০৭. বিচ্ছেদ

বিচ্ছেদ

বহু কারণে দাম্পত্য অচল অবস্থায় পৌঁছতে পারে। আগেই দেখেছি পরিবার বা সমাজের প্রতিকূল অভিমত, পারিবারিক দায়িত্ব সম্বন্ধে মতদ্বৈধতা, স্ত্রীর পরিবারে স্বামীর সম্বন্ধে ঔদাসীন্য বা স্ত্রীর প্রতি শ্বশুরবাড়ির অত্যাচারে স্বামীর নিষ্ক্রিয়তা, সন্তান চাই কিনা, কটি চাই, কখন চাই সে বিষয়ে মতানৈক্য, যৌনমিলনে নানা অসন্তুষ্টি, আর্থিক অসাচ্ছন্দ্য, আদর্শগত পার্থক্য, রাজনীতিবোধে দ্বিমত, রুচিদ্বৈধতা, ছোটখাট ব্যাপারে দুটি স্বভাবের নানা পার্থক্য যা স্ফীত হতে হতে দুরতিক্রম্য হয়ে ওঠে— এ ছাড়াও নানা খুঁটিনাটি নিয়ে পরস্পর-বিমুখতা কখনও কখনও এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে তার একমাত্র সমাধান রূপে দেখা দেয় বিবাহ বিচ্ছেদ। কত পুরুষ ও নারীকে বলতে শোনা যায়, ‘নাঃ, সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল। ওর সঙ্গে আর এক দণ্ড থাকতে পারব না। ওই সংসারে দম বন্ধ হয়ে আসছে।’

এ অবস্থা কাল্পনিক নয়। খুব বেশি দাম্পত্যে পরস্পরের প্রতি যথার্থ ঔদাসীন্যের সম্পর্ক স্থায়ী হয় না, যদি না দাম্পত্য সম্বন্ধে তাদের প্রত্যাশাই কম থাকে। যে সম্পর্কের ভিত্তি প্রেম সেখানে প্রেমের মৃত্যু ঘটলে প্রায়ই দেখা যায় বিদ্বেষ এবং তখন পরস্পরের সান্নিধ্য অসহ্য হয়ে ওঠে। অনেক দম্পতি অবশ্য এ অবস্থায় মাথা ঠাণ্ডা রেখে হিসেব করে দেখেন সন্তানের জন্যে অথবা সন্তান না থাকলে পরিবার বা সমাজের বিরূপ প্রতিক্রিয়া এড়াবার জন্যে দাম্পত্যের কাঠামোটা বজায় রেখে চলাই ভাল। কখনও বা এর মধ্যে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য, সুবিধে, ইত্যাদিরও হিসেব হয়। অনেক বড় চাকরিতে বড় কর্তাদের স্ত্রীর একটা আবশ্যিক ভূমিকা থাকে পার্টিতে; অর্থাৎ দাম্পত্য অটুট থাকার চেহারাটা বজায় রাখার বৃত্তিগত প্রয়োজন থাকে; সে সব ক্ষেত্রে স্ত্রী রাজি থাকলে অভিনয়টা চলে। আবার কখনও প্রেমের মৃত্যু ঘটলেও, আবেগের দিকটা ছাড় হয়ে গেলেও, যৌন সম্পর্কের দিকটা স্তিমিত হয়ে এলেও, বা না হলেও, এক ধরনের একটা মমতা, পারস্পরিক দায়িত্ববোধ, কখনও উভয়েরই কখনও বা একজনের প্রবল সন্তানবাৎসল্য বিচ্ছেদ ঠেকিয়ে রাখে। যেখানে এ মনোভাব অনুপস্থিত সেইখানেই বিচ্ছেদ অনিবার্য হয়। আর একটা কারণে ইদানীং বহু সংসারে দাম্পত্য কলহ বাড়ছে, সেটা হল সংসারে গৃহকর্ম একা মেয়েটিকেই সামলাতে হয়। উচ্চবিত্ত পরিবারের পক্ষে অত্যধিক পারিশ্রমিক দিয়ে লোক নিযুক্ত করে এবং গৃহকর্ম নির্বাহ করা সম্ভব। নিম্নবিত্ত পরিবারে ধরে নেওয়াই হয় যে বাইরে কাজ করলেও আর্থিক অসঙ্গতির জন্যে গৃহকর্মে বাইরের লোকের সাহায্য পাওয়া সম্ভব নয়; তাই সমস্ত চাপই বধূটির এবং একটু বড় ছেলেমেয়ের ওপরে পড়ে। মধ্যবিত্ত মানসিকতাটা ভৃত্যনির্ভর, কাজেই এখন বাইরে চাকরি করে যে বধূটি, সে জানে বাড়ি ফিরে অধিকাংশ গৃহকর্ম তাকেই সমাধা করতে হবে। এখনও মধ্যবিত্ত পুরুষের মানসিকতাটা এতটা মার্জিত নয় যে স্ত্রীকে গৃহকর্মে সাহায্য না করাটা যে পুরুষের পক্ষে যথার্থ পৌরুষের অভাব এবং মানসিক দৈন্য, সংকীর্ণতা ও স্বার্থপরতাই সূচিত করে তা উপলব্ধি করবে, এবং লজ্জা বা অপমান বোধ করবে এবং গৃহকর্মে স্ত্রীর সঙ্গে সমান ভাবে হাত লাগাবে। দোকানবাজার, বাসনমাজা, শিশুর সর্বাঙ্গীণ পরিচর্যা করা ঘরমোছা, ইত্যাদি আনুষঙ্গিক সমস্ত গৃহকর্মে সমান অংশ নেওয়াতেই যে পুরুষটির মানবিক মর্যাদা রক্ষিত হয়, অন্যথা যে সে মানুষ হিসেবে হেয় বলে প্রতিপন্ন হবে এ কথা স্মরণ রেখে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এগিয়ে এসে স্ত্রীর সঙ্গে সমানে সব কাজ করা উচিত। খুব বিরল হলেও এর দৃষ্টান্ত ইদানীং কিছু আছে এবং সুখের বিষয়, ধীরে ধীরে হলেও এ দৃষ্টান্ত বাড়ছে। হয়তো এর একটা কারণ হল, কিছু কিছু ভারতীয় পাশ্চাত্য দেশে গিয়ে এ ধরনের দাম্পত্য সাহচর্য দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। আবার যাদের ‘অন্তজ্য’ বলে ঘৃণা করা হয় তেমন নিচু জাতের মধ্যে এমন উদাহরণ দেখতে পাওয়া যায়।

এ মনোভাব এবং গৃহকর্মে সাহায্যের এ উদ্যম স্বাভাবিক ভাবেই আসে যদি দাম্পত্য হয় প্রেমনিষ্ঠ। ভালবাসার মধ্যেই নিহিত থাকে সহানুভূতি এবং তা থাকলে স্ত্রীর কষ্ট লাঘব করার জন্যে স্বামীর স্বতঃউৎসারিত উৎসাহ আসবে। যেখানে মৌলিক ভালবাসার অন্তরালে থাকে পুরুষের মর্যাদা সম্বন্ধে বাসি বস্তাপচা ধারণা, যার বশে পুরুষ কর্মস্থল থেকে ফিরে এসে কর্মক্ষেত্র থেকে ফেরা স্ত্রীকে চায়ের ফরমাস করে এবং সিগারেট টানতে টানতে চেয়ে দেখে ক্লান্ত স্ত্রীর ফের একদফা পরিশ্রমের ভূমিকা, সেখানে সে স্বামী সিনেমার টিকিট বা শাড়িগয়না দিয়ে ভোলাবার চেষ্টা করলেও স্বামীর স্বার্থপর নিষ্ক্রিয় আলস্য দেখে স্ত্রীর মনে যে স্বাভাবিক অভিযোগ পুঞ্জিত হতে থাকে, সেটা গভীর ক্ষোভে পরিণত হয়, কখনও বা ফেটে পড়ে আক্রোশে। সে দিন দারুণ দুঃখদিন। স্বামী নিশ্চিত জানে যে, স্ত্রী স্বামী এবং সন্তানদের অভুক্ত রাখতে পারবে না; কাজেই গৃহকর্ম পড়ে থাকবে না। পড়ে থাকেও না, কিন্তু তাতে দাম্পত্যের মর্মমূলে যে আঘাত লাগে তার কোনও প্রতিকার নেই। স্ত্রী যদি তখন বোঝে যে তার কষ্টে, পরিশ্রমে, ক্লান্তিতে, ঘরে বাইরে একক পরিশ্রমের গ্লানিতে স্বামী বিচলিত নয়, তা হলে প্রকৃত অর্থে আত্মমর্যাদাজ্ঞানহীন সেই স্বামীর সম্পর্কে তার শ্রদ্ধায় চিড় লাগে এবং ধীরে ধীরে দাম্পত্য ক্লিষ্ট ও কলুষিত হয়। যত্রতত্র ভুল ইংরিজি বলে, বুঝে না বুঝে ইংরিজি ছবি দেখে, ‘মামি ড্যাডি’র বকুনিতে বিগলিত যে অপসংস্কৃতিতে পুষ্ট আজকের মধ্যবিত্ত মানস, তার মধ্যে পাশ্চাত্য প্রভাবের সুস্থ দিকগুলি এখনও পৌঁছল না। তারা চোখ মেলে দেখলো না অধিকাংশ পাশ্চাত্য পরিবারে পুরুষ গৃহকর্মে কোনও গ্লানি বোধ করে না, স্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে বাসন ধোয়, মোছে, রান্নাও করে শিশুর সেবাযত্নও করে। এইখানে যদি এদেশি নারী দাবি করে স্বামী তার পারিবারিক শ্রমের অর্ধাংশ বহন করুক, তবে সেটা তো একেবারেই অযৌক্তিক দাবি নয়। এবং এ সাহচর্য না পেলে যদি তার দাম্পত্যে অতৃপ্তি জন্মায়, তবে তা নিতান্তই স্বাভাবিক। কর্মক্ষেত্র থেকে ফিরেই গেরস্থালির জোয়ারে ‘স্বেচ্ছায়’ নিজেকে যুক্ত করে যে সব নারী তাদের উচ্চকণ্ঠে যে প্রশংসা করা হয় তা সম্পূর্ণ ভাবেই পুরুষের স্বার্থ-প্রণোদিত নীচতার প্রতীক। তার বদলে যদি অকুণ্ঠ প্রশংসা করা হত সেইসব পুরুষের, যারা গৃহকর্মে স্ত্রীর ভার লাঘব করবার জন্যে বহু কাজ স্বেচ্ছায় করে, তবে স্ত্রীই যে শুধু সহানুভূতি ও মানসিক আশ্রয় পেত তাই নয়, দাম্পত্য ছন্দপতন ঘটত না এবং ছেলেমেয়েরাও ভিন্নতর, সুস্থতর একটি মূল্যবোধের পরিবেশে লালিত হত; তারাও বুঝত যে, কোনও শ্রমই মানুষকে, পুরুষকেও— হীন করে না, বরং স্বনির্ভর হতে শেখায় এবং তার একটা নিজস্ব গৌরব আছে। এ ধরনের সহমর্মিতায় দাম্পত্যের মর্যাদা অনেক বাড়ে।

বিবাহ হলেই বিচ্ছেদের প্রশ্ন ওঠে এবং এ প্রশ্ন সঙ্গে নিয়ে আসে বহুতর জটিল সমস্যা; সেই কারণে বিবাহ এবং বিবাহ অনুষ্ঠানটিই বাহুল্য এই বোধে এখন বহু তরুণ তরুণী বিবাহ সম্বন্ধে ক্রমে ক্রমে উদাসীন হয়ে উঠেছে। তাদের মতে যদি প্রেমই হয় বিবাহের ভিত্তি, তবে তার ওপরে ধর্মানুষ্ঠানের গোবরজল ছড়া দেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। বহু শতাব্দী পূর্বে গান্ধর্ব বিবাহকে স্বীকার করে এ দেশের সমাজই তো এ কথা মেনে নিয়েছিল। আইনের সমর্থন সম্বন্ধে এদের মধ্যে কেউ কেউ বলে, ‘আমরা সন্তান চাইনা, যদি কখনও চাই তখন আইনের সমর্থন চাইব সন্তানের বৈধতার জন্যে।’ অন্য কেউ কেউ বলে ‘শিশু কোনও অবস্থাতেই অবৈধ নয়, সংসারে যে এসেছে, রাষ্ট্র তার দায়িত্ব নিতে বাধ্য। পিতামাতা চাইলে এবং পারলে তার ভরণপোষণের দায়িত্ব নেবে, না পারলে রাষ্ট্র নেবে, কিন্তু তাকে অবৈধ বলা চলবে না।’ অর্থাৎ সামাজিক বা আইনের সমর্থিত বিবাহের ছাপ নিষ্প্রয়োজন। ওই ছাপে সন্তান এক ধরনের স্বীকৃতি ও নিরাপত্তা পায় এ কথা তো সত্যই। পিতৃপরিচয়, পারিবারিক পরিচয় শিশুকে এক বৈধ স্বীকৃত নাগরিকের মর্যাদা দেয়। এখন যারা বলছে এটা নিষ্প্রয়োজন, তারা বলছে সর্ব অবস্থাতেই শিশুর ওই মর্যাদা প্রাপ্য, তার অবিবাহিত জনকজননীও যে তার জন্মদাতা জন্মদাত্রী, সেই পরিচয়ই যথেষ্ট, তারা বিবাহিত কিনা সেটা অবান্তর। এ জন্যে এখনও সমাজ যে অবস্থায় আছে তাতে রাষ্ট্রের অ-সমর্থন যথেষ্ট গুরুত্ব পায়। বিবাহ যদিও দুটি মানুষের ব্যক্তিগত সম্পর্ক, তবুও রাষ্ট্রও এতে সক্রিয় ভূমিকা নেয়। মেহতা লিখছেন, ‘বিবাহ হল পরিবার সৃষ্টির সুস্পষ্ট উদ্দেশ্যে নারী ও পুরুষের মধ্যে একটি সংবিধানসম্মত মিলন। এই কারণেই রাষ্ট্র এই মিলনে উৎসাহী এবং এটিকে নিয়ন্ত্রণ করার কর্তব্য নিজে স্বীকার করে নেয়।[১] বিবাহ অর্থাৎ রাষ্ট্রসমর্থিত নারী পুরুষের মিলন থেকে সন্তান এলে একটি পরিবারের সূচনা হয়, যা ধীরে ধীরে পল্লবিত হয়ে বৃদ্ধিলাভ করে। অর্থনৈতিক,

[১. ‘Marriage is a legalized union betwen man and woman entered into with a definite purpose of raising a family. It is because of this purpose that the state is interested in the union and takes upon itself the duty of regulating it.’ Indian Woman, p. 129]

রাষ্ট্রনৈতিক ও সামাজিক একক সেই পরিবার; কাজেই তা যেন সমাজের নির্দিষ্ট ছকের মধ্যে প্রবর্তিত হয় সে স্বার্থ সমাজ তথা রাষ্ট্রেরই। বিবাহ রাষ্ট্রের পক্ষে প্রয়োজনীয়। যারা রাষ্ট্রের ও সমাজের এই ছক অস্বীকার করে, স্বভাবতই রাষ্ট্র তাদের সম্বন্ধে দায়িত্ব নিতে চাইবে না। এঙ্গেলস দেখিয়েছেন, ‘সমাজে বিবাহের দ্বারা যে একটি পারিবারিক একক সংযুক্ত হচ্ছে এতেই’রাষ্ট্রের সন্তোষ এবং এই জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রে বিবাহের একটা স্থান আছে; নতুবা একটি বিবাহের সঙ্গে রাষ্ট্রের সরাসরি প্রত্যক্ষ অন্য কোনও যোগ নেই। যখন দুটি পক্ষ তাদের মিলিত হওয়ার বাসনাকে প্রকাশ্যে জ্ঞাপন করে তখন বিবাহ সংক্রান্ত খুব প্রগতিশীল আইনও তাতেই তুষ্ট হয়।’[২] কাজেই বিবাহের একটা প্রান্তে দুটি ব্যক্তি থাকলেও অপর প্রান্তে পরিবার, এমনকী সমাজকেও অতিক্রম করে নৈর্ব্যক্তিক রাষ্ট্রেরও একটা ভূমিকা লক্ষিত হয়। এই কারণে আদিম যুগে মানুষ যৌনমিলনের ব্যাপারে যে স্বাধীনতা ভোগ করত, এখন আর তার সে স্বাধীনতা নেই। যা তাদের একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার সে আচরণ নিয়ে দম্পতিকে জবাবদিহি করতে হয় রাষ্ট্রের কাছে। রাষ্ট্র খবরদারি করে যেন তার যৌন বা দাম্পত্য আচরণ রাষ্ট্রের কোনও ক্ষতিসাধন না করতে পারে। অথচ যৌন আচরণের অন্য দিকটায় পুরুষের পক্ষে অবাধ স্বাধীনতা: গণিকাগমন, পরস্ত্রীগমন, ইত্যাদির জন্যে তাকে কোথাও জবাবদিহি করতে হয় না। নারীর এ অর্থে কোনও প্রকাশ্য ও যথার্থ বিকল্প ক্ষেত্র নেই যেখানে সে তার অতৃপ্ত যৌনকামনা চরিতার্থ করতে পারে। এই হল রাষ্ট্রিক ও সামাজিক আইনের চোখে নারীপুরুষের বৈষম্যের একটা প্রকাশ। এবং রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে নারীর এই অবনমন হল সামাজিক পরিবেশে নারীর অর্থনৈতিক স্বাতন্ত্র্যের অভাবের ফল— হেতু নয়। অর্থাৎ, ‘অর্থনৈতিক বৈষম্য থেকেই আইনের দৃষ্টিতে এই দু’জনের, নারী ও পুরুষের যে বৈষম্য পূর্বপুরুষের সামাজিক উত্তরাধিকার হিসেবে এসেছে, তা নারীর অর্থনৈতিক নির্যাতনের কারণ নয়, কাৰ্য বা ফল মাত্র।[৩]

[২. ‘As far as marriage is concerned, even the most progressive law is fully satisfied as soon as the parties formally register their voluntary desire to get married.’ Origin of Family, Private Property and the State, p. 211

৩. The inequality of the two (man and woman) before the law which is a legacy of the previous social conditions is not the cause but the effect of the economic operession of woman.’ Origin of the Family, etc. p. 211]

বিবাহিত জীবনে দম্পতির মধ্যে নানা সমস্যা দেখা দেয় যা বিশেষ ভাবে দাম্পত্য জীবনেরই সমস্যা। এ কথা অবশ্যই সত্য যে, যে-কোনও দু’জন মানুষের সম্পর্কের মধ্যেই সংঘাতের ও সমস্যার অবকাশ আছে। বাবা মা ছেড়ে মেয়েদের মধ্যে, ভাইবোনের মধ্যে, মাসি-পিসি-জেঠি-খুড়ির সঙ্গে, ভাইপো-ভাইঝি-বোনপো-বোনঝিদের সঙ্গে, জ্যাঠা-খুড়ো- মামা-মেসোর সংঘাত একটুও অপরিচিত নয়। এমনকী দুই প্রজন্ম পেরিয়েও কখনও কখনও দিদিমা-দাদু, ঠাকুমা-ঠাকুরদার সঙ্গেও নাতি-নাতনির সংঘর্ষ ঘটে থাকে। সে দিক থেকে দেখলে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বিরোধ বা অনৈক্য স্বতন্ত্র কিছু নয়। কিন্তু পৃথিবীর এই একটি মাত্র আত্মীয়তা যা রক্তের সম্পর্কের ওপরে দাঁড়িয়ে নেই। সম্পূর্ণ অনাত্মীয়, রক্তের সম্পর্কে সম্পূর্ণ অসম্পৃক্ত দুটি মানুষকে হিসেব করে পূর্ব পরিকল্পনার ফলে কাছাকাছি আনা হয় বা তারা স্বেচ্ছায় কাছাকাছি আসে। এখানে চেষ্টা করলেও বিবাহোত্তর জীবনের সংঘাত এড়ানো যেত না; খুব মধুর সূচনার পরেও তিক্ততা আসতে পারে এবং অত্যন্ত সাদামাটা ব্যবহারিক সূচনার পরেও গভীর প্রেমের মাধুর্য আসতে পারে। এই একটি মাত্র সম্বন্ধ যার মধ্যে দিয়ে পৃথিবীতে নতুন মানুষ আসে এবং যাকে অবলম্বন করে বহু মানুষ আশ্রয়, সাহচর্য লাভ করতে পারে। অতএব এ সম্পর্কটি যদি প্রেমের ভিত্তিতে এবং কিছু প্রলম্বিত পরিচয়ের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে, যাতে সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ রুচি বা আদর্শের সংঘাত দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা না থাকে, তা হলে এই সম্পর্কটিতে যথার্থ আত্মার আত্মীয়তা গড়ে উঠতে পারে। অবশ্য পরে সম্পর্কটি নষ্ট হওয়ার, অর্থাৎ পূর্বপ্রেমের মৃত্যু ঘটার সম্ভাবনা ঠেকানো যায় না, তবু হয়তো আনুপাতিক ভাবে সে সম্ভাবনা কিছু কমে।

বিবাহে যে দুটি মানুষ কাছাকাছি আসে তারা তাদের দেহ ও মন নিয়েই পরস্পরের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়, এর যে নানা অনুসঙ্গ তা অনেক সময়ে চাপা পড়ে যায় এর আইনগত দিকটির অন্তরালে। ‘বুর্জোয়া ধারণা অনুসারে বিবাহ একটা চুক্তি, একটা সংবিধান সংক্রান্ত ব্যাপার, এবং সত্যিই এ ধরনের ব্যাপারগুলির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এর দ্বারা সারা জীবনের মতো দুটি দেহ ও মনের একটা ব্যবস্থা হয়ে যায়।’[৪] এই সম্পর্কটির নানা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছে, যা অন্য কোনও সম্পর্কেই থাকে না। এই বৈশিষ্ট্যগুলি সমাজে ও পরিবারে বহুধাব্যাপ্ত, বহু গভীরে প্রোথিত এদের মূল এবং জীবনের বহু বিস্তৃত ক্ষেত্রে এগুলির প্রসার। স্বামী স্ত্রী পরস্পরের জীবনে বহু গঠনমূলক বা ধ্বংসমূলক প্রভাব আনতে পারে, যা অন্য কোনও সম্পর্কে কেউই তেমন ভাবে বিশেষ আনতে পারে না। মা বাবার প্রভাব সন্তানের জীবনে নিশ্চয়ই খুব ব্যাপক হতে পারে, কিন্তু এ প্রভাব সন্তানের জন্ম থেকেই শুরু হয়ে দীর্ঘকাল পর্যন্ত চলতে থাকে এবং কিছুকাল পরে প্রত্যক্ষত এ প্রভাব আর থাকে না; সন্তানের স্বতন্ত্র একটি ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে। পারস্পরিক প্রভাবের কালসীমা হ্রস্বতর এবং ব্যতিক্রমী কয়েকটি ক্ষেত্র ছাড়া, এ প্রভাবের গুরুত্বও তেমন বেশি নয়। কিন্তু স্বামী স্ত্রী পরস্পরের জীবনে প্রবেশ করবার পর থেকেই দু’পক্ষই নতুন একটি মানুষের জীবনবোধ, রুচি, আদর্শ, স্নেহমমতার প্রকাশ ও ক্ষেত্র, সহমর্মিতার গভীরতা ও অধিকার এ সব সম্পর্কেই এমন স্পর্শকাতর থাকে যে পারস্পরিক প্রভাব— ভাল, মন্দ অথবা মিশ্র— অতি দ্রুত অনুভূত হয় এবং সে প্রভাব দুটি জীবনের পরিসরে সুদূরপ্রসারী হয়। কখনও কখনও তা অতি তীব্র ভাবে লক্ষিত হয়। ১৭৯২ সালেই মেরি উলস্টোনক্রাফট বলেছিলেন, ‘দুটি লিঙ্গের মানুষ পরস্পরকে নষ্ট অথবা উন্নত করে।’[৫] এই আর একটা কারণেও দাম্পত্যের সামাজিক গুরুত্ব এত বেশি। দুটি মানুষ পরস্পরের নিকটতম সাযুজ্যে এসে ক্রমে ক্রমে নীতিনিষ্ঠ, আদর্শের অনুসারী উন্নততর মানুষে পরিণত হতে পারে, আবার একে অন্যের নীতিভ্রষ্টতার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ক্রমে স্বার্থসংকীর্ণ দুর্জনেও পরিণত হতে পারে। তৃতীয় পরিণাম, অন্য পক্ষের অশুভ প্রভাব থেকে সরে থাকার দুঃসহ নিঃসঙ্গ যন্ত্রণা সারাজীবন বহন করে চলতে বাধ্য হওয়া। যেমন গান্ধারী, হয়তো বা মন্দোদরীও। এই সম্পর্কটি দুটি মানুষকে এত কাছাকাছি আনে যে মনের দিক থেকে সাহচর্য না পেলে সেটা মর্মান্তিক যন্ত্রণারই হতে পারে। এ দুঃখ প্রাকবিবাহ পর্বে নিবারণ করবার কোনও উপায়ই নেই, শুধু যথাসম্ভব একে অপরের চিত্তবৃত্তির সঙ্গে পরিচিত হয়ে জেনে নেওয়া যে দৈনন্দিন জীবনে রুচি, আদর্শ বা মূল্যবোধের সংঘাত অসহ্য হয়ে উঠবে কিনা।

[৪. ‘According to bourgeoies conceptions matrimony was a contract, a legal affair, indeed the most important of all, since it disposed of the body and mind of two persons for life.’ Origin of the Family, etc. p. 216

৫. ‘The two sexes mutually corrupt and improve each other.’ A Vindication of the Rights of Women. p. 153]

এ প্রসঙ্গে দু’টি কথা সত্যি। জীবনের অন্যান্য কিছু সম্পর্কেও আন্তর-বিরোধ দুর্বহ হয়ে উঠতে পারে। তবে ডিভোর্সের মতো প্রকাশ্য এবং কষ্টকর পদ্ধতি ছাড়াও তেমন অধিকাংশ সম্পর্ক থেকেই পরিত্রাণের উপায় আছে। যদি একে অপরের ওপর আর্থিক বা শারীরিক ভাবে নির্ভরশীল হয় (রোগে, পঙ্গুতায় অথবা মস্তিষ্কবিকৃতিতে) তা হলে এ ধরনের মুক্তিও দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠতে পারে। রাষ্ট্র অবশ্য এখন এ ধরনের অনেক পরিস্থিতিতেই দায়িত্ব নিচ্ছে; আশ্রয় এবং/বা চিকিৎসার ব্যবস্থা করাচ্ছে। কিন্তু দম্পতির মধ্যে পরস্পরনির্ভরতার অনুষঙ্গ অনেক বেশি গভীর ও জটিল, ফলে বিচ্ছেদও সেই অনুপাতে দুঃসাধ্য। দ্বিতীয়ত, আইন যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাতে গোড়া থেকেই বিচ্ছেদ অনিবার্য বলে ধরে না নেওয়া হয়। সব কিছুই ভাঙা অনেক সোজা, জোড়া বা জুড়ে রাখা অনেক কঠিন। তাই বহু দম্পতিই আন্তর-দূরত্ব মেনে নিয়েও কাজ-চলা-গোছের একটা আপোষ করে নেন, এতে হয়তো সন্তানরা পারিবারিক আশ্রয় থেকে বিচ্যুত হওয়ার দুঃখটা পায় না। তবে সেটাই যে সব ক্ষেত্রে বাঞ্ছনীয় তা নয়, কারণ স্বভাবে উগ্র বা অসহিষ্ণু বা অত্যন্ত আবেগপ্রবণ হলে অনেক ভাঙা পরিবারে, যে ধরনের কলহ ও উচ্চগ্রামে পরস্পরকে দোষারোপ চলতে থাকে, কখনও বা রুচি ও শালীনতার সীমা লঙ্ঘন করেও— তার মধ্যে যে সন্তান বেড়ে ওঠে সে কি সুস্থ পরিবেশ পায়? এ সব ব্যাপারে অবশ্য প্রত্যেক দম্পতিকে পরিস্থিতি অনুসারে স্বতন্ত্র ভাবে বিচার করে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হবে, কোনও সাধারণ সূত্রই সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

দাম্পত্য জীবনে কোনও বিপত্তি দেখা দিলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীকে দোষ দেওয়া হয়। দাম্পত্য সুখও যেন একা নারীরই হাতে, ‘সে স্বামীর মতের অনুবর্তিনী হলেই গৃহে সুখ থাকে, গৃহাশ্রমের তুল্য কিছুই হয় না যদি নারী স্বামীর বশানুগা হয়।[৬] দাম্পত্য বিরোধে স্বামীর কোনও দায়িত্ব নেই, কারণ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী পুরুষের ছায়েবানুগামিনী হবে এইটেই অপেক্ষিত; নারীর কোনও ব্যক্তিত্ব, মতস্বাতন্ত্র্যের কোনও অবকাশই শাস্ত্র রাখেনি। অথচ সাহিত্য কিন্তু অন্য কথা বলে। গান্ধারী প্রকাশ্য রাজসভায় স্বামীর মতের বিরোধিতা করেছেন, দ্রৌপদী স্বয়ং ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে ধর্ম নিয়েই তর্ক করেছেন। গঙ্গা, শকুন্তলা ও সত্যবতী নিজেদের শর্তে বিয়ে করেন; মহাভারতে শকুন্তলা প্রকাশ্য রাজসভায় দুষ্যন্তকে নানা ভাবে ভর্ৎসনা করেন।[৭]  তার চেয়েও বড় কথা অরুন্ধতী স্বামী বশিষ্ঠকে সন্দেহ করে ত্যাগ করে যান।[৮] অনসূয়া স্বামী অত্রিকে ছেড়ে যান এই বলে যে, ‘আমি কোনও মতেই ওর বশে থাকব না।’[৯] দেবগুরু বৃহস্পতির স্ত্রী তারা স্বামীকে ত্যাগ করে সোমের কাছে গিয়ে তার সঙ্গে বাস করেন। সোমের পুত্র বুধ জন্মানোর বেশ কিছুকাল পরে ওই ছেলেকে নিয়েই বৃহস্পতির কাছে আসেন ও দু’জনে আবার এক সঙ্গে বাস করতে থাকেন।[১০] সুগ্রীবের স্ত্রী তারা বালীর সঙ্গে বাস করার পরে আবার সুগ্রীবের কাছে ফিরে আসেন। এমন আরও বেশ কিছু নিদর্শন আছে যেখানে নারীর আচরণে শাস্ত্রবচনের বিরুদ্ধ সাক্ষ্য পাই সাহিত্যে। এটা জানা যে, সমাজ নারীর কাছে যা প্রত্যাশা করে সেই নিরিখেই শাস্ত্র রচিত হয়, কিন্তু সাহিত্য জনমানসে দীর্ঘকাল সঞ্চরমাণ বহু কাহিনির মধ্যে বেঁচে থাকে, ফলে লিপিবদ্ধ হয়ে যখন তা স্থায়িত্ব লাভ করে তখন শাস্ত্র বচনের সঙ্গে না মিললেও নিজের সত্য সত্তার জোরেই তার পরমায়ু অক্ষয় হয়। তাই অনুজ্ঞা ও আচরণে বৈষম্য থেকে যায়। অনুজ্ঞা বলে স্ত্রীর নিজস্ব মত থাকবে না, সে স্বামী ও তার আত্মীয়স্বজনের নিষ্প্রতিবাদ পরিচর্যা করেই জীবনে চরিতার্থতা লাভ করবে; স্বামীই তার ইহপরকালের প্রভু। ‘স্ত্রী স্বামীর হাতে নিজের সম্পূর্ণ সত্তার ভার দিলেই স্বামী তার জীবনে তাৎপর্য এনে দেবেন।’[১১] এটা এখনও অধিকাংশ সমাজের অনুক্ত প্রত্যাশা। স্বামী তার স্ত্রীর জীবনের একমাত্র প্রভু, যিনি স্ত্রীর সত্তাকে অর্থপূর্ণ করেন। কী ভাবে? তাকে পত্নীর আসনে স্থান দিয়ে। এতে শুধু যে নারীর সহজাত মানসিক ন্যূনতা প্রতিপন্ন হচ্ছে তা নয়, সে ন্যূনতা পূরণের একমাত্র উপায় যে বিবাহ, তাও সংকেতিত হচ্ছে। এই বোধই সহমরণের নির্দেশের মধ্যেও লক্ষ্য করা যায়। এবং সহমরণ শুধু প্রাচীন ভারতবর্ষেই আচরিত হত না, অন্যত্র এর বেশ কিছু দৃষ্টান্ত মেলে। ‘থ্রেসে স্বামীর মৃত্যুর পর তার সমাধির ওপরে তার নিকটতম আত্মীয় স্ত্রীকে বধ করে দু’জনকে এক সঙ্গে সমাধিস্থ করত।[১২] ‘গলদের মধ্যেও স্ত্রীর জীবনমৃত্যুর ওপরে স্বামীর প্রভুত্ব ছিল এবং বিধবার আত্মহনন বাধ্যতামূলক ছিল।’[১৩] বিগত তিন হাজার বছরের যে ইতিহাস পাওয়া যায় তাতে দাম্পত্য সম্পর্ককে বিশেষিত করেছে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব যাতে এ সম্পর্কে স্বামী-স্ত্রী ব্যাপারে একটা রাজাপ্রজা মনোভাব উভয়েই মেনে নিয়েছে। এখনও বহু পরিবারে পুরুষের অনস্বীকার্য শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে নারীর বিশ্বাস আছে। এ বিশ্বাস সে সমাজ ও পরিবারের সুদীর্ঘ বিবর্তনের উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেছে— তার মা-দিদিমা, শাশুড়ি-ননদ প্রতিবেশিনীদের নির্দ্বিধায় বারংবার উচ্চারণের দ্বারা এটা তার মধ্যে অলক্ষ্যে অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে। এই বিশ্বাস ‘শুধুমাত্র স্বামীর লিঙ্গগত বৈশিষ্ট্যকেই প্রাধান্য দিয়ে প্রভুত্বের অধিকার হিসাবে স্বীকার করে স্বামীর অহমিকাকে পুষ্ট করেছে।’[১৪] এ ধারণার পশ্চাতে কার্যকরী আর একটি ধারণা, তা হল নারী মাত্রই পুরুষের তুলনায় হীন। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ পুরুষপ্রাধান্য অক্ষুণ্ণ রাখবার জন্যই এই ধারণাটি সৃষ্টি ও প্রচার করেছে। বৈজ্ঞানিক সমীক্ষায় আজ এ ধারণার ভ্রান্তি ধরা পড়েছে এবং ক্রমেই এটি ভ্রান্ত বলে বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষিত মানসে প্রতিভাত হচ্ছে। স্টুয়ার্ট মিল বলেছিলেন, ‘এ কথা ঠিক নয় যে, লিঙ্গের প্রকৃতিই তাদের বর্তমান কর্মক্ষেত্রে ও (সামাজিক) অবস্থানের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ায়, এবং তাদের এগুলির উপযুক্ত করে তোলে।’[১৫] অথচ লিঙ্গগত বৈষম্য যে পরিবারে ক্ষমতা, প্রাধান্য, দায়িত্বের, বৈষম্যের ভিত্তি এমনই একটি ধারণা নারীপুরুষ নির্বিচারে সকলেরই অবচেতনে অল্পবিস্তর কার্যকর; এবং এর ফলেই এ ধরনের বৈষম্য মেনে নিয়েই পরিবারের পত্তন হন।

[৬. পত্নীমূলং গৃহং পুংসাং যদি ছন্দোহনুবর্তিনী স। গৃহাশ্রমসমং নাস্তি যদি ভার্যা বশানুগা। যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতা (৪:১)

৭. মহা. (১:৬৯:১-২৭)

৮. মহা. (১:২২৪:২৭-২৮)

৯. মহা. (১৩:১৪:৬৫-৬৭)

১০. দেবীভাগবত পুরাণ (১:১১)

১১. ‘She has only to put her existence in his hands and he will give it meaning. The Second Sex, p. 467

১২. ‘Thracian wives were slain over the grave by the hand of their next of kin, and then buried with their husband. Herodotus. The Histories, IV. 71

১৩. ‘Gallic husbands right on wives life and death and to the obligatory self-immolation of the widow.’ Caeser: Gallic War vi: 19

১৪. ‘Woman feeds man’s vanity as the dominant person.’ The Second Sex, p. 208

১৫. ‘Neither does it avail to say that the nature of the two sexes adapts them to their present functions and position and renders these appropriate to them.’ The Subjection of Women, p. 238]

এই বৈষম্য মেনে নেওয়ার ফলে পরিবারে নারীর অবদান একটি অনুচ্চারিত (মধ্যে মধ্যে সরবে উচ্চারিতও) মূলসূত্র। নারীর হীনতা সম্বন্ধে বোধ এত গভীর ও এমন ব্যাপক যে নারীর পক্ষে সুবিচারের আশা করাই ধৃষ্টতা। ফরাসি বিপ্লবের পরে যে সংবিধান রচিত হয় তার সম্বন্ধে এমন কথাও বলা হয়েছে যে, সংবিধান কিছু ব্যক্তিকে অন্যদের চেয়ে বেশি অধিকার দিয়েছে, কিন্তু নারীকে কিছুই দেয়নি।’[১৬] এই ধরনের বৈষম্য পৃথিবীর সকল দেশে বহু যুগ ধরে চলিত আছে অথচ রাষ্ট্রসঙ্ঘের সমীক্ষা বলে ‘পৃথিবীর জনসংখ্যার অর্ধেক নারী; এরা পৃথিবীর মোট শ্রম-প্রহরের দুই তৃতীয়াংশ পরিশ্রম করে; পৃথিবীর উপার্জনের এক দশমাংশ ভোগ করে; এবং পৃথিবীর সম্পত্তির এক শতাংশেরও কমের অধিকারিণী।’ এমন এক ভয়াবহ চিত্র সম্ভবই হত না, যদি না নরনারী নির্বিচারে মানবমনের অবচেতনে নারীর হীনতা সম্বন্ধে ধারণা, সুদীর্ঘকাল ধরে পুঞ্জিত হয়ে থাকত। নারীর ন্যূনতা প্রকৃতিদত্ত, এই বিশ্বাসের ফলেই নারীর স্থান দাম্পত্যে, পরিবারে ও সমাজে পুরুষের নীচে। এই হীনতা প্রমাণ করার কোনও দায় কেউ কোনও দিন বোধ করেনি, ফলে স্বতঃসিদ্ধের মতো এ বোধ নারী ও পুরুষ মেনে নিয়েছে এবং পুরুষ কোনও দিন চিন্তা করেনি যে, দাম্পত্যে নারীর সমানাধিকারের প্রশ্ন উঠতে পারে। এই অধিকার না থাকার ফলে নারীর অন্তর্জগৎ কী পরিমাণে বিধ্বস্ত, বিষাদগ্রস্ত ও হতাশাময় হতে পারে তা নিয়েও সে কখনও ভাবেনি।

[১৬. ‘The constitution gave some men more rights than other, but gave none to women.’ In the Company of Educated Women p. 11]

কদাচিৎ এমন দম্পতি দেখা যায় যেখানে স্ত্রী আপন যোগ্যতায়, বিদ্যাবুদ্ধি ও কৃতিত্বে স্বামীর ওপরে স্থান পেয়েছে। এ রকম ক্ষেত্রে অধিকাংশ স্বামী হীনম্মন্যতায় ক্লিষ্ট এবং তাদের অনেকেই বিদ্রূপ বক্রোক্তি ও কর্কশ ব্যবহারের দ্বারা স্ত্রীর বশ্যতা অর্জন করবার চেষ্টা করে। এই অসাম্যের একটা দৃষ্টান্ত হল স্ত্রী যদি কর্মক্ষেত্রে উচ্চপদস্থও হয়, তার বদলি হলে কদাচিৎ স্বামী তার কর্মক্ষেত্রে গিয়ে স্থায়ী ভাবে বাস করে। অপরপক্ষে স্বামীর বদলি হলে কর্মরতা স্ত্রী কাজে ইস্তফা দিয়ে স্বামীর কর্মস্থলে চলে যাবে, এইটেই সাধারণ ভাবে অপেক্ষিত। কিছু কিছু ব্যতিক্রম নিশ্চয় আছে এবং ইদানীং তা বাড়ছে: বেশ কিছু দম্পতি এখন যে যার কর্মস্থলে একাই থাকেন, ছুটিতে একত্র হন। ব্যবস্থাটি বাঞ্ছনীয় নয়, তবে যে পর্যন্ত না উভয়ের কর্মস্থল এক জায়গায় আনা সম্ভব হয়— যদি তা আদৌ হয়— ততক্ষণ এটি হয়তো পূর্বের সিদ্ধান্তের চেয়ে বেশি খারাপ নয়। এখানে অন্তত স্ত্রীর কর্মের স্বতন্ত্র স্বীকৃতি আছে, বর্তমান সমাজব্যবস্থায় যার প্রয়োজন প্রশ্নাতীত। নারী ও পুরুষের পক্ষে বিবাহের অর্থ বা অনুষঙ্গ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এক নয়। ‘বিবাহের জৈব, আবেগগত, মানসিক প্রয়োজন নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে মূলত একই, কিন্তু এই প্রয়োজনগত সাম্য পারস্পরিক সম্পর্কে কোনও সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি।’[১৭] এখনও বিবাহ নারীর পক্ষে অনেক বেশি গুরুভার, অনেক বেশি দায়িত্বের প্রতীক। পুরুষ বিবাহকে গৃহ এবং গৃহিণী পাওয়ার উপায় হিসেবে গ্রহণ করে কিন্তু এখন পুরুষের পক্ষে এই দুইয়ের দায়িত্ব এতটা দৃঢ় নয় যে, তার থেকে সে সরে যেতে পারে না। বস্তুত, সরে যাওয়ার বহু পথ তার সামনে ইতিহাসের আদিপর্ব থেকেই খোলা। ‘সে (পুরুষ) গৃহ ও গৃহিণী চায় কিন্তু এ দুই থেকে পলায়নে স্বাধীনতাও তার চাই।’[১৮] সিমোন দ বোভোয়া এই প্রসঙ্গে চূড়ান্ত অত্যুক্তি করেছেন এই বলে যে, ‘বলা হয় বিবাহ পুরুষকে খর্ব করে। এ কথা প্রায়শই সত্য, কিন্তু প্রায় সর্বদাই বিবাহ নারীকে ধ্বংস করে।’[১৯] এই মতের শেষ প্রান্তে আছে বিবাহ প্রেমকে হত্যা করে আসলে পবিত্র দাম্পত্য স্বর্গেই রচিত হয়; ঈশ্বর নির্বাচিত বর বধূই মর্ত্যে মিলিত হয়; জ্যোতিষ শাস্ত্রের নির্দেশে রাজযোটক মিলন ঘটে। নানাদি অলৌকিক বিভায় মণ্ডিত দাম্পত্যকে ওই কৃত্রিম গৌরব থেকে মুক্ত করে বাস্তব পরিস্থিতিতে এর যথার্থ রূপ ও বহু বিচ্যুতি, বহু কলঙ্ক এবং নিতান্ত স্বার্থসংকীর্ণ উদ্দেশে সংঘটিত এই বিবাহকে অনলংকৃত রূপে দেখবার চেষ্টাতেই বোভোয়া বিপ্রতীপ প্রান্ত থেকে এই ধরনের মন্তব্য করেছেন। এতকাল যাকে দিব্য বিভার পরিমণ্ডলে কৃত্রিম ভাবে স্থাপিত করা হয়েছিল, গ্রন্থকর্ত্রী দেখালেন তার মধ্যে বহু ফাঁক, বহু ফাঁকি। এবং বিবাহের দীর্ঘ জটিল ইতিহাস স্মরণে রাখলে এ দেখারও মূল্য আছে। এ-ও ভ্রান্ত দর্শনমাত্র নয়।

[১৭. ‘The two sexes are necessity to each other but this necessity has never brought about a condition of reciprocity between them.’ The Second Sex, p. 446

১৮. ‘…he wants to have hearth and home while being free to escape therefrom.’ প্রাগুক্ত; p. 475]

১৯. ‘It has been said that marriage diminishes man, which is often true, but almost always it annihilates woman.’ প্রাগুক্ত; p. 496]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *