০৭. নিশাত বলল, ছটফট করছ কেন

নিশাত বলল, ছটফট করছ কেন? চুপ করে বসে থাক। আমি যা বলছি মন দিয়ে শোন।

কটা বাজে।

পাঁচটা পঁচিশ।

ও আসছে না কেন?

আসবে। অফিস ছুটি হয় পাঁচটায়, আসতে সময় লাগবে না?

আপনি চলে যাবেন না তো?

না, আমি আছি। আমি এক সেকেণ্ডের জন্যেও এই ঘর থেকে যাব না।

আপা আমি কাঁদতে পারছি না।

তোমার কাঁদার কোনো দরকার নেই।

আর কেউ জানে না তো?

কেউ জানে না।

আপনি কাউকে বলবেন না। আপনি কাউকে বললে আমি ছাদ থেকে লাফ দিয়ে রাস্তায় পড়ব।

আমি কাউকে কিছু বলব না।

নিশাত উঠে এসে পুষ্পের গায়ে চাদর ভালো করে জড়িয়ে দিল। পল্টু চোখ বড়বড় করে মাকে দেখছে।

আপা!

বল।

পল্টু কি কিছু বুঝতে পারছে?

কিছু বুঝতে পারছে না। তুমি একটু শুয়ে থাক।

না। আপনি কিন্তু যাবেন না।

বললাম তো আমি যাব না।

কটা বাজে আপি?

পাঁচটা পঁয়ত্রিশ।

আমার কেমন যেন গা ঘিনঘন করছে। আপা আমার বমি আসছে।

বাথরুমে যাও, বমি করে আস। এস আমি নিয়ে যাচ্ছি।

পুষ্প বাথরুম পর্যন্ত যেতে পারল না, হড়হড় করে বমি করল। সেই বমির অনেকখানি এসে লাগল নিশাতের শাড়িতে।

আপা, আপনাকে নোংরা করে ফেলেছি।

কোনো অসুবিধা নেই। আমি পরিষ্কার করে নেব। তুমি যাও, হাতমুখ ধুয়ে এস।

আমি আরেক বার গোসল করব আপা।

তুমি একটু পরপর গোসল করছ। বড় একটা অসুখ বাধাবে।

আমি এখন গোসল করতে না পারলে মরে যা আপা।

পুষ্প বাথরুমের দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। শাওয়ার খুলে দিয়েছে। প্রচণ্ড তোড়ে পানি নেমে এসেছে। পানির নিচে মাথা দিয়ে পুষ্প বসে আছে। যেন সে মানুষ নয়। পাথরের কোনন মূর্তি।

নিশাত দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে পল্টুকে কোলে করে তার নিজের ঘরে গেল। পুষ্প বাথরুম থেকে বেরুবার আগেই দ্রুত কয়েকটা টেলিফোন করা দরকার। প্রথমেই কথা বলা দরকার বাবার সঙ্গে। বাবা খুব ঠাণ্ডা মাথায় বুদ্ধি দিতে পারবেন।

হ্যালো বাবা।

কে, নিশু বেটি? কি হয়েছে রে মা?

একটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার হয়েছে বাবা।

বল শুনি।

তুমি কি এক্ষুণি আসতে পারবে?

না, পারব না। কোমরের ব্যথা শুরু হয়েছে। কী হয়েছে বল?

আমার পাশের ফ্ল্যাটের মেয়েটির কথা তোমাকে বলেছি না? সেই মেয়েটি রেপড় হয়েছে। পল্টুর মা। বাবা আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?

ফরহাদ সাহেব মেয়ের কথার জবাব দিলেন না। ভ্রূ কুঞ্চিত করলেন।

বাবা!

শুনছি মা।

এখন আমি কী করব বল? মেয়েটির স্বামী এখনো ফেরে নি।

মেয়েটির শরীরের অবস্থা কেমন? হাসপাতালে নিতে হবে?

না, তা হবে না। আমি কী করব? পুলিশে খবর দেব?

তুমি কিছু করবে না। কাউকে খবর দেবে না। মেয়েটির স্বামীর জন্যে অপেক্ষা করবে।

পুলিশের কোনো বড় অফিসারের সঙ্গে তোমার জানাশোনা আছে?

হ্যাঁ, আছে। কিন্তু মা, বী পেশেন্ট, মন দিয়ে আমার কথা শোন। তুমি কিছু করবে না। মেয়েটির স্বামী আসুক।

উনি তো এখনন আসছেন না!

মা, তুমি এত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? এটা তো তোমার কোনো ব্যাপার না।

একটা মেযে রেপড় হয়েছে। আমি নিজেও একটা মেয়ে। আমার কাছে কেমন লাগছে তুমি বুঝতে পারছ না। মনে হচ্ছে পারবে না।

নিশু মা, একটা কথা শোন…….

আমি পরে কথা বলব।

নিশাত টেলিফোন নামিয়ে পুষ্পের ঘরে ছুটে গেল। পুষ্প এখনো বাথরুমে। শাওয়ার থেকে প্রবল বেগে পানি ঝরছে।

পুষ্প, পুষ্প—এই পুষ্প।

জ্বি।

বেরিয়ে এস।

পুষ্প জবাব দিল না।

তুমি যদি এই মুহূর্তে বের না হও, আমি কিন্তু চলে যাব।

পুষ্প শাওয়ার বন্ধ করে বের হয়ে এল। তার চোখ টকটকে লাল। শীতে সে কাঁপছে। ঠোঁট নীল হয়ে আছে। নিশ্চয়ই জ্বর এসেছে।

কটা বাজে আপা?

জানি না কটা বাজে। তুমি শুকনো কাপড় পর। কম্বলটল কিছু-একটা গায়ে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়।

ঐ বিছানায় আমি কোনোদিন শুতে পারব না।

ঠিক আছে, বিছানায় শুতে হবে না। চাদর পেতে দিচ্ছি।

আপা, আপনার শাড়ি নোংরা হয়ে আছে।

তোমাকে শুইয়ে রেখে আমি যাব, দুই-তিন মিনিট লাগবে।

না আপা, আপনি যাবেন না।

বেশ, আমি যাব না।

মেঝের বিছানায় শোয়ামাত্র পুষ্প ঘুমিয়ে পড়ল। পল্টু ঘুমুচ্ছে। নিশাত মার পাশে তাকে শুইয়ে নিজের ঘরে এসে কাপড় বদলাল। ঘরে টেলিফোন বাজছে। টেলিফোন ধরতে ইচ্ছা করছে না। মনে হচ্ছে বাবার টেলিফোন।

জহির এখনন ফিরছে না। রাত আটটার আগে সে সাধারণত ফেরে না। আজ যদি সকাল-সকাল আসত। নিশাত ঘরে তালা লাগিয়ে বারান্দায় এসে দেখল—পর বাবা সিড়ি ভেঙে উপরে উঠছে। তার এক হাতে বাজারের ব্যাগ, অন্য হাতে দড়িতে বাঁধা কলা। নিশাতের চোখে চোখ পড়ামাত্র সে চোখ নামিয়ে নিল।

রকিব সাহেব।

রকিব অবাক হয়ে তাকাল।

আপনি একটু আমার ঘরে আসুন।

আমাকে বলছেন?

হ্যাঁ, আপনাকেই বলছি। আসুন।

 

হাত গুটিয়ে রকিব বসে আছে। কলাগুলো তার কোলের উপর রাখা। সে ছোট-ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলছে। তার কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম। সে মাথা নিচু করে শুনছে। মাঝে-মাঝে এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন কোনো কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না। পকেটে হাত ঢুকিয়ে সে সিগারেট বের করে আবার পকেটে রেখে দিল। নিশাত বলল, আপনি সিগারেট খান, কোনো অসুবিধা নেই।

পল্টু। পল্টু কোথায়?

আছে, ওর মার কাছেই আছে। আপনাকে শক্ত হতে হবে, বুঝতে পারছেন? এখন। যান, আপনার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলুন। ঘুমিয়ে থাকলে ঘুম ভাঙাবেন না। অপেক্ষা করবেন। আপনার স্ত্রীর মানসিক অবস্থাটা আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন?

রকিব জবাব দিল না। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। নিশাত বলল, পুলিশে খবর দিতে হবে। আমি অনেক আগেই দিতাম। আপনার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম।

পুলিশ?

হ্যাঁ, পুলিশ। এত বড় একটা ঘটনার পরও আপনি পুলিশে খবর দেবেন না?

রকিব চুপ করে রইল। নিশাত বলল, আপনি আপনার বন্ধুকে শাস্তি দিতে চান না?

চাই।

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই চান। কেন চাইবেন না?

লোক জানাজানি হবে।

তা তো হবেই। কিন্তু আজ যদি ঐ লোকটির শাস্তি না হয়, তা হলে কী হবে ভেবে দেখুন। ও বুক ফুলিয়ে অন্য কোনো মেয়ের কাছে যাবে। ঠিক একই অবস্থা হবে অন্য একটা মেয়ের।

আমি একটু ভেবে দেখি।

এর মধ্যে ভেবে দেখার কিছু আছে কি?

রকিব জবাব দিল না। নিশাত বলল, যান, আপনার স্ত্রীর কাছে যান। আমিও আসছি।

রকিব উঠে দাঁড়াল। সবগুলো কলা মেঝেতে গড়িয়ে পড়ল। রকিব নিচু হয়ে কলাগুলি তুলছে। মনে হচ্ছে সে একটা ঘোরের মধ্যে আছে।

রকিব সাহেব, আপনি আপনার স্ত্রীর কাছে যান। আমি একটু পরেই আসছি। রকিব ঘর থেকে বের হতে আবার দরজায় একটা ধাক্কা খেল। কলাগুলি আবার মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ল। টেলিফোন বাজছে। নিশাত ফোন ধরল।

মা নিশু!

হ্যাঁ বাবা।

একটু পরপর টেলিফোন করছি, কৈউ ধরছে না।

আমি ছিলাম না।

মেয়েটির ব্যান্ড কি এসেছে?

হ্যাঁ, এসেছে।

পুলিশ কেস করতে চায়?

কেন চাইবে না? চায়।

এখন হয়তো ঝোঁকের মাথায় চাচ্ছে। তারপর যখন চারদিকে হৈচৈ শুরু হবে, তখন মাথার চুল ছিড়বে।

তখনকার কথা তখন হবে।

আমাদের সোসাইটিকে তুমি চেন না মা।

আমার চেনার দরকার নেই। বাবা, তুমি কি তোমার গাড়িটা পাঠাতে পারবে?

পারব। গাড়ি দিয়ে কী হবে?

থানায় যাব।

নিশু মা, আমার একটা কথা শোন।

তুমি গাড়িটা পাঠাও তো বাবা!

নিশাত টেলিফোন নামিয়ে ঘড়ি দেখল। সাতটা পাঁচ বাজে। জহিরের আসতে এখনও অনেক দেরি।

সে তালাবন্ধ করে পাশের ফ্ল্যাটের দরজার সামনে দাঁড়াল। দরজা বন্ধ। বেশ কয়েক বার কলিংবেল টেপার পর রকিব দরজা খুলে দিল।

পুষ্প মেঝেতে মাথা নিচু করে বসে আছে। নিশাতকে ঢুকতে দেখেই বলল, ও পুলিশের কাছে যেতে চাচ্ছে না আপা। তুমি আমাকে নিয়ে চল। ওরা তো টাকা নেবে, তাই না? আমার কাছে টাকা আছে। আমার নানিজান আমাকে পাঁচ হাজার টাকা। দিয়েছেন।

পুষ্প হু-হু করে কেঁদে ফেলল। রকিব চেয়ারে বসে আছে। তার দৃষ্টি ভাবলেশহীন।

আপা, ও আমাকে পুলিশের কাছে নিয়ে যেতে চাচ্ছে না আপা।

তুমি যদি চাও আমি নিয়ে যাব। এক্ষুণি নিয়ে যাব। আর শুনুন ভাই, আপনি কেন নিতে চাচ্ছেন না?

রকিব জবাব দিল না। পল্টু জেগে উঠেছে। সে হামাগুড়ি দিয়ে তার মাকে ধরতে গেল। পুষ্প বাঁ হাতে এক ঝটকা দিয়ে তাকে ফেলে দিল। এই শিশু মার কাছ থেকে। কখনন এরকম ব্যবহার পায় নি। সে এতই অবাক হল যে কাঁদতে পারল না। চোখ বড়-বড় করে তাকিয়ে রইল। অভিমানে তার ঠোট বেঁকে যাচ্ছে। চোখ ছলছল করছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *