আমি বসে আছি শিমুল গাছের নীচে। আগুনরাঙা ফুলে গাছ ঢেকে আছে। আমার চারদিকেও রাশি রাশি ফুল। আমার হাতে একটা কাগজ এবং কলম। কাগজে আমি একটি চিঠি লিখছি। তিন লাইনের চিঠি।
জামিল ভাই,
আমি আপনাকে ভালবাসি।
ভালবাসি ভালবাসি ভালবাসি।
আমার চোখ ভর্তি পানি। চিঠি শেষ হওয়া মাত্র আমার গাল বেয়ে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। এবং আমি ভয়ানক চমকে উঠলাম কারণ জামিল ভাই চুপিচুপি আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। আমি হাতের কাগজটা মুঠোর ভেতর লুকিয়ে ফেললাম।
না, বাস্তব কোনো ব্যাপার না। এই আমি রুমালী নই—এই আমি হচ্ছি ছবির দিলু, যে তার জীবনের প্রথম প্রেমপত্র লিখেছে। যে প্রেমপত্র সে তার প্রেমিককে দিতে পারছে না। সে তার গোপন ভালবাসার কথা পৃথিবীর কাউকেই জানাবে না। জানানো সম্ভব নয়।
জামিল ভাইয়ের সঙ্গে দিলুর কিছু কথা হবে। কথা শেষ হবার পর দিলু ছুটে চলে যাবে। চিত্রনাট্যটা এরকম।
শট ওয়ান। (টপ শট। ক্যামেরা প্যান করবে।)
শিমুল গাছের শিমুল ফুল থেকে দিলু। দিলু কাগজে চিঠি লিখছে। দিলুর চারপাশে শিমুল ফুল।
শট টু।
(ক্যামেরা চার্জ করে দিলুর মুখের উপর। ক্লোজ শট।)
দিলুর চোখে জল। জল গড়িয়ে গালে পড়ে স্থির হয়ে গেল।
শট থ্রি। (ও এস শট। ক্যামেরা দিলুর পেছনে। ঘাড়ের ফাঁক দিয়ে চিঠির লেখাগুলি পড়া যাচ্ছে। ক্যামেরা ওয়াইড হবে। ফ্রেমে ঢুকবে জামিল। দিলুর পাশে দাঁড়াবে। দিলু চমকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়বে।)
শট ফোর। (টু শট। মিড ক্লোজ। দিলু ও জামিল।)
জামিল : তুই এখানে? চারদিকে তোকে খোঁজা হচ্ছে। কী করছিলি?
দিলু : কিছু করছিলাম না।
জামিল ও কাগজ-কলম নিয়ে বসে আছিস, চোখ ভেজা …. ব্যাপার কী? কবিতা লিখছিলি?
দিলু : হু।
জামিল : দেখি কী লিখলি?
দিলু : না।
জামিল : না কেন? তুই সবাইকে ফাকি দিয়ে গোপনে গোপনে মহিলা কবি হয়ে যাবি আমরা কেউ জানব না, তা হবে না। দেখি। একী, কাগজটা কচলাচ্ছিস কেন?
শট ফাইভ।
(ক্লোজ শট। দিলুর হাত। হাতের মুঠোয় কাগজ। কাগজটা সে কচলাচ্ছে। জামিল কাগজটা নিতে হাত বাড়াল।)
শট সিক্স।
(লং শট! দিলু জামিলকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ছুটে চলে যাচ্ছে। বাতাসে দিলুর চুল উড়ছে। শাড়ির আঁচল উড়ছে।)
শট সেভেন।
(মিড ক্লোজ শট। বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে জামিল।)
শট এইট।
(দিলু নদীর পার ঘেঁষে দৌড়াতে দৌড়াতে কাশবনের ভিতর ঢুকে গেল। তাকে আর দেখা যাচ্ছে না। বাতাসে শুধু কাশবনের ফুল কাঁপছে।)
সাত নম্বর শট পর্যন্ত নেয়া হয়ে গেল। আট নাম্বার শট–কাশবনের দৃশ্য বাকি রইল। কাশবনের জন্যে যেতে হবে সোমেশ্বরী নদীর পারে। কাশবন যেখানে পাওয়া গেছে সেই জায়গাটাও অনেক দূরে। হেঁটে যেতে হবে। দুতিন ঘণ্টা লাগবে যেতে। এই শটটা অন্যদিন নেবার কথা। কিন্তু ডিরেক্টর সাহেব বললেন, আজই শটটা নিয়ে নেব। পরে কনটিনিউইটি সমস্যা দেখা দিতে পারে। ক্যামেরা চলে যাক। আমরা একটু পরে যাই।
ক্যামেরা ইউনিট সঙ্গে সঙ্গে রওনা হয়ে গেল। ক্যামেরাম্যান আজিজ আংকেল আমাকে বললেন, বকুল শুনে যাও।
আমি তার কাছে গেলাম। তিনি কী বলবেন তা আমি জানি বলে মনে হচ্ছে। অবশ্যি যে কথাগুলি মানুষ বলবে বলে ভেবে রাখে সব সময় তা বলতে পারে না। শেষ মুহূর্তে অন্য কথা বলে। আজিজ আংকেলের ব্যাপারে এই সমস্যা হবার কথা না।
বকুল আজ গরমটা কেমন পড়েছে বল তো?
খুব গরম।
শেষ বিচারের দিন সূর্য যেমন মাথার উপর চলে আসবে মনে হচ্ছে আজও সূর্য মাথার উপর চলে এসেছে।
জি।
খুব বেশি করে পানি খাবে। শরীর ঠিক রাখার একটামাত্র পথ, বেশি করে পানি খাওয়া। সারা দিনে মাঝারি সাইজের এক কলসি পানি খেলে তুমি শরীর নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পার।
আচ্ছা, এখন থেকে সারা দিনে এক কলসি পানি খাব। আর কোনো উপদেশ?
না, আর কোনো উপদেশ না। তোমার অভিনয় খুব ভাল হয়েছে। মঈন ভাই তোমাকে নিশ্চয়ই বলবেন। আমি আগেই বললাম। তোমার অভিনয় তো আমি আগে দেখি নি এই প্রথম দেখছি। যতবার তুমি পর্দায় আসবে ততবার পর্দা ঝলমল করে উঠবে।
থ্যাংক য়্যু।
তোমাকে ছোট্ট একটা টিপস্ দেই। তোমার চোখ যেই মুহূর্তে ক্যামেরা লেভেলের সঙ্গে চলে আসবে সেই মুহূর্তে তুমি তোমার থুতনি একটু ভেতর দিকে টেনে নেবে। নেবে খুব আস্তে? ঝট করে না। মনে থাকবে?
থাকবে।
একটু করে দেখাও তো!
আমি দেখালাম। আজিজ আংকেল বললেন, হ্যা, ঠিক আছে। এখন যাও। এক জগ ঠাণ্ডা পানি খেয়ে ফেল।
আমি যাচ্ছি আমার মার দিকে। মার জ্বর নেই তবে শরীর এখনো সারে নি। ঠাণ্ডা লেগে গেছে। সারাক্ষণ কাশছেন। বুকের ভেতর থেকে কেমন ঘড়ঘড় শব্দও হচ্ছে। তার বিছানায় শুয়ে থাকার কথা, কিন্তু তিনি শুটিং দেখতে এসেছেন। বড় ছাতার নীচে বসে আছেন। গরমে ঘেমে চপচপ করছেন। মুখে রুমাল চাপা দিয়ে একটু পরে পরে কাশছেন। তার চোখমুখ লালচে হয়ে আছে। আবার বোধহয় জ্বর আসছে।
মার হাতে পাখা। তিনি প্রবল বেগে নিজেকে হাওয়া করছেন। তাতে লাভের মধ্যে লাভ এই হচ্ছে যে তিনি আরো ঘামছেন। আমি তার পাশে দাঁড়ানো মাত্র মা গলা নিচু করে বললেন— বকু, তুই যখন দৌড়াচ্ছিলি তখন তোর শাড়ি উঠে গিয়েছিল।
তাই?
হ্যাঁ, একেবারে হাঁটু পর্যন্ত উঠে গেছে।
পায়ের বড় বড় লোম সব দেখা গেছে?
উদ্ভট কথা বলছিস কেন? তোর পায়ে লোম আছে নাকি?
ও আচ্ছা আমি ভুলেই গেছি আমার পায়ে লোম নেই।
বকু, তুই ফাজিল ধরনের হয়ে যাচ্ছিস।
কী করব মা বল–ছবির লাইনের এই সমস্যা। একটা ভাল মেয়ে টোকে, ফাজিল মেয়ে হয়ে বের হয়ে যায়। তোমার শরীর কেমন মা?
ভাল।
তুমি কি যাচ্ছ আমাদের সঙ্গে?
কোথায় যাব?
কাশবনে। এখন কাশবনের শুটিং হবে। এখান থেকে সাত কিলোমিটার দূর। নদীর পার ঘেষে হেঁটে হেঁটে যেতে হবে, পারবে?
কাশবনের শুটিংতো আজ হবার কথা না।
হবে, আজই হবে। কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা রওনা হব।
তোকে আমি একা ছাড়ব কীভাবে?
একা ছাড়তে তো বলছি না। তুমি সঙ্গে চল। পালকি তো পাওয়া যাবে — ডিরেক্টর সাহেবকে বল উনি একটা খাটিয়া জোগাড় করে আনবেন। তুমি খাটিয়াতে শুয়ে শুয়ে আমার সঙ্গে যাবে। আমরা তোমাকে কাঁধে করে নিয়ে যাব।
তোর কী হয়েছে বকু?
কিছু হয় নি তো?
তোর সঙ্গে আমার কথা আছে।
বল।
এখন বলব না— রাতে বলব।
মা উঠে দাঁড়িয়েছেন। আমি দেখলাম তিনি উত্তেজিত ভঙ্গিতে ডিরেক্টর সাহেবের দিকে যাচ্ছেন। তিনি তাকে কী বলবেন কে জানে! তাঁর প্রধান চেষ্টা থাকবে আজ যেন কাশবনের শুটিংটা না হয়। কারণ তিনি সুস্থ না তিনি অতদূর যেতে পারবেন না। তবে তিনি নিজের কথা বলবেন না, অন্য কোনো অজুহাত বের করবেন। আমি ছাতার নীচে বসলাম। তৃষ্ণা পেয়েছে। আজিজ আংকেলের কথা মত সারা দিনে এক কলসি পানি খাওয়া দরকার। আমার ইচ্ছা করছে এখনি এক কলসি পানি খেয়ে ফেলতে। টেবিলের উপর জগ আছে, গ্লাস আছে। আমি ইচ্ছা করলেই পানি খেতে পারি। কিন্তু খাচ্ছি না, তৃষ্ণাটা আরো বাড়ুক। তৃষ্ণা বাড়তে বাড়তে যখন সারা শরীরে হাহাকারের মত ছড়িয়ে পড়বে তখন পানি খাব।
মা ডিরেক্টর সাহেবের কাছে পৌঁছেছেন, কিন্তু কথা বলার সুযোগ পাচ্ছেন না। ডিরেক্টর সাহেব গভীর মনোযোগে চিত্রনাট্যের পাতা ওল্টাচ্ছেন। তার পাশে গম্ভীর মুখে ফরহাদ সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। আমার ধারণা ডিরেক্টর সাহেব ফরহাদ সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছেন না বলেই এত মনোযোগ দিয়ে চিত্রনাট্য দেখছেন। এইবার ফরহাদ সাহেব কী যেন বলছেন। হাত-পা নেড়ে নেড়ে বলছেন। ডিরেক্টর সাহেব একবার শুধু তাকালেন, তারপর আবার চিত্রনাট্য পড়া শুরু করলেন। এখন মনে হচ্ছে মা কিছু বললেন। মা বললেন ফরহাদ সাহেবকে। মার সঙ্গে ফরহাদ সাহেবের কী কথা থাকতে পারে? ফরহাদ সাহেব আবার কী যেন বললেন। এখন মা চলে আসছেন। মার মুখ হাসিহাসি। মনে হয় ফরহাদ সাহেবের সঙ্গে ডিরেক্টর সাহেবের ঝগড়া হচ্ছে। ঝগড়া না হলে মার মুখ এমন হাসিহাসি হত না।
ছুটে আসার কারণে মা হাঁপাচ্ছেন! হাঁপানি সামলে উজ্জ্বল চোখে আমার দিকে তাকালেন।
বকু।
বল।
ফরহাদ সাহেব অশ্রাব্য গালাগালি করছে। আমি দেখলাম এর মধ্যে থাকা ঠিক না। চলে এসেছি।
চলে এলে কেন? ইন্টারেস্টিং ঝগড়া সবটা শোনা উচিত ছিল।
তুই এরকম করে কথা বলছিস কেন?
রোদে মাথা এলোমেলো হয়ে গেছে বলে যা মনে আসছে বলছি! মা, তুমি কি যাচ্ছ আমার সঙ্গে?
হ্যাঁ। তোকে কি আমি একা ছাড়ব?
ভাল।
তুই কি চাস আমি সঙ্গে যাই না?
না না, তোমাকে যেতেই হবে। তুমি না গেলে কে দেখবে আমার শাড়ি হাঁটু পর্যন্ত উঠল কি উঠল না?
মা তাকিয়ে আছেন। আমিও হাসি মুখে তাকিয়ে আছি। মা কাশতে শুরু করেছেন। কাশি কিছুক্ষণের জন্যে থামতেই আমি বললাম, কাশি থামিও না তো মা, চালিয়ে যাও। ঝগড়ার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিসেবে কাশির কোনো তুলনা হয় না।
মা কিছু একটা বলতে গেলেন, বলতে পারলেন না। তাঁর কাশি আবারো শুরু হল।
ডিরেক্টর সাহেব এবং ফরহাদ সাহেবের ঝগড়া মনে হয় ভালই জমেছে। সোহরাব চাচা দৌড়ে যাচ্ছেন। তিনি চোখে ইশারা করলেন ইউনিটের আরো একজন দৌড়াচ্ছে। তারা ডিরেক্টর সাহেবকে গার্ড দিয়ে রাখবে। ফরহাদ সাহেব একটা ব্যাপার বোধহয় বুঝতে পারছেন না—তিনি এখন বাস করছেন ডিরেক্টর সাহেবের জগতে। এখানে কোনো উনিশ-বিশ করা যাবে না। ইউনিটের প্রতিটি মানুষ ডিরেক্টর সাহেবের মহা ভক্ত। এরা তাঁর জন্যে জীবন দিয়ে দিতে প্রস্তুত। ডিরেক্টর সাহেব একবার যদি বলেন–ফরহাদ নামের এই বেয়াদবটাকে মেরে সোমেশ্বরী নদীতে ফেলে দাও, সঙ্গে সঙ্গে তার হুকুম তালিম হবে। ইউনিটের আরো একজন ছুটে যাচ্ছে। পাপিয়া ম্যাডামকে কোথাও দেখছি না। তিনি আজ শুটিং স্পটে আসেন নি।
বকু!
হুঁ।
চল কাছে গিয়ে শুনি কথাবার্তা কী হচ্ছে।
তুমি যাও মা, আমার যেতে ইচ্ছে করছে না। তুমি গিয়ে সব মন দিয়ে শোন— পরে আমাকে রিপোর্ট করবে।
এরকম করছিস কেন, আয় না! সব বিষয়ে তোর কৌতূহল এত কম কেন? আয় না।
আমি নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে এগুচ্ছি। অনিচ্ছার প্রধান কারণ হচ্ছে ফরহাদ সাহেবের কুৎসিত গালাগালি শুনে ডিরেক্টর সাহেব যদি কোনো কুৎসিত গালি দিয়ে বসেন তা হলে আমার খুব খারাপ লাগবে। ভদ্রলোক এখনো অবশ্যি মোটামুটি শান্ত ভঙ্গিতেই দাঁড়িয়ে আছেন। এই শান্ত ভঙ্গি কতক্ষণ থাকবে সেটাই কথা। এক সময় হয়তো তার ধৈর্যচ্যুতি হবে তিনি বস্তির মানুষের মুখের কোনো নোংরা গালি দিয়ে বসবেন। তাঁর মুখে সেই গালি শুনে মা খুব মজা পেতে পারেন আমি পাব না।
এদের দুজনকে ঘিরে এখন অনেকেই দাঁড়িয়ে আছে। প্রথম দিন যে মওলানার সঙ্গে দেখা হয়েছিল তিনিও আছেন। মেরাজ মাস্টার। এই ভদ্রলোকের আগ্রহই মনে হচ্ছে সবচে বেশি। তিনি চোখ বড় বড় করে প্রতিটি কথা শুনছেন এবং মনে হয় বিমল আনন্দ পাচ্ছেন। আমরা দুজন কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালাম। যেসব কথাবার্তা শুনলাম তা হচ্ছে—
ফরহাদ : (রাগে তাঁর মুখে থুথু চলে এসেছে। ঠোঁটের কোণায় থুথু। তিনি মনে হয় মদ খেয়ে এসেছেন। গন্ধে টেকা যাচ্ছে না।) বাইচলামি? আমার সঙ্গে বাইচলামি! সারাদিন মেকাপ নিয়ে বসায়ে রেখে আরেকজনকে দিয়ে শুটিং করায়। সম্বুন্ধির বাচ্চা তুমি ভাব কী?
ডিরেক্টর সাহেব : (তাঁর মুখভঙ্গির সামান্যতম পরিবর্তন হয় নি। তিনি পকেট থেকে সিগারেট বের করলেন। নিজে একটা ধরালেন। প্যাকেট এগিয়ে দিলেন।) ফরহাদ সাহেব, নিন সিগারেট খান। সিগারেট খেয়ে মেজাজ ঠিক করুন।
ফরহাদ ও সিগারেট। শালা সিগারেট আমি তোর ইয়ে দিয়ে ঢুকায়ে দিব।
ডিরেক্টর : (একটু মনে হল বিস্মিত হয়েছেন।) তাই নাকি?
ফরহাদ : (রাগ এখন চরমে উঠেছে) আবার বলে তাই নাকি? আমি দুইশ টাকা শিফটের এক্সট্রা না, আমি মেগাস্টার।
ডিরেক্টর মেগাস্টার–আমার কথা শুনুন। আপনার গালাগালি যা দেবার দ্রুত দিয়ে শেষ করুন। আমার কাজ আছে। আপনার গালাগালি আমি অনেক আগেই বন্ধ করতে পারতাম, বন্ধ করছি না কারণ সবাই আগ্রহ নিয়ে শুনছে এবং খুব আনন্দ পাচ্ছে, তাদের এই আনন্দ থেকে আমি বঞ্চিত করতে চাচ্ছি না।
ফরহাদ ও শুওরের বাচ্চা আমি তোর মুখে পিশাব করে দি।
ডিরেক্টর : কখন করতে চান, এখন? করুন।
মা এই পর্যায়ে খামচি দিয়ে আমার হাত ধরলেন–কারণ ফরহাদ সাহেব সত্যি সত্যি তার প্যান্টের জিপারে হাত দিয়েছেন। টেনশনে মার কাশি ভাল হয়ে গেছে। তিনি এতক্ষণে একবারও কাশেন নি। মা ফিসফিস করে বললেন—বকু ও তো সত্যি সত্যি প্যান্ট খুলছে। চল চলে যাই।
আমি ফিসফিস করে বললাম, না। শেষটা দেখব। তোমার লজ্জা বোধ করার কোন কারণ নেই মা। ভেবে নাও রাস্তার কোনো নগ্ন পাগল। তাছাড়া ফরহাদ সাহেব নগ্ন হবার আগেই কোনো একটা ব্যবস্থা হবে।
কী ব্যবস্থা হবে?
কী ব্যবস্থা হবে আমি জানি না, কিন্তু একটা কিছু ব্যবস্থা হবে।
ফরহাদ সাহেব টান দিয়ে জিপার পুরোপুরি খুলে ফেলেছেন। জিপারের ফাঁক দিয়ে তার লাল আন্ডারওয়ার দেখা যাচ্ছে। ছেলেরা এমন লাল টুকটুক আন্ডার ওয়ার পরে আমি জানতাম না। আমি ডিরেক্টর সাহেবের দিকে তাকালাম। ঘটনাটা তিনি অনেক দূর এগুতে দিয়েছেন। এতদূর এগুতে দেয়া ঠিক হয় নি। আমি হলে দিতাম না।
ডিরেক্টর সাহেব সিগারেট ধরালেন। তারপর সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে মওলানা সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন–মওলানা সাহেব একটু শুনুন তো। কাছে আসুন।
মওলানা সাহেব এগিয়ে গেলেন।
ডিরেক্টর সাহেব বললেন, আপনি কি আমার জন্যে ছোট্ট একটা কাজ করে দিতে পারবেন?
মওলানা বললেন, অবশ্যই পারব জনাব।
ফরহাদ নামের এই বদ মানুষটাকে আমি এমন এক শাস্তি দিতে চাই যা তার দীর্ঘদিন মনে থাকবে। আপনি এর কানে ধরে পুরো মাঠের চারদিকে একবার চক্কর দেয়াবেন। এই দৃশ্যটা আমরা ক্যামেরায় ধরে রাখব। পারবেন না?
জনাব, আপনি হুকুম দিলে পারব। ইনশাল্লাহ।
ফরহাদ সাহেব হতভম্ব হয়ে গেলেন। কিছু বলতে গেলেন— বলতে পারলেন। আমি তাকালাম ডিরেক্টর সাহেবের দিকে–তাঁর মুখ হাসিহাসি। তার চোখ কঠিন হয়ে আছে। এমন কঠিন চোখ সচরাচর দেখা যায় না। মা আমার হাত খামচে ধরে বললেন, কী হবে রে? আমি জবাব দিলাম না। লক্ষ্য করলাম সোহরাব চাচা এগিয়ে এসে ফরহাদ সাহেবের কানে-কানে কী যেন বললেন। সঙ্গে সঙ্গে ফরহাদ সাহেবের মুখ পাংশুবর্ণ হয়ে গেল। জোঁকের মুখে নুন পড়ার অবস্থা। এতক্ষণ যে মানুষটা হৈচৈ চিৎকার করছিল সে কুঁকড়ে ছোট হয়ে গেল। বেঁটেখাটো মেরাজ মাস্টার এগিয়ে যাচ্ছে। সত্যি সত্যি কি এই মানুষটাকে কান ধরে মাঠের চারপাশে চক্কর খাওয়ানো হবে?
ফরহাদ সাহেব তার প্যান্টের খোলা জিপার টান দিয়ে তুলে বিড়বিড় করে বললেন–মঈন ভাই, আমার ভুল হয়েছে। মাফ করে দেন। সকাল থেকে বিয়ার খাচ্ছি যা করেছি নেশার ঝেকে করেছি।
ডিরেক্টর সাহেব গলা উঁচিয়ে বললেন–স্টিল ক্যামেরাম্যান কোথায়? কানে ধরে দৌড়ানোর ছবি তুলে রাখ। ক্যামেরা ইউনিট কি কাশবনে চলে গেছে?
সোহরাব চাচা বললেন, জ্বি স্যার।
আর্টিস্ট? আর্টিস্ট গিয়েছে?
বলেই তিনি আমাকে দেখলেন। সহজ স্বাভাবিক গলায় বললেন–চল যাই, দেরি হয়ে গেল তো। মেকাপম্যান কোথায়? তাকেও যেতে হবে।
ফরহাদ সাহেবের সামনে এসে মেরাজ মাস্টার দাঁড়িয়েছেন। কানে হাত দেবেন কি দেবেন না মনস্থির করতে পারছেন না। তিনি আবারো তাকালেন ডিরেক্টর সাহেবের দিকে। ডিরেক্টর সাহেব বললেন, মওলানা সাহেব বাদ দিন। একে এই জংলা মাঠের চারদিকে কানে ধরে ঘোরালে কিছু হবে না। একে ঘোরাতে হবে এফডিসির চারদিকে। এই কাজটা আমি ঢাকায় গিয়ে করব।
মেরাজ মাস্টার বললেন, স্যার, আমি কি শুটিং দেখার জন্যে আপনাদের সঙ্গে আসব?
ডিরেক্টর সাহেব বললেন, অবশ্যই আসবেন। আপনি বিসমিল্লাহ বলে ক্যামেরায় ফু দিয়ে দেবেন, তারপর ক্যামেরা ওপেন হবে। তার আগে না।
চারপাশের পরিবেশ স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। শুধু ফরহাদ সাহেব ঘামছেন। খুব ঘামছেন। তিনি যে হঠাৎ করে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছেন তা বোঝা যাচ্ছে। সোহরাব চাচা কানে-কানে কথা বলার পর থেকে পরিবর্তনটা হয়েছে। কানে-কানে বলা কথাগুলি কী? সোহরাব চাচা কি আমাকে বলবেন? মনে হয় না। তিনি হড়বড় করে সারাক্ষণ কথা বলেন ঠিকই, কিন্তু গোপন কথা গোপনই রাখেন। মানুষটাকে হয়তো এই কারণেই সবার ভাল লাগে। যে কথাগুলি ম্যাজিকের মত কাজ করল, সেই কথা সোহরাব চাচা আগে কেন বললেন না!
আমরা কাশবনের দিকে রওনা হয়েছি। মা যাচ্ছেন আমাদের সঙ্গে। তার এমন অসুস্থ শরীর — আমি জানি আজ শুটিং শেষে তিনি পুরোপুরি শয্যাশায়ী হবেন। না গেলে চলত, কিন্তু তিনি যাবেনই। মা লেফট রাইটের ভঙ্গিতে দ্রুত পা ফেলছেন। প্রমাণ করার চেষ্টা যে তিনি মোটেই অসুস্থ না। খুব সুস্থ। তিনি হাঁটছেন ডিরেক্টর সাহেবের পাশে পাশে। আমি পিছিয়ে পড়েছি। আমার পাশে পাশে আসছেন মেরাজ মাস্টার। ভদ্রলোক আজ সেজেগুজে এসেছেন। চোখে সুরমা। পায়জামা ইস্ত্রি করা। আমাদের সঙ্গে দুজন ছত্রধর যাচ্ছে। একজনের হাতে সবুজ রঙের বিশাল ছাতি। এই ছাতি ডিরেক্টর সাহেবের মাথায় ধরার কথা। ডিরেক্টর সাহেব ইশারায় নিষেধ করেছেন বলে ছাতা ধরা হয় নি। ছাতাটা ধরলে ভাল হত, মা খানিকটা ছায়া পেতেন। আমার মাথায় উপর ছাতা ধরা আছে। আমি ভদ্রতা করে নিষেধ করি নি। ছায়া আমার প্রয়োজন। কড়া রোদে মেকাপ নষ্ট হয়ে যাবে। অবশ্যি আমার ধারণা মেকাপ নষ্ট হলেও ক্ষতি নেই। পুরো দৃশ্যটা লং শটে ধরা থাকবে। এতদূর থেকে পরিষ্কার কিছু দেখতে পাওয়ার কথা না।
মা, আপনি কি আমাকে চিনেছেন?
জ্বি চিনেছি। আপনি মেরাজ মাস্টার।
আপনাদের সঙ্গে যে যাচ্ছি খুবই ভাল লাগছে। সবাই কেমন হৈচৈ করতে করতে যাচ্ছেন। দলের সঙ্গে থাকার মজাই আলাদা।
জ্বি।
আপনাদের ডিরেক্টর সাহেবের সঙ্গে কয়েকবার আলাপ হয়েছে— বিশিষ্ট ভদ্রলোক। এরকম বিশিষ্ট ভদ্রলোক সচরাচর দেখা যায় না। অতি অমায়িক।
জ্বি।
এ স্যারের সঙ্গে কফি খেয়েছি। নানান বিষয় নিয়ে আলাপও হয়েছে। ধর্ম বিষয়েও স্যারের জ্ঞান অতি উচ্চ শ্রেণীর।
ধর্ম নিয়ে আপনারা আলাপ করলেন?
উনিই আলাপ করলেন, আমি শুধু শুনলাম, আমার জ্ঞানবুদ্ধি ও কম, পড়াশোনাও কম।
ও আচ্ছা।
শৈশবকালে হাফিজিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছিলাম। পাক কোরান মুখস্থ করেছিলাম।
করেছিলাম বলছেন কেন? এখন মুখস্থ নাই?
জ্বি না। স্মৃতি শক্তির গোলমাল হয়— এক সূরা থেকে আরেক সূরায় চলে যাই— আল্লাহর কাছে গুনাহগার হই। তবে আম্মা এখনো চেষ্টা চালায়ে যাচ্ছি। বোজ এক-দেড় ঘণ্টা পড়ি। আল্লাহ পাকের যদি দয়া হয় ইনশাল্লাহ আবার মুখস্থ হবে। উনার বিশেষ দয়া ছাড়া কোরানে হাফেজ হওয়া সম্ভব না।
তাই না-কি?
জি। উনার পাক কালাম রাম শ্যাম যদু মধু মুখস্থ করে ফেলল, আর হয়ে গেল তা না। উনার হুকুম লাগবে।
উনার হুকুম ছাড়া কিছু হবে না?
অবশ্যই না।
আচ্ছা ধরুন খুব সুখী একটা পরিবার স্বামী স্ত্রী এবং কন্যা। তারা সুখে শান্তিতে ঘর সংসার করছে। হঠাৎ একদিন স্বামীটি সবাইকে ছেড়ে অন্য একটা মেয়ের সঙ্গে চলে গেল। এই ঘটনাটাও কি আল্লাহর হুকুমেই ঘটল?
অবশ্যই মা। অবশ্যই।
মানুষকে তো বিচার-বিবেচনার শক্তি দেয়া হয়েছে। ভাল এবং মন্দ বোঝার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। সে সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করবে না?
অবশ্যই করবে, কিন্তু মা শেষ পর্যন্ত সেই কাজই সে করবে যে কাজের হুকুম তাকে করা হয়েছে।
ও আচ্ছা। আপনি কি বিয়ে করেছেন? জ্বি না। বিয়ে করেন নি কেন? আপনার তো বয়স ভালই হয়েছে।
সংসারধর্ম পালন করার মত অর্থের সংস্থান নাই আম্মা। প্রাইভেট স্কুল, বেতন নামমাত্র। তাও সব মাসে পাওয়া যায় না। এক বাড়িতে জায়গীর থাকি। এতে দুই বেলা খাওয়াটা হয়।
বিয়ে করা তো ফরজ, বিয়ে না করে আপনি গুনাহ করছেন না?
জ্বি না। রসুলে করিমের একটা হাদিস আছে। স্ত্রীর ভরণপোষণের ক্ষমতা যাদের নাই তাদেরকে তিনি বিবাহ না করার পরামর্শ দিয়েছেন।
আপনি কি সবকিছু হাদিস কোরান মেনে করেন?
জি আম্মা চেষ্টা করি। তবে আমার জ্ঞান সীমিত। সব হাদিস জানিও না।
নিজের অবস্থার পরিবর্তনের চেষ্টা করছেন না কেন? নাকি হাদিসে নিষেধ আছে।
কোনো নিষেধ নাই। চেষ্টা করতেছি আম্মা।
কীভাবে চেষ্টা করছেন? দোয়া করে? প্রতিদিন নামাজ শেষ করে দোয়া করছেন?
জি করি। তার উপর লোকজনদেরকেও বলি আমার একটা চাকরির খোঁজ দিতে। ডিরেক্টর সাহেবকেও বলেছি। উনি বলেছেন—দেখবেন।
উনি তো আপনাকে ছবির লাইনে একটা কাজ জোগাড় করে দিয়ে দেবেন। নায়িকাদের পোশাকের কনটিনিউইটি ঠিক রাখার কাজ। সেই কাজ আপনি করবেন?
আল্লাহপাক যদি নির্ধারণ করে রাখেন আমাকে তো করতেই হবে।
আপনি খুব আল্লাহভক্ত মানুষ।
জ্বি আম্মা। তবে উনাকে ভক্তির চেয়ে ভয় বেশি করি।
দোজখের আগুনে আপনাকে পোড়াবেন সেই ভয়?
দোজখে শুধু যে আগুন থাকে তা না–খুব ঠাণ্ডা দোজখও আছে। বড়ই শীতল।
সেকী— জানতাম না তো!
দোজখের একটা জায়গা আছে নাম হল জামহারীর–বড়ই শীতল স্থান মানুষের কল্পনাতেও আসবে না এমন শীতল। তবে সবচে ভয়ংকর হল— জুব্বল হুযন।
জুব্বল হুযনটা কী?
জুবুল হুনের অর্থ হল আম্মা বিষাদের ঘাঁটি। এই জায়গাটা জাহান্নাম দোজখের অতি ভয়ংকর স্থান। আমাদের নবী-এ করিম বলেছেন সুম্বুল হুযন প্রধান দোজখ— অতি ভয়ংকর সেই স্থান।
মওলানা সাহেবের গা থেকে আতরের গন্ধ আসছে। আতরের গন্ধ সাধারণত তীব্র হয়ে থাকে। গন্ধ নাকে এলেই মৃত মানুষের কথা মনে আসে। মওলানা সাহেবের আতরের গন্ধ সেরকম না। মিষ্টি গন্ধ।
কাশবনের কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে দুপুর গড়িয়ে গেল। দুটা লং শট নেয়া হবে দুদিক থেকে সময় লাগল পুরো দুঘণ্টা। ডিরেক্টর সাহেব একটা বাড়তি শটও নিলেন— ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে ক্যামেরাম্যান কাশবনে শুয়ে পড়লেন। কাশফুলের ভেতর দিয়ে আকাশ ধরা হল। বাতাসে কাশফুল ক্যামেরার লেন্স ঢেকে দিচ্ছে আবার সরে যাচ্ছে। ডিরেক্টর সাহেব বললেন, এই শটটা ব্যবহার করতে পারব না। তবু নিয়ে রাখলাম। আকাশে শাদা মেঘ থাকলে ভাল হত। শাদা কাশফুল থেকে শাদা মেঘ। White to White.
এতদূর হেঁটে এসে মার অবস্থা কাহিল। তিনি একটা গাছে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে আছেন। একটু পরপর পানি খাচ্ছেন। তার চোখের নীচ কালো হয়ে আছে। সাধারণত রাতে ঘুম না হলে চোখের নীচে কালি পড়ে। মার চোখের নীচে কালি পড়েছে রোদে হেঁটে। আমি তার পাশে গিয়ে বসতেই তিনি বিরক্ত মুখে বললেন, ঐ মওলানার সঙ্গে কী নিয়ে এত গুজগুজ করছিলি?
ধর্মতত্ত্ব নিয়ে আলাপ করছিলাম মা। দোজখের শ্রেণীবিভাগ শিখছিলাম। গরম দোজখ ঠান্ডা দোজখ এইসব। তোমার তো মনে হচ্ছে অবস্থা কাহিল। ফিরবে কীভাবে?
ফিরব কীভাবে মানে? যেভাবে এসেছি সেইভাবে ফিরব।
তোমার পা ফুলে গেছে মা। ফোলা পা নিয়ে হাঁটতে পারবে না। তোমাকে কোলে করে নিয়ে যেতে হবে। কে তোমাকে কোলে নেবে সেইটা হচ্ছে কথা। দেখি তোমার হাতটা। জ্বর এসেছে কি না দেখি।
দূরে থাক! খবর্দার আমার গায়ে হাত দিবি না!
আমার দৌড় দিয়ে কাশবনে ঢোকার দৃশ্যটা কেমন হয়েছে মা?
জানি না কেমন হয়েছে। তুই আমার সঙ্গে কথা বলিস না।
আমি মার পাশে বসে আছি। তাকিয়ে আছি কাশবনের দিকে। বাতাসে কাশফুল দুলছে। অদ্ভুত সুন্দর একটা দৃশ্য। ডিরেক্টর সাহেব দূর থেকে হাত ইশারায় ডাকছেন। বুকে ধক করে একটা ঝাঁকুনি লাগল। কাকে তিনি ডাকছেন? আমাকে নাতো? আমার হাত-পা শক্ত হয়ে গেল। মা বললেন, একী কাণ্ড! তুই বসে আছিস কেন? মঈন ভাই তোকে ডাকছেন।
ইচ্ছে করছে ঠিক যে ভাবে দৌড়ে কাশবনে ঢুকেছি সেভাবে ছুটে যাই। আশ্চর্য আমি হাঁটতেও পারছি না। আমি তার কাছে দাঁড়াতেই তিনি বললেন, খুব টায়ার্ড?
এইসব ক্ষেত্রে বলতে হয় না, টায়ার্ড না। এই বলে মিষ্টি করে হাসতে হয়। আমি তা করলাম না। আমি বললাম–হ্যাঁ, টায়ার্ড।
তোমার অভিনয় খুব ভাল হচ্ছে।
দৌড় দিয়ে কাশবনে ঢুকে যাওয়া— এর মধ্যে অভিনয়ের কী আছে?
অনেক কিছুই আছে। একজন বড় অভিনেতা কী করেন? ইমপ্রোভাইজেশন করেন। খুব সচেতন ভাবে যে করেন তা না— সাবকনশাসলি করেন। তুমি কাশবনে ঢোকার মুখে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে গেলে তারপর পলকের জন্যে পেছনে ফিরে বনে ঢুকে গেলে। তোমাকে দাঁড়াতেও বলা হয় নি, পেছনে ফিরতেও বলা হয় নি। কাজটা তুমি করলে তোমার মত। আমার খুব পছন্দ হয়েছে।
আমি বিড়বিড় করে কিছু একটা বললাম। থ্যাংক য়্যু জাতীয় কিছু। তবে পরিষ্কার শোনা গেল না।
ডিরেক্টর সাহেব বললেন, তুমি আগেভাগে বল নি কী করবে। আমরাও জানতাম না কী করবে কাজেই আগের শট এন জি হয়ে গেল। নতুন করে ন্যামেরা ঠিকঠাক করতে হল। আগে ক্যামেরা ফিক্সড ছিল–এখন ক্যামেরা তোমাকে অনুসরণ করেছে। আসল যে কথা সেটা মন দিয়ে শোন আসল কথা হচ্ছে, তোমার অভিনয় আমার খুব পছন্দ হয়েছে।
সেলিম ভাইয়ের অভিনয় কেমন হচ্ছে?
ওকে যা বলা হচ্ছে সে তা করতে পারছে। যে-কোন ভাল পরিচালক সেলিমকে দিয়ে কাজ আদায় করে নিতে পারবেন, এর বেশি কিছু না। তুমি যে-কোনো পরিচালকের সঙ্গে অভিনয় করতে পারবে। সে পারবে না।
এক সময় হয়তো শিখে ফেলবেন। তখন পারবেন।
না, তাও পারবে না। অভিনয়কলা একটা পর্যায় পর্যন্ত শেখা যায়। মিডিওকার অভিনেতা হবার জন্যে যতটুকু অভিনয় জানতে হয় ততটুকু অভিনয় শেখানো যায়। তার বেশি শেখানো যায় না।
আমরা রওনা হব কখন?
এখনই রওনা হব। আমি চা করতে বলেছি— চা-টা হোক, চা খেয়েই রওনা দেব।
আমি প্রোডাকশনের কাউকে চা বানাতে দেখলাম না। ইউনিটের সঙ্গে সঙ্গে ছোট্ট আউটডোর কিচেন যায়। এখানে আসে নি। তবে ডিরেক্টর সাহেব যখন চা খাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন তখন চা আসবে। আসতেই হবে। আমি মায়ের দিকে তাকালাম–তিনি দূর থেকে একদৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমাদের মধ্যে কী কথা হচ্ছে তা জানার জন্যে তিনি কৌতূহলে ছটফট করছেন। মায়ের পাশে মওলানা মেরাজ মাস্টার। তিনিও নিজ মনে কথা বলে যাচ্ছেন। হয়ত দোজখ কত প্রকার ও কী কী তা বোঝাচ্ছেন।
চা চলে এসেছে। সুন্দর দুটা কাপে চা। টি ব্যাগের সুতা বের হয়ে এসেছে। কিচেন সঙ্গে না এলেও চায়ের সরঞ্জাম এসেছে। গ্রামের কোনো বাড়ি থেকে গরম পানি এনে চা করা হয়েছে। ডিরেক্টর সাহেব বললেন, বকুল, এখন তোমাকে খুব জরুরি একটা কথা বলব। কী বলব, মন দিয়ে শুনবে। কিন্তু মন খারাপ করবে না।
মন খারাপ করার মত কোনো কথা?
না, মন খারাপ করার মত কোনো কথা না। তারপরেও মন খারাপ হতে পারে। তুমি ভয় পাচ্ছ কেন?
ভয় পাচ্ছি না তো।
পাচ্ছ। তোমার হাত কাঁপছে।
সরি।
আশ্চর্য ব্যাপার! তুমি কি আমাকে ভয় পাও?
জি পাই।
কেন?
জানি না কেন। আমি কখনো উঁচু গলায় কাউকে ধমক দিয়েছি বলেও তো মনে পড়ে না।
সেই জন্যেই হয়তো ভয় পাই। আপনার উঁচু গলা একবার শুনে ফেললে— ভয় ভেঙ্গে যেত। তা ভাঙ্গেনি।
তুমি স্বাভাবিক হও তো! এখনো তোমার হাত কাঁপছে। আমি কখনো তোমাকে এমন কিছু বলব না যে ভয়ে তোমার আত্মা উড়ে যাবে।
কী বলতে চাচ্ছিলেন বলুন।
না থাক, বাদ দাও।
বাদ দিতে পারবেন না, আপনি বলুন। আপনাকে বলতেই হবে।
তুমি এমন করছ কেন বকুল? হোয়াট হ্যাপেনড?
আমি চোখমুখ শক্ত করে বললাম, আপনি কী বলতে চাচ্ছিলেন বলুন।
ব্যাপারটা খুবই সাধারণ যেহেতু তুমি অভিনয় করছ তোমার জন্যে ব্যাপারটা জানা জরুরি। যারা লম্বা মেয়ে তাদেরই এই সমস্যাটা বেশি হয়, তারা যখন হাঁটে তখন কুঁজো ভাব দেখা যায়। এরা হাঁটে মাটির দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি থাকে পায়ের কাছে। তুমি মাটির দিকে তাকিয়ে হাট ক্ষতি নেই, তবে দৃষ্টিটা যদি পা থেকে খুব কম হলেও দশফুট দূরে রাখ তা হলে কুঁজো ভাবটা চলে যাবে। এখন ব্যাপারটা পরীক্ষা করে দেখ। হেঁটে হেঁটে মায়ের কাছে যাও। দুভাবে হাঁটবে— পায়ের কাছে চোখ রেখে এবং পা থেকে দশফুট দূরে চোখ রেখে।
আমার চা শেষ হয় নি। চা খাওয়া শেষ হোক তারপর যাব।
বকুল, তুমি আমার কথায় রাগ কর নি তো? রাগ করব কেন?
মানুষমাত্রই তার ত্রুটি ধরিয়ে দিলে রাগ করে। পাপিয়াকে তো তুমি কাছ থেকে দেখছ–তার মস্তবড় ত্রুটি কী বল তো?
জানি না। মানুষের ত্রুটি দেখে বেড়ানো আমার স্বভাব না।
তুমি দেখি ভালই রেগেছ।
আপনি ভুল করেছেন। আমি রাগি নি। এই দেখুন আমি এখন হেঁটে হেঁটে দুভাবে মার কাছে যাব। এবং আর কখনোই আপনি আমার মধ্যে কুঁজো ভাব দেখবেন না।
একসেলেন্ট! তা হলে আমি এক কাজ করি–গতদিন তোমার যতগুলি শট নিয়েছিলাম সেগুলি আবার নেই?
নিন। আজকেরটা নেবেন না?
না, আজকেরটা নেব না। আজকের দৃশ্যটি ঠিকই আছে। মাথা নিচু করে দৌড়াচ্ছিলে, দেখতে ভাল লেগেছে।
আমি যাই।
তুমি আরো কিছুক্ষণ থাক তারপর যাও। বি নরম্যাল।
আমি নরম্যাল আছি।
এসো অন্য কোন প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলি।
কোন প্রসঙ্গ?
ফরহাদকে নিয়ে যে নাটকটা হল, সেই নাটকটা তোমার কেমন লাগল?
ভাল লাগে নি।
নাটকটা যখন শুরু হল তখন কি তার শেষ কী হবে তুমি আঁচ করতে পারছিলে?
জ্বি না। তবে বুঝতে পারছিলাম যে ভয়াবহ কিছু হবে না। আপনি তা হতে দেবেন না।
আমি হতে দিতাম না তা ঠিক না, আমি হতে দিতাম। আমাদের জীবনে নাটকীয় মুহূর্ততো খুব বেশি তৈরি হয় না। অল্প অল্প হয়। যখনই হয় আমি মজা করে লক্ষ্য করি।
ও।
ব্যাপারটা মনে হয় তোমার পছন্দ হচ্ছে না।
আমার পছন্দ-অপছন্দেতো কিছু যাচ্ছে আসছে না।
তারপরেও আমাদের পছন্দ-অপছন্দ থাকে। কদম ফুল অনেকের পছন্দ, অনেকের পছন্দ না। তারপরেও কিন্তু কদম গাছ থাকে এবং বর্ষায় কদম ফুল ফোটে। কদম ফুল মানুষের পছন্দ-অপছন্দের তোয়াক্কা করে না। ঠিক বলেছি?
জ্বি বলেছেন।
ফরহাদ যখন তার প্যান্টের জিপার খোলার উপক্রম করল তখন তোমার কী মনে হয়েছিল বল।
জানাটা কি খুব প্রয়োজন?
হ্যাঁ প্রয়োজন।
আমার মনে হচ্ছিল জাহেদার কথাই বোধ হয় ফলে যাচ্ছে। এখানে অভিনয় হবে না। ছবি বন্ধ হয়ে যাবে এবং একজন মারা যাবে।
তার মানে কী? জাহেদা কে?
জাহেদার ব্যাপার আপনি জানেন না?
না।
জাহেদা হচ্ছে হাফিজ আলির স্ত্রী। এই গ্রামের একটা বৌ। তার অসাধারণ তা। জেন ডিক্সনের মত সে ভবিষ্যৎ বলতে পারে। সে আমাদের সম্পর্কে একটা ভবিষ্যৎবাণী করেছে।
কী ভবিষ্যৎবাণী?
এখানে শুটিং শেষ পর্যন্ত হবে না। আমাদের মধ্যেই একজন কেউ মারা বে। সব লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে।
ডিরেক্টর সাহেব আমার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন। তাকে সামান্য চিন্তিত মনে হচ্ছে। গ্রামের সামান্য একটা মেয়ের ভবিষ্যৎ বাণীতে তিনি চিন্তিত হবেন কেন আমি বুঝতে পারছি না। আমি বললাম, এখন যাই? তিনি হ্যাঁ-না কিছু বললেন না।
আমি চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে মায়ের কাছে চলে এলাম। মওলানা সাহেব এখন নেই। আছর নামাজের সময় হয়েছে, তিনি হয়তো মসজিদের খোজে গেছেন। মা উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, মঈন ভাই তোর সঙ্গে কী এত কথা বলছিলেন?
আমার খুব প্রশংসা করছিলেন মা।
মা আনন্দিত গলায় বললেন, তাই নাকি?
হ্যাঁ, তিনি বললেন আমি যে কুঁজো হয়ে হাঁটি এটা দেখতে খুব ভাল লাগে।
মা হতভম্ব হয়ে বললেন, তুই আবার কখন কুঁজো হয়ে হাঁটিস? কী অদ্ভুত কথা।
অদ্ভুত হলেও কথা সত্যি।
আর কী কথা হল?
আর কোনো কথা হয় নি।
বল না! বলতে অসুবিধা কী?
বললাম তো মা, আর কোনো কথা হয় নি। তুমি নিশ্চয়ই ভাবছ না উনি আমাকে প্রেমের কথাবার্তা বলছেন–লক্ষ্মীসোনা, চাঁদের কণা, কুটুস কুটুস, পুটুস পুটুস।
ছি বকুল! এইসব কী ধরনের কথা!
ফাজলামি ধরনের কথা, গুরুত্ব দিও না মা।
একবার দেখলাম মঈন ভাই কী একটা কথা বলে খুব হাসছেন। কথাটা কী?
মা শোন, আমার মনে নেই। উনি হেসেছেন কি না তাও মনে নেই। তুমি আমাকে আর বিরক্ত করো না। উনি আমাকে কুঁজো বলেছেন, আমার মন খুবই খারাপ। তুমি অকারণ কথা বলে সেই মন খারাপ ভাবটা আর বাড়িও না!
তাকে কুঁজো বলবে কেন?
কুঁজোকে তো কুঁজোই বলবে, অন্ধ বলবে না।
মা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে চুপ করলেন। আমরা মনে হচ্ছে এখন রওনা হব। মার পাশাপাশি আমি হাঁটতে চাচ্ছি না। মার পাশে থাকলেই তিনি ঘুরেফিরে জানতে চাইবেন ডিরেক্টর সাহেবের সঙ্গে আমার কী কথা হল।
বকুল!
হুঁ।
কোত্থেকে এই মওলানা জুটেছে বল তো! ক্রমাগত আমার কানের কাছে বকবক করছিল। কয়টা দোজখ আছে, দোজখের নাম কী এইসব হাবিজাবি–।
তাই নাকি?
হুঁ। জাহান্নাম, হাবিয়া, জাহীম, লাযা … এইগুলি হচ্ছে দোজখের নাম।
ভাল তো, দোজখের সব নাম জেনে গেলে।
তুই চোখমুখ এমন শক্ত করে রেখেছিস কেন?
আমার খুবই কান্না পাচ্ছে। কান্না আটকে রেখেছি বলে চোখমুখ শক্ত হয়ে। গেছে।
কান্না পাচ্ছে কেন?
উনি আমাকে কুঁজো বলবেন, আমার কান্না পাবে না?
মা কোমল গলায় বললেন— নদীর পারে চলে যা। লোকজন নেই, কেউ দেখবে না। সেখান থেকে কেঁদে আয়।
আমি নদীর কাছে যাচ্ছি। মাথা সোজা করে যাচ্ছি। সত্যি সত্যি কাদার জন্যে যাচ্ছি, কিন্তু আমার চোখে পানি নেই। জানি পানি আসবে না। আয়োজন করে কাঁদা যায় না। নির্জন একটা জায়গায় কাঁদব বলে গেলাম। সঙ্গে রুমাল নিয়ে গেলাম— এই ভাবে কি আর কেউ কাঁদে?
সোমেশ্বরী নদী— নাম শুনলে মনে হয় বিশাল ব্যাপার, বিশাল নদী। আসলে ছোট্ট ফিতার মত নদী। হেঁটে এক পার থেকে আরেক পারে যাওয়া যায়। পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ভেজে।
বর্ষায় এই নদী নাকি প্রমত্তা হয়। পাহাড়ি পানি নেমে ভয়াবহ কাণ্ড করে বসে। সোমেশ্বরী নদীর ভয়ে মানুষজন আতঙ্কগ্রস্ত থাকে। কোনো এক বর্ষায় এসে নদীটা দেখে গেলে হত।
নদীর বুক জুড়ে বিশাল চর। ধবধবে শাদা বালি চকচক করছে। এরকম কোনো নদী দেখেই কি রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন— আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাকে–বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে …..।