০৭. বুধবারটা রফিকের জন্যে খুব লাকি

বুধবারটা রফিকের জন্যে খুব লাকি। বুধবারে সে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘর থেকে বেরুতে পারে। এইদিন কোনো অঘটন ঘটবে না। কারে সঙ্গে দেখা করতে গেলে দেখা হবে। বাসে উঠলে জানালার পাশে বসার সিট পাওয়া যাবে। বাসের কণ্ডাকটার ভাংতি হিসেবে তাকে দেবে চকচকে নতুন নোট।

আজ বুধবার, কিন্তু তবু অঘটন ঘটল। ফার্মগেটে বাস থেকে নোমর সময় নতুন পাঞ্জাবিটা ফস করে পেটের কাছে ছিঁড়ে গেল। অনেকখানি ছিড়ল। রফিকের সঙ্গের শুকনো ভদ্রলোক বললেন, কণ্ডাকটারকে একটা চড় দেন। ভাই। তাড়াতাড়ি করেন, বাস ছেড়ে দেবে।

রফিক অবাক হয়ে বলল, তাকে চড় দেব কেন? সে তো ছেঁড়ে নি।

সে না ছিড়ুক, তার বাস তো ছিঁড়েছে।

অকাট্য যুক্তি। কিন্তু বাস ছেড়ে দিয়েছে। রফিক বিমর্ষ মুখে ষ্টেডিয়ামের দিকে এগুতে লাগল। তার প্ল্যান-প্রোগ্রাম বদলাতে হবে। ছোড়া পাঞ্জাবি নিয়ে ঘুরে বেড়ানো যায় না। সবচে ভালো বুদ্ধি হচ্ছে, একটা বই কিনে পেটের কাছে ধরে রাখা। অত্যন্ত বিরক্তিকর ব্যাপার।

রফিক নিউজ ষ্ট্যাণ্ড থেকে এক কপি বিচিত্রা কিনে উঠে দাঁড়ানোমাত্র মেয়েলি গলা শোনা গেল।–রাফিক সাহেব।

সে তাকিয়ে দেখে।–শারমিন। হালকা গোলাপী রঙের শাড়ি গায়ে। লাল টুকটুকে একটা শাল। হাতে পাটের ব্যাগ। শারমিন বলল, এভাবে তাকাচ্ছেন, যেন আমাকে চিনতে পারছেন না।

চিনতে পারছি।

আমি তখন থেকে লক্ষ করছি।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। দেখলাম পেটে হাত দিয়ে খুব চিন্তিত মুখে আপনি হাঁটছেন। কি হয়েছে আপনার?

রফিক কিছু বলল না।

আপনার শরীর খারাপ করেছে কিনা এটা জিজ্ঞেস করবার জন্যে দাঁড়িয়ে আছি।

শরীর ঠিকই আছে। বাস থেকে নামার সময় পাঞ্জাবি ছিঁড়ে গেছে। ছেঁড়াটা হাত দিয়ে ঢেকে হাঁটছি।

শারমিন হেসে ফেলল। রফিক বিরক্ত মুখে বলল, আপনি হাসছেন!

সরি, আর হাসব না।

এখানে কী করছেন?

বই কিনতে এসেছি। বিদেশে কিছু বই পাঠাতে হবে। এক জন চেয়েছে।

কী বই? গল্প-উপন্যাস?

না, সে গল্প-উপন্যাস পড়ে না। সিরিয়াস ধরনের বই পড়ে।

একটা ডিকশনারি কিনে পাঠিয়ে দিন।

শারমিন খিলখিল করে হেসে ফেলল। রফিকের মনে হল, বুধবার দিনটি আসলে তার জন্যে ভালোই।

রফিক সাহেব, আপনার কাজ না থাকলে আসুন আমার সঙ্গে, বই পছন্দ করে দেবেন। আছে কোনো কাজ?

না, কাজ নাই কোনো। আর থাকলেই-বা কি?

তারা হাঁটতে শুরু করল। শারমিনের হাঁটার ভঙ্গি স্বাভাবিক। কোনো রকম সঙ্কোচ নেই, জড়তা নেই। যেন তারা দীর্ঘদিনের বন্ধু। শারমিন হালকা গলায় বলল, ঐদিন আপনি খুব রাগ করেছিলেন, তাই না?

হ্যাঁ।

খুব বেশি রাগ করেছিলেন?

হ্যাঁ।

এখানে রাগ আছে?

আছে।

কী করলে আপনার রাগ কমবে?

আপনি যদি আজ সারা দিন আমার সঙ্গে থাকেন, তাহলে রাগ কমবে।

শারমিন চমকে তাকাল। অনেকক্ষণ কোনো কথা বলল না। রফিক বলল, এখন বোধহয় আপনি রাগ করেছেন, তাই না?

ন, আমি রাগ করি নি।

তাহলে কি আজ সারা দিন থাকবেন আমার সঙ্গে? বাজার শেষ করে আমরা চিড়িয়াখানায় যেতে পারি।

শারমিন হেসে ফেলল। রফিক বলল, হাসছেন কেন?

চিড়িয়াখানায় যাবার কথা শুনে হাসছি।

তাহলে অন্য কোথাও, মিউজিয়ামে কিংবা সোনার গাঁয়ে যেতে পারি।

প্রাচীন বাংলার রাজধানী।

আজ আপনার এত ঘোরাঘুরির শখ হয়েছে কেন?

কারণ, আজ আমার জন্মদিন।

বলেই রফিকের একটু খারাপ লাগল। একটা মিথ্যা কথা বলা হল। কিছু কিছু মানুষের সঙ্গে মিথ্যা কথা বলতে ইচ্ছা করে না। কপটতা করতে ইচ্ছা করে না। রফিক সিগারেট ধরিয়ে টানতে লাগল। জন্মদিন প্রসঙ্গে এই মিথ্যা কথাটা বলে তার খুব খারাপ লাগছে।

আপনার জন্মদিন আজ? বাহ্, বেশ মজা তো! খুব ভালো দিনে দেখা হল আপনার সঙ্গে। আসুন, আপনাকে একটা গিফট কিনে দেব। আপনি কিন্তু না বলতে পারবেন না।

রফিক কিছু বলল না।

আপনাকে খুব সুন্দর একটা পাঞ্জাবি কিনে দেব। ছেঁড়া পাঞ্জাবি পরা কেউ আমার পাশে পাশে হাঁটলে আমার ভালো লাগে না।

শারমিন আবার হেসে উঠল। কিশোরীদের মতো হাসি। ক্লিনারিন করে কানে বাজে। হঠাৎ করে মন খারাপ করে দেয়।

রফিক মৃদুস্বরে বলল, শারমিন, আমার জন্মদিনের কথাটা মিথ্যা। আজ আমার জন্মদিন নয়।

জন্মদিন নয়, তাহলে জন্মদিনের কথাটা কেন বললেন?

আমার ধারণা ছিল, এটা বললে আপনি আমার সঙ্গে থাকবেন।

আমার থাকাটা এত জরুরি কেন?

রফিক কোনো জবাব দিল না। কিছু কিছু প্রশ্ন আছে যার জবাব সরাসরি দেওয়া যায় না। শারমিন দ্বিতীয় বার বলল, বলুন, কেন আপনি চান আমি আজ সারা দিন। আপনার সঙ্গে থাকি।

জানি না, কোন চাই।

শারমিন হালকা গলায় বলল, আমরা সারা জীবনে অনেক কিছুই চাই, কিন্তু সবকিছু পাই না। আমি সব সময় স্বপ্ন দেখি, আমার অনেকগুলি ভাইবোন। সবাই হৈচৈ ছোটাছুটি করছে, ঝগড়া করছে। কিন্তু থাকি একা একা। আমার কী মনে হয় জানেন, কেউ যদি তীব্রভাবে কোনো জিনিস চায়, সে সেটা পায় না। কোনো কিছুর জন্যেই প্রবল আকাঙ্খা থাকা ঠিক না। বুঝতে পারছেন?

পারছি।

চলুন, পাঞ্জাবি কিনি। জন্মদিন উপলক্ষেই দিলাম। এ্যাডভান্স গিফ্‌ট।

না, কোনো দরকার নেই। আচ্ছা, আমি যাই।

চলে যাবেন।

হ্যাঁ।

শারমিন বলল, রফিক সাহেব, আপনাকে একটা কথা বলা দরকার। আসুন কোথাও বসে কথাটা বলি। এখানে কোনো ভালো রেস্টুরেন্ট আছে?

না, এদিকে তেমন কিছু নেই।

চলুন, কোনো একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসি। চাইনিজ রেস্টুরেন্টগুলি এই সময় ফাঁকা থাকে। আসবেন?

চলুন যাই।

রফিক, শারমিনের সহজ-স্বাভাবিক আচার-আচরণের প্রশংসা করল। এই মেয়েটি জানে, সে কী বুলছে, কী করছে। এটা খুব বড়ো কথা। বেশির ভাগ জানে না, সে কী করছে, কী বলছে।

রমিন বলল, চায়ের সঙ্গে আর কিছু খাবেন? এরা খুব ভালো সমুসা। জাতীয় একটা খাবার তৈরি করে। চায়ের সঙ্গে ভালো লাগবে। দিতে বলি?

বলুন।

শারমিন খাবারের কথা বলল। অস্বস্তির সঙ্গে এদিক-ওদিক খানিকক্ষণ তাকাল। যেন কী বলবে তা একটু গুছিয়ে নিচ্ছে। রফিক বলল, বলুন, কী বলবেন।

আপনি এত গম্ভীর হয়ে থাকলে বলি কী করে? সহজ হয়ে বসুন। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি ভাইভা দিতে এসেছেন।

রফিক হাসতে চেষ্টা করল। শারমিন কী বলবে, তা সে বুঝতে চেষ্টা করছে।

শারমিন চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, সাব্বির আহমেদ নামে এক জন ভদ্রলোক আছেন। পি-এইচ. ডি করছেন আমেরিকায়। অত্যন্ত ভালো ছাত্র এবং আমার বাবা তাঁকে খুব পছন্দ করেন। আমি নিজেও করি। পছন্দ করার মতোই মানুষ। তাঁর মাকে আমি চাচী ডাকি। যখন আমার কোনো কারণে খুব মন খারাপ লাগে, তখন আমি ওনার কাছে যাই, মন ভালো করবার জন্যে। বুঝতেই পারছেন ইনি কেমন মহিলা। পারছেন না?

পারছি।

ঐ সাব্বির আহমেদ ছেলেটির সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে, যখন আমি কলেজে পড়ি, তখন থেকে। সে জুলাই মাসে দেশে ফিরবে——তখন আমাদের বিয়ে হবে।

রফিক কিছু বলল না। শারমিন মৃদুস্বরে বলল, আমি সুখী হতে চাই। গুরু আমি জানি এই বিয়ে আমার জন্যে সুখ নিয়ে আসবে। আমার ইনট্যুশন তাই বলে।

রফিক সিগারেট ধরাল। শারমিন বলল, আমি আসলে এক জন দুঃখী মেয়ে। আমি সুখ চাই, সুখী হতে চাই।

সবাই চায়।

হ্যাঁ, সবাই চায়। তবে আমি বোধহয় একটু বেশি চাই।

সে মুখ নিচু করে হাসল। রফিক বলল, কঠিন কঠিন বইগুলি ঐ ভদ্রলোকের জন্যে কিনবেন?

হ্যাঁ। আপনার কথামতো একটা ডিকশনারিও কিনে দেব। ওর খুব মেজাজ খারাপ হবে।

রফিক হেসে ফেলল। শারমিন বলল, বই পছন্দ করবার জন্যে আপনি আসবেন তো আমার সঙ্গে?

হ্যাঁ, আসব।

কেনাকাটার পর আপনার কথামতো আমরা ঘুরে বেড়াব। সারা দিন ঘুরব।

তার দরকার নেই।

দরকার আছে। আজ আমার খুব ঘুরতে ইচ্ছা হচ্ছে। এবং আরেকটা কথা, রফিক সাহেব।

বলুন।

এখন থেকে আমরা তুমি-তুমি করে বলব। আপনি-আপনি শুনতে খারাপ লাগছে।

ঠিক আছে।

প্রথম প্রথম বলতে হয়তো একটু অস্বস্তি লাগবে, পরে আর লাগবে না।

সত্যি সত্যি তারা সারা দিন ঘুরে বেড়াল। চিড়িয়াখানা, বোটানিক্যাল গার্ডেন দেখার পর শারমিনের ইচ্ছা হল, প্রাচীন বাংলার রাজধানী সোনার গী দেখবো। রফিক বলল, ফিরতে দেরি হয়ে যাবে। সন্ধ্যা হয়ে যাবে!

হোক সন্ধ্যা, আমার দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে। সঙ্গে গাড়ি আছে, অসুবিধা কী?

উৎসাহে ও আনন্দে শারমিন ঝলমল করছে। এই আনন্দের উৎসটি কোথায়, কে জানে? সারা পথ হাত নেড়ে নেড়ে সে অনেক গল্প করতে লাগল। তুচ্ছ সব কথা–এতেই একেক বার সে হাসতে হাসতে ভেঙে গড়িয়ে পড়ছে।

রফিক মুটামুটি চুপচাপই আছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, সে একটা ঘোরের মধ্যে আছে। পরিষ্কারভাবে সে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না।

সোনার গাঁ যাওয়ার পথে শারমিনের চায়ের পিপাসা পেয়ে গেল। পথের পাশে গাড়ি থামিয়ে তারা চা খেল। শারমিন বলল, কেমন গ্রাম-গ্রাম চারদিক, তাই না?

এটা তো গ্রামই। গ্রাম-গ্রাম তো লাগবেই।

তুমি কখনো গ্রামে গিয়েছ রফিক?

যাব না কেন, অনেক বার গিয়েছি।

আমি কখনো গ্রাম দেখি নি। এক বার তোমার সঙ্গে গিয়ে দেখে আসব।

বেশ তো।

গ্রামের জোছনা নাকি খুব সুন্দর হয়?

হয় বোধহয়, আমার এমন কাব্য ভাব নেই। মন দিয়ে দেখি নি কখনো।

তেমন কোনো হাসির কথা নয়, কিন্তু খিলখিল করে হেসে উঠল। শারমিন, যেন খুব মজার কথা, রফিক বলল, তোমার সাব্বির সাহেব কি তোমাকে আমার সঙ্গে গ্রামে যেতে দেবেন?

দেবে না কেন? নিশ্চয়ই দেবে।

দেখা যাবে।

ওর মধ্যে কেনো প্রিজুডিস নেই।

না থাকলেই ভালো।

আর সে খুব ভাবুক ধরনের, রাতদিন বই নিয়ে থাকে।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। মাঝে মাঝে হঠাৎ রোমান্টিক হতে চেষ্টা করে, সেটা আরো হাস্যকর লাগে।

দু একটি উদাহরণ দাও, শুনি।

না, থাক, আমার লজ্জা করবে।

আহ, লজ্জার কী আছে। এর মধ্যে?

শারমিন গম্ভীর হয়ে বলল, যেমন, গত মাসে হঠাৎ চিঠি লিখল——শারমিন, তুমি অবশ্যই তোমার মাথার একগাছি চুল খামে ভরে পাঠাবে।

বলেই শারমিন লজ্জা পেল। সন্ধ্যার আলোয় তার লজ্জারাঙা মুখ দেখতে বড়ো ভালো লাগল। রফিকের। তার জীবনে এই দিনটি বিশেষ দিন হয়ে থাকবে। একটি গোপন সঞ্চয়। রফিক একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস গোপন করল। তার মনে হল, সুখ এবং দুঃখ একসঙ্গে মিশে থাকে, এমন ঘটনার সংখ্যা পৃথিবীতে খুব বেশি।

 

শারমিন বাড়ি ফিরল রাত আটটায়। রহমান সাহেব উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছিলেন। তাকে দেখেই বললেন, কোথায় ছিলে মা?

ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। আমেরিকায় পাঠাবার জন্যে কিছু বই কিনলাম, তারপর এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ওকে নিয়ে খুব ঘুরলাম।

খবর তো দেবে। খুব চিন্তা করছিলাম।

আই এ্যাম সরি।

একটা টেলিফোন করে দিলেই হত।

একদম মনে হয় নি। প্লীজ বাবা, রাগ করো না।

শারমিন বাবাকে জড়িয়ে ধরল। রহমান সাহেব হেসে ফেললেন।

খুব ভালো বন্ধু বুঝি?

হ্যাঁ।

অনেক দিন পর দেখা হল?

বাসায় নিয়ে এলে না কেন?

নিয়ে আসব এক দিন।

সাব্বিরের চিঠি এসেছে। তোমার টেবিলে রেখে এসেছি।

থ্যাংকস।

কিছু বইপত্রও বোধহয় পাঠিয়েছে। বিরাট একটা প্যাকেট দেখলাম।

ভূতের বই পাঠাতে বলেছিলাম–তাই পাঠিয়েছে।

সাব্বিরের চিঠিগুলো সাধারণত ছোট হয়। তুমি কেমন আছ? আমি ভালো। এখানকার ওয়েদার এখন বেশ চমৎকার! এতেই শেষ।

কিন্তু এবারের চিঠিটি বেশ দীর্ঘ। ওয়েদার ভালো ছাড়াও অনেক কিছু লেখা। শারমিন লক্ষ করল, চিঠি পড়তে তার কেমন যেন আগের মতো ভালো লাগছে না। জড়ানো ধরনের হাতের লেখার দিকে তাকিয়ে তার সত্যি সত্যি হাই উঠল।

পাঠানো বইগুলিও খুলে দেখতে ইচ্ছা করছে না। এরকম হচ্ছে কেন? দায়িত্ব পালনের মতো করে সে চিঠি শেষ করল। বইয়ের প্যাকেট খুলে বইগুলি উল্টেপাল্টে দেখল। রাত দশটার দিকে গেল বাবার ঘরে। শোবার আগে গুড নাইট জানাতে।

রহমান সাহেব বেতের চেয়ারে গা এলিয়ে চুরুট টানছিলেন। ঘরে একটা হালকা মিষ্টি গন্ধ। রাতের খাবারের পর তিনি সাধারণত এক পেগ হুইঙ্কি খেয়ে থাকেন।

শারমিনকে ঢুকতে দেখে নড়েচড়ে বসলেন। আদুরে গলায় বললেন, ঘুমুতে যাচ্ছ মা?

বস, একটু।

শারমিন বসল।

কী লিখেছে সাব্বির? কেমন আছে সে?

ভালোই আছে।

কবে আসবে কিছু লিখেছে?

না।

আমি ভাবছি। ওকে লিখব। জুন-জুলাইয়ের দিকে এক বার দেশে আসতে। বাই দিস টাইম তোমার এম. এ. পরীক্ষার রেজাল্টও নিশ্চয়ই বের হয়ে যাবে। হবে না?

হ্যাঁ, হবে। আগস্টেই হবার কথা।

গুড। তাই লিখব। যাও মা, এখন ঘুমুতে যাও। মনে হয় অনেক রাত হয়েছে।

শারমিন উঠে দাঁড়াল এবং হঠাৎ রহমান সাহেবকে অবাক করে দিয়ে শান্ত স্বরে বলল, বাবা, আমি ঠিক করেছি, সাব্বির ভাইকে বিয়ে করব না।

রহমান সাহেব পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেনু মেয়ের দিকে। তাঁর চেহারা বা বসে থাকার ভঙ্গিতে পরিবর্তন হল না। চুরুট নিতে গিয়েছিল, তিনি চুরুট ধরালেন এবং অত্যন্ত স্বাভাবিক স্বরে বললেন, এই নিয়ে আমি কাল সকালে তোমার সঙ্গে কথা বলব, এখন ঘুমুতে যাও।

শারমিন নড়ল না। যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। রহমান সাহেব শীতল কণ্ঠে বললেন, ঘুমুতে যাও শারমিন।

শারমিন ঘর ছেড়ে গেল। রহমান সাহেব সাধারণত এগারটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েন। আজ অনেক রাত পর্যন্ত জেগে রইলেন। রাত একটায় বারান্দায় হাঁটতে গিয়ে দেখেন, শারমিনের ঘরেও বাতি জ্বলছে। এক বার ভাবলেন, ডাকেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ডাকলেন না।

ছোটবেলায় শারমিন মাঝে মাঝে ভয় পেয়ে বাতি জ্বালিয়ে বিছানায় বসে থাকত। তিনি দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলতেন, ভয় পাচ্ছি মা?

হ্যাঁ।

আমার সঙ্গে ঘুমুবো?

না।

মজনুর মাকে বলব তোমার ঘরে ঘুমুতে? মেঝেতে বিছানা পেতে সে ঘুমুবে।

না।

আচ্ছা ঠিক আছে, সে না-হয় দরজার বাইরে ঘুমাক!।

না, দরকার নেই।

শারমিন অত্যন্ত জেদী। তাকে দেখে অবশ্যি খুব নরম ধরনের মেয়ে বলেই মনে হয়। রহমান সাহেব অত্যন্ত চিন্তিত বোধ করলেন। শারমিনের ভেতর এক ধরনের দৃঢ়তা আছে, যাকে তিনি ভয় করেন। তার সঙ্গে খোলাখুলি আলাপ করতে হবে। সেজন্যে তাঁকে সকাল হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। অপেক্ষা করার মতো বাজে ব্যাপার আর কিছুই নেই।

 

ভোরবেলা শারমিনকে খুব স্বাভাবিক মনে হল। নিজের হাতে বাবার জন্যে বেড টি নিয়ে এল। মার্টিকে খাবার দিয়ে বাগানে বেড়াতে গেল। তার রোজাকার অভ্যাস হচ্ছে টেবিলে নাশতা না দেয়া পর্যন্ত বাগানে হাঁটা। তার সঙ্গে হাঁটবে মাটি। মাটি খানিকক্ষণ হাঁটবে। আবার দৌড়ে গিয়ে তার খাবার খাবে, আবার ছুটে আসবে শারমিনের কাছে।

নাশতার টেবিলে রহমান সাহেব শারমিনকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ করলেন। চেহারায় রাত্রি জাগরণের ক্লান্তি নেই। তোরবেলায় গোসল করেছে। স্নিগ্ধ একটা ভাব এসেছে চেহারায়। রহমান সাহেব চা খেতে খেতে বললেন, কাল রাতে তুমি একটি প্রসঙ্গ তুলেছিলে, আমরা কি সেটা নিয়ে এখন আলাপ করব?

শারমিন মৃদুস্বরে বলল, আলাপ করার দরকার নেই।

আমি কি লিখব সাব্বিরকে আসবার জন্যে?

হ্যাঁ, লেখা।

কোনো কারণে কি তোমার মন বিক্ষিপ্ত?

না।

রহমান সাহেব নিঃশব্দে চা পান পর্ব শেষ করলেন। চুরুট ধরালেন এবং একসময় ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, চল আমরা বরং বেড়িয়ে আসি কোনো জায়গা থেকে। যাবে?

যাব।

কোথায় যেতে চাও?

আমি জানি না, তুমি ঠিক কর।

নেপালে যাবে? হিমালয়-কন্যা নেপাল।

যাব।

বেশ, আমি ব্যবস্থা করছি।

শারমিনরা পরের সোমবারেই সাত দিনের জন্যে নেপাল চলে গেল। বেড়াতে যাবার জন্যে সময়টা ভালো নয়। প্রচণ্ড শীত, কিন্তু তবু ঢাকা ছেড়ে বেরোতে পেরে শারমিনের ভালোই লাগল। কেমন যেন হাঁপ ধরে গিয়েছিল।

নেপাল থেকে সে সুন্দর একটি চিঠি লিখল সাব্বিরকে।

শ্রদ্ধাস্পদেষু,
আমরা বেশ কদিন হল নেপালে এসেছি। চমৎকার জায়গা। আপনিও চলে আসুন। আপনি এলে আমার আরো ভালো লাগবে। কিছুদিন ধরেই আমার কেন জানি খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগে। আপনি এলে রাত-দিন আপনার সঙ্গে গল্প করব। আপনার যত কাজই থাকুক, সব ফেলে রেখে আমার সঙ্গে গল্প করতে হবে। গোমড়ামুখের প্রফেসর আমার এতটুকুও পছন্দ নয়।
বিনীতা
শারমিন

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *