নিশানাথ ঘুম থেকে ওঠেন ভোর পাঁচটায়। বাড়ি থেকে ময়দান পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে আবার ফিরে আসেন। নিজের প্রাতঃকৃত্য সেরে তারপর তিনি সুব্রতকে ডেকে তুললেন, বললেন, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে।
বাসন্তীও উঠে পড়েছে। সে সাহস করে জিজ্ঞেস করল, বাবা, তোমরা আজকেই ফিরবে তো?
নিশানাথ বললেন, না।
জামাকাপড় কিছু গুছিয়ে দিতে হবে? সঙ্গে যদি নিয়ে যেতে হয়—
কিচ্ছু লাগবে না!
দাঁত-টাত মেজে সুব্রত চোরের মতন ভয়ে ভয়ে চা-জলখাবার খাচ্ছে। কোথায় যাবে, কেন যাবে, কিছুই ঠিক বুঝতে পারছে না।
সাতটার মধ্যেই নিশানাথ ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। বাস ধরে শিয়ালদা স্টেশন। টিকিট কেটে নিশানাথ যখন সাউথ স্টেশনের দিকে এগোলেন, তখন সুব্রত ভাবল, তাহলে তো খুব বেশি দূর যেতে হবে না। এদিক তো বড়োজোর ডায়মণ্ডহারবার কিংবা ক্যানিং।
ট্রেনে কিন্তু বাবা আর ছেলে পাশাপাশি বসল না। জানলার ধারে বসবার অছিলায় সুব্রত চলে গেল একেবারে অন্য দিকে। সেখান থেকে আড়চোখে মাঝে মাঝে বাবাকে দেখতে লাগল।
নিশানাথের মুখখানা গম্ভীর। অন্য দিনের চেয়েও বেশি গম্ভীর। শূন্যদৃষ্টিতে চেয়ে আছেন বাইরের দিকে।
নিশানাথ প্রায়ই ছুটির দিনে কলকাতার বাইরে কোথাও যান। একা। সুব্রত আবছাভাবে শুনেছিল, বাবা গ্রামের দিকে তাঁর এক বন্ধুর কাছে যান। সেখানে একটা হাসপাতাল না কী যেন আছে।
একটু বাদে একজন দরিদ্র মুসলমান নিশানাথের পাশে বসে কথা বলতে লাগল। মনে হয় লোকটি তাঁকে আগে থেকেই চেনে। হয়তো এই ট্রেনেই নিশানাথ মাঝে মাঝে যান। ট্রেনটা যাচ্ছে ডায়মণ্ডহারবার, সেখানে গিয়ে কী করবে?
কাল রাত্রে বেশ বৃষ্টি হয়েছিল, গাছপালাগুলোর বেশ পরিচ্ছন্ন চেহারা। কলকাতা ছাড়বার একটু পরেই দু-দিকে এত বেশি ফাঁকা মাঠ, দেখলে ঠিক বিশ্বাসই করা যায় না। তাহলে কলকাতায় এত ভিড় কেন?
যতদূর দেখা যায়, আকাশটা কালো হয়ে আছে। সেই গাঢ়মেঘের ছায়া পড়েছে গাছপালায়। সানগ্লাস চোখে দিলে প্রকৃতিকে যেরকম দেখায়। বাতাসে নারকোল গাছগুলোর ডগা অস্থির। এইরকম সময় মাঠ ও গাছপালার দিকে তাকিয়ে থাকলে চোখে একটা ঠাণ্ডা ভাব লাগে।
সুব্রতর পাশেই একটা লোক কালো চশমা পরে বসে আছে। হাতে একটা লাঠি। প্রথমে সুব্রত কিছু বুঝতে পারেনি, অনেকক্ষণ পরে টের পেল লোকটি অন্ধ। হঠাৎ খুব দুঃখ হল সুব্রতর। এর আগে সে কোনো অন্ধ মানুষের জন্য চিন্তা করেনি। কিন্তু আজ এই সকালে, ট্রেনের জানলায় বসে তার মনে হল, কোনো জীবিত মানুষের অন্ধ থাকা উচিত না। যদি বেঁচে থাকতে হয়, তাহলে চোখ দুটো অন্তত থাকা দরকার। সুব্রত যদি বিশেষ কোনো ক্ষমতা বলে, এইমুহূর্তে লোকটির চোখ দুটো সারিয়ে দিতে পারত! যেন সত্যিই সুব্রত লোকটির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। রহস্যময় ভঙ্গিতে বললে, আপনার চশমাটা একবার খুলুন। লোকটি শুনতে পায়নি। সে নিজেই চশমাটা খুলে, চোখের ওপর আলতো করে হাত বুলোত লাগল। একটুখানি পিটপিট করার পর খুলে গেল চোখ, সেই মধ্যবয়স্ক লোকটা জীবনে প্রথম চোখ খুলেই তাকিয়ে রইল কটমট করে, যেন চোখের সামনে সব কিছু ভস্ম করে দেবে। সুব্রত ভয় পেয়ে যাচ্ছে। লোকটা কী দৃষ্টিশক্তি পাওয়ায় খুশি না?
…দিল্লি থেকে সুব্রতর ডাক এসেছে। রাশিয়ান, আমেরিকান, ইংরেজ, ফরাসি বৈজ্ঞানিকরা তাকে পরীক্ষা করে দেখবে। সুব্রতর এই অসম্ভব ক্ষমতার কথা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে গেছে। সে কোনো ওষুধ ব্যবহার করে না, সে কোনো মন্ত্রও উচ্চারণ করে না, শুধু যেকোনো অন্ধ লোকের চোখে হাত দিয়ে খুব কোমলভাবে বলে, তাকাও, আমার দিকে তাকাও! অমনি অন্ধদের চোখ খুলে যায়। এর ফলে অবশ্য সুব্রতর নিজের দৃষ্টিশক্তি অনেক কমে আসছে। তা হোক, যে ক-দিন বাঁচবে, যদি আরও কয়েক হাজার অন্ধের চোখ খুলে দিতে পারে…
বৈজ্ঞানিকরা বলছেন, আপনার কায়দাটা কী বলুন, মি. হালদার! আমরা যন্ত্রপাতি দিয়ে সেটা পরীক্ষা করে দেখব, তারপর যদি ফর্মুলাটা বার করা যায়, তাহলে চিকিৎসাবিজ্ঞানে একটা যুগান্তর এসে যাবে!
সুব্রত উত্তর দিল, আমার তো কোনো কায়দা নেই! শুধু মনের জোর। আমি খুব আন্তরিকভাবে বলি, পৃথিবীতে কেন কেউ অন্ধ থাকবে? তুমি তাকাও…
ট্রেন এসে থামল বারুইপুরে। একগাদা লোক হুড়মুড় করে উঠে এল কামরায়। সুব্রতর ঘোর ভেঙে গেল। অন্ধ লোকটি জানলায় মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে। সুব্রত বাবার দিকে একবার তাকাল। নিশানাথ সেই মুসলমানটির সঙ্গে আলোচনায় মত্ত। কোথায় নামতে হবে তা সুব্রত এখনও জানে না।
বাবার সঙ্গে সুব্রত অনেকদিন কোথাও যায়নি। স্কুলে পড়ার সময় সুব্রতকে বাবার সঙ্গে বাজারে যেতে হত। নিশানাথ তখন প্রতিদিন ভোর বেলা উঠে গঙ্গায় সাঁতার কাটতে যেতেন, সেখান থেকেই চলে আসতেন বাজারে। সুব্রত ঠিক সাড়ে সাতটার সয়ম নির্দিষ্ট আলুর দোকানের পাশে থলি হাতে দাঁড়িয়ে থাকত। নিশানাথ বাজার করে দিয়ে ছেলের হাতেই পাঠিয়ে অন্য কোথায় যেন চলে যেতেন। সুব্রত নিজে কখনো বাজার করেনি, বাজারের থলে বহন করেছে।
একবার শুধু বড়োমামার বিয়ের সময় যাওয়া হয়েছিল পাটনায়। তখন সুব্রত খুবই ছোটো, তখন বাবার সঙ্গে কথা বলতে ভয় করত না। বাবাও বোধ হয় তখন এ-রকম গম্ভীর ছিলেন না। রাগি ছিলেন অবশ্য খুবই। দুটো ঘটনা এখনও মনে আছে। জসিডি স্টেশনে বাবা কুজোতে জল ভরে আনতে গিয়েছিলেন। হঠাৎ ট্রেন ছেড়ে দিল। বাবাকে কোথাও দেখা গেল না। মা চেঁচামেচি শুরু করে দিলেন। অন্য লোকেরা বলল, ভয় কী নিশ্চয়ই অন্য কামরায় উঠেছেন। এমন সময় দেখা গেল, বাবা দৌড়ে দৌড়ে আসছেন। এক হাতে কুঁজো, এক হাতে চটি, বাবা লম্বা লম্বা পায়ে দৌড়োচ্ছেন। পাশে পাশে দৌড়াচ্ছে আর একজন কাবুলিওয়ালা। ট্রেন তখন বেশ জোরে যাচ্ছে। সমস্ত কামরা থেকে লোকেরা জানলা দিয়ে ঝুঁকে দেখছে বাবাকে আর চেঁচিয়ে বলছে, যেকোনো কামরায় উঠে পড়ুন! চেন টানার কথাও কারুর মনে পড়েনি। শেষপর্যন্ত বাবা সেই কাবুলিওয়ালাকেও হারিয়ে দিয়ে আগে দৌড়ে এসে ঠিক নিজের কামরাতেই উঠলেন। সুব্রতর খুব গর্ব হয়েছিল।
সুব্রতর তখন এগারো বছর বয়েস। তার জন্য কাটা হয়েছিল হাফ টিকিট। বয়সের তুলনায় সুব্রতকে বেশি লম্বা দেখাতো। একজন খিটখিটে মতন টিকিট চেকার উঠে অনেকক্ষণ ধরে টিকিট পরীক্ষা করে সুব্রতকে দেখিয়ে বলেছিল, এর বয়েস বেশি, এর ফুল টিকিট কাটতে হবে। এইসব কথা শুনলে বাবা যে কীরকম রেগে যান তা আর বাইরের লোক জানবে কী করে? বাবা কী বলে চেঁচিয়ে উঠে দাঁড়াতেই মা ভয় পেয়ে বলেছিলেন, ঝগড়া কোরো না। বাকি টাকাটা দিয়ে দাও। কিন্তু বাবাকে এত সহজে সামলানো যায় না। বাবা চেকারবাবুকে বললেন, আমার ছেলের বয়েস আমি জানি না? আপনি শেখাবেন? চেকারটা নাছোড়বান্দা। ফুল টিকিট না নিয়ে ছাড়বে না। কিছুক্ষণ কথা কাটাকাটির পর চেকারটি বাবাকে একবার মিথ্যেকথা বলছে বলায় বাবা ঠাস করে এক চড় মেরেছিলেন। চড় খেয়ে টলে পড়ে গিয়ে চেকারটি-র মাথা ঠুকে গেল। সে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। বাবা তখনও হাত তুলে বলেছিলেন, আর একটা কথা বললে, আর এক চড় মারব।
ব্যাপার অনেকদূর গড়িয়েছিল। পরের স্টেশনে চেকারবাবুটি পুলিশ ডেকে এনেছিলেন। মা কাঁদছিলেন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। বাবা প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে স্টেশনমাস্টারকে বলেছিলেন, হ্যাঁ, মেরেছিই তো, বেশ করেছি। আমাকে মিথ্যেবাদী বললে মারব না? মায়ের কান্নাকাটির জন্যই শেষপর্যন্ত অন্যযাত্রীরা মধ্যস্থ হয়ে মিটিয়ে দেয়। বাবা তখনও গোঁ ধরেছিলেন, চেকারকে ক্ষমা চাইতে হবে। সেবারও সুব্রতর খুব গর্ব হয়েছিল বাবার জন্য। তার বাবা ছাড়া আর কী কেউ একজনকে চড় মারার পরেও ক্ষমা চাইতে বলতে পারে?
সুব্রত তার বাবাকে মার খেতেও দেখেছে একবার। চৌষট্টি সালের দাঙ্গার সময়। সকাল বেলা বাজারের মধ্যে হঠাৎ মারামারি শুরু হয়ে গেল। একটা বুড়ো ডিমওয়ালাকে বাঁশ দিয়ে পেটাচ্ছিল কয়েকজন লোক। বাবা বাজারের থলিটা সুব্রতর হাতে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন লোকগুলোর ওপর। লাথি, কিল, ঘুসি মেরে তাদের সরিয়ে দিয়ে বুড়ো লোকটাকে আড়াল করে দাঁড়ালেন। বুড়োটির তখন উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই। অন্য লোকগুলো কিন্তু ছাড়েনি। বাবাকেও মারতে শুরু করেছিল। বাবা তাঁর বিশাল শরীর নিয়ে বুড়ো লোকটার ওপর ঝুঁকে রইলেন, আর তাঁর পিঠে পড়তে লাগল দমাদ্দম বাঁশ আর লোকের লাথি। সুব্রতর দম আটকে এসেছিল। কথা বলার ক্ষমতা ছিল না। ভিজিলেন্স পার্টির ললাকেরা না এসে পড়লে নিশানাথ বোধ হয় সেইদিনই মরে যেতেন। কিংবা শেষমুহূর্তে ঘুরে দাঁড়ালে বোধ হয় আরও দু-একজন লোকের প্রাণ যেত।
ডায়মণ্ডহারবার এসে গেছে। নিশানাথ উঠে দাঁড়িয়ে ছেলের দিকে তাকালেন। সুব্রত ট্রেন থেকে বেরিয়ে নেমে এল। নিশানাথ এখনও কোনো কথা বলছেন না। স্টেশন থেকে বেরিয়ে হাঁটতে লাগলেন। টিপিটিপি বৃষ্টি পড়ছে। এখানে সাইকেল-রিকশা আছে, কিন্তু বাবা যে রিকশাতে উঠবেন না, তা তো সুব্রত আগে থেকেই জানে। চার-পাচ মাইল হাঁটতে হলেও রিকশা নেওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। নিশানাথ জীবনে একবারও রিকশা চেপেছেন কিনা সন্দেহ।
বেশিদূর হাঁটতে হল না অবশ্য। কাছেই বাস স্ট্যাণ্ড। নিশানাথ সুব্রতকে নিয়ে কাকদ্বীপের বাসে চাপলেন। সুব্রতর কৌতূহল ক্রমশই প্রখর হচ্ছে। এর আগে বন্ধুদের সঙ্গে দু-একবার ডায়মণ্ডহারবার দেখতে এলেও কাকদ্বীপে কখনো যায়নি। তার আগ্রহই হচ্ছে এখন।
কিন্তু কাকদ্বীপ যাওয়া হল না। মাত্র আধ ঘণ্টা বাদেই নিশানাথ আবার বাস থেকে নেমে পড়লেন মাঠের মধ্যে। জনমানবশূন্য জায়গা। দু-পাশে চাষের খেত, মাঝখান দিয়ে একটা সরু পায়ে-চলা রাস্তা। নিশানাথ সেই রাস্তা ধরলেন।
সুব্রত আর কৌতূহল চেপে রাখতে পারল না। সে হঠাৎ বলে ফেলল, আমরা কোথায় যাচ্ছি?
নিশানাথ ছেলের দিকে না তাকিয়েই উত্তর দিলেন, গঙ্গার ওপারে।
সেখানে কী আছে?
গেলে দেখতে পাওয়া যাবে।
ব্যাস, এরপর আর কথা চলে না। সুব্রত চুপচাপ হাঁটতে লাগল। জল-কাদায় পিচ্ছিল পথ, একটু অসাবধান হলেই চিত্তির হতে হবে। চটি একেবারে কাদায় মাখামাখি। এ-রকম রাস্তায় আসতে হবে জানলে সুব্রত রবারের জুতো পরে আসত। বাবা তো আগে থেকে কিছুই বলবেন না।
আকাশ এখন প্রায় মিশমিশে কালো। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝিলিক দিচ্ছে। যেকোনো সময় দারুণ বৃষ্টি নামবে। বৃষ্টি নামলে দাঁড়াবার কোনো জায়গা নেই। মাঝে মাঝে দু-একটা রোগা রোগা গাছ ছাড়া একবারে ধু-ধু করছে মাঠ।
সুব্রতর মনে হচ্ছে যেন সে একেবারে অন্তহীন পথ হেঁটে চলেছে। আর কতদূর যেতে হবে কে জানে? নিশানাথ এত জোরে জোরে হাঁটেন যে, তাঁর সঙ্গে পাল্লা রাখতে গেলে সুব্রতকে প্রায় দৌড়াতে হয়।
একসময় সামনেই দেখা গেল নদী। রাস্তাটা যেন সোজা এসে নদীতে ডুব দিয়েছে। হু-হু করছে হাওয়া। সুব্রতর লম্বা চুল উড়ে এসে পড়ছে চোখে-মুখে। জামাটা এমন পতপত করে উড়ছে, যেন পকেটগুলো উলটে গিয়ে পয়সাকড়ি পড়ে যাবে।
গঙ্গা এখানে প্রায় সমুদ্রের মতো চওড়া। গাঢ় মেঘের ছায়ায় জলের রং এখন রহস্যময়। ছলাৎ ছলাৎ করে ঢেউ এসে ভেঙে পড়ছে পাড়ে। ওপারটা দেখাই যায় না। ভীষণ শব্দে মধ্য আকাশে একটা বজ্রপাত হতেই সুব্রত দারুণ চমকে উঠল। তার বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ করছে। এত বড়ো নদী দেখে তার চিত্ত উদবেলিত হয়নি। সে ভয় পেয়েছে। তার জলের ভয় আছে।
তিনটে ছোটো নৌকো বাঁধা আছে ঘাটের কাছে। একটাতেও লোক নেই। নিশানাথ উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখে এলেন। তাঁর ভুরু কুঁচকে গেছে।
কাছেই একটা অশ্বত্থ গাছের নীচে দু-টি খড়ের চালা। একটি বোধ হয় চায়ের দোকান। অন্যটিতে মাছের পাইকাররা বসে। নিশানাথ সেই দিকে হাতছানি দিয়ে ডাকতে লাগলেন, মাঝি কে আছে? কার নৌকো ভাড়া যাবে?
প্রবল হাওয়ার জন্য ভালো করে কথা শোনা যায় না। তবু নিশানাথের হাঁকডাকে টোকা মাথায় দু-জন লোক নেমে এল। নিশানাথ বললেন, ওপারে রামশিঙাতে যাব। কোন নৌকা যাবে?
একজন বলল, এখন কোনো নৌকা যাবে না বাবু!
কেন?
দেখছেন-না ঝড়-বৃষ্টি আসছে!
নিশানাথ যেন কথাটা শুনে অবাক হলেন। যেন তিনি আকাশের দিকে একবারও তাকাননি। এবার তাকালেন। তারপর তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, কোথায় ঝড়-বৃষ্টি? অনেক দেরি আছে।
মাঝি বলল, না বাবু, গতিক খুব খারাপ। আপনি একটু বসে যান। একধারা বৃষ্টি হয়ে যাক আগে।
নিশানাথ বললেন, বৃষ্টি আসবার আগেই আমরা পৌঁছে যাব। কতক্ষণ আর লাগবে?
আধঘণ্টা বড়োজোর।
না বাবু, উজানে যেতে হবে, সোওয়া ঘণ্টা লাগবে অন্তত।
তাগদ দিয়ে টানতে পারলে পৌনে এক ঘণ্টার বেশি কিছুতেই লাগে না। তোমরা যাবে কী না বলো।
মাঝি দু-টি নিজেদের মধ্যে সামান্য পরামর্শ করে বলল, না।
নিশানাথ একটুক্ষণ গুম হয়ে রইলেন। তাঁর কোনো ইচ্ছেতেই বাধা পড়লে তিনি সহ্য করতে পারেন না। মাঝিরা যেতে একেবারেই রাজি না হলে, তিনি বোধ হয় সাঁতরেই গঙ্গা পার হওয়ার চেষ্টা করবেন।
নিশানাথ গম্ভীরগলায় জিজ্ঞেস করলেন, নাসিরুদ্দিন নেই এখানে? সে আমাকে ঠিক নিয়ে যেত। সে ভয় পায় না।
একজন মাঝি অবহেলার সঙ্গে বলল, নাসিরুদ্দিন তো ওই ঘরে বসে চা খাচ্ছে।
একটু ডাকো তো।
মাঝি দুজন জায়গা ছেড়ে নড়ল না।
নিশানাথ নিজেই দুপদুপ করে পা ফেলে চলে গেলেন চায়ের দোকানের কাছে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একজন লুঙি-পরা বৃদ্ধকে নিয়ে ফিরে এলেন। লোকটি এমনই রোগা ও নিরীহ ধরনের যে তাকে দেখলে খুব একটা সাহসী পুরুষ মনে হয় না।
তুমি পারবে না নাসিরুদ্দিন?
নাসিরুদ্দিন খুব শান্তভাবে বলল, শোনেন বড়োবাবু, আমার দুইডে কথা শোনেন। আর ঘণ্টাভরের মধ্যে ভাড়ি পইড়বে। তখন ড্যাংডেঙিয়ে চলে যাব। আর বাদলাটাও যদি ইয়ের মধ্যে কেঁপে যায়—
নিশানাথ শিশুর মতন ছটফটে। তাঁর সব কিছুই এক্ষুনি চাই। তিনি মাঝিকে মাঝপথেই বাধা দিয়ে বললেন, তুমি কি আগে আমাকে উজান বেয়ে পার করে দাওনি?
তা দিছি। তবু শোনেন—
আগে আমার কথা শোনো! বৃষ্টি আসতে এখনও দেরি আছে।
কিন্তু তুফানডা দেখেন।
সামান্য হাওয়া দিচ্ছে, এর নাম তুফান? তুমি ভয় পাচ্ছ!
আমার শরীরডে ভালো নেই। বেমারিতে ধরেছে এবার।
কী হয়েছে?
পেডের মধ্যে দরদ হয়।
দুর, পেটব্যথা আবার কোনো অসুখ নাকি! চলল, চলো, আর দেরি কোরো না।
বইঠে ধরবে কে! শুকুর ছোঁড়াডা তো এখেনে নেই।
আমি বইঠা ধরব। ধরিনি আগে? চিন্তা কোরো না, চলো—
গ্রাম্য মাঝিটি অবিকল ফরাসি কায়দায় কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, আপনি তো কোনো কথাই শোনেন না।
সে এগিয়ে গিয়ে দড়ির বাঁধন খুলতে লাগল। নিশানাথ এবার হৃষ্টস্বরে বললেন, চলো, তোমাকে খিচুড়ি খাওয়াব।
খানিকটা জলের মধ্যে দিয়ে গিয়ে নৌকোয় উঠতে হবে। নিশানাথ সেই দিকে এগোতে এগোতে সুব্রতকে বললেন, জুতো খুলে হাতে নিয়ে নে।
সুব্রত থমকে দাঁড়িয়েই রইল। তার গলা শুকিয়ে গেছে। মরিয়া হয়ে বলল, বাবা, আমি সাঁতার জানি না।
তাতে কী হয়েছে?
সুব্রতর ইচ্ছে হল দৌড়ে পালিয়ে যায়। বাবার এই গোঁয়ারতুমির কী মানে হয়? মাঝিরাও পর্যন্ত ভয় পাচ্ছে, নদীর বুকে আর একটাও নৌকো দেখা যাচ্ছে না, অন্ধকারে ঢেকে গেছে দিগন্ত, তবু এরমধ্যেই যাওয়া চাই! মাঝিদের উচিত বাবাকে জোর করে আটকানো। সুব্রত পারবে না, কিছুতেই পারবে না, এই ভয়ংকরী নদী পার হতে।
কিন্তু নিশানাথ নৌকোর ওপর উঠে ছেলের দিকে হাত বাড়িয়ে যেই বললেন, আয়, সুব্রত আর প্রতিবাদ করতে পারল না। জুতো খুলে জলে নেমে পড়ল। আশ্চর্য, জলটা গরম।
নাসিরুদ্দিন কাদার মধ্যে বইঠার এক খোঁচা দিতেই নৌকো জলে ভেসে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে দুলতে লাগল খুব।
ছই লাগানো ছোটো নৌকা। সুব্রত টলটলে পায়ে গলুই থেকে এগিয়ে গিয়ে ঠিক মাঝখানের পাটাতনের ওপর বসে শক্ত করে ধরে রইল। নাসিরুদ্দিন বইঠাটা নিশানাথের হাতে তুলে দিয়ে নিজে ডগার কাছে গিয়ে হাল ধরল। নিশানাথ জলে ছপছপ করে বইঠা ফেলতে লাগলেন। তাঁর বেশ অভ্যেস আছে মনে হয়।
সুব্রতর মুখ-চোখ সাদা হয়ে গেছে। জীবনে তো কখনো এত ভয় পায়নি। নৌকোটা অসম্ভব দুলছে। একবার যদি উলটোয়, তাহলে সে পাথরের টুকরোর মতন টুপ করে ডুবে যাবে। কিন্তু সাঁতার জানলেও এত বড়ো নদীতে কী নৌকো উলটোলে বাঁচা যায়? পাড় থেকে যত দূরে সরে আসছে, তত হাওয়ার জোর বাড়ছে। নিজের মাথার লম্বা লম্বা চুলই চাবুকের মতন ঝাপটা মারছে চোখের ওপর। পাটাতন থেকে হাত তুলে যে চুল সামলাবে সে সাহস নেই। এক-একবার বিদ্যুৎ চমকের পরেই হাড় আরও হিম হয়ে আসছে, তার কয়েক মুহূর্ত পরেই বজ্রের গুরুগুরু আওয়াজ। নদীটা যেন বিরাট একটা হিংস্র প্রাণী, অপেক্ষা করে আছে। সুব্রত জলের দিকে তাকাতেও সাহস করছে না।
নিশানাথের ভঙ্গি কিন্তু নিশ্চিন্ত। অল্প অল্প বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। বড়ো বড়ো ফোঁটা। হাওয়ার তেজের জন্যই বৃষ্টিটা ঝুপঝাপ করে নামতে পারছে না। ভিজে জামার মধ্যে দিয়ে লোহার দরজার মতো নিশানাথের শক্ত বুকটা দেখা যায়। বইঠা টানার সময় ফুটে উঠছে তাঁর হাতের সবল পেশি। তাঁকে কোনো জলদস্যুর ভূমিকায় চমৎকার মানায়। এখন তাঁকে দেখলে কে বিশ্বাস করবে যে, এই মানুষই কোনো সওদাগরি অফিসে দশটা-পাঁচটার চাকুরি করে!
সুব্রত অদ্ভুত ভাঙা গলায় জিজ্ঞেস করল, বাবা, আর কতক্ষণ লাগবে?
নিশানাথ বললেন, এখনও তো অর্ধেকও আসিনি। তারপর গলা চড়িয়ে ডাকলেন, নাসিরুদ্দিন, ও নাসিরুদ্দিন, এ-রকম একটা নৌকোর কত দাম পড়ে?
নাসিরুদ্দিন উত্তর দিল, কিনতে চান নাকি?
কিনে রাখলে মন্দ হয় না। তাহলে আর তোমাদের সাধতে হয় না। কীরকম দাম?
বিককিরি আছে একডা লৌকা, সাড়ে পাঁচ-শো চেয়েছে।
সাড়ে পাঁচ-শো? বড্ড বেশি দাম। ক-পয়সার কাঠ আছে এতে? সাড়ে তিন-শো-চার-শোর মধ্যে পাওয়া যায়।
ছাউনিতে তেরপল পাবেন।
ছাউনি-ফাউনি আমার দরকার নেই। ডিঙি হলেও চলবে।
ভরা বর্ষায় ডিঙি কী করবেন?
নিশানাথ একবার চতুর্দিকে চোখ ঘোরালেন। তারপর বললেন, এ আর কী নদী দেখছ! পদ্মায় গেছ কখনো? আমার ছেলেবেলায় সেখানে আমি নৌকো চালিয়েছি।
বৃদ্ধ মাঝি একটুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, আর বাবু, কুথাও আর যাওয়া হবে। পেট বড়ো ব্যথা ব্যথা করে—
ওষুধপত্র খাওনি কিছু?
ইন্তেকালে আর ওষুধড়া কোন কাজে লাগে?
নিশানাথ ভর্ৎসনার চোখে তাকিয়ে রইলেন মাঝির দিকে। মৃত্যুর কাছে এ-রকম আত্মসমর্পণ করে দেয় কেন মানুষ? মৃত্যু তো একটা ঘটনামাত্র। তার আগে নিজের কাজ সম্পূর্ণ করার মতন মনের জোর হারালে চলবে কেন?
একটা পোর্ট কমিশনের ছোটো জাহাজ বৃষ্টির মধ্যে রহস্যময় বাড়ির মতন ধীরগতিতে এগোচ্ছে, তারই কী বড়ো বড়ো ঢেউ। ঢেউ-এর ধাক্কায় নৌকোটা লাফিয়ে উঠল। তারপর আবার নীচে নেমেই দু-দিকে এমন কাত হতে লাগল যেন এক্ষুনি হুড়হুড় করে জল উঠে আসবে। বৃদ্ধ নাসিরুদ্দিন কাত হয়ে শুয়ে পড়ে হালটা চেপে ধরে আছে। বৃষ্টিতে চুপসে গেছে। তার সাদা দাড়ি।
এই টালমাটালের সময় সুব্রত একটা ভুল করল। নৌকো এক দিকে কাত হতেই সে ভয় পেয়ে সরে এল অন্য দিকে। ফলে পরের মুহূর্তেই সেই দিকটা আরও বেশি কাত হয়ে গেল, জল ঢুকে এল খানিকটা।
নিশানাথ ধমক দিয়ে বললেন, কী বোকার মতন করছিস? ওইখানে একটা মগ আছে, জলটা ছেঁচে ফেল—
সুব্রত সে-কথা শুনতে পেল না। আর একটা চোখ-ধাঁধানো বিদ্যুৎ ও কান-ফাটানো বজ্রপাতের সঙ্গে সঙ্গে সে যেন একেবারে অন্ধ হয়ে গেল। পাটাতনগুলো ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে এসে নিশানাথের হাঁটু চেপে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল, বাবা, আমার ভয় করছে। ভীষণ ভয় করছে।
নিশানাথ আবার বললেন, কী পাগলের মতন করছিস! যা, ওইখানে গিয়ে বোস! জলটা ঘেঁচে ফেল!
সুব্রত তখন সত্যিই পাগল। মৃত্যুভয় তাকে উন্মত্ত করে তুলেছে। ইতিমধ্যেই যেন সে জলে ডুবে গেছে এবং তার দম আটকে এসেছে, এইরকমভাবে সে বলতে লাগল, নাঃ, নাঃ, নাঃ, আমি পারব না—
নিশানাথ জল থেকে বইঠা তুলে হিংস্রভাবে তাকালেন ছেলের দিকে। মনে হল যে তিনি রাগের চোটে বইঠার ঘা মারবেন ছেলের মাথায়। তার বদলে, বইঠা ছেড়ে তিনি দু-হাতে ছেলেকে উঁচু করে তুলে ছুড়ে ফেলে দিলেন মাঝগঙ্গায়। চেঁচিয়ে বললেন, দেখ, এবার দেখ!