০৭. পদ্মায় বিশাল চর জেগেছে

মুন্সিগঞ্জের দক্ষিণে পদ্মায় যে বিশাল চর জেগেছে, শুভ্ৰ আছে সেখানে। সে খাটো করে লুঙ্গি পরেছে। গায়ে কুচকুচে কালো রঙের গেঞ্জি। পায়ে রাবারের লাল জুতা। সে নৌকায় বসা, হাতে ছিপ। নৌকা খুঁটি দিয়ে আটকানো। জোয়ারে পানি বাড়ছে। নৌকা দুলছে। শুভ্রর দৃষ্টি ফাতনার দিকে। তিনটা ছিপ সে ফেলেছে। একটা হাতে নিয়ে আছে। মাছ বড়শি ঠোকরাচ্ছে, কিন্তু গিলছে না। মাছ মারার বিষয়টা সে এখনো রপ্ত করতে পারে নি। এখন পর্যন্ত সে ছিপ দিয়ে মাছ ধরতে পারে নি। তার ধারণা আজ একটা অঘটন ঘটবে।

চরে শুভ্রকে সবাই চেনে ধলা মিয়া নামে। গায়ের রঙের জন্যে তার নাম ধলা। তবে রোদে পুড়ে তার গায়ের রঙ ঝলসে গেছে। শরীরের পেলবতার কিছুই অবশিষ্ট নেই। চারের অন্য মানুষদের থেকে তাকে আলাদা করা কঠিন। গত পরশু মাথার উকুনের হাত থেকে বাঁচার জন্যে সে মাথা কামিয়েছে। তাকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে। গতকাল থেকে তাকে ডাকা হচ্ছে মাথা ছিলা ধলা মিয়া। চরাঞ্চলে মানুষের নাম এবং পরিচয় দ্রুত বদলায়।

হঠাৎ শুভ্রর নৌকা দুলে উঠল। ছাতি মাথায় অচেনা একজন নৌকায় উঠে এসেছে। তার থুতনিতে সামান্য দাড়ি। মাথায় কিস্তি টুপি। তার গা থেকে সস্তা আতরের গন্ধ আসছে।

আপনি ধলা মিয়া না?

শুভ্র বলল, জি, আমি মাথা ছিলা ধলা মিয়া।

কী করেন?

মাছ ধরার চেষ্টা করছি।

আপনি কি আমারে চিনেন?

শুভ্র বলল, না। চিনি না।

চরের সবাই আমারে চিনে, আপনি চিনেন না, এইটা কেমন কথা! আমার নাম হারুন, এখন চিনেছেন?

হ্যাঁ, এখন চিনেছি। আমি আপনাকে অত্যন্ত বলশালী কেউ ভেবেছিলাম। আপনি রোগাপাতলা মানুষ ভাবি নি।

হারুন বলল, আপনার মুখের ভাষা ঢাকা শহরের মতো। আপনি কি ঢাকার লোক।

হ্যাঁ, আমি ঢাকার।

ঢাকার লোক চরে কেন?

বোনের সঙ্গে এসেছি।

মর্জিনা আপনার বোন?

জি।

বোনের সঙ্গে আসছেন কী কারণে?

শুভ্র বলল, ভাই বোনের কাছে আসবে না?

হারুন বলল, আসছেন ভালো কথা। কিছুদিন চরের বাতাস খেয়েছেন, এইটাও ভালো। চরের বাতাসে ভাইটামিন আছে। শরীরে ভাইটামিন পড়েছে, এখন বোন নিয়া বিদায় হয়ে যান।

শুভ্ৰ বলল, বিদায় হব কেন? পদ্মায় যাদের জমি চলে গেছে তারাই চরে জমি পেয়েছে। কাগজপত্ৰ দেখিয়ে আমরা দখল নিয়েছি। সরকারি লোক দখল দিয়েছে।

হারুন গলায় ঝুলানো পেতলের খিলাল দিয়ে দাঁত খিলাল করতে করতে বলল, চরে কোনো সরকার নাই। চরে আমরাই সরকার। আমি হুকুম দিলাম, তিন দিনের মধ্যে চর ছাড়বেন। যদি না ছাড়েন কী হবে শুনতে চান?

শুভ্র বলল, শুনতে চাই না, তবে বলতে চাইলে বলতে পারেন।

হারুন বলল, আপনার লাশ পানিতে ভাসবে।

শুভ্রর ছিপের একটা ফাতনা ড়ুবে গেছে। উত্তেজনায় অস্থির হয়ে সে ছিপ টানল এবং বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে দেখল, মধ্যম আকৃতির একটা বোয়াল মাছ বরশিতে বিঁধেছে। মাছটা তার প্রাণশক্তিতে ছটফট করেই যাচ্ছে। সূর্যের আলোতে সে ঝলমল করছে। শুভ্ৰ প্ৰাণপণে চেঁচাল, মাছ ধরে ফেলেছি! মাছ ধরে ফেলেছি!

হারুন বলল, মাছ ভালোই ধরেছেন। এই বোয়ালের নাম কালিবোয়াল, এর স্বাদ অদ্ভুত।

শুভ্ৰ বলল, এই বোয়ালটা আপনি নিয়ে যান।

হারুন বলল, আমি নিয়া যাব? দুই পয়সার বোয়াল দিয়া আমারে খুশি করা যাবে না। আপনারে তিন দিন সময় দিয়েছি, বোয়াল মাছের কারণে এক মিনিট সময় বেশি পাবেন। তিন দিন এক মিনিট। এর মধ্যে আসসালামু আলায়কুম বলবেন।

শুভ্র বলল, এক মিনিট সময় বেশি পাবার জন্যে মাছটা আপনাকে দিতে চাচ্ছি তা না। আমি মাছ ধরে যতটা আনন্দ পেয়েছি, আপনি আমার মাছ ধরা দেখে ততটাই আনন্দ পেয়েছেন। আপনার চোখ ঝলমল করে উঠেছিল, এইজন্যেই দিচ্ছি।

হারুন বলল, আপনি বিরাট চালাক লোক, তবে চালাকিতে কাজ হবে না।

হারুন সিগারেট ধরাল।

শুভ্র বলল, আপনার কথা কি আরও বাকি আছে?

হারুন বলল, কথা যা বলার বলে ফেলেছি। এখন আপনার মাছ ধরা দেখি। হারুনের কথা শেষ হবার আগেই শুভ্রর ছিপে একটা রুই মাছ ধরা পড়ল।

হারুন বলল, ধলা মিয়া! আপনি ভাগ্যবান মানুষ। এই বড়শিতে এত বড় রুই মাছ ধরা পড়ে না। সিগারেট খাবেন?

সিগারেট খাই না। হারুন বলল, আপনি একটা বোয়াল মাছ দিলেন, আমি নিলাম। আমি সিগারেট দিলাম, আপনি নিবেন।

শুভ্র বলল, বোয়াল মাছ আপনি খান। সিগারেট আমি খাই না। কাজেই নিব না।

হারুন বোয়াল মাছ হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, সময় তিন দিন এক মিনিট। মনে থাকে যেন।

শুভ্ৰ জবাব দিল না। সে একদৃষ্টিতে ফ্যাতনার দিকে তাকিয়ে আছে। তার মন বলছে আরেকটা মাছ ধরা পড়বে। মাছের সংখ্যা হবে তিন। তিনি একটি প্রাইম সংখ্যা। পিথাগোরাসের মতে, অতি রহস্যময় সংখ্যা। স্বৰ্গ, মর্ত্য ও পাতালের প্রতীক। পৃথিবী, চন্দ্র এবং সূর্যের প্রতীক। তিন হচ্ছে। আমি, তুমি, সে। পিতা, মাতা ও সন্তান।

 

চরের লোকজন সবাই শুভ্ৰকে চিনে আধাপাগল মানুষ হিসাবে। আধাপাগলরা পথের ফকির হয়, ধলা মিয়া পথের ফকির না। সে অনেককেই ঘর বাঁধার বাঁশ কিনে দিয়েছে। চরে দুটা টিউবওয়েল বসিয়েছে। একটা স্কুলঘর তৈরি হচ্ছে। স্কুলঘরে চরের ছেলেমেয়েরা যাবে। পড়াশোনা করবে। তাদের জন্যে একজন শিক্ষকও জোগাড় হয়েছে। বাবু নলিনী বসাক। তিনি আগে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। নদীভাঙনের শিকার হয়ে ঢাকা শহরে বাচ্চাদের খেলনা এবং বেলুন বিক্রি করতেন। চরাঞ্চলে সবারই মূল নামের বাইরে আরেকটা নাম থাকে। বসাক স্যারের সেই নাম হচ্ছে পাইখানা স্যার! কোনো একটি বিচিত্র কারণে তিনি স্যানিটারি পায়খানা নিয়ে বিশেষভাবে উত্তেজিত। রিং এবং স্লাভ বসিয়ে কীভাবে স্যানিটারি পায়খানা তৈরি করতে হয় তা তিনি জানেন। এবং সবাইকে এই বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া পবিত্র দায়িত্ব মনে করেন। এইখানেই পাইখানা স্যার নামকরণের সার্থকতা।

চরের সবচেয়ে দুর্বল, অশক্ত এবং রুগ্ন মানুষটার নাম কল্লাকাটা। সে কথায় কথায় বলে, কোন বান্দিরপুত চর থাইকা আমারে সরাইব? কল্লা কইটা ফেলুম। কল্লাকাটার কাছে শুভ্ৰ দেবতাদের একজন। শুভ্র সম্পর্কে সামান্য বিরূপ কোনো কথা বললে সে চেঁচিয়ে বলে, ধলা মিয়া বিষয়ে একটা অন্ধমন্দ কথা কেউ বলছি কি কল্লা কাইটা ফেলুম।

চরে চার-পাঁচটা দোকান চালু হয়েছে। একটা চায়ের স্টল বসেছে এবং তারা ভালো ব্যবসা করছে।

শুভ্ৰ ঠেকে ঠেকে শিখছে। তার প্রধান শিক্ষা, কেউ কোনো স্বাৰ্থ ছাড়া কিছু করতে চায়-এই বিশ্বাস চরের মানুষদের নেই। শুভ্রর স্বাৰ্থ কী তারা বুঝতে পারছে না বলেই শুভ্রর বিষয়ে তাদের সন্দেহ দূর হচ্ছে না, বরং বাড়ছে।

 

তিনটা মাছ ধরার কথা। শেষ মুহূর্তে তিন নম্বর মাছ ধরা পড়ল। ফলি মাছ। মাছ ছোট, কিন্তু তার প্রাণশক্তি দেখার মতো। শুভ্ৰ মুগ্ধ হয়ে মাছের ঝাঁপাঝাঁপি দেখে বড়শি খুলে মাছটা ছেড়ে দিল।

মর্জিনা নৌকায় উঠতে উঠতে বলল, ভাইজানের বিষয় কী? বর্শেল হইছেন কবে? শেষপর্যন্ত মাছ ধরছেন। আলহামদুলিল্লাহ।

শুভ্র বলল, মাছ মারার বিষয়টা খুবই এনজয় করছি। চিন্তা করার সবচেয়ে ভালো ব্যবস্থা হলো ছিপ ফেলে বসে থাকা। দুই ধরনের ছিপ ফেলতে হবে, মাছের ছিপ এবং চিন্তার ছিপ। মাছের ছিপে মাছ ধরা পড়বে। চিন্তার ছিপে চিন্তা।

মর্জিনা বলল, আপনার পাগলা কথা কিছুই বুঝি না। আইজ চিন্তা কইরা কী পাইছেন?

শুভ্র বলল, আজ চিন্তা করে পেয়েছি চরে কারও আলাদা করে কিছু থাকবে না। এখানে সবকিছুই সবার। অনেকগুলি নৌকা থাকবে। নৌকায় মাছ ধরা হবে। নৌকাও সবার, মাছের মালিকানাও সবার। ফসল যা হবে সেখানেও সবার সমান ভাগ। কমিউনিস্টটাইপ চিন্তা।

মর্জিনা বলল, পাগলা চিন্তা বাদ দেন। আপন দুই ভাই একত্রে থাকতে পারে না। সবে মিল্যা একত্রে থাকবে! নদীতে একটা ড়ুব দিয়া মাথা ঠাণ্ডা কইরা আসেন। মাছ নিয়া যাইতেছি, নিজের হাতে মাছ রানব। দেখি আমার ভাইজানের মাছের সোয়াদ কেমন। নদীর ভিতরে বেশিদূর যাইয়েন না। সাঁতার জানেন না কিছু না। ড়ুইব্য মরবেন।

শুভ্র বলল, সাঁতার শিখে ফেলব মর্জিনা। অনেকখানি শিখেছি। মাথা ড়ুবিয়ে দুই মিনিট ড়ুবে থাকতে পারি। মাথা তুললেই পারি না।

শুভ্ৰ নদীতে নেমে গেল। তার মনে হলো, স্রোতে গা ভাসানের আনন্দের কাছে সব আনন্দই তুচ্ছ। মাথার ওপরে গানগনে রোদ। নদীর পানি হিমশীতল। নদীতে নেমে শুভ্রর মাথায় আরেকটা চিন্তা চলে এল। তার কাছে মনে হলো নদীগুলি হচ্ছে আটারি। আর সমুদ্র হৃৎপিণ্ড। হৃৎপিণ্ড সচল রাখার জন্যেই নদী।

 

চরের চায়ের দোকানের চাওয়ালার নাম হেকমত। অতি ধুরন্দর মানুষ। সে একই সঙ্গে হারুনের ঘনিষ্ঠজন এবং ধলা মিয়ার ঘনিষ্ঠজন। চরের বেশ কিছু জমি এখন তার দখলে। সে জমি চাষাবাদ শুরু করেছে। চিনা বাদাম এবং বাঙ্গির বীজ পুতেছে। চারের মাটিতে এই দুই জিনিস ভালো হয়। হেকমতের বয়স চল্লিশের ওপর। এখনো বিয়ে করে নি। সে ঠিক করেছে, জমির দখলের ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত হলেই বিয়ে করে ফেলবে। চারের জমি হলো বাজারের মেয়েমানুষ। ঘনঘন দখল বদলায়। হেকমত ঠিক করেছে গুছিয়ে বসলে চরের কোনো মেয়েকেই বিয়ে করবে। এরা যন্ত্রের মতো কাজ করতে পারে। বেশ কয়েকটি মেয়ের দিকে তার লক্ষ আছে। এদের মধ্যে মর্জিনাকে তার বিশেষ পছন্দ। মর্জিনার বয়স অল্প, রূপবতী। সে তার বাড়িঘরও সুন্দর করে গুছিয়েছে। মর্জিনার বাপের যে বয়স এবং শরীরের যে অবস্থা তাতে মনে হয় না বেশিদিন টিকবে। তখন মর্জিনার বিষয়ও চলে আসবে তার হাতে। একটাই সমস্যা-ধলা মিয়া। ধলা মিয়ার সঙ্গে মর্জিনার ভাইবোন সম্পর্ক, এটা হেকমত বিশ্বাস করে না। মায়ের পেটের ভাইবোন হলো ভাইবোন। বাকি সব ভাইবোন সেক্সের সুবিধা নেওয়ার ভাইবোন। হেকমত ঘাস কাটা গরু না। সে সব বুঝে। ধলী মিয়াকে চরছাড়া করা বিশেষ প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।

পরপুরুষের সঙ্গে বোন সেজে সম্পর্ক যে মেয়ের, তাকে বিবাহ করা কঠিন। তবে এই বিয়েটা সে করবে। স্বার্থের কারণে। মর্জিনা বান্দির মতো সংসারে খাটবে। সংসারের আরো উন্নতি হবার পর সে দেখেশুনে ভালো একটা মেয়ে বিবাহ করবে। সংসার থাকবে সেই মেয়ের হাতে। মর্জিনার পরিচয় হবে বান্দি বউ। চার অঞ্চলে এটা নতুন কিছু না। চর অঞ্চলে একেক পুরুষের তিন-চারটা বউ থাকে। তারও থাকবে। এক বউ হলো সুন্দরের জন্যে। সে সেজোগুজে থাকবে। পায়ে আলতা, চোখে কাজল, ঠোঁটে লিপষ্টিক। বাকি বউরা হবে কামলা বউ।

হেকমত চুলা নিভিয়ে দিল। ভরদুপুরে কেউ চা খেতে আসে না। ভাত খেয়ে এখন সবাই ভাতম্বুম দিবে। হেকমতের ঘরে ভাত রাধার কেউ নাই। নিজের ভাত তাকে নিজেকেই রাঁধতে হবে।

 

শুভ্ৰ দুপুরের খাবার খেয়ে শুয়েছে। দুপুরের খাবার তাকে একা খেতে হয়েছে। মর্জিনার বাবা ইয়াকুব জুরে কাতর। সে ঘরে শুয়ে কাতরাচ্ছে। মর্জিনা বাবার ঘরে উঁকি পর্যন্ত দিচ্ছে না। শুভ্ৰ পার্টি পেতে শুয়েছে পাকুরগাছের নিচে। চারের গাছপালা দ্রুত বড় হয়। পাকুরগাছ ভালোই বড় হয়ে ছায়াদায়িনী বৃক্ষ হয়ে গেছে। সে তার পছন্দের বই চোখের সামনে ধরে আছে। বইটা ভারী। হাত দিয়ে ধরে রাখতে কষ্ট হয়। তার চোখে ঘুম। গরম বাতাস বইছে। ঠান্ডা বাতাসে ঘুম কেটে যায়। গরম বাতাসে ঘুম আসে। অথচ উল্টোটা হওয়া উচিত ছিল।

শুভ্ৰ প্ৰাণপণে চোখ খোলা রাখতে চেষ্টা করছে। বইয়ের লাইনগুলি অস্পষ্ট श्५श् अप्रिाgछ—

Twelve more years passed. Each year the Bagginses had given very lively combined birth dayparties at Bag End; but now it was understood that some thing quite exceptional was being planned for the the Autumn.

ভাইজান! চোখ বন্ধ কইরা বই পড়েন ক্যামনে?

শুভ্ৰ হাত থেকে বই নামাতে নামাতে বলল, চোখ খুলেই বই পড়ছিলাম। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে এসেছে।

মাথার চুল টাইল্যা ঘুম পাড়ায়া দেই?

শুভ্র বলল, আমার মাথায় চুল কোথায় যে টানবে?

মর্জিনা বলল, তাও তো কথা। পা টিপ্যা দিব?

উঁহু। এমনিতেই ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। তাছাড়া কেউ গায়ে হাত দিলে আমার ভালো লাগে না।

ভালো লাগে না কী জন্যে?

শরীর খুবই ব্যক্তিগত জিনিস। সেটা থাকবে সেভাবেই।

তাও ঠিক। ভাইজান ঘুমান। আমি আপনার কাছে বইসা থাকি।

বসে থাকতে হবে না।

দূরে বইসা থাকব। চিন্তা কইরেন না ভাইজান, শ‍ইলে হাত দিব না।

শুভ্ৰ ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখল, সে পরীক্ষার হলে বসে আছে। তার হাতে প্রশ্নপত্র দেওয়া হয়েছে। ফিজিক্সের বদলে ইংরেজি সাহিত্যের প্রশ্ন। প্রথম প্রশ্ন : Write an essay on Tolkien’s Lord of the Rings. সে লেখা শুরু করতে গিয়ে দেখল, চশমা আনতে ভুলে গেছে। কিছুই দেখতে পাচ্ছে না।

 

মর্জিনা গ্লাস নিয়ে হেকমতের চায়ের দোকানো গিয়েছে। গ্লাস ভর্তি করে চা নিয়ে আসবে। ঘুম ভাঙলে সে ভাইজানকে গরম গরম চা দেবে। হেকমতের দোকানের চা ভাইজানের পছন্দ।

গ্লাসে চা ঢালতে চালিতে হেকমত বলল, তোমার যে ভাই ধলা মিয়া সে কেমন ভাই?

মর্জিনা বলল, ভাই যেমন হয় তেমন।

তারে পাইলা কই?

আচানক ঘটনা। শুনলে শাইলের লোম খাড়া হয়া যায়। শুনতে চান?

চাই। একদিন সইন্ধ্যাকালে বিরাট ঝড় উঠছে! এমন ঝড় আমি আমার জন্মে দেখি নাই। গাছের ডাল ভাইঙ্গা পড়তাছে। শুরু হইছে বৃষ্টি। হঠাৎ দূরে ঠাড়া পড়ল। ঠান্ডার শব্দের সাথে ধূপুস কইরা এক শব্দ। তাকায়া দেখি, আসমান থাইক্যা চাউলের বস্তার মতো কী জানি পড়ছে। কাছে গিয়া দেখি মানুষ। আমি বললাম, আপনি কে? মানুষটা বলল, আমি তোমার ভাই। আমার নাম মাথা ছিলা ধলামিয়া। এই হইল ঘটনা।

হেকমত বলল, তুমি পাজি মেয়েছেলে। তোমারে যে বিবাহ করবে, তার কপালে দুঃখ আছে।

মর্জিনা বলল, কথা সত্য। এই কারণে ঠিক করেছি। বিবাহ করব না। অন্যরে দুঃখ দিয়া লাভ কী?

মর্জিনা উঠতে যাচ্ছিল, হেকমত বলল, বসো। এক কাপ চা খাও, দাম লাগবে না। মাগনা।

মর্জিনা বসল। তার ঠোঁটের কোনায় হাসি। চেষ্টা করেও সে হাসি গোপন করতে পারছে না।

হেকমত বলল, হাসো কেন?

আপনার ভাব দেইখা হাসি। আপনার ভাব ভালো না। অনেকদিন মেয়ে মাইনষের শইলের গন্ধ না পাইলে পুরুষের যেমন অবস্থা হয় আপনের তেমন অবস্থা।

তুমি তাহলে ভাবও বোঝ?

পুরুষের ভাব বুঝে না এমন মেয়েছেলে আল্লাপাক পয়দা করেন না।

তুমি তো অন্যের পয়সায় ভালো সংসার পাতছ। গাইগারু কিনতেছ শুনলাম।

মর্জিনা বলল, গাইগরু কিনব না। মহিষ কিনব। মহিষের বাথান দিব।

হেকমত বলল, গরু, মহিষ না কিনাই ভালো। হারুন সাব যখন ধাক্কা দিব তখন গরু মহিষ নিয়া পালাইতে পারবা না।

পালাইতে না পারলে আপনেরে দিয়া যাব। খবর পাই, আপনে উনার প্রিয় লোক। আপনেরে তো ধাক্কা দিব না।

চ্যাটাং চ্যাটা কথা কই শিখেছ? তোমার ভাইজানের কাছে?

মর্জিনা বলল, উঠি। চা শেষ।

হেকমত বলল, চায়ের তিয়াস লাগলে চইল্যা আসবা। চা খায়া যাবা। তিয়াস চাইপা রাখা ঠিক না।

মর্জিনা বলল, বিরাট জ্ঞানের কথা বলেছেন গো। তিয়াস চাইপা রাখা ঠিক না। আপনেও চাইপা রাইখেন না। উত্তর চরে নটিবেটিরা কয়েকটা চালাঘর তুলছে। সেইখানে যান। চায়ের দোকানের লাভের কিছু টাকা দিয়া আসেন।

 

সন্ধ্যার পর এখানে গানের আসর বসে। একজনই গায়ক-কল্লাকাটা। তার গলায় সুর আছে। তবে হাঁপানির টান উঠলে গান এলোমেলো হয়ে যায়। সে গান থামায় না। হাঁপানির টান কমানোর চেষ্টা করে। শ্রোতারা কেউ কিছু মনে করে না।

কল্লাকাটা গানের সময় ডান পায়ে নুপুর পরে নেয়। পা ঝাঁকিয়ে তাল দেয়। হারমোনিয়াম আছে, হারমোনিয়াম বাজানোর লোকও আছে। ঢোলবাদক বেশ কয়েকজন আছে। তারা টিনের ক্যানাস্তারায় বাড়ি দিয়ে তাল দেয়। শুভ্ৰ গানের দলকে ঢোল, বেহালা এবং নতুন হারমোনিয়াম কেনার টাকা দিয়েছে। সামনের শুক্রবারে মুন্সিগঞ্জ থেকে বাদ্যযন্ত্র কেনা হবে।

গানের আসর তেমন জমছে না। হারুন এসে ঘুরে গেছে—এই আতঙ্কেই সবাই অস্থির। বোঝাই যাচ্ছে চরে মারামারি শুরু হবে। কখন হবে সেটাই কথা। হারুন জেলে ছিল, অল্প কিছুদিন হলো ছাড়া পেয়েছে। সে এমপি সাহেবের আপনা লোক—এটাই সমস্যা।

চরে মিটিং করে এমপি সাহেব নিজে বলেছিলেন, চর দখলের সংস্কৃতি থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। লাঠি যার চর তার—এই পুরনো স্লোগানে আমরা বিশ্বাস করি না। পদ্মা যাদের জমি কেড়ে নিয়েছে শুধু তারাই জমি পাবে। আর কেউ না। বিলিব্যবস্থা আমি নিজে দেখব। যেন কোনো বিশ্ব বলয়ান হয় তার জন্যে চর এলাকায় পুলিশ ফাঁড়ির ব্যবস্থা হয়েছে। আসুন ফ্লেন্দাভেদ ভুলে আমরা সবাই একত্রে হয়ে সোনার বাংলা গড়ি।

সেই সাংসদ এখন উল্টে গেছেন। পুলিশ ফাঁড়ি উঠে গেছে। এমপি সাহেবের পেয়ারা আদমি হারুন কিছু লোকজন নিয়ে চর মেপে বেড়াচ্ছে। চরে দখল পাওয়া অর্ধেকের মতো মানুষকে উঠে যেতে বলা হয়েছে।

বাবু নলিনী বসাকের নেতৃত্বে একদল চরের মানুষ মাননীয় সাংসদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। মাননীয় সাংসদ ব্যস্ত বিধায় সাক্ষাৎ হয় নি। (পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, এই সাংসদ কোন দলের? আওয়ামী লীগ না-কি বিএনপি? অঁদের আশ্বস্ত করছি, যে দলেরই হোক জিনিস একই। গুণগত মানের কোনো উনিশ-বিশ নেই। আওয়ামী ভাবধারার পাঠকরা ধরে নিন সাংসদ বিএনপির। বিএনপি ভাবধারার পাঠকরা ধরে নিন সাংসদ আওয়ামী লীগের।)

 

রাত আটটা। ইয়াকুবের জ্বর আরো বেড়েছে। মর্জিনা তার মাথায় পানি ঢালছে। এলাকায় কোনো ডাক্তার নেই, একমাত্র ভরসা হুজুরের পানিপড়া এবং প্যারাসিটামল ট্যাবলেট। ইয়াকুবকে প্যারাসিটামল ট্যাবলেটও খাওয়ানো যায় নি। কারণ দোকান বন্ধ।

শুভ্র তাঁর ঘরে। চৌকিতে উপুড় হয়ে বসে সে চিঠি লিখছে। তার সামনে দুটা হারিকেন। একটা হারিকেনের আলোয় তার দেখতে সমস্যা হয়। পাশের ঘরে ইয়াকুব কাতরাচ্ছে, তাতে তার চিঠি লেখায় অসুবিধা হচ্ছে না।

মা,
তোমাকে চিঠি লিখতে বসেছি, কিন্তু এই চিঠি পাঠাতে পারব না। যেখান থেকে লিখছি সেখানে পোষ্টঅফিস নেই। সেটা সমস্যা না। নৌকায় করে মুন্সিগঞ্জ সদর পোস্ট অফিসে যাওয়া যায়। সমস্যাটা হচ্ছে, আমি তো তোমাদের বাড়ির ঠিকানা জানি না। ঠিকানা জানার প্রয়োজন কখনো হয় নি। বিশাল এসি গাড়িতে সারা জীবন ঘোরাঘুরি করেছি।

মা! আমি আনন্দে আছি। অন্য ধরনের আনন্দ। কী রকম বুঝিয়ে বলি।

মনে করো প্ৰচণ্ড গরম পড়েছে। লু হওয়ার মতো বইছে। ধুলি উড়ছে। গা দিয়ে স্রোতের মতো ঘাম বের হচ্ছে। শরীর জ্বলে যাচ্ছে। তারপর হঠাৎ একসময় আকাশের এককোণে কালো মেঘ দেখা গেল। সবার মধ্যে সে কী উত্তেজনা! আসছে, বৃষ্টি আসছে। যখন বৃষ্টি নামে কী যে শান্তি! প্রথমদিনের বৃষ্টির আনন্দে আমি পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলাম। চরের ছেলেমেয়েরা (বলতে ভুলে গেছি, আমি চরে বাস করি) একসময় কাদায় গড়াগড়ি করা শুরু করল। আমিও তাই করলাম। গাভর্তি কাদা নিয়ে নদীতে মহিষের মতো শরীর ড়ুবিয়ে বসে রইলাম। কী শান্তি! কী শান্তি!

মা! তুমি কি উইলিয়াম গোল্ডিংয়ের Lord of the Fies উপন্যাসটা পড়েছ? মনে হয় পড় নি। বাবা পড়েছেন। একদল শিশু নির্জন দ্বীপে উপস্থিত হয়। একে একে তাদের চরিত্র প্রকাশিত হতে থাকে। আমি খুব কাছ থেকে গোল্ডিং সাহেবের উপন্যাস দেখছি। ফিজিক্সে ল্যাবরেটরি আছে। সাহিত্যে কোনো ল্যাবরেটরি নেই। এই প্রথম আমি সাহিত্যের ল্যাবরেটরি দেখছি এবং মজা পাচ্ছি।

মানুষের চরিত্রের অন্ধকার সবসময় প্রকাশিত হয় না। হঠাৎ হঠাৎ প্রকাশিত হয়। তার জন্যে বিশেষ পরিস্থিতির প্রয়োজন হয়। চর হচ্ছে সেই পরিস্থিতি। আমার কাছে হচ্ছে, আমি একটা virtual জগতে ঢুকে গেছি। কিছুই না জেনে আমি এই জগতের একজন observer।

কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় observer অতি গুরুত্বপূর্ণ। রিয়েলিটি অবজার্ভারনির্ভর। আমি কোয়ান্টাম বলবিদ্যা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি।

অনেক জটিল জটিল কথা লিখে ফেললাম। এখন হালকা কথা। আমাদের দ্বীপের মানুষের খুব মন খারাপ। কেন জানো? কারণ দ্বীপে কোনো পাগল নেই। একজন উন্মাদ না-কি তার হতভাগ্যের কারণে অন্যের ভাগ্য নিয়ে আসে। আমরা সবাই একজন পাগলের জন্যে অপেক্ষা করছি। বাইরে থেকে পাগল আনলেও চলে, তবে নিজেদের পাগল থাকলে সবচেয়ে ভালো হয়।

মা! এখন গানবাজনার আসর বসেছে। যে গান করছে তার নাম কল্লাকাটা। এই অদ্ভুত নামের কারণ হচ্ছে সে কথায় কথায় মানুষের কল্লা কেটে ফেলতে চায়। কল্লাকাটার গলা সুন্দর। শুনেছি আগে অনেক সুন্দর ছিল। প্রচুর গাজা খাবার কারণে গলা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কল্লাকাটা শুধু যে গান করে তা না, সে আবার গীতিকারও। নিজেই গান লিখে, নিজেই সুর দেয়। আমাকে নিয়ে সে বেশ কয়েকটা গান লিখেছে। তার একটার কথা এরকম—

ধলা মিয়া করবে বিয়া
নয়া পাড়ায় গিয়া
ঘাট থাইকা কইন্যা তুললাম
মুন্সিগঞ্জে গিয়া।
মুন্সিগঞ্জের কইন্যা সুন্দর
সুন্দর তাহার আঁখি
তারে দেখলে মন উদাস
যেন কোকিল পাখি।
ধলা মিয়া বড়ই ধলা
কন্যা হইলেন কালো
ধলা-কালা মিলনেতে
জগৎ হইবে আলো…

বিশাল গান। পুরোটা মনে নেই; ধলা মিয়া আমার নাম। সবাই আমাকে ধলা মিয়া ডাকে। কেউ কেউ ডাকে মাথা ছিলা ধলা মিয়া। মাথা কামিয়েছি তো-এইজন্যে।

মা, তোমাকে চিঠিটা পাঠানোর বুদ্ধি বের করেছি। তোমার বাড়ির ঠিকানা ভুলে গেলেও যুথীর ঠিকানা মনে আছে; এবং খাতায় লেখাও আছে।

মা, আমার জন্যে ব্যস্ত হয়ে না। আমি একটা experiment শুরু করেছি। তার ফলাফল দেখতে চাই।

কয়েকদিন আগে স্বপ্নে দেখলাম। M.Sc. পরীক্ষার রেজাল্ট হয়েছে। আমি থার্ড ক্লাস পেয়েছি।

খারাপ হলো কেন? চেয়ারম্যান স্যার বললেন, শেকসপিয়ার থেকে চারটা প্রশ্ন এসেছিল। তুমি সবকটা ভুল আনসার করেছি।

আমি বললাম, স্যার, আমি তো ফিজিক্সের ছাত্র।

চেয়ারম্যান স্যার বললেন, তুমি ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্ৰ। তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, যাও পাগলাগারদে ভর্তি হয়ে যাও।

স্যারের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে স্বপ্ন বদলে গেল। আমি দেখলাম, আমি একটা পাগলাগারদে বসে আছি। আমার সঙ্গে আরও কয়েকজন পাগল আছে। এবং এদের সঙ্গে আমার অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। আমি এই পাগলদের একজনকে ভুলিয়ে ভালিয়ে চরে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছি। ভয়ঙ্করটাইপ একজন মোটামুটি রাজি হয়েছে।

মা, ঘুম পাচ্ছে। আবার ক্ষিধেও লেগেছে। আমি এখন খিচুড়ি রান্না করব। কারণ মর্জিনা তার বাবাকে নিয়ে ব্যস্ত। তার বাবার শরীর খুবই খারাপ করেছে। যেভাবে নিঃশ্বাস নিচ্ছে আজ রাতেই মারা যায় কি না কে জানে।

ইতি
তোমার শুভ্র

পুনশ্চ-১ : মর্জিনার কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। চিৎকার করে কাঁদছে। মনে হয় তার বাবা মারা গেছেন; আমি খোঁজ নিয়ে আসছি।

পুনশ্চ-২ : না, এখনো বেঁচে আছেন। মাঝখানে অজ্ঞানের মতো হয়ে গিয়েছিলেন বলে ভয় পেয়ে মর্জিনা কাঁদছিল।

চিঠি শেষ করে শুভ্র খিচুড়ি বসাল। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। হালকা বাতাস দিচ্ছে। বাতাস আরেকটু বাড়লে উঠানের চুলা ঘরে চলে যেতে হবে।

মর্জিনা এসে পাশে বসল। শুভ্র বলল, তোমার বাবার অবস্থা কী?

মর্জিনা হাই তুলতে তুলতে বলল, বাঁচব না।

শুভ্র বলল, সামান্য জ্বরে মানুষ মারা যায়?

মর্জিনা বলল, জ্বরে কেউ মরে না, মৃত্যুরোগে মরণ হয়। ঘরের ভিতরে আজরাইল ঢুইক্যা পড়ছে।

শুভ্র বলল, কী বলে এইসব?

হামাগুড়ি দিয়া ঢুকছে। পরিষ্কার দেখছি। বাপজানের দিকে চাইয়া হাসছে। তারপরে চৌকির নিচে চইলা গেছে। এখন সে অপেক্ষায় আছে।

শুভ্র বলল, তোমার মাথা সামান্য খারাপ আছে মর্জিনা।

মর্জিনা বলল, আপনের সঙ্গে যে ভাইবোন পাতাইছি, বাপজানের মৃত্যুর পর সব শেষ। তখন আপনে আমার আর ভাই না।

আমি কে?

আপনি পুরুষমানুষ। আর কিছু না।

এর মানে কী?

এর মানে আপনে জানলে জানেন, না জানলে নাই। খিচুড়ি নামান, খিদা লাগছে।

মাত্ৰ বসিয়েছি, এখনো চাল ফুটে নাই।

ভাইজান, একটা গল্প করেন। গল্প শুনি।

কী গল্প শুনতে চাও?

পীরিতের গল্প। ভাব-ভালোবাসার গল্প।

ভাব-ভালোবাসার গল্প তো সেইভাবে আমি জানি না।

আপনে কোনোদিন ভাব-ভালোবাসা করেন নাই?

না।

মর্জিনা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, যে-কোনো একটা গল্প বলেন।

ভারচুয়াল রিয়েলিটির গল্প শুনবে?

সেইটা আবার কী?

শুভ্র বলল, বিষয়টা যথেষ্টই জটিল, আমি চেষ্টা করব সহজভাবে বোঝাতে। আমার ধারণা তুমি মন দিয়ে শুনলেই বুঝবে। কারণ তুমি অতি বুদ্ধিমতী একজন মেয়ে।

 

 

শুভ্র গল্প শুরু করেছে। মর্জিনা মন দিয়েই শুনছে, তবে তার দৃষ্টি শুভ্রর দিকে না। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। বিজলি চমকাচ্ছে, সে তাই দেখছে। বিদ্যুৎচমকের সময় আকাশে নানান নকশা তৈরি হয়। এইসব নকশায় অনেক ইশারা থাকে। ইশারায় আল্লাহপাক অনেক কিছু বলেন। আক্কেলমন্দ মানুষরা সেটা ধরতে পারে।

শুভ্র বলছে, প্রথমেই একটা বিষয় বুঝতে হবে–তা হলো বাস্তবতা, ইংরেজিতে যাকে বলে Reality। আমি উঠানে বসে খিচুড়ি রান্না করছি। তুমি সামনে বসে আছ। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। তোমার এবং আমার কাছে এটা রিয়েলিটি। তুমি যদি আগুনে হাত দাও, হাত পুড়ে যাবে। এটাও রিয়েলিটির অংশ। আবার তুমি যখন স্বপ্ন দেখ, সেটাও রিয়েলিটি। স্বপ্নে আগুনে হাত দিলে ব্যথার অনুভূতি হবে।

এখন কথা হচ্ছে, দুটি রিয়েলিটির কোনটি সত্য? না-কি এই দুই রিয়েলিটির বাইরে কিছু আছে? আমরা বড় কোনো রিয়েলিটির অংশ? এমন কি হতে পারে যে, আমরা কম্পিউটার প্রোগ্রাম ছাড়া কিছুই না? একজন মাস্টার প্রোগ্রামার আমাদের তৈরি করেছেন। আমাদের জন্ম-মৃত্যু, সুখ-দুঃখ দিচ্ছেন। আমরা বিষয়টি বাস্তব ভেবে আনন্দ পাচ্ছি। আসলে পুরোটাই একটা কম্পিউটার প্রোগ্রাম। প্রোগ্রামার আমাদের জন্যে ভারচুয়াল রিয়েলিটি তৈরি করেছেন।

মর্জিনা বলল, বকবকানি বন্ধ করেন তো ভাইজান। ভাত সিদ্ধ হইছে কি না দেখেন। হওয়ার কথা।

মর্জিনা উঠে গেল। দুটা প্লেট নিয়ে এল। ঘিয়ের কৌটা আনল। চায়ের চামচে দুচামচ ঘি খিচুড়িতে ছেড়ে দিয়ে প্লেট ধুতে বসল।

তারা খাওয়া শুরু করামাত্র বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়া শুরু হলো। মর্জিনা বলল, যেখানে বইসা আছেন বইসা থাকেন। খাওয়ার মাঝখানে জায়গা বদল করতে নাই। জায়গা বদল করলে রিজিক কমে।

বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে খাব?

হুঁ।

তোমার সব অদ্ভুত অদ্ভুত কথা।

মর্জিনা বলল, আপনার নিজের কথাও অদ্ভুত। অদ্ভুতে অদ্ভুতে কাটাকাটি।

ভালো বৃষ্টি শুরু হয়েছে। থালার ওপর বৃষ্টির পানি পড়ছে। মর্জিনা নির্বিকার। সে মাঝে মাঝে আকাশের দিকে তাকিয়ে হা করে বৃষ্টির পানিও খাচ্ছে। শুভ্র খাওয়া বন্ধ করে মর্জিনার কাণ্ড দেখছে।

ঘরের ভেতর থেকে ইয়াকুবের গলা শোনা গেল। ভীত গলা।

ও মার্জিনা! মজিনা কই? মর্জিনা!

মর্জিনা বলল, আমি উঠানে ভাত খাই।

ইয়াকুব বলল, তুফানে তো বাড়িঘর উড়ায় নিয়া যাইতেছে।

মর্জিনা বলল, তুফানের বংশও নাই। বৃষ্টি পড়তাছে। চুপ কইরা শুইয়া থাকেন, আসতেছি।

এক্ষণ অয়।

খাওয়া শেষ কইরা আসব।

বাড়িঘর সব তো উড়ায় নিয়া যাইতেছে। শেষে ঘরচাপা পইড়া মরব। তাড়াতাড়ি আয়, চৌকির নিচে বইসা থাকি।

মর্জিনা বলল, আপনের ইচ্ছা করলে আপনে চৌকির নিচে বসেন।

মর্জিনার কথা শেষ হবার আগেই খুব কাছে কোথাও বজ্ৰপাত হলো। কঠিন নীল আলোয় মর্জিনার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। মর্জিনা বলল, কী ভয়ঙ্কর!

শুভ্র বলল, বিজলির এক ঝলকানিতে কী পরিমাণ বিদ্যুৎ থাকে তুমি জানতে চাও?

মর্জিনা বলল, না।

সে খাওয়া শেষ করে ঘরে ঢুকে দেখে, ইয়াকুব চৌকির নিচে। তার বসার ভঙ্গি হিজ মাস্টার্স ভয়েসের কুকুরের মতো। শুধু মুখ হা হয়ে আছে। তার শরীরে প্ৰাণ নেই।

মর্জিনা বলল, বাবা, চৌকির নিচ, থাইকা বাইর হন।

কোনো উত্তর এল না। মৃত মানুষরা জীবিতদের সঙ্গে যোগাযোগ করে না। তাদের আলাদা সমাজ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *