০৭. বাবু দাড়ি শেভ করতে বসেছে

বাবু দাড়ি শেভ করতে বসেছে।

ব্লেডটা পুরানো কাজেই গালে সাবান লাগিয়ে বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকতে হবে। দাড়িগুলিকে নরম হবার সময় দিতে হবে। সে তাই করছে। সাবান লাগিয়ে বসে আছে। রুবা দাঁত মাজতে মাজতে ভাইকে লক্ষ্য করছে।

কতক্ষণ বসে থাকবে ভাইয়া?

এই কিছুক্ষণ। দাড়ি নরম হোক।

কি বিরাট যন্ত্রণা তোমাদের, তাই না ভাইয়া?

হুঁ।

বিশেষ করে তোমার মত যাদের টাকা-পয়সা কম তাদের আরো বেশি যন্ত্রণা। এক ব্লেড যাদের এক মাস ব্যবহার করতে হয়।

বাবু জবাব দিল না। আয়না হাঁটুর উপর রেখে ব্লেড হাতে নিল। রুবা তখন খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে নতুন কেনা ঝকঝকে শেভিং বাক্স তার সামনে এনে রাখিল। বাবু অবাক হয়ে বলল, ব্যাপার কি? টাকা কোথায় পেলি?

যেখান থেকেই পাই তাতে তোমার কি। দাও ব্রেড় ভরে দেই। জিনিসটা সুন্দর ভাইয়া? এই দেখ সঙ্গে ব্রাশও আছে।

বাবু বিস্মিত হয়ে বলল, এতো দামী জিনিসরে।

হুঁ দামী। দুশি পঁচিশ টাকা পড়েছে।

বলিস কি?

আপা আমাকে কিছু টাকা দিয়েছে, ঐ টাকায় কিনলাম। হা করে তাকিয়ে থাকিবে না তো? দাড়ি কাটতে শুরু কর আমি দেখি।

টাকা নষ্ট করলি? সংসারে দিলে কাজে লাগত। এতগুলি টাকা। এটা এখন ফেরত দিলে ফেরত নেবে না?

না নেবে না।

টাকাটা পানিতে ফেললি রুবা।

মোটেই পানিতে ফেলি নি। তুমি মুখটা ফেনায় ফেনায় ভর্তি কর তো ভাইয়া, আমি দেখি।

বাবু লজ্জিত মুখে ব্রাশ ঘসছে। শেভ করতে তার কেন জানি লজ্জা লজ্জা লাগছে। রেজার টানতেই গাল খানিকটা কেটে গেলে। ধবধবে সাদা ফেনার লাল রক্ত। রুবা তাকিয়ে আছে। বাবু বিব্রত মুখে বলল, বড়লোকি জিনিসে অভ্যাস নেই। এই দেখ গাল কেটে ফেলেছি।

রুবা ভাইয়ের পাশে বসল। গলা নিচু করে বলল, ভাইয়া তুমি আপাকে একদিন গিয়ে দেখে আস না কেন? তাদের নতুন ফ্ল্যাটে তুমি একদিনও যাও নি।

ইলা কি কিছু বলেছে?

না বলে নি। আপা কোনদিন কিছু বলবে না। না গেলে কষ্ট পাবে–এই পর্যন্তই।

যাব। একদিন যাব। খালি হাতে তো যাওয়া যায় না। হাতেও টাকা-পয়সা নেই। একসের মিষ্টি তো অদ্ভুত নিয়ে যাওয়া উচিত।

একসের মিষ্টির দম আমি তোমাকে দেব।

বলিস কি।

আমার কাছে টাকা আছে। ইলা আপা পাঁচশ টাকা দিয়েছে।

এত টাকা সে পেল কোথায়?

দুলাভাই দিয়েছে। এ ছাড়া আর কোথায় পাবে?

বাবুর গাল আবার খানিকটা কেটেছে। সে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে। এতগুলি টাকা বোনকে দিয়ে দিল, জামান জানতে পারলে অশান্তি করবে। লোকটা টাকা পয়সার ব্যাপারে খুব কৃপণ। জামানকে না জানিয়ে ইলার উচিত নয় এত টাকা এদিক-ওদিক করা। পাঁচশ টাকা অনেক টাকা, জামানের স্বভাব ভাল না। জামানের স্বভাব যে খারাপ তা বাবু ইলার বিয়ের এক সপ্তাহ পরই টের পেয়েছে। বোনকে দেখতে গিয়েছিল। ভেবেছিল যাবে আর দেখা করে চলে আসবে। ইলা কিছুতেই আসতে দেবে না। কেঁদে-টেদে এককাণ্ড–খেয়ে আসতে হবে।

 

খাবার টেবিলে জমান বলল, ভাইসাহেব আপনার ব্যবসা কেমন চলছে?

চলছে। ক্যাপিটেলের অভাব। ক্যাপিটেল ছাড়া সবই আছে। ছোটখাট একটা অর্ডার পেয়েছি। ক্যাপিটাল জোগাড় না হলে অর্ডার নিতে পারব না। হাজার দশেক টাকার মামলা।

জামান সঙ্গে সঙ্গে বলল, আমার হতি তো একদম খালি। আপনাকে তো দিতে পারব না।

বাবু বিস্মিত হয়ে বলল, আপনি কেন দেবেন? আপনার কাছে তো টাকা চাই নি।

চাইতে হবে কেন? আমার তো নিজ থেকেই দেয়া উচিত। সম্ভব হচ্ছে না–হাত একেবারে খালি। ধার-দেনা করে বিয়ে।

বাবুর গলায় খাবার অটিকে যেতে লাগল। কিছুই মুখে কুচছে না। অল্প সময়ে প্রচুর আয়োজন করেছে ইলা। পোলাও করেছে। রোস্ট করেছে। না খেলে কষ্ট পাবে।

জামান বিরক্ত গলায় বলল, গরমের মধ্যে পোলাও কেন? প্লেন ভাত করতে পারলে না? আর তিনজন মানুষ আমিরা, এত কি রান্না করেছ? পঞ্চাশজন লোক এ দিয়ে খাওয়া যায়। এমন অপচয় মানুষ করে?

ইলা অসম্ভব লজ্জা পেয়েছিল। তার ফর্সা মুখ টকটকে লাল হয়ে গিয়েছিল। খাবার সময়টাতে সে আর সামনে থাকে নি। হয়ত বাথরুমে দরজ্জা বন্ধ করে কেঁদেছে।

রুবা এখনো হা করে বাবুর দাড়ি শেভ করা দেখছে। সে ব্যাপারটায় খুব মজা পাচ্ছে। বাবু বলল, ইলাকে কেমন দেখে এলি?

ভালই দেখলাম।

কথায় বার্তায় কি মনে হয় সে সুখী?

সুখী অসুখী কি আর কথায়বার্তায় বোঝা যায়?

তা ঠিক বোঝা যায় না। যেমন আমার কথাই ধর। আমাকে দেখে সবাই মনে করে অসুখী। আমি কিন্তু আসলে সুখী, বেশ সুখী।

তুমি এবং নাসিম ভাই তোমরা দুজনেই যে সুখী তা কিন্তু তোমাদের মুখ দেখে বোঝা যায়। শুধু সুখী না–মহা সুখী। তোমরা কি ঐ বিলটা পেয়েছ ভাইয়া?

না।

পাবে মা?

বুঝতে পরাছি না। নাসিম অবশ্যি আশা ছাড়ে নি। এখনো চেষ্টা করে যাচ্ছে। এখন চেষ্টা হচ্ছে আধ্যাত্মিক লাইনে। রোজ সন্ধ্যায় এক পীর সাহেবের পা জড়িয়ে ধরে বসে থাকে।

বাবু শব্দ করে হেসে ফেলল। রুবাও হাসতে লাগল।

সুরমা রান্নাঘর থেকে অনেকক্ষণ থেকেই দেখছেন ভাই বোন বারান্দায় বসে গুনগুন করছে। হাসাহাসি করছে। দুজনের খুব খাতির। ইলা যখন আসে তখন তিনজন মিলে গুনগুন করে। তিনি কাছে গেলে তাদের গুনগুনানি থেমে যায়। তারা অবশ্যি বলে–এস মা। বস। তিনি প্রায়ই বসেন তখন তাদের কথাবার্তা আর জমে না। এদের সংসারে তিনি যেন আলাদা মানুষ।

আজো দুজন বসে গুনগুন করছে। তিনি পাশে গেলেই থেমে যাবে। সুরমা রান্নাঘর থেকে বের হয়ে এলেন। বিরক্ত গলায় বললেন–তোরা সারাদিন বারান্দায় বসে থাকবি? নাশতা নিয়ে বসে থাকা ছাড়া আমার অন্য কাজ নেই?

রুবা বলল–তুমি যাও মা আমরা আসছি। সুরমা চলে এলেন। দুঃখে তাঁর চোখে পানি এসে যাচ্ছে। কি রকম কথা–তুমি যাও মা। তিনি যেন কাছেও থাকতে পারেন না। আশেপাশে থাকলেও দোষ।

বাবুর গাল আরেক জায়গায় কেটেছে। রুবা বলল, গালটা কি অবস্থা করেছ ভাইয়া। মোরব্বা বানিয়ে ফেলছ।

তাই তো দেখছি। তোর এই জিনিস আমার পোষাচ্ছে না রে। আমাকে মনে হয় আগের জিনিসে ফিরে যেতে হবে। বরং একটা ক্ষুর কিনে নেব।

আমারো তাই মনে হচ্ছে ভাইয়া।

এই বলেই রুবা হঠাৎ গলার স্বর পাল্টে বলল–আচ্ছা ভাইয়া, তুমি কি জান আপা নাসিম ভাইকে বিয়ে করতে চেয়েছিল?

জানি।

কিভাবে জান? কে বলেছে তোমাকে?

কেউ বলে নি। অনুমান করেছি।

আমি পুরো ব্যাপারটা জানি। আমারটা কিন্তু অনুমান না।

রুবা গলার স্বর আরো নিচু করে বলল, যে রাতে আপা মাকে ঘুম থেকে তুলে বলল, আমি সেই রাতেই জানি। আমি আসলে একজন স্পাই টাইপের মেয়ে। মাঝ রাতে আপা বিছানা ছেড়ে উঠে গেল। আমি তার পেছনে পেছনে চুপি চুপি বিছানা ছেড়ে উঠলাম। আড়ালে পাড়িয়ে শুনলাম কথাবার্তা।

কাজটা কি ঠিক হল রুবা?

ঠিক হয় নি। আমি তো ভাইয়া তোমার বা আপার মত ভাল মানুষ না। আমি খারাপ মানুষ। কে কি করছে, কে কি ভাবছে–এইসব আমি ধরতে চেষ্টা করি।

আর করিস না।

আচ্ছা আর করব না।

রুবা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আপার সঙ্গে নাসিম ভাইয়ের বিয়ে হলে খুব চমৎকার হত। মানুষ হিসেবে দুজনই অসাধারণ। আমি আমার জীবনে আপার মত ভাল মেয়ে যেমন দেখি নি, নাসিম ভাইয়ের মত ভাল ছেলেও দেখি নি। এই দুজন মানুষকে যে আমি কি পছন্দ করি তা তোমরা বুঝতে পারবে না। ঐদিন কথায় কথায় নাসিম ভাই বলল, একটা মেয়েকে তার খুব ভাল লেগেছে–শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখে পানি এসে গেছে।

 

বাবু দাড়ি শেভ করা বন্ধ করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। রুবা ভাইয়ের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে শান্ত গলায় বলল, তুমি কেন এ রকম করে তাকিয়ে আছি তা আমি বুঝতে পারছি ভাইয়া। তুমি যা ভাবছ তা কিন্তু না।

আমি কি ভাবছি?

তুমি ভাবছ–রুবারও কি ইলার মত সমস্যা হল? না, তা হয় নি।

শুনে ভাল লাগল।

বাবু হাসল। রুবাও হাসল।

সুরমা অবাির বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। লক্ষ্য করলেন তাঁকে দেখেই দুই ভাই বোন হাসি বন্ধ করে দিয়েছে। কেন তারা এরকম করে। তারা মনে করার চেষ্টা করে না —–তাদের বাবা মারা যাবার পর এই সংসার তিনি একা টেনে তুলেছেন। প্রাণপণে চেষ্টা করেছেন বাবার অভাব যেন এরা বুঝতে না পারে।

এক সময় ছেলেমেয়ের কাছে তাঁর প্রয়োজন ছিল। আজ নেই। আজ তিনি এদের বিরক্তির কারণ।

রুবা বলল, দাঁড়িয়ে আছ কেন মা? কিছু বলবে?

না।

না। তাহলে দয়া করে অন্য কোথাও যাও তো মা। তুমি যেভাবে আমাদের দিকে তাকাচ্ছি তাতে মনে হচ্ছে অভিশাপ দিচ্ছ।

সুরমা ক্লান্ত গলায় বললেন, অভিশাপ দিচ্ছি না। আর অভিশাপ দিলেও–মার অভিশাপ ছেলেমেয়েদের স্পর্শ করে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *