বেদ ও ঈশ্বরের বিষয়
অথ সপ্তম-সমুল্লাসারন্থঃ
অথেশ্বরবেদবিষয়ং ব্যাখ্যাস্যামঃ
ঋচো অক্ষরে পরমে ব্যোমন্যস্মিন্ দেবা অধি বিশ্বে নিষেদুঃ।য়স্তন্ন বেদকিমৃচা করিষ্যতি য় ইত্তদ্বিদুস্ত ইমে সমাসতে ॥১॥ ঋ০ ম০ ১ ॥১৬৪।৩৯ ঈশা বাস্যমিদ সর্বংয়ৎ কিঞ্চ জগত্যাংজগৎ তেন ত্যক্তেন ভূঞ্জীথা মা গৃধঃ কন্স্য স্বিদ্ধনম্ ॥ ২ ॥ যজু০ ৪০১। অহম্ভবং বসুনঃ পূৰ্বম্পতিরহং ধনানি সংজয়ামি শশ্বতঃ। মাং হবন্তে পিতরং ন জন্তবোহংদাশুষে বিভজামি ভোজনম্ ॥৩॥ ঋ০ ১০ ।৪৮। ১ অহমিন্দ্রো ন পরা জিগ্য ইদ্ধনং ন মৃত্যবেবিতস্থে কদাচন। সোমমিন্ম সুম্বন্তো য়াচতা বসুন মে পূরবঃ সখ্যে রিষাথন ॥ ৪ ॥ ঋ০১০৪৯৫ অহং দাং গৃণতে পূর্বং বস্বহং ব্রহ্ম কৃণবং মহ্যংবর্ধন। অহং ভূবং য়জমানস চোদিতায়জ্বনঃ সাক্ষি বিশ্বস্মিন্ ভরে ॥ ৫৷ ঋ০১০১০৪৯১ ॥ (ঋচো অক্ষরে) –এই মন্ত্রের অর্থ ব্রহ্মচর্যাশ্রমের শিক্ষা প্রসঙ্গে লিখিত হইয়াছে অর্থাৎ যিনি সকল দিব্য গুণ-কর্ম-স্বভাব ও বিদ্যাযুক্ত এবং যাঁহাতে পৃথিবী ও সূৰ্য্যাদিলোক স্থিত; যিনি আকাশের ন্যায় ব্যাপক এবং যিনি সকল দেবতাদিগের দেবতা পরমেশ্বর; যে মনুষ্যগণ তাহাকে জানে না, মানে না ও তাঁহার ধ্যান করে না, সেই সকল মন্দমতি নাস্তিক সর্বদা দুঃখসাগরে ডুবিয়া থাকে এইজন্য তাহাকেই জানিয়া সকল মনুষ্য সর্বদা সুখী হয়।
প্রশ্ন–বেদে ঈশ্বর অনেক ইহা তুমি স্বীকার কর কী না?
উত্তর –করি না। কারণ চারি বেদের কোন স্থলে এইরূপ লেখা নাই, যদ্বারা অনেক ঈশ্বর সিদ্ধ হইতে পারে। কিন্তু ইহাই লিখিত আছে যে ঈশ্বর এক।
প্রশ্ন– বেদে যে অনেক দেবতার উল্লেখ আছে তাহার অভিপ্রায় কী?
উত্তর –’দিব্য গুণযুক্ত হইলেই’ ‘দেবতা’ বলা হয়; যথা–পৃথিবী। কিন্তু ইহাকে কোন স্থলে ঈশ্বর অথবা উপাসনীয় বলিয়া মানা হয় নাই। দেখ, এই মন্ত্রেই ‘যাহাতে সকল দেবতা স্থিত আছে, তিনি জানিবার ও উপাসনা করিবার যোগ্য ‘ঈশ্বর। দেবতা শব্দের ঈশ্বর অর্থ গ্রহণ করা ভুল। পরমেশ্বর দেবতাদিগের দেবতা বলিয়া মহাদেব কথিত হন। কেননা তিনি সমস্ত জগতের উৎপত্তি, স্থিতি ও প্রলয়কর্তা, ন্যায়াধীশ এবং অধিষ্ঠাতা ॥
ত্রয়স্ত্রিংশৎত্রিশতা, ইত্যাদি বেদে প্রমাণ আছে। শতপথ ব্রাহ্মণে ইহার ব্যাখ্যা করা হইয়াছে। ‘তেত্রিশ দেব’ অর্থাৎ পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায়ু, আকাশ, চন্দ্রমা, সূৰ্য্য এবং নক্ষত্র সকল-সৃষ্টির নিবাস স্থান বলিয়া এ সকলকে ‘আট বসু’ বলে; প্রাণ, অপান, ব্যান, উদান, সমান, নাগ,কূর্ম, কৃকল, দেবদত্ত, ধনঞ্জয় এবং জীবাত্মা–এই এগারটি দেহান্তকালে রোদন করায় বলিয়া ইহাদিগকে ‘রুদ্র’ বলে; সংবৎসরের বার মাস সকলের আয়ু হরণ করে বলিয়া এই সকলকে ‘আদিত্য’ বলে; পরম ঐশ্বৰ্য হেতু বলিয়া বিদ্যুতের নাম ‘ইন্দ্র’। যজ্ঞকে ‘প্রজাপতি’ বলিবার কারণ এই যে, তদ্বারা বায়ু, বৃষ্টি, জল, ওষধির, বিদ্বানদিগের সম্মান এবং বিবিধ শিল্পবিদ্যার সাহায্যে প্রজাপালন হইয়া থাকে।
পূর্বোক্ত গুণ সমূহের সংযোগ বশতঃ এই তেত্রিশটিকে ‘দেব’ বলে। দেবগণের অধিপতি ও সর্বাপেক্ষা মহান্ বলিয়া পরমাত্মা চতুত্রিংশ উপাস্য দেব। ইহা শতপথ ব্রাহ্মণের চতুর্দশ কাণ্ডে স্পষ্টরূপে লিখিত আছে। অন্যত্রও এইরূপ লিখিত আছে। এই সকল শাস্ত্র দেখিলে বেদে বহু ঈশ্বরবাদরূপ ভ্রমজালে পতিত হইয়া বিভ্রান্ত হইবে কেন? ॥ ১ ॥
হেমনুষ্যগণ! যিনি জগতের যাবতীয় গতিশীল বস্তুর মধ্যে পরিব্যাপ্ত হইয়া (উহার) নিয়ন্তারূপে বিদ্যমান রহিয়াছেন, তোমরা সেই ঈশ্বরকে ভয় করিয়া অন্যায়রূপ কাহারও ধন গ্রহণের আকাঙ্ক্ষা করিও না। তাদৃশ অন্যায় আচরণ পরিত্যাগ পূর্বক ন্যায় আচরণ ধর্মানুষ্ঠান দ্বারা নিজ আত্মায় আনন্দ উপভোগ কর ॥ ২ ॥
ঈশ্বর সকলকে উপদেশ দিতেছেন,”হে মনুষ্যগণ! আমি সকলের পূর্বে বিদ্যমান্ সব জগতের পতি, সনাতন জগকারণ এবং সমস্ত ধনের বিজেতা ও দাতা। যেমন পিতাকে সম্বোধন করে, সকল জীব সেইরূপ আমাকে সম্বোধন করুক। আমি সকলের সুখদাতা। আমি জগতের পালনার্থ বিবিধ আহাৰ্য্য দ্রব্য বিতরণ করিয়া থাকি।৩ ॥
‘আমি পরম ঐশ্বৰ্য্যশালী এবং সূৰ্য্যের ন্যায় সমস্ত জগতের প্রকাশক। আমি কখনও পরাজিত ও মৃত্যু কবলিত হই না। আমিই জগদ্রপ ঐশ্বর্য্যের নির্মাতা। তোমরা আমাকেই জগতের সৃষ্টিকর্তা বলিয়া জানিবে। হে জীবগণ! তোমরা ঐশ্বৰ্য্যলাভের জন্য যত্নবান হইয়া আমার নিকট বিজ্ঞান প্রভৃতি ধন প্রার্থনা কর। আমার মিত্রভাব হইতে পৃথক্ হইও না’ ॥৪ ॥
‘হে মনুষ্যগণ! আমি সত্যাভাষণরূপ স্তুতিকারীদের সকলকে সনাতন জ্ঞানাদি ধন প্রদান করি। আমি ‘ব্রহ্ম’ অর্থাৎ বেদ প্রকাশক। বেদ আমার যথার্থ রূপে বর্ণনা প্রকাশ করে। আমি বেদ দ্বারা সকলের জ্ঞান বর্ধিত করি। আমি সৎপুরুষদের প্রেরণাদাতা। আমি যজ্ঞানুষ্ঠাতাদের ফলদাতা। আমি । এই বিশ্বে সকল পদার্থের স্রষ্টা ও ধর্তা। অতএব তোমরা আমাকে পরিত্যাগ করিয়া, আমার স্থানে (পরিবর্তে) অন্য কাহারও পূজা করিও না, অন্য কাহাকেও ঈশ্বর বলিয়া মানিও না জানিও না ॥ ৫ ॥
হিরণ্যগর্ভঃ সমবাগ্রে ভূতস্য জাতঃ পতিরেক আসীৎ। স দাধার পৃথিবীং দ্যামুতেমাং কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম৷ ঋজু ১৩। ৪ ॥
ইহা যজুর্বেদের মন্ত্র। হে মনুষ্যগণ! যিনি সৃষ্টির পূর্বে সূৰ্য্যাদির তেজোময় লোকসমূহের উৎপত্তি স্থান, আধার এবং যাহা কিছু উৎপন্ন হইয়াছিল, আছে ও ভবিষ্যতে হইবে, তাহার অধিপতি ছিলেন, আছেন ও থাকিবেন; তিনি পৃথিবী হইতে সূর্যালোক পর্যন্ত যাবতীয় সৃষ্টি রচনা করিয়া ধারণ করিতেছেন; সেই সুখ স্বরূপ পরমাত্মারই ভক্তি আমরা যেরূপ করি তোমরাও সেইরূপ কর।
প্রশ্ন–আপনি ঈশ্বর ঈশ্বর বলেন, কিন্তু ঈশ্বর সিদ্ধি করেন কীরূপে?
উত্তর –প্রত্যক্ষাদি প্রমাণ দ্বারা।
প্রশ্ন –ঈশ্বর সম্বন্ধে প্রত্যক্ষাদি প্রমাণ কদাপি ঘটিতে পারে না।
উত্তর ইন্দ্রিয়ার্থসন্নিকর্ষোৎপন্নং জ্ঞানমব্যপদেশ্যমব্যভিচারিব্যবসায়াত্মকং প্রত্যক্ষম্৷ ইহা গৌতম মহর্ষি কৃত ন্যায় দর্শনের সূত্র।
কর্ণ, ত্ব, চক্ষু, জিহ্বা, ঘ্রাণ এবং মনের শব্দ, স্পর্শ, রূপ,রস, গন্ধ, সুখ, দুঃখ এবং সত্যাসত্য বিষয়ের সহিত সম্বন্ধ হওয়ায় যে জ্ঞান উৎপন্ন হয়, তাহাকে ‘প্রত্যক্ষ’ বলে। কিন্তু সেই জ্ঞান অভ্রান্ত হওয়া উচিত। এখানে বিচাৰ্য্য এই যে, ইন্দ্রিয় এবং মন দ্বারা গুণের প্রত্যক্ষ হয়, গুণীর প্রত্যক্ষ হয় না। যেমন ত্ব প্রভৃতিচারি ইন্দ্রিয় দ্বারা স্পর্শ, রূপ, রস এবং গন্ধের জ্ঞান হয় বলিয়া গুণবিশিষ্ট পৃথিবীকে, আত্মা সংযুক্ত মন দ্বারা প্রত্যক্ষ করা যায়। সেইরূপ এই প্রত্যক্ষ সৃষ্টিতে রচনা বিশেষ প্রভৃতি (কর্ম ও) জ্ঞানাদি গুণের প্রত্যক্ষ হওয়ায় পরমেশ্বরও প্রত্যক্ষ।
আর যখন আত্মা মনকে এবং মন ইন্দ্রিয় সমূহকে কোন বিষয়ে নিযুক্ত করে, বা চৌৰ্য্যাদি কুকর্ম অথবা পরোপকারাদি সৎকর্ম করিতে যখনই আরম্ভ করে, তখন জীবের ইচ্ছা, জ্ঞানাদি সেই ইচ্ছিত বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়। সেই মুহূর্তে আত্মার ভিতর হইতে কুকর্ম করিতে ভয়, সংশয় ও লজ্জা তথা সৎকর্মে নিশাঙ্কতা, অভয়, আনন্দ ও উৎসাহ জাগ্রত হইয়া উঠে। ইহা জীবাত্মার দিক হইতে নহে, কিন্তু পরমাত্মার দিক হইতে হইয়া থাকে।
যখন জীবাত্মা পবিত্র হইয়া পরমাত্মার চিন্তায় মগ্ন থাকে, তখন তাহার উভয়ই প্রত্যক্ষ হয়। পরমেশ্বর প্রত্যক্ষ হইলে অনুমানাদি দ্বারা পরমেশ্বর বিষয়ক জ্ঞান সম্বন্ধে সন্দেহ কী? কেননা, কাৰ্য্য দেখিয়া কারণের অনুমান হইয়া থাকে।
প্রশ্ন –ঈশ্বর ব্যাপক, অথবা তিনি কোন স্থান বিশেষে থাকেন?
উত্তর –ঈশ্বর ব্যাপক। কারণ একস্থানে থাকিলে তিনি সবান্তর্যামী, সর্বজ্ঞ, সর্বনিয়ন্তা, সকলের স্রষ্টা, ধর্তা, প্রলয়কর্তা হইতে পারিতেন না। যে স্থানে কর্তা নাই, সে স্থানে তাহার ক্রিয়া হওয়া অসম্ভব।
প্রশ্ন –পরমেশ্বর দয়ালু ও ন্যায়কারী কিনা?
উত্তর –হ্যাঁ।
প্রশ্ন –এই দুটি গুণ পরস্পর বিরুদ্ধ। ন্যায় করিলে দয়া এবং দয়া করিলে ন্যায় থাকে না। কেননা, কর্মানুসারে ন্যূনাধিক না করিয়া সুখ দুঃখ দেওয়াকে ‘ন্যায়’ বলে। আর বিনাদণ্ডে অপরাধীকে অব্যাহতি দেওয়ার নাম ‘দয়া’।
উত্তর –ন্যায় ও দয়ার মধ্যে কেবল নাম মাত্র প্রভেদ। কারণ ন্যায় দ্বারা যে প্রয়োজন সিদ্ধ হইয়া থাকে তাহাই দয়া দ্বারা সিদ্ধ হয়। মনুষ্য অপরাধজনক কাৰ্যে দুঃখলাভ না করুক–ইহাই দণ্ড দানের উদ্দেশ্য। পরদুঃখ মোচনের নাম দয়া। তুমি দয়া ও অন্যায়ের যে অর্থ করিয়াছ তাহা প্রকৃত অর্থ নহে। কারণ যে যেমন এবং যতটা কুকর্ম করিয়াছে, তাহাকে সেইরূপ এবং ততটা দণ্ড দেওয়া কর্তব্য। ইহারই নাম ন্যায়।
অপরাধীকে দণ্ড না দিলে দয়া নষ্ট হইয়া যায়। কারণ একজন অপরাধী দস্যুকে ছাড়িয়া দিলে, সহস্র সহস্র ধর্মাত্মাকে দুঃখ দেওয়া হয়। যদি এক জনকে ছাড়িয়া দিলে সহস্ৰ জনের দুঃখ দেওয়া হয়, তবে দয়া কীরূপে হইতে পারে? কিন্তু উক্ত দস্যুকে কারারুদ্ধ করিয়া পাপকর্ম হইতে নিবৃত্ত করিলে তাহার প্রতি দয়া করা হয়। সেই দস্যুকে বধ করিলে সহস্র মনুষ্যের প্রতি দয়া প্রকাশ পায়।
প্রশ্ন –তবে দয়া ও ন্যায় এই দুই শব্দের প্রয়োজন কী? কেননা ঐ দুইশব্দের অর্থ যদি একই প্রকার হয় তাহা হইলে দুইটি শব্দ রাখা বৃথা। এই কারণে একটি শব্দ থাকাই উত্তম। ইহা দ্বারা জানা যায় যে, দয়া ও ন্যায়ের উদ্দেশ্য এক নহে।
উত্তর –এক বস্তুর অনেক নাম এবং এক নামের কি অনেক অর্থ হয় না?
প্রশ্ন– হয়।
উত্তর –তবে সংশয় হইল কেন?;
প্রশ্ন –সংসারে তো তাহাই শুনিয়া থাকি।
উত্তর –সংসারে তো সত্য মিথ্যা দুইই শুনা যায়। কিন্তু বিচার পূর্বক নির্ণয় করা নিজের কাজ। দেখ, ঈশ্বরের পূর্ণ দয়া এই যে, তিনি সকল প্রয়োজন সিদ্ধির জন্য জগতে সকল পদার্থ সৃষ্টি করিয়া দান করিয়াছেন। ইহা অপেক্ষা মহতী দয়া কী হইতে পারে? ন্যায়ের ফলও প্রত্যক্ষ দেখা যায়। সুখ দুঃখের ব্যবস্থা কম ও বেশী দ্বারাই ফল প্রকাশিত হয়। উভয়ের মধ্যে প্রভেদ এই যে, সকলে সুখী হউক, সকলের দুঃখ দূর হউক, মনে এইরূপ ইচ্ছা ও তজ্জনিত ক্রিয়ার নাম ‘দয়া। আর বাহ্য চেষ্টা, অর্থাৎ বন্ধন ও ছেদনাদি যথাবৎ দণ্ডবিধান করার নাম ন্যায়’। উভয়ের একই উদ্দেশ্য–সকলকে দুঃখ ও পাপ হইতে দূরে রাখা।
প্রশ্ন –ঈশ্বর নিরাকার না সাকার?
উত্তর –নিরাকার। কারণ, সাকার হইলে তিনি ব্যাপক হইতেন না। ব্যাপক না হইলে সর্বজ্ঞাদি গুণও তাহাতে সম্ভব হইত না। কারণ পরিমিত বস্তুর গুণ-কর্ম স্বভাবও পরিমিত এবং উহা শীতোষ্ণ ক্ষুধা-তৃষ্ণা, রোগ-দোষ ও ছেদন-ভেদনাদি বিহীন হইতে পারে না। সুতরাং ঈশ্বর। নিশ্চয়ই নিরাকার। সাকার হইলে তাহার নাসিকা, কর্ণ এবং চক্ষু প্রভৃতি অঙ্গের নির্মাতা অপর । কেহ থাকা উচিত। কারণ, যাহা সংযোগ হইতে উৎপন্ন হয়, তাহার সংযোগকর্তা নিরাকার ও চেতন হওয়া অবশ্য উচিত। যদি কেহ বলেন যে, ঈশ্বর স্বেচ্ছায় স্বয়ং স্বীয় শরীর নির্মাণ করিয়াছেন, তাহা হইলেও সিদ্ধ হইতেছে যে, শরীর নির্মাণের পূর্বে তিনি নিরাকার ছিলেন। অতএব পরমাত্মা কখনও শরীর ধারণ করেন না, কিন্তু তিনি নিরাকার বলিয়া সমগ্র জগৎকে সূক্ষ্ম কারণ হইতে স্থলাকাররূপে নির্মাণ করিয়া থাকেন।
প্রশ্ন –ঈশ্বর সর্বশক্তিমান কি না?
উত্তর –হ্যাঁ, কিন্তু তুমি সর্বশক্তিমান শব্দের অর্থ যাহা জানো তাহা নহে। সর্বশক্তিমান’শব্দের অর্থ এই যে, ঈশ্বর স্বীয় কর্ম অর্থাৎ সৃষ্টি– স্থিতি– প্রলয়াদি এবং সর্বজীবে পাপ পুণ্যের যথাযোগ্য ব্যবস্থা। করিতে, কাহারও কিছুমাত্র সহায়তা গ্রহণ করেন না। অর্থাৎ তিনি তাহার অনন্ত সামর্থ্য দ্বারা নিজের যাবতীয় কর্ম পূর্ণ করিয়া থাকেন।
প্রশ্ন –এইরূপ মানি যে, ঈশ্বর যাহা ইচ্ছা তাহাই করেন। কারণ তাহার উপর দ্বিতীয় কেহই নাই।
উত্তর –তিনি কী ইচ্ছা করেন? যদি তুমি বল যে, তিনি সমস্তই ইচ্ছা করেন, সমস্তই করিতে পারেন, তবে আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করি, পরমেশ্বর কি আত্মহত্যা করিতে পারেন? তিনি বহু ঈশ্বর সৃষ্টি করিতে পারেন? পরমেশ্বর মূর্খ হইতে পারেন? পরমেশ্বর কিচুরি, ব্যভিচারাদি পাপকর্ম করিয়া দুঃখী হইতে পারেন?যদি এইসকল কর্মঈশ্বরের গুণকর্মও স্বভাববিরুদ্ধহয়, তাহা হইলে তুমি বলিতেছ–তিনি। সবকিছু করিতে পারেন, এ উক্তি কখনও প্রযুক্ত হইতে পারে না। সুতরাং আমি সর্বশক্তিমান্ শব্দের যে অর্থ করিয়াছি, তাহাই ঠি।
প্রশ্ন –পরমেশ্বর আদি না অনাদি?
উত্তর –অনাদি। অর্থাৎ যাঁহার কোন আদি কারণ বা কাল নাই, তাহাকে ‘অনাদি’ বলে। এই সকল ব্যাখ্যা প্রথম সমুল্লাসে করা হইয়াছে। সে স্থলে দ্রষ্টব্য।
প্রশ্ন– পরমেশ্বর কী চান?
উত্তর –তিনি সকলের কল্যাণ ও সুখ চান। কিন্তু তিনি স্বাধীনভাবে কাহাকেও বিনা পাপে পরাধীন করেন না।
প্রশ্ন –পরমেশ্বরের স্তুতি, প্রার্থনা এবং উপাসনা করা উচিত কিনা?
উত্তর –করা উচিত।
প্রশ্ন –স্তুতি প্রভৃতি করিলে কি ঈশ্বর নিজ নিয়ম ভঙ্গ করিয়া স্তুতি প্রার্থনাকারীর পাপ মোচন করিয়া দিবেন?
উত্তর –না।
প্রশ্ন –তবে স্তুতি প্রার্থনা করিবার প্রয়োজন কী?
উত্তর –ঐ সকলের অন্য ফল আছে।
প্রশ্ন –সে ফল কী রূপ?
উত্তর –‘স্তুতি’ দ্বারা ঈশ্বর প্রীতি জন্মে। তাহার গুণ-কর্ম-স্বভাব দ্বারা নিজ গুণ কর্ম স্বভাবের সংশোধন হয়। প্রার্থনা’ দ্বারা নিরভিমানতা, উৎসাহ ও সাহায্য লাভ হয়। উপাসনা’ দ্বারা পরম ব্রহ্মের সহিত মিলন ঘটে এবং তাহার সাক্ষাৎকার হয়।
প্রশ্ন –ইহাকে স্পষ্ট করিয়া বুঝাইয়া বলুন।
উত্তর –যথা–ঈশ্বরস্তুতি। স পয়গাচ্ছুক্রমকায়মব্রণস্নাবির শুদ্ধমপাপবিদ্ধ কবিৰ্মনীষী পরিভুঃস্বয়ম্ভুয়াথাতথ্যতোর্থাব্যদধাচ্ছা শ্বতীভ্যঃসমাভ্যঃ ॥১॥ যজু ০ ৪০৮
সেই পরমাত্মা সর্বত্র ব্যাপক, ক্ষিপ্র কর্মা এবং অনন্ত শক্তিশালী। তিনি শুদ্ধ, সর্বজ্ঞ, সকলের অন্তর্যামী, সর্বোপরি বিরাজমান, সনাতন এবং স্বয়ংসিদ্ধ। পরমেশ্বর বেদ দ্বারা অপর জীবরূপ সনাতন অনাদি প্রজাদিগকে সনাতন বিদ্যা দ্বারা ও যথাবৎ অর্থবোধ করাইয়া থাকেন। ইহা ‘সগুণ স্তুতি। অর্থাৎ যে সকল গুণের সহিত পরমেশ্বরের স্তুতি করা হয় উহা ‘সগুণ’ এবং অকায়’ অর্থাৎ পরমেশ্বর কখনও শরীর ধারণ অথবা জন্মগ্রহণ করেন না। তাঁহার ছিদ্র নাই। তিনি নাড়ী প্রভৃতির বন্ধনে আবদ্ধ হন না। তিনি কখনও পাপাচারণ করেন না। তাহাতে ক্লেশ, দুঃখ ও অজ্ঞানতা কখনও সম্ভব হয় না। ইত্যাদি সকল রোগ ও দ্বেষাদি গুণ হইতে পৃথক্ জানিয়া ঈশ্বরের স্তুতি করা ‘নির্গুণ স্তুতি’।
ইহার দ্বারা পরমেশ্বরের গুণ-কর্ম-স্বভাব অনুযায়ী নিজ গুণ-কর্ম-স্বভাব নির্মাণ করা অর্থাৎ পরমেশ্বর যেরূপ ন্যায়কারী তুমি নিজেও সেইরূপ ন্যায়কারী হইবে। কিন্তু যে ব্যক্তি কেবল ভণ্ডের ন্যায় পরমেশ্বরের গুণ কীর্তন করিতে থাকে এবং নিজ চরিত্র সংশোধন করে না তাহার স্তুতি নিষ্ফল। প্রার্থনা
য়াং মেধাং দেবগণাঃ পিতরশ্চোপাসতে ॥ তয়া মামদ্য মেধয়াগ্নে মেধাবিনং কুরু স্বাহা ॥১॥ যজুঅ০৩২ ॥ ১৪ ॥ তেজোসি তেজোময়ি ধেহি। বীৰ্য্যমসি বীয়ং ময়ি ধেহি। বলমসি বলংময়ি ধেহিওজোস্যোজো ময়ি ধেহি। মোরসি মংময়ি ধেহি। সহোসি সহো ময়ি ধেহি ॥ ৷ ২ ॥ যজু০ অ০ ১৯ ॥ ৯ ॥ মজ্জাগ্রততা দূরমুদৈতি দৈবং তদু সুপ্তস্য তথৈবৈতি। দূরঙ্গমং জ্যোতিষাং জ্যোতিরেকং তন্মে মনঃ শিব সঙ্কল্পমস্তু ॥ ৩ ॥ য়েন কৰ্মাণ্যপসোেমনীষিণো য়জ্ঞে কৃন্তি বিদথেষু ধীরাঃ। য়দপূর্বংয়ক্ষমন্তঃ প্রজানাং তন্মে মনঃ শিবশঙ্কল্পমস্তু ॥ ৪ ॥ য়প্রজ্ঞানমুত চেতো ধৃতিশ্চয়জ্জ্যোতিরন্তরমৃতং প্রজাসু। য়স্মান্নঋতে কিং চন কর্ম ক্রিয়তে, তন্মে মনঃ শিবসঙ্কল্পমস্তু ॥ ৫ ॥ য়েনেদং ভূতং ভূবনং ভবিষ্যৎ পরিগৃহীতমমৃতেন সর্বম্ ॥ য়েন য়জ্ঞস্তায়তে সপ্তহোতা তন্মেমনঃ শিবসঙ্কল্পমস্তু ॥ ৬ ॥ যস্মিন্চঃসময়জুষি য়স্মিপ্রতিষ্ঠিতারথনাভাবিবারাঃ। য়স্মিশ্চিত্তওঁ সর্বমোতং প্রজানাং তন্মে মনঃ শিবসঙ্কল্পমস্তু ॥ ৭ ॥ সুষারথিরশ্বানিবয়ম্মনুষ্যান্নেনীয়তেড়ীশুভির্বাজিনইব ॥ হৃৎপ্রতিষ্ঠং য়দজিরং জবিষ্ঠং তন্মে মন-শিবসঙ্কল্পমস্তু ॥ ৮ ॥ যজু০ অ০ ৩৪১-৬ ॥
হে অগ্নে! অর্থাৎ প্রকাশ স্বরূপ পরমেশ্বর। আপনার কৃপায় বিদ্বান, জ্ঞানী এবং যোগীগণ (যোগপরায়ণ ব্যক্তিরা) যে বুদ্ধির উপাসনা করিয়া থাকেন, আপনি অদ্য আমাদের সকলকে সেই বুদ্ধির দ্বারা বুদ্ধিমান করুন ॥ ১ ॥
আপনি প্রকাশ স্বরূপ, কৃপা করিয়া আমাকেও প্রকাশিত করুন। আপনি অনন্ত পরাক্রমশালী, অতএব কৃপাকটাক্ষপাতে আমাকেও পূর্ণ পরক্রমশালী করুন। আপনি অনন্ত বলশালী, অতএব আমাকে বলশালী করুন। আপনি অনন্ত সামর্থ্যবান, আমাকেও পূর্ণ সামর্থ্য প্রদান করুন। আপনি দুষ্ট কর্ম এবং দুষ্কৃতকারীদের প্রতি ক্রোধ প্রকাশ করেন, আমাকেও সেইরূপ করুন। আপনি নিন্দা, স্তুতি এবং আপনার বিরুদ্ধে অপরাধকারীদের প্রতি সহনশীল। কৃপা করিয়া আমাকেও সেইরূপ করুন ৷ ২ ॥
হে দয়ানিধে! আপনার কৃপায় আমার মন জাগ্রত অবস্থায় দূর দুরান্তরে গমন করে এবং দিব্যগুণযুক্ত থাকে, আর নিদ্রিত অবস্থায় আমার সেই মন সুষুপ্তি প্রাপ্ত হয় বা স্বপ্নে দূর দূরান্তরে। গমনবৎ ব্যবহার করে। সকল প্রকাশকের প্রকাশক আমার সেই মন শিবসংকল্প অর্থাৎ নিজের ও অন্য প্রাণীদের পক্ষে কল্যাণসংকল্পকারী হউক। আমার মনে যেন কখনও কাহারও অনিষ্ট করিবার ইচ্ছা না হয় ॥ ৩ ॥
হে সর্বান্তর্যামি। যদ্বারা কর্মনিষ্ঠ ধৈৰ্য্যবান বিদ্বানেরা যজ্ঞ ও যুদ্ধাদিতে কাৰ্য্য করেন, যাহা অপূর্ব সামর্থ্যবান, পূজনীয় এবং প্রজাদিগের অন্তরে নিহিত, আমার সেই মন ধর্মাভিলাষী হইয়া। সর্বথা অধর্ম পরিত্যাগ করুক ॥ ৪ ॥
যাহা উৎকৃষ্ট জ্ঞান ও অপরের প্রতি জ্ঞানপ্রদ নিশ্চয়ত্মক বৃত্তি, যাহা প্রজাদিগের অন্তরে প্রকাশমান ও অবিনাশী এবং যাহা ব্যতীত কেহ কোনও কর্ম করিতে পারে না আমার সেই মন। শুদ্ধগুণাভিলাষী হইয়া দুগুণ হইতে দূরে থাকুক ॥ ৫ ॥
হে জগদীশ্বর! যদ্বারা যোগিগণ ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান কাৰ্য্য জানিতে পারেন, যাহা অবিনাশী জীবাত্মাকে পরমাত্মার সহিত মিলিত করিয়া সর্বপ্রকারে ত্রিকালজ্ঞ করে, যাহাতে জ্ঞান ও ক্রিয়া আছে; যাহা পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়, বুদ্ধি ও আত্মার সহিত সংযুক্ত এবং যদ্বারা যোগিগণ যোগরূপে যজ্ঞের বৃদ্ধি সাধন করেন, আমার মন সেই যোগবিজ্ঞান সম্পন্ন হইয়া অবিদ্যাদি ক্লেশ হইতে দূরে থাকুক ॥ ৬ ॥
হেপরম বিদ্বান্ পরমেশ্বর। আপনার কৃপায় যেমনে রথনাভি সংলগ্ন অরার ন্যায় ঋগ্বেদ, যজুর্বে সামবেদও অথর্ববেদ প্রতিষ্ঠিত এবং যাহার মধ্যে সর্বজ্ঞ, সর্বব্যাপক, প্রজাদিগের সাক্ষী চিত্ত চৈতন্যস্বরূপ বিদিত হয়;আমার সেই মন অবিদ্যা হইতে মুক্ত হইয়া সর্বদা বিদ্যাপ্রিয় থাকুক ॥ ৭ ॥
হে সর্বনিয়ন্তা ঈশ্বর! যে মন রজ্জবদ্ধ অশ্বের ন্যায় অথবা অশ্বনিয়ন্তা সারথির ন্যায় মনুষ্যদিগকে ইতস্ততঃ অত্যন্ত দোলায়মান করে যে মন হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত, গতিশীল এবং অত্যন্ত বেগবান্ আমার সেই মন ইন্দ্রিয় সমূহকে অধর্মাচরণ হইতে নিরুদ্ধ করিয়া সর্বদা ধর্মপথে চালিত করুক। আপনি আমার প্রতি এইরূপ কৃপা করুন ॥ ৮ ॥
অগ্নেনয় সুপথা রায়েঅস্মা বিশ্বানি দেববয়ুনানি বিদ্বান। য়ুয়োধ্যম্মজুহরাণমেনো ভূয়িষ্ঠান্তেনম উক্তিংবিধেম৷ ৯ ॥ যজু অ০৪০১৬ ॥
হে সুখদাতা, স্বপ্রকাশ-স্বরূপ সর্বজ্ঞ পরমাত্মন্। আপনি আমাদিগকে শ্রেষ্ঠ মার্গে পরিচালিত করিয়া সম্পূর্ণ প্রজ্ঞান প্রাপ্ত করান। এবং আমাদিগকে কুটিল পাপ আচরণরূপ মার্গ হইতে দূরে রাখুন। আমরা নম্রভাবে আপনার বহুবিধ স্তুতি করিতেছি। আমাদিগকে পবিত্র করুন ॥ ॥ ৷
মা নো মহান্তমুত মা নোঅর্ভকং মন উচ্চমুত মান উক্ষিত। মা নো বধীঃ পিতরং মোত মাতরংনঃ প্রিয়াস্তন্বো রুদ্র রীরিষঃ ॥১০ ॥ যজু০ অ০ ১৬।১৫ ॥
হে ‘রুদ্র’! দুষ্টদিগকে পাপের দুঃখরূপ ফল প্রদান করিয়া আপনি রোদন করান। আমাদের জেষ্ঠ-কনিষ্ঠ, গর্ভ, মাতাপিতা, প্রিয়জন, বন্ধুবর্গ তথা (তাহাদের) শরীর হনন করিবার জন্য কাহাকেও প্রেরণা দিবেন না। আমাদের সকলকে এরূপ পথে পরিচালিত করুন, আমরা যেন আপনার দ্বারা দণ্ডনীয় না হই ॥ ১০ ॥
অসতো মা সদ্ গময় তমসো মা জ্যোতির্গময় মৃত্যোর্মা মৃতং গময়েতি ॥ ৷
শতপথ ব্রা ১৪৩।১৩০ হে পরম গুরো পরমাত্মান! আপনি আমাদের সকলকে অসৎ মার্গ হইতে পৃথক করিয়া সম্মার্গে লইয়া চলুন। অবিদ্যারূপ অন্ধকার হইতে আমাদের সকলকে মুক্ত করিয়া আমাদের নিকট বিদ্যারূপ সূৰ্য্য প্রকাশিত করুন। মৃত্যু ও রোগ হইতে দূরে রাখিয়া আমাদের মোক্ষানন্দরূপ অমৃত প্রদান করুন।
অর্থাৎ যে যে দোষ অথবা দুগুণ হইতে পরমেশ্বরকে এবং নিজেকে পৃথক্মনে করিয়া পরমেশ্বরের নিকট প্রার্থনা করা হয়, বিধি-নিষেধমুখী হওয়াতে তাহাকে ‘সগুণ ও নির্গুণ প্রার্থনা বলে।
যিনি যে বিষয়ের জন্য প্রার্থনা করেন, তাহার তদ্রূপ আচরণ করা উচিত। অর্থাৎ কেহ যদি সর্বোত্তম বুদ্ধি লাভ করিবার জন্য পরমেশ্বরের নিকট প্রার্থনা করে, তজ্জন্য তাহাকে যথা সম্ভব প্রযত্ন করিতে হইবে। অর্থাৎ নিজ পুরুষকারের অতিরিক্ত প্রার্থনাও করা উচিত।
এইরূপ প্রার্থনা কখনও করা উচিত নহে এবং পরমেশ্বরও তাহা স্বীকার করেন না; যথা– হে পরমেশ্বর। আপনি আমার শত্রুদের বিনাশ করুন, আমাকে সর্বাপেক্ষা মহান করুন, আমারই খ্যাতি প্রতিপত্তি হউক, সকলে আমার অধীনতা স্বীকার করুক ইত্যাদি। কারণ, দুই শত্রুই পরস্পরের বিনাশের প্রার্থনা করিলে পরমেশ্বর কি উভয়কে বিনাশ করিবেন? যদি কেহ বলে যে, যাহার প্রেম অধিক তাহারই প্রার্থনা সফল হইবে। তাহা হইলে আমরা ইহাও তো বলিতে পারি যে, যাহার প্রেম অল্প তাহার শত্রু নাশ অল্প হওয়া উচিত। এইরূপ মূর্খতাসূচক প্রার্থনা করিতে করিতে কেহ এমন প্রার্থনা করিবে ‘হে পরমেশ্বর’! আপনি আমার জন্য অন্ন প্রস্তুত। করিয়া আমাকে খাওয়ান। আমার গৃহ পরিষ্কার করিয়া দেন। আমার বস্ত্র ধৌত করুন। আমার কৃষিকর্ম করুন।
যাহারা এইরূপে পরমেশ্বরের উপর নির্ভর করিয়া অলস ভাবে বসিয়া থাকে, তাহারা মহামূর্খ। কারণ, পরমেশ্বর পুরুষকার করিবার জন্য যে আদেশ দিয়াছেন, যে ব্যক্তি তাহা। লঙ্ঘন করে, সে কখনও সুখী হইতে পারে না। যথা–
কুন্নেবেহ কর্মাণি জিজীবিষেচ্ছতংসমাঃ। যজু০ অ০ ৪০।২ ॥
পরমেশ্বর আজ্ঞা দিতেছেন যে, মানুষ শত বৎসর পর্যন্ত, অর্থাৎ আজীবন কর্ম করিতে করিতে জীবনধারণের ইচ্ছা করিবে, কখনও অলস হইবে না ॥
দেখুন, সৃষ্টিতে যত প্রাণী অথবা অপ্রাণী আছে, সকলেই স্ব স্ব কর্ম করে এবং সচেষ্ট থাকে। পিপীলিকা প্রভৃতি সর্বদা কর্মরত থাকে। পৃথিবী আদি সর্বদা ভ্রমণ করে। বৃক্ষাদি সর্বদা বৃদ্ধি ও হ্রাস প্রাপ্ত হয়। এই সকল দৃষ্টান্ত মনুষ্যেরও গ্রহণ করা উচিত। যেরূপ পুরুষকাররত ব্যক্তির সহায়তা অপরেও করিয়া থাকে, সেইরূপ পরমেশ্বরও ধর্মপথে পুরুষার্থকারীর সহায় হইয়া থাকেন। যেরূপ কর্মঠ ব্যক্তিকে ভৃত্যরূপে নিযুক্ত করা হয়, অলস ব্যক্তিকে করা হয় না; যেরূপ দর্শনেচ্ছু নেত্রবান পুরুষকেই কোন বস্তু দেখান হয়, অন্ধকে দেখানও হয় না; সেইরূপ পরমেশ্বর সকলের উপকারার্থে প্রার্থনাকারীর সহায়ক হইয়া থাকেন। তিনি কোন অনিষ্ট কর্মে। সাহায্য করে না। যদি কেহ বলে গুড় মিষ্ট, একথা বলিলেই যেমন সে গুড় পায় না, বা গুড়ের আস্বাদন পায় না, কিন্তু যত্নবান্ পুরুষ শীঘ্র হউক অথবা বিলম্বে, গুড় পাইয়াই থাকে।
এবার তৃতীয় উপাসনা :– সমাধিনিধূর্তমলস্য চেতসো নিবেশিতস্যাত্মনিয়ৎসুখংভবেৎ। নশ্যতে বর্ণয়িতুং গিরা তদা স্বয়ন্তঃকরণেন গৃহ্যতে ॥
ইহা উপনিষদের বচন। সমাধিযোগ দ্বারা যাঁহার অবিদ্যা প্রভৃতি মল নষ্ট হইয়া গিয়াছে, যিনি আত্মস্থ হইয়া পরমাত্মাতে চিত্ত-সংলগ্ন করিয়াছেন, তিনি পরমাত্মার যোগজনিত যে আনন্দ প্রাপ্ত হন তাহা অনির্বচনীয়, জীবাত্মা অন্তঃকরণ দ্বারা সেই আনন্দ গ্রহণ করে।
‘উপাসনা’শব্দের অর্থ সমীপস্থ হওয়া। অষ্টাঙ্গ যোগ দ্বারা পরমাত্মার সমীপস্থ হইবার এবং তাহাকে সর্বব্যাপী ও সর্বান্তর্যামী রূপে প্রত্যক্ষ করিবার জন্য যাবতীয় কর্তব্য কর্ম করা উচিত। অর্থাৎ :
তত্র –অহিংসাসত্যস্তেয় ব্রহ্মচর্যপরিগ্রহা য়মাঃ ॥ ইত্যাদি পাতঞ্জাল যোগশাস্ত্রের সূত্র।
যিনি উপাসনা আরম্ভ করিতে ইচ্ছা করেন, তিনি কাহারও সহিত বৈরভাব রাখিবেন না। সর্বদা সকলের প্রতি প্রীতি করিবেন। সত্য বলিবেন, কখনও মিথ্যা বলিবেন না। সত্য আচরণ করিবেন। জিতেন্দ্রিয় হইবেন, লম্পট হইবেন না। নিরহঙ্কারী হইবেন, কখনও গর্ব করিবেন না। একত্রে এই পঞ্চবিধ ‘যম মিলিয়া’ উপাসনা যোগের প্রথম অঙ্গ।
শৌচসন্তোষপঃস্বাধ্যায়ের প্রণিধানানি নিয়মাঃ ॥ যোগ সূত্র ॥
রাগ-দ্বেষ পরিত্যাগ করিয়া অন্তরে এবং জলাদির দ্বারা বাহিরে পবিত্র থাকিবে। ধর্মানুসারে পুরুষাৰ্থ করিলে লাভে সন্তুষ্ট অথবা হানিতে অসন্তুষ্ট হইবে না। আলস্য পরিত্যাগ করিয়া সর্বদা প্রফুল্লচিত্তে পুরুষাৰ্থ করিতে থাকিবে। সর্বদা সুখ-দুঃখ সহ্য করিয়া ধর্মেরই অনুষ্ঠান করিবে। কখনও অধর্মের অনুষ্ঠান করিবে না। সর্বদা সত্য শাস্ত্রসমূহ অধ্যয়ন করিবে করাইবে। সৎপুরুষদিগের সঙ্গ করিবে। প্রতিনিয়ত পরমাত্মার ওম্ এই নামের অর্থ মনন পূর্বক জপ করিবে। নিজ আত্মাকে পরমেশ্বরের আজ্ঞানুকূল করিয়া (তাঁহাতেই) সমপর্ণ করিবে। এই পঞ্চবিধ ‘নিয়ম একত্রে মিলাইয়া ‘উপাসনা যোগের দ্বিতীয় অঙ্গ’বলা হয়। অতঃপর ছয় অঙ্গ, যোগশাস্ত্র অথবা ঋগ্বেদাদিভাষ্য ভূমিকা দ্রষ্টব্য।* [* ঋগ্বেদাদির ভাষ্যভূমিকার উপাসনা বিষয়ে এ সকলের বর্ণনা আছে।]
উপাসনা করিতে ইচ্ছা করিলে নির্জন ও পবিত্র স্থানে আসন পাতিয়া মনকে নাভি প্রদেশ, হৃদয়, কণ্ঠ, নেত্র, শিখা অথবা মেরুদণ্ডের মধ্যস্থিত অস্থির কোথাও স্থির করিয়া প্রাণায়াম দ্বারা ইন্দ্রিয় সমূহকে বাহ্য-বিষয় হইতে নিরুদ্ধ করিবে। স্থির করিয়া নিজ আত্মা ও পরমাত্মা সম্বন্ধে বিবেচনা করিবে ও পরমাত্মাতে মগ্ন হইয়া সংযমী হইবে।
এই সকল সাধন অবলম্বন করিলে আত্মা ও অন্তঃকরণ পবিত্র হইয়া সত্য দ্বারা পূর্ণ হইয়া যায়। নিত্য প্রতি জ্ঞানবিজ্ঞান বৃদ্ধি করিলে মুক্তি পৰ্য্যন্ত প্রাপ্ত হত্তয়া যায়। যিনি অষ্টপ্রহরের মধ্যে একঘন্টা কালও এইরূপে ধ্যান করেন তিনি সর্বদা উন্নতি করেন।
পূর্বোক্ত স্থলে সর্বজ্ঞত্ব প্রভৃতি গুণের সহিত পরমেশ্বরের উপাসনা করাকে ‘সগুণ এবং রাগ, দ্বেষ, রূপ, রস, গন্ধ ও স্পর্শাদি হইতে পৃথক রাখিয়া পরম সূক্ষ্ম আত্মার অন্তরে বাহিরে ব্যাপক পরমেশ্বরে দৃঢ় স্থিত হওয়াকে ‘নির্গুণ উপাসনা’ বলে।
ইহার ফল –যেমন অগ্নির নিকটবর্তী হইবামাত্র শীতার্ত ব্যক্তির শীত নিবৃত্তি হয়, সেইরূপ পরমেশ্বরের সামীপ্য প্রাপ্ত হইলে সকল দোষ ও সকল দুঃখ দূর হয় এবং পরমেশ্বরের গুণ-কর্ম-স্বভাবের ন্যায় জীবাত্মার গুণ-কর্ম-স্বভাব পবিত্র হইয়া উঠে। অতএব,পরমেশ্বরের স্তুতি-প্রার্থনা-উপাসনা করা কর্তব্য।
ইহার পৃথক্ ফল আছে; কিন্তু ইহাতে আত্মার বল এতদূর বৃদ্ধি পাইবে যে পর্বতাকার দুঃখ উপস্থিত হইলেও সে ব্যাকুল হইবে না এবং সমস্ত কষ্ট সহ্য করিতে সমর্থ হইবে। ইহা কি তুচ্ছ কথা? যে ব্যক্তি পরমেশ্বরের স্তুতি, প্রার্থনা ও উপাসনা করে না, সে কৃতঘ্ন ও মহামূর্খ। কারণ, যে পরমাত্মা জীবগণের সুখের জন্য ইহ জগতে সমস্ত পদার্থ দান করিয়াছেন তাহার গুণ ভুলিয়া যাওয়া এবং ঈশ্বরকে না মানা কৃতঘ্নতা ও মুখ।
প্রশ্ন–যখন পরমেশ্বরের শ্রোত্র ও নেত্রাদি ইন্দ্রিয় নাই, তিনি ইন্দ্রিয়ের কাৰ্য্য কীরূপে করেন—
উত্তর— অপাণিপাদো জবননা গ্রহীতা পশ্যত্যচক্ষুঃ সশৃণোত্যকর্ণঃ ॥ স বেক্তি বিশ্বং ন চ তস্যাক্তি বেত্তা তমাহুরং পুরুষং পুরাণম্ ॥ ইহা শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের বচন।
পরমেশ্বরের হস্ত নাই। কিন্তু তিনি নিজ শক্তিস্বরূপ হস্ত দ্বারা সমস্ত রচনা এবং গ্রহণ করেন। তাহার চরণ নাই, কিন্তু তিনি ব্যাপক বলিয়া সর্বাপেক্ষা অধিক বেগবান। তাহার চক্ষুগোলক নাই, কিন্তু তিনি সমস্ত যথাযথরূপে দর্শন করেন। তাঁহার শ্রোত্র নাই, তথাপি তিনি সকলের কথা শ্রবণ করেন। তাহার অন্তঃকরণ নাই, কিন্তু তিনি সমস্ত জগৎকে জানেন। তাহাকে সম্পূর্ণরূপে জানিতে পারে, এমন কেহই নাই। তিনি সনাতন, সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বত্র পূর্ণ বলিয়া তাহার নাম ‘পুরুষ’। তিনি ইন্দ্রিয় ও অন্তঃকরণ দ্বারা (অনুষ্ঠিত যাবতীয়) কর্ম নিজ সামর্থ্য দ্বারা করিয়া থাকেন।
প্রশ্ন –অনেকে তাঁহাকে নিষ্ক্রিয় ও নির্গুণ বলিয়া থাকেন।
উত্তর—-ন তস্য কায়ংকরণং চ বিদ্যতে, ন তৎসমশ্চাত্যধিক দৃশ্যতে। পরাস্য শক্তির্বিবিধৈব শূয়তে, স্বাভাবিকী জ্ঞানবক্রিয়া চ ॥
ইহা শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের বচন ॥
পরামাত্মার ন্যায় কোন তদ্রপ কাৰ্য্য এবং উহার করণ অর্থাৎ সাধকতম অপর কেহ অপেক্ষিত নাই। তাহার সদৃশ অথবা তদপেক্ষা মহান্ কেহই নাই। তাহার সর্বোত্তম শক্তি, অর্থাৎ তাহাতে যে অনন্ত জ্ঞান, অনন্ত বল এবং অনন্ত ক্রিয়া আছে, তাহা স্বাভাবিক, অর্থাৎ সহজাত বলিয়া শুনা যায়। যদি পরমেশ্বর নিষ্ক্রিয় হইতেন, তাহা হইলে জগতের উৎপত্তি, স্থিতি এবং প্রলয় করিতে পারিতেন না। এইজন্য তিনি বিভু। তথাপি চেতন হওয়ায় তাহাতে ক্রিয়াও আছে।
প্রশ্ন –যদি তিনি ক্রিয়া করিয়া থাকেন তাহা হইলে সে ক্রিয়া সান্ত না অনন্ত?
উত্তর– তিনি যে পরিমাণ দেশ-কালে ক্রিয়া করা উচিত বুঝেন সেই পরিমাণেই দেশকালে ক্রিয়া করেন, ন্যূনাধিক নহে। কারণ তিনি জ্ঞানময়।
প্রশ্ন—- পরমেশ্বর নিজের অন্ত জানেন কি না?
উত্তর—- পরমাত্মা পূর্ণজ্ঞানী। জ্ঞান তাহাকে বলে, যাহা দ্বারা পদার্থকে যথার্থরূপে জানা যায়। অর্থাৎ যে বস্তু যেমন, তাহাকে তদ্রপ জানাকে ‘জ্ঞান’ বলে। পরমেশ্বর অনন্ত, সুতরাং নিজেকে অনন্ত বলিয়া জানাই জ্ঞান, তদ্বিরুদ্ধ অজ্ঞান। অর্থাৎ অনন্তকে সান্ত এবং সান্তকে অনন্ত জানা ‘ভ্রম’। যথার্থ দর্শনং জ্ঞানমিতি’যাহার যেরূপ গুণ-কর্ম-স্বভাব, তাহাকে তদ্রপ জানা ও মানাকেই ‘জ্ঞান ও বিজ্ঞান’ বলে। এই কারণেই :
ক্লেশ কর্ম বিপাকশয়ের পরামৃষ্টঃ পুরুষবিশেষ ঈশ্বরঃ ॥
যিনি অবিদ্যাদি ক্লেশ, কুশল-অকুশল, ইষ্ট-অনিষ্ট ও মিশফল দায়ক কর্ম-বাসনা রহিত, তিনি সকল জীব হইতে বিশেষ ‘ঈশ্বর’ নামে প্রসিদ্ধ।
প্রশ্ন—- ঈশ্বরাসিদ্ধেঃ ॥১॥ প্রমাণাভাবান্ন তৎসিদ্ধিঃ ॥২॥ সম্বন্ধাভাবান্নানুমান ॥ ৩ ॥ সাংখ্য সূ০
প্রত্যক্ষ দ্বারা ঈশ্বরসিদ্ধি হয় না ॥১॥ কারণ ঈশ্বরসিদ্ধি বিষয়ে প্রত্যক্ষ প্রমাণ না থাকাতে অনুমান প্রভৃতি প্রমাণও থাকিতে পারেনা ॥ ২ ॥ আর ব্যাপ্তি সম্বন্ধ না থাকাতে অনুমানও হইতে পারে না। আবার প্রত্যক্ষ ও অনুমান হয় না বলিয়া শব্দ প্রমাণাদিও হইতে পারে না। এইসকল কারণে ঈশ্বরসিদ্ধি হইতে পারে না। ৩ ॥
উত্তর –এস্থলে ঈশ্বরসিদ্ধি বিষয়ে প্রত্যক্ষ প্রমাণ নাই, আর ঈশ্বর জগতের উপাদান কারণও নহেন। আবার পুরুষ হইতে বিলক্ষণ, অর্থাৎ সর্বত্র পূর্ণ হইয়া পরমাত্মার নাম ‘পুরুষ’, আবার শরীরে শয়ন করে বলিয়া জীবেরও নাম ‘পুরুষ’। কেননা এই প্রকরণে বলা হইয়াছে যে —
প্রধানশক্তিয়োগাচ্চেৎ সঙ্গাপত্তিঃ ॥১॥ সত্তামাত্রাচ্চেৎ সবৈশ্বয়ম ॥২॥ শ্রুতিরপি প্রধান কার্যত্বস্য ॥৩ ॥ সাংখ্য সূ০
যদি পুরুষের সহিত প্রধান শক্তির যোগ হয় তাহা হইলে পুরুষে সঙ্গপত্তি ঘটিবে। অর্থাৎ যেরূপ প্রকৃতি সূক্ষরূপে মিলিত হইয়া কাৰ্য্যরূপের সঙ্গত হইয়াছে সেইরূপ পরমেশ্বরও স্থূল হইয়া পড়িবে। এইজন্য পরমেশ্বর জগতের উপাদান কারণ নহেন, কিন্তু নিমিত্ত কারণ ॥১॥
চেতন হইতে জগতের উৎপত্তি হইলে পরমেশ্বরের ন্যায় জগতেও সমগ্র ঐশ্বর্যের যোগ হওয়া আবশ্যক। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাহা নহে। এইজন্য পরমেশ্বর জগতের উপাদান কারণ নহেন, কিন্তু নিমিত্ত কারণ ॥ ২ ॥
কেননা উপনিষদও প্রধানকেই জগতের উপাদান বলিয়া থাকে ॥ ৩ ॥ যথা–
অজামেকাং লোহিতশুক্লষ্ণাংবহ্বীঃ প্রজাঃ সৃজমানাং স্বরূপাঃ ॥
ইহা শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের বচন। জন্মরহিত সত্ত্ব-রজঃতমোগুণরূপ যে প্রকৃতি স্বরূপাকার হইতে বহু প্রজারূপ হইয়া থাকে, অর্থাৎ প্রকৃতি পরিণামিনী হওয়ায় অবস্থান্তর হয়। আর পুরুষ অপরিণামী হওয়ায় সে কখনও অবস্থান্তর প্রাপ্ত হইয়া অন্যরূপে কদাপি পরিণত হয় না, সর্বদা কুটস্থ ও নির্বিকার থাকে। এ কারণে যদি কেহ কপিলাচাৰ্য্যকে অনীশ্বরবাদী বলে, জেনো সে নিজেই অনীশ্বরবাদী, কপিলাচাৰ্য্য নহেন।
সেইরূপ মীমাংসায় ‘ধর্ম’ ‘ধর্মী’ হইতে, বৈশেষিক এবং ন্যায়ে ‘আত্মা’ শব্দ হইতে প্রমাণিত হয় যে, ইহারা অনীশ্বরবাদী নহেন। কেননা যিনি সর্বজ্ঞতাদি ধর্মযুক্ত এবং অততি সর্বত্র ব্যাপ্নোতীত্যাত্মা’ যিনি সর্বত্র ব্যাপক ও সর্বজ্ঞত্বাদি এবং যিনি সকল জীবের আত্মা তাহাকে মীমাংসা, বৈশেষিক এবং ন্যায়ে ঈশ্বর’বলিয়া মানেন।
প্রশ্ন –ঈশ্বর অবতার হয় কিনা?
উত্তর –না। কারণ, অজ একপাৎ সপয়গাচ্ছুক্রমকায়’ ইত্যাদি যজুর্বেদের বচন;এই সব বচন হইতে সিদ্ধ হয় যে, ঈশ্বর জন্মগ্রহণ করেন না।
প্রশ্ন –যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভূত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্৷ ভ০গী ॥ শ্রীকৃষ্ণ বলিতেছেন, যখন যখনই ধর্মের গ্লানি উপস্থিত হয়, তখন তখনই আমি শরীর ধারণ করিয়া থাকি ॥
উত্তর –এই কথা বেদবিরুদ্ধ বলিয়া প্রমাণ নহে। কিন্তু এইরূপ হইতে পারে যে, শ্রীকৃষ্ণ ধর্মাত্মা ছিলেন এবং তিনি ধর্মের রক্ষা করিতে ইচ্ছা করিয়াছিলেন। “আমি যুগে যুগে জন্মগ্রহণ করিয়া শ্রেষ্ঠদিগকে রক্ষা এবং দুষ্টদিগকে বিনাশ করিয়া থাকি”। এইরূপ হইলে কোন দোষ নাই। কারণ পরোপকারায় সতাং বিভূতয়ঃ, সৎপুরুষদিগের দেহমন-ধন পরোপকারের জন্য। সুতরাং ইহা দ্বারা শ্রীকৃষ্ণ ঈশ্বর হইতে পারেন, ইহা প্রমাণিত হয় না।
প্রশ্ন –যদি এরূপ হয়— তাহা হইলে সংসারে যে ঈশ্বরের ২৪টি অবতার হইয়াছে, তাহাদের মানা হয় কেন?
উত্তর –বেদার্থনা জানায় সাম্প্রদায়িক লোকদিগের দ্বারা বিভ্রান্ত হইয়া নিজেদের মূর্খতাবশতঃ তাহারা ভ্রমজালে আবদ্ধ হয় এবং এইরূপ অপ্রামাণিক কথা বলে ও বিশ্বাস করে।
প্রশ্ন– যদি ঈশ্বরের অবতার না হয়, তবে কংস ও রাবণ প্রভৃতি দুর্বৃত্তগণের বিনাশ কীরূপে হইতে পারে?
উত্তর– প্রথমতঃ যে জন্মগ্রহণ করে, সে অবশ্যই মৃত্যু মুখে পতিত হয়। যদি ঈশ্বর অবতার দেহ ধারণ ব্যতীত জগতের সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় করেন, তাঁহার নিকট কংস, রাবণ প্রভৃতি একটা কীট তুল্যও নহে। তিনি সর্বব্যাপক বলিয়া কংস রাবণাদির শরীরেও পরিপূর্ণ হইয়া আছেন। যখনই ইচ্ছা তখনই মর্মচ্ছেদন করিয়া তাহাদিগকে বিনাশ করিতে পারেন। বলুন। তো? যাহারা এই অনন্ত গুণ-কর্ম-স্বভাব বিশিষ্ট পরমাত্মাকে একটি ক্ষুদ্র জীবের বধের জন্য জন্ম- মরণশীল বলে,তাহাদিগকে মূর্খ ভিন্ন অন্য কীসের সহিত তুলনা দেওয়া যাইতে পারে?
যদি কেহ বলে যে, ভক্তজনের উদ্ধারের জন্য ঈশ্বর জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাহাও সত্য নহে। কারণ যে সকল ভক্ত ঈশ্বরের আজ্ঞানুসারে চলেন, তাহাদিগকে উদ্ধার করিবার পূর্ণ সামর্থ্য ঈশ্বরে আছে। পৃথিবী ও চন্দ্র সূৰ্য্যাদি সমন্বিত জগতের সৃষ্টি-স্থতি–প্রলয়রূপকর্ম অপেক্ষা কংস-রাবণাদির বিনাশ অথবা গোবর্ধন উত্তোলন কি গুরুতর কর্ম? যদি কেহ এই সৃষ্টিতে পরমেশ্বরের কর্ম সম্বন্ধে বিচার করেন, তবে মনে হইবে যে ন ভূতান ভবিষ্যতি’, অর্থাৎ ঈশ্বর সদৃশ কেহ হয় নাই এবং হইবেও না ॥
যুক্তি দ্বারাও ঈশ্বরের জন্ম সিদ্ধ হয় না। যদি কেহ বলে যে, অনন্ত গর্ভস্থ হইল, অথবা আকাশকে হাতের মুষ্টিতে রাখিল, তবে তাহা কখনও সত্য হইতে পারেনা। কারণ আকাশ অনন্ত ও সর্বব্যাপক; অতএব আকাশ ভিতরেও যায় না, বাহিরেও আসে না। সেইরূপ পরমাত্মা অনন্ত ও সর্বব্যাপক বলিয়া তাহার গমনাগমন কখনও সিদ্ধ হইতে পারে না। যে স্থানে যাহা নাই, সে স্থানেই তাহার গমনাগমন হইতে পারে। পরমেশ্বর কি গর্ভে ব্যাপক ছিলেন না যে, অন্য কোন স্থান হইতে বহির্গত হইলেন? ঈশ্বর সম্বন্ধে বিদ্যাহীন ব্যক্তি ব্যতীত আর কে এইরূপ বলিতে ও বিশ্বাস করিতে পারে? “অতএব ঈশ্বরের গমনাগমন ও জন্মমৃত্যু কখনও সিদ্ধ হইতে পারে না।
এতদ্বারা বুঝিতে হইবে যে ঈশা’ (খৃষ্ট) প্রভৃতি ঈশ্বরের অবতার নহেন। কেননা রাগ, দ্বেষ, ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ভয়, শোক, দুঃখ, জন্ম এবং মৃত্যু প্রভৃতি গুণধর্মযুক্ত বলিয়া তাঁহারা মনুষ্য ছিলেন।
প্রশ্ন –ঈশ্বর নিজের ভক্তদিগের পাপ ক্ষমা করেন কিনা?
উত্তর –না। কারণ পাপ ক্ষমা করিলে, তাঁহার ন্যায় নষ্ট হইয়া যাইবে। ন্যায় নষ্ট হইলে মনুষ্যগণও মহাপাপী হইয়া যাইবে। কেননা, ক্ষমার কথা শুনিয়াই তাহারা পাপকর্মে নির্ভীক হইয়া। উঠিবে। রাজা অপরাধীদিগকে ক্ষমা করিলে তাহারা উৎসাহের সহিত আরও গুরুতর পাপ করিতে থাকিবে। কারণ রাজা তাহাদের অপরাধ ক্ষমা করিলে তাহাদের এই ভরসা, যে রাজার সম্মুখে। হাত জোড় করিয়া দাঁড়াইলে রাজা তাহাদের অপরাধ ক্ষমা করিবেন। ফলে যাহারা অপরাধ করেনা, তাহারাও নির্ভয়ে পাপকর্মে প্রবৃত্ত হইবে। সুতরাং সকল কর্মের যথোচিত ফল প্রদান করাই ঈশ্বরের কাৰ্য্য,ক্ষমা করা নহে ॥
প্রশ্ন –জীব স্বতন্ত্র, না পরতন্ত্র?
উত্তর –জীব নিজ কর্তব্য কর্মে স্বতন্ত্র, কিন্তু ঈশ্বরের ব্যবস্থায় পরতন্ত্র। স্বতন্ত্রঃ কর্তা’ ইহা পাণিনীয় ব্যাকরণের সূত্র। যিনি স্বতন্ত্র অর্থাৎ স্বাধীন তিনিই কর্তা।
প্রশ্ন –স্বতন্ত্র কাকে বলে?
উত্তর –শরীর প্রাণ, ইন্দ্রিয় ও অন্তকরণাদি যাহার অধীনে থাকে। স্বতন্ত্র না হইলে তাহার পাপপুণ্যের ফল লাভ কখনও হইতে পারিবে না। কেননা যেরূপ ভৃত্য, স্বামীর এবং সেনা সেনাধ্যক্ষের আজ্ঞা অথবা প্রেরণা অনুসারে যুদ্ধে বহু মনুষ্যকে বিনাশ করিয়াও অপরাধী হয় না। সেইরূপ পরমেশ্বরের প্রেরণা ও অধীনতায় কার্যসিদ্ধি হইলে জীবকে পাপপুণ্য স্পর্শ করিবে না। প্রেরণাদাতা পরমেশ্বর তাহার ফলভোগী হইবে। স্বর্গ-নরক অর্থাৎ সুখ এবং দুঃখের প্রাপ্তিও পরমেশ্বরেরই হইবে।
যেরূপ কোন হত্যাকারী কোন শস্ত্র বিশেষ দ্বারা কাহাকেও হত্যা করিয়া ধরা পড়িলে হত্যাকারী দণ্ডভোগ করে, শস্ত্র দণ্ডভোগ করেনা, সেইরূপ পরাধীন জীব পাপপুণ্যেরও ভাগী হইবে না। অতএব জীব নিজ সামর্থ্য অনুসারে কর্ম করিতে স্বতন্ত্র, কিন্তু কোন পাপকর্ম করিলে সে ঈশ্বরের ব্যবস্থানুসারে পরতন্ত্র হইয়া পাপের ফল ভোগ করে। সুতরাং কর্ম বিষয়ে জীব স্বতন্ত্র, কিন্তু পাপের দুঃখরূপ ফলভোগ বিষয়ে সে পরতন্ত্র।
প্রশ্ন –যদি পরমেশ্বর জীবকে সৃষ্টি না করিতেন এবং সামর্থ্য না দিতেন তাহা হইলে জীব কিছুই করিতে পারিত না। অতএব পরমেশ্বরের প্রেরণা দ্বারাই জীব কর্ম করে।
উত্তর –জীব কখনও উৎপন্ন হয় নাই, সে অনাদি। যেরূপ ঈশ্বর এবং জগতের উপাদান কারণ নিত্য, তথা পরমেশ্বর কর্তৃক জীবের শরীর ও ইন্দ্রিয়গোলক সৃষ্ট হইয়াছে। পরন্তু ঐ সকল জীবের অধীন। যদি কেহ কায়-মন-বাক্যে কোন পাপপুণ্য করে, তবে সে নিজেই তাহার ফলভোগ করে, ঈশ্বর করেনা। মনে করুন, কোন কর্মকার কোন পর্বত হইতে লৌহ বাহির করিয়া আনিল, কোন ব্যবসায়ী সেই লৌহ গ্রহণ করিল। অপর একজন কর্মকার তাহার দোকান হইতে লৌহ লইয়া তদ্বারা তরবারি প্রস্তুত করিল। কোন সৈনিক তাহার নিকট হইতে তরবারি লইয়া তদ্বারা কাহাকেও হত্যা করিল। এস্থলে লৌহ উৎপাদন কর্তা, গ্রহীতা, তরবারি নির্মাতা এবং তরবারিকে রাজা দণ্ডদান করেন না, কিন্তু তরবারি দ্বারা যে হত্যা করে তাহাকেই দণ্ডদান করেন। সেইরূপ শরীরাদির সৃষ্টিকর্তা পরমেশ্বর তাহার ফলভোগী হন না। কিন্তু জীবকেই ভোগ করাইয়া থাকেন।
যদি পরমেশ্বর কর্ম করাইতেন, তাহা হইলে কোন জীব পাপ করিত না। কারণ পরমেশ্বর পবিত্র ও ধামিক বলিয়া কোন জীবকে পাপ করিতে প্রেরণা দেন না। সুতরাং জীব নিজ কর্মে স্বতন্ত্র। যেরূপ জীব স্বীয় কর্ম করিতে স্বতন্ত্র সেইরূপ পরমেশ্বরও নিজ কর্মে স্বতন্ত্র।
প্রশ্ন –জীব ও ঈশ্বরের স্বরূপ, গুণ-কর্ম এবং স্বভাব কীরপ?
উত্তর—- (জীব ও ঈশ্বর) উভয়েই চৈতন্যস্বরূপ। উভয়েরই স্বভাব পবিত্র। উভয়ই অবিনাশী এবং ধার্মিকতা প্রভৃতি গুণযুক্ত কিন্তু সৃষ্টিস্থিতি প্রলয়ও সকলকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং জীবদিগের পাপপুণ্যের ফলদান প্রভৃতি ধর্মযুক্ত কর্ম পরমেশ্বরের। আর সন্তানোৎপত্তি, সন্তানপালন এবং শিল্পবিদ্যাপ্রভৃতি উত্তম-অধম কর্ম জীবের। নিত্যজ্ঞান, আনন্দ এবং অনন্ত বল প্রভৃতি ঈশ্বরের গুণ। আর জীবের —
ইচ্ছাদ্বেষ প্রয়সুখদুঃখজ্ঞানান্যাত্মনো লিঙ্গামিতি। ন্যায় সূত্র। ‘প্রাণাপাননিমেষোন্মেষ জীবন মনোগতীন্দ্রিয়ান্তর্বিকারাঃ সুখদুঃখেচ্ছাদ্বেষপ্রয়াশ্চাত্মনো লিঙ্গানি৷ বৈশিষিক সূত্র।
(ইচ্ছা) পদার্থ সমূহের পাইবার অভিলাষা, (দ্বেষ) দুঃখাদি প্রাপ্তির অনিচ্ছা অর্থাৎ বৈরভাব, (প্রয়ত্ন) পুরুষার্থ, বল; (সুখ) আনন্দ, (দুঃখ) বিলাপ, অপ্রসন্নতা; (জ্ঞান) বিবেক, চিনিতে পারা–এইগুলি সমান; (ন্যায় ও বৈশেষিকের একরূপ] কিন্তু বৈশেষিকে; (প্রাণ) প্রাণ বায়ুকে বহির্গত করা; (অপান) প্রাণকে বাহির হইতে ভিতরে আনা; (নিমেষ) পলকগতি; (উন্মেষ) চক্ষু উন্মীলন করা, (জীবন) প্রাণ ধারণ করা; (মন) নিশ্চয়, স্মরণ ও অহঙ্কার করা; (গতি) চলন, (ইন্দ্রিয়) সমস্ত ইন্দ্রিয়ের পরিচালনা, (অন্তর্বিকার) ভিন্ন-ভিন্ন রূপে ক্ষুধা, তৃষ্ণা, হর্ষশোকাদি যুক্ত হওয়া; জীবাত্মার এই সকল গুণ পরমাত্মার গুণ হইতে পৃথক্। ইহাদের দ্বারাই প্রতীতী করিবে কারণ আত্মা স্থূল পদার্থ নহে ॥
আত্মা যতকাল দেহে থাকে ততকাল পর্যন্ত এই সকল গুণ প্রকাশিত থাকে। কিন্তু আত্মা দেহত্যাগ করিয়া চলিয়া গেলে এই সকল গুণও দেহে থাকে না। যাহা থাকিলে যাহা থাকে, এবং যাহা না থাকিলে যাহা থাকে না তাহাই তাহার গুণ। যেমন প্রদীপ সূৰ্য্যাদি না থাকিলে আলোক থাকে না কিন্তু থাকিলে থাকে। সেইরূপ গুণ দ্বারাই জীবাত্মা ও পরমাত্মার সম্বন্ধে বিশেষ জ্ঞান হইয়া থাকে।
প্রশ্ন –পরমেশ্বর ত্রিকালদর্শী সুতরাং তিনি ভবিষ্যতের কথা জানেন। তিনি যেরূপ নির্ধারণ করিবেন, জীব সেইরূপই করিবে। সুতরাং জীব স্বতন্ত্র নহে। আর ঈশ্বর জীবকে দণ্ডও দিতে পারেন না। কারণ তিনি নিজ জ্ঞান দ্বারা যেরূপ নির্ধারণ করিয়াছেন, জীব সেইরূপ করিতেছে।
উত্তর –ঈশ্বরকে ত্রিকালদর্শী বলা মুখ কারণ, যাহা হইবার পর থাকে না, তাহাকে ‘ভূতকাল’, আর যাহা (এখনও) হয় নাই অথচ (পরে) হইবে তাহাকে ‘ভবিষ্যৎ কাল বলে। পরমেশ্বরের কোন ও জ্ঞান কি উৎপন্ন হইয়া বিদ্যামান থাকে না, অথবা কোনও জ্ঞান হয় নাই, কিন্তু পরে হইবে? পরমেশ্বরের জ্ঞান সর্বদা এক রস ও অখণ্ডিত রূপে বর্তমান থাকে। অতীত ও ভবিষ্যকাল জীবের জন্য। হ্যাঁ, জীবের কর্ম সাপেক্ষ ত্রিকালজ্ঞতা ঈশ্বরে আছে কিন্তু স্বতঃ নাই। জীব স্বতন্ত্রভাবে যেমন কর্ম করে, ঈশ্বর সর্বজ্ঞতা দ্বারা সেইরূপ জানেন। আর ঈশ্বর যেমন জানেন, জীব সেইরূপ করে। অর্থাৎ ভূত, ভবিষ্যৎ এবং বর্তমানের জ্ঞান ও ফলদান বিষয়ে ঈশ্বর স্বতন্ত্র আর জীব কিঞ্চিৎ বর্তমান ও কর্ম করিতে স্বতন্ত্র; ঈশ্বরের জ্ঞান অনাদি হওয়াতে তাহার কর্মজ্ঞানের ন্যায় দণ্ড দিবার জ্ঞান ও অনাদি। হার উভয় জ্ঞানই সত্য। কর্মজ্ঞান সত্য আর । দণ্ডজ্ঞান মিথ্যা, এইরূপ কি কখনও হইতে পারে? সুতরাং এ বিষয়ে কোন দোষ ঘটে না।
প্রশ্ন –জীব শরীরে ভিন্ন বিভু অথবা পরিচ্ছিন্ন?
উত্তর –পরিচ্ছিন্ন; বিভূ হইলে জাগ্রত, স্বপ্ন, সুষুপ্তি, জন্ম-মরণ, সংযোগ-বিয়োগ এবং গমনাগমন কখনও হইতে পারিত না। এইজন্য জীবের স্বরূপ অল্পজ্ঞ এবং অল্প অর্থাৎ সূক্ষ্ম। আর পরমেশ্বর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম, অনন্ত, সর্বজ্ঞ এবং সর্বব্যাপক স্বরূপ। সুতরাং জীব এবং পরমেশ্বরের মধ্যে সম্বন্ধ ব্যাপ-ব্যাপক।
প্রশ্ন –যে স্থানে একটি বস্তু থাকে, সে স্থানে আর একটি বস্তু থাকিতে পারে না। সুতরাং জীব ও ঈশ্বরের মধ্যে সংযোগ সম্বন্ধ থাকিতে পারে, কিন্তু ব্যাপ-ব্যাপক থাকিতে পারে না।
উত্তর –এই নিয়মসমান আকার বিশিষ্ট পদার্থের সম্বন্ধে ঘটিতে পারে, অসম আকার । বিশিষ্ট পদার্থের মধ্যে ঘটিতে পারে না। যেরূপ লৌহ স্থূল এবং অগ্নি সূক্ষ্ম বলিয়া লৌহের মধ্যে বিদ্যুৎ ও অগ্নি ব্যাপক হইয়া উভয়ে একই আকাশে অবস্থান করে, সেইরূপ জীব পরমেশ্বর অপেক্ষা স্থূল এবং পরমেশ্বর জীব অপেক্ষা সূক্ষ্ম বলিয়া পরমেশ্বর ব্যাপক এবং জীব ব্যাপ্য। জীব ঈশ্বরের মধ্যে ব্যাপ-ব্যাপক সম্বন্ধের ন্যায়, সেব্য-সেবক, আধার-আধেয়, স্বামী-ভৃত্য, রাজা-প্রজা এবং পিতা-পুত্র প্রভৃতি সম্বন্ধও আছে।
প্রশ্ন –ব্রহ্মাও জীব পৃথক্ অথবা এক?
উত্তর–পৃথক পৃথক্।
প্রশ্ন –যদি পৃথক পৃথক্ হয়, তবে বেদের এই মহাবাক্য গুলির অর্থ কি? প্রজ্ঞানংব্রহ্মা ॥১॥ (ঐতারয়) অহংব্রহ্মাস্মি ॥ ২ ৷ (শত০) তত্ত্বমসি ॥৩ ॥ (ছাউ০) অয়মাত্মা ব্রহ্মা ॥৪॥ (মাভুক্যো)
উত্তর –এইগুলি বেদবাক্যই নহে, এগুলি ব্রাহ্মণগ্রন্থের বচন। এই সমস্ত ‘মহাবাক্য এরূপ কোনো সত্য শাস্ত্রে লেখা নাই। অর্থাৎ ব্রহ্ম প্রকৃষ্ট জ্ঞানস্বরূপ ॥১ ॥
অহং ব্রহ্মাস্মি (অহম) আমি, অর্থাৎ (ব্রহ্ম), অর্থাৎব্রহ্মস্থ (অস্মি) আছি। এখানে তাৎস্থ্যোপাধি। যথা মঞ্চাঃ ক্রোশন্তি, মঞ্চ চীৎকার করিতেছে। মঞ্চ জড় পদার্থ, তাহাদের চিৎকার করিবার সামর্থ্য নাই। এইজন্য মঞ্চস্থ মনুষ্য চিৎকার করিতেছে। এইরূপ এস্থলেও বুঝিতে হইবে।
যদি কেহ বলে যে, সকল পদার্থই ত ব্রহ্মস্থ, এমতাবস্থায় জীবকে ব্রহ্মস্থ বলায় বিশেষ কী বলা হইল? ইহার উত্তর এই যে, সকল পদার্থ ব্রহ্মস্থ ইহা সত্য, কিন্তু যেমন সাধর্মযুক্ত নিকটস্থ তদ্রপ অন্য নহে। আর জীবের ব্রহ্মজ্ঞান হইয়া থাকে এবং মুক্তিতে জীব ব্রহ্মের সাক্ষাৎ সম্বন্ধে থাকে। এইজন্য ব্রহ্মেরসহিত জীবের ‘তাস্থ্য বা তৎসহচরিতোপাধি’, অর্থাৎ জীব ব্রহ্মের সহচারী। অতএব জীব এবং ব্রহ্ম এক নহে, যথা, যদি কেহ কাহাকে বলে ‘আমি ও এই ব্যক্তি এক’ অর্থাৎ অবিরোধী, সেইরূপ যিনি সমাধিস্থ অবস্থায় পরমেশ্বরের প্রেমে বদ্ধ হইয়া তাহাতে নিমগ্ন থাকেন, তিনি বলিতে পারেন, আমি এবং ব্রহ্ম এক অর্থাৎ অবিরোধী, অর্থাৎ এক অবকাশস্থ। যে জীব পরমেশ্বরের গুণ-কর্ম-স্বভাবানুয়ায়ী নিজের গুণ-কর্ম-স্বভাব গঠন করে, সাধৰ্ম দ্বারা সে ব্রহ্মের সহিত এক বলিতে পারে ॥ ২ ॥
প্রশ্ন –আচ্ছা, এবার বলুন এই বাক্যের অর্থ কীরূপে করিবেন? (তৎ) ব্রহ্ম (ত্বম) তুমি জীব (অসি) হও। (অর্থাৎ) হে জীব। (ত্ব) তুমি (তৎ) সেই ব্রহ্ম (অসি) হও।
(উত্তর পক্ষ) আপনি তৎ’ শব্দের দ্বারা কী গ্রহণ করিতেছেন? (পূর্ব পক্ষ) ব্রহ্ম। (উত্তর পক্ষ) ব্রহ্ম’পদের অনুবৃত্তি কোথা হইতে আনিলেন? (উত্তর পক্ষ) “সদেব সসাম্যেদমগ্র আসীদেকমেবাদ্বিতীয়ং ব্রহ্ম’।
এই পূর্ব বাক্য হইতে। (উত্তর পক্ষ) আপনি এই ছান্দোগ্য উপনি দর্শনও করেন নাই। দর্শন করিয়া থাকিলে জানিতেন যে, সেখানে ব্রহ্ম শব্দের পাঠই নাই। কেন এরূপ মিথ্যা বলিতেছেন। ছান্দোগ্য’তে–
‘সদেব সোম্যদমগ্র আসীদেকমেবাদ্বিতীয় এইরূপ পাঠ আছে। সে স্থলে ‘ব্রহ্ম’ শব্দ নাই।
প্রশ্ন –আপনি তৎ’ শব্দ দ্বারা কী গ্রহণ করিতেছেন?
উত্তর –“স য় এযোমণিমৈত্মমিদ সর্বং তৎসত্যওঁ স আত্মা তত্ত্বমসি শ্বেতকেতো ইতি”। ছান্দো
হে প্রিয় পুত্র শ্বেতকেতো। সেই পরমাত্মা জানিবার যোগ্য। তিনি অতীব সূক্ষ্ম এবং সমস্ত জগৎ ও জীবের আত্মা।তিনিই সত্যস্বরূপ এবং নিজেই নিজের আত্মা তদাত্মকস্তদন্তয়ামী ত্বমসি’। তুমি সেই অন্তর্যামী পরমাত্মার সহিত যুক্ত। এই অর্থই সমস্ত উপনিষদের অবিরুদ্ধ ॥
কারণঃ– ‘য় আত্মনি তিষ্ঠান্নত্মাননান্তরোয়মাত্মান বেদয়স্যাত্মা শরীর ॥ আত্মননান্তরো য়ময়তি স ত আত্মান্তর্যাম্যমৃতঃ।ইহা বৃহদারণ্যকের বচন।
মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য স্বীয় পত্নী মৈত্রেয়ীকে বলিতেছেন –“হে মৈত্রেয়! যে পরমেশ্বর আত্মা অর্থাৎ জীবের মধ্যে অবস্থিত এবং জীবাত্মা হইতে পৃথক মূঢ় জীবাত্মা জানে না যে, সেই পরমাত্মা তাহার মধ্যে ব্যাপক রহিয়াছেন। জীবাত্মা পরমেশ্বরের শরীর অর্থাৎ যেমন শরীরের মধ্যে জীব থাকে, সেইরূপ জীবের মধ্যে পরমেশ্বর ব্যাপক রহিয়াছেন। তিনি জীবের পাপ-পুণ্যের সাক্ষীরূপে জীবাত্মা হইতে পৃথক্ থাকিয়া জীবকে পাপ-পুণ্যের ফল দান করিয়া নিয়ন্ত্রিত করেন। সেই অবিনাশীস্বরূপ আত্মা তোমারও অন্তর্যামী অর্থাৎ তোমার মধ্যে ব্যাপক রহিয়াছেন; তাহাকে তুমি জানিও। এ সকল বচনের কি কেহ অন্যরূপ অর্থ করিতে পারে? ॥৩ ॥
‘অয়মাত্মা ব্রহ্ম’ অর্থাৎ সমাধি অবস্থায় যোগীর পরমেশ্বর প্রত্যক্ষ হয়, তখন তিনি বলেন, ‘যিনি আমার মধ্যে ব্যাপক, সেই ব্রহ্মই সর্বত্র ব্যাপক। এইজন্য আজকালের যে সকল বেদান্তীরা বলেন যে, জীব এবং ব্রহ্ম এক, তাহারা বেদান্তশাস্ত্র জানেন না ॥ ৪ ॥
প্রশ্ন অনেনাত্মনা জীবেনানুপ্রবিশ্য নামরূপে ব্যাকরণবাণি ॥১॥ তৎসৃষ্টা তদেবানুপ্রাবিশৎ ॥২॥ তৈত্তিরীয় ॥
পরমেশ্বর বলিতেছেন,–আমি জগৎ এবং শরীর রচনা করিয়া জগতে ব্যাপক ও জীবরূপে শরীরে প্রবিষ্ট হইয়া নাম ও রূপের ব্যাখ্যা করিয়া থাকি ॥ ১ ॥
পরমেশ্বর ঐ জগৎ এবং শরীর নির্মাণ করিয়া তন্মধ্যে প্রবিষ্ট হইয়াছে ॥ ২ ॥ ইত্যাদি শ্রুতির। অন্যরূপ অর্থ কীরূপে করিবে?
উত্তর– যদি আপনি পদ, পদার্থ এবং বাক্যার্থ জানিতেন, তাহা হইলে কখনও এরূপ অনর্থ করিতেন না। কারণ, এস্থলে বুঝিতে হইবে যে, একটি প্রবেশ, অন্যটি অনুপ্রবেশ অর্থাৎ (যাহাকে বলা হয়) পশ্চাৎ প্রবেশ। পরমেশ্বর শরীরে প্রবিষ্ট হইয়া জীবের মধ্যে অনুপ্রবিষ্টের ন্যায় থাকিয়া বেদ দ্বারা সমস্ত নাম, রূপাদি বিদ্যা প্রকাশ করেন। তিনি শরীরের মধ্যে জীবকে প্রবেশ করাইয়া স্বয়ং জীবের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট হইয়া আছেন। আপনি ‘অনু’ শব্দের অর্থ জানিলে এইরূপ বিপরীত অর্থ কখনও করিতেন না।
প্রশ্ন –’সোয়ং দেবদত্তোয় উষ্ণকালে কাশ্যাং দৃষ্টঃ, স ইদানীং প্রাবৃটসময়ে মথুরায়াং দৃশ্যতে ॥ অর্থাৎ যে দেবদত্তকে গ্রীষ্মকাল কাশীতে দেখিয়াছিলাম, তাহাকেই বর্ষাকালে মথুরায় দেখিতেছি। এস্থলে কাশীদেশ ও গ্রীষ্মকাল এবং মথুরা দেশ ও বর্ষাকাল পরিত্যাগ পূর্বক শরীর মাত্রকেই লক্ষ্য করিয়া দেবদত্ত লক্ষিত হইতেছে। সেইরূপ এই ভাগ-ত্যাগলক্ষণা দ্বারা ঈশ্বরের পরোক্ষ দেশ, কাল, মায়া উপাধি এবং জীবের এই দেশ-কাল-অবিদ্যা ও অল্পজ্ঞতা উপাধি ত্যাগ করিয়া কেবল চেতনমাত্র লক্ষ্য করিলে একই ব্রহ্ম বস্তু উভয় লক্ষিত হয়। এই ভাগ-ত্যাগলক্ষণা’ অর্থাৎ কিঞ্চিৎগ্রহণ ও কিঞ্চিৎ বর্জনের দ্বারা যেমন ঈশ্বরের সর্বজ্ঞত্বাদি বাচ্যার্থ ঈশ্বরের এবং জীবের অল্পজ্ঞত্বাদি বাচ্যার্থ জীবেরই চেতন মাত্র লক্ষ্যার্থ গ্রহণ করিলে ‘অদ্বৈত’ সিদ্ধ হয়। এবিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?
উত্তর –প্রথমতঃ আপনি কি জীব এবং ঈশ্বরকে নিত্য মানেন না অনিত্য মানেন?
প্রশ্ন –এই উভয়কে উপাধি জন্য কল্পিত বলিয়া অনিত্য মনে করি।
উত্তর –সেই উপাধিকে নিত্য মানেন, না অনিত্য?
প্রশ্ন –আমার মতে– জীবেশেী চবিশুদ্ধা চিবিভেদস্তু তয়োর্ধয়োঃ। অবিদ্যা তচ্চিতোয়োগঃ ষডস্মাকমনাদয়ঃ ॥১॥ কায়েপাধিরয়ংজীব কারণোপাধিরীশ্বরঃ। কার্যকারণংহিত্বা পূর্ণবোবধাবশিষ্যতে ॥২॥ ইহা সংক্ষেপ শারীরক’ এবং শারীরক ভাষ্যের’ কারিকা।
আমরা বেদান্তিগণ ছয়টি পদার্থ প্রথম জীব, দ্বিতীয় ঈশ্বর, তৃতীয় ব্রহ্ম, চতুর্থ জীব ও ঈশ্বরে ভেদ, পঞ্চম অবিদ্যা-অজ্ঞান এবং ষষ্ঠ অবিদ্যা ও চেতনের যোগ,এই সকলকে অনাদি বলিয়া মানি ॥ ১ ॥
কিন্তু এক ব্রহ্মই অনাদি অনন্ত, আর অন্য পাঁচটি অনাদি সান্ত, যথা প্রাগভাব। যতকাল অজ্ঞান থাকে ততকাল পর্যন্ত এই পাঁচটি থাকে এবং এই পাঁচটির আদি বিদিত হয় না, এই জন্য অনাদি এবং জ্ঞান হইবার পর নষ্ট হইয়া যায়, এইজন্য ইহাকে সান্ত অর্থাৎ নাশবান বলে।
উত্তর –তোমাদের পূর্বোক্ত এই দুই শ্লোকই অশুদ্ধ। কারণ, তোমাদের মতে অবিদ্যার যোগ ব্যতীত জীব এবং মায়ার যোগ ব্যতীত ঈশ্বর সিদ্ধ হইতে পারে না। অতএব ‘তচ্চিতোয়োগঃ, যে ষষ্ঠ পদার্থ তোমরা গণনা করিয়াছ, তাহা রহিল না। কারণ সেই অবিদ্যা ও মায়া, জীব ও ঈশ্বরে চরিতার্থ হইয়া গেল। আবার ব্রহ্ম এবং মায়া অথবা অবিদ্যার যোগ ব্যতীত ঈশ্বর সিদ্ধ হইতে পারে না। সুতরাং ঈশ্বরকে অবিদ্যা এবং ব্রহ্ম হইতে পৃথক্ গণনা করা বৃথা। অতএব তোমাদের মতানুসারে কেবলমাত্র দুইটি পদার্থ অর্থাৎ ব্রহ্ম এবং অবিদ্যা সিদ্ধ হইতে পারে, ছয়টি নহে ॥ ১ ৷
আর অনন্ত, নিত্য, শুদ্ধ, বুদ্ধ, মুক্ত স্বভাব এবং সর্বব্যাপক ব্রহ্মে অজ্ঞান সিদ্ধ হইলেই তোমাদের কাৰ্য্যোপাধি ও কারণোপাধি হইতে জীব ও ঈশ্বর সিদ্ধ হইতে পারে।
যদি তাহার এক দেশে স্বাশ্রয় এবং স্ববিষয়ক অজ্ঞান অনাদি সর্বত্র স্বীকার কর, তাহা হইলে সমস্ত ব্রহ্ম শুদ্ধ হইতে পারে না। একদেশে অজ্ঞান মানিলে ইহা পরিচ্ছন্ন হওয়ায় ইতস্ততঃ গমনাগমন করিতে থাকিবে। যে যে স্থানে সে যাইবে সেই সেই স্থানের ব্রহ্ম অজ্ঞানী এবং যে যে স্থান সে ত্যাগ করিবে সেই সেই স্থানের ব্রহ্ম জ্ঞানী হইতে থাকিবে। সুতরাং কোন স্থানের ব্রহ্মকে অনাদি শুদ্ধ এবং জ্ঞানী বলিতে পারিবে না। আর যে ব্রহ্ম অজ্ঞানের সীমায় থাকিবে সে অজ্ঞানকে জানিবে। তাহাতে বাহিরের এবং ভিতরের ব্রহ্ম খণ্ড খণ্ড হইয়া যাইবে।
যদি বল, খণ্ড খণ্ড হউক, ইহাতে ব্রহ্মের ক্ষতি কী? এমতাবস্থায় ব্রহ্ম অখণ্ড রহিবে না। যদি অখণ্ড হয় তবে সে অজ্ঞানী নহে। আবার, জ্ঞানের অভাব অথবা বিপরীত জ্ঞানও গুণ বলিয়া কোন দ্রব্যের সহিত নিত্য সম্বন্ধ যুক্ত হইয়া থাকে। যদি তাই হয়, তবে সমবায় সম্বন্ধ হওয়ায় কখনও অনিত্য হইতে পারিবে না।
আবার যেমন শরীরের একদেশে ব্রণ হইলে শরীরের সর্বত্র পীড়া হয় সেইরূপ এক দেশে অজ্ঞান, সুখ, দুঃখ এবং ক্লেশের উৎপত্তি হইলে সমস্ত ব্রহ্ম দুঃখাদি অনুভব দ্বারা অজ্ঞানী (দুঃখী) হইবে। যদি কাৰ্য্যোপাধি অর্থাৎ অন্তঃকরণের উপাধির যোগ বশতঃ ব্রহ্মকে জীব মনে কর, তবে জিজ্ঞাসা করি, ব্রহ্ম কি ব্যাপক অথবা পরিচ্ছিন্ন? যদি বল ব্রহ্ম ব্যাপক ও উপাধি পরিচ্ছিন্ন অর্থাৎ
একদেশী ও পৃথক পৃথক্ তাহা হইলে অন্তঃকরণ চলাফেরা করে, না করে না?
উত্তর –চলাফেরা করে।
প্রশ্ন –অন্তঃকরণের সহিত ব্রহ্ম গমনাগমন করে অথবা স্থির থাকে?
উত্তর –স্থির থাকে।
প্রশ্ন –যদি তাহাই হয়, তাহা ইহলে অন্তঃকরণ যে যে স্থান ত্যাগ করিবে সে সে স্থানের ব্রহ্ম অজ্ঞানরহিত এবং যে যে স্থানে যাইবে সে সে স্থানের শুদ্ধ ব্ৰহ্ম অজ্ঞানী হইতে থাকিবে। এইরূপে ব্রহ্ম ক্ষণে জ্ঞানী এবং ক্ষণে অজ্ঞানী হইতে থাকিবে। ইহাতে মোক্ষ এবং বন্ধও ক্ষণস্থায়ী হইবে। আবার যেমন একের দৃষ্ট বস্তু অন্যে স্মরণ করিতে পারে না, সেইরূপ গতকালের দৃষ্ট ও শ্রুত বস্তু বা বিষয়ের জ্ঞান থাকিতে পারে না। কারণ যে সময় দর্শন বা শ্রবণ হইয়াছিল, তাহা অন্য দেশ ও অন্য কাল এবং যে সময়ে স্মরণ করা হয় উহা অন্য দেশ ও অন্য কাল।
যদি বল যে, ব্রহ্ম এক, তাহা হইলে ব্রহ্ম সর্বজ্ঞ নহে কেন? যদি বল যে, অন্তঃকরণ ভিন্ন ভিন্ন, এমতাবস্থায় ব্রহ্মও ভিন্ন ভিন্ন হইয়া পড়িবে, তাহা হইলে উহা জড়। জড়ে জ্ঞান থাকিতে পারে না। যদি বল যে, কেবল ব্রহ্মের অথবা কেবল অন্তঃকরণেরই জ্ঞান হয় না, কিন্তু অন্তঃকরণস্থ চিদাভাসেরই জ্ঞান হইয়া থাকে, তাহা হইলেও অন্তঃকরণ দ্বারা চেতনেরই জ্ঞান হইল, তবে তাহা। নেত্র দ্বারা অল্পজ্ঞ হইবে কেন? সুতরাং কারণোপাধি ও কাৰ্য্যোপাধির যোগবশতঃ ব্রহ্ম, জীব এবং ঈশ্বর সিদ্ধ করা যাইবে না।
কিন্তু ঈশ্বর নাম ব্রহ্মের এবং ব্রহ্ম হইতে ভিন্ন অনাদি, অনুৎপন্ন ও অমৃতস্বরূপ জীবের নাম জীব। যদি বল যে, তবে তাহা ক্ষণভঙ্গুর হওয়ায় নষ্ট হইয়া যাইবে। তাহা হইলে মোক্ষসুখ ভোগ। করিবে কে? অতএব ব্রহ্ম কখনও জীব এবং জীব কখনও ব্রহ্ম নহে, হয় নাই এবং হইবে না।
প্রশ্ন –তবে সদেব সোম্যমগ্র আসীদেকমেবাদ্বিতীয়। ছান্দোগ্য।
অদ্বৈতসিদ্ধি কীরূপে হইবে? আমার মতে তো ব্রহ্ম হইতে পৃথক কোন সজাতীয়, বিজাতীয় ও স্বগত অবয়বসমূহের ভেদ না থাকায় এক ব্রহ্মই সিদ্ধ হয়। জীব অন্য হইলে অদ্বৈতসিদ্ধি কীরূপে হইতে পারে?
উত্তর –এই ভ্রমে পড়িয়া ভয় পাইতেছে কেন? ‘বিশেষ্য বিশেষণ’ বিদ্যার ফল কী সে বিষয়ে জানো। যদি বল,ব্যাবৰ্ত্তৰ্কং বিশেষণং ভবতীতি’ বিশেষণ ভেদকারক হয়, তাহা হইলে ‘প্রবর্তকং প্রকাশকমপি বিশেষণং ভবতীতি’, বিশেষণ যে প্রবর্তক এবং প্রকাশক হয়, তাহাও। স্বীকার কর।
তাহা হইলে বুঝিতে হইবে যে, অদ্বৈত ব্রহ্মেরই বিশেষণ। ইহাতে ব্যবৰ্ত্তক ধর্ম এইরূপ যে, অদ্বৈত বস্তু ব্রহ্মকে যাবতীয় জীব ও তত্ত্ব হইতে পৃথক্ করিতেছে এবং বিশেষণের প্রকাশক ধর্ম দ্বারা ব্রহ্মের একত্ব প্রতিপাদন করিতেছে। উদাহরণ স্বরূপ, “অস্মিন্নগরে দ্বিতীয়ো ধনাঢ্যো দেবদত্তঃ; অস্যাং সেনায়ামদ্বিতীয়ঃ শূরবীরো বিক্রমসিংহঃ”। কেহ কাহাকেও বলিল যে, এই নগরে দেবদত্ত অদ্বিতীয় ধনাঢ্য এবং বিক্রম সিংহ এই সেনার মধ্যে অদ্বিতীয় শূরবীর। এতদ্বারা সিদ্ধ হইল যে, এই নগরে দেবদত্ত সদৃশ অন্য ধনাঢ্য ও এই সেনার মধ্যে বিক্রমসিংহের ন্যায় শূরবীর দ্বিতীয় কেহ নাই, অবশ্য তদপেক্ষা নিকৃষ্ট আছে। তদ্ব্যতীত পৃথিবী আদি জড় পদার্থ, পশ্বাদি প্রাণী এবং বৃক্ষাদি আছে। এই সকলের নিষেধ হইতে পারে না। সেইরূপ ব্রহ্ম সদৃশ জীব ও প্রকৃতি নাই, কিন্তু তদপেক্ষা নিকৃষ্ট আছে।
এতদ্বারা ইহাই সিদ্ধ হইল যে, ব্রহ্মা সদা এক, কিন্তু জীব এবং প্রকৃতিস্থ তত্ত্ব অনেক। ঐ সকল হইতে পৃথক্ করিয়া ব্রহ্মের একত্ব প্রতিপাদক ‘অদ্বৈত’অথবা ‘অদ্বিতীয় বিশেষণ। ইহাতে জীব অথবা প্রকৃতির এবং কাৰ্য্যরূপ জগতের অভাবও নিষেধ হইতে পারে না। কিন্তু এইসকল আছে, তবে ব্রহ্মের তুল্য নহে। ইহাতে অদ্বৈতসিদ্ধি অথবা দ্বৈতসিদ্ধির ব্যতিক্রম হয় না। অস্থির হইও না, বিচার করিয়া, বুঝিবার চেষ্টা কর।
প্রশ্ন –ব্রহ্মের সৎ, চিৎ এবং আনন্দ আর জীবের অস্তি, ভাতি এবং প্রিয়রূপে একতা বিদ্যমান। তবে খণ্ডন করিতেছেন কেন?;
উত্তর –কিঞ্চিৎ সাধর্ম থাকিলেই একত্ব হইতে পারে না। যেরূপ পৃথিবী জড় ও দৃশ্যমান, সেইরূপ জল এবং অগ্নি আদিও জড় ও দৃশ্যমান। কেবল এইমাত্র বলিলেই একতা সিদ্ধ হয় না। ইহাদের মধ্যে বৈধর্ম ভেদকারক অর্থাৎ বিরুদ্ধ ধর্ম, যথা–গন্ধ, রুক্ষতা ও কাঠিন্য প্রভৃতি পৃথিবীর গুণ, এবং রস, দ্রব্যত্ব ও কোমলত্ব প্রভৃতি জলের ধর্ম এবং অগ্নিতে রূপ ও দাহকত্ব প্রভৃতি গুণ থাকিলেও ইহাদের মধ্যে একতা নাই।
যেরূপ মনুষ্য ও কীট চক্ষু দ্বারা দেখে, মুখ দ্বারা আহার করে (এবং) পদ দ্বারা গমনাগমন। করে; তথাপি মনুষ্যের আকৃতিতে পদদ্বয় এবং কীটের আকৃতিতে অনেক পদ ইত্যাদি ভেদ বশতঃ একত্ব হইতে পারে না। সেইরূপ পরমেশ্বরের অনন্ত জ্ঞান, আনন্দ, বল, ক্রিয়া, নির্ভাক্তিত্ব ও ব্যাপকতা জীব হইতে ভিন্ন এবং জীবের অল্প জ্ঞান, অল্প বল, অল্প স্বরূপ সব ভ্রান্তিত্ব ও পরিচ্ছিন্নতা প্রভৃতি গুণ হইতে ব্রহ্ম ভিন্ন। অতএব জীব ও পরমেশ্বর এক নহে। কেননা ইহাদের স্বরূপও (পরমেশ্বরের অতীব সূক্ষ্ম এবং জীব পরমেশ্বর অপেক্ষা কিছু স্থূল হওয়ায়) ভিন্ন।
প্রশ্ন –অগোদরমন্তরংকুরুতে, অথতস্য ভয়ংভবতি।(তৈউ০) দ্বিতীয়াদ্বৈ ভয়ংভবতি ॥ ইহা বৃহদারণ্যকের বচন।
অর্থ –যে ব্যক্তি ব্রহ্ম ও জীবের মধ্যে অল্পমাত্রও ভেদ বুদ্ধি রাখে সে ভীত হন। কারণ ভয় অন্য হইতেই হইয়া থাকে ॥
উত্তর –ইহার অর্থ এইরূপ নহে। কিন্তু ইহার অর্থ এই যে, যে জীব ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করে, অথবা পরমাত্মাকে কোন দেশ-কালে পরিচ্ছিন্ন বলিয়া মনে করে, অথবা ঈশ্বরের আজ্ঞা ও গুণ-কর্ম স্বভাবের বিরুদ্ধাচারী হয় অথবা কোন মনুষ্যের প্রতি বৈরভাবাপন্ন হয়, সেই ভীত হয় কেননা দ্বিতীয় বুদ্ধি অর্থাৎ ঈশ্বরের সহিত আমার কোন সম্বন্ধ নাই–এইরূপ বুদ্ধি হইলে, অথবা কাহাকেও যদি বলে আমি তোমাকে কিছুই মনে করি না, তুমি আমাকে কিছুই করিতে পারিবে না। অথবা যে কাহাকেও কষ্ট দেয় বা ক্ষতি করে সে ব্যক্তি হইতে তাহার ভয় উপস্থিত হয়। আর সর্বপ্রকারে অবিরোধ হইলেই এক বলা হয়। যেমন লোকে বলে যে, ‘দেবদত্ত, যজ্ঞদণ্ড এবং বিষ্ণুমিত্র এক, অর্থাৎ অবিরুদ্ধ। বিরোধ না থাকিলে সুখ এবং বিরোধ থাকিলে দুঃখ।
প্রশ্ন –ব্রহ্ম ও জীবের মধ্যে সর্বদা একতা ও অনেকতা থাকে অথবা কখনও উভয়ে মিলিয়া এক হইয়া যায় বা যায় না?
উত্তর –ইহার পূর্বে কিছু উত্তর দিয়াছি। কিন্তু সাধর্ম অন্বয়ভাবে একতা হইয়া থাকে। যেমন আকাশে ও মূর্তদ্রব্যে জড়ত্ব থাকায় এবং কখনও পৃথক না থাকায় একতা এবং আকাশের বিভু, সূক্ষ্ম, অরূপ, অনন্তাদি গুণ ও মূর্তিমান পদার্থের পরিচ্ছিন্ন, দৃশ্যাত্বাদি বৈধর্মবশত ভেদ হইয়া থাকে। অর্থাৎ পৃথিবী আদি পদার্থ আকাশ হইতে কখনও ভিন্ন থাকিতে পারে না, কেননা ‘অন্বয়’ অর্থাৎ অবকাশ ব্যতীত মূর্তদ্রব্য থাকিতে পারে না এবং ব্যতিরেক’ অর্থাৎ স্বরূপতঃ ভিন্ন হওয়ায় পার্থক্য আছে। সেইরূপ ব্রহ্ম ব্যাপক হওয়ায় জীব ও পৃথিবী আদি পদার্থ ব্রহ্ম হইতে পৃথক থাকিতে পারে না।
যেরূপ গৃহ নির্মাণ করিবার পূর্বে ভিন্ন-ভিন্ন দেশে মৃত্তিকা, কাষ্ঠ, লৌহ আদি পদার্থ আকাশেই থাকে, যখন গৃহ নির্মিত হইয়া গেল তখনও আকাশেই বর্তমান থাকে এবং যখন নষ্ট হইয়া গেল অর্থাৎ সেই ঘরের সব অবয়ব ভিন্ন-ভিন্ন দেশকে প্রাপ্ত হইল, তখনও তাহারা আকাশেই থাকিল। অর্থাৎ তিন কালেই আকাশ হইতে ভিন্ন হইতে পারিল না এবং স্বরূপতঃ ভিন্ন হওয়ায় কখনও এক ছিল না, এক নাই ও এক হইবে না। এইরূপ জীব ও সংসারের সমস্ত পদার্থ পরমেশ্বরে ব্যাপ্য হওয়ায় পরমাত্মা হইতে তিনকালেই ভিন্ন এবং স্বরূপতঃ ভিন্ন হওয়ায় কখনও এক হয় না।
আজকাল বেদান্তিগণের দৃষ্টি কাণা পুরুষের ন্যায় অন্বয়ের দিকে পড়িয়া ব্যতিরেক ভাব হইতে পৃথক হইয়া বিরুদ্ধ গিয়াছে। এরূপ কোনো দ্রব্য নাই যাহাতে সগুণ-নিগুর্ণতা, অন্বয়, ব্যতিরেক, সাধ, বৈধম ও [ বিশেষ্য ] বিশেষণ ভাব থাকে না।
প্রশ্ন– পরমেশ্বর সগুণ অথবা নির্গুণ?
উত্তর –উভয় প্রকার।
প্রশ্ন –বেশ তো বলিলে। –এক কোষে কী দুই তরবারি কখনও থাকিতে পারে? একই পদার্থে সগুণতা এবং নিগুর্ণতা কীরূপে থাকিতে পারে?;
উত্তর –যেরূপ জড়ের রূপাদি গুণ আছে, কিন্তু চেতনের জ্ঞানাদি গুণ জড়ের মধ্যে নাই, সেইরূপ চেতনের মধ্যে ইচ্ছা প্রভৃতি গুণ আছে, কিন্তু রূপাদি জড়ের গুণ নাই। সুতরাং ‘য়দ গুণৈঃ সহবর্তমানংতং সগুণ’ “গুলোভ্যোয়নিৰ্গতং পৃথভূতং তন্নিগুণ” যাহা গুণবিশিষ্ট তাহা ‘সগুণ’ এবং যাহা গুণবিহীন তাহাকে ‘নির্গুণ’ বলে। নিজ নিজ স্বাভাবিক গুণযুক্ত এবং বিরোধী গুণ রহিত হওয়াতে সকল পদার্থই সগুণ ও নির্গুণ। এরূপ কোনও পদার্থ নাই যাহা কেবল সগুণত্ব অথবা কেবল নির্গুণত্ব বিশিষ্ট। প্রত্যুত একই পদার্থে সগুণত্ব ও নির্গুণত্ব সর্বদা থাকে। সেইরূপ পরমেশ্বরে স্বীয় অনন্ত জ্ঞান-বল ইত্যাদি গুণ থাকায় তিনি সগুণ কিন্তু রূপাদি জড়ের এবং দ্বেষাদি জীবের গুণ তার মধ্যে না থাকায় তিনি ‘নির্গুণ’ কথিত হন।
প্রশ্ন –সংসারে নিরাকারকে নির্গুণ এবং সাকারকে সগুণ বলে। অর্থাৎ যখন পরমেশ্বর জন্মগ্রহণ করেন না, তখন তিনি নির্গুণ আর যখন অবতার হন, তখন তিনি সগুণ।
উত্তর –ইহা কেবল অজ্ঞানী এবং বিদ্যাহীনদের কল্পনা মাত্র। মূর্খেরা পশুর ন্যায় যেখানে সেখানে বৃথা চীৎকার করিয়া থাকে। সন্নিপাত জরাক্রান্ত মনুষ্য যেরূপ নিরর্থক প্রলাপ করে, সেইরূপ মূর্খদের কথা অথবা তাহাদের লেখাকে ব্যর্থ মনে করা উচিত।
প্রশ্ন –পরমেশ্বর আসক্ত অথবা বিরক্ত?
উত্তর –উভয়ই নহেন। কারণ ‘আসক্তি নিজ অপেক্ষা উত্তম বস্তুতে হইয়া থাকে। পরমেশ্বর হইতে বিচ্ছিন্ন এবং পরমেশ্বর অপেক্ষা উত্তম কোনো পদার্থ নাই সুতরাং তাহাতে আসক্তি থাকা সম্ভব নহে। আবার, প্রাপ্ত বস্তু পরিত্যাগ করাকে বিরক্ত’ বলে। পরমেশ্বর ব্যাপক বলিয়া তিনি কোনো পদার্থকে ত্যাগ করিতে পারেন না। অতএব,পরমেশ্বর বিরক্তও নহেন।
প্রশ্ন –পরমেশ্বরের ইচ্ছা আছে কি না?
উত্তর –তথাকথিত ইচ্ছা নাই। কারণ ইচ্ছাও অপ্রাপ্ত উত্তম বস্তুর জন্য এবং যাহা লাভ করিলে সুখ বিশেষ হয়, এমতাবস্থায় ঈশ্বরে ইচ্ছা থাকিবে কীরূপে? ঈশ্বর বিষয়ে তাহা সম্ভব হইলে তাহার ইচ্ছা থাকিতে পারিত। কিন্তু ঈশ্বরের কোনো বস্তু অপ্রাপ্ত নাই। ঈশ্বর অপেক্ষা উত্তম এবং পূর্ণসুখময় কোনো পদার্থ নাই। এজন্য ঈশ্বরে সুখের অভিলাষাও নাই। সুতরাং তাহাতে ইচ্ছা সম্ভব নহে। কিন্তু সকল প্রকার বিদ্যার দর্শন ও সমস্ত সৃষ্টি রচনা, যাহাকে ঈক্ষণ’বলে, তাহাতে সেই ঈক্ষণ আছে। এই সকল সংক্ষিপ্ত বিষয় হইতেই সৎপুরুষ বিস্তার করিতে পারিবেন ॥
ঈশ্বর বিষয়ে সংক্ষেপে ইহা লিখিত হইল। অতএব বেদ বিষয়ে লিখিত হইতেছে –য়স্মাদৃচো অপাতক্ষয়জুর্যম্মাদোকষ। সামানিয়স্য লোমান্য থর্বাঙ্গিরসো মুখং স্কন্তং তং ক্রহি কতমঃ স্বিদেব সঃ ॥ অর্থবকা০১০।২৩ ॥ ৪।২০ ॥
(অর্থঃ) –যে পরমাত্মা হইতে ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ এবং অথর্ববেদ প্রকাশিত হইয়াছে, তিনি কোন্ দেবতা? ইহার (উত্তর)–যিনি সকলকে সৃষ্টি করিয়া ধারণ করিতেছেন, তিনি সেই পরমাত্মা ॥
স্বয়ম্ভয়াথাতথ্যতোমর্থান্ ব্যদধাচ্ছাশ্বতীভ্যঃ সমাভ্যঃ ॥ ২ যজু। অ৪০। ৮ ॥
যিনি স্বয়ম্ভু, সর্বব্যাপক, শুদ্ধ, সনাতন, নিরাকার পরমেশ্বর, তিনি সনাতন জীবরূপ প্রজাবর্গের কল্যাণার্থে যথার্থ রীতি অনুসারে বেদ দ্বারা সকল বিদ্যার উপদেশ প্রদান করেন।
প্রশ্ন –আপনি পরমেশ্বরকে নিরাকার না সাকার মানেন?
উত্তর –নিরাকার মানি।
প্রশ্ন –পরমেশ্বর নিরাকার হইলে মুখ দ্বারা বর্ণোচ্চারণ ব্যতীত কীরূপে বেদবিদ্যার উপদেশ প্রদান করা সম্ভব হইয়াছিল? কেননা বর্ণের উচ্চারণে তালু প্রভৃতি স্থান ও জিহ্বার প্রযত্ন অবশ্য হওয়া আবশ্যক।
উত্তর –পরমেশ্বর সর্বশক্তিমান ও সর্বব্যাপক বলিয়া স্বীয় ব্যাপ্তি দ্বারা জীবদিগকে বেদবিদ্যার উপদেশ প্রদান করিতে তাহার মুখাদি কিছুরই প্রয়োজন হয় না। কারণ, মুখ ও জিহ্বা দ্বারা বর্ণোচ্চারণ নিজের জন্য নহে,কিন্তু অপরের বোধের জন্য করা হইয়া থাকে। মুখ ও জিহ্বার ব্যাপার ব্যতীত মনে অনেক বিষয়ের এবং শব্দোচ্চারণ হইতে থাকে। অঙ্গুলি দ্বারা কর্ণররুদ্ধ করিয়া দেখ ও শ্রবণ কর, মুখ জিহ্বা এবং তালু প্রভৃতি স্থান ব্যতীত কীরূপ শব্দ হইতেছে। সেইরূপ ঈশ্বর অন্তর্যামী রূপে জীবকে উপদেশ দিয়াছেন। কিন্তু কেবল অন্যকে বুঝাইবার জন্য উচ্চারণের প্রয়োজন হয়।
পরমেশ্বর নিরাকার বলিয়া সর্বব্যাপক তিনি আপন অখিল বেদবিদ্যার উপদেশ জীবস্থ স্বরূপ দ্বারা জীবাত্মায় প্রকাশ করেন। পুনরায় মনুষ্য তাহা নিজ মুখে উচ্চারণ করিয়া অপরকে শ্রবণ করাইয়া থাকে। এই জন্য ঈশ্বরে পূর্বোক্ত দোষ লাগিতে পারে না।
প্রশ্ন –ঈশ্বর কবে কাহার আত্মায় বেদ প্রকাশ করিয়াছেন?
উত্তর –অগ্নের্বাঋগবেদো জায়তেবায়য়ায়জুর্বেদঃ সূয়াৎ সামবেদঃ ॥ শত০ ॥
পরমাত্মা প্রথমে সৃষ্টির আদিতে অগ্নি, বায়ু, আদিত্য এবং অঙ্গিরা–এই সকল ঋষিগণের আত্মায় এক একটি বেদ প্রকাশ করিয়াছেন।
প্রশ্ন –’য়ো বৈ ব্রহ্মাণং বিদধাতি পূর্বং যো বৈ বেদাংশ্চ প্রহিণোতি তস্মৈ ॥
ইহা শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের বচন। এই বচনানুসারে পরমেশ্বর ব্রহ্মার হৃদয়ে বেদোপদেশ প্রদান করিয়াছিলেন। তাহার পর পুনরায় অগ্নি ইত্যাদি ঋষিদের আত্মায় করিলেন কেন?
উত্তর –ব্রহ্মার আত্মায় অগ্নি প্রভৃতি ঋষিগণ দ্বারা বেদ প্রকাশ করিয়াছিলেন। দেখ! মন স্মৃতিতে কী লিখিয়াছেন :
অগ্নিবায়ুরবিভ্যস্তু ত্রয়ংব্রহ্ম সনাতন। দুদোহয়জ্ঞসিদ্ধ্যর্থমৃগয়জুঃসামলক্ষণ ॥ মনু
পরমাত্মা আদি সৃষ্টিতে মনুষ্য উৎপন্ন করিয়া অগ্নি প্রভৃতি চারি মহর্ষিদের দ্বারা ব্রহ্মাকে চারিবেদ শিক্ষা দিয়েছিলেন, আর ব্রহ্মা, অগ্নি, বায়ু, আদিত্য এবং অঙ্গিরার নিকট হইতে ঋক্, যজুঃ, সাম এবং অথর্ববেদ শিক্ষা লাভ করিয়াছিলেন।
প্রশ্ন –সেই চারিজনের মধ্যেই বেদ প্রকাশ করিয়াছিলেন, অন্যের মধ্যে করেন নাই, ইহার দ্বারা ঈশ্বর পক্ষপাতী হইলেন।
উত্তর –সেই চারিজন সব জীবের মধ্যেই সর্বাপেক্ষা অধিক পবিত্ৰাত্মা ছিলেন। অথবা কেহ তাহাদের সদৃশ ছিলেন না। এই কারণে তাহাদেরই মধ্যেই পবিত্র বিদ্যার প্রকাশ করা হইয়াছিল।
প্রশ্ন– কোনো দেশীয় ভাষায় বেদ প্রকাশ না করিয়া সংস্কৃত ভাষায় করা হইল কেন?
উত্তর –কোনোও দেশীয় ভাষায় প্রকাশ করিলে ঈশ্বর পক্ষপাতী হইতেন। কারণ, তিনি যে দেশের ভাষায় বেদ প্রকাশ করিতেন, সেই দেশের অধিবাসীদের পক্ষে বেদের অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা। সহজ, আর অন্য দেশীয়দের পক্ষে অধ্যয়ন কঠিন হইত। এইজন্য সংস্কৃত ভাষাতেই প্রকাশ করিয়াছেন। সংস্কৃত কোনো দেশের ভাষা নহে। আর বেদ-ভাষা অন্য সমস্ত ভাষার মূল। অতএব সেই বৈদিক। ভাষাতেই বেদ প্রকাশ করা হইয়াছে। যেরূপ ঈশ্বরের পৃথিব্যাদি সৃষ্টি সকল দেশ এবং সকল দেশবাসীর জন্যই একরূপ ও সকল শিল্পবিদ্যার মূল, সেইরূপ পরমেশ্বরের বিদ্যার ভাষাও একরূপ হওয়া উচিত। তাহাতে সর্বদেশীয় লোকের অধ্যয়ন অধ্যাপনায় সমান পরিশ্রম হইয়া থাকে।
অতএব ঈশ্বর পক্ষপাতী নহেন। সংস্কৃত ভাষা সল্ল ভাষার মূলও বটে।
প্রশ্ন –বেদ ঈশ্বরকৃত, অন্য কৃত নহে, এ বিষয়ে প্রমাণ কী?
উত্তর –(১) যেরূপ ঈশ্বর পবিত্র, সর্ববিদ্যাবিৎ, শুদ্ধ গুণ-কর্ম-স্বভাববিশিষ্ট, ন্যায়কারী, দয়ালু আদি গুণসম্পন্ন, সেইরূপ যে পুস্তকে ঈশ্বরের গুণ-কর্ম-স্বভাবের অনুকূল কথন থাকিবে উহা ঈশ্বর কৃত, অন্য কৃত নহে।
(২) আর যাহাতে সৃষ্টিক্রম,প্রত্যক্ষাদি প্রমাণ এবং আপ্ত ও পবিত্ৰাত্মাদিগের ব্যবহার বিরুদ্ধ কথা নাই উহা ঈশ্বরোক্ত।
(৩) ঈশ্বরের জ্ঞান যেরূপ অভ্রান্ত, যে পুস্তকে সেইরূপ অভ্রান্ত জ্ঞানের প্রতিপাদন করা আছে, উহা ঈশ্বরোক্ত ॥
(৪) পরমেশ্বর ও তাহার সৃষ্টিক্রম যেরূপ, যে পুস্তকে সেইরূপ ঈশ্বর সৃষ্টি-কাৰ্য-কারণ এবং জীবের প্রতিপাদন করা আছে, সেই পুস্তক পরমেশ্বর কৃত।
(৫) যাহা প্রত্যক্ষাদি প্রমাণ বিষয়ে শুদ্ধাত্মা স্বভাবের অবিরুদ্ধ উহা পরমেশ্বরোক্ত পুস্তক এইরূপ বেদ। অন্যান্য বাইবেল ও কুরাণ প্রভৃতি পুস্তক সেইরূপ নহে। এই পুস্তকের ত্রয়োদশ এবং চতুদর্শ সমুল্লাসে বাইবেল ও কোরাণ বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যা করা যাইবে।
প্রশ্ন –ঈশ্বর কর্তৃক বেদ প্রকাশের কিছুই প্রয়োজন নাই। কারণ মনুষ্যগণ ক্রমশঃ জ্ঞানোন্নতির সঙ্গে সঙ্গে পুস্তকও রচনা করিতে পারিবে।
উত্তর –না। কখনও হইতে পারে না। কেননা, কারণ ব্যতীত কাৰ্য্যের উৎপত্তি অসম্ভব। বন্য মনুষ্যেরা সৃষ্টিকে দেখিয়াও বিদ্বান হয় নাই। কিন্তু কোন শিক্ষক পাইলেই তাহারা বিদ্বান্ হইয়া থাকে। এখনও কাহারও নিকট বিদ্যাশিক্ষা না করিয়া কেহই বিদ্বান্ হয় না। সেইরূপ যদি পরমাত্মা পূর্বোক্ত আদি সৃষ্টিতে ঋষিদিগকে, এবং ঋষিগণ অপর মনুষ্যদিগকে বেদবিদ্যা শিক্ষা না দিতেন, তাহা হইলে সকলেই বিদ্যাহীন থাকিয়া যাইত। জন্মের সঙ্গে সঙ্গে কাহারও কোনও বালককে নির্জন স্থানে, মুখ অথবা পশুদিগের সঙ্গে রাখা হইলে সে তাহার সঙ্গীদের ন্যায়ই হইয়া যাইবে।
অরণ্যবাসী ভীল প্রভৃতি ইহার দৃষ্টান্ত স্বরূপ।
যতদিন আৰ্য্যাবৰ্ত্ত দেশ হইতে শিক্ষা বিস্তৃত হয় নাই, ততদিন মিশর, গ্রীস এবং ইউরোপ প্রভৃতি দেশের মনুষ্যগণের মধ্যে কোনরূপ বিদ্যার বিস্তার হয় নাই। ইওরোপের কলম্বাস প্রভৃতি ব্যক্তি যতদিন পর্যন্ত আমেরিকায় যান নাই, ততদিন পর্যন্ত তাহারাও সহস্র, লক্ষ অথবা কোটি বৎসর ধরিয়া বিদ্যাহীন ছিল। পরে সুশিক্ষাপ্রাপ্ত হওয়াতে বিদ্বান্ হইয়াছে। সেইরূপ সৃষ্টির আদিতে মনুষ্য পরমাত্মার নিকট হইতে বিদ্যা শিক্ষা করিয়া উত্তরোত্তর বিদ্বান্ হইয়া আসিতেছে।
স [এষ] পূর্বের্ষামপি গুরুঃ কালোনানবচ্ছেদাৎ ॥ যোগসূত্র ০ ॥
যেরূপ বর্তমানকালে আমরা অধ্যাপকের নিকট শিক্ষা করিয়াই বিদ্বান্ হইয়া থাকি, সেইরূপ পরমেশ্বর সৃষ্টির প্রারম্ভে উৎপন্ন অগ্নি প্রভৃতি ঋষিদেরও গুরু, অধ্যাপক ছিলেন। কারণ,পরমেশ্বরের জ্ঞান নিত্য বলিয়া তিনি জীবের ন্যায় সুষুপ্তি এবং প্রলয় কালে জ্ঞান রহিত হন না। তাঁহার জ্ঞান নিত্য। সুতরাং ইহা নিশ্চিতরূপে জানা আবশ্যক যে, নিমিত্ত ব্যতীত কখনও নৈমিত্তিক অর্থ সিদ্ধ হয় না।
প্রশ্ন– বেদ সংস্কৃত ভাষায় প্রকাশিত হইয়াছে। কিন্তু অগ্নি প্রভৃতি ঋষিগণ সেই ভাষা জানিতেন। না। তাহারা বেদের অর্থ জানিলেন কীরূপে?
উত্তর –পরমেশ্বর জানাইয়াছেন। ধর্মাত্মা যোগী মহর্ষিগণ যখন যে যে মন্ত্রের অর্থ জানিতে ইচ্ছা করিয়া ধ্যানাবস্থিত হইয়া পরমেশ্বরের স্বরূপে সমাধিস্থ হইতেন, তখন তখন পরমাত্মা তাহাদিগকে অভীষ্ট মন্ত্রের অর্থ জানাইয়াছেন। যখন অনেকের আত্মায় বেদার্থের প্রকাশ হইল, তখন ঋষি মুনিগণ সেই বেদার্থ ও ঋষি মুনিদের ইতিহাস সম্বলিত গ্রন্থ রচনা করিলেন। ঐ সকল গ্রন্থের নাম ‘ব্রাহ্মণ’। ব্রহ্ম অথবা বেদের ব্যাখ্যা গ্রন্থ বলিয়া ঐ সকলের নাম ব্রাহ্মণ’ হইয়াছে। আরঃ —
ঋষয়ে মন্ত্রদৃষ্টয়ঃ, মন্ত্রা সম্প্রদুঃ৷ নিরু
যে যে ঋষি যে যে মন্ত্রের অর্থ দর্শন করিলেন, তাহার পূর্বে কেহ সেই মন্ত্রের অর্থ প্রকাশ করেন নাই। তিনি সেই মন্ত্রের অর্থ প্রকাশ করিলেন এবং অপরকেও শিক্ষা দিলেন। সেই জন্য মন্ত্রের সেই ঋষির নাম অদ্যাবধি স্মরণার্থ লিখিত হইয়া আসিতেছে। যদি কেহ ঋষিদিগকে মন্ত্রের কর্তা বলেন, তবে বুঝিতে হইবে যে, তিনি অসত্য কথা বলিতেছেন। তাহারা তো মন্ত্রার্থের প্রকাশক মাত্র।
প্রশ্ন– কোন্ গ্রন্থের নাম বেদ?
উত্তর –ঋক, যজুঃ, সাম এবং অথর্ব মন্ত্রসংহিতার নাম বেদ। অন্য কোনো গ্রন্থের নাম বেদ। নহে।
প্রশ্ন –মন্ত্রব্রাহ্মণয়োর্বেদনামধেয়৷ [দ্রষ্টব্য কাত্যায়ন পরিশিষ্ট প্রতিজ্ঞা সূত্র ১১] ইত্যাদি কাত্যায়ন প্রভৃতি মুনিকৃত প্রতিজ্ঞাসূত্রের কী অর্থ করিবেন?
উত্তর –দেখ! সংহিতার আরম্ভ (ও) অধ্যায় সমাপ্তিতে সনাতন কাল হইতে বেদ শব্দ লিখিত হইয়া আসিতেছে। কিন্তু ব্রাহ্মণগ্রন্থের আরম্ভে বা অধ্যায় সমাপ্তিতে উহা কোথায়ও লিখিত হয় নাই। আর নিরুক্তে–
ইত্যাপি নিগমো ভবতি। (নিরুক্ত ৫৩) ইতি (চ) ব্রাহ্মণ (নিরুক্ত ৫৪) ছন্দো ব্রাহ্মণানি চ তদ্বিষয়াণি ॥ ইহা পাণিনীয় সূত্র ॥
ইহাতে স্পষ্টরূপে জানা যাইতেছে যে, বেদ মন্ত্রভাগ এবং ব্রাহ্মণ ব্যাখ্যা ভাগ। এবিষয়ে বিশেষ জানিতে ইচ্ছা হইলে মৎপ্রণীত ‘ঋগ্বেদাদি ভাষ্যভূমিকা’ দ্রষ্টব্য। সেই গ্রন্থে প্রমাণ করা। হইয়াছে যে, নানারূপে প্রমাণ বিরুদ্ধ বলিয়া উক্ত বচন কাত্যায়নের হইতে পারে না সেই বচন। মানিলে বেদ কখনও সনাতন হইতে পারে না। কারণ, ব্রাহ্মণ গ্রন্থ সমূহে বহু ঋষি, মহর্ষি ও রাজাদের ইতিহাস লিখিত আছে। কাহারও ইতিহাস তাহার জন্মের পরেই লিখিত হইয়া থাকে। সেই গ্রন্থও তাহার জন্মের পরেই হয়। বেদে কাহারও ইতিহাস নাই, কিন্তু তন্মধ্যে যে সকল শব্দ দ্বারা বিদ্যা জানা যায়, সেই সকল শব্দের প্রয়োগ করা আছে। কোন মনুষ্যবিশেষের সংজ্ঞা অথবা। কথাপ্রসঙ্গ বেদে নাই।
প্রশ্ন– বেদের কতগুলি শাখা আছে?
উত্তর –এক হাজার একশত সাতাইশ।
প্রশ্ন –শাখা কাহাকে বলে?
উত্তর –ব্যাখ্যানকে ‘শাখা’ বলে।
প্রশ্ন –সংসারে বিদ্বান্ ব্যক্তিরা বেদের অবয়বভূত বিভাগ সমূহকে শাখা বলিয়া মানেন কি?
উত্তর –একটু বিবেচনা করিয়া দেখিলে সত্য জানিতে পারিবে। কেননা, বেদের যতগুলি শাখা আছে সেগুলি ‘আলায়ন’ প্রভৃতি ঋষিদের নামে প্রসিদ্ধ, কিন্তু মন্ত্রসংহিতা পরমেশ্বরের নামে প্রসিদ্ধ। চারি বেদ যেরূপ পরমেশ্বরকৃত বলিয়া মানি, সেইরূপ আলায়নী প্রভৃতি শাখাগুলিকে সেই সেই ঋষিকৃত বলিয়া মানি, এবং সেই সমস্ত শাখায় মন্ত্রের প্রতীক উল্লেখ করিয়া ব্যাখ্যা করা হইয়াছে। উদাহরণ স্বরূপ, তৈত্তিরীয় শাখায় ইমোত্বোর্জেত্বা ইতি’,ইত্যাদি প্রতীক উল্লেখ করিয়া ব্যাখ্যা করা হইয়াছে। কিন্তু বেদসংহিতায় কোনো প্রতীক গ্রহণ করা হয় নাই। অতএব পরমেশ্বর কৃত চারিবেদ মূল বৃক্ষ এবং আলায়ন প্রভৃতি যাবতীয় শাখা ঋষিমূনিকৃত, পরমেশ্বর কৃত নহে।
ইহার বিশেষ ব্যাখ্যা যাহারা দেখিতে ইচ্ছা করেন, তাহারা ঋগ্বেদাদিভাষ্য ভূমিকায় দেখিয়া লইবেন। যেরূপ মাতা-পিতা নিজ সন্তানদের প্রতি কৃপাদৃষ্টি রাখিয়া তাহাদের উন্নতি ইচ্ছা করেন, সেইরূপ পরমেশ্বর সকল মনুষ্যের প্রতি কৃপা করিয়া বেদকে প্রকাশ করিয়াছেন। তদ্বারা মনুষ্যগণ অবিদ্যারূপ অন্ধকার এবং ভ্রমজাল হইতে মুক্ত হইয়া বিদ্যা ও বিজ্ঞানরূপ সূৰ্য্য প্রাপ্ত হইয়া পরমানন্দে অবস্থান করে এবং বিদ্যা ও সুখবৃদ্ধি করিয়া থাকে।
প্রশ্ন –বেদ নিত্য অথবা অনিত্য?
উত্তর –“নিত্য। পরমেশ্বর নিত্য বলিয়া তাহার জ্ঞানাদি গুণও নিত্য। নিত্য পদার্থের গুণ-কর্ম-স্বভাব নিত্য, আর অনিত্য দ্রব্যের গুণ-কর্ম-স্বভাব অনিত্য হয়।
প্রশ্ন– বেদ পুস্তকও কি নিত্য?
উত্তর –না। কেননা, পুস্তক তো কাগজ (পত্র) ও মসীনির্মিত, উহা কীরূপে নিত্য হইতে পারে? যে সমস্ত শব্দ, অর্থ ও সম্বন্ধ আছে সে সমস্তই নিত্য।
প্রশ্ন –সম্ভবতঃ ঈশ্বর পূর্বোক্ত ঋষিদিগকে জ্ঞান দিয়া থাকিবেন এবং তাহারা সেই জ্ঞানের। সাহায্যে বেদ রচনা করিয়া থাকিবেন?
উত্তর –জ্ঞেয় ব্যতীত জ্ঞান হয় না। গায়ত্রী আদি ছন্দ, ষড়জাদি ও উদাত্তনুদাত্ত আদি স্বর জ্ঞানের সহিত গায়ত্রী প্রভৃতি ছন্দ সমূহের রচনাসামর্থ্য সর্বজ্ঞ ব্যতীত কাহারও নাই। এইরূপ সর্বজ্ঞানযুক্ত শাস্ত্র নির্মাণ করাও অপরের সাধ্যাতীত। হ্যাঁ, ঋষিমুনিগণ বেদাধ্যয়নের পর ব্যাকরণ, নিরুক্ত ও ছন্দ প্রভৃতি গ্রন্থ বিদ্যাপ্রকাশার্থ রচনা করিয়াছেন। পরমাত্মা বেদপ্রকাশ না করিলে কেহ কিছুই রচনা করিতে পারিতেন না। সুতরাং বেদ পরমেশ্বরোক্ত। এতদনুসারে সকলের চলা উচিত। যদি কেহ কাহাকেও জিজ্ঞাসা করে, আপনার মত কী? তবে এই উত্তর দেওয়া উচিত আমার । মত ‘বেদ’। অর্থাৎ যাহা কিছু বেদোক্ত আমি উহা স্বীকার করি। অতঃপর সৃষ্টি বিষয়ে লিখিত হইবে।
ঈশ্বর এবং বেদবিষয় সংক্ষেপে ব্যাখ্যাত হইল ॥ ৭ ॥
ইতি শ্রীমদ্দয়ানন্দ সরস্বতী স্বামীকৃতে সত্যার্থ প্রকাশে
সুভাষাবিভূষিতে ঈশ্বরবেদবিষয়ে
সপ্তমঃ সমুল্লাসঃ সম্পূর্ণঃ ॥৭॥