অধ্যায় ৭: পরিবার পরিকল্পনা
সহজে বোঝা সম্ভব কেন কেউ কেউ পিতামাতাদের সন্তানদের প্রতি প্রদর্শিত পরার্থবাদীতার সাথে অন্যান্য ‘কিন-নির্বাচিত বা আত্মীয়দের প্রতি প্রদর্শিত পরার্থবাদীতাকে পৃথকভাবে দেখতে চান। পিতামাতা সন্তান প্রতিপালন করার প্রক্রিয়াটিকে প্রজনন প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে হয়, অন্যদিকে, যেমন, ভাইপোর প্রতি পরার্থবাদীতাকে তেমনটি ভাবা হয়না। আমি মনে করি আসলেই একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য এখানে লুকিয়ে আছে কিন্তু সেই মানুষগুলো ভুল করেছেন এই পার্থক্যটি আসলে কি সেটি বুঝতে। তারা প্রজনন আর প্যারেন্টাল কেয়ার বা সন্তান প্রতিপালন করার বিষয়টিকে একসাথে একপাশে সরিয়ে রেখেছেন এবং অন্য সব ধরনের পরার্থবাদীরা যেখানে অন্য একপাশে অবস্থান করছে। কিন্তু আমি, ‘কোন নতুন সদস্য পৃথিবীতে নিয়ে আসার বিষয়টি একদিকে আর অন্যদিকে বিদ্যামান কোন সদস্যদের উপকার করার মধ্যে পার্থক্যটি স্পষ্ট করতে চাইছি। আমি এই দুটিকে যথাক্রমে নামকরণ করবো, ‘সন্তান ধারণ করা এবং সন্তান প্রতিপালন করা। কোনো একক সারভাইভাল মেশিনকে খুব ভিন্ন ধরনের দুটি সিদ্ধান্ত নিতে হয়, প্রতিপালন করার সিদ্ধান্ত অথবা ‘সন্তান ধারণের সিদ্ধান্ত। আমি সিদ্ধান্ত’ শব্দটি ব্যবহার করছি অবেচেতন মনে নেয়া কৌশলগত একটি পদক্ষেপ হিসাবে। প্রতিপালন করার সিদ্ধান্তটি এই ধরনের একটি শিশু আছে, যার সাথে আমার এক প্রকার জিনগত আত্মীয়তা আছে; যদি তাকে আমি খাওয়াই, তাহলে তার মরে যাবার সম্ভাবনা হচ্ছে, এমন কিছু (সুনির্দিষ্ট নয়), আমি কি তার খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করবো’? আর সন্তান-ধারণ করার সিদ্ধান্তগুলো, অন্যদিকে, এরকম: “আমি কি প্রয়োজনীয় সেই সব পদক্ষেপগুলো নেবো যা কোনো একটি নতুন সদস্যকে এই পৃথিবীতে আনার জন্য প্রয়োজন? কিছুটা পর্যায় অবধি, সন্তান ‘প্রতিপালন’ আর ‘ধারণ’, কোনো একটি সদস্যের সময় আর অন্য সম্পদের উপর তাদের দাবীর অগ্রাধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য পরস্পরের সাথে অবধারিতভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। সেই সদস্যটিকে হয়তো একটি সিদ্ধান্ত বেছে নিতে হবে: ‘আমি কি এই শিশুটির প্রতিপালন করবো, নাকি নতুন কোনো সন্তান জন্ম দিতে গর্ভধারণ করবো?
কোনো প্রজাতির পরিবেশগত বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের খুঁটিনাটি বিষয়গুলোর উপর নির্ভর করে, প্রতিপালন আর সন্তান জন্ম দেবার নানা ধরনের মিশ্র কৌশল বিবর্তনীয়ভাবে স্থিতিশীল কৌশল (ইএসএস) হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। যে একটি বিষয় বিবর্তনীয়ভাবে স্থিতিশীল হতে পারেনা সেটি হচ্ছে : ‘বিশুদ্ধভাবে’ প্রতিপালন করার কোনো কৌশল বিবর্তনীয়ভাবে স্থিতিশীল হতে পারেনা। যদি সব একক সদস্যই তাদের নিজেদের জীবিত সন্তানদের দেখাশোনা করতে নিবেদন করে এমন একটি পর্যায় অবধি যে, আর কোনো নতুন সন্তানের জন্ম দেয়া না হয়, পুরো জনগোষ্ঠী পরিবর্তিত মিউটেশনযুক্ত সদস্যদের দ্বারা খুব দ্রুত আগ্রাসনের শিকার হবে, যারা সন্তান ধারণ করার জন্য বিশেষায়িত ভুমিকা পালন করবে। সে কারণে প্রতিপালন’ বিবর্তনীয়ভাবে স্থিতিশীল কৌশল হতে পারে তখনই, যখন এটি মিশ্র কোনো কৌশলের একটি অংশ হয়–নিদেনপক্ষে কিছু সন্তান ধারণ অবশ্যই অব্যহত থাকতে হবে।
যে প্রজাতিদের সাথে আমরা সবচেয়ে বেশী পরিচিত– স্তন্যপায়ী ও পাখিরা– তারা সন্তান প্রতিপালনে অত্যন্ত দক্ষ। নতুন কোনো সন্তানের জন্ম দেয়ার সিদ্ধান্তটি সাধারণত তার প্রতিপালন করার সিন্ধান্ত নেবার মাধ্যমে অনুসরিত হয়। এর কারণ, ব্যবহারিক ক্ষেত্রে সন্তান জন্ম ও প্রতিপালন প্রায়শই একসাথে ঘটে যে, অনেকেই দুটি বিষয় মিলিয়ে ফেলেন। কিন্তু কোনো স্বার্থপর জিনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, আমরা যেমনটি দেখেছি, নীতিগতভাবে কোনো শিশু ভাইয়ের প্রতিপালন করার সাথে নিজের শিশু সন্তানের প্রতিপালন করার কোনো পার্থক্য সেই। দুটি শিশুই জিনগতভাবে আপনার নিকটাত্মীয়। খাদ্যের ব্যবস্থা করতে যদি দুজনের মধ্যে কোনো একজনকে আপনার বেছে নিতে হয়, সেক্ষেত্রে কেন শুধুমাত্র আপনার নিজের সন্তানকে বাছাই করা উচিৎ হবে, তার কিন্তু জিনগত কোনো কারণ নেই, তবে এর বিপরীত অবশ্যই সংজ্ঞানুযায়ী কোনো শিশু ভাইকে আপনি জন্ম দিতে পারবেন না। আপনি শুধু তারা দেখাশোনা করতে পারবেন, যখন অন্য কেউ তাকে এই পৃথিবীতে জন্ম দেবে। এর আগের অধ্যায়ে আমরা দেখেছিলাম আদর্শগতভাবে একটি সারভাইভাল মেশিনের কিভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ, তারা কি যারা বেঁচে আছে তাদের সাথে পরার্থবাদীতার সাথে আচরণ করবে নাকি করবে না। এই অধ্যায়ে আমরা দেখবো কিভাবে তাদের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিৎ, তারা কি নতুন কোনো সদস্যকে এই পৃথিবীতে জন্ম দেবে কি বা দেবে না সেই বিষয়ে।
এবং এই বিষয়টি নিয়ে গ্রুপ সিলেকশনের মূল বিতর্কটি প্রধানত লড়া হচ্ছে, যা আমি প্রথম অধ্যায়ে উল্লেখ করেছিলাম। এর কারণ ওয়েইন-এডওয়ার্ডস, যিনি মূলত প্রথম গ্রুপ সিলেকশনের মূল ধারণাগুলোর সূত্রপাত করেছিলেন, এবং তিনি সেটি করেছিলেন “জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ তত্ত্ব প্রসঙ্গে (১)। তিনি প্রস্তাব করেছিলেন যে সার্বিকভাবে পুরো গ্রুপের মঙ্গলের কথা ভেবে একক সদস্য স্তরে প্রাণীরা সুপরিকল্পিতভাবে এবং পরার্থবাদী অর্থে তাদের জন্মের হার কমায়।
এটি খুবই আকর্ষণীয় একটি হাইপোথিসিস, কারণ প্রতিটি একক সদস্যের কি করা উচিৎ ধারণাটির সাথে এটি খুব ভালোভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ। মানবজাতি অনেক বেশী সন্তানের জন্ম দেয়। কোনো একটি জনসংখ্যার আকার নির্ভর করে চারটি জিনিসের উপর: জন্ম, মৃত্যু, অভিবাসন, দেশান্তর। পুরো পৃথিবীর জনসংখ্যা যদি একসাথে গ্রহন করা হয়, তাহলে সেখানে কোনো অভিবাসন আর দেশান্তর ঘটেনা, এবং আমাদের শুধু থাকে জন্ম আর মৃত্যুর ঘটনা। যতক্ষণ অবধি দম্পতি-প্রতি গড় সন্তান সংখ্যা দুই’ এর বেশী হয়, যারা বেঁচে থাকে ও প্রজনন করে, পৃথিবীতে জন্ম নেয়া শিশুদের সংখ্যা বছর প্রতি ক্রমান্বয়ে ক্রমবর্ধমান একটি হারে বাড়তে থাকবে। প্রতিটি প্রজন্মে একটি নির্দিষ্ট পরিমান হারে বাড়ার পরিবর্তে এটি বাড়ে যে আকারটি ইতিমধ্যে অর্জিত হয়েছে তার একটি নির্দিষ্ট শতাংশ হারে। যেহেতু এই মূল আকারটি ইতিমধ্যেই আরো বড় হচ্ছে, সেই সাথে এর বাড়ার হারটি ক্রমশ বাড়তে থাকে। যদি এই ধরনের বৃদ্ধিকে কোনো বাধা ছাড়াই নিয়ন্ত্রণহীনভাবে অব্যহত থাকার অনুমতি দেয়া হয়, জনসংখ্যার আকার সেক্ষেত্রে খুব দ্রুত অত্যন্ত বিশাল আকার ধারণ করে।
ঘটনাচক্রে, একটি বিষয় মাঝে মাঝে এমনকি সেই সব ব্যক্তিরাও অনুধাবন করেন না, যারা জনসংখ্যা সমস্যা নিয়ে ভাবেন, আর সেই বিষয়টি হচ্ছে জনসংখ্যা বাড়ার বিষয়টি নির্ভর করে কখন মানুষ সন্তানের জন্ম দিচ্ছে, এবং সেই সাথে তাদের কয়টি সন্তান আছে। যেহেতু, জনসংখ্যা বাড়ার প্রবণতা আছে, ‘প্রতি প্রজন্মে’ একটি নির্দিষ্ট শতাংশ হারে, এখান থেকে আমরা বুঝতে পারি, আপনি যদি প্রজন্ম-মধ্যবর্তী সময়টি বৃদ্ধি করতে পারেন আরো বেশী, জনসংখ্যা বছর-প্রতি আরো কম দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাবে। যে সচেতনামূলক ব্যানারটি বলছে ‘দুটি হলেই যথেষ্ট’ সেটা কোনো ক্ষতি ছাড়াই পরিবর্তন করা যেতে পারে ‘ত্রিশের আগে কোনো সন্তান নয়। কিন্তু যে-কোনো পরিস্থিতিতেই ক্রমবর্ধিষ্ণু জনসংখ্যা বৃদ্ধি মানে ভয়ঙ্কর সমস্যা সৃষ্টির সম্ভাবনা।
সম্ভবত আমরা সবাই সেই বিস্ময়কর গণনার উদাহরণগুলো দেখেছি, যা এই বিষয়টি বোঝার জন্য সহজ করে তোলে। যেমন, ল্যাটিন আমেরিকার বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ৩০০ মিলিয়ন এবং ইতিমধ্যে তাদের অনেকেই পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন। কিন্তু জনসংখ্যা যদি বর্তমান হারে বাড়তে থাকে তাহলে ৫০০ বছরের চেয়েও কম সময় লাগবে যখন মানুষ যে যেখানে আছে সেখানে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে অবিচ্ছিন্ন মানব কার্পেট তৈরী করবে সারা মহাদেশ জুড়ে। এবং এটা এমনকি হবেই, এমনকি যদি প্রতিটি মানুষ খুব শীর্ণকায় হবে আমরা এমন ধারণাও করি– কারণ সেটি অবশ্যই অবাস্তব কোনো ভাবনা হবেনা। এখন থেকে হাজার বছর পরে তারা একে অপরের কাঁধে দাঁড়াবার মত অবস্থা হবে, তার গভীরতা মিলিয়ন মানুষের সমান। ২০০০ বছর নাগাদ, মানুষের পর্বত, আলোর গতিতে বাইরের দিকে ছুটে চলার মাধ্যমে পৌঁছে যাবে আমাদের পরিচিত মহাবিশ্বের সীমানা পেরিয়ে।
নিশ্চয়ই আপনি বুঝতে সক্ষম হয়েছেন যে এটি একটি হাইপোথেটিকাল গণনা মাত্র। বাস্তবে খুব ভালো কিছু বাস্তবতা নির্ভর ব্যবহারিক কারণে এটি ঘটবে না। আর এই সব কারণগুলোর কিছু হচ্ছে, দুর্ভিক্ষ, মহামারী, যুদ্ধ অথবা যদি আমরা ভাগ্যবান হই তাহলে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ। কোনো লাভ হবে না কৃষি বিজ্ঞানের বিস্ময়কর মহা অগ্রগতির উপর ভরসা করে –“সবুজ বিপ্লব’, ইত্যাদি বা সেকরম কোনো কিছু। খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি হয়তো সাময়িকভাবে সমস্যাটি মোকাবেলা করবে, কিন্তু গাণিতিকভাবে আমরা নিশ্চিৎ যে এটি দীর্ঘমেয়াদী কোনো সমাধান হতে পারে না। আসলেই, চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতি যা এই সমস্যাটি সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে, তারা হয়তো সেই সমস্যাটিকে আরো খারাপ একটি রুপ দিতে পারে, জনসংখ্যা সম্প্রসারণ বিষয়টি তরান্বিত করার মাধ্যমে। এটি খুব সাধারণ যৌক্তিক সত্য যে ব্যাপক গণহারে মহাশূন্য অভিমূখে পৃথিবীত্যাগ, যেখানে প্রতি সেকেন্ডে কয়েক মিলিয়ন রকেটের যাত্রা করা ছাড়া অনিয়ন্ত্রিত জন্ম হার অবধারিতভাবে ভয়ঙ্করভাবে মৃত্যুর হারও বৃদ্ধি করবে। খুবই কঠিন বিশ্বাস কআ যে, সেই নেতাদের সাধারণ এই সত্যটি বোঝার ক্ষমতা নেই, যারা তাদের অনুসারীদের কার্যকরী জন্মনিরোধক ব্যবস্থা গ্রহন করতে নিরুৎসাহিত করছেন। যারা ‘প্রাকৃতিক পদ্ধতি ব্যবহার করতে তাদের মতামত ব্যক্ত করেছেন এবং তারা ঠিক সেই প্রাকৃতিক উপায়টি দেখতে পাবেন, আর তার নাম হচ্ছে, দুর্ভিক্ষ।
কিন্তু অবশ্যই এধরনের দীর্ঘমেয়াদী হিসাব নিকাশের কারণে উদ্রেক হওয়া সেই অস্বস্তিকর অনুভূতির ভিত্তি আসলে ভবিষ্যতে আমাদের প্রজাতির জন্য সার্বিক কল্যাণ কামনা। ভবিষ্যতে অতিমাত্রায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি হবার ভয়ঙ্কর পরিণতির ব্যপারে প্রয়োজনীয়ভাবে সতর্ক হতে মানুষের (তাদের কারো কারো অবশ্য) সচেতন দূরদর্শিতা আছে। এই বইটির এটি একটি মৌলিক ধারণা যে, সারভাইভাল মেশিনগুলো সাধারণত পরিচালিত হয় স্বার্থপর জিনের মাধ্যমে, খুব নিশ্চিৎভাবে যার ক্ষেত্রে প্রত্যাশা করা যায়না যে, সে ভবিষ্যৎ দেখতে পারে, বা প্রজাতির কল্যাণ নিয়ে তার অন্তরে কোনো বিশেষ ভাবনা আছে। আর এখানে ওয়েইন-এডওয়ার্ডস প্রথাগত বিবর্তনীয় তাত্ত্বিকদের থেকে পৃথক পথে চলেছেন। তিনি ভাবছেন, অবশ্যই একটি উপায় আছে যেখানে সত্যিকারের পরার্থবাদী জন্ম নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া বিবর্তিত হতে পারে।
ওয়েইন-এডয়ার্ডসের লেখায় বা আর্সে যখন ওয়েইন-এডওয়ার্ডস ধারণাটি জনপ্রিয়করণ করেছিলেন, যে বিষয়টির উপর গুরুত্বারোপ করা হয়নি, সেই বিষয়টি হচ্ছে, বিশাল পরিমান ঐক্যমত ভিত্তিক বাস্তব সত্য আছে, যা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। সুস্পষ্টভাবে বন্য প্রাণীদের জনসংখ্যা অস্বাভাবিক উচ্চহারে বৃদ্ধি পায় না, তাত্ত্বিকভাবে যে হারে বংশ বৃদ্ধি করার জন্য তারা সক্ষম। মাঝে মাঝে বন্য প্রাণী জনসংখ্যার আকার কম বেশী স্থিতিশীল থাকে, যেখানে জন্ম আর মৃত্যুর হার পরস্পরের কাছাকাছি অবস্থান করে। অনেক ক্ষেত্রেই লেমিংসরা বিখ্যাত একটি উদাহরণ হতে পারে, জনসংখ্যার হার যখন ব্যাপক এলোমেলো হারে ওঠা নামা করে, যেখানে মাঝে মাঝে বিস্ফোরণের মত জনসংখ্যা বৃদ্ধির সমান্তরালে অত্যন্ত নিম্ন অভিমূখে এই হারের পতন এবং প্রায় বিলুপ্তি থাকে। কখনো ফলাফল হচ্ছে সুস্পষ্টভবে বিলুপ্তি, অন্ততপক্ষে কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থানীয় এলাকায়। কখনন, যেমন কানাডিয় লিঙ্কসদের কথা ধরা যাক –যেখানে তাদের চামড়া বা পেন্ট সংখ্যার পরিসংখ্যান আমরা পাই হাডসন বে কোম্পানীর ধারাবাহিক বছরওয়ারী হিসাব থেকে –জনসংখ্যা সেখানে একটি নির্দিষ্ট ছন্দে ওঠা নামা করেছে। একটি জিনিস যা কোন প্রাণী জনগোষ্ঠী করে না, তাহলে অনির্দিষ্টভাবে তারা তাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি অব্যহত রাখেনা।
বন্য প্রাণীরা প্রায় কখনোই বৃদ্ধ হয়ে মারা যায় নাঃ পুরোপুরি বার্ধক্যে জরাগ্রস্থ হয়ে মারা যাবার আগেই খাদ্যাভাব, অসুখ বা শিকারী প্রাণীরা তাদের মৃত্যুর কারণ হয়। খুব সাম্প্রতিককাল অবধি এটি মানুষের জন্যেও সত্যি ছিল। বেশীর ভাগ প্রাণী তাদের শৈশবে মারা যায়, অনেকেই ডিম্বাণু পর্যায় কখনো পার হতে পারে না। খাদ্যাভাব আর অন্যান্য মৃত্যুর কারণ হচ্ছে মূল সেই কারণগুলো, যা ব্যাখ্যা করে কেন জনসংখ্যা অনির্দিষ্টভাবে বাড়তে পারেনা। কিন্তু যেমনটি আমরা আমাদের নিজেদের প্রজাতির ক্ষেত্রে দেখেছি, সেই একই পরিণতি আমাদেরও নিয়তি হবে এমন কোনো আবশ্যিকতা নেই। শুধুমাত্র যদি প্রাণীরা তাদের জন্মের হার’ নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো, খাদ্যাভাব বা দূর্ভিক্ষ হবার কোনো প্রয়োজন ছিল না, তারা ঠিক এই কাজটি করে– এটাই ওয়েইন-এডওয়ার্ডসের মূল ধারণা ছিল। কিন্তু এখন সেখানে কম মতানৈক্য আছে, এমনকি তার বইটি পড়ে আপনি যতটা ভাবছেন তারও কম। স্বার্থপর জিন ধারণার সমর্থকরা খুব সহজেই একমত হবেন যে, প্রাণীরা তাদের জন্মহার নিয়ন্ত্রণ করে। কোনো একটি প্রজাতি বরং একটি সুনির্দিষ্ট আকারে ক্লাচ সাইজ বা লিটার-সাইজ থাকে; কোনো প্রাণীরই অসীম সংখ্যক সন্তান উৎপাদন করার ক্ষমতা নেই। তারা জন্মহার নিয়ন্ত্রণ করে কি করে না, মতানৈক্য কিন্তু সেই বিষয়ে নয়। মতের অমিলটা হচ্ছে ‘কেন তারা সেটি নিয়ন্ত্রণ করে: প্রাকৃতিক নির্বাচনের কোন প্রক্রিয়াটিতে পরিবার পরিকল্পনা বিবর্তিত হয়েছে? সংক্ষেপে মতের অমিলটির মূল উৎস হচ্ছে প্রাণীদের এই জন্মসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়াটি কি পরার্থবাদী, যা তারা অনুশীলন করে সার্বিকভাবে গ্রুপের মঙ্গলের জন্য, নাকি স্বার্থপর, যা তারা অনুশীলন করে যে সদস্যটি প্রজনন করছে তার নিজের কল্যাণে। ধারাবাহিক অনুক্রমে এই দুটি তত্ত্ব নিয়ে আমি আলোচনা করবো।
ওয়েইন-এডওয়ার্ডস মনে করেছিলেন যে, সার্বিকভাবে সেই গ্রুপের কল্যাণে একক সদস্যরা তাদের যা সামর্থ আছে তার চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম সংখ্যক সন্তানের জন্ম দেয়। তিনি অনুধাবন করেছিলেন যে সাধারণ প্রাকৃতিক নির্বাচনের পক্ষে এই ধরনের কোনো পরার্থবাদীতার জন্ম দেয়া সম্ভব নাঃ গড় হারের চেয়ে কম কোনো প্রজনন হারের প্রাকতিক নির্বাচন এর মুল অর্থেরই স্ববিরোধী। সে-কারণে তিনি গ্রুপ সিলেকশন ধারণাটি প্রস্তাব করেন যেমন আমরা অধ্যায় ১ এ দেখেছি। তার মতামত অনুযায়ী, যে গ্রুপগুলোর সদস্যরা তাদের নিজেদের জন্মহার নিয়ন্ত্রণ করে তাদের বিলুপ্ত হবার সম্ভাবনা কম অন্য কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপদের চেয়ে, যাদের সদস্যরা দ্রুত বংশ বিস্তার করে এমন হারে যে তারা তাদের খাদ্য সরবরাহকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়। সুতরাং পৃথিবীতে সেই সব গ্রুপ প্রাধান্য বিস্তার করে যারা সংযত প্রজননকারী। জন্মদান করার ব্যপারে সংযত কোনো একক সদস্য যা ওয়েইন-এডওয়ার্ডস প্রস্তাব করেছিলেন সেটি আসলে সাধারণ অর্থে জন্ম নিয়ন্ত্রণের সমতূল্য, কিন্তু তিনি তার চেয়ে বেশী সুনির্দিষ্ট ছিলেন এবং সত্যি সত্যি একটি সুবিশাল ধারণার প্রস্তাব করেন যেখানে পুরো সামাজিক জীবনই দেখা হয়েছে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের একটি প্রক্রিয়া হিসাবে। যেমন, বহু প্রজাতির সামাজিক জীবনের দুটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাদের টেরিটোরিয়ালিটি বা আঞ্চলিকতা আর ডমিন্যান্স হায়ারার্কি বা প্রাধান্য-পরম্পরা, ইতিমধ্যে যা অধ্যায় ৫ এ বর্ণিত হয়েছে।
বহু প্রাণী প্রচুর পরিমান সময় আর শক্তি বিনিয়োগ করে আপাতদৃষ্টিতে কোনো একটি এলাকাকে রক্ষা করার প্রচেষ্টায়, যাকে প্রকৃতি বিজ্ঞানীরা বলেন, একটি ‘টেরিটোরি’। এই প্রপঞ্চটি প্রাণী জগতে ব্যাপকভাবেই দৃশ্যমান, শুধুমাত্র পাখি, স্তন্যপায়ী এবং মাছই নয়, কীটপতঙ্গ এমনকি সী-অ্যানিমোনরাও এর অন্তর্ভুক্ত। এই টেরিটোরি বা এলাকা কোনো বনভূমির বিশাল কোনো এলাকা হতে পারে, যা কোনো একটি প্রজনন সঙ্গী যুগলের প্রধান খাদ্য সংগ্রহের এলাকা, যেমন, রবিন পাখিরা। বা যেমন হেরিং গালদের ক্ষেত্রে, এটি হতে ছোট একটি এলাকা, যেখানে খাদ্য নেই, বরং এর ঠিক মাঝখানে থাকে তাদের নীড়। ওয়েইন-এডওয়ার্ডসের মতে যে প্রাণীরা কোনো একটি এলাকার জন্য যুদ্ধ করে তারা আসলে একটি “রুপক’ পুরষ্কারের জন্য, কোনো আসল পুরষ্কারের জন্য নয়, যেমন এক টুকরো খাবার। অনেক ক্ষেত্রে স্ত্রী সদস্যরা এমন কোনো পুরুষ সদস্যদের প্রজনন সঙ্গী হতে অস্বীকৃতি জানায় যাদের কোনো নিজস্ব টেরিটোরি নেই। আসলেই প্রায়শ যা দেখা যায় সেটি হচ্ছে যখনই কোনো স্ত্রী সদস্য, যার পুরুষ সঙ্গী মারা যায়, তার টেরিটোরী দখলকারী পুরুষ সদস্যর সাথে সে নিজেকে দ্রুত সংযুক্ত করে নেয়। এমনকি আপাতদৃষ্টিতে একগামী বিশ্বস্ত যুগল দেখা যায় এমন প্রজাতিতে কোনো স্ত্রী সদস্য আসলেই মূলত ব্যক্তিগতভাবে পুরুষ সদস্যটির চেয়ে তার অধিকৃত টেরিটোরী বা অধিকৃত এলাকার সাথে বেশী যুক্ত থাকে।
জনসংখ্যার আকার যদি বেশী বড় হয়, কিছু সদস্য তাদের টেরিটোরি পাবে না এবং সুতরাং তারা প্রজনন করবে না। কোনো একটি টেরিটোরি দখল করা সেকারণে ওয়েইন-এডওয়ার্ডসের মতে অনেকটাই লটারী জেতা টিকিট পাবার মত বা প্রজনন করার অধিকার। যেহেতু দখল করার মত টেরিটোরির সংখ্যা সীমিত, এটি অনেকটা সীমিত সংখ্যক প্রজনন করার জন্য লাইসেন্স ইস্যু করার মত। সদস্যরা প্রত্যেকেই পরস্পরের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, কে এই সীমিত সংখ্যক লাইসেন্সের একটি জয় করতে পারে, কিন্তু মোট শিশুর সংখ্যা, যা কোনো জনগোষ্ঠী পেতে পারে সার্বিকভাবে সেটি সীমাবদ্ধ কত সংখ্যক টেরিটোরি দখল করার আছে তার উপর। কোনো কোনো ক্ষেত্রে যেমন, রেড গ্রাউসদের ক্ষেত্রে একক সদস্যরা, প্রথম দৃষ্টিতে, মনে হতে পারে যেন তারা সংযম প্রদর্শন করছে, কারণ যারা টেরিটোরি দখল করতে পারেনি তারা শুধুমাত্র যে প্রজনন করতে পারেননি, তারা একই সাথে মনে হয় যে কোনো টেরিটোরী জয় করার প্রচেষ্টার হালও ছেড়ে দিয়েছে। যেন মনে হয় তারা সবাই কোনো খেলার নিয়ম মেনে নিয়েছে : সেটি হচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঋতুর পর আপনি যদি প্রজনন করার জন্য কোনো সম্মতিসহ টিকিট না পান, আপনি স্বেচ্ছায় বিরত থাকবেন প্রজনন করা থেকে এবং ভাগ্যবানদের কোনো ধরনের বাধা বিপত্তি ছাড়াই প্রজনন ঋতুতে প্রজনন করার সুযোগ দিবেন, যেন তারা প্রজাতির বংশধারা অব্যহত রাখার কাজটি করতে পারে।
ওয়েইন-এডওয়ার্ডস এই প্রাধান্য-পরম্পরার বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন একই ভাবে। অনেক প্রাণী গ্রুপের মধ্যে বিশেষ করে বন্দি দশায় এবং একইভাবে বন্য পরিবেশে কিছু ক্ষেত্রে, প্রতিটি জীব সদস্য একে অপরের পরিচিতি সম্বন্ধে ধারণা করতে পারে এবং তারা শিক্ষা লাভ করে কাকে তারা যুদ্ধে হারাতে পারবে এবং কাদের কাছে তাদের পরাজিত হবার সম্ভাবনা আছে। যেমনটি আমরা অধ্যায় ৫ এ দেখেছিলাম, তারা কোনো যুদ্ধ ছাড়াই নিজেকে সমর্পন করে সেই সদস্যদের কাছে, যাদের তারা নিজেদের চেয়ে শক্তিশালী হিসাবে জানে ও তাদের সাথে যুদ্ধ হলে তাদের নিজেদেরই হারার সম্ভাবনা বেশী। ফলাফলে কোনো প্রকৃতিবিদ কোনো একটি বিভিন্ন প্রাধান্য পরম্পরা বা পে-অর্ডার (এটি বলার কারণ প্রথম এটি আবিষ্কৃত হয়েছি মুরগীদের মধ্যে অর্থাৎ প্রাধান্যের বিভিন্ন স্তর-বিন্যাসবদ্ধ সমাজ যেখানে প্রত্যেকেই জানে তার অবস্থানটি কোথায় এবং তার নিজের অবস্থানের উপরে সে কোনো কিছু ভাবার চেষ্টা করেনা। অবশ্যই কখনো কখনো সত্যিকারের দ্বন্দ্ব হয় এবং কখনো কেউ কেউ তাদের ইতিপুর্বে প্রাধান্য বিস্তারকারীদের হারিয়ে তার উপরের স্তরে ওঠার পুরষ্কারও পায়। কিন্তু যেমনটি আমরা দেখেছিলাম। অধ্যায় ৫ এ, নীচের স্তরের কোন সদস্যর স্বতঃস্ফূর্ত এই সমর্পনের সার্বিক প্রভাবটি হচ্ছে অল্প কিছু দীর্ঘমেয়াদী দ্বন্দ্ব আসলেই সংঘটিত হয় এবং খুব বেশী কোনো জখম হবার মত ঘটনা কদাচিৎ ঘটে।
বহু মানুষই মনে এটিকে মনে করেন অস্পষ্টভাবে গ্রুপ সিলেকশন মতবাদী ভাবনায় ভালো কোনো কিছু হিসাবে। ওয়েইন-এডওয়ার্ডস সম্পূর্ণ ভিন্ন আর একটি সাহসী ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন বিষয়টির। প্রাধান্য পরম্পরায় উপরের স্তরে থাকা সদস্যদের নীচের স্তরের সদস্যদের চেয়ে প্রজনন করার বেশী সম্ভাবনা থাকে। হয় স্ত্রী সদস্যরা তাদের বেশী পছন্দ করে অথবা তারা শারীরিকভাবে নিচু স্তরের সদস্যদের স্ত্রী সদস্যদের কাছাকাছি আসতে বাধা দেয়। তিনি এই উঁচু সামাজিক মর্যাদাটাকে দেখেছিলেন প্রজনন করার অধিকারের আরো একটি ছাড়পত্র হিসাবে। এবং স্ত্রী সদস্যদের জয় করার জন্য সরাসরিভাবে কোনো যুদ্ধে না জড়িয়ে, একক সদস্যরা তাদের সামাজিক মর্যাদার জন্য যুদ্ধ করে। এবং তারা এরপর মেনে নেয় যদি তারা সামাজিক উঁচু স্তরে পৌঁছাতে না পারে, তাহলে তাদের প্রজনন করার কোনো অধিকার নেই। তারা সরাসরিভাবে যেখানে স্ত্রী সদস্যরা সংশ্লিষ্ট সেখানে নিজেদের সংযত রাখে, যদি তারা হয়তো কখনো কখনো সামাজিকভাবে উচ্চ মর্যাদা পাবার চেষ্টা করে আর সেকারণে বলা যেতে পারে ‘পরোক্ষভাবে তারা স্ত্রী সদস্যদের জন্য যুদ্ধ করছে। কিন্তু যেমন, টেরিটোরি সংক্রান্ত আচরণে আমরা দেখি, ‘স্বেচ্ছায় এই মেনে নেবার’ আইনটির ফলশ্রুতিতে শুধুমাত্র সামাজিকভাবে উচ্চ মর্যাদার সদস্যদের প্রজনন করা উচিৎ, ওয়েইন-এডওয়ার্ডসের মতে সেই জনগোষ্ঠীতে খুব দ্রুত জনসংখ্যায় বৃদ্ধি পায় না। বরং আসলেই অনেক বেশী সন্তান হবার পর ঠেকে শিখে অনুধাবন করা যে কাজটা ভুল হয়েছে, তার বদলে জনগোষ্ঠীগুলো সামাজিক মর্যাদা আর অধিকৃত স্থান নিয়ে আনুষ্ঠানিক একটি প্রতিযোগিতার ব্যবহার করে জনসংখ্যার আকার যে পর্যায়ে পৌঁছালে দুর্ভিক্ষের শিকার হবে তার নীচের স্তরে সীমিত রাখে।
ওয়েইন-এডওয়ার্ডসের ধারণাগুলোর মধ্যে হয়তো সবচেয়ে বিস্ময়কর ধারণাটি হচ্ছে ‘এপিডাইকটিক’ (epideictic) আচরণের ধারণাটি, এই শব্দটি তার নিজের আবিষ্কার। বহু প্রাণীরা বিশাল অংশ সময় কাটায় বড় আকারের দলবদ্ধ হয়ে। বেশ কিছু সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান নির্ভর কারণগুলো– কেন এ ধরনের সমবেত হবার আচরণকে প্রাকৃতিক নির্বাচন বিশেষ সহায়তা করে– তা প্রস্তাবও করা হয়েছে। আমি তাদের কয়েকটি নিয়ে আলোচনা করবো অধ্যায় ১০ এ। ওয়েইন-এডওয়ার্ডস ধারণা এ বিষয়ে পুরোপুরি ভিন্ন। তিনি প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে যখন স্টারলিং পাখিদের বিশাল আকারের দল জড়ো হয় সন্ধ্যায় বা একগুচ্ছ মিজ কোনো গেটপোস্ট এর উপর নাচানাচি করে, তারা আসলে সেই সময় তাদের জনসংখ্যা শুমারীর মত কিছু করে। যেহেতু তিনি মনে করছেন যে একক সদস্যরা তাদের জন্ম হার নিয়ন্ত্রণ করে পুরো গ্রুপের মঙ্গলের জন্য এবং তারা অপেক্ষাকৃত কম সংখ্যক শিশুর জন্ম দেয় যখন জনসংখ্যার ঘনত্ব অনেক বেশী থাকে। খুব যৌক্তিক এমন কিছু ভাবা যে আসলে তাদের হয়তো কোনো উপায় থাকা উচিৎ যা দিয়ে তারা জনসংখ্যার ঘনত্ব পরিমাপ করতে পারে, একটি থার্মোমিটারের কাজ করা প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে ঠিক যেমন একটি থার্মোস্ট্যাটের দরকার হয়। ওয়েইন-এডওয়ার্ডস এর জন্য এই ‘এপিডাইকটিক’ আচরণ হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে কোনো জমায়েত হবার একটি উপায় যা জনসংখ্যার পরিমান সম্পর্কে একটি ধারণা দেয়। তিনি অবশ্যই কোনো সচেতন প্রক্রিয়ায় জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কথা বলছেন না এখানে, কিন্তু একটি স্বয়ংক্রিয় স্নায়বিক ও হরমোন নির্ভর কোনো প্রক্রিয়া, যা কোনো একক সদস্যর তাদের জনসংখ্যার ঘনত্বের প্রতি সংবেদী অনুভূতির সাথে তাদের প্রজনন তন্ত্রকে সংযুক্ত করেছে। আমি চেষ্টা করেছি ওয়েইন-এডওয়ার্ডসের তত্ত্বটির প্রতি সুবিচার প্রদর্শন করার জন্য, এমনকি যদিও বরং খানিকটা সংক্ষিপ্ত আকারে। যদি আমি সফল হয়ে থাকি, আপনার এখন প্ররোচিত হবার সেই অনুভূতি অনুভব করা উচিৎ যে, তত্ত্বটি যা মূলত দাবী করছে, সেটির একটি আপাতগ্রাহ্যতা আছে। কিন্তু এই বইয়ের আগের অধ্যায়গুলো আপনাকে খানিকটা সন্দেহবাদী হিসাবে প্রস্তুত করেছে এমন একটি পর্যায় পর্যন্ত যে আপনি হয়তো বলবেন যদিও সম্ভাব্য মনে হতে পারে শুনলে, ওয়েইন-এডওয়ার্ডসের তত্ত্বটির পক্ষে প্রমাণগুলো যেন মজবুত হয় নতুবা…; এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রমাণগুলো তেমন। মজবুত নয়। বহু সংখ্যক উদাহরণ আছে যা তার মত করে ব্যাখ্যা করা সম্ভব, কিন্তু সেগুলো আবার সমানভাবে আরো প্রথাগত ‘স্বার্থপর জিন’ তত্ত্বটির আলোকেও ব্যাখ্যা করা যায়।
যদিও তিনি কখনোই সেই বিশেষ নামটি ব্যবহার করেননি, তবে পরিবার পরিকল্পনায় স্বার্থপর জিন তত্ত্বটির প্রধান স্থপতি হচ্ছেন প্রখ্যাত পরিবেশবিদ ডেভিড ল্যাক। তিনি বন্য পাখিদের ক্লাচের ( কোনো প্রজনন ঋতুতে তাদের ডিমের সংখ্যা) আকার নিয়ে কাজ করেছিলেন কিন্তু তার তত্ত্ব আর উপসংহারগুলোর সাধারণভাবে নানা ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার মত বিশেষ গুণাবলী আছে। প্রতিটি পাখি প্রজাতির একটি বৈশিষ্ট্যসূচক ক্লাচ সাইজ আছে। যেমন, গ্যানেট আর গিলেমটরা একটি করে ডিমে তা দেয় একটি সময়ে, সুইফটা তিনটি, গ্রেট-টিটরা আধা ডজন বা তার কিছুটা বেশী। বেশ কিছু পার্থক্য আছে বা বৈচিত্র্যও আছে: যেমন, কিছু সুইফট মাত্র দুটি করে ডিম পাড়ে একবারে, গ্রেট টিটস কখনো বারোটি ডিমও পাড়তে পারে। এটা মনে করা যুক্তিসঙ্গত হবে যে-কোনো একটি স্ত্রী পাখি কয়টি ডিম পাড়বে এবং বাচ্চা ফুটানোর জন্য সেটি সেগুলো তা দেবে, অন্য যে-কোনো বৈশিষ্ট্যাবলীর মত বিষয়টি অন্তত আংশিকভাবে নির্ভর করবে জিনগত নিয়ন্ত্রণের উপর। এর মানে হচ্ছে এমন কিছু বলা যে, হয়তো একটি জিন আছে দুটো ডিম পাড়ার আর কোনো একটি প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যালিল আছে তিনটি ডিম পাড়ার জন্য, হয়তো অন্য আরেকটি জিন আছে চারটি ডিম পাড়ার ইত্যাদি। যদিও ব্যবহারিক ক্ষেত্রে বিষয়টি এতটা সহজ না হবার সম্ভাবনাই বেশী, এখন স্বার্থপর জিন তত্ত্ব আমাদের বাধ্য করে প্রশ্ন করতে এই জিনগুলোর মধ্যে কোনটি জিন পুলে সংখ্যাধিক্য অর্জন করবে। উপরিভাবে মনে হতে পারে যে চারটি ডিম পাড়ার জন্য কোনো জিন এর অবশ্যই দুটি বা তিনটি ডিম পাড়ার জিন এর চেয়ে বাড়তি কিছু সুবিধা ভোগ করবে। যদিও কয়েক মুহূর্ত ভাবলে স্পষ্ট হয় যে, খুব সরল এই ‘বেশী মানে ভালো’ যুক্তিটি সত্যি হতে পারেনা। এটি আমাদের প্রত্যাশা করতে শেখায় যে পাঁচটি ডিম চারটি ডিম থেকে উত্তম, দশটি আরো বেশী ভালো, ১০০ এমনকি আরো অনেক বেশী ভালো এবং অসীম সংখ্যক সবচেয়ে বেশী ভালো। অন্যার্থে যৌক্তিকভাবে এটি অসম্ভাব্যতার দিকে নিয়ে যায়। অবশ্যই বেশী সংখ্যক ডিম পাড়ার যেমন লাভও আছে তেমনি এর জন্য মূল্যও পরিশোধ করতে হয়। বেশী সংখ্যক সন্তান ধারণের মূল্য অবশ্যই। পরিশোধ করতে হবে প্রতিপালন করার ক্ষেত্রে দুর্বলতার মাধ্যমে।
ল্যাকের মূল প্রস্তাবনাটি ছিল যে-কোনো একটি প্রজাতির জন্য, কোনো একটি পরিবেশগত পরিস্থিতিতে, অবশ্যই একটি সবচেয়ে সুবিধাজনক ক্লাচ সাইজ থাকবে। ওয়েইন-এডওয়ার্ডস থেকে তার প্রস্তাবনার পার্থক্যটা আমরা দেখতে পাবো ‘কার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সবচেয়ে সুবিধাজনক’? এই প্রশ্নটির উত্তরে। ওয়েইন-এডওয়ার্ডস বলবেন যে গুরুত্বপূর্ণ সবচেয়ে সুবিধাজনক সংখ্যাটি, যা সব একক সদস্যের অর্জন করার ইচ্ছা পোষণ করা উচিৎ, সার্বিকভাবে গ্রুপের জন্যে যে সংখ্যাটি সবচেয়ে সুবিধাজনক। ল্যাক বলবেন প্রতিটি স্বার্থপর সদস্যই তাদের নিজেদের স্বার্থে ক্লাচ সাইজ বেছে নেয়, তার পক্ষে সম্ভব সর্বোচ্চ সংখ্যা সন্তান প্রতিপালন করার প্রচেষ্টায়। সুইফট পাখিদের ক্ষেত্রে তিন যদি আদর্শ ক্লাচ সংখ্যা হয়, এর অর্থ হচ্ছে, ল্যাকের জন্য, কোনো একটি একক সদস্য যে কিনা চারটি সন্তান প্রতিপালন করার চেষ্টা করবে, পরিশেষে সে তার প্রতিদ্বন্দ্বীর তুলনায় সম্ভবত কম সংখ্যক সন্তান প্রতিপালন করতে সক্ষম হবে, অপেক্ষাকৃত বেশী হিসাবী ও সতর্ক সদস্যরা চেষ্টা করবে শুধুমাত্র তিনটি সন্তানের প্রতিপালন করার জন্য। এরকম করার সুস্পষ্ট কারণটি হতে পারে চারটি শিশুর জন্য সংগৃহীত খাদ্য মাথাপিছু ভাগে এতটা কম হতে পারে যে তাদের অল্প কয়েকজনই প্রজনন সক্ষম পূর্ণবয়স্ক হওয়া অবধি বাঁচার সম্ভাবনা থাকবে। এটি সত্যি হবে যেমন শুরুতেই চারটি ডিম এর জন্য ইয়োক বা কুসুম ভাগ বাটোয়ারা করার সময়ে, তেমনি ডিম ফুটে বের হবার পর তাদের খাদ্য প্রাপ্তির ভাগাভাগিতেও। ল্যাকের মতে সেকারণে, প্রতিটি সদস্য তাদের ক্লাচ সাইজ নিয়ন্ত্রণ করে পরার্থবাদীতা ছাড়া অন্য কোনো কারণে। গ্রুপের সীমিত সম্পদের অতি-ব্যবহার প্রতিরোধে তারা জন্মনিয়ন্ত্রণের অনুশীলন করছে না। তারা জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির চর্চা করে যেন তারা তাদের আসলেই জন্ম দেয়া সন্তানদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী সংখ্যক সন্তানদের বেঁচে থাকা নিশ্চিৎ করতে পারে, এই লক্ষ্যটি একেবারেই বিপরীত জন্মনিয়ন্ত্রণের সাথে আমরা যে লক্ষ্যটিকে সাধারণত সংযুক্ত করে থাকি।
শিশু পাখিদের প্রতিপালন করা খুবেই পরিশ্রমসাধ্য একটি ব্যাপার। ডিম উৎপাদন করার জন্য মাকে একটি বিশাল পরিমান খাদ্য, সময় আর শক্তি বিনিয়োগ করতে হয়। সম্ভবত তার সঙ্গীর সাহায্যে স্ত্রী পাখি প্রচুর পরিশ্রম করে তাদের নীড় তৈরী করে, যেন সেখানে সে ডিম পাড়তে ও সেই ডিমগুলোকে রক্ষা করতে পারে। পিতামাতা দুজনকেই সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধৈর্য ধরে ডিমের উপর বসে থাকতে হয়। তারপর, যখন বাচ্চারা ডিম ফুটে বের হয়, পাখি পিতামাতা তাদের সন্তানদের জন্য খাবার যোগাড় করতে আক্ষরিকার্থে পরিশ্রম করে প্রায় নিজেদের মেরে ফেলার উপক্রম করে, কম বেশী অবিরাম, কোন বিশ্রাম ছাড়াই তারা তাদের সন্তানদের রক্ষা করে। যেমন, আমরা এর আগেই দেখেছিলাম গ্রেট টিট বাবামা সুর্যের আলো থাকা অবস্থায় প্রতি ৩০ সেকেন্ডে একটি করে খাবার তাদের নীড়ে নিয়ে আসে। স্তন্যপায়ীরা যেমন আমরা এই কাজটি করি খানিকটা ভিন্ন ভাবে, কিন্তু প্রজনন করার মূল ধারণাটাই বেশ পরিশ্রম ও ব্যয়সাধ্য একটি ব্যাপার। বিশেষ করে মায়েদের জন্য বিষয়টি কোনো অংশেই কম সত্য নয়। স্পষ্টতই যদি কোনো পিতামাতা চেষ্টা করেন তাদের সীমিত পরিমান খাদ্য আর পরিশ্রম অনেকগুলো সন্তানের মধ্যে বন্টন করার জন্য, পরিশেষে দেখা যাবে আরো সংযত উচ্চাকাঙ্খ নিয়ে শুরু করলে সে যতটা সন্তান প্রতিপালন করতে পারতো, তার চেয়ে। কম সংখ্যক সন্তান প্রতিপালন করা তার পক্ষে সম্ভব হবে। সুতরাং তাকে একটা ভারসাম্য খুঁজে নিতে হবে সন্তান প্রতিপালন আর জন্ম দেবার মধ্যে। খাদ্য ও অন্যান্য সম্পদের মোট পরিমান, যা কোনো একক স্ত্রী সদস্য বা কোনো একজোড়া সঙ্গী যোগাড় করতে পারে সেটি কয়টি সন্তান তারা প্রতিপালন করতে পারে তা নির্ধারণ করার জন্য প্রয়োজনীয় একটি নিয়ামক। প্রাকৃতিক নির্বাচন, ল্যাকের তত্ত্বানুযায়ী, নির্ধারণ করে শুরুর ক্লাচ সাইজ ( বা লিটার সাইজ ইতাদি) কেমন হবে, যেন সেই সিদ্ধান্তটি সীমিত সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার করতে পারে।
যে সব সদস্যদের বেশী সংখ্যক সন্তান আছে তারা শাস্তি পাবে, তবে পুরো জনসংখ্যা বিলুপ্ত হবে সে কারণে না, বরং শুধুমাত্র অপেক্ষাকৃতভাবে তাদের কম সন্তানই বেঁচে থাকে। খুব বেশী সংখ্যক সন্তান জন্ম দেবার জিনটি পরবর্তী প্রজন্মে হস্তান্তরিত হয় না। বেশী পরিমান কোনো সংখ্যায় কারণ তাদের খুব কম সংখ্যক সন্তানই পারে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া অবধি বেঁচে থাকতে। আধুনিক সভ্য মানুষদের সাথে যা ঘটেছে তা হলো যে পরিবারের আকার আর সীমিত সম্পদের উপর নির্ভর করে না, যা কোনো পিতামাতা তাদের সন্তানের জন্য খরচ করতে পারে। যদি কোন স্বামী বা স্ত্রী তাদের পক্ষে খাওয়ানো সম্ভব না এমন সংখ্যক সন্তানের জন্ম দেন, তাহলে রাষ্ট্র, যার মানে জনসংখ্যার বাকী অংশ, সেখানে দ্বায়িত্ব নিতে এগিয়ে আসে এবং তারা এই অতিরিক্ত শিশুদের স্বাস্থ্য ও ভালোভাবে বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করে। বাস্তবিকভাবে, কোনো একটি দম্পতি যাদের কিনা তেমন কোনো সম্পদ নেই সেই নারীর পক্ষে শারীরিকভাবে যতটা নেওয়া সম্ভব ততটা সন্তানের সঠিকভাবে প্রতিপালন করার জন্য, তাকে বাধা দেবার কিছু নেই। কিন্তু এই ধরনের ওয়েলফেয়ার বা কল্যাণমূখী সমাজ প্রকৃতিতে খুবই অস্বাভাবিক একটি ব্যাপার। প্রকৃতিতে যে পিতামাতা তাদের সামর্থের বাইরে গিয়ে বেশী সংখ্যক সন্তানের জন্ম দেয়, তাদের বেশী নাতিনাতনী থাকে না। এবং তাদের জিনও পরবর্তী প্রজন্মে হস্তান্তরিত হতে পারে না। সেখানে জন্মসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনো পরার্থবাদী সংযমের প্রয়োজন নেই, কারণ প্রকৃতিতে কোনো সমাজকল্যাণ মূলক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার অস্তিত্ব নেই। যে-কোনো জিন, যা কিনা তার সীমা অতিক্রম করবে অমিতব্যয়ী আচরণে দ্রুত সে শাস্তি পায়: সেই জিন যে শিশুরা বহন করে তারা খাদ্যাভাবে মারা যায়। যেহেতু আমরা মানুষরা সেই প্রাচীন স্বার্থপর জীবনে ফিরতে চাইনা যে সময়ে আমরা বড় পরিবারের শিশুদের অনাহারে মারা যাবার ক্ষেত্রে কোন বাধা দেইনি। আমরা পরিবারকে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার একক হিসাবে বিলুপ্ত করেছি, তার জায়গা নিয়েছে রাষ্ট্র। কিন্তু নিশ্চিভাবে সন্তানের প্রতিপালনে রাষ্ট্রীয় সহায়তা পাওয়া যাবে এমন সুযোগের অপব্যবহার থেকে বিরত থাকা উচিৎ।
জন্মনিরোধ প্রক্রিয়াকে কখনো কখনো ‘অপ্রাকৃতিক’ হিসাবে চিহ্নিত করে আক্রমণ করা হয়। আসলেই সেটা তাই, প্রাকৃতিক নয়। সমস্যা হচ্ছে, একই ভাবে কল্যাণমুখী সমাজ বা রাষ্ট্রও ঠিক সেকরমই অপ্রাকৃতিক। আমি মনে করি আমরা অধিকাংশ মানুষই ভাবি কল্যাণমুখী রাষ্ট্র আমাদের জন্য খুবই কাম্য একটি ব্যবস্থা, কিন্তু আপনি কোনো অপ্রাকৃতিক কল্যাণমুখী রাষ্ট্র তৈরী করতে পারবেন না, যদি আপনার সেই অপ্রাকৃতিক জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও না থাকে, নতুবা এর পরিণতি হবে ভয়াবহ দুর্দশা এমনকি আমরা প্রকৃতিতে যা দেখি তার চেয়েও বেশী। কল্যাণমুখী বা ওয়েলফেয়ার রাষ্ট্র সম্ভবত সর্বশ্রেষ্ট পরার্থবাদী পদ্ধতি যা প্রাণীজগতে দেখা যায়। কিন্তু কোনো পরার্থবাদী সিস্টেম হচ্ছে অন্তর্গতভাবেই অস্থিতিশীল, কারণ, স্বার্থপর সদস্যদের দ্বারা এই সিস্টেমটি অপব্যবহৃত হবার ঝুঁকি থাকে সবসময়, তারা এটিকে তাদের নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে সবসময় প্রস্তুত। যারা তাদের ভরণ পোষণ করার ক্ষমতার বাইরে বেশী সন্তান নেয়, সম্ভবত বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই এই পদ্ধতিটিকে খারাপ উদ্দেশ্যে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারার জন্য তারা যথেষ্ট পরিমান অজ্ঞ। কিন্তু শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান আর নেতারা যারা পরিকল্পিতভাবে তাদের সেরকম কিছু করার জন্য উৎসাহ দেয়, তাদের উদ্দেশ্য বরং খুব বেশী সন্দেহের উর্ধে না বলেই আমার কাছে মনে হয়।
আবার বন্য প্রাণীদের নিয়ে আলোচনায় ফিরে আসি। ল্যাকের ক্লাচ সাইজ যুক্তিকে আমরা সাধারণীকরণ করতে পারি অন্য সব উদাহরণগুলোর ক্ষেত্রে, যা ওয়েইন-এডওয়ার্ডস ব্যবহার করেছিলেন: টেরিটোরি রক্ষা করার আচরণ এবং আধিপত্য প্রাধান্য পরম্পরা ইত্যাদি। যেমন, ধরুন, রেড গ্রাউস পাখির ক্ষেত্রে, যার উপর তিনি ও তার সহকর্মীরা গবেষণা করেছিলেন। এই পাখিরা মূলত নিরামিষাশী, তারা হিদার গাছের ফুল, বীজ আর ডাল খায় এবং তারা মুর বা পাহাড়ী উন্মুক্ত পতিত জমি এমন এলাকা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়, যেখানে আপাতদৃষ্টিতে সেই এলাকার মালিকদের যে পরিমান খাদ্য প্রয়োজন তার চেয়ে বেশী পরিমান খাদ্য থাকে। ঋতুর শুরুতেই তারা এলাকা দখলের জন্য যুদ্ধ করে, কিন্তু কিছুকাল পরে পরাজিতরা, আপাতদৃষ্টি মনে হয় তারা মেনে নিয়েছে যে তারা হেরে গেছে এবং তারা আর যুদ্ধ করে না। তারা গোত্রচ্যুত হয় এবং আর কখনোই কোনো টেরিটোরির মালিক হতে পারেনা এবং ঋতুর শেষ নাগাদ তারা মূলত না খেয়েই মারা যায়। শুধুমাত্র টেরিটোরি দখলকারীরা প্রজনন করতে পারে। যারা টেরিটোরির মালিক না তারা শারীরিকভাবে প্রজনন করতে সক্ষম সেটি দেখা গেছে একটি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে, যদি কোনো টেরিটোরির মালিককে গুলি করে হত্যা করা হয়, তার শূন্যস্থানটি দ্রুত দখল করে নেয় ইতিপূর্বে গোত্রচ্যুত কোনো গ্রাউস, এবং সে এরপর প্রজনন করে। আর এই চরমপন্থী আঞ্চলিক প্রাধান্য বিস্তারের আচরণ সংক্রান্ত ওয়েইন-এডওয়ার্ডসের ব্যাখ্যা হচ্ছে, যেমনটা আমরা দেখেছি, গোত্রচ্যুতরা মেনে নেয় তারা প্রজনন করার টিকিট পায়নি বা লাইসেন্স পেতে ব্যর্থ হয়েছে, এবং তারা প্রজনন করার চেষ্টা করে না।
বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করলে মনে হতে পারে স্বার্থপর জিনতত্ত্ব ব্যাখ্যা করার জন্য এটি একটি অদ্ভুত উদাহরণ। কেন তাহলে এই গোত্রচ্যুত পরাজিত গ্রাউসরা টেরিটোরি দখলের জন্য তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে না, যেন তারা কোনো টেরিটোরির মালিককে পরাজিত করতে পারে কোনো না কোনো এক সময়, তাদের শরীরের শক্তির শেষ বিন্দুটি থাকা অবধি কেন তারা সংগ্রাম করেনা? মনে হতে পারে তাদের তো কিছুই হারাবার নেই। আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি যখন কোনো টেরিটোরির মালিক হঠাৎ করে মারা যায়, একটি গোত্রচ্যুত পরাজিত পাখি সুযোগ পায় তার জায়গাটি দখল করার, সুতরাং সে সুযোগ পায় প্রজনন করার। যদি কোনো গোত্রচ্যুত পরাজিত পাখির এভাবে কোনো টেরিটোরি দখল করার সম্ভাবনা, যুদ্ধ করে কোনো টেরিটোরি দখল করার সম্ভাবনা থেকে বেশী হয়, তাহলে কাজটি করলে সে হয়তো সুফল পাবে, কোনো স্বার্থপর সদস্য হিসাবে, অপেক্ষায় থাকা, যদি কেউ মারা যায়, বরং ব্যর্থ নিষ্ফল যুদ্ধে তার অবশিষ্ট শক্তি ক্ষয় না করে। ওয়েইন-এডওয়ার্ডস এর জন্য, এই গোত্রচ্যুত পরাজিতদের ভূমিকা হচ্ছে গ্রুপের কল্যাণের জন্য অপেক্ষা করা, অনেকটা মঞ্চের উইং এ দাঁড়ানো মূল অভিনেতার বদলে প্রয়োজনে অভিনয় করার জন্য কোনো অভিনেতার মত, তারা প্রস্তুত থাকে যখনই কোনো টেরিটোরীর মালিক মারা যায়, তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই দ্বায়িত্ব নেবার জন্য, গ্রুপ প্রজননের মূল মঞ্চে প্রজনন অব্যাহত রাখতে। আমরা এখন দেখতে পারছি এটি একই। সাথে হয়তো বিশুদ্ধভাবে স্বার্থপর সদস্য হিসাবেও তাদের জন্য সবচেয়ে ভালো কৌশল। যেমন আমরা অধ্যায় ৪ এ দেখেছি, আমরা এই সব প্রাণীদের মনে করতে পারি জুয়াড়ী হিসাবে। কোনো জুয়াড়ীর জন্য কখনো কখনো সেরা কৌশল হচ্ছে অপেক্ষা আর আশা করার কৌশল, যা একেবারে সরাসরি যুদ্ধং দেহী কৌশল অপেক্ষা অনেক বেশী ভালো।
একইভাবে অনেক উদাহরণ আছে, যেখানে প্রাণীদের দেখে মনে হতে পারে তারা তাদের প্রজনন না করতে পারার মর্যাদাটি বিনা প্রতিবাদে ‘মেনে নিচ্ছে, সেইসব ক্ষেত্রগুলো খুব সহজে ব্যাখ্যা করা সম্ভব স্বার্থপর জিন তত্ত্ব ব্যবহার করে। এই ব্যাখ্যার সাধারণ রুপটি সবসময় একই: একক সদস্যদের জন্য ভবিষ্যতে ভালো সুযোগ পাবার আশায় নিজেকে সংযত করে রাখাটার বাজিটা আপাতত সেই মুহূর্তের জন্য সবচেয়ে সেরা বাজি। কোনো একটি সিল যে কিনা হারেম দখল করে রাখা সিলদের কোনো আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকে, সে তাদের গ্রুপের সার্বিক মঙ্গলের জন্য কাজটি করছে না। সে অপেক্ষা করছে, অপেক্ষা করছে ভালো সুবিধাজনক সময়ের জন্য। এমনকি যদি সেই মুহূর্ত নাও আসে এবং তাকে কোনো উত্তরসূরি জীবন শেষ করতে হয়, এই বাজীর মূল্য হয়তো পরিশোধিত হয়; যদি বর্তমানের তথ্য নিয়ে অতীতের ঘটনা বিশ্লেষণ করা যায়, সেই মূহুর্ত কখনোই আসে না এবং তার পরিণতিতে কোনো উত্তরসূরি ছাড়াই তাকে চলে যেতে হয়। এবং যখন লেমিংরা ঝাঁকে ঝাকে তাদের জনসংখ্যা বিস্ফোরণের কেন্দ্র স্থল ত্যাগ করে, তারা সেই কাজটি কিন্তু তাদের পরিত্যাক্ত এলাকার জনসংখ্যার ঘনত্ব কমানোর উদ্দেশ্যে করে না। তারা খোঁজে, প্রতিটি স্বার্থপর লেমিংসরা, বসবাস করার উদ্দেশ্যে অপেক্ষাকৃত কোনো কম জনবহুল এলাকার অনুসন্ধান করে। সেই বাস্তব তথ্যটি, যেকোনো একটি নির্দিষ্ট লেমিং হয়েতো নীচে পড়ে যায় সেটি খুঁজে পেতে ও মারা যায়, যা আমরা দেখতে পারি বর্তমানের তথ্য নিয়ে অতীতের ঘটনা বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা ব্যবহার করে। কিন্তু এটি আদৌ সেই সম্ভাবনাটাকে পরিবর্তন করেনা যে, নীচে না পড়ে গিয়ে আগের জায়গায় থাকাটা তাদের জন্য আরো খারাপ একটি বাজি হতে পারে।
সুপর্যবেক্ষিত একটি বাস্তব সত্য হচ্ছে জনসংখ্যার বাহুল্য, ঘন জনবসতি কখনো কখনো জন্ম-হার হ্রাস করে। এটিকে মাঝে মাঝে ব্যবহার করা হয় ওয়েইন-এডওয়ার্ডসের তত্ত্বের সপক্ষে একটি প্রমাণ হিসাবে। কিন্তু ব্যপারটি আসলেই সেরকম কিছু নয়। এটি যেমন সামঞ্জস্যপূর্ণ তার তত্ত্বের সাথে, এটি ঠিক একই ভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ স্বার্থপর জিন তত্ত্বটির সাথেও। যেমন, একটি পরীক্ষায় ইঁদুরদের বাইরে একটি আবদ্ধ এলাকায় রাখা হয় প্রচুর পরিমানে খাদ্য দিয়ে এবং তাদেরকে স্বাধীনভাবে প্রজনন করার সুযোগ দেয়া হয়। জনসংখ্যা বাড়তে থাকে একটি পর্যায় অবধি তারপর এটি আর বাড়ে না, মোটামুটি একটি স্থিতিশীল অবস্থায় এসে দাঁড়ায়। আর এই স্থিতিশীল অবস্থায় পৌঁছানোর কারণ হিসাবে দেখা যায় স্ত্রী ইঁদুররা ঘনবসতি আর জনসংখ্যার ঘনত্বেও বৃদ্ধির কারণে অপেক্ষাকৃত কম উর্বর হয়; অর্থাৎ তারা অল্প সংখ্যক সন্তান উৎপাদন করে। এই ধরনের প্রভাব প্রায়শই লিপিবদ্ধ করা হয়েছে নানা গবেষণায়। এর তাৎক্ষণিক কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়, স্ট্রেস বা চাপ, যদিও কোনো একটি নাম দেয়ার মানে এই না যে এটি নিজে নিজে সেটি ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করবে। তবে এর তাৎক্ষণিক কারণ যাই হোক। না কেন, আমাদের এখন এর আসল বা বিবর্তনীয় কারণটি ব্যাখ্যা করতে হবে। কেন প্রাকৃতিক নির্বাচন সেই সব স্ত্রী সদস্যদের সাহায্য করে যারা তাদের সন্তান জন্ম দেবার হার কমাতে পারে, যখন তাদের জনসংখ্যা বিস্ফোরণ হয়?
ওয়েইন-এডওয়ার্ডসের উত্তর খুব স্পষ্ট। গ্রুপ’ সিলেকশন টিকে থাকার জন্য সেই সব গ্রুপদের সাহায্য করে, যেখানে স্ত্রী সদস্যরা জনসংখ্যার পরিমাপ বুঝতে পারে ও তারা তাদের জন্মহার সেই অনুসারে ঠিক করে নেয় এমনভাবে যেন খাদ্য সরবরাহ অতিমাত্রায় ব্যবহৃত না হয়। সেই পরীক্ষার একটি শর্ত ঘটনাচক্রে ছিল, খাদ্য সরবরাহর কোনো ঘাটতি থাকবে না সেখানে, কিন্তু ইঁদুরদের সেটা অনুধাবন করতে পারে এমন প্রত্যাশা করা যেতে পারে না। তারা বন্য পরিবেশ বেঁচে থাকবার মত করেই প্রোগ্রাম করা এবং খুবই সম্ভাবনা আছে যে কোনো প্রাকৃতিক পরিবেশে জনসংখ্যার বাহুল্য ও ঘনবসতি ভবিষ্যতে সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষের নির্ভরযোগ্য একটি সূচক।
স্বার্থপর জিন তত্ত্ব তাহলে কি বলবে? প্রায় ঠিক একই কথাই, তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যসহ। আপনি হয়তো মনে করতে পারবেন যে ল্যাকের প্রস্তাবনায়, প্রাণীদের নিজেদের স্বার্থপর দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী একটি আদর্শ সন্তান সংখ্যা থাকে। তারা যদি খুব কম বা খুব বেশী পরিমান সন্তান ধারণ করে, পরিশেষে দেখা যায় তারা আসলেই কম সংখ্যক সন্তানকে প্রতিপালন করতে পারে, তবে পরিস্থিতিটি তাদের জন্য সবচেয়ে ভালো হয় যদি তারা সেই সঠিক সুবিধাজনক সংখ্যাটিতে পৌঁছাতে পারে। এখন এই ‘ঠিক সেই সঠিক সংখ্যাটির ক্ষুদ্রতর কোনো সংখ্যা হবার কথা যখন সেই বছরে জনসংখ্যার ঘনবসতি হয়, যদি তুলনা করা হয় অন্য বছরগুলোর সাথে যখন জনসংখ্যা ঘনত্ব কম থাকে। আমরা ইতিমধ্যেই একমত হয়েছি যে জনসংখ্যার অতিরিক্ত ঘনত্ব সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষের ইঙ্গিত করে। অবশ্যই যদি কোনো স্ত্রী সদস্যকে বিশ্বাসযোগ্য কোনো প্রমাণ দেখানো যায় যে দুর্ভিক্ষ আসন্ন বা প্রত্যাশা করা হচ্ছে, তাহলে তাদের নিজের সন্তান উৎপাদনের হার হ্রাস করার মধ্যে নিজস্ব একটি স্বার্থপর উদ্দেশ্য আছে আর প্রতিদ্বন্দ্বীরা যারা এই সতর্ক সংকেতের প্রতি কোনো প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে না, পরিশেষে তারা আসলেই কম সংখ্যক সন্তানকে প্রতিপালন করার সুযোগ পায়, এমনকি যখন কিনা তারা বেশী সংখ্যক সন্তানের জন্ম দিচ্ছে। সেকারণে আমরা ওয়েইন-এডওয়ার্ডসের মত প্রায় একই উপসংহারে উপনীত হই, কিন্তু আমরা সেখানে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের বিবর্তনীয় যুক্তি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পৌঁছাই।
স্বার্থপর জিন তত্ত্বের কোনো এমনকি ‘এপিডাইকটিক’ প্রদর্শনীর সাথে সমস্যা নেই। আপনি মনে করতে পারবেন যে ওয়েইন এডওয়ার্ডস তার হাইপোথিসিসে প্রস্তাব করেছিলেন যে প্রাণীরা সুপরিকল্পিতভাবে বড় জমায়েত হিসাবে নিজেদের প্রদর্শন করে, এবং তার উদ্দেশ্য হচ্ছে সব সদস্যরা তাদের জনসংখ্যার আকার সম্বন্ধে একটি ধারণা বা শুমারী তথ্য জানতে পারে এবং সেটার সাথে সামঞ্জস্যতা রেখে তারা তাদের জন্ম হার নিয়ন্ত্রণ করে। এমন কোনো সরাসরি প্রমাণ নেই যে এই ধরনের কোনো জমায়েত আসলেই এপিডাইকটিক, কিন্তু শুধু ভাবুন এমন কিছু প্রমাণ পাওয়া গেলো। তাহলে কি স্বার্থপর জিন তত্ত্বটি বিব্রত হতে পারে? এক ফোটাও নয়।
স্টারলিং পাখিরা একসাথে একটি বিশাল বড় সংখ্যায় বসবাস করে থাকে। ধরুন গবেষণা প্রমাণ করলো যে শীতের সময় ঘনবসতি পরবর্তী বসন্তে শুধুমাত্র উর্বরতার হারই কমিয়ে দিচ্ছে না, এছাড়াও এমন কিছু ঘটার প্রত্যক্ষ কারণ হচ্ছে ‘পাখিদের পরস্পরের ডাক শুনতে পারা’। এটি হয়তোবা পরীক্ষামূলকভাবে প্রদর্শন করা যেতে পারে, যেকোনো সদস্যদের উচ্চ স্বরে আর বহু সংখ্যক স্টারলিং এর আওয়াজ টেপ রেকর্ডিং যদি শোনানো যায় তারা কম সংখ্যক ডিম পারে, যাদের আরো শান্ত আর কম সংখ্যক পাখিদের ডাকের রেকর্ডিং শোনানো হয়, তাদের তুলনায়। সংজ্ঞানুযায়ী এটি ইঙ্গিত দেয় স্টারলিং পাখিদের ডাক একধরনের ‘এপিডাইকটিক’ প্রদর্শনীর সমতুল্য। স্বার্থপর জিন তত্ত্ব এটি একইভাবে ব্যাখ্যা করবে যেমন করে ইঁদুরদের ক্ষেত্রে এটি ব্যাখ্যা করেছে।
আবারো, আমরা শুরু করেছি সেই ধারণা নিয়ে যে ভরণ-পোষণের সামর্থের বাইরে পরিবারের কোনো আকারের জন্য জিনটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে শাস্তি পাবে প্রাকৃতিক নির্বাচনের দ্বারা এবং ফলশ্রুতিতে জিনপুলে তাদের সংখ্যা কমে আসবে। কোনো একটি দক্ষ ডিম পাড়া পাখির একটি কাজ হচ্ছে আগেই থেকেই ধারণা করা তার জন্য সর্বোত্তম আদর্শ ক্লাচ সাইজটি কেমন হবে। এবং এ ধারণাটি একজন স্বার্থপর প্রজাতি সদস্য হিসাবে সে করবে, আসন্ন প্রজনন ঋতুর জন্য। অধ্যায় ৪ থেকে আপনি হয়তো মনে করতে পারবেন আমরা একটি বিশেষ অর্থে এই ভবিষ্যদ্বাণী বা পূর্বধারণাটি ব্যবহার করছি। কিন্তু কিভাবে একজন স্ত্রী পাখি তার জন্য উপযুক্ত হতে পারে এমন একটি ক্লাচ সাইজের সংখ্যা অনুমান করতে পারে? কোন নিয়ামকগুলোর তার এই সিদ্ধান্তগুলোকে প্রভাবিত করা উচিৎ? হতে পারে যে বহু প্রজাতির কোনো না কোনো একটি স্থির ভবিষ্যদ্বাণী করে, যা বছর প্রতি পরিবর্তিত হয়না। এভাবে গড়পড়তা কোনো একটি গ্যানেটের জন্য আদর্শ ক্লাচ সাইজ হচ্ছে, এক। খুবই সম্ভব যে কোনো একটি বছরে যখন খাদ্য হিসাবে মাছের সহজপ্রাপ্যতা বিশেষভাবে ভালো ছিল, তখন হয়তো সত্যিকারের আদর্শ ক্লাচ সাইজ সাময়িকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে হতে পারে দুটি ডিম। যদি গ্যানেটদের পক্ষে কোনভাবে আগে থেকে জানার উপায় না থাকে যে কোনো একটি বিশেষ বছর খাদ্য সরবরাহের দিক থেকে কি তাদের অনুকূলে থাকবে কিনা, তখন আমরা আশাও করতে পারিনা যে স্ত্রী সদস্যরা তাদের সীমিত সম্পদ নষ্ট করার ঝুঁকি নেবে দুটি ডিম পেড়ে, যখন এটি গড়পড়তা বছরে তাদের প্রজনন সাফল্য হ্রাস করবে।
কিন্তু অন্য আরো প্রজাতি থাকতে পারে, হয়তো স্টারলিং পাখিরাই, যেখানে নীতিগতভাবে এটি সম্ভব ভবিষ্যদ্বাণী করা শীতের সময়, পরবর্তী বসন্তে কি কোনো বিশেষ খাদ্য উৎসর ভালো ফলন হবে কিনা। গ্রামের মানুষদের অসংখ্য প্রবাদ আছে, যেগুলো প্রস্তাব করে এমন কিছু ‘সংকেত’, যেমন, হলি বেরীর ব্যাপক ফলন আসন্ন বসন্তে ভালো আবহাওয়ার ইঙ্গিত দেয়। এই সব প্রবাদ কোনটি আসলেই সত্যি কিংবা মিথ্যা হোক, যৌক্তিকভাবেই অবকাশ থাকে ভাবার যে আসলেই এমন কিছু ধরনের ইঙ্গিত থাকা সম্ভব কিনা এবং একজন ভবিষ্যদ্রষ্টা পাখি তাত্ত্বিকভাবে তার নিজের সুবিধা অনুযায়ী ক্লাচ সাইজের আকার বছর অনুযায়ী পরিবর্তন করতে পারে। হলি বেরী নির্ভরযোগ্য কোনো সংকেত হোক বা না হোক, যেমন আমরা ইঁদুরের ক্ষেত্রে দেখেছি, খুবই সম্ভাবনা আছে যে জনসংখ্যার ঘনত্ব ও ঘনবসতির একটি ভালো আগাম সংকেত হতে পারে। একটি স্ত্রী স্টারলিং পাখি নীতিগতভাবে জানতে পারে যে, যখন সে তার সন্তানদের খাওয়াবে আগামী বসন্তে, সে তার নিজের প্রজাতির অন্য সদস্যদের সাথেও খাদ্যের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। যদি কোনো কোনো ভাবে সে পারে শীতের সময় তার নিজের প্রজাতির সদস্যদের ঘনত পরিমাপ করার জন্য, এটি তাকে ভবিষ্যদ্বাণী করার শক্তিশালী একটি উপায় দেবে বুঝতে যে আগামী বসন্তের সময় তার সন্তানদের জন্য খাদ্য সংগ্রহ করা ঠিক কতটা কঠিন হতে পারে। যদি সে বুঝতে পারে, শীতের সময় জনসংখ্যা বিশেষভাবে বেশী, তার সংযত নীতি হবে, তার নিজের স্বার্থপর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, কম সংখ্যক ডিম পাড়া। তার নিজের জন্য উপযুক্ত ক্লাচ সাইজ সংক্রান্ত তার পরিমাপ তাই হ্রাস পাবে পরিস্থিতি অনুযায়ী।
এখন যে মুহূর্তে এটি সত্যে পরিণত হবে যে সদস্যরা তাদের ক্লাচের আকার কমিয়ে দিচ্ছে তাদের জনসংখ্যার ঘনত্ব পরিমাপ করার মাধ্যমে, তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিটি স্বার্থপর সদস্যদের জন্য এটি সুবিধায় পরিণত হবে, যদি প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রতি “জনসংখ্যার আকার বিশাল’ এমন কোনো ইঙ্গিত দিয়ে তারা ভান করতে পারে, সেটি সত্য বা মিথ্যা যাই হোক না কেন। যদি স্টারলিং পাখিরা তাদের শীতকালের গ্রুপের ডাকের তীব্রতা পরিমাপ করে জনসংখ্যার আকার সম্বন্ধে ধারণা নেয়, তাহলে আসলেই প্রতিটি সদস্য লাভবান হবে যত জোরে সম্ভব তত জোরে চিৎকার করলে, যেমন, তাদের ডাক শুনলে মনে হবে একটি নয় দুটি স্টারলিং ডাকছে। প্রাণীরা যে এইভাবে ভান করতে পারে যে তারা আসলে এক নয় একাধিক প্রাণী একসাথে, এমন ধারণা প্রস্তাব করা হয়েছিল ভিন্ন একটি প্রসঙ্গে, সেটি করেছিলেন জে. আর. ক্রেবস। তিনি এর নাম দিয়েছিলেন Beau Geste Effect; নামটি এসেছে একটি উপন্যাস থেকে যেখানে একটি ফরাসী সেনা বা লিজিয়নদের ইউনিট একই কৌশল ব্যবহার করেছিল। আমাদের এই ক্ষেত্রে ধারণাটি হচ্ছে তাদের ক্লাচ সাইজ কমানোর জন্য প্রতিবেশী স্টারলিংদের আওয়াজ দিয়ে প্ররোচিত করা, সেই বছরের জন্য যা আদর্শ, সেটি যেন তার চেয়ে কম হয়। আপনি যদি কোনো একটি স্টারলিং হন, আর আপনি যদি সফল হন এমন কিছু করার জন্য, আপনার স্বার্থপর সুবিধার কথা বিবেচনা করে, কারণ আপনি সেই সদস্যদের সংখ্যা কমাবার চেষ্টা করছেন যারা আপনার জিন বহন করছে না। আমি সেকারণে উপসংহার টানতে পারি যে ওয়েইন-এডওয়ার্ডসের এপিডাইকটিক প্রদর্শনী আসলেই ভালো একটি ধারণা: তিনি হয়তো সবসময়ই ঠিকই ছিলেন কিন্তু ভুল কিছু কারণে। আমরা সাধারণভাবে, স্বার্থপর জিনের ভাষায় ব্যাখ্যা করার জন্য ল্যাকের প্রস্তাবিত হাইপোথিসিসটি যথেষ্ট শক্তিশালী, কারণ সব প্রমাণ মনে হতে পারে যে গ্রুপ সিলেকশন তত্ত্বটিকে সমর্থন করেছে, যদি এমন কোনো উদাহরণ কোনো দিন খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়।
এই অধ্যায় থেকে আমাদের উপসংহার হচ্ছে, একক কোনো পিতামাতা জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি পালন করে, কিন্তু সেটি এমন একটি অর্থে যে, তারা তাদের জন্ম দেবার হারকে তাদের জন্য সবচেয়ে অনুকূল রুপ দেবার চেষ্টা করে, সবার কল্যাণে তারা নিজেদের সংযত রাখে না। তারা চেষ্টা করেন তাদের জন্ম দেয়া সবকটি সন্তানের মধ্যে জীবিত ও প্রজনন সফল হতে পারে এমন সংখ্যক সন্তানের সর্বোচ্চ সংখ্যা নিশ্চিৎ করতে। এর মানে হচ্ছে কম সংখ্যক সন্তান না নেয়া আবার বেশী সংখ্যক সন্তানের জন্ম না দেয়াও। যে জিনগুলো কোনো একটি একক সদস্যকে অনেক বেশী সন্তান নেবার জন্য সাহায্য করে সেই জিনগুলো জিনপুলে সাধারণত টিকে থাকে না, কারণ তাদের সন্তানরা যারা এই জিনটি বহন করে তারা প্রাপ্তবয়স্ক অবধি পৌঁছাতে পারে না।
বেশ তাহলে পারিবারিক আকারের সংখ্যাবাচক দিকটি বিবেচনা সংক্রান্ত অনেক আলোচনা হলো। আমরা এখন এসে পৌঁছেছি। পরিবারের অভ্যন্তরে সদস্যদের পারস্পরিক স্বার্থ নিয়ে সংঘাত সংক্রান্ত আলোচনায়। আসলেই কি সবসময় মায়ের জন্য লাভ হয় তার সব সন্তানকে সমানভাবে প্রতিপালন করার ক্ষেত্রে, অথবা, তার কি কোনো প্রিয় সন্তান থাকতে পারে? পরিবারের কি উচিৎ এমনভাবে কাজ করা, যেন পারস্পরিক সহযোগিতাপূর্ণ কোনো একক একটি ইউনিট, অথবা, আমাদের আশা করা উচিৎ স্বার্থপরতা আর প্রতারণার উপস্থিতি থাকবে পরিবারের মধ্যে? কোনো পরিবারের সব সদস্যরাই কি তাদের জন্য সবচেয়ে অনুকূল লক্ষ্যের উদ্দেশ্যে একসাথে কাজ করবে অথবা কোনটি তাদের জন্য সবচেয়ে অনুকূল লক্ষ্য হবে সেটি নির্ধারণের ক্ষেত্রে তারা কি নিজেদের মধ্যে মতানৈক্য প্রদর্শন করবে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেবার চেষ্টা করবো আমরা পরের অধ্যায়ে এবং সম্পর্কযুক্ত আরেকটি প্রশ্ন, দুই প্রজনন সঙ্গীর মধ্যেও কি স্বার্থের সংঘাত আছে? সেই বিষয়ে আলোচনা আমরা অধ্যায় ৯ পর্যন্ত স্থগিত রাখলাম।
নোটস (অধ্যায় ৭)
(১) অন্যান্য অ্যাকাডেমিক ভিন্নমতাবলম্বীরা প্রায়শই যেমন বৈরীতার মুখোমুখি হন, সেই তুলনায় ওয়েইন-এডওয়ার্ডস, অপেক্ষাকৃত কম প্রতিআক্রমণের স্বীকার হয়েছিলেন। সুস্পষ্টভাবে ভুল একটি অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও তাকে ব্যাপকভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে যে (যদিও আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি এই বিষয়টি নিয়ে একটু বেশী বাড়াবাড়ি করা হয়েছে) তিনি বিজ্ঞানীদের নির্বাচন বিষয়ে আরো সুস্পষ্টভাবে চিন্তা করার জন্য প্ররোচিত করেছিলেন। ১৯৭৮ সালে তিনি নিজেই একটি মহানুভব পুনরাবির্ভাব ঘটিয়েছিলেন, যখন তিনি লিখেছিলেন:
‘বর্তমানে তাত্ত্বিক জীববিজ্ঞানীর মধ্যে সাধারণ ঐক্যমত হচ্ছে, কোনো বিশ্বাসযোগ্য মডেল পরিকল্পনা করা সম্ভব না, যার মাধ্যমে গ্রুপ সিলেকশনের ধীর প্রবাহ স্বার্থপর জিনদের অনেক বেশী মাত্রায় দ্রুত বিস্তারকে অতিক্রম করে যেতে পারে যা একক সদস্যদের ফিটনেসের ক্ষেত্রে লাভজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। সে কারণে আমি তাদের মতামতের সাথে একমত পোষণ করছি।
এই দ্বিতীয় ভাবনাটি মহানুভব মনে হতে পারে কিন্তু দুঃখজনকভাবে তার একটি তৃতীয় মতামতও ছিল: তার সর্বশেষ বইটি এটি প্রত্যাখ্যান করে:
গ্রুপ সিলেকশন, যে অর্থে এটিকে আমরা দীর্ঘদিন ধরে বুঝে আসছি, যখন আমার প্রথম সংস্করণটি প্রকাশ হয়েছিল সেই সময়ের তুলনায় সেটি এখন জীববিজ্ঞানীর মধ্যে এখন আরো বেশী সুনজর বঞ্চিত হয়েছে। বিপরীত কিছু ভাবার জন্য কেউ ক্ষমা পেতে পারেন: বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে একটি প্রজন্ম বড় হয়েছে, তারা গ্রুপ সিলেকশন’ নামটি যত্রতত্র ছড়িয়ে বেড়াচ্ছেন উৎসবের কনফেটির মত। সব ধরনের ক্ষেত্রে এটি অনুপ্রবেশ করেছে এর আগে যা ছিল তার তুলনায়। যে সমস্ত কেসগুলো (এবং আমাদের বাকীদের কাছে এখনও যা পরিষ্কার সুস্পষ্টভাবে আর সরাসরি বোঝা সম্ভব হয়েছে অন্য কিছু হিসাবে, যেমন ধরুন, ‘কিন সিলেকশন। আমি মনে করি এটি সম্পূর্ণ নিষ্ফল একটি ব্যপার হবে এই সব অপেক্ষাকৃত নবাগতদের শব্দের অর্থের চর্চা নিয়ে বিচলিত হলে। যাই হোক এক দশক আগে গ্রুপ সিলেকশনের পুরো বিষয়টি খুবই সন্তোষজনকভাবে সমাধান করেছেন জন মেনার্ড স্মিথ এবং অন্যান্যরা। আসলেই বিরক্তিকর এখন যখন দেখি আমাদের দুটি প্রজন্ম, এমনকি দুটি জাতি, একটি সাধারণ ভাষার দ্বারা বিভাজিত হয়ে আছে। আরো বেশী দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে অনেক দেরীতে এই ক্ষেত্রে প্রবেশ করা দার্শনিকরা আরো গুলিয়ে ফেলেছেন তাদের সাম্প্রতিক ভাষা ব্যবহারের খামখেয়ালীপনায়। আমি অ্যালান গ্রাফেনের সুস্পষ্ট ধারণাপূর্ণ Natural Selection, Kin Selection and Group Selection প্রবন্ধটি পড়তে অনুরোধ করবো,এবং আমি এখন আশাকরি বর্তমানের এই নব্য গ্রুপ সিলেকশন সমস্যাটি সমাধানের জন্য নির্ধারণী ভূমিকা রাখবে।