বুড়ি মনোযোগ দিয়ে গান শোনে। সলীম লীমের কথা মনে হয়। ওরাও ঠিক এই বলে। নীতার কণ্ঠ বুড়ির অন্তর ছুঁয়ে সারা গায়ে ভেসে চলে যায়। বাঁশবনে, খালের ধারে, স্টেশনের রাস্তায়, শিমুল গাছের মাথায় একটা ছোট বলের মত লাফিয়ে লাফিয়ে যায়। বাতাসের সঙ্গে তার সব ভাব। বুড়ি অভিভূত হয়। নীতাকে বড় আপন, বড় কাছের মনে হয়। ও এখন কেবল মনের মানুষ খোজা বাউল নীতা নয়। নীতার সুখ দুঃখ কণ্ঠের গান মিলিয়ে নীতা বুড়ির ঘরের লোক। দূরের নক্ষত্র হয়ে কেবল জ্বলে না। নীতার দোতারার টুংটাং ধ্বনি সারা বাড়িময় জেগে রয়। উঠোনে রমিজা বাঁশপাতা দিয়ে ভাত ফোটায়। মুঠো মুঠো শুকনো পাতা চুলের মধ্যে খুঁজে দিচ্ছে। একদফা পুড়ে নিঃশেষ হবার আগেই আরেক মুঠো দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে। আগুন দেখতে দেখতে নীতার দোতারা থেমে যায়। বলে, আজ আমার যাবার তাড়া নেই সই। তোর এখানে ভাত খেয়ে একটু গড়িয়ে নিয়ে বিকেলে যাব। তোর ছেলেরা বাড়িতে নেই তো?
–না, তাছাড়া ওরা কখন ফিরবে তারও ঠিক নেই।
–ওরা থাকলে বড় সংকোচ লাগে।
মিছামিছি লজ্জা পাস। ওরা বড় ভাল ছেলে।
কি বেঁধেছিস সই?
ধুন্দুল দিয়ে শোল মাছ। লাল শাক ভাজি। ডাল। নারকেলের ভর্তা।
বাঃ বেশ। খাওয়াটা ভালই হবে। ডাল আর নারকেলের ভর্তা হলেই আমার চলবে। ভাল খাবার খেতে না পেয়ে জিহ্বায় চড়া পড়ে গেছে সই।
–কি আমার ভাল খাবার। তুই তো বেশি কিছু খাসই না।
নীতা হেসে মাথা নাড়ে।
বুড়ি রমিজাকে ডেকে বলে, ও রমিজা, সই আজ এখানে ভাত খাবে।
–ভালই তো। তারপর নীতার দিকে তাকিয়ে বলে, আম্মার সই এলে আম্মা খুব খুশি হয়। আপনি কিন্তু বেশি বেশি করে আসবেন।
–প্রায়ই তো আসি।
–কই আসেন? একবার গেলে আম্মার কথা তো ভুলেই যান। আবার কতদিন পরে মনে পড়ে।
–পথে পথে ঘুরি। আখড়ায় দিন কাটে। আমাদের কি পথের ঠিক আছে।
রমিজা হেসে মাথা নাড়ে। চুলো থেকে ভাত নামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বুড়ি ডালায় করে মুড়ি এনে নীতার সামনে দেয়। ঘটিতে করে জলও। রইস বারান্দার একপাশে বসে আছে। মুখ দিয়ে লালা গড়াচ্ছে। বাম হাত দিয়ে বারবার মাছি তাড়ায়। বুড়ি নাতিকে ঘুম পাড়ায়।
নীতা রইসকে মুড়ি দেয়। ও খাবার জন্যে আগ্রহ দেখায় না। ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। নীতা হেসে ফেলে।
–আমাকে তোর ছেলের পছন্দ নয় সই। দেখতেই পারে না।
–ওর কথা আর বলিস না। আমার কত সাধ, কত আকাঙ্ক্ষা ছিলরে সই।
–ঐ দেখ কি কথায় কি কথা। যা তোর নাতিকে শুইয়ে দিয়ে আয়। ও ঘুমিয়ে গেছে।
বুড়ির ওঠে না। নাতিকে কোলে দোলায়।
নীতা আনমনে মুড়ি চিবোয়। রমিজার রান্না শেষ হয়েছে। গনগনে চুলো লাল হয়ে আছে। তাপ ছড়াচ্ছে। রমিজা গামছা নিয়ে পুকুরঘাটে যায়। নীতা ওর চলার দিকে তাকিয়ে বলে, তোর বৌমার স্বাস্থ্য ভাল হয়েছে রে?
বুড়ি বোকার মত বলে, হ্যাঁ ও খুব ভাল মেয়ে।
নীতা পায়ের নখ দিয়ে মাটি আঁচড়ায়। মুড়ির দিকে মনোযোগ নেই। খেতেও ভাল লাগে না। শুকনো মুড়ি গলায় আটকে যায়। আনমনে দূরের জামরুল গাছের দিকে তাকিয়ে থাকে। উঠোনের ওপর দিয়ে একটা তিতির ডাকতে ডাকতে উড়ে যায়। বুড়ি অস্বস্তি বোধ করে। কোলের মধ্যে নাতি ঘুমিয়ে গেছে। ওকে ঘরে শুইয়ে দিয়ে আসতেও ইচ্ছে করে না। কি হল নীতার? ওর মনে দোতারার তার কি ছিঁড়ে গেল? এমন বেসুরো হয়ে গেল কেন? কি যেন ভাবছে নীতা। কখনো নীতা এমনি করে বুড়ির কাছ থেকে সরে যায়। কখনো কাছে আসে আপন হয়ে। তখন বুড়ির মনে হয় নীতা আজ একলা এসেছে। সঙ্গে কেউ নেই।
–তোর মনের মানুষ কৈ সই?
–মনের মানুষ?
–ওমা ভুলে গেলি নাকি? তোর চরণদাস?
–চরণদাস আখড়ায়।
–এলো না তোর সঙ্গে?
–এখন আমি ওর কেউ না। ও আবার মনের মানুষ জুটিয়েছে। ওর কথা বলিস সই। আস্ত ছোটলোক। এমন হারামী লোক আমি দেখিনি।
–তাহলে তুই এখন কি করছিস?
–আমার জন্যে এখন আছে অখিল বাউল। খুব ভাল মানুষ। সারাদিন বসে বসে গান লেখে। ঐ যে গাইলাম ওটা তো ওর লেখা গান। আমাকে বলে কি জানিস সই? বলে আমি ঘরে বসে বসে গান লিখবো তুই রাস্তায় রাস্তায় গেয়ে বেড়াবি। তবে তো দেশের মানুষ দেশের কথা জানবে। আমরা যদি গানে গানে না জানাই তবে গাঁয়ের লোকগুলো জানবে কোথা থেকে? ওর কথা শুনলে পরাণ জুড়িয়ে যায় সই। কতো ভাল ভাল কথা বলে অখিল বাউল। আখড়ায় কত লোক আসে। রোজ আমি ওর গান গাই। লোকে চুপ করে শোনে। জানিস কারো কারো চোখে জল এসে যায়।
অখিল বাউলের কথায় উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে নীতা। আবেগে চোখ বুজে আসে। ও গুনগুন করে। নীতার শুকনো মুখে দেশের রেখা খুঁজে ফেরে। ও এখন অন্য জগতের বাসিন্দা।
আগে যখন গান গাইতাম তখন মনে হতো নিজের জন্য গাই। এখন মনে হয় সবার জন্য গাই। গাইতাম ভক্তির গান, প্রেমের গান। এখন গাই দেশের গান।
নীতার মুখে প্রশান্তির ছাপ। বুক ভরে শ্বাস টানে। বুড়ির দম আটকে আসতে চায়। অবাক হয়। নীতা এত কথা শিখল কোথা থেকে? ও তো এত কথা জানত না? আগে কখনো বলেনি। ওর মনের মানুষ নিয়ে ব্যস্ত থাকত। ভিখ করত, গান গাইত। সঙ্গী ছাড়া পথ চলতে পারতো না।
–তুই এতো কথা শিখলি কোথা থেকে সই?
–সবই অখিল বাউল। একদিন আখড়ায় আমার গান শুনে ঘরে নিয়ে গেল। রাতভর আমার গান শুনল। অখিল বাউলের মত এমন করে কেউ আমার গান শুনতে চায়নি। আমি মন-প্রাণ ঢেলে গাইলাম। মনে হল এমন করে কোনদিন কার জন্যে গাইনি। আমি এক অন্য মানুষ হয়ে গিয়েছিলাম সই। চরণদাস আমাকে ছেড়ে যাবার পর থেকে কেবল চিৎকার করে গান গাইতে ইচ্ছে করত। আমি ওকে ভুলতে চাইছিলাম। নিজের দুঃখ ছাড়াতে চাইছিলাম। অখিল বাউলের মিষ্টি কথায় সেদিন আমার গলা গানের নদী হয়ে গিয়েছিল। গান শেষে অখিল আমাকে বুকে টেনে নিল। তখন অনেক রাত। চারদিকে নিঝুম অন্ধকার। ঝি ঝি-র ডাকও বন্ধ ছিল। শেষ রাতটুকু দুজনে চুপচাপ শুয়েছিলাম। কেউ একটি কথাও বলিনি। অখিল বাউলের চওড়া বুকে অনেক তাপ সই। আমার মনে হয়েছিল জনম বুঝি এবার সার্থক হলো।
বুড়ি সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ করে নীতার কথা শোনে। নীতা যেন রূপকথার গল্প বলছে। সেই সাত সমুদ্র তের নদীর পারের গল্প। বুড়ির জীবনের ছায়া সেই সমুদ্রের পাড়ে আর পড়ে না। সেজন্যেই গল্পের জন্যে বুড়ির এখন এত ঔৎসুক্য। শুনতে পেলে আর ছাড়ে না।
জানিস সকালে উঠে অখিল আমাকে বললো, তুই এখন আমার নীতা। এই ঘর তোর আর আমার। নিজের বুকে হাত দিয়ে দেখালো। বললো, এই বুক তোর ঘুমুবার। জন্যে। আর তোর ঐ মিষ্টি গানের গলা তোর একলার নয়। ঐ গলা সবার। এবার থেকে আমি গান বাঁধবো। তুই গাইবি। মাস তিনেক অনেক গান গাইলাম। বিরহের গান, দেহের খান, বাউল গান, মরমি গান কতো কি? তারপর জানিস সই সেই ফাগুন মাসে রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার পর ও বলল, এসব গান আর ভাল লাগে না নীতা। এবার থেকে অন্য গান বাঁধবো। আমি বললাম কি? বলল, দেশের গান। দেশের মানুষ এখন অন্যরকম হয়ে গেছে রে। দেশের গান দিয়েই ওদের এখন জাগিয়ে রাখতে হবে। এই গান দিয়েই আমরা আজ দেশের কাজ করবো। সেই থেকে আমি এই গান গাই। আর অন্য কিছু ভাল লাগে না। কত জায়গায় ঘুরে ঘুরে গান গাইলাম। লোকে আমাদের ঘিরে ধরে রে। শরীরে খুব যোশ পাই। জানিস পরশুদিন যখন গান গাইতে শুরু করলাম লোকে আমাদের সঙ্গে গাইতে শুরু করলো। ওরা বলল, আমরাও তোমার সঙ্গে গাইবো। আমি এক লাইন গাই তারপর ওরা গায়। সে কি উত্তেজনা! সকলে দেশের গানে পাগল হয়ে উঠল। মনে হল আকাশ-বাতাস যেন গানে গানে ভরে গেল। কালকে তোর কথা মনে হল। তাই আজ চলে এলাম দেখতে।
–সেই মানুষটাকে আনলি না কেন?
–ও বেশি বেরুতে পারে না। মাঝে মাঝে পায়ে একটা ব্যথা হয়।
–আবার এলে আনবি।
–হ্যাঁ তোর এখানে একবার না আনলে নিজেই শান্তি পাব না যে। নীতা দুহাত দিয়ে চুলের খোপা বাধে।
–বেলা অনেক গড়িয়ে গেল এবার উঠি সই?
বুড়ি নাতিকে দোলনায় শুইয়ে দেয়। রমিজা গোসল সেরে ফিরে এসেছে। ভিজে কাপড় সপ্ স করে। ওর ভিজে শরীরের দিকে তাকিয়ে নীতার দেহ শীতল হয়ে যায়।
–চল সই ডুব দিয়ে আসি। বুড়ির কথায় সাড়া দেয় নীতা।
–চল। যা গরম। সব যেন পুড়ছে।
দুজনে পুকুরের ঘাটে এসে দাঁড়ায়। পুকুরের শ্যাওলা সবুজ জলে অনেকক্ষণ ধরে নিজের ছায়া দেখে নীতা। চারদিকে ঘন ঝোপঝাপ। তারই ছায়ায় ঠাণ্ডা শীতল জল।
এই গরমেও গায়ে হিম ধরে। পুবদিকের একটা গাছে বসে কুটুম পাখি ডাকে।
–বুড়ি বলে, আজকাল কেবলই কুটুম পাখি ডাকে।
–কুটুম আসবে।
–তেমন কুটুম আর কৈ? আর আসবেই বা কে? আছেই বা কে? বুড়ি যেন নিজেকেই বলে। নীতা সরসরিয়ে পানির বুকে নেমে যায়। এক ডুবে চলে যায় পুকুরের মাঝখানে। বুড়ি ঘাটের কাছাকাছি থেকে ডুব দেয়। ও কখনো গভীর জলে যেতে পারে না। কেমন ভয় লাগে। শরীর শিরশিরিয়ে ওঠে। দুই তিন ডুব দিয়ে বুক পানিতে দাঁড়িয়ে থাকে বুড়ি। এক দুই তিন। কুটুম পাখি ডাকে একটানা। বুড়ির মনের,ব্য কুটুম পাখির আনাগোনা। কুটুমের আগমনের উল্লাস নেই, কেমন একটা থিতানো ভাব। এই কুটুমের জন্যে পিঠে পুলির উৎসব নেই। বরং জল ঢেলে চুলো নিবিয়ে লুকিয়ে থাকা। বুড়ি বিষন্ন হয়ে যায়। জলের বুকে নিজের শরীর। মাথার ভেতর কুটুম পাখির। আনাগোনা। চেতনায় সুপপারি বাগানের আলো-আঁধারি। বুড়ির মন ছটফট করে। দুপুরের সূর্য ঠিক মাথার ওপর। গরম রোদ পুকুরের গায়ে তেমন উত্তাপ দেয় না। ছায়া। ছায়া বিস্তার। পাড় ঘেঁষে ডাহুকের ঠোঁটের মত কাল জল। ফিসফিসানি শব্দের মত পাতা ঝরে। হলুদ পাতা জলে ভাসে। গাছের নিচে বিছিয়ে যায়। বুড়ি জল ছেড়ে ঘাটে উঠে যায়। ভেজা গামছা দিয়ে চুল ঝাড়ে। নীতা চিৎ-সঁতারে পুকুরের জলে ভাসে। ওর মনে অখিল বাউলের ছবি। অখিল বাউলের গন্ধভরা উত্তাপ। কণ্ঠে অখিল বাউলের গান। বুড়ির মন এখন মুছে যাওয়া শ্লেটের মত। ধার কমে গেছে। তেমন গভীর দাগের আঁচড় পড়ে না। বুড়ি ভাবে, নীতা সব পারে। এজন্যে জীবন ওর কাছে বোঝা নয়। জীবনের দায় ওকে কাঁধে বোঝা মুটের মত বাঁকা করে রাখে না। কিন্তু বুড়ি কাত হয়ে গেছে। ওর আর সোজা হয়ে দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই। জীবনকে যত আঁকড়ে ধরেছে তত বঞ্চিত হয়েছে। ও যদি পারত সব বন্ধন পিছে ফেলে রেখে কেবলই এগিয়ে যেতে, যদি পারত পথে পথে গান গাইতে, মন চাইলে নির্ভাবনায় ঘুমিয়ে পড়তে, শ্রান্তিতে কারো বুকে আশ্রয় নিতে। ধুত বুড়ি কিছুই পারবে না। ওর তেমন শক্তি নেই। সবকিছু এক জায়গায় এসে আটকে থাকে। বুড়ি মানসিক দিক দিয়ে যতই এগিয়ে যাক না কেন পারিপার্শ্বিক সীমাবদ্ধতা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখে। বেরুনোর কোন পথ নেই। তালগাছের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি করা ঘাটের ওপর দাঁড়িয়ে নীতার ভাসমান শরীরের দিকে তাকিয়ে থাকে। ও নিশ্চিত নির্ভাবনায় হাল ছেড়ে দিয়ে ভাসছে। উঠে আসার কোন লক্ষণ নেই।
বুড়ি ঘাটের ওপর দাঁড়িয়ে কাপড় ছাড়ে। শুকনো কাপড় গায়ে জড়ায়। শরীরের এখানে সেখানে জলের ফোঁটা লেগে থাকে। নীতা পুকুরের মাঝখান থেকে চিৎকার করে।
–কিরে তোর হয়ে গেল?
–হ্যাঁ। উঠে আয় সই। খিদে পেয়েছে।
–বড় ঠাণ্ডা জল। আর একটু থাকি?
বুড়ি নিরুপায়ের মত দাঁড়িয়ে থাকে। নীতার কথার পিঠে কোন কথা বলতে পারে না। নীতার ইচ্ছেশক্তি আছে। ও যখন যা খুশি তা করতে পারে। বুড়ির চারপাশে তো নিয়ম। তাই নীতার জন্যে ঘাটের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া উপায় কি? খানিকক্ষণ। বিরতির পর আবার কুটুম পাখি ডাকে। বুড়ি অস্থির হয়ে ওঠে। হাঁ করে আকাশ দেখে। এখন কত বেলা? বুড়ি সরে এসে নারকেল গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়। মনের বিষন্নতা কাটে না। ছায়া ছায়া ঝোপঝাড়, শ্যাওলা জল, হাঁসের ঝাক, মাছরাঙা সবকিছু দৃশ্য ওর চোখের সামনে ওলোটপালোট খায়। মাথা পরিষ্কার হয়ে যায়। ওখানে আর। কুটুম পাখি আসে না। বুড়ি অনায়াসে পাখির ডাক ঝেড়ে ফেলে। নীতা ঘাটের দিকে এগিয়ে আসছে।
–উঃ অনেকদিন পর শরীরটা একদম জুড়িয়ে গেল। তোর এখানে এলেই মন আমার ঘরের দিকে ছোটে সই।
বুড়ি কথা বলে না। নীতা গামছা দিয়ে চুল ঝাড়ে।
–রাগ করছিস নাকি? খুব ক্ষিদে পেয়েছে? মনের মত কিছু হলে আমার আবার খিদেটিদে উবে যায়।
–হয়েছে চল।
বুড়ি আগে আগে হাঁটে। পেছনে নীতা।
রমিজা ভাত বেড়ে গুছিয়ে রেখেছে। সব কাজ ও খুব পরিপাটির সঙ্গে করে। সলীম কলীম কেউ ফেরেনি। কখন ফিরবে ঠিক নেই। ওদের ভাত শিকায় উঠিয়ে রাখে। খেতে বসে খুশি হয়ে যায় নীতা।
–বাহ্ বউ তো খুব ভাল রাধে। আমরা হাটঘাটের মানুষ। যত্নের খাবার পেলে ধন্য হয়ে যাই।
–তুই ঘর বাঁধিস না কেন সই?
–ধুত ওসব সয় না।
এক ঢোক জল খায় নীতা। ভর্তা দিয়ে ভাত মাখিয়ে একটু একটু করে খায়। বুড়ির আগে খাওয়া হয়ে যায়। হাত ধুয়ে উঠে পড়ে। নীতার দিকে তাকিয়ে ওর মনে হয় তড়িঘড়ি করে আয়েশটা শেষ করে দিতে চায় না ও। আয়েশ উপভোগ করতে চায়। বুড়ির সব কাজে হুটোপুটি। ঝটপট শেষ করে ফেলে। হরিণের মত বুড়ি আগে আগে দৌড়ায়। আর নীতা কচ্ছপ। ধীরে ধীরে ছন্দতাল সব বজায় রাখে। তাই নীতার জীবনে ছন্দপতন হয় না। ও অনায়াসে তাল ঠিক রাখে। আর বুড়ির তাল কেটে যায়।
খাওয়া-দাওয়ার পর বুড়ি চিকন সুপপারি কাটতে বসে। বিকেলের দিকে পান চিবুতে চিবুতে চলে যায় নীতা। পিঠে কাপড়ের পুঁটলি, হাতে দোতারা, কণ্ঠে গান:
জননী জন্মভূমি
আমার সোনার বাংলাদেশ……….
নীতা বোধহয় পথ খুঁজে পেয়েছে। নীতার সেই অস্থিরতা নেই। মনের মানুষের অভাব ওকে বিষন্ন করে রাখে না। এখন একলাই পথ চলতে পারে। কারো অপেক্ষায় বসে থেকে পথচলা থামিয়ে রাখে না। ও নিজের ভেতর একটা আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে। ওর আর অন্য কিছুর দরকার নেই। আসলে এমনি হয়। ভেতরের চাওয়া ফুরিয়ে গেলে বাইরের কোন কিছুর জন্যে আর ছুটতে হয় না। তখন নিজের ওপরে চমৎকার ভালবাসা গজায়। সমাহিত হয়ে যায় মন। বারান্দায় এক কোণে মাদুর পেতে রমিজা ছেলে বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে আছে। ওর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকালে মনে হয় না যে পৃথিবীর জন্যে কোন চিন্তা ওর মনে আছে। এ জন্যেই ও শান্তিতে ঘুমোতে পারে। যত জ্বালা বুড়ির। এমন একটা মন না থাকলেই বোধ হয় ভাল হত। কখনো অকারণ যন্ত্রণায় বুক ফেটে কান্না আসে। পরক্ষণে বুড়ি নিজেকে শাসায়। খারাপ কিছু না ভাবাই ভাল। আসলে রমিজার ঘুমের অন্য কারণ আছে। সারাদিন ভীষণ খাটুনি করে বেচারী। সংসারের সব কাজ একলা সামলায়। খুব অসুবিধা না হলে বুড়িকে ধরতে দেয় না। বুড়ির মায়া হয় ওর জন্যে। দুপুরে ঘুমোতে পারে না বুড়ি। সলীম লীমের ভাত আগলে বসে থাকতে হয়। এই একটা কাজ রমিজা ওকে দিয়েছে। রাতের বেলাও তাই। ওদের ফিরতে যত রাতই হোক বুড়ি ওদের ভাত নিয়ে বসে থাকে। আজও বারান্দার ওপর গালে হাত দিয়ে বসে আছে। বাড়িটা চুপচাপ। নিস্তব্ধ। বুড়ি নিঃসঙ্গ। মাঝে মাঝে বুক মোচড় দিয়ে ওঠে। নীতার দোতারার টুংটাং শব্দের মত।
দুপুরে কিংবা বিকেলে মাঝে মাঝে জলিল আসে। খুব দ্রুত বুড়িয়ে গেল ও। বুড়ির। কাছ থেকে পান চেয়ে নিয়ে খায়। এখন আর কেউ নেই ওর। মা-ও মারা গেছে অনেকদিন আগে। কোনদিন রাধে, কোনদিন রাধে না। কখনো রমিজার কাছে এসে বলে, হাঁড়িতে কিছু আছে নাকি রমিজা?
রমিজার হাঁড়িতে পান্তা সব সময় থাকে। জলিলকে কখনো ফিরিয়ে দিতে হয়নি। বুড়ি কাছে বসে জলিলের খাওয়া দেখে। জলিল কখনো মুখ তুলে বলে, নেংটি পরা মানুষগুলোর পেটে ভাত না থাকলে কি হবে কলজায় সাহস আছে বুড়ি। সেই দিনকার ঢাকা শহর তো তুমি দেখনি। অফিস-আদালত, কল-কারখানা, স্কুল-কলেজ সব বন্ধ। মিছিল আর মিছিল। এখনো আমার চোখের সামনে ভাসে। তারপর–তারপর রাতের অন্ধকারে …..। নাহ্ মাথাটা কেমন করে। গুলি–আগুন।
–এসব কথা থাক। তুমি খাও জলিল ভাই।
–আমাদের হাতে কিছু ছিল না বুড়ি।
–ছিল না এখন জোগাড় কর।
–সেটাই তো করছি। প্রতিশোধ না নিয়ে ছাড়ব না।
জলিলের খাওয়া শেষ হয়। বুড়ি পান এগিয়ে দেয়। পান নিয়ে চলে যায় ও। বুড়ি যতিতে চিকন সুপারি কাটে। কুটুস কুটুস শব্দে বুড়ির মনে হয় সোনার কাঠি, রূপার। কাঠি। জলিলের কথাগুলো রূপকথার মত। বন্যা, খরা, আকাল ছাড়া আর কোন দানব তো বুড়ির চোখে পড়েনি। অথচ জলিলের কথায় সেই দানবের একটা ছবি ফুটে ওঠে। ওর সুপপারি কাটা থেমে যায়।
জ্যৈষ্ঠের মাঝামাঝি। বুড়ির সিদুরিয়া গাছের আমে পাক ধরেছে। ওর মনে খুশি। নাতিটাও বেশ ডাঙর হচ্ছে। কি যে আনন্দ ওকে নিয়ে। এখন ওকে বুকে করে এখানে ওখানে যায়। পরিবর্তনটা সহজেই টের পায়। কি যেন হয়েছে ওদের। এবার অন্যরকম। বুকের ছাতি ফুলিয়ে জয় বাংলা বলে চিৎকার করে না। সলীম লীমের মুখ শুকনো। ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া করে না। কথা বললে রেগে যায়।
আবার মনে ভাবনা এসে জড়ো হয় বুড়ির, হলদী গার লোকের চোখে মুখে কেন সন্ত্রাস? কাচারীঘরের পাশে দাঁড়িয়ে একদিন সলীম আর জলিলের কথা শোনে।
–গাঁয়ে ঢোকার মুখের পুলটা যদি ভেঙে দেই জলিল চাচা তাহলে ওরা আর ঢুকতে পারবে না?
–না রে ঠিক হবে না। ছোট একটু নদী। ওরা নৌকা জোগাড় করে পার হবে। কিছুতেই ওদের আটকে রাখা যাবে না।
–হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন। ভেঙে দিলে বরং গাঁয়ের লোকের অসুবিধা হবে।
দুজনে চুপ করে থাকে। বুড়ি সরে আসে। খালের ধারে দাঁড়িয়ে দেখে। স্টেশনে যাবার রাস্তার পাশেও দাঁড়ায়। লোকগুলো ফিসফিসিয়ে কি যেন বলাবলি করে। সবার চোখে আতঙ্ক। বুড়ি বুঝতে পারে না ব্যাপারটা। কি হল আবার? ওরা কি এত ভাবে? ঘুরেফিরে রমিজার কাছে এসে বসে।
–জানিস রমিজা ওদের যেন আবার কি হয়েছে?
রমিজা ডালের পাতিল নামিয়ে রেখে অবাক হয়ে তাকায়।
–কাদের?
–ঐ যে হলদী গার লোকগুলোর।
–ধুত আম্মার যে কি বাতিক! কেবল সারাদিন রোদে ঘোরাঘুরি করলে মাথা গরম হবে না।
ও খলুইয়ে রাখা মাছগুলো টেনে নিয়ে মাছ কাটায় মনোযোগ দেয়। বুড়ি আর কথা খুঁজে পায় না। রমিজা অবলীলায় কচ্ করে মাছ কাটে। রক্তের ধারা গড়ায় বঁটির গায়ে, রমিজার হাতে, মাটির ওপরে। তাজা ফটফটে মাছগুলো সলীম পুকুর থেকে ধরে দিয়ে গেছে। এক খ্যাপে অনেক উঠেছে। জালে বেঁধে মাছ উঠোননাও দেখেছে বুড়ি। আজ ভেতরের পুকুর থেকে মাছ ধরেছে ও। সলীম কখনো এক খ্যাপের বেশি দুই খ্যাপ দেয় না। নিজের হাতে মাছ মারাটা সলীমের বিশেষ শখ। পারতপক্ষে অন্য কাউকে দিয়ে মাছ ধরায় না ও। বিশেষ করে বাড়ির পুকুরের মাছ। জাল ঝেড়ে দেবার সঙ্গে সঙ্গে মাছগুলো বুড়িই টুকরিতে উঠিয়েছে। এনে ডালা দিয়ে ঢেকে রেখেছে। কাটতে বসেনি। রমিজা অন্য কাউকে কাটতে দেয় না। এ নিয়ে বুড়ি মাঝে মাঝে ঠাট্টা করে।
–আরেক জন্মে তুই ঠিক মেছুনী ছিলি রমিজা। নইলে মাছের সঙ্গে তোর এত ভাব কেন?
রমিজা হাসে। সেই চিরাচরিত খুখু হাসি। ওর মাছ কাটা শেষ হলে ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে।
–আপনি যে সারাদিন কি এত ভাবেন আম্মা?
–বুড়ি ওর কথায় উত্তর না দিয়ে বলে, কুটুম পাখি ডাকে রমিজা।
–ডাকুক। কে আর আসবে। আমার বাপ তো গত মাসেই এসে গেল। এই মাসে আর আসবে না।
রমিজা মাছ ধুতে পুকুরঘাটে চলে যায়। কখনো বুড়ির এ ধরনের উদ্ভট ভাবনা চিন্ত Tয় ও রেগে যায়। শাশুড়ী বলে বেশি কিছু বলতে পারে না। রমিজার পিছু পিছু বুড়িও পুকুরঘাটে এসে বসে। জায়গাটা ভীষণ ছায়াচ্ছন্ন। জলের বুকে শ্যাওলা ভাসে। বেতবনে ডাহুক ডাকে। বিরাট একটা বরই গাছ পুকুরের ওপর ঝুঁকে পড়ে আছে। পচা পাতার গন্ধ আসছে, গন্ধ আসছে কাদামাটির। রমিজা ঘাটের জল ঘোলা করে মাছ ধুয়ে চলে যায়। মাছের আঁশটে গন্ধ বুড়ির কেমন বিদঘুটে লাগে। নারকেলের চিকন পাতার ফাঁক দিয়ে এক টুকরো রোদ এসে পড়েছে পানির ওপর। সব কিছু একাকার হয়ে মুছে গিয়ে বটির গায়ে রক্তের ক্ষীণধারা বুড়ির চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তাজা ফটফটে মাছগুলোর লাফানি বন্ধ হয়ে যায় এক পোঁচে। বুড়ির মনে হয় কুটুম আসবে। অর্থাৎ এই যে এ কুটুম সে কুটুম নয়। বন্যা, মহামারী, খরা যেমন ও ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে টের। পায় এ কুটুমের আগমন তেমনি। মাঠ ঘাট প্রান্তর তোলপাড় করে দিয়ে ওর আঙ্গিনায় কুটুম আসছে।
রাতে ঘুম আসে না বুড়ির। সন্ধ্যারাত থেকে সলীম কলীম জল্পনা-কল্পনা করছে। ভোররাতে সলীম সীমান্ত পার হওয়ার জন্যে চলে যাবে। কলীম থাকবে ওদের দেখাশোনার জন্যে। রমিজা কান্নাকাটি করে এখন শান্ত হয়ে শুয়ে আছে। বুড়ি ওদের কথা কিছুই বুঝতে পারে না। বিকেলে জলিল বলছিল গ্রামে থাকা নাকি নিরাপদ নয়। তাড়াহুড়োয় বেশি কথা বলতে পারেনি। সলীমের সঙ্গে জলিলও যাচ্ছে। জলিলের সঙ্গে। দুদণ্ড কথা বলার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু হয়নি। ওরা ভীষণ ব্যস্ত। কথা বলারও সময় নেই। গাঁয়ে কি হলো আবার? বুড়ির জীবনে এমন ঘটনা ঘটেনি। গ্রাম থেকে কাউকে পালিয়ে যেতে হয়নি। যত কিছুই ঘটুক সকলে গ্রামে থেকেছে। সুখে-দুঃখে বিপদে-আপদে বুকে বুক মিলিয়ে। কিন্তু এখন কি হল? কারা ওদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে? হলদী গাঁ কি দখল করে নিল কেউ? এর আগে হলদী গা কোনদিন এমন করে নিজেকে জানান দেয়নি। বুড়ির ছেলেবেলায় মাঝে মাঝে শহর থেকে লোক আসত বসন্তের টিকা দেবার জন্যে তখন বুড়ি দেখতো বাড়ির মেয়েরা ভয়ে যে যেদিকে পারত লুকিয়ে যেত। কিন্তু তখন তো গোটা গাঁয়ের লোকের চোখেমুখে এমন ভয়-ভীতি দেখেনি। বরং লুকোনোর জন্যে বাবার কাছে গালি শুনত ওর মা, চাচি, বোনেরা। এখন কি হল? বুড়ির কিছুই ভাল লাগে না। বিছানা থেকে উঠে দাওয়ায় এসে বসে। ওপাশ থেকে সলীম ডাক দেয়।
–কি হয়েছে মা?
–কিছু না রে।
–বাইরে গিয়ে বসলে কেন?
–বুকটা কেমন ধড়ফড় করে।
সলীম উঠে এসে ওর পাশে বসে। কলীম আসে। রমিজাও। বুড়ি টের পায় আসলে ওরা কেউই ঘুমোয়নি। সবাই চুপচাপ শুয়েছিল কেবল। অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বা আকাশ পাতাল ভাবছে। হঠাৎ বুড়ি শব্দ করে কেঁদে ওঠে। নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারে না। এ কদিনের গুমোট পরিবেশে ভেতরে ভেতরে একটা রুদ্ধ
অভিমান জমে উঠেছিল। আজকের কান্না তার বহিঃপ্রকাশ।
–আঃ মা চুপ কর। কেউ শুনতে পাবে।
–তুই যাবি কেন বাবা?
–খবর পেয়েছি গ্রামে মিলিটারি আসবে।
–মিলিটারি? বুড়ির চোখ বিস্ফারিত হয়।
বুঝতেই পারছ আমাকে পেলে ওরা জ্যান্ত রাখবে না। বসে বসে মরার চাইতে ওদের সঙ্গে একবার লড়েই দেখি। শোন মা, আমি যে যাচ্ছি একথা কাউকে বলবে না। জানাজানি হলে তোমাদের ওপর বিপদ আসবে। কেউ জিজ্ঞাসা করলে সোজা বলে। দেবে জানি না।
বুড়ি মাথা নাড়ে। কলীম চুপ করে বসে আছে। ও এমনিতেই কম কথা বলে। অন্ধকারে ওদের শ্বাস-প্রশ্বাস ওঠানামা করে। সলীম একটা বিড়ি ধরায়। রমিজার ছেলে কেঁদে উঠলে ও চলে যায়। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ওদের তিনজনের সামনে হাঙরের মুখের মত হাঁ করে আছে। কারো মনে কোন স্পষ্ট ধারণা নেই। সামগ্রিক অবস্থাকে নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে কেউ ধরতে পারছে না। সলীম লড়তে যাচ্ছে। ফলাফল জানা নেই। ও ফিরে আসতে পারবে কি না জানে না। যারা এখানে থাকবে তারাও একটা অনিশ্চিত অবস্থা মোকাবেলা করার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে। এর বাইরে ওরা আর কেউ কিছু জানে না। ওরা খুব সাধারণ। ওদের কোন গভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নেই–চেতনা নেই। ওরা কেবল বোঝে দেশের সীমানা এবং মাটি। এটুকু সম্বল করেই ওরা এগোয়। বিপদে বুক পেতে দেয়। প্রয়োজনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রাণের এই গভীর টানটুকু আছে বলেই ওরা অনমনীয় এবং দুর্বার হয়ে ওঠে।
সলীম শেষ টান দিয়ে বিড়িটা উঠোনে ছুড়ে ফেলে। ওরা তিনজন অনেক্ষণ ধরেই চুপচাপ। কারো মুখেই কথা নেই। কলীম হাই তোলে। সলীম উঠে দাঁড়ায়।
–যাও মা ঘুমোও। আবার ভোররাতে উঠতে হবে।
বুড়ি আঁচলে চোখ মোছে। সলীম বুড়ির কাছে এসে বসে।
–ও-মা-মাগো। তুমি এমন করলে কে আর আমাকে শক্তি যোগাবে বল? তুমি মন খারাপ করলে কে আর আমাকে সাহস দেবে? ভোর ভোর রওনা করতে না পারলে দিনের বেলা আবার সব জানাজানি হয়ে যাবে। যাও মা, ঘুমোও।
সলীম বুড়িকে হাত ধরে টেনে ওঠায়। ওর কথায় বুড়ি কোন সান্ত্বনা পায় না। উঠতেও ইচ্ছে করে না।
–তোরা যা বাবা। আমি একটু পরে আসি।
সলীম কলীম চলে যায়। আশেপাশের ঝোপঝাপে খস্ খস্ শব্দ হয়। বুড়ির বুক ভয়শূন্য হয়ে থাকে। শুধু সলীমের পালিয়ে যাওয়া ওকে কেমন অভিভূত করে রাখে। ও কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। ঝিঝির শব্দে বুড়ির কানে তালা লাগে। বাঁশবনের মাথার ওপর দিয়ে অনেক দূরের আকাশটা ধূসর, ম্রিয়মাণ। ফেলে আসা দিনের মত মনে হয় বুড়ির কাছে।
একসময় ও বিছানায় ফেরে। রইস হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। ও কিছুই জানে। রইসের পাশে গুটিশুটি শুয়ে পড়ে বুড়ি। ঘুম আসে না। পাশের ঘরে রমিজা কাঁদছে। বিয়ের পর থেকে দুজনে কোনদিন একলা হয়নি। সলীম ওকে সঙ্গে করে বাপের বাড়ি নিয়ে গেছে আবার নিজেই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। রমিজা এখন একলা হয়ে যাচ্ছে। সলীম খুব নরম স্বরে কথা বলছে। বুড়ির ভাবতে ভাল লাগে যে ছেলেটা একদম পাল্টে গেছে। ছেলে হবার পর থেকে আর সলীম ওর গায়ে হাত তোলেনি। রমিজার জন্যে সলীমের এখন অনেক ভালবাসা। সলীম এখন রমিজাকে বুকে নিয়ে আদর করছে। তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে বলে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। রমিজার কান্নার রেশ কমে আসছে। রইস ঘুমের ঘোরে বিড়বিড় করে। বুড়ি বিছানার ওপর উঠে বসে থাকে। কিছুতেই ঘুম আসে না।
ভোররাতে সলীম ওঠে। এক সানকি পান্তা খেয়ে নেয়। ছেলেকে আদর করে। বুড়ির পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে। চুপিচুপি জলিল আসে, একটুও শব্দ না করে। বুড়ির কাছ থেকে বিদায় নেয়। ওর ভিটের দিকে খেয়াল রাখতে বলে। সকাল সন্ধ্যায় ঘরদোর আঙিনা যেন ঝাড় দেয়া হয় সেকথা বলে। মাচায় অনেক ঝিঙ্গে ধরেছে। তুলে এনে রাধতে বলে। শেষে জলিল চোখের জল আর রাখতে পারে না। বুড়ির চোখও ছলছলিয়ে ওঠে। সলীম ধমক দেয়।
–আঃ চাচা কি হচ্ছে। চোখে পানি থাকলে যুদ্ধ হয় না চাচা। তাড়াতাড়ি যাই চলেন।
জলিল আর একটা কথাও বলে না। সলীমের সঙ্গে রওনা করে। একবারও পেছন ফিরে চায় না। কেশে নিয়ে রুদ্ধ কণ্ঠ পরিষ্কার করে না।
বুড়ি বাঁশবন পর্যন্ত আসে। মনে হয় এ ঘটনা ওর জীবনে একদম নতুন। কাউকে এমন করে কোনদিন চলে যেতে দেখেনি ও। চুপে চুপে কাদে। জোরে কাঁদতে পারে না। নির্ঘুম চোখের পাতা জলের স্পর্শে কাতর। সে জল ধরে রাখতে চায় বুড়ি, মুছে ফেলতে ইচ্ছে হয় না।
সলীম চলে যাবার দুদিন পরে স্টেশনে যাবার বড় রাস্তা দিয়ে মিলিটারি আসে হলদী গায়ে। জ্যৈষ্ঠের প্রচণ্ড গরমে মাটি পুড়ে যায়। বাতাস দম ধরা। গাছের পাতা নড়ে না। বুড়ির সিঁদুরিয়া আম পেকে লাল। ওরা ফাঁকা আওয়াজ করতে করতে ঢোকে। নদীর ধারে ক্যাম্প করে। বুড়ি স্টেশনে যাবার রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখেছে। কিছুই প্রকাশ করতে পারে না। ওর মনে কুটুম পাখির আনাগোনা। ফিরে এসে ঘরের দাওয়ায় ধপ করে বসে পড়ে। রমিজার শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে বুড়ি বলে, কুটুম এসেছে রমিজা।
রমিজা কথা বলতে পারে না। ছেলেকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে। মাছ-কোটা বটি উঠোনে কাত হয়ে পড়ে থাকে। চুলোয় আগুন জ্বলে না। দুই-মুখো চুললাটা শীতল ছাই বুকে নিয়ে শান্ত। রমিজা ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠে বলে, আমাদের কি হবে আম্মা?
–যা হয় হবে। বুড়ি শক্ত মুখে সজনে গাছের মাথার ওপর দিয়ে তাকিয়ে থাকে।
–আমার ভয় করে।
–অত ভয় করতে নেই রমিজা। দে ছেলেটাকে আমার কাছে দে।
বুড়ি নাতি বুকে নিয়ে সুপপারি বাগানে আসে। ওখান থেকে ক্যাম্পটা পরিষ্কার দেখা যায়। ওরা কি করে দেখতে চায় বুড়ি। এমন অতিথি বুড়ি আর কোনদিন দেখেনি।
রাতে কলীমের মুখের দিকে চেয়ে বুড়ির বুক মুচড়ে ওঠে।
–তুইও পালিয়ে যা কলীম?
–কেন মা?
–সলীম গেছে তোর থাকা ঠিক না।
–বড় ভাই যে চলে গেছে এই খবর মনসুর মেম্বার ওদের জানিয়ে দিয়েছে।
–তোকে কে বলল?
–মনসুর মেম্বারই। ওদের সঙ্গে মনসুর মেম্বার খুব জমিয়েছে। গাঁয়ের খবরাখবর দিচ্ছে।
–তুই কোথাও চলে যা বাবা?
–তোমাদের কি হবে?
–আমরা ঠিকই থাকতে পারব।
–তা হয় না মা। তোমাদের রেখে বাড়ি খালি করে আমি যেতে পারি না। বুড়ি আর কথা বলে না।
–জান মা মনসুর মেম্বার বললো খুব লাফালাফি করছিলে বাবারা এবার মজা টের পাবে। ভিটেয় ঘুঘু চরিয়ে ছাড়বে। আমি অবশ্য একটুও ভয় পাইনি। মনসুর মেম্বারের মুখের ওপর কড়া জবাব দিয়ে দিয়েছি। ইচ্ছে হচ্ছিল পাছায় দুটো লাথি মেরে দেই। ব্যাটা আস্ত শয়তান। উঃ কেমন করে যে হাসছিল। ভাবলে এখনো গা জ্বলে উঠে।
বুড়ি আর রমিজা কলীমের কথা শুনে কাঠ হয়ে যায়। কলীমের খাওয়া শেষ হলে বুড়ি আবার ওকে পালানোর কথা বলে। কলীমের চোখ লাল হয়ে ওঠে। রুক্ষভাবে বলে, নিজের ভিটে ছেড়ে কোথাও যাব না। ওদের ভয়ে পালাবো নাকি? কি করবে দেখিই না?