুই কই মাছ খাওয়া দেখতে এসেছিস, তুই শুধু দেখবি।
জে আচ্ছা।
রিলিফের কম্বল কি পেয়েছিস?
জে-না।
কোটি কোটি রিলিফের কম্বল এসেছে, আর তুই পাস নাই! আমার চারপাশে আছে চাইট্যা খাওয়ার দল। রিলিফের সব কম্বল এরাই চেটে খেয়ে ফেলেছে। তুই আর কী পাবি? যাই হোক, আমি বলে দিচ্ছি দুটা ভালো কম্বল যেন পাস।
৪. সতেরজন সম্ভাব্য জেলা গভর্নর
এঁরা সবাই ব্যক্তিগতভাবে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলতে চান। এরা কেউ অন্যের সামনে মুখ খুলবেন না। বঙ্গবন্ধু তাদের কারোর সঙ্গেই কথা বললেন না। তবে প্রত্যেককে কই মাছ ভাজা খেয়ে যেতে বললেন। তারা সবাই মুখ ভোঁতা করে ভাজা কই মাছের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলেন।
৫. খন্দকার মোশতাক
তিনি কাঠের বাক্সে করে বঙ্গবন্ধুর জন্যে বিশেষ এক উপহার নিয়ে এসেছেন। একুশ ভরি সোনায় বানানো বটগাছ। নিচে লেখা—‘বটবৃক্ষ শেখ মুজিব’। তার নিচে লেখা—’আগামসি লেন স্বর্ণকার সমিতি’।
মোশতাক বললেন, সবাই আপনাকে দেয় নৌকা। এরাও নৌকা বানাতে চেয়েছিল। আমি বললাম, গাধারা! বটগাছ বানা। বঙ্গবন্ধু আমাদের বটবৃক্ষ। আমরা আছি তার ছায়ার নিচে।
বঙ্গবন্ধু স্বর্ণের বটগাছ দেখে আনন্দ পেলেন।
খন্দকার মোশতাক বললেন, বাজারে চালু গুজবটা কি শুনেছেন?
কী গুজব?
তাজউদ্দিনকে আপনি নাকি আবার মন্ত্রীসভার সদস্য করছেন।
কী আশ্চর্য কথা!
খন্দকার মোশতাক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, এই গুজব তাজউদ্দিন নিজেই ছড়াচ্ছে। যাতে আবার ফিরে আসতে পারে।
বঙ্গবন্ধু দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন।
খন্দকার মোশতাক বললেন, অন্য কারও বিষয়ে আপনার সাবধান হওয়ার প্রয়োজন নাই। তাজউদ্দিনের বিষয়ে শুধু সাবধান থাকবেন।
৬. রাধানাথ বাবু
রাধানাথ বাবুর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু দেখা করতে চাচ্ছিলেন না, কিন্তু ইন্ডিয়ান অ্যাম্বাসি বিশেষভাবে চাচ্ছে তিনি যেন দেখা করেন।
বঙ্গবন্ধু বললেন, আপনাকে কি আমি চিনি?
বঙ্গবন্ধু অনেক বৃদ্ধকেও ‘তুই’ করে বলেন। রাধানাথ বাবুর সৌম্য চেহারা মনে হয় বাধ সাধল। তাঁকে তিনি ‘আপনি করে বললেন।
রাধানাথ বললেন, আপনি আমাকে চেনেন না। আপনার সঙ্গে পরিচয় থাকার মতো যোগ্যতা আমার নেই।
আপনি কে?
আমার নাম রাধানাথ। আমার একটা ছাপাখানা আছে। ছাপাখানার নাম ‘আদর্শলিপি।
আমার কাছে কী? আমি একজন হস্তরেখাবিদ। আমি আপনার হাত দেখতে এসেছি।
আমার হাত দেখে কী করবেন? আমার কর্ম দেখুন। সাধুর বিচার ধর্মে, পুরুষের বিচার কর্মে।
রাধানাথ বললেন, জনাব, আমি আপনাকে সাবধান করতে এসেছি। আপনার সামনে মহাবিপদ।
হাত না-দেখেই আপনি আমার মহাবিপদে টের পেয়ে গেলেন? ভালো কথা, আপনি কি কোনোভাবে ইন্ডিয়ান অ্যাম্বাসির সঙ্গে যুক্ত?
জি-না জনাব। তবে ইন্ডিয়া বিশাল দেশ। এই দেশ শুধু যে অ্যাম্বাসির মাধ্যমে কাজ করে তা না। তার আরও প্রক্রিয়া আছে।
আপনি কি প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত?
হ্যাঁ। আপনাকে আমার সাবধান করার কথা। আমি তা করলাম। আপনার সবচেয়ে বড় ভরসা বাংলাদেশের মানুষ। আপনার মহাবিপদে তারা কিন্তু আপনাকে ত্যাগ করবে। আপনার পাশে থাকবে না।
বঙ্গবন্ধু বিরক্ত ও তিক্ত গলায় বললেন, ইন্ডিয়ান কারও পক্ষে বাংলাদেশের মানুষ চেনার কথা না। আমি আমার মানুষ চিনি।
জনাব। কিন্তু আমি বাংলাদেশের মানুষ। আমার বাড়ি কিশোরগঞ্জ।
আপনার কথা কি শেষ হয়েছে?
অপ্রয়োজনীয় কথা শেষ হয়েছে। প্রয়োজনীয় কথাটা বাকি আছে।
প্রয়োজনীয় কথা বলে চলে যান। আমি অসম্ভব ব্যস্ত। ভালো কথা, কই মাছ খাওয়ার নিমন্ত্রণ। কই মাছ ভাজা হচ্ছে। এক পিস খেয়ে যাবেন। এখন বলুন আপনার প্রয়োজনীয় কথা।
খন্দকার মোশতাক বিষয়ে আপনাকে সাবধান করতে এসেছি। ইনি চেষ্টায় আছেন আপনাকে সরিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে ফেডারেশন জাতীয় কিছু করার।
বঙ্গবন্ধু বিরক্ত গলায় বললেন, খন্দকার মোশতাককে আপনি চেনেন না। আমি চিনি। আমি যদি তাকে বলি, এক মাস ঘাস খেতে হবে, সে দু’মাস ঘাস খাবে।
রাধানাথ বাবু দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আমরা সবাই ঘাস খাওয়া শিখলে দেশের খাদ্যসমস্যা সমাধান হয়ে যেত।
বঙ্গবন্ধু উঠে দাঁড়ালেন। এই আধাপাগলকে সময় দেওয়াই ভুল হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু মন খারাপ করে ৩২ নম্বর বাড়ির উঠানে এসে দাঁড়ালেন। সঙ্গে সঙ্গে তার মন ভালো হয়ে গেল। উঠানভর্তি মানুষ। ভুখা মিছিলের মানুষ না। সাধারণ মানুষ, যারা বঙ্গবন্ধুকে একনজর দেখতে এসেছে।
স্লোগান শুরু হলো, জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’। বঙ্গবন্ধু হাসিমুখে তাদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লেন।
ধবধবে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা অতি সুপুরুষ এক যুবক দামি ক্যামেরায় মিছিলের ছবি তুলছে। যুবক একপর্যায়ে ইশারায় বঙ্গবন্ধুর ছবি তোলার অনুমতি প্রার্থনা করল। বঙ্গবন্ধু উচ্চস্বরে বললেন, ছবি তুলতে চাইলে তুলবি। অনুমতির ধার ধারবি না।
যুবককে বঙ্গবন্ধুর পরিচিত মনে হচ্ছে। তবে তিনি তার নাম মনে করতে পারছেন না। হঠাৎ হঠাৎ তার এ রকম হয়, নাম মনে আসে না।
যুবক এসে বঙ্গবন্ধুকে কদমবুসি করল। বঙ্গবন্ধু বললেন, কই মাছ খেয়ে যাবি। কই মাছ ভাজা হচ্ছে।
যুবকের নাম ফারুক। সে এসেছে রেকি করতে। মূল আক্রমণের সময় কোন গানার কোথায় থাকবে তা জানা থাকা দরকার।
বাড়ি আক্রান্ত হলে পালাবার পথগুলো কী কী তাও জানা থাকা দরকার। ধানমন্ত্রি পুরনো বাড়িগুলোতে মেথর প্যাসেজ বলে এক কাঠার মতো ফাঁকা জায়গা থাকে। এ বাড়িতেও নিশ্চয়ই আছে। মেথর প্যাসেজ দিয়ে কেউ যেন পালাতে না পারে।