প্রথম রাত্রে মায়াবতীর লজ্জা হচ্ছিলো।
বিবাহের পর মাসাধিককাল তার স্বামীগৃহে অতিবাহিত করেছে। স্বামীসঙ্গে প্রথম কদিন তার ভয় হতো–বিশেষত দেহ মিলনের ব্যাপারটা তাকে রীতিমতো পীড়িত করতো। পুরুষ মানুষ যে ঐ একটি বিষয় বই অন্য কিছু চায় না, এটা বুঝতে পেরে সে তখন মনে মনে কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু অল্প কদিন পরই সে অনুভব করে যে স্বামী তার কাছে আরও কিছু চায়। কিন্তু সেটা যে কি বস্তু তা সে বুঝে উঠতে পারে না, ঐ সময় সে কখনই পারেনি। তারপর বসন্তদাস হঠাৎ বাণিজ্য যাত্রা করে। শুরু হয় তার বিরহযাপন। স্বামীসঙ্গহীনা না হলে স্বামী যে কি বস্তু তা কোনো নারীর পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। সে নিজেও প্রথমদিকে বোঝেনি। বুঝলো গত সাত/আট মাসে। সাত/আট মাস পর আবার তার স্বামীসঙ্গ।
তবু প্রথমদিন তার লজ্জা কাটছিলো না। শুধু লজ্জা নয়, সেই সঙ্গে সে আবার প্রবল আকর্ষণও অনুভব করছিলো। তদুপরি ছিলো একটি দুর্বহ কষ্ট, প্রণয়ভারের কষ্ট।
সুতরাং ঐ প্রকার নানাভাবে মিশ্রিত বিচিত্র একটি মানসিক অবস্থা নিয়ে সে শয্যাপার্শ্বে দাঁড়িয়ে ছিলো।
প্রকোষ্ঠে ধূপ জ্বলছিলো–দীপাধারে প্রদীপ শিখাঁটি ছিলো উজ্জ্বল–শয্যা কোমল এবং দুগ্ধফেননিভ। উপাধান স্কীদের–তাতে আবার সুচারু সূচিকর্ম–একটি লতিকা, দুটি পত্র, একটি কলিকা–এইরূপ চিত্রণ। ওদিকে বক্ষের কঙুলি স্বেদসিক্ত হয়ে যাচ্ছিলো। একেকবার মনে হচ্ছিলো, গবাক্ষ উন্মুক্ত করে।
কিন্তু রাত্রি তখনও গম্ভীর হয়নি একথা স্মরণ হওয়ায় তাকে বিরত থাকতে হয়েছে। সে জানে, কৌতূহলী রমণীরা বাইরে অপেক্ষা করে আছে। গবাক্ষ অর্গলমুক্ত করলেই তারা একত্রে হেসে উঠবে।
ঐভাবে স্বেদাপ্লুত হতে থাকলে কুঙ্কুমবিন্দু এবং চন্দনতিলকের কি দশা দাঁড়াবে ভেবে তার কান্না পাচ্ছিলো। কেন যে দহ্মাননা লীলাবতী তাকে এমন করে সাজিয়ে দিলো? তাম্বুল রাগে ওষ্ঠ রঞ্জিত করবার জন্য তাকে দুতিনবার তাম্বুল চর্বণ করতে হয়েছে। শেষ তাম্বুলটিতে আবার মৃগনাভিচূর্ণ প্রযুক্ত ছিলো। সে বুঝছিলো, অতিমাত্রায় স্বেদাক্ত হওয়ার কারণ ঐটিই। বারেক সে মনে মনে প্রগল্ভা হচ্ছিলো, বারেক আবার লজ্জায় মরমে মরে যাচ্ছিলো।
তার মনে হচ্ছিলো, প্রকোষ্ঠের বাইরে যায়। কেননা এমন রীতির কথা তো সে কখনও শোনেনি। পিতৃগৃহে কন্যা শয়নগৃহে অপেক্ষা করবে স্বামীর জন্য, এমন কি হয়? লোকটা মায়াবতাঁকে জানিয়ে গেলো, আমি এখনই আসছি–কিন্তু তার সেই এখন কি এতোক্ষণেও হয়নি?
বসন্তদাস শয়নগৃহে বেশ বিলম্বে আসে। কক্ষে প্রবেশ করেই স্ত্রীকে ঐভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সেও তার পশ্চাতে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে কৌতুকে ঈষৎ হাসে। তারপর মায়াবতীর স্কন্ধদেশ স্পর্শ করে ডাকে, হলুদ পক্ষিটি আমার!
মায়াবতী অপ্রস্তুত, এ কী সম্ভাষণ–ছি! পূর্বদেশ অঞ্চল থেকে কি এই আচরণ শিক্ষা করে এসেছে? ক্ষণকাল পরে কানের কাছে উষ্ণ শ্বাস পড়ে এবং শোনে, হলা পিয় সহি!
মায়াবতী ওষ্ঠ দংশন করে, না, এই নির্বোধের সম্ভাষণে সে সাড়া দেবে না।
কিন্তু নির্বোধ নিরস্ত হয় না। সে সম্মুখে এসে দাঁড়ায় এবং অবগুণ্ঠন উন্মোচন করতে চায়। তখন তার অক্ষিপক্ষ্ম আপনা থেকেই নির্মীলিত হয়ে এসেছে–আর ঐ মুহূর্তটিতে বসন্তদাস গভীর স্বরে ডাকে, মায়া, আমার মায়াময়ী!
ঐ ডাকে মায়াবতীর অন্তরাত্মা আমূল কম্পিত হয়। শরীরের ভার যেন পদযুগল আর ধারণ করতে পারে না। তার চক্ষুরুন্মীলন হয়, কিন্তু দৃষ্টি বিনতই থেকে যায়।
আমার মুখপানে চাও মায়াবতী!
প্রণয়ীর প্রার্থনা যেন। অনুশীলনসিদ্ধ একেবারে কুশলী প্রণয়ী! না জানি কতত রমণীর মানভঞ্জনে এই একই বাক্য প্রয়োগ করে এসেছে। মায়াবতী মনের ভেতরে কোথায় যেন ক্ষীণ একটি কণ্টক দংশন অনুভব করে। স্বেদ তখন আর বিন্দুতে থেমে নেই, একেবারে স্রোতধারা হয়ে নেমে আসছে। সে পুনরায় মুখ নত করে।
এই যদি তোমার আচরণ হবে, তাহলে কি কারণে এই কবরী–বন্ধন, বলো? কেন এই কুরুবক আর শিরিষ, কেন এই পট্টবস্ত্র? কি প্রয়োজনে কণ্ঠে এই স্বর্ণমালা, সুদৃশ্য এই কথুলিই বা কেন? কুঙ্কুম চন্দন এবং অলক্তক কোন কাজে লাগবে, বলো?
অতিশয় নীচ! মায়াবতী তখন মনে মনে বলছে, অতিশয় নীচ এই ব্যক্তি যে প্রণয় সম্ভাষণকালেও কলহ করতে চায়।
স্ত্রীকে নিরুত্তর দেখে বসন্তদাস তাকে বাহুপাশে আবদ্ধ করে। বলে, জানো আমি কি করবো এই কবরীবন্ধনের?
ছি ছি–এ কি নারী পীড়ক! একেবারে অকৃত্রিম দস্যু হয়ে এসেছে পূর্বদেশে বাণিজ্য করে সে বারেক ভাবে, বাহুপাশ ছিন্ন করে ছুটে পলায়ন করে।
জানো, এই কুঙ্কুম চন্দনের কি হবে?
মা গো! এ বড়ই দুঃশীল–এই নাগরস্বভাব কিভাবে হলো এর–এ তো এমন ছিলো। তবে কি অন্য কোনো ব্যক্তির বাহুপাশে আবদ্ধা সে? মায়াবতী এবার প্রাণপণে দেহ সঞ্চালিত করে, যদি পাশমুক্ত হওয়া যায়।
আর এই সুদৃশ্য কণ্ডুলিটির কি দশা হবে, ভেবেছো একবার?
মরণ দশা! ছি ছি, এমন ওষ্ঠকর্তিতও হয় মানুষ! সে কুঞ্চিত করে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিপাত করে স্বামীর দিকে।
বসন্তদাসের কিন্তু বিকার নেই। সে তখনও হাসছে। বললো, কুপিতা রমণী কিন্তু অধিকতর রমণীয়া–সে কথা জানো তো? কথাটি বলে সে তাম্বুল পাত্র থেকে দুটি গ্রন্থিবদ্ধ তাম্বুল একত্রে হাতে নিয়ে বললো, শ্বশুরালয়ে আসব পানের ব্যবস্থা থাকে না কেন বলতে পারো? অতো মধুক বৃক্ষ দিয়ে তোমরা কি করো?
এবার আর সহ্য হলো না। মায়াবতী ঈষদুচ্চকণ্ঠে শ্লেষ ঢেলে উত্তর করলো, আসব পানের যদি এতোই আগ্রহ, তাহলে নটিগৃহে গেলেই হতো, এখানে আগমনের তো প্রয়োজন ছিলো না।
বসন্তদাস তখনও হাসে। ততক্ষণে সে তাম্বুল চর্বণ করেছে এবং চর্বণজনিত কারণে স্বেদাক্ত হতে আরম্ভ করেছে। ঐ অবস্থাতেই সে বলে, হ্যাঁ, সে স্থানে গেলেও হতো, কিন্তু সেখানে কি মায়াবতী পাওয়া যায়, এমন মায়াবতী কি আর কোথাও আছে, বলো?
অতঃপর বসন্তদাস যা আরম্ভ করলো সে বর্ণনা বাৎসায়ন বিস্তৃত এবং অনুপুঙ্খ দিয়েছেন। তার পুনর্বৰ্ণনা সকলের পক্ষে সম্ভব নয়।