বিন্দুবাসিনী ঠাকুরঘরের মেঝেতে আঁচল ছড়িয়ে শুয়ে আছে। সারা বাড়ি নিস্তব্ধ। বেলা এখন তিন প্রহর। বাড়ির সকলে এই সময় খেয়েদেয়ে ঘুমোয়। নীচতলার দাস-দাসীদের কোলাহলও এখন কিছুক্ষণের জন্য শান্ত। বাইরে রাস্তায় ঠা ঠা পোড়া রোদুর, লোকজন বেশী হাঁটে না, গাড়ি-ঘোড়াও কম। মাঝে মাঝে কাকের কা-কা আর চিলের চি-হি-হি-তে শুধু স্তব্ধতায় একটুখানি চিড় ধরে।
ঠাকুরঘরের একটা জানলা খোলা। তা দিয়ে হাওয়া আসছে। হু হু করে। আর সেই জানলার ওপর বসে দুটো কাক একমনে দেখছে বিন্দুবাসিনীকে। তারা খুব চিন্তিত ভঙ্গিতে কিছু একটা আলোচনা করছে। পরস্পরের সঙ্গে। আমরা কাকের ভাষা জানি না, কিন্তু তারা যে বিন্দুবাসিনী সম্পর্কেই কথা বলছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই মেয়েটিকে কদিন আগেও তারা কত উচ্ছলা-চঞ্চল দেখেছিল, আজ সেই মেয়েটি একা মাটিতে শুয়ে আছে অশ্রুসজলা হয়ে।
আজ বিন্দুবাসিনীর একা থাকবারই দিন। আজ একাদশী। এর আগেও তো কত একাদশী গেছে, সাড়ে ন বছর বয়েসে বিধবা হওয়ার পর থেকে বিন্দুবাসিনী নিয়মিত একাদশী করে আসছে। ক্ষিদের জন্য তার কষ্ট হয় না। একাদশীর দিন না খেয়ে থেকেও সে তার বোনেদের সঙ্গে দৌড়োদৌড়ি করে কত রকম খেলেছে। সকাল বিকেলে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে মুখস্থ করেছে পড়া। মায়ের কাছে সে জাঁক করে বলেছে, একদিন কেন, আমি সাতদিনও উপোস দিতে পারি মা। তুমি দেখতে চাও? আগেকার দিনে মুনি-ঋষিরা বছরের পর বছর না খেয়ে তপস্যা করতো। মহাভারতের অম্বাও এ রকম তপস্যা করেছিল।
মা হেসে বলতেন, মেয়ে আমার একেবারে গুরু ঠাকুর! কথায় কথায় বেদ-পুরাণের তুলনা।
বিন্দুবাসিনীর পরের বোন কুন্দমালার তখনো বিয়ে হয়নি, সে বলতো, তুই কার জন্য তপস্যা করবি রে, সেজদি?
মা বলতেন, তুই চুপ কর, কুন্দ। পরের জন্মে আমাদের বিন্দু শিবের মতন স্বোয়ামী পাবে।
বিন্দুবাসিনী বলতো, রক্ষে কর। আমার আর পরের জন্মে শিবের মতন স্বোয়ামী দরকার নেই, আমি পরের জন্মে পুরুষ মানুষ হবো।
কুন্দমালা আর বিন্দুবাসিনী পিঠোপিঠি বোন। কথায় কথায় টক্কর লাগতো। সে একদিন বলেছিল, জানো মা, প্রত্যেক একাদশীতে সেজদি পাছপুকুরে তিন চারবার ড়ুব দিয়ে আসে। সেজদি ড়ুবে ড়ুবে জল খায়।
বিন্দুবাসিনী রাগ করে বলেছিল, কী অখাদ্য কথা! পাছপুকুরে শ্ৰীভদর গাড়োয়ান গোরু-মোষ চান করায়, আমি সেই জল খেতে যাবো? ওয়াঃ!
মা বলেছিলেন, তুই থাম তো কুন্দ! কেড়ে রাঢ়ী, একাদশীর দিন জল খাবে কী? ওকথা শুনলেও অকল্যাণ হয়।
কুন্দমালা বয়েসের তুলনাতেও বেশী ছেলেমানুষ। বৈধব্যের দুঃখ সে ঠিক বুঝতে না। শ্বশুরবাড়ি নামক একটা অচেনা জায়গায় থাকবার বদলে দিদি যে আবার বাবা-মায়ের কাছে ফিরে এসেছে, এটাকে সে একটা সুখের বিষয় জ্ঞান করতো।
সে বলেছিল, আমন একাদশী আমরাও করতে পারি, মা! পরের দিন দিদির কত খাতির! কত রকম মেঠাই, সন্দেশ, পেস্তার সরবৎ
বিধুশেখর-জায়া হেসে ফেলে কুন্দর মাথায় একটা চাপড় মেরে বলেছিলেন, এ মেয়েটা আমার একেবারে হাবা! পরীক্ষণেই তাঁর চোখের কোণে অশ্রুবিন্দু চিকচিক করে ওঠে। বিন্দুবাসিনীর দিকে তাকিয়ে তিনি দীর্ঘশ্বাস গোপন করেন।
কুন্দমালাকে বৈধব্য যাতনা সহ্য করতে হয়নি। যথা সময়ে তার বিয়ে হয় উত্তরপাড়ার জমিদারদের বাড়িতে। সেখানে গিয়ে সে সব সময় মায়ের কাছে আসবার জন্য কান্নাকাটি করতো। দয়ালু শ্বশুরকে জপিয়ে সে চলেও এসেছিল বেশ কয়েকবার। তারপর তার বারো বছর বয়েসে তাকে পাকাপাকিভাবে চলে যেতে হলো এবং সাড়ে চার মাস ধরে জমিদারগিন্নী সাজবার প্রাণপণ চেষ্টা করে সে হঠাৎই মরে গেল একদিন। বছর না ঘুরতেই তার সৌভাগ্যবান স্বামী প্রচুর যৌতুক সমেত আর একটি অষ্টম বর্ষীয়াকে ঘরে আনলো। পৃথিবী থেকে একেবারে বিলীন হয়ে গেছে। কুন্দমালা।
বিন্দুবাসিনী তার বৈধব্যকে কখনো গ্রাহ্য করেনি। ছোটখাটো জিনিস থেকেই সুখ খুঁজে নেবার একটা প্রবণতা ছিল তার স্বভাবের মধ্যে। তার চরিত্রের নির্মল তেজস্বিতার জন্য কেউ কখনো খবরদারি করেনি তার ওপরে। কিন্তু হঠাৎ এ কী হলো? যেন একদিন সহসা ঘুম ভেঙে জেগে উঠে তার বাড়ির লোক আবিষ্কার করলো, সে আর বালিকাটি নেই, সে এখন স্ত্রীলোক। আর সেইজন্যই সে এখন থেকে আর ইচ্ছে মতন চলাফেরা করার স্বাধীনতা পাবে না, এমনকি এই বাড়ির মধ্যেও না।
বিধবা হবার বছর তিনেক বাদে বিন্দুবাসিনী একবার ভয় পেয়েছিল, যেদিন সে রক্ত দর্শন করে। রজঃস্বলা হওয়ার ব্যাপারটা সে জানতো না। জানবেই বা কী করে, সাধারণত বিবাহিতা বালিকাদের বয়স্থ ননন্দ-ভাজরাই ঐ সব গূঢ় কথা জানিয়ে দেয়। বিন্দু তো ওদের সঙ্গে থাকেনি। ভয় পেয়ে বিন্দুবাসিনী লুকিয়ে ছিল নিজের ঘরে, ভেবেছিল তার কোনো কঠিন অসুখ হয়েছে, এবার কুন্দমালার মতন সে-ও মরে যাবে। টানা দেড়দিন বিন্দুবাসিনী ঘরের বার হয়নি।
শেষ পর্যন্ত তার মায়ের কানে খবর যায়। বৃহৎ সংসার, সৌদামিনীর সঙ্গে তাঁর সন্তানদের প্রতিদিন দেখাও হয় না। স্বামীর সেবাতেই তিনি ব্যস্ত থাকেন, সন্তানদের তত্ত্বাবধানের ভার দাস-দাসীর ওপর। খবর পেয়ে তিনি এসে মেয়েকে এক পলক দেখেই আসল ব্যাপারটি বুঝেছিলেন। বিন্দুবাসিনীর পিঠে হাত বুলিয়ে তিনি বলেছিলেন, পাগলী আমার, এইজন্য বুঝি নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে শুয়ে থাকতে হয়? এতে ভয়ের কী আছে? মেয়েমানুষের অমন হয়। ভগবান মেয়েমানুষদের যেমন ভাবে গড়েছেন, তেমনি তো হবে!
যে মেয়েরা স্বামীকে ভালো করে চিনবার আগেই বিধবা হয়, ঋতুমতী হয় তারাও, প্রকৃতির এমনই আশ্চর্য বিধান!
সেদিন থেকে বিন্দু মেয়েমানুষ হয়েছিল, কিন্তু স্ত্রীলোক হয়নি। কেন না, তখনো খর্ব করা হয়নি তার স্বাধীনতা। তারপরও সে পুকুর পাড়ে গিয়ে গাছে চড়েছে, ভর দুপুরবেলা ভূত-তাড়ানি খেলা খেলেছে, আবার পুঁথিপত্তর নিয়ে আচার্য মশাইয়ের কাছে পাঠ নিতেও গেছে। মা কখনো বড়জোর সস্নেহ ভর্ৎসনায় বলেছেন, অত আর দস্যিপনা করিস না, বিন্দু। মেয়েমানুষের একটু নরম সরাম হতে হয়। আদালতে বেরুবার মুখে কিংবা ফেরবার সময় বিধুশেখর কতদিন দেখেছেন সিঁড়ি দিয়ে দুদ্দাড় করে নেমে যাচ্ছে বিন্দুবাসিনী কিংবা নীচের দালানে বসে গঙ্গানারায়ণের সঙ্গে তর্ক করছে, তিনি সকৌতুকে হেসেছেন। বিন্দুবাসিনী তার পিতার মুখে কখনো কঠোর কথা শোনেনি।
মাত্র সেই এক শনিবার সব কিছু ওলোট-পালোট হয়ে গেল। আচার্য মশাই বললেন, তিনি আর বিন্দুবাসিনীকে পড়াবেন না। কারণ, বিন্দু স্ত্রীলোক হয়ে গেছে। বিন্দু পরে হিসেব করে দেখেছে, সেই দিনটিতে তার বয়েস হয়েছিল চোদ্দ বছর সাত মাস এগারো দিন। ঠিক চোদ্দ বছর সাত মাস এগারো দিনের দিনই এই দুনিয়ায় সব মেয়েরা স্ত্রীলোক হয়ে যায়? সেই রাতে বিধুশেখরও গম্ভীরভাবে বলেছিলেন, মা বিন্দু, তুমি আর নীচতলায় যখন তখন যেও না। পণ্ডিতমশাইয়ের কাছে তোমার আর পাঠ নেবারও দরকার নাই, তাতে লোকাপবাদ হবে। ভগবত পাঠ করতে শিকোচো, চণ্ডী শিকোচো, তাই যথেষ্ট। এখন বড় হয়েচো, এবার জনর্দিনের পাদপদ্মে মন দাও।
রাগে অভিমানে বিন্দুবাসিনীর ইচ্ছে হয়েছিল নিজের শরীরটাই কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ফেলতে। সে কেন স্ত্রীলোক হলো? ঈশ্বর কেন এত নিষ্ঠুর যে তার বয়েস বাড়িয়ে দিলেন?
বিধুশেখরের মুখের কথাই আদেশ। পরদিনই বিন্দু দেখলো তার ঘর থেকে সব বইপত্র উধাও হয়ে গেছে। কয়েক খণ্ড মহাভারতের হাতে লেখা পুঁথি, আর শ্রীরামপুরে ছাপা কিছু বাঙলা সংস্কৃত বই সংগ্রহ করেছিল বিন্দু, সেগুলি ছিল তার প্রাণাধিক প্রিয়! সেগুলি হারিয়ে সে যেন নিঃস্ব হয়ে গেল।
বিধুশেখরের নীতিজ্ঞান অতি কঠোর। কুলশ্রেষ্ঠ কুলীন ঘরে জন্মেও তিনি একাধিক দার পরিগ্রহ করেননি। সন্ধ্যেবেল ল্যাণ্ডো হাঁকিয়ে তিনি বারযোষিৎ সংসগের জন্য বের হন না কোনোদিন। আবাল্য সুহুৎ রামকমল সিংহ কয়েক বার কূটকৌশল করেও পারেননি বিধুশেখরকে তাঁর স্মৃর্তির স্থানে নিয়ে যেতে। অবশ্য বিধুশেখরও পারেননি রামকমলকে পণ্যা রমণী-গমন থেকে নিবৃত্ত করতে।
দুই বন্ধুর ব্যক্তিত্বে বৈপরীত্য অনেক। রামকমল সিংহ দুর্বল ও উদার, বিলাসী ও পরনির্ভরশীল। তাঁর সবচেয়ে বেশী নির্ভরতা ভাগ্যের ওপরে। অপর দিকে বিধুশেখর তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন ও হিসেবী, তাঁর ললাট ও চিবুকে রয়েছে আত্মবিশ্বাসের ধারালো রেখা। খাদ্য-পানীয়ে অসংযমের জন্য রামকমলের শরীর, মধ্যবয়েসে পৌঁছোবার আগেই, শিথিল ও মেদবহুল। বিধুশেখর জীবনে কখনো সুরা স্পর্শ করেননি, এবং তাঁর ঋজু দীর্ঘ শরীরখানি এখনো তলোয়ারের মতন ঝকঝকে। সুরার কারণেই বিধুশেখর রামমোহন রায়ের ওপর চটা। রামমোহন সুদূর ইংলণ্ডে দেহরক্ষা করার পরই এদেশে তাঁর নামে অনেক সোরগোল ওঠে। জীবিতকালে যারা রাজার বিরোধী ছিল, তারাও অনেকে এখন মত বদলে নিয়েছে। কিন্তু বিধুশেখর তাঁর মতবাদ থেকে এখনো টলেননি। কোনো মজলিসে রামমোহনের প্রসঙ্গ উঠলে সবাই যখন তাঁর প্রশস্তি শুরু করে, তখনো বিধুশেখর জিবে আফসোসের শব্দ করে বলেন, কিন্তু রাজা ভদ্রসমাজে মদের স্রোত বাহায়ে দেওয়াটা ভালো কলেন কি? আমার বিবেচনায় শিক্ষিত ব্যক্তিদের এমত ব্যবহার উচিত হয় না। রাজা নিজে সেয়ানা ছিলেন, অল্প পানে সংযম রক্ষা কত্তেন, কিন্তু অপরে তাহা পারে কি? রাজা ফেসিয়ান চালু করে দিলেন, এখন দেখ পথে পথে মুক্তকচ্ছ মাতালরা গড়াগড়ি যায়।
রামকমল এ সব শুনে হাসতে হাসতে বলেন, বিধু, তুমি তো এ রসের মর্ম বুঝলে না! একদিন না। হয় বোতল টেনে গড়াগড়ি করেই দ্যাকো না! দোকবে, তাতেও সুখ আচে!
হাত নেড়ে রামকমলের কথাটা নিতান্ত তুচ্ছভাবে অগ্রাহ্য করে বিধুশেখর অপ্ৰসন্নমুখে বলেন, তোমরা যত ইচ্ছে রাজার গুণগান কত্তে চাও করো, আমি তাঁকে সমর্থন করতে পারি না। সংস্কৃতকে হেয় করে রাজা যে ম্লেচ্ছ বিদ্যা চালু করে গেলেন, তার ফল ভালো হবে বলতে চাও? দুপাত ইংরিজি পড়েই ছেলেগুলান বাপ-পিতোমোর অবাধ্য হয়ে যাচ্চে। কী কুক্ষণেই যে রাজার সঙ্গে ঐ খরগোশটার বন্ধুত্ব হলো!
অন্য একজন তখন বলেছিল, বিধুভায়া, ঐ ইংরিজির জন্য তুমিও তো বিলক্ষণ দশ টাকা উপায় কচ্চো!
কয়েক বছর আগে আদালতে সরকারীভাবে ফাঁসীর বদলে ইংরেজি চালু হয়েছে। বিধুশেখর ফাঁসীতে কৃতবিদ্য ছিলেন, ইদানীং এক ফিরিঙ্গি শিক্ষক রেখে কাজ চালানো গোছের ইংরেজি শিখে নিয়েছেন।
এত গরমিল সত্ত্বেও কোনো এক অনিৰ্দেশ্য কারণে বিধুশেখর ও রামকমলের মধ্যে এক গভীর অন্তরের টান রয়েছে। সুখে-সঙ্কটে, আপদে-আহ্লাদে দুজনে সব সময় পাশাপাশি থাকেন। বিষয়কর্মের ব্যাপারে বিধুশেখরের পরামর্শ ছাড়া রামকমল এক-পা চলেন না। সমবয়েসী হলেও রামকমলের প্রতি বিধুশেখরের ব্যবহার অনেকটা অনুজের মতন। অনেক দিন আগে বারানসী থেকে আগত এক জ্যোতিষী বলেছিল, রামকমল সিংহ অল্পায়ু হবেন। সেই জ্যোতিষী-উক্ত নির্দিষ্ট সময় সীমা পার হয়ে এসেও রামকমল এখনো বেঁচে-বর্তে আছেন যদিও কিন্তু একটা সিরসিরে মৃত্যুভয় প্রায়ই তাঁর বুকে এসে ধাক্কা মারে। সেইজন্য তিনি আগে থেকেই বন্ধুকে বলে রেখেছেন, আমি চক্ষু মুদলে তুই-ই তো আমার সংসারের ভার লবি, বিধু। যে কদিন আছি, তোর বকলমাতেই আছি।
সত্যই, রামকমলের সংসারের বিলি ব্যবস্থার ভার অনেক দিনই বিধুশেখরের হাতে। সিংহ-বাড়িতে কোনো দাস-দাসীর চুরি করা ধরা পড়লেও সালিশীর জন্য বিধুশেখরের ডাক পড়ে। বিধুশেখরেরও এমন অভ্যোস হয়ে গেছে যে সময় পেলেই তিনি ও বাড়িতে চলে যান। ও বাড়ির বৈঠকখানায় তাঁর জন্য পৃথক আলবোলা রাখা আছে। তাঁর স্ত্রী সৌদামিনী মাঝে মাঝে অনুযোগ করেন, তুমি তো বন্ধুর সংসার নিয়েই মেতে আচে, নিজের সংসারের ভালোমন্দ কিছুই দেকো না!
এ অনুযোগ অসত্য। নিজের সংসারের প্রতিও যে বিধুশেখরের তীক্ষ্ণ নজর আছে, তার প্রমাণ তিনি দেন সঠিক সময়ে। যেমন বিধবা কন্যা বয়স্থ হয়েছে বলে একদিনেই তিনি তার যথেচ্ছ ঘোরাঘুরি এবং পড়াশুনো বন্ধ করে দিলেন।
বিধুশেখর নিজে নির্দেশ দিয়েছেন, একাদশীর দিন বিন্দুবাসিনী যেন কোনো অব্রাহ্মণের মুখ না দেখে। বাড়িভরা দাস-দাসী। বাইরের লোকেরও সব সময় আনাগোনা, সেইজন্য ঐ দিনটা সৰ্বক্ষণ ওর পক্ষে ঠাকুরঘরে থাকাই শ্ৰেয়।
আগে কখনো বিন্দুবাসিনীর এমন খিদে পায়নি, এত তেষ্টা পায়নি। ক্ষুধা তৃষ্ণা ছাড়িয়েও তার শরীরে জ্বলতে থাকে রাগ। সেই রাগে তার চোখ দুটি বন-বিড়ালীর মতন ঝকঝাঁক করে!
একাদশীর দিন বিন্দুবাসিনী আগে পড়াশুনো নিয়ে ভুলে থাকতো। বিশেষত এই দিনটি ছিল মুগ্ধবোধ মুখস্থ করার পক্ষে আদর্শ। কঠিন ব্যাকরণের নিয়মের মধ্যে মন নিবিষ্ট করে রাখলে মন আর অন্য কিছু চিন্তা করার সুযোগ পায় না। এখন বিন্দুবাসিনীর সারাদিনব্যাপী এক আগ্রাসী শূন্যতা।
গঙ্গানারায়ণও আর সেইদিন থেকে বিশেষ আসে না। শিবরাম আচার্যের কাছে সেও পাঠ নেওয়া বন্ধ করেছিল, তারপর আচাৰ্যমশাই তো পাকাপাকিভাবে চলে গেলেন শ্ৰীরামপুরে। কখনো সখনো গঙ্গানারায়ণ এলেও নীচতলা থেকে ওপরে ওঠে না। এ-বাড়িতে তার অবারিত দ্বার। সে কি ওপরে এসে দেখা করে যেতে পারে না বিন্দুবাসিনীর সঙ্গে? অকৃতজ্ঞ! এখন সে তার সহপাঠী বন্ধুদের নিয়েই মত্ত। অথচ এক সময় লাজুক মুখচোরা ছিল, বিন্দুবাসিনী ছাড়া আর কারুর সঙ্গে ভালো করে মিশতেই পারতো না। আজকাল সে নিশ্চয়ই লুকিয়ে চুরিয়ে মদ খায়, তাই ভয়ে বিন্দুবাসিনীর কাছে আসে না। বিন্দুবাসিনী সংবাদ প্রভাকরে পড়েছিল, হিন্দু কলেজের সব ছাত্রই নাকি ইদানীং মদ খেয়ে দেখানো-পনা করে। অথচ গঙ্গানারায়ণ বিন্দুবাসিনীকে ছুঁয়ে শপথ করেছিল যে সে কখনো সুরা পান করবে না। না রাখতে পারলে তেমন শপথ করা কেন? বিন্দুবাসিনী তাকে তকে আছে, গঙ্গানারায়ণকে একদিন না একদিন তো সামনাসামনি পাবেই, সেদিন সে গায়ের ঝাল ঝেড়ে নেবে।
গঙ্গানারায়ণ আগে বিন্দুবাসিনীর সঙ্গে তর্ক করতো, এখন মাঝে মাঝে সে এ-বাড়িতে এসে বিধুশেখরের সঙ্গে তর্কযুদ্ধে মাতে। এখন তার মুখে দিব্যি বোল ফুটেছে। রামকমল সিংহকে সে অতিরিক্ত সমীহ করে বলে তাঁর সঙ্গে প্ৰাণ খুলে কথা বলতে পারে না। কিন্তু বিধুশেখরের সঙ্গে বাল্যকাল থেকেই তার খুব সহজ সম্পর্ক। বিধুশেখর এক সময় নিজের মেয়েদের সঙ্গে গঙ্গানারায়ণকেও বসিয়ে কত স্তোত্ৰ মুখস্থ করিয়েছেন। শৈশবে কতদিন কোলে কাঁধে নিয়ে আদর করেছেন ওকে। আজ সেই বিধুশেখরের সঙ্গে গঙ্গানারায়ণ নাস্তিকতা বিষয়ে আলোচনা করে। রামকমল সিংহ বিষয় তদারকীতে আবার মফঃস্বলে গেছেন। এদিকে গঙ্গানারায়ণের সহপাঠী বন্ধুর কনিষ্ঠ ভগ্নীর বিবাহ হবে ফরাসডাঙ্গায়, সেখানে যাবার জন্য বন্ধুরা সবাই তাকে পেড়াপোড়ি করছে। খুব। এ ব্যাপারে জননী বিম্ববতীর কাছ থেকে অনুমতি নেওয়াই যথেষ্ট নয়, তাই গঙ্গানারায়ণ এসেছিল বিধুশেখরের মতামত জানতে।
বিধুশেখর আপত্তি করলেন না। তবে যাতায়াত ব্যবস্থা সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ সংবাদ নেবার পর সিদ্ধান্ত জানালেন যে ও বাড়ির গোমস্তা দিবাকরীও তার সঙ্গে যাবে। ব্যাপারটা গঙ্গানারায়ণ খুব পছন্দ না করলেও মেনে নিতে হলো।
কথায় কথায় বিধুশেখর গঙ্গানারায়ণেরও বিবাহ প্রসঙ্গ তুললেন। হাসতে হাসতে বললেন, অন্যের বের নেমন্তন্ন খেয়ে বেড়াচ্চিস, এবার তো তোর বোটাও দিতে হয় রে, গঙ্গা। আর তো দেরি করা যায় না। বয়েস কত হলো?
গঙ্গানারায়ণ লজ্জায় মাথা নিচু করে রইলো।
বিধুশেখর বললেন, দাঁড়া, আমিই হিসাব করে বলে দিই। ভাদ্র মাসে জন্ম, তাহলে এই ভাদ্রে হলো গো-কত? সতেরো! অ্যাঁ? ষোলো পার হয়ে গেছে। এখনো বে হয়নি! লোকে বলবে কি? তোর বাপেরও যেমন ইস নেই, সবই আমার ওপর চাপায়! কন্যেপক্ষ তাড়া দিচ্চে, এখনো দিন ধাৰ্য হলো না! গত সালে তো ওদের বাড়িতে কালাশৌচ গ্যালো, তারপর তো এক বচর পার হয়ে গ্যাচে, যায়নি? আফসোস করিসনি, এই শীতেই তোরটা লাগিয়ে দেবো!
আফসোস কি, গঙ্গানারায়ণের মনের মধ্যে গুনগুন করছে প্রতিবাদ, কিন্তু সেটা সে মুখ ফুটে বলতে পারবে না।
—বেটা হয়ে গেলে তারপর তুই বিষয়কম্মে লেগে পড়। কলেজ-টালেজ আর যেতে হবে না। যা হয়েচে, যথেষ্ট হয়েচে!
গঙ্গানারায়ণ চমকে উঠলো। বিধুশেখর বিন্দুবাসিনীর পড়াশুনো বন্ধ করে দিয়েছেন। এবার কি তার পড়াও বন্ধ করতে চান? এর প্রতিবাদ করতেই হবে, চোখ-কান বুজে না হয়। বিয়েটা করে ফেলা যাবে। বিয়ের সঙ্গে কলেজ ছাড়ার সম্পর্ক কী?
—খুড়োমশাই, আমার যে এখনো দু ক্লাস পড়া বাকি আচে?
—যা হয়েচে যথেষ্ট হয়েচে! ইংরেজিতে অ্যাসে লিখতে শিখিচিস, বলতে কইতে শিখিচিস, আর কলেজে গিয়ে কী হাতি ঘোড়া শিখবি? না উটুকো লোকদের মতন তোকে চাকরি খুঁজতে হবে? গঙ্গানারায়ণ জানে যে এ ব্যাপারে বিধুশেখরের সঙ্গে তর্ক করে লাভ নেই। উনি যদি এক কথায় না। বলে দেন, তাহলে আর সে কথা ফেরাবার উপায় থাকবে না। সে অনুনয়ের পথ নিল।
—আপনি অনুমতি দিন, খুড়োমশাই। আমি আরও দু বছর পড়বো।
–শোনা গঙ্গা, আমার যখন চোদ্দ বছর বয়েস, তখন আমি শেরউড সাহেবের সেরেস্তায় কাজ নিয়িচিলুম। তখন থেকে রোজগার করি। তোর বাপ রামকমলের বয়েস যখন পনেরো, তখন থেকেই সে হাজার হাজার টাকার কারবার করে। আর তোর বয়েস এখন সতেরো, আজও তুই ছাড়া গোরুর মতন ঘুরে ঘুরে বেড়াস।
—আপনাদের আমলে তো লেখাপড়ার এত রেওয়াজ ছিল না।
—আমরা তোদের চেয়ে কম লেখাপড়া করিচি বলতে চাস?
—আজ্ঞে না! আপনারা নিজে নিজে শিক্ষিত হয়েচোন। খুড়োমশাই, আপনি যদি রিচার্ডসন সাহেবের লেকচার শুনতেন, তাহলে বারবার না গিয়ে কিছুতেই থাকতে পারতেন না।
—রিচার্ডসন? সেই মাতালটা? তার ওপর ছেলেদের পড়বার ভার! স্কুল সোসাইটি যে ওকে এখনো রেখেচে, সেটাই এক কলঙ্ক!
—না, না, উনি এখন নেই। মান্দ্ৰাজ চলে গেছেন।
–হাঃ হাঃ হাঃ! তাহলে আর টান কিসের? শোন বাবা, আমি সত্যি কথাটা বলি। তোদের ঐ কালেজী শিক্ষা যে ছেলেগুলানের মাথা বিগড়েচ্চে, এ আমার মোটেই পছন্দ হয় না। ধর্মশিক্ষা ছাড়া আবার মানুষের শিক্ষা হয় না কি? সাদা খরগোশটা যেদিন থেকে খয়েরি হলো, সেদিন থেকেই দেশের সর্বনাশ শুরু হলো।
—সাদা খরগোশ? ও, হেয়ার সাহেব!
—তুই এসেছিলিস ঘড়ির ব্যবসা করতে, তাই কর। সাহেবসুবো লোক, তোর অত নেটবদের সঙ্গে মেলামেশা করারই বা কী ঠ্যাক? দিশী লোকদের লেখাপড়া শেখাবার জন্যই বা তোর অন্ত মাথা ব্যথা কেন? এ-দেশের লোক নিজের ভালো বোঝে না? হেয়ার যেদিন নিজের ঘড়ির ব্যবসা তুলে দিল গ্রে সাহেবের হাতে, সেদিন এক ইংরিজি কাগজে লিখেচিল, ওলড হেয়ার টার্নড গ্রে। লেখাপড়া তো লবডঙ্কা, আসলে নাস্তিকতা প্রচারের চেষ্টা। আমি বুঝি না? থাক। ওসব কতা। আমরা তো বুড়ো হচ্চি, এখন তো তুই আমাদের একটু দায়দায়িত্ব থেকে নিষ্কৃতি দিবি। কোনদিন চোখ বুজবো…তোর বাপ যা বিষয়সম্পত্তি রেখে যাবে, তাতে তোদের কয়েক পুরুষ অন্তত ইংরেজের গোলামী কত্তে হবে না।–তবে আর ঐ ইংরেজের শিক্ষা নিয়ে অত মাতামাতি কেন? আস্তে আস্তে কাজ বুঝে নেএইসব কথা যখন হচ্ছিল, তখন দোতলার বারান্দা থেকে শুনছিল বিন্দু। বাবা গঙ্গারও পড়াশুনো বন্ধ করে দিতে চান শুনে তার আনন্দ ও বিষাদ দুরকমই বোধ হচ্ছিল। এক সময় সে দেখলো, গঙ্গা ম্লান মুখে বেরিয়ে যাচ্ছে, একবারও ওপর পানে চাইলো না।
ঠাকুরঘরের মেঝেতে শুয়ে শুয়ে বিন্দুর এই রকম নানা কথা মনে পড়ে। কিছুতেই তার ঘুম আসে না। তার মনে হয়, সে যেন বিশ্ব পরিত্যক্ত। অসহ্য তৃষ্ণায় গলাটা খরখর করে। বুকটা যেন যে-কোনো মুহূর্তে ফেটে যাবে। জানলায় বসে দুটি কাক অবিশ্রান্তভাবে ডেকে যাচ্ছে। সেই কা-কা ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। বিন্দুবাসিনী মুখখানা উঁচু করতেই তার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়তে লাগলো। কেন সে কাঁদছে, জানে না।
কান্নারও সীমা আছে। নির্জন ঘরে বসে কেউ তো অবিশ্রান্তভাবে কেঁদে যেতে পারে না। এক সময় বিন্দু চোখ মুছলো। তারপর সে দেখলো মেঝেতে কয়েকটি জলের ফোঁটা। কোনো কিছু না চিন্তা করে বিন্দু লোভীর মতন সেই জল চাটতে লাগলো। ক ফোঁটা তো জল, জিভটাও ভিজলো না তাতে, শুধু একটু নোনতা স্বাদ। তবু পরীক্ষণেই বিন্দু আঁচল দিয়ে ঘষে ফেললো জিভটা। তার কি পাপ হলো? একটু জল থেয়ে ফেলেছে। নিজেরই চোখের জল, তা খেলে কী পাপ হয়?
–বিন্দু! বিন্দু!
বিন্দুবাসিনী আমূলভাবে চমকে উঠলো। কে? কে ডাকছে তাকে? খানিকটা চেনা, খানিকটা অচেনা কণ্ঠস্বর। এ সময় কোনো পুরুষমানুষ তো তাকে ডাকবে না।
বিন্দু ধড়মড় করে উঠে জানলার সামনে দাঁড়ালো। এ দিয়ে বাইরের পথ দেখা যায় না। এদিকে তাদের বাগান, গোয়ালঘর আর একটু দূরে পুকুর। পুকুর ধারের জামরুল গাছটা থেকে গুড়ো ওঁড়ো ফুলের রেণু ঝরে পড়ছে, এদিকে কেউ নেই।
দরজা খুলে বিন্দু বাইরে এলো। সিঁড়ির কাছে এসে উঁকি মারলো নীচে। কেউ নেই, সব সুনসান। বিধুশেখর বাড়িতে নেই, ইচ্ছে করলে সে এখন নীচে যেতে পারে। কিন্তু তার অভিমান আছে, সে যাবে না।
ঠাকুরঘরে ফিরে আবার শুয়ে পড়তেই বিন্দু ফের শুনতে পেল সেই ডাক। এবার আর একটু ব্যাকুল গলায়, বিন্দু! বিন্দু!
এই দারুণ নিদাঘের মধ্যেও বিন্দুর সারা শরীরে যেন শীতের অনুভূতি হলো। প্রতিটি রোমকূপে সেই স্পর্শ ঠিক এক ঝলক। বিন্দু চিনতে পেরেছে কণ্ঠস্বর। এ তো অঘোরনাথ। কতদিন আগে, মনে হয় যেন বহু যুগ আগে, রাজপুর গ্রামে ঐ রকম গলায় যেন একজন ডাকতো বিন্দুকে। মালকোঁচা দিয়ে কাপড় পরা, খালি গা, গোরাদের মতন গায়ের রঙ, মাথায় বাবরি চুল, চোদ্দ বছর বয়েসের এক কিশোর। ঐ চেহারাটাই শুধু মনে আছে বিন্দুর। ঐ চেহারা, ঐ কণ্ঠস্বর তার স্বামী অঘোরনাথের।
গাছে চড়ায় ওস্তাদ ছিল অঘোরনাথ। পেয়ারা গাছের মগডালের ওপর দাঁড়িয়ে সে তার বালিকা বধুর দিকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারতো পাকা পেয়ারা।
সে ডাকছে? কিন্তু সে তো নেই। বিন্দু নিজে দেখেছে, মাত্র দেড়দিনের ভেদবমিতে তাকে ছটফটিয়ে মরে যেতে। সে কি ফিরে এসেছে বিন্দুর টানে, সে কি বিন্দুকে নিয়ে যেতে চায় মৃত্যুর অদৃশ্যলোকে। বিন্দু ভয় পেয়ে মুখ ঢেকে ফেললো। তার ইচ্ছে করলো, ছুটে গিয়ে মায়ের কোল ঘেঁষে শুয়ে পড়তে। ছেলেবয়েসে যেমন যেত। কিন্তু তীব্র অভিমান তার ভয়কেও ছাপিয়ে গেল। সে আবার কাঁদতে লাগলো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে।
এই কান্নাও আবার এক সময় থামে। এবার আর সে নিজের অশু পান করলো না, বরং জ্বলন্ত চোখে তাকালো জনাৰ্দন মূর্তির দিকে। এক বিঘৎ পরিমাণ সোনার মূর্তি, শিল্পীর কারিগরিতে তার ওষ্ঠাধর সব সময় হাস্যময়। যে মানুষ বা যে মূর্তি সব সময় হাসে, তার মতন নিষ্ঠুর বুঝি আর কিছু হয় না। বিন্দুর সারা শরীরে বেরুচ্ছে ক্রোধের ছটা। সে খানিকক্ষণ একদৃষ্টি চেয়ে রইলো সেই মূর্তির দিকে।
অঘোরনাথ ডাকলেই বা বিন্দু কেন তার সঙ্গে যাবে মৃত্যুর অদৃশ্যলোকে। বাবা বলেছেন, এখন থেকে জনাৰ্দনই তার স্বামী। বিন্দু ফুলমালার স্তূপ থেকে সেই মূর্তিটা তুলে নিল হাতে।
বুকে কঠিন স্বর্ণমূর্তিটি চেপে ধরে বিন্দু ব্যাকুল গলায় বললো, তুমি আমায় কী দেবে? বলো, কী দেবে তুমি আমায়?