০৭. বান্ধবপুরের পশ্চিমে মাধাই খাল

বান্ধবপুরের পশ্চিমে মাধাই খালের দু’পাশে পাঁচমিশালি গাছের ঘন জঙ্গল। বাঁশঝাড়, ডেউয়া, বেতঝোপ, ভূতের নিবাস ঝাঁকড়া শ্যাওড়া গাছ। জায়গায় জায়গায় বুনো কাঁঠাল গাছ— যে গাছ কখনো ফল দেয় না। এমনই এক কাঁঠাল গাছের নিচে আজ ভোর রাতে একটা বকনা, গরু জবাই হয়েছে। জবাই করেছেন মাওলানা ইদরিস। ধনু শেখের মানতের গরু। ধনু শেখকে গতবছর কলেরায় ধরেছিল। জীবন যায় যায় অবস্থায় তিনি মানত করেন— যদি এই দফায় প্ৰাণে বাচেন তাহলে গরু শিন্নি দেবেন।

গরুর শিন্নির কঠিন বিষয় জঙ্গলের ভেতর করতে হয়েছে। ধনু শেখ বাড়ির দু’জন কমলা এবং তার ছোটভাইকে নিয়ে এসেছেন। গরু জবাইয়ের সব চিহ্ন মুছে ফেলতে হবে। চামড়া হাড়গোড় গর্ত করে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। কেউ যেন বুঝতে না পারে। শিন্ত্রির মাংস সবাইকে ভাগ করে দেয়া নিয়ম। ধনু শেখ নিজে এই কাজটি করছেন। মুসলমান ঘর হিসাব করে করে মাংস ভাগ করছেন। পদ্মপাতায় মাংস পুটলি করা হচ্ছে। দিনের মধ্যেই বাড়ি বাড়ি মাংস পৌঁছে যাবে।

মাওলানা ইদরিস একটু দূরে বসেছেন। তাকে সামান্য চিন্তিত মনে হচ্ছে। গোপনে গরু জবেহ করার খবর চাপা থাকবে তার এরকম মনে হচ্ছে না। সামনে মহাবিপদ।

ধনু শেখ বললেন, মাওলানা, আপনারে দুই ভাগ দেই?

মাওলানা বললেন, প্রয়োজন নাই। এক ভাগ দিলেই চলবে। আমি একজন মোটে মানুষ।

ঘরে তেল আছে তো? গরুর মাংসের সোয়াদ তোলে। অর্ধেক মাংস অর্ধেক তেল, যতটুকু মাংস ততটুক পেঁয়াজ। পেয়াজের অর্ধেক আদা। অল্প আঁচে দুপুরে বসাবেন সন্ধ্যারাতে নামাবেন— অমৃত।

ধনু শেখের এক কামলা বলল, অন্য মশলা পাতি লাগবে না?

ধনু শেখ বললেন, মশলাপাতি থাকলে দিবা, না থাকলে দিবা না। ইলিশ মাছে যেমন মশলা লাগে না, গরুর মাংসেও লাগে না। একটু লবণের ছিটা, একটু কাঁচামরিচ, ইলিশ মাছের জন্যে এই যথেষ্ট। রুই মাছের ক্ষেত্রে ভিন্ন কথা। পাকের নানান হিসাব।

রান্নাবান্নার গল্প শুনতে মাওলানার মোটেই ভালো লাগছিল না। ধনু শেখ এত আগ্রহ করে রান্নার গল্প করছে, কিছু না বললে ভালো দেখায় না বলে তিনি বললেন, রুই মাছের হিসাবটা কী?

ধনু শেখ বললেন, রুই মাছ তরিবত করে রাঁধতে হয়। কথায় আছে—

অরাঁধুনীর হাতে পড়ে রুই মাছ কাঁদে
না জানি রাঁধুনী মোরে কেমন করে রাঁধে।

মাওলানা নিম্পূহ গলায় বললেন, ও আচ্ছা।

ধনু শেখ বললেন, আপনি কি চিন্তাযুক্ত?

মাওলানা হঁহা-সূচক মাথা নাড়লেন।

ধনু শেখ বিড়ি ধরাতে ধরাতে বললেন, কোনো চিন্তা করবেন না। কেউ কিছু জানবে না। আর জানলেও অসুবিধা নাই। ব্যবস্থা নেয়া আছে।

কী ব্যবস্থা?

সেটা আপনার না জানলেও চলবে। সবার সবকিছু জানতে নাই। আপনি মাওলানা মানুষ। হাদিস কোরান নিয়া থাকবেন। যার যে কৰ্ম সে সেই কর্ম নিয়া থাকবে।

ধনু শেখের চেহারা আনন্দে ঝলমল করছে। ছোটখাটো মানুষ। লাখের বাতি জ্বালাবার পর থেকে ছোটখাটো মানুষটাকেই বড় লাগছে। যেন মানুষটা এখন বিশেষ কেউ। তাকে অগ্রাহ্য করা যাবে না।

মাওলানা, দেশের খবর কিছু রাখেন?

দেশের কী খবর?

স্বরাজের খবর। স্বরাজ শুরু হইছে।

সেইটা কী?

স্বাধীন হওয়ার জন্যে মারামারি কাটাকাটি। হেন্দুরা এরে বোমা মারতেছে ওরে বোমা মারতেছে।

ক্ষুদিরামের কথা শুনেছি।

ধনু শেখ তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বোকার দল স্বরাজ কইরা মরুক, আমরা এর মধ্যে নাই।

মাওলানা বললেন, আমরা নাই কেন?

ধনু শেখ গলা নামিয়ে বললেন, দেশ তো মুসলমানের। দিল্লির সিংহাসনে কি কোনো হেন্দু ছিল? ছিলাম আমরা। হেন্দুরা দেশ স্বাধীন কইরা দিব। আমরা গদিতে বসব। এরার চোখের সামনে গরু, কাঁইট্টা খাব। হেন্দুরাও পেসাদ পাইব। হা হা হা।

জঙ্গল থেকে তারা বের হলো দুপুরের আগে আগে। ধনু শেখ পদ্মপাতায় মোড়া মাংসের ঝাকা এবং দলবল নিয়ে মাধাই খালে এসে নৌকায় উঠল। নৌকা সরাসরি ধনু শেখের বাড়ির পেছনে থামলা। ধনু শেখ নিজ বাড়িতে ছেলের আকিকা উপলক্ষে দুটা খাসি জাবেহের ব্যবস্থা করেছেন। খাসি জবেহতে কোনো বাধা নেই। এই কাজ প্রকাশ্যে করা যায়।

ধনু শেখ খাসির মাংসের সঙ্গে সব মুসলমান বাড়িতে এক পোটলা গরুর মাংসও দিয়ে দিলেন। হতদরিদ্ররা যেন মাংস ঠিকমতো রাধতে পারে তার জন্যে তেলমসলা কেনা বাবদ একটা করে আধুলি পেল। বাড়িতে বাড়িতে মাংস রান্না হবে। গন্ধ ছড়াবে। কারোর কিছু বলার নেই। খাসির মাংস রান্না হচ্ছে।

এক পোটলা মাংস গেল অম্বিকা ভট্টাচার্যের কাছে। ধনু শেখ নিজেই নিয়ে গেলেন। অতি বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ঠাকুর! আমার ছেলের আকিকার খাসির মাংস। আত্মীয় বান্ধবদের বাড়িতে এই মাংস বিলি করার বিধান আছে। এই মাংস আপনি কি গ্ৰহণ করবেন?

অম্বিকা ভট্টাচাৰ্য বললেন, খাসির মাংসে কোনো দোষ নাই। তবে মুসলমানের বাড়ির মাংস বিধায় শোধন করে নিতে হবে। শোধন করার খরচা যদি দাও মাংস নিতে পারি।

খরচ কত?

এক টাকার কমে হবে না। কপূর লাগবে। একশ’ বছরের পুরনো ঘিতে কপূর দিতে হবে। সেই ঘি পুড়িয়ে তার ধোঁয়া মাংসের গায়ে লাগাতে হবে। বিরাট ঝামেলা।

ধনু শেখ এক টাকার জায়গায় দুটাকা দিলেন। মাংস শোধন বাবদ এক টাকা। তেল এবং মশলা পাতি কেনা বাবদ এক টাকা।

ঠাকুর অম্বিকা ভট্টাচাৰ্য পরিবারের সবাইকে নিয়ে আনন্দ করে সেই রাতে গরুর মাংস খেলেন।

ধনু শেখ যাবেন নটিবাড়িতে। সপ্তাহে একদিন (মঙ্গলবার) তিনি নটিবাড়িতে রাত্রিযাপন করেন। আজ মঙ্গলবার। চাদরে আতর মাখিয়ে পাম্পশু পায়ে রওনা হয়েছেন, পথে ঠাকুর অম্বিকা ভট্টাচার্যের বাড়িতে থামলেন। বিনয়ের সঙ্গে জানতে চাইলেন, পুত্রের আকিকার মাংস ঠাকুর খেয়েছেন কি-না।

অম্বিকা ভট্টাচার্য বললেন, সবাইকে নিয়ে খেয়েছি। তৃপ্তি করে খেয়েছি।

ধনু শেখ বললেন, শুনে খুশি হলাম। তবে ঠাকুর একটা বিষয়। মাংস গরুর। ভুলক্রমে খাসির মাংস ভেবে আপনাকে গরুর মাংস দিয়েছি। গোপনে একটা গরু জবেহ করেছিলাম। সেই গরুর মাংস।

হতভম্ব অম্বিকা ভট্টাচাৰ্য বললেন, কী বললা?

ধনু শেখ বললেন, যা বলেছি। সত্য বলেছি। তবে আপনার চিন্তার কিছু নাই। কেউ জানবে না।

অম্বিকা ভট্টাচাৰ্য বিড়বিড় করে বললেন, কেউ জানুক বা না-জানুক, জাত তো চলে গেছে।

ধনু শেখ হাই তুলতে তুলতে বললেন, জাত চলে গেলেও চুপ করে থাকেন। আপনার কন্যা আছে। তার বিবাহ দিতে হবে না? ঠাকুর, যাই।

অম্বিকা ভট্টাচাৰ্য ঘোর লাগা মানুষের গলায় বললেন, কোথায় যাও?

ধনু শেখ বললেন, আজ মঙ্গলবার। নটিবাড়িতে যাই। মঙ্গলবার রাতটা আমি নটিবাড়িতে কটাই। জানেন নিশ্চয়ই?

অম্বিকা ভট্টাচাৰ্য কাদো কাদো গলায় বললেন, এইটা তুমি কী করলা?

ধনু শেখ হাই তুলতে তুলতে বললেন, আপনাদের এমন কিছু কি আছে যা খেলে মুসলমানের জাত যাবে? থাকলে দেন খাই। সমানে সমান হবে।

ঠাকুর অম্বিকা ভট্টাচার্যের সপরিবারে গো-মাংস ভক্ষণ কাহিনী তৃতীয় দিনের দিন প্রকাশিত হয়ে পড়ল। বিধান দেবার জন্যে শ্যামগঞ্জ থেকে ন্যায়রত্ন রামনিধি চলে এলেন। তিনি বললেন, গরু যদি অল্পবয়স্ক হয় তাহলে জাত যাবে না। প্ৰায়শ্চিত্ত করলেই হবে। কারণ পাৰ্বতীর পিতা, শিবের শ্বশুর মহারাজা দক্ষ যে যজ্ঞ করেছিলেন সেখানে গোবৎস বধ করা হয়েছে। ব্ৰাহ্মণরা গোবৎসের খেয়েছেন।

জানা গেল ঠাকুর অম্বিকা ভট্টাচার্য যে মাংস খেয়েছেন তা বয়স্ক গরুর মাংস।

ন্যায়রত্ন রামনিধি বললেন, এরও বিধান আছে। যে পরিমাণ গো-মাংস প্ৰত্যেকে খেয়েছে সেই পরিমাণ কাঁচা গোবর এক সপ্তাহ খাবে। তাতে শরীর শোধন হবে। শরীর শোধিত হবার পর গঙ্গায় একটা ড়ুব দিলে গো-মাংস ভক্ষণজনিত বিষ শরীর থেকে চলে যাবে।

ঠাকুর অম্বিকা ভট্টাচার্য শরীর শোধনের প্রাথমিক পরীক্ষায় ফেল করলেন। এক চামচ গোবর মুখে দিয়ে বমি করতে করতে মৃতপ্রায় হলেন। সপরিবারে মুসলমান হবার সিদ্ধান্ত নিলেন।

এক শুক্রবার জুমা নামাজের পর তিনি মাওলানা ইদরিসের কাছে ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নিলেন। সবাই মুখে তিনবার বললেন—

লা ইলাহা ইল্লাললাহ।
আল্লাহ ছাড়া কোনো মারুদ নাই।
মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ।
মুহাম্মদ তাঁর রসুল।

মাওলানা ইদরিস প্রত্যকের ডান কানে তিনবার করে সূরা ইয়াসিন পাঠ করে ফুঁ দিয়ে দিলেন। ফু’র পরপরই ডান হাতে কান বন্ধ করতে হলো। সূরা ইয়াসিন দীর্ঘ সময় ক্যানের ভেতর থাকে।

হাজাম ধারালো বাঁশের কঞ্চি নিয়ে অপেক্ষা করছিল। ইসলাম ধর্মগ্রহণ পর্ব শেষ হওয়া মাত্র সে দলের পুরুষদের খতনা শুরু করল। তাদের চোখের জল এবং চাপা গোঙানির ভেতর দিয়ে ইসলামধর্মে দাখেলের অনুষ্ঠান সুসম্পন্ন হলো। অম্বিকা ভট্টাচার্যের নাম হলো— মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম। সবাই ডাকা শুরু সিরাজ ঠাকুর। ঠাকুর থেকে মুসলমান হয়েছিল এই জন্যই নামের শেষে ঠাকুর।

এই ঘটনার বিস্তৃত ব্যাখ্যার একটা কারণ আছে। বাংলাদেশের ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদের মাতুল বংশের একটা শাখার পূর্বপুরুষ ঠাকুর অম্বিকা ভট্টাচার্য। বর্তমান পুরুষরা হিন্দুয়ানির সব ছেড়েছেন, ঠাকুর পদবি ছাড়েন নি। ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদের এক নানার নাম আনিসুর রহমান ঠাকুর। তিনি কঠিন ধাৰ্মিক মানুষ ছিলেন। তাঁর রাত কাটতো এবাদত বন্দেগি করে।

 

জুলেখার বাড়িতে আজ নতুন অতিথি। অতিথিকে জুলেখার চেনা চেনা লাগছে। ঠিক চিনতে পারছে না। তবে এই মানুষটাকে সে যে দেখেছে। এই বিষয়ে সে নিশ্চিত।

অতিথি খাটে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসেছেন। এই খাট জুলেখা নতুন কিনেছে। ময়ূর খাট। ময়ুরের কাজ করা। অতিথি বলল, তোমার সৌন্দর্যে মোহিত হয়েছি। তোমার নাম কী গো?

জুলেখা বলল, পিতামাতা নাম রাখতে বিস্মরণ হয়েছেন। আপনে সুন্দর দেইখা নাম দেন।

অতিথি বলল, আমার সাথে মীমাংসায়’ (ধাধায়) কথা বলব না। আমি মীমাংসা পছন্দ করি না। তোমার নাম বলো, ধর্ম বলো।

জুলেখা বলল, আমার যেমন নাম নাই, ধৰ্মও নাই। আমার ঘরে যে আসে তার ধর্মই আমার ধর্ম।

নাম বলো। নাম না বললে উইঠ্যা চইলা যাব।

অতিথি উঠার ভঙ্গি করল। জুলেখা চুপ করে রইল। চলে যেতে চাইলে চলে যাবে। জুলেখা বাধা দিবে না। অতিথি বলল, তুমি সুন্দর ঠিক আছে, কিন্তু অতি বেয়াদব মেয়ে। সঙ্গে বন্দুক থাকলে গুল্লি করতাম। বেয়াদব মেয়ের একটাই শাস্তি— নাভি বরাবর গুল্লি।

জুলেখা এই কথায় অতিথিকে চিনল। ইনি এককালের জমিদার শশাংক পাল। হাতি নিয়ে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরতেন। বাঘের সন্ধান করতেন। জুলেখা বলল, আপনের মাথা সামান্য গরম হয়েছে। শরবত খাবেন? শরবত খাইলে মাথা ঠাপ্ত হবে।

তুমি তোমার নাম বলো। নাম বললে মাথা ঠাণ্ডা হবে।

আমার এক নাম জুলেখা। আরেক নাম চান বিবি।

কোনটা আসল?

দুইটাই আসল।

মুসলমান?

হুঁ।

কালো ব্যাগটা খোল। বোতল আছে। গোলাসে কইরা বোতলের জিনিস দেও। আইজ এই জিনিস বেশি কইরা খাইতে হবে। মন অত্যধিক খারাপ।

মন খারাপ কী জন্যে?

আইজ অম্বিকা ভট্টাচাৰ্য দলেবলে মুসলমান হইছে, খবর পাও নাই?

জুলেখা বলল, তার গরু খাওনের ইচ্ছা হইছে সে মুসলমান হইছে। আপনের কী? আপনে ফুর্তি করতে আইছেন ফুর্তি করেন। গান শুনবেন?

গান জানো?

শিখতেছি।

শিখা শিখির গানের মধ্যে আমি নাই। সারাজীবন বড় বড় ওস্তাদের মাহফিলে গান শুনেছি। বড় বড় বাইজিদের নাচ গান শুনে সোনার মোহর দিয়েছি।

জুলেখা চাপা হাসি হাসতে হাসতে বলল, এখন তো আপনের হাতে সোনার মোহর নাই। আমার গান ছাড়া গতি কী?

শশাংক পালের ভুরু কুঁচকে গেল। চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো। এই মেয়ে কথার পিঠে কথা বলার বিদ্যায়। ওস্তাদ। এর সঙ্গে সাবধানে কথা বলতে হবে।

জুলেখা গ্লাস এগিয়ে দিতে দিতে নিচু গলায় গান ধরল—

ও পক্ষী আমার চক্ষু খাইও না।
সৰ্বাঙ্গ খাইও পক্ষী
চক্ষু খাইও না।

শশাংক পালের মুগ্ধতার সীমা রইল না। মেয়ের যেমন কণ্ঠ তেমন গান। সে এক জায়গায় বসে বসে গান করছে না। ঘুরাফেরা করতে করতে গাইছে। কখনো কাছে আসছে, কখনো দূরে যাচ্ছে। গান গাইতে গাইতে সুপারি। কাটছে। ছড়তার শব্দটাও তখন তালে হচ্ছে। শশাংক পালের মনে হলো, আগেকার দিন থাকলে অবশ্যই এই মেয়ের দিকে একটা বা দুটা স্বর্ণমুদ্রা ছুঁড়ে দেয়া যেত।

অ্যাই মেয়ে, তোমার নাম যেন কী?

কমলা রানী।

একটু আগে বলেছ। জুলেখা, এখন কমলা রানী বলতেছ। কেন?

নাম তো আপনের মনে আছে, আবার জিজ্ঞাস করলেন কেন?

তামুক খাব। ব্যবস্থা কর। তামাক সঙ্গে আছে। ইকার নল ভালো করে ধুয়ে তারপর দিবা।

জুলেখা হাসল।

শশাংক পাল ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করল— আফসোস, সময়কালে তোমার সঙ্গে দেখা হয় নাই।

জুলেখা বলল, সময়কালে দেখা হইলে কী করতেন?

শশাংক পাল জবাব দিলেন না। গ্লাস শূন্য। তিনি গ্লাস বাড়িয়ে দিলেন। জুলেখা গ্লাস ভর্তি করতে করতে বলল, আমার জন্যে টাকা পয়সা কী এনেছেন?

তুমি কত নাও?

যে যা দেয়। তাই নেই। আপনে জমিদার মানুষ, আপনে দিবেন। আপনের সম্মান মতো।

আজ সেই রকম দিতে পারব না। কাল দিব।

আইজ কি খালি হাতে আসছেন?

শশাংক জবাব দিলেন না। তিনি ঠিক খালি হাতে আসেন নি। রুপার একটা ফুলদানি নিয়ে এসেছেন। দামি জিনিস। এই মেয়ে কি তার কদর বুঝবে?

আইজ খালি হাতে আসলেও ক্ষতি নাই। আইজ খালি হাতে আসছেন, কাইল ভরা হাতে আসবেন। জগতের এই নিয়ম। আইজ পূর্ণিমা কাইল অমাবস্যা। খানা খাবেন না? খানা দেই।

খানা খাব? হাবিজাবি জিনিস বেশি খাইলে খানা খাইতে পারবেন না। কী খাওয়াবে?

আলোচলের ভাত। গাওয়া ঘি। বেগুন ভাজি আর মুগের ডাল। নিরামিষ খাওয়া। দিব?

দাও।

আসেন হাত-মুখ ধুয়ায়ে দেই, তারপর খানা খান।

জুলেখা।

জি।

তুমি অতি ভালো মেয়ে।

আপনেও অতি ভালো মানুষ। আপনের হাত কাঁপতেছে কেন?

আমার হাতকাঁপা রোগ হয়েছে।

চিকিৎসা কইরা হাত ঠিক করেন। হাতকাঁপা রোগ নিয়া গুল্লি করবেন ক্যামনে?

জুলেখা খিলখিল করে হাসছে। মুগ্ধ চোখে শশাংক পাল তাকিয়ে আছেন।

জুলেখা!

জি।

তুমি কি আমাকে বিবাহ করবে? এখন আমার কিছুই নাই, তারপরেও মরাহাতি লাখ টাকা বইলা কথা। তোমারে আমি আদর সোহাগে রাখব।

রাখবেন কই?

কলিকাতা নিয়া চইল্যা যাব। মালিটোলায় আমার ঘর আছে। দোতলা ঘর।

জুলেখা বলল, যাব। কইলকাতা শহর দেখা হয় নাই। দেখার শখ আছে।

তোমারে সবকিছু দেখাব। বজরা ভাড়া করব। কালিঘাট থাইকা বজরা ছাড়ব। সমুদ্র বরাবর বজরা যাবে। তুমি আমি ছাদে বইসা থাকব। তুমি গান করবা, আমি শুনব।

জুলেখা বলল, বাহ!

শশাংক পাল বললেন, যৌবনে আমি অনেক গান লিখেছি। ট্রাংকভর্তি ছিল লেখা। গানগুলা থাকলে সুবিধা হইত। তুমি গাইতে পারতা।

কোনোটা মনে নাই?

উহু। মনে করার চেষ্টা নিতেছি। মনে পড়লেই তোমারে বলব। বৃদ্ধ বয়সের এক সমস্যা— কিছু মনে থাকে না।

শশাংক পালকে জুলেখা যত্ন করে খাওয়ালো। নিরামিষ শশাংক পাল খেতে পারেন না। আজ তৃপ্তি করেই খেলেন। খাওয়ার শেষে হাতে পান দিতে দিতে জুলেখা বলল, এখন বাড়ি যান।

শশাংক পাল বিস্মিত হয়ে বললেন, বাড়ি যাব কেন? তোমার এখানে নিরামিষ খাওয়ার জন্যে আসি নাই। রাত্রি যাপন করতে আসছি।

জুলেখা বলল, আরেকদিন আসবেন। টাকা-পয়সা নিয়া আসবেন। রঙিলা বাড়ির মালেকাইন সরাজুবালা, উনার কঠিন নিয়ম। উনি বলেছেন— তেল মাখার আগে কড়ি ফেলতে হবে।

তুমি তাকে আমার নাম বলো। নাম বললেই মন্ত্রের মতো কাজ হবে। তাকে বলো জমিদার শশাংক পাল এসেছেন। এটা তার বাড়ির জন্য একটা ইজ্জত।

সরাজুবালা ঘুমায়ে পড়েছেন। একবার ঘুমায়া পড়লে তারে জাগানো যাবে माँ।

তোমার জন্যে আমি রুপার ফুলদানি এনেছি।

শশাংক পাল ব্যাগ খুলে ফুলদানি বের করলেন। জুলেখা হাই তুলতে তুলতে বলল, ফুলদানি এনেছেন ভালো করেছেন। পরেরবারে যখন আসবেন দেখবেন ফুলদানি ভর্তি ফুল। এখন বাড়িতে যান।

বাইরে বৃষ্টি পড়তেছে। বৃষ্টির মধ্যে আমি কই যাব? ছাতা দিতেছি।

ছাতা মাথায় দিয়া চইলা যাবেন।

জুলেখা শোন। আমি রাতে যাব না। চারদিকে আমার শত্রু। রাতে বিরাতে আমার চলাচল নিষেধ।

জুলেখা হাসিমুখে বলল, ধানাই পানাই কইরা লাভ নাই। আপনার যাইতে হবে। বৃষ্টির মধ্যেই যাইতে হবে। আগে আপনাকে বলেছিলাম ছাতা দিব। ভুল বলেছিলাম। ছাতা দিতে পারব না। ঘরে ছাতা নাই। আপনি যাবেন ভিজতে ভিজতে।

 

হরিচরণ টিনের চালাঘরে খাটের উপর বসেছিলেন। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। টিনের চালায় বৃষ্টির শব্দ শুনতে ভালো লাগছে। রাত অনেক হয়েছে। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে, তিনি ঘুমুতে যাচ্ছেন না। চোখে প্রবল ঘুম নিয়ে জেগে থাকার আনন্দ আছে। তার কোলের উপর লালসালু কাপড়ে বঁধানো খাতা এবং ঝর্ণা কলম। সন্ধ্যায় খাতায় অনেক কিছু লিখেছেন। আরো লেখার ইচ্ছা হচ্ছে কিন্তু আলসি লাগছে। বৃষ্টির শব্দ মানুষকে অলস করে দেয়। হরিচরণ খাতার পাতা উল্টালেন—

অদ্য ঠাকুর অম্বিকা ভট্টাচার্যের ধর্মান্তরের দৃশ্য প্রত্যক্ষ করিলাম। তাঁহাকে ভুলুষ্ঠিত বিষাদ বৃক্ষের মতো মনে হইল। তাহার দীর্ঘ দেহ ছটফট করিতেছিল। এক পর্যায়ে তিনি ‘জল জল’ বলিয়া চিৎকার করিলেন, তখন আসরে উপস্থিত ধনু শেখ বলিল, জল কবেন না। এখন থাইকা পানি কবেন। অম্বিকা ভট্টাচাৰ্য বিড়বিড় করিয়া বলিলেন, পানি। পানি।

হরিচরণকে লেখা বন্ধ করতে হলো। টিনের দরজা নাড়ার শব্দ হচ্ছে। রাত অনেক হয়েছে। বাইরে দুর্যোগ। এই দুর্যোগে কে আসবে তার কাছে!

হরি, দরজা খোল। আমি শশাংক।

হরিচরণ দরজা খুলে বিস্মিত হলেন। শশাংক পাল কাদায়-পানিতে মাখামাখি হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। চোখ রক্তবর্ণ। শীতে থারথার করে কাঁপছেন।

হরি, বিশটা কাঁচা রুপার টাকা দিতে পার? বায়না হিসেবে দাও।

কিসের বায়না?

কলিকাতা শহরে আমার একটা দোতলা বাড়ি আছে। ঐ বাড়ি আমি লেখাপড়া করে তোমাকে দিয়ে দিব। ভগবান সাক্ষী, কথার অন্যথা হবে না।

হরিচরণ বললেন, আপনি ঘরে এসে বসুন। আপনাকে শুকনা কাপড় দেই। তোয়ালে দেই। মাথা মুছেন। আগুন করে দেই, আগুনের পাশে বসেন।

আমার এখনই যেতে হবে। বিশেষ প্রয়োজন। তুমি বিশটা টাকা দাও। দিতে পারবো? ঘরে টাকা আছে?

আছে।

তাহলে আরেকটা কাজ করো। তোমার হাতিটা আমাকে কিছুক্ষণের জন্যে ধার দাও। আমি হাতির পিঠে করে এক জায়গায় যাব।

কোথায় যাবেন?

কোথায় যাব তোমার জানার প্রয়োজন নেই। অনেক দিন হাতির পিঠে চড়ি না। হাতির পিঠে চড়তে ইচ্ছা করতেছে।

হরিচরণ বললেন, আপনার শরীর ভালো না। দেখে মনে হয় জ্বর এসেছে। রাতটা আমার এখানে থাকেন। হাতিতে চড়ে সকালে যেখানে যাবার সেখানে যাবেন।

হরিচরণ! আমার এখনি যেতে হবে। আমি যেখানে যাব সেখানে দিনের আলোয় কেউ যায় না। ঠিক আছে, তোমারে খোলসা করে বলি। আমি যাব রঙিলা বাড়িতে। এখন বুঝেছ?

হরিচরণ কিছু বললেন না। শশাংক পাল গলা নামিয়ে বললেন, মৃত্যুর পরে কিছু নেই। শরীর পুড়ায়ে ফেলবে। ছাই পড়ে থাকবে। ছাইয়ের ভোগের ক্ষমতা নেই। আনন্দ পাওয়ার ক্ষমতা নেই। দেহধারীর আছে। এখন বুঝেছ? টাকা বের করো।

হরিচরণ টাকা বের করলেন।

কাগজে লেখে— কলিকাতা ১৮ ধর্মচরণ সড়কের বাড়ি মজু ভিলার ক্রয়ের বায়না বাবদ বিশ টাকা। আমি টিপসই দিতেছি।

টিপসই দিতে হবে না, আপনি টাকা নিয়ে যান।

হাতি বের করতে বলো। হাতির পিঠে হাওদা দিতে বলো।

 

গভীর রাতে হাতির পিঠে চড়ে শশাংক পাল রওনা হলেন। হাতির গলায় রুপার ঘণ্টা বাজতে লাগল-টুন টুন টুন।

পথ কর্দমাক্ত। হাতির চলতে অসুবিধা হচ্ছে। কাদায় পা ডেবে যাচ্ছে। তবে হাতি আপত্তি করছে না। বাজার পার হয়ে উত্তরের সরু পথের কাছে হাতি থমকে দাঁড়াল। শুঁড় দোলাতে লাগল। সে আগাবে কি আগাবে না। এই সিদ্ধাও নিচ্ছে।

ধনু শেখ এই সময় বাজারের দোকান বন্ধ করে ফিরছে। তার মাথায় একজন ছাতি ধরে আছে। পেছনে আরেকজন, তার হাতে বাঁশের পাকা লাঠি। হাতি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার বিস্ময়ের সীমা রইল না। হাতির পিঠে বসে থাকা মানুষটাকে চেনা যাচ্ছে না। ধনু শেখের হাতে হারিকেন। সে হারিকেন উঁচু করে ধরে বলল, কে? হাতির পিঠে কে?

শশাংক পাল বললেন, নিজের পরিচয় আগে দাও। তুমি কে?

ধনু শেখ বলল, গোস্তাকি মাফ হয়। আপনাকে চিনতে পারি নাই। সালাম। হুজুর কই যান?

শশাংক পাল বললেন, বিষ্টি বাদলার দিনে আলাপ পরিচয় করতে ভালো লাগতেছে না। তুমি ধনু শেখ না?

জে।

খাসির মাংস বইলা তুমিই তো অম্বিকা ভট্টাচার্যকে গরু দিলা?

ভুলক্রমে দিয়েছি। আমি বিরাট অপরাধ করেছি।

ভুলক্রমে কর নাই। কাজটা তুমি করেছ সজ্ঞানে। আগের ক্ষমতা যদি থাকতো তোমারে আমি নেংটা কইরা গ্রাম চক্কর দেওয়াইতাম।

ধনু শেখ বলল, দশজন বললে এখনো আমি নেংটা হইয়া গ্রাম চক্কর দিতে পারি। কোনো অসুবিধা নাই।

তুমি অতি ধুরন্ধর।

কথা সত্য।

আমার একটা দোনলা বন্দুক আছে, খরিদ করতে চাও?

অবশ্যই চাই।

দোনলাটা নেত্রকোনা সদরে বন্ধক দেয়া আছে। বন্ধকি ছুটায়ে বিক্রি করতে রাজি আছি। আমার অর্থের প্রয়োজন।

ধনু শেখ বললেন, আমি আগামীকাল নিজে উপস্থিত হব।

হাতি নড়তে শুরু করেছে, সম্ভবত তার বিবেচনায় এখন যাওয়া যায়। বৃষ্টি কমে এসেছে। চারপাশে ঘন অন্ধকার। দূরে রঙিলা বাড়িতে আলো দেখা যায়।

ধনু শেখ দোটানায় পড়েছে। রঙিলা বাড়ির দিকে যাবে, না নিজ বাড়িতে যাবে? আজি মঙ্গলবার না, তারপরেও ঝড়বৃষ্টির রাতে গানবাজনা, আমোদ ফুর্তি ভালো লাগে। আজ সারাদিন নানান ঝামেলা গিয়েছে। ঝামেলার শেষ করতে হয়। আমোদ দিয়ে। এইটাই নিয়ম।

ধনু শেখ নিয়মের ব্যতিক্রম করে বাড়ির দিকে রওনা হলো। বাড়িতেও আনন্দের ব্যবস্থা আছে। তারা নামের যে ঘাটুছেলেকে দুই মাসের চুক্তিতে রাখা হয়েছে সেই ছেলেটা ভালো। তার গানের গলাও ভালো। দুই মাসের চুক্তি শেষ হওয়ার পথে। ছেলের বাবা এসেছিল ছেলেকে নিয়ে যেতে। অনেক দেনদরবার করে তাকে ফেরানো হয়েছে। লোকটা বিদের হাডি। নতুন চুক্তিতে যাবে না। সে না-কি জমি কিনেছে। খেতের কাজে ছেলেকে দরকার। চাপ দিয়ে চুক্তির টাকার পরিমান বাড়াতে চায় এটা পরিষ্কার। ধনু শেখ চাপ খাওয়ার বস্তু না।

বাড়িতে পৌঁছে ধনু শেখ গরম পানিতে গোসল করল। খাওয়া দাওয়া সেরে পালঙ্কে গা ছেড়ে দিল। ধনু শেখের স্ত্রী কমলা পানের বাটা নিয়ে এলো। পান মুখে দিতে দিতে ধনু শেখ জড়ানো গলায় বলল, তারাকে ডাক। গানবাজনা হোক।

কমলা বলল, সে তো নাই।

হতভম্ব ধনু শেখ বলল, নাই মানে কী?

চইলা গেছে।

কই চইলা গেছে?

তার দেশের বাড়িতে।

কখন গেছে?

সাইন্ধ্যা কালে।

ধনু শেখ কঠিন গলায় বলল, মাগি তুই নিজেরে কী ভোবস? সইন্ধ্যা কালে গেছে, তুই আমারে খবর দিবি না? আমার বন্দুক নাই। বন্দুক থাকলে আইজ তরে গুলি কইরা মারতাম।

ধনু শেখ পালঙ্ক থেকে নামছে। চাদর গায়ে দিচ্ছে। কমলা ভীত গলায় বলল, আপনে যান কই?

ঐ বলদ পুলারে আনতে যাই। আইজ রাইতের মধ্যে যদি তারে না। আনছি, ঘুংঘুর পরাইয়া না নাচাইছি তাইলে আমার নাম ধনু শেখ না। আমার নাম কুত্তা শেখ।

কমলা ক্ষীণস্বরে বলল, সকালে যান।

ধনু শেখ বলল, মাগি চুপ! আমি এখনই যাব। ঐ পুলারে আইন্যা মাওলানা ডাকায়া শাদি করব। সে-ই হইব তোর আসল সতিন।

পুরুষের সাথে পুরুষের বিবাহ হয়?

টাকা থাকলে সবই হয়।

ধনু শেখ দুর্যোগের রাতেই বের হয়ে গেল। পথে কালী মন্দির পড়ল। বাজারের কালী মন্দির। ধনু শেখ কালীমূর্তির মাথা ভেঙে ফেলল। গুরুত্বপূর্ণ কাজে যাওয়ার সময় কোনো মুসলমান যদি হিন্দু মন্দিরের কোনো ক্ষতি করে তাহলে বিনা ঝামেলায় কাৰ্য সমাধা হয়। এই ছিল তখনকার লোকজ বিশ্বাস।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *