০৭. প্রবাসে দৈবের বশে

প্রবাসে দৈবের বশে

বাংলা ভাষায় ছাপা প্রথম আত্মচরিতের লেখক দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায় কর্মোপলক্ষে বিদেশ বাস করতে হয়েছিল বলে অনেক আফসোস করেছেন। বিদেশ মানে কৃষ্ণনগর, ওঁদের পৈতৃক গ্রাম থেকে বিশ মাইল দূরে। ১৯৩২ বা ‘৩৩ সালে এই দুর্ভাগ্য আমার কপালেও ঘটল। তার বেদনা যে কত তীব্র হতে পারে বয়স্ক মানুষের পক্ষে তা বোঝা কঠিন। ১৯৪৮ সনে বরাবরের মতো দেশত্যাগের সময়ও অত কষ্ট হয়নি।

বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। অসুখ ধরা পড়তে অনেক সময় চলে গেল। শেষে বোঝা গেল টাইফয়েড। বাড়িতে তিনটি অপোগণ্ড শিশু নিয়ে মা একা। কীর্তিপাশায় খবর পাঠানো হল। সেখান থেকে মেজজ্যাঠা আর নিজের গ্রাম থেকে শীতল জ্যাঠা এসে গেলেন। যত দূর জানি, টাইফয়েডের বিশেষ কোনও চিকিৎসা তখন ছিল না। শীতল জ্যাঠা এবং জেলার সিভিল সার্জন দুজনেই বললেন, প্রাণের আশঙ্কা আছে। চিকিৎসার জন্য কলকাতা নিয়ে যাওয়াই সমীচীন হবে। জ্বর একটু কমতেই শীতল জ্যাঠার সঙ্গে আমরা সবাই কলকাতা গেলাম। কবে ফেরা হবে ঠিক নেই। চোখের জলে বুক ভাসল। কিন্তু সামনে ঘোর অনিশ্চয়তা, সমূহ বিপদ। নির্বোধ ছেলেটার কান্নার দিকে দৃষ্টি দেওয়ার সময় কারও নেই। শুধু দাদা আড়ালে নিয়ে গিয়ে সান্ত্বনা দিল, “কেঁদো না, ক’দিন পরেই আমরা পালিয়ে আসব।”

মা বাবার সঙ্গে যাচ্ছি, সঙ্গে নগা, বসা, ধর্ম, এমনকী শীতল জ্যাঠাও আছেন। তবে কান্না কীসের জন্য? সে কথা কে বুঝবে? রাত্রে শোবার ঘরে জানলা দিয়ে হাসনুহানার ঝাড় থেকে যে গন্ধ আসে, কলকাতায় তা কোথা থেকে পাব? আর আঁকশি দিয়ে যে রোজ আঁশফল পাড়ি, যা নিয়ে সবাই হাসাহাসি করে, তার কী হবে? ঘোড়ারা ততদিনে মরে গেছে, কিন্তু গোয়ালে যে দুটো গাই আর পাটকিলে রঙের বাছুর আছে, আমাকে ছাড়া তাদের চলবে? আর মেনার সঙ্গে দুপুরের পর রোজ কিসসা আর নাচ-গানের আসর। হাসমাতালির কাছে ফুলগাছের তত্ত্ব নেওয়া। ছোট বউদি আর বুচিদিদির তৈরি নাড়ু ভক্ষণ, নদীতে শু-র হুস করে ভেসে ওঠা দেখা, মটফল নিয়ে মগো বেজির সাহায্যে পোলাও রান্না, ঠিকাবাসায় জুড়ানবাবু আর নায়েব মশায়ের সঙ্গে আড্ডা– কলকাতা নামের সেই বিশাল অচেনা বিচ্ছিরি শহরে এই চেনা পৃথিবীটা কোথায় হারিয়ে যাবে! ওখানে কি গুবরে শালিক আছে? আর বেজি আর কুখখা পাখি? সারাদিন মনের দুঃখে কাটে। রাত্রে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদি। দাদা মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেয়, “বড় হয়েছ এখন। কাঁদতে নেই।”

কলকাতা আমার সম্পূর্ণ অচেনা ছিল না। দাঁতে পোকা ধরায় বাবা একবার কলকাতা নিয়ে গিয়েছিলেন—দাঁত তোলাতে। ছিলাম পিসেমশায় কিরণশঙ্কর রায়ের বাড়ি। তেওতার জমিদার ভবন। ইউরোপিয়ান অ্যাসাইলাম লেনে বিশাল বাড়ি। অবশ্যি আমাদের গ্রামের বাড়িও কিছু ছোট নয়। কিন্তু শিশুরও status-চেতনা থাকে, বয়স্করা তা খেয়াল করেন না। ইউরোপিয়ান অ্যাসাইলাম লেনের ওই বিশাল বাড়িতে আমি হীনম্মন্যতায় ভুগতাম, পিসতুত বোনেরা মফস্বলবাসী গেঁয়ো ছেলেটাকে একটু করুণার চোখে দেখত। আর সাক্ষাৎ ডাকাত ছিল আমার পিসতুত ভাই। বয়সে সে আমার চেয়ে দু-আড়াই বছরের ছোট। উহ, কী বজ্জাত, কী বজ্জাত! খেতে বসলে থালায় জল ঢেলে দিচ্ছে, পিঁপড়ে ধরে এনে মাথায় ছেড়ে দিচ্ছে, সুযোগ পেলেই আঁচড়াচ্ছে খিমচোচ্ছে—সে এক মহামারী কাণ্ড। সাতদিনে আমার জান কয়লা করে ছেড়েছিল। পরবর্তীকালে ইনি ট্রেড ইউনিয়ন নেতা, রাজ্য সভায় C.P.. দলের সভ্য কল্যাণশঙ্কর রায়। তিন বছর বয়সে যে ব্যক্তি মানুষকে নাজেহাল করার আর্ট সম্পূর্ণ রপ্ত করে ফেলে, সে যে পরে রাজনৈতিক নেতা হবে এ আর বিচিত্র কী? কল্যাণ শুধু আত্মীয় না, আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। তার অকালমৃত্যুটা এখনও ঠিক মেনে নিতে পারিনি। কিন্তু তিন বছর বয়সে তার কীর্তিকলাপ স্মরণ করলে এখনও হৃদকম্প হয়।

প্রথম দর্শনে কলকাতা আমার হৃদয় জয় করেনি। অত লোকজন গাড়িঘোড়া গোলমালে আমি এক অদ্ভুত আতঙ্কে কুঁকড়ে গিয়েছিলাম। সেই আতঙ্ক চলে গিয়ে গভীর অনুরাগে পৌঁছাতে অনেকদিন সময় লেগেছিল। মনোভঙ্গির দিক থেকে আমি শুধু ছেলেবেলায় না, পরিণত বয়সেও মফস্বলবাসী বাঙালই ছিলাম। এখনও কিছুটা রয়ে গেছি—গভীর কলকাতাপ্রীতি সত্ত্বেও।

পাঁচ বছর বয়সে প্রথম কলকাতা দর্শনের কয়েকটি স্মৃতি মনে গেঁথে আছে। সম্পূর্ণ যুক্তিহীনভাবে তার মধ্যে একেবারে প্রথম সারিতে প্রথম হচ্ছে লিফট। আমার চকোলেটের কৃপায় পোকায় খাওয়া দাঁত ফেলাতে বাবা নিয়ে গিয়েছিলেন বিখ্যাত দাঁতের ডাক্তার আর আহমেদের কাছে। ভয়টা কাটানোর জন্য ওঁর ধর্মতলার সার্জারিতে যাবার আগে আমাকে সোডা ফাউন্টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে গোলাপি রঙের রোজ মিল্ক শেক খেয়ে মনে হয়েছিল পৃথিবীতে এর চেয়ে আরও বেশি সুখ বোধ হয় সম্ভব না। তারপর লিফট চড়ে ডেন্টিস্টের সার্জারি। এ কী আশ্চর্য ঘটনা? আস্ত একখানা ঘর হুস করে উপরে উঠে গেল? অগো বেঙ্গি, মগো বেঙ্গি, জগদীশ্যা কি এই গল্প শুনে বিশ্বাস করবে? ডেন্টিস্টের ঘরে ঢুকে কোন মহাবীরের না হৃদকম্প হয়? চেয়ারে বসিয়ে মুখে গ্যাগ দিয়ে দিলে ভীমই কি খুব স্বস্তিবোধ করতেন? কিন্তু সমস্ত ভয় নিরসন করে ডক্টর আহমেদ ইথার স্প্রে দিলেন। আহ্ কী ঠান্ডা। কতগুলি দাঁত তুলে ফেলা হল। কিছুই বুঝতে পারলাম না। দাঁত তোলার পর বীরদর্পে পিসিমার বাড়ি ফিরে এলাম। “দাঁত তোলার সময় কাঁদোনি?” সদর্প এবং অক্ষরে অক্ষরে সত্য উত্তর, “না।” পিসতুত বোনেরা সত্যিই বিস্ময়ে হতবাক। ছেলেটা হাবা হলে কী হয়, সাহস আছে! বাবা সন্ধেবেলা হাবা ছেলেটা আর বোনদের নিয়ে ম্যাডান থিয়েটারে গেলেন—ইংরাজি সিনেমা দেখতে। কী ঘটছে তার একবর্ণও না বুঝতে পারলেও রুপোলি পর্দার উপর মানুষজন নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে, কথা বলছে—এই অচিন্তনীয় ঘটনার আমি দর্শক, কথাটা ভেবেই আমি আত্মহারা। তারপর ইন্টারভেলের সময় সবাইকে নিয়ে বাবা গেলেন ব্রাসেরিতে। ধপধপে সাদা সুগন্ধ আইসক্রিম এল, রুপার মতো ঝকঝকে বাটিতে। এত ঠান্ডা যে ধোঁয়া উঠছে মনে হয়। এত সৌভাগ্যও আমার কপালে লেখা ছিল? এ কি স্বপ্ন, এ কি সত্য, এ কি মায়া? কিন্তু মানুষের ভাগ্যচক্রবৎ পরিবর্তন্তে। এক চামচে হিমশীতল আইসক্রিম মুখে দিতেই, সদ্য তোলা দাঁতের গোড়ায় তীব্র যন্ত্রণা, ফলে আমার হাহাকারে আকাশ-বাতাস পূর্ণ। পিসতুত বোনেরা হেসে গড়াচ্ছে। এত অপমান জীবনে কখনও সইতে হয়নি। কলকাতা-ভ্ৰমণ আমার কাছে বিষ হয়ে গেল।

কিন্তু দ্বিতীয়বার কলকাতা যাত্রার পারিপার্শ্বিক সম্পূর্ণ আলাদা। বাবার চিকিৎসার জন্য যাওয়া হচ্ছে। ছেলেমানুষ হলেও বুঝতে পারছি, ওঁর প্রাণের আশঙ্কা আছে। মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভাঙলে দেখি মা চোখ মেলে শুয়ে আছেন। যতি দিনের মধ্যে দশবার বলে, “ঠাকুরের পায়ে ধর। বল বাবাকে ভাল করে দিতে।” এসব কথার পেছনে যে বিপদের কালো ছায়া তাকে চিনতে অসুবিধে হয় না। জিনিসপত্র গোছানো হচ্ছে। কারও মুখে হাসি নেই। সবাই গলা নামিয়ে কথা বলে। মেজজ্যাঠা আর শীতল জ্যাঠা সব সময় বাবার ঘরে থাকেন। মেজজ্যাঠা সুকুমার রায়ের লেখা নতুন বই, ‘আবোল তাবোল’ নিয়ে এসেছেন। বাবাকে পড়ে শোনান। ও ঘরে আমাদের যাওয়া বারণ। মাঝে মাঝে বাবা ডাকলে দু-এক মিনিটের জন্য গিয়ে দাঁড়াই। বাবা অনেক রোগা হয়ে গেছেন। রোজ দাড়ি কামানো হয় না। চোখ লাল। ওঁকে দেখে কেমন যেন মনে হয় অপরিচিত মানুষ। অস্বস্তি লাগে।

এই থমথমে আবহাওয়ার মধ্যে একদিন আমরা সত্যিই কলকাতা রওনা হলাম। শীতল জ্যাঠা সঙ্গে চলনদার। মেজজ্যাঠা আগেই চলে গেছেন। ওঁরা এখন কলকাতায় বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন—মেয়ের লেখাপড়ার সুবিধে হবে বলে। আমরা প্রথমে গিয়ে ওদের বাড়িতেই উঠব। সকলের কাছে বিদায় নিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে স্টিমারঘাট রওনা হলাম। ভুইঞা জ্যাঠা আর নেই। কিন্তু জ্যেঠিমা আর দাদা-দিদিরা অনেক আদর করলেন। সেরেস্তার কর্মচারীরা আর খেলার সাথী সব সার দিয়ে দাঁড়িয়ে। মেনা চোখের জল ফেলছে, হাসমাতালিরও মুখখানা বেজার। স্টিমারে উঠে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আমার বেজায় কান্না পেল। আর কি কখনও বরিশাল ফিরব? যদি ফিরিও তা কবে? দাদা বোধ হয় অবস্থার গুরুত্বটা আমার চেয়ে ভাল বুঝছিল। কিন্তু সে কখনও কলকাতা যায়নি। কলকাতা দেখার উৎসাহ তার কম না। সুতরাং তারও কান্না পাচ্ছিল কি না জানি না। স্টিমারের ডাইনিং রুমে ও বেশ রসিয়ে চিকেন কারি খেল। আমার তখন কিছুই খেতে ভাল লাগত না। ডাল-ভাত খেয়ে কেবিনের বাঙ্কবেডে শুয়ে রইলাম।

স্টিমারে খুলনা, সেখান থেকে ট্রেনে শিয়ালদা। শিয়ালদায় পিসেমশায় আমাদের নিতে এসেছিলেন। ওঁদের হিলম্যান গাড়ি করে সোজা কালিঘাট-প্রিন্স গোলাম মহম্মদ রোডে মেজজ্যাঠার বাড়ি। তার পাশের বাড়ি আমাদের জন্য ভাড়া করা ছিল। সে বাড়ি গোছানো হলে কদিন বাদে আমরা উঠে গেলাম।

পাষাণকায়া রাজধানী আমার যেন গলা টিপে ধরত। বাড়িতে থমথমে আবহাওয়া। কোনও খেলার সাথী নেই। নগা-বসা সঙ্গে এসেছে। কিন্তু তারাও একটু জোরে কথা বললেই ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে চুপ করতে বলে। বাড়ির থেকে বের হওয়া যায় না। বিকেলবেলা নগা বা বসা কিছুক্ষণের জন্য কালীঘাট পার্কে নিয়ে যায়। এটা কোনও বেড়াবার জায়গা? ঘাস উঠে যাওয়া মরা মরা একটা মাঠ, চারপাশে ভাঙাচোরা রেলিং, মাঠে কয়েকটা নোংরা নোংরা বেঞ্চি আর গোটা দুই দোলনা। কোথায় আমাদের নদীর পাড়ের সারি সারি ঝাউগাছ, ধানের ক্ষেত আর বেলস পার্কের সবুজ ঘাস আর কোথায় এই খয়া খয়া পার্ক। বাড়িতে বাবা কেমন আছেন বুঝতে পারি না। পিসেমশায় একদিন মস্ত লম্বা এক ভদ্রলোককে সঙ্গে করে নিয়ে এলেন। শুনলাম ইনিই ডক্টর বিধান রায়। তিনিও বিশেষ কিছু না বলে চলে গেলেন।

দিন পনেরো পরে বাবা বিছানা ছেড়ে উঠে বসলেন। সবাই বেশ খুশি খুশি, শীতল জ্যাঠা নিজ মূর্তি ধারণ করেছেন। ডেকে বললেন, “শোন্ সব মূর্খের ডিম। যা বাপেরে দেইখ্যা আয়। বেশি জ্বালাইস না কইলাম।” মনে হল, আমাদের মাথার উপর অন্ধকার একটা মেঘ জমেছিল—সেটা যেন কেটে গেছে।

কিন্তু বিপদ কখন কোন দিক থেকে আসবে তা কি কারও আগে থেকে জানা থাকে? একদিন সকালবেলা মেজজ্যাঠা এসে বললেন, “অতু-তপু, এই দিকে শোনো। এদিক-ওদিক কোথাও যাইও না। শহরে কলেরা লাগছে। কর্পোরেশনের লোক আইবে ইনজেকশন দিতে।” ইংরাজি শব্দটার অর্থ আমার জানা ছিল না। ব্যাপারটার অভিজ্ঞতা আগে নিশ্চয় হয়েছিল, কিন্তু তা আমার স্মৃতির অংশ ছিল না। কিন্তু দাদার মুখ দেখে বুঝলাম সামনে ঘোর বিপদ, মহতী প্রণষ্টি। মেনার একটি প্রিয় গান স্মরণ হল, ‘দরিয়ায় ঘোর তুফান, পার কর নাইয়া’। কিন্তু এই মহা সঙ্কটে কে আমাদের পার করবে? ধ্রুব-প্রহ্লাদকে এ রকম সিচুয়েশনে বিষ্ণুও নানা চেহারা নিয়ে এসে বাঁচিয়ে দিতেন। কিন্তু আমরা কি সে রকম পুণ্যবান? আর বিষ্ণু হঠাৎ নৃসিংহমূর্তি ধরে এলে কি ভাল হবে? তিনি যে শুধু ইনজেকশানবাবুকেই সংহার করবেন এমন তো কোনও কথা দেননি। কিন্তু দাদা ছেলেমানুষ হলেও সহজে হার মানার পাত্র না। সে আমাকে পাশের ঘরে ডেকে নিয়ে গেল, যেখানে অন্য কেউ নেই। বলল, “চল আমরা সন্ন্যাসী সেজে পালিয়ে যাই।” “গেরুয়া কাপড় পাব কোথায় আমরা?” “সব সন্ন্যাসীরা গেরুয়া পরে না। গায়ে ভস্ম মেখে কৌপীন পরলেই হবে।”“ভস্মই বা কোথায় পাব? আর কৌপীনও কি আমাদের আছে?” “ভস্ম আর কয়লার গুঁড়ো একই জিনিস। কৌপীনের দরকার নেই, ইজার পরলেই চলবে।” কলকাতার রাস্তায় ইজার-পরিহিত কয়লার গুঁড়াবৃত দুই বালক সন্ন্যাসী কল্পনা করে আমার চোখে জল এল। কপালে এত-ও ছিল? একে তো বাড়ি ছেড়ে এই যাচ্ছেতাই জায়গায় এসে পড়েছি। তার উপর আবার সন্ন্যাসী সেজে ভিক্ষে করে খেতে হবে? সকালবেলা ওভালটিনের সঙ্গে থিন অ্যারারুট বিস্কুট খাওয়া আমার অভ্যেস। কেউ কি আর বিস্কুট ভিক্ষে দেবে? কিন্তু তখন শিরে সংক্রান্তি। প্রাণ বাঁচানো নিয়ে কথা। সুতরাং দ্বিরুক্তি না করে, গায়ের জামা খুলে রেখে দাদার পেছন পেছন কলঘরের পাশে কয়লাঘরে গিয়ে ঢুকলাম। গুঁড়ো কয়লা কিছু এদিক ওদিক ছড়ানো ছিল। মুখে গায়ে তার কিছু মাখলাম। পরিকল্পনা হল ইনজেকশানবাবু এসে চলে গেলে সন্তর্পণে রাস্তায় বের হয়ে পড়ত্ব। কিন্তু বিপদ কি প্ল্যান-মাফিক আসে? ইনজেকশানবাবু এসে পড়ামাত্র অতু-তপুর ডাক পড়ল। অনেক খোঁজাখুঁজির পর যখন পাওয়া গেল না, তখন যতি এক মারাত্মক সিদ্ধান্তে পৌঁছাল—ছেলে দুটোকে নিশ্চয়ই ছেলেধরায় নিয়েছে। সিদ্ধান্তটা মারাত্মক এই জন্য যে, ওটায় পৌঁছানমাত্র যতির স্বভাবসিদ্ধ শোকসঙ্গীত শুরু হয়ে গেল, “ওরে বাবা রে! ছেলে দুটোকে মেরে ফেলবে রে! আমি কোথায় যাব রে!” সেই সঙ্গীত যে কতটা হৃদয়, কর্ণ এবং মস্তিষ্ক বিদারক ছিল তা যে না শুনেছে তার পক্ষে বোঝা সম্ভব না। শিশু-চরিত্র-বিশারদ শীতল জ্যাঠা কিন্তু চট করে ব্যাপারটা বুঝে ফেললেন। যতিকে বললেন, “চ্যাঁচাইও না, নিশ্চয়ই ইনজিকশনের ভয়ে পলাইছে।” বলে একটুও সময় নষ্ট না করে সোজা কলঘরে উপস্থিত। তারপর দুই নবীন সন্ন্যাসীর কান ধরে সাধারণ্যে উপস্থিত করা হল। সবাই হেসে খুন। ইনজেকশান তো নিতে হলই। তার উপর অপমানের একশেষ।

কলকাতার নিরানন্দ-জীবনে একমাত্র ভরসা শীতল জ্যাঠাই। উনিই শত কাজের মধ্যেও সময় করে চিড়িয়াখানা, জাদুঘর, পরেশনাথ অর্থাৎ পার্শ্বনাথের মন্দির দেখাতে নিয়ে যেতেন। কিন্তু এত গাড়িঘোড়া আর মানুষের ভিড়ে কিছুই ভাল লাগে না। রাস্তায় বের হলেই গাড়ি চাপা পড়ার ভয়ে কুঁচকে থাকি। তার উপর ছেলেধরার ব্যাপারটাও আছে। যতি বিপদটা সম্যকভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে। ছেলেধরারা নাকি ছেলে চুরি করে নিয়ে প্রথমেই হাত-পা ভেঙে দেয়, তারপর রাস্তায় বসিয়ে দেয় ভিক্ষে করার জন্য। রাস্তায় হাত-পা ভাঙা ভিখিরি তো রোজই দেখি। এরা সবাই ছেলেবেলায় চুরি গিয়েছিল তাতে আর সন্দেহ কী? তবে সকলেরই হাত-পা ভেঙে দেয় এমন না। কেউ কেউ আড়কাঠিদের কাছে বিক্রি হয়ে আসামের চা বাগানে চালান হয়। সেখানেও জীবন কিছু সুখের না। রোজ সকালে ছোট হাজরি খেতে খেতে চাকর সাহেবরা কুলিদের পঞ্চাশ ঘা বেত মারে। যেদিন কলকাতা রওনা হয়েছি, সেদিনই জানি কপালে অনেক দুঃখ আছে। দাদা পারসপেকটিভ প্ল্যানিং-এ বিশ্বাসী ছিল। চুরি যাওয়া এবং হাত-পা ভাঙার মধ্যে যে কয়েক ঘণ্টা সময় পাওয়া যাবে তার সদ্ব্যবহার করে কীভাবে পালানো যাবে, তার সব অব্যর্থ উপায় বের করেছিল। তার কিছু কিছু আরবব্যাপন্যাসের সিন্ধবাদ নাবিকের কাহিনি থেকে সংগৃহীত। এইসব শলা-পরামর্শ শ্রদ্ধার সঙ্গে শুনতাম। কিন্তু ইনজেকশান-বিভ্রাটের পর আর কিছুতেই বেশি ভরসা পেতাম না। বাকি জীবনটা হাত-পা ভাঙা অবস্থায় ভিক্ষে করেই কাটাতে হবে একথা স্থির জেনে হৃদিস্থিত হৃষীকেশের কাছে বীতরাগ হয়ে আত্মসমর্পণ করেছিলাম। ভদ্রলোক যদি ভিক্ষায় বা চা-কুলির কাজে নিযুক্ত করবেন মনস্থির করে থাকেন, তবে তাই-ই করতে হবে।

এই ঘোর অন্ধকারের মধ্যে হঠাৎ একটু আশার আলো দেখা গেল। বাবা কিছুটা সুস্থ হয়েছেন। ডক্টর রায় বলেছেন—চেঞ্জে যেতে। কিরণশঙ্করবাবুদের কার্শিয়াং পাহাড়ে একটা বাড়ি আছে। সেখানেই যাওয়া স্থির হয়েছে। ‘চেঞ্জ’ কথাটা আমার কাছে অপরিচিত না। ‘চেঞ্জ’ মানেই তো ককসোবাজার আর না দেখা শিলং। আমার চেতনায় ককসোবাজার তো স্বর্গের পরেই সেকেন্ড প্লেস। স্বর্গ দেখা হয়নি ফলে ফার্স্ট প্লেসও হতে পারে। কার্শিয়াংও ওই রকমই কিছু হবে। শুনলাম ওখানে সমুদ্র, বালিয়াড়ি, লাল কাকড়া এসব নেই। তবে বাড়ির সামনেই নাকি কাঞ্চনজঙ্ঘা বলে একটা বরফে ঢাকা পাহাড় আছে। হাত বাড়ালেই ছোঁওয়া যায়। বরফ জিনিসটা অচেনা না। অসুখবিসুখ কিংবা ঠান্ডা পুডিং খাওয়ার শখ হলে স্টিমার কোম্পানি থেকে করাতের গুঁড়োয় ঢাকা বরফ চটের ছালায় করে আনা হত। চাঁদমারির পাহাড় (উচ্চতা বিশ ফুট) ওই বরফের গুঁড়ো দিয়ে ঢেকে দিলে কী রকম দেখতে হবে কল্পনা করার চেষ্টা করি। যা হোক, এই যাচ্ছেতাই জায়গা কলকাতা শহর থেকে তো পালাতে পারব সন্ন্যাস না নিয়েই।

শেষ অবধি কার্শিয়াং যাওয়ার দিন এসে গেল। বড় ট্রেন, ছোট খেলনা ট্রেন চেপে কার্শিয়াং পৌঁছলাম। স্টেশনে পৌঁছতেই নেপালি আর ভুটিয়া মেয়েরা আমার ছোট বোনকে হাতে হাতে নিয়ে প্রায় উধাও। ওর নাক তখন পর্বতবাসিনীদের মতোই খ্যাঁদা ছিল। বোধ হয় সেই কারণেই একটা নৈকট্যবোধ থেকে ভুটিয়ানিরা ওর এত সমাদর করছিল। অতি কষ্টে তাকে উদ্ধার করে গাড়ি চেপে আমাদের বাসস্থানে পৌঁছলাম।

কাঠের তৈরি অতি সুন্দর বাড়ি। বারান্দার থামগুলি গোল। জড়িয়ে ধরে তাদের ঠান্ডা স্পর্শ বেশ কিছুক্ষণ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করলাম। বাড়ির সামনেই মরসুমি ফুলের বাগান। তার অন্যতম আকর্ষণ ভুটিয়া মালির ছেলে যে আমার সমবয়সি। পারিপার্শ্বিক বিষয়ে তার প্রায় সহজাত জ্ঞান এত বেশি যে, তা লিখে ফেললে ছোটখাটো একটা এনসাইক্লোপেডিয়া হয়ে যেত। আর ঝকঝকে সূর্যের আলোয় সামনেই দেখলাম–কাঞ্চনজঙ্ঘা। না, হাত বাড়িয়ে ছোঁয়া যায় না ঠিকই, কিন্তু বেশ কাছেই তো মনে হয়। ‘পাহাড় বসে আছে মহা মুনি’। অবাক হয়ে চেয়েছিলাম। যে বালকের চেতনায় পাহাড় অর্থ বিশ ফুট উঁচু চাঁদমারি, সে আজ কোথায় এসে পড়েছে। পারহীন সমুদ্র সদাচঞ্চল। আর এখানে সমুদ্রের সবচেয়ে বড় ঢেউগুলি যেন সাদা বরফ হয়ে জমে আছে। যৌবনে যখন ‘কুমারসম্ভবম’ পড়ি, তখন ‘অস্তি উত্তরস্যাং দিশি দেবতাত্মা হিমালয় নাম নগাধিরাজ’ এই শব্দ কয়টি পড়তেই প্রথম দেখা কাঞ্চনজঙ্ঘার অপার্থিব রূপ স্মরণ হয়েছিল। শুনেছিলাম সন্ন্যাসীরা শুধু অরণ্যে না, পর্বতের গুহায়ও থাকেন, যোগবলে ওঁদের ঠান্ডা লাগে না। মনে মনে ভবিষ্যৎ জীবন সম্পর্কে এক অমোঘ সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি পৰ্বতকরবাসী সন্ন্যাসীই হব। ওই দেবতাত্মা হিমালয় আমার ভবিষ্যৎ বাসস্থান। ডুবে যাবার ভয়ে সমুদ্রের প্রতি অনুরাগটা নির্ভেজাল হয়নি। কিন্তু বরফের পাহাড়? এর কি তুলনা আছে? পিছলে পড়ে মরার সম্ভাবনাটা তখনও চেতনাগোচর হয়নি।

মালির ছেলেটি এক মুঠো ধুলো তুলে নিয়ে দেখালতার মধ্যে কী যেন চিকচিক করছে। ভাঙা কাচ? উঁহু আব। আব মানে অভ্র? তার টুকরো এরকম রাস্তায় গড়াগড়ি যায়? আরও বিস্ময়কর সব জিনিস নতুন স্যাঙাতের কৃপায় দেখতে পেলাম। কমলা রঙের ছোট ছোট ফল রাস্তার পাশে ঝোপে হয়ে আছে। বলল, “বুনা স্ট্রবেরি।” বেশ তো খেতে। মাটি খুঁড়ে একটা জংলা গাছের গোড়ায় ছোট ছোট পেঁয়াজের মতো দেখতে কী এক অজানা ফল বা মূল তুলে আমাকে দিল। রসে ভরা চমৎকার খেতে। বুঝলাম, সন্ন্যাসজীবনে আহারাদি ভালই হবে। সাধুবাবাদের ভুড়িটি যে সাধারণত বেশ নেয়াপাতি হয়, তার কারণটা এখন জানা গেল। মনে মনে স্থির করলাম–বুঝেশুনে খেতে হবে। ভুঁড়ি বাগানো একেবারেই চলবে না। অল্পদিন আগেই ব্রতচারীদের নাচ দেখেছি। তাদের অন্যতর প্রতিজ্ঞা—”ভুলেও ভুড়ি বাগাইব না” বেশ মনে ধরেছিল। ভূধরদাদু ছাড়া আর সব ভুড়িওয়ালা লোকদের বিশেষ অপছন্দ করি। আমার কেমন ধারণা—ওরা বেশি রাগী হয়।

বাড়ির সামনের বাগানে এক দিন এক কাণ্ড ঘটল। বাগানে অনেক পপি ফুটেছিল। মৌমাছিরা এসে পপির অন্তর্দেশে ঢুকে মধুপানে মত্ত। শাস্ত্রে বলেছে ‘বিনাশকালে বিপরীত বুদ্ধি’। আমার মাথায় হঠাৎ বাঁদুরে বুদ্ধি চেগে উঠল। ভাবলাম একটা মৌমাছিকে বন্দি করা যাক। যথা চিন্তা তথা কাজ। মৌমাছি-পূর্ণ একটি লম্বাটে ফুলের খোলা মুখটা চেপে ধরলাম। পরক্ষণেই হাহাকার। পাপড়ি ছেঁদা করে মৌমাছি হুল ফুটিয়েছে। সবাই বলতে লাগল, “বেশ হয়েছে।” বুঝতে পারলাম মানুষের চিত্তে এমপ্যাথির ক্ষমতা নিতান্তই সীমিত।

পাহাড়ে রাস্তায় বেড়াতে বেশ লাগত। কিন্তু মালি সাবধান করে দিয়েছিল—রাত করবেন না, নীচে তরাইতে ভালুক আছে, মাঝে মাঝে উপরে উঠে আসে। বরিশালের একটা চালু লোক প্রবাদ—’পাগলারে তুই শাগ (অর্থাৎ সাঁকো) লাড়াইস না।” “ভাল মনে করছ।” এই কথার উৎপত্তি বোধ হয় শীতল জ্যাঠাকে দেখেই। যেদিন শুনলেন, ভালুকের ভয় আছে, সেদিন থেকে রোজ সন্ধেবেলা বের হতে শুরু করলেন। এবং বাবাকে সঙ্গে করে। দু’জনেরই বক্তব্য একই। বুনো ভালুক কখনও দেখেননি। বুনো ভালুকও যে ওঁদের দেখেনি এবং সেই পারস্পরিক অসাক্ষাতের ফলেই ওঁরা এতদিন বেঁচে আছেন, সে কথা ওঁদের মনে হল না। একদিন বিকেল চারটে নাগাদ আমাদের দুই ভাইকে সঙ্গে নিয়ে শীতল জ্যাঠা বৈকালিক ভ্রমণে বের হলেন। সান্ধ্য ভ্রমণও বটে, কারণ পাঁচটা না বাজতেই সন্ধে হয়ে যায়। লজ্জার মাথা খেয়ে ঘোমটা একটু বেশি টেনে মা এসে বললেন, “শীতলদাদা, ওদের কিন্তু ভাল্লুক দেখানোর চেষ্টা করবেন না।” সাত হাত জিভ কেটে শীতল জ্যাঠা বললেন। “পাগল হইছ?” পাগল কে হয়েছে, সে সম্বন্ধে মা’র ধারণা খুব স্পষ্ট ছিল। জ্যাঠা প্রথমে আমাদের কার্শিয়াং স্টেশনে নিয়ে গেলেন। সেখানে কাঁচের বাক্সে বীভৎস রকমের সবুজ এবং গোলাপি রঙের হালুয়া দেখে খাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলাম, বাবা সঙ্গে থাকায় এই বদিচ্ছা পূর্ণ হয়নি। এখন অবশ্য কর্তব্যজ্ঞানে ওই হালুয়া খাওয়াতে শীতল জ্যাঠা আমাদের নিয়ে গেলেন। কিনে দিয়ে সংক্ষিপ্ত মন্তব্য করলেন, “তোরগো বাপে একডা মূর্খের ডিম।” মানবজাতির অধিকাংশই যখন মূর্খের ডিম, তখন আমাদের বাবা তার ব্যতিক্রম হবে এমন মনে করার মতো ধৃষ্টতা আমাদের ছিল না। কিন্তু হালুয়া খাওয়া গেল না। কারণ পুরনো জুতার শুকতলিতে খুব নিকৃষ্ট ভুরা চিনি মাখালে বোধ হয় ওই ধরনের স্বাদ হত, জুতার শুকতলি খাওয়া হয়ে ওঠেনি তাই ঠিক বলতে পারছি না। ওই হালুয়া-গোষ্ঠির কুলাঙ্গার থু থু করে ফেলে দিলাম। শীতলজ্যাঠা নিতান্ত প্রত্যাশিতভাবেই বললেন, “মুর্খের ডিম।”

হালুয়াপর্ব শেষ করে যখন বাড়ির পথ ধরেছি, তখন বেশ অন্ধকার হয়ে গেছে। কিছুটা যেতেই দুর থেকে দেখা গেল অন্ধকারে কোনও একটা প্রাণী আসছে—চতুষ্পদ সন্দেহ নেই, আর কিছু তখনও বোঝা যাচ্ছে না। শীতল জ্যাঠা বেশ উল্লসিত : “বোধ হয় ভালুকই হইবে!” বোধ হয় ভালুকই হইবে? হেইলে আমাগো কী হইবে? এমন সুসমাচার আগে কখনও শুনিনি। আমাদের যৌথ ভীতি দাদা ভাষায় প্রকাশ করল, “অ জ্যাডা, কও কী? আমাগো যে মারিয়া ফেলাইবে!” শীতল জ্যাঠা নিশ্চিন্ত, “ক্যামনে মারবে? আমার হাতে লাডিডা আছে কী করতে?” কী করতে আছে তা আমাদের জানা নেই। তবে ওটা দিয়ে ভালুক মারা যাবে এমন কোনও স্থির বিশ্বাসও আমাদের নেই। আমি ভয়ে সিঁটিয়ে রইলাম, দাদা ভ্যা করে কেঁদে ফেলল। জন্তুটি আর একটু কাছে এলে দেখা গেল, সাইজে বেশ বড়। তবে ঘনকৃষ্ণ এবং লোমশ হলেও, জাতিতে সে ভাল্লুক না, কুকুর-সম্ভবত রিট্রিভার জাতীয়। তখনকার মতো আমাদের প্রাণ বাঁচল। শীতল জ্যাঠা আশাহত, বিমর্ষ : “ভাল্লুক দেখা আর হইল না।” জীবনে সব উচ্চাশা কি পূর্ণ হয়?

কার্শিয়াং থেকে কলকাতা ফিরে আর এক দুঃসংবাদ পেলাম। স্থির হয়েছে আপাতত আমরা কলকাতায়ই থেকে যাব। ছেলেদের লেখাপড়ার সুবিধা হবে বলে বাবা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বুক ভেঙে যাওয়া কথাটার অর্থ কী, আমরা দু ভাই এবার ভালই বুঝলাম। একে তো প্রবাসে দৈবের বশে জীবতারা যে কোনও মুহূর্তে খসার আশঙ্কা, তার উপর আর এক উপদ্রব শুরু হল। দীর্ঘদিন থাকার জন্য কোনও বাড়িই বাবার পছন্দ হয় না। প্রিন্স গোলাম মহম্মদ রোড থেকে সর্দার শঙ্কর রোড, তারপর যতীন দাস রোড, সেখান থেকে হিন্দুস্থান রোড, তারপর সাউথ এন্ড পার্ক। হেনস্তার এক শেষ। দাদা আর আমি রোজই বসে পালিয়ে বরিশাল ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা করতাম, বরিশালে সবাই আমাদের দেখে কী রকম অবাক হয়ে যাবে বড়দা, ছোড়দা, বউদিরা, মেনা, হাসমতালি সবাই কে কী বলবে, এই আমাদের প্রধান আলোচ্য ছিল। সাউথ এন্ড পার্কে এসে শেষ পর্যন্ত বছর দেড়েকের মতো থিতু হলাম। এ বাড়ির বাড়তি আকর্ষণ, পাশের বাড়ির বাসিন্দা সপরিবারে শীতল জ্যাঠা। মুর্খের ডিমরা সত্যিই উল্লসিত।

কলকাতার জীবন সম্পূর্ণ নিরানন্দ ছিল এমন না। ‘এক এক আনা-দু আনা’ বলে এক আনার ফিরিওয়ালা নানা লোভনীয় জিনিস বিক্রি করতে আনত। আর শালপাতায় পসরা সাজিয়ে আসত খোয়া সন্দেশ এবং শোনপাপড়ি বিক্রেতা। কাপড়ের বস্তা পিঠে চিনা ফিরিওয়ালা সম্পর্কেও আমাদের অপরিসীম কৌতূহল ছিল, বিশেষ করে ওরা আরশোলা খায় শুনে। এক অতি চৌখস ভৃত্য একটা ভাল জিনিস খাওয়াবে বলে আমাদের হাতখরচার দৈনিক দু পয়সা নিয়ে নিল। (তখন এক পয়সায় এক প্যাকেট নকুলদানা পাওয়া যেত।) সেই পয়সা দিয়ে বিড়ি কিনে আমাদের দু-ভাইকে একটা খেতে দিল। বাকিটা তার। বলল, “বিড়ি খেলে শরীরে ভীমের মতো বল হয়।” ওর মানা সত্ত্বেও এই শক্তিসাধনার কাহিনি মা বাবাকে বললাম। বিড়ি খেয়ে দু ভাই ভীম হতে যাচ্ছি—এ কথা না জানানোর কোনও কারণ দেখলাম না। ফলে ভৃত্যপ্রবরের চাকরি গেল।

হিন্দুস্থান রোডের ফ্ল্যাটে থাকবার সময় বাবা হঠাৎ ঠিক করলেন—পোলট্রির ব্যবসা করবেন। ছোটমামা কুমিল্লা থেকে এসেছিলেন। সেখানে হাঁস-মুরগি সস্তা, সুতরাং প্রথম সাপ্লাইটা উনিই পাঠাবেন, পরে সুবিধে মতো ফার্ম করে তাদের বংশবৃদ্ধি করা হবে এবং ভাল মুনাফায় বিক্রি করে জমিদারি বাবদ আয়ের ঘাটতি পূরণ হবে। ছোট মামা করিৎকর্মা মানুষ। যাঁহা বলা, তাঁহা করা, কোনও কাজ ফেলে রাখা উনি পছন্দ করতেন না। ফলে এই আলোচনার সাতদিনের মধ্যে কুমিল্লা থেকে এক হাজার মোরগ-মুরগি ডাকযোগে আমাদের ফ্ল্যাটে পৌঁছাল। তাদের ফ্ল্যাটে থাকতে দিলে, আমাদের অন্যত্র যেতে হত। সহাবস্থান সম্ভব ছিল না। তাই তাদের তখনকার মতো ছাদে থাকার ব্যবস্থা হল। ভাড়াটে হিসাবে ছাদে যাওয়ার অধিকার আমাদের অবশ্যই ছিল, কিন্তু মুরগি রাখার অধিকার ছিল কি না এ সম্বন্ধে ব্রিটিশ ভারতের আইনে স্পষ্ট কোনও নির্দেশ ছিল বলে মনে হয় না। আর ঝাঁকা থেকে বের হয়ে একই বাড়ির বাসিন্দা সদাচারী ব্রাহ্মণ বাড়িওয়ালার শয়নকক্ষ এবং রন্ধনগৃহে প্রবেশ যে মুরগিদের অধিকারবহির্ভূত সে বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ ছিল না। বাড়িওয়ালা ব্ৰহ্মতেজে জ্বলে উঠে লোকসভায় অচল সব ভাষা ব্যবহার করা শুরু করলেন (অবশ্যি প্রশ্ন করতে পারেন, আমাদের লোকসভায় অচল এমন ভাষা বা কাজ কি কিছু আছে?)। মোটকথা তাঁর বক্তব্য—যেদিন বাঙাল জমিদারকে বাড়ি ভাড়া দিয়েছেন, সেদিনই জানেন পিতৃপুরুষের ধর্ম বিপন্ন হবে। মুরগি যে পথ প্রদর্শন করেছে সেই পথে যে অনতিবিলম্বে মদ এবং মদের অনুল্লেখযোগ্য সব আনুষঙ্গিক প্রবেশ করবে এ কথা কে না জানে? এরপর আর সেই ব্রাহ্মণভবনে থাকা সম্ভব হল না। আমরা সাউথ এন্ড পার্কে শ্রীযুক্ত নলিনীরঞ্জন সরকারের পৃষ্ঠপোষিত এক বিমা কোম্পানির সম্পত্তি, একতলা একটি বাড়িতে এসে উঠলাম।

আমরা যখন হিন্দুস্থান রোডের ফ্ল্যাটে বাসিন্দা, তখনই আমার জীবনে ইস্কুল পর্ব শুরু হয়। বরিশালে পাঁচ বছর বয়সে হলুদ রঙে ছোপানো ধুতি পরে সরস্বতী পূজার দিন আমার হাতেখড়ি হয়েছিল। বাড়ির পুরুতঠাকুর কালো পাথরের থালায় এক টুকরো খড়ি দিয়ে অ, আ, ক, খ লিখিয়েছিলেন। তারপর কিছুদিন তালপাতায় পেরেক দিয়ে খোদা অক্ষরের উপর খাগের কলম কালিতে চুবিয়ে অক্ষর লেখা মকসো করেছিলাম। বাবার অসুখ বিসুখের ফলে এর পর আর নিয়মিত পড়াশুনা করা হয়নি। ভাসা ভাসা মনে পড়ে—ঠিকাবাসা নিবাসী আশ্রিত যুবক প্রতুল এবং জুড়ানবাবু আমাকে বর্ণপরিচয় আর ইংরাজি ফার্স্টবুক পড়িয়েছিলেন। ইস্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় সম্পূর্ণ নিরক্ষর ছিলাম না। ইংরাজিজ্ঞানও কিছুটা ছিল। “H A M, হ্যাম—Ham মানে শূকরের লবণাক্ত শুষ্ক মাংস” এই কথাটা খুব বিজাতীয় আনন্দের সঙ্গে তারস্বরে ঘোষাতাম। শুদ্ধাচারী ঠাকুমারা শুনলে বেশ বিরক্ত হতেন মনে আছে। সকালবেলা ঠাকুরের নাম না করে শুয়ার কীর্তন কার ভাল লাগে?

ফার্ন রোডে জগদ্বন্ধু স্কুল। তার সেক্রেটারি ছিলেন বরিশালনন্দন খ্যাতনামা ঐতিহাসিক ডক্টর সুরেন্দ্রনাথ সেন। সুরেনবাবুর সুপারিশে জগদ্বন্ধু স্কুলে ভর্তি হলাম। রীতিমতো লিখিত পরীক্ষা দিয়ে ক্লাস ফোরে, ১৯৩৪ সনে। ওই স্কুলটি আমার ভাল লেগেছিল। মাস্টারমশাইরা সবাই বেশ ভালমানুষ ছিলেন। দেখেই বোঝা যেত—এঁরা গরিব, পরনের ফরসা ধুতি-পাঞ্জাবি বোধহয় বাড়িতেই কাঁচা, নিপাট ইস্ত্রি করা না। কথাটা মাথায় আসার কারণ ছিল। ক্লাস ফোরে স্বাস্থ্যরক্ষা বিষয়ে একটা বই পড়তে হত। তাতে ক্ষার দিয়ে কাপড় কী করে কাঁচা যায় সে-সম্পর্কে নিখুঁত নির্দেশ ছিল। পরবর্তী নির্দেশ কী করে ধুতি আর কুর্তা সযত্নে ভাঁজ করে বালিশের নীচে রেখে দিতে হয়। এ প্রসঙ্গে ইস্ত্রি নামক যন্ত্রের কোনও উল্লেখ ছিল না, মাস্টারমশাইদের দেখে মনে হত—ইস্কুল রওনা হওয়ার আগে এঁরা ধুতি পাঞ্জাবি ক্ষার দিয়ে কেচে রোদে শুকোতে দিয়ে এসেছেন। আবার বিকেলে বাড়ি ফিরে ওগুলো সযত্নে ভাঁজ করে বালিশের নীচে রেখে দেবেন, পরদিন স্নানের পর পরে স্কুলে যাবেন। এরা কেউ বকাবকি মারধর করতেন না। সাধ্যমতো যত্ন করে পড়াতেন।

জগদ্বন্ধু স্কুলের এক অপ্রত্যাশিত বৈশিষ্ট্য ছিল ঘুষোঘুষি অর্থাৎ বক্সিং শিক্ষা। তার কারণ আমাদের ড্রিলমাস্টার ছিলেন বিখ্যাত ঘুষিবীর জগা শীল। যার ইচ্ছে ঘুষি শিখতে পারত, অবশ্যি জগা শীল টিপেটুপে দেখে উপযুক্ত বিবেচনা করলে তবেই। অধিকারীভেদ বলে কথা। সন্ধেবেলা স্কুলে গেলেই দেখা যেত কিছু ছেলে চামড়ার দস্তানা পরে হুঁশ হুঁশ আওয়াজ করতে করতে ঘুষি ছুড়ছে। আমরাও বাড়ি ফিরে হুঁশ হুঁশ ধ্বনি তুলে ঘুষোঘুষি করতাম। তখন মুষ্ট্যাঘাতে সবাইকে ধরাশায়ী করা জীবনের মহত্তম আদর্শ বলে মনে হত।

শুধু ঘুষিখেলা শেখানো না, ছেলেদের স্বাস্থ্যর যাতে সর্বাঙ্গীণ উন্নতি হয় সেদিকেও শীলবাবুর লক্ষ্য ছিল। উনি স্বাস্থ্যরক্ষা সম্বন্ধে একটি প্রামাণ্য বই লিখেছিলেন। তার নাম ‘শরীর সামলাও’। এই বই কিনতে সবাইকে উৎসাহ দেওয়া হত। উপযুক্ত পাত্রদের মাস্টারমশাই বইটা বিনামূল্যে উপহার দিতেন। উক্ত গ্রন্থে শরীর রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় কোনও প্রক্রিয়াই উপেক্ষিত হয়নি। একটি পরিচ্ছেদের নাম ছিল ‘এক নিশ্বাসে মলত্যাগ’। এই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করলে ত্যক্ত বস্তুটির রূপ ও প্রকৃতি কী হবে তারও বিশদ বর্ণনা ছিল। সে বর্ণনা পড়লে মনে হত জগা শীল কোনও উচ্চাঙ্গের শিল্পের ইতিহাস লিখেছেন।

ইস্কুলের দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য চরিত্র ছিলেন হেডমাস্টারমশাই–নীহার সেন৷ ওঁকে আমরা বেজায় ভয় পেতাম। বোধহয় হেডমাস্টার বলেই। অবশ্যি ওঁর জমকালো এক জোড়া গোঁফ ছিল। তবে গোঁফ থাকলেই মানুষ বাঘ-ভাল্লুক হয়ে যায়, কোনও শাস্ত্রে এমন লেখা নেই।

.

সেই যে কবে উপনিষদে লিখে রেখেছে, ‘চরৈবেতি, চরৈবেতি’, (থুড়ি, মুনিঋষিরা মন্ত্রদ্রষ্টা হলেও সাক্ষর ছিলেন না) আমাদের লেখাপড়া শেখার ব্যাপারে বাবা সেই আদর্শ অবলম্বন করলেন। জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনে বেশ ছিলাম। লেখাপড়া কিছু খারাপ হচ্ছিল না। হঠাৎ বাবা স্থির করলেন, আমাদের বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলে ভর্তি করবেন। সেটা নাকি আরও ভাল স্কুল। যথাসময়ে পরীক্ষা দিয়ে বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলে ভর্তি হলাম। এ স্কুলের ধরনধারণ আলাদা। প্রথমেই বুঝলাম—এখানকার মাস্টারমশাইরা ক্ষার দিয়ে কেচে ভাঁজ করে ধুতিকোর্তা বালিশের নীচে রেখে দেন না, কেউ কেউ রীতিমতো স্যুটবুট পরেন। আর ছাত্ররা? তাদের কেউ কেউ পয়লা নম্বরের কাপ্তান। টিফিনের সময় খেলার মাঠে দেওয়ালের কাছে গিয়ে সিগ্রেট ফোঁকে। উপরের ক্লাসের ছেলেরা অনেকে দিব্যি ফরফর করে ইংরিজি বলছে। শুনলাম কেউ কেউ বাড়িতে মা বাপের সঙ্গেও ওই বিজাতীয় ভাষায়ই কথা বলে। বড় বড় গাড়ি চেপে তারা ইস্কুলে আসে যায়। কলকাতার বড় মানুষ নামক প্রাণীর সঙ্গে এর আগে সাক্ষাৎ হয়নি। এবার হল। ফিরে তাকিয়ে মনে হয় কিছু কিছু চালিয়াত ছেলে চালিয়াতির আবরণে তাদের অন্তঃসারশূন্যতাই ঢাকতে চেষ্টা করত। সেই অন্তঃসারশূন্যতা ব্যক্তিগত না, শ্রেণিগত। এই লুপ্তপ্রায় প্রজাতির কিছু কিছু এখনও বেঁচে আছে—যাদের ছেলেপেলেরা মা বাপকে মাম্মি, পাপা ডাকে, বাড়িতে চি-চি ইংরাজি বলে। লক্ষ্মীর কৃপা হয়তো লাভ হয়েছে, কিন্তু মা সরস্বতীকে অনেক আগেই ব্যর্থ নমস্কারে বিদায় দিয়েছে। ফিরিঙ্গি-পনাই এদের গৌরবের পতাকা।

একদিনের ছোট একটা ঘটনা মনে পড়ে। দুপুরে টিফিনের সময় চালিয়াত এক বালক পাশে এসে বসল। হঠাৎ সে নাক কুঁচকে জিগ্যেস করল, “তোরা পরিজ খাস?” এ প্রশ্নের অর্থবোধ হল না। পূর্বজন্মকৃত পাপের ফলে সকালবেলা পরিজ আমাদের খেতে হত। ওর চেয়ে স্বাদহীন জিনিস কিছু খেয়েছি বলে আমার মনে পড়ে না। তাই অবাক হয়ে বলোম, “হ্যাঁ। কিন্তু এ প্রশ্ন কেন করছ?” উত্তর, “যাঃ যাঃ, বাজে বকছিস। তুই তো বাঙাল, বাঙালরা কখনও পরিজ খায়? পরিজ খাই আমরা। তোরা খাস মুড়ি, নয়তো পান্তাভাত।” ওই দুই বস্তুই আমার অত্যন্ত প্রিয় খাদ্য। সে কথা বলায় মন্তব্য হল, “তা-ই বল। তবে পরিজ খাস বলছিলি কেন?” মুড়ি খেলে পরিজ খাওয়া চলে না, এ তথ্য আগে জানা ছিল না। একটা কথা ধোঁয়া-ধোঁয়া ভাবে বুঝতে পারলাম। চালিয়াত চন্দরের বক্তব্য : সাহেবরা পরিজ খায়। সাহেবরা কংসরাজার বংশধর। আমরাও সাহেবদের মতো পরিজ খাই। তাই আমরাও অন্ততপক্ষে কংসরাজার খানসামার বংশধর। সেটা কি কম কথা! আর আমাদের সঙ্গে তোদের মতো ভেতো বাঙালির তুলনা হয়?

সাম্প্রতিক কালে দেশে একবার এই প্রজাতির কয়েকটি প্রাণীর সঙ্গে এক টেবিলে বসে খাওয়ার দুর্ভাগ্য হয়েছিল। তার একটি হঠাৎ বেশ উচ্চৈঃস্বরে মন্তব্য করল, “Champagne is a much exaggerated drink.” সুরুচির পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে কথাটা বলল ঠিক যখন গৃহস্বামী বহু ব্যয়ে কেনা শ্যাম্পেন পরিবেশন করছেন। শুনলাম লোকটা বড় ঘরের ছেলে, নিজের ব্যবসায়ও সুপ্রতিষ্ঠিত। ভব্যতাজ্ঞানশূন্য জীবটির বক্তব্য খুব সরল : “চারবেলা শ্যাম্পেন খেয়ে খেয়ে থকে গেছি। ও আর আমাদের মুখে রোচে না। তোমরা যারা এ সব জিনিস ন’ মাসে ছ’ মাসে চোখে দেখ, তারা এ নিয়ে হইচই করতে পার।” মর্কটপ্রবরের কান মলে দেওয়ার প্রবল বাসনা অনেক কষ্টে সামলেছিলাম। না হলে বিপদ হত। কারণ জীবটি বেশ সফল আইনজীবী! ওই পরিজ খাওয়ায় গৌরববোধের অথবা শ্যাম্পেনের নিকৃষ্টতা ঘোষণার পেছনে একটা বেদনাদায়ক ঐতিহাসিক সত্য লুকিয়ে আছে বলে আমার ধারণা। বিদেশি শাসনের সময় সাহেবের লাথি খাওয়ার অভিজ্ঞতা অনেক ভারতীয়রই হয়েছে। কিন্তু এক শ্রেণির বাঙালি যেভাবে প্রভুর সবুট চরণ মোক্ষজ্ঞানে বক্ষে ধারণ করেছিল তার তুলনা বোধ হয় উপমহাদেশের অন্যত্র কোথাও নেই। একেবারে ‘তোমার চরণে আমার পরাণে বেঁধেছি প্রেমের ফাঁসি’। নির্বোধ অনুকরণের মর্কটবৃত্তি কার কতটা রপ্ত হয়েছে, তার পরিমাপ করে এরা নিজেদের মাহাত্ম্য বিচার ও ঘোষণা করে। বিশ্বায়নের টেসু-মার্কা জীবনাদর্শ সেই মহান ঐতিহ্য যেন আবার পুনরুজ্জীবিত করছে মনে হয়। তবে দাস্যবৃত্তি এবার শুধু বাঙালি শ্রেণিবিশেষে না, সব ভারতীয়দেরই গ্রাস করতে চলেছে বলে আশঙ্কা করি।

বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলের সব ছাত্রই টেসুমার্কা চালিয়াত ছিল—এটা আমার বক্তব্য না। তবে ওই বিশেষ প্রজাতির প্রাণীর সঙ্গে ওখানেই প্রথম সাক্ষাৎ হয়। এবং সেই সাক্ষাতে যে বিবমিষা বোধ করি তা কোনও দিনই কাটিয়ে উঠতে পারিনি। শুধু ভেবে অবাক হই—দেশ স্বাধীন হওয়ার ষাট বছর পরেও আমাদের সমাজে এই জাতীয় জীব এখনও দিব্যি বেঁচেবর্তে আছে।

বালিগঞ্জ স্কুলের কয়েকটি চরিত্র এখনও বেশ মনে আছে। একটি অত্যন্ত সুপুরুষ তরুণ ভারী সুন্দর ইংরাজি কবিতা আবৃত্তি করতেন। শুনতাম তিনি লর্ড সিনহার নাতি। আর পাশেই ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজ। সেখানকার অধ্যক্ষ মিস্টার লাহিড়ি বেজায় সাহেবি কেতার মানুষ ছিলেন। উনি আমাদের স্কুলে প্রায়ই আসতেন, কারণ ওঁদের ছাত্ররা অর্জিত বিদ্যা প্রথম পরীক্ষা করতেন আমাদের উপর। তরুণ শিক্ষকরা প্রাণমন দিয়ে পড়াতেন। বড় ভাল লাগত। স্থায়ী শিক্ষকদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলেন কবি গোলাম মোস্তাফা। মানুষটি অত্যন্ত লাজুক প্রকৃতির ছিলেন। স্কুলে কোনও উৎসব হলেই উনি গান করতেন, কিন্তু একটি স্ক্রিনের আড়ালে বসে। অনাদিকাল থেকেই বোধ হয় স্কুলের ছাত্রদের এক উৎকট আনন্দ শিক্ষকদের অর্থহীন অদ্ভুত নামে অভিহিত করা। ‘কোনও তার অর্থ নেই সেই তার খোঁচা।‘ এরকম খোঁচার অন্যতর শিকার ছিলেন আমাদের বাংলা স্যার—ভ্যান পণ্ডিত। কেন এবং কীভাবে উনি এই নাম অর্জন করলেন তা কারও জানা ছিল না। কিন্তু উনি ক্লাসে ঢোকার ঠিক আগেই “ভ্যান! ভ্যান” বলে একটা প্রচণ্ড রব উঠত। সাপের মাথায় ধুলো পড়ার মতো উনি ক্লাসে ঢোকামাত্র সেই মহারব নিশ্ৰুপ হয়ে যেত।

সব মিলিয়ে বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুল আমার ভাল লাগেনি। কেমন যেন দম আটকে আসত। বোধ হয় ওখানকার সামাজিক পরিবেশ আমার ঠিক সহ্য হয়নি। যে কারণেই হোক, মানুষে-মানুষে যে সহজ সম্পর্ক বাঙালি সমাজের বিশিষ্ট সম্পদ, তার স্বাদ আমি ওখানে পাইনি। শিক্ষক এবং সহপাঠী সবাইকেই কেমন দূরের মানুষ মনে হত। হয়তো সেটা আমার বাঙালপনারই ফল।

কিন্তু ওইখানেই দুটি বন্ধুত্বর সূচনা হয়, যা আমার বাকি জীবনের সম্পদ হয়ে থাকে। মহাত্মা অশ্বিনীকুমারের ছোট ভাই কামিনী দত্তর নাতি অশোক ওরফে টুকু আমার অতি শৈশবের সঙ্গী। বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলে তার সঙ্গে আবার সাক্ষাৎ। তার অনেক বছর পরে আবার দেখা হয় প্রেসিডেন্সি কলেজে। কয়েক বছর হল টুকু চলে গেছে। ও যতদিন বেঁচে ছিল ততদিন আমাদের যোগাযোগ অক্ষুণ্ণ থাকে। দ্বিতীয় যে ব্যক্তির কথা বলছি—তিনি বাংলাদেশের নাগরিক। বর্তমানে ছোটখাটো শিল্পপতি দেলওয়ার হোসেন। প্রথম পরিচয় বালিগঞ্জ স্কুলে। তারপর কিছুদিন পরে বরিশাল জিলা স্কুলে আবার সাক্ষাৎ। তৃতীয় সাক্ষাৎ সেই প্রেসিডেন্সি কলেজে। সেই থেকে নানা ওঠা-পড়ার ভিতর দিয়ে আমরা গিয়েছি, কিন্তু যোগাযোগ কখনও ছিন্ন হয়নি।

আমরা স্কুলে যেতাম মাস হিসাবে ভাড়া করা রিকশা চেপে। সাউথ এন্ড পার্ক থেকে অনেকটা পথ, তার অনেকটাই ঘরবাড়িহীন মাঠ। ঢাকুরিয়ার ছোট লেক তখনও খোঁড়া চলছে। মাঝে মাঝে ম্যান্ডেভিলা গার্ডেন্সের ভিতর দিয়ে রিকশা যেত। একতলা বাংলোর অনেকগুলিই তখন বিদেশি অধ্যুষিত। ওই পথে যেতে এক অপরিচয়ের উত্তেজনা বোধ করতাম।

একদিন স্কুলে ক্লাস করছি। শরীরটা বেশ খারাপ লাগতে শুরু করল। যিনি পড়াচ্ছিলেন তিনি হঠাৎ কাছে এসে প্রশ্ন করলেন, “কী হয়েছে তোমার?” তারপর কপালে হাত দিয়ে বললেন, “তোমার তো খুব জ্বর হয়েছে। বাড়ি চলে যাও।” একটা রিকশা ডেকে আমাকে তুলে দেওয়া হল। বাড়ি ফিরে শয্যা নিলাম। ডাক্তার এলেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত হল—প্যারাটাইফয়েড। আমার বালিগঞ্জ স্কুলে পড়ার ওইখানেই ইতি।

ইতি ঘটার কারণ অবশ্যি আমার অসুখ না। অনেকদিন পর পারিবারিক বন্ধু চরামুদ্দির জমিদার খান ইসমাইল চৌধুরী আমাদের সাউথ এন্ড পার্কের বাড়িতে হঠাৎ এসে উপস্থিত। এটা-ওটা কথাবার্তার পর উনি বাবাকে সোজাসুজি বললেন—আমাদের জমিদারির অবস্থা খুব সঙ্গিন। বারোভূতে এমন লুটে খেয়েছে এবং খাচ্ছে যে, অনতিবিলম্বে লুটে খাওয়ার মতো আর কিছু বাকি থাকবে না। দু-একটা মহাল এর মধ্যেই নিলামে উঠেছে। বাকি সবও যাওয়ার মুখে। সম্পত্তি বাঁচাতে হলে অনতিবিলম্বে বাবার দেশে ফেরা দরকার। এরপর আর দেরি করা চলে না, ‘Doll and Dummy’ কোম্পানির সরঞ্জামপত্র শীতল জ্যাঠাকে দিয়ে বাবা আমাদের নিয়ে বরিশাল ফিরলেন। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।

কলকাতা প্রবাসের কাহিনি একটি মানুষের কথা না লিখে শেষ করলে অসমাপ্ত থাকবে। তিনি আমার প্রথম গৃহশিক্ষক পিতৃবন্ধু অনন্তকুমার সেন, বর্তমানে খ্যাতনামা নট রুদ্রপ্রসাদ সেনের বাবা।

এই প্রসঙ্গে একটা তাত্ত্বিক মন্তব্য করতে চাই। উনিশ শতকে বাঙালি তথা ভারতীয় জীবনে নবজন্ম বা রেনেসাঁস ঘটেছিল কি না, এ নিয়ে অনেক তর্ক আছে। এ সম্পর্কে আমার যা বক্তব্য তা অন্যত্র লিখেছি। শুধু এক বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ। জাতীয়তাবাদ নিন্দনীয় কি প্রশংসনীয়, এ প্রশ্নের এক কথায় কোনও উত্তর নেই। কিন্তু ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ফল হিসাবে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত জীবনের সর্বক্ষেত্রে এবং সর্বস্তরে কিছু মানুষ জন্মেছিল, মনুষ্যত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে যাদের তুলনীয় ব্যক্তিত্ব পৃথিবীর ইতিহাসে বেশি পাওয়া যাবে না বলেই আমার বিশ্বাস। জাগতিক স্বীকৃতির চূড়ায় যেমন গাঁধী-রবীন্দ্রনাথের মতো অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব, তেমনই অগণিত নামহীন মানুষ আদর্শনিষ্ঠ স্বার্থবোধহীন জীবনচর্যার ভিতর দিয়ে এক নতুন এবং অত্যুজ্জ্বল জীবনাদর্শের সন্ধান দিয়েছিলেন। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য এই রকম বেশ কিছু মানুষের সংস্পর্শে আমি এসেছিলাম। স্বাধীনতা লাভের পর এঁরা যেন দৃশ্যপট থেকে সরে গেলেন। এঁদের সঙ্গে তুলনা করা যায় এরকম মানুষ হয়তো আজও আছেন। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে পরিচয় আমার হয়নি।

সম্পূর্ণ শুদ্ধচরিত্র মানুষ কাকে বলে, তেমন মানুষ আছে কি না বা সম্ভব কি না আমি জানি না। কিন্তু সেই ইউক্লিড-কল্পিত সরলরেখার কাছাকাছি যদি কেউ বা কারা পৌঁছে থাকেন, তাঁদের একজন প্রয়াত অনন্তকুমার সেন। অনন্তবাবু যৌবনে বিপ্লবী দলে যোগ দেন। পরিণত বয়সে আমি যখন তাঁকে দেখি, তখন তিনি গাঁধীবাদী, পরিধানে স্বহস্তে কাটা সুতোয় তৈরি খদ্দরের ধুতি-পাঞ্জাবি। অনেকদিন বরিশাল জেলায় নিজের গ্রামে অন্তরীণ থাকার পর ছাড়া পেয়ে উনি সপরিবারে কলকাতা আসেন। সেখানে উনি এক স্কুলের হেডমাস্টার হন। দুর্নীতি ওঁর সহ্য হত না, এবং দুর্নীতিমুক্ত প্রতিষ্ঠান আমাদের দেশে বরাবরই দুর্লভ। ফলে কোনও স্কুলেই উনি বেশি দিন টিকতে পারতেন না। কিন্তু শিক্ষক এবং প্রধানশিক্ষক হিসাবে খ্যাতি হওয়ায় ওঁর চাকরির অভাব হয়নি। ওঁর বন্ধুদের কাছে ওঁর এক স্কুলে শেষ দিনটার একটি উল্লেখযোগ্য বর্ণনা শুনেছি। প্রধানশিক্ষক অনন্তবাবু তাঁর অফিসে উপবিষ্ট। রাগে দুই চোখ রক্তবর্ণ। সামনের চেয়ারে অতিশয় বজ্জাত মালিক তথা সেক্রেটারিবাবু। অনন্তবাবুর আদেশমতো দশম শ্রেণির দুই ছাত্র সেক্রেটারির দুই কান মলে দিচ্ছে—বেশ সম্যক ভাবেই মলছে। কর্ণমর্দনপর্ব শেষ হলে অনন্তবাবু ওই সেক্রেটারিরই হাতে পদত্যাগপত্রটি দিয়ে বিদ্যালয়ভবন ত্যাগ করলেন।

সাত-আট বছর বয়সে মানুষের চরিত্রমাহাত্ম বোঝার ক্ষমতা থাকে না। কিন্তু মাস্টারমশাই যে অন্য পাঁচজন মানুষের থেকে স্বতন্ত্র, সেটা বুঝতে পারতাম। ওঁর চারিত্রিক শুচিতা ওঁকে কঠিন বা কঠোর করে তোলেনি। সদাহাস্য মানুষটি যে অফুরন্ত স্নেহের আধার সে কথা বুঝতে কষ্ট হত না। পাঠ্য এবং পাঠ্যের বাইরে বই পড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আর একটি কর্তব্য উনি নিজের দায়িত্ব বলে ধরে নিয়েছিলেন। নিজের হাতে সেলাই করা নীল মলাটে মোড়া ছোট একটি খাতা উনি প্রত্যেক ছাত্রকে উপহার দিতেন। মলাটের উপর ওঁর সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা থাকত—’আত্মপরীক্ষার খাতা’। প্রতি সপ্তাহের জন্য খাতার এক একটি পৃষ্ঠা নির্দিষ্ট থাকত-আর প্রতি দিনের জন্য এক একটি লাইন। বাঁদিকে এক দুই করে বালকের পক্ষে যে সব দুর্মতিমূলক কাজ বা মনোভাব সম্ভব তার একটা তালিকা থাকত। যথা–ক্রোধ, অবাধ্যতা, আলস্য, পাঠে অমনোযোগ, দেরি করে শয্যাত্যাগ, কলহ ইত্যাদি। সন্ধ্যাবেলা এসেই খাতাটি খুলে উনি আমাদের দিনগত দুষ্কর্মের হিসাব নিতেন। যে খাতে অন্যায় করেছি, সে খাতে একটি ঢেরা পড়ত। বলতে হত কী করেছি। ভবিষ্যতে তার পুনরাবৃত্তি না হয়, এবং তা কীভাবে সম্ভব উনি বুঝিয়ে দিতেন। আর কোনও দিন যদি কোনও খাতেই ঢেরা না পড়ত, তা হলে উনি সত্যিই দাঁড়িয়ে উঠে হাততালি দিয়ে নাচতেন। এর চেয়ে বড় পুরস্কার আমরা কিছু কল্পনা করতে পারতাম না। নীরদ চৌধুরী মশায়ের কাছে শুনেছি ওঁরাও ছোটবেলা এবং কৈশোরে এইরকম একটি খাতায় আত্মসমীক্ষা করতেন। তবে আমাদের তুলনায় ওঁদের আত্মপরীক্ষার খাতায় দুর্নীতির ফর্দটা কিছু লম্বা ছিল। ফর্দে একটি অবাঞ্ছনীয় মনোভঙ্গির অভিধা ছিল—’রূপমোহ’। পরপর সাতদিন ওঁর দাদার খাতায় ‘রূপমোহ’র খাতে ঢেরা দেখে ওঁদের পিতাঠাকুর উত্তমরূপে পুত্রের কর্ণমর্দন করেন। এ জাতীয় দুর্ভোগ আমাদের ভুগতে হয়নি। তবে এও বলি–ভদ্রলোকের দশ বছর বয়সে একাদিক্রমে সাতদিন রূপমোহ ঘটাটা ঠিক উচিত হয়নি, সে ফ্রয়েড এবং এলিস সাহেব যা-ই বলুন।

সব নিয়মের ব্যতিক্রম করে কোনও খবর না দিয়েই পরপর ক’দিন অনন্তবাবু আমাদের পড়াতে এলেন না। উনি থাকতেন উত্তর কলকাতায়। ওঁর বা ওঁর কাছাকাছি কোনও বাড়িতে টেলিফোন ছিল না, খবর নেওয়ার একমাত্র উপায় ওঁর বাড়ি যাওয়া। চতুর্থ দিন সন্ধ্যার দিকে আমরা উত্তর কলকাতা রওনা হলাম। এই আমার প্রথম উত্তর কলকাতা অভিযান। ওখানকার গলির ভিতর ঢুকে মনে হল এক অপরিচিত জগতে এসে পৌঁছেছি। এত সরু গলি, এত অন্ধকার রাস্তা, এত পুঞ্জীভূত আবর্জনা এর আগে কখনও দেখিনি। সত্যিই মনে হচ্ছিল দম আটকে আসছে। কিছুক্ষণ খুঁজে ওঁর বাড়ির হদিশ পেলাম। দরজা খোলাই ছিল। ভিতরে ঢুকে ডাকাডাকি করতে দোতলা থেকে এক ভদ্রলোক নেমে এলেন। বোধ হয় মাস্টারমশাইয়ের ভাই। বাবা জিগ্যেস করলেন—”উনি আছেন কেমন?” আত্মীয় ভদ্রলোক একটু চুপ করে থেকে উত্তর দিলেন, “শেষ হইয়া গ্যাছে–কাইল।” বাবা অনুবাদ করলেন, “তোমাদের মাস্টারমশাই আর নেই।” নিতান্ত প্রিয়জনের মৃত্যুর অভিজ্ঞতা এই প্রথম। কথাটা বুঝে কান্না আসতে বোধ হয় কয়েক মিনিট সময় লেগেছিল। সমস্ত চেতনা জুড়ে একটা তীব্র অভাববোধ শরীরমন আচ্ছন্ন করে ফেলল। সেই শোকের স্মৃতি এখনও রয়ে গেছে। কিন্তু তাকে ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার নেই। শুধু একটা কথাই ভাঙা রেকর্ডের মতো মনের মধ্যে বারবার ঘুরছিল, “ওঁকে আর কখনও দেখতে পাব না।” ওঁর মৃত্যুর সঙ্গে আমার বাল্যজীবনের উজ্জ্বল এক অধ্যায় শেষ হয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *