ফয়সল সাহেব ডেনটিস্টের কাছে গিয়েছিলেন। তার মনে হয়েছে উপরের পাটির একটি দাঁত তুলে ফেলতে হবে। মাঝে মাঝেই ব্যথা হচ্ছে। অসহ্য ব্যথা নয়–চিনচিনে ব্যথা। ঠাণ্ডা পানি খেতে পারেন না। দাঁত শির শির করে।
অল্প বয়স্ক ডেনটিস্ট তাকে অবাক করল। সে গম্ভীর হয়ে বলল, আপনার দাঁত তো ঠিক আছে? শুধু শুধু তুলতে চান কেন? চমৎকার দাঁত, হেসে খেলে আরো দশ বছর যাবে। এনামেল নষ্ট হয়েছে সে জন্যই ঠাণ্ডা পানি খেতে পারেন না, এটা কিছুই না।
ফয়সল সাহেব হৃষ্ট চিত্তে বাড়ি ফিরলেন। রিকশা নিলেন না। দের মাইল রাস্তা হাঁটলেন। এই বয়সে হাঁটা ভাল। ব্লাড সাকুলেশন ভাল হয়। হার্ট ঠিক থাকে। ভাদ্র মাসের কড়া রোদে তার খানিক কষ্ট হল। কিন্তু মনে আনন্দ। আনন্দ থাকলে কোনো কষ্ট মনে হয় না। তার ধারণা হল তিনি দীর্ঘদিন বাঁচবেন। আরো দশ বছর তো বটেই। দশ বছর খুব কম সময় নয়। দীর্ঘ সময়। তাঁর খুব বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করে। মৃত্যুর মত একটা ভয়াবহ ব্যাপারকে যত ঠেকিয়ে রাখা যায় ততই ভাল।
কাবুল মিয়া ফয়সল সাহেবকে দেখেই ছুটে গিয়ে গেট খুলে দিল। কাবুল মিয়া ফয়সল সাহেবের বুইক গাড়ির ড্রাইভার। এই গাড়ি গত দুবছর ধরে নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। ফয়সল সাহেব সরাচ্ছেন না। অবশ্যি কাবুল মিয়ার চাকরি ঠিকই আছে। খাওয়া-দাওয়া এবং বেতন ঠিক মতই পাচ্ছে। তার বর্তমান চাকরি হচ্ছে বারান্দায় পা ছড়িয়ে ঘুমানো এবং হঠাৎ কোনো কোনো দিন ছুটে গিয়ে গেট খুলে দেয়া। অবশ্যি এই বিশেষ কাজটি সে শুধু ফয়সল সাহেবের জন্যেই করে। তার নিজের পদমৰ্যাদা সম্পর্কে সে অত্যন্ত সচেতন।
ফয়সল সাহেব হাসি মুখে বললেন–কী খবর কাবুল মিয়া? কাবুল মিয়ার বিস্ময়ের সীমা রইল না। বড় সাহেব এই সুরে কখনো কথা বলেন না।
ভাল তো কাবুল মিয়া?
জি স্যার।
তোমার গাড়িটা তো ঠিকঠাক করতে হয়।
কাবুল মিয়া হাত কচলাতে লাগল।
বাগানের এই অবস্থা কেন?
কাবুল মিয়া কী বলবে ভেবে পেল না। মালীকে ফয়সল সাহেব নিজেই গত মাসে বিদায় করেছেন; এমনিতেই বাগানের অবস্থা কাহিল ছিল। মালী চলে যাবার পর মরুভূমি হয়ে গেছে।
বাগান সাজাতে হবে বুঝলে কাবুল মিয়া। শীত এসে যাচ্ছে। ফ্লাওয়ার বেড তৈরি করতে হবে, ঝামেলা আছে, আছে না?
জি স্যার আছে।
তিনি উৎফুল্ল মনে দোতলায় উঠে শিশুদের গলায় ডাকলেন, বীথি। বীথি।
বাড়ির সবাই ফয়সল সাহেবের এই পরিবর্তন লক্ষ্য করল। এ বাড়িতে অনেক লোকজন। বেশিরভাগই আশ্রিত। আশ্রিত লোকজন গৃহকর্তার মেজাজের দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখে। তাদের মেজাজ গৃহকর্তার মেজাজের সঙ্গে ওঠানামা করে। কাজেই এ বাড়ির সবার মনেই সুবতাবস বইল। যদিও সবাই জানে এ সুবাতাস ক্ষণস্থায়ী। ফয়সল সাহেবের মেজাজ খুব বেশি সময় ঠিক থাকে না। কে জানে হয়ত আজি সন্ধ্যার মধ্যেই তিনি উলটে যাবেন।
কিন্তু তিনি উল্টালেন না। সন্ধ্যাবেলায় তাকে দেখা গেল বীথির সঙ্গে। ইজিচেয়ারে কাত হয়ে শুয়ে আছেন। বীথি কিছু বলছে না। তিনি একাই কথা বলছেন
বুঝলে বীথি, ব্রিটিশ আমলে নাইনটিন ফটিসিক্স কিংবা ফর্টি ফাইভে একটা স্ট্রেঞ্জ মামলা হয়। দুই ভদ্রলোক একই সময়ে একটা ছেলের পিতৃত্ব দাবী করে মামলা করেন। এদের একজনের নাম রমেশ হালদার। আমি ছিলাম। এই রমেশ হালদারের লইয়ার। মামলায় আমরা জিতে যাই। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে রমেশ হালদার ঐ ছেলের বাবা ছিল না বলে আমার ধারণা।
বলেন কী?
এই যুগে অবশ্যি পিতৃত্ব এস্টাবলিশ করা খুব সোজা। ডি এন এ টেস্ট করলেই হয়। তখন তো। এসব ছিল না। বুঝলে বীথি মামলাটা ছিল দারুণ ইন্টারেস্টিং।
এইসব লিখে ফেলেন না কেন?
কথাটা খারাপ বলনি তো, লেখা যায়।
ফয়সল সাহেব, সোজা হয়ে বসলেন। হাসিমুখে বললেন. এইটা আর কী মামলা, একটা মামলা ছিল মেয়ে-ঘটিত। ফিকসান তার কাছে কিছু না।
আপনি স্যার লিখে ফেলেন।
এই বয়সে কী আর লেখা সম্ভব হবে। কিছু পড়তে গেলেই চোখে স্ট্রেইন পড়ে।
আপনি বলবেন, আমি লিখব।
ফয়সল সাহেবের চোখ-মুখ উজ্জল হয়ে উঠল। তিনি নিজেই বের হলেন খাতা কিনতে।
রাতে টেলিফোন করলেন ছেলেকে। একটি অস্বাভাবিক ঘটনা। ওসমানের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই। পুত্র-কন্যাদের খোঁজ-খবর রাখাকে তিনি চারিত্রিক দুর্বলতা মনে করেন।
ওসমান নাকি?
জি কী ব্যাপার।
ব্যাপার কিছু না। তুই আছিস কেমন?
ভাল আপনার শরীর কেমন?
শরীর ভালই।
কোন দরকারে টেলিফোন করছেন, না এমনি?
তোর কাছে আবার আমার কী দরকার? এমনি করলাম। আচ্ছা শোন বীথি মেয়েটাকে তোর কেমন লাগে? আমার সেক্রেটারি। দেখেছিস তাকে?
না, দেখিনি। শুনেছি মিলির কাছে।
এই বাড়িতেই সে এখন থাকে। নিডি মেয়ে, বিয়ে হয়েছিল। হ্যাসবেন্ডের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়।
ও তাই নাকি।
আমার এখানে থাকে বলে তোরা আবার কিছু মনে করিস না তো?
না, কী মনে করব?
আচ্ছা রাখলাম।
ফয়সল সাহেব, হৃষ্টচিত্তে ঘুমুতে গেলেন। এবং তার কিছুক্ষণ পরই খবর পেলেন টগরের ডিপথেরিয়া হয়েছে বলে ডাক্তাররা সন্দেহ করছেন। তাকে একটা ক্লিনিকে ভর্তি করার জন্যে নেয়া হচ্ছে।
ফয়সল সাহেবকে দেখে মনে হল না। এই খবরটি তাকে বিচলিত করেছে। তিনি ক্লিনিকে যাবার জন্যে বেশ উৎসাহের সঙ্গে কাপড় বদলাতে লাগলেন। বীথিকে বললেন, গাড়িটা ঠিক করা দরকার। কখন কী দরকার হয়। কালকে আমাকে মনে করিয়ে দিও তো?