প্রীতমের ঘুম ভাঙে খুব ভোরবেলায়, যখন সূর্য ওঠে না, যখন চারদিক এক ভুতুড়ে আবছায়ায় নিঃঝুম হয়ে পড়ে থাকে। তখনই কি প্রথম ঘুম ভাঙে প্রীতমের? তা তো নয়। সারারাত আরও বহুবার ঘুম ভেঙে যায় তার। খুব তুচ্ছ সব কারণে। কখনও রান্নাঘরের এঁটো বাসনে ধেড়ে ইঁদুরের শব্দ, আরশোলার পাখার আওয়াজ, কখনওবা নিছকই স্বপ্ন দেখে, কখনও এমনিই।
ঘুম ভাঙলেই বড় একা। ভীষণ একা। পাশের ঘরে এক খাটে বিলু আর লাবু, খাওয়ার ঘরের মেঝেয় বিন্দু নামে নতুন কিশোরী ঝি। তাদের ঘুম খুব গাঢ়। প্রীতমের কোনওদিনই গাঢ় ঘুম ছিল না। আর বরাবরই সে ঘুম ভেঙে একাকিত্বকে হাড়ে হাড়ে, মজ্জায় মজ্জায় টের পেয়েছে।
এখন প্রীতম আরও একা। সামান্য সর্দিজ্বর বা ইনফ্লুয়েঞ্জা হলেও বরাবর বিলু ছোয়াচ বাঁচিয়ে চলেছে প্রীতমের। এখন দীর্ঘ রোগভোগের কালবেলা চলছে। এখন তার নিরেট নিচ্ছিদ্র একা থাকা, একা হয়ে যাওয়া।
কিন্তু মনকে দুর্বল হতে দেয় না প্রীতম। জানে, একবার ভয়কে প্রশ্রয় দিলে আর পরিত্রাণ নেই। মৃত্যুর চেয়েও বহুগুণ ভয়ংকর মৃত্যুভয় ধারেকাছে তরুণ উৎসাহী চিতাবাঘের মতো অপেক্ষা করে আছে। প্রীতম তার অন্ধকার নড়াচড়া চোখের নীল আগুন সব টের পায়, দেখতে পায় তার শরীরের কটাশে ছাপচকর। এক মুহূর্তে হাল ছেড়ে দেওয়ার ভাব দেখলেই লাফিয়ে পড়বে।
ঘুম ভাঙলে তাই প্রীতম একা বোধ করা থেকে নিজের পরিত্রাণ খুঁজছিল প্রাণপণে। সে জানে তার বহু বহু দুর পরিধির মধ্যেও কোনও মানুষ নেই। বউ না, আত্মীয় না, ডাক্তার বা বন্ধুও না। সে একা, আর তার শরীরের অজস্র জীবাণু।
এইসব রহস্যময় জীবাণু কীরকম, কোথা থেকে এল তা জঁহাবাজ ডাক্তারেরাও জানে না। তারা শুধু জানে হাড়ে-মজ্জায় কোনও গোপন অদ্ভুত রন্ধ্রপথে জীবাণুরা দিনরাত অবিরাম কাজ করে চলেছে।
একদিন তারা মেরুদণ্ডের হাড়ের জোড়গুলি পেরিয়ে মগজে পৌঁছে যাবে। আজও অবশ্য ততদূরে পৌঁছয়নি তারা। প্রীতমের চিন্তাশক্তি আজও পরিষ্কার। থট প্রসেসে কোনও গোলমাল নেই। মাঝে মাঝে সে এখনও জটিল কুটিল সব এন্ট্রি দু’বার না ভেবেই করতে পারে। হায়ার অ্যাকাউন্টেন্সির কয়েকটা বই তার শিয়রের কাছে থাকে, সব সময়ে পাশে খাতা, ডটপেন।
তবু প্রীতম জাগে এবং কিছুক্ষণ একা বোধ করে। এই বোধের সঙ্গে তার লড়াই চলছে দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে। প্রায় হারতে হারতেও লড়াইটা টিকিয়ে রেখেছে সে। বাঘের চোখ বোজ অন্ধকারে দপ দপ করে জ্বলে উঠে তাকে দেখে নেয়।
কিন্তু এক বিপুল গভীর অন্ধকারের বাঁধভাঙা স্রোত জানালা দরজার সব রন্ধ্রপথ দিয়ে হুড়হুড় করে ঘরে ঢুকে আসে। বর্ণ গন্ধ আকারহীন সে এক নিষ্ঠুর অন্ধকারের বিপুল সমুদ্র। এই আবছা ভোরে ভয় ভয় করে। কাছে এগিয়ে আসে কি বৈতরণী? প্রীতম তখন খুব খেলোয়াড়ের মতো চোখ বুজে নিজের শরীরের ভিতরে চিরজাগ্রত অবিরাম ক্রিয়াশীল নিদ্রা ও বিশ্রামহীন জীবাণুদেরই ডাকতে থাকে। বলে, তোমরা তো আছ। তোমরা তো আছ! আমি তো একা নই! মৃত্যু পর্যন্ত তোমরা তো থাকবেই সঙ্গে। তারপর একসঙ্গেই মরণ আমাদের।
কথাটা কতদূর ঠিক কে জানে। তবে প্রীতম টের পায় যখনই সে ডাকে তখনই শরীরের ভিতরে ঝাকে ঝাকে কী যেন জেগে ওঠে, সাড়া দেয়। সে কেমন? যেন শরীরের ভিতরে ভিতরে এক রোমাঞ্চ, এক সচেতনতা, এক চনমনে ভাব।
তখন নিশ্চিন্ত হয় প্রীতম। একা কথা বলছে দেখলে বিলু হয়তো তাকে পাগল ভাববে। কিন্তু মাঝরাতে বা খুব ভোরের বেলায় কেউ তাকে দেখার জন্য জেগে থাকে না। তাই প্রীতম একা একা কথা বলে, তোমাদের দোষ নেই। তোমাদের কাজ তোমরা করছ মাত্র। জীবাণুরাই কি শুধু মারে মানুষকে? মানুষ নিজেও কি মারে না? কষ্ট দেয় না? তোমাদের তা হলে দোষ কী বলো? আমার। তাতে কোনও দুঃখ নেই। শরীরটাই তো শুধু আমি নয়। এই হাত, এই পা, এই চোখ, কান, এগুলো আলাদাভাবে কোনওটাই তো আমি নয়। তবে আমি কেন তোমাদের শত্রু ভাবব? তোমরা একটা বাসা দখল করেছ মাত্র, তোমরা জোগাড় করছ বেঁচে থাকার রসদ। অন্যায় ভাবেও তো নয়। বেঁচে থাকার জন্য মানুষও তো কত কী করে। তবু বলি, আমাকে তোমরা ছুঁতে পারেনি আজ পর্যন্ত। কী করে পারবে? দেহটাই তো আর আমি নয়। এর ভিতরেই কোথাও আছে আর-এক আমি, তাকে স্পর্শ করা যায় না।
খুবই আন্তরিকভাবে কথাগুলি বলে প্রীতম। আর তখন তার পুবের জানালার অন্ধকার ক্রমে ফ্যাকাসে হতে থাকে। ভবানীপুরের এই গলির মধ্যে সরাসরি জানালার ওপর সূর্যের আলো এসে পড়ে না প্রথমেই। একটু সময় নেয়। ততক্ষণ এবং যতক্ষণ বিলু না ওঠে এবং চতুর্দিকের কাজকর্ম যতক্ষণ না শুরু হয় ততক্ষণ ঠোঁট অবিরাম নড়ে যায় প্রীতমের। ততক্ষণে সে এক ভয়াবহ লড়াই চালিয়ে যায়। এবং টিকে থাকে একের পর এক দিন।
একটা দিনের বাড়তি আয়ু পাওয়া, আর-একটা দিনের সূর্যের আলো দেখাই কি এখন যথেষ্ট বেশি আহ্লাদের বিষয় নয়?
তাই সকালের দিকে প্রীতম ক্লান্ত থাকলেও মনটা একরকম শক্ত সমর্থ রয়ে যায়। চোখ বুজে সে মৃদু মৃদু একটু হাসতেও থাকে। যতক্ষণ না বিলু এসে মশারি তুলে উঁকি দেয়।
মাঝে মাঝে মশারির মধ্যে এক-আধটা মশার গুনগুন শুনে মাঝরাতে চোখ মেলে চায় প্রীতম। খুব কান পেতে শোনে। বেড় সুইচ টিপে আলোও জ্বালায়। অবশ্যই মশা মারবার জন্য নয়। সে সাধ্য তার নেই। হাঁটু গেড়ে বসো, সাবধানে মশাটাকে খুঁজে বের করো, সেটাকে কোথাও নিশ্চিন্তে বসতে দাও, তারপর এগিয়ে গিয়ে দু হাতে চটাস করে মারো। না, এতসব প্রীতমের কাছে বিরাট বিরাট কাজ। মারবার কথা তার মনেও হয় না।
ঘুম ভেঙে সে মশারির মধ্যে কোনও মশার অস্তিত্ব টের পেলে চুপ করে শব্দ শোনে, তারপর ফিসফিস করে বলতে থাকে, তোমরা অন্য জগতের। তোমরা এক চিন্তাশূন্য কর্তব্যের জগৎ থেকে আসা জীব। সূখীও নও, দুঃখীও নও। জেগে থাকো, আমার সঙ্গে জেগে থাকো।
বিলু মশারি তুলে উঁকি দিয়ে জিজ্ঞেস করে, তুমি জেগেছ?
হুঁ।
বাথরুমে যাবে এখন?
একটু পরে।
পরে আবার কেন? এখনই সেরে নাও। গরম জল বসিয়ে এসেছি। ওঠো।
বলে হাত বাড়িয়ে পাঁজাকোলা করে প্রীতমকে বসায় বিলু। প্রীতম তখন বিলুর শরীরে বাসি জামাকাপড়ের গন্ধ পায়। বিলুর শরীরে কোনও উৎকট গন্ধ নেই। গ্রীষ্মকালেও বিলুর ঘাম হয় না। তবু সব শরীরেই যেমন একটা না একটা গন্ধ থাকে তেমনি বিলুরও আছে। প্রীতম গন্ধটা ভালই বাসে।
দাঁড় করানোর সময় বিলুর মুখ প্রীতমের মুখের কাছাকাছি এসেছিল। বিলু বলল, আজ ভাল করে তোমার পঁত মেজে দিতে হবে। মুখে দুর্গন্ধ হচ্ছে।
দাঁড়ানোটা ভারী কষ্টকর প্রীতমের কাছে। তবু এখনও বিলুর ওপর শরীরের পুরো ভর ছেড়ে দিয়ে দাঁড়াতে পারছে। বিলু বলল, কতবার বলি বাথরুমে যাওয়ার দরকার নেই। বিছানাতেই তো
প্লাস্টিকের গামলায় মুখ ধোওয়া যায়।
আমার ঘেন্না করে।
ঘেন্না করলে চলবে কেন? যেমন অবস্থা তেমনি তো ব্যবস্থা হবে।
এখনও পারছি।
কষ্টও হয় তো!–বিলু বলল।
আমার চেয়ে তোমার কষ্টই বেশি।
আমার কষ্ট! আমার আবার কষ্ট কী!
সকালের দিকে বিলুর মন ভাল থাকে। এই সময়টায় বিলুর শরীরটা যেন মায়ের শরীরের মতো নতা ও সুঘ্রাণে ভরা থাকে।
বিলুর শরীরে ভর দিয়ে হাঁটি হাঁটি পা-পা করে বাথরুমে যায় প্রীতম। বিলু খুবই সাবধানে তার বগলের নীচে কাঁধ দিয়ে, কোমরে হাত জড়িয়ে ধরে থাকে তাকে।
বাথরুমে বাচ্চা ছেলের মতো তাকে ধরে থেকে হিসি করায়, তারপর একটা বেতের চেয়ারে বসিয়ে মাথাটা বুকের সঙ্গে চেপে ধরে গুঁড়ো মাজনে আঙুল দিয়ে খুব যত্নে তার দাঁত মেজে দেয়। কোষে জল নিয়ে কুলকুচো করায়।
এসব করতে করতেই বলে, আজ স্নান করাব তোমাকে।
ভাল লাগে না। বড্ড ঝামেলা।
স্নান না করলে শরীর কষে যাবে।
আজকের দিনটা থাক।
রোজই তো থাকছে। ডাক্তার বলেছে সপ্তাহে তিন দিন স্নান করাতে।
আবার ধরে নিয়ে এসে চেয়ারে বসিয়ে চিরুনিতে চুল পাট করে দেয়। বাসি জামাকাপড় বদলে দেয়। বিছানার চাদর, বালিশের তোয়ালে পালটে দেয়। বোজই চাদর আর তোয়ালে পালটানো হয়, ডেটল-জলে কাচা হয়। বেডসোর যাতে হতে না পারে তার জন্য পিঠে সযত্নে একটা ওষুধ দেওয়া পাউডার ছড়িয়ে দেয়।
এইসব প্রাতঃকৃত্যের পর শরীরের ভার অনেক কমে যায় প্রীতমের। বিলু তাকে সকালের ঠান্ডা থেকে বাঁচাতে জামার ওপর গরম সোয়েটার পরিয়ে দেয়, হালকা শাল টেনে দেয় গলা অবধি।
তারপর বিছানায় হাত রেখে মুখের কাছে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করে, আজ কী খাবে?
এই সময়ে রোজ প্রীতমের মনে হয় বিলু এখন খুব আলতো আমাকে চুমু খেলে কত ভাল হত! এরকম অবস্থায় খাওয়াই তো নিয়ম। খাবে কি?
কিন্তু বিলু কখনওই তা করে না। প্রীতমও কোনওদিন এরকম কোনও প্রস্তাব মুখ ফুটে করতে পারেনি।
প্রীতম বলে, যা খেতে দেবে তাই খাব।
কোনও বায়না নেই তো?
প্রীতম স্নিগ্ধ হেসে বলে, না। কোনওদিন বায়না করেছি? বলো!
বিলু হাসে না। ভ্রু কুঁচকে কেমন একটু আনমনা হয়ে যায়। আর ঠিক এই সময় প্রীতমের মনে হতে থাকে, এবার বিলু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলবে। নিশ্চয়ই ফেলবে।
কিন্তু বিলুর দীর্ঘশ্বাস নেই। কোনওদিনই দীর্ঘশ্বাস ফেলে না বিলু।
প্রীতম বলে, আজকাল ডিমে বড় আঁশটে গন্ধ লাগে। আজ আমি ডিম খাব না।
এই তো বায়না করছ! করো না বলে?
এটা তো না খাওয়ার বায়না। একে বায়না বলে না।
এটাও বায়না।—বিলু বলল, কিন্তু হাসল না। অথচ এরকম কথায় একটু হাসাটাই কি নিয়ম নয়?
বিলু বলল, ঠিক আছে, মাখন দিয়ে ডিমের পোচ করে দিচ্ছি, তা হলে অতটা আঁশটে গন্ধ লাগবে না।
দাও। আর জানালার কাছে ইজিচেয়ারটা পেতে দাও। একটু বাইরেটা দেখি।
বিলু লোহার ইজিচেয়ারটা পেতে দেয়, ধরে ধরে নিয়ে গিয়ে বসায়, সযত্নে গলা পর্যন্ত চাপা দিয়ে দেয়।
প্রীতম বিলুর দিকে চেয়ে বলে, সকালে উঠে রোজ একটু ফিটফাট হয়ে নাও না কেন? চুল উড়ছে, সিদুর লেপটে আছে, ওরকম চেহারা দেখতে কি ভাল?
আমার এখন সাজবারই সময় কিনা!
প্রীতম ভ্রু কুঁচকে বলে, কেন? তোমার কি দুঃসময় চলছে?
তবে কি সুসময়?
তাও নয়। কিন্তু তোমাকে দেখে মনে হয়, তুমি সব হাল ছেড়ে দিয়ে বসে আছ।
বিলু মৃদু স্বরে আত্মবিশ্বাসহীন গলায় বলে, হাল ছাড়ার কী আছে! ঘরে রুগি থাকলে কার সাজতে ইচ্ছে করে বলো তো!
প্রীতম ঘুনঘুনে নেই-আঁকড়া স্বরে বলে, না, ওরকম দেখতে ভাল লাগে না। ওভাবে কখনও আমার সামনে এসো না। আমার খারাপ লাগে।
আচ্ছা।-বলে বিল চলে যায়।
জানালা দিয়ে কিছুই দেখার নেই প্রীতমের। ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে রাস্তা দেখা যায় না। শুধু কয়েকটা বাড়ির তিন বা চারতলা আর আকাশ দেখা যায়। কিন্তু প্রীতমের কোনও অন্যমনস্কতা নেই। যেটুকু দেখে সেটুকুই যথাসাধ্য চেতনা আর প্রখর অনুভূতি দিয়ে গ্রহণ করে অভ্যন্তরে।
বিলু খাবার নিয়ে আসে। প্রীতমের গলায় বাচ্চাদের মতো একটা ন্যাপকিনের বিপ বেঁধে দেয়। তারপর পাশে একটা টুলে বসে আস্তে আস্তে খাইয়ে দেয় তাকে। খাওয়া জিনিসটা বরাবরই প্রীতমের কাছে খুব বিরক্তিকর ছিল। খেতে হবে বলেই তার খাওয়া। বরাবর সে খায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে এবং খুব তাড়াতাড়ি। বিলু এখন তা হতে দেয় না। প্রীতমও বুঝেছে খাওয়াটা খুবই জরুরি ব্যাপার। যদি বেঁচে থাকতে হয়, যদি লড়াই চালাতে হয়, তবে যথেষ্ট রসদের দরকার।
প্রীতম মুখ ফিরিয়ে বলে, আজকাল আমার খাওয়া কি খুব বেড়ে গেছে বিলু?
অন্য বউ হলে বলত, ছিঃ ছিঃ, ওসব কথা কি বলতে আছে? বিলু গম্ভীর মুখে বলল, আরও একটু বাড়লে ভাল হয়।
প্রীতম লক্ষ করল, বিলুর চুল এখনও রুক্ষ, এলোমেলো, কপালে সিঁদুর লেপটানো। এ নিয়ে আর বলতে গেলে সকালের নরম-সরম বিলু আর নরম-সরম থাকবে না। রেগে যাবে, ঠান্ডা কঠিন এক ব্যবহার দিয়ে সারাদিন প্রতিবাদ জানিয়ে যাবে।
খাওয়া শেষ হলে প্রীতম মুখ তুলে ফের জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে থাকে। ও-ঘরে লাবু ঘুম ভেঙে মাকে ডাকতে থাকে, মা! ও মা! মা! ও মা! মা! ও মা! ঠিক নামতা পড়ার মতো। বিলু বোধহয় বাথরুমে। সাড়া দিচ্ছে না। কিন্তু যতক্ষণ না সাড়া দেবে ততক্ষণ এক সুরে, এক গলায় একঘেয়ে ডেকেই যাবে লাবু।
মেয়েকে পারতপক্ষে ডাকে না প্রীতম। বড় মায়া। এই বাসায় এই এক পুকুর ভালবাসার ড়ুবজল অপেক্ষা করে আছে তার জন্য। বড় গভীর জল। একবার পা বাড়ালে তলিয়ে যেতে হবে। এখন ভালবাসায় ভেসে যেতে নেই। মন নরম হবে, মৃত্যুভয় এসে যাবে তবে। প্রীতম তাই কান কাড়া করে মেয়ের ডাক শোনে, কিন্তু নিজে তাকে ডাকে না বা সাড়াও দেয় না। লাবুর সঙ্গে তার এখন আড়ি।
ঝি-টা বাড়িতে নেই, দোকানে গেছে। প্রীতম লাবুর ওই অবিকল পাখির স্বরের ডাক সইতে পারছে না। ছটফট করে ভিতরটা। আপনা থেকেই শরীরটা দাঁড়িয়ে পড়তে চায়। সরু হাত তুলে সে কপাল টিপে ধরার এক অক্ষম চেষ্টা করে।
বাথরুম থেকে বন্ধ দরজা ভেদ করে বিলুর ক্ষীণ স্বর এল এই সময়ে, আসছি-ই।
লাবু শোনে এবং চুপ করে। মেয়েটা কেমন একরকম হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। মাকে ছেড়ে এক মুহূর্ত থাকতে চায় না। সারাদিন খাওয়া নিয়ে বিলু ওকে মারে, বকে। বিলুকে ভয়ও পায় ভীষণ, আবার অবাধ্যতাও করে যায় অনবরত। মার খেলে মায়ের কাছ থেকে সরে যায় না, পালায় না। একই জায়গায় দাঁড়িয়ে অসহায় ভয়ে আর ব্যথায় চিৎকার করতে থাকে।
যত ভাববে তত মায়ার পলি জমবে মনের মধ্যে। তাই প্রাণপণে নিজের অনুভূতির অন্য জগৎ জাগিয়ে তুলতে চেষ্টা করে প্রীতম। আগে উদাস ছিল প্রীতম, এখন সে অনেক অনুভূতিপ্রবণ হয়েছে। কীটপতঙ্গ জীবাণুদের জগৎকে সে আজকাল স্পষ্ট টের পায়। বাড়িময় যেসব আরশোলা ওড়ে, যে একটা-দুটো ইঁদুর বা ছুঁচো আনাগোনা করে তাদের গতিবিধি, সময়জ্ঞান ও চরিত্র সম্পর্কে সে অনেক অভিজ্ঞ হয়েছে ইদানীং। একটা দুধের শিশু বেড়াল অনেক তাড়া খেয়েও এই ফ্ল্যাটের আনাচে কানাচে নাছোড়বান্দা হয়ে ঘুরে বেড়াত। তাকে দু চোখে দেখতে পারত না প্রীতম। এখন সেই বেড়ালটা বড় হয়েছে। সারাদিন পাড়া বেড়ায়, কিন্তু মাঝে মাঝে এসে প্রীতমকে দেখা দিয়ে যায় ঠিকই। আর রোজ রাতে নিয়মিত এসে প্রীতমের খাটের তলায় শুয়ে থাকে। কখন শুতে আসবে বেড়ালটা, তার জন্য ঘুমের আগে উন্মুখ হয়ে থাকে প্রীতম, এলে নিশ্চিন্ত হয়।
মানুষ কীভাবে বেঁচে থাকবে তার তো কোনও বাঁধাধরা ছক নেই। প্রীতম এইভাবে বেঁচে আছে, সুতরাং যতদূর সম্ভব এই বাচাটাকে সে সইয়ে নেয়। খুব কঠিন কাজ কিন্তু প্রীতমকে পারতেই হবে।
লাবু ছিল তার প্রাণ। যতক্ষণ বাসায় থাকত প্রীতম ততক্ষণ লাবু এঁটুলির মতো লেগে থাকত তার সঙ্গে। মেয়ের প্রতি তার ভালবাসা ছিল একবুক তেষ্টার মতো, সহজে মিটতে চাইত না। মেয়েকে ছুঁয়ে না থাকলে রাতে ঘুমোত পারত না প্রীতম। অসুখ হওয়ার পর বিলু লাবুকে সরিয়ে নিয়েছে। সরিয়ে নেওয়া নয়, যেন ছিড়ে নেওয়া। প্রথমদিকে লাবুকে ছাড়া খাঁ খাঁ শুন্য লাগত বুক। তারপর সয়েও গেছে। আগে আগে লাবু বাবার কাছে আসতে না পারায় ভীষণ কাঁদত, নিষেধ। মানতে চাইত না, ফাঁক পেলেই এসে ঝাঁপিয়ে পড়ত কোলে। কিন্তু ক্রমে সেও দুরত্ব রক্ষা করে চলতে শিখল তো! পারতপক্ষে প্রীতমও আর মেয়েকে ডাকে না, কথা বলে না। তাও সইল তার।
বিলুর সঙ্গে বরাবরই একটু দূরত্ব ছিল প্রীতমের। ঝগড়াঝাটি নয়, মন কষাকষিও নয়, ঠান্ডা লড়াইও বলা যায় না। তবে বিলু একটু অন্যরকম, কোনওদিনই প্রীতমের কাছে নিজের মনটা সবটুকু খুলে দেয়নি সে। বিয়ের পর প্রথম ভাব হলে মানুষ কত আগড়ুম বাগড়ম বলে, কত তুচ্ছ কথার পাহাড় বানায়। বিলু কোনওদিন সেরকম ছিল না। কথা বরাবর কম বলত। কিন্তু একথাও বলা যাবে না যে, বিলুর প্রীতমের প্রতি ভালবাসা নেই। বললে খুব মিথ্যে বলা হবে, ভুল বলা হবে। গড়পড়তা বাঙালি বউরা যা করে বিলু তার চেয়ে একরত্তি কম করে না তার জন্য। কিন্তু তার ওই সেবার মধ্যে কোথায় যেন দক্ষ নার্সের পটুত্ব আছে, কোনও আবেগ নেই। অন্য কারও স্বামীর এরকম শক্ত অসুখ হলে চোদ্দোবার কেঁদে ভাসাত, বিলু একদিনও চোখের জল ফেলেনি। কিন্তু যারা কেঁদে ভাসায় তারাও হয়তো ওষুধ দিতে এক-আধবার ভুল করে, রুগির সেবা করতে করতে হয়তোবা কখনও বিরক্তি প্রকাশ করে ফেলে। বিলুর সেরকম ভুল হয় না, বিরক্তির প্রকাশও তার নেই। তবে বিলুর মুখ সর্বদাই গম্ভীর, বিষণ্ণ। যে স্থায়ী বিরক্তির ছাপ বিলুর মুখে আছে তার সঙ্গে প্রীতমের অসুখের কোনও সম্পর্ক নেই।
বিয়ের আগে বিলুর সঙ্গে ভাব ছিল না প্রীতমের। তবে শিলিগুড়িতে বিলু মাঝে মাঝে তার পিসির বাড়ি বেড়াতে যেত। তখন দেখেছে। বিলুর হাতে কখনও এক গ্লাস জল বা এক কাপ চা খেয়েছে প্রীতম। দুটো-চারটে কথাবার্তাও হত তখন। পরে সেই পিসিই বিয়ের সম্বন্ধ আনে এবং বিয়ে হয়েও যায়। মনে আছে, প্রথম রাত্রে বিলু তাকে বলেছিল, তুমি খুব শান্ত স্বভাবের। আমার শান্ত মানুষ খুব ভাল লাগে।
এটা কি ভালবাসার কথা নয়?
আজকাল ঘরবন্দি প্রীতম প্রায়ই ভালবাসার কথা ভাবে। কিন্তু ভালবাসার কথা ভাবলে কখনওই তার বিলুর মুখ মনে পড়ে না, কী আশ্চর্য! মনে পড়ে বনগন্ধ ভরা শিলিগুড়ির মাঠঘাট, আকাশ উপুড় করা শীতের ঢালাও রোদ, নীলবর্ণ মেঘের মতো দিগন্তে ঘনীভূত পাহাড়, মহানন্দার সাদা চর, মনে পড়ে তাদের ভরা সংসারের কলরোল। ভালবাসা ছিল ঝুমকো ভোরে ফুল চুরি করতে যাওয়ায়, ভালবাসা মাখা থাকত জোহা চালের ফেনা ভাতে গলে-যাওয়া ঘিয়ের গন্ধে, হাইস্কুলের নরেশ মাস্টার মশাইয়ের বিজবিজে কাঁচাপাকা দাড়িওলা মুখে ভালবাসার নিবিড় একটা ছায়া দেখেনি কী? প্রীতম, শতম, রূপম আর মরম এই চার ভাইয়ের মধ্যে ছিল অবিরাম খুনোখুনি ঝগড়া, বিছানায় বালিশকে গদা বানিয়ে প্রবল মারপিট, খাওয়া নিয়ে, খেলা নিয়ে, জামাকাপড় নিয়ে বরাবর রেষারেষি। এখন মনে হয় তার মধ্যেই ভালবাসার কীট গোপনে গোপনে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে এর হৃদয়ের সঙ্গে ওর হৃদয়ের পথ করে দিয়েছিল। আর মা? বাবা? কোনওদিন তারা কেউ তো মুখ ফুটে বলেনি, প্রীতম তোকে বড় ভালবাসি। কিংবা, তুই বড় ভাল ছেলে। জ্ঞান বয়সে তাদের মুখে কখনও আদরের কথা শোনেনি প্রীতম, তবু সেই বাড়ি বুকসমান ভালবাসার জলে ছিল আধোবা। চিরদিনই কলকাতা ছিল প্রীতমের কাছে নিষ্ঠুর প্রবাস। আজও তাই আছে। ভবানীপুরের এই ফ্ল্যাটটা তার কাছে নিতান্তই এক বাসাবাড়ি, মেসবাড়ির মতো, হাসপাতালের মতো একটা নিরাপদ আশ্রয় মাত্র। এখানে ড়ুবজলে স্নান নেই।
যখনই শিলিগুড়ির কথা, ভালবাসার কথা মনে পড়ে তখনই বুকের মধ্যে নাটবল্ট ঢিলে হয়ে একটা কপাট যেন ভেঙে পড়তে চায়। ভারী ঘুঘুনে এক নেই-আঁকড়া ভাব আসে মনে, শিশু হয়ে যেতে ইচ্ছে জাগে। সেই দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দেয় না প্রীতম। কাগজ খাতা ডটপেন নিয়ে অঙ্কে ড়ুবে যাওয়ার চেষ্টা করে।
আচমকাই কলিং বেল বেজে ওঠে রি-রি করে।
প্রীতম তখনও আনমনে ভালবাসার কথাই ভাবছে। ভাবছে, তুমি কি অকৃতজ্ঞ নও প্রীতম? বিলু কি তোমার জন্য নিজেকে নিংড়ে দিচ্ছে না? দিচ্ছে তো? শুধু সকালে মুখের কাছে মুখ এনেও চুমু খায়নি বলেই কি এ বাড়িতে ভালবাসা নেই? এ কেমন ইল্লতে কথা?
কে গিয়ে দরজা খুলে দিল সদরের। হঠাৎ একটা আফটার-শেভ লোশনের সুগন্ধে ভরে গেল। শুধু আফটার-শেভ নয়, সঙ্গে হয়তো আরও কোনও সুগন্ধ আছে।
এ গন্ধ চেনা প্রীতমের। মুখে হাসি নিয়ে চোখ তুলে সে বলল, আসুন।
আজ ভালই আছেন মনে হচ্ছে! নইলে এই সাতসকালে কেউ কি অ্যাকাউন্টস নিয়ে বসে? বলতে বলতে অরুণ ইজিচেয়ার টেনে এনে বসে।
প্রীতম লক্ষ করল, অরুণ জুতোসুষ্ঠু ঘরে ঢুকেছে। প্রীতম এ নিয়ে কাউকে কিছু বলতে পারে না কখনও। কিন্তু বিলু পারে। অরুণের এ ধরনের ভুল প্রায়ই হয় এবং বিলু বকলে ফের গিয়ে জুতো ছেড়ে আসে। আজও বিলু ওকে বকবে ঠিক।
প্রীতম কিছুতেই অরুণের জুতোজোড়া থেকে চোখ তুলতে পারে না। কী সাংঘাতিক দামি এবং ঝকঝকে উঁচু হিলের জুতো! জুতো থেকে চোখ তুললে গাঢ় খয়েরি রঙের ঢোলা প্যান্ট এবং তার ওপর ডাবল ব্রেস্টেড কোট, কোটের ফাঁকে গাম্ভীর্যপূর্ণ টাই চোখে পড়বে। তার ওপর অরুণের সুন্দর গোলপানা ফর্সা মুখখানা। বেড়ালের মতো একটু কটা চোখ, সামান্য লালচে এক ঝাক চুল, চোখ দুখানা বিশাল। আভিজাত্যের স্থায়ী ছাপ তার সর্বাঙ্গে। হাতের আঙুলগুলো দেখ, কী মোলায়েম, লাল টুকটুকে পেলব।
প্রীতম হাসছিল। বলল, আজ একটু ভালই।
অরুণ খুব চোখা হেসে বলল, খুব ভাল কি থাকবেন আজ! ডাক্তার যে আজ বিকেলে আবার গোটা দশ বারো ছুঁচ ফোটাবে। আমি ঠিক ছ’টায় গাড়ি নিয়ে চলে আসব।
প্রীতম অস্বস্তি বোধ করে বলে, আপনার আসার কী দরকার? বিলুই ঠিক নিয়ে যেতে পারবে। এতদিন তো নিয়ে গেছে।
বিলু পারবে না, বলিনি তো! তবে কষ্ট হবে। দিন দিন কলকাতার কনভেয়ানস কেমন ডিফিকাল্ট হয়ে দাঁড়াচ্ছে জানেন তো! ঠিক সময়ে ট্যাক্সি না পেলে? ডেটটা মিস হওয়া কি ভাল?
প্রীতম কৃতজ্ঞতাবোধে অস্বস্তি বোধ করে সবচেয়ে বেশি। একটা লোক নিজের পেট্রল পুড়িয়ে গাড়ি নিয়ে আসবে, নিয়ে যাবে, ফের দিয়েও যাবে–এতটা কি পাওনা প্রীতমের ওর কাছে? অথচ অরুণের জন্য কিছু করারও নই,তার।
হতাশ হয়ে প্রীতম বলে, ঠিক আছে তা হলে।
ঠিকই আছে। খামোখা আমার অসুবিধের কথা ভেবে নিজেকে ব্যস্ত করেন কেন? আমার অসুবিধে হচ্ছে না।
অরুণ এরকম। কোনও জড়তা নেই, অকারণ বেশী ভদ্রতার ধার ধারে না। সবদিক দিয়েই ঝকঝকে প্রকৃতির মানুষ। ভীষণ ধারালো। উচিত কথা বলতে বা রুখে দাঁড়াতে ভয় খায় না। প্রীতমের মতো।
রান্নাঘর থেকে এলোচুল দু হাতে পাট করতে করতে তড়িৎ পায়ে বিলু ঘরে ঢুকতেই প্রীতমের বুক কেঁপে ওঠে। এইবার ঠিক অরুণের পায়ের জুতোজোড়া নজরে পড়বে বিলুর। সে চোখ কুঁচকে উদ্যত মারের অপেক্ষা করতে থাকে।
বিলু খুব ঝাঁঝালো গলায় অরুণকে বলে, আমার কমলা রঙের উলের কী হল? কবে থেকে বলছি, মেয়েটা জানুয়ারি থেকে স্কুলে যাবে! ওর ইউনিফর্ম লাগবে না?
অরুণ বিন্দুমাত্র অপ্রতিভ না হয়ে অন্যদিকে চেয়ে বলে, কমলা রং কাকে বলে তাই তো আমি বুঝি না। আমি একটু রংকানা আছি।
তা জানি। কানা শুধু নয়, ঠসাও। কতবার জুতো নিয়ে রুগির ঘরে ঢুকতে বারণ করেছি?