পদার্থবিজ্ঞান
17. কোয়ান্টাম মেকানিক্স
একটা কাল্পনিক পরীক্ষা করা যাক। ধরা যাক আমি একটা ঘরে বসে আছি এবং এই ঘরের আলো আস্তে-আস্তে কমিয়ে আনা হচ্ছে তাহলে শেষ পর্যন্ত কী হবে? উত্তরটি খুব সহজ, আমাদের চোখ কতটুকু আলো দেখতে পারে তার একটা হিসেব আছে, যখন ঘরের আলো তার থেকে কমে আসবে তখন আমি আর কিছু দেখতে পারব না। মনে হবে ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে বসে আছি। আমাদের চোখের সংবেদী ক্ষমতা একটুর জন্যে পৃথিবীর সবচেয়ে রহস্যময় একটি বিষয় দেখার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছে! যদি আমাদের চোখের সংবেদী ক্ষমতা আর মাত্র দশ গুণ বেশি হতো তাহলে আলো কমিয়ে আনা হলে আমরা একটা বিস্ময়কর ব্যাপার দেখতাম। আলো যখন খুব কমে আসতো তখন আমরা আলোর একধরনের ঝলকানি দেখতে পেতাম! আলো যখন বেশি থাকে তখন সেই ঝলকানিগুলো আলাদা করে দেখা যায় না, যখন কমে আসে তখন দেখা সম্ভব হয়। বোঝানোর জন্যে এর সবচেয়ে সহজ উদাহরণ হচ্ছে পানির ধারা। পানির ট্যাপ ভোলা হলে ঝরঝর করে পানি বের ততে থাকে, এখন যদি ট্যাপটা বন্ধ করে পানির ধারা কমিয়ে আনতে থাকি তাহলে হঠাৎ করে আমরা ধীরে ধীরে দেখব পানির ধারা কমে এসে ফোঁটা ফোঁটা করে পড়তে শুরু করেছে। প্রথমে ফোঁটাগুলো পড়বে ঘনঘন, যদি ট্যাপ আরও বন্ধ করে দিই তাহলে ফোঁটাগুলো পড়বে আরও ধীরে ধীরে। আরও বন্ধ করে দেয়া হলে আরও ধীরে। আলোর বেলাতেও সেই একই ব্যাপার যখন আলো কমে আসবে তখন আমরা দেখব কমসংখ্যক আলোর ঝলকানি, যখন আরও কমিয়ে দেয়া হবে তখন সেটি হবে আরও কমসংখ্যক আলোর ঝলকানি। একটা জিনিস এখানে খেয়াল করতে হবে পানির ফোঁটার কিন্তু একটা নির্দিষ্ট আকার আছে, বড় পানির ফোঁটা বা ছোট পানির ফোঁটা হয় না। পানির ট্যাপ যখন বন্ধ করে দেয়া হতে থাকে তখন কিন্তু পানির ফোঁটার আকার কমে যায় না, শুধু মাত্র কমসংখ্যক ফোঁটা পড়তে থাকে। আলোর বেলাতেও তাই, আলোর ঝলকানি একটা নির্দিষ্ট উজ্জ্বলতার। ঘরের আলো যখন কমিয়ে দেয়া হয় তখন ঝলকানির উজ্জ্বলতা কমে যায় না, একই ঔজ্জ্বল্যের কমসংখ্যক ঝলকানি দেখা যায়।
আমি জানি কেউ কেউ নিশ্চয়ই আমার এই কথায় সন্দেহ পোষণ করছে, আমাদের চোখ যখন এই বিচিত্র বিষয়টি দেখতে পারবে না তাহলে শুধু শুধু এই বিয়ষটা উত্থাপন করে মানুষকে বিভ্রান্ত করার কী যুক্তি রয়েছে? সন্দেহপ্রবণ পাঠকদের আশ্বস্ত করার জন্যে বলা যায় যে, খুব কম আলো দেখার জন্যে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি আছে তাদের একটার নাম হচ্ছে ফটো মালটিপ্লায়ার টিউব। মানুষের চোখ যখন কিছুই দেখতে পায় না এই ফটো মাল্টিপ্লায়ার টিউব সেখানেও দেখতে পায়। এই ফটো মাল্টিপ্লায়ার টিউব দিয়ে বিজ্ঞানীরা সন্দেহাতীতভাবে দেখেছেন যে কম আলো আসলে কমসংখ্যক আলোর ঝলকানি। পানির যেরকম ফোঁটা আছে আলোরও সেরকম ফোঁটা আছে, সেই ফোঁটাকে অনেকটা কাকতালীয়ভাবে বলা হয় ফোটন! যখন তীব্র আলো থাকে তখন আলোর এই কণা বা ফোটনকে আলাদাভাবে বোঝা যায় না, কিন্তু যখন আলো খুব কমে আসে তখন সেটাকে অস্বীকার করার কোনো উপায়ই নেই।
এবারে আমি সব পাঠকদের বিপদের মাঝে ফেলে দিতে পারি। প্রথম পরীক্ষাটা আমাদের কল্পনা করে নিতে হয়েছে, চোখ আরেকটু বেশি সংবেদী হলে আমাদের কল্পনা। করতে হতো না আমরা সত্যি সত্যি দেখতে পেতাম। দ্বিতীয় পরীক্ষাটি আমরা সহজেই করতে পারি, আসলে সবাই কখনো না কখনো করেও ফেলেছি। সেটা হচ্ছে জানালার কাচ দিয়ে জোছনা দেখা। আমরা সবাই নিশ্চয়ই কখনো না কখনো রাত্রিবেলা ঘুমানোর সময় ঘরের আলো নিভিয়ে আবিষ্কার করেছি বাইরে কী সুন্দর জোছনা! শুধু যে জোছনা তাই নয়, জানালার কাচ দিয়ে সেই জোছনা ঘরের ভেতরে এসে আমাদের মুগ্ধ করেছে। যতক্ষণ ঘরে আলো জ্বলছে ততক্ষণ কিন্তু আমরা বাইরের জোছনাটুকু দেখতে পাই না। তার কারণটা খুব সহজ, জানালার কাঁচকে আমরা স্বচ্ছ বলে ভাবি কিন্তু সেটা পুরাপুরি স্বচ্ছ নয়, তার পৃষ্ঠ থেকে অল্প একটু (নিখুঁত হিসেবে চার শতাংশ) আলো প্রতিফলিত হয়। তাই যখন ঘরের ভেতরে তীব্র আলো জ্বলছে তার শতকরা চার শতাংশ জানালার কাচ থেকে প্রতিফলিত হয়ে ভেতরে আসছে। এই চার শতাংশ আলো জোছনার কোমল আলো থেকে তীব্র, তাই আমরা সেটাকেই দেখি, জোছনার আলোকে আর দেখি না!
এবারে আবার বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় আসি–আমরা জোছনা দেখতে গিয়েই আবিষ্কার করেছি আলোর চার শতাংশ প্রতিফলিত হয়। এবারে সেই একই পরীক্ষাটি করতে চাই, শুধু পরীক্ষাটি করা হবে কম আলোতে। অর্থাৎ, যখন আলো আসলে রশ্মি নয় যখন আলো হচ্ছে ফোঁটা বা কণা, বৈজ্ঞানিক ভাষার আলোর ফোটন! তখন আমরা কী দেখব?
বৈজ্ঞানিকরা অসংখ্যবার এই পরীক্ষা করেছেন এবং তারা দেখেছেন আলো যখন কমে আসে তখনও চার শতাংশ প্রতিফলিত হয়। অর্থাৎ, যদি একশটা ফোটন কাচের পৃষ্ঠকে আঘাত করে তখন ছিয়ানব্বইটা বের হয়ে যায় কিন্তু চারটা প্রতিফলিত হয়। এখন লক্ষ টাকার প্রশ্ন : কোন চারটা প্রতিফলিত হবে? তার উত্তর হচ্ছে : কেউ জানে না! একশটা ফোটন কাচের পৃষ্টকে আঘাত করলে মোটামুটিভাবে চারটা প্রতিফলিত হবে সেটা বিজ্ঞানীরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারেন কিন্তু কোন চারটা সেটা তারা কখনোই আগে থেকে বলতে পারেন না। কেউ যেন মনে না করে ভালো যন্ত্রপাতি হলে এটা বলে দেয়া যাবে, এর সাথে যন্ত্রপাতির কোনো সম্পর্ক নেই, বিজ্ঞানীরা কখনোই এটা বলতে পারবে না। প্রকৃতি সেই তথ্যটা আমাদের থেকে আড়াল করে রেখেছে। বিজ্ঞানের সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা থেকে হঠাৎ আমাদের সরে আসতে হচ্ছে সম্ভাবনার জগতে! একটা-কিছু হবে না বলে আমাদের বলতে হচ্ছে “হতে পারে” এবং “হবে” থেকে “হতে পারে এই বিষয়টিই হচ্ছে কোয়ান্টাম মেকানিক্স।
আমাদের জীবনে সম্ভাবনার বিষয়টা আমরা এর মাঝে অনেকবার দেখেছি। লুডু খেলার। সময় যখন ছক্কাটি ফেলি আমরা আগে থেকে কখনই সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারি না কত বের হতে। কিন্তু সব সময়েই মোটামুটি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি ছয়বারের মাঝে একবার ছয় পড়তে পারে। ছয় পড়ার প্রোবাবিলিটি বা সম্ভাবনা হচ্ছে ছয়ভাগের এক ভাগ। নিশ্চিত করে কিছু একটা বলতে না পারা, শুধুমাত্র একটা বিষয়ের সম্ভাবনাটুকু জানতে পারাকে অনেকেই বিজ্ঞানের একটা বড় দুর্বলতা বলে মনে করতে পারেন, কিন্তু সেটা মোটেও তা নয়। প্রকৃতি তার রহস্যের পুরোটুকু বিজ্ঞানীদের কাছে প্রকাশ করতে রাজি নয়। বিজ্ঞানীরা সেটি বুঝে ওঠার পর সেটাকে গ্রহণ করেই এগিয়ে গেছেন। কোয়ান্টাম মেকানিক্স ব্যবহার করে তারা কিন্তু প্রকৃতির রহস্য উদঘাটন করেই গেছেন, নিউক্লিয়ার বোমা থেকে সিডি প্লেয়ার কোথাও কোন সমস্যা হয় নি!
একজন সাধারণ মানুষ যেটুকু গণিত জানে সেটা দিয়েই কিন্তু কোয়ান্টাম মেকানিক্সের একেবারে ভেতরে যাওয়া সম্ভব, কেমন করে তার নিখুঁত হিসেব নিকেশ করা হয় সেটাও দেখানো সম্ভব। কিন্তু এই ছোট লেখায় তার ভেতরে না গিয়ে আমরা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের একটা চমকপ্রদ তথ্য দিয়ে শেষ করে দিই। বিষয়টি এত চমকপ্রদ যে, সেটি এর মাঝে সাধারণ মানুষের কথাবার্তায় চলে এসেছে এবং সেটি হচ্ছে অনিশ্চয়তার সূত্র বা আনসার্টেইনিটি প্রিন্সিপাল।
‘অনিশ্চয়তার সূত্র’ নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে কোনো কিছু যে নিশ্চিতভাবে জানা যাবে না এটা তার একটা ইঙ্গিত দিচ্ছে। অনেকভাবেই ‘অনিশ্চয়তার সূত্র’ ব্যাখ্যা করা যায় তবে বুঝতে সোজা হয় যদি আমরা সেটা অবস্থান আর ভরবেগ দিয়ে ব্যাখ্যা করি। খুব স্কুলভাবে বলা যায় আমরা কোনো বস্তুর অবস্থান আর গতিবেগ কখনোই পুরোপুরি জানতে পারব না। অন্যভাবে বলা যায় যদি অবস্থান নিশ্চিতভাবে জেনে ফেলি তাহলে গতিবেগ কত সেটা সম্পর্কে কোনো ধারণাই থাকবে না। আবার এর উল্টোটাও সত্যি অর্থাৎ গতিবেগটা যদি নিশ্চিতভাবে জেনে যাই তাহলে এর অবস্থান সম্পর্কে কিছুই জানতে পারব না। আমাদের খুব সৌভাগ্য যে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অনিশ্চয়তার সূত্র কার্যকরী নয়, তাহলে যে কী ভয়ানক বিপদে পড়তাম সেটি আর বলার মতো নয়।
যেমন ধরা যাক ট্রেনে যাবার ব্যাপারটি। স্টেশনে ট্রেন এসে থেমেছে, এখন আমরা ট্রেনে উঠব। ট্রেনটা যেহেতু থেমেছে তার অর্থ গতিবেগ হচ্ছে শূন্য অর্থাৎ গতিবেগটা আমরা নিশ্চিতভাবে জেনে গেছি। ট্রেনের জন্যে কোয়ান্টাম মেকানিক্স সত্যি হলে বলা যেত এখন আমরা যেহেতু গতিবেগটা নিশ্চিতভাবে জেনে গেছি তাই তার অবস্থান সম্পর্কে কিছুই জানব না! ট্রেনটি কী ঢাকা না কুমিল্লা না চট্টগ্রাম কোথায় আছে জানার কোনো উপায় নেই। এবারে উল্টোটাও হতে পারে। ধরা যাক আমরা নিশ্চিতভাবে জানি ট্রেনটা আখাউড়া রেলস্টেশনে, এখন কি আমরা ট্রেনে উঠতে পারব? মোটেও নয়, যেহেতু অবস্থানটা জেনে গেছি তাই এর গতিবেগ সম্পর্কে কিছুই জানব না। হয়তো ট্রেনটা ভয়ংকর গতিতে ছুটে যাচ্ছে সেটাতে উঠতে গিয়ে একেবারে ছাতু হয়ে যাব!
আমি নিশ্চিত অনেকেই আমাকে অবিশ্বাস করছেন–ট্রেনের ব্যাপার হলে অবিশ্বাস করতেই পারে। কিন্তু ক্ষুদ্র একটা পরমাণুর ব্যাপার হলে এর মাঝে অবিশ্বাস করার কিছু নেই, এটা সব সময়েই ঘটছে। কেন ঘটছে সেটা বোঝাও খুব সহজ, একটা সহজ উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যায়। ধরা যাক একটা ইলেকট্রন যাচ্ছে–ইলেকট্রন খুব ছোট, ট্রেনের মতো বিশাল নয় তাই তার বেলায় কোয়ান্টাম মেকানিক্স শতভাগ সত্যি। কাজেই নিশ্চয়ই অনিশ্চয়তার সূত্রটিও সত্যি হবে অর্থাৎ, তার অবস্থান সম্পর্কে জানলে গতিবেগ (আসলে ভরবেগ) সম্পর্কে অনিশ্চিত হয়ে যাব। কেউ মনে করতে পারে কেন এটি হবে? খুব ছোট একটা মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখে তো অবস্থান সম্পর্কে জানাই যায়। তাতে তার বেগ অনিশ্চিত হবে কেন? আসলে “দেখা” মানে হচ্ছে প্রতিফলিত আলো থেকে তথ্য বের করা কাজেই কোনো কিছুকে দেখতে হলে তার উপর আলো পড়তে হবে, সেই আলো মাইক্রোস্কোপে ফিরে আসতে হবে। মজার ব্যাপারা হচ্ছে ইলেকট্রন এত ছোট যে তাকে দেখার জন্যে আলোর ফোটন যখন তাকে আঘাত করে সেই আঘাতেই তার গতিবেগ ওলট পালট হয়ে যায়। (17.3 নং ছবি) কাজেই ইলেকট্রন কোথায় আছে সেই তথ্যটা আমরা জানতে পারলাম সত্যি কিন্তু সেটা জানার কারণে তার গতিবেগ পুরোটাই ওলট-পালট হয়ে গেল। আমরা যে জগৎকে সব সময় দেখি সেটি ক্ষুদ্র জগৎ নয় তাই অনিশ্চয়তার সূত্র নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তা করতে হয় না। কিন্তু পুরমাণু বা ফোটনের যে নিজস্ব ক্ষুদ্র জগৎ আছে সেখানে এটা কিন্তু একেবারেই নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার।
পৃথিবীর সব বিজ্ঞানীই তে কোয়ান্টাম মেকানিক্স নিয়ে খুব স্বস্তি বোধ করেন তা নয়–মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইন কখনোই কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে সুনজরে দেখেন নি (যদিও তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ফটো ইলেকট্রিক এফেক্ট ব্যাখ্যা করে, যেটি ছিল আলোর ফোটন হিসেবে পরিচিতির ব্যাখ্যা!)। কিন্তু বিজ্ঞানীরা অসংখ্যবার অসংখ্যভাবে পরীক্ষা করে কখনই কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে তার জায়গা থেকে বিচ্যুত করতে পারেন নি!
কে জানে হয়তো ভবিষ্যতে প্রকৃতির নূতন কোনো গোপন রহস্য আমাদের চোখে নূতনভাবে উন্মোচিত হবে। যেখানে থেকে পুরো বিষয়টি অন্যভাবে দেখা হবে! যতদিন সেটি হচ্ছে ততদিন কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে নিয়েই আমাদের বেঁচে থাকবে হবে।
.
18. থিওরি অফ রিলেটিভিটি
1905 সালে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন দুটি সূত্র দিয়েছিলেন। সূত্র দুটি এত সহজ যে একজন শিশুও সেটা বুঝতে পারবে। সূত্রদুটি এরকম : (এক) পদার্থবিজ্ঞানের সব সূত্র সকল ইনারশিয়াল রেফারেন্স ফ্রেমে (inertial reference Frame) একই থাকবে। (দুই) আলোর গতি সব ইনারশিয়াল রেফারেন্স ফ্রেমে সমান।
সূত্র দুটি লেখার জন্যে “ইনারশিয়াল রেফারেন্স ফ্রেম” নামে একটা ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, এটাকে বাংলায় অনুবাদ করা হলে শব্দটি এত কটমটে হয়ে যাবে যে এটাকে ইংরেজি রেখেই বরং বিষয়টি বুঝিয়ে দেয়া ভালো। ধরা যাক আমি ল্যাবরেটরিতে বসে পদার্থবিজ্ঞানের কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি, তাহলে আমি বলতে পারি আমার ল্যাবরেটরিটি একটি ইনারশিয়াল রেফারেন্স ফ্রেম। এবারে ধরা যাক আমার হঠাৎ ইচ্ছে হলো আমি ট্রেনে বসে পদার্থবিজ্ঞানের পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলো করব যদি ট্রেনটা সমবেগে যায় তাহলে এই ট্রেনটাও একটা ইনারশিয়াল রেফারেন্স ফ্রেম। এখানে মনে রাখতে হবে ল্যাবরেটরি ঘরে বসে যে জিনিসটাকে স্থির মনে হয়েছিল ট্রেনে বসে সেটাকে মনে হবে উল্টোদিকে ছুটছে। ল্যাবরেটরি এবং ট্রেন এই দুটি ইনারশিয়াল রেফারেন্স ফ্রেমে একটা বস্তুকে কিন্তু একভাবে দেখা গেল না তাহলে আইনস্টাইনের প্রথম সূত্রটি সত্যি হলো কেমন করে? সূত্রটি একটু ভালো করে দেখতে হবে। আইনস্টাইন বলেন নি সবকিছু এক রকম দেখাবে, তিনি বলেছেন পদার্থবিজ্ঞানের সব সূত্র এক থাকবে। কাজেই আমি যদি ল্যাবরেটরিতে দেখি বল প্রয়োগ করলে ত্বরণ হয়, কিংবা তাপ প্রয়োগ করলে গ্যাসের চাপ বেড়ে যায় তাহলে চলন্ত ট্রেন থেকেও সেটা দেখব। পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলো এক থাকবে, পর্যবেক্ষণগুলো ভিন্ন হতে পারে।
আইনস্টাইনের দ্বিতীয় সূত্রটি বরং একটু বিচিত্র, সেটি বলছে ইনারশিয়াল রেফারেন্স ফ্রেমে আলোর বেগ সমান। আমরা দৈনন্দিন জীবনে বেগ নিয়ে যেসব ব্যাপার দেখে অভ্যস্ত আইনস্টাইনের এই সূত্রটির তার সাথে মিল নেই। আমরা যখন কোথাও যাবার জন্যে ট্রেনে উঠি তখন অনেক সময়েই যারা বিদায় দিতে আসে তারা প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে ট্রেনের জানালা দিয়ে গল্প করে। ট্রেন যখন চলতে শুরু করে তখন শেষ মুহূর্তে দু একটি কথা বলতে হলে প্লাটফর্মের মানুষটিকে ট্রেনের সাথে সাথে হাঁটতে শুরু করতে হয়। ট্রেনের জানালা দিয়ে তাকালে আমাদের তখন মনে হবে ট্রেনের তুলনার মানুষটিও বুঝি দাঁড়িয়ে আছে! ট্রেন থেমে মাথা বের করে অনেক সময়েই আমরা পাশাপাশি রাস্তার একটা গাড়িকে যেতে দেখেছি, গাড়িটা আর ট্রেনটা যদি একই দিকে যায় তাহলে মনে হয় গাড়িটা ধীরে ধীরে যাচ্ছে! এটি হচ্ছে আমাদের পরিচিত আপেক্ষিক গতি একটির তুলনায় আরেকটার গতি। এটা বের কারাও সহজ একটা থেকে অন্যটা বিয়োগ দিলেই হয়। আইনস্টাইন তার সূত্রে বলেছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা, তিনি বলেছেন আলোর বেলায় আমাদের পরিচিত আপেক্ষিক গতি কাজ করে না। আমি যদি কোথাও দাঁড়িয়ে থেকে দেখি আলো ছুটছে সেকেন্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল বেগে তাহলে একটা চলন্ত ট্রেন থেকেও তাই দেখব। শুধু যে সমবেগে চলতে থাকা একটা চলন্ত ট্রেন থেকে সেটা দেখব তা নয়, যদি আলোর পাশাপাশি সেকেন্ডে এক লক্ষ মাইল বেগে ছুটে যাওয়া একটা রকেট থেকে দেখি সেখানেও তাই দেখব। সেই আলোর বেগ আমাদের প্রচলিত নিয়মে (1,86,000-1,00,000=86,000) ছিয়াশি হাজার মাইল হবে হবে না, এবারেও হবে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল। ধরা যাক আমরা প্রায় আলোর বেগের কাছাকাছি বেগে একটা মহাকাশযানে যাচ্ছি, যার গতিবেগ একলক্ষ পঁচাশি হাজার নয়শত নিরানব্বই মাইল, অর্থাৎ আলো থেকে তার গতিবেগ মাত্র এক মাইল কম। তাহলেও আমাদের মহাকাশযান থেকে মনে হবে আলোটি তার নিজস্ব গতিবেগ সেকেন্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল বেগে ছুটছে! (খুব স্বাভাবিক প্রশ্ন, আমাদের মহাকাশযানটি যদি আলোর বেগে ছুটে তাহলে কী হবে? আইনস্টাইনের এই সূত্র দুটি থেকেই বের করে ফেলা যায় কোন বস্তুর গতিবেগই ঠিক আলোর গতিবেগের সমান হতে পারবে না। কখনো না!)
একশ বছর আগে আইনস্টাইনের দেয়া এই সূত্র দুটি হচ্ছে আজকে সবার পরিচিত আপেক্ষিক সূত্র বা থিওরি অফ রিলেটিভিটি। এই সূত্র দুটি আমাদের পরিচিত পদার্থবিজ্ঞানের জগতে যে আলোড়নের সৃষ্টি করেছিল একশ বছর পরেও সেই আলোড়ন শেষ হয় নি। আইনস্টাইনের সেই যুগান্তকারী আপেক্ষিক সূত্রের একশ বছর পূর্তি উপলক্ষে 2005 সালে সারা পৃথিবীতে খুব হইচই করে সেটা পালন করা হয়েছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো এত বড় যুগান্তকারী একটি সূত্র, কিন্তু সেটি বুঝতে যে গণিতের প্রয়োজন হয় সেটি ছাত্রছাত্রীরা স্কুলেই শিখে ফেলে, তার জন্যে আলাদা কিছু শিখতে হয় না!
আমরা আপেক্ষিক সূত্রটি ব্যাখ্যা না করে তার কারণে কী কী দেখা যায় সেটা নিয়ে আলোচনা করি। ধরা যাক আমি দাঁড়িয়ে আছি এবং আমার মাথার উপর দিয়ে একটা রকেট উড়ে গেল। রকেটের গতিবেগ যদি খুব বেশি না হয় তাহলে আমি রকেটটার মাঝে বিচিত্র কিছু দেখব না। কিন্তু রকেটটা যদি আলোর বেগের কাছাকাছি একটা গতি বেগে পৌঁছাতে পারে তাহলে আমি সবিস্ময়ে আবিষ্কার করব রকেটটা যেন সংকুচিত হয়ে গেছে (18.3 নং ছবি)! এখানে আরও মজার একটি ব্যাপার ঘটে। ধরা যাক রকেটের ভেতরে একজন মহাকাশচারী বসে আছে এবং সে আমাকে তাকিয়ে দেখছে, সে যেহেতু রকেটে বসে আছে তার কাছে মনে হবে রকেটটাই স্থির এবং রকেটের তুলনায় আমিই যেন বিশাল গতিবেগে ছুটছি। তাই সে দেখবে রকেট নয়, আমি সংকুচিত হয়ে গেছি! কেউ যেন মনে না করে এগুলো গাল-গল্প, বিজ্ঞানীরা ল্যাবরেটরিতে রীতিমতো পরীক্ষা করে এই বিষয়গুলো সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছেন।
এটি তো হলো চলন্ত বস্তুর দৈর্ঘ্যের সংকোচন, সময় নিয়ে যেটা হয় সেটা আরও অনেক বেশি চমকপ্রদ। আগে আমাদের ধারণা ছিল সময় সব জায়গায় সমান। আইনস্টাইনের আপেক্ষিক সূত্রটি একটু বিশ্লেষণ করলে অত্যন্ত চমকপ্রদ একটা সত্য বের হয়ে আসে, সেটা হচ্ছে চলন্ত বস্তুর সময়ের প্রসারণ (Time dilation)। বিষয়টা একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝানো সবচেয়ে সহজ।
ক্যালিফোরনিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে (caltech) থাকাকালীন সময়ে আমি টাইম প্রজেকশান চেম্বার নামে একটি ডিটেক্টর তৈরি করেছিলাম, সেটা ঠিকভাবে কাজ করছে কি না দেখার জন্যে আমি যে জিনিসটা ব্যবহার করতাম তার নাম হচ্ছে মিউওন (Muon)। এমনিতে মিউওনকে পাওয়া যায় না কারণ তার আয়ু হচ্ছে মাত্র দুই মাইক্রোসেকেণ্ড (দুই সেকেন্ডের দশ লক্ষ ভাগের এক ভাগ) কোথাও এটা তৈরি হওয়ার দুই সেকেন্ডের মাঝে এটা শেষ হয়ে যায়। তবে পৃথিবীতে তার অভাব নেই কারণ প্রচণ্ড শক্তিশালী মহাজাগতিক রশ্মি প্রতিনিয়ত পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলকে আঘাত করছে এবং সেই আঘাতে মিউওনের জন্ম হচ্ছে। তবে সমস্যা হচ্ছে এই মিউওনগুলোর জনা হয় পথিবী থেকে একশ কিলোমিটার উপরে বায়ুমণ্ডলের প্রান্ত সীমানায়। তারা যে গতিবেগে আসে (আলোর গতিবেগের বেশ কাছাকাছি) তাতে পৃথিবী পর্যন্ত পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় তিনশত মাইক্রোসেকেন্ড। যে জিনিসটার আয়ু মাত্র দুই মাইক্রোসেকেন্ড সেটা কেমন করে তিনশত মাইক্রোসেকেন্ড পর্যন্ত টিকে থাকে? বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের আপেক্ষিক সূত্রের আগে এই রহস্যের কোনো ব্যাখ্যা ছিল না। এখন আমরা কারণটি জানি। একটি মিউওন তার নিজস্ব ইনারশিয়াল রেফারেন্স ফ্রেমে কিন্তু তার আয়ু মাত্র দুই মাইক্রো সেকেন্ডই বেঁচে থাকে। কিন্তু আমাদের কাছে সেই সময়টা অনেক দীর্ঘ, তিনশ মাইক্রোসেকেন্ড। কাজেই ক্যালিফোরনিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির বেসমেন্টে বসানো আমার সেই ডিটেক্টারে আমি এক ধরনের মুগ্ধ বিস্ময়ে নিয়ে মিউওনগুলোকে দেখতাম। বায়ুমণ্ডলের একেবারে উপরে জন্ম নিয়ে, প্রচণ্ড শক্তিতে বায়ুমণ্ডল, বিল্ডিংয়ের ছাদ, ডিটেক্টরের ধাতব দেয়াল সবকিছু ভেদ করে চলে যেত। এই মিউওনগুলোকে আমি দেখতাম কারণ তাদের সময়টি প্রসারিত হয়ে গেছে!
আপেক্ষিক সূত্রের এই বিষয়টি আমাদের জন্যে অনেক রহস্যের জন্ম দিয়েছে। একজন মানুষ যদি কোনো মহাকাশযানে করে সূদুর মহাকাশে পাড়ি দেয়, তার গতিবেগে যদি আলোর কাছাকাছি হয় তাহলে সে হয়তো বছর দশেক পর ফিরে এসে আবিষ্কার করবে এই দশ বছরে পৃথিবীতে এক হাজার বৎসর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। তার পরিচিত পৃথিবীর কিছুই আর নেই!
বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর লেখকেরা বিজ্ঞানের কাল্পনিক গল্প লিখেন, কিন্তু সত্যিকারের কাহিনী যে কল্পনা থেকেও একশ গুণ বেশি চমকপ্রদ সেটা কী কখনো ভেবে দেখেছেন?
.
19. বিগ ব্যাং : একটি নাটকীয় বিষয়
যারা ট্রেন লাইনের পাশে দাঁড়িয়ে একটা চলন্ত ট্রেনকে হুইসেল দিতে দিতে আসতে শুনেছে তারা নিশ্চয়ই একটা ব্যাপার লক্ষ করেছে। ট্রেনটা যখন এগিয়ে আসতে থাকে তখন হুইসেলটা শোনায় একরকম (তীক্ষ) এবং যখন ছেড়ে চলে যেতে থাকে তখন শোনায় অন্যরকম (ভেঁতা)। তার কারণ হুইসেলের শব্দটা এক ধরনের তরঙ্গ, ট্রেন যখন সেই তরঙ্গটা ছাড়তে ছাড়তে এগিয়ে আসে তখন তরঙ্গ দৈর্ঘ্যটা একটু কমে আসে। তাই হুইসেলের শব্দটা শোনায় তীক্ষ্ম । আবার ট্রেনটা যখন তরঙ্গটা ছাড়তে ছাড়তে দূরে সরে যেতে থাকে তখন তরঙ্গ দৈর্ঘ্যটা একটু বেড়ে যায় তাই শব্দটা একটু ভোঁতা হয়ে আসে। তরঙ্গ যেখান থেকে আসছে তার গতির সাথে তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেড়ে যাওয়া এবং কমে যাওয়ার এই প্রক্রিয়াটার নাম হচ্ছে ডপলার এফক্ট (19.1 নং ছবি)।
শুধু যে শব্দের জন্যে ডপলার এফেক্ট হয় তা নয়, যে কোন তরঙ্গের জন্যে ডপলার এফেক্ট হতে পারে। প্রকৃতপক্ষে ডপলার এফেক্ট ব্যবহার করে খুব সহজে গতিবেগ বের করা যায়। যে সব দেশে গাড়ি খুব বেশি এবং বাড়াবাড়ি গতিতে গাড়ি চালানোর সমস্যা আছে সেখানে রাস্তার মোড়ে মোড়ে পুলিশ হাতে এক ধরনের রাডার যন্ত্র নিয়ে বসে থাকে এবং ডপলার এফেক্ট ব্যবহার করে গাড়ির গতিবেগ মাপতে থাকে। কোন গাড়ি নির্ধারিত গতিসীমার থেকে বেশি গেলেই রয়েছে বিশাল জরিমানা!
আলোর তরঙ্গের ডপলার এফেক্ট মাপার প্রক্রিয়া বের করার পর বিজ্ঞানীরা প্রথম যে বস্তুগুলোর গতি মাপার চেষ্টা করলেন সেগুলো হচ্ছে মহাজাগতিক নক্ষত্র গ্যালাক্সি। বহুদূরের যে নক্ষত্রটা আকাশে মিটমিট করে জ্বলছে সেটি কী এক জায়গাতেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নাকি কোনো দিকে ছুটে যাচ্ছে সেটা জানতে সবারই আগ্রহ। যে নক্ষত্রটার গতি মাপতে যাচ্ছি সেখান থেকে যে আলো বের হয়ে আসছে তার তরঙ্গ দৈর্ঘ্য যদি যা হওয়ার কথা তার থেকে লম্বা হয়ে যায় তার মানে নক্ষত্রটা দূরে সরে চলে যাচ্ছে। যদি তরঙ্গ দৈর্ঘ্য যা হওয়ার কথা তার থেকে কম হয় তাহলে বুঝতে হবে সেটা আমাদের দিকে ছুটে আসছে। গতিবেগের কারণে যখন তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বেড়ে যায় সেটাকে বলে ডপলারের রেড শিফট (কারণ দৃশ্যমান আলোর লাল রঙটার তরঙ্গ দৈর্ঘ্য সবচেয়ে বেশি)। আবার তরঙ্গ দৈর্ঘ্য যখন কমে যায় তখন সেটাকে বলে ব্লু শিফট (কারণ দৃশ্যমান আলোর কম তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আলোটি হচ্ছে নীল)।
খুব সঙ্গত কারণেই একটা প্রশ্ন উঠতে পারে একটা নক্ষত্রের আলোতে রেড শিফট হয়েছে না ব্লু শিফট হয়েছে সেটা বিজ্ঞানীরা বোঝেন কেমন করে? যে আলোটা আসছে তার প্রকৃত তরঙ্গ দৈর্ঘ্যই হয়তো সেটা! আসলে বিষয়টা খুব সহজ–বহুদূর গ্যালাক্সির কোনো নক্ষত্র বা তারাও আসলে তৈরি হয়েছে আমাদের পরিচিত পরমাণু দিয়ে। একটা পরমাণু সেটা পৃথিবীতেই থাকুক আর কোটি কোটি মাইল দূরেই থাকুক সেটা থেকে বিশেষ তরঙ্গ দৈর্ঘ্যে কিছু আলো বের হয়। তাই বিজ্ঞানীরা তার সঠিক তরঙ্গ দৈর্ঘ্য জানেন। তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের প্যাটার্ন দেখেই সেটা চিনে ফেলেন। যখন কোনো দূর নক্ষত্র থেকে আসার কারণে সেই তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের পরিবর্তন হয়ে যায় সেটা বোঝা খুব সহজ। কতটুকু রেড শিফট বা ব্লু শিফট হয়েছে সেখান থেকে শুধু যে নক্ষত্রটার গতি বেগ বের করা যায় তা নক্ষত্রটা কি আমাদের দিকে আসছে নাকি আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে সেটাও নিখুঁতভাবে বের করে ফেলা যায়।
বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল মহাকাশের বিভিন্ন নক্ষত্র বা গ্যালাক্সির গতিবেগ মেপে তারা দেখবেন কোনটা স্থির কোনটা গতিশীল। কোনটার গতি বেশি কোনটার গতি কম। কোনটা আমাদের দিকে ছুটে আসছে কোনটা আমাদের থেকে দূরে সরে চলে যাচ্ছে এক কথায় নক্ষত্র বা গ্যালাক্সির গতিবেগগুলোর কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডউইন হাবল ক্যালিফোরনিয়ার মাউন্ট উহলসনের একশ ইঞ্চি টেলিস্কোপ ব্যবহার করে মহাকাশের নানা নক্ষত্র, নানা গ্যালাক্সির ডপলার শিপট মেপে দুটো অত্যন্ত বিচিত্র সত্য আবিষ্কার করলেন। মহাজগতের সকল নক্ষত্র বা গ্যালক্সিই আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে (অর্থাৎ, রেড শিফট হচ্ছে ) এবং যে নক্ষত্র আমাদের থেকে যতদূরে সেই নক্ষত্রটি তত জোরে সরে যাচ্ছে। প্রথমে মনে হতে পারে আমাদের পৃথিবীটা তাহলে নিশ্চয়ই সমস্ত মহাজগতের কেন্দ্রস্থল, সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান কারণ এটাকে কেন্দ্রে রেখে সবকিছু দূরে সরে যাচ্ছে। আসলে ব্যাপারটি তা নয়, আমরা পৃথিবীতে বসে এই পরীক্ষাগুলো না করে যদি মহাজগতের অন্য কোনো গ্যালাক্সির অন্য কোনো গ্রহে বসে
এই পরীক্ষাগুলো করতাম তাহলেও হুবহু এই একটই জিনিস দেখতে পেতাম। ব্যাপারটা বোঝা খুব সহজ হয় একটি বেলুনকে দেখলে। বেলুনের উপর বেশ কয়েকটা বিন্দু এঁকে সেটাকে ফোলাতে থাকলে যে কোন বিন্দুরই মনে হবে অন্য বিন্দুগুলো তার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। বিজ্ঞানী হাবলের এই যুগান্তকারী আবিষ্কার থেকে পৃথিবীর মানুষ জানতে পারল যে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল কিছু একটির কাছ থেকে অন্য একটি দূরে সরে যাচ্ছে। বেলুনের উদাহরণটি পুরাপুরি সঠিক ছিল না। কারণ, বেলুনের মাঝে আমরা শুধু পৃষ্ঠদেশে কয়েকটা বিন্দু আকঁতে পেরেছি। ত্রিমাত্রিক কোনো কিছুকে যদি ফোলানো যেত তাহলে সেটা আরও
সঠিক উদাহরণ হতো তাহলে আমরা দেখতাম কোনো একটা বিন্দু থেকে অন্য সব বিন্দু দূরে সরে যাচ্ছে এবং এক বিন্দু থেকে অন্য বিন্দু যতদূরে সেটি তত দ্রুতগতিতে সরে যাচ্ছে, ঠিক হাবল যেটা দেখেছেন।
বিজ্ঞানীরা যখন বুঝতে পারলেন এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আসলে স্থির নয়–এটা প্রচণ্ড গতিতে দ্রুত সরে যাচ্ছে, অন্যভাবে বলা যায় বিশ্বব্রহ্মাণ্ডটাই যেন ফুলে ফেপে উঠছে তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে, “কেন?”
বিষয়টি দুভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হলো, প্রথম ব্যাখ্যাটি হচ্ছে স্থিত অবস্থা (Stealy state)। এই ব্যাখ্যার অর্থ হচ্ছে এ-রকম : যদিও দেখা যাচ্ছে যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড বৃদ্ধি পাচ্ছে অর্থাৎ, নক্ষত্র বা গ্যালাক্সি একটি থেকে আরেকটি দূরে সরে যাচ্ছে কিন্তু এই ব্যাপারটিই আসলে এক ধরনের চলমান স্থিতি অবস্থা। অর্থাৎ, এভাবে চলতে থাকলে যেহেতু সময়ের সাথে সাথে একটি নক্ষত্র থেকে অন্য নক্ষত্র অনেক দূরে চলে যাবে, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে বস্তুর ঘনত্ব কমে যাবে কাজেই সেটা ঠিক রাখার জন্যে মহাজগতে ক্রমাগত নূতন পদার্থের জন্ম হবে। এই স্থিতি অবস্থা ব্যাখ্যার জনক ছিলেন ফ্রেড হয়েল এবং তার এই ব্যাখ্যাটি সত্যি হতে হলে ক্রমাগত নূতন নূতন গ্যালাক্সির জন্ম হতে হবে। আসলে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এত বড় যে ফ্রেড হয়েলের ব্যাখ্যাটি সত্যি হওয়ার জন্যে খুব বেশি পদার্থের জন্ম দেয়ার প্রয়োজন হয় না। এক কিউবিক মিটারে প্রতি বিলিওন বছরে (শত কোটি) একটা হাইড্রোজেন পরমাণুর জন্ম দিতে পারলেই যথেষ্ট।
দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটি দিয়েছিলেন জর্জ গ্যামো। তার ব্যাখ্যাটি অনেক বেশি নাটকীয়। আমরা এখন যেহেতু দেখতে পাচ্ছি সবকিছু প্রবল বেগে একটি থেকে অন্যটি দূরে সরে যাচ্ছে, তার
অর্থ অতীতে নিশ্চয়ই সবকিছু এক জায়গায় ছিল। সঠিকভাবে বলতে গেলে বলতে হয় এক বিন্দুতে ছিল। তখন প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণের ভেতর দিয়ে পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের জন্ম হয় এবং সেই বিস্ফোরণের কারণে সবকিছু ছুটে যেতে শুরু করেছে এবং আমরা সেটাই দেখছি। এই ব্যাখ্যাটির নাম বিগ ব্যাং (Big Bang)। বোঝাই যাচ্ছে এ ধরনের একটা নাটকীয় ব্যাখ্যা শুনলেই আমরা ভুরু কুচকে নানা ধরনের প্রশ্ন শুরু করি, এত বড় বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কেমন করে একটা বিন্দুতে থাকে, কেমন করে সেই বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণের আগে সেখানে কী ছিল, ইত্যাদি ইত্যাদি।
বোঝাই যাচ্ছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড নিয়ে তো ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করা সম্ভব নয়, তাই কোন ব্যাখ্যাটি সত্য সেটা বের করা নিশ্চয়ই খুব সহজ একটা ব্যাপার হবে না। বিজ্ঞানীরা বুঝি আজীবন একটি কিংবা অন্যটির পক্ষে বিপক্ষে যুক্তিতর্ক দিয়ে ঝগড়াঝাটি করতে থাকবেন।
কিন্তু সেটি হয় নি, পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা অতি নাটকীয় বিগ ব্যাং ব্যাখ্যাটিই গ্রহণ করে নিয়েছেন। তার বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণটি ঘটেছে 1965 সালে। আর্নো পেনজিয়া এবং রবার্ট উইলসন নামে বেল ল্যাবের দুজন বিজ্ঞানী একটা মাইক্রোওয়েভ এন্টেনা দিয়ে একটা নিখুঁত পরীক্ষা করতে গিয়ে খুব ঝামেলায় পড়ে গেলেন, তার এন্টেনাতে সব সময়েই একটা বিরক্তিকর সিগন্যাল এসে নিখুঁত পরীক্ষার মাঝে বাধা সৃষ্টি করতে লাগল। অনেক চেষ্টা করেও এই অনাকাঙ্ক্ষিত বিরক্তিকর সিগন্যালটা দূর করতে না পেরে বিজ্ঞানী দুজন হতাশ হয়ে বললেন, যেদিকেই এই এন্টেনাটি ব্যবহার করা যাক না কেন, সব দিক থেকেই এই সিগন্যালটি আসছে। মনে হচ্ছে পুরো পৃথিবী বা পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডটা যেন এই সিগন্যালে ডুবে আছে। বিজ্ঞানের ভাষায় বলা যায় পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের তাপমাত্রা হচ্ছে তিন ডিগ্রি কেলভিন।
ঠিক একই সময়ে মাইল বিশেক দূরে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসেব করে বের করলেন বিগ ব্যাং এর প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটে থাকলে সেখানে প্রচণ্ড তাপমাত্রার সৃষ্টি হবে, এতদিন তার তাপমাত্রা কমে সেটি তিন ডিগ্রি কেলভিনে নেমে আসবে। খুব সহজেই পরীক্ষা করে এটা মাপা সম্ভব। কিছুদিনের মাঝেই তারা খবর পেলেন এই পরীক্ষাটি আসলে দাঁড় করানোর প্রয়োজন নেই। ইতোমধ্যে সেটা করা হয়ে গেছে। পরীক্ষার ফলাফলও প্রস্তুত।
কাজেই পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা এখন বিশ্বাস করেন আজ থেকে বিশ বিলিওন বৎসর আগে ভয়ংকর এক বিস্ফোরণের ভেতর দিয়ে আমাদের এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের জন্ম হয়েছিল। বিজ্ঞানের জগতে নাটকীয় বিষয়ের স্থান খুব কম। কিন্তু বিগ ব্যাংয়ের মতো একটি অতি নাটকীয় বিষয় আমাদের বিজ্ঞানের মাঝে মনে হয় পাকাপাকিভাবেই ঢুকে গেছে।
.
20. সবকিছুর তত্ত্ব : স্ট্রিং থিওরি
পৃথিবীতে চার ধরনের বল রয়েছে। মহাকর্ষ বল, নিউক্লিয়ার বল, বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় বল এবং উইক (weak বা দুর্বল) বল। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রথম তিনটির কথা ঘুরে ফিরে চলে আসে, অনুমান করা যায় চতুর্থটির নাম আমরা সেরকম শুনতে পাই না। মহাকর্ষ বলের কারণে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরে কিংবা আছাড় খেলে আমরা শূন্যে ঝুলে না থেকে ধরাম করে পড়ে যাই! নিউক্লিয়ার বল ব্যবহার করে নিউক্লিয়ার বোমা তৈরি করা হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে এই বোমা দিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। আমরা সূর্য থেকে যে আলো আর তাপ পাই সেটাও আসে নিউক্লিয়ার বল থেকে। বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় বলের উদাহরণ অসংখ্য, আমাদের চারপাশে তার ছড়াছড়ি। ঘরের লাইট বালু বা গাড়ির ইঞ্জিন সবকিছুর মূলে এই বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় শক্তি। উইক বলের উদাহরণ দিতে হলে একটু মাথা চুলকাতে হয় কারণ আমাদের চারপাশে আমরা যা কিছু দেখি তার মাঝে চট করে সেরকম উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায় না। উইক বলের কারণে সূর্যের ভেতরে নিউট্রিনো নামে এক ধরণের কণা তৈরি হয়, সেগুলো প্রতি মুহূর্তে আমাদের শরীরের ভেতর দিয়ে চলে যায় আমরা কখনো টের পাই না! শুধুমাত্র চোখের ভিতর দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে এক মিলিওন নিউট্রিনো চলে যাচ্ছে কেউ সেটা দেখছে না! কারণটি সহজ, উইক বল আসলেই দুর্বল। আসলেই এটা কোনো কিছুর সাথে বিক্রিয়া করে না।
বিজ্ঞানীরা সব সময়েই সবকিছু সহজ করে বোঝার চেষ্টা করেন। একটা সময় ছিল যখন চুম্বক এবং বিদ্যুৎকে আলাদা বলে মনে করা হতো। একসময় তারা দেখলেন যে আসলে এই দুটো আলাদা কিছু না, একই বলের দুটি ভিন্নরূপ। ঠিক একইভাবে তারা বিশ্বাস করেন প্রকৃতিতে যে চারটি বল রয়েছে সেগুলো আসলে আলাদা নয়, সেগুলো আসলে একই বলের ভিন্ন ভিন্ন রূপ। এই বিশ্বাস নিয়ে কাজ করে ইতোমধ্যে তারা বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় বল এবং উইক বলকে একত্র করে ফেলেছেন, সেটার নাম দেয়া হয়েছে ইলেকট্রো উইক বল! কাজেই যদি শুরুতে যদি বলা হতো প্রকৃতিতে তিন ধরনের বল মহাকর্ষ, নিউক্লিয়ার এবং ইলেকট্রো উইক তাহলে ভুল হতো না! আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় এবং উইক বলকে আলাদাভাবে দেখি, তাপমাত্রা যদি অনেক বেশি হতো তা হলে সেটা আর আলাদা থাকত না এক হয়ে যেত। বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন তাপমাত্রা যদি আরও বাড়িয়ে দেয়া যেত তাহলে নিইক্লয়ার বল এবং ইলেকট্রো উহক বলও এক হয়ে যাবে এবং এই ধারণাটার নাম স্ট্যান্ডার্ড মডেল (Standard model)। পদার্থবিজ্ঞানের এটা বেশ গ্রহণযোগ্য একটা ধারণা।
সবাই সম্ভবত লক্ষ করেছে তাপমাত্রা আরও বাড়িয়ে দিলে মহাকর্ষ বলটিও তার সাথে একত্র হয়ে যাবে এই কথাটি বলা হয় নি! আসলে মহাকর্ষ বল অন্য তিনটি বল থেকে একেবারে অন্যরকম। নিউক্লিয়ার, বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় এবং উইক বলকে ব্যাখ্যা করার জন্যে পদার্থবিজ্ঞানের যে অংশ ব্যবহার করা হয় তার নাম কোয়ান্টাম মেকানিক্স। মহাকর্ষকে ব্যাখ্যা করার জন্যে পদার্থবিজ্ঞানের যে অংশ ব্যবহার করা হয় সেটি হচ্ছে জেনারেল রিলেটিভিটি! বিজ্ঞানী আইনস্টাইন জেনারেল রিলেটিভিটির জনক, তিনি তার জীবনের ত্রিশ বৎসর মহাকর্ষ বলের সাথে অন্য বলগুলো একত্র করার জন্যে ব্যয় করেছিলেন, পারেন নি। মহাকর্ষ বল এমন একটি বল যে সেটাকে অন্য বলের সাথে একত্র করা অত্যন্ত দূরুহ!
মহাকর্ষ বল তুলনামূলকভাবে অত্যন্ত দুর্বল। এটা কত দুর্বল সেটা খুব সহজে পরীক্ষা করা যায়। শীতের দিনে চুল আচড়ে একটা চিরুনীকে ছোট কাগজের টুকরোর কাছে ধরলে কাগজটা লাফিয়ে চিরুনীর গায়ে লেগে যায়। বিশাল পৃথিবী তার সমস্ত ভর ব্যবহার করে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি দিয়ে কাগজটাকে নিচের দিকে টানছে অথচ ছোট একটা প্লাস্টিকের চিরুনীতে অল্প একটু স্থির বিদ্যুৎ দিয়েই পুরো পৃথিবীর সম্মিলিত মহাকর্ষ বল থেকে বেশি বল প্রয়োগ করা সম্ভব। মনে হতে পারে এটা বুঝি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের বল, কিন্তু দেখা গেছে মহাকর্ষ বল অন্য সব বলের মতো। এটাও আলোর বেগের দ্রুততায় কাজ করে। অর্থাৎ, কোনো জাদুমন্ত্রের সাহায্যে যদি সূর্যটাকে উধাও করে দেয়া যায় পৃথিবী তার কক্ষপথ থেকে সাথে সাথে ছিটকে যাবে না, এটা ছিটকে যাবে আট মিনিট পরে। কারণ, সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে সময় লাগে আট মিনিট। আলো হচ্ছে বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ। দেখা যাচ্ছে কোনো এক রহস্যময় কারণে মহাকর্ষ বল বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গকে তার বল প্রয়োগের সময় হিসেবে বেছে নিয়েছে, কাজেই নিশ্চয়ই তাদের ভেতরে কোনো এক ধরনের যোগসূত্র রয়েছে।
সব ধরনের বলকে একত্র করার জন্যে বিজ্ঞানীদের চেষ্টার অন্ত নেই, ঝামেলা ছিল মহাকর্ষ বলকে নিয়ে। শেষ পর্যন্ত যে পদ্ধতিতে এই চারটি বলকে একত্র করার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে সেটার নাম হচ্ছে সুপার স্ট্রিং থিওরি (Super sting theory)। এর জন্ম ইতিহাসটা মোটামুটি চমকপ্রদ কারণ এর মাঝে আছে বৈচিত্র, কৌতূহল, হতাশা এবং ধৈয্যের এক অপূর্ব সম্মেলন!
1968 সালে গ্যাব্রিয়েল ভেনেজিয়ানো নামে একজন তরুণ পদার্থবিজ্ঞানী শক্তিশালী এক্সেলেটরে এক্সপেরিমেন্টের ফলাফলগুলো পরীক্ষা করতে করতে একটা বিচিত্র মিল খুঁজে পেলেন। তিনি দেখলেন বিখ্যাত গণিতবিদ অয়লার দুশ বছর আগে যে বিটা ফাংশান তৈরি করে দিয়েছেন পরীক্ষার ফলাফলগুলো তার সাথে মিলে যায়। কেন এটা হয় এই তরুণ বিজ্ঞানী সেটা ব্যাখ্যা করতে পারলেন না। দুই বছর পর 1970 সালে লিওনার্ড সাসকিন্ড, হলজার নিলসেন এবং ইওশিরো নামবু নামে তিনজন বিজ্ঞানী দেখেলেন যদি দুটো কণা আসলে সুতার মতো রিং হিসেবে থাকে তাহলে তাদের ভেতরে যে শক্তির আদান-প্রদান হয় সেটি অয়লারের বিটা ফাংশান দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। বিষয়টি অত্যন্ত চমকপ্রদ কারণ এর আগে সবাই জানত সবকিছুই একটা বিন্দুর মতো যার কোনো ব্যাপ্তি নেই কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে এটি বিন্দু নয়, এগুলো রবার ব্যান্ডের মতো স্ট্রিং! এত বড় একটা আবিষ্কারের পরও পৃথিবীর বিজ্ঞানী সমাজ সেটাকে তেমন আমল দিলেন না কারণ এই তত্ত্বটি অন্য অনেক ফলাফলকে ব্যাখ্যা করতে পারল না। 1974 সালের মাঝে সবাই স্ট্রিং থিওরির কথা মোটামুটি ভুলেই গেল।
জন শোয়ার্জ নামে একজন শুধু স্ট্রিং থিওরিকে ভুলে গেলেন না, তার কেন জানি মনে হলো এর ভেতরে গভীর কোনো ব্যাপার লুকিয়ে আছে। তিনি এবং তার সহকর্মীরা এর পিছনে লেগে রইলেন। কোয়ান্টাম মেকানিক্স ব্যবহার করে তিনি স্ট্রিং থিওরি ব্যাখ্যা করলেন এবং আবিষ্কার করলেন স্ট্রিং থিওরি থেকে ভর শূন্য এবং স্পিন 2 এক ধরনের কণা বের হয়ে আসার কথা। (স্পিন কণাদের একটা ধর্ম। আলোর কণা হচ্ছে ফোটন তার স্পিন হচ্ছে 1) কোনো এক্সপেরিমেন্টে কোথাও কখনো স্পিন 2 কণা পাওয়া যায় নি। সবাই ধরেই নিল স্ট্রং থিওরিতে সমস্যা রয়েছে।
জন শোয়ার্জ এবং তার সহকর্মী জোয়েলের তখন হঠাৎ একটা চমকপ্রদ ব্যাখ্যা কথা মনে হলো বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় বলের বাহক হচ্ছে ফোটন, সে-রকম ধরে নেয়া হয় মহাকর্ষ বলের বাহক হচ্ছে গ্রেভিটন। গ্রেভিটন কেউ কখনো দেখে নি, কিন্তু যদি এটা থেকে থাকে তাহলে এটি হবে ভরশূন্য এবং এর স্পীন হবে 2! শোয়ার্জ এবং জোয়েল তখন ভাবলেন পৃথিবীর কেউ যেটা পারে নি মহাকর্ষ বলকে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের আওতায় আনা, তাহলে কী তারা সেই সম্ভাবনায় হাত দিয়েছেন? তারা তাদের কাজ জার্নালে প্রকাশ করলেন, ভেবেছিলেন বিজ্ঞানী মহলে হইচই পড়ে যাবে কিন্তু দেখা গেল কেউ গা করল না। সবাই ধরে নিল একটা মৃতপ্রায় থিওরিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে তারা চেষ্টা করে যাচ্ছেন!
স্ট্রিং থিওরিকে কোনো গুরুত্ব না দেওয়ার জন্যে বিজ্ঞানী মহলকে অবশ্যি দোষ দেওয়া যায় না। এর মাঝে তখন বড় বড় সমস্যা ছিল। গাণিতিক অসামঞ্জস্যতা ছিল, পদার্থবিজ্ঞানীরা এ রকম সমস্যাবহুল থিওরি নিয়ে মাথা ঘামাবেন সেটা কেউই আশা করে না।
জন শোয়ার্জ আশা ছাড়লেন। । তার কাছে মনে হলো যদি এটা সত্যিকারের একটা থিওরি হয়ে থাকে তাহলে এর মাঝে কোনো অসামঞ্জস্য থাকার কথা নয়। পুরো তত্ত্বটা যদি নিখুঁতভাবে হিসেব করা যায় হয়তো দেখা যাবে একটা সমস্যা অন্য সমস্যাকে কাটাকাটি করে দিচ্ছে। সমস্যারা নিজেরা কাটাকাটি করে সমস্যাহীন নিখুঁত একট তত্ত্ব বের হয়ে আসবে! ব্যাপারটা খুব বিশ্বাসযোগ্য নয় কিন্তু জন শোয়ার্জ লেগে থাকলেন। এবারে তার সাথে যোগ দিলেন মাইকেল গ্রীন এবং দুজন মিলে প্রায় দশ বৎসর টানা পরিশ্রম করে তারা আবিষ্কার করলেন যে তাদের ধারণা সত্যি, সমস্যাগুলো একটা আরেকটাকে কাটাকাটি করে দূর হয়ে গেছে! কোয়ান্টাম মেকানিক্সের কাছে পুরাপুরি গ্রহণযোগ্য এই স্ট্রিং থিওরি। 1984 সালে তাদের এই আবিষ্কারের কথা যখন বিজ্ঞানী মহলে প্রচারিত হলো তখন একসাথে সবার টনক নড়লো। মহাকর্ষকে নিয়ে সকল বলকে এক সূত্রে গাথার এই তত্ত্বটি নিয়ে এতদিন গবেষণা করছিলেন মাত্র দুজন, রাতারাতি সেখানে কয়েক হাজার গবেষক ঝাঁপিয়ে পড়লেন। (জন শোয়ার্জ তখন ক্যালটেকের প্রফেসর, আমিও তখন পোস্ট ডক্টরাল কাজে ক্যালটেকে যোগ দিয়েছি। বিজ্ঞানীদের সেই উত্তেজনা আমার খুব কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল!)
বোঝাই যাচ্ছে স্ট্রিং থিওরির বিষয়টা কোনো সহজ বিষয় নয়, কিন্তু ভেতরে মূল ভাবটা এমন কিছু কঠিন নয়। বিষয়টা এভাবে বোঝানো যায় :
আমরা যে কোনো জিনিস নিয়েই শুরু করি না কেন, সেটাকে যদি ভাংতে শুরু করি তাহলে একসময় আমরা পরমাণুতে পৌঁছে যাবে। (20.1নং ছবি) এই পরমাণুর একটা যদি আমরা ভালো করে পরীক্ষা করি তাহলে দেখব এর মাঝখানে রয়েছে নিউক্লিয়াস এবং সেই নিউক্লিয়াসকে ঘিরে ঘুরছে ইলেকট্রন। ইলেকট্রনকে আর ভাঙা সম্ভব নয়, ধরে নেয়া হয় সেটাই তার আদি রূপ, তার কোনো ব্যাপ্তি নেই, এটি একটি বিন্দুর মতো। তবে নিউক্লিয়াসকে আরো ভাঙা সম্ভব এবং তাহলে আমরা পাব–প্রোটন আর নিউট্রন। বিশ্বাস করা হয় প্রোটন এবং নিউট্রন তৈরি হয়েছে কোয়ার্ক দিয়ে। ইলেকট্রনের মতো কোয়ার্ককেও ধরে নেয়া হয় ব্যাপ্তিহীন একটা বিন্দুর মতো, এটাকে ভেঙে আর নূতন কিছু পাওয়া সম্ভব নয়।
স্ট্রিং থিওরি বলছে যে ইলেকট্রন বা কোয়ার্কদেরকে আমরা একটা বিন্দু বলছি কারণ আমরা সেটাকে খুব সূক্ষ্মভাবে দেখতে পাচ্ছি না। যদি এটাকে আরো সূক্ষ্মভাবে দেখতে পেতাম তাহলে দেখতাম এগুলো আসলে বিন্দু নয় সুতা দিয়ে তৈরি রিংয়ের মতো এক ধরনের আকৃতির বস্তু! এই রিংগুলো নানাভাবে কাঁপতে পারে এবং এর এক একটি কম্পন হচ্ছে (20.3 নং ছবি) সৃষ্ট জগতের এক একটি কণা! এতদিন বিশ্বাস করা হতো সৃষ্ট জগতের সবকিছু তৈরি হয়েছে তিন ধরনের কণার পরিবার দিয়ে। এই পরিবারের চার সদস্য, ইলেকট্রন, নিউট্রিনো, আপ কোয়ার্ক এবং ডাউন কোয়ার্ক। (আপ কোয়ার্ক এবং ডাউন কোয়ার্ক দিয়ে তৈরি হয় নিউট্রন এবং প্রোটন) এ-রকম আরো দুটি পরিবার আছে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে যার খোঁজখবর থাকার কথা নয়।
সৃষ্টির এই আদি রূপের সবগুলো আসলে একটি করে স্ট্রীং! এই স্ট্রীংয়ের এক এক ধরনের কম্পনের জন্যে এক একটি কণার জন্ম হয়ে থাকে। বিজ্ঞানীরা যেভাবে সবকিছু একটি সূত্র দিয়ে প্রকাশ করতে পছন্দ করেন এটা হচ্ছে ঠিক সেরকম একটি সূত্র। সৃষ্টজগতের সবকিছু হচ্ছে স্ট্রিং বা সুতোর বাঁধন!
এত চমৎকার একটা তত্ত্ব দেয়ার জন্যে আমাদের নিশ্চয়ই কিছু মূল্য দিতে হয়েছে। সেই মূল্যটা কী?
মূল্যটা কিন্তু কম নয়। মূল্যটা অনেক বড়–আমাদের পরিচিত ত্রিমাত্রিক জগৎকে বিসর্জন দিতে হয়েছে। স্ট্রিং থিওরি যদি সত্যি হয় তাহলে আমাদের জগৎটি আসলে ত্রিমাত্রিক নয় এর আরো ছয়টি মাত্রা রয়েছে যেগুলো খুব ক্ষুদ্র জায়গায় কুকড়ে রয়েছে বলে আমরা দেখতে পাচ্ছি না! সামনে পিছনে এক মাত্রা ডানে বায়ে দুই মাত্রা এবং উপরে নিচে হচ্ছে তিন মাত্রা এই তিনটি নিয়ে আমাদের পরিচিত ত্রিমাত্রিক জগৎ! এর বাইরে আরো ছয়টি মাত্রা কীভাবে থাকবে কেউ কী কল্পনা করতে পারবে?
যেটা কল্পনাও করা যায় না সেটার অস্তিত্ব আছে এর চাইতে চমকপ্রদ ব্যাপার আর কী হতে পারে?
amr ekta prosno mathai khub khota dicche..
accha dhore nilam alor beg sob inershial fram e soman..
ekhn, mne korun ami alor bege chutchi , ami jkhan thek chota suru kreclm skhane amr ek bondhu light hate dariya ase,amr chotar kichukkhon por se amr dik alo fello. ekhn ki sei alo amak dhorte perbe? (amr to mne hoi perbe na)
kingba dhorun ami light tir alo felar sathe sathe chota suru krlm,tkhn ki ami alota k sthir dekhbona?
kingba erokm o to howa drkr j ami amr bahone bosei alo fellam tkhn to alo tak amr esthir dekhar ktha…