পাগলা দাশু
আমি একটা পাথরের চাতালে বসে আছি। বহু নীচে বাগরাকোটে যাওয়ার পিচের রাস্তার একটা বাঁক মাত্র চোখে পড়ে। তারও হাজার ফুট নীচে কোনও শাখানদীর জল সরু সুতোর মতো দেখা যায়। কিছুক্ষণ আগে বাগরাকোটমুখো এক লরি থেকে নেমে আমি যখন এই পাহাড়টা আবিষ্কার করতে শুরু করেছিলাম তখন এক কাঠরে, পাহাড় থেকে নামবার মুখে আমাকে বলল, সাবধানে যাবেন। ওপরে একটু আগেই আমি মস্ত এক সাপ দেখেছি। সাপের ভয়ে আমি থেমে থাকিনি। বর্ষায় পিছল সরু একটু পথের আভাস মাত্র পাহাড়ের গা বেয়ে উপরে উঠেছে। আলগা মাটি আর নুড়ি পাথরে কেডসে রবার শোল কামড়ে ধরে না বলে বারবার পা হড়কে যায়। ক্রমশ ভার হয়ে ওঠে চায়ের ফ্লাস্ক, জলের বোতল আর পাউরুটি এবং কলা বওয়ার ঝোলা ব্যাগ। লোহার নাল বসানো লাঠিখানা পর্যন্ত বোঝা বলে মনে হয়। মেধভাঙা চড়া রোদের গরমে সারা গা ঘামে সপসপে ভেজা। খাস ঘন ও গরম। বুকে হাফ।
অনেকটা উঠে এই পাথরের জিভ বের করা ব্যালকনি পাওয়া গেল। বেশির ভাগ গাছ লতা বা ঝোপ আমি চিনি না, বহু ফুল জন্মেও দেখিনি, বহু নতুন রকমের পাখির ডাক কানে আসছে। তাই যে কোনও পাহাড়ে ওঠাই আমার কাছে আবিষ্কারের মতো। পাহাড়ের চূড়া ঘন জঙ্গলে ঢাকা। তাই আর কতটা আমাকে উঠতে হবে তা বুঝতে পারছি না। তবে উঠব। উঠবই।
ফ্লাক্সের ঢাকনায় চা ঢেলে চুমুক দিই। বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে যায়। উঁচু থেকে আমি দক্ষিণের দিকে উদাস চোখে চেয়ে থাকি। দক্ষিণ দিকে পাহাড়ের খাড়ির ভিতর দিয়ে বহুদূরে এক ফালি সমতল দেখা যায়। রোদে ধু ধুকরা, দিগন্ত পর্যন্ত গড়ানো। এদিকে কলকাতা, যেখানে আমার জন্ম, যেখানে আমি একাল বেড়ে উঠেছি একটানা। হায়, আজ সকালে কলকাতার স্মৃতি আরও আবছা হয়েছে মনে করতে গিয়ে দেখি, ধর্মতলা দিয়ে মহানন্দা বয়ে যাচ্ছে। হাওড়ার পোলের ওপর গন্ধরাজের বাগান। শ্যামবাজারের দিকে বিশাল, নীলবর্ণ পাহাড় উঁচু হয়ে আছে। সায়ন্তনীর কপালটাও আজ মনে পড়ল না। যতবার ভেবেছি ততবারই দেখি, খুব ফরসা চেহারার একটা মেয়ে, লম্বাটে চেহারা, চোখদুটো ভীষণ উল। সায়ন্তনী ওরকম নয় মোটেই। সে ছোটখাটো রোগা, শ্যামলা এবং সাধারণ। জোর করে আবার মনে করার চেষ্টা করতে গিয়ে যে শ্যামলা এবং ছোটখাটো মেয়েটিকে দেখতে পেলাম সেও সায়নী নয়। ভাল করে লক্ষ করলে হয়তো লিচুর মুখের আদল আসত। আমি তাই ভয়ে চোখ খুলে ফেলি।
কাল লিচুদের বাড়িতে সত্যনারায়ণ পুজোর নেমন্তন্ন ছিল। হারমোনিয়াম ফেরত দেওয়ার পর এই প্রথম ওদের বাড়ি যাওয়া। বাড়িতে কাল অনেক এভিগেন্ডি কাচ্চাবাচ্চা আর গ্রাম্য মহিলাদের ভিড় হয়েছিল। দু’বাটি শিন্নি খাওয়ার পর লিচু আমাকে এসে চোখ পাকিয়ে বলল, কী হচ্ছেটা কী? কাঁচা আটার শিন্নি অত খেলে পেট খারাপ করবে যে।
আমি জীবনে কখনও শিমি খেয়েছি বলে মনে পড়ে না। কলকাতার বাড়িতে বা আশেপাশে কখনও সত্যনারায়ণ পুজোও হয়নি, বললাম, খেতে বড় ভাল তো!
ভাল বলেই কী? শিন্নি অত খেতে নেই।
আমি হতাশ হয়ে বাটিটা ফেরত দিই। কাঁঠাল, আম আর নারকেল মেশানো চমৎকার জিনিসটা আমি আরও দু’বাটি খেতে পারতাম। বললাম, তাহলে থাক।
অমনি আমার ওপর মায়া হল লিচুর। বলল, আহা রে, কিন্তু কী করি বলুন তো? এ জিনিস আপনাকে বেশি খাওয়াতে পারি না।
লিচু গিয়ে কিছুক্ষণ বাদেই আবার ফিরে এল।
বলল, সত্যিই আরও খেতে ইচ্ছে করছে?
আমি লাজুক মুখে বললাম, না, থাকগে।
দেখুন তো, আপনার আরও শিন্নি খাওয়ার ইচ্ছে ছিল, অথচ আমি আপনাকে খেতে দিইনি শুনে মা খুব রাগ করছে।
খচ্ করে একটা অম্বলের টেকুড় উঠল। পেটটাও বেশ ভরা ভরা লাগছিল ততক্ষণে। আমি বললাম, আমি আর খাবও না।
লিচু আমার মুখের দিকে খরদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, অম্বল হয়নি তো! দাঁড়ান জোয়ান এনে দিই।
আবার দৌড়ে চলে গেল। জোয়ান নিয়ে ফিরে এল।
কিছুক্ষণ বাদে এসে আবার জিজ্ঞেস করল, এখন একটু ভাল লাগছে? বড় বাটির দু’বাটি শিন্নি, যা ভয় হচ্ছে না আমার।
এক ঘর লোকের মধ্যেই এইসব করল লিচু।
মাঝখানে একবার ওর বাবা এসে খুব হেঁ হেঁ করে গেল খানিকক্ষণ। বলল, ঘরদোর আজ সব লিচই সাজিয়েছে। বড় কাজের মেয়ে।
ঘরদোরে অবশ্য সাজানোর কোনও লক্ষণ ছিল না। তবু আমি মাথা নেড়ে ই দিলাম।
এক ফাঁকে লিচুর মাও এসে দেখা করে গেলেন। বললেন, নিজে সবাইকে যত্ন আত্তি করতে পারছি না বাবা, কিছু মনে কোরো না। লিচুর ওপরেই সব ছেড়ে দিয়েছি। সে তোমার যত্ন আত্তি করেছে তো? তুমি অবশ্য ঘরের মোক।
এই সব কথাবার্তা এবং হাবভাবের মধ্যে আমি সুস্পষ্টই একটা ষড়যন্ত্রের আভাস পাই। পশুপতি খুব মিথ্যে বলেনি হয়তো।
সত্যি কথা বলতে কী, লিচুকে আমার খারাপ লাগে না। কিন্তু কেন খারাপ লাগে না তাই ভেবে ভেবে আমার মাথা গরম হয়ে ওঠে আজকাল। নিজের ওপরে ক্রমে রেগে যাই। লিচুকে খারাপ লাগাই তো উচিত, তবে কেন খারাপ লাগছে না আমার। চোরা নদীর স্রোতে তবে কি তলে তলে ভূমিক্ষয় হল আমার! এরপর একদিন হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ব?
জোৎস্নারাত্রি ছিল কাল। ফিরে আসার সময় লিচু আমাকে অনেকটা এগিয়ে দিল।
এখানকার জ্যোৎস্নাও কী সাংঘাতিক! সার্চ লাইটের মতো এমন স্পষ্ট ও তীব্র জ্যোৎস্না আমি খুব বেশি দেখিনি। এ যেন চাঁদের বিস্ফোরণ। আদিগন্ত পাহাড় পর্বত জ্যোৎস্নার মলমে মাখা। সেই জ্যোৎস্নায় পরির ছদ্মবেশ ধরেছিল লিচু। বলল, আপনার জন্য আমাকে সেদিন কাটুর কাছে কথা শুনতে হল।
আমি অবাক হয়ে বলি, কাটু আবার কে?
ও মা! অমিতদার ভাবী বউ, রায়বাড়ির মেয়ে। চেনেন না?
না তো। কেউ আমাকে বলেনি। অমিতদার কি বিয়ে ঠিক হয়ে আছে?
কবে!- লিচু হেসে বলল, আপনার সঙ্গে পরিচয়ও নেই! সত্যি বললেন?
আমি মিথ্যে বড় একটা বলি না।
লিচু খুব চোখ টেরে বলল, কিন্তু আপনার জন্য খুব দরদ দেখলাম যে। আপনি না চিনলেও কাটু আপনাকে ঠিকই চেনে। কত কথা শোনাল আপনার হয়ে।
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, আমার হয়ে তোমাকে কথা শোনানোর কী? কেনই বা শোনাচ্ছে?
সেই হারমোনিয়াম।
হারমোনিয়ামের পাট তো চুকে গেছে। আমি গান গাওয়া ছেড়েও দিয়েছি। আর এ হল আমার নিজের ব্যাপার, এতে অন্য কারও মাথা ঘামানোর কথা নয়।
কাটু হয়তো ভাবী দেওরের স্বার্থ ভেবেই বলেছে।
মেয়েটাকে চিনিয়ে দিয়ো। বকে দেব।
ও বাবা!– লিচু ভয়-খাওয়া হাসি হেসে বলল, কাটুকে বকার সাহস কারও নেই। যা দেমাক!
খুব দেমাক নাকি?
ভীষণ। অবনী রায়ের মতো পাত্রকেই পাত্তা দেয়নি।
দেমাক তোমারও আছে। আমি মেয়েদের দেমাক পছন্দ করি।
আহা, আমার দেমাক দেখলেন কোথায়?
দেখেছি। যার আছে সে বোঝে না। অবনী রায়টা কে?
শচীবাবুর ছেলে। বিরাট বড়লোক। তার ওপর খুব শিক্ষিতও বটে। কাটু হায়ার সেকেন্ডারিতে ফাস্ট ডিভিশন পেয়েছিল ওঁর জন্যই তো! সেই কৃতজ্ঞতাবোধটুকু পর্যন্ত কাটুর নেই। বয়সের অবশ্য একটু তফাত ছিল, কিন্তু তাতে কী?
কাটুর জায়গায় তুমি হলে অবনী রায়কে বিয়ে করতে?
লিচু মুখ ফিরিয়ে হঠাৎ আমাকে চোখের ছোবল মারল। বলতে নেই লিচুর চোখদুটি বিশাল। বলল, হঠাৎ আমার কথা কেন?
সব জিনিস নিজের ঘাড়ে নিয়ে ভাবতে হয়, তবে বোঝা যায় অন্যে কেন কোন কাজটা করল বা করল না।
লিচু হেসে বলল, কাটুর মতো কপাল কি আমার! আমাকে আজ পর্যন্ত কেউ বিয়েই করতে চায়নি। তাহলে কী করে নিজের ঘাড়ে নিয়ে ভাবব বলুন!
আমি বললাম, এ কথাটা সত্যি নয় লিচু।
লিচু মাথা নিচু করল হঠাৎ। তারপর মাথা তুলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
আমরা একটা মাঠের ভিতর পায়ে হাঁটা পথ দিয়ে হাটছিলাম। সকালে বৃষ্টি হয়ে গেছে খুব। মাঠে অল্প-স্বল্প কাদা ছিল। দু’ধারে দুটো সাদা বাঁকাচোরা গোলপোস্ট। জ্যোৎস্নায় ঝিমঝিম করছিল চারিধার।
লিচু ফিসফিস করে বলল, হ্যাঁ, চেয়েছিল। তাতে কী?
তুমি কি তাদের পাত্তা দিয়েছ?
লিচু মাথা নেড়ে হেসে বলে, পাত্তা দেওয়ার মতো নয়।
আমি শ্বাস ফেলে বললাম, দেমাক কারও কম নয় লিচু।
দুই গোলপোস্টের মাঝামাঝি জ্যোৎস্নার কুহকে আমাদের মতিচ্ছন্ন হয়ে থাকবে। লিচু টলটলে জ্যোৎস্নায় বোয়া স্বপ্নাতুর দুই চোখ তুলে তাকাল। জাদুকর পি সি সরকাররাত দিয়ে মেয়ে কাটার আগে যেভাবে তাকে সম্মোহিত করতেন অবিকল সেই সম্মোহন আমার ওপর কাজ করছিল।
লিচু ধরা গলায় বলল, দেমাক। আমাদের আবার দেমক!ী আছে বলুন তো আমার দেমাক করার মতো?
দেমাকের জন্য কিছু থাকার দরকার হয় না। শুধু দেমাক থাকলেই হয়। দেমাক থাকা ভাল লিচু, তাহলে আজেবাজে আমার মতো লোককাহ যেতে পারে না।
ভুল হয়েছিল, বড় ভুল হয়েছিল ওই কথা বলা। জ্যোৎস্না ঢুকে গিয়েছিল মাথার মধ্যে, বুকের মধ্যে। চোখের সম্মোহন ছিল বড়ই গভীর। মাথায় ছিল মি।
লিচু ঠিক সেন্টার লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ল। মুৰতুলে স্পষ্ট করে চাইল আমার দিকে। বলল, তাই বুঝি?
আমি একটা সাদা গোলপোস্টের দিকে চোখ ঘুরিয়ে নিলাম। ওই গোলপোস্টে আমার হাত ফসকে কতবার গোলে বল ঢুকে গেছে। ছেলের বলে, পাগলা দাও এত গোল খায় যে বাড়িতে গিয়ে আর ভাত খেতে হয় না।
আমি বললাম, তাই নয় বুঝি?
লিচু মাথা নত করে বলল, আমি বুঝি তোমাকে যেতে দিই না? আর কীভাবে বোঝাব বলো তো? বোকা কোথাকার!
এত সুন্দর গলায় বলল যে, জ্যোৎস্না আর একটু ফরসা হয়ে উঠল। আমি স্পষ্ট দেখলাম, আকাশ থেকে চাঁদটা গড়িয়ে পড়ল মাঠের মধ্যে। পড়ে লাফাল বার কয়েক কে যে চাঁদটাকে ফুটবলের মতো শট করল তা বোঝা গেল না। কিন্তু পশ্চিম ধারের গোলপোস্টে সেটা কোনাকুনি ঢুকে গেল বিনা বাধায়। আমি হাত বাড়িয়েও গোল আটকাতে পারলাম না।
কিন্তু নেপথ্যে একটা গলার স্বর বারবার আমাকে কী যেন প্রম্পট করছিল। ফিসফিস করে খুব জরুরি গলায় বলছিল, বলুন। বলুন। এই বেলা বলে ফেলুন।
লিচু নতমুখ তুলে একটু হাসল।
আমি হাত বাড়িয়ে লিচুর একটা হাত ধরলাম। গলা আমারও ধরে এসেছে। বুকের মধ্যে দ্বন শ্বস। বললাম, লিচু, আমি যে তোমাকে…
ঠিক এই সময়ে আমার মাথার মধ্যে লাউড স্পিকারের ভিতর দিয়ে প্রম্পটার বলে উঠল, না।! মনে নেই কী শিখিয়ে দিয়েছিলাম।
আমি চিনলাম। আমার মাথার মধ্যে প্রম্পট কমছে পশুপতি। পশুপতি তাড়া দিয়ে বলল, আহা! টাকার কথাটা বলুন। বলুন!
আমি লিচুর দিকে চেয়ে যে কথাটা বলতে চেয়েছিলাম সেটা গিলে ফেলে নতুন করে বললাম, লিচু, তোমার বাবার কাছে আমি এখনও একশো পঁচাত্তর টাকা পাই।
লিচুর হাত চমকে উঠে খসে গেল আমার মুঠো থেকে।
আমি ফ্লাস্কের মুখ বন্ধ করি এবং পাথরের চাতাল ছেড়ে আবার পাহাড়ে ওঠা শুরু করি। এর চূড়ায় আমাকে উঠতেই হবে।
রাস্তাটা আর দেখতে পাই না। গাছের গোড়ায়, পাথরে বহুকালের পুরোনো শ্যাওলা। লতাপাতায় জড়ানো ঘন গাছের জল। পথ নেই। ডাইনে বাঁয়ে খুঁজে অবশেষে আমি একটা নোরার সন্ধান পেয়ে যাই। এখনও তেমন বর্ষা শুরু হয়নি বলে জলধারা প্রবল নয়। ঝিরঝির করে কয়েকটা সরু ধারা নেমে যাচ্ছে। খাত বেয়ে আমি উঠতে থাকি। বড্ড খাড়াই। পা রাখার জায়গা। পাই না। ফলে আবার জঙ্গলে ঢুকে যেতে হয়। আদাড় বাদাড়ি ভেঙে প্রাণপণে শুধু উঁচুতে ওঠা বজায় রাখি।
কিন্তু না উঠলেই বা কী?
পায়ের ডিম আর কুচকিতে অসহ্য শিরার টান টের পেয়ে আমি দাঁড়িয়ে কথাটা ভাবি। উপরে উঠে আমি কিছু পাব না। না পাহাড় জয়ের আনন্দ, না ব্যায়ামের সুফল।
উপর থেকে একটা ঘটানাড়া পাখির ডাক আসছিল। তীব্র, উঁচু একটানা, অবিকল পুজোর ঘণ্টার মতে। সেই ধ্বনির মধ্যে বারবার একটা না না না না’ শব্দ বেজে যাচ্ছে। জীবন কিছু না, প্রেম কিছু না, অর্থ কিছু না, মায়া মোহ কিছুই কিছুনা।
আমি মাটিতে রাখা কেডস জোড়ার দিকে চেয়ে থাকি নতমুখে। কিছুই নেই, তবু জীবন তো যাপন করে যেতেই হয়। আমি একটু দম নিই, তারপর ধীরে ধীরে আবার উঠতে থাকি।
যখন চড়াই শেষ হল তখন বুঝতে পারলাম, আমি চূড়ায় উঠেছি। একরত্তি দম নেই বুকে, শরীরে এক ফোঁটা জোরও নেই আর। কপাল থেকে বৃষ্টির মতো ঘাম নামছে, পিঠ বুক বেয়ে ঘামের পাগলা ঝোরা। চারদিকে ঘন কালচে সবুজ জঙ্গল। কিছুই স্পষ্ট দেখা যায় না। এতদূর উঠে কোনও তৃপ্তি বা আনন্দও বোধ করি না। বেল শরীর আর মন ভরা বিরক্তিকর এক ক্লান্তি।
ছোট একটা চৌকো পার হয়ে তার ওপর বসলাম। মনের মধ্যে ঘোর এক বৈরাগ্য ধীরে ধীরে ঢুকে যেতে লাগল। বুঝতে পারছি, আমি আর কলকাতার কেউ নই, কলকাতাও আমার কেউ নয়। বুঝতে পারি, আমি সায়ন্তনীকে ভাবাসি না, লিচুকেও না।
ভাবতে ভাবতে বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়ি।
দিন সাতেক বাদে আবার ফুলবাগানে চোর এল। আমি আজকাল সকালে উঠে কলকাতা বা সায়নীর কথা ভাববার চেষ্টা করি না। তোরকে চুম ভেঙে গেলে জানালার কাছে বসে ব্রোঞ্জ রঙের পাহাড়ের দিকে চেয়ে থাকি। ঘোর অন্ধকার থেকে ক্রমে ফিকে অন্ধকার। আকাশের গায়ে পাহাড় হঠাৎ আবছা জাহাজের মতো জেগে ওঠে। আমার সমস্ত শরীরে ভয় আর শিহরন খেলে যায়।
আস্তে আস্তে ব্রোঞ্জ সোনা হয়, তারপর রুপোর রং ধরে।
আজ অবশ্য দেখার কিছুই ছিল না। গত সাতদিন এক আদিম হিংস্র বৃষ্টি গিলে রেখেছিল শহরটাকে। এই শহর যথেষ্ট উঁচু বলে বন্যা হয় না। তবু রাস্তায় ঘাটে জল জমে আছে। আশপাশ থেকে পাহাড়ি নদীতে ভয়াবহ বানের খবর আসছে। শহর ডুবছে, গাঁ ডুবছে, চাষের জমিতে গলা বা মাথা ছাড়িয়ে জল।
কাল রাতে বৃষ্টি ছেড়েছে। সু ন মেঘে আকাশ ঢাকা, উত্তরে পাহাড় বলে যে কিছু ছিল তা আর বোঝাই যায় না। তবু অভ্যাসবশে আমি রোজই উঠে বসে থাকি ভোরে।
আজও যেমন, মেঘলা দিনের মলিন ভোরের আলো কষ্টেসৃষ্টে অনেক চেষ্টায় যখন চারদিক সামান্য ভাসিয়ে তুলেছে তাই ফুলচোর এল। আগের বারের মতোই ডাকাবুকো হাবভাব। শব্দ করে ফটক খুলল, চোরদের মতো ঢাক গুড়গুড় নেই। ভয় ভীতি নেই। এ কেমন চোর?
ধরা পড়ার ভয়ে বরং আমিই দেয়ালের দিকে সরে দাঁড়িয়ে চুপিসারে দেখতে থাকি। আজ কীইবা চুরি করবে ফুলচোর? বাগানে গোড়ালি ডুব জল, জলের নীচে থকথকে কাদা। হিংস্র বৃষ্টিতে একটাও আস্ত ফুল টিকে থাকতে পারেনি গাছে। বহু গাছ শুয়ে পড়েছে মাটিতে। জলে আধাবো, কাদায় মাখামাখি।
আশ্চর্য! আশ্চর্য! ফুলচোর আমার জানালার ধারের ঝুমকো লতার ঝোপের মধ্যে মাথা নিচু করে ঢুকে আসে যে! চুপি চুপি জানালার কাছে এসে দাঁড়ায়।
শুনছেন?
সেই ডাকে আমার হাত পা কেঁপে ওঠে। ধরা পড়ে যাই। জানালার সামনে সরে এসে বলি, শুনছি! বলুন।
আপনি জেগে ছিলেন?
আমি খুব ভোরে উঠি। এ সময়টায় রোজ আমি পাহাড় দেখি।
তবে আড়ালে লুকিয়ে ছিলেন কেন?
চোর ধরার জন্যই লুকোতে হয়।
ফুলচোর হাসল একটু। বলল, কিন্তু আমি তো ধরা পড়তে ভয় পাই না, পালিয়েও যাই না। আমাকে ধরতে লুকোতে হবে কেন?
কথাটা ভেবে দেখার মতো। বাস্তবিকই তো আমি চোর ধরার জন্য লুকোইনি, লুকিয়েছি চোরেরই ভয়ে। কিন্তু সেটা কবুল করি কী করে? এ চোরও আলাদা ধাতের। কোথায় আমি চোরকে জেরা করব, তা নয় চোরই উল্টে আমার নিকেশ নিচ্ছে। আমি একটু দুর্বল গলায় বলি, কথাটা ঠিক, আপনি পালান না। তার মানে, হয়তো আমার কাকা কাকিমার সঙ্গে আপনার চেনা আছে।
বাব্বাঃ, ভীষণ বুদ্ধি তো আপনার। এতই যদি বুদ্ধি তবে বলুন লুকোলেন কেন?
সেটা বলা শক্ত। হঠাৎ আপনাকে দেখে কেন যেন লুকোতে ইচ্ছে হল।
ফুলচোর হি হি করে হাসে। বলে, সাধে কি লোকে নাম দিয়েছে পাগলা দাশু!
আমি কথাটা শুনি না শুনি না করে পাশ কাটিয়ে বলি, আজ কী চুরি করবেন? দেখুন, বাগানটার দুর্দশা!
আপনার সাজানো বাগান কি শুকিয়ে গেল?- ফুলচোর এখনও হাসছে।
একটা বড় শ্বাস হঠাৎ বেরিয়ে যায় বুক থেকে। জবাব দিই না। কোনও জবাব মাথায় আসছেও না। ফাজিল মেয়েদের সঙ্গে টক্কর দিতে যাওয়াটাই বোকামি।
ফুলচোর গলা একটু মাখো মাখো করে বলে, গান শেখা ছেড়েছেন, ফুটবলের মাঠে যান না, সাইকেলেও চড়তে দেখা যায় না আজকাল, আপনার কী হয়েছে বলুন তো!
আমি ফুলচোরের ব্যবহারে খুবই অবাক হয়েছি আজ! তবে কি ফুলচোর আমার প্রেমে পড়েছে। এই ভোরে সেই ভালবাসাই জানাতে এল। আমার মাথার ভিতরে হঠাৎ পশুপতির গলার স্বর প্রম্পট করতে থাকে, বলে ফেলুন! বলে ফেলুন! ভালবাসা একেবারে ছানার মতো ছেড়ে যাবে। কিন্তু কিছুই বলার নেই আমার। ফুলচোরের বাবাকে আমি টাকা ধার দিইনি। ওর বাবা কে তাই জানি না। পশুপতি ভুল পার্ট প্রম্পট করছে।
আমি গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করে বললাম, আজ আপনি ফুল চুরি করতে আসেননি।
তবে কী করতে এসেছি?
আপনার অন্য মতলব আছে।
আছেই তো!
আমার সম্পর্কে এত খবর আপনাকে কে দিল?
খবর জোগাড় করতে হয়।
কেন জোগাড় করতে হচ্ছে?
আমার মতলব আছে যে।
আপনি একটু বেশিরকম ডেসপারেট।
সেটাও সবাই বলে। নতুন কথা কিছু আছে?- ফুলচোর মুখে ভালমানুষি মাখিয়ে বলে।
আছে। আমি গভীর ভাবে বলি, এর আগে আপনাকে আমি কোথাও দেখেছি।
ফুলচোর হি হি করে হেসে বলে, আমারও তাই মনে হয়,জানেন! মনে হয় যেন, কত কালের চেনা।
আমার গা জ্বলে যায়। বলি, কী বলতে এসেছেন বলুন তো!
রাগ করলেন?
না, সাবধান হচ্ছি। আমার কাকা কাকিমাও আরলি রাইজার। যে কোনও সময়ে এদিকে এসে পড়তে পারেন।
ও বাবা!
বলে ফুলচোর চকিতে একবার চারদিক দেখে নেয়। এখনও যথেষ্ট আলো ফোটেনি। আবছা আলোর মধ্যে এখনও ভুতুড়ে দেখাচ্ছে গাছপালা, ঘরবাড়ি। ফুলচোর আমার দিকে আবার মুখ ফিরিয়ে বলে, লিচুর সঙ্গে কি আপনার ঝগড়া হয়েছে?
তা দিয়ে আপনার কী দরকার?
লিচু ভীষণ কাঁদছে যে।
কাঁদছে! কেন কাঁদছে?
তার আমি কী জানি? পাড়ার লোকে বলছে, আপনার সঙ্গে নাকি ওর ভাব ছিল।
মোটেই নয়।
ফুলচোর আচমকা জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা ন্যাপথালিন খেলে কি লোকে মরে?
আমি জানি না। কেন?
লিচু ন্যাপথালিন খেয়ে মরার চেষ্টা করেছিল। হাসপাতালে পর্যন্ত নিতে হয়।
উদ্বেগের সঙ্গে আমি জিজ্ঞেস করি, বেঁচে আছে তো!
আছে। কিছু হয়নি। বেশি খায়ওনি। হাসপাতালে পেটে নল ঢুকিয়ে সব বের করে দিয়েছে।
মরতে চেয়েছিল কেন?
বোধহয় আপনার জন্য। অবশ্য ভেঙে কিছু বলছে না।
আমি একটু রেগে গিয়ে বলি, এতক্ষণ ইয়ার্কি না করে এই সিরিয়াস খবরটা অনেক আগেই আপনার দেওয়া উচিত ছিল।
আপনার সঙ্গে যে আমার ইয়ার্কিরও একটা সম্পর্ক আছে।
তার মানে?
পালাই, আপনার অত ভয়ের কিছু নেই। লিচু ভাল আছে।
কিন্তু ইয়ার্কির সম্পর্ক না কী যেন বলছিলেন।
না, বলছিলাম যে, আমি ভীষণ ইয়ার্কি করি। বাড়িতে তার জন্য অনেক বকুনিও খাই। বলে ফুলচোর আবার হি হি করে হাসে। তারপর বলে, লিচু কিন্তু খুব কাঁদছে।
তার আমি কী করতে পারি?
আপনি কি ওকে রিফিউজ করেছেন?
রিফিউজের প্রশ্ন ওঠে না। ফর ইয়োর ইনফর্মেশন, আমি একজনকে অলরেডি ভালবাসি!
তাই বলুন। বাব্বা! ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল।
কেন?
আমি তো ধরেই নিয়েছিলাম, আপনি লিচুকেই বুঝি বিয়ে করবেন।
বিয়ে অত সস্তা নয়।
আপনার লাভার কি কলকাতার মেয়ে?
হ্যাঁ।
খুব স্মার্ট?
তা জেনে কী হবে?
বলুন না। আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে।
স্মার্ট বটে, তবে আপনার মতো নয়।
দেখতে?
তাও আপনার মতো নয়। রূপটাই কি সব?
সে অবশ্য ঠিক। গায়ের রং কেমন? খুব ফরসা?
না। শ্যামলা। আপনার পাশে দাঁড়ালে কালোই বলবে লোকে।
লম্বা?
লম্বা আপনার মতো নয়। অ্যাভারেজ।
রোগা?
হ্যাঁ, বেশ রোগা।
বোধ হয় পড়াশুনোয় ব্রিলিয়ান্ট?
একদম নয়। তবে গ্র্যাজুয়েট।
বয়স?
আমার প্রায় সমান। আপনার তুলনায় বুড়ি।
বারবার আমার সঙ্গে তুলনা দিচ্ছেন কেন?
খুশি করার জন্য! মেয়েরা অন্য মেয়েদের সঙ্গে নিজেদের মিলিয়ে দেখতে ভালবাসে।
আচ্ছা, আচ্ছা। এবার বলুন তার নাম কী?
সায়ন্তনী। আপনার নামটা কি তার চেয়ে ভাল?
চালাকি করে নাম জেনে নেবেন, আমি তত বোকা নই।
নামটা বলতে দোষ কী?
চোরেরা নাম বলে না।
না কি অন্য কোনও কারণ আছে?
থাকতে পারে। সকাল হয়ে এল, আমি যাই!
আবার কবে আসছেন?
নিচু হয়ে ঝোপ পেরোতে পেরোতে এবার ফিরে তাকায় ফুলচোর। চাপা স্বরে বলে, এলে খুশি হবেন?
বোধ হয় খারাপ লাগবে না। আজ তো বেশ লাগল।
ফুলচোর হি হি করে হাসে, তাহলে আসব।
বলে ঝোপটা জোর পায়ে পেরিয়ে চলে গেল ফুলচোর। ওকে বলা হল না যে, সব কথা আমি সত্যি বলিনি। কী করে বলব? সায়ন্তনীর চেহারাটা আমার মনে পড়ছে না যে।