০৭. বেগম্যান এবং ক্রাউচ

০৭. বেগম্যান এবং ক্রাউচ

হ্যারি রনের কাছ থেকে নিজেকে মুক্ত করে দাঁড়াল। মনে হল এক জনমানব শূন্য অদ্ভুত এক মরুভূমিতে ওরা সবাই দাঁড়িয়ে আছে। ওদের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে অতি ক্লান্ত দুজন জাদুকর। একজনের হাতে বিরাট এক সোনার ঘড়ি অন্যজনের হাতে একগাদা পার্চমেন্ট আর পাখির পালক। ওদের পরণে মাগলদের জামা–কাপড়। একজনের হাতে ঘড়ি… ঢিলেঢালা টুইডের স্যুট। হাঁটু পর্যন্ত রবার ঢাকা প্যান্ট। অপরজন পরেছে ঝালরওয়ালা জামা আর হাতকাটা আলখেল্লা।

উইসলি ওদের চেনেন। বললেন–সুপ্রভাত বাসিল। বুটটা তুলে নিয়ে আলখেল্লা পরা জাদুকরকে দিলেন। ব্যবহৃত পোর্ট–কীর বিরাট এক বাক্সে বুটটা ফেলে দিল জাদুকর। হ্যারি বাক্সের মধ্যে দেখল, কিছু পুরনো খবরের কাগজ। খালি টিনের কৌটা আর পাংচার হওয়া ফুটবল রয়েছে।

–হ্যালো, আর্থার বাসিল বলল–আজ ছুটি নিয়েছ নাকি? কিছুদিন ছুটি নেওয়া অবশ্য ভাল–আমরা এই ঠাণ্ডায় সারারাত ডিউটি দিচ্ছি। তোমরা তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে গেলেই ভাল। ব্ল্যাক ফরেস্ট থেকে পাঁচটা পনের মিনিটে একটা বড় দল আসবে। দেখি তোমার জন্য কোথায় থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। উইসলি, উইসলি, বাসিল নামের লিস্ট পড়ে যেতে যেতে থেমে গিয়ে বলল, প্রায় আধ মাইল হেঁটে প্রথম সাইট ম্যানেজার মি. রবার্টের সঙ্গে দেখা হবে, ওকে মি. পেইনের নাম বলবে… সে ব্যবস্থা করে দেবে।

–ধন্যবাদ বাসিল, মি. উইসলি বলল। তারপর সব ছেলেমেয়েদের ওর সঙ্গে লাইন ধরে যেতে বললেন।

ওরা সেই নির্জন প্রান্ত দিয়ে হাঁটতে শুরু করল। হালকা কুয়াশা–রাস্তা ঠিক দেখা যাচ্ছে না। দূর থেকে দেখল পাহাড় আর জঙ্গলের কোলে অনেকগুলো টেন্ট ঠিক ভূতের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। সামনে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ সীমানায় মিশেছে। ডিগরিকে ওরা ধন্যবাদ জানিয়ে একটা কটেজের সামনে দাঁড়াল।

একজন দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিল। দৃষ্টি তার আবছা আবছা টেন্টের দিকে। হ্যারি ওকে দেখেই বুঝতে পারলো এই তল্লাটে একমাত্র মাগল। ওদের পায়ের শব্দ শুনে মুখ ফেরাল।

–সুপ্রভাত! উইসলি হাসি হাসি মুখে বললেন।

–সুপ্রভাত! মাগল বলল।

–আপনি… আপনি কী মি. রবার্টস?

–ঠিক বলেছেন, রবার্টস বলল, আপনারা?

–উইসলি নাম দিয়ে দুটো টেন্ট দুদিনের জন্য বুক করা আছে।

–ওহ তাই। রবার্টস বলল।… কটেজের দরজায় ঝোলানো একটা লিস্ট দেখে বলল,–না একরাতের জন্য দেখছি।

উইসলি বললেন–ঠিক আছে।

–আপনি কী অগ্রিম ভাড়া দেবেন? রবার্টস বলল।

–হ্যাঁ, অবশ্যই, উইসলি বললেন। একটু সামনে হেঁটে হ্যারিকে ডাকলেন হ্যারি খুব কম আলোতে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি না, তুমি একটু আমাকে সাহায্য করবে? কথাটা বলে পকেট থেকে একতাড়া মাগল নোট বার করে নোটের বান্ডিল খুলতে আরম্ভ করলেন… ওহ এটা দেখছি… দ… দ… দশ? ও এটা তাহলে পাঁচ?

–কুড়ি… পাঁচ নয়। হ্যারি সংশোধন করেদিল।

-এত ছোট করে ছাপা পড়া যায় না। লক্ষ্য করল, রবার্টস ওদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। আপনারা বিদেশী? রবার্টস জিজ্ঞেস করল।

বিদেশী! না–তো। উইসলি ভ্যাবাচাকা খেয়ে পেমেন্ট করতে করতে বললেন।

রবার্টস বলল–আপনিই প্রথম নন, এর আগেও অনেকের এই টাকা নিয়ে অসুবিধা হয়েছে। দশ মিনিট আগে আমাকে দুজন সোনার কয়েন দিয়েছে।

–সত্যি?

রবার্টস একটা বাক্স থেকে ভাঙতি টাকা খুঁজতে লাগল।

-এর আগে কখনও এত ভিড় হয়নি, হঠাৎ রবার্টস বলল। বলার সময় সামনের মাঠের দিকে তাকাল। শয়ে শয়ে আগে থেকে বুকিং করা লোকেরা আসছে।

–সেটাই তো ভাল। কথাটা বলে ভাঙতির জন্য হাত বাড়ালেন। কিন্তু রবার্টস কোনও ভাঙতি দিল না।

–সারা পৃথিবী থেকে হাজার হাজার বিদেশী আসছে, বিদেশী শুধু নয়, অবলিভিয়েটদের আপনি জানেন? দেখেননি দুজনকে? একজন ঝালর দেওয়া জামা আর অন্যজন রবারে ঢাকা প্যান্ট!

ঠিক সেই সময় একজন জাদুকর পাস–ফোরে রবার্টের পেছনে ভেসে এসে দাঁড়াল।

ও রবার্টের সামনে ওর জাদুদণ্ডটা এগিয়ে দিয়ে বলল, অবলিভিয়েট।

সঙ্গে সঙ্গে রবার্টের দৃষ্টি আউট অফ ফোকাস হয়ে গেল, ভুরু সঙ্কুচিত হল মুখের ওপর এক স্বপ্ন ভাব ছেয়ে গেল।

হ্যারি বুঝতে পারলো–ওইরকম ভাব হচ্ছে ওর স্মৃতি ঠিক করা।

–আপনি যে ক্যাম্পে থাকবেন তার একটা ম্যাপ মি, উইসলি… এই নিন, চেঞ্জ নিন, রবার্টস শান্ত হয়ে বলল।

–অসংখ্য ধন্যবাদ, উইসলি বলল।

প্লাস ফোর জাদুকর ওদের যে ক্যাম্পে থাকার কথা সেখানে গাইড নিয়ে গেল। লোকটির মুখ–চোখ দেখে মনে হয় খুবই ক্লান্ত। মি. রবার্টের শ্রবণশক্তির বাইরে গিয়ে ও উইসলিকে বলল–লোকটার অনেক গোলমাল আছে, তাই দিনে দশবার ওকে মেমরি চার্ম চার্জ করতে হয়… তাহলে ও আনন্দে থাকে। ওদিকে লাডো বেগম্যান ওকে একটুও সাহায্য করে না। পরে তোমার সঙ্গে দেখা হবে আর্থার।

ও অদৃশ্য হয়ে গেল।

জিন্নি একটু আশ্চর্য হয়ে বলল–আমি ভেবেছিলাম বেগম্যান হেড অফ ম্যাজিক্যাল গেমস অ্যান্ড স্পোর্টস? মাগলদের সামনে পর্যটকদের সাথে কেমন করে কথা বলতে হয় জানা উচিত।

 উইসলি হাসতে হাসতে বললেন–অবশ্যই। ওদের আগে আগে নির্দিষ্ট ক্যাম্পের দিকে চললেন।… তবে লাডো মাঝে মাঝে সিকিউরিটিতে গাফিলচতি করে। তবে তোক ভাল। স্পোর্টস ডিপার্টমেন্টে খুব চটপটে লোক সব সময় আসে না। ও ইংল্যান্ডের হয়ে একবার কিডিচ খেলেছিল। ওর মতো ভালো উইসবোর্ন ওয়াসপতে খুব কমই এসেছে বলতে পার।

ওরা যার যার টেন্টের সামনে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলল। উইলসি টেন্টের সাজ দেখে বললেন–প্রত্যেক বছর ওরা এমনিভাবে সাজায়। কোনটা দোতলা, কোনটার সামনে বাগান… নানা রকমের ফেস্টুন। যে যেরকমভাবে পারে আনন্দ ভোগ করে।

হাঁটতে হাঁটতে ওরা বনের শেষ প্রান্তে পৌঁছল এবং মাঠের অগ্রভাগে। মাঠে অনেকটা ভোলা জায়গা। টেন্টের সামনে সাইনবোর্ড রয়েছে উইসলি।

উইসলি জায়গাটা দেখতে দেখতে বললো–সুন্দর জায়গা। এর চেয়ে ভাল অল্প সময়ে পাওয়া মুস্কিল ছিল। খেলার পিচ মাঠের ওধারে। ভালই হল খুব কাছে আছি। আগেই বলেছি, তোমরা এখানে কেউ জাদুবিদ্যা ফলাবে না। আমরা জাদুবিদ্যায় টেন্ট তুলে নিয়ে যাব না। মাগলদের মতো বগলদাবা করে নিয়ে যাব। খুব একটা কষ্ট হবে বলে মনে হয় না। মাগলরা সব সময়ে নিজেরাই করে। কারও সাহায্য–টাহায্য নেয় না।

হ্যারি জীবনে এই প্রথম ক্যাম্প করে থাকছে। ডার্সলেরা কখনও ওকে ছুটির সময় কোথাও নিয়ে যায় না। যখনই গেছে ওকে রেখে গেছে আধাপাগল ফিগের কাছে। হারমিওন ঠিক করল কোথায় টেন্টটা খাটাবে। উইসলি এত উত্তেজিত যে, বারে বারে বাধা দিতে লাগলেন। নানা মত দিতে লাগলেন কাজের মাঝে। শেষ পর্যন্ত দুটো টেন্ট খাটান হল। খুব একটা সুন্দর না হলেও থাকা মোটামুটি চলে। উইসলি হাঁটু গেড়ে টেন্টের দরজা সরিয়ে ভেতরে ঢুকে হো. হো করে হেসে উঠলো। বললেন, ঢুকতে অবশ্য একটু অসুবিধে হচ্ছে, তাহলেও চলবে। এসো তোমরা সকলে, ভেতরটা কেমন দেখা যাক।

উইসলি টেন্টের ভেতর থেকে বললেন–জায়গা কম, আমাদের হাত–পা গুটিয়ে থাকতে হবে। থাকগে ভেতরে এসে দেখ।

হ্যারি নিচু হয়ে টেন্টের ছোট ঝাপটা সরিয়ে ঢুকতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল। কোনও রকমে টলতে টলতে হাঁটতে লাগল। টেন্টের ভেতর তিনটে ঘর (থ্রি–রুমড ফ্ল্যাট মালিক বলেছে) বাথ, কিচেন সবই আছে। একেবারে মিসেস ফিগের ফ্ল্যাটের মতো অগোছালো। চেয়ারের কাভার অমানানশই, ঘরে বেড়ালের গায়ের গন্ধ!

মি, উইসলি হাসবার চেষ্টা করে টাক মাথায় রুমাল ঘষতে ঘষতে বললেন, থাকগে, এটা তো আমাদের স্থায়ী বাসস্থান নয়। ঘরের শোবার জন্য চারটে বাঙ্কারও দেখালেন। বললেন–আমি এগুলো আমাদের অফিসের পরিকিন্সের কাছ থেকে আর্নিয়েছি। খুব একটা নরম বিছানা নয়।

তারপর একটা ধূলো ভর্তি কেতলি নিয়ে বললেন, খোবার জন্য জল দরকার।

মাগলরা যে নক্সা আমাকে দিয়েছে জলের কল কোথায় মার্ক করা আছে। রন বলল–ও হ্যারির পেছনে পেছনে টেন্টে ঢুকেছে। ভেতরের অবস্থা দেখে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেছে। জল তো দেখছি মাঠের ওপাশে পাওয়া যাবে।

মি. উইসলি বললেন, বেশ, তাহলে হ্যারি আর হারমিওন দুজনে গিয়ে জল নিয়ে এস। কথাটা বলে মি. উইসলি ওদের হাতে সেই পুরনো কেতলিটা আর প্যান ধরিয়ে দিলেন। বাকি তোমরা বনে গিয়ে শুকনো ডাল–পালা নিয়ে এস।

রন বলল–ড্যাডি আমাদের তো ওভেন আছে, আমরা তো ওটা ব্যবহার করতে পারি?

–রনের আন্টি মাগল সিকুইরিটি! উইসলি বললেন, অনেক আনন্দ ভোগ করবেন সেই আশায় মুখটা জ্বল জ্বল করছে। তারপর বললেন, মাগলরা খুব একটা ক্যাম্পের ভেতরে থাকে না। ক্যাম্পের সামনে কাঠ জ্বালিয়ে রান্না–বান্না করে। মেয়েদের জন্য নির্দিষ্ট টেন্টে গিয়ে হারমিওন দেখল ওদেরটা সামান্য ছোট। তবে টেন্টের মধ্যে বেড়ালের গায়ের গন্ধ নেই। হ্যারি, রন, হারমিওনকে যেসব কাজ দেওয়া হয়েছে তা করার জন্য কেতলি আর সসপ্যান নিয়ে চলে গেল ধুয়ে জল আনতে।

সূর্যের মুখ দেখার সঙ্গে সঙ্গে আবছা কুয়াশাও সরে গেল। শহরের চতুর্দিকে টেন্ট পোঁতা হয়েছে দেখতে পেল। হ্যারি ওইসব দেখে মনে মনে সারা পৃথিবীতে জাদুকর–জাদুকরীদের সংখ্যা অনুমান করতে লাগল।

তখন ওদের প্রতিবেশীরা বিছানা ছেড়ে উঠতে আরম্ভ করেছে। প্রথমে যেসব পরিবারে ছোট ছোট বাচ্চারা আছে, হ্যারি তাদের বাচ্চাদের আজ পর্যন্ত দেখেনি। দেখল, দুবছরের একটা বাচ্চা পিরামিড আকারের একটা টেন্ট থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরোচ্ছে। ওর হাতে একটা দণ্ড, সেটা দিয়ে টেন্টে সামনের ঘাসগুলো ঘষছে। মাঝে মাঝে নরম মাটিতে পোঁতবার চেষ্টা করছে। দত্রে আঘাতে ঘাসগুলো তখন সালামির (মাংস দিয়ে তৈরি খাবার) মতো হয়ে যাচ্ছে। বাচ্চাটা হ্যারির দিকে আসতেই ওর মা ওকে কোলে তুলে টেন্টে নিয়ে গেল।

কেভিন কতবার বলেছি তুমি বাবার ওই জাদুদণ্ড ধরবে না? এই দুষ্টু ছেলে হাত দেবে না বলছি… ড্যাডির… দণ্ড… ইউচ…।

মহিলাটি বড় আকারের শামুকের উপর হাঁটতেই সেটা ফেটে গেল। ওর বকুনি স্থির বাতাস সুদূরে ভাসিয়ে নিয়ে গেল…. তার সঙ্গে বাচ্চা ছেলেটার তারস্বরে কান্না–তুমি শামূক ফাটিয়ে দিয়েছ! ফাটিয়ে দিয়েছ!

আরেকটু এগিয়ে গিয়ে ওরা দুটি ছোট ছোট জাদুকরী দেখল। কেভিনের সামান্য বড়ই হবে। ওরা খেলার ঝাড়ুর ওপর রয়েছে। ঝাড়ুটা মেয়েটির পায়ের আঙ্গুল থেকে সামান্য ওপরে উঠেছে। শিশির ভেজা ঘাসগুলো আলতোভাবে স্পর্শ করেছে। মিনিষ্ট্রির এক জাদুকর ওদের দেখে হয়ত চিনতে পেরেছে ও হারমিওন, রন, হ্যারিকে ছেড়ে আপন মনে বিড়বিড় করতে করতে এগিয়ে গেল।

ওরা দেখল আশেপাশের টেন্ট থেকে জাদুকর–জাদুকরীরা দলে দলে বেরিয়ে আসছে। বাইরে কাঠ জ্বেলে ব্রেকফাস্ট বানাতে শুরু করে দিয়েছে। কেউ কেউ তাদের জাদুদণ্ড দিয়ে আগুন জ্বালাচ্ছে। অনেকেই বা দ্বিধাগ্রস্ত মুখ করে কাজ করছে। ভাবটা এমন যে, এরকমভাবে চলবে না। তিনজন আফ্রিকান জাদুকর এক জায়গায় তাদের ব্যাপারে আলোচনা করছে। তাদের গায়ে লম্বা সাদা আলখেল্লা খরগোসের মতো কিছু একটা কাঠের আগুনে রোস্ট করছে। আবার কিছু মধ্যবয়সী আমেরিকান জাদুকর তাদের টেন্টের সামনে নিজেদের দেশের পতাকা উড়িয়ে খোশগল্প করছে। পতাকায় বড় বড় করে লেখা–দ্যা সালেম উইচেস ইনস্টিটিউট।… কোন কোন টেন্টের পাশ দিয়ে যেতে যেতে শুনতে পেল আজব সব কথাবার্তা যার এক বিন্দু বিসর্গ জানে না।

রন বলল, আমি সবুজ দেখছি, না সব সবুজ হয়ে গেছে?

রনের একার চোখ নয়, সকলেই দেখল কতগুলো টেন্টের পাশ দিয়ে গেল সেগুলো শ্যাম রক দিয়ে ঢাকা (আয়ারল্যান্ডের জাতীয় প্রতীক রূপে গণ্য ত্রিপত্র) দিয়ে ঢাকা–অনেকটা ছোট পাহাড়ের মতো দেখাচ্ছে।… অনেকটা যেন পৃথিবীর বক্ষ হঠাৎ মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। যারা টেন্টের ছোট ঝাঁপ খুলেছে তাদের কেউ হতাশ বা কেউ গম্ভীরা… তারপর হঠাৎ শুনতে পেল তাদের কে যেন ডাকছে। ডাকছে ওদের গ্রিবন্ডর হাউজের একবন্ধু–চতুর্থবর্ষের ছাত্র ডিন টমাস। এখানকার সাজ–সজ্জা কি পছন্দ হয়েছে? সিমনস দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলল। মন্ত্রণালয় কিন্তু একটুও খুশি নয়।

মিসেস ফিন্নিগন বললেন–বাঃ আমাদের রঙ কেন দেখাব না? বুলগেরিয়ানরা তাদের টেন্টে নানা রঙে সাজিয়েছে–তোমরা আয়ারল্যান্ডকে অবশ্যই সাপোর্ট করবে। হ্যারি, রন আর হারমিওনের দিকে উচ্ছাসের ভঙ্গিতে তাকিয়ে বললেন।

যখন ওরা তিনজন বুঝতে পারলো মিসেস ফিন্নিগনরা আয়ারল্যান্ডের সাপোর্টার তখন ওরা আশ্বস্থ হয়ে অগ্রসর হতে লাগল।

হারমিওন বুঝতে পারলো না বুলগেরিয়ানরা ওদের টেন্টের সামনে দোলনার মতো দিয়ে কি সাজিয়েছে।

হ্যারি গাছ, লতাপাতা ও পতাকায় সাজান টেন্টগুলো দেখে বলল, চলো কাছ থেকে দেখে আসি। প্রত্যেকের বাড়ির সামনে একটা করে বুলগারিয়ান পোস্টার ঝোলান।

রন বলল…. ক্রাম…!! হারমিওন বলল–কি বললে? ক্রাম… ভিক্টর ক্রাম…?

রন বলল… ক্রাম, হ্যাঁ ভিক্টর ক্রাম, বুলগেরিয়ন সীকার!

–দেখলেই মনে হয় দারুণ বদ মেজাজি, হারমিওন বলল।

সত্যি মেজাজি লোক? রন আকাশের দিকে মুখ তুলে বলল–ও দেখতে কেমন সেটা বড় কথা নয়। খুব বেশি হলে ওর বয়স আঠার–উনিশ। দারুণ ট্যালেন্ট, আজ রাত পর্যন্ত অপেক্ষা কর, দেখতে পাবে।

মাঠের শেষ দিকে যেখানে কলের জলের ট্যাপ আছে সেখানে ভিড় জমতে শুরু করেছে। লাইন লেগেছে। রন, হারমিওন দুজনের পেছনে দাঁড়াল। ওদের মধ্যে দারুণ তর্ক চলেছে। ওদের মধ্যে একজন বৃদ্ধ জাদুকর পরণে ফুল ফুল ছাপ দেওয়া লম্বা নাইট গাউন পরা। অন্যজন দেখলেই বোঝা যায় মন্ত্রণালয়ের কর্মচারী। ওর হাতে একটা পিন স্ট্রাইপড ট্রাউজার… অসম্ভব রেগে গিয়ে প্রায় কাঁদছে বলা যায়।

–আর্চি আমার কথা শোন মাগল মেয়েরা ওইরকম পরে… ওটা পর। মাগলরা তোমায় সন্দেহের চোখে দেখছে।

বৃদ্ধ জাদুকর বলল–আমি আমারটা মাগলদের দোকান থেকে কিনেছি। মাগলরা ওই রকম পিন স্ট্রাইপড পরে।

বৃদ্ধ আর্চি বলল–আমি পরবো না; আমি পরিষ্কার, দেখতে ভাল জামা–কাপড় চাই।

ওরা ওদের ছাড়িয়ে আরও ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগল। একটা জায়গায় এসে দেখল অনেক লোক। সেখানে ছাত্র–ছাত্রীদের সংখ্যা বেশি। হ্যারিকে দেখে হোগার্ট স্কুলের প্রাক্তন কিডিচ ক্যাপ্টেন অলিভার উড মহাখুশি। হাত ধরে টানতে টানতে ওর বাবা-মার কাছে নিয়ে গেল। দারুণ খুশিতে বলল–আমি এখন পাভল মেয়র ইউনাইটেড রিজার্ভ টিমে আছি। তারপর ওদের আটকাল এরনি ম্যাকমিলন, হাফলপাফের আবাসিক ছাত্রী। এখন ফোর্থ ইয়ারে পড়ে। যেখানে আরেকটু দূরে গিয়ে দেখা হল চো–চ্যাংগের সঙ্গে। মেয়েটি দেখতে খুবই সুন্দরী ও র‍্যাভন ক্ল ছাত্রাবাসের টিমের হয়ে খেলে। হ্যারিকে দেখে হাত নেড়ে ওকে দেখে খুশি হয়েছে বোঝাল… তারপর ওই দল থেকে একগাদা ছেলে–মেয়ে ওকে ঘিরে ধরল, যাদের ও চেনে না।

হারমিওন বলল–ওরা তোমায় চিনল কেমন করে? ওরা তো হোগার্টে পড়াশুনা করে না।

–ওরা মনে হয় বিদেশী স্কুলের ছাত্র–ছাত্রী, রন বলল। বিলের সঙ্গে অনেক বিদেশী ছাত্র–ছাত্রীদের সঙ্গে আলাপ ছিল, অবশ্য পেনফ্রেড। ওরা প্রায়ই চিঠি লিখত। ব্রাজিলে আসার জন্য বলেছিল। অনেক খরচ, মাম ড্যাড তাই যেতে দিতে চাননি। তাই ওর পেন ফ্রেডরা খুব রেগে গিয়ে চিঠি লেখা বন্ধ করেছিল।… শেষকালে একটা কার্সড হ্যাট পাঠিয়েছিল। ওটা পরার পর ওর কান দুটো শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল।

রনের কথা শুনে হ্যারি হাসল না। অন্য জাদুবিদ্যার স্কুলের কোনও ব্যাপারে মজা পেলেও কোনও মন্তব্য করে না। হ্যারি এর আগে জানত না হোগার্ট ছাড়া সারা পৃথিবীতে আরও অনেক আবাসিক জাদু বিদ্যালয় আছে। হারমিওন ওর কথা শুনে খুব হাসল। জর্জ ওদের টেন্টে ফিরে আসতে দেখে বলল, এতক্ষণ তোমরা কোথায় ছিলে? তারপর ক্লান্ত হয়ে ওরা উইসলির টেন্টে ফিরে এল।

রন ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ে বলল–অনেক লোকজন, ছেলে–মেয়েদের সঙ্গে আলাপ হল। আরে এখনই দেখছি উনুন ধরান হয়নি! ফ্রেড বলল–বাবা দেশলাই নিয়ে মজা করছেন।

মি. উইসলি অনেক চেষ্টা করেও কাঠে আগুন ধরাতে পারেননি। তবে সেটা ভাগ্যের কোনও ব্যাপার নয়। ওরা দেখল উইসলির পাশে একগাদা দেশলাই কাঠি পরে রয়েছে; কিন্তু মুখ দেখে অকৃতকার্যের কথা মনে হয় না। বাহ জ্বলেছে, উইসলি শেষ পর্যন্ত একটা কাঠি জ্বালাতে পেরেছেন। জ্বলন্ত কাঠিটায় আঙ্গুল পুড়ে যাবার ভয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন।

হারমিওন দেশলাইয়ের বাক্সটা হাতে নিয়ে বলল–আসুন মি. উইসলি; দেখুন কেমন করে দেশলাই জ্বালাতে হয়। প্রায় এক ঘণ্টা লেগে গেলে কাঠের আগুন ঠিকমত রান্না করবার মত জ্বলতে। ওদের টেন্টটা যাতায়াতের পথে তাই মিনিস্ট্রির কর্মচারীরা ওকে দেখে খুশি হয়ে অভিনন্দন জানিয়ে চলে যেতে লাগল। উইসলি রেডিওর কমেন্ট্রির মত ছেলে–মেয়েদের তারিফ করে যেতে লাগলেন। হারমিওন ও হ্যারিকে তার অফিস, অফিসের সহকর্মীদের সম্বন্ধে বলতে লাগলেন। ফ্রেড আর জর্জের কথাগুলো শুনে শুনে কান পচে গেছে। তাই ওদের বাদ দিয়েই উইসলি বলে গেলেন।

–ওকে দেখছ? ওর নাম কাৰ্থবাৰ্ট সকরিজ। গবলিন লায়জঁ অফিসের প্রধান… ওই আসছে গিলবার্ট উইসলি, ও এক্সপেরিমেন্টাল চার্মসের কমিটিতে আছে। …হ্যালো, আর্ননি… আয়ারল্ড পিজগুভ ও অ্যাকসিডেন্টাল ম্যাজিক রিভার্সসাল কমিটির অলিভেটর… নিশ্চয়ই কমিটির নাম শুনেছ।… ওই যে বোভে আর কুকার আসছে–ওদের কথা না বলাই ভাল…।

–মানে…?

–ডিপার্টমেন্ট অফ মিস্টিরিজ–দারুণ গোপনীয়–ওদের সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা নেই।

শেষ পর্যন্ত কাঠের আগুনের উনুন ঠিকমত ধরে গেল। ওরা সবাই মিলে ডিম, সসেজ বানাতে লাগল। সেই সময় অরণ্য থেকে বিল, চার্লি আর পার্সি ফিরে এলো–আঃ দারুণ লাঞ্চ বানিয়েছ দেখছি। ওদের খাওয়া প্রায় শেষ হয়ে এসেছে ঠিক সেই সময় একজনকে দেখে খাওয়া ফেলে লাফিয়ে উঠলেন মি. উইসলি আরে! লাডো যে!

হ্যারির চোখে আর কেউ না থোক লাডো বেগম্যান সত্যিই একজন চোখে পড়ার মতো মানুষ। ঝালরওয়ালা রোব পরা বৃদ্ধ আর্চি তো কোন্ ছাড়। উজ্জ্বল, হলুদ আর কালো লম্বালম্বি স্ট্রাইপড দেওয়া মোটা কাপড়ের কিডিচের রোব পরেছেন। বুকের ওপর এক বিরাট বোলতার ছাপ। দেখলেই মনে হয় দারুণ শক্তিশালী এক পুরুষ। সামান্য একটু ঝুঁকে পড়া দেহ। পেটের পরিধি একটু বেশি তাই কিডিচ রোবটা পেটের কাছে টাইট হয়ে আছে। একসময় ইংল্যান্ডের হয়ে কিডিচ খেলেছেন। ওর নাকটা একটু থ্যাবড়া। হ্যারির মনে হল স্ট্রে রাজারে কেউ ওর নাকটা থেতলে দিয়েছে, ছোট ঘোট সোনালী চুল, বড় বড় দুই চোখ, গোলাপ ফুলের মতো লাল গায়ের রং… দেখে মনে হয় স্কুলের এক উঁচু ক্লাসের ছাত্র। আহা… তুমি। বেগম্যান আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল। লাডো এমনভাবে হাঁটছিল যেন পায়ের তলায় স্প্রিং লাগান আছে। যেমন তেমন নয়, তড়াক তড়াক করে। সব সময় যেন লাডো দারুণ খুশিতে উপচে পড়ছে।

–ওভম্যান আর্থার তোমাকে দেখে, সত্যি দারুণ ভাল লাগছে।… আহা কি সুন্দর দিন… কি সুন্দর দিন। খট খট আকাশে এক টুকরো মেঘ নেই। আবহাওয়ার পূর্বাভাস রাত্রিটাও দারুণ সুন্দর থাকবে। এমন সুন্দর দিন, সুন্দর আকাশ রোজ কেন হয় না আর্থার।

লাডোর পেছনের রাস্তা দিয়ে একগাদা যাকে বলা যায় হ্যাগার্ড বেশ ভূষা আর চেহারার জাদুকর ছুটতে ছুটতে একটা আগুনের দিকে চলেছে। অদ্ভুত সেই আগুন… বেগুনি রঙের শিখা প্রায় কুড়ি ফিট ওপরে উঠছে।

পার্সি লাডোকে তেমন পছন্দ করে না। না করার কারণ অফিসের পলিটিক্স।

–আহ, তুমি তো আমার ছেলে পার্সিকে চেন? উইসলি পার্সিকে দেখিয়ে বললেন। এই কিছুদিন হল মিনিস্ট্রিতে কাজে যোগ দিয়েছে।… আর তোমার সামনে দাঁড়িয়ে ফ্রেড, বিল, ওহ্ না জর্জ ফ্রেড বিল, চার্লি, রন… আর আমার একমাত্র মেয়ে জিনি। আর ওধারে দাঁড়িয়ে রনের বন্ধু হারমিওন গ্রেঞ্জার আর হ্যারি পটার।

বেগম্যান হ্যারিকে দেখে বা নাম শুনে একটুও তাপ–উত্তাপ দেখল না শুধু তাকিয়ে রইল বিদ্যুৎ চমকানোর মতো ওর কপালের কাটা দাগের দিকে।

.., শোনো ইনি লাডো বেগম্যান, এককালে ইংল্যান্ডের কিডিচ দলে ছিলেন, আগেই বলেছি। এরই বদন্যতায় কিডিচ ওয়ালৰ্ডকাপের টিকিট পেয়েছি। ধন্যবাদ জানাও।

বেগম্যান মৃদু হাসল, হাত তুলল। মুখের ভাবটা এমন যে টিকিট পাইয়ে দেওয়া ব্যাপারটা তার কাছে কিছুই নয়।

তারপর ওরা আসন্ন খেলা নিয়ে সামান্য আলোচনা করল। উইসলি বললেন আয়ারল্যান্ড জিতলে ছেলেদের আমি গ্যালিয়ন দেব।

–গ্যালিয়ন মাত্র! কথাটা লাডোর মনপুত: হল না।

–আমার স্ত্রী আবার জুয়া খেলা–টেলা মোটেই পছন্দ করেন না। তাহলে আরও গ্যালিয়ন (স্বর্ণ মুদ্রা) বাজি রাখতে পারতাম।

ফ্রেড জর্জ বলল–আমরা, সাঁইত্রিশটা গ্যালিয়নস, পনের সিকিলস (রূপার মুদ্রা), তিনটে নাটস… জমিয়েছি… অবশ্য যদি আয়ারল্যান্ড জেতে তাহলে দেব…।

পার্সি ধমকে উঠল–তোমাদের মি. বেগম্যানকে এসব দেখাতে হবে না। পার্সির ধমক শুনে বেগম্যান জোরে জোরে হেসে উঠল। ফ্রেডের হাত থেকে অকেজো দণ্ডটা নিয়ে ক্লিক করতেই একটা রবারের চিকন দণ্ড থেকে বেরিয়ে এল। বেগম্যান সশব্দে হেসে উঠল।

–দারুণ সুন্দর ফ্রেড। এর জন্য তোমার পাঁচ গ্যালিয়ন পুরস্কার প্রাপ্য।

পার্সি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল ব্যাপারটা ওর একটুও ভাল লাগেনি, কারণ মা ভেলকিবাজী দেখাতে মানা করে দিয়েছিলেন।

–ছেলেরা, মি. উইসলি বললেন, বলতে গেলে রাগ চেপে,–তোমাদের মা কিন্তু আমার আগে তোমাদের বেটিং করতে পই পই করে বারণ করে দিয়েছিলেন তোমাদের মা, মনে আছে? ওই সব কাজ করতে নিষেধ করে দিয়েছেন।

তোমাদের এসব কাজের কথা কী তোমাদের মাকে কাউকে পাঠিয়ে খবর দিতে হবে? পার্সি বেগম্যানের হাতে এক কাপ চা দিল।

একজন জাদুকর সেই সময় অপারেট করে ওদের উনুনের সামনে এসে হাজির হল। বার্টি ক্রাউচ লম্বা, সদাই সোজা হয়ে দাঁড়ান, বয়স্ক জাদুকর। পরনে খুব দামী স্যুট, গলায় টাই। মাথার মধ্যখানে সিথি। গোঁফগুলো টুথ ব্রাশের মতো। ছাঁটা হয়েছে যেন ফ্রাইড রুল দিয়ে। টিপ টপ ড্রেস যেমন, চেহারাও তেমন। পায়ের বুট জুতো দারুণ চকচকে… অনেকটা সময় দিয়ে যেন পালিশ করা। হ্যারির বুঝতে বাকি থাকে না কেন পার্সির কাছে ক্রাউচ একজন আদর্শ পুরুষ। পার্সি অসম্ভব সতকর্তা ও নিষ্ঠার সঙ্গে আইন মেনে চলে। মি. ক্রাউচ মাগলদের ড্রেস অতি নিখুঁতভাবে তৈরি করেছেন। আসলে তিনি এক ব্যাংক ম্যানেজার! হ্যারির মনে কোনও সন্দেহ নেই আঙ্কেল ভার্নন হাজার চেষ্টা করেও নিখুঁত পোশাক–পরিচ্ছদ সম্বন্ধে মি. ক্রাউচের সামনে দাঁড়াতে সাহস করবেন না।

লাডো তার পাশে সবুজ ঘাস দেখিয়ে বললেন-একগুচ্ছ ঘাস তোল দেখি বাটি।

–না, ধন্যবাদ লাডো, ক্রাউচ বললেন। ওর কথার মধ্যে অসহিষ্ণুতার ছাপ আমি তোমাকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না বার্টি। বুলগেরিয়ানরা চাইছে আরও বারটা সিট টপবক্সে।

–ওহ্ তাহলে ওরা এই চায়? বেগম্যান বললেন। আমি ভাবলাম বুঝি ও একজোড় টুইজার চায়। বেশ শক্ত পোক্ত।

–মি. ক্রাউচ আপনি কী এককাপ চা খাবেন? একটু ঝুঁকে পার্সি জিজ্ঞেস করল।

–ও হা। ধন্যবাদ! ক্রাউচ সম্মত হয়ে বললেন।

ফ্রেড আর জর্জ কাপে মুখ দিয়ে রয়েছে। পার্সির অবস্থা দেখে হাসতে পারে এমনই অবস্থা। পার্সির কান লাল… কাউচের জন্য চা বানাতে লাগল।

–ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। আর্থার তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। কাউচ বললেন। তীক্ষ্ণ চোখ উইসলির ওপর।–জানতো আলি বশির কোনও সমঝোতা চাইছে না। ও ফ্লাইং কার্পেট আমদানির ব্যাপারে তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে।

কথাটা শুনে উইসলি গভীর নিঃশ্বাস নিলেন। আমি গত সপ্তাহে পেঁচার সাহায্যে ওকে একটা খবর পাঠিয়েছি। শুধু একবার নয় একশবার বলেছি, রেজিস্ট্রি অফ প্রোসক্রাইবড় চার্মেবল অবজেক্টস অনুসারে কার্পেট মাগল আর্টেফেক্ট (হস্তশিল্প) হিসেবে ধরা হয়েছে বা বলা হয়েছে, কিন্তু দুঃখের বিষয় ও শুনতে রাজি নয়। তাকে কী বোঝানো যাবে?

মি. ক্রাউচ বললেন আমার সন্দেহ হয়; ও এদেশে ওগুলো পাঠাবার জন্য বদ্ধপরিকর।… পার্সির হাত থেকে এক কাপ চা নিলেন।

বেগম্যান বললেন–ওরা কী বদলে ব্রিটেন থেকে ঝাড়ু নেবে?–আলি মনে করে বাজারে পারিবারিক গাড়ি কেনার একটা চাহিদা আছে। ক্রাউচ বললেন আমার মনে আছে আমার গ্রান্ডফাদারের একটা এক্সমিনিস্টার গাড়ি ছিল। তাতে কম করে বারজন বসতে পারত। কিন্তু সেটা অবশ্য কার্পেট নিষিদ্ধ করার আগের ব্যাপার।

ক্রাউচ এমনভাবে বললেন যেন তিনি কাউকে কোনরকম সন্দেহ করতে দিতে চান না যে তার পূর্বপুরুষরা কেউ আইন অনুসরণ করেননি।

–বেগম্যান হেসে হেসে বললেন, তাহলে তোমার কাজকর্ম সুষ্ঠুভাবে চলছে বাটি।

-এই একরকম, ক্রাউচ বললেন–পাঁচটি কন্টিনেন্টে পোর্ট–কী অর্গানাইজ করা সোজা ব্যাপার নয়–লাডো। মি. উইসলি বললেন–ওয়ার্ল্ডকাপ শেষ হলে আপনারা দুজনই আশাকরি খুশি হবেন।

কথাটা শুনে মনে হয় বেগম্যান সামান্য ব্যথিত হলেন। বললেন–হাঁ খুশি তো হবোই! জানি না কখন এই কাজ শেষে মুক্তি পেয়ে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলব… তার মানে এই নয় বার্টি… আমরা আরও সামনের দিকে তাকাব না, নিশ্চয়ই তাকাবো। তাই না?… অনেক কিছু করার আছে।

মি. ক্রাউচ বেগম্যানের দিকে তাকালেন–আমরা একমত হয়েছি যে, আমরা কোন ঘোষণা করব না যতক্ষণ না বিস্তারিত আলোচনা…

–ও বিস্তারিতভাবে! বেগম্যান বললেন, কথাগুলো অনেকটা এক ঝাক পতঙ্গের মতো উড়িয়ে দিলেন–ওরা দস্তখত করেছে তাই না? ওরা সবকিছু মেনে নিয়েছে–মানে নি? আমি মনে করি ছোট বাচ্চারাও জেনে যাবে–আমি বলতে চাইছি হোগার্টে।

ক্রাউচ স্পষ্টভাবে, যাকে বলে চাছাছোলাভাবে বললেন, আমাদের বুলগেলিয়ানদের সঙ্গে দেখা করতে হবে। বেগম্যানের বক্তব্য থামিয়ে বললেন, ধন্যবাদ চায়ের জন্য মি. উইসলি।

চা কাপে তখনও অর্ধেক পড়ে রয়েছে, শেষ হয়নি। সেটা পার্সির দিকে এগিয়ে দিলেন ক্রাউচ। লাড়ো ওঠার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। বেগম্যান চা খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন। পকেটে সোনাগুলো ঝনঝন করে উঠল। অনেকটা খুশিতে।

আবার তোমাদের সঙ্গে টপ বক্সে দেখা হবে; বেকম্যান বললেন–আমি কমেন্টেটর হব! বার্টি ক্রাউচকে হাত নাড়লেন। বার্টি ক্রাউচও মাথা নত করল। তারপর দুজনেই অদৃশ্য হয়ে গেল।

ওরা চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে ফ্রেউ বলল–হোগাটে কি হচ্ছে ড্যাড? কি সব বলছিলেন ক্রাউচ আর বেগম্যান?

মি. উইসলি হেসে বললেন, যথাসময় অনেক কিছুই জানতে পারবে।

পার্সি অফিসিয়াল স্টাইলে বলল–ওগুলো ক্লাশিফাইড নির্দেশ। প্রকাশিত হবে মিনিস্ট্রি ঠিক সময় মনে না করলে। মি. ক্লাউচ সেগুলো না বলে ঠিক কাজ করেছেন।

ফ্রেড বলল–চুপ করত হে মোসাহেব!

ক্যাম্প সাইটে তখন দারুণ অস্থিরতা–উত্তেজনা। আকাশ নির্মল মেঘের দেখা নেই… চতুর্দিকে গরম হাওয়া। খেলা দেখতে আসা দেশী–বিদেশী দর্শকরা অপেক্ষা করছে দিনটির।

মন্ত্রণালয়ের আইন সকলেই ভাঙছে… তাদের ম্যাজিক যত্রতত্র ব্যবহার করে।… বিক্রি হচ্ছে অবাধে সব জিনিসপত্র। উজ্জ্বল গোলাপ–আয়ারল্যান্ডের সবুজ, বুলগেরিয়ার লাল, তার ওপর তাদের খেলোয়াড়দের নাম লেখা… নানাভাবে; নানারকমে যে যার দেশকে উঁচু করে রাখতে চাইছে। দিনরাত শুধু তাদের নৃত্যগীত–আমোদ–প্রমোদ আর খাওয়া–দাওয়া ছোট পরিসরে। আবদ্ধ হয়ে কেউ থাকতে চাইছে না। দেশের জয়ের জন্য পাগল হয়ে গেছে যেন তারা সবাই।

দোকানে বাজারে ঘুরতে ঘুরতে রন হ্যারিকে বলল-এই খেলাতে খরচ করব বলে অনেক জমিয়েছি। হারমিওনকে সঙ্গে নিয়ে ওরা দোকানের পর দোকানে ঘুরতে লাগল। ওদের জামায় আয়ারল্যান্ডের প্রতীক।

একটা হাতে ঠেলাগাড়ি দেখিয়ে হ্যারি বলল–দেখ কত দূরবীন, বিক্রির জন্য নিয়ে চলেছে। প্লাস্টিক বা হালকা লোহার নয় ভারি ভারি বোতলের।

হ্যারি বলল–আমাদের একটা থাকলে ভাল হতো। দূর থেকে ভালভাবে রনের মুভমেন্ট দেখতে পেতাম।

যে জাদুকরী বায়নোকুলার বিক্রি করছিল তাকে রন বলল–তিনটে আমাদের দাও।

হ্যারির হাতে অনেক গ্যালিয়ন। ও দাম দিতে চাইলে রন রেগে গিয়ে বলল খবরদার। দাম আমি দেব। ওরা যখন দিনান্তে ক্লান্ত হয়ে টেন্টে ফিরে আসবে তখন দেখবে ওদের মানিব্যাগ চুপসে গেছে।

ফ্রেড–জর্জ–চার্লি–বিল–জিন্নি সকলেই বুকে আয়ারল্যান্ডের তকমা এঁটে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মি. উইসলি বয়ে বেড়াচ্ছেন একটা আইরিশ ফ্ল্যাগ। ফ্রেড আর জর্জের হাত খালি, কারণ তারা সব স্বর্ণই তাদের দিয়ে দিয়েছে।

অনেক দূরে বড় বড় গাছের ডালে পাতায় ছোট ছোট নানা রঙের বাতি জ্বলে উঠল। মি. উইসলি বললেন–আর দেরি নয় এবারে আমাদের যেতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *