পৃথু কাঁদছে।
শামসুদ্দিন বিছানায় শুয়ে শুয়ে ছেলেটার কান্না শুনছেন। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না। বেচারা কান্না বন্ধ করার চেষ্টা করছে, পারছে না। নিশ্চয়ই কোনো কঠিন শাস্তির ভেতর দিয়ে তাকে যেতে হচ্ছে। শামসুদ্দিনের ইচ্ছা করছে ছেলেটাকে উদ্ধার করার চেষ্টা করেন। সকালে ঘুম ভাঙবে বাচ্চা একটা ছেলের কান্নায় এটা কেমন কথা? রাহেলাকে কি বুঝিয়ে ব্যাপারটা বলা যায়?
শামসুদ্দিন উঠে বসেছেন। কী করবেন মনস্থির করতে পারছেন না। রফিক বাসায় আছে। তার কথা শোনা যাচ্ছে। ছেলের মহাবিপদ হলে সে এগিয়ে যাবে, কাজেই তাকে খুব বেশি চিন্তিত না হলেও হবে। তিনি ঘড়ির দিকে তাকালেন, আটটা পাঁচ। অনেক বেলা হয়ে গেছে। অন্যদিন ভোর ছটার আগেই তার ঘুম ভাঙে। আজ আটটা পর্যন্ত একটানা ঘুমিয়েছেন। গত রাতে ঘুম ভালো হয়েছে। শরীর প্রফুল্ল। শুধু পৃথুর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদার কারণে মনটা খারাপ হয়ে আছে। এমন কোনো দোয়া কি আছে যা পড়লে মায়ের মনে শিশুদের প্রতি করুণা জাগে?
ভাইজানের ঘুম ভেঙেছে?
শামসুদ্দিন দেখলেন হাসিমুখে রফিক ঢুকেছে। তার হাতে ট্রে। ট্রেতে দুকাপ চা। একটা পিরিচে দুটা টোস্ট বিস্কিট। এক গ্লাস পানি। রফিক টেবিলে
ট্রে নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল, বেড-টি এনেছি।
শামসুদ্দিন বললেন, এখনো মুখ ধোয়া হয় নি।
রফিক হাসতে হাসতে বলল, বেড-টি বাসিমুখে খেতে হয়। বিদেশে যাচ্ছেন বেড-টি খেতে হবে। এখন থেকে প্র্যাকটিস করুন। খুব বেশি অস্বস্তি লাগলে কুলি করে নিন। বাসিমুখে চা খেতে পারবেন না ভেবেই পানি নিয়ে এসেছি। বেড-টি খাওয়ার নিয়ম অবশ্যি তা না। প্রথম যে জিনিসটা মুখে ঢুকবে সেটা হচ্ছে গরম চা, কিংবা গরম কফি। গরম পানিতে মুখের ময়লা ধুয়ে স্টমাকে চলে যাবে। মুখ হবে ক্লিন।
শামসুদ্দিন বললেন, পৃথু কাঁদছে কেন?
রফিক বলল, তাকে নাঙ্গু বাবা করা হয়েছে, এই জন্যে কাঁদছে।
নাঙ্গু বাবা মানে কী?
আবার বিছানা ভিজিয়েছে বলে রাহেলা তাকে শাস্তি দিয়েছে। পৃথু আজ সারাদিন কোনো প্যান্ট পরতে পারবে না। নেংটো হয়ে ঘুরে বেড়াতে হবে। পৃথু কাঁদছে লজ্জায়।
শামসুদ্দিন মন খারাপ করে বললেন, বাচ্চা একটা ছেলেকে এটা কেমন শাস্তি?
রফিক বলল, আপনি আরাম করে চা-টা খান তো ভাইজান! আমি পৃথুকে উদ্ধারের ব্যবস্থা করব। রাহেলার মেজাজ আজ অতিরিক্ত খারাপ, এই জন্যে তাকে ঘাটাচ্ছি না। মেজাজ নামুক।
শামসুদ্দিন চায়ে চুমুক দিচ্ছেন। পৃথুর ফুঁপিয়ে কান্নাটা মন থেকে দূর করতে পারছেন না।
রফিক বলল, চা-টা ভালো হয়েছে ভাইজান? আমি বানিয়েছি।
ভালো হয়েছে।
আজ এক কৌটা কফি কিনে আনব। কফি খাওয়ার অভ্যাস হওয়া দরকার। আমেরিকায় শুনেছি সবাই কফি খায়। চায়ের চল নেই। বৃটিশরা চা ভক্ত।
কফি আনতে হবে না রফিক।
ভাইজান, যাবার তারিখ কি ঠিক হয়েছে?
খুব সম্ভব আগামী মাসের ৭ তারিখে যাব। জয়নাল ছেলেটা সে-রকমই ঠিক করেছে।
জয়নালের সঙ্গে এখনো ঝুলে আছেন? বললাম না এই ছেলের কাছ থেকে দূরে থাকতে! আমেরিকায় পৌঁছেই এই ছেলে আপনার ডলার নিয়ে কেটে পড়বে।
ছেলেটা ভালো।
আপনার কাছে তো সবই ভালো। আমার সাবধান করে দেবার কথা, সাবধান করে দিলাম। আগামী মাসের সাত তারিখে চলে যাবেন, হাতে তো তাহলে সময় একেবারেই নেই। আপনার কী কী খেতে ইচ্ছা করে দয়া করে বলবেন। ব্যবস্থা করব।
শামসুদ্দিন বললেন, তুমি এমনভাবে কথা বলছ যেন আমি মারা যাচ্ছি। মৃত্যুর আগে প্রিয় খাবারগুলি খেতে হবে।
সাত সমুদ্র তের নদী পার হচ্ছেন। দেশী খাওয়া-খাদ্য কতদিন পাবেন না। কচুর লতি, মলা মাছ, উচ্ছে ভাজি, মাষকলাইয়ের ডাল–আমেরিকায় এইসব পাবেন না।
আমার খাওয়া নিয়ে তুমি মোটেই চিন্তা করবে না। তুমি রাহেলার দিকে একটু নজর দাও। ইদানীং তার মেজাজ এত খারাপ হয়েছে।
রফিক সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, মেজাজ আসলেই বেশি খারাপ হয়েছে। পেটের সন্তান খালাস না হওয়া পর্যন্তু মেজাজ ঠিক হবে না। পৃথু যখন পেটে ছিল তখনো এরকম মেজাজ খারাপ থাকত। একবার তো ছাদে গিয়ে উঠল–তিনতলা থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়বে এরকম প্ল্যান। আমি হাতে পায়ে ধরে নামিয়ে এনেছিলাম। একেক মেয়ের একেক নেচার।
ডাক্তারের সঙ্গে কথা বললে হয় না?
কথা বলেছি। ডাক্তার বলেছে এটা এমন কিছু না। হরমোনাল ইমব্যালান্স থেকে এরকম হয়। ঠিক হয়ে যাবে। আমাকে বলেছে তাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে খুশি রাখার চেষ্টা করতে। আমি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। রাহেলা যাই বলছে আমি তাতেই সায় দিচ্ছি। রাহেলা বলল, বিছানা ভিজাননার শাস্তি হিসেবে পৃথু সারাদিন পান্ট ছাড়া থাকবে। আমি বলেছি, অবশ্যই তাই থাকবে। ভাইজান কি চায়ের সঙ্গে একটা সিগারেট খাবেন?
শামসুদ্দিন সিগারেট নিলেন। রফিক সিগারেট ধরিয়ে দিতে দিতে বলল, রাহেলাকে খুশি করার আরেকটা বুদ্ধি বের করেছি ভাইজান!
কী বুদ্ধি?
ভালো সেন্ট ওর পছন্দ। ভালো সেন্টের এমন দাম, কিনে দেওয়া সম্ভব না। তারপরও দু বোতল সেন্ট কিনে এনেছি। সেন্ট পেলে সে এক সপ্তাহ খুশি থাকবে। ফুস ফুস করে গায়ে সেন্ট ছাড়বে আর হাসবে।
রাহেলার সেন্ট এত পছন্দ জানতাম না তো!
খুবই পছন্দ। মাঝে মাঝে যখন দোকানে নিয়ে যাই ও কী করে জানেন? দুনিয়ার সেন্ট নেড়ে-চেড়ে দেখে। হাতে স্প্রে করে। গন্ধ শোঁকে। তখন তাকে দেখলে আপনার মনে হবে সে জগতের সুখী মহিলাদের একজন।
বলো কী!
রফিক সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বলল, সেন্টের শিশি দুটা আমি আপনার ড্রয়ারে রেখে দিচ্ছি ভাইজান। এক সময় তাকে ডেকে বলে দেবেন যে আপনি তার জন্যে কিনে এনেছেন। আপনার কাছ থেকে সেন্ট পেলে সে অনেক বেশি খুশি হবে।
শামসুদ্দিন তাকিয়ে রইলেন। সেন্টের শিশি তিনি দিলে রাহেলা বেশি খুশি হবে কেন ঠিক ধরতে পারছেন না।
রফিক বলল, আমার উপরে সে নানান কারণে রেগে আছে। আমি যদি দিই তাতে লাভ হবে না। হয়তো ছুড়ে ফেলে দেবে। দামি একটা জিনিস নষ্ট হবে।
শামসুদ্দিন বললেন, আমি সেন্টের শিশি দিয়ে তাকে কী বলব?
বলবেন আপনি তার জন্যে কিনেছেন।
মিথ্যা কথা বলা হবে তো।
সংসারে থাকতে হলে দুএকটা মিথ্যা কথা বলতে হয় ভাইজান। এতে দোষ হয় না। তারপরও আপনার যদি খারাপ লাগে আপনি আমাকে টাকা দিয়ে দেবেন। নেন, আরেকটা সিগারেট নেন। দেশে যেমন যে-কোনো জায়গায় আরাম করে সিগারেট ধরাতে পারবেন, আমেরিকায় পারবেন না। স্মোকিং ওরা দেশ থেকে তুলে দিচ্ছে। খুব হেলথ কনশাস জাতি।
শামসুদ্দিন আরেকটা সিগারেট ধরালেন। পৃথুর ফেঁপানি শোনা যাচ্ছে না। তিনি এতে স্বস্তি পাচ্ছেন। মনে হচ্ছে তার উপর দিয়ে ঝড় যা যাবার চলে গেছে। বাচ্চাটা আজকের মতো রেহাই পেয়েছে। শামসুদ্দিন মনে মনে ঠিক করে ফেললেন আজ বিকেলে পৃথুকে নিয়ে বের হবেন। তার পছন্দের কোনো খেলনা কিনে দেবেন। একটা কোন-আইসক্রিম কিনে দেবেন। বাবার হাত ধরে আইসক্রিম খেতে খেতে বাচ্চা একটা ছেলে গুট গুট করে এগুচ্ছে। কী সুন্দর দৃশ্য। পৃথুর মতো একটা ছেলে যদি তার থাকত!
পৃথু দরজার আড়ালে দাড়িয়ে আছে। তার খুবই লজ্জা লাগছে, কারণ তার পরনে প্যান্ট নেই। তার গায়ে হালকা গোলাপি রঙের একটা হাফশার্ট। শার্টের ঝুল এমন যে তার লজ্জা ঢাকা পড়ে। ঘরের ভেতর শুধু শার্ট পরে থাকতে হচ্ছে এই লজ্জাতেই সে মরে যাচ্ছে। লজ্জার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভয়, কারণ মা একটু আগে বলেছে পঞ্চকে এইভাবেই কাল স্কুলে যেতে হবে। মা এত নিষ্ঠুর আচরণ করবে বলে পৃথুর মনে হয় না। তবে করতেও পারে। রেগে গেলে মা নিষ্ঠুর আচরণ করে। সত্যি সত্যি তাকে যদি কাল এইভাবে স্কুলে যেতে হয় তাহলে কী হবে! সবাই তাকিয়ে থাকবে তার দিকে। হাসাহাসি করবে। ক্লাসের টিচার বলবেএই পৃথু, ছিঃ ছিঃ তুমি নেংটো হয়ে স্কুলে এসেছ কেন?
মার রাগ কি এর মধ্যে পড়বে না? অবশ্যই পড়বে। পৃথু মনে মনে বলল, আল্লাহ, মায়ের রাগ কমিয়ে দাও। গত শবেবরাতে মায়ের রাগ কমাবার কথাটা আল্লাহকে বলা দরকার ছিল। শবেবরাতে সে আল্লাহর কাছে অনেক কিছু চেয়েছে শুধু এই জিনিসটা চাইতে ভুলে গেছে। বিরাট ভুল হয়েছে। শবেবরাতে সে আল্লাহর কাছে যে সব জিনিস চেয়েছে তার মধ্যে আছে–
একটা ফুটবল (পাম্পারসহ)
একটা পেনসিল বক্স : (ডোনাল্ড ডাকের ছবিওয়ালা। তাদের ক্লাসের একটা মেয়ের আছে। মেয়েটির নাম অমি। মেয়েটা খুব ভালো।)।
বেনানা ইরেজার : (কলার মতো দেখতে ইরেজার। ইরেজারটার গায়ে পাকা কলার গন্ধ। মুস্তাক নামের একটা ছেলের আছে। ছেলেটা খুবই দুষ্ট। সবার সঙ্গে মারামারি করে।
তালাচাবি দেয়া খাতা; (চাবি দিয়ে রাখলে এই খাতা খোলা যায়। শান্তনুর এরকম খাতা আছে। শান্তনু হিন্দু। তার কোনোদিন মুসলমানি হবে না।)
দুই পকেটওয়ালা ফুলপ্যান্ট : (তাদের ক্লাসের সিরাজের এরকম প্যান্ট আছে। অনেকগুলি পকেট। প্যান্টের হাঁটুর কাছে জিপার আছে। জিপার খুললে ফুলপ্যান্টটা হাফপ্যান্ট হয়ে যায়।)
একটা পাজেরো জিপগাড়ি; (তাদের ক্লাসের মীরা নামের মেয়েটা এরকম গাড়িতে করে আসে। তাদের গাড়ির রঙ কালো। পৃথু আল্লাহর কাছে লাল রঙের গাড়ি চেয়েছে। মীরা মেয়েটাকে পৃথুর খুবই ভালো লাগে। পৃথু ঠিক করেছে সে কোনোদিন বিয়ে করবে না। তারপরও তাকে যদি বিয়ে করতেই হয় তাহলে সে মীরাকেই বিয়ে করবে। মীরা পৃথুকে পৃথু ডাকে না। ডাকে পৃথিবী। এটাও পৃথুর খুব ভালো লাগে। নাম বদলাবার কোনো ব্যবস্থা থাকলে সে নিজের নাম বদলে পৃথিবী রাখত। মনে হয় এরকম কোনো ব্যবস্থা নেই।)
অনেকক্ষণ হলো দরজার আড়ালে পৃথু দাঁড়িয়ে আছে। তার পানির পিপাসা পেয়েছে, কিন্তু পানি খাবার জন্যে দরজার আড়াল থেকে বের হবার সাহস পাচ্ছে। মা খাটে বসে আছেন। বের হলেই সে সরাসরি মায়ের সামনে পড়ে যাবে। পৃথুর কাছে আলাউদ্দিনের দৈত্যের চেরাগটা থাকলে দৈত্যকে বলত এক গ্লাস পানি এনে দিতে। অলিউদ্দিনের দৈত্যের চেরাগ যাদের কাছে আছে তারা কতই সুখী।
পৃথু!
রাহেলার কঠিন গলা শুনে পৃথু শক্ত হয়ে গেল। কান্নাটা থেমে গিয়েছিল, আবার তা ফিরে আসছে বলে মনে হলো। গলার কাছে শক্ত হয়ে গেছে। এটা কান্না আসার লক্ষণ।
কথা বলছ না কেন, পৃথু?
কী মা!
দরজার আড়াল থেকে বের হয়ে আস।
পৃথু দরজার আড়াল থেকে বের হয়ে এলো। রাহেলা চাপা-গলায় বলল, কাল এইভাবেই স্কুলে যাবে। মনে থাকবে?
পৃথু হাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
স্কুলের সবাই যখন জিজ্ঞেস করবে এই অবস্থা কেন? তখন বলবে আমি প্রতিরাতে বিছানা ভিজিয়ে ফেলি এই জন্যে এটা আমার শাস্তি। বলতে পারবে না?
পৃথু আবারো হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
এখন আমার সামনে থেকে যাও। আমার মাথা ধরেছে, আমি দরজা বন্ধু করে শুয়ে থাকব। খবরদার! প্যান্ট পরবে না। যেভাবে তোমাকে থাকতে বলেছি সেইভাবে থাকবে।
পৃথু আবারো মাথা নাড়ল। সে এক হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে আছে। কারণ তার কান্না এসে যাচ্ছে, কান্নাটা আটকানো দরকার। পৃথু চুপিচুপি শামসুদ্দিন সাহেবের ঘরের খাটের নিচে চলে গেল। খাটের নিচে লুকিয়ে বসে থাকলে কেউ তার এই অবস্থাটা দেখবে না।
শামসুদ্দিন দেখে ফেললেন। তিনি পৃথুকে কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না। নিজের একটা লুঙ্গি ছোট করে পৃথুকে পরিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। পৃথু ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তিনি কিছুই জিজ্ঞেস করছেন না। এটাও পৃথুর খুব ভালো লাগছে। শান্তি শান্তি লাগছে। ঘুম এসে যাচ্ছে। ঘুমিয়ে পড়লে সে হয়তো এই বিছানাও ভিজিয়ে দেবে। তাতে কোনো অসুবিধা হবে না। বড় মামা তাকে কিছুই বলবেন না। কাউকে জানাবেনও না। বড় মামার বিছানা সে আগেও কয়েকবার ভিজিয়েছে। বড় মামা প্রতিবারই বলেছেন, কাণ্ড দেখেছিস পৃথু রাতে পানি খাবার সময় বিছানায় পানি ফেলে দিয়েছি। মনে হয় তোর প্যান্টও ভিজিয়ে ফেলেছি। যা, তাড়াতাড়ি প্যান্ট বদলে আয়।
পৃথু!
জি বড় মামা।
আজ বিকেলে আমার সঙ্গে বেড়াতে যাবি?
কোথায়?
পার্কে খানিকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করব, তারপর যাব দোকানে। তুই যদি কিছু কিনতে চাস কিনে দেব।
আচ্ছা।
বড় মামা এখনো পিঠে হাত বুলাচ্ছেন। কী যে আরাম লাগছে! কারো কারো হাতে খুব মায়া থাকে। গায়ে হাত বুলালেই মায়ায় শরীর ভরে যায়। পৃথু ঘুমিয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পরেই রাহেলা ছেলের খোঁজে ঘরে ঢুকল। শামসুদ্দিন বললেন, ওকে ডাকিস না। ঘুমাচ্ছে। সামান্য জ্বরও মনে হয় এসেছে। গা গরম।
রাহেলা বলল, ও যে আমাকে কী যন্ত্রণা করছে ভাইজান! একটাতেই এই অবস্থা, দুনম্বরটা আসলে কী যে হবে!
শামসুদ্দিন বললেন, তুই এই চেয়ারটায় বেসি।
রাহেলা বিস্মিত হয়ে বলল, কেন? কিছু বলবে? পৃথুর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করি এটা নিয়ে উপদেশমূলক কথা বলবে?
না। আমি কখনো কাউকে উপদেশ দিই না। তুই আরাম করে বোস।
রাহেলা বসল। শামসুদ্দিন টেবিলের ড্রয়ার খুলতে খুলতে বললেন, তোর জন্যে সামান্য উপহার এনেছি। এই নে।
রাহেলা থমথমে গলায় বলল, এইগুলো কখন কিনেছ?
কখন কিনেছি এটা দিয়ে তোর দরকার কী?
দরকার আছে। আমার ধারণা তুমি সেন্টের বোতল দুটা গত পরশু কিনেছ।
আমার মনে নেই, হতে পারে।
হতে পারে-টারে না। অবশ্যই তুমি গত পরশু কিনেছ। কীভাবে বুঝলাম সেটাও তোমাকে বলি। বললে তুমি বিশ্বাস করবে না, তারপরও বলি–আমি স্বপ্নে দেখেছি।
শামসুদ্দিন বিস্মিত হয়ে বললেন, স্বপ্নে দেখেছিস?
হুঁ, পরশু রাতে স্বপ্নে দেখেছি। কী স্বপ্ন সেটা তোমাকে বলা ঠিক হবে না।
বলা ঠিক না হলে বলতে হবে না।
আচ্ছা ঠিক আছে, কী স্বপ্নে দেখেছি তোমাকে বলি। না বললে শান্তি পাব না। আমার কোনো স্বপ্ন ফলে না। এটা কীভাবে ফলল কে জানে। খুবই অবাক লাগছে। ভাইজান, দেখ আমার গায়ে কাঁটা দিয়েছে। চোখে দেখে গায়ের কাটা বোঝা যাবে না। হাত দিয়ে দেখ। আমার গায়ে হাত রাখলে তোমার হাত পচে যাবে না। আমার এইডস হয় নি।
তোর গায়ে যে কাঁটা দিয়েছে এটা খালি চোখেই দেখতে পাচ্ছি। এখন স্বপ্নটা কী বল।
স্বপ্নে দেখেছি আমি তোমার সঙ্গে আমেরিকা গিয়েছি। দুজন হাঁটছি। রাস্তার দুপাশে বিশাল বড় বড় দোকান। একেকটা দোকান এত বড় যে আকাশ দেখা যাচ্ছে না। চারদিকে খুব শব্দ হচ্ছে। একটু পরপর মাথার উপর দিয়ে জেট প্লেন উড়ে যাচ্ছে। আমার খুবই ভয় লাগছে। তুমি বললে, আয় একটা দোকানে ঢুকে দেখি এদের দোকানগুলো কেমন। আমি তোমার সঙ্গে দোকানে ঢুকলাম। দোকানটা হলো পারফিউমের। রাজ্যের পারফিউম। কেনার সাধ্যও নাই, এত দাম। দোকানের একজন সেলসগার্ল আমাদের দেখে এগিয়ে এসে বলল, আপনারা কি প্রথম আমাদের দোকানে এসেছেন? তুমি বললে, হ্যাঁ। সেলসগার্ল বলল, প্রথম যারা আমাদের দোকানে আসে তাদেরকে একটা করে ফ্রি পারফিউম দিই। তোমরা দুজন তোমাদের পছন্দমতো দুটা পারফিউম বেছে নাও। তখন আমি ছুটে গিয়ে দুটা বেছে নিয়ে নিলাম। আমারটাও নিলাম। তোমারটাও নিলাম। এই হলো স্বপ্ন। অদ্ভুত স্বপ্ন না ভাইজান?
হুঁ।
ভাইজান শোন, তুমি যে আমাকে দুটা পারফিউম কিনে দিয়েছ এটা পৃথুর বাবাকে জানিও না।
কেন?
সে অন্য কিছু ভেবে বসতে পারে। কী দরকার!
অন্য কিছু ভাববে কেন?
ভাবলে আমি কী করব? আমি তো আর অন্যের ভাবনা কনট্রোল করতে পারি না। এই বিষয়ে তুমি পৃথুর বাবার সঙ্গে কোনো কথা বলবে না।
আচ্ছা।
রাহেলা চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে চাপা গলায় বলল, এত কিছু থাকতে তুমি বেছে বেছে আমার জন্যে পারফিউম কেন কিনেছ বলো তো? আচ্ছা থাক, বলতে হবে না। আমি জানি কেন কিনেছ।
শামসুদ্দিন দেখলেন রাহেলার চোখ চকচক করছে। সে মনে হচ্ছে এখনই কেঁদে ফেলবে। শামসুদ্দিনের মনটাই খারাপ হয়ে গেল।
পৃথুকে দোকানে নিয়ে গিয়ে শামসুদ্দিন একটা ফুটবল কিনে দিলেন। পৃথু হতভম্ব হয়ে গেল। শবেবরাতে আল্লাহর কাছে তো সে ফুটবলই চেয়েছিল। যা সে চেয়েছিল তাই তো পাচ্ছে। তবে ফুটবলের সঙ্গে সে একটা পাম্পারও চেয়েছিল। পাম্পারটা পাওয়া যায় নি।
শামসুদ্দিন বললেন, আর কী লাগবে বল।
পৃথু লজ্জিত গলায় বলল, আর কিছু লাগবে না।
লজ্জা করিস না, বল।
একটা পেনসিল-বক্স কিনব–ডোনাল ডাকের ছবিওয়ালা।
এই দোকানে সে-রকম পেনসিল-বক্স ছিল না। শামসুদ্দিন চার-পাঁচটা দোকান ঘুরে পৃথুর পছন্দের পেনসিল-বক্স কিনলেন। আশ্চর্য ব্যাপার, বেনানা ইরেজারও পাওয়া গেল। শামসুদ্দিন বললেন, আয় তোকে লাল টুকটুক একটা গেঞ্জি কিনে দিই।
গেঞ্জি কিনব না মামা। ফুলপ্যান্ট কিনব। হাঁটুর কাছে জিপার থাকে। জিপার খুললে ফুলপ্যান্টটা হাফপ্যান্ট হয়ে যায়।
কোথায় পাওয়া যায়?
কোথায় পাওয়া যায় আমি জানি না।
আয় খুঁজতে থাকি। কোথাও না কোথাও নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। তুই টায়ার্ড না তো?
না।
বিশেষ ধরনের প্যান্ট শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল। পৃথুর এত অবাক লাগছে! শবেবরাতে আল্লাহর কাছে যা যা চাওয়া হয়েছে সবই পাওয়া গেছে, শুধু লাল রঙের পাজেরো জিপটা এখনো পাওয়া যায় নি। তবে পাওয়া নিশ্চয়ই যাবে।
রাতে ঘুমোতে যাবার সময় রফিক বলল, রাহেলা তুমি কি গায়ে সেন্ট মেখেছ। নাকি? মিষ্টি গন্ধ আসছে।
রাহেলা বলল, গা থেকে মিষ্টি গন্ধ এলে কি তোমার ঘুমের অসুবিধা হবে? অসুবিধা হলে গরম পানি দিয়ে গোসল করে আসি।
রফিক বলল, খুবই মিষ্টি গন্ধ। সেন্ট কবে কিনলে? নাকি কেউ উপহার দিয়েছে?
এত কিছু বলতে পারব না। গন্ধটা ভালো লাগছে?
হ্যাঁ।
আমার কাছে আরেকটা সেন্ট আছে, সেটার গন্ধ এটার চেয়েও ভালো।
বলো কী।
দুটা সেন্টই আমাকে একজন উপহার দিয়েছে।
কে দিয়েছে? ভাইজান দিয়েছেন নাকি?
ভাইজান আমাকে সেন্ট দেবেন কেন? আমি কি ভাইজানের প্রেমিকা? হুট করে তুমি ভাইজানকে সন্দেহ করে ফেললে। তোমার লজ্জাও করল না? খালাতো ভাই হলেও তো সে ভাই।
সরি।
সেন্ট দুটা আমি নিজের টাকায় কিনেছি। কিছু প্রাইজবন্ড ছিল। প্রাইজবন্ড বিক্রি করে কিনেছি।
ভালো করেছ।
রাহেলা বিছানায় উঠে বসে উৎসাহের সঙ্গে বলল, আমার ঐ সেন্টের গন্ধটা শুঁকে দেখতে চাও?
রফিক বলল, অবশ্যই চাই। এক কাজ কর, আমার শার্টে খানিকটা স্প্রে করে দাও।
বোকার মতো কথা বলবে না, মেয়েদের সেন্ট তোমার গায়ে স্প্রে করব কেন? এত দামী একটা জিনিস খামাখা নষ্ট হবে।
তাহলে থাক।
রাহেলা সেন্টের শিশি বের করে নিয়ে এলো এবং রফিককে বিস্মিত করে তার শার্টে স্প্রে করে দিল। অনেক অনেক দিন পর রাহেলা ঘুমুতে যাবার সময় স্বামীর গায়ে হাত রাখল।