০৭. প্রতি-সংস্কৃতি (১৯২৫-৬০)

৭. প্রতি-সংস্কৃতি (১৯২৫-৬০)

নিৎশে ঈশ্বরের প্রয়াণের ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই আধুনিক মানুষ নানাভাবে তাদের সংস্কৃতির মূলে একটি শূন্যতার ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠতে শুরু করেছিল। ফরাসি অস্তিত্ববাদী দার্শনিক জাঁ-পল সার্ত্র (১৯০৫-৮০) একে বলেছেন মানুষের চেতনায় ঈশ্বর আকৃতির গহবর, যেখানে স্বর্গীয় সত্তা সব সময় ছিলেন কিন্তু এখন এক শূন্যতা পেছনে ফেলে অদৃশ্য হয়ে গেছেন। বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের বিস্ময়কর সাফল্য প্রাচীন পৌরাণিক সচেতনতাকে দমন করার সাথে তাল মিলিয়ে অগ্রসর হওয়ায় খোদ ঈশ্বরের ধারণাকেই বহু পাশ্চাত্যকৃত মানুষের পক্ষে অবিশ্বাস্য ও অসম্ভব করে তুলেছিল। পবিত্রতার অনুভূতি জাগানোর মতো কাল্ট ছাড়া ঈশ্বরের প্রতীক ক্ষীয়মান ও অর্থহীন হয়ে পড়ে। কিন্তু অধিকাংশ আধুনিক মানুষ কোনওরকম অনুতাপ করেনি। অনেক দিক থেকেই পৃথিবী আগের চেয়ে ঢের ভালো জায়গায় পরিণত হয়েছিল। তাদের জীবনকে একটা মূল্য দেবে ও তাদের এতদিন পর্যন্ত কনফেশনাল ধর্মগুলোর মাধ্যমে প্রকাশিত সত্তার গভীর প্রবাহের কাছে পৌঁছে দিতে সাহিত্য, শিল্পকলা, যৌনতা, মনোবিশ্লেষণ, মাদক এমনকি ক্রীড়ায় দুয়ের অনুভূতির সন্ধান করে সেক্যুলারিস্ট আধ্যাত্মিকতা গড়ে তুলছিল তারা। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পাশ্চাত্য জনগণ ধরে নিয়েছিল যে, ধর্ম আর কখনওই বৈশ্বিক কর্মকাণ্ডে প্রধান ভূমিকা পালন করতে পারবে না। একে দৃঢ়তার সাথে ব্যক্তিগত বলয়ে ঠেলে দেওয়া হয়েছে; আবারও ক্ষমতার বিভিন্ন অবস্থান দখল করে রাখা বা প্রচারমাধ্যম ও সরকারী ডিসকোর্সের নিয়ন্ত্রণকারী বহু সেক্যুলারিস্টের চোখে একথা সত্যি মনে হয়েছিল। পাশ্চাত্য খৃস্টজগতে ধর্ম প্রায়শঃই নিষ্ঠুর ও নিপীড়নমূলক ছিল। আধুনিক রাষ্ট্রের চাহিদা ছিল সমাজকে সহিষ্ণু হতে হবে। ক্রুসেড বা ইনকুইজিশনের যুগে ফিরে যাবার কোনও উপায় ছিল না। সেক্যুলারিজম এসেছে থাকবার জন্যে। কিন্তু একই সময়ে, বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ পৃথিবীকে এও স্বীকার করে নিতে হয়েছিল যে, ‘শূন্যতা’ যে এখন আর মনস্তাত্ত্বিক শূন্যতা নেই, বরং একে স্পষ্ট ও ভীতিকর রূপ দেওয়া হয়েছে।

১৯১৪ সাল থেকে ১৯৪৫ সালের ভেতর ইউরোপ ও সোভিয়েত ইউনিয়নে সত্তর মিলিয়ন মানুষ সহিংস মৃত্যু বরণ করেছিল।’ ভয়াবহ কিছু নিষ্ঠুরতা সংঘটিত হয়েছিল ইউরোপের অন্যতম সংস্কৃত সমাজের বাসিন্দা জার্মানদের হাতে। যৌক্তিক শিক্ষা বর্বরতা নিশ্চিহ্ন করতে পারবে, এমনটি আর মনে করা যাচ্ছিল না; কেননা এক মহান বিশ্ববিদ্যালয়ের একেবারে কাছেই নাৎসি হলোকাস্ট নির্যাতন শিবিরের অস্তিত্ব প্রকাশ করেছিল। নাৎসি হলোকাস্ট বা সোভিয়েত গুলাগের ভয়ঙ্কর মাত্রা সেগুলোর আধুনিক উৎস তুলে ধরে। এর আগের কোনও সমাজই নিশ্চিহ্নতার এমনি ব্যাপক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা ভাবেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-৪৫) ভয়াবহতা শেষ হয়েছিল কেবল জাপানি শহর হিরোশিমা ও নাগাসাকির উপর প্রথম অ্যাটম বোমা বর্ষণের ভেতর দিয়ে। এটাও আবার আধুনিক বিজ্ঞানের ক্ষমতার ভীতিকর রূপ ও আধুনিক সংস্কৃতির নিশ্চিহ্নতার বীজাণু। দশকের পর দশক নারী-পুরুষ ঈশ্বর নির্ধারিত চূড়ান্ত প্রলয়ের অপেক্ষা করে এসেছিল; কিন্তু এখন মনে হচ্ছিল যেন এই বিশ্ব ধ্বংস করার জন্যে মানবজাতির কোনও অতিপ্রাকৃত উপাস্যের প্রয়োজন পড়বে না। নিজেরাই অসাধারণ দক্ষতার সাথে একাজটি করতে খেয়ালি দক্ষতা ও শিক্ষাকে কাজে লাগিয়েছে তারা। জীবনের এইসব নতুন সত্য বিবেচনা করার সময় জনগণ আগের যেকোনও সময়ের চেয়ে যৌক্তিক রীতিনীতির সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে অতিমাত্রায় সচেতন হয়ে উঠতে শুরু করেছিল। এমনি ভয়াবহ মাত্রার বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়ে যুক্তি নীরব হয়ে গিয়েছিল; আক্ষরিকভাবেই এর বলার মতো কিছু ছিল না।

হলোকাস্ট আধুনিক কালের অশুভের প্রতিমূর্তিতে পরিণত হবে। এটা ছিল একেবারে গোড়া থেকেই যা জাতিগত শুদ্ধিকরণের কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্ট আধুনিকতার উপজাত। নাৎসিরা শিল্পযুগের বহু সরঞ্জাম ও সাফল্যকে মারাত্মক কার্যকারিতার সাথে প্রয়োগ করেছে। মৃত্যুশিবিরগুলো ছিল একেবারে খোদ শিল্পকারখানার চিমনি পর্যন্ত ফ্যাক্টরির প্যারোডি। তারা রেলপথ, অগ্রসর রাসায়নিক শিল্প ও দক্ষ আমলাতন্ত্র এবং ব্যবস্থাপনার পূর্ণ ব্যবহার করেছে। হলোকাস্ট ছিল বৈজ্ঞানিক ও যৌক্তিক পরিকল্পনার নজীর, যেখানে সমস্ত কিছু ছিল একক, সীমিত ও স্পষ্ট সংজ্ঞায়িত লক্ষ্যের অধীন। আধুনিক বৈজ্ঞানিক বর্ণবাদ থেকে উদ্ভুত হলোকাস্ট ছিল বিংশ শতাব্দীর ‘উদ্যান’ সংস্কৃতি নামে আখ্যায়িত সামাজিক প্রকৌশলের চরম রূপ। খোদ বিজ্ঞানই মৃত্যু-শিবিরে গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট ছিল, সেখানে সুপ্রজনন বিদ্যার পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানো হয়েছে। আর কিছু না হোক হলোকাস্ট দেখিয়েছে যে, সেক্যুলারিস্ট মতাদর্শ যেকোনও ধর্মীয় ক্রুসেডের মতোই মারাত্মক হতে পারে।

মানব চেতনায় ঈশ্বরের পরলোকগমনের ফলে আবির্ভূত বিপদেরও স্মারক ছিল হলোকাস্ট। খৃস্টতত্ত্বে নরককে ঈশ্বরের অনুপস্থিতি হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। শিবিরগুলোকে যেন অপার্থিবভাবে শত শত বছর ধরে ইউরোপিয়দের তাড়া করে ফেরা নরককুণ্ডের পুঙ্খানুপুঙ্খ পুনর্নির্মাণ বলে মনে হয়েছিল। প্রহার, শূলে চরানো, চাবুকপেটা করা এবং পরিহাস, বিকৃত, বিনষ্টদেহ, অগ্নিশিখা ও গন্ধময় হাওয়া এসব কিছুই ক্রিশ্চানদের ইউরোপের কবি, চিত্রশিল্পী, ভাস্কর ও নাট্যকারদের বর্ণিত নরকের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। অশউইচ ছিল এক কৃষ্ণ এপিফ্যানি, পবিত্রতার অনুভূতি হারিয়ে গেলে জীবনের চেহারা কেমন হতে পারে মানুষকে তার একটা আভাস দিয়ে গিয়েছিল। সর্বত্তোম অবস্থায় (কেবল সর্বোত্তম অবস্থাতেই) ধর্ম মানুষকে এর মিথ, আচার ও কাল্টিক ও নৈতিক অনুশীলনের ভেতর মানবজাতির পবিত্রতার উপলব্ধি চর্চা করতে সাহায্য করেছিল। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ মনে হয়েছে, বল্গাহীন যুক্তিবাদ পৃথিবীর বুকেই নরক নামিয়ে আনতে নিজেকে বাধ্য মনে করতে পারে, ঈশ্বরের অনুপস্থিতির সহসম্পর্কিত উদ্দেশ্য। আগের যেকোনও সময়ের চেয়ে বেশি সৃজনশীলতার সাথে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটানোর ক্ষমতা সম্পন্ন মানুষকে আকর্ষণ করার মতো এক ধরনের বিনাশী প্রবণতা ছিল। ঈশ্বরের প্রতীক মানবীয় সম্ভাবনার সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করেছিল; এবং রক্ষণশীল যুগে নারী-পুরুষের কর্মতৎপরতার উপর সীমা আরোপ করেছিল। আইনের নির্দেশনা তাদের মনে করিয়ে দিয়েছে এই পৃথিবী তাদের খেয়ালখুশি মতো কিছু করার জায়গা নয়। আধুনিক মানব সত্তা এখন এমন ব্যাপক মাত্রায় স্বায়ত্তশাসন ও মুক্তিকে মূল্য দিচ্ছিল যে সর্বশক্তিমান স্বর্গীয় আইনপ্রণেতার ধারণাই তাদের কাছে ঘৃণ্য হয়ে উঠেছিল এই পরিবর্তন মানুষের মর্যাদার এক বিরাট অগ্রগতি চিহ্নিত করেছিল। কিন্তু হলোকাস্ট ও গুলাগ দেখিয়েছে, মানুষ এধরনের সকল বাধা ছুঁড়ে ফেললে কিংবা জাতি বা রাজনীতিকে পরম মূল্যে পরিণত করলে কী ঘটতে পারে। জীবনের পবিত্রতা এবং পৃথিবীকে সম্মান দেখাতে মানুষকে ‘অতিপ্রাকৃতের’ অপুর্ণাঙ্গ প্রতীক নিয়ে আধুনিক শুদ্ধতার সাথে আপোস করবে না এমন শিক্ষা দেওয়ার নতুন উপায় বের করতে হবে।

মৃত্যু-শিবির ও মাশরুম মেঘ হচ্ছে এমন প্রতিমা যা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে ও মনে রাখতে হবে যাতে আমরা যেন উন্নত বিশ্বে আমাদের অনেকেরই উপভোগ করা আধুনিক বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতির ব্যাপারে বড় বেশি শভেনিস্টিক না হয়ে উঠি। কিন্তু এইসব প্রতিমা আবার কিছু কিছু ধার্মিক মানুষ আমাদের আধুনিক সেক্যুলার সামাজকে কীভাবে দেখে সে সম্পর্কে একটা ধারণাও দেয়, যেখানে তারাও ঈশ্বরের অনুপস্থিতি বোধ করে। কোনও কোনও মৌলবাদী আধুনিকতাকে সমানভাবে অহংময়, অশুভ ও দানবীয় মনে করে; আধুনিক শহর বা সেক্যুলার মতাদর্শ সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটা অশউচের অন্ধকারে তাকিয়ে থাকা উদারপন্থী সেক্যুলারিস্টদের মতো একই ধরনের ভীতি ও অসহায় ক্রোধে তাদের ভরিয়ে তুলেছিল। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে তিনটি একেশ্বরবাদী ধর্মের সবকটার মৌলবাদীরাই মূলধারার সমাজ থেকে সরে গিয়ে তাদের ধারণায় পরিস্থিতি কেমন হওয়ার কথা ছিল সেটাকেই তুলে ধরে প্রতি-সংস্কৃতি গড়ে তুলতে শুরু করেছিল। তারা কেবল অহঙ্কার বশতঃ নিজেদের সরিয়ে নিচ্ছিল না, বরং প্রায়শঃই ত্রাস ও ভীতির কারণে এমনটি করতে বাধ্য হয়েছিল। মৌলবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রাণকেন্দ্রে যে ভীতি ও উদ্বেগের বাস সেটা উপলব্ধি করা আমাদের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ কেবল তাহলেই আমরা এর প্রবল ক্রোধ, নিশ্চয়তা দিয়ে শূন্যতাকে পূর্ণ করার প্রবল আকাঙ্ক্ষা এবং এর ক্রমাগত এগিয়ে আসা অশুভ সংক্রান্ত বিশ্বাস উপলব্ধি করতে পারব।

কোনও কোনও ইহুদি আধুনিক বিশ্বকে হলোকাস্টের আগে থেকেই দানবীয় মনে করে আসছিল। প্রকৃতপক্ষেই নাৎসি নিষ্ঠুরতা কেবল তাদের এই বিশ্বাসকেই নিশ্চিত করেছিল যে, জেন্টাইল বিশ্ব নিরাময় অতীত অশুভই নয়, বরং অধিকাংশ আধুনিক ইহুদি ভয়ঙ্করভাবে সাজা পাওয়ার যোগ্য। ১৯৩০-র দশক পর্যন্ত আধুনিক সংস্কৃতির সাথে কোনও সম্পর্ক রাখতে অনিচ্ছুক বেশিরভাগ অর্থডক্স ইহুদি ইয়েশিভা বা হাসিদিক সভায় নিজেদের মগ্ন রাখতে পারত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা প্যালেস্তাইনে অভিবাসন করার ইচ্ছা বা প্রয়োজন কোনওটাই ছিল না তাদের। কিন্তু ১৯৩০ ও ১৯৪০-র দশকের আলোড়ন বুঝিয়েছিল যে, জীবিতদের ইউরোপ ও সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে পালানো ছাড়া কোনও উপায় নেই। হেরেদিমদের অনেকে প্যালেস্তাইনে গিয়ে যায়নবাদীদের মুখোমুখি পড়ে যায়, এরা তখন ইহুদিদের আসন্ন বিপর্যয় থেকে বাঁচানোর লক্ষ্য একটি রাষ্ট্র গঠনের জন্যে সংগ্রাম করছিল।

জেরুজালেমের আল্ট্রা অর্থডক্স ইহুদি সম্প্রদায় এদাহ হেরেদিস বেলফোর ঘোষণার বহু আগে থেকেই যায়নবাদের প্রবল বিরোধী ছিল। ছোট দল ছিল এটি, ১৯২০-র দশকে প্যালেস্তাইনে বসবাসরত ১৭৫,০০০ জন ইহুদির মধ্যে মাত্র ৯,০০০ জনকে আকৃষ্ট করতে পেরেছিল তারা। পবিত্র টেক্সটে নিমগ্ন এই সম্প্রদায়টির নিজেদের রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত করার উপায় সম্পর্কে কোনও ধারণাই ছিল না, কিন্তু অচিরেই যারা আধুনিক রাজনীতির খেলার কায়দা রপ্ত করা আগুদাত ইসরায়েলের সদস্যরা তাদের সাথে যোগ দেবে। আগুদাত তখনও যায়নবাদের বিরোধী আদর্শগত মতবাদ লালন করলেও সদস্যরা পবিত্র ভূমিতে তাদের নিজস্ব ধর্মীয় বসতি স্থাপন করার মাধ্যমে সেক্যুলারিস্টদের প্রভাব হ্রাস করার প্রয়াস পেয়েছিল, তরুণ সম্প্রদায় যেখানে তোরাহ ও তালমুদের পাশাপাশি আধুনিক বিষয়াদি পাঠ করেছে। এমনি আপোস আগুদাত ‘সীমানা অতিক্রম’ করে গেছে, এই বিশ্বাস লালনকারী অধিকতর আল্ট্রা অর্থডক্স ইহুদিদের ভীত করে তুলেছিল। এই আল্ট্রা অর্থডক্স বিরোধ থেকেই প্রথম নজীরে প্রায়শঃই যেমন ঘটে থাকে সহধর্মাবলম্বীদের ভেতর বিবাদে অনুপ্রাণিত হয়ে একটি মৌলবাদী আন্দোলনের জন্ম ঘটেছিল।

এই প্রত্যাখ্যানবাদী অর্থডক্সির প্রধান মূখপাত্র ছিলেন হাঙেরিয় ইহুদি সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান হাসিদিক নেতা র‍্যাবাই হাইম এলিয়েযার শাপিরা অভ মুনকাকস (১৮৭২-১৯৩৭)। ১৯২২ সালে আগুদাতের বিরুদ্ধে এক প্রবল প্রচারণা শুরু করেন তিনি। তাঁর দৃষ্টিতে আগুদাত সদস্যরা যায়নবাদীদের সাথে যোগসাজশে গোয়িশি আলোকনের এইসব ‘বিষাক্ত আগাছা ও সোমরস’ দিয়ে নিষ্পাপ স্কুলছাত্রদের আক্রান্ত করছে, ‘তেমনি সেইসব গান দিয়ে যেগুলো এরেত্য ইসরায়েলের ভূমিতে ক্ষেতখামারে ও আঙুর বাগিচায় ভূমিতে বসতি গড়ার কথা বলে-ঠিক যায়নিবাদী কবিদের মতো।’৫ তারা পবিত্র জমিনকে চাষ করার মাধ্যমে কেবল প্রার্থনা ও পবিত্র পাঠের জন্যেই নির্ধারিত পবিত্র ভুমিকে অপবিত্র করছে। স্লোভাকিয়ায় এক সভায় হেরেদিমের সবচেয়ে রেডিক্যাল মুনকাক্যার রেব্বের সাথে একমত হয়ে আগুদাতের সাথে সংশ্লিষ্টতার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে নির্দেশে স্বাক্ষর করেন। সুস্পষ্টভাবে যায়নবাদের বিরোধিতা করে অস্তিত্ব লাভ করা আগুদাত সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি সঠিক ছিল না; এই দলটি যারা যায়নবাদকে সমর্থন করে না আবার আগুদাতের উপর শাপিরার নিষেধাজ্ঞাকেও সমান বাড়াবাড়ি মনে করে এমন পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপের সংখ্যাগরিষ্ঠ অর্থডক্সের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়ার ব্যাপারে সজাগ ছিল। তা সত্ত্বেও যায়নবাদের সহজাত ত্রাসের কারণে এই বিচ্ছিন্নতাবাদী নীতিকে তারা যুক্তিসঙ্গত মনে করেছে। নিষেধাজ্ঞায় স্বাক্ষরকারী অন্যতম প্রথম হেরেদিম ছিলেন তরুণ র‍্যাবাই মোশে তেইতেলবাম (১৮৮৮-১৯৭৯), পরে হাঙেরির সাতমারের হাসিদিম নেতা এবং যায়নবাদ ও ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রবলতম হেরেদি বিরোধীতে পরিণত হবেন তিনি।

শাপিরা ও তেইতেলবাম প্যালেস্তাইনে যায়নবাদী কিম্ভুতযিম নিয়ে ভাববার সময় লোকে পরবর্তী কালে নাৎসি মৃত্যু-শিবিরের কথা শুনলে যেমন ভীতি ও ক্রোধের অনুভূতিতে তাড়িত হত তেমনি বোধ করেছেন। এটা মোটেই বাড়াবাড়ি ছিল না। স্বজাতির সাথে আমেরিকায় অভিবাসন করে অল্পের জন্যে রেহাই পেয়েছিলেন তেইতেলবাম, হলোকাস্টের সম্পূর্ণ দায়ভার ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ ইহুদি জনগণকে ভয়ানক ধর্মদ্রোহিতার পথে প্রলুব্ধকারী’ যায়নবাদীদের মহাপাপের উপর চাপিয়ে দিয়েছিলেন তিনি, ‘এমন কিছু পৃথিবীর সৃষ্টির পর আর দেখা যায়নি…তো এটা বিস্ময়ের কিছু নয় যে, প্রভু ক্রোধে আঘাত হেনেছেন। এই প্রত্যাখ্যানবাদীরা মরুভূমিতে যার ফসল ফলানো যায়নবাদীদের কৃষিখাতে সাফল্যের ভেতর বা ইহুদিদের প্রাণ বাঁচাতে লড়াই চালিয়ে যাওয়া তাদের নেতাদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় ইতিবাচক কিছুই প্রত্যক্ষ করতে পারেননি। এটা ছিল এক ধরনের ‘উন্মত্ততা’, ‘এক ধরনের ‘অপবিত্রকরণ’, এবং অশুভ শক্তির চূড়ান্ত বিস্ফোরণ।’ যায়নবাদীরা ছিল নাস্তিক, অবিশ্বাসী, তাদের উদ্যোগ তারপরেও অশুভ কারণ এটা ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, যিনি আদেশ দিয়েছিলেন যে ইহুদিদের অবশ্যই নির্বাসনের কষ্ট ভোগ করতে হবে, তারা অবশ্যই নিজেদের উদ্ধার করার কোনও পদক্ষেপ নিতে পারবে না।

শাপিরার চোখে ভূমি সাধারণ ইহুদিদের বসতি স্থাপনের পক্ষে অত্যন্ত পবিত্র, আত্মস্বীকৃত যায়নবাদী বিদ্রোহীদের কথা তো বাদই। কেবল সারা জীবন পাঠ ও প্রার্থনায় কাটিয়ে দেওয়া ধর্মীয় অত্যুৎসাহীই সেখানে নিরাপদে বাস করতে পারে। যেখানে এরেত্য ইসরায়েলের (ইসরায়েল দেশ) মতো কোনও পবিত্র বস্তু থাকে, অশুভ শক্তি সেখানেই আক্রমণ চালাতে সমবেত হয়। যায়নবাদীরা, ব্যাখ্যা করেছেন শাপিরা, স্রেফ দানবীয় প্রভাবের বাহ্যিক প্রকাশ মাত্র। সুতরাং, খোদ পবিত্র ভুমি দুষ্ট শক্তিতে ভরে উঠেছে, যা ঈশ্বরের ক্রোধ ও ক্ষোভ জাগিয়ে তুলবে।’ ঈশ্বরের বদলে এখন খোদ শয়তান জেরুজালেমে বাস করছে। ভূমিতে ‘আরোহণে’র ভানকারী যায়নবাদীরা আসলে নরকের গভীরে নেমে যাচ্ছে” পবিত্ৰ ভুমি এখন ঈশ্বর শূন্য; অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয়েছে। যায়নবাদীদের বক্তব্য মোতাবেক এরেত্য ইসরায়েল মোটেই স্বদেশভূমি নয়, বরং রণক্ষেত্র। এমনি ভয়ঙ্কর সময়ে সেখানে কেবল যারা বাস করতে পারে তারা গৃহস্থ বা কৃষক নয়, বরং ‘জেরুজালেমের পবিত্র পাহাড়ে ঈশ্বরের অবশিষ্ট ঐতিহ্যের পক্ষে ন্যায়যুদ্ধ করতে অগ্রসর হওয়া যোদ্ধা, ‘অন্ধ ঈশ্বরভীরুর দল,’ ‘যুদ্ধের বীর পুরুষ’। গোটা যায়নবাদী উদ্যোগ শাপিরাকে অস্তিত্বগত ভীতিতে ভরিয়ে তুলেছিল। তেইতেলবাম যায়নবাদীদের ইহুদি জনগণের উপর লাগাতার বিপর্যয় নিয়ে আসা অশুভ অহঙ্কারের সর্বশেষ প্রকাশ হিসাবে দেখেছেন: টাওয়ার অভ বাবেল, সোনালি বাছুরের বহুঈশ্বরবাদীতা, সিই দ্বিতীয় শতাব্দীতে বার কোচবা বিদ্রোহ ও শাব্বেতেই যেভি কেলেঙ্কারী। কিন্তু যায়নাবাদই সব সেরা ধর্মদ্রোহীতা। এটা ছিল বিশ্বের খোদ ভিত্তিমুলের নাড়া দেওয়া ভীষণ ঔদ্ধত্য। ঈশ্বরের হলোকাস্ট প্রেরণের ভেতর বিস্ময়ের কিছুই নেই!৯

সুতরাং, বিশ্বাসীকে অবশ্যই নিজেদের অশুভ থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন করে নিতে হবে। ১৯২০ ও ১৯৩০-র দশকে লেখালেখি করেছেন জেরুজালেমের অন্যতম অত্যুৎসাহী হাসিদিম র‍্যাবাই ইয়েশায়াহু মারগোলিস, শাপিরা ও তেইতেল বামের বিরাট ভক্ত ছিলেন তিনি, তেইতেলবামকে এদাহ হেরেদিসের নেতা হিসাবে দেখতে চেয়েছিলেন। মারগোলিস ইসরায়েলের প্রতি-ইতিহাস নির্মাণ করেছিলেন যেখানে অবিরাম শত শত বছর ধরে ঈশ্বরের নামে রুখে দাঁড়িয়ে অন্য ইহুদিদের বিরুদ্ধে নিজেদের লড়াই করতে বাধ্য মনে করা যুদ্ধংদেহী একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের প্রতি জোর দেওয়া হয়েছে। লেভাইরা মোজেস সিনাই পাহাড়ের চূড়ায় তোরাহ গ্রহণ করার সময় সোনালি বাছুরের উপাসনাকারী তিন হাজার ইসরায়েলিকে হত্যা করেছিল; একারণেই, মন্দিরে তাদের সেবার জন্যে নয়, ঈশ্বর অন্য গোত্রগুলোর উপরে তাদের মর্যাদা দিয়েছিলেন। মোজেস ছিলেন সারা জীবন অন্য ইহুদিদের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাওয়া একজন মহান ধর্মোৎসাহী। আরনের পৌত্র ফিনেহাস ইসরায়েলের রাজপুত্র হওয়া সত্ত্বেও যিমরির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, কারণ তিনি ব্যাভিচার করেছিলেন। এলিযাহ আহাবের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বাআলের ৪৫০জন পয়গম্বরকে হত্যা করেছেন। এই অত্যুৎসাহী ধার্মিকরা, ঈশ্বরের প্রতি যাদের আবেগ প্রায়শঃই নিয়ন্ত্রণহীন ক্রোধের ভেতর দিয়ে প্ৰকাশ পায়, সত্যিকারের ইহুদি, অবশিষ্ট বিশ্বাসী। অনেক সময় জেন্টাইলদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে তাঁদের, অনেক সময় সতীর্থ ইহুদিদের বিরুদ্ধে, কিন্তু যুদ্ধ বরাবর একই। বিশ্বাসী ইহুদিদের অবশ্যই ঈশ্বরকে ত্যাগ করে অশুভের দলে নাম লেখানো আগুদাতের সদস্যের মতো ইহুদিদের সাথে নিজেদের শেকড়বাকর শুদ্ধ বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে হবে। যায়নবাদের সাথে সহযোগিতা করে আগুদাত ইহুদিদের ‘পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপের চেয়েও বেশি ক্ষতি করেছে।’ ওদের সাথে মেশা পাপ এবং শয়তানের সাথে চুক্তি করার মতোই।১১

একারণেই বিচ্ছিন্নতার দায়িত্ব। তোরাহ যেমন পবিত্রকে অপবিত্র থেকে, আলোকে অন্ধকার থেকে, দুধকে মাংস থেকে এবং সাব্বাথকে বাকি সপ্তাহ থেকে বিচ্ছিন্ন রাখে তেমনি ন্যায়নিষ্ঠকে নিজেকে বিচিছন্ন রাখতে হবে। কখনও দলে ফিরে আসবে না এমন বিদ্রোহী, এইসব দুষ্ট ইহুদিদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্নভাবে বাস করে প্রকৃত হেরেদিম তাদের সাথে অধিবিদ্যিক স্তরে বিরাজিত অস্তিত্বের মহাগহ্বরেরই ভৌত প্রকাশ ঘটাচ্ছে। কিন্তু ভীতিকর এই দর্শন বোঝায় যে, শয়তানি অশুভের ভেতর বাস করে বিশ্বাসীদের জীবনের প্রতিটি বিষয় মহাজাগতিক গুরুত্ব বহন করে। পোশাক, পড়াশোনার কৌশল, এমনকি রুটির টুকরোকে অবশ্যই সঠিক হতে হবে। ইহুদি জীবন মারাত্মকভাবে বিপদাপন্ন, যেকোনও রকম উদ্ভাবনই দারুণভাবে নিষিদ্ধ: খেয়াল রাখতে হবে যেন ডান দিকের ল্যাপেল বাম দিকের ল্যাপেলের উপরে থাকে, যাতে পরমেশ্বরের ডান হাত, ‘পরমপ্রভুর ডান হাত উপরে থাকে’ এর মহান ভালোবাসায় (হেসেদ), অশুভ প্রবণতার ক্ষমতা (দিন) প্রকাশকারী বামদিকের উপর প্রাধান্য বিস্তার করে।১২ প্রোটেস্ট্যান্ট মৌলবাদ যেখানে কঠোর মতবাদগত সমরূপতায় পরম নিশ্চয়তার সন্ধান করে শূন্যতাকে পুরণ করার প্রয়াস পেয়েছে, এইসব যায়নবাদ বিরোধী আল্ট্রা অর্থডক্সরা ঐশী বিধান ও রেওয়াজের অনুপুঙ্ক্ষ পরিপালনের ভেতর নিশ্চয়তার খোঁজ করেছে। এটা যেগুলো কেবল প্রাচীন সীমারেখার পুঙ্খানুপুঙ্খ সংরক্ষণ, নতুন সীমানার সৃষ্টি, কঠোর বিচ্ছিন্নতা ও ঐতিহ্যের মূল্যবোধের আবেগময় পরিপালনের মাধ্যমেই প্রশমিত হতে পারে এমন প্রায় নিয়ন্ত্রণের অতীত ভীতি তুলে ধরা এক ধরনের আধ্যাত্মিকতা।

যেসব ইহুদি যায়নবাদী সাফল্যকে বিস্ময়কর ও উপশমকারী মনে করেছিল তাদের কাছে এই প্রত্যাখ্যানবাদী দর্শন বোধগম্য ঠেকেনি। এটাই গোটা বিংশ শতাব্দী জুড়ে ইহুদি, ক্রিশ্চান ও মুসলিমদের সকলের মোকাবিলা করা সেই টানাপোড়েন: মৌলবাদী ও আধুনিক সেক্যুলার বিশ্বের প্রতি অধিকতর ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি লালনকারীদের ভেতরকার অনতিক্রম্য এক দূরত্ব রয়েছে। বিভিন্ন গোষ্ঠী স্রেফ অবস্থাকে একই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে পারে না। যৌক্তিক তর্ক কোনও কাজে আসে না, কারণ বিরোধের সৃষ্টি হয় মনের গভীরতর ও অধিকতর স্বজ্ঞামূলক স্তরে। শাপিরা, তেইতেলবাম এবং মারগোলিস সেক্যুলার যায়নবাদীদের উদ্দেশ্যমূলক, বাস্তববাদী ও যৌক্তিকভাবে অনুপ্রাণিত কর্মকাণ্ড নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার সময় তাঁরা কেবল তাদের ঈশ্বরহীন এবং একারণে দানবীয় রূপেই দেখতে পেয়েছেন। পরে তাঁরা এবং তাঁদের অনুসারীরা মৃত্যু-শিবিরে নাৎসিদের যৌক্তিক, বাস্তবভিত্তিক ও নিষ্ঠুরভাবে পরিচালিত কর্মকাণ্ডের কথা শুনে তাদের যায়নবাদী উদ্যোগের মতো একই প্রকৃতির মনে করেছেন। দুটোই ঈশ্বরের অনুপস্থিতি তুলে ধরেছে, সুতরাং এগুলো ধ্বংসাত্মকভাবে হেরেদিমদের কাছে মূল্যবান পবিত্র সকল মূল্যবোধ মাড়িয়ে যাওয়া শয়তানসুলভ ও বিনাশী। এখন পর্যন্ত জেরুজালেমের যায়নবাদ বিরোধী এলাকার প্ল্যাকার্ড ও গ্রাফিতিগুলো রাষ্ট্রের রাজনৈতিক নেতাদের হিটলারের সাথে তুলনা করে। বহিরাগত কারও চোখে এমনি তুলনা হতবুদ্ধিকর, মিথ্যা ও বিকৃত, তবে মৌলবাদীদের হৃদয়ে সেক্যুলারিজম কেমন গভীর ভীতি জাগিয়ে তুলতে পারে আমাদের সে সম্পর্কে একটা ধারণা দেয়।

এরেত্য ইসরায়েলে ইহুদি ধর্মদ্রোহীদের একটি সেক্যুলার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ধারণাটিই একটা টাবুকে লঙ্ঘন করেছিল। শত শত বছর ধরে হারানো ভূমি একে ঈশ্বর ও তোরাহর সাথে এক ধরনের পবিত্র ট্রিনিটিতে সম্পর্কিত করে এক প্রতীকী ও অতীন্দ্রিয়বাদী মূল্য লাভ করেছিল। ধর্মকে ছুঁড়ে ফেলার ব্যাপারটি গোপন করেনি এমন একদল লোকের হাতে এর অপবিত্রকরণ প্রত্যক্ষ করা পবিত্র উপাসনালয়ের অমর্যাদার মতোই মিশ্র ক্রোধ ও ভীতির উদ্রেক ঘটিয়েছে, বিশেষ করে ইহুদি বিশ্বে একে প্রায়শঃই ধর্ষণ হিসাবে অনুভব করা হয়ে থাকে।” যায়নবাদীরা যতই তাদের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, রেডিক্যাল হেরেদিমদের কেউ কেউ ততই বেপরোয়া হয়ে উঠছিল; অবশেষে ১৯৩৮ সালে যায়নবাদীদের সাথে ‘সহযোগিতা’র কারণে আগুদাত থেকে বের হয়ে আসা আমরাম ব্লঅ ও আহারন কাতযেনেলেনবোগেন এদাহ হেরেদিস ছেড়ে বের হয়ে আসেন। ইহুদি সম্প্রদায় সম্প্রতি আরব আক্রমণের বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিরক্ষার খরচ মেটানোর লক্ষ্যে বিশেষ কর আরোপ করেছিল, এই প্রত্যাখানবাদীরা তা আদায় করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। তাঁদের প্রত্যাখ্যানকে যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ করতে ব্লঅ ও কাতযেনেলেনবোগেন একটি তালমুদিয় কাহিনী উদ্ধৃত করেছেন। তৃতীয় শতাব্দীতে রোমান প্যালেস্তাইনের একটি শহরে সশস্ত্র প্রহরীরা একটি ইহুদি সম্প্রদায়ের প্রতিরক্ষা সংগঠিত করার সময় দুজন ইহুদি সাধু তাদের বলেছিলেন: “তোমরা শহরের অভিভাবক নও, বরং ধ্বংসকারী।১৪ ব্লঅ ও কাতযেনেলে বোগেনের হাতে গড়ে ওঠা নতুন দলটিকে একটি আরামাইক নাম দিয়েছিলেন, নেচারেই কারতা (‘দ্য গার্ডিয়ান অভ দ্য সিটি’): ইহুদিরা যায়নবাদীদের জঙ্গী তৎপরতার মাধ্যমে নয় বরং অর্থডক্সদের নিবেদিতপ্রাণ ও নিষ্ঠ ধর্মীয় পরিপালনের ভেতর দিয়েই রক্ষা পাবে। তাঁরা যায়নবাদীদের দৃষ্টিভঙ্গিকে চ্যালেঞ্জ করেন। তাঁদের চোখে ইহুদিদের যখন তোরাহ দেওয়া হয়েছিল, তারা বিভিন্ন জাতি থেকে এক ভিন্ন বলয়ে প্রবেশ করেছিল। রাজনীতি বা সশস্ত্র সংগ্রামে যোগ দেওয়ার কথা নয় তাদের, বরং উচিত আত্মার কর্মকাণ্ডে নিজেদের নিবেদন করা। ইহুদিদের ইতিহাসের জগতে ডাক দিয়ে যায়নবাদীরা আসলে ঈশ্বরের রাজ্যকে পরিত্যাগ করেছে ও এমন এক রাষ্ট্রে প্রবেশ করেছে যেটা ইহুদিদের পক্ষে কোনও অস্তিত্বমূলক অর্থ রাখে না। তারা নিজেদের প্রকৃতিকেই অস্বীকার করেছে এবং ইহুদিদের ধ্বংসের পথে স্থাপন করেছে।১৫

যায়নবাদ যত সফল হয়ে উঠল নেচারেই কারতা ততই হতবাক হয়ে চলল। কী কারণে দুষ্টরা সমৃদ্ধি লাভ করছে? ১৯৪৮ সালে হলোকাস্টের খুব অল্প পরেই ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করলে তেইতেলবাম ও ব্লঅ কেবল এই উপসংহারেই পৌঁছতে পেরেছিলেন যে, ইহুদিদের অর্থহীন অশুভ ও অপবিত্রতার দিকে চালিত করতে খোদ শয়তান ইতিহাসে প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ করেছে।১৬ অধিকাংশ অর্থডক্স ও আল্ট্রা-অর্থডক্সরা নতুন রাষ্ট্রকে মেনে নিতে পেরেছিল। তারা ঘোষণা করেছিল যে, এর কোনও ধর্মীয় মূল্য নেই, ইসরায়েলে বাসরত ইহুদিরা এখনও ঠিক ডায়াসপোরার মতোই নির্বাসনে আছে; কোনও কিছুই বদলায়নি। আগুদাত ইসরায়েল ইহুদদের ধর্মীয় স্বার্থ নিশ্চিত করতে ঠিক ইউরোপের জেন্টাইল সরকারগুলোর সাথে আলোচনা করার মতোই ইসরায়েলি সরকারের সাথে শতাদলানাতে-সংলাপ ও আলোচনা-প্রস্তুত ছিল। কিন্তু নেচারেই কারতা এসবের কোনও কিছুই মেনে নিতে পারেনি। ১৪ই মে, ১৯৪৮ তারিখে রাষ্ট্রের ঘোষণা দেওয়ার পরপরই নির্বাচনে যেকোনও ধরনের অংশ গ্রহণের উপর দলটি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, ইয়েশিভোতের জন্যে সরকারী অর্থসংস্থান গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায় ও সরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহে কখনওই পা না রাখার শপথ নেয়। আগুদাতের উপর আক্রমণও দ্বিগুন করে দেয়, তাদের বাস্তবভিত্তিক রাষ্ট্র মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্তকে তারা কীলকের ডগা বিবেচনা করেছে। ‘ঈশ্বর না করুন, অশুভ, বলাৎকারকারী ও দূষিতকারীদের প্রতি আমাদের ঘৃণা থেকে আমরা এতটুকু সরে এলেও,’ জোরের সাথে বলেছেন ব্লঅ, [আমরা যদি] পবিত্র তোরাহর আমাদের উপর অরোপিত বিচ্ছিন্নতাকে ভঙ্গ করি…তাহলে প্রতিটি নিষিদ্ধ জিনিসের জন্যে রাস্তা উন্মুক্ত হয়ে যাবে, কারণ বাঁকা পথের জন্যে সরল ও সংকীর্ণ পথ ছেড়ে দেব।১৭ বলতে গেলে গোটা ইহুদি জাতিকে ঈশ্বরের কাছ থেকে প্রলুব্ধ করে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়নবাদী উদ্যোগ সকল শোভন ও পবিত্র মূল্যবোধের বিনাশী প্রত্যাখ্যানে পতিত হচ্ছে।

ইহুদি বিশ্বে যায়নবাদ শেকড় গেড়ে বসার সাথে সাথে ইহুদি রাষ্ট্রটি সফল হয়ে ওঠার ফলে উভয়ের প্রতিই নেচারেই কারতার ঘৃণা প্রবল হয়ে উঠল। সমন্বয়ের কোনও সম্ভাবনা ছিল না। কারণ ইসরায়েল রাষ্ট্রটি ছিল শয়তানের সৃষ্টি। তেইতেলবাম যেমন ব্যাখ্যা করেছেন, কোনও ইহুদির পক্ষে ‘রাষ্ট্রের প্রতি ও তোরাহর প্রতি একসাথে বিশ্বাস রাখা সম্ভব নয়, কারণ তারা সম্পূর্ণ বিপরীত।’ এমনকি রাজনীতিবিদরা তালমুদিয় সাধু ও নির্দেশনার নিবেদিতপ্রাণ অনুসারী হলেও রাষ্ট্র তারপরেও দানবীয় অশ্লীলতাই রয়ে যাবে কেননা এটা ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে ও নিষ্কৃতি ও অন্তিমকালকে ত্বরান্বিত করার প্রয়াস পেয়েছে।১৮ ইসরায়েলি পার্লামেন্ট নেসেটে ধর্মীয় আইন পাসের নেচারেই কারতার প্রয়াস নিয়ে আগুদাত ইসরায়েলের মাথা ঘামানোর কোনও ফুরসত ছিল না। আইন করে সাব্বাথে সরকারী পরিবহন সীমিত করা বা ইয়েশিভার ছাত্রদের সেনাবাহিনীতে যোগদানের বাধ্যবাধকতা থেকে রেহাই দেওয়া ধর্মীয় কাজ নয়। এটা স্রেফ স্বর্গীয় আইনকে মানবীয় আইনে পরিণত করা; এটা তোরাহকে বাতিল করারই শামিল, হালাখাহর অপবিত্রকরণ। নিউ ইয়র্কের সাতমার হাসিদিম সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় পণ্ডিত র‍্যাবাই শিমন ইসরায়েল পোসেন নেসেটের আগুদাত সদস্যদের সম্পর্কে যেমন বলেছেন:

যারা প্রতিদিন ‘নেসেট’ নামে পরিচিত দুষ্টদের সমাবেশে ফিল্যাম্ব্রিজ পরে আর মিথ্যার উদ্দেশে গান গায়, ঈশ্বর না করুন, আশীর্বাদপ্রাপ্ত পবিত্র জনের স্বাক্ষর জাল করে, তাদের উপর লানত বর্ষিত হোক। কারণ তারা মনে করে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোট দিয়ে তোরাহর সত্যিকে আরও দলিত করা যাবে কিনা বা ঈশ্বরের তোরাহকে কর্তৃত্ব প্রদান করা যাবে কিনা সেটা স্থির করতে পারবে।১৯

কিন্তু তারপরেও নেচারেই কারতা যায়নবাদের প্রতি আকর্ষণ বোধ করেছে। যায়নবাদীদের ‘বলাৎকারকারী’ হিসাবে ব্লঅর বর্ণনা তাৎপর্যপূর্ণ। ইহুদি ভূমিতে একটি ইহুদি রাষ্ট্র ইহুদির আত্মায় প্রবল আকর্ষণ সৃষ্টি করে। এটাই মৌলবাদী টানপোড়েনের অংশ। প্রায়শঃই তারা আধুনিকতার যেসব সাফল্য থেকে আতঙ্কে পশ্চাদপরণ করে থাকে সেগুলোর প্রতিই তীব্রভাবে আকর্ষণ বোধ করে।° মোহনীয় বিশ্বাসযোগ্য প্রতারক অ্যান্টিক্রাইস্টের প্রোটেস্ট্যান্ট মৌলবাদী চিত্রণ একই বিরোধের একটা কিছু তুলে ধরে। আধুনিকতার মৌলবাদী দর্শনে বিস্ফোরক হয়ে ওঠার মতো এক ধরনের টেনশন রয়েছে যা, ব্লঅ যেমন ইঙ্গিত দিয়েছেন, যায়নবাদ বিরোধীদের ধার্মিকতা এক ধরনের নীতিগত ‘ঘৃণা’ এবং ঘৃণা প্রায়শঃই অজ্ঞাত ভালোবাসার সাথে হাত ধরাধরি করে চলে। ইসরায়েল রাষ্ট্রের কথা ভাবতে গেলে হেরেদিম ক্রোধ অনুভব করে। তারা হত্যা করে না বটে, কিন্তু আজও সাব্বাথের দিন আইন ভেঙে যেসব ড্রাইভার গাড়ি চালায় তাদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোঁড়ে। অনেক সময়, অর্থাৎ ধরা যাক টেলিভিশন রেখে বা স্ত্রীকে অশোভান পোশাক পরার অনুমতি দিয়ে প্রত্যাশিত মান অনুযায়ী বাস করতে ব্যর্থ সতীর্থ হেরেদির বাড়িতে আক্রমণ চালায়। সহিংসতার এই ধরনের কর্মকাণ্ডকে কিদ্দুশ হাশেম, ‘ঈশ্বরের নামের পবিত্রকরণ’ হিসাবে দেখা হয় এবং চারদিক থেকে হেরেদিমকে ঘিরে রেখে তাদের গ্রাস করার হুমকি দিয়ে চলা অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে আঘাত মনে করা হয়।২১ তবে এমনটা হওয়া অসম্ভব নয় যে, এইসব সহিংসতা আসলে তাদের নিজেদের মনেরই চাপা আকাঙ্ক্ষা ও আকর্ষণ দমানোরই প্রয়াস।

যায়নবাদ বিরোধী এই হেরেদিমরা ক্ষুদ্র সংখ্যালঘুর অংশ। ইসরায়েলের এদের সংখ্যা মাত্র দশ হাজার, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আরও হাজার দশেক; তবে উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে তাদের।২২ বেশিরভাগ আল্ট্রা-অর্থডক্সরা যায়নবাদ বিরোধী হওয়ার চেয়ে বরং যায়নবাদ নিরপেক্ষ হলেও নেচারেই কারতা ও সাতমার হেরেদিমের মতো অন্য রেডিক্যালরা রাষ্ট্রের সাথে খুব ঘনিষ্ঠভাবে সহযোগিতা করার বিপদে থেকে তাদের মোকাবিলা করে। ইসরায়েল রাষ্ট্র থেকে তাদের সুদৃঢ় প্রত্যাহার প্রায়শঃই ইহুদি রাষ্ট্রে অখণ্ডতা ও নিখাঁদতার অভাব বোধকারী অধিকতর কম উৎসাহী হেরেদিমদের মনে করিয়ে দেয় যে, পার্থিব অর্থে ইসরায়েল যত শক্তিশালী ও সফল হয়ে উঠুক না কেন ইহুদিরা এখনও অস্তিত্বগত নির্বাসনে রয়ে গেছে, আধুনিক বিশ্বে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে অংশ নিতে পারবে না তারা।

ইসরায়েলকে শয়তানি সৃষ্টি ছাড়া অন্য কিছু মানতে হেরেদিদের এই অস্বীকৃতি তাদের অনেকেরই বাসস্থান এক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অব্যাহত বিদ্রোহেরই শামিল ছিল। তারা সাব্বাথে গাড়ি লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোঁড়া বা সাঁতারের পোশাকের বিজ্ঞাপনে স্বল্পবসনা নারীর ছবি ছেঁড়ার সময় তারা ইহুদি রাষ্ট্রের সেক্যুলার রীতিনীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে যেখানে কর্মতৎপরতার একমাত্র মাপকাঠি এর যৌক্তিক, বাস্তব উপযোগিতা। তিনটি একেশ্বরবাদী ধর্মবিশ্বসের সব কটিতেই মৌলবাদীরা আধ্যাত্মিকতাকে বর্জন করে আধুনিক সমাজে প্রাধ্যান্য বিস্তারকারী পবিত্রের আরোপিত সীমা অগ্রাহ্যকারী বাস্তবভিত্তিক লোগোসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে থাকে। কিন্তু সেক্যুলার প্রতিষ্ঠান অত্যন্ত শক্তিশালী বলে অধিকাংশকেই তাদের বিদ্রোহকে ছোট প্রতীকী কর্মকাণ্ডে সীমিত রাখতে হয়। তাদের দুর্বলতার বোধ ও উদাহরণ স্বরূপ, যুদ্ধের সময় রাষ্ট্রের উপর নির্ভরতার নীরব স্বীকৃতি কেবল মৌলবাদীদের ক্রোধই বাড়িয়ে তুলতে পারে। হেরেদিমদের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিশাল অংশ প্রতি পদক্ষেপেই তাদের মূল্যবোধকে চ্যালেঞ্জ করে চলা সেক্যুলার রাষ্ট্র থেকে দৃঢ় পশ্চাদপসরণ ও প্রতি-সংস্কৃতি গড়ে তোলার ভেতর তাদের প্রতিবাদ সীমিত রেখেছে।

হেরেদিমদের বিকল্প সমাজ আধুনিক রীতিনীতির কারণে সৃষ্ট শূন্যতা পূরণের আকাঙ্ক্ষায় অনুপ্রাণিত ছিল। হলোকাস্টের পর ইহুদিদের পক্ষে এই শূন্যতা ভীষণভাবে স্পষ্ট ছিল। প্রাণে বেঁচে যাওয়ারা ইসরায়েল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হাসিদিক সভা ও মিসনাগদিক ইয়েশিভোত পুনর্নির্মাণের দায় বোধ করেছে। হিটলারের মৃত্যু-শিবিরে প্রাণ হারানো লক্ষ লক্ষ হেরেদিমের প্রতি এটা ছিল ধার্মিকতার একটি আচরণ ও অশুভের শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। তাদের বিশ্বাস ছিল হেরাদি প্রতিষ্ঠানসমূহকে নতুন জীবন দান করে ও সেই মৃত জগৎকে আবার জীবিত করে কেবল বেঁচে থাকতেই দিয়ে নয় বরং আগের যেকোনও সময়ের চেয়ে বেশি শক্তিশালী করে পবিত্রের পক্ষে আঘাত হানছে তারা।২৩ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইসরায়েল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নতুন ইয়েশিভোত প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৪৩ সালে র‍্যাবাই আরন কোতলার (১৮৯১–১৯৬২) ফোলোঝিন, মির ও স্লোবোদকার ইয়েশিভোতের অনুসরণে নিউ জার্সির গেদোলাহয় বায়াস মিদ্রাশ প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে আমেরিকায় প্রথম লিথুয়ানিয় ইয়েশিভা স্থাপন করেন। ১৯৪৮ সালের পর তেল আভিভের কাছে নেই ব্রাক ‘তোরাহ নগরীতে’ পরিণত হয়। এর নব প্রতিষ্ঠিত ইয়েশিভা ইসরায়েল ও ডায়াসপোরার সব জায়গা থেকে ছাত্রদের আকর্ষণ করতে থাকে। এখানে পরিচালনাকারী চেতনা ছিলেন র‍্যাবাই আব্রাহাম ইয়েশাইয়াহু কারলিত্য (১৮৭৮-১৯৪৩), হাযন ইশ (তাঁর একটি গ্রন্থের নাম) নামেও পরিচিত ছিলেন তিনি। এইসব নতুন প্রতিষ্ঠান ইয়েশিভাকে আগের যেকোনও সময়ের চেয়ে হেরেদি জীবনের মূলে পরিণত করেছিল। তোরাহ পাঠ পরিণত হয়েছিল আজীবন পূর্ণকালীন প্রয়াসে। বিয়ের পরেও পুরুষরা পড়াশোনা চালিয়ে যেত, স্ত্রীরা তাদের আর্থিক সহযোগিতা দিত। বলতে গেলে গোটা ইউরোপিয় ইহুদি সম্প্রদায়কেই নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া আধুনিকতার নতুন বিপজ্জনক জগতে ইয়েশিভায় বাসকারী পণ্ডিতদের একটা ক্যাডারের বাইরের জগতের সাথে ন্যূনতম সম্পর্ক ছিল, নিজেদের পবিত্র টেক্সটে পরিপূর্ণভাবে মগ্ন করে রেখেছিলেন তাঁরা, ইহুদিবাদের নতুন অভিভাবকে পরিণত হবেন তাঁরা।২৪

কোতলারের বিশ্বাস ছিল তাঁর ছাত্ররাই গোটা বিশ্বের অস্তিত্বকে ধরে রেখেছে। স্রেফ মানুষকে তোরাহ পাঠে সক্ষম করে তোলার জন্যেই ঈশ্বর স্বর্গ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। একমাত্র ইহুদি জাতি দিনরাত তোরাহ পাঠ করলেই তার দায়িত্ব পালন হবে। তারা সেটা বন্ধ করে দিলে, ‘সমগ্র বিশ্বজগৎ সাথে সাথে ধ্বংস হয়ে যাবে।২৫ এটা পূর্ণ নিশ্চিহ্নতার সাথে সংঘর্ষের ফলে আবির্ভূত এক ধার্মিকতা। যেকোনও সেক্যুলার পাঠ কেবল সময়েরই অপচয় নয়, বরং তা খুনে জেন্টাইল সংস্কৃতির সাথে মিশে যাওয়ার শামিল। আধুনিক সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যকে আত্মস্থ করার প্রয়াসী ইহুদিবাদের যেকোনও ধরন-ধর্মীয়, যায়নবাদী, সংস্কার, রক্ষণশীল বা নিও- অর্থডক্স—অবৈধ।২৬ সম্প্রতি ইহুদিবাদকে ধ্বংস করার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করা এক বিশ্বে এমন কোনও আপোসের অবকাশ থাকতে পারে না। প্রকৃত ইহুদিকে অবশ্যই এই জগৎ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে সম্পূর্ণভাবে টেক্সটে নিমগ্ন করতে হবে। যুদ্ধোত্তর নতুন ইয়েশিভোত মৌলবাদী আধ্যাত্মিকতার মরিয়া ভাবের প্রতিফলন ঘটিয়েছে। বিংশ শতাব্দীতে আধুনিকতার সাথে বিধ্বংসী মোকাবিলার পর কেবল পবিত্র টেক্সটই অবশিষ্ট রয়ে গেছে। ছয় মিলিয়ন ইহুদিকে হত্যা করা হয়েছে। অগুনতি ধ্রুপদী ইহুদি শিক্ষার সাথে ইয়েশিভোত ও হাসিদিক সভাগুলো ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে; ঘেটোর জীবনধারা এবং এর সাথে সাথে প্রথাগত অনুসরণের শত বছরের আন্তরিক বিদ্যাও চিরকালের জন্যে হারিয়ে গেছে; পবিত্র ভূমি যায়নবাদীদের হাতে দূষিত হয়েছে। ধর্মপ্রাণ ইহুদিরা এখন কেবল ঈশ্বরের সাথে শেষ সম্পর্কটুকু ধরে রাখা টেক্সট আঁকড়ে ধরে থাকতে পারে।

হলোকাস্টের ধ্বংস তোরাহ পাঠের ধরনকেই পাল্টে দিয়েছিল। ঘেটো বিশ্বে প্রচলিত বহু আচার ও রেওয়াজ ‘নির্দিষ্ট’ বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল; জীবন যাপনের বা তোরাহ পালনের অন্য কোনও বিকল্প পথ ছিল না। প্রথম প্রজন্মের শরণার্থীদের তখনও এইসব আচার পালন করার জ্ঞান ছিল, কিন্তু নিহত পূর্বপুরুষের হারানো বিশ্বকে নতুন করে গড়ে তুলতে উদগ্রীব তাদের সন্তানসন্ততি ও প্রপৌত্ররা আর সহজাতভাবে আনুষ্ঠানিকভাবে কখনওই লিখিত রূপে রাখার প্রয়োজন অনুভূত হয়নি এমন সাম্প্রদায়িক পরিপালন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল না। অপসৃয়মান তোরাহ উদ্ধার করার একমাত্র উপায় ছিল বিচ্ছিন্ন তথ্যের জন্যে টেক্সটে অনুসন্ধান চালানো। ১৯৫০-র দশক থেকে ইয়েশিভাগুলো হলোকাস্ট পূর্ববর্তী ইউরোপে স্বাভাবিক ও প্রচলিত ধারা হিসাবে প্রতীয়মান বিভিন্ন অনুপুঙ্ক্ষ ও জটিল বিস্তারিত প্রক্রিয়ার বিজ্ঞ পাণ্ডুলিপিতে ভরে গিয়েছিল। প্রত্যেক পরবর্তী প্রজন্ম তাদের পূর্বসুরিদের চেয়ে আরও বেশি হারে এইসব পাণ্ডিত্যের উপর নির্ভর করবে।২৭ বিনাশের ফলে ইহুদি জীবন আরও টেক্সটমুখী ও আগের যেকোনও সময়ের চেয়ে বেশি করে লিখিত শব্দের উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছিল।

মৌলবাদী ইহুদিবাদে এক নতুন কঠোরতা দেখা দিয়েছিল। ১৯৬০-র দশক নাগাদ সেই সময়ের অতিথি বনেই ব্রাক র‍্যাবাই সিমলা এলবার্গ উল্লেখ করেছেন যে, ‘গোটা ধর্মীয় জীবনের সম্পূর্ণ সীমানা জুড়ে নিবিড় বিপ্লব’ ঘটছে। ‘তোরাহ নগরীর’ ইহুদিরা আগের যেকোনও সময়ের চেয়ে অনেক নিষ্ঠার সাথে নির্দেশনা মেনে চলছে।২৮ পূর্ববর্তী যুগের চেয়ে আরও পূর্ণাঙ্গভাবে আইন পালনের এই প্রয়াস বীরত্বসূচক: এটা নিষ্ঠুরভাবে ঈশ্বর শূন্য করে তোলা এক বিশ্বে ঈশ্বরকে মূর্ত করে তোলার এক ধরনের উপায়। বৃনেই ব্রাকের হেরেদিমরা খাদ্য ও পবিত্রতার বিষয়গুলোর মতো বিষয়ে আরও নিষ্ঠ ও সঠিক হওয়ার উপায় বের করার প্রয়াস পাচ্ছিল, যদিও তা তাদের জীবনকে আরও জটিল করে তুলেছিল।

১৯৩০-র দশকে হাযন ইশ এই সুর স্থির করে দিয়েছিলেন, তখন প্রথম বারের মতো প্যালেস্তাইনে পৌঁছেছিলেন তিনি। ধার্মিক যায়নবাদীদের একটা দল জিজ্ঞাসা নিয়ে এসেছিল তাঁর কাছে। বসতিতে ইহুদি কৃষি বিধান মেনে চলতে ইচ্ছুক ছিল তারা, তোরাহ মোতাবেক পবিত্র ভূমিতে খামার স্থাপন করতে চেয়েছে। তার মানে কি আইনে যেমন বিধান দেওয়া হয়েছে, প্রতি সাত বছরে একবার জমিন পতিত রাখতে হবে তাদের?২৯ এই ‘সাব্বাতিয় বছর’ পালন নিশ্চিতভাবেই দারুণ দুর্ভোগের জন্ম দেবে, এবং তা দক্ষতা সর্বোচ্চ করাই যার লক্ষ্য সেই আধুনিক কৃষিবিজ্ঞান বিরোধী। বসতিস্থাপনকারীদের জন্যে একটা ফাঁক খুঁজে বের করেছিলেন র‍্যাবাই কুক, কিন্তু হাযন ইশ কঠোরভাবে এই ধরনের শৈথিল্যের (কুলা) বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, কষ্টের ভেতরই রয়েছে চ্যালেঞ্জ। আইনের দাবি, কৃষকরা আরও ভালো কিছুর জন্যে তাদের সমৃদ্ধিকে বিসর্জন দেবে। সাব্বাতিয় বছর নির্ধারণ করা হয়েছে ভূমির পবিত্রতা উদযাপন, ইহুদিদের এর অলঙ্ঘনীয়তা সম্পর্কে সজাগ করে তোলার জন্যে এবং সকল পবিত্র বস্তুর মতো এটাও আবিশ্যিকভাবে ব্যক্তির প্রয়োজন ও ইচ্ছা থেকে বিচ্ছিন্ন। ইহুদিদের নিজস্ব লাভের জন্যে ভূমিকে ব্যবহার করা যাবে না, বর্ধিত উৎপাদনশীলতার জন্যে দোহন করা যাবে না বা ব্যয়সংকুলান মূলক ব্যবস্থার অধীন করা যাবে না। সত্যিকারের ধার্মিক কৃষকদের উচিত হবে সেক্যুলার অগ্রগামীদের যৌক্তিক মূলধারাকে চ্যালেঞ্জ করা, এরা যায়নবাদী’ হতে পারে, কিন্তু তা মোটেই ‘ইহুদিসুলভ’ নয়।

নেই ব্রাকে হাযন ইশ-র‍্যাবাই এলবার্গ যাকে ‘হুমরোতের বিশ্ব (‘কট্টরপন্থী’)’ বলে আখ্যায়িত করেছেন-এর নেতৃত্ব দান করছিলেন। শিষ্যদের নির্দেশনা পালনের জন্যে ‘সবচেয়ে সীমিতকারী, কঠোর ও যথার্থ’ উপায় বের করার শিক্ষা দিয়েছেন তিনি।৩১ এই অনুশীলন তাদের আধুনিকতার বাস্তববাদী রীতিনীতি থেকে সর্বাত্মকভাবে বিচ্ছিন্ন করবে। এই ধরনের কঠোরতা ইউরোপের প্রথাগত ইহুদি সম্প্রদায়ের রাব্বিনিক প্রতিষ্ঠানের ভ্রূকুটির শিকার হয়েছে। র‍্যাবাইগণ আইনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয় নিয়ে ভাবিত বিবেকবান লোকদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, কিন্ত সামগ্রিকভাবে গোটা সম্প্রদায়ের উপর এই কঠোরতা (হুমরা) চাপিয়ে দিতে সম্মত ছিলেন না, কারণ তাতে বিভাজন সৃষ্টি হতে পারত। পশু জবাই করার কঠোর মান অনুসরণকারী সম্প্রদায় থেকে আগত ইহুদিরা আরও শিথিলভাবে আইনের ব্যাখ্যাকারী ইহুদিদের সাথে একসাথে মাংস খেতে পারবে না। বাড়াবাড়ি ধরনের কঠোরতা এইসব বিষয়ে ততখানি কঠোর ছিলেন না অতীতের এমন সাধুদেরও বিরাট অসম্মান হবে। র‍্যাবাইগণ তোরাহর ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে শৈথিল্য প্রবণ ছিলেন: আধ্যাত্মিক অভিজাত একটি গোষ্ঠীকে সাধারণ ইহুদিদের পক্ষে অনুসরণ অসম্ভব করে তুলতে দেওয়া যাবে না।

বৃনেই ব্রাকের বিপ্লবী কঠোরতা ছিল হেরেদিমের নতুন প্রতি-সংস্কৃতির সৃষ্টির প্রয়াসের অংশ। এটা দক্ষতা ও বাস্তবাদীতাকে মূল মানদণ্ডে পরিণতকারী আধুনিকতার যৌক্তিক চেতনার সম্পূর্ণ বিপরীত এক ধর্মীয় মানদণ্ড স্থাপন করেছিল। সংস্কার, রক্ষণশীল ও নিও-অর্থডক্স ইহুদিরা আইনের কোনও একটা অংশ বিসর্জন দিচ্ছে বা আরও শিথিল ও যৌক্তিক জীবনের সন্ধান করছে, এমন একটা সময়ে হেরেদিমদের অধিকতর কঠোর পরিপালন মূলধারার সমাজের রেওয়াজের সাথে আপোসে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। নেই ব্রাক সফরের সময় র‍্যাবাই এলবার্গ লক্ষ করেছিলেন যে, এটা ‘নিজেই এক বিশ্বে’ পরিণত হয়েছে;৩৩ হেরিদি ইহুদিরা আধুনিক সমাজ থেকে কেবল প্রত্যাহৃতই হচ্ছে না, বরং অন্য কম নিয়মনিষ্ঠ ইাহুদিদের থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। ওদের ভিন্ন কসাইয়ের প্রয়োজন হচ্ছিল, কোশার খাবার সম্পর্কে গোঁড়া দোকান ও নিজস্ব আচরিক স্নানের প্রয়োজন হচ্ছিল। সময়ের মেজাজের বিপরীতে ভিন্ন পরিচয় গড়ে তুলছিল তারা।

একইভাবে ইয়েশিভোতে ইহুদিরা সেক্যুলার কলেজের ছাত্রদের মতো পরে বাস্তবক্ষেত্রে প্রয়োগ করার মতো তথ্যের জন্যে তোরাহ পাঠ করছিল না। তোরাহর বহু আইন, যেমন মন্দিরের আচার বা পশুবলী সম্পর্কিত বিধিবিধানসমূহ বাস্ত বায়নযোগ্য ছিল না; টর্টস ও ক্ষয়ক্ষতির বিধান মেসায়াহ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার পর হয়তো পুনর্বহাল করা যাবে। তারপরেও ছাত্ররা ঘণ্টার পর ঘণ্টা এমনকি বছর পর্যন্ত তাদের শিক্ষকদের সাথে আপাত অচল হয়ে যাওয়া বিধিবিধান পাঠে কাটিয়ে দিয়েছে, কারণ এগুলো ঈশ্বরের আইন। ঈশ্বর-কোনওভাবে-সিনাই পাহাড়ের চূড়ায় মোজেসকে আইন প্রদানের সময়ে যে বাণী উচ্চারণ করেছিলেন সেই হিব্রু শব্দের পুনরাবৃত্তি ঈশ্বরের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের একটা উপায়। আইনের প্রতিটি বিষয় অনুসন্ধান ছাত্রকে প্রতীকীভাবে ঈশ্বরের মনে প্রবেশে সক্ষম করে তোলে। ভীতিকরভাবে স্বর্গীয় আইন ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া একটা সময়ে ইহুদিরা আগের চেয়ে বেশি করে যথার্থভাবে এর পরিপালন করবে। নিজেকে অতীতের মহান র‍্যাবাইদের আইনি মতামতের সাথে পরিচিত করে তোলা ছাত্রের পক্ষে ঐতিহ্যকে মনে-প্রাণে আপন করে নেওয়ার ও সাধুদের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের একটা উপায়। ইয়েশিভোতে পাঠ পদ্ধতি উপকরণের মতোই জটিল ছিল। ইয়েশিভা শিক্ষার উদ্দেশ্য এই বিশ্বের বিরাট কোনও সুবিধা লাভ নয়, বরং ঈশ্বরকে ত্যাগের প্রয়াসী এক বিশ্বে স্বর্গীয় সত্তার অনুসন্ধান। ইয়েশিভা জগতের সব কিছুই বস্তুজগতের থেকে আলাদা। মূলধারার সমাজে পুরুষ (১৯৫০-র দশকে তখনও প্রধান লিঙ্গ বিবেচিত) ব্যবসার কাজে ঘরের বাইরে যায়, আর নারী ঘরে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকে। হেরেদিমদের মধ্যে নিম্নতর লিঙ্গই গোয়িমরা যাকে ‘প্রকৃত’ জাগতিক বিষয় বলে থাকে সেখানে অংশ নেয় (আভাসে এর গৌণ মর্যাদা ঘোষণা করে), অন্যদিকে পুরুষরা ইয়েশিভায় প্রকৃত বাস্তবতার সাথে সীমাবদ্ধ সুরক্ষিত জীবন যাপন করে। সেক্যুলার ইসরায়েলে সেনাবাহিনী প্রায় পবিত্র প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছিল, উভয় লিঙ্গের পক্ষেই জাতীয় সেবা বাধ্যতামূলক ছিল, একজন পুরুষ কর্মময় জীবনের গোটা সময় তার সেনা ইউনিটের অধীনে থাকবে। অবশ্য একজন ইয়েশিভা ছাত্র সামরিক চাকরি থেকে অব্যহতি লাভ করে, ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সেস (আইডিএফ)-এর প্রতি পিঠ ফিরিয়ে নিজেকে ইসরায়েলি জাতির প্রকৃত ‘অভিভাবক’ ঘোষণা করে এবং চারপাশ থেকে ইয়েশিভার উপর আগ্রাসীভাবে এগিয়ে আসা অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রথম কাতারে অবস্থান করার কথা ঘোষণা করে।৩৪

হেরেদিমের কাছে আধুনিকতা—এমনকি ইসরায়েলে রাষ্ট্রেও-স্রেফ নির্বাসন, বিচ্ছিন্নতা ও ঈশ্বরের কাছ থেকে দূরত্ব গালুতের সর্বশেষ অবস্থা। হলোকাস্ট এর আবিশ্যিক বৈরিতা তুলে ধরেছিল। এমন এক জগতে একজন ইহুদির স্বস্তি বোধ করার কথা নয়, যদিও বিপরীত দিক থেকে ইসরায়েল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুজায়গাতেই তোরাহ শিক্ষা উদারভাবে অর্থসংস্থান এবং আগের যেকোনও সময়ের চেয়ে বেশি বিকাশ লাভ করছিল। ছাত্রদের অবশ্য সেক্যুলার বিশ্ব থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখার শিক্ষা দেওয়া হচ্ছিল। একজন হেরেদি শিক্ষক যেমন ব্যাখ্যা করেছেন, ইয়েশিভা কেবল তরুণদের ‘তোরাহর প্রতি পূর্ণ আনুগত্যেরই শিক্ষা’ দেয়নি, বরং ‘এই বিশ্ব থেকে দূরত্ব বজায় রাখার পদ্ধতির শিক্ষা দিয়েছে। ইয়েশিভার প্রাচীরগুলো তোরাহ যে কোনওদিনই গালুতে স্বস্তি বোধ করতে পারে না তারই স্মারক। ছাত্রদের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্নতা বাড়ানোর লক্ষ্যেই প্রতি-সংস্কৃতির পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এডুকেশন ইন দ্য ফেস অভ দ্য জেনারেশেন-এ (১৯৫৪) আভ্রাহাম উল্ফ যেমন উল্লেখ করেছেন, সেক্যুলারিস্টদের নিস্পৃহতা সত্ত্বেও ইয়েশিভা ইহুদি বাপ-দাদার জগৎকে পুনরুজ্জীবিত করার দায়িত্বে নিবেদিত। ‘একাজে আমরা একা। আমরা আমাদের চারপাশের সবার চেয়ে ভিন্ন। সংস্কার ইতিহাসবিদগণ…কবি [অন্যরা তাদের মহান ব্যক্তি মনে করে]।’ এমনকি ইহুদি রাষ্ট্রেও হেরেদিম বিচ্ছিন্ন। ‘পথঘাটের নাম রাখা হয়েছে ঐতিহসিক চরিত্রের নামে, আমরা যাদের একেবারেই নেতিবাচক আলোয় দেখি। আমরা একা।৩৬

যৌক্তিক আধুনিকতার বিরুদ্ধে হেরেদি বিদ্রোহ ব্যাপকভাবে পিছু হটায় সৃষ্ট। কিন্তু এই সময়ে রাশিয়ায় হাবাদ ইয়েশিভায় দীর্ঘদিন ধরে জঙ্গী মানসিকতাকে লালনকারী লুবাভিচ হাসিদিম আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। বলশেভিকরা কার্যত রাশিয়ায় হাবাদকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। ইহুদি স্কুল ও ইয়েশিভাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তোরাহ পাঠকে প্রতিবিপ্লবী হিসাবে নিন্দা জানানো হয়েছে, উপেক্ষা করার মানে ছিল উপবাস, কারাবাস বা মৃত্যুদণ্ড। ষষ্ঠ রেব্বে (জোসেফ ইসাক শিয়ারসন, ১৮৮০-১৯৫০) এইসব ব্যবস্থাকে কেবল ‘মেসায়াহর জন্ম বেদনা’ হিসাবেই দেখেছিলেন। ধার্মিকের এই জগৎ থেকে প্রত্যাহারই যথেষ্ট নয়; হাসিদিমকে অবশ্যই ঈশ্বরের জন্যে এই আধুনিক বিশ্বকে অধিকার করে নিতে হবে। রাশিয়ায় রেব্বে একটি ইহুদি গোপন সংগঠন গড়ে তোলেন, এখানে হাবাদ ইয়েশিভার স্নাতকদের তোরাহ ও তালমুদের ক্লাস করানো হত। তরুণ ইহুদিদের সারা বিশ্বের লুবাভিচদের সাথে যোগাযোগ রক্ষার জন্যে নতুন যোগাযোগ কৌশল শিক্ষা দেওয়া হত। হিটলারের কাছ থেকে পালিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আসতে বাধ্য হওয়ার পর রেব্বে মিশন অব্যাহত রাখেন ও নতুন বিশ্বে মিশে যাওয়া বা নিজেদের উন্মুল মনে করা ইহুদিদের ফিরিয়ে আনার অভিযানে নামেন। প্রত্যাহারের বদলে এটা ছিল হাত বাড়ানো। ১৯৪৯ সালে রেব্বে কফার ইসরায়েলে প্রথম হাসিদিক বসতি হাবাদ প্রতিষ্ঠার এক দর্শনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। যায়নবাদের প্রতি বৈরিতা একবিন্দুও কমাননি তিনি, বরং বিশ্বাস করেছিলেন যে শেষের এই কালে তাঁর কর্মকাণ্ডকে অবশ্যই ইসরায়েলের অপবিত্র ভূমির ইহুদিদের কাছে পৌঁছাতে হবে।৩৭

১৯৫০ সালে রেব্বে পরলোক গমন করলে তাঁর মেয়েজামাই র‍্যাবাই মেনাচেম মেন্দেল শিয়ারসন (১৯০৪-৯৪) উত্তরাধিকারী হন। এটা ছিল এক বিস্ময়কর পরিবর্তন, সেক্যুলার বিশ্বকে পরিবর্তনের লক্ষ্যে তাকে আলিঙ্গন করার হাবাদের ইচ্ছাকেই তুলে ধরতে হবে যাকে। সপ্তম রেব্বে ইয়েশিভায় শিক্ষিত ছিলেন না, আধুনিক শিক্ষা লাভ করেছিলেন তিনি। বার্লিনে ইহুদি দর্শনে ও সবোর্নে মেরিন এঞ্জিনিয়ারিং পড়াশোনা করেছেন। ১৯৪১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পৌছানোর পর নৌবাহিনীর পক্ষে কাজ করেছেন, কিন্তু শ্বশুরের কাজেও সাহায্য করেছিলেন। এই রেব্বে আধুনিক বিশ্বের সৃষ্টি ছিলেন, সারা বিশ্বের সকল ইহুদিকে উদ্ধার করার লক্ষ্যে দক্ষ প্রচারমাধ্যমের প্রচারণা চালাতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। এখন কেবল ইয়েশিভা ছাত্ররাই রেব্বের সেনাদলের সৈনিক হবে না, বরং প্রতিটি হাবাদ ইহুদি এই দায়িত্ব পাবে। সযত্নে তাঁর অভিজান পরিকল্পনা করেছিলেন রেব্বে। ১৯৭০-র দশকে সেক্যুলারাইজেশন ও মিশ্রণের বিরুদ্ধে এক ব্যাপক পাল্টা আক্রমণের সূচনা করেছিলেন তিনি। দূরবর্তী শহরে বসতি স্থাপন করার জন্যে হাজার হাজার তরুণ- তরুণীকে লুবাভিচে পাঠানো হবে যেখানে ইহুদিরা হয় সম্পূর্ণ সেক্যুলারাইজড হয়ে গেছে বা সংখ্যালঘু হিসাবে বাস করছে। এই বাড়িটি হবে ইহুদিবাদের বিভিন্ন তথ্যের যোগান দেওয়া একটি ‘ড্রপ-ইন’ সেন্টার যা সাব্বাথের আয়োজন করবে ও উৎসবের অনুষ্ঠান করবে, লেকচার ও ক্লাস নেবে। অন্য তরুণ হাসিদিমদের পাঠানো হবে আমেরিকার ক্যাম্পাস ও রাস্তায়, যেখানে তারা পথে দেখা পাওয়া ইহুদিদের সাথে পরিচিত হয়ে তেফেলিন পরা বা প্রার্থনা বাণী উচ্চারণ করার মতো যেকোনও একটি নির্দেশনা প্রকাশ্যে পালনে সম্মত করাবে। এই আচার প্রত্যেক ইহুদির হৃদয়ে প্রোথিত স্বর্গীয় ‘স্ফুলিঙ্গ’ স্পর্শ করে তার আবিশ্যিক পবিত্রতাকে জাগিয়ে তুলবে বলে ধারণা করা হয়েছিল।৩৮

রেব্বে এই জগতেই স্বস্তি বোধ করেছেন। তাঁর বৈজ্ঞানিক জ্ঞান হাবাদ হাসিদিমের প্রাচীন জ্ঞানের সাথে সহাবস্থান করে। মেরিন বায়োলজিতে তাঁর শিক্ষা স্বর্গীয় স্ফুলিঙ্গের দর্শন থেকে তাঁকে বিচ্যুত করেনি; তিনি এক শক্তিশালী মেসিয়ানিজম গড়ে তুলবেন এবং ষষ্ঠ রেব্বের সাথে ঐশ্বরিক সম্পর্ক থাকার দাবি করে হাবাদের নেতৃত্বে নির্বাচিত হবেন। তাঁর আধ্যাত্মিকতায় লোগোস ও মিথোস অন্তর্দৃষ্টির সম্পূরক উৎস। তিনি বাইবেলকে যেকোনও প্রোটেস্ট্যান্ট মৌলবাদীর মতোই আক্ষরিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারতেন, বিশ্বাস করতেন ঠিক ছয় হাজার বছর আগে ঈশ্বর মাত্র ছয় দিনে এই পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু আবার এও বিশ্বাস করতেন যে, দেহ ও মনের সম্পর্ক বা বস্তু ও শক্তির ভেতরকার সম্পর্ক নিয়ে আধুনিক বিজ্ঞানের আবিষ্কারসমূহ মানবজাতিকে বাস্তবতার জৈবিক ঐক্যের এক নতুন উপলব্ধির দিকে নিয়ে যাচ্ছে, যা শেষ পর্যন্ত একেশ্বরবাদের প্রতি উন্মুখ করে তুলবে।৩৯ তাঁর ব্যাপক প্রচারণা আধুনিক ভাবধারায় পরিকল্পিত ছিল। কীভাবে নিজের সম্পদকে ব্যবহার করতে হবে এবং সেক্যুলারাইজড নারী-পুরুষের সাথে কথা বলতে হবে সেটা বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। তবে মনে হয় হাবাদের পুরাণ ও অতীন্দ্রিয়বাদ লুবাভিচকে আত্মরক্ষামূলকভাবে পিছু না হটে জগতের দিকে অগ্রসর হওয়ার আত্মবিশ্বাসের যোগান দিয়েছিল। সাম্প্রতিক রেব্বেরা আলোকনের চেতনা থেকে পিছু হটে গিয়েছিলেন, কিন্তু প্রথম রেব্বে ও হাবাদের প্রতিষ্ঠাতা তাঁর হাসিদিমকে তাঁদের কালের পৃথিবী সম্পর্কে একটি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির চর্চায় সাহায্য করেছেন। অতীন্দ্রিয়বাদী প্রেক্ষাপটে যৌক্তিক ক্ষমতা ব্যবহার করে ঠিক খোদ যালমানের মতোই সপ্তম রেব্বে যেন এই আদি চেতনায় ফিরে গিয়েছিলেন। হাবাদ পবিত্র ও অপবিত্রের আধুনিক বিচ্ছিন্নতা গ্রহণে অস্বীকার গেছে। যত জাগতিক ও তুচ্ছই হোক না কেন, সব কিছুই স্বর্গীয় স্ফুলিঙ্গ ধারণ করে। ‘সেক্যুলার ইহুদি’ বলে কেউ নেই, এমনকি গোয়িমেরও সম্ভাব্য পবিত্রতা রয়েছে। জীবনের শেষ দিকে অন্তিম কাল আসন্ন বিশ্বাস করে রেব্বে আমেরিকার জেন্টাইলদের উদ্দেশে প্রচারাভিযানে নেমেছিলেন, তিনি স্বীকার করেছিলেন ইহুদিদের প্রতি ভালো ছিল তারা। লুবাভিচ আধুনিক কালে দারুণ ভুগেছে, কিন্তু রেবে তাদের গালুতকে সম্পূর্ণ দানবীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে না দেখার প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন, প্রতিশোধ ঘৃণার ফ্যান্টাসি লালন না করে বিশ্বকে এমন একটি স্থান হিসাবে কল্পনা করতে বলেছেন যেখানে ঐশী সত্তাকে নতুন করে সূচিত করতে পারবে তারা। ৪০

*

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রোটেস্ট্যান্ট মৌলবাদীরা শেষ পর্যন্ত তাদের পরাস্তকারী আধুনিকতার বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণের সূচনা করবে, কিন্তু বর্তমান আলোচিত কালে তারা হেরেদি ইহুদিদের মতো নিজস্ব আত্মরক্ষামূলক প্রতি-সংস্কৃতি গড়ে তুলছিল। স্কোপস ট্রায়ালের পর প্রোটেস্ট্যান্ট মৌলবাদীরা সাধারণ বলয় থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়ে নিজস্ব গির্জা ও কলেজে আশ্রয় নিয়েছিল। উদার ক্রিশ্চানরা ধরেই নিয়েছিল যে, মৌলবাদী সংকটের অবসান ঘটেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ নাগাদ মৌলবাদী দলগুলোকে যেন তাৎপর্যহীন প্রান্তিক গোষ্ঠী মনে হচ্ছিল। মূলধারার গোষ্ঠীগুলোই সংখ্যাগরিষ্ঠ বিশ্বাসীদের আকর্ষণ করছিল। কিন্তু অদৃশ্য হওয়ার বদলে মৌলবাদীরা স্থানীয় পর্যায়ে শেকড় বিস্তার করছিল। মূল- ধারার গোষ্ঠীতে তখনও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মৌলবাদী রয়ে গিয়েছিল; উদারপন্থীদের বহিষ্কারের সকল আশা হারিয়ে বসলেও ‘মৌলবিষয়ে’ বিশ্বাসকে বিসর্জন দেয়নি তারা, সংখ্যাগরিষ্ঠ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। অতি-রেডিক্যাল, বিশেষ করে তুরীয় আনন্দের জন্যে অপেক্ষা করার সময়টুকুতে নিজেদের ঈশ্বরবিহীন উদারপন্থীদের থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা পবিত্র দায়িত্ব বলে বিশ্বাসকারী প্রিমিলেনিয়ানরা নিজস্ব চার্চ গঠন করে। এক নতুন প্রজন্মের ইভাঞ্জেলিস্টদের পরিকল্পনায় নতুন সংস্থা ও নেটওয়ার্ক গঠন করতে শুরু করেছিল তারা। ১৯৩০ সাল নাগাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অন্ততপক্ষে পঞ্চাশটি মৌলবাদী বাইবেল কলেজ ছিল। মহামন্দার বছরগুলোতে আরও ছত্রিশটি কলেজ স্থাপন করা হয়। ইলিনয়ের মৌলবাদী হুইটন কলেজ ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্রুত বিকাশ লাভকারী উদারপন্থী আর্ট কলেজ। মৌলবাদীরাও তাদের নিজস্ব প্রকাশনা ও প্রচারণা সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল। ১৯৫০-র দশকে টেলিভিশনের আগমন ঘটলে তরুণ গ্রাহাম, রেক্স হামবার্দ ও ওরাল রোবার্টস পুরোনো ভবঘুরে যাজকদের স্থান দখল করে ‘টেলিভেঞ্জালিস্ট’ হিসাবে মিনিস্ট্রি চালু করেন ১ এক বিশাল আপাত অদৃশ্য প্রচারণা নেটওয়ার্ক সারা দেশের মৌলবাদীদের সংযুক্ত করেছিল। নিজেদের তারা বহিরাগত ভেবেছে, কিন্তু তাদের নতুন কলেজ ও টেলিভিশন কেন্দ্রগুলো বৈরী বিশ্বে তাদের আবাসের ব্যবস্থা করেছিল।

প্রোটেস্ট্যান্ট মৌলবাদীদের নির্মিত এই প্রতি-সংস্কৃতিতে তাদের কলেজগুলো ছিল চারপাশের অপবিত্রের মাঝে নিরাপদ পবিত্র ছিটমহল। বিচ্ছিন্নতার মাধ্যমে পবিত্রতা সৃষ্টির প্রয়াস পাচ্ছিল তারা। ফ্লোরিডায় ১৯২৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এবং দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার গ্রিনভিলে চূড়ান্ত আবাস পাওয়ার আগে টেনেসিতে স্থানান্তরিত বব জোনস ইউনিভার্সিটি নতুন মৌলবাদী প্রতিষ্ঠানের রীতিকে মূর্ত করে তুলেছে। এর প্রতিষ্ঠাতা বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের তরুণ ইভাঞ্জেলিস্ট বুদ্ধিজীবী ছিলেন না, কিন্তু একটি নিরাপদ স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন তিনি যা তরুণদের নাস্তিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার সময় তাদের বিশ্বাস রক্ষায় সাহায্য করবে; তিনি বিশ্বাস করতেন নাস্তিক্যবাদ সেক্যুলার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আবৃত্ত করে রেখেছে।৪২ উদার শিল্পকলার পাশাপাশি ছাত্রদের ‘সাধারণ জ্ঞানের’ ক্রিশ্চান ধৰ্ম শিক্ষা দেওয়া হত। প্রত্যেক সেমিস্টারে প্রত্যেককে অন্তপক্ষে একটি বাইবেল কোর্স নিতে হত, চ্যাপেলে যোগ দিতে হত এবং পোশাক, সামাজিক মেলামেশা ও সাক্ষাতের কঠিন নিয়মসহ ‘ক্রিশ্চান’ জীবনধারা মোতাবেক চলতে হত। অমান্যকরণ ও অনুগত্যহীনতা, বব জোন্স জোরের সাথে বলেছেন, ‘ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ’ এবং তা সহ্য করা হত না।৪৩ কর্মচারী ও ছাত্রদের সমানভাবে নিয়ম মেনে চলতে হত। বব জোনস ইউনিভার্সিটি নিজেই ছিল একটা ভিন্ন জগৎ: সেক্যুলার প্রতিষ্ঠানের সাথে আপোস পাপ বিশ্বাস করে একাডেমিক এক্রিডিশন না নেওয়ার কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল একে।88 এই বিসর্জন বিশ্ববিদ্যালয়টিকে ভর্তি, পাঠ্যক্রম নির্ধারণ ও লাইব্রেরির সম্পদ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সক্ষম করে তুলেছিল।

এই শৃঙ্খলাটুকু জরুরি ছিল, কারণ বিজেইউ-ছাত্রদের জানা ছিল যে তারা যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। একটি সাম্প্রতিক আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ক্যাটালগ যেমন ব্যাখ্যা করেছে, এই স্কুল ‘ঐশীগ্রন্থের উপর সকল নাস্তিক্যবাদী, সংশয়বাদী ও মানবতাবাদী আক্রমণের বিরুদ্ধে’; সকল ‘তথাকথিত আধুনিকতাবাদী,’ ‘উদার, ’ ও ‘নিও অর্থডক্স’ অবস্থান ও ‘নব্য ইভাঞ্জেলিস্টদের অ-ঐশীগ্রন্থীয় আপোস ও ‘ক্যারিশম্যাটিকদের অ-ঐশীগ্রন্থীয় অনুশীলনের বিরুদ্ধে।৪৫ ছাত্র ও কর্মচারীরা ধর্মবিশ্বাসকে রক্ষা ও প্রতিপক্ষের উপর হামলা শানাতে জগৎ হতে প্রত্যাহৃত হয়েছে। এই ‘বিচ্ছিন্নতা’, বব জোন্সের ছেলের (দ্বিতীয় বব জোন্স) মতে ‘মৌলিক সাক্ষী ও সাবুদের একান্ত ভিত্তি।’৪৬ বিশ্বাসের এই ঘাঁটি থেকে ছাত্ররা ‘ধর্মের শত্রুদের আক্রমণ করার মাধ্যমে’৪৭ ‘বাইবেলিয় কর্তৃত্ব ও ভ্রান্তিহীনতার’ পক্ষে উগ্রভাবে লড়াই করবে। আমেরিকার একাডেমিয়ার উপর বিজেইউ-র সামান্যই প্রভাব ছিল, তবে ক্রিশ্চান জাতির উপর এর প্রভাব ব্যাপক। বব জোন্স ইউনিভার্সিটি দেশের মৌলবাদী শিক্ষকদের সবচেয়ে বড় যোগানদাতায় পরিণত হয়েছে; গ্র্যাজুয়েটরা উদার শিক্ষার জন্যে না হলেও তাদের আত্মসংযমের জন্যে পরিচিত 1

এই বছরগুলোতে প্রতিষ্ঠিত বাইবেল কলেজ ও মৌলবাদী বিশ্বাবিদ্যালয়গুলো হেরেদি ইয়েশিভার মতো বিচ্ছিন্ন দুর্গ ছিল। মৌলবাদীরা মনে করেছে তাদের ধর্ম বিশ্বাস বিপদাপন্ন; আমেরিকান জীবনধারার কেন্দ্র থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে তাদের, নিজেদের ‘দরজার ওপাশের’ লোক হিসাবে দেখার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে।৪৮ উগ্রতা গভীরতর ক্রোধ প্রকাশ করে। এই বছরগুলোয় জনসংখ্যার সবচেয়ে প্রান্তিকায়িত অংশের ভীতি, ঘৃণা ও কুসংস্কারের অনেকটাই ভাষা দেওয়া অধিকতর চরমপন্থী ক্রিশ্চানদের উচ্চারণে তা প্রকাশ পেয়েছে। ১৯২০-র দশকে বিবর্তনের শিক্ষার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার লক্ষ্যে ডিফেন্ডার্স অভ ক্রিশ্চান ফেইথের সংগঠক ব্যাপ্টিস্ট জেরাল্ড উইনরড ১৯৩০-র দশকে নাৎসি জার্মানি সফর করে আমেরিকান জনগণের কাছে ‘ইহুদি ভীতি’ প্রমাণ করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে ফিরে আসেন। একই সময়ে তিনি রুজভেল্টের ‘জুইশ নিউ ডিল’কে শয়তানীসুলভ বলে প্রত্যাখ্যান করেন। কার্ল ম্যাকইন্টায়ার ও বিলি জেমস হাগরিসের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সব রকম ‘উদারনৈতিক’ প্রবণতার বিরোধিতা করেন উইনরড। মৌলাবাদীরা সেক্যুলারিস্ট বা ক্রিশ্চান যে ধরনেরই হোক না কেন ‘প্ৰকৃত’ ক্রিশ্চানদের প্রান্তিক মর্যাদার কারণে উদারপন্থীদের নিন্দা করেছে। রাজনৈতিক ডানপন্থার দিকে সরে যেতে শুরু করছিল তারা। উনবিংশ শতাব্দীতে ইভাঞ্জেলিকালরা দেশপ্রেমকে বহুঈশ্বরবাদীতা মনে করেছে। এখন আমেরিকান জীবনধারার পক্ষে দাঁড়ানো পবিত্র দায়িত্বে পরিণত হয়েছে। কমিউনিস্ট বিরোধী মিনিস্ট্রি ক্রিশ্চান ক্রুসেডের প্রতিষ্ঠাতা হাগরিস সোভিয়েত ইউনিয়নকে দানবীয় মনে করেছেন, তিনি তাঁর চোখে কমিউনিস্ট অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে ক্লান্তিহীন লড়াই করে গেছেন: উদার সংবাদপত্র, বামপন্থী শিক্ষক এবং সুপ্রিম কোর্টসহ সকলে তাঁর চোখে আমেরিকাকে ‘লাল’-এ পরিণত করার ষড়যন্ত্রেরই অংশ ছিল। বাইবেল প্রেসবিটারিয়ান চার্চ অ্যান্ড দ্য ফেইথ থিওলজিক্যাল সেমিনারি প্রতিষ্ঠার জন্যে প্রেসবিটারিয়ান চার্চ থেকে বের হয়ে আসা কার্ল ম্যাকইন্টায়ার সর্বত্র গোপন শত্রুর দেখা পেয়েছেন। খোদ মূলধারার গোষ্ঠীগুলোই আমেরিকায় ক্রিশ্চান ধর্মকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রের অংশ। ১৯৫০-র দশকে জোসেফ ম্যাককার্থির সাথে কমিউনিস্ট বিরোদী ক্রুসেডে যোগ দেন ম্যাকইন্টায়ার। টিপিক্যাল ছিলেন না এই চরমপন্থীরা, বরং প্রভাবশালী ছিলেন। ১৯৩৪ সাল নাগাদ প্রায় ৬,০০,০০০ লোক উইনরডের ডিফেন্ডার ম্যাগাজিনের গ্রাহক হয়েছিল; ১২০,০০০ জন ম্যাকইন্টায়ারের ক্রিশ্চান বীকন গ্রহণ করেছিল। রেডিও অনুষ্ঠান টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ক্রিশ্চান আওয়ারের মাধ্যমে ম্যাকইন্টায়ার আরও হাজার হাজার মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছিলেন, এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ঘৃণার ধর্মতত্ত্বে বিশ্বাস করে না এমন সকল ক্রিশ্চান এবং অজ্ঞদের কাছে দয়াময় ও ক্রিশ্চান মনে হতে পারে কিন্তু আসলে যারা ‘নাস্তিক্যবাদী, কমিউনিস্ট ভাবধারার, বাইবেলকে পরিহাসকারী, রক্ত-ঘৃণাকারী, মুখখিস্তিকারী, যৌন শৃঙ্খলিত সবুজ চোখ দানবের সন্তান’* সকল উদার যাজকের নিন্দা করা হয়েছে।

মৌলবাদ ক্রোধের ধর্মে পরিণত হচ্ছিল, কিন্তু হেরেদি ইহুদিবাদের মতো এই ক্রোধ ছিল গভীর ভীতিতে প্রোথিত। এই সময়ের বৈশিষ্ট্যে পরিণত হওয়া প্রিমিলেনিয়ালিজমে এই বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নাগাদ কেবল প্রিমিলেনিয়ালিস্টরাই নিজেদের ‘মৌলবাদী’ আখ্যায়িত করেছিল; বিলি গ্রাহামের মতো অন্য রক্ষণশীল ক্রিশ্চানরা নিজেদের ‘ইভাঞ্জেলিস্ট’ বলতেই পছন্দ করতেন: এই পচা সভ্যতার আত্মাকে রক্ষা করার দায়িত্ব ধর্মীয় বিশ্বাস যাই হোক না কেন অন্য ক্রিশ্চানদের সাথে কিছু মাত্রার সহযোগিতা দাবি করে। অবশ্য মৌলবাদীদের মূলধারা বিচ্ছিন্নতা ও ভিন্নতার উপরই জোর দিয়ে গেছে। যুদ্ধের বছরগুলো যেন উদারপন্থীদের পোস্টমিলেনিয়াল আশাবাদ তিরোহিত হয়েছে বলে মনে হয়েছে; মৌলবাদীরা নতুন জাতিসংঘ-কে পুরোনো লীগ অভ নেশনস-এর মতোই নেতিবাচক আলোকে দেখেছে। এটা পৃথিবীকে অ্যান্টিক্রাইস্টের স্বৈরাচার ও আসন্ন দুর্ভোগের জন্যে প্রস্তুত করবে। বিশ্বশান্তি বলে কিছু থাকবে না। “বাইবেল এই ধরনের ইউটোপিয় স্বপ্নের বিরোধিতা করে,’ ১৯৪২ সালে লিখেছেন হারবার্ট লকিয়ার। ‘এটাই শেষ যুদ্ধ নয়। বর্তমান ভয়াবহতা আসলে আরও ভয়ঙ্কর কষ্টের জন্ম দেওয়া বীজমাত্র।’৫১ উদারপন্থীদের দৃষ্টিভঙ্গির একেবারেই বিপরীত ছিল এটা। আমেরিকায় আধুনিক বিশ্ব সম্পর্কে একে অন্যের দৃষ্টিভঙ্গি মেনে নিতে অপারগ ‘দুই জাতি’ ছিল। প্রিমিলেনিয়াল দর্শন মৌলবাদীদের যারপরনাই অসহায়ত্বের বোধের সাক্ষ্য দেয়। তাদের বিশ্বাস ছিল পারমাণবিক বোমা ছিল সেইন্ট পিটারের ভবিষ্যদ্বাণী, যিনি আভাস দিয়েছিলেন যে, অন্তিমকালে ‘সগর্জনে আকাশ অদৃশ্য হয়ে যাবে, নানা উপাদান আগুন ধরে ছিনভিন্ন হবে, পৃথিবী ও এর অভ্যন্তরস্থ সমস্ত কিছু জ্বলে-পুড়ে খাক হয়ে যাবে।৫২ চূড়ান্ত হলোকাস্ট এড়ানোর কোনওই আশা নেই, ১৯৪৫ সালে ইটারনিটি ম্যগাজিনে ভাবনা প্রকাশ করেছেন ডেভিড গ্রে বার্নহাউস: ‘ঐশী পরিকল্পনা অনিবার্য বাস্তবায়নের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। বেস্টসেলার দ্য অ্যাটোমিক এজ অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ড অভ গড-এ (১৯৪৮) মৌলবাদী লেখক উইলবার স্মিথ যুক্তি দেখিয়েছেন, বোমা প্রমাণ করেছে যে, অক্ষরবাদীরা আগাগোড়াই সঠিক ছিল।৫৩ ঐশীগ্রন্থে পারমাণবিক বোমার সঠিক পূর্বাভাস দেখিয়েছে যে বাইবেল আসলেই নির্ভুল এবং একে এর সহজ অর্থেই পাঠ করতে হবে।

তারপরেও এই অদৃষ্টবাদী দৃশ্যপট আবার মূলধারার সংস্কৃতির কারণে নিজেদের ঘৃণিত ও সমাজ-বিচ্ছিন্ন বোধকারী মৌলবাদীদের এক ধরনের আত্মবিশ্বাস ও প্রাধান্যের বোধ যুগিয়েছে। তাদের কাছে ছিল সেক্যুলারিস্ট বা উদারপন্থী ক্রিশ্চানদের বঞ্চিত করা বাড়তি সুবিধাজনক তথ্য, তারা জানে আসলে কী ঘটছে। বিংশ শতাব্দীর বিপর্যয়কর ঘটনাপ্রবাহ আসলে ক্রাইস্টের চূড়ান্ত বিজয়ের দিকে পরিচালিত করছে। তাছাড়া, পারমাণবিক হলোকাস্ট সত্যিকারের বিশ্বাসীদের ক্ষতি করবে না, কারণ আমরা যেমন দেখেছি, তারা নিশ্চিত ছিল, সমাপ্তির আগে তাদের তুরীয় আনন্দের মাধ্যমে স্বর্গে তুলে নেওয়া হবে। কেবল ধর্মদ্রোহী ও অবিশ্বাসীরাই এইসব চূড়ান্ত শাস্তি ভোগ করবে। সুতরাং গস্পেলের মৌল চেতনার সাথে খাপ খায় না এমন প্রতিশোধের ফ্যান্টাসি লালন করার সুযোগ করে দিয়ে মৌলবাদীদের অনুভূত অসন্তোষকে ইন্ধন যোগানোই ছিল প্রিমিলেনিয়ালিজম। নতুন ইসরায়েল রাষ্ট্র সম্পর্কে তাদের আপাত ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতেও স্ববিরোধিতা ছিল।

প্রিমিলেনিয়ালিজমের প্রতিষ্ঠাতা জন ডারবির দর্শনে ইহুদি জাতিই ছিল মূল বিষয়। মৌলবাদীরা ১৯১৭ সালের বেলফোর ঘোষণায় শিহরিত হয়েছিল ও ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রকৃত সৃষ্টিকে মৌলবাদী যাজক জেরি ফলওয়েল কর্তৃক ‘জেসাস ক্রাইস্টের পুনরাগমনের একক মহান লক্ষণ’ হিসাবে দেখা হয়েছিল; বেন গুরিয়নের ইসরায়েল রাষ্ট্রের ঘোষণা দেওয়ার তারিখ ১৪ই মে, ১৯৪৮-কে জেসাসের স্বর্গারোহণের পর ইসরায়েলের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসাবে দেখেছেন তিনি।৪ ইসরায়েলের পক্ষে সমর্থন দান বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়িয়েছে; ইসরায়েলের ইতিহাস মানুষের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে, চিরকাল ঈশ্বর স্বয়ং তা নির্ধারণ করে আসছেন। ইহুদিরা পবিত্রভূমিতে বাস না করলে ক্রাইস্ট ফিরে আসতে পারবেন না, সূচনা হতে পারবে না অন্তিমকালের।

প্রোটেস্ট্যান্ট মৌলবাদীরা উৎসাহী যায়নবাদী হলেও তাদের দর্শনের একটা অন্ধকার দিক ছিল। জন ডারবি শিক্ষা দিয়েছিলেন যে, অন্তিম কালে অ্যান্টিক্রাইস্ট প্যালেস্তাইনে বসবাসকারী দুই তৃতীয়াংশ ইহুদিকে হত্যা করবে: যাকারিয়াহ এই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন; এবং এমনি অন্যসব ভবিষ্যদ্বাণীর মতো তাঁর বক্তব্যকে ও আক্ষরিকভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে।৫৬ মৌলবাদীদের কেউ কেউ হলোকাস্টকে ইহুদিদের পরিবর্তন করার ঈশ্বরের শেষ প্রয়াস হিসাবে দেখেছে এবং দুঃসময়ের পূর্ব নজীর মনে করেছে। ইসরায়েল অ্যান্ড প্রফিসি-তে দ্রুতপ্রজ মৌলবাদী লেখক জন ভালভুর্দ ভবিষ্যদ্বাণীর সমাবেশের উপর ভিত্তি করে ইহুদিদের এই চূড়ান্ত নির্যাতনের বিস্তারিত সময়সূচি তুলে ধরেছেন। অ্যান্টিক্রাইস্ট ইহুদিদের মন্দির নির্মাণে সাহায্য করবে, অনেককেই নিজেকে মেসায়াহ বিশ্বাস করাতে সক্ষম হবে; কিন্তু তারপর নতুন মন্দিরে উপাসনার বস্তু হিসাবে নিজের প্রতিমা স্থাপন করবে। এই ধর্মদ্রোহের পর ১৪৪,০০০ ইহুদি অ্যান্টিক্রাইস্টকে প্রত্যাখ্যান করবে, আবার ফিরে আসবে ক্রিশ্চান ধর্মে, শহীদ হিসাবে প্রাণ হারাবে। অ্যান্টিক্রাইস্ট এরপর জঘন্য নিপীড়ন শুরু করবে, বিপুল সংখ্যায় মারা যাবে ইহুদিরা। জেসাসকে তাঁর দ্বিতীয় আগমনে স্বাগত জানানোর জন্যে মাত্র অল্প কয়েকজন রেহাই পাবে। এ একইসময়ে প্রোটেস্ট্যান্ট মৌলবাদীরা নতুন ইসরায়েল রাষ্ট্রের সৃষ্টি উদযাপন করার পাশপাশি অন্তিমকালে চূড়ান্ত গণহত্যার ফ্যান্টাসিও লালন করছিল। ইহুদি রাষ্ট্র অস্তিত্ব লাভ করেছে কেবল ক্রিশ্চানদের আরও পূর্ণতা দান করার জন্যে। শেষ কালে ইহুদিদের নিয়তি অনন্যভাবে বিষণ্ন, কারণ ক্রাইস্টকে গ্রহণ করুক বা না করুক তারা অভিশপ্ত। আমেরিকান প্রোটেস্ট্যান্টরা ইহুদিদের মতো নির্যাতিত না হলেও তাদের আধুনিকতার দৃষ্টিভঙ্গিও ছিল অন্ধকার ও অভিশপ্ত। আধুনিক বিশ্বের যৌক্তিক চেতনার প্রতি সাড়া হিসাবে ঐশীগ্রন্থ পাঠের নিজস্ব আক্ষরিক ও ‘বৈজ্ঞানিক’ পদ্ধতি গড়ে তুলেছিল তারা। তারপরও বিশ্বাসীদের সহানুভূতির মৌল শিক্ষা চর্চায় সাহায্য করাই প্রকৃত ধর্মীয় দর্শনের পরীক্ষা হলে (বুক অভ রেভেলেশনে না হলেও গস্পেল ও সেইন্ট পলের চিঠিপত্রে এই শিক্ষা নিহিত) প্রোটেস্ট্যান্ট মৌলবাদ যেন ধর্মীয় আন্দোলন হিসাবে ঠিক স্কোপস ট্রায়ালে এর বিজ্ঞান ভ্রান্তিপূর্ণ প্রমাণিত হওয়ার মতোই ব্যর্থ হচ্ছিল। প্রকৃতপক্ষেই, বাইবেলের দারুণভাবে নির্বাচিত অনুচ্ছেদের আক্ষরিক পাঠ তাদের আধুনিকতার ঈশ্বরহীন গণহত্যামূলক প্রবণতাকে আত্মস্থ করতে উৎসাহিত করেছিল।

*

মুসলিমরা তখন পর্যন্ত কোনও মৌলবাদী আন্দোলনের জন্ম দেয়নি, কারণ তাদের আধুনিকায়ন প্রক্রিয়া তখনও পর্যাপ্তভাবে অগ্রসর হয়নি। তখনও আধুনিকতার নতুন চ্যালেঞ্জ মেটাতে তারা তাদের ধর্মীয় ঐতিহ্য পুনর্গঠনে ব্যস্ত ছিল এবং নতুন চেতনা উপলব্ধি করতে জনগণকে সাহায্য করার কাজে লাগাচ্ছিল ইসলামকে। মিশরে এক তরুণ শিক্ষক সব সময়ই বুদ্ধিজীবীদের ক্ষুদ্র বলয়ে সীমাবদ্ধ আফগানি, আব্দুহ ও রিদাহর সংস্কার ধারণা অধিকতর সাধারণ মানুষের মাঝে নিয়ে এসেছিলেন। খোদ এটাই ছিল আধুনিকায়নের একটি প্রক্রিয়া। প্রাচীন সংস্কারকগণ তখনও রক্ষণশীল রীতিনীতিতে আকার লাভ করছিলেন, অধিকাংশ প্রাক আধুনিক দার্শনিকদের মতো অভিজাতপন্থী ছিলেন তাঁরা, সাধারণ মানুষকে তাঁদের বিমূর্ত ধারণা বোঝার উপযুক্ত মনে করেননি। হাসান আল-বান্না (১৯০৬-৪৯) তাঁদের সংস্কার ধারণাকে গণআন্দোলনে পরিণত করার একটা উপায় বের করেছিলেন। একাধারে আধুনিক ও প্রথাগত ধর্মীয় শিক্ষা ছিল তাঁর। তিনি কায়রোর বিজ্ঞান বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা প্রদানের প্রথম টিচার্স ট্রেনিং কলেজ দার আল-উলুমে পড়াশোনা করেছিলেন, কিন্তু সুফিও ছিলেন বান্না, গোটা জীবন জুড়ে সুফিবাদের আধ্যাত্মিক অনুশীলন ও আচার তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ রয়ে গিয়েছিল।৫৮ বান্নার কাছে বিশ্বাস কোনও ক্রিডের প্রতি মতামতগত সম্মতি ছিল না; এটা এমন কিছু যাকে কেবল যাপন এবং এর আচারগুলোকে যত্নের সাথে পালন করা হলেই উপলব্ধি করা যেতে পারে। তিনি জানতেন, মিশরিয়দের পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রয়োজন ছিল; তিনি এও বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাদের সমাজকে অবশ্যই রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে আধুনিক করে তুলতে হবে। কিন্তু এগুলো ছিল বাস্তব ও যৌক্তিক বিষয় যেগুলোকে অবশ্যই আধ্যাত্মিক ও মনস্তাত্ত্বিক সংস্কারের সাথে হাতে হাত রেখে চলতে হবে। ৫৯

কায়রোর ছাত্র হিসাবে বান্না ও তাঁর বন্ধুরা শহরের রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভ্রান্তি দেখে আবেগে প্রায় কেঁদে ফেলেছিলেন। রাজনৈতিক অচলাবস্থা বিরাজ করছিল সেখানে: অর্থহীন ও প্রবল বিতর্কে মেতে ছিল বিভিন্ন পক্ষ, মিশরিয় ‘স্বাধীনতা’ সত্ত্বেও তখনও দেশের নিয়ন্ত্রণে রয়ে যাওয়া ব্রিটিশের হাতে পরিচালিত হচ্ছিল। ব্রিটিশদের নিরাপদ আরামদায়কভাবে আবাস স্যুয়েয খাল এলাকায় ইসমাইলিয়াহয় প্রথম শিক্ষকের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর আপন জাতির মানুষগুলোর দুর্দশা একেবারে আত্মায় আঘাত করেছিল তাঁর। ব্রিটিশ ও অন্য প্রবাসীদের স্থানীয় জনগণের প্রতি বিন্দুমাত্র দরদ ছিল না, বরং অর্থনীতি ও সরকারী উপযোগের উপর কঠিন নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছিল তারা। ব্রিটিশদের বিলাসী বাড়িঘর ও মিশরিয় শ্রমিকদের কাহিল দর্শন কুঁড়ের বৈপরীত্যে গ্লানি বোধ করেছেন তিনি।৬১ নিবেদিত প্রাণ মুসলিম বান্নার চোখে এটা স্রেফ রাজনীতির কোনও ব্যাপার ছিল না। মুসলিম সম্প্রদায়, উম্মাহর অবস্থা ইসলামে ক্রিশ্চান ধর্মের কোনও মতবাদগত নীতিমালার মতোই গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় মূল্য রাখে। বান্না আধ্যাত্মিকভাবে তাঁর জনগণের দুঃখকষ্টে বিচলিত বোধ করেছেন ঠিক একজন প্রোটেস্ট্যান্ট মৌলবাদী বাইবেলের ভ্রান্তি হীনতার ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে মনে করলে বা নেচারেই কারতার কোনও সদস্য তার চোখে যায়নবাদীদের হাতে পবিত্র ভূমির অপবিত্রকরণ মনে করা কিছু দেখলে যেমন বোধ করবে। বান্না বিশেষ করে লোকজনকে মসজিদ ছেড়ে চলে যেতে দেখে উদ্বিগ্ন ছিলেন। মিশরিয়দের বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে আধুনিকায়নের প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, এই প্রক্রিয়ায় কায়রোয় প্রকাশিত অসংখ্য পত্রিকায়, সাময়িকী ও ম্যাগাজিনে পাশ্চাত্য ধারণার মুখোমুখি হয়ে বিস্মিত হয়ে গিয়েছিল তারা-যেগুলোকে ইসলামের সাথে সম্পর্কহীন বা এর প্রতি ইতিবাচকভাবে বৈরী ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি। উলেমাবা আধুনিক দৃশপট থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন, সাধারণ মানুষকে সঠিক কোনও নির্দেশনা দিতে পারছিলেন না তাঁরা। আর রাজনীতিবিদগণ গণমানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক বা শিক্ষা সমস্যা নিয়ে কোনওরকম স্থিতিশীল প্রয়াস পাচ্ছিলেন না।৬২ বান্না স্থির করেন, একটা কিছু করতে হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যেখানে নিজেদের বিভ্রান্ত ও মনোবলরহিত মনে করছে সেখানে জাতীয়তাবাদ ও ইউরোপের সাথে মিশরের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নিয়ে উচ্চমার্গের আলোচনায় কোনও ফায়দা হবার নয়। তাঁর মনে হয়েছিল, লোকে কেবল কোরান ও সুন্নাহর প্রথম নীতিমালায় ফিরে গিয়েই আধ্যাত্মিক উপশম লাভ করতে পারে।

বান্না মসজিদ ও কফিহাউসে উপস্থিত ‘সারমন’ দেওয়ার জন্যে কিছু বন্ধুবান্ধবকে সমবেত করেন। শ্রোতাদের তিনি বললেন, পাশ্চাত্যের প্রভাব ও সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তনসমূহ তাদের ভারসাম্য নষ্ট করে দিয়েছে, এখন আর নিজেদের ধর্মকে তারা উপলব্ধি করতে পারছে না। ইসলাম পাশ্চাত্য কেতার ধর্মতত্ত্ব বা ক্রিডের কোনও সেট নয়। এটা সর্বাঙ্গীন জীবন ব্যবস্থা, আন্তরিকভাবে এই ধর্ম অনুযায়ী জীবন যাপন করতে পারলে তা আবার বহুদিন আগে বিদেশীদের হাতে উপনিবেশে পরিণত হওয়ার আগে মুসলিম উম্মাহর অধিকারে থাকা সেই গতিময়তা ও শক্তি ফিরিয়ে আনবে। উম্মাহকে ফের শক্তিশালী করে তুলতে তাদের অবশ্যই মুসলিম আত্মাকে আবিষ্কার করতে হবে।৬৪ তখনও বিশের কোঠার শুরুর দিকে বয়স হলেও বেশ প্রভাব সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন বান্না। ১৯২৮ সালের মার্চের এক সন্ধ্যায় ইসমাইলিয়াহর ছয়জন স্থানীয় কর্মী তাঁর কাছে এসে তৎপরতা শুরু করার অনুরোধ জানালেন:

আমরা ইসলামের মাহাত্ম্যে পৌঁছানোর বাস্তব পথ জানি না, মুসলিমদের কল্যাণের লক্ষ্যে সেবা করতেও না। আমরা এই অপমান আর বিধিনিষেধে ভরা জীবনে ক্লান্ত। তো আমরা দেখতে পাচ্ছি আরব ও মুসলিমদের কোনও মর্যাদা বা সম্মান নেই। আমাদের রক্ত ছাড়া আর কিছুই নেই…আর আছে প্রাণ…আর সামান্য কটি পয়সা। আমরা আপনার মতো করে কর্মের পথ বা পিতৃভূমি চিনতে পারিনি, ধর্ম ও উম্মাহকে আপনার মতো সেবার পথও চিনতে অক্ষম ৬৫

এই আবেদনে আলোড়িত হয়েছিলেন বান্না। একসাথে তিনি ও তাঁর অতিথিরা ‘ইসলামের বাণীর স্বার্থে সেনাদল [জুন্দ]’ হওয়ার শপথ গ্রহণ করলেন। সেরাতে সোসায়েটি অভ মুসলিম ব্রাদার্সের জন্ম হলো। নগণ্য এই সূচনা থেকে সম্প্রসারিত হয়। ১৯৪৯ সালে বান্নার পরলোকগমনের সময় সারা মিশরে সোসায়েটির ২,০০০ শাখা ও ৬০০,০০০ ব্রাদার ও সিস্টার ছিল। এটাই মিশরের সমাজের প্রতিটি গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করা একমাত্র সংগঠন: সিভিল সার্ভেন্ট, ছাত্র ও সম্ভাব্য শক্তিধর শহুরে শ্রমিক গোষ্ঠী ও কৃষক সমাজ।৬৬ দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ নাগাদ মিশরিয় রাজনীতির দৃশ্যপটে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীতে পরিণত হয়েছিল সোসায়েটি।

অস্তিত্বের প্রথম রাত থেকেই উগ্র ইমেজারি সোসায়েটির বৈশিষ্ট্যে পরিণত হলেও বান্না সব সময়ই জোরের সাথে বলেছেন যে, অভ্যুত্থান সংগঠন বা ক্ষমতা দখলের কোনও অভিলাষ তাঁর নেই। সোসায়েটির প্রধান লক্ষ্য ছিল শিক্ষা। তিনি বিশ্বাস করতেন, সাধারণ মানুষ ইসলামের বাণী আত্মস্থ করতে পারলে সহিংস ক্ষমতা দখল ছাড়াই জাতি মুসলিম হয়ে উঠবে। একেবারে গোড়ার দিকে আফগানি, আব্দুহ ও রিদাহর সালাফিয়াহ সংস্কার আন্দোলনের প্রতি ঋণ প্রকাশ করে ছয়দফা কর্মসূচি প্রণয়ন করেছিলেন বান্না: (১) যুগের চেতনায় কোরানের ব্যাখ্যা, (২) ইসলামি জাতিগুলোর ঐক্য, (৩) জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন ও সামাজিক ন্যায়বিচার ও শৃঙ্খলা অর্জন, (৪) নিরক্ষরতা ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, (৫) বিদেশী আধিপত্য থেকে মুসলিম অধিকৃত অঞ্চলসমূহ উদ্ধার ও (৬) বিশ্বজুড়ে ইসলামি শান্তি ও ভ্রাতৃত্ববোধের প্রসার।৬৭ বান্না চাননি, সোসায়েটি সহিংস বা রেডিক্যাল হোক, কিন্তু নীতিগতভাবে তিনি উপনিবেশিক অভিজ্ঞতার কারণে নমিত ও শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া মুসলিম সমাজের মৌলিক সংস্কারের ব্যাপারে চিন্তিত ছিলেন।৬৮ মিশরিয়রা নিজেদের ইউরোপিয়দের চেয়ে নিম্ন পর্যায়ের ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে, কিন্তু এর কোনও প্রয়োজনই ছিল না। তাদেরও অসাধারণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে, যা আমদানি করা আদর্শ থেকে ঢের বেশি সাহায্য করবে তাদের।৬৯ ফরাসি বা রাশিয়ান বিপ্লব অনুকরণ করা উচিত হবে না, কারণ পয়গম্বর মুহাম্মদ (স) ১৩০০ বছর আগেই স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ববোধ ও সামাজিক ন্যায়বিচারের আহ্বান জানিয়ে গেছেন।৬৯ শরীয়াহ এমনভাবে মধ্যপ্রাচ্যীয় দেশগুলোর সাথে খাপ খেয়ে যায় যেভাবে কোনও বিদেশি আইনের পক্ষে সম্ভব হবে না। মুসলিমরা যতদিন অন্য জাতিকে অনুকরণ করবে তত দিন তারা ‘সাংস্কৃতিক সঙ্কর’ই রয়ে যাবে।

কিন্তু সবার আগে ব্রাদার ও সিস্টারদের নিজেদের ইসলামের সাথে নতুন করে পরিচিত হতে হবে। মুক্তি ও মর্যাদা লাভের কোনও সংক্ষিপ্ত পথ নেই। মুসলিমদের নিজেদের ও সমাজবে একেবারে শূন্য থেকে নতুন করে গড়ে তুলতে হবে। এই লক্ষ্য অর্জনে বছরের পর বছর অবিরাম পর্যালোচনা ও আত্মমূল্যায়নের মাধ্যমে বান্না একটি দক্ষ ও আধুনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। ১৯৩৮ সালে সদস্যদের বিভিন্ন ‘ব্যাটালিয়নে’ বিভক্ত করা হয়, প্রতিটিতে তিনটি করে গ্রুপ ছিল-একটি শ্রমিকদের জন্যে, একটি ছাত্রদের ও অন্যটি ব্যবসায়ী ও সিভিল সার্ভেন্টদের। গ্রুপগুলো সপ্তাহে একদিন প্রার্থনা ও আধ্যাত্মিক অনুপ্রেরণার জন্যে মিলিত হত। যে আশা নিয়ে নবীনদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল সেটা পূরণ না হওয়ায় ১৯৪৩ সাল নাগাদ ‘ব্যাটালিয়নগুলোকে’ ‘পরিবার’ দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা হয়। এর প্রতিটির দশ জন করে সদস্য ছিল, ইউনিট হিসাবে তৎপরতার জন্যে দায়ী ছিল তারা। পরিবারের সদস্যরা সপ্তাহে একবার মিলিত হত, একে অন্যের উপর নজর রাখত যাতে প্রত্যেকে ‘স্তম্ভ’গুলো অনুসরণ করে; জুয়া, মদ, সুদ ও ব্যাভিচার থেকে দূরে থাকে। মিশরের সমাজ আধুনিকায়নের চাপে ভেঙে পড়ার একটা সময়ে পরিবার ব্যবস্থা মুসলিমদের বাঁধনের উপর জোর দিয়েছিল। প্রতিটি পরিবার ছিল প্রধান কার্যালয়ের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখা একটি বৃহত্তর ‘ব্যাটালিয়নের’ অংশ।

এই সময়ের কোনও ক্রিশ্চান সংস্কার আন্দোলনের মতবাদ নির্দিষ্ট করার প্রয়োজন হত; অংশত এর কারণ ছিল ধর্মকে কতগুলো বিশ্বাসের বিন্যাস পরিপালন হিসাবে মেনে নেওয়া বিবেচনাকারী আধুনিক পাশ্চাত্য সংস্কৃতি। অবশ্য মুসলিমদের নির্দিষ্ট উপায়ে নিজেদের মাঝে এক মুহাম্মদীয় আদর্শরূপ গড়ে তুলতে সাহায্যকারী শরীয়াহর রক্ষণশীল ধার্মিকতায় সোসায়েটি পরিচালিত হত। তবে এই প্রাচীন কেতার ধার্মিকতা এক আধুনিক বেশে প্রসারিত হয়েছিল। পয়গম্বরের মতো ঈশ্বরমুখীনতা সৃষ্টি করার লক্ষ্যে আচার, প্রার্থনা ও নৈতিক অনুশীলনের নকশা করা হয়েছিল। কেবল এই আধ্যাত্মিক প্রেক্ষাপটেই আধুনিক প্রতিষ্ঠান ও সংস্কার মুসলিম জাতির কাছে অর্থবহ হয়ে উঠতে পারে বলে বিশ্বাস করতেন বান্না। ১৯৪৫ সালে এক জনাকীর্ণ সভায় বান্না সিদ্ধান্ত নেন যে, দারুণ প্রয়োজনীয় হয়ে উঠলেও কোনও সরকারই যার জন্যে যথার্থ পদক্ষেপ নেয়নি এমন একটি সামাজিক কল্যাণমূলক কর্মসূচি গ্রহণের সময় হয়েছে। ব্রাদাররা সব সময় কোথাও কোনও শাখা খোলার সাথে সাথে মসজিদের পাশে ছেলে ও মেয়েদের জন্যে স্কুল নির্মাণ করেছে। আধুনিক স্কাউট আন্দোলন রোভার্সও প্রতিষ্ঠা করেছিল তারা, যেখানে তরুণ ব্রাদারদের শারীরিক ও প্রায়োগিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নাগাদ দেশের বৃহত্তম ও সবচেয়ে শক্তিশালী যুব সংগঠনে পরিণত হয়েছিল রোভাররা এবার এইসব সেবা আরও সুশৃঙ্খল ও দক্ষ হয়ে উঠল। ব্রাদাররা শ্রমিকদের জন্যে নাইট স্কুল ও সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার জন্যে টিউটোরিয়াল কলেজ পরিচালনা করত; তারা গ্রামাঞ্চলে ক্লিনিক ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে; আর দরিদ্রতর পল্লী এলাকার পয়ঃনিষ্কাষণ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও স্বাস্থ্য শিক্ষার কাজেও নিয়োজিত ছিল রোভাররা। সোসায়েটি আধুনিক ট্রেড ইউনিয়নও প্রতিষ্ঠা করে, শ্রমিকদের অধিকারের ব্যাপারে সচেতন করে তোলে। কিছু ভয়াবহ শ্রমিক শোষণের ঘটনা প্রকাশ করে দেয়; নিজস্ব কারাখানা স্থাপন ও মুদ্রণ, তাঁত, নির্মাণ ও প্রকৌশলের হালকা কারাখানা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কর্মসংস্থানের ব্যাপারে তৎপর ছিল তারা।

সোসায়েটির শত্রুরা সব সময়ই বান্নার বিরুদ্ধে ‘রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে রাষ্ট্র’ সৃষ্টির অভিযোগ তুলে আসছিল। তিনি প্রকৃতই স্পষ্ট হুমকিস্বরূপ সরকারের ঘাটতিগুলোকে উজ্জ্বল করে তোলা এক ব্যাপক সফল প্রতি-সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিলেন। শিক্ষা ও শ্রমিকদের অবস্থার প্রতি সরকারের অবহেলার দিকে তা দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে; সোসায়েটি একাই ফেলাহিনদের কাছে আবেদন সৃষ্টি করতে সক্ষম হওয়ার ব্যাপারটি সত্যিই বিব্রতকর ছিল। কিন্তু তারচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, সোসায়েটির সকল প্রতিষ্ঠানের সুস্পষ্ট মুসলিম পরিচয় ছিল। এর সমস্ত কারখানায় মসজিদ ছিল, আবশ্যক প্রার্থনার জন্যে শ্রমিকদের প্রয়োজনীয় সময় দেওয়া হত; কোরানের সামাজিক বাণী মোতাবেক কর্ম পরিবেশ ও মজুরি ছিল ভালো। শ্রমিকরা স্বাস্থ্য বীমা ও শোভন অবকাশ পেত; যে কোনও বিরোধের সমাধান করা হত ন্যায়সঙ্গতভাবে। বুদ্ধিজীবী ও পণ্ডিতরা যাই বলে থাকুন না কেন, মিশরের বেশির ভাগ মানুষই ধার্মিক হতে চায় এই বাস্তবতার নাটকীয় প্রকাশ‍ই ছিল সোসায়েটির অসাধারণ সাফল্য। এটা দেখিয়েছে যে ইসলাম প্রগতিশীল হতে পারে। সপ্তম শতাব্দীর রেওয়াজে কোনও দাসত্বমূলক প্রত্যাবর্তন ছিল না। ব্রাদাররা সৌদি আরবের নতুন ওয়াহাবি রাজ্যের ব্যাপারে দারুণভাবে সমালোচনামুখর ছিল, ইসলামি আইনের আক্ষরিক ব্যাখ্যার-যেমন চোরের হাত কাটা বা ব্যাভিচারীকে পাথর ছুঁড়ে হত্যা-নিন্দা করেছে। ভবিষ্যৎ ইসলামি রাষ্ট্রের রাজনীতির রূপ সম্পর্কে ব্রাদারদের কোনও ধারণা ছিল না। তবে তারা জোরের সাথে বলেছে কোরান ও সুন্নাহর চেতনার প্রতি বিশ্বস্ত হতে হলে সৌদি আরবের চেয়েও সম্পদের ন্যায়সঙ্গত বণ্টন থাকতে হবে। ওদের সাধারণ ধারণা নিশ্চিতভাবে সময়ের সাথে তাল মেলানো ছিল: শাসকদের নির্বাচিত হতে হবে (আদি মুসলিমকালের মতো), এবং রাশিদুন (‘ন্যায়নিষ্ঠ’) খলিফাগণ যেমন তাগিদ দিয়েছেন, একজন শাসককে অবশ্যই তাঁর জাতির কাছে জবাবদিহি করতে হবে; তিনি স্বৈরাচারীমূলক শাসন চালাতে পারবেন না। কিন্তু সম্ভাব্য ইসলামি রাষ্ট্র সংক্রান্ত আলোচনাকে বান্না সব সময়ই অপরিপক্ক মনে করেছেন, কারণ এখনও প্রাথমিক অনেক কাজ বাকি রয়ে গেছে।৭৮ বান্না স্রেফ মিশরকে ইসলামি রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার কথা বলেছিলেন; সোভিয়েতরা কমিউনিজম বেছে নিয়েছে, পাশ্চাত্য বেছেছে গণতন্ত্র; যেসব দেশে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, ইসলামি ভিত্তিতে তাদের রাজনীতি নির্মাণ করার অধিকার থাকা উচিত, যদি তারা কখনও ইচ্ছা করে।

সোসায়েটি নিখুঁত ছিল না। সাধারণ মানুষের কাছে এর আবেদনের কারণে প্রতিবুদ্ধিজীবী প্রবণ হয়ে উঠেছিল। এর বিভিন্ন ঘোষণা অনেক সময়ই আত্মরক্ষামূলক ও স্বয়ং-ন্যায়নিষ্ঠ হতে দেখা গেছে। পাশ্চাত্য সম্পর্কে এর লোভ, স্বৈরাচার ও আধ্যাত্মিক দেউলিয়াত্বের উপর জোর দেওয়া ব্রাদারস-এর ইমেজ উপনিবেশিক অভিজ্ঞতার কারণে বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের উদ্দেশ্য কেবল, সোসায়েটির এক মুখপাত্র যেমন বলেছিলেন, ‘আমাদের অমর্যাদা করা, আমাদের দেশ দখল করা ও ইসলামের ধ্বংস শুরু করা ছিল না। সোসায়েটির নেতৃবৃন্দ সাধারণ কাতারে মতদ্বৈততার ব্যাপারে অসহিষ্ণু ছিলেন। চরম আনুগত্যের উপর জোর দিয়েছেন বান্না, তিনি পর্যাপ্তভাবে দায়িত্ব হস্তান্তর করেননি। ফলে তাঁর মৃত্যুর পর কেউই তাঁর স্থান নিতে পারেননি। সোসায়েটি কার্যত অর্থহীন অন্তর্কলহের কারণে শেষ হয়ে গেছে। তবে এর সবচেয়ে মারাত্মক ও ক্ষতিকর ব্যর্থতা ছিল ১৯৪৩ সালে ‘দ্য সিক্রেট অ্যপারেটাস’ (আল-জিহাজ আল-সিররি) নামে সন্ত্রাসী গ্রুপ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করা। ১ সামগ্রিকভাবে সোসায়েটিতে তা প্রান্তিক রয়ে গিয়েছিল। গোপন সংগঠন হওয়ায় আমরা এর সম্পর্কে খুব কমই তথ্য জানি, তবে সোসায়েটির নিশ্চিত গবেষণায় রিচার্ড পি. মিচেল তাঁর বিশ্বাস ব্যক্ত করেছেন যে, ১৯৪৮ সাল নাগাদ ইউনিটের মাত্র হাজার খানেক সদস্য ছিল, বেশির ভাগ ব্রাদারই তখন পর্যন্ত এর অস্তিত্বের কথা জানত না।` বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের কাছে সামাজিক ও আধ্যাত্মিক সংস্কার ছিল সোসায়েটির রেইজন দে’এতরে, অ্যাপারেটাসের সন্ত্রাসের নিন্দা করেছে তারা। তাসত্ত্বেও ঈশ্বরের নামে মানুষ হত্যা শুরু করলে কোনও সংগঠন সবচেয়ে মৌলিক ধর্মীয় মূল্যবোধকে অস্বীকারকারী এক বিনাশী পথে পা বাড়ায়।

১৯৪০-র দশক মিশরের পক্ষে খুবই উত্তাল সময় ছিল। উদার গণতন্ত্রের ব্যর্থতা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল, এবং অধিকাংশ মিশরিয় সংসদীয় গণতন্ত্র সম্পর্কে নৈরাশ্যবাদী হয়ে পড়েছিল। ব্রিটিশ বা মিশরিয় জাতীয়তাবাদীদের কেউই বুঝতে পারেনি যে উপরিতলের ও অতি দ্রুত আধুনিকায়নের ফলে মূলত তখনও সামন্ত বাদী ও কৃষিভিত্তিক রয়ে যাওয়া একটি দেশে সরকারের আধুনিক পদ্ধতি কায়েম সম্ভব নয়। ১৯২৩ সাল থেকে ১৯৫০ সালের মধ্যে সতেরটি সাধারণ নির্বাচনের প্রত্যেকটিতে জাতীয়তাবাদী ওয়াফদ পার্টি জয়লাভ করলেও মাত্র পাঁচবার তাদের শাসন করার সুযোগ দেওয়া হয়। ওয়াফদপন্থীদের সাধারণত ব্রিটিশ বা রাজপ্রাসাদের তরফ থেকে পদত্যাগে করতে বাধ্য করা হত।৮৩ ১৯৪২ সালে এমনকি ব্রিটিশরা জার্মানপন্থী প্রধানমন্ত্রীকে ইস্তফা দিতে বাধ্য করে অপেক্ষাকৃত কম খারাপ হিসাবে ওয়াফদ পার্টিকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করলে এর উপরও শ্রদ্ধা হারিয়ে বসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কায়রোয় এক সন্ত্রাসের আবহ বিরাজ করছিল, সেই সাথে হতাশা; ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্রের সৃষ্টির পর প্যালেস্তাইনে আগ্রাসন চালানোর পর মিশরসহ পাঁচটি আরব বাহিনীর শোচনীয় পরাজয়ে তা আরও গভীর হয়ে ওঠে। প্যালেস্তাইন হাতছাড়া হয়ে যাওয়া ও ১৯৪৮ সালে গৃহত্যাগে বাধ্য হওয়া ৭৫০,০০০ প্যালেস্তাইনি শরণার্থীর দুঃখদুর্দশার প্রতি বিশ্বসম্প্রদায়ের উদাসীনতা আধুনিক বিশ্বে আরবদের অক্ষমতাই তুলে ধরেছে। আরব আজও ১৯৪৮ সালের ঘটনাকে আল-নাখবাহ: মহাজাগতিক পর্যায়ের বিপর্যয় হিসাবে আখ্যায়িত করে থাকে। এমনি ভীষণ আবহে অনেকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে সন্ত্রাসই ‘একমাত্র উপায়। নিশ্চিতভাবেই এটা পরে মিশরের প্রেসিডেন্ট পদে আসীন আনোয়ার আল-সাদাতের মত ছিল; ক্যানাল যোনে ব্রিটিশদের হামলা ও ব্রিটিশদের ‘দালালী’ করা মিশরিয় রাজনীতিবিদদের হত্যা করার লক্ষ্যে ১৯৪০-র দশকে ‘মার্ডার সোসায়েটি’ গঠন করেছিলেন তিনি। সহিংসতাকেই একমাত্র উপায় মনে করা অন্য প্যারামিলিটারি গ্রুপও ছিল: রাজপ্রাসাদের সাথে সংশ্লিষ্ট দ্য গ্রিন শার্টস এবং ওয়াফদ-এর সাথে সম্পর্কিত ব্লুশার্টস।৮৫

সম্ভবত মিশরিয় রাজনৈতিক মঞ্চে প্রধান কুশীলব সোসায়েটি অভ মুসলিম ব্রাদার্সেরও নিজস্ব সন্ত্রাসী সংগঠন থাকার ব্যাপারটা অনিবার্য ছিল, কিন্তু এটা ছিল একটা করুণ পরিবর্তন। বান্না স্বয়ং গোপন অ্যাপারেটাসের কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন কিনা সেটা পরিষ্কার নয়। তিনি সবসময়ই তাদের নিন্দা করেছেন, কিন্তু এই বছরগুলোয় সরকারের নিন্দাবাদেও উচ্চকণ্ঠ ছিলেন তিনি।৮৬ নিজের সন্ত্রাসী ইউনিটকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি বান্না, এই সংগঠনের কর্মকাণ্ড এমন কিছু ঘটনাপ্রবাহের সৃষ্টি করেছিল যা তাঁর মৃত্যু ডেকে এনেছে, সোসায়েটির নৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা মসীলিপ্ত করেছে এবং শেষ পর্যন্ত এর ধ্বংস ডেকে এনেছে। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে সিক্রেট অ্যাপারেটাসের সদস্যরা সম্মানিত বিচারক আহমাদ আল-খাযিন্দারের হত্যাকাণ্ডের ভেতর দিয়ে সূচিত সন্ত্রাসের কর্মসূচি হাতে নেয়, গোটা গ্রীষ্মকাল জুড়ে তা অব্যাহত থাকে; কায়রোর ইহুদি অধ্যুষিত এলাকা সহিংস আক্রমণ হয়, বোমা বর্ষণ করা হয়, ফলে অনেক সম্পদ বিনষ্ট হয়, অসংখ্য মানুষ আহত হয় বা প্রাণ হারায়; ২৮শে ডিসেম্বর, ১৯৪৮ প্রধানমন্ত্রী মুহাম্মদ আল- নাকরাশির হত্যাকাণ্ডের ভেতর দিয়ে এটা পরিণতি লাভ করে।

সোসায়েটি এইসব হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করেছে, নাকরাশি হত্যাকাণ্ডে ত্রাসের ভবিষ্যদ্বাণী করেন বান্না। ৭ তাসত্ত্বেও সমাজের সকল স্পষ্ট সেক্টরের নিন্দার পাত্র নতুন প্রধানমন্ত্রী ইব্রাহিম আল-হাদি বড্ড বেশি ক্ষমতাধর হয়ে ওঠা ব্রাদারহুডকে ধ্বংস করার এই সুযোগ লুফে নেন। সোসায়েটিকে দমন করা হয়, সদস্যদের ঘেরাও করে গ্রেপ্তার করা হয়, নির্যাতনের শিকারে পরিণত হয় তারা, এবং ১৯৪৯ সালের জুলাই নাগাদ আব্দ আল-হাদি অবশেষে পদত্যাগ করার সময় পাঁচ হাজারেরও বেশি ব্রাদার কারাগারে অবস্থান করছিল।৮৮ কিন্তু ১২ই ফেব্রুয়ারি ১৯৪৯ বান্নাকে ইয়াং মেন’স মুসলিম অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান কার্যালয়ের ঠিক বাইরে প্রায় নিশ্চিতভাবেই প্রধানমন্ত্রীর ইঙ্গিতে রাস্তায় গুলি করে হত্যা করা হয়।

১৯৫০ সালে গোপনে সোসায়েটি আবার সংগঠিত হতে শুরু করে, একজন নতুন নেতা নির্বাচন করে তারা: মধ্যপন্থী ও সহিংসতা এড়িয়ে চলার কারণে সুপরিচিত বিচারপতি হাসান ইসমাইল আল-হুদাইবি। আশা করা হয়েছিল যে, সোসায়েটিকে অতি প্রয়োজনীয় সম্মান এনে দেবেন তিনি। কিন্তু হুদাইবি তাঁর দায়িত্বের উপযুক্ত ছিলেন না। বান্নার শক্তিশালী নেতৃত্বের অভাবে নেতাদের ভেতর উপদলীয় কোন্দল ছড়িয়ে পড়ে, সিক্রেট অ্যাপারেটাসকে নিয়ন্ত্রণে অক্ষম প্রমাণিত হন হুদাইবি, ১৯৫৪ সালে ফের সোসায়েটির পতন ঘটায় তারা।

এই সময় নাগাদ মিশর ভয়ঙ্কর তরুণ আর্মি অফিসার জামাল আব্দ-আল নাসেরের (১৯১৮-৭০) হাতে শাসিত হচ্ছিল। ২২শে জুলাই ১৯৫২ তারিখে ফ্রি অফিসারদের অ্যাসোসিয়শনকে সাথে নিয়ে পুরোনো মর্যাদাহীন শাসকগোষ্ঠীকে এক সামরিক অভ্যুত্থানে উৎখাত করেছিলেন তিনি। মিশরে এক বিপ্লবী প্রজাতন্ত্র কায়েমের পথে অগ্রসর হচ্ছিলেন। পুরোনো উদার আদর্শ থেকে সম্পূর্ণই ভিন্ন ধরনের উগ্র জাতীয়বাদের প্রবক্তা ছিলেন নাসের। ১৯২০ ও ১৯৩০-র দশকের মিশরিয় বুদ্ধিজীবীদের বিপরীতে নতুন আরব জাতীয়বাদীরা পাশ্চাত্যের প্রতি মুগ্ধ ছিল না। আর মধ্যপ্রাচ্যে এমন পরিষ্কারভাবে ব্যর্থ সংসদীয় গণতন্ত্রেরও ফুরসত ছিল না তাদের। নাসেরের সরকার উগ্রভাবে সমাজতন্ত্রী ছিল, তিনি সোভিয়েতদের তোয়াজ করে চলতেন। ব্রিটিশদের চিরকালের জন্যে মিশর থেকে তাড়াতে ছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ; পাশ্চাত্য ও ইসরায়েলের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তাঁর জনগণের জন্যে মোহমুক্তভাবে উপেক্ষার। তাঁর বিদেশ নীতি ছিল প্যান-আরব এবং ইউরোপিয় নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তি লাভের প্রয়াসে রত অন্য এশিয় ও আফ্রিকান দেশগুলোর সাথে মিশরের সংহতির উপর জোর দিয়েছে। নাসের পোড়খাওয়া সেক্যুলারিস্ট ছিলেন। ধর্মসহ কোনও কিছুকেই জাতীয় স্বার্থের প্রতি বাধা হতে দেওয়া যাবে না; ধর্মসহ সমস্ত কিছু রাষ্ট্রের অধীনে থাকতে হবে। শেষ পর্যন্ত নাসের মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় মানবে পরিণত হবেন এবং ‘নাসেরবাদ’ হবে প্রধান মতাদর্শ। কিন্তু গোড়ার দিকের বছরগুলোয় নাসেরকে সংগ্রাম করতে হচ্ছিল: তিনি তেমন একটা জনপ্রিয় ছিলেন না, কোনও প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীকে বেঁচে থাকতে দিতে পারেননি।

অবশ্য প্রথমে ব্রাদারকে তোয়াজ করেছেন নাসের। ওদের তাঁর প্রয়োজন ছিল, ইসলামি বাগাড়ম্বর ব্যবহার করতে পছন্দ করতেন বলে সোসায়েটি তাঁকে সমর্থন দিয়েছে, এর রোভাররা জুলাই বিপ্লবের পর আইন শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে বিশেষ করে জনমুখী মুসলিম বাগাড়ম্বব সত্ত্বেও নাসেরের ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিন্দুমাত্র ইচ্ছাও ছিল না এটা পরিষ্কার হয়ে যাবার পর এক ধরনের প্রাথমিক টানাপোড়েন চলছিল। হুদাইবির ইসলামি নীতিমালার পূর্ণ বাস্তবায়নের দাবি অসমেয়োচিত পরিণত হলে নাসেরের কেবিনেট ১৫ই জানুয়ারি, ১৯৫৪ পাল্টা বিপ্লব সংগঠন করার অভিযোগ তুলে আরও একবার সোসায়েটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। * ব্রাদারহুডের একটা নিউক্লিয়াস আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যায়, অপপ্রচারের অভিযান শুরু করে সরকার, ব্রাদারদের বিরুদ্ধে অবৈধ অস্ত্র রাখা ও ব্রিটিশদের সাথে মিলে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তোলা হয়। শাসককুল নিজেদের ইসলামি পরিচয় স্পষ্ট করে তোলার প্রয়াস পায় এবং নতুন ইসলামি কংগ্রেসের সেক্রেটারি জেনারেল আনোয়ার সাদাত আধাসরকারী পত্রিকা আল-জামহারিয়াহ- ‘প্রকৃত’ ও ‘উদার’ ইসলামের উপর বেশ কয়েকটি নিবন্ধ লিখেন। অবশ্য শেষ পর্যন্ত ২৬শে অক্টোবর, ১৯৫৪ তারিখে খোদ ব্রাদারহুড নাসেরের হাতের খেলার পুতুলে পরিণত হয়, সোসায়েটির সদস্য আব্দ আল-লতিফ এক র‍্যালিতে নাসেরকে লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণ করে।

আক্রমণ থেকে প্রাণে বেঁচে যান নাসের। হামলার মুখে তাঁর অসম সাহস ও নিরাসক্তি জনপ্রিয়তার পক্ষে বিস্ময়কর ভূমিকা রাখে। এবার সোসায়েটিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করার পক্ষে মুক্ত ছিলেন তিনি। ১৯৫৪ সালের নভেম্বর মাসের শেষ দিকে এক হাজারেরও বেশি ব্রাদার সদস্যকে গ্রেপ্তার করে বিচারের সম্মুখীন করা হয়েছিল। তবে আরও অসংখ্য সদস্য যারা লিফেলট বিলির চেয়ে মারাত্মক কোনও কাজ করেনি, তাদের কোনওদিনই আদালতে হাজির করা হয়নি, পরের পনেরটি বছর নাসেরের কারাগার ও নির্যাতন শিবিরে ধুঁকে ধুঁকে মরেছে তারা। নাসের যেন ব্রাদারহুডকে শেষ করে দিয়েছেন বলে মনে হয়েছিল, তাঁর চলার পথেই মিশরের একমাত্র প্রগতিশীল ইসলামি আন্দোলনকে থমকে দিয়েছিলেন। বিশেষ করে নাসের দুই বছর পরে স্যুয়েয সঙ্কটের পরবর্তী সময়ে আরব বিশ্বের নায়কে পরিণত হলে সেক্যুলারিজমকেই যেন বিজয়ী মনে হচ্ছিল, এই সময় তিনি কেবল পাশ্চাত্যকে সাফল্যের সাথে উপেক্ষাই করেননি, বরং ব্রিটিশের উপর শোচনীয় অপমান চাপিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ব্রাদারদের বিরুদ্ধে এই বিজয় শেষ পর্যন্ত শ্মশানের বিজয়ে পরিণত হয়। নাসেরের জীবদ্দশায় যেসব ব্রাদার কারাগারে ছিল সেক্যুলারিজমের সবচেয়ে আগ্রাসী চেহারা দেখতে পেয়েছে তারা। আমরা দেখব যে, শিবিরে বান্নার কিছু সংখ্যক অনুসারী ব্রাদার বান্নার সংস্কারবাদী দর্শন ত্যাগ করে একটি নতুন সহজাতভাবে সহিংস সুন্নি মৌলাবাদ গড়ে তুলেছিল।

ইরানিরাও ভয়ঙ্কর সেক্যুলারিস্ট আক্রমণের অভিজ্ঞতা লাভ করছিল। রেযা শাহর আধুনিকায়ন কর্মসূচি মিশর বা তুরস্কের আধুনিকায়নের কর্মসূচির চেয়ে ঢের বেশি দ্রুত গতির ছিল, কারণ তিনি ক্ষমতায় আসীন হওয়ার সময় ইরানে তখনও বলতে গেলে আধুনিকায়ন শুরুই হয়নি। ` রেযা ছিলেন নিষ্ঠুর। বিরোধীদের স্রেফ নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে; প্রথম যাদের বিদায় নিতে হয়েছিল তাঁদের অন্যতম ছিলেন মজলিসে শাহর বিরোধিতাকারী আয়াতোল্লাহ মুদাররিস। ১৯২৭ সালে তাঁকে কারাবন্দি করা হয়েছিল এবং ১৯৩৭ সালে হত্যা করা হয়।` রেযা প্রথমবারের মতো দেশটিকে কেন্দ্রিভূত করতে সক্ষম হয়েছিলেন, কিন্তু বিদ্ৰোহ দমন ও এযাবৎ কার্যত স্বায়ত্তশাসন ভোগকারী যাযাবর গোত্রগুলোকে দরিদ্রতর করে তোলার মাধ্যমে সবচেয়ে নিষ্ঠুর উপায়ে। রেযা বিচার ব্যবস্থাকে সংস্কার করেন, তিনটি নতুন সেক্যুলার আইনি বিধি-সিভিল, কমার্শিয়াল ও ক্রিমিনাল-শরীয়াহকে প্রতিস্থাপন করে।১৪ দেশকে শিল্পায়িত করে আধুনিক সুযোগসুবিধার আমদানি করতে চেয়েছিলেন তিনি। ১৯৩০-র দশকের শেষদিকে বেশিরভাগ শহরেই বিদ্যুৎ ও পাওয়ার প্ল্যান্ট ছিল। কিন্তু সরকারী নিয়ন্ত্রণ একটি সত্যিকারের প্রগতিশীল পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিকাশকে রুদ্ধ করে দিয়েছিল; মজুরি ছিল কম, শোষণ ছিল মারাত্মক। এই অতিশয় নির্মম পদ্ধতি নিষ্ফল প্রমাণিত হয়েছে; ইরান অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করতে পারেনি, ব্রিটেন তখনও প্রতিশ্রুতিশীল তেল শিল্পের মালিকানা বজায় রেখেছিল, অর্থনীতিতে বলতে গেলে যার কোনও অবদানই ছিল না, বিদেশী ঋণ ও বিনিয়োগ গ্রহণে ইরানকে বাধ্য করা হচ্ছিল।

রেযার কর্মসূচি অনিবার্যভাবে উপরিতলের ছিল। পুরোনো কৃষিভিত্তিক অবকাঠামোর উপরই আধুনিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে চাপিয়ে দিয়েছিল, মিশরে এই পদ্ধতি ব্যর্থ হয়েছিল, এখানেও একই ভাগ্য বরণ করবে। কৃষিক্ষেত্রে নিয়োজিত জনসংখ্যার নব্বই ভাগকে উপেক্ষা করা হয়েছিল; প্রথাগত কৃষি পদ্ধতি ছিল অব্যাহত এবং অনুৎপাদশীল রয়ে গেছে। সমাজের মৌলিক কোনও সংস্কার সাধিত হয়নি। দরিদ্রদের দুঃখদুর্দশায় সামান্যতমও আগ্রহী ছিলেন না রেযা, সেনাবাহিনী মোট বাজেটের পঞ্চাশ ভাগ পেলেও মাত্র চার ভাগ ব্যয় করা হত শিক্ষাখাতে, তাও ছিল সুবিধাভোগী শ্রেণীর অধিকারে। ৫ মিশরের মতোই ইরানে দুটি জাতি গড়ে উঠছিল, যারা ক্রমবর্ধমানহারে পরস্পরকে বুঝে উঠতে পারছিল না। ক্ষুদ্র পাশ্চাত্যকৃত সমাজের উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অভিজাত সম্প্রদায়কে নিয়ে ছিল একটি ‘জাতি’, রেযার আধুনিকায়ন কর্মসূচির ফায়দা লুটছিল তারা; অন্য ‘জাতি’টি ছিল শাসকগোষ্ঠীর নতুন সেক্যুলার জাতীয়তাবাদ প্রত্যক্ষ করে হতচকিত বিশাল দরিদ্র জনসাধারণকে নিয়ে, আগের চেয়ে আরও বেশি করে উলেমাদের পরামর্শের উপর নির্ভর করেছে তারা।

কিন্তু খোদ উলেমারাই রেযার সেক্যুলারাইজেশন নীতির প্রভাবে গুঁড়িয়ে যাচ্ছিলেন। যাজকদের ঘৃণা করতেন তিনি, ইরানে তাঁদের উল্লেখযোগ্য ক্ষমতা হ্রাস করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন। তাঁর প্রাচীন পারসিয় সংস্কৃতি ভিত্তিক ইরানি জাতীয়তাবাদ ইসলামকে সম্পূর্ণ নাকচ করে দেওয়ার প্রয়াস পেয়েছিল। রেযা ইমাম হুসেইনের সম্মানে আয়োজিত আশুরা উদযাপন (তাদের বিপ্লবী সম্ভাবনাকে স্বীকৃতি দান করা) দমনের প্রয়াস পেয়েছিলেন, মক্কায় হাজ্জ করতে যাওয়ার ব্যাপারে ইরানিদের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। ১৯৩১ সালে শরীয়াহ আদালতের আওতা মারাত্মকভাবে খর্ব করা হয়। যাজকদের কেবল ব্যক্তিগত বিষয়াদি নিয়ে কাজ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল; অন্য সমস্ত মামলা নতুন সিভিল আদালতে পাঠনো হচ্ছিল। এক শত বছরেরও বেশি সময় ধরে উলেমারা ইরানে প্রায় বল্গাহীন ক্ষমতা ভোগ করে এসেছেন; কিন্তু এবার পদ্ধতিগতভাবে তাদের ক্ষমতা খর্ব করার বিষয়টি প্রত্যক্ষ করলেন তাঁরা, কিন্তু মুদাররিসের হত্যাকাণ্ডের পর বেশির ভাগ যাজকই প্রতিবাদ করার সাহস করে উঠতে পারেননি। ৯৬

রেযার পোশাকের সমরূপতার আইন (১৯২৮) তাঁর আধুনিকায়ন প্রক্রিয়ার উপরিতলগত চেহারা ও সহিংস রূপ দুটোই দেখায়। সকল পুরুষের পক্ষে পশ্চিমা পোশাক বাধ্যতামূলক করা হয় (কেবল উলেমাদের ছাড়া; যাজকীয় পদে যোগদানের জন্যে রাষ্ট্রীয় পরীক্ষায় পাস করার শর্তে জোব্বা ও পাগড়ী পরার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল তাঁদের।), পরে মেয়েদের বোরখা পরার উপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। তাঁর সৈনিকরা সাধারণত বেয়োনেট দিয়ে মহিলাদের বোরখা ছিঁড়ে দিত, কুটিকুটি করে রাস্তার উপর ছুঁড়ে ফেলত। ৯৭ অন্তস্থঃ রক্ষণশীলতা সত্ত্বেও ইরানকে আধুনিক দেখাতে চেয়েছিলেন রেযা, এই লক্ষ্য অর্জনে যেকোনও কিছু করতে প্রস্তুত ছিলেন তিনি। ১৯২৯ সালের আশুরার সময় পুলিস কুমের ফায়যিয়াহ মাদ্রাসা ঘেরাও করে, ছাত্ররা রাস্তায় নেমে এলে তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক ছিঁড়ে পশ্চিমা পোশাক পরতে বাধ্য করে। পুরুষরা সাধারণত চওড়া কিনারাঅলা পশ্চিমা টুপি অপছন্দ করত, কারণ তাতে আচরিক প্রার্থনার সময় সেগুলো বাধা হয়ে দাঁড়াত। ১৯৩৫ সালে মাশাদে অষ্টম ইমামের মসজিদে একটি বিশ্রী ঘটনা ঘটে, পোশাক আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শনের সময় পুলিস জনতার উপর গুলি বর্ষণ করে। শত শত নিরস্ত্র বিক্ষোভকারী হয় প্রাণ হারায় কিংবা পবিত্র স্থানে আহত হয়। এটা বিস্ময়কর নয় যে, বহু ইরানি সেক্যুলারাইজেশনকে নির্যাতনকারী রাষ্ট্রের কবল থেকে ধর্মকে মুক্ত করার লক্ষ্যে নয় (পাশ্চাত্যের মতো), আসলে ইসলামকেই ধ্বংস করাই লক্ষ্যই পরিকল্পিত ভয়ঙ্কর নীতি হিসাবে ভয় করতে শিখেছিল। ৯৮

ঠিক এমনি এক পরিস্থিতিতেই মৌলবাদী আন্দোলন ক্রমশঃ বেড়ে উঠতে পারে। এই সময়কালেই ব্যাপারটা ঘটেনি, তবে চারটি ঘটনা ঘটেছিল যা পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। প্রথমটি ছিল এক প্রতি-সংস্কৃতির সৃষ্টি। ১৯২০ সালে বিশিষ্ট মুজতাহিদ শায়খ আব্দ আল-করিম হায়রি ইয়াযদিকে (১৮৬০-১৯৩৬) কুমের মোল্লাহরা সেখানে এসে থাকবার আমন্ত্রণ জানান। কারণ অষ্টম শতাব্দীতে ইরানি শিয়াবাদের বুদ্ধিবৃত্তিক কেন্দ্রে পরিণত হওয়া কারাবালা ও নাজাফের উপাসনালয়গুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভীত থাকায় কুমকে ফের শিয়া মানচিত্রে পুনঃস্থাপনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন তিনি। শায়খ হায়রির কুমে পৌঁছানোর অল্প পরেই ব্রিটিশরা সত্যিই কয়েক জন নেতৃস্থানীয় উলেমাকে ইরাক থেকে বহিষ্কার করে। সবচেয়ে বিজ্ঞ দুজনের একজন ‘সংবিধানবাদী’ মুজতাহিদ নাইনি কুমে বাস করতে আসেন। শহর আবার পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠতে শুরু করে। মাদ্রাসাগুলো নতুন করে সাজানো হয়, বিশিষ্ট পণ্ডিতগণ সেখানে শিক্ষা দান শুরু করেন, ভালো ভালো ছাত্রদের আকর্ষণে সক্ষম করে তোলে তাঁদের। নবাগতদের ভেতর একজন ছিলেন জ্ঞানী ও জগৎবিমুখ আয়াতোল্লাহ সায়ীদ আকা হুসেইন বোরুজারদি (১৮৭৫-১৯৬১); তিনি শিয়াহদের মারজে-ই তাকলিদ-সর্বোচ্চ আদর্শ-পরিণত হয়েছিলেন, কুমের আরও পণ্ডিতদের আকর্ষণ করেন তিনি।৯৯ ক্রমে কুম নাজাফকে ৷১৯ প্রতিস্থাপিত করতে শুরু করে, ১৯৬০ ও ১৯৭০-র দশকে ইরানের ধর্মীয় রাজধানী ও তেহরানের রাজকীয় রাজধানী বিরোধীদের কেন্দ্রে পরিণত হবে তা। কিন্তু প্রাথমিক এই বছরগুলোতে কুমের মোল্লাহরা শিয়া ঐতিহ্য অনুসরণ করে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন; যেকোনও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শাহর রোষ ডেকে আনত, কুমের পুনরুজ্জীবন শিশুকালেই দমন হয়ে যেত।

দ্বিতীয় মারাত্মক ঘটনাটা ছিল ১৯২০ সালে কুমে এমন একজন মানুষের আগমন যিনি ইরানের সবচেয়ে বিখ্যাত মোল্লাহয় পরিণত হবেন। শায়খ হায়রি ইয়াযদি পশ্চিম ইরান থেকে কুমে আসার সময় কয়েকজন শিষ্যকে নিয়ে এসেছিলেন, তরুণ রুহুল্লাহ মুসাভি খোমেনি (১৯০২-৮৯) ছিলেন তাঁদের একজন। প্রথমে অবশ্য খোমেনিকে বরং প্রান্তিক চরিত্র মনে হয়েছে। ফায়যিয়াহ মাদ্রাসায় ফিকহ পড়াতেন তিনি, তবে পরে নৈতিকতা ও অতীন্দ্রিয়বাদে (ইরফান) বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠবেন; ফিকহের তুলনায় এগুলোকে বরং ‘প্রান্তিক’ বিষয়ই বলা যেতে পারে। তাছাড়া, মোল্লাহ সদ্রার অতীন্দ্রিয়বাদের চর্চা করতেন খোমেনি, দীর্ঘদিন ধরেই প্রশাসন যাকে তীর্যক চোখে দেখে এসেছে। রাজনৈতিক প্রশ্নে তাঁর আগ্রহ আছে বলে মনে হলেও সেটা তাঁর যাজকীয় পেশার উন্নতির লক্ষ্যে চিন্তা করা হয়নি; বিশেষ করে প্রাচীন শিয়া নীরবতাবাদ অনুসরণকারী ও রাজনীতিতে অংশ গ্রহণের ব্যাপারে উলেমাদর উপর নিষেধাজ্ঞা জারিকারী আয়াতোল্লাহ বোরুজারদি মারজা পরিণত হওয়ার পর। ইরানে উত্তাল সময় ছিল এটা, কিন্তু স্পষ্ট রাজনৈতিক উদ্বেগ সত্ত্বেও খোমেনি সক্রিয় কর্মীতে পরিণত হননি। তারপরেও ১৯৪৪ সালে কাশফ আল-আসরার (‘দ্য ডিসকভারি অভ সিক্রেটস’) প্রকাশ করেছিলেন তিনি, সেই সময়ে তেমন একটা মনোযোগ টানতে না পারলেও এটাই শিয়া দৃষ্টিকোণ থেকে প্রথমবারের মতো পাহলভী নীতির প্রতি চ্যালেঞ্জের প্রয়াস ছিল। এই পর্যায়ে খোমেনি তখনও সংস্কারক, কোনও অর্থেই মৌলবাদী নন। তাঁর অবস্থান অনেকটা শরীয়াহ সাথে বিরোধপূর্ণ সংসদীয় আইন বাতিলের ক্ষমতাসহ মুজতাহিদদের প্যানেলের ধারণা মেনে নেওয়া ১৯০৬ সালের প্রথম মজলিসের অনুরূপ ছিল। তখনও পুরোনো সংবিধানের সমর্থক ছিলেন খোমেনি, এই আধুনিক প্রতিষ্ঠানকে ইসলামি প্রেক্ষিতে স্থাপনের প্রয়াস পাচ্ছিলেন। কেবল ঈশ্বরেরই আইন জারি করার ক্ষমতা রয়েছে, যুক্তি দেখিয়েছেন তিনি, শিয়াদের পক্ষে আতাতুর্ক বা রেযা শাহ’র মতো কোনও শাসককে মানা যুক্তিসঙ্গত নয়, যাঁরা ইসলামকে ধ্বংস করার জন্যে সাধ্যমতো সবই করেছেন। কিন্তু এমনি প্রাথমিক সময়ে তখনও একজন যাজকই সরাসরি দেশ শাসন করবেন, এমন পরামর্শ দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট প্রথাগত ছিলেন খোমেনি: শত শত বছরের শিয়া রেওয়াজ বিরোধী হত সেটা। তাঁর তত্ত্ব অনুযায়ী ঈশ্বরের বিধিবিধানের উপর জ্ঞানধারী মুজতাহিদগণ একজন সাধারণ সুলতান নির্বাচনের অনুমতি রাখেন, যিনি তাদের জানা মতে স্বর্গীয় বিধান অমান্য করবেন না বা জনগণের উপর নির্যাতন করবেন না। ১০০

খোমেনির বই প্রকাশিত হতে হতে ব্রিটিশরা জার্মানপন্থী সহানুভূতির কারণে শাহকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করেছে, বইটি দেখিয়ে দিয়েছিল যে স্বাধীনতা নিয়ে শোরগোলময় নিশ্চয়তা সত্ত্বেও কাজারদের মতোই ইউরোপিয় শক্তির নিগড়ে বন্দি ছিলেন তিনি। ১৯৪৪ সালে রেযার মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে মুহাম্মদ রেযা (১৯১৯-৮০) উত্তরাধিকারী হন; তিনি ছিলেন অপেক্ষাকৃত শান্ত এবং এই পর্যায়ে দুর্বল চরিত্র। এক কঠিন সময়ে সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ইরানে দারুণরকম বিঘ্নকারী ছিল; শিল্পকারখানাগুলো অচল হয়ে গিয়েছিল, যন্ত্রপাতি ক্ষয়ে গেছে, ব্যাপকবিস্তারি দুর্ভিক্ষ চলছিল। সুযোগের অভাবে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছিল নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণী; এমনি কঠিন একটা সময়ে ইরানি তেলের উপর ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ বিরাজ করছিল। উলেমাগণ অবশ্য খুশি ছিলেন। নতুন শাহ তখনও তাঁদের দাবির বিরোধিতা করার মতো শক্তিশালী হয়ে ওঠেননি: আশুরার আবেগি নাটক ও আবৃত্তি আবার চালু করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, ইরানিরা ফের হজ্জে যাবার অনুমতি লাভ করে; মহিলাদেরও বোরখা পরার অনুমতি দেওয়া হয়। বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব ঘটে এই সময়: সোভিয়েতপন্থী মুহাম্মদ মুসাদ্দিকের (১৮৮১-১৯৬৭) নেতৃত্বে তুদেহ বা দ্য ন্যাশনাল ফ্রন্ট ইরানি তেলের জাতীয়করণের দাবি তোলে, এবং একটি নতুন প্যারামিলিটারি গ্রুপ ফেদায়িন-ই ইসলাম (‘ফাইটার্স অভ ইসলাম’)-সেক্যুলারিস্ট এজেন্ডার পক্ষাবলম্বনকারীদের সন্ত্রস্ত করে তুলছিল এরা।

১৯৪৫ সালে যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকারের কারাবন্দি করে রাখা আয়াতোল্লাহ সায়ীদ মুস্তাফা কাশানি (c. ১৮৮২-১৯৬২) ১০১ ইরানে ফিরে আসার অনুমতি লাভ করেন। তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে বিশাল জনসমাবেশ ঘটে, তাঁর গাড়ির নিচে গালিচা পেতে দেওয়া হয়। বাস ভর্তি করে বিপুল সংখ্যক মেধাবী উলেমা কাশানির দেশ প্রত্যাবর্তনে স্বাগত জানাতে অনেক দূর পথ পাড়ি দিয়ে হাজির হয়েছিলেন, দলে দলে নেমে এসেছিল মাদ্রাসার মহাআনন্দিত ছাত্ররা।১০২ কাশানি ছিলেন এই সময়ে ভবিষ্যৎ ঘটনাপ্রবাহের তৃতীয় আলামত। তাঁর অসাধারণ জনপ্রিয়তা হয়তো অভিজ্ঞ পর্যবেক্ষককে আভাস দিয়ে থাকবে যে, ইরানিরা সম্ভবত কোনও সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক বেশি উৎসাহের সাথে রাজনৈতিক বিষয়ে যাজকদের অনুসরণ করবে। কাশিয়ানি ও খোমেনি পরস্পরকে ভালো করেই চিনতেন, কিন্তু আসলে তাঁরা ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রের। খোমেনি যেখানে ছিলেন দারুণ শৃঙ্খলা পরায়ণ, কোনও উদ্দেশ্য অর্জনের একরোখা, কাশানি সেখানে অনেক বেশি খেয়ালি, হুজুগে মেতে উঠতে ইচ্ছুক ছিলেন, তাঁর কিছু পরিকল্পনা নৈতিক দিক থেকে সমর্থনযোগ্য ছিল না। জার্মানপন্থী কর্মকাণ্ডের জন্যে ব্রিটিশরা ১৯৪৩ সালে তাঁকে কারাবন্দি করেছিল: কাশানির চোখে নাৎসিদের দুরাচার তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, বরং ব্রিটিশদের কবল থেকে ইরানিদের রক্ষা পেতে সাহায্য করতে পারার ব্যাপারটাই আসল।১০৩ ফেদায়িন-ই ইসলামের সাথেও যোগাযোগ ছিল কাশানির। ১৯৪৯ সালে তাদের একজন শাহকে হত্যার চেষ্টা করলে কাশানিকে নির্বাসনে পাঠানো হয়। বেইরুত থেকে ন্যাশনাল ফ্রন্ট পার্টিতে যোগ দিয়ে ১৯৪৯ সালের জুলাই মাসে তেলের জাতীয়করণের পক্ষে একটি ফতওয়া জারি করেন তিনি। ১৯৫০ সালে ইরানে ফিরে আসার অনুমতি পান কাশানি, নায়কোচিত অভ্যর্থনা লাভ করেন। তাঁর আগমনের আগের দিন সন্ধ্যা থেকেই জনতা মেহরাবাদ এয়াপোর্টে ভীড় জমাতে শুরু করে। তেল ইস্যুর কল্যাণে মুসাদ্দিকের নাশনাল ফ্রন্ট সবে নির্বাচনে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছিল, প্রবীন উলেমাদের অভ্যর্থনা কমিটিতে যোগ দেন তিনি; কাশানি বিমান থেকে নেমে এলে শোরগোল এমন প্রবল হয়ে উঠেছিল যে, তাঁর সম্মানে নির্ধারিত ভাষণ বাদ দিতে হয়েছিল। তিনি তেহরানের নিজ বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলে জনতা আচ্ছন্ন হয়ে ওঠে, অনেক সময় তার গাড়িটিকে রাস্তা থেকে শূন্যে তুলে ফেলছিল তারা।১০৪

এই বছরগুলোর চতুর্থ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল তেল সংকট,[১০৫] ১৯৫৩ সালে অ্যাংলো-পার্সিয়ান অয়েল কোম্পানির সমর্থক প্রধানমন্ত্রী আলি রাযমারা ফেদায়িনদের হাতে নিহত হলে এই সংকট প্রবল হয়ে ওঠে। দুই দিন পরে মজলিস সরকারকে তেল সম্পদ জাতীয়করণের পরামর্শ দেয়। শাহর প্রার্থীকে প্রতিস্থাপিত করে মুসাদ্দিক পরিণত হন প্রধানমন্ত্রীতে। ইরানি তেল জাতীয়করণ করা হয়, কিন্তু দ্য হেগের আন্তর্জাতিক আদালত নিজস্ব তেল সম্পদ জাতীয়করণে ইরানের অধিকারের পক্ষে রায় দিলেও ব্রিটিশ ও আমেরিকান তেল কোম্পানিগুলো একজোট হয়ে ইরানি তেলের বিরুদ্ধে অঘোষিত অবরোধে যোগ দেয়। ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়া মুসাদ্দিককে ইরানকে ইউএসএসআর-এর হাতে তুলে দেওয়া (যদিও মুসাদ্দিক ইরানকে বিদেশী নিয়ন্ত্রণ মুক্ত রাখতে ইচ্ছুক জাতীয়তাবাদী ছিলেন) বিপজ্জনক ফ্যনাটিক, তস্কর (যদিও তিনি সব সময়ই ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছেন) ও কমিউনিস্ট হিসাবে চিত্রিত করে। অবশ্য ইরানে মুসাদ্দিক ছিলেন বীর, অনেকটা স্যুয়েয খাল জাতীয়করণের পর নাসের যেমনটা পরিণত হবেন। শাহকে বঞ্চিত করে নিজ হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে শুরু করেন তিনি। ১৯৫২ সালের জুলাই মাসে তিনি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ দাবি করামাত্র শাহ তাঁকে বরখাস্ত করেন, কিন্তু মুসাদ্দিকের পক্ষে এক গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত হয়, ফলে রয়ালিস্টরা সতর্ক হয়ে ওঠে, কারণ এতে বোঝা যাচ্ছিল ইরানিরা প্রজাতান্ত্রিক শাসন দাবি করার উপান্তে পৌঁছে গেছে। দাঙ্গা মুসাদ্দিকের অপসারণ আকাঙ্ক্ষী লন্ডন ও ওয়াশিংটনকেও অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। এইসব বিক্ষোভে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন আয়াতোল্লাহ কাশানি, কাফনের কাপড় পরে রাস্তায় নেমে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে পবিত্র যুদ্ধে প্রাণ দেওয়ার ইচ্ছার কথা ঘোষণা করেন। মাত্র দুই দিন পরে মুসাদ্দিককে পুনর্বহাল করতে বাধ্য হন শাহ।

এমনি মুহূর্তে এযাবত উদারশক্তি হিসাবে বিবেচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানে রাজনৈতিক সরলতা হারায়। ১৯৫৩ সাল নাগাদ মুসাদ্দিকের পক্ষে সমর্থন হ্রাস পেতে শুরু করেছিল। কখনও সশস্ত্র বাহিনীর পূর্ণ আনুগত্য লাভ করতে পারেননি তিনি। কিন্তু তেল অবরোধ এবার দারুণ অর্থনৈতিক সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, বাজারিরা তাঁকে ত্যাগ করেছিল। কাশানিসহ। উলেমারাও : মুসাদ্দিক ধর্মকে ব্যক্তিপর্যায়ে অবনমিত করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ অন্তপ্রাণ সেক্যুলারিস্ট ছিলেন। মজলিস বাতিল করার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী ভেবেছিলেন নিজেকে। এতে শিয়া যাজকগোষ্ঠী স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ভীত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এইসব পুরোনো মিত্ররা মুসাদ্দিককে পরিত্যাগ করলেও সেক্যুলারিস্ট তুদেহ পাটি তাঁর সমর্থনে এগিয়ে আসে। ফলে প্রেসিডেন্ট ডিউইট আইজেনহাওয়ারের নেতৃত্বাধীন মার্কিন সরকার কমিউনিস্টপন্থী অভ্যুত্থানের আশঙ্কায় সতর্ক হয়ে ওঠে। এই কারণে মুসাদ্দিককে অপসারণ করার লক্ষ্যে ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্স ও সিআইএ-র পরিকল্পিত অভ্যুত্থান প্রয়াস অপারেশন অ্যাক্সিসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অংশ গ্রহণের অনুমোদন দেন তিনি। অবশ্য ১৯৫৩ সালের আগস্টে মুসাদ্দিক এই ষড়যন্ত্রের আভাস পান, জানাজানি হওয়ার ক্ষেত্রে শর্তানুযায়ী দেশ থেকে চলে যান শাহ ও রানি, কিন্তু তিন দিন পরে সিআইএ এজেন্টদের আশ্রয়ে আবার ফিরে আসেন। তারা অসন্তুষ্ট ইরানি ও সামরিক বাহিনীর প্রধান ব্যক্তিদের মাধ্যমে অভ্যুত্থানের আয়োজন করে যাতে মুসাদ্দিক গদিচ্যুত হন। পরে এক সামরিক আদালতে তাঁর বিচার করা হয়, নিজের পক্ষে অত্যন্ত চমৎকারভাবে যুক্তি তুলে ধরেন তিনি, মৃত্যুদণ্ড থেকে বেঁচে গেলেও জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নজরবন্দি হয়ে কাটাতে হয়েছিল তাঁকে।

দেশে উল্লেখযোগ্য অসন্তোষ বিরাজ না করলে ১৯৫৩ সালের অভ্যুত্থান সফল হতে পারত না, তবে এটাও ঠিক যে বিদেশী হস্তক্ষেপ ছাড়া এমন ঘটনা ঘটত না। ইরানিরা এত দিন পর্যন্ত বন্ধু জেনে আসা দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেইমানি ও অপমানের শিকার হয়েছে বলে মনে করেছে। আমেরিকা এখন রাশিয়া ও ব্রিটিশদের পদচিহ্ন অনুসরণ করছে, নিজেদের ফায়দা অর্জনের জন্যে ইরানের ঘটনাপ্রবাহের বিশ্রিভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। ১৯৫৪ সালে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল বলে মনে হয়। এক নতুন তেল চুক্তি তেল উৎপাদন, এর বিপনন, শতকরা পঞ্চাশ ভাগ মুনাফা ওয়ার্ল্ড কার্টেল কোম্পানিগুলোর কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিল।১০৬ ব্যাপারটা চিন্তাশীল ইরানিদের অসুস্থ করে তোলে। আন্তর্জাতিক আদালতের সমর্থন নিয়ে নিজেদের সম্পদের নিয়ন্ত্রণ পেতে চেষ্টা করেছিল তারা, কিন্তু তার মর্যাদা দেওয়া হয়নি। ভীত হয়ে উঠেছিলেন আয়াতোল্লাহ কাশানি। আমেরিকার সাহায্য ইরানে মাত্র মুষ্টিমেয় কিছু লোকের উপকারে এসেছে, প্রতিবাদ করেন তিনি, পেট্রডলারের হিসাবে ইরান থেকে যে পরিমাণ সম্পদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে গেছে তার শতভাগের এক ভাগেরও সমান নয় তা। ‘আমেরিকান উপনিবেশবাদী সাম্রাজ্যবাদীরা তেলের যে শত শত মিলিয়ন ডলার লাভ করবে,’ ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন তিনি, “তার বিনিময়ে নিপীড়িত জাতি মুক্তির সমস্ত আশা খোয়াবে, পাশ্চাত্য বিশ্ব সম্পর্কে নেতিবাচক মত সৃষ্টি হবে।১০৭

অন্তত এই দিক থেকে ঠিক কথাই বলেছিলেন কাশানি। ইরানিরা অপারেশন অ্যজাক্সের কথা ভাববার সময় মুসাদ্দিকের পক্ষ থেকে তাদের নিজেদের লোকদের সরে যাওয়ার কথা ভুলে যায়, মনে প্রাণে বিশ্বাস করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার নিজের স্বার্থে একা হাতে তাদের উপর শাহর স্বৈরাচার চাপিয়ে দিয়েছে। ১৯৬০-র দশকের গোড়ার দিকে তিক্ততা প্রবল হয়ে ওঠে, শাহর শাসন এই সময় আরও স্বৈারচারী ও নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছিল। দ্বৈতনীতি চলছিল যেন। আমেরিকা গর্বের সাথে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রে বিশ্বাসের কথা ঘোষণা করলেও নিজ শাসনের কোনও রকম বিরোধিতার অনুমতি দিতে অস্বীকারকারী, ইরানিদের মানবাধিকার অস্বীকার যাওয়া শাহকে আন্তরিকভাবে সমর্থন যোগাচ্ছিল। ১৯৫৩ সালের পর ইরান আমেরিকার সুবিধাপ্রাপ্ত মিত্রে পরিণত হয়। প্রধান তেল উৎপাদনকারী দেশ হিসাবে ইরান ছিল আমেরিকান সেবা ও প্রযুক্তির প্রধান বাজার। আমেরিকা ইরানকে অর্থনৈতিক সোনার খনি মনে করত। বছর পরিক্রমায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটিশদের প্রয়োগ করা রাজনৈতিক প্যাটার্নই কাজে লাগিয়েছে: তেল বাজারে শক্ত হাতের কৌশল, রাজণ্যের উপর অন্যায় প্রভাব, কূটনৈতিক দায়মুক্তির দাবি, ব্যবসা ও বাণিজ্য ছাড় এবং খোদ ইরানিদের প্রতি এক ধরনের পরিহাসের দৃষ্টিভঙ্গি। আমেরিকান ব্যবসায়ী ও উপদেষ্টাতে দেশ ভরে গিয়েছিল, অনেক টাকা পয়সার মালিক বনে গিয়েছিল তারা। তাদের জীবন ধারার সাথে অধিকাংশ ইরানির জীবনধারার বিশাল পার্থক্য ছিল; সাধারণ মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় বাস করত তারা, বেশির ভাগই সিংহাসনের সাথে সম্পর্কিত চুক্তির অধীনে কাজ করত বলে শাসকগোষ্ঠীর সাথে মারাত্মকভাবে সম্পর্কিত হয়ে উঠেছিল। এটা ছিল অদূরদর্শী, স্বার্থপর নীতি শেষ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে একটা দানবীয় চেহারা দেবে।

মেরুকৃত দেশে পরিণত হচ্ছিল ইরান: আমেরিকান বুম থেকে অল্প কিছু মানুষ ফায়দা পাচ্ছিল, কিন্তু বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ পড়ে ছিল পেছনে। ইরান একা ছিল না। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ মনে করা হচ্ছিল যেন আমাদের বিবেচিত সমস্ত দেশের সমাজগুলো দুটি ভিন্ন শিবিরে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ আধুনিক কালকে মুক্তিদায়ী ও ক্ষমতায়নের উপায় হিসাবে দেখছিল, বাকিরা একে অশুভ আক্রমণ বিবেচনা করেছে। ভীতি, ঘৃণা ও কোনওমতে চাপা পড়া ক্রোধ বিরাজ করছিল। অচিরেই তীব্রভাবে ক্রোধবোধকারী এই মৌলবাদীরা স্থির করবে যে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে প্রতি-সংস্কৃতি গড়ে তোলা আর যথেষ্ট নয়। অবশ্যই সংগঠিত হয়ে পাল্টা আক্রমণ চালাতে হবে তাদের।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *