নিয়োগীজির মৃত্যুর পরে মোর্চার নেতারা আর তেমন করে বস্তার জেলার দিকে দৃকপাত করার ফুরসত পাননি। তখন ভিলাই তাদের কাছে এক মরণ বাঁচন সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। শিল্পপতিরা ও সমস্ত রাজনৈতিক দল মিলে মুক্তিমোর্চাকে শেষ করে দেবার ঘৃণ্য অপচেষ্টা শুরু করে দেয়। আর মোর্চা তার সর্বশক্তি নিয়ে ভিলাইয়ের শ্রমিক আন্দোলনকে জয় যুক্ত করবার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। নিয়োগীজিকে হত্যা করে দিতে পারার ফলে এবং শাসন প্রশাসন থেকে সেভাবে কোন চাপ না আসায় শিল্পপতিদের মনোবল তখন তুঙ্গে। তারা আর মোর্চা নেতাদের সঙ্গে শ্রমিক সমস্যা সমাধানের জন্যে কোন রকম আলোচনায় বসতে রাজি ছিল না। যখন কোনভাবে আর মালিক পক্ষকে সরকারি মধ্যস্থতায় আলোচনার টেবিলে বসানো গেল না তখন মুক্তি মোর্চা এক রেল অবরোধ কর্মসূচি গ্রহণ করে। প্রায় কুড়ি হাজার মানুষ রেল লাইনের উপর বসে পড়ে এই দাবি নিয়ে যে সরকারকে নিয়োগী হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও মজুরদের ন্যায্য দাবি পূরণে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। তখন বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী সুন্দর লাল পটোয়ার নির্দেশে পুলিশ প্রশাসন মজুরদের উপর এক ভয়ংকর আঘাত হানে। তারা বৃষ্টির মত গুলি চালিয়ে আন্দোলনরত মজুরদের ষোলজনকে হত্যা আর দেড়দুশো জনকে মারাত্মক ভাবে ঘায়েল করে দেয়। তাদের একটাই উদ্দেশ্য থাকে যত বেশি সংখ্যক মানুষকে খুন করে আন্দোলনকারীদের আতঙ্কিত করে ফেলা। বলা চলে এতে তারা সফল হয়। এরপর মুক্তিমোর্চা ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়তে থাকে। তারপক্ষে আর সেভাবে শক্তিশালী আন্দোলন সংগঠিত করা সম্ভব হয় না। আন্দোলন হয় তবে তা দুর্ধর্ষ মালিক শ্রেণিকে নত করার পক্ষে যথেষ্ট নয়, নিয়োগীজির মত সবল সাহসী নেতৃত্ব না থাকায় মোর্চা মালিক এবং সরকারের মিলিতআক্রমণের সামনে দাঁড়াতে পারে না।
নিয়োগীগির অন্তিম সময়ে তার মৃতদেহের সামনে আমরা যে তিনজন বাঙালী উপস্থিত ছিলাম যাদের সাথে পশ্চিমবঙ্গের একটা যোগ আছে তার একজন ডাক্তার পুণ্যব্রত গুণ। নিয়োগীজির মৃত্যুর অল্প কিছুদিন পরে মুক্তিমোর্চার স্থানীয় নেতাদের সাথে তার মতোবিরোধ ঘটে এবং তিনি কলকাতায় ফিরে যান, এবার চলে গেলেন ডঃ শৈবাল জানা, উনি কলকাতায় গিয়ে দুর্বার মহিলা সমিতিতে যোগ দেন। কিন্তু আমি কোথায় যাব! আমার তখন যাবার মত কোন জায়গা ছিল না বলে থেকে গিয়েছিলাম। তখন সংগঠনে নিজেকে ভীষণ উপেক্ষিত বলে মনে হতো। কারণ আমি বা বস্তার জেলার সংগঠন নিয়ে তখন মোর্চার নেতাদের আর কোন মাথা ব্যথা ছিল না। আছে থাকুক না থাকে তো যাক এমন একটা মনোভাব প্রকাশ পেত প্রত্যেকের ব্যবহারে। সংগঠনের ভগ্নদশা, নেতাদের অমনোযোগ সংগঠনের সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের ব্যক্তি জীবন ও রাজনৈতিক ভূমিকাকে প্রভাবিত না করে পারে না। মানুষ এক্ষেত্রে হতোদ্যম হয়ে পড়াটা অস্বাভাবিক নয়।
আমার তখন সাংসারিক অবস্থাও বড় খারাপ। আমি আগে তো কখনও ব্যবসা করিনি, ফলে কোন মাল কখন কতটা স্টক করা দরকার, কখন স্টক খালি না করে দিলে পুঁজি আটকে যায় তার কোন পূর্বধারণা নেই। আমার দোকানটি স্কুল পাঠ্য বইয়ের দোকান। প্রধানতঃ যার বিক্রয় নতুন সেশন শুরু হবার পর এক দেড়মাস ভালো চলে। এবং এর ক্রেতার সংখ্যাও সীমিত। একবার বই কেনা হয়ে গেলে মানুষ আর সারা বছর বইয়ের দোকানের দিকে ফিরেও তাকাবে না। গত বছর প্রথম দু সপ্তাহ ধূম বই বিক্রি হচ্ছিল বলে না বুঝে কাঁকেরের নাজিব কুরেশির কাছ থেকে একগাদা বই তুলে নিয়ে এসেছিলাম। সে সব বই আর বিক্রি হয়নি। আশা করেছিলাম এ বছর বিক্রি হয়ে যাবে। কিন্তু তা আর হল না। মধ্যপ্রদেশ শিক্ষাপর্ষদ সে সব বই বাতিল করে নতুন সিলেবাস চালু করে দেওয়ায় সর্বনাশ হয়ে গেল আমার। এখন যে নতুন বই তুলবো সেই পুঁজি আর নেই। প্রচুর টাকা লোকসান দিয়ে ব্যবসা ডুবে গেল আমার। নাজিব কুরেশি নিয়োগীজি জীবিত থাকাকালীন সময়ে আমার প্রতি যে বদান্যতা দেখিয়ে ছিল তা উবে গেছে। কারণ তখন তার বিশ্বাস ছিল, বাকিতে বই এনে আমি যদি তার মূল্য পরিশোধ দিতে না পারি, নিয়োগীজি দিয়ে দেবেন। এখন তো তিনি নেই, তাই বাকিতে মাল দেবার ঝুঁকি নিতে রাজি হল না। বলল-আমি আর ব্যবসা দেখাশোনা করি না। আমার ভাইয়েরা দোকান চালাচ্ছে। ওরা নগদ ছাড়া মাল দেবে না বলেছে।
নিয়োগীজি না থাকায় এবং মোর্চার নেতৃত্ব আমাদের সাথে কোন যোগাযোগ না রাখায় কাপসীর মুক্তিমোর্চার ছেলেরা হতাশ নিরাশ হয়ে একে একে অন্য দলে চলে গেল। পারালকোট সর্ব অর্থে একটা কুয়ো। সমুদ্রের সঙ্গে সংযোগ থাকলে তবেই কুয়োয় জল থাকে। যদি সমুদ্রের জলস্তর নিচে চলে যায় কুয়ো শুকিয়ে খটখটে। এখন আমি সারা অঞ্চলে একেবারে একা হয়ে গেলাম। এই সুযোগে জীতেন ব্যানার্জিরা নানাভাবে আমাকে বিপদে ফেলার চেষ্টা চালাতে লাগল। বিজেপির কাপসী পঞ্চায়েতের সরপঞ্চ অরুণ দত্ত চাপ দিতে লাগল তাদের দলে যোগ দেবার জন্য। আর পুলিশ? তারাও মাঝে মাঝে থানায় ডেকে নিয়ে এসে জিজ্ঞাসাবাদের নামে ঘণ্টার পর ঘন্টা বসিয়ে রেখে কেন কে জানেহয়রান করা শুরু করে দিল। এ সময়ে বস্তার জেলা জুড়ে পি.ডব্লু.জি-র ব্যাপক সক্রিয়তা, পুলিশ তো মুক্তিমোর্চাকে ওদের সহযোগী সংগঠন বলে মনে করে।
জীবনে বহুবার বাঘের মতো মানুষের মুখোমুখি হয়েছি। কিন্তু সত্যিকারের বাঘের সামনে পড়িনি কখনও। এমন কী চিড়িয়াখানার বাঘ আমি তখন পর্যন্ত দেখিনি। এবার সেই বাঘের সামনে পড়ে গেলাম একদিন, একেবারে একা এক জঙ্গলে।
সেদিন বিকেল বেলা, বড়েগাঁও হাট থেকে ডিউটি শেষ করে থানায় ফিরে যাবার সময় বুলেট মোর্টর সাইকেল চালিয়ে এক পুলিশ অফিসার এসে দাঁড়িয়ে পড়ল আমার ঘরের দরজায়–ব্যাপারীজি, আভি আপকো থোরা থানেমে যানা পড়েগা। বড় সাহেব আপকো লে যানেকা লিয়ে বোলা। পুলিশ অফিসারের চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছিল আমাকে এ্যারেস্ট করতেই এসেছে। যদিও সেটা সে বলছেনা। তাহলে তো কেন এ্যারেস্ট করছে জিজ্ঞাসা করা যায়। ওয়ারেন্ট দেখতে চাওয়া যায়। তাই অনুকে বলি–এ বেলা আর আমার জন্য রান্না করার দরকার নেই। ফালতু চালটুকু নষ্ট হবে। ওটুকু থাকলে কাল দুপুরে তোমাদের কাজে লাগবে। আমার মনে হচ্ছে বাড়ি আসতে সেই কাল রাত আটটা নটা হয়ে যাবে।
আমার বাড়ি থেকে পাখানজুড় থানার দূরত্ব এগার/বারো মাইল। পথের দুধারেই ঘন বন। তবে সবটা বন নয়, কোথাও কোথাও পথের পাশের কিছু বন সাফ করে চাষের উপযুক্ত কিছু কিছু জমিও বের করা হয়েছে। পি.ভি ৫৬ থেকে দক্ষিণ মুখে আদিবাসী গ্রাম হারানগড় পেরিয়ে খানিকটা পথ গেলে একটা পাহাড় আছে। পাহাড়ের উপরে বাঁশ শাল সেগুন অর্জুন আমলকি আরও নানা ধরনের প্রচুর গাছ গাছালি। পাহাড় পার হলে রাস্তার দুধারে নয় নাম্বার ভিলেজের মানুষদের বেশ কিছুটা চাষের জমি আছে। নয় নাম্বার ভিলেজ এখান থেকে পূর্বদিকের দুই আড়াই মাইল দূরে। তবু এই পাহাড়টার নাম নয় নাম্বারের পাহাড়।
বড় সাহেব আমাকে থানায় নিয়ে আসতে বলেছে, থানায় গিয়ে শুনি তিনি এই কিছুক্ষণ আগে বান্দে বলে এক জায়গায় গেছেন। কখন ফিরবেন কিছু বলে যাননি। আর জানবার এখন কোন উপায়ও নেই। সে সময় মোবাইল ফোন এত সস্তা ও সর্বসাধারণের ব্যবহারযোগ্য মোটেই ছিল না।
এখন কি করা? যে অফিসারটি আমাকে নিয়ে এসেছে সে আর আমাকে এখন লকআপে দিল না। থানার সামনে বহেড়া গাছের বাঁধানো গোড়ায় বসিয়ে রাখল বড় সাহেব কখন আসবে সেই অপেক্ষায়। আমার পাহারায় রইল থানার গেটের ডিউটি সেপাই। প্রায় দু আড়াই ঘণ্টা ঠায় বসে রইলাম সেখানে। এর মধ্যে থানায় দু দুটো কেস এসে গেল। একটা মারপিটের আর একটা মোষ চুরির। তার ডায়েরি লেখা হল কিন্তু বড়বাবু এল না। এক সময় বলে গেট ডিউটির সেপাই–যাইয়ে ব্যাপারীজি–ঘুমকে চায় বায় পি পাকে আইয়ে। কিতনা দের এইসা বইঠিয়েগা। এ্যারেস্ট হো যাতা তো বাত কুছ ঔর থা, ফোকটমে বইঠে রহনা…। তা চা খেতে যেতে বলার সময় এটাও মনে করিয়ে দিল যে–আমি যেন বাড়ি চলে না যাই। কারণ আমাকে যদি এ্যারেস্ট করার জন্য আনা হয়ে থাকে–বড় সাহেব এসে আমাকে না পেলে তাকে ধমকাবে।
পশ্চিমবঙ্গে ছিল না, তবে এখানকার পুলিশ বিভাগের সঙ্গে আছে আমার যাকে বলে একটা শত্রুতামূলক বন্ধুত্ব বা বিশ্বস্ততা। তাই শুধু এটাই প্রথম নয়, আগেও এমন হয়েছে। সেটা সেই জীতেন ব্যানার্জির সাথে মারামারির সময়কার ঘটনা। গতকাল বিকালে এ্যারেস্ট হওয়া আমাকে, হাতে হাতকড়া যা নিয়মানুসারে পরানো হয়েছে, সেই পাখানজুড় থানার দুই কনস্টেবল কাকের কোর্টে নিয়ে এসে, বিচার পর্ব শুরু হবার আগে নিজেরা সরকারি পয়সায় খাবে বলে ঢুকে পড়েছিল বাসস্ট্যান্ডের এক দামি হোটেলে। আর আমাকে বিশ্বাস করে ছেড়ে দিয়েছিল কোন সস্তার হোটেলে খেয়ে আসার জন্য। হাতে হাতকড়া নিয়ে আমি একা হেঁটে হেঁটে চলে গিয়েছিলাম আধ মাইল দূরে–দুধ নদীর কিনারে–যেখানে, কাকেরে কোন কাজে এলে ছয়টাকায় ডালভাত তরকারি খাই, সেই গরিব হোটেলে।
আমি সেদিন ইচ্ছা করলে পালিয়ে যেতে পারতাম। আর তা করলে দুই বেচারার চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়ে যেত। ওদের বিশ্বাসের মর্যাদা দিতে সেটা করতে পারিনি। ওরা খেয়ে দেয়ে পরম নিশ্চিন্তে বসেছিল আমার ফেরবার অপেক্ষায়। আর আমি ফিরে এসেছিলাম। এই কারণেই এখন সেপাই বলতে পারছে–যান চাটা খেয়ে আসুন।
সে যাইহোক, চাটা খেয়ে ফিরে এসে আবার বসে পড়লাম সেই গাছের গোড়ায়। রাত যখন মনে হয় নটা কি সাড়ে নটা তখন এলেন বড় সাহেব। এসে আমাকে দেখে মাথা নাড়লেন–আপ আ গিয়া!
বলি–আমি আসিনি, আমাকে আনা হয়েছে।
–আমি আনতে বলেছিলাম।
–কেন?
–কাল আপনাদের কি পোগ্রাম?
-–কি পোগ্রাম মানে! ঠিক বুঝলাম না!
উনি বুঝিয়ে বললেন–এবং জানতে চাইলেন-–কালকে ছত্তিশগড় মুক্তিমোর্চা যে ছত্তিশগড় জুড়ে থানা তহসিল এসবের সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে তাতে আমাদের পারালকোটবাসী কর্মী সমর্থকরা অংশ নেবে কিনা! সত্যি বলতে কী আমি এটা জানতামই না। আর তো দল্লীর সাথে তেমন যোগাযোগ নেই। তাছাড়া পেপারও পড়িনি। তাই বলি–আমরা কিছু করব না। বলতে পারি না, যে কিছু করার মত জনবলও আর আমাদের নেই।
ব্যাস! এটাই জানবার ছিল। স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে বলেন তিনি–যান আপনি। অনেক রাত হয়ে গেছে। আর আপনাকে আটকাব না।
উনি তো বলে দিলেন যান। কিন্তু এখন এই এগার বারো মাইল পথ যাব কি করে! পথঘাট একেবারে শুনশান। একটাও জিপ লরী নেই। শেষ বাসটা চলে গেছে বিকেল চারটেয়। অথচ আমাকে তো যেতেই হবে। না গেলে বাড়ির লোক চিন্তায় থাকবে। অনুকে বলে এসেছি আমি হয়ত এ্যারেস্ট হবো। এই রাতে আমি না গেলে সে কী ঘুমাতে পারবে? স্বামী লকআপে থাকলে কোন স্ত্রীর কি ঘুম আসে?ফায়েকোন ভাবে বাড়ি আমাকে যেহেব। অগত্যা আর কোনদিকে না তাকিয়ে রাতের খাবার জন্য একটা পাউরুটি কিনে হাঁটা দিলাম বাড়ির দিকে। আজ মনে হয় পূর্ণিমা আকাশে রূপোর থালার মত গোলাকার চাঁদ, যার উজ্জ্বল জোছনায় ভেসে যাচ্ছে মাঠপাথার বন জঙ্গল। বেশ ফুরফুরে হাওয়া আছে। দু ঘণ্টা হাঁটলে কি বাড়ি পৌঁছাতে পারব না!
নির্জন জঙ্গল পথ ধরে হাঁটা দিলাম আমি। হাঁটতে হাঁটতে কেমন যেন একটা ঘোর লেগে গেল আমার। নিশিতে পাওয়া মানুষের যেমন হয়। শরীর সচল চেতনা অবশ। হাঁটতে হাঁটতে এক সময় এসে গেলাম সেই বিখ্যাত নয় নাম্বার পাহাড়ের সামনে। সামনে মানে একেবারে সন্নিকটে নয়, পাহাড়টা তখনও সিকি মাইল দূরে। এখানে রাস্তার দুই ধারে ফাঁকা মাঠ। বৃষ্টি নামলে এই মাঠ চাষের জমিতে বদলে যাবে। তখন পাটমেস্তা অরহর তিল সোয়াবিন এ সব ফসল বোনা হবে। সেই মাঠের মাঝখান থেকে বাস চলা পাকা রাস্তার উপর আমি। আর আমার দেড়দুশো ফুট দূরে মাঠের মাঝে কটা কালো কালো বড় পাথর, পাথরের ছায়ায় কিছু অন্ধকার।মনে হয় সেই অন্ধকারে বসে ঘুমোচ্ছিল সেই বাঘটা। আমি যেমন বুঝতে পারিনি ওখানে একটা বাঘ আছে সে-ও বুঝতে পারেনি যে একজন লোক হেঁটে একেবারে তার কাছে এসে পড়েছে। হঠাৎ একটা শব্দ আমার কানে এল। না, হালুম নয়! হালুম আর উফ্ এই দুয়ের সংমিশ্রণে যে শব্দ হয়–হ্যাঁউ। সেটা আমার কাছে একটা আর্তনাদ আর বিরক্তি অথবা ভীত গলার স্বর–তেমনই মনে হল। বাঘটা আমাকে হঠাৎ দেখে ভয় পেয়ে গেছে। তাই সে হাউফ শব্দ করে জোছনা ধোয়া শুকনো মাঠের উপর দিয়ে উধশ্বাসে ছুটে জঙ্গলের দিকে পালিয়ে গেল।
মানুষ বাঘকে ভয় পায়, এটা যেমন সত্যি, এটাও মিথ্যা নয় যে বাঘও মানুষ নামক জীবটিকে ভয় পায়। কিন্তু এখন আমার মন বাঘকে ভয় পেতে দেখে পুলকে ভরে ওঠে না, আতঙ্কে সারা শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে। আর এক পা-ও সামনে এগোতে পারি না। দাঁড়িয়ে পড়ি পথের উপরে। কী হল আর কী হতে পারত সেই ভেবে শিউরে উঠি। এটা ঠিক যে দণ্ডকারণ্যে বাঘে মানুষ খায় না। যে কারণে ধর্ম বিশ্বাসীরা প্রচার করে থাকে এটা নাকি সীতাদেবীর বরদানের ফল। কিন্তু আসল কারণ হল–এখানে বাঘেরা পর্যাপ্ত পরিমাণে অন্য আহার পেয়ে যায়। তাছাড়া এখানে এখনও মরিচঝাঁপির মত কোন ঘটনাও ঘটেনি যে নরমাংস খেয়ে বাঘের পুরাতন খাদ্যাভাস বদলে যাবে। অনু জালের একটা লেখা থেকে জানা যায় সুন্দরবনের বাঘ আগে নর-মাংস লোভি ছিলনা। মরিচঝাঁপির ঘটনার পর তাদের খাদ্যাভাস বদলে গেছে। কিন্তু ভয় পাওয়া বাঘ যদি আত্মরক্ষার কথা ভেবে আচমকা আমার উপর আক্রমণ করে বসত তাহলে কি হতো? অথবা ওটা বাঘ না হয়ে যদি ভাল্লুক হতো? ভাল্লুক এমন এক প্রাণী যারা আমিষ আহার করে না, একেবারে সাত্ত্বিক শাকাহারি। কিন্তু সামনে মানুষ পেলে আর তার রক্ষা নেই। ঝাঁপিয়ে পড়ে। বিশেষ করে মাদি ভালুক হলে তো আর কথাই নেই। মহুয়া ফুলের সিজনে প্রচুর ভালুক গভীর জঙ্গল থেকে বের হয়ে লোকালয়ের দিকে চলে আসে। যে কারণে বস্তারের কোন আদিবাসী নিরস্ত্র পথ চলে না। একটা ধারালো ফারসা বা টাঙ্গি কাঁধে রাখে। বাঙালীরাও এখন সেই অভ্যাসে রপ্ত করে নিয়েছে। কিন্তু আমি তো এখন একেবারে খালি হাতে। পাউরুটির বদলে কমপক্ষে হাতে যদি পাথর রাখতাম তা দিয়ে আত্মরক্ষার একটা চেষ্টা অন্ততঃ করা যেত। নিজের বোকামিতে এখন আমার নিজের মাথায় পাথর মারতে ইচ্ছা হল। আর একটু হলে বিদেশ বিভুয়ে আমার ছোটছোট বাচ্চা নিয়ে অনু অনাথ হয়ে যেত।
পরে শুনেছিলাম, আকারে কিছু ছোট এই বাঘকে নাকি তেলুয়া বলে। আমি একা নই, অনেকে দেখেছে তাকে। নয় নাম্বারের পাহাড়ে এদের একজোড়া ছিল। একটা এক রাতে ট্রাক চাপা পড়ে মারা গেছে। বেঁচে আছে এই একটা। বাড়ি ফিরে সেদিন অনুকে এই ঘটনা বলার পর সে প্রথমে কাঁপলো, তারপর কাঁদলো তারপর বলল–এরপর আর কোনদিন অন্ধকার হয়ে গেলে পাখানজুর থেকে আসবে না। ওদের বলবে যে রকম বাড়ি থেকে নিয়ে গেছে ফিরিয়ে রেখে যাক। আর না হয় থানায় থাকার জায়গা দিক।
সে যাইহোক, এই রকম এক পরিস্থিতিতে এখন পড়ে গেছি আমি যে সেই অবস্থা সহ্য করে কাপসীতে বসবাস করা খুবই কঠিন। দুটি বৃহৎ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আর পুলিশ প্রশাসনের চাপ তার উপর আবার সংসারে অভাব। এই অবস্থায় কাপসীতে থেকে কেমন ভাবে সংসার চালাই। এখানে তো অন্য কোন কাজকর্মের বিশেষ সুযোগ সুবিধা নেই। আমার জন্যে যা আছে, যে কাজ আমি পারি তা হল কাঠ বেঁচা। কিন্তু আমি যে এখন ধর্মচ্যুত হয়ে গেছি। জাত বদলে গেছে আমার। তাই আর কাঠ বেচা যাবে না। জঙ্গলে কুড়ুল নিয়ে ঢোকাই বনরক্ষা আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ। নেতাগিরি করে বন বিভাগের কর্মচারীদের খেপিয়ে রেখেছি। এখন আমাকে বাগে পেলে কাঠ কুড়ুল সব জপ্ত করে নিতে পারে। ওগুলো গেলে অল্পে গেল, যদি সাইকেলও নিয়ে নেয়, ঢাকের দায়ে মনসা বিক্রি।
এখানে একমাত্র চাষের মরশুমের তিনমাস আর তেন্দু পাতা ভাঙার একমাস বাদে অন্য সময়ে জনমজুরের কাজেরও বড় আকাল। তাই আমি যে এখন কীভাবে চাল ডাল তেল নুন যোগাড় করব বুঝে উঠতে পারছি না। আশে পাশে পরিচিত একজনও আর অবশিষ্ট নেই যার কাছ থেকে ধার নিতে বাকি রেখেছি। কি করে ছেলেমেয়ে নিয়ে বেঁচে থাকব সেই চিন্তায় তখন আমার পাগল পাগল দশা। সেই সময় আমার একজন পরিচিত লোক এসে একটা সুখবর দিল-পাখানজুর থেকে একশো আট নাম্বার ভিলেজ পর্যন্ত একটা রাস্তা তৈরি হচ্ছে। দিন দশ পনের হল কাজ শুরু হয়েছে। শেষ হতে আরও মাস দুয়েক লাগবে। এর একটা অতি সুখবর যে ঠিকাদার সেই দল্লীতে থাকে। তোমার তো দল্লীর বিধায়ক, ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চার নেতা জনক লাল ঠাকুরের সাথে খুবই চেনা জানা। এবার তাকে গিয়ে চেপে ধরো। সে একবার ঠিকাদারকে বলে দিলে তুমি একটা মুনশির কাজ পেয়ে যাবে। পাখানজুড়ের পাঁচ ছয় জন মুনশির কাজ করছে। দিনে তিরিশ টাকা করে পায়। তুমি যদি মাস দুয়েক ওখানে কাটিয়ে দিতে পারো এরপর তো তেন্দুপাতা তোলবার মরশুম এসেই যাবে। তখন আমি তোমাকে দূরে কোনদিকে পাতাফড়ির ইনচার্জ বানিয়ে দেব। এক মাসে যাতে পাঁচ সাত হাজার টাকা রোজগার হয়ে যায় সেই কায়দা শিখিয়ে দেব।
কথাটা আমার মনে ধরে গেল। কিন্তু এবারও আমার সেই একই সমস্যা, দল্লীতে জনকলাল ঠাকুর সমীপে যে যাব তার গাড়িভাড়া নেই। যেতে কুড়ি আসতে কুড়ি হাত খরচা দশ, এত টাকা পাবো কোথায়? তখন বলে সেই প্রতিবেশি–আমি না হয় গোটা পঞ্চাশ টাকা ধার দিচ্ছি। কাজ করে টাকা পেলে শোধ দিও। সেই টাকায় বাসের টিকিট কেটে পরের দিন সকালে বাসে চেপে দুপুরে পৌঁছালাম দল্লী। শুনলাম এই কিছুক্ষণ আগে ঠাকুর সাহেব ভুপালে চলে গেছেন। রাজ্যসভার অধিবেশন না ভুপাল গ্যাসপীড়িতদের আন্দোলন কী একটা কার্যক্রমে যোগ দিতে। কবে ফিরবেন? না, খুব বেশি দেরি হবে না। দু চার দিনের মধ্যে ফিরে আসবেন।
আমার তখন আর কি করবার! মোর্চার মেসে আতপ চালের ভাত অরহর ডাল খেয়ে পড়ে রইলাম দল্লীতে। বাড়ি ফিরে আসায় এক ভয় ছিল, আবার কার কাছে টাকা ধার করব? আর যদি বাস ভাড়া যোগাড় না হয় তাহলে আসব কেমন করে?
চারদিন কেটে গেল। বিধায়কজি এলেন না–খবর এল উনি ভুপাল থেকে সোজা দিল্লী চলে গেছেন। স্বামী অগ্নিবেশজি কোন এক জরুরি কারণে তাকে ডেকে পাঠিয়েছে। তাই। শোনা গেল বিধায়কজির দল্লী ফিরে আসতে দিন পনের তো লাগবেই। এতদিন দল্লীতে পড়ে থেকে কি করব? উনি যা পারবেন অন্য কেউ তো তা পারবে না। কথা বলেছিলাম এক দুজন নেতার সাথে। সবার উত্তর–আমি কি বলব, বিধায়কজির সাথে কথা বলে দেখুন। বাধ্য হয়ে ফিরে এলাম কাপসী। চারটে দিন আর পঞ্চাশটা টাকা অকারণে খরচা হয়ে গেল।
দিন পনের পরে আবার আর একবার হাত পাতলাম সেই প্রতিবেশির কাছে। আরও পঞ্চাশ টাকা ধার করে আবার রওনা দিলাম দল্লীর দিকে। বিধায়কজি দিল্লী থেকে দল্লী এসেছেন কীনা তা জানবার অন্য কোন উপায় নেই। কাপসী বা পাখানজুর থেকে তখনও টেলিফোন পরিষেবা শুরু হয়নি।
দল্লীতে গিয়ে শুনি পনের নয় দশও নয় দিল্লীর কাজ মিটিয়ে উনি সাতদিনের মাথায় ফিরে এসেছিলেন। দুদিন একটু বিশ্রাম নিয়ে কিছু সঙ্গীসাথী সহ উনি ছুটে গেছেন নর্মদা নদীর পাড়ে। ওখানে নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনের নেত্রী মেধা পাটেকর বড় বাঁধের বিরোধ ও উচ্ছেদ হওয়া পরিবারের পুনর্বাসনের দাবিতে আমরণ অনশনে বসেছেন। বিধায়ক জনকলাল ঠাকুর ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চার পক্ষ থেকে সেই আন্দোলনের প্রতি নৈতিক সমর্থক জানাতে গেছেন। তবে আজ যত রাত হোক উনি এখানে অবশ্যই ফিরে আসবেন। কারণ কাল একটা মিটিং আছে।
যখন উনি ফিরে এলেন রাত তখন গভীর। স্বাভাবিক কারণে আমি যে সময় ঘুমে অচেতন। ইউনিয়ান অফিসের সামনের মাঠে কখন এসে বিধাকয়জির জিপ থেমেছে টের পাইনি। এখানে থেকে সামান্য একটু দূরে শ্রমিক বস্তির মধ্যে ওনার বাসা। সাধারণ দরকারে বাসায় গিয়ে বিরক্ত করা উচিত হবে না বলে ইউনিয়ান অফিসে বসে রইলাম। আটটা না হয় নটা যখন তোক উনি তো এখানেই আসবেন। দু চার ঘন্টায় আর এমন কি হেরফের হবে। এতদিন যখন কেটে গেছে এটুকু সময়ও যাবে। তিনি এলেন দশটা দশে। অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে একঘন্টা দশ মিনিট দেরিতে। ততক্ষণে দল্লী-রাজহরা ব্যবসায়ী সমিতির সব লোক এসে গেছে। তাদের সাথেই আজকের মিটিং। বিধায়কজি ঝড়ের বেগে এলেন এবং কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা মিটিং কক্ষে গিয়ে ঢুকলেন। আর দরজা বন্ধ কক্ষে যখন মিটিং চলছে গভীর উৎকণ্ঠা নিয়ে আমি তখন দরজার এপারে বসে আছি। পায়চারী করছি, বিড়ি খাচ্ছি, তবু উনি বের হচ্ছেন না। অবশেষে প্রায় বেলা দুটোর সময় সে মিটিং শেষ হয়ে গেল। তিনি বাইরে বের হয়ে আমাকে দেখলেন। একটু হাসলেন–ব্যাপারীজি, আপ কব আয়ে? সব কুশল মঙ্গল?
বলি–আপনার সাথে একটা দরকারি কথা ছিল।
বলেন উনি–এখন থাক। আমি খুব ক্লান্ত। খিদেও লেগে গেছে। আপনি এখন খেয়েদেয়ে বিশ্রাম করুন। রাত্রে সব শুনবো। ঠিক হ্যায় না?
রাতে দেখা হল, আর আমার সমস্যার কথা মন দিয়ে শুনলেন। তারপর জানতে চাইলেন–ঠিকাদারের নাম কি? নাম শুনে বললেন–সুরিন্দর সিং? আমাদের রাজহরার সুরিন্দর পাখানজুরে কাজ নিয়েছে। কোন চিন্তা নেই আপনার, সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। সুরিন্দর খুব ভালো লোক, আমার কথা ফেনাবালকেজানেন তে ট্রাক ওনার্স এসোসিয়েশনের রামপাল ভাটিয়া। রামপাল আর সুরিন্দর একই মহল্লায় থাকে। আমি রামপালকে যা বলার তা বলে দেব। আপনি রামপালের সাথে সোজা সুরিন্দরের ফ্লাটে চলে যাবেন। কাজ হয়ে যাবে।
কিন্তু রামপালের সাথে আমার দেখা কিকরে হবে? সে তো ভীষণ ব্যস্ত লোক। তার সমিতিতে তিনশোখানা ট্রাক, তিনশো রকম ঝামেলা।
বলেন তিনি–আমি দেখছি কি করে আপনার সমস্যার সমাধান করা যায়। কাল কাউকে দিয়ে রামপালের কাছে খবর পাঠাচ্ছি। যদি সে দল্লীতে থাকে, খবর পেলেই চলে আসবে। এখন তো কিছু করা যাবে না। রাত হয়ে গেছে। যান খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন, সকালে দেখছি।
এই খবর পাঠানো আর রামপাল ভাটিয়ার আসা এর মধ্যে কেটে গেল আরও দু চারদিন। তারপর এক সকালে মুখোমুখি হলাম আমরা তিনজন। আমি, জনক লাল ঠাকুর আর রামপাল। সব কথা শুনে বলে রামপাল বিধায়কজি, এটা অতি সামান্য একটা কাজ। আপনার জোর তলব পেয়ে আমি তো ভাবলাম কি না কী? এটা আপনি আমার উপর ছেড়ে দিন। আমি সব ব্যবস্থা করে দেব। এনিয়ে আর আপনাকে ভাবতে হবে না। তারপর আমাকে বলে–আপ কাল মেরা ফ্লাট মে আ যাইয়ে। আপকো সাথমে লেকে ম্যায় খুঁদ চলকে আপসে সুরিন্দরকা বাত করা দেঙ্গে। মানকে চলিয়ে আপকা কাম হো গিয়া।
বড় আশা ভরসার কথা। এতে মনটা নেচে ওঠা খুব স্বাভাবিক। পরের দিন নাচতে নাচতে পৌঁছালাম রামপালের ফ্ল্যাটে। ঘন্টা খানেক বসে থাকতে হল। বেলা নটার আগে তাকে কাঁচা ঘুম থেকে তোলা বারণ। জেগে উঠে প্রাতঃকৃত্য সেরে, চাফা খেয়ে সাড়ে দশটা নাগাদ মোটর সাইকেলে চাপতে পারলেন রামলাল। আমি বসলাম পিছনের সিটে। সুরিন্দর ঠিকাদারের ফ্ল্যাটে পৌঁছাতে পাঁচ মিনিটের বেশি সময় লাগেনি। কিন্তু পাঁচ মিনিট তো অনেক সময়, কখনও কখনও পাঁচ সেকেন্ড সময়ের ব্যবধান মানুষের জীবনে পাহাড় প্রমাণ সমস্যার সৃষ্টি করে দিতে পারে। আমার তাইহল। মাত্র ষাট সেকেন্ড আগে সুরিন্দর সিং জিপ নিয়ে সাইডে বের হয়ে গেছে। বলে সুরিন্দরের স্ত্রী। কোন সাইড? তার কি কোন ঠিক আছে। নাঁদগাও, ডোন্ডি, পাখানজুর, পরতাপপুর, চার জায়গায় চারটে সাইড চলেছে। সে কোন সাইডে গেছে তা বাড়ির বউ কী করে জানবে? বাধ্য হয়ে ফিরে এলাম মোর্চার অফিসে।
পরের দিন আবার গেলাম রামপালের কাছে। আজ আর সে আমাকে নিয়ে সুরিন্দরের কাছে যেতে পারল না। তাকে বিশেষ জরুরি কাজে এখনই রায়পুরে যেতে হবে। হাতে মোটেই সময় নেই। মোর্চার অফিসে ফিরে গিয়ে জনকলাল ঠাকুরেরও দেখা পেলাম না। তিনি গেছেন তার নির্বাচন ক্ষেত্র ডোন্ডি লোহরার কৃষকদের নিয়ে জেলা শাসকের দরবারে কি এক দাবি সনদ পেশ করতে।
পরের দিন দেখা হল রাত দশটায় বিধায়কজির সাথে। শুনলেন আমার সব কথা। খুবই দুঃখ পেলেন তিনি। তারপর বললেন–এক কাজ করুন, এত কষ্ট করে আর আপনার এখানে ফালতু ফালতু পড়ে থাকার দরকার নেই। রামপাল রায়পুর থেকে নাগপুরে যাবে। ওর ফিরে আসতে সময় লাগবে। আমি আপনাকে একটা চিঠি লিখে দিচ্ছি। সাইডে গিয়ে চিঠিটা সুরিন্দরকে দেবেন। কাজে লাগিয়ে নেবে।
সেদিন আর বাড়িতে ফিরে আসব কী করে? বাস কই? ফিরলাম তার পরের দিন। দল্লী থেকে কাপসী আসতে দিনদুপুর। চান করে দুটো নাকে মুখে গুঁজে রোদ মাথায় করে ছুটলাম পাখানজুর সাইডে। এগারো আর দুই তের কিলোমিটার পথ সাইকেলে পার হতে ঘেমে নেয়ে একশা। ঘড়িতে সময় তখন বেলা চারটে। সদ্য নির্মিয়মান সারা রাস্তা জুড়ে তখন শত শত মাটিকাটা মজুর কাজ করছে। অনেক খুঁজে এই সাইডের যে ইনচার্জ তার দেখা পেলাম। বেশ বয়স্ক লোক। দেখেই বোঝা যায় দক্ষ লোক। এই লাইনের কাজে মাথার চুল পাকিয়ে ফেলেছেন। বললাম তাকে–আমি একটু ঠিকাদার সাহেবের সাথে দেখা করতে চাই। একটা এম.এল.এর চিঠি নিয়ে এসেছি। তাকে দেব। উনি কবে, কখন সাইডে আসেন–যদি একটু বলেন।
সাইড ইনচার্জ কিছুসময় চুপ করে থেকে শেষে বলেন-যদি তার আসবার হয় তবে শনিবার এসে থাকেন। ওইদিন লেবারদের পেমেন্ট দেবার দিন। চারটে পাঁচটার সময় এলে দেখা পেয়ে যাবে।
আজ সবে মঙ্গলবার। মাঝে আছে অসহ্য তিন তিনটে দিন। তিনদিন অপেক্ষার পর আবার গেলাম সেই সাইডে। গিয়ে শুনি উনি এসেছিলেন এবং লেবার পেমেন্ট করে চলেও গেছেন।
কিন্তু এখনও তো চারটে বাজেনি। আপনি বলেছিলেন চারটে পাঁচটায় আসে।
চারটের পরেই সবদিন আসে। লেবারদের জিজ্ঞাসা করে দেখো। আজ যে বেলা দুটোর সময় এসে যাবে তা কি করে জানবো বলো!
কিন্তু আমার যে দেখা করা খুবই দরকার ছিল।
বলে সাইড ইনচার্জ, এক কাজ করো। সামনের সপ্তাহে এসো। একটু তাড়াতাড়ি যদি এসে যাও নিশ্চয় দেখা হয়ে যাবে।
সেইমত পরের শনিবার আবার গেলাম সাইডে। আজ আর কোন ঝুঁকি নেইনি, একেবার সকাল আটটায় এসে গেছি। বসে পড়লাম এক গাছ তলায় পেতে রাখা এক দড়ির খাঁটিয়ায়। আসুক এবার ঠিকাদার–যখন আসে। দেখা না হবার কোন কারণই নেই। সকাল থেকে দুপুর তারপর বিকাল–বসে বসে এক সময় শুয়ে পড়েছি খাঁটিয়ার উপরে। শেষে ঘুমিয়ে পড়েছি। যখন চোখ খুলেছি মজুররা সব কাজ শেষ করে চলে যাচ্ছে। এখনও ঠিকাদার আসেনি। তখন বৃদ্ধ সাইড ইনচার্জ বলে–কী হলো বলো তো। এখন লেবার পেমেন্ট কী করে হবে? কাল হাটবার; সবার বাজার হাট আছে। কী যে করি, সবাই তো আমাকে ধরবে।
মুখ দেখে বোঝা যায় বৃদ্ধ তার নিজের সমস্যায় বিব্রত। আমি তাকে আর কি স্বান্তনা দেবো সে আমাকেই সান্ত্বনা দেয়–সারাটা দিন তোমার বেকার চলে গেল। দুপুরে নিশ্চয় কিছু খেতেও পারোনি। কী আর করবে সামনের শনিবার এসো। এ হপ্তায় যখন আসেনি সামনের হপ্তায় নিশ্চয় আসবে। পরের দিন সাইড বন্ধ। আমার সেখানে গিয়ে কোন লাভ নেই। তাই যাওয়া হল না। পরে খবর পেলাম রবিবার সকালে এসে ঠিকাদার লেবার পেমেন্ট করে দিয়ে চলে গেছে।
এরপর যা হল সে আর কহতব্য নয়। শনিবার সাইডে গিয়ে শুনি ঠিকেদার একদিন আগে শুক্রবারই লেবার পেমেন্ট করে দিয়েছে। কবে যে আবার আসবে তা সঠিকভাবে সাইড ইনচার্জ জানে না। তার ফলে আমি আর শনিবারের উপর ভরসা করে বসে থাকতে পারলাম না। সোম থেকেশনি পাক্কা ছয়দিন সকাল থেকে সন্ধ্যে অবধি ধর্না দিয়ে বসে রইলাম পথের ধারে-গাছতলায়। কষ্টে দুঃখে ব্যর্থশ্রমে আমার তখন কান্না পাচ্ছে। কিন্তু ঠিকাদারের আর দেখা মেলে না। এতখানি তপস্যা করলে মানুষ তো ছাড় ভগবান থাকলে নির্ঘাৎ তার দর্শন পেয়ে যেতাম। কে জানে ঠিকাদার হয়ত ভগবানের চেয়েও এককাঠি উপরের জীব ও তা
আমার অধ্যবসায়, কষ্ট সহিষ্ণুতা, ধৈর্য দেখে বৃদ্ধ সাইড ইনচার্জ একদিন বড় বিচলিত হয়ে পড়ে। শেষে বলে–বেটা তুমসে এক বাত পুছনা চাহতে হ্যায়। যদি বলতে না চাও বোলো না। তুমি এতদিন ধরে সে ঠিকাদারের সাথে দেখা করার জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছো, কীসের জন্যে? ব্যাপারটা কী? কি দরকার তার সাথে আমাকে বলা যাবে?
বলি–আমার সংসারে খুব অভাব। একটা কাজ মানে একটা মুনশির কাজ পাবার জন্য তার সাথে দেখা করতে চাচ্ছি।
আমার কথা শুনে বেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন বৃদ্ধ ইনচার্জ। তারপর ধীরে ধীরে বলেন-মুনশির কাজ চাও। যার মজুরি দিনে তিরিশ টাকা!
আমার কাছে তিরিশ টাকাই এখন বিরাট। এবার ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন বৃদ্ধতার জন্য তুমি এম.এল.এর চিঠি কেন নিয়ে আসতে গেলে।সরাসরি আমাকে এসে বলতে, আমি লাগিয়ে নিতাম। এখানকার পাঁচ সাতটা ছেলেকে আমি রেখেছি। আমার কাছে না এসে চলে গেছো এম.এল-এর কাছে। এম.এল.এ-র চিঠির কথা শুনেই তো ভয়ে, কিনা কী ভেবে কে জানে, ঠিকাদার সাহেব সাইডে আসার দিনক্ষণই বদলে দিল। মারবে মশা, দেগে দিয়েছে কামান।
কাতর হয়ে বলি–তা আপনি যখন পারেন, আমাকে কাজে লাগিয়ে নিননা চাচা। আমি এই কাজটা আগেও করেছি। আমি বাইরের লোক, এখানে এসে বড় বিপদে পড়ে গেছি। ঘরে চাল ডালের সমস্যা। দুটো ছোট ছোট বাচ্চা আছে আমার।
আর কি লাগাব? হতাশা ঝরে পড়ে তার গলায় লাগিয়ে আর হবেটা কী? এখানকার কাজ তো শেষ আমাদের। সব মালপত্র নিয়ে সামনের সপ্তাহেই তো আমরা নাঁদগাও চলে যাব।
বলি–তাহলে আমাকে নাঁদগাও নিয়ে চলুন। আমি ওখানে যেতে রাজি আছি।
বলেন তিনি–পাগল নাকি। এখানে কাজ চলছিল তাই পাঁচ সাতটা লোকাল ছেলে রাখা হয়েছিল। এখান থেকে লোক নিয়ে গেলে নাঁদগাওয়ের লোক কী করবে? লোকাল লোক সাথে না রাখলে ভালোভাবে কাজ তুলতে পারব? সব ঝামেলা পাকাবে না?
আমার আর তখন বলার মত কোন কথা, করার মত কোন কিছু রইল না। রইল শুধু হাতে ধরা একখানা এম.এল.এ সাহেবের চিঠি। যা একদিনের ব্যর্থ প্রয়াসের একটা সকরুণ স্মৃতি বাহক।
.
কী ভাবে যে একটা বছর কেটে গেল তা জানি না। তবে কেটে গেল। একদিন কাঁকেরের রত্নেশ্বর নাথ আমার কাছে খবর পাঠালেন-ব্যাপারীজি বহুত জরুরি কাম হ্যায়, আপ জিতনা জলদি হোসকে কাকের আইয়ে। আপ আনে পর মার্গ ব্যায়কা সারি খর্চাকা প্রবন্ধ ম্যায় উঠাউঙ্গা। তাই যেতে হল কাঁকেরে। তখন বলেন তিনি–এবার একতা পরিষদ ২রা অক্টোবর গান্ধী জয়ন্তীর দিন কাকেরের মসজিদ ময়দানে জল জঙ্গল জমিন হো জনতাকে অধীন এই দাবিকে সামনে রেখে একটা সমাবেশ করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যে সমাবেশে শহীদ শংকর গুহ নিয়োগীকে স্মরণ করা হবে। এই সমাবেশে যোগ দিতে দিল্লী থেকে গান্ধী পিস ফাউন্ডেশনের অধ্যক্ষ পি.ভি. রাজগোপালন আসবেন। এই সমাবেশ সফল করার জন্য আপনার সহযোগিতা চাই।
বহু গণ সংগঠনের মত একতা পরিষদও ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চার একটি সহযোগী দল বা সংগঠন। মূলতঃ এরা বস্তার জেলার আদিবাসী সমস্যা নিয়ে মিটিং মিছিল সভা সমাবেশ করে থাকে। কাঁকের শহরের আশেপাশের কিছু অঞ্চল এদের ভালো কর্মী সমর্থক আছে। যে কারণে এরা এই শহরে যে কোন দাবি দাওয়ার জন্য প্রচুর জনসমাবেশ করতে পারে। যা কোন ভোট রাজনীতির পার্টি পারে না। এরা গত ২৮শে সেপ্টেম্বর নিয়োগীজির মৃত্যুর দিন ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চার–”শহীদ দিবস” পালন সমাবেশে যোগ দিতে দল্লী গিয়েছিল। আমরা যারা বস্তার জেলার নিয়োগী অনুগামী–তাদের একতা পরিষদের কার্যসূচিতে সক্রিয় অংশ নেবার একটা দায় অবশ্য পালনীয় কর্তব্যের মধ্যে এসে গেছে। কথা কিছুটা ২৮শে সেপ্টেম্বর হয়েছিল। তখনই রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। দুদিন পরে বিধিবদ্ধ আমন্ত্রণ পত্র এসে গেল।
আমি কোন নেতা নই। সে আমি কোনদিন হতেও পারব না। একদিন বলেছিলাম সে কথা ডাঃ শৈবাল জানাকে–আমি সেনাপতি নই। সেনাপতি হবার দক্ষতা যোগ্যতা কোনটাই আমার নেই। আমি একজন সৈনিক-ভালো সৈনিক। আমার কাজ শুধু সেনাপতির নির্দেশ পালন করা। সঠিক বেঠিক সফল বিফল সব দায় থাকবে তার। আমার নয়। নিয়োগীজি ছিলেন সেই সেনাধ্যক্ষ। ওনার অবর্তমানে আমার অবস্থা হাল ভাঙা পাল ছেঁড়া কান্ডারি বিহীন নৌকো যাত্রীর মতো। রত্নেশ্বর নাথ একজন দক্ষ সংগঠক। কিন্তু আমার নেতা হবার মতো তার কোন গুণ নেই। আর মতাদর্শের ক্ষেত্রে রয়েছে আকাশ পাতাল প্রভেদ। আমি একজন মার্কসবাদের ছাত্র বলে মনে করি নিজেকে। আর তার সব আন্দোলনের প্রেরণা মহাত্মাগান্ধী। সে মঞ্চে বসে বক্তৃতা দেয় আমি মিছিলে হাঁটি। সে থানা তহবিল কোর্টের সামনে গিয়ে ধর্না দেয় জেলে যাবার জন্যে। আর আমি না যাবার জন্যে লুকিয়ে থাকলে পুলিশ খুঁজে ধরে নিয়ে যায়।
তবু রত্নেশ্বর নাথ যখনই আমাকে ডাকে কাকের যাই। আগেও এসেছি, আজও এলাম। না এসে আর যাবই বা কোথায়। আর কেউ তো এ জেলায় নেই যে নিয়োগীজির আন্দোলনের শরিক হয়েছে। তা ছাড়া লোকটা তো লড়ছে আদিবাসী মানুষদের জন্যে।
আমি আগেই বলেছি–নেতা নই। একজন অনুগত কর্মী। প্রয়োজনে বক্তৃতা দিই, প্রয়োজনে পোষ্টার মারি। সেদিন ১ অক্টোবর রাতে সাত আটজন আদিবাসী ছেলেকে সাথে করে তাই করছিলাম। সারা শহরময় পোষ্টার মারছিলাম। এই শহরটা খুব বেশি বড় নয়। আর খুবই ছিমছাম সজাগ আর প্রাণচঞ্চল। এমন প্রাণবন্ত শহর আমি দ্বিতীয়টি দেখিনি। এ শহর সারারাত জেগে থাকে, একটুও ঘুমায় না। রাতভর এখানে সব দূর পাল্লার বাসগুলো এসে থামতে থাকে। যাত্রীরা নামে–ওঠে। তাদের জন্য জেগে বসে থাকে বাসস্ট্যান্ডের হোটেল রেস্টুরেন্ট ও অন্য দোকান পাট।
আমরা বরদে ভাটা নামক স্থান যেখানে একতা পরিষদের অফিস, সেখান থেকে পোষ্টার মারা শুরু করে, পাকা রাস্তা ধরে এসে দুধ নদীর ব্রিজ পার হয়ে বাসস্ট্যান্ড তারপর মসজিদ ময়দান পিছনে ফেলে চলে গিয়েছিলাম শহরের আর এক প্রান্ত পাঞ্জাবি ঢাবা পর্যন্ত। প্রায় মাইল চারেক লম্বা পথের দু পাশের দালান দেওয়ালে, আগামী কাল বিকেল চারটেয় সমাবেশের বার্তা জানিয়ে পোষ্টার লাগিয়ে আমরা যখন ফিরে আসছিরাত তখন প্রায় দুটো। তখন দেখি, বাসস্ট্যান্ডে ঢোকার ঠিক মুখটায় যে ডেকরেটস দোকান সেখান থেকে খান আট দশেক চেয়ার নিয়ে ফুটপাতে পেতে বসে আছে আট দশজন লোক। এরা সব সঁকের কংগ্রেসের কর্মী। কালভোরে এরাও গান্ধীজির জন্য কিছু একটু করবে বলে ভেবে রেখেছে। কমপক্ষে বাসস্ট্যান্ডে একটা পতাকা দুটো ফুল একটু শ্লোগান টোগান। রাত্রে বাড়ি গিয়ে শুয়ে পড়লে ভোরে যদি ঘুম না ভাঙে–সেই ভয়ে রাত জাগছে। সকালে পতাকা টতাকা তুলে একবারে গিয়ে শোবে। এদের মধ্যে একজন লোক–যার আফ্রিকান বক্সারের মত চেহারা। সে হাত তুলে ভারি গলায় আমাদের ডাকল–এ ইধার আ। ডাকের ভঙ্গিটা আমার কাছে বড় অপমানজনক–তুচ্ছ তাচ্ছিল্য বলে মনে হল। থানার অফিসারও আমাকে আপনি বলে। কিন্তু কে লোকটা? সে আমাদের ডাকছে কেন? আমরা কোন অন্যায় করছি না। পোষ্টার মারছি। মারতেই পারি–শহর তো কারও বাপের সম্পত্তি নয়। তাহলে? আমাদের সাথের একটা ছেলে লোকটাকে চেনে। সে ভীত গলায় বলে–দাদা চলো ভাগ চলো। এ আদমি শহরকা সবসে বড়া ‘দাদা’। রবি শ্রীবাস্তব নাম উসকা। অরবিন্দ নেতমকা ডায়া হাত।
ছত্তিশগড়ে দাদা শব্দের অর্থ মাস্তান বা গুন্ডা। আর অরবিন্দ নেতাম হচ্ছে কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী। আগে ইন্দিরা গান্ধীর বড় স্নেহভাজন ছিল। এখন রাজীব গান্ধীর। বড় বড় চোখ, কালো আর দৈত্যাকার চেহারার এই লোকটাকে ভয় না পায় এমন লোক এই শহরে একজনও নেই। আমি রবি শ্রীবাস্তবের নাম শুনেছি, দেখছি এই প্রথম। রবি শ্রীবাস্তবও আমাকে চাক্ষুস দেখেনি। ছবিতে দেখেছে খবরের কাগজের পাতায়। অমৃত সন্দেশ পত্রিকার সাংবাদিক সুশীল শর্মা–যে আমাকে নিয়ে প্রতিবেদন লিখেছিল, সেও এখানে বসে আছে। সে-ই রবি শ্রীবাস্তবকে বলে দিয়েছে–ওই যে সেই মনোরঞ্জন ব্যাপারী। তারই ফলে ওই ডাক-ইধার আ।
অরবিন্দ নেতামের ডান হাত রবি শ্রীবাস্তব আর তার ডান হাতের নাম কোহলিয়া। কোহলিয়া শব্দের অর্থ শেয়াল। তার আসল নাম জিতেন্দ্র সিং। কাকের রোডওয়েজের সুপার ভাইজার এই জিতেন্দ্র সিং একখানা ছোটগাড়ি নিয়ে শেয়ালের মত জঙ্গলে লুকিয়ে থাকে। বাসের ড্রাইভার কন্ডাক্টর কিছু বোঝার আগে সে জঙ্গল থেকে শেয়ালের মত ক্ষিপ্রতায় বের হয়ে বাসের সামনে এসে দাঁড়ায়। তারপর বাসে উঠে চেকিং করে কোন যাত্রীর কাছ থেকে পয়সা নিয়ে টিকিট দেওয়া হয়নি। এখানকার আইন একটু অন্যরকম, বিনা টিকিটে যাত্রী ধরা পড়লে, যাত্রীর নয়, জরিমানা দিতে হবে কন্ডাক্টটরের। এরাই তার নাম দিয়েছে কোহলিয়া। কোহলিয়া রবি শ্রীবাস্তবের সাথে পার্টনারশিপে কন্ট্রাকটারিও করে। বাধ ব্রিজ রাস্তা, রাজনৈতিক প্রভাব খাঁটিয়ে এরা কন্ট্রাক্ট নিয়ে অন্য কাউকে সাবকন্ট্রাক্ট দিয়ে দেয়। কোহলিয়ার আর একটা শখ নারী শিকার। যদি জঙ্গল পথে একা কোন আদিবাসী যুবতী পেয়ে যায়-তার উপর শেয়ালের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে। বোকাসোকা আদিবাসী জানে না এমন অবস্থায় কার কাছে গেলে ন্যায় বিচার পাবে। পুলিশ তো তাদের কথা শোনে না। প্রভাবশালী পয়সাঅলারা যা বলে তা-ই শোনে।
এখানে একটি ঘটনার কথা বলা বোধহয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে বস্তার জেলায় পিপলস ওয়ার গ্রুপ সর্বপ্রথম যে ল্যান্ডমাইনটির বিস্ফোরণ ঘটায় যাতে আঠার জন পুলিশ কর্মী একজন ড্রাইভার ও অন্য একজন মারা যায়–যা নিয়ে আমার গল্প “পথ যেখানে পৌঁছাল”তার সূত্রপাত হয়েছিল একটি ধর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। এক ধর্ষিতা আদিবাসী কন্যা গর্ভস্থ সন্তান নিয়ে পুলিশের কাছে সুবিচার চাইতে গিয়েছিল। বিচার পায় না, বিদ্রূপ পায়। এরপর সে চলে যায় “দাদা”দের কাছে। তারা এসে ধর্ষককে গুলি করে মেরে দেয়।মৃতের ভাই থানায় যায়। এবার কিন্তু পুলিশ আসে। আসবে যে সে যারা জানত তারা পথে ল্যান্ডমাইন পুতে রাখে। আর তাতেই–। আমি অবশ্য এ সব পত্র পত্রিকায় পড়েছি সত্যি কী তা জানিনা।
তবে এটা সত্যি যে ভানপুরী নামে একটি আদিবাসী গ্রামের মেয়ে ক্লাশ নাইনের ছাত্রী দময়ন্তী বিকেল বেলা একা স্কুল থেকে ফিরে যাচ্ছিল, বাড়িতে রোজ যেমন যায়। সেদিন তার দুই সঙ্গী নিয়ে দময়ন্তীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল কোহলিয়া। জোর করে তাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে গিয়ে ছিল দূরে-ঘন জঙ্গলে তিনজনে সারা রাত ধর্ষণ করে অর্ধচেতন অবস্থায় তাকে ভোর বেলায় নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিল গ্রামের কাছে। প্রতিবারই ওরা এসব করে পার পেয়ে গেছে। ভেবেছিল এবারও বিশেষ কিছু হবে না। দময়ন্তীর বাবা একজন স্কুল শিক্ষক। সে মেয়েকে নিয়ে থানায় যায়। কিন্তু থানা কোহলিয়ার নাম শুনে আর কেস নেয় না। শিক্ষককে পরামর্শ দেয় কোন ঝামেলা না
পাকিয়ে চেপে যান। কারণ তাতে ঝামেলাই হবে–কোন লাভ হবে না। তখন দময়ন্তীর বাবা যায় রত্নেশ্বর নাথের কাছে।নাথ তাকে প্রতিশ্রুতি দেয় অবশ্যই দময়ন্তী ন্যায় বিচার পাবে। এর জন্য সে ব্যাপক গণআন্দোলন সংগঠিত করবে। যতক্ষণ ধর্ষণকারী গ্রেপ্তার না হয় আন্দোলন জারি থাকবে। এবং সে তাই করে। আমাকেও খবর পাঠানো হয়। খবর পেয়ে আমি এসে এই আন্দোলনে যোগ দেই। কাঁকেরে মিছিল করা হয় মিটিং করা হয় এবং থানা ও কোর্টের সামনে ধর্ণায় বসি। ছত্তিশগড়ের সবকটা দৈনিক পত্রিকার কল্যাণে “দময়ন্তী বলকার কাণ্ড” জেলার এক আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা হয়ে যায়। আমাদের আন্দোলনের চাপে শেষ পর্যন্ত পুলিশ কোহলিয়াকে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হয়।
এই সময়–যখন আমরা ককেরে দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছিলাম, তখন রবি শ্রীবাস্তব এখানে ছিল না। চেম্বার অফ কমার্সের অধ্যক্ষ-কাকের শহরের “রতন টাটা” বর্মা লাল খটবানিকে শারীরিক নিগ্রহের অভিযোগে কোর্টের বিশেষ আদেশে এক বছরের জন্য “জেলা বদর” সাজা খাটছিল। সম্প্রতি তার সাজার সময় সীমা পার হয়ে গেছে তাই ফিরে এসেছে নিজের পুরাতন ঘাটিকাকেরে।
রবি শ্রীবাস্তব এখন আমাকে ডাকছে। শারীরি ভাষ্যে বোঝা যাচ্ছে চা বিস্কুট খাওয়াবে বলে ডাকছে না। এরই প্রধান শাগরেদকে জেলখানায় পাঠানোয় একটা বড় ভূমিকা ছিল আমার। যে কারণে আমার উপর রাগ থাকা স্বাভাবিক। এখন এই রাতে যদি মারে আমাকে কে বাঁচাবে?
এই ভাবনা মনের মধ্যে স্থায়ী হয়েছিল মাত্র পাঁচদশ সেকেন্ড। পরক্ষণে স্থির করে নিলাম–পালাব না। ডাকছে যখন সামনেই যাব। জীবনে এমন অনেক ঘটনা আছে যার সামনে সাহস করে গিয়ে দাঁড়াতে পেরেছিলাম বলেই জয়ী হয়েছিলাম। আর আজ যদি পালাই সে পলায়ন তো শুধু এই সময়ের মধ্যে এই স্থানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না একটা চিরস্থায়ী মানসিক পলায়নের চিহ্ন হয়ে যাবে। যা আমার সুনামের গায়ে কালো দাগ হয়ে থাকবে। আমি বস্তার জেলায় রাজনীতি করি। আমার কর্মাঞ্চলে যে কোন সমস্যা তা নিয়ে শেষ লড়াই লড়তে হবে তো এই কাঁকেরে এসেই। যা কিছু সরকারি দপ্তর সবই তো এখানে। তখন তো সবল ও আক্রমণাত্মক প্রতিপক্ষের মুখোমুখি দাঁড়াতেই হবে। তাহলে তখন যদি দাঁড়াতে পারি–এখন পারব না কেন? এখন না পারলে তখন পারব কী করে? কী করতে পারে ওরা এখন আমার? খুব বেশি হলে মারবে। কিন্তু তারপর? কাল কী হবে? কাল যখন মসজিদ ময়দান থেকে গর্জন উঠবে তার বিরুদ্ধে, কোথায় যাবে সে? যাতে আমার লোকসানের চেয়ে লাভের পাল্লা ভারি হবে। বস্তার জেলার আদিবাসীদের মধ্যে কাজ করে আর একটি সংগঠন–ভারত জন আন্দোলন। এর অধ্যক্ষ ড. ব্রহ্মদেও শর্মা। তার কাজে বিজেপির স্থানীয় নেতারা বেজায় খাপ্পা। তারা একদিন জগদ্দলপুরে ওনাকে ধরে জামা কাপড় সব ছিঁড়ে দেয় আর আন্ডার ওয়ার পড়িয়ে গায়ে গোবর জল ঢেলে শহরময় ঘোরায়। সে ছবি পত্র পত্রিকায় ছাপা হয়ে যায়। আর তখন সারা দেশে ছিঃ ছিঃ ধ্বনি ওঠে। দিল্লীতে স্বামী অগ্নিবেশের নেতৃত্বে চারশো জন বুদ্ধিজীবি পার্লামেন্টের সামনে বিক্ষোভ দেখায়। যারা কোনদিন ব্রহ্মদেও শর্মার নাম জানত না তারাও জেনে যায়। তখন অটল বিহারি বাজপেয়ি দলের কর্মীদের এহেন আচরণে ক্ষমা চেয়ে নেন। যারা মেরে ছিল তারা নয়, জয়ী হয় সে যে মার খেয়েছিল। রাজনীতিতে কখনও কখনও মারার চেয়ে মার খাওয়া বেশি লাভদায়ক হয়। তাই দৃঢ় পায়ে এগিয়ে যাই রবি শ্রীবাস্তবের সামনে–বোলিয়ে ক্যা বাত হ্যায়, কাহে বুলা রহে হামকো?
–তেরা নাম মনোরঞ্জন ব্যাপারী?
–জি হা, মেরা হি নাম।
–কাপসী রহতা হ্যায়?
–জি, রহতা হু।
সেই গরগর করা গলায় বলে সে–ইতনা রাত কো ইহা ক্যা কর রহা।
–ও তো আপ দেখহি রহে হ্যায় ক্যা কর রহা হু।
সুশীল শর্মা মাথা নিচু করে মুখ টিপে হাসছে। এই সবকিছুর নাটের গুরু সে-ই। রবিশ্রীবাস্তবকে আমার পিছনে ও-ই লেলিয়ে দিয়েছে। আমার বিষয়ে যা কিছু তথ্য সে-ই যোগান দিচ্ছে। অন্য যারা বসা সবার চোখে নাচছে কৌতুক। আমার হেনস্থায় তারা বড় মজা পাচ্ছে। তবে আমিও বরিশালের বাঙাল। জানি, আমি যত ভয় পাবো ওরা তত মজা পাবে। তাই ভয় পাওয়া আমার চলবে না।
জানতে চায় রবি শ্রীবাস্তবকেইসে? তুম কোহলিয়া কো জেলমে ভেজা থা?
মাথানাড়ি আমি-না।
–না? ভানুপুরীতে মিটিং কে করেছে, ভাষণ কে দিয়েছে? কোর্টের সামনে ধর্নায় কে বসেছে?
–আমি।
–তাহলে কে পাঠাল ওকে জেলে?
খুব ধীরে ধীরে শান্ত মাথায় ঠান্ডা গলায় প্রতিটা বাছাই করা শব্দের উপর সতোর জোর দিয়ে অবিচলিত ভাবে বলি–সাহেব, আমি কোন কোহলিয়া মোলিয়াকে চিনি না। আর চিনতে চাইও না। একটি আদিবাসী মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়েছে। যে ধর্ষণ করেছে সে অন্যায় করেছে। তার শাস্তি হওয়া উচিৎ। সেই জন্যে আমি লড়েছি। এবং আবারও যদি এমন ঘটনা ঘটে আমি আবারও লড়ব। নিয়োগীজি আমাদের সেই শিক্ষা দিয়ে গেছেন। সমাজে দুর্বল অসহায় মানুষের পাশে যদি না দাঁড়াই তবে রাজনীতি করব কেন?
এবার রবি শ্রীবাস্তব আমাকে এবং আমার সঙ্গীদের বসবার জন্য চেয়ার দেন। চা আনায়। উইলস সিগারেটের প্যাকেট সামনে বাড়িয়ে দেয়। গলার স্বর চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিক হয়ে আসে। বলে–আচ্ছা দাদা, একটা জিনিস কিছুতে আমার মাথায় আসে না, একটু বুঝিয়ে বলো তো, পারাল কোটে যত বাঙালী আছে সব তো বাংলাদেশের লোক। মুসলমানরা তাদের তাড়িয়ে দিয়েছে। কংগ্রেস সরকার তাদের এখানে নিয়ে এসেছে। ঘরবাড়ি জমি জায়গা সব কিছু দিয়েছে। তবু বাঙালীরা কংগ্রেসকে কেন ভোট দেয় না? নারানপুর বিধানসভার সিটে বারবার আমরা হেরে যাই। আর কিছু না করে বিজেপি জিতে যায় এটা কেন?
রবি শ্রীবাস্তবের পিছনে বসা জগদীশ মিশ্রা আমাকে তাতিয়ে দেবার চেষ্টায় বলে-বাঙালী লোকেরা স্বভাবে বেইমান। তারা যে থালায় খায় সেই থালায় ছিদ্র করে। রবি শ্রীবাস্তব মাস্তান বা গুন্ডা হলেও মাথা মোটা–অশিক্ষিত মুখ লোকনয়। রবি শংকর বিশ্ব বিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্র। সবাই বলে সে যদি জেলা বদর না হতো বস্তারের জেলাশাসক হতে পারত। ওই একটা কালোদাগ তার সরকারি চাকরির পথে বাধা হয়ে গেছে। তবে সে একদিন রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নিজের যোগ্যতায় কাঁকের নগর পালিকা পরিষদের অধ্যক্ষ হয়ে গিয়েছিল। সে কিছুদিন পরের কথা। আর তার কিছুদিন পরে মাওবাদীদের হাতে মার্ডার হয়ে যায়।
এখন তার প্রশ্নের ধরন দেখে বুঝতে পারি–কোন হালকা, চটুল, চট জলদি উত্তর দিয়ে তার জিজ্ঞাসাকে শান্ত করা যাবে না। সে চেষ্টা করাটাও সঠিক নয়। তাই ধীরে ধীরে একজন শিক্ষকের মত কথা বলা শুরু করি। সতর্ক থাকি কোনভাবে যেন মাথা গরম করে না ফেলি। তাহলে কোন ভুল পথে চলে যাব। জগদীশমিশ্রার উস্কানিমূলক বাক্য গায়ে না মেখে বলি-বাঙালী মানসিকতাটা বুঝতে হলে আপনাকে সেই অবস্থার মধ্যে গিয়ে পড়তে হবে। না হলে বোঝা যাবে না।
রবি শ্রীবাস্তবের চোখে চোখ রাখি–আচ্ছা সাহেব, আপনি এই কাকের শহরে থাকেন। এটা কলকাতা বোম্বাই দিল্লীর মত বড় শহর নয়। এই মাটি জল হাওয়ায় আপনি বড় হয়েছেন। এখানকার সব কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আপনার অনেক সুখ দুঃখের গভীর স্মৃতি। তা ধরুন আপনাকে এখান থেকে উৎখাত করে নিয়ে গিয়ে ফেলে দেওয়া হল অবুঝ মাড় বা অন্যকোন গহীন জঙ্গলে আদিবাসী মানুষদের মাঝখানে। সেখানে আপনাকে পাঁচসাত একর ককর পাথর মেশানো জমি দেওয়া হবে। যে জমিতে বৃষ্টির জল ছাড়া চাষ হবে না। চাষ হলেও তেমন ফসল হবে না। সেখানে আপনাকে থাকার জন্য একটা ঘর দেওয়া হবে, গরু দেওয়া হবে, এখানকার রিফিউজিরা যাযা পেয়েছে সব দেওয়া হবে। আর সেখানে পাহারা বসিয়ে বাধ্য করা হবে আপনাকে থাকতে। বলে দেওয়া হবে আপনি কোনদিন কাকেরে আসতে পারবেন না। পারবেন সেখানে থাকতে? আর যে আপনাকে এই রকম জীবন যাপনে বাধ্য করেছে যদি বলা হয় তাকে ভালোবাসো তার কথা শোনো সে তোমার বন্ধু, মানবেন সে কথা? পারবেন ভালোবাসতে?
আপনি এক বছর জেলা বদর হয়েছিলেন। নিজের মাটি নিজের মানুষ থেকে দূরে থাকার যে যন্ত্রণা তাতে আপনার অজানা নয়। বাঙালীরা পঁচিশ তিরিশ–কেউ কেউ তার চেয়েও বেশি বছর “দেশ বদর” প্রদেশ বদর হয়ে রয়েছে। এর জন্য তারা কংগ্রেস পার্টিকেই দায়ী বলে মনে করে। কংগ্রেসের নেতারা যদি দেশ ভাগের শর্তে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাবে রাজি না হতো, তাদের জীবনে এত বড় দুর্ভোগ কখনই আসত না। এই কারণে তারা কংগ্রেসকে ভোট দেয় না। কংগ্রেসের প্রতি তাদের এই কারণে যেমন রাগ, মুসলমানদের উপরেও একই কারণে রাগ-তারা দেশভাগের দাবি তুলে দাঙ্গা করেছিল। সেই আতঙ্কে এরা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। সেই রাগ তাদের কোনদিন যাবার নয়। যে কারণে কিছু না করা সত্বেও এরা বিজেপিকে ভোট দেয়। কিছু না করাটাই তাদের একটা গুণ হয়ে গেছে।
–কিন্তু তাদের এই সমর্থন তো দেশের পক্ষে একটা আরও বড় বিপদ হয়ে আসছে। যে পথে বিজেপি চলছে দেশটা তো আর একবার ভাগ হয়ে যাবে। তোমার কী মনে হয়?
বলি আমি–সেই কথাগুলো ধৈর্য ধরে বাঙালীদের কে বোঝাবে? বোঝাবার জন্য কেউ তো তাদের কাছে কোনদিন যায়নি। যায় শুধু একবার ভোটের সময়। অন্যদলের কথা জানি না তবে বাঙালীদের বিজেপি মোহ থেকে মুক্ত করতে সব চেয়ে সুবিধাজনক স্থানে ছিল সিপিএম পার্টি। যদি তাদের হাতে ওই রক্তের দাগটা না থাকত। তারা মরিচঝাঁপিতে যে ঘটনা ঘটিয়েছিল তা আজও মানুষের মনে দগদগে হয়ে আছে। সে দাগ সহজে মুছে যাবার নয়।
–তাহলে কী চিরদিনের জন্য ওই সিট বিজেপির থেকে যাবে?
–না, তা হবে না। শুধু সেই কটা দিন—যতদিন দেশভাগ আর আর মরিচঝাঁপির ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলো মরে মুছে না যায়। এরপর যে নতুন প্রজন্ম আসবে–যারা ওই দুটো দ্বারা প্রভাবিত নয়, তাদের মধ্যে যদি যত্ন আর ধৈর্য নিয়ে চেষ্টা চালানো হয় আগামীতে বিজেপির হাত থেকে ওই সিট কেড়ে নেবার একটা পথ হলেও হতে পারে।
এরপর কারও মুখে কোন কথা নেই। সব চুপ। ওরা আমার চেহারা পোষাক দেখে যতটা অজ্ঞ ভেবেছিল ততটা যেনই সে প্রমাণ করে দিয়েছি। তখন আবার বলি–নিয়োগীজি পারালকোট থেকে মাত্র একশো মাইল দূরে থাকতেন। উনি যাননি। যাননি বললে ভুল হবে, গিয়ে সব দেখে শুনে ফিরে এসেছিলেন সেই বাহাত্তর তেহাত্তর সালে। উনি তখন বুঝেছিলেন যে বর্তমান সময়ে বাঙালীদের যে মানসিক আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি, তাদের এই মুহূর্তে সমাজ বদলের দীর্ঘস্থায়ী লড়াইয়ে অংশ গ্রহণ করা অসম্ভব। এদের যা হোক আর যেমন হোক একটা ঠিকানা তো হয়েছে। কিন্তু মানসিক পুনর্বাসন হয়নি। যেখানে তার বাস সেই সমাজ সংস্কৃতির সঙ্গে তার গভীর নিবিড় কোন যোগ নেই। তাদের এখানকার মানুষ মাটি পাহাড় জঙ্গলের প্রতি কোন টানও নেই। এদের ঘুমে জাগরণে একটাই আশা একটাই স্বপ্ন স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। সে স্বদেশ বাংলাদেশ। আর নিয়োগীজির স্বপ্ন ছিল শোষণ মুক্ত এক নয়া ছত্তিশগড়ের নির্মাণ। নয়া ভারতের জন্য নয়া ছত্তিশগড়ের নির্মাণ। তাই নিয়োগীজি আর পারালকোটের বাঙালীদের মধ্যে কোন সেতু তৈরি হয়নি। তা যদি হতে পারত তাহলে নারানপুর বিধানসভায় বিজেপি জিততে পারত না। সে-ই জিততে নিয়োগীজি যাকে জেতাতে চাইতেন।
তারপর আলোচনা অন্যদিকে বেঁকে যায়। সে আলোচনায় ছত্তিশগড়ের বিকাশ নকশাল সমস্যা, এন.জি.ওদের ভূমিকা নানা বিষয় উঠে আসে। এভাবেই রাত ফুরিয়ে যায়। তখন বলে রবি শ্রীবাস্তব–দেশ দুনিয়ার তো অনেক কথা হলো, এবার তোমার নিজের কথা কিছু বলো। কাজকর্ম কী করো, সংসার খরচ কী করে চলে?
বলি–চলে না।
–তার মানে!
–চলে না, এর মানে তো চলে নাই হয়।
–তাহলে খাও কী?
–হাওয়া খাই জল খাই, আর যারা আমাকে পছন্দ করে না তাদের খিস্তি খাই।
সেদিন আমি রবি শ্রীবাস্তবের কাছে সত্যি কথা বলিনি। সত্যি কী আর মানুষ জল হাওয়া খেয়ে বেঁচে থাকে। তবে সত্যি এটাই যে তখন সংসার আর চলছিল না। দোকানে তো দু একটা পেন দু একটা খাতা ছাড়া বেচবার মত বিশেষ কোন মাল ছিল না। তবে আমার স্ত্রী অনু তখন নিজের চেষ্টাতে অঙ্গনওয়াড়ি শিক্ষাকেন্দ্রে একটা কাজ যোগাড় করে নিয়েছিল যাতে বাচ্চাদের চার ঘন্টা পড়াবার বিনিময়ে মাসে আড়াইশো টাকা ভাতা পেত। এই কাজটা করার জন্য তাকে রোজ সকালে দশ কিলোমিটার পথ সাইকেলে পাড়ি দিয়ে ইরিকভুট্টা গ্রামে যেতে হতো। আর দুপুরের রোদে ফিরতে হতো দশ কিলোমিটার সাইকেলে। সেই পয়সায় চলছিল চারটে পেট। তবু একে নিশ্চয় হাওয়া বলা চলে না।
বলে রবি শ্রীবাস্তব–কোন চাকরি বাকরি করো না কেন? সংসারটা ঠিকঠাক রেখে বাদবাকি সময় দেশ জনগণ এসবের সেবা করলে ভালো হয় না?
-সে তো হয়, কিন্তু চাকরি পাবো কোথায়? আমার তো কোন সোর্স নেই। কে দেবে আমাকে চাকরি?
–আমি দিতে পারি। অবশ্য যদি তুমি করো, আমি তোমাকে একটা চাকরি দেবো। বলো করবে আমার কাছে চাকরি?
–আমি তো তেমন লেখাপড়া–মানে কোন ডিগ্রি নেই আমার।
–ডিগ্রি চাই না। আমি কাজ চাই।
–কী কাজ?
–তোমাকে সেই কাজই দেওয়া হবে যা তুমি পারো। করবে?
–একটু ভেবে দেখি তারপরে বলবো।
-–ঠিক আছে, সবদিক ভেবে দেখে তবেই বোলো৷ যেদিন বলবে তারপর দিনই কাজ। তবে আমার একটা শর্ত থাকবে–যতক্ষণ আমার কাজে থাকবে ইনকিলাব বলা চলবে না। তা যদি ইচ্ছা হয় আগে চাকরিটা ছেড়ে পথে এসে দাঁড়াবে–তারপর যত ইচ্ছা ইনকিলাব করবে।
আমার ভীষণ অভাব। কাজ তো আমার একটা দরকার। কী করব? কথা বলি নাজিব কুরেশি রত্নেশ্বর নাথ আর বিষ্ণু প্রসাদ চক্রবর্তীর সাথে। এই তিনজন কাকেরে আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ। মোটামুটি ভাবে তিনজনের এককথা–চাকরি পাওয়াটা খুব কঠিন। তবে ছাড়া কোন কঠিন কাজ নয়। আগে তো ঢুকে পড়ো, তারপর দেখো। যদি ঠিক লাগে–করবে। অসুবিধা দেখোচলে আসবে। আমাদের তো তেমন কোন সুযোগ নেই, যাতে তোমাকে কোন সহায়তা দিতে পারব। ও যখন দিচ্ছে নিয়ে নাও। আপাতত টিকে থাকো, পরে যা হয় দেখা যাবে।
একদিন সকালে অবশেষে গিয়ে হাজির হলাম রবি শ্রীবাস্তবের বাড়িতে। কাকের বাসস্ট্যান্ডের উল্টোদিকেই বিশাল বাড়ি। কিছুক্ষণ বসার ঘরে অপেক্ষা করার পর সে একটা চিঠি লিখে আমার হাতে দিয়ে বলল–এটা নিয়ে ভানু প্রতাপপুরে চলে যাও। ইরিগেশান ডিপার্টমেন্টের এস.ডি.ও বার্মা সাহেবকে দেবে। কোর্টের পাশেই তার কোয়ার্টার। হয় সেখানে নয় অফিসে যেখানে থাকুক চিঠিটা দিয়ে বলবে কাল থেকে যেন কাজে লাগিয়ে নেয়। ওখানে কিছুদিন থাকো, সময় হলে আমি তোমাকে কাকেরে টেনে নেব। যাও।
রবি শ্রীবাস্তবের এক চেলা আমাকে বাসে তুলে দিয়ে কন্ডাক্টরকে বলে দিয়ে গেল–রবি ভাইয়াকা আদমি, কেরায়া মাৎ লেনা। কাকের থেকে ভানুপ্রতাপপুর আটটাকা বাসভাড়া সেটা বেঁচে গেল। তখন সকাল নটা বাজে, বার্মা সাহেবকে পেয়ে গেলাম তার কোয়ার্টারে। চিঠি দিলাম তার হাতে, বললাম–রবি ভাইয়া বোলা কাল সে কাম মে রাখ লেনে কা। বর্মা সাহেব চিঠি পড়লেন। ভুরু কুঁচকে আমাকে দেখলেন তারপর বললেন–এক কাম করো, তোম এক তারিখ কো আ জানা। রবিজিকো যো ভি বাতানা হোগা ম্যায় বাতাদুঙ্গা।
রবি শ্রীবাস্তব বলেছিল আমি যেদিন আসব তার পর দিন থেকে কাজ। আর বর্মা সাহেব বলছে এক তারিখ। এর মানে পনের দিন পর। মাত্র পাঁচটা মিনিট দেরি হয়েছিল বলে পাখানজুরের কাজটা পাইনি। পনের দিন পরে কী হবে তা কে জানে! বর্মা সাহেবের হার্ট এ্যাটাক আসতে পারে, রবি শ্রীবাস্তব মার্ডার হয়ে যেতে পারে। বিশ্ব যুদ্ধ শুরু হতে পারে। তার চেয়েও বড় কথা আমার সেদিন আসার জন্য বাস ভাড়া না-ও থাকতে পারে। তাই কাতরতা ফুটে ওঠে আমার গলায়। বর্মা সাহেবকে বলি রবি ভাইয়া কালসে লাগালেনেকা বোলা।
ওতো চিঠিমে ভি লিখা। বলে বর্মা সাহেব–মাহিনাকা বিচমে কেইসে ভাউচার বনেগা! এইসা তো নেহি হোতা না। তোম এক তারিখ কো আও।
আমি বাড়ি গেলাম না। ফের ফিরে গেলাম কাঁকেরে। আবার গিয়ে দেখা করলাম রবি শ্রীবাস্তবের সাথে। বর্মা সাহেব যা বলেছে জানালাম তাকে সব। তারপর রবি শ্রী বাস্তব আবার আর একখানা চিঠি লিখে আমাকে দিয়ে বলল–গিয়ে এই চিঠি বর্মা সাহেবকে দিয়ে বলবে, রবি ভাইয়া বলেছে, কালই এক তারিখ। আর পেমেন্ট শিটও পুরা তিরিশ দিনের হবে। আবার সেই চিঠি নিয়ে বর্মা সাহেবকে দিলাম। চিঠি হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। সম্ভবতঃ সেটা নিজের উপর ধিক্কারে। একজন সরকারি অফিসার তিনি। বলে দিয়েছিলেন–এক তারিখ। এখন সেই নিজের ফেলা থুতু আবার নিজে চেটে নিতে হবে। কী জঙ্গলের রাজত্ব। এক গুন্ডার কথায় তাকে চলতে হচ্ছে। উনি আমার মুখের দিকে তাকাচ্ছেন না। মনে হয় তাকাতে পারছেন না। মাথার উপর দিয়ে চেয়ে আছেন দূর আকাশের দিকে। সেই ভাবে বলেন তিনি–বাড়ি চলে যাও। কাপসীতে থাকো তো? সেখানেই চলে যাও। আর কাকের যাবার দরকার নেই। মনে কর কাল থেকে তুমি কাজে লেগে গেছে। কিন্তু আসবে সেই এক তারিখেই।
বর্মা সাহেবের কথামত বাড়ি চলে গেলাম। পনের দিন বাড়িতে কাটিয়ে পরের মাসের এক তারিখে ভানুপ্রতাপপুরে গিয়ে ভাউচার সই করে বিগত মাসের বেতন তুললাম প্রথমে। তারপরে যোগ দিলাম কাজে। সেই কাজ যা আমি পারি। পলাচুর নামক একস্থান যেখানে নদীর উপর একটা বাঁধ দেওয়া হচ্ছে একটি জলাধার তৈরি করার জন্য। যে জলে আশেপাশের চার পাঁচটি আদিবাসী গ্রামের জলকষ্ট নিবারণ হবে। নালা কেটে এই জল পৌঁছে দেওয়া হবে তাদের গ্রামে–চাষের জমিতে। এখানকার লেবারদের কাজ দেখাশোনা করতে হবে আমাকে। মাইনে মাসে সাড়ে সাতশো টাকা।
এই বাঁধ তৈরির ঠিকা কাগজ পত্র রয়েছে রবি শ্রীবাস্তবের নামে। কিন্তু সে সব ভার সমর্পণ করে দিয়েছে এস.ডি.ও বর্মা সাহেবকে। যা কিছু লেবার পেমেন্ট লুকিয়ে বর্মা সাহেব করে দেন। আমি গিয়ে ভানুপ্রতাপপুর থেকে সে টাকা নিয়ে আসি। হিসেব করে যার যা পাওনা বুঝিয়ে দেই। ররি শ্রীবাস্তবের সাথে বর্মা সাহেবের কী হিসাব নিকাশ আমি তা জানি না।
পলাচুর বাঁধটা যেখানে অবস্থিত তার কিছুটা সামনে ভানুপ্রতাপপুর থেকে চলে এসে পাখানজুরের দিকে চলে যাওয়া একটা পাকা রাস্তা আছে। যাতে সারাদিনে বার চারপাঁচ একটা বাস চলে। আর গোটা কয়েক জিপ ও ট্রাক আসা যাওয়া করে। মাত্র এইটুকু। না হলে বাঁধের পূর্বদিকে দু মাইলের মত দূরে দ্রুগ কোন্দল–ওখানেই যা কিছু জনসমাগম। এর পরে আর যে তিনদিক পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ পাঁচ ছয় কিলোমিটারের মধ্যে লোক বসতি নেই। চারদিকে ঘন জঙ্গল। সে জঙ্গলে রয়েছে প্রচুর জন্তু জানোয়ার। তবে তাদের চেয়েও বেশি ভয় জঙ্গলের জংলি মানুষদের নিয়ে। যাদের ভাষা অবোধ্য আচার আচরণ অদ্ভুত, ধর্মাচরণ ভীতিজনক। ভাষা হচ্ছে মানুষের মনের ভাব প্রকাশ করার বড় বাহন। এদের ভাষা না বুঝতে পারার কারণে মনের গতি প্রকৃতি রাগ দ্বেষ স্নেহ প্রেম আন্দাজ করা আমার মতো মানুষের পক্ষে খুবই মুশকিল। তবে এই সব কিছুর চেয়ে আর একটা ভয়–যে ভয়ে শাসন প্রশাসন সব কেঁপে যাচ্ছে তা হল নকশাল। পুরো ছত্তিশগড় এখন তাদের দখলে। ওরা যে কোন সময়ে বনরাজ্যের যে কোন জায়গায় হামলা করে দিতে পারে।
বিগত প্রায় তিরিশ বছর ধরে দণ্ডকারণ্যের ঘন জঙ্গলে নকশালদের একটা ঘাটি ছিল। পুলিশের হিসাবে মোট ১৩টা দল। যদি একটা দলে দশ জনও সদস্য থাকে তবে মোট একশো তিরিশ জন। চম্বলের ডাকাতের সংখ্যা এর অন্তত একশোগুণ বেশি। এখানকার ভৌগোলিক পরিবেশ এমন যে হাতে বন্দুক নিয়ে কেউ একবার জঙ্গলে ঢুকে গেলে প্রশাসনের পক্ষে তার টিকি ছোঁয়া মুশকিল। সেবিহড়ের বদমাশ বাগী বা বস্তারের আদর্শবাদী বিপ্লবী যে-ই হোক। তাই দণ্ডকারণ্যের বনে বিপ্লবীআদর্শবাদ বুকে পিডজির কিছু তরুণ আত্মগোপন করে বসেছিল। মাও সেতুং যতই বলুক–এটা বিশ্ব বিপ্লবের যুগ তবু ব্যাপক মানুষ তাদের পাশ গিয়ে দাঁড়াচ্ছিল না। কারণ-শোষণ বঞ্চনা অত্যাচার সব কিছু পরেও মানুষ শান্তিকামী। তারা খুনোখুনি রক্তপাত এ সবে ভয় পায়। চায়, শান্তিপূর্ণ উপায়ে আবেদন নিবেদনের মাধ্যমে তাদের সমস্যার সমাধান হোক। ফলে নকশালদের হাজার প্রয়াস সত্ত্বেও কিছুতে তাদের সংখ্যা বাড়াতে পারেনি। হঠাৎ কী যে হল তা কে জানে বছর খানেক হল তাদের সংখ্যা অস্বাভাবিক রকম বৃদ্ধি পেয়ে গেছে। এখন তাদের এত শক্তি বৃদ্ধি পেয়ে গেছে যে আর শুধু আত্মরক্ষা নয়–এগিয়ে এসে আক্রমণও করে দিচ্ছে। আগে পুলিশ তাদের খুঁজতে জঙ্গলে যেত। এখন তারা জঙ্গল থেকে পুলিশ খুঁজতে থানা ফাঁড়িতে চলে আসে।
হঠাৎ করে এত অল্প সময়ে কেন এই পরিবর্তন? তার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন বড়ে গাঁওয়ের আদিবাসী যুব নেতা “রবি টেইলর”–ছত্তিশগড়ের শ্রমজীবী মানুষের নয়নের মনি ছিলেন শংকর গুহ নিয়োগী।তিনি ভারতবর্ষের সংবিধান যে নাগরিক অধিকার দিয়েছে তারইমধ্যে থেকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে গণতান্ত্রিক পথ পদ্ধতির মধ্য দিয়ে অহিংস আন্দোলন করে মানুষের দুঃখ দুর্দশা যতটা দুর করা সম্ভব, তাই তিনি করতেন। যে কারণে ছত্তিশগড়ের কিছু বুদ্ধিজীবী তাকে বলত ছত্তিশগড়ের গান্ধী। শুধু সেই অপরাধে তাকে গুলি করে মারা হল। কোন অন্যায় করেননি–তবু মরতে হল। যারা তাকে মারল একজন অপরাধীরও কোন শাস্তি হল না। শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি দাওয়ার আন্দোলন-সরকারের পুলিশ আর শিল্প মাফিয়াদের গুন্ডারা বন্দুক দিয়ে দমন করল। এখন মানুষ যাবে তো কার কাছে যাবে? কার কাছে গিয়ে সে তার দুঃখ বেদনার কথা জানাবে? সরকার তো সাধারণ মানুষের কথা শোনে না। সে শোনে ধনবানদের কথা।
নিয়োগীজি মারা যাবার পর একটা বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল। চারদিকে নেমে এসেছিল একটা দিক দিশাহীন অন্ধকার। মানুষ তখন একটা অবলম্বন চাইছিল। মানুষ তো বাঁচতে চায়। তো সেই শূন্যতা পূরণ করল নকশালরা। অন্ধকারে আলো হয়ে দেখা দিল–মুমুর্ষ মানুষের অবলম্বন হল। তারা নিয়োগীজির উদাহরণ তুলে মানুষকে দেখালো–দেখো, শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পরিণতি কী হয়। অহিংস আন্দোলনের ভাষা এই সরকার বোঝে না। সে বোঝে বন্দুকের ভাষা। তাকে সেই ভাষায় বলল, ঠিক বুঝে যাবে। মার খাবার জন্য পিঠ পেতে রেখো না, মার তো অনেক খেয়েছো, এবার মারার জন্য বুক বেছে নাও। এমন লাঠি মারো যে পাঁজর ভেঙে যায়।
এখন মানুষ সেটাই করতে নেমেছে। যারা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তাদের জীবন তছনছ করতে আসছে, বারুদি সুরঙ্গ দিয়ে উড়িয়ে দিচ্ছে। মনে রাখা দরকার প্রথম বারুদি সুরঙ্গে বিস্ফোরণ ঘটে নিয়োগীজির মৃত্যুরই পরে। তার আগে নয়। উনি বেঁচে থাকলে এমন অবস্থা হয়ত আসত না।
পলাচুর বাঁধে যারা কাজ করে সবাই স্থানীয় আদিবাসী। আদিবাসীরা সরল সোজা মানুষ। তারা জানে না যে এখন মধ্যপ্রদেশ সরকারের ন্যূনতম মজুরি দৈনিক তেত্রিশ টাকা তেত্রিশ পয়সা। ফলে তাদের খাঁটিয়ে তেত্রিশ টাকা তেত্রিশ পয়সার কাগজে টিপছাপ নিয়ে ষোল টাকা হিসাবে মজুরি দেওয়া হয়। এটা নকশালপন্থীদের চোখে অপরাধ। আগে যে সাইড ইনচার্জ ছিল তারা তাকে মাস কয়েক আগে একবার বারণ করে গিয়েছিল–এটা কোরো না, কাজটা ঠিক নয়। পরের বার আবার এসে যখন শুনলো–এখনও সেই ষোল টাকা দেওয়া হচ্ছে সাইড ইনচার্জকে গাছের গায়ে বেঁধে ঠেঙিয়ে হাড়গোর সব ভেঙে দিল। সারারাত গাছে বাঁধাই থাকে। সকাল বেলা পুলিশ এসে হাসপাতালে নিয়ে যাবার পথে মারা যায়। সেই থেকে বাঁধের কাজ প্রায় বন্ধ হয়ে পড়েছিল। এমন কাউকে পাওয়া যাচ্ছিল না যে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে এখানে এসে, থেকে, কাজটা তুলে দিয়ে যাবে। সেই মৃত মুনশির স্থলে আমার নিযুক্তি হয়েছে। এখন আমাকে সেই লোক ঠকানো অপ্রিয় কাজটা করতে হবে।
আমাকে এখানে কাজের দায়িত্ব দিয়ে পাঠাতে পেরে রবি শ্রীবাস্তবের এক ঢিলে অনেক পাখি মারাটা সহজ হয়ে গেছে। এক, প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া বাঁধের কাজ নবোদ্যমে শুরু করা গেল। দুই, আমি যদি নকশালদের হাতে মারা পড়ি, সেটায় তার কোন ক্ষতি হবে না, কিছু লাভ হবে। লোককে বলা যাবে শ্রমিক দরদি নিয়োগীজির মৃত্যুর পর তার লোকজন আদর্শচ্যুত নীতিভ্রষ্ট হয়ে গেছে। দেখো, আমাদের কাছ থেকে সব টাকা বুঝে নিয়ে গিয়ে বোঁকাসোকা আদিবাসী মজুর গুলোকে কী ভাবে ঠকাচ্ছিল। তিন, যদি মারা না যাই যদি কাজটা তুলে দিতে পারি লাভের কয়েক লক্ষ টাকা হামাগুড়ি দিয়ে তার পকেটে ঢুকে যাবে। চার, মনোরঞ্জন ব্যাপারীর আনুগত্য পাওয়া যাবে, তাকে নিষ্ক্রিয় করে রেখে দিলে কিছুটা হলেও রত্নেশ্বর নাথ দুর্বল হবে।
আমি পলাচুর বাঁধে আসার দিন কয়েক পরে এখানে মিনিট কয়েকের জন্য এসেছিল রবি শ্রীবাস্তব। এখানে ঠিকাদার অফিসার যে কেউ আসুক দু পাঁচ মিনিটের বেশি দাঁড়ায় না। যত তাড়াতাড়ি পারে চলে গিয়ে লোকজনের ভিড়ে দ্রুগকোন্দলের অফিসে বসে। বাঁধের আশেপাশের জঙ্গলে শুকনো পাতায় মচমচ শব্দ হলেও তাদের প্রাণ উড়ে যায়, ওই, ওই বুঝি তারা আসে।
সেদিন আমাকে বলেছিল রবি শ্রীবাস্তব–এখানে অনেক কিছু জানবে অনেক কিছু দেখবে। কিন্তু মাথা গরম করা চলবে না। সব সহ্য করে নিতে হবে। আমিও সেটা বুঝে গিয়েছিলাম, যদি সহ্য না করতে পারি আমার কাজটা থাকবে না। আমার সংসারে আবার অভাব এসে ঘিরবে। তাই ন্যায্য মজুরির অর্ধেকেরও কম দিয়ে পুরা মজুরির কাগজেটিপ ছাপ নিয়ে আদিবাসী মানুষগুলোকে ঠকানোর কাজে আমিও যুক্ত হয়ে গিয়েছিলাম নীরবে, নিজের ভিতরের প্রতিবাদী সত্তাটাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে।
পলাচুর বাঁধের অল্প কিছু দুরে যে টাউন মত অঞ্চল যার নাম দ্রুত কোন্দল, সেখানে একটা পুলিশ ফাড়ি আছে। কিছু দোকান, কটা সরকারি অফিস আর স্কুল আছে। এখানে চাকরি করে বিলাসপুর রাজনাদগাঁও রায়পুরের কিছু অর্ধশিক্ষিত লোকজন। “এক পুরুষের অক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন” সংরক্ষণ ব্যবস্থার ফাঁক গলে চাকরিতে ঢুকে এই সব লোক প্রচুর বেতন এবং ঘুষ পায়। অসম্পূর্ণ শিক্ষা এবং সংস্কৃতিহীন হবার কারণে সেই টাকা কি ভাবে খরচ করতে হবে তা জানে না। এদের ঘর আঁতিপাতি করে খুঁজেও একখানা বই পাওয়া যাবে না। এরা টাকা খরচ করার জন্য বেছে নিয়েছে সেই সহজ পথ যা বেশির ভাগ বদলোক নিয়ে থাকে। তা হল মদ মেয়েমানুষ আর জুয়া। বড় বড় শহরে যে রকম ঘোড়ার রেসে টাকা ওড়ে, এখানে ওড়ে মুরগা লড়াইয়ে। হাটবারের দিন এক একটা মুরগার হার জিত নিয়ে হাজার দুহাজার টাকা বাজির দর ওঠে। আদিবাসী অঞ্চলের সুস্থ সাধারণ জীবনকে এরা তছনছ করে দিচ্ছে। এদের প্রত্যেকের মোটর সাইকেল আছে। সন্ধ্যেবেলায় এরা মোটর সাইকেলে চেপে পকেটে টাকার বান্ডিল নিয়ে চলে আসে নির্মিয়মান বাঁধের কাছে। বাঁধে পুরুষদের তুলনায় নারী শ্রমিক বেশি। যেই তারা কাজ সেরে ঘরে ফেরার পথ ধরে তাদের পিছু নেয় এই নারী শিকারীর দল। শাড়ি রূপোর গহনা নগদ টাকা দিয়ে ভুলিয়ে ভালিয়ে যাকে তার পছন্দ মোটর সাইকেলে তুলে নেয়। এটা যেমন ঠিক, ওটাও মিথ্যা নয়, যে, কোন কোন মেয়ে মোটর সাইকেলে চড়বার মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই বাঁধের কাজে আসে। আবার এটাও হয় যে কাউকে কাউকে জোর করেও বাইকে তোলা হয়। এক দময়ন্তীর বলাৎকার নিয়ে আমি তোলপাড় করেছিলাম, এখানে প্রায়দিনই কোন না কোন দময়ন্তী শিকার হয়ে যায়।
এখানকার মানুষ এ সব মেনে নিয়েছে। তাদের মুখে কোন রা নেই। যেন এটাই স্বাভাবিক ঘটনা। আমিও মেনে নিই। দেখে দেখে চোখ পচে যায়। এ সব ঘটনা আমাকে আর কোন যন্ত্রণা দেয় না। রামকৃষ্ণ বলেছেন–যে সয় সে রয়, যে না সয় সে নাশ হয়। কত বড় মহাপুরুষ ছিলেন তিনি। তার কথা মেনে নিয়ে চোখ কান বন্ধ করে পড়ে থাকি।
সারাদিন বাঁধে কাজ চলে। ট্রাক রোলার লেবারে জঙ্গল গমগম করে। সন্ধ্যে নামবার সাথে সাথে সব শুনশান। সবাই চলে গেলে বাঁধের পাশে বানানো এক ঘরে ঢুকে সেই যে দরজা বন্ধ করি সারারাতে আর খুলি না। পেচ্ছাব পেলে চৌকির উপর দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে সেরে নিই। বারো ঘন্টার লম্বা রাত কাটে আমার এক নিদারুণ ভয়ের মধ্যে দিয়ে। যদি সাপ আসে, যদি ভালুক ঢুকে পড়ে পলকা দরজা ভেঙে ফেলে, যদি নকশালরা আসে, যদি আদিবাসীরা ধরে নিয়ে যায় তাদের নররক্ত প্রিয় দেবতা আঙ্গাকে তুষ্ট করার জন্য বলি দিতে? নকশালদের নিয়ে আমার খুব বেশি দুশ্চিন্তা নেই। এসেই ওরা গুলি চালাবে না, দুটো কথা বলবে দুটো কথা শুনবে। আত্মবিশ্বাস আছে, আমি যদি দু কথা বলতে পারি–একটা চান্স পাবো। কিন্তু যারা আমার ভাষা বোঝে না (আমার বাংলা ভাষা) আমি যাদের ভাষা বুঝি না (গোন্ডি) তাদের কী করে বোঝাবো? তখন আমি হয়ত কাঁদতে পারি। সে কান্নায় আর কী হবে? আগে আমাদের রাজারা কালীপূজায় নরবলি দিতো। যাকে বলি দিতে আনা হতো সে কী কাঁদত না? তাবলে কী ধর্মান্ধ কাঁপালিকরা তাদের ছেড়ে দিত?
একেই বলে বোধহয় ভাগ্য। আঙ্গার কোন ভক্ত পূজারি আমাকে খুঁজে বাঁধে ধরতে এল না, আমিই একদিন পৌঁছে গিয়েছিলাম আঙ্গার থানে। সে দেব না দেবী তা জানি না–যে নররক্ত পেলে বড় খুশি হয়, আর ভক্তের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করে দেয়।
সেদিন আমার বাঁধের এক লেবার ঝাড়ুরামকে নিয়ে সন্ধ্যেবেলায় বাঁধের কাজের শেষে বেড়িয়েছি কিছু লেবার যোগাড় করতে। কাল থেকে আরও বেশি লোক লাগাতে হবে। বর্ষা আসছে, তার আগে বাঁধের কাজ শেষ করতে হবে। তাই গেছি ঝাড়ুরামদের গ্রামে। বাঁধ থেকে পূর্বদিকে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে ঘন্টা খানেক হেঁটে তবেই ঝাড়ুরামদের গ্রাম। এখানকার সব আদিবাসী গ্রামেরই জনসংখ্যা হয় খুব কম, তবে গ্রামের পরিধি হয় খুব বড়। একটা বাড়ি থেকে আর একটা বাড়ি থাকে সিকি মাইল কী আধ মাইল দূরত্বে। আর বাড়ির চারদিক ঘিরে থাকে ঘন জঙ্গলে। ঝাড়ুরাম সাথে আছে তাই, না হলে এ গ্রামে পথ চিনে আমার একা আসা বা চলে যাওয়া কঠিন ব্যাপার। ও সারা গ্রাম পরিক্রমার পর শেষ বেলায় নিয়ে গেল গ্রামের একেবারে শেষ মাথায় পাহাড় আর ঘন জঙ্গলের মধ্যে এই গ্রামের পূজারির বাড়িতে।
আদিবাসী সমাজ সরঞ্চনায় তিনজন মানুষের স্থান সবার উপরে। একজন হল প্যাটেল। যে গ্রামের যাবতীয় বিবাদ বিসংবাদের বিচার কর্তা। তার কথাই শেষ কথা, এর কোন আপিল নেই। আর একজন হচ্ছে বেগা। অর্থাৎ ডাক্তার। সে ওষুধ এবং নিদান দেবে রোগ নিরাময়ের। আর একজন হল এই পূজারি দেব। দেবতাকে সন্তষ্ট করে আদিবাসী জীবন সুখময় করার জন্য যা কিছু করা দরকার তা করে। পূজারি না থাকলে এতদিন দেব দেবীর রোষে, ঝড় বৃষ্টি খরা মহামারী থেকে আদিবাসী মানুষকে কে বাঁচাত? আদিবাসী মানুষের কাছে সব চেয়ে বড় হচ্ছে ভগবান, তারপরে বড় রাজা, যে ভগবানের প্রতিনিধি। এবং তারপরে এই তিন সেয়ান।
আমরা এখন এক সেয়ান–পূজারির বাড়িতে এসেছি। সে বাড়ির এমন পরিবেশ যে যাওয়া মাত্রই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল আমার। মনে হল যেন এ বাড়ির মধ্যে কতগুলো প্রেতাত্মার বাস। তারা ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ছে। ফিস ফিস করে কিছু বলছে। কোন গোপন পরামর্শ করছে। আর পূজারিকে দেখে তো ভয়ে মুচ্ছা যাবার মত অবস্থা। তখন সন্ধ্যা নামছে। চারদিকে ছেয়ে গেছে একটা ছাই ছাই অন্ধকার। সেই আবছায়া আলো অন্ধকারে সামনে এসে দাঁড়াল নেংটি পড়া, মিশকালো, প্রায় ছয় ফুট লম্বা, সেই রকম চওড়া, মাথার লম্বা লাল চুলে জট পাকানো, বড় বড় চোখ বড় বড় হলদেটে দাঁত, গায়ে বিকট দুর্গন্ধ, মাথা ঘামে ভেজা সেই পূজারি। যে ঝাড়ুরামকে এ সময়ে আমাকে নিয়ে উপস্থিত হতে দেখে হাসল। তার বড়বড় হলদেটে দাঁতের হাসি আর ইঙ্গিতময় চোখের ইশারায় ঝাড়ুরামকে কেমন যেন বিব্রত বলে মনে হল। আর আমি? আমার মনের মধ্যে ছোট্ট মুনিয়া পাখিটা কাতরে উঠল–বড় ভুল হয়ে গেছে। এখানে আসাটা বড় ভুল হয়ে গেছে রে।
আদিবাসীদের অতিথি সৎকারের নিয়ম মদ পরিবেশন। বাঙালীদের যেমন চা। সে লাউয়ের খোসায় বানানো পাত্র–যার স্থানীয় নাম তুম্বা, তা থেকে পাতার ঠোঙায় উগ্রগন্ধের মহুয়া মদ ঢেলে দিল। আমি আজ তার অতিথি। বড় আদরের অতিথি। আদিবাসীর পরিবেশন করা মদ ফিরিয়ে দেওয়া যায় না। যেমন রাজার দান প্রজার। মদ ফিরিয়ে দিলে গৃহকর্তার অপমান হয়। বাড়ি বয়ে এসে অপমান? আদিবাসী অপমান সহ্য করে না। অপমানিত আদিবাসী আর আহত বাঘ দু জনেই ভয়ংকর। আর বস্তারের গোণ্ড ও মুড়িয়া আদিবাসীদের কীসে যে মান কীসে যে অপমান সেটা বোঝাও এক সুকঠিন সমস্যা। যা এত দিনেও আমি বুঝে উঠতে পারলাম না।
একটি যুবতী বাজারে গেছে। একটি যুবক তার পশ্চাদ দেশে ছোট একটি চড় মেরে দিল কিংবা কোন ছুতোয় ছুঁয়ে দিল বুক। মেয়েটি বুঝে ফেলেছে ছুতোটা। বাঙালী হলে নিশ্চয় বাজার মাথায় তুলে নেবে। আদিবাসী মেয়েটা নেবে না। কারণ এটা মান। যুবা তার অঙ্গ সৌষ্ঠবকে মান দিয়েছে। যুবকটির নরম হাতের কোমল ছোঁয়ায় তো লুকনো ছিল সেই স্বীকৃতি যে যুবতীর ওই প্রত্যঙ্গগুলো আকর্ষক, মনোলোভা। এটা অপমান কী করে হয়?
এক পথিক পথ দিয়ে যাচ্ছিল তার তেষ্টা পেয়েছে। সে গিয়ে দাঁড়াল এক গৃহের সামনে–জল দাও আর্জি নিয়ে। বাড়িতে কোন অন্যলোক নেই অথবা ছিল সে অন্যকথা। জল এনেছিল সে বাড়ির অষ্টাদশী মেয়েটি। পথিক জল খেয়ে পাত্র রেখে হেঁটে চলে গেল। একটু হাসল না মেয়েটার গালটা একটু টিপে দিল না কৃতজ্ঞতায় হাতটা ধরল না–এটা অপমান। কেন হাসলে না? মেয়েটা কুরূপা? তার গায়ে কী শুয়োরের বিষ্ঠা লেগে আছে? তা যদি থাকে তবে কেন খেলে জল? কতদূর থেকে জল বয়ে এনে রেখেছে কী এই জন্যে যে কেউ এসে সে জল খেয়ে তাকে মান না দিয়ে চলে যাক? আমার ছোট্ট একটি উপন্যাস আছে অন্য ভুবন। তাতে আমি এই মান আর অপমান নিয়ে লিখেছি।
একপ্রস্ত, যাকে অবতরণিকা, গৌরচন্দ্রিকা, সমারম্ভ বলা চলে। এরপর আসল পানপর্ব বা অবগাহনে যাবার প্রস্তুতি শুরু হল। আমি তখন চাইছি–যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে কোন অঘটন ঘটার আগে সরে পড়ি। কিন্তু ঝাড়ুরাম উঠছে না। নাগালে মদের পাত্র পেয়েছে। ভরাভাণ্ড মদ রেখে চলে যাবে এত মনের জোর তার নেই। বস্তারে কার আছে কে জানে!
এবার একটা মুরগি নিধন হল। চায়ের সাথে টা দিতে হয়, মদের সাথে চাট। একটানে মুরগির মাথাটা ছিঁড়ে ফেলল পূজারি। এখানকার প্রত্যেকটা আদিবাসী বাড়িতে শীত গ্রীষ্ম বর্ষা, দিন কিংবা রাত সর্বক্ষণ উঠোনে অগ্নিকুন্ড জ্বলে। আগুন জ্বালানোর আধুনিক পদ্ধতি এখানে এখনও ব্যাপকতা লাভ করেনি। দেশলাই কাকে বলে এরা জানে না। সেই আগুনে মুরগিটাকে উল্টেপাল্টে পুড়িয়ে, টেনে ছিঁড়ে তিনটে পাতায় ভাগ করে রাখে সে। পাশে রাখে খানিকটা নুন কয়েকটা লঙ্কা। এত কর্মকাণ্ডের কোথাও কোন জলের ব্যবহার নেই। জল বলতে এখন মদ। পাতার ঠোঙায় এবার ঘরে বানানো মহুয়া ফুলের মদ-যা আগুনে ঢাললে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে, গলায় ঢাললে কলজে জ্বলে–চড়চড় করে পেটে নামে-তা দেওয়া হল। আমি আজ বিশেষ অতিথি।
রামকৃষ্ণ ঠাকুর বলেছেন–লজ্জা ঘৃণা ভয় ত্যাগ করতে। মদই একমাত্র সেই পানীয় যা মানুষকে ওই তিনটি থেকে মুক্ত করে মুক্তির মার্গ প্রশস্ত করে দেয়। মদ পেটে যাবার ফলে এখন আর আমার সেই গা ঘিনঘিন ভাব নেই। দিব্যি নুন লঙ্কা দিয়ে পোড়া মুরগি চালিয়ে দিলাম। দু বোতল খাঁটি মদ যা সাধারণ পানাসক্ত আটজনের খোরাক তা তিনজনে শেষ করার পর পূজারির লাল চোখ আরো লাল রক্ত জবার আকার ধারণ করল। তার ভয়ংকর শরীর আরও ভয়ংকর হয়ে উঠল। তখন সে ঝাড়ুরামকে বলে–আব এলা যে চল। মানে, এখন একে নিয়ে চল।
ঝাড়ুরামের ভীত বিস্মিত আর্তরব–কাঁহা!
–পূজ দেথন। মানে, পুজো করে দেব। বলে পূজারি, লে চল।
আমরা বাঙালীরা অনেক সময় বলে থাকি–মায়ের ভোগে দেব। কথাটার মধ্যেকার প্রতিটা শব্দই অতি নিরীহ ও নিরামিষ। কিন্তু এই কর্মকাণ্ডের সবটা জুড়ে শুধু আমিষ আর আমিষ। আদিবাসীদের ভাষায়ও পুজো করে দেব মানে ফুল জল ছেটানো নয়–আঙ্গার উদ্দেশ্যে বলিদান দেওয়া। পূজারি এখন আমাকে বলি দেবার জন্য ঝাড়ুরামের সহায়তা চাইছে।
ঝাড়ুরামও আদিবাসী। সে জানে তাদের দেবতা কতখানি তৃপ্ত হবে নররক্ত পেলে। সামনে চাষ আসছে। পুজোর পরে সেই রক্ত বীজ ধানে মাখিয়ে জমিতে ছড়ালে ফসলে মাঠ ভরে যাবে। জীবন সুখময় হবে। তাকে বলে রেখেছিল পুজারি–চারদিকে যখন ঘুরিস দেখিস না চেষ্টা করে, যদি পাওয়া যায়। আজ যখন সে আমাকে নিয়ে পূজারির কাছে এল আনকোড়া মুখ দেখে তার ধারণা হয়, দেবী না দেবতা কে জানে, তার তুষ্টির জন্যে ঝাড়ুরাম আমাকে ফুঁসলে নিয়ে এসেছে। এবার সে সেই পবিত্র কর্মটা সম্পন্ন করে দিতে চাইছে।
তখন চারদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। জঙ্গলের সে জংলি অন্ধকার আরও নিকষ ভয়াবহ–হাড় হিম করা। লে চল কথার সাথে ঝাড়ুরাম সহযোগিতা দিলে আর আমার রক্ষা নেই। সভ্য জগতের শিক্ষিত মানুষেরা ভাগ্য ভগবান দেবী দেবতা নিয়ে যে মাতামাতি করে–ছাগ বলি মোষ বলি গরু উট কোরবানি, সেখানে বুনো জংলি শিক্ষাদীক্ষাহীন এক আদিবাসীর আর কি দোষ। সে আমাকে খুন খতম মার্ডার হনন সংহার এসব করতে চাইছে না–দেবতার কাছে উৎসর্গ করে দিতে চাইছে মানুষের মঙ্গলের জন্য। দেবতা খুশি হলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হবে সোনার ফসলে ভরে যাবে আদিবাসীদের ক্ষেত। যদিও নেশায় ঝাড়ুরামের সারা শরীর টলছে তবু তার বুদ্ধি বিলোপ হয়নি। বলে সে, এলা নেহি। না, একে নয় “কাবর”? পূজারির প্রশ্ন–কেন, একে নয় কেন? বলে ঝাড়ুরাম–এ সরকারি লোক। একে পূজো করে দিলে কাল সবাই আমাকে জিজ্ঞাসা করবে-লোকটা কোথায় গেল। তুমি তো সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলে! পুলিশ এসে আমাকে ধরবে, তখন আমি কী করব?
–বলে দিবি, কোথায় গেছে আমি তার কি জানি। আমি তো নিয়ে এসে বাঁধের ঝুপড়িতে রেখে দিয়ে চলে গিয়েছিলাম।
ঝাড়ুরাম আর পূজারি দুজনে একে অপরকে বহু সময় ধরে বোঝাবার চেষ্টা করতে থাকে। এ যেন বহুদিন আগেকার বর্ধমানের সেই অন্ধকার রাত আবার ফিরে এল নতুন ভাবে। সেদিনের মত আজও আমার ভয়ে পা থেকে মাথা পর্যন্ত সব অবশ হয়ে যেতে থাকে। সেদিন পুড়ে যাবার ফলে আমার শরীর ছিল অক্ষম আজ অত্যধিক মদ্যপানের ফলে অচল।
কালীঘাট শশ্মানে আমার এক বন্ধু থাকে–অর্জুন মল্লিক। যে সম্পর্কে ফঁসুড়ে নাটা মল্লিকের ভাই। সে নাকি ৮৯/৯০ সালের দিকে দাদার সহযোগী হয়ে সেন্ট্রাল জেলে দুই ডাকাতের ফাঁসি দিতে গিয়েছিল। সে বলেছে–যখন কেউ বুঝে যায় তার বাঁচার আর কোন উপায় নেই, তখন শরীর ভয়ে একেবারে ঝিম মেরে যায়। আর নড়তে চড়তেও পারে না। আমার অবস্থা এখন তাই। শরীর অসাড় হয়ে যাচ্ছে। একদিন আমার জীবন মরণ ঝুলেছিল ভুতোর একটা হ্যাঁ, না, এর উপর। এখন ঝুলে আছে ঝাড়ুরামের সম্মতি অসম্মতির উপরে। আমি ততক্ষণ বেঁচে থাকব যতক্ষণ ঝাড়ুরাম আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে। পূজারির সাথে আমার কোন শত্রুতা নেই। তা থাকলে কেঁদে ঝাঁকিয়ে হাতে পায়ে ধরে–অথবা কোন কৌশল করে, যে ভাবে একবার কামার পাড়া থেকে। বেঁচে ফিরেছিলাম–সেভাবে বাঁচার একটা চেষ্টা করা যেত। কিন্তু সে সব কায়দা এখন চলবে না। এটা দেবতার কাজ। এখানে আমাকে ছেড়ে দেবার কোন প্রশ্নই নেই। কবে কোথায় কোন গৃহস্থ্য ব্যাব্যা কান্না শুনে মানত করা পাঠাকে ছেড়ে দিয়েছে বলি না দিয়ে? আমি যে ভাষায় কাঁদতে কাতরাতে জানি আমার সেই আ-মরি বাংলা ভাষা ওদের কাছে তো ব্যাব্যা ছাড়া আর কিছুই নয়। যেমন মালায়ালাম, কন্নর, গোন্ডি, বা চাটগায়ের ভাষা আমাদের কাছে।
ঝাড়ুরাম এখন নেশায় লুড়কে গিয়েও বারবার জোর দিচ্ছে “সরকারি আদমি” শব্দটার উপর। হিন্দু শাস্ত্রে যেমন গোবধ নিষিদ্ধ, আদিবাসী চেতনায় রাজার লোক অবধ্য জীব। রাজার স্থান এখন নিয়েছে সরকার। বলে সে সরকারি লোক “লাপাতা”হয়ে গেলে মহা তুলকালাম হবে। পিত্তে পুরিয়ার পূজারির এখন কি দশা? ফরেষ্টারকে মেরেছিল বলে পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়ে “দাদালোগ” বলে কেস দিয়ে দিয়েছে। এখন পচছে জেলে। এর কিছু হয়ে গেলে আমার আর তোমার সেই দশা হবে। বাঁধের কাজ বন্ধ হয়ে গেলে পুলিশ আমাদের ছাড়বে না।
আমার এখন মনে হয় পূজারি একটু নরম হয়ে পড়েছে। সেই নরমত্বের ফাঁকে আমি আমার আবেদন গুঁজে দেই শুদ্ধ হিন্দিতে–কাক্কা, মেরা ছোটাছোটা দো বাচ্চে হ্যায়। বিবি হ্যায়। হাম না রহনে সে উনলোগোকো কোন দেখে গা। সবকে সব ভুখ মে তড়পকর মর যায়েগা। ইসমে তুমহারা পাপ লাগে গা। বাচ্চে ভগওয়ানকা প্যারা হোতা হ্যায়। তখন কি বুঝলো পূজারি তা কে জানে! তবে তার চেহারা থেকে ধর্মোন্মাদী কাঠিন্যটা চলে গেল। হেসে হেসে বলে উঠল–আরে বেটা মজাক করেহন। মজাক মানে রসিকতা। সে নাকি এতক্ষণ আমার সঙ্গে ঝাড়ুরামের সঙ্গে। রসিকতা করছিল। এতক্ষণ তাকে ঝাড়ুরাম যা বলেছিল সে আমাকে তাই বলে–আরে বেটা তুই হচ্ছিস সরকারি আদমি। তোকে কী করে পুজো দেব! সে কী পারি? কেউ কী পারে? ডর মাৎ, লে দারঘো পি!
শেষবারের মত মদ খেয়ে সেই যে আমি চলে এলাম তারপর আর কোনদিন ও পাড়া মুখো হবার মত মনের জোর পাইনি।
প্রায় দেড় বছর লেগেছিল পলাচুর বাঁধ নির্মাণ হতে। তিনদিকে পাহাড়, আর একটা দিকে পাহাড় সমান বাঁধ দিয়ে ব্যবস্থা করা হয়েছিল জল ধরে রাখার। এক কোটি ছিয়াশি লক্ষ টাকা ব্যায়ে বানানো হয়েছিল এই “বালির বাঁধ”। যার ল থেকে ইকার সরিয়ে একার বসিয়ে দিলেই মানেটা যথার্থ হয়। এই বাঁধের ঠিকাকার্য যার নামে সে একবারের বেশি দুবার বাঁধে আসেনি। তারই বকলমে কাজ চালিয়েছে বর্মা সাহেব। সরকার যাকে বেতন দিয়ে রেখেছে ঠিকদারের কাজটা ঠিকঠাক করছে কিনা তা বুঝে নেবার জন্য। সে ঠিকঠাক করছে কিনা তা দেখবে কে? কেউ দেখার ছিল না, তাই কেমন বাঁধ তৈরি হল সে তো আমি আগেই বলেছি। প্রথম বর্ষাতেই বাঁধ ভেঙে জলের তোড়ে সরকারের এককোটি ছিয়াশি লক্ষ ধুয়ে বেড়িয়ে গেল। এতদ অঞ্চলের মাননীয় মন্ত্রী অরবিন্দ নেতাম দ্বারা জনগণের উদ্দেশ্যে বাঁধ উৎসর্গ হবার একমাসের মধ্যে এ ঘটনা ঘটল। কর্তব্যে গাফিলতির অভিযোগে বর্মা সাহেব বিভাগীয় তদন্তের সামনে পড়লেন।
বর্মা সাহেব আমার নিয়োগ কর্তা। ভাউচারে সই করিয়ে তিনি আমাকে বেতন দেন। তিনি থাকলে আমি কোথায় থাকি? আবার আমি দ্বারস্থ হলাম রবি শ্রী বাস্তবের। সে আবার চিঠি লিখলো। আবার আমি চিঠি নিয়ে হাজির হলাম আর এক এস.ডি.ওর সমীপে। উনি ছিলেন বর্মা সাহেব ইনি হলেন শর্মা সাহেব। আবার কাজ পেলাম বাঁধ নির্মাণে। ওটা ছিল মাটির বাঁধ, এটা সিমেন্টের। কাকের বাসস্ট্যান্ডের পূর্বদিকে দুধ নদীর উপরে এই বাঁধ তৈরি হবে। মাস ছয় চলল এই কাজ। এরই মধ্যে রবি শ্রীবাস্তব কাকের নগর পালিকা পরিষদে নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রথমে পার্ষদ পরে অধিকাংশ পার্ষদের সমর্থন পেয়ে নগর পালিকা পরিষদের অধ্যক্ষ মনোনীত হলেন।
তখন একদিন আমাকে ডেকে বলল–এখানকার বাঁধের কাজ প্রায় শেষ। এরপর তুমি আর কঁকেরে থাকতে পারবে না। তখন শর্মা সাহেব তার যেখানে ইচ্ছা পাঠিয়ে দেবে। কিন্তু আমার ইচ্ছা বরাবরের জন্য তুমি কাকেরে থেকে যাও। তোমার বউ বাচ্চা সব এখানে নিয়ে এসে থাকো। বউকে কোথাও আই.সি.ডি.এস. এর নতুন সেন্টার হলে সেখানে লাগিয়ে দেব।
বলি–কিন্তু ওদের এনে রাখবো কোথায়?
যদি তুমি রাজি থাকো নগর পালিকার অধীনে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেব। দেড় বছর ক্যাজুয়াল তারপর পার্মানেন্ট। থাকার জন্য একটা কোয়ার্টার দেওয়া হবে। জল বিদ্যুতের ব্যবস্থা থাকবে। খোলামেলা শান্ত পরিবেশ। থাকো খাও আর আরামসে লেখো।
কাঁকেরে নাজিব কুরেশি রত্নেশ্বর নাথ বিষ্ণুপ্ৰসাদ চক্রবর্তী থাকে। এ ছাড়া এই ছয় মাসে বেশ কিছু নতুন বন্ধুও হয়ে গেছে যারা আমার মনের খুব কাছাকাছি। এদের সাথে সময়টা ভালোই কাটে। এদের ছেড়ে মাঠে ঘাটে পাহাড়ে জঙ্গলে এবং যাদের ভাষা সংস্কৃতি কোন কিছুর সাথে পরিচয় নেই সেই মানুষদের মধ্যে রাতদিন পড়ে থাকা সত্যিই খুবই কষ্টকর। যদি সংগঠন গড়বার প্রয়োজনে যেতাম তার একটা অন্য রকম আনন্দ থাকত। আমার মাষ্টার মশাই বলেছিলেন–যাহা আনন্দ তাহাই অমৃত। সেই অমৃত এখন আর ওখানে পাচ্ছি না। পাচ্ছি এখানে–কঁকেরে। তাই ভাউচারে সই করে বেতন নেবার পর ইরিগেশন ডিপার্টমেন্টের চাকরিটা ছেড়ে দিলাম। নব নিযুক্তি নিলাম নগর পালিকা পরিষদে। আর প্রথম দিন ডিউটিতে গিয়ে আমার চক্ষু চড়ক গাছ। এ আমার জন্য কী চাকরি বেছে রেখেছে “রবি ভাইয়া”!
শহর ছাড়িয়ে বেশ খানিকটা দূরে, পশ্চিম দিকে থেকে একেবারে সোজা যে দুধ নদী এসেছে এবং যা এগিয়ে গিয়ে কাঁকের শহরকে বেড় দিয়ে নব নির্মিত বাঁধ পার হয়ে একটা জেড অক্ষরের মত পূর্বদিকে চলে গেছে সেই নদীর দক্ষিণ পাশে কমপক্ষে পঁচিশ একর জায়গা জুড়ে যে শ্মশান যার নাম দেওয়া হয়েছে মুক্তিধাম, বহুযত্নে বহু অর্থব্যায়ে তার সৌন্দর্যকরণ করা শুরু হয়েছে। প্রায় পাঁচ একর জায়গা জুড়ে লাগানো হয়েছে এবং হচ্ছে নানাবিধ ফল ও ফুলের গাছ। সে গাছকে রক্ষা করার জন্য চারদিকে আটফুট উঁচু করা হচ্ছে পাঁচিল। মুক্তিধামের দুদিকে দুটো দরজা। দক্ষিণ দিকের দরজা দিয়ে বের হয়ে সামনে পাকা রাস্তা। এই রাস্তায় কালে ভদ্রে এক আধটা জিপ গাড়ি চলে, না হলে সবই সাইকেল। এই পথে যাওয়া যায় মন্ত্রী অরবিন্দ নেতামের গৃহ-গ্রামে। কাকের থেকে যত মৃতদেহ আসবে, এই পথে এসে মুক্তিধামে প্রবেশ করবে। আর উত্তর দিকের দরজা দিয়ে যাওয়া যাবে দুধ নদীর পাড়ে। যদি কেউ মৃতদেহ স্নান করায়, নিজেরা স্নান করে, এই পথে গিয়ে করবে। অপরূপ সৌন্দর্য এই দুধ নদীর। দু পাড়ে শুধু বালি আর বালি। তারই মাঝখানে যেন চিরশান্ত বালিকার মতো এক হাটু জল বুকে ধরে রেখে ঘুমিয়ে আছে। তার শ্বাস প্রশ্বাসের মতো তিরি তিরি করে বয়ে চলে কঁচের মত স্বচ্ছ জল। সে জলে নামলে শরীর মন জুড়িয়ে যায়। দুধ নদীর এই রূপ থাকে বছরে নয় মাস। অন্য তিন মাস সে বেগবান, যুবতী। দুকূল ছাপিয়ে তখন তার উদ্দাম ছুটে চলা।
এই মুক্তিধামে আমার ডিউটি। না, কাজ বলতে তেমন কিছু একটা নেই। বেশ বড়, সপরিবারে থাকার মত একটা ঘর আছে, সেখানে সর্বক্ষণ শুয়ে বসে থাকা। টিভি থাকলে টিভি দেখতে পারি, বই থাকলে পড়তে পারি, কাগজ কলম থাকলে লিখতে পারি। কাউকে ডেকে এনে তাকে নিয়ে দাবা খেলতে পারি। আর যদি কখনও কোনদিন একটা মৃতদেহ আসে, তবে মৃতের আত্মীয়দের কাছ থেকে পঞ্চাশ টাকা কুইন্টাল দরে দাম নিয়ে যতটা কাঠ তারা চাইবে গোডাউন থেকে মেপে দিয়ে দিতে হবে। ব্যাস এই।
এই শহরের অর্ধেক লোক সিন্ধি সিকি ভাগ মুসলমান। পাঞ্জাবি বাঙালী এবং অন্যান্য সব মিলিয়ে আর পঁচিশ ভাগ। এবং সবচেয়ে যেটা মজার আদিবাসী একজনও নেই। এই শহরে একটা বড় হাসপাতাল আছে, তাছাড়া আছে ভালো ভালো ডাক্তার। যে কারণে মৃত্যুর হার খুবই কম। সপ্তাহেদাহহতে গড়ে একটা মৃতদেহ আসে কীনা সন্দেহ। রবি শ্রীবাস্তব বলে–মুক্তিধামকে আমি মৃতের জন্য নয়, জীবিতের জন্যে বানাচ্ছি। একে এমন ভাবে সাজাব যে মানুষ এসে মনের শান্তির জন্য এখানে বসে থাকবে। আর ধীরে ধীরে সে মুক্তিধামকে সেইভাবে গড়েও তুলছে।
এই সময় একদিন বিনা মেঘে যেন বজ্ৰাপাত। আর তা পড়বি তো পড় একেবারে আমারই মাথার তালুতে। হাবালা নামক সেই বহু চর্চিত টাকা লেনদেন কাণ্ডে ফেঁসে গেল মন্ত্রী অরবিন্দ নেতাম। তখন লোকসভার নির্বাচনের দিনও আর খুব একটা দূরে ছিল না। তখন কংগ্রেস পার্টির পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয় যে যতদিন অরবিন্দ নেতাম নির্দোষ প্রমাণিত না হয়, তাকে টিকিট দেওয়া হবে না। তবে সেই স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত নেতাম পরিবার কংগ্রেসের বিশ্বস্ত সেবক। সেই জন্য অরবিন্দ নেতাকে টিকিট না দেওয়া হলেও তার স্ত্রী ছবিলা নেতামকে কাকের লোকসভার আসনে টিকিট দেওয়া হবে।
যথাসময়ে নির্বাচনি রণদামামা বেজে উঠল। কাঁকের লোকসভার আসনে সর্বমোট তেরজন প্রার্থী ভোট যুদ্ধে অবতরণ করল। কংগ্রেস বিজেপি বহুজন সমাজপার্টি জনতাদল নির্দল এবং তার সাথে প্রার্থী হল ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চার জনকলাল ঠাকুর।
আমি তখন সারাদিন শ্মশানে আর রাত হলে নগর পালিকা পরিষদ দ্বারা সঞ্চালিত ধর্মশালায় গিয়ে থাকি। যে ঘরটায় আমার সপরিবারে থাকার কথা সেটির নির্মাণ কিছু বাকি আছে। তাই আমি এখানে একা আছি। এক দু মাসের মধ্যে অনুকে নিয়ে আসতে পারব এমন মনে হয়।
একদিন সেই ধর্মশালায় রত্নেশ্বর নাথ আর নাজিব কুরেশি গিয়ে হাজির। তাদের সাথে রয়েছে জনকলাল ঠাকুর। বলে নাথ–এবার তো ব্যাপারীজি, গায়ের ধুলো ঝেড়ে ফেলে উঠে দাঁড়ানো দরকার। সময় তো এসে গেছে। নেতামের বদনাম হয়ে গেছে, তার স্ত্রীকে কেউ ভোট দেবে না। বিজেপি তো সবদিন হারে। গোটা কয়েক সিন্ধি আর গোটা কয়েক বাঙালী ছাড়া তাদের তো কোন জনাধার নেই। বি.এস.পি, জনতা দল এদের ভোটার তো দুরের কথা সব কটা বুথে এজেন্টও দিতে পারবে না। আগে একবার ঠাকুর সাহেব এই কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সবাই তার নাম জানে, কাজ জানে। আমরা যদি জোর লাগাই ঠাকুর সাহেব এবার ঠিক জিতে যাবে।
বলি–ঠাকুর সাহেবের হয়ে যদি প্রচারে নামি আমার চাকরিটা তো থাকবে না।
–দাদা, তোমার মত একজন সমাজকর্মী–নিয়োগীজির অনুগামী, চাকরির মায়ায় এই রকম সময়ে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকবে এটা ভাবতেও আমার ভালো লাগছে না। বলে নাজিব।
জনকলাল ঠাকুর বলে–পিছন দিকে তাকিও না। সামনে দেখো। যা পরিস্থিতি তাতে আমার জয়ী হবার যথেষ্ট সম্ভাবনা। আমি তো আছি। ও সব চাকরি ফাঁকরি দেখা যাবে। এখন কাজে নেমে পড়ো। পরের কথা পরে ভাবা যাবে।
জনকলাল ঠাকুরের জিপে লাল সবুজ পতাকা লাগানো। বাস রাস্তায় দাঁড় করানো হয়েছিল সে জিপ। ফলে সে যে আমার কাছে এসেছিল তা আর গোপন রইল না। নাথ তা গোপন করে রাখেও না। ধূর্ত লোক, রাজনীতির খেলাটা সে ভালোই জানে। কোহলিয়া যে হেতু রবি শ্রীবাস্তবের লোক, তার গ্রেপ্তারের দাবিতে আন্দোলন করার জন্য বর্মালাল খটবানি, যে বিজেপির নেতা, তার কাছ থেকে জিপ নিয়েছিল। রবি শ্রীবাস্তবের সাথে রত্নেশ্বরের সেয়ানা সেয়ানায় কোলাকুলি। সে কৌশল করে রবি শ্রীবাস্তবের কানে কথাটা তুলে দেয়, ব্যাপারী দাদা কো উত্তর বস্তারকা প্রভারী বানাকর হাম পারাল কোট ভেজনকা সারি প্রবন্ধ করচুকে হ্যায়। এরই এক দুদিন বাদে আমাকে ডেকে পাঠাল রবি শ্রীবাস্তব তার নিজস্ব নগর পালিকার কক্ষে।
বলে–দাদা, হামনে আপকো কভি নেহি বোলা কি আপ মেরে পার্টিমে আও৷ বোলা ক্যা? নেহি বোলা। আউর কভি বোলতা ভি নেহি। লেকিন আজ এই সময় আ গিয়া ইতনা বড়া মুশিবৎ। আপ তো জানতে হ্যায় নেতামজিকো টিকট নেহিমিলা। আগার ছবিলাজি ইস চুনাব জিৎ
পায়ে, তো হাম লোগ যো নেতাম পরিবারকে সামনে রাখকর রাজনীতি করতে হ্যায়~-হামলোগ কঁহা রহেঙ্গে? যব হাম হিনা রহে তো আপ কাহা?ইসলিয়ে আপ হাম সবকো চাহিয়ে জি জানসে জুট জানা। আউর কেইসে ভি হো ছবিলাজি কো জিতাকে লানা। আপ এক কাম করিয়ে, কাল এক জিপ লে লিজিয়ে। উসমে বাঁধ লিজিয়ে মাইক টাঙ দিজিয়ে ঝান্ডা। কুছ পয়সা বয়সা ভি লে লিজিয়ে। আউর চলা যাইয়ে পারাল কোট।ব্যানার্জী লোগ যো কর রহা করনে দিজিয়ে। আপ সিধা হামসে সম্পর্ক বানাকে রাখিয়ে। আপকা হাজিরা ইধার চলতা রহেগা। হামকো এ বাত মালুম হ্যায় কী বাঙালী লোগ নেতামজিকো পসন্দ নেহি করত। লেকিন আপকা কথন ভাষণ সামঝানে পর কুছ তো অসর হোগা। কমসেকম হাজার ভোেট তো মিলেগা পচাত্তর হাজার মে সে? আভি হামারা লিয়ে এক এক ভোট বহোত কিমতি।
বলি আমি–এটা আমার দ্বারা সম্ভব হবে না।
কাল কাপসীতে পাখানজুর বান্দেতে দাঁড়িয়ে যাদের আদ্যশ্রাদ্ধ করেছি আজকী করে সেখানেই দাঁড়িয়ে মানুষকে বলব কংগ্রেসকে ভোট দিন। ব্যানার্জীরা দাঁত বের করে হাসবে। আর পাবলিক ভাববে ভালো দাম পেয়ে নিজেকে বিক্রি করে দিয়েছি। তার চেয়ে বড় কথা–আগামী প্রজন্ম, যার মধ্যে আমার ছেলে মেয়ে ওরাও থাকবে। তারা যদি আমার লেখাগুলো পড়ে, আমার নাকের সামনে তুলে ধরে বলে–লেখার সময় এ সব কী লিখেছিলে আর করার সময় এসব কী করেছ? তখন তার কী জবাব দেব? আমি নিজের হাতে যা নির্মাণ করেছি কেমন করে তার বিরুদ্ধে যাব।
বলে রবি শ্রীবাস্তব–দাদা আমরা সোজা পথে চলি আর সোজা কথা বলি। কোন প্যাঁচঘোচ বুঝি না, তত্ত্ব ফত্তর ধার মাড়াই না। আর হ্যাঁ কাউকে কোন মিথ্যা প্রতিশ্রুতিও দিই না। আমি তোমার বিপদের সময় দেখেছি–কথা দিলাম আগেও দেখতে থাকব। আমি চাই আজ আমাদের বিপদের দিনে তুমি আমাদের পাশে দাঁড়াও। সাগর বাঁধায় কাঠ বেড়ালির কথা জানা আছে নিশ্চয়। হামলোগ কিসিকো কুছ দেতে হ্যায় তো উসকা রিটার্ন ভি মাঙতে হ্যায়।
বললাম–আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু নির্বাচনের প্রচার ছাড়া আর যা বলবেন আমি তা সব করতে রাজি আছি। ওটা আমি পারব না। এই আদেশ আমাকে দেবেন না। আপনি মাইনে দেন আপনার হুকুম তামিল করাই আমার কাজ। কিন্তু রাজনৈতিক মতবাদের ক্ষেত্রে আমি আমার নিজের অধীন।
বলে সে-যদি তুমি আমাদের হয়ে প্রচারে না যাও আমি ধরে নেব গোপনে গোপনে তুমি জনকলাল ঠাকুরের পক্ষে কাজ করছে। সে ক্ষেত্রে আমি তোমাকে চাকরিতে না-ও রাখতে পারি। ভেবেচিন্তে যা বলার কাল আমাকে জানাবে।
রবি শ্রীবাস্তবের আজকের আচরণ অন্য দিনের চেয়ে অন্যরকম। আমার কেন জানি না তার ব্যবহারে অপমান বোধ হয়। তখন বলি–তাহলে গোপনে নয়, সরাসরি আমি কাল থেকে জনকলাল ঠাকুরের পক্ষেই প্রচারে যাচ্ছি। আমি শংকর গুহ নিয়োগীর লোক। এটা আমার বিরাট গর্বের, ভীষণ অহংকারের। সেই পরিচয় আমি মুছতে পারব না।
সেই রাতেই ধর্মশালা থেকে বেড়িয়ে চলে গিয়েছিলাম দল্লীতে। পরের দিন ফিরে যাই কাপসীতে। সাধ্যমত আমরা চেষ্টা করি। তবে সেই নির্বাচনেও কংগ্রেস বা বলা চলে অরবিন্দ নেতামই জয়ী হয়। তের জন প্রার্থীর এক মাত্র বিজেপি বাদে অন্য এগারো জন সবার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়। হাবালা কান্ড নিয়ে সারা দেশ তোলপাড় হয়েছিল তা এ অঞ্চলের আদিবাসী ভোটারদের মনে কোন ক্ষতিকারক প্রভাবই ফেলতে পারেনি। বরং উল্টে অনেক বেশি জন সহানুভূতি পেয়ে অরবিন্দ নেতামের স্ত্রী ছবিলা নেতাম জিতে যায়।
ভোটের প্রচার যে কয়দিন চলেছিল কাপসীতে জিপ কর্মী চাল ডাল কোন কিছু আসার বিরাম ছিল না। কটা দিন আমাদের দারুণ উত্তেজনা আনন্দে কেটে গিয়েছিল। তারপর আবার নেমে এল এক অখন্ড নীরবতা এক অসহনীয় সংবাদহীনতা। আর কেউ দল্লী থেকে বা কাকের থেকে আমার কোন খোঁজ খবর নিতে এল না। যেন তারা ভুলেই গেল আমার কথা।
এদিকে আমার স্ত্রী অনুর মাস গেলে পাওয়া আড়াই শো টাকায় আর সংসার চলে না। শেষে একদিন গেলাম দল্লী। বাস থেকে নেমে বুকটা ছ্যাক করে উঠল আমার। একোন দল্লী দেখছি আমি। প্রাণ চাঞ্চল্যে ভরপুর আন্দোলনে উত্তাল “লালহরা” পতাকায় মোড়া সে শহর কই? এযে এক মৃতপ্রায় মুমূর্ষনগরী। যার প্রাণবাতি নিভু নিভু। নিয়োগীজি মারা যাবার পর মুক্তিমোর্চার নেতাদের সঙ্গে মালিক পক্ষ আর সরকার পক্ষ তাদের অনুকুলে নানা রকম চুক্তি করে দল্লী খাদানের শেষ ঘন্টা বাজিয়ে দিয়েছে। তারা এক চুক্তির বলে প্রায় অর্ধেক মজুরকে মেডিকেল আনফিট দেখিয়ে ভলেন্টারি রিটায়ারমেন্ট দিয়ে কাজ থেকে বসিয়ে দিয়েছে। গ্রাম থেকে তারা শহরে এসেছিল এখন আবার ফিরে গেছে গ্রামে। যারা একটু নেতা গোছের তাদের সরাসরি সরকারি চাকরির আওতায় এনে বদলি করে দেওয়া হয়েছে মিটিং মিছিল থেকে দূরে-অন্যকোন খাদানে সুপারভাইজার করে। আর অল্প কিছু অসহায় মানুষ রয়ে গেছে কোন ঠিকাদরের অধীনে। যাদের সংখ্যা হাজার বারোশোর বেশি নয়। মজদুর জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা শহরে যদি মজদুরইনা থাকে দোকানপাট বাজার হাট গাড়ি ঘোড়ার সে চমক দমক থাকে কী করে?
যখন আমি দল্লী পৌঁছালাম তখন ঘড়ির কাটায় বিকেল চারটে বাজে। খাদান থেকে মজুররা সব নিচে নেমে গেছে। পাহাড়ে এখন ব্লাস্টিং চলছে। লাল ধুলোয় চারদিকে আচ্ছন্ন। পথে আগের মত জন সমাগম নেই। সব চোখে পড়ার মত ফাঁকা ফাঁকা। সেই যে ব্রিজ যে ব্রিজের উপর থেকে গুলি চালিয়ে পুলিশেরা মজুরদের মেরেছিল ৭৭ সালের এক সকালে, সেখানে এখনও একটা চা দোকান আছে। সেই যে কী এক বিপর্যয়ে ডাইনোসর মরে গেছে কিন্তু বেঁচে আছে ছোট্ট পিঁপড়ে, সেই রকম। বাস মোড় থেকে শহীদ হাসপাতাল এই আধ কিলোমিটার পথের দুপাশে শতাধিক দোকান ছিল বড়বড়। সব এখন খরিদ্দারের অভাবে বন্ধ। সেই একমাত্র দোকানে বসা দেখলাম মুক্তি মোর্চার এক নেতাকে। আমাকে দেখে গলায় এক সমুদ্র উচ্ছ্বাস এনে সে ডাকলোব্যাপারীজি আইয়ে আপকো চায় পিলাতে হ্যায়। বড়া খুশিকা দিনমে আপ সে মোলাকাত হো গয়া। চা খেতে খেতে বলে নেতা, কাল থেকে আমরা ডিপার্টমেন্টাল হয়ে যাব। এ্যাপয়ন্টমেন্ট লেটার আজ হাতে পেয়েছি।
আমরা মানে সে একা নয়, অনেক কজন কাল থেকে সরাসরি সরকারি কর্মচারী হয়ে যাচ্ছে। কাল থেকে বদলে যাবে জীবনের স্তর। কাল থেকে এরা আর মজুর নয়, মজুর খাটানো ইনচার্জ। তাই গলায় থৈ থৈ করছে আবেগ আর আনন্দ।
চা শেষ করে বলি–চলুন মোর্চার অফিসে যাওয়া যাক। বলে সে–আমি তো আর ওখানে যেতে পারব না। আপনি যান। আমাদের সাথে ওদের এই রকম চুক্তি হয়েছে, ইউনিয়ন ফিউনিয়ন করা চলবে না। কতকাল এক সাথে ছিলাম বলুন তো! খুব ইচ্ছা করে ওখানে যেতে। কিন্তু কি কবর, কোন উপায় তো নেই। জীবনটা একটা স্থিতি পেতে যাচ্ছে এখন কোনরকম ছেলেমানুষি করে সেটা নষ্ট করা ঠিক নয়।
জানিনা কেন আমার বুকটা ভেঙেচুরে যেতে থাকে কী এক বেদনায়। আমি এদের কথা শুনে নগর পালিকার অমন আরাম আর নিশ্চিন্ত চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছি, আর এরা মুক্তিমোর্চা ছেড়ে দিয়ে চাকরিতে চলে যাচ্ছে। নিয়োগীজির রক্ত ঘাম শ্রম ত্যাগ করা তপস্যার দ্বারা গড়ে ওঠা সংগঠন শেষ হয়ে যাচ্ছে।
শুধু এদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। এ আমি নকশাল আন্দোলনের দিনেও দেখেছি। অনেক আগুনখোর বিপ্লবীকে চাকরি দিয়ে বিপ্লবী আগুন নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে মন থেকে।
আমি শালা এক গাড়োল। খানিকক্ষণের জন্য ভুলে গিয়েছিলাম যে সারা দুনিয়ার সবাই সমঝোতা করছে। দু কলম লিখে আর দুদিন নিয়োগীজির আগে পিছে ঘুরে বড় বড় আদর্শবাদের বাত ঝাড়ছি, এদিকে যে প্যান্ট ছিঁড়ে পেছন দেখা যাচ্ছে সে দিকে খেয়াল নেই।
.
আমি কাঁকের কাহিনী সমাপ্ত করে অন্য কাহিনীতে যাবো। যে সব কথা এতক্ষণ ধরে শোনালাম তা সেই ১৯৯৫/৯৬ সালের কথা। এখন ২০১২ সাল। ছত্তিশগড় আলাদা রাজ্য হয়ে গেছে। কেরল রাজ্যের চেও বড়ো এই বস্তার জেলাকে ভেঙে পাঁচটা জেলা বানানো হয়েছে। দান্তেওয়ারা, বিজাপুর, নারানপুর, কাঁকের ও বস্তার।
এখন নকশাল আন্দোলন আরও শক্তিশালী হয়েছে। আর হ্যাঁ, প্রবল প্রতাপশালী কাকের নগর পালিকা পরিষদের অধ্যক্ষ রবিশ্রীবাস্তব মারা গেছেন। কাঁকেরে এসে তার সুরক্ষিত বাসভবনে চুকে গুলি করে গেছে নকশালরা।
পরের দিন ভগ্নমনে এক পরাজিত সৈনিকের মত ফিরে এসেছিলাম বাড়িতে। আর কাউকে নয় নিজেকেই বড় অপরাধী বলে মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আমি আমার বউ বাচ্চা কারও সঙ্গে ন্যায় করিনি। আমি তো এখন একা নই আরও তিনটে প্রাণ আছে আমার উপর নির্ভর করে। এই গহীন বনে তাদের আমি ছাড়া আর কেউ নেই। আমার অনেক ভাবনা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিৎ ছিল।
অনু তখন সকাল বেলা দশ কিলোমিটার পথ সাইকেল চালিয়ে পিত্তেপুরিয়া গ্রামে যায়। দুপুরের রোদে সেই পথে আবার ফেরে। দুই সন্তানের মা যার প্রথম সন্তান হয়েছে সিজার করে, দ্বিতীয় সন্তান ফরসেফে, তারপরে পেটে আর একটি অপারেশান আছেনসবন্দীর। এতসব কাটাকুটির পারে রোজ কুড়ি কিলোমিটার উবর খাবর পাহাড়ি পথে সাইকেল চালানো সে যে কী কষ্টের তা একমাত্র সে-ই জানে যে ভুক্তভুগি। যখন সে ফেরে রোদে পোড়া ঘর্মাক্ত মুখের দিকে তাকাতে পারি না লজ্জায়। ওর সব কষ্টের জন্য নিজেকেই দায়ী মনে হয়।
যেদিন দল্লী থেকে ফিরে আসি, ফেরার আগে দেখা করেছিলাম জনকলাল ঠাকুরের সাথে। বলেছিলাম বড় অভাব চলছে। সংসারে চাল ডালের সমস্যা। উনি ভীষণ কষ্টে, যেন এককালীন দান, এমনভাবে পাঁচশো টাকা দিয়ে বলেছিলেন–আমাদেরও আজকাল খুব টাকার টানাটানি। বুঝেছিলাম এই শেষ। আমি আবার এদের কাছে মূল্যহীন হয়ে গেছি। এরপর দল্লী এলে খালি হাতে ফিরে যেতে হবে।
.
একদিন গেলাম সেই ফরেস্টের ডেপুটি রেঞ্জার জনসন ক্র্যাকের কাছে। যাকে একদিন বকেয়া বিড়ির পাতার মজদুরির দাবিতে ঘেরাও করেছিলাম। কিন্তু এখন তার মনে সে রাগ ক্ষোভ অপমানের বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নেই। সময় সব চেয়ে বড় চিকিৎসক। সময় মানুষের সব ক্ষত নিরাময় করে দেয়। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের সবচেয়ে রাগী সব চেয়ে খুংখার সবচেয়ে বদমাশ বলে বদনাম কুড়ানো এই লোকটা কেন কে জানে বর্তমানে আমাকে একটু অন্যরকম চোখে দেখে। কাপসী। অঞ্চলে “নেতাগিরি” করে খাওয়া লোকেদের চেয়ে অন্যরকম। সবাই জানে বন বিভাগ বন বিনাশকারী একটি সরকারি সংগঠন। এরাই জঙ্গলের মূল্যবান কাঠ পাচার করার জন্য বেতন পায় সরকারি কোষাগার থেকে। ফলে অনেক নেতা এবং সাংবাদিক এদের কাছে পৌঁছে যায় ব্লাকমেল করার জন্য। কিন্তু আমি কোনদিন যাইনি। এটাই তার কাছে আশ্চর্যের, এটাই তার কাছে ভালো লাগার এবং এটাই তার কাছে ভয়েরও।
একদিন সে তার সেই ভয় আর বিস্ময় থেকে জিজ্ঞাসা করেছিল–হর কোঈ এক বিল লেকর ফরেস্ট লোগোকে পাশ পৌচ যাতা, কি, চান্দা দেও। লেকিন তুমকো কভি নেহি দেখা!
বলেছিলাম–আমাদের সংগঠন আমাকে কোন বিল যে দেয়নি, চাদা তোলার। যেদিন দেবে সেদিন যাব চাদা নিতে। আর তারপরই বলেছিলাম-চাঁদা চাইনা যদি পারেন আমাকে একটা কাজ দিন। খুব উপকার হবে।
বলেছিলেন তিনি–ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে তো তোমাদের সাপ আর নেউলের সম্পর্ক। আমরা যা করি তোমরা তার বিরোধিতা করো। কি করে ফরেস্টে কাজ করবে? আমি তোমাকে একটা চৌকিদারি দিতে পারি। এটাই আমার হাতে আছে। যারা জঙ্গলের কাঠ চুরি করে কেটে নিয়ে যায়, ধরতে হবে। পারবে?
বলেছিলাম–এই কাজ আমার আদর্শের পরিপন্থী নয়। গাছ আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। নিয়োগীজি পরিবেশ এবং পর্যাবরণ রক্ষার জন্য আন্দোলন করেছিলেন। চিপকো আন্দোলনের নেতা সুন্দরলাল বহুগুনা আমাদের আদর্শ। বন বিনাশ যে করুক চোর বা
সরকার, আমরা তার বিরোধ করি। তাই আমার কাজটা যদি হয় বন রক্ষকের সানন্দে করব। করতে পারব। বলেন তিনি–সরকার যে বনবিনাশ করে তার পিছনে নানা কারণ থাকে, আমি বলব সেটা বাধ্য হয়ে করতে হয়। এই যে হাজার হাজার গাছ কেটে জমি খালি করা হল, তা না করা হলে তো শরণার্থীদের পুনর্বাসন দেওয়া যেতো না। আর সেই বন ধ্বংসের কারণে যারা জঙ্গলের উপর নির্ভরশীল-ফলমূল মধু মাংস জ্বালানি পেত সেই আদিবাসীর চোখে বাঙালী আর তার সাথে সরকারও শত্রু হয়ে গেছে। তা সেটা বাদ দিলাম। এখন সামান্য যে কিছু বন পারাল কোটে অবশিষ্ট আছে সেও জঙ্গল চোরদের হাত থেকে রক্ষা করা যাচ্ছেনা। সবচেয়ে ক্ষতি হচ্ছে খ্যারকাটা বিটের। এক নাম্বার আর দু নাম্বার ভিলেজে মনে হয় চার পাঁচটা করাত দল আছে। ওরাই গাছ কেটে জঙ্গল সাফ করে দিচ্ছে। যদি তুমি কাজ চাও, আমি ওই বিটে চৌকিদারি দেব। পারলে এসো।
চৌকিদারি একটা বিপদজনক বিরক্তিকর কাজ। সারাদিন একা জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে হবে। সারা পারাল কোট জুড়েই কাঠ চোরদের দৌরাত্ম। প্রায় প্রতি বাঙালী গ্রামেই একটা দুটো করাত দল আছে। যারা আট দশজন একত্র হয়ে ঘন জঙ্গলে চলে যায় জঙ্গল ধ্বংস করতে। বীজা সেগুন এসব দামি গাছ কেটে তাকে প্রথমে তক্তা তারপর ফার্নিচার বানিয়ে গোপন পথে পাচার করে দেয় নানা স্থানে। এবং এটাও সত্যি যে এদের সাথে বন বিভাগের কর্মচারীদেরও কারও কারও গোপন লেনদেন আছে।
আমার কাছে এখন সবচেয়ে বড় পেটের টান, আর তাকে সাপোর্ট দেবার জন্য আদর্শবাদের অজুহাত হাতে আছে, তাই পর্যাবরণ প্রেমের দোহাই দিয়ে ঢুকে গেলাম ফরেস্টের চৌকিদারি করতে আটত্রিশ টাকা মজুরিতে। আমার কাজ কে কোথায় গাছ কাটছে তা লুকিয়ে দেখে এসে ডেপুটি রেঞ্জারকে জানানো। সে লোকজন নিয়ে গিয়ে ঘেরাও করে তাদের ধরবে। এ কাজে ভয় অনেকগুলো। সাপ বিছে ভালুক কামড়াতে পারে। জঙ্গলে পথ হারিয়ে অন্যদিকে চলে যেতে পারি। আদিবাসী ধরে বলি দিয়ে দিতে পারে। কাঠ চোরেরা ধরলে মেরে পুতে দিতে পারে। আর তার চেয়েও যেটা বড় ভয় নকশালরা ধতে পারে। ওর কষ্ট কোন জঙ্গলে থাকে সে তো কেউ জানে না। ফরেস্টের লোকরা তাদের দু চোখের বিষ। তারা কোথায় লুকিয়ে আছে পুলিশের কানে বেশ ক’বার তারা বলে দিয়েছে। ওটা একটা, অন্যটা গরিব আদিবাসীর উপর ফরেষ্টের লোকের জুলুমবাজি।
আমার একটা সাইকেল আছে। রোজ সকালে আমি সাইকেলে জল আর দুপুরের খাবার নিয়ে জঙ্গলের দিকে রওনা দেই। কাপসী থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে আসি সেই খ্যারকাটা ড্যামের কাছে। এ পথে জঙ্গল খুবই পাতলা আর কিছু লোকজনের দেখা মেলে। এ দিকে কয়েকটা আদিবাসী কয়েকটা বাঙালী গ্রাম আছে। খ্যারকাটা ড্যাম পার হলে শুরু হয় ঘন জঙ্গল। পুর্ব থেকে সোজা পশ্চিম দিকে মাইল পাঁচ সাত চলার পর উত্তর দিকে ধনুকের মতো বাঁকা পথ ধরি। চলি, আর জঙ্গলে কান পেতে রাখি কোথাও কোন কুড়ুল করাতের শব্দ, কোন মানুষের অস্তিত্ব টের পাই কিনা। পথ মসৃণ নয়, উবর খাবর পাথর মাটির। একটা দুটো নালাও পার হতে হয়। এইভাবে বেলা বারোটা সাড়ে বারোটায় পৌঁছাই জঙ্গলের মধ্যের ছোট গ্রাম ইরিকভুট্টায়। সেখানে এক গাছতলায় বসে দুপুরের খাবার খেয়ে খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে, অন্য এক জঙ্গল পথ ধরে জঙ্গল দেখতে দেখতে ফিরতে থাকি খ্যারকাটা ড্যামের দিকে। এ পর্যন্ত আসতে চারটে বেজে যায়। এতক্ষণ ছিল কঁচা রাস্তা। এবার পাকা রাস্তা। আসবার সময় ছিল চড়াই, এখন উতরাই। খ্যারকাটা ড্যামে চান করে তখন চেপে বসি সাইকেলে। সন্ধ্যে নাগাদ ফরেষ্ট অফিসে গিয়ে রিপোর্ট করি-অল ও.কে। কেউ কোন গাছ কাটছে না। তারপর ছুটি। এই আমার রোজকার কাজ।
একদিন চলেছি এই পথে। ইরিক ভুট্টা গ্রাম তখনও মাইল খানেক দূরে। জঙ্গলের পাশে এখানে আদিবাসীদের অল্প কিছু চাষের জমি আছে। যাতে বর্ষাকালে ধান ভুট্টা এই সব ফসল হয়। বন্যজন্তুদের হাত থেকে ফসল রক্ষা করার জন্য রাত পাহারাদার থাকতে হয় বলে একটি ঘর বানানো আছে–একে স্থানীয় ভাষায় লাড়ি বলে। সেই লাড়ির কাছাকাছি আসতেই ভয়ে সারা শরীর কেঁপে গেল আমার—’রোক’, এই হুঙ্কার শুনে। দেখি এক গাছের আড়াল থেকে আমার বুক সোজা উঁচু করে ধরা একখানি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র, তাড়াতাড়ি সাইকেল থেকে নিচে নেমে হাত উঁচু করে দাঁড়াই। একবার আমি জঙ্গলে চোরা শিকারীর সামনে পড়েছিলাম। হরিণ খরগোস কিছু একটা মারবে বলে চারখানা গাদা বন্দুক নিয়ে বনে এসেছিল। আমাকে দেখে বন্দুক ফেলে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালিয়ে ছিল তারা। আমি ডেকে তাদের বন্দুক নিয়ে যেতে বলি। আদিবাসী কামার শালায় বানানো সে বন্দুকের চেহারা এমন কদাকার যে দেখলে ভয় করে না, হাসি পায়। কিন্তু এই অস্ত্রখানা দেখলে প্রাণ আপনি উড়ে যায়।
বন্দুকধারী এবার গাছের আড়াল থেকে বের হয়ে আসে। তার পরিধানে লতাপাতা আঁকা সামরিক পোষাক। তার জিজ্ঞাসা–তোম কোন? বলি–বাঙালী। কাপসীতে থাকি।
জঙ্গলমে ক্যা কর রহা?
প্রশ্নের জবাবে বলি–মার্কিং করছি। অর্থাৎ যে কটা গাছ এখনও চোরে নিয়ে যায়নি তা গুনে রাখছি। তখন সে আমাকে নিয়ে গেল সেই লাড়িতে। দেখি, তারই মত পোষাক পড়া আরও পাঁচজন শুয়ে বিশ্রাম করছে। একজন রান্না করছে। সেই মাঠের কাছে পাঁচ ছটা ছেলে গরু চড়াচ্ছে। তাদের ডাকল ওরা। ছেলেরা কাছে এলে তাদের আমাকে দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করল–একে চিনিস? আদিবাসী বালকেরা–মাথা নাড়ে-কৌন জানে। অর্থাৎ চেনে না। তখন তাদের বলে একজন–প্যাটেলকো বুলা লা।
এই গ্রামের প্যাটেলের নাম সুরজা রাম। এ সেই চেতনা মণ্ডল সংস্থার এক নেতা যাকে সুরেশ মোড়ে ভোটে দাঁড় করাতে চেয়েছিল, আর আমি বিরোধিতা করেছিলাম নেতাম-এর লোক বলে। এখন সে আসছে আমাকে শনাক্ত করার জন্য। সে যদি বলে চিনি না বা যদি বলে পুলিশের চর, কপালে আমার দুর্ভোগ লেখা আছে।
শোয়া কজন সব এখন উঠে বসেছে। একজন জানতে চায়–জনসন ক্র্যাক কব আয়েগা ইধর?
যে কোন সময় আসতে পারে। ভীষণ সাহসী এই অফিসার একা যখন তখন জঙ্গলে ঢুকে যায়। বুলেট মোটর সাইকেলে সারা জঙ্গল কাঁপিয়ে–দাপিয়ে বেড়ায়। ভয় পাই আমি, এখন যদি এখানে এসে পড়ে–আর কী এরা আস্ত রাখবে। কদিন আগে এইইরিক ভুট্টা থেকে এক আদিবাসীর বাঁধা ঘর ভেঙে দরজা জানালা সব নিয়ে গেছে। কেস দিয়েছে। তার বদলা আজ এরা নিয়ে নেবে।
বলি আমি–অফিসার লোগ কব কাহা যাতা হামকো বাতাকে থোরিই যায়েঙ্গে?তখন আবার বলে সে–জিসদিন বো জঙ্গলমে মিল যায়েগা উসদিন উসকা আখেরি দিন হোগা।
এতক্ষণে সুরজারাম এসে পড়ে। সে আমাকে দেখে বলে–আরে এ তোমরা কাকে ধরেছ। এতো আমাদের নিয়োগীজির লোক। সুরজার প্রতি কৃতজ্ঞতায় আমার মন আপ্লুত হয়ে ওঠে। আমি একদিন ওর বিরোধিতা করেছিলাম। বাগে পেয়েও সে তার শোধ নিল না। কিন্তু “দাদালোগ” সুরজার কথা শুনে বড় অবাক। এ কী করে হয়। মোর্চার লোক হয়ে ফরেষ্টের মজদুরি। ওঝার অনুগামী হয়ে সাপের সাথী–এত বড় রঙ্গ।
বলি–নিয়োগীজি বলতেন-গরিব মানুষের কাছ থেকে কোন নীতি নৈতিকতার আশা করা যায় না। খিদেয় তার পা পিছলে দেয়। আমি বাইরে থেকে এখানে এসে পড়েছি। এক কাচ্চা চাষের জমি নেই। এখানে আমার করার মতো কোন কাজ নেই। সংগঠনের অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। কী করব, বাধ্য হয়েই এই সব। ওদের রান্না হয়ে গেছে। আতপ চালের দলাদলা ভাত আর কুলতির কালো ডাল। আর কিছু নেই। সাতজনের দুজন মেয়ে। একজন কালো আর সামনের একটা দাঁত অর্ধেক ভাঙা। এদের অন্ধ্র প্রদেশের বলে মনে হয়। ছেলেদের এক দুজন বস্তারের থাকলেও থাকতে পারে। আমার কাছে সেদ্ধ চালের ভাত আলুর তরকারি পেঁয়াজ কাঁচালঙ্কা ছিল। আমি সেগুলো বের করে ওদের সাথে মিলে মিশে খাই।
খেতে খেতে একজন বলে–তোমরা নিয়োগীজিকে বাঁচাতে পারলে না।
বলি–আমি থাকি বস্তারে, উনি ছিলেন ভিলাইয়ে। যাদের উপর ওনাকে রক্ষা করার দায়িত্ব ছিল, তারা কি করেছে তা আমি কি করে বলব। তবে এটুকু আমি বলতে পারি, যদি আমার উপর সে ভার থাকত, নিয়োগীজিকে বাঁচাতে পারি আর না পারি খুনিকে অত সহজে পালিয়ে যেতে দিতাম না। তার লাশও ওখানে পড়ে থাকত।
আর একজন বলে নিয়োগীজি মারা যাবার পর একটা মহল এই রকম একটা ধারণা তৈরি করার চেষ্টায় ছিল যে পি.ডব্লু.জি তাকে মেরেছে।
বলি আমি-সেটা মুক্তি মোর্চা বা সাধারণ মানুষ কেউ বিশ্বাস করে নি। কারণ নকশালরা যা করে, তার দায় স্বীকার করে নেয়। নিয়োগীজির বেলা তারা সেটা করেনি।
অন্য একজন বলে–জনকলাল ঠাকুরের এখন পি.ডব্লু.জি সম্বন্ধে, তাদের কাজ সম্বন্ধে কি বক্তব্য?
বলি–নিয়োগীজি বলতেন–তিনি নকশালদের প্রত্যেকটা কথা, প্রত্যেকটা কাজের সমর্থন করেন। শুধু সমর্থন করেন না কাঁধের বন্দুকটা। জনকলাল ঠাকুর যখন তার অনুগামী ওই কথাই বলবে বলে আমার ধারণা।
–কিন্তু সারা দেশ জুড়ে যে রকম রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চলছে–মানুষের ন্যায্য দাবিদাওয়ার আন্দোলন যেভাবে বন্দুক দিয়ে দমন করা হচ্ছে, অস্ত্র ছাড়া কি ভাবে তার মোকাবিলা করা সম্ভব হবে?
আমার জবাব–সংগঠিত ব্যাপক গণ আন্দোলন। কথাটা বলে মনে হয় আমি তোতা রটন রটে যাচ্ছি। তার জবাবে সে বলে–ছত্তিশগড়ে নিয়োগীজির মত গণ সংগঠন আর কার ছিল? কে এতবড় ব্যাপক আন্দোলন গড়তে পেরেছে? কিন্তু সংগঠন তার নেতাকেই রক্ষা করতে পারেনি। পঁচিশ বছরের চেষ্টায় যে সংগঠন তিনি গড়েছিলেন, এক গুলিতে সব শেষ। মোর্চার কোমর ভেঙে গেছে। আর কোনদিন কী সে ভাঙা কোমর সোজা করে উঠে দাঁড়াতে পারবে?
বলি আমি–তাহলে যারা প্রথম দিকে নকশাল বাড়িতে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন চারু মজুমদার কানু সান্যাল জঙ্গল সাওতাল সুশীতল রায়চৌধুরী খোকন মজুমদার, সরোজ দত্ত, তারা
তো আজ নেই। কেউ মারা গেছেন কেউ সরে গেছেন, কিন্তু আন্দোলনটা আজও আছে। স্থান কাল পাত্র অনুসারে তার আকার প্রকার তত্ত্বের কিছু পরিবর্তন পরিবর্ধন ঘটেছে বটে–কিন্তু যেটা মুল বিষয়–সেই শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে মানুষ তো লড়েই যাচ্ছে।
এরপর বলে একজন–যদি আমাদের কোনদিন প্রয়োজন হয় তোমার সাহায্য কতটা পেতে পারি?
বলি–আমি একজন সংসারে বাঁধা পড়ে যাওয়া মানুষ। যতটা সাহায্য করলে আমার ঘর সংসার বরবাদ না হয়ে যায় ততটা।
এখন তাদের ব্যাগপত্র গোছানো হয়ে গেছে। এবার তারা স্থান বদল করবে। বড় বিপদজনক পথের যাত্রী ওরা। একই স্থান অনেকক্ষণের জন্য তাদের কাছে নিরাপদ নয়। বলে তারা আবার দেখা হবে। কিন্তু আমার মন জানতো আর দেখা হবে না।
ওরা চলে যাবার পর ইরিক ভুট্টা থেকে কাপসী ওই দশ কিলোমিটার পথ যেন এক মরণ ম্যারাথন দিয়ে শেষ করেছিলাম আমি। ফরেষ্ট অফিসে পৌঁছে ওদের দেওয়া বার্তাটি রেখেছিলাম জনসন ক্র্যাকয়ের কাছে–সাব, দাদা লোগোকো সাথ মুলাকাত হো গিয়া থা জঙ্গলমে। ও লোগ আপকা ইন্তেজারমে বইঠা থা। বোলকে গিয়া আপ জঙ্গলমে মাৎ জানা। আগার আপ জঙ্গলমে দিখ যায়ে–ওহি আপকা আখেরি দিন হোগা।
আমার কথা শুনে অসম সাহসী লোকটার কপালে দেখা দিয়েছিল বিন্দু বিন্দু ঘাম। ফরসা মুখ লাল হয়ে গিয়েছিল উচ্চ রক্ত চাপে। দিন কয়েক সে আর অফিস ছেড়ে কোথাও বের হল না। তারপর একদিন ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে গেল। ছুটির পরে সে তার কর্মস্থল উপর মহলের প্রভাবে বদলে নিল কোণ্ডাগাও ফরেষ্টে। আমার কাজটাও চলে গেল। চৌদ্দ দিনের কাজের কোন পয়সা পাওয়া গেল না।
.
কাঁকের শহর থেকে তিরিশ কিলোমিটার পশ্চিমে একটি ছোট্ট মফস্বল টাউন আছে যার নাম লাখনপুরী। এখানে রাজিন্দর বলে একজন লোক থাকে। তার শুভ চিন্তক নামে একটি সমাজসেবী সংস্থা আছে। এমনিতে বস্তার জেলায় সমাজসেবী সংস্থা, যার ইংরাজি নাম এন.জি.ও–তার কোন অভাব নেই। যারা দেশ বিদেশের বহু দান অনুদান বস্তার জেলার আদিবাসীদের উন্নয়নের জন্য পেয়ে থাকে। আদিবাসীদের উন্নয়ন হোক বা না হোক যারা এর সঞ্চালক তাদের প্রভুত উন্নয়ন হয়ে থাকে।
শুভ চিন্তক সমাজ সেবী সংস্থাটি উদ্ভব হয়েছিল–ইঁদুর মারো এই কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে। সেই সময় কি এক কারণে কে জানে বস্তার জেলার ইঁদুরের সংখ্যা ভীষণভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। কৃষকদের কষ্টের ফসল সব চলে যাচ্ছিল ইঁদুরের উদরে। তাই শুভ চিন্তক নেমে পড়েছিল লাঠিসোটা নিয়ে। এরপর সাক্ষরতা বিস্তারে তারা কিছুদিন জিপে মাইক বেধে ক্যাসেট করা বক্তৃতা হাটে হাটে ঘুরে মানুষকে শোনায়। নাটক করে মানুষকে বোঝায় যে সাক্ষর হওয়াটা কতখানি দরকারি। এরপর পরিবার নিয়োজন, ম্যালেরিয়া নির্মুল, কুষ্ঠরোগ নির্মূল, বৃক্ষরোপণ, মাদক বর্জন, নানাবিধ বিষয়ে তারা নাচগান নাটক বক্তৃতার আয়োজন করে যথেষ্ট সুনাম কুড়িয়েছে।
সম্প্রতি তাদের বাসনা হয়েছে একটি অনাথালয় স্থাপনার। নাগপুরের একটি সংস্থা-নারায়ণ সেবা আশ্রম তাদের প্রেরণার উৎস। ওই সংস্থা সারা বছর ধরে বস্তারের হাটে বাজারে দোকানে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অফিসে দলে দলে ঘুরে হাজার হাজার টাকা চাঁদা তুলে নিয়ে চলে যায়। এখানকার টাকা এই ভাবে–জেলার বাইরে, প্রদেশের বাইরে চলে যায়। দানশীল মানুষ, যারা দান করতে চায় অনাথ অসহায় বাচ্চাদের, তারা চাইলেই বা কি করে দান দেবে? বস্তারে যে কোন অনাথালয়ই নেই। তাই রাজিন্দর পণ করেছে একটা অনাথালয় বানাবে। মাতৃপিতৃহীন যে সব বাচ্চা পথে পথে ঘুরে বেড়ায় সবাইকে ধরে এনে এখানে রেখে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করবে।
এটা একটা মহৎ কাজ সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। আর সব মহৎ কাজের সঙ্গে কাকেরের যে লোকটা যুক্ত থাকে তার নাম নাজিব কুরেশি। ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চার সঙ্গে সে যেমন একটা মহৎ প্রেরণায় যুক্ত হয়, রত্নেশ্বর নাথের সঙ্গে, বস্তার জেলার আরও গোটা পঁচিশ সংস্থার সঙ্গে সে যুক্ত। যুক্ত সে শুভ চিন্তকের সঙ্গেও।
একদিন নাজিব কুরেশির মাথায় আসে–কাপসীর বাঙালী দাদা মনোরঞ্জন ব্যাপারীর হাতে এখন কোনই কাজ নেই। একেবারে হাত পা গুটিয়ে বসে আছে। তাকে শুভ চিত্তকের সাথে যুক্ত করে নিতে হবে। তাতে তারও লাভ, লাভ শুভ চিন্তকের। যার ফলে একদিন শুভ চিন্তকের কর্ণধার রাজিন্দর আর নাজিব যৌথভাবে পরামর্শ করে দুজনে মোটর সাইকেলে চেপে হাজির হল আমার কাছে। দাদা তোমাকে নিতে এসেছি। বলে নাজিব–আমরা কেউ সংস্থা থেকে কোন ভাতা নিইনা। তবে তোমার যাতে সংসার চলে সেই রকম একটা ব্যবস্থা করা হবে। রাজিন্দর জানায়–এখন দিনে পঁচিশ মানে সাড়ে সাতশো, এটা থাকবে ভাতা। আর যে কাজটা আমাকে দেওয়া হবে–সেটা যদি ঠিকঠাক করতে পারি, যাতে আরও কিছু পাই সেটা দেখা হবে।
–কি কাজ?
–কাজ আবার কি? সমাজ সেবা। অনাথ বাচ্চাদের সেবা করা এই তো। পরের দিন সকালে, গিয়ে পৌঁছালাম লাখনপুরী। সেখানে ইতিমধ্যে ষোলটি বাচ্চা ছেলে দুটি বাচ্চা মেয়ে যোগাড় হয়ে গেছে। অনুসন্ধান চলছে, আরও আসবে। এক সহৃদয় ভদ্রলোক আপাততঃ অস্থায়ী অনাথালয় হিসাবে তার একটি বাড়ি ব্যবহার করতে দিয়েছেন। রাজিন্দর তহসিলদার, পাটোয়ারি এদের সাথে কথা বলেছে। তারা কথা দিয়েছে যাতায়াতের সুবিধা যুক্ত কোথাও খাস জমি থাকলে পাঁচ ছয় একর ব্যবস্থা করে দেবে। কে একজন বলেছে–তার মায়ের নামে অনাথালয় হলে সে একটা বড় ঘর বানিয়ে দেবে। ওর এ তও
বাচ্চাদের দেখাশোনা করার জন্য দুজন মহিলাকে রাখা হয়েছে। একজন রান্না করে অন্যজন ওদের চান করায় জামা কাপড় পড়ায়, স্কুলে দিয়ে আসে। পাশেই একটি প্রাথমিক সরকারি বিদ্যালয় আছে। সব তো ঠিকঠাকই চলছে। তবে আমার জন্য কি কাজ! অনাথদের কোন সেবা করার জন্য আমাকে এখানে আনা, আর দিনে পঁচিশ টাকা ভাতা দেওয়া।
দিন কয়েক পরে একটা বিল ধরিয়ে দিল আমার হাতে রাজিন্দর–এই যে দাদা, এই তোমার কাজ। কাকের কেসকল কোড়াগাও ভানুপ্রতাপপুর বিল নিয়ে যেদিকে মন চায় চলে যাও। দোকানে হাটে বাজারে মানুষের বাড়ি। কথা তো তুমি জানো। তাদের বুঝিয়ে বলল আমরা কি করছি আর কি কি করতে চাই। তারপর চাঁদা চাও। কোন জোর নেই, যে যা দেয়।
রাজিন্দর বেশ অনেকক্ষণ ধরে বোঝালো যে বস্তার জেলার বিত্তবান মানুষ দানটাকে একটা পুণ্যকর্ম বলে মনে করে। বিশেষ করে সিন্ধি আর মাড়োয়ারিরা। কেউ গিয়ে দরজায় দাঁড়ালে খালি হাতে ফেরায় না। যদি আমি সারাদিনে কুড়ি পঁচিশটা দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়াই যদি দশ টাকা করেও দেয় দু তিনশো কোথাও যাবার নয়। যারা এই ভাবে ঘুরে ঘুরে চাঁদা তোলে নারায়ন সেবাশ্রম তাদের শতকড়া চল্লিশ টাকা কমিশন দেয়। শুভ চিন্তকও আমাকে তাই দেবে। সে এও বলে-অনাথ বাচ্চাদের সেবা করার মতো মহৎ কাজ আর কিছু হয় না।
জীবনে আমি অনেক রকম কাজ করতে বাধ্য হয়েছি। কিন্তু ভিক্ষে কখনও করিনি। কে জানত ভাগ্য আমাকে একদিন সেই কাজও করার জন্য মনোনীত করবে। চাঁদা চাওয়া এ তো এক ধরনের ভিক্ষাই। তা-ও আবার কমিশনে। হে জীবন, তুমি আমাকে আর কোথায় নামাবে। নামতে নামতে সপ্ত পাতালের শেষ তলে রসাতলে যে পা ঠেকে গেল। বাড়িতে অনু আমার পথের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। আমি কাজ করে “মাইনে” নিয়ে বাড়ি যাব টাকা পেলে ওরা দুবেলা ভাত খেতে পারবে। এখন আমি কী করব? বাড়ি ফিরে গিয়ে বলব, কাজটা পছন্দের ছিল না?
জয়হোক জীবন তোমার। তুমি ধন্য। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো যিনি তোমাকে এই জীবন দিয়েছে। বলো তো এক জীবনের মধ্যে কত রকম জীবনের স্বাদ। এমন জীবন আর কার আছে। এত বড় প্রাপ্তি বড় ভাগ্যে মেলে। ছাগল চড়ানো থেকে জীবন শুরু করে হাজার মাইল পথ হেঁটে এখন তুমি এসে পৌঁছেছে তোমার যোগ্য জায়গায়–ভিক্ষায়।
তবে আর কী! চালাও পানসি। স্রোতে ভাসা মরা মানুষের মত ভেসে চলো, যতক্ষণ পচে গলে জল হয়ে না যাও। কেড়ে নেবার ক্ষমতা যখন অর্জন করতে পারোনি, বর্জন করো আত্মসম্মানবোধ। হাত পেতে দাঁড়াও মানুষের দরজায়। বলো–বাবুগো কিছু দিন, বাড়িতে বউ বাচ্চা অনাহারে। আপনি কিছু দিলে তবেই আমি কিছু পাবো।
বের হয়ে পড়লাম বস্তার পরিক্রমায়। আমার কাছে বিল বই আছে। আর আছে শুভচিন্তক সংস্থার কাগজ পত্রের জেরক্স। বহু বিশিষ্ট মানুষ দ্বারা প্রদত্ত প্রমাণপত্র–যে আমি ব্যক্তিগত নয়, একটি সমাজসেবী সংস্থা দ্বারা মনোনীত দান সংগ্রহকারী। কোন নকলি মাল নই। এই কাজ করতে গিয়ে মানব মন সম্বন্ধে আমার এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা হল। মোটামুটি আমার যা হিসেব তাতে প্রতি একশোজনের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালে শতকরা পাঁচজন মুখে যা আসবে তা বলে অপমান করবে। পয়সা দেবে না, বাক্য দিয়ে বিষ ঝেড়ে দেবে।কীসের অনাথ সেবা শুনি। সব ধান্দাবাজি। বাচ্চাদের নাম করে নিজেদের পেট ভরাবার চালাকি। এর চেয়েও খারাপ খারাপ কথা বলে বিদেয় দেবে। উল্টো দিকে পাঁচজন বেশ ভালো রকম দান দেবে। যা কখনও একশো টাকার কম হবে না। আপনারাই সত্যিকারের সেবা কাজ করছেন। আসবেন মাঝে মাঝে। যতটুকু যা পারি নিশ্চয় দেব। এই সব ভালো কথাও বলবে। পঁচিশ থেকে তিরিশজন দান দেবে পাঁচ টাকা থেকে পঁচিশ টাকার মধ্যে। কেউ খুশি মনে কেউ বিরক্ত হয়ে। কেউ কেউ চাঁদা দেবার আগে বিলটা চেয়ে নিয়ে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পাতা উল্টে দেখবে আশেপাশের কে কত উঁদা দিয়েছে। তিনি দেবেন তার চাইতে কমপক্ষে পাঁচ টাকা বেশি। কেউ আছে যিনি চাদা দেবেন কিন্তু বিল নেবেন না–বিল চাই না কারণ যে পরিমাণ চাঁদা তিনি দিয়েছেন তা তার কাছে এত তুচ্ছ যে বিলে লিখলে যদি কেউ দেখে নেয় সেটা তার পদ এবং প্রতিষ্ঠার পক্ষে সম্মানজনক হবে না। এটাই তার ধারণা। কেউ চাঁদা দেবার আগে সমস্ত প্রমাণপত্র খুটিয়ে পরীক্ষা করে দেখবেন। দানটা যথার্থই অনাথ সেবায় যাচ্ছে কিনা। আর পঁচিশ থেকে তিরিশজন যত ককাই যত বোঝাই পাঁচের উপর কিছুতে উঠবেন না। তবে খালি হাতেও ফেরাবেন না। এক দুই–কিছু দেবেন। আর বাকি যারা তারা কপালে হাত ঠেকাবে–মাফ করো।
এইভাবে চাদা তুলতে একবার গেছি কেসকল ঘাটিতে। কেসকল ঘাটি দুর্গম বন আর পাহাড় ঘেরা একটা অঞ্চল। এখানে যে কারণে নকশালদের একটা দলম বহুদিন ধরে বেশ নিরাপদে ঘাটি গেড়ে আছে। আর তাদের সাথে মোকাবিলার জন্য এখানে এনে রাখা হয়েছে কিছু আধা সামরিক বাহিনীর জোয়ান।
বস্তার জেলায়–যারা ঘুমক্কর অর্থাৎ ঘুরে ঘুরে বেড়ায়, যেমন আমি, এদের প্রতি প্রশাসনের নির্দেশ আছে, আগে তাকে নিকটস্থ পুলিশ ফাঁড়িতে গিয়ে সুচনা দিতে হবে। জানাতে হবে তার সম্পূর্ণ গতিবিধি। কেন সে এখানে এসেছে, কোথা থেকে এসেছে রাতে থাকবে কিনা, থাকলে কোথায় থাকবে। যে এই নির্দেশ পালন করবে না পুলিশ আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারবে। আইন রক্ষা করতে আমি পৌঁছেছি ওখানকার পুলিশ ফাড়িতে। তখন বেলা মনে হয় বারোটা হবে। পুলিশদের কেউ চান করছে কেউ ঘুরছে কেউ ঘুমোচ্ছে। আর যিনি এই বাহিনীর কমাণ্ডার-চান করে চুল আঁচড়ে এক তাবুতে বসে সদ্য হাতে আসা খবরের কাগজে পড়ছেন। গিয়ে দাঁড়াই তার সামনে এবং এখানে আসার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করি।
আমি গিয়েছিলাম ওনার কাছে অঞ্চলটিতে পরিভ্রমণের পারমিশান নিতে। ওনার ধারণা হল গেছি অনাথদের জন্য সাহায্য চাইতে। খবরের কাগজ ভাজ করে রেখে উনি উঠে জামার পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট এনে আমার হাতে দিয়ে দুঃখ করলেন, মাসের শেষ, এর বেশি দেওয়া যাবে না। তারপর হাঁক দিলেন সহকর্মীদের–সব লোগ ইধার আও। দেখো, এ আদমি হাম। সবকে পাশ আয়া হ্যায়। কোন ক্যা মদত কর সকতে হো।–করো!
পুলিশ সম্বন্ধে আমার ধারণা এরা ঘুষখোর অভদ্র অত্যাচারী নির্দয়। কিন্তু জানা ছিল না যে এদের মধ্যে এমন তিরিশজনও আছে যারা শুধু নিতে জানে না, ভালো কাজের জন্য দিতেও জানে। প্রত্যেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে একের পর এক নাম লিখিয়ে, বিল নিয়ে, দশ টাকা করে তুলে দিল আমার হাতে, লাখনপুরীতে বাস করা অনাথ বাচ্চাদের জন্য। যখন আমি সব কাজ সেরে ফাঁড়ি থেকে বের হয়ে বাস স্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে চলেছি, দেখি একজন পুলিশ–হেই রোকো হেই রোকো করতে করতে ছুটে আসছে। আমি থামতে সে এসে আমাকে দিল এক তীব্র ভৎর্সনা, সবার কাছ থেকে চাঁদা নিয়েছি আর তাকে কিনা বাদ দিয়ে চলে যাচ্ছি। চাঁদা নিতে গিয়ে ভর্ৎসনা খেতে হয় তা জানতাম, জানতাম না যে না নিলেও তা খেতে হতে পারে।
দিন পনেরোর মধ্যে আমি বেশ পরিণত হয়ে গেলাম। কালীপুজো দুর্গাপুজো এবং রাজনৈতিক দল কারও জন্য কোনদিন চাঁদা তুলিনি। আমি যে এত ভালো চাঁদা তুলতে পারি আগে জানতাম না। বক্তৃতা দেবার অভ্যেস ছিল, কথার সাথে কথা জুড়ে কি ভাবে নিজের বক্তব্য জোরালো করে তুলে চাঁদার বিলে একটা মোটা অংক বসিয়ে নিতে হয় সেটা শিখে গেছি। দিনে এখন তিন চারশো টাকা অনায়াসে তুলে ফেলি। ভিড়ভাড় আর বড় শহরের মানুষ একটু যান্ত্রিক, আবেগ শুন্য ও সংবেদনশীলতাহীন হয় তাই আমার পছন্দ ছোট শহর নগর আর ফাঁকা ফাঁকা অঞ্চল। একবার এক পারাল কোটের বাঙালী গ্রামে চাঁদা চাইতে গিয়ে চাঁদা না নিয়ে একেবারে খালি হাতে ফিরতে হল আমাকে। কারণ আর কিছুই নয়-এদের কাছে নগদ টাকা নেই। নিতে হলে চাল নিতে হবে। কিন্তু আমার কাছে বস্তা নেই। বস্তা বইবার লোকও নেই।
আমার বাবা মাঝে মাঝে বলতেন–নিজের খাবার ঠিক নেই কেডি (কুকুর) পালে বরগা। অর্থাৎ যে লোকটা নিজেই খেতে পায়না সে আধা ভাগে কুকুর পুষতে নিয়েছে। আমি এখন তাই করি। কেনারাম নামে একটি ছেলেকে আমার সঙ্গে রাখি।
পারালকোটে একশো তেত্রিশটি গ্রাম, উমরকোটে পয়ষট্টি আর মালকানগিরিতে দুশোর কিছু বেশি। একদিনে এক গ্রামের বেশি ঘোরা যায় না। তাহলে সব কটি গ্রাম ঘুরতে বছর শেষ হয়ে যাবে। আর বছরে একবার তো সব বাড়িতে যাওয়াই যায়। যারা নাগপুর থেকে এখানে আসে, এসেই বলে–বছরে একবারই আসি। ওদেরও নিশ্চয় তিনশো পঁয়ষট্টিটা শহর নগর গ্রাম এলাকা ধরা আছে। বাংলা আমার প্রাণের ভাষা বাঙালী আমার আপনজন। দণ্ডকারণ্যের বাঙালীদের গ্রামগুলো আমার অধিকারে নিতে হবে। বছরে একবার যেতে হবে সব দরজায়। যদি প্রতি ঘর থেকে বেশি না এক কিলো চালও দেয়। তো বস্তা ভরে যাবে আমার।
কেনারাম বলল–পারাল কোট এখন থাক। সবাই এখানে চেনে তাই একটু লজ্জা লজ্জা করে। আগে চলো উমর কোট তারপর মালকানগিরি। ও দিকে যদি আমাদের চলে যায় তাহলে এদিকে আর যাই না। তাই একদিন কেনারামের সাথে গেলাম উমরকোট। সরাসরি বাসে নয়, কোল্ডাগাও থেকে পথে চাদা তুলতে তুলতে।
উমরকোট! উড়িষ্যার এক রুক্ষ ঊষর ভূমির নাম। পূর্ববঙ্গের একদল মানুষকে সেই কবে যেন মায়ের কোল থেকে তুলে এনে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল এই অহল্যা মাটিতে। সেই মাটিকে মানুষ তার কঠিন শ্রমে আজ বাসযোগ্য করে নিয়েছে। মৃত্যুকে পরাস্ত করে বেঁচে আছে। তারা। কঠোর জীবনযাত্রা, অগ্নিবর্ষি রোদের তাপ তাদের শরীর ঝলসে দিলেও মনটা কিন্তু রেখে দিয়েছে এখনও সেই আগেরই মত নরম কোমল। এখনও তারা তাদের কৃষ্টি সংস্কৃতিকে ধরে রেখেছে ঝিনুকের বুকের মুক্তোর মত। সেই কবে কে যেন তাদের বলেছিল–ক্ষুধার্তকে অন্ন দাও তৃষ্ণার্তকে জল দাও আশ্রয়হীনকে আশ্রয় দাও, সে তারা আজও ভোলেনি। কে যেন তাদের বলেছিল-অতিথি নারায়ণ। বলেছিল নারায়ণ নররূপ ধরে মাঝে মাঝে মানুষের দুয়ারে এসে দাঁড়ায়, তাকে পরীক্ষা করার জন্য। তাই নর মাত্রেই নারায়ণ জ্ঞানে সেবা করো।
বড় আশ্চর্য এই গরিব বাঙালী গ্রামগুলো। যে বাড়িতে গিয়ে দাঁড়াই “ভিক্ষা দেয় পরে আগে চাটাই পেতে বসায় জল বাতাসা দেয়, কুশল জিজ্ঞাসা করে। দুপুর হলে তো কথা নেই, তেলের শিশি আর গামছা এগিয়ে দেয়–চান করে দুটো ডালভাত সেবা করুন। বাকি কথা পরে। রাত হলে যে বাড়ি গিয়ে বলি—খেতে দিতে হবে না, রাতটা একটু থাকতে দেবেন? জবাব আসে, না খেলে আমার বাড়িতে থাকার জায়গা হবে না। এত অভাব এত দুঃখ কষ্টের মধ্যেও মানুষের মনের প্রসারতা দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারি না। নিম্নবর্ণের মানুষের এমন উচ্চ মনোবৃত্তি উচ্চদের মধ্যে নেই। আমি ধর্ম মানি না, কিন্তু যে ধর্ম মানুষকে এমন মহান বানিয়ে দেয়–উদার বানিয়ে দেয় তাকে প্রণাম। যে ধর্ম মানুষকে বলে যত্র জীব তত্র শিব তাকে প্রণাম।
একদিন বাস থেকে নেমে আমরা এক গ্রামের দিকে হাঁটা দিয়েছি। তার আগে জিজ্ঞাসা করে জেনে নিয়েছি একজনের কাছ থেকে সেই গ্রামে যাবার পথটা। যখন আমরা মাইল দুয়েক গেছি দেখি সেই লোকটি একখানা সাইকেল নিয়ে দাদা দাঁড়ান দাদা দাঁড়ান করে ছুটে আসছে। আমরা থামতেই কাছে এসে বলেন তিনি ওই গ্রামে আপনারা কেন যাবেন? কেন যাব তা বুঝিয়ে বলি তাকে। বলেন তিনি–তা আপনারা তো বাইরের লোক। এখানে দুপুরে খাবেন কোথায়? বলি যে এখনও তো তা জানি না। গিয়ে দেখি। তখন বলেন তিনি–আমি এই গ্রামেই থাকি। যাকে বলবেন মাষ্টারের বাড়ি দেখিয়ে দেবে। দয়া করে আজ আপনারা আমার অতিথি হবেন। আমি বাজার করতে এসেছি। একটু পরেই বাড়ি যচ্ছি। আসবেন কিন্তু আপনারা!আসবেন তো?
দুজন অজানা অচেনা বিদেশী মানুষ আজকের পরে আর যাদের সাথে কোনদিন দেখা হবার নয়, তাদের এমন আদর আপ্যায়ন করে নিয়ে গিয়ে অন্নদান করার আকুলতা, এর উৎসভূমির অনুসন্ধান আমি করে উঠতে পারিনি আজও। শুধু নীরবে মাথা নত করেছি এমন মানুষের পায়ের ধুলোয়।
.
আমার জীবনটা যেন হাল ভাঙা পাল ছেঁড়া কান্ডারি বিহীন একটা নৌকার মত। ছোট ঢেউ বড় ঢেউ মেজ ঢেউ সেজ ঢেউ–এক একটা ঢেউ এসে লাগছে আর নৌকা কুলহীন অতল অজানার দিকে ভেসেই যাচ্ছে। কেন যে যাচ্ছে কি করে থামবে–কোনদিকে গেলে যে কুল পাবে সে তা জানে না।
সেই যে বালক বেলায় এক অজানা উদ্দেশ্যের দিকে যাত্রা শুরু করেছিলাম–হাজার মাইল পথ হেঁটে এসেও আজও তার সমাপ্তি হলো না। ক্রমাগত চলতে হচ্ছে। আমি শ্রান্ত ক্লান্ত হয়ে থামতে চাইলে–কে যেন পেছন থেকে ঠেলে সামনের দিকে এগিয়ে দেয়। কে সে? সেকি আমার অদেখা অজানা-নিষ্ঠুর ভবিতব্য!
কিন্তু আমি যে আর পারছি না। ভীষন ক্লান্ত আমি। দেহ মন যে বিশ্রাম চাইছে। চাইছে পায়ের নিচে একটা স্থির ভূমি। যেখানে নিশ্চিন্তে দুদন্ড বসা যায়। পাশে পাওয়া যায় কোন প্রিয়জন। পরম নির্ভরতায় যার কাঁধে মাথাটা রাখা যায়। একটু হাসা যায়, একটু কাঁদা যায়।
তেমন এক জীবনের তপস্যায় উন্মাদপ্রায়, প্রচলিত অপ্রচলিত কত পথ হাঁটলাম, হাঁটতে হাঁটতে এসে গিয়েছিলাম এই সবুজ অন্ধকারে। সেই যে কবিগুরু বলেছেন ‘দাও ফিরে সে অরন্য লহ এ নগর’। অমি সেই অরন্যে একটি বৃক্ষ হতে চেয়েছিলাম। বনস্পতি নয়–গৃহস্থের উঠোনের এক ধারে একটা ছোট তুলসি চারা। মাটিতে শেকর বসাবার আগেই এক ঝড়ে ছিন্নভিন্ন ভুলুষ্ঠিত হয়ে গেছে সব সম্ভাবনা। আবার শুরু হয়ে গেছে ঘুরে বেড়ানো উড়ে বেড়ানো ভেসে বেড়ানো, শেকড়হীন জীবন। অপ্রতিরোধ্য ভবিতব্য আবার প্রবল ধাক্কা দিচ্ছে। তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে স্থান থেকে স্থানান্তরে। সে বলছে এই জীবন তোর জীবন নয়। আমি ক্লান্ত কাতর স্বরে জানাতে চাইছি–তাহলে কোন জীবন আমার জীবন। সে বলছে এগিয়ে চল–সামনে আছে।
আমার ভবিতব্য আমাকে বাধ্য করেছে সামনে আগাতে। তুচ্ছ মানুষের কি ক্ষমতা তাকে উপেক্ষা করা! তাই আবার পা রাখলাম পথে। পিছনে পরে রইল আমার স্বজন-স্ত্রী-সন্তান-আর আমার আট বছরের তপঃভূমি দন্ডকারন্য।
আবার যাবো সেই হিংস্র নরখাদক সদৃশ্য মানুষের বাস ইট কাঠ পাথরের জঙ্গল–কলকাতা মহানগর। সেই মহানগর যেন আমাকে ডাকছে–আয়। যেখানে শুরু করেছিলি সেখানে এসে শেষ কর। এইখানে না এলে চন্ডালজীবনের ইতিবৃত্ত অসম্পূর্ন রয়ে যাবে।
.
অনেক বছর আগে–তা সে প্রায় আট দশ বছর নিশ্চয় হবে, অনেক দুঃখ কষ্ট অনেক অপমান অত্যাচারের শরীরময় দাগ আর বুক বোঝাই বিষজ্বালা নিয়ে চলে গিয়েছিলাম বঙ্গভূমি ছেড়ে। আবার যে একদিন বিদেশবিভূঁই থেকে এখানে ফিরে আসব তেমন কোনো আশা বা ইচ্ছা কোনোটাই অবশিষ্ট ছিল না। জানতাম সেখানেই আমার শেষ নিঃশ্বাস পড়বে–বাংলা আর বাঙালিদের প্রতি তীব্র অভিমানে। যে ব্যবহার তাদের কাছ থেকে পেয়েছি তাতে বাংলা আমার প্রিয় স্বদেশ, বাংলা আমার প্রাণের ভাষা, বাঙালি আমার স্বজন এই ভাবনায় আর অবগাহন করতে মনের কোনো সায় পাই না। এর চেয়ে গোণ্ড মুরিয়া হলবা কয়া এইসব আদিম উপজাতির দেশ দণ্ডকারণ্য আমার কাছে বহুগুণে শ্রেয়।
তবু একদিন পশ্চিমবঙ্গে আসতে হল। যেন আমার ভাগ্য আমাকে পেছন থেকে তাড়া দিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে এল ঠিক সেই স্থানে–যেখান থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসনে গিয়েছিলাম। গিয়েছিলাম বহুদূর পাথর, পাহাড়, মোরাম মাটির দেশ ছত্তিশগড়ের বস্তার জেলার পারালকোট নামক স্থানে। এই স্থানটির আর একটা নাম দণ্ডকারণ্য।
আমাকে যে ভাগ্য প্রবল চাপ দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে ফিরে আসতে বাধ্য করল তার নাম–কেনারাম। বছর পঁচিশের এই বাংলাভাষী ছেলেটির জন্ম দণ্ডকারণ্যের ঘন গভীর জঙ্গল গ্রামের এক রিফিউজি পরিবারে। সেই যখন ১৯৫৮ সালে কেন্দ্রীয় পুনর্বাসন প্রকল্পের অন্তর্গত দণ্ডকারণ্যে রিফিউজি প্রেরণ শুরু হয় ওর বাবা এখানে আসেন এবং পারালকোটের ১নম্বর ‘ভিলেজে’পুনর্বসতি পান। এখানেই কেনারামের জন্ম হয়। সে কোনোদিন বাংলাদেশটা কেমন চোখেই দেখেনি। শুধু সেই দেশের মন কেমন করা হাজার গল্প শুনেছে। আর দেখেছে শুধু বাবা-কাকা পাড়া প্রতিবেশী বৃদ্ধদের সোনার বাংলার জন্য দিনরাত–হুঁতাশ, দীর্ঘশ্বাস, চোখের জল। তাই তার বুক মোচড়ায় সেই দেশটা একবার স্বচক্ষে দেখে নেবার গভীর আকুলতায়। যেদিন থেকে সে জেনেছে আমি পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা শহরে অনেক বছর ছিলাম দর্শনীয় স্থানসমূহ সব চিনি, অস্থির করে তুলল আমাকে–দাদা একবার আমাকে নিয়ে চলো। দিনসাতেক থেকে ফিরে আসব। সব খরচা আমার।
চাঁদটাকে দূর থেকে খুব সুন্দর দেখায়। যারা তার কাছাকাছি গেছে দেখে এসেছে সেখানে অসংখ্য খানাখন্দ, পাহাড় আর অক্সিজেনহীনতা। পাহাড়টাকেও দূর থেকে মনোরম মনে হয়। সেখানে গেলে দেখা যায় ঝোঁপঝাড় জঙ্গল। জঙ্গলে সাপ বিছে চিতা হায়না।
কেনারাম বয়সে তরুণ। সে বয়সে যুক্তি থাকে অনেক কম আর আবেগ থাকে অত্যাধিক।ও জানেনা শোনা কথা সর্বাংশে সত্য হয় না। শোনা কথায় বিশ্বাস করতে নেই। আমি ওই দেশটাকে দেখেছি বহু বছর। চিনেছি ওখানকার মানুষজনকে হাড়ে মাংসে মজ্জায়। এমন দয়ামায়া শুন্য মানুষ এত বিশাল সংখ্যায় আর কোথায় আছে আমার জানা নেই।
পশ্চিমবঙ্গের বক্ষস্থল কলকাতা মহানগর। শিক্ষা সভ্যতা সংস্কৃতির পীঠস্থান। বাঙালির বড় গর্ব কলকাতার জন্য। এখানে বড় বড় হোটেল-রেস্টুরেন্ট-বার। যেখানে এক কাপ চায়ের দাম নাকি দুশো টাকা। এক রাতের খাবারে উড়ে যায় দু-পাঁচ হাজার। গাড়ির মিছিল দেখলে বোঝা যায় এখানে দেদার লোকের আনাগোনা। রাত যত বাড়ে তাদের সংখ্যা বাড়ে। মদ মেয়ে জুয়ায় লক্ষ লক্ষ টাকার লেনদেন চলে।
আবার সেই হোটেলের উল্টো দিকের ফুটপাতে এক ভিখারি স্রেফ একখানা শুকনো রুটির জন্য সারারাত কেঁদেঝাঁকিয়ে ভোরবেলায় মরে যায়। ভোগবাদী স্বার্থপর সমাজ তার দিকে ফিরেও তাকায় না।
এখানে বড় বড় হাসপাতাল, চিকিৎসালয়, নার্সিংহোম, কত দামি দামি যন্ত্র, কত নামি দামি ডাক্তার। তাদের সেবা পরায়ণতা বিষয়ে কত বিজ্ঞাপন।সেই হাসপাতালের সামনে শুয়ে অবহেলায় অবলীলায় প্রাণ হারায় দুর্ঘটনাগ্রস্ত পথচারী, দরিদ্র গ্রামের চাষি, কোনো দুঃস্থ কারখানার মজুর। সামান্যতম দয়া দরদ মানবিকতার দরজা খোলে না হৃদয়হীন যান্ত্রিক মানুষ।
এই কলকাতা–যেখানে গ্রাম থেকে নিয়ে এসে কোনো অভাবি মা বাপের কিশোর পুত্র, কিশোরী কন্যাটিকে কোনো উচ্চশিক্ষিত উচ্চবিত্ত পরিবারে চাকর ঝিয়ের কাজে লাগিয়ে দিয়ে যাবার কিছুদিন পরে আবার সেই মা বাপকে বুক চাপড়ে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে আসতে হয় কলকাতায়। এসে দেখে তার পুত্রকে কাজের বাড়ির লোক কাজ করতে না পারায় গায়ে গরম জল ঢেলে দিয়েছে বা ছ্যাকা দিয়েছে গরম খুন্তি দিয়ে। থালা ছুঁড়ে মাথাও ফাটিয়ে দিয়ে থাকতে পারে।
আর নাবালিকা কন্যাটিকে কেন কে জানে মেরে ঝুলিয়ে দিয়েছে পাখার হুকে। গায়ে আগুন ধরিয়েও দিতে পারে। পারে ছাদ থেকে ঠেলে ফেলে দিতে। যদি পোস্টমর্টেমে প্রমাণ হয়, এই সব করার আগে তাকে ধর্ষণ করা হয়েছিল, প্রমাণ হবে না, সে কাজটি এই বাড়ির কারও দ্বারা কৃত। ছিঃ তারা কী আর তা পারে! সভ্য শিক্ষিত ভদ্রলোক বলে কথা। তারা শিক্ষক, অধ্যাপক, অফিসার, ডাক্তার কত কী। তারা অনেক কিছু পারে–শুধু ধর্ষণ পারে না। তাই পুলিশ তিনশো ছিয়াত্তর ধারায় কেস লেখে না। যা লেখে তাতে সাজা হয় না।
এই পশ্চিম বাংলা, যেখানকার বাঙালিদের আত্মহনন বিলাসী বললে খুব একটা ভুল বলা হবে না। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত নিজেরা তাদের নিজেদের মত মানুষকে মেরে ফেলেছে, অনেক কটা ছেচল্লিশ দাঙ্গার যোগফল অতোটা হবে কিনা সন্দেহ। আর এত খুন এত রক্তপাত ঘটানো হয়েছে মাত্র কয়েকজন রাজনেতার উচ্চাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে। ক্ষমতার শীর্ষে আরোহনের অসৎ অভিপ্রায়ে।
এই বাঙালি, যে তার নেতার নির্দেশে ভিয়েতনামে বন্যা হলে পিতৃবিয়োগ বেদনার মতো শোকাতুর হয়, কেঁদে বুক ভাসায়, চিনে রোদ উঠলে উদ্দাম নাচ শুরু করে উন্মাদের মতো, সেই বাঙালি ১৯৭৮ সালে বোবা বধির অন্ধ আর মেরুদণ্ডহীন প্রাণি হ য়েছিল সেই নেতারই নির্দেশে।
সুদূর দণ্ডকারণ্য থেকে প্রায় একলক্ষ কুড়ি হাজার ছিন্নমূল বাঙালি পশ্চিমবঙ্গে ফিরে এসে সুন্দরবনের এক দ্বীপ মরিচঝাঁপিতে আশ্রয় নিয়েছিল। আর তাদের চারদিক চল্লিশখানা লঞ্চ দিয়ে ঘিরে দুর্বল অসহায় বন্য পশুর মতো নির্বিকারে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। কতো মানুষকে মারা হয়েছিল সেদিন? কেউ বলে দু’হাজার কেউ বলে চার হাজার কেউ আরও বেশি। দলিত লেখক রণজিৎ শিকদার হত বলেছেন–কুড়ি হাজার।
সেদিন এই বঙ্গের কোনো বুদ্ধিজীবী, কোন নেতা মন্ত্রী, কোন জনদরদী মানবাধিকার সংগঠন, হত্যাকারী শাসকদের বিরুদ্ধে একটা আঙুল পর্যন্ত তোলেনি। বলেনি এই হত্যালীলা বন্ধ করো। আর পশ্চিমবঙ্গের জনগণ, রাজনীতি সচেতন জনগণ, এক নয়া পয়সা ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধি হলে সেই শোকে উথলে ওঠা জনগণ, সেদিন যেন লেজ গুটানো প্রভুভক্ত হয়ে ঢুকে গিয়েছিল যে যার গর্তে।
যে পিতা পুত্রের মৃতদেহ শনাক্ত করতে ভয় পায়, কবি তাকে ঘৃণা করেন, বলেছেন। যে জনগণ এমন খুনি শাসকদের দুধকলা দিয়ে পোষে, তার অন্যায়ের প্রতিবাদ করে না–আমি ঘৃণা করি, দুরে থাকতে চাই তাদের কাছ থেকে। কিন্তু কেনারাম নাছোড়, তারই চাপে অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনেক বছর পরে আবার আমাকে আসতে হল পশ্চিমবঙ্গে।
কে যেন একজন বিখ্যাত নাট্যকার বলে গেছেন–জীবনটা হচ্ছে একটা নাটক আর এই পৃথিবীটা একটা রঙ্গমঞ্চ প্রতিটা মানুষ সেই নাটকের এক একটা চরিত্র। সবাই স্রেফ অভিনয় করে চলেছে। তার নিজের কিছু করার নেই। অদৃশ্যে বসে নাট্য পরিচালক যেভাবে তাকে পরিচালনা করবে, তার দেওয়া সংলাপতারই নির্দেশমতো মঞ্চে ফুটিয়ে তুলতে হবে। ব্যাস, এই তার ভূমিকা।
আমি এখনও ঠিক জানিনা সেই অদৃশ্য নাট্যকার আমার জন্য ঠিক কোন ভূমিকা নির্ধারিত করে রেখেছেন। বিগত জীবনটার দিকে চোখ ফেরালে নিজেকেঅকুল দরিয়ায় ভেসে চলা শেকড়হীন পানার মতো মনে হয়। যে শুধু ভেসেই চলেছে। কোথায় গিয়ে থামবে কিছুই জানে না।
তবে জীবন যখন একটা নাটক তখন সব নাটকের মতো এর একটা শেষ দৃশ্য অবশ্যই আছে। না থেকে পারে না। আর সেই দৃশ্যটাই সমগ্র নাটকের সবচেয়ে মূল্যবান অংশ। সমগ্রের মূল্যমান নির্ধারক।
আমি জানি না আমার জীবনদেবতা নাটকের শেষ দৃশ্যে আমার জন্য কী চমকপ্রদ সংলাপ-সমাপ্তি রেখেছেন যে অভিনয়টুকু শেষ হওয়া মাত্র হলঘর ফেটে পড়বে করতালিতে। নাকি উড়ে আসবে একখানা ছেঁড়া হাওয়াই চটি। এখন আমার কাজ শুধু ভেসে থাকা আর অপেক্ষা করে যাওয়া।
যখন পশ্চিমবঙ্গ থেকে ভাসতে ভাসতে ছত্তিশগড়ে চলে যাই বা বলা চলে, চলে যেতে বাধ্য হই তখন সমস্ত পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটা গ্রাম, নগর, শহর, জনপদ জুড়ে বয়ে যাচ্ছিল একটা উন্মত্ত, উত্তপ্ত, অস্থির, অশান্ত বাতাস। চারদিকে রোজই বোমাবাজি, মারামারি, হানাহানি, খুনোখুনি চলছিল। লাশ পড়ছিল। মনে হচ্ছিল কোনোদিন এই লাশ গাদায় আমাকেও কেউ শুইয়ে দেবে।
আর তখন, যখন ফিরে এসেছি, চারিদিক কেমন যেন অস্বাভাবিক রকম শান্ত-নিঝুম নিঃস্তব্ধ। যেন কোন শিশু কাঁদছে না, কোনো বৃদ্ধ কাশছে না, যৌবন হাসছে না।
এককালে অনেকে আমাকে ভয় দেখাত, আমি ভয় পেতাম। এককালে আমিও কাউকে কাউকে ভয় দেখাতাম। সে ভয় পেত কিনা তা জানি না। তবে ভয়ের সঙ্গে সহবাস আমার অনেক দিনের। ভয়কে আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি বলে গভীর ভাবে চিনি। জানি, বিষম ভয়ে মানুষ এমন বিষঃ-বধির-বাকহারা হয়ে যায়। মনে হয় আমার যেন সমাজদেহের শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত হচ্ছে ভয়ের নীল বিষ। তাই মানুষ এত মুহ্যমান এর নিঃস্তব্ধ।
অভিজ্ঞ মানুষ এই স্তব্ধতাকে অন্তদৃষ্টি দিয়ে চিনে নিতে ভুল করবে না। বুঝতে পারবে–এই শান্তি যথার্থ শান্তি নয় এর নাম শ্মশানের শান্তি। সব মানুষ যেন ভয়ে মরে–বেঁকে নুয়ে গেছে। বাঙালির যা ধর্ম সেই ছোটবেলা থেকে সত্তর দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত যেমন দেখেছি যে কোনো অন্যায় অবিচার দেখলে সুর্য সমান তেজে জ্বলে উঠে সমুদ্র গর্জনে ফুঁসে ওঠা, সেসব আর নেই। কেউ নিজেকে বিক্রি করছে কিছু প্রাপ্তির প্রলোভনের কাছে, কেউ ভয়ে ভীত হয়ে অত্যাচারীর পায়ের কাছে বসে পড়ছে আত্মসম্ভ্রম পরিত্যাগ করে।
অনেকদিন পরে এসেছি, তাই আমি যেন দেখতে পাই, এই শান্ততার চাপা দেওয়া কফিনের নীচে আগে যে হিংস্রতা ছিল তা আরও বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়ে বলপ্রাপ্ত হয়ে বিরাজমান। তফাৎ শুধু এই যে তা আগের মতো উচ্চ-উগ্রতায় নয়, বহে চলেছে ধীরে অন্তঃশীলা চোরা স্রোতের মতো নিঃশব্দে।
যা বাইরে থেকে বোঝা যায় না, বিশেষ করে শহরে বসে তো আরওই নয়। বোঝা যায় সংবেদী আর নিরপেক্ষ মন নিয়ে সকালবেলায় সংবাদপত্রের পাতায় চোখ রেখে। গ্রামবাংলা থেকে রাতের অন্ধকারে নিহত আর নিখোঁজ মানুষের বুক হিম করে দেওয়া পরিসংখ্যান দেখে। এবং এটাও হিমশৈলের চূড়া মাত্র। কজন বা এমন বুকের পাটা রাখে যে শাসক দলের রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে থানায় গিয়ে বলবে আমার স্বামী বা ছেলেকে ওরা নিয়ে গেছে, আর ফেরেনি। কোনো থানার এমন অফিসার আছে যে শাস্তির ঝুঁকি নিয়ে ডায়েরি লিখবে।
আগের মানুষ–যারা কোন না কোন রাজনৈতিক দলের কর্মী বা পোষাগুণ্ডা, তারা প্রয়োজনবোধে লাঠিসোটা নিয়ে একে অপরের দিকে ধেয়ে যেত, খুব হৈচৈ বাধাত, এক আধজনার মাথা ফাটাতো। তাতে বাওয়াল খুব বেশি হলেও মানুষ মরতো কম। এখন রাঝনৈতিক দলের মাস্তান গুন্ডারা অনেক বেশি চালাকচতুর হয়ে গেছে। বিবেচক এবং দূরদর্শী হয়ে গেছে। এখন আর তারা মারামারির মতো তুচ্ছ জিনিস করে সময়ের অপচয় এবং মানসিক উৎকণ্ঠায় থাকা পছন্দ করে না। প্রতিপক্ষ দলের কাউকে যদি মারধোর দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়, সে যে কোনো একদিন প্রতিশোধ স্পৃহায় আমার উপর ঝাঁপ দিয়ে পড়বে না, সে গ্যারান্টি কে দেবে? সেদিন যে সে আমাকে মেরে ফেলবে না, সেটা কেমন করে বিশ্বাস করি?
সে সব যদি বা না করে থানাতে তো যাবে। যদি পুলিশ অফিসার আমাদের দলের কথা না শোনে, যদি কেস লেখে, যদি আমাকে এ্যারেস্ট করে? তখন মহা হ্যাপা। উকিল ধরো জামিন করো, তারিখে তারিখে কোর্টে যাও। গাদাগুচ্ছের টাকা ধ্বংস।
তাই তারা এখন কোনো এক অসতর্কমুহূর্তে প্রতিপক্ষ দলের নির্দিষ্ট ব্যক্তির উপর ওতপাতা শিকারি চিতার মতো অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে টুক করে গলার নালিটা কেটে দুক করে দেয়। তা না হলে খুব মেপে-নির্ভুল নিশানায় বুকে বিধিয়ে দেয় এক ঝাঁক বুলেট। যদি তেমন সময় সুযোগ থাকে মাটিতে একটা গর্ত করে, নীচে দু’বস্তা নুন, তার উপর লাশ, ফের দু’বস্তা নুন দিয়ে মাটি চাপা দিয়ে দেয়। এতে মারামারির চেয়ে সময় যেমন কম ব্যয় হয়, হত্যাকারীদের ভবিষ্যও বেশ নিরাপদ-নির্ঞ্ঝাট থাকে। মরা মানুষ আর যাই করুক বদলা নিতে পারে না, কোর্টের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সাক্ষ্যও দিতে পারে না। প্রতি আক্রমণের ভয় না থাকায় শনাক্তকরণের উপায় না রাখায় হাতের রক্ত দাগ ধুয়ে, সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরে, হনন বিলাসি রাজনেতা নিশ্চিন্ত মনে নিজের কাজ করে যেতে পারে। নির্ভয়ে বাড়ি ফিরে প্রিয় শয্যায় শুয়ে পড়তে পারে সঙ্গীনীকে নিয়ে।
বঙ্গভূমির বক্ষ-হৃদয় এই কলিকাতা মহানগর। এখানকার মানুষের বদলে যাওয়া মানসিকতার সাথে সাযুজ্য রেখে তারও অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ঘটে গেছে সামুহিক পরিবর্তন। রাস্তাঘাট বেশ চওড়া আর দৃষ্টিনন্দন হয়ে গেছে। গড়ে উঠেছে অজস্র ঝাঁ-চকচকে শপিং মল। সুপারমার্কেট, বিউটি পার্লার, ডিনার পাব, ম্যাসাজ বাথ, নাইট ক্লাব, মদিরালয় আরও কত কী। এখন শহরের এক রাস্তাকে আর এক রাস্তার সাথে জুড়ে বিশাল বিশাল উড়ালপুল। পুলের উপর দেশি বিদেশি দামি দামি গাড়ির মিছিল। মাত্র দশ পনেরো বছরে এই শহরটার এত পরিবর্তন হয়ে যাবে এ আমার কল্পনায় ছিল না। যে ছেলেটাকে দেখে গিয়েছিলাম একটা ছেঁড়া জামা গায়ে বসে থাকে সে নাকি এখন কয়েক কোটির মালিক। তার এত উন্নতি হয়েছে স্রেফ পার্টি করে। যেখানে যে বাড়ি তৈরি হবে ইট বালি সিমেন্ট সব কিনতে হবে তার বলা দামে তারই কাছ থেকে। জমি বাড়ি যা কেনাবেচা হোক একটা ভাগ তার নামে বরাদ্দ।
এইসব কারণে নয় কোটি জনসংখ্যার পশ্চিমবঙ্গে লাখ পঞ্চাশ লোক দাবি করে এই সরকারের শাসনে বঙ্গের বিশাল উন্নয়ন ঘটেছে, মানুষ খুব সুখে আছে। এই সুখ অক্ষয় হোক। আসুন চোখের মণির মতো রক্ষা করি এই সুখে যারা সাঁতার কাটতে সুযোগ করে দিয়েছে সেই পার্টিকে। যারা তাকে অপসারণ করতে চায় সব প্রতিক্রিয়াশীল, আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের দালাল।সি.আই.এ.-র চর, দেশীয় বুর্জোয়াদের চামচা।
এই দল তার কর্মীদের গভীরভাবে বুঝিয়ে দেয়–যে বিরোধী দলে, ভিন্ন মতাবলম্বী, আমাদের মিটিং মিছিলে যায় না, তাকে যেভাবেই শায়েস্তা করা হোক সেটা অন্যায় নয়, এতে পার্টির কাজই করা হয়। পার্টি সন্তুষ্ট থাকলে তুমি প্রমোটারি দালালি, সাপ্লাই সিন্ডিকেট, এইসব করে মহাসুখ প্রাপ্ত করতে পারবে। জীবিত কালে ভোগ করতে পারবে স্বর্গের যাবতীয় সুখ।
গতকাল সকালে ট্রেন থেকে হাওড়ায় নেমে বাস ধরে এসে পৌঁছেছি যাদবপুরে। তারপর থেকে আমার চেনাজানা জায়গাগুলোয় ঘুরে ঘুরে কী বা কাকে যেন পাগলের মতো খুঁজে খুঁজে বেড়িয়েছি। কাকে খুঁজি? কে আমার আপনজন-আত্মীয় এই শহরে? ঘুরছি আর বুকটা কী এক বোবা বেদনায় যেন টন টন করে উঠছে। চোখে ছল ছল করে ঢেউ ভাঙছে বাঁধ ভাঙা নোনা জল।
এ সেই শহর–বাল্যকাল থেকে যুবা–সারা জীবন, অপমান অত্যাচার অনাহার ছাড়া আর কোনোদিন কিছু দেয়নি। কতবার যে মেরে ফেলার চেষ্টা পর্যন্ত করেছে। চোখ বুজলে দেখতে পাই সেই অন্ধকার সময়ের গর্ভে খোলা চাকু হাতে দাঁড়িয়ে থাকা একদল আততায়ী মুখ। এই শহর আমার শত্রু, একে ভালোবাসার প্রশ্নই ওঠেনা। তবু বুকটা এমন দুমড়ে মুচড়ে উঠেছে কেন! কেন চোখে জল ভরে আসছে!
কাদছো দাদা? কেনারাম শুধায়।
না তো!
তাহলে চোখে জল?
কী যেন একটা গেল চোখে। ধুলো টুলো মনে হয়।
যাদবপুর। একদার সেই বাস্তুহারাদের আশ্রয়স্থল। এখন এর পুরানো ভৌগোলিক বিন্যাসও বদলে গেছে ভীষণভাবে। আড়ে-বহরে ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে গেছে। আগে চারিদিকে ছিল দরমার বেড়া দেওয়া ঘরে বাঁশের খুঁটির উপর পোড়া মাটির টালি। যাতে বসবাস করত ওপার বাংলা থেকে পালিয়ে আসা ছিন্নমূল হতদরিদ্র মানুষ।
এখন সেইসব ঝুপড়িগুলো আর নেই। সেখানে মাথা উঁচু করেছে বিরাট বিরাট এক একটা দালান। সেই সব বাড়িতে বাস করা মানুষগুলোর ভাষা বা পোষাকে বাঙালিয়ানার নাম গন্ধ অতি কষ্টে খুঁজতে হয়। এখন এরা কলোনির লোক বলতে লজ্জায় কুঁকড়ে যায়। ইতিমধ্যে কিছু কলোনি আগের নাম বদলে পল্লী করে ফেলেছে। সেই কলোনির এই প্রজন্মের যুবক যুবতীরা এখন ভাষা এবং পোষাকে সংস্কার এবং সংস্কৃতিতে মিশ্রণ করে নিয়েছে ইঙ্গ-বঙ্গ খিচুড়ি ধ্যান ধারণা। এখন এদের দেখে আর সেই পদ্মাপাড়ের বঙ্গসন্তান বলে মনে হয় না, মনে হয় যেন সাগর পারের কোনো সাহেবের কোনো বাঙালি গর্ভে ফেলে যাওয়া বীজে উৎপন্ন ফসল।
এরা আর নিজেদের বাঙালি পরিচয়ের মধ্যে কোনো আনন্দ, গর্ব, অহঙ্কার খুঁজে পায় না। সেটা যেন কোনো অনুন্নত জাতি গোষ্ঠীর পরিচয়, পিছিয়ে পড়ার কারণ। তাই এদের ঐকান্তিক প্রয়াস যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশটাকেবিদেশ বানিয়ে তুলবে। যে কারণে নিউইয়ার, ভ্যালেন্টাইন-ডে, লিভ-টুগেদার, বয়ফ্রেন্ড এইসব বিদেশি জঞ্জাল সাদরে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে সমাজ করে।
এরা আর বঙ্গ সংস্কৃতি-কৃষ্টি ভাষা সাহিত্য এইসব নিয়ে খুব একটা আন্তরিক নয়। লোক লৌকিকতা, নীতিনৈতিকতা এমনকী শালীনতা অশালীনতা এই সবেরও খুব একটা ধার ধারে না। যান্ত্রিক জীবনে, যান্ত্রিক নিয়মে যেটুকু একেবারে না করলে নয় সেটুকু করে দায় সেরে দেয়। যার মধ্যে সেই পুরাতন দিনের প্রাণের উত্তাপ-আবেগ, আন্তরিকতা খুঁজে পাওয়া কঠিন।
যারা এখানে বসবাস করে, এই জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে তাদের চোখে নাগরিক জীবনের এই পরিবর্তনটা তেমন প্রকটভাবে ধরা পড়ার কথা নয়। আমার পড়ছে। কারণ আমি এখানে ছিলাম না। অনেকদিন পরে এসে দেখছি। তাই পদে পদে হোঁচট খাচ্ছি আর ভাবছি কী দেখে গিয়েছিলাম, আর এখন কী দেখছি।
আমার চোখের দৃষ্টিতে এখন পরিলক্ষিত হচ্ছেশহরের সারা শরীর জুড়ে কদাকার ভোগবাদের স্বেচ্ছাচারী সংস্কৃতির জোয়ার। উদ্দাম-উৎশৃঙ্খল যৌনাচারের অবাধ প্রত্যোৎসাহন, স্বাধীন শব্দের রক্ষা কবচের আড়ালে চূড়ান্ত বেলেল্লাপনা। মনে হচ্ছে একদল পক্ককেশ বদমাশ অতি সুপরিকল্পিতভাবে বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যে দেশের যুব সমাজকে ওই দিকে এগিয়ে যেতে প্রলুব্ধ করছে। একটা গোটা প্রজন্মকে গড়ে তুলতে চাইছে আত্মসুখ সর্বস্ব-ভোগবাদে আকণ্ঠ নিমজ্জিত একদল চেতনাহীন প্রাণী হিসাবে। আর এইসব করছে তারাই যারা একদিন গলার শিরা ফুলিয়ে, মুষ্ঠিবদ্ধ হাত আকাশে ছুঁড়ে বলত–এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাব।
যে বছর চিন ভারতের মধ্যে সীমান্ত সংঘর্ষ হয় সেইবছর কী তার পরের বছর তীব্র অনাহারের ছোবল থেকে বাঁচতে বাড়ি থেকে পালিয়ে আমি এই যাদবপুরে আসি। এখানে খাবার মতো, থাকার মতো কোনো জায়গা ছিল না। আমার দিন কাটত পথে পথে ঘুরে আর রাত কাটত রেল স্টেশনে শুয়ে। তখন এই পোড়া পেটটা ভরাবার জন্য কত কী যে করেছি। তবে কলকাতা ছেড়ে ফিরে যাওয়া হয়নি পুরাতন ঠিকানায়, যেখানে আমার মা-বাবা সবাই থাকে। তবে কিছু পরে বাবা সবাইকে নিয়ে এই যাদবপুরে এসে ওঠে।
যখন আমার চৌদ্দ কী পনের বছর বয়স, তখন একদিন দেখি পুরো শহরটা একেবারে লালে লাল হয়ে গেল। সন্ধ্যের পরে রাস্তার পাশে যেখানে যত দোকান, বাজার, যত লাইট পোস্ট, সব বাম্ব টিউবকে মুড়ে ফেলা হল লাল কাগজ দিয়ে। তখন টিভি তো ছিল না, তবে রেডিও ছিল। তা অবশ্য সবার ঘরে নয়। যারা আর্থিক দিক থেকে কিছু স্বচ্ছল, শৌখিন, তারাই রেডিও পুষত। তখন ঘরে রেডিও রাখার জন্য সরকারকে বছরে পঞ্চাশ টাকা ট্যাক্স দিতে হত। সেই সময় পঞ্চাশ টাকার মূল্য অনেক। আমার একমাসের শ্রমের মজুরি মাত্র দশ টাকা। যাদের তখন পঞ্চাশ টাকা ব্যয় করার ক্ষমতা ছিল তাদের বিনোদন এবং গৃহের শোভা বৃদ্ধি করত ওই বস্তুটি।
যাদবপুরে আর কার কাছে রেডিও ছিল তা কে জানে, তবে সন্তোষপুরের ত্রিকোণপার্কের বড়লাল সাউয়ের যে চায়ের দোকান সেই দোকানে একটা ছিল। আমি এখানে চা বানানো গেলাস ধোবার চাকরি করতাম।(চাকরগণ যাহা করিয়া থাকে তাহাই চাকরি) রোজ বেলা আড়াইটা থেকে তিনটা আধঘন্টা রেডিওর বিবিধ ভারতী অনুষ্ঠানে মনের মতো গান হতো। পথচলা লোকের হাতে সময় থাকলে দাঁড়িয়ে সে গান শুনত। আর যেদিন মোহনবাগান ইস্ট বেঙ্গলের ফুটবল ম্যাচ হতো সেদিন দোকানের সামনে খেলার ধারা বিবরণী শোনার জন্য লোকে লোকারণ্য হয়ে যেত।
সন্ধে সাতটার খবর শোনবার জন্যও খুব ভিড় হতো। যে সংবাদ আগামীকাল পাওয়া যাবে খবরের কাগজের পাতায় তা আজই মানুষ জেনে যেত রেডিওর মাধ্যমে খবর পড়তেন বেশিরভাগ দিন দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সময় তার গলার নাটকীয় স্বরের আবরাহ অবরোহনে মানুষ জেনে নিত সারাদিনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলির বিবরণ।
একদিন তারই গলায় পাওয়া গেল সেই অবিশ্বাস্য খবর, স্বাধীনতার পর থেকে একাদিক্রমে প্রায় তিরিশ বছর যে দলটার হাতে পশ্চিমবঙ্গের শাসন ক্ষমতা ছিল তারা এতকাল যারা বিরোধী ভূমিকা পালন করেছে সেই ছোট ছোট দলের এক সম্মিলিত ফ্রন্টের কাছে নির্বাচনে পরাজিত হয়ে গেছে। ফলে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে গেছে কংগ্রেস দল।
সেই প্রথম বঙ্গের মানুষ একটা অন্য ধরনের শাসন ক্ষমতার স্বাদ পেল। দেখল রাজার ছেলেই রাজা হয় সেই নিয়ম যেমন কিছুকাল আগে বদলে গিয়েছিল, এখন বদলে গেল সেই বিধান, যে রাজ্য শাসন করতে হলে সভ্য শিক্ষিত ধনবান হতে হবে। দেখা গেল এখন এমন কিছু এম.এল.এ. হয়েছে যারা সম্পূর্ণ নিরক্ষর এমন কিছু মন্ত্রী হয়েছে যারা এইট পাশ। সব জন্মেছে এমন পরিবারে যাদের পেটে ভাত, গায়ে জামা, পায়ে চটি, মাথায় তেল থাকে না। এরাই এখন চালাবে রাজদণ্ড-পাবে রাজসুখ।
মানুষ ভেবেছিল এরা যখন নীচুতলা থেকে গরিব ঘর থেকে ওখানে গেছে-নীচের লোক, নিজের লোকদের দিকে নিশ্চয় ফিরে তাকাবে। তাদের জীবন একটু যন্ত্রণামুক্ত করার উদ্দেশ্যে উদ্যোগ নেবে। মানুষ অনেক কিছু ভাবতে পারে অনেক আশা করতে পারে, কিন্তু চিরসত্য এই–”যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ”।
একটা প্রবাদ আছে যে বাঘ একবার রক্তের স্বাদ পেয়ে গেছে তার পক্ষে আর তা বর্জন করা সম্ভব হয় না। তেমনই যে নেতা একবার ক্ষমতার স্বাদ-সুখ পেয়ে যায়, আরাম আয়াসে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে, সেই মধুর ভাণ্ডারটির লোভ সামলে আগের মতো মাঠে ময়দানে-ক্ষেতে খামারে, কলে কারখানায় মানুষের মাঝে-মানুষের কাজে প্রাণপাত করবার সদিচ্ছাকে ধরে রাখতে পারে না। তখন তার মধ্যে একটাই উদ্দেশ্য বড় বিকটভাবে বৃদ্ধি পায়–ছল বলে কলে কৌশলে যে কোনোভাবেইক্ষমতাকে ধরে রাখা। সে জন্য সে নীচতা হীনতা হিংস্রতার যে কোনো সীমা অতিক্রম করে যেতে পারে।
একদিন যেসব আমলা-অফিসার তাদের অবহেলা-অপমান করত, তারাই আজ স্যার স্যার করে হাত কচলে আগু পিছু ঘুরছে, লেজ নাড়ছে, সে যে কী আনন্দের, কী ভীষণ পরিতৃপ্তির, কী ভীষণ নেশার বস্তু–তা একমাত্র সেই জানে যার ভাগ্যে এসব জুটে গেছে।
ফলে, তখন ওইসব নেশাগ্রস্ত নেতাদের কাছে কোনো নীতি আদর্শ জনহিত কার্য নয় একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল মধু ভাণ্ডারটির দখল রেখে নিজের ভাগে যতবেশি পরিমাণ সম্ভব মধু ঢেলে নেওয়া। আর তাই ভাগাড়ে গরু পড়লে যেমনভাবে শেয়াল-শকুনে ছেঁড়াঘেঁড়ি করে কামড়া কামড়ি করে, নিজেদের মধ্যে প্রথম যুক্তফ্রন্টের নেতায় নেতায় কর্মীতে কর্মীতে শহরের গলি থেকে গ্রামের মেঠো পথ–সর্বত্র শুরু হয়ে গিয়েছিল তুমুল লড়াই। নিজেরাই নিজেদের লাশ ফেলা শুরু করে দিয়েছিল পাইকারি হারে। এখন যেমন একা ইজ্রাইল চারদিক ঘিরে থাকা আরব দেশগুলোকে ব্যাপক মার দেয়, একা সিপিএম প্যাদাচ্ছিল সবকটা রাজনৈতিক দলকে। জয়নগর কুলতলিতে এস.ইউ.সি., বাসন্তিতে আর.এস.পি.,প্রসাদপুরে সিপিআই, বর্ধমানে কংগ্রেস কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছিল ওদের নির্মম মারে।
তাই সেই প্রথম যুক্তফ্রন্ট আর পাঁচ বছরের মেয়াদকাল পূর্ণ করতে পারল না। বিল্টুদায় নিল মাঝপথে।
রাজনীতিতে যেমন চিরকাল বন্ধু বলে কিছু হয় না, চিরদিনের শত্রু বলেও কিছু হয়না। আজ যার নামে মুর্দাবাদ বলে হুংকার দেওয়া হচ্ছে, দেখা যাবে কাল তাকে বুকে জড়িয়ে ধরছে। আজ যে বন্ধুর সাথে এক গেলাসে মদ্যপান করছে কাল তার প্রাণ নিতে চাকু হাতে ঝাপাচ্ছে।
তাই, যেসব দলের কর্মীরা নিজেরা নিজেরা খুনোখুনি করছিল একদা নেতা-ই যাদের ওই কর্মে নিয়োজিত করেছিল–সেইসব নেতারা পুনঃ ক্ষমতা কেন্দ্রে ফেরবার প্রয়াসে–নিজেদের মনোবিবাদ দুরে সরিয়ে রেখে দ্বিতীয়বার একত্র হয়ে গড়ে তুলল–আবার একটা ফ্রন্ট। পরবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতা দখল করল সেই দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট।
এই ফ্রন্টের সবচেয়ে বড়শরিক সিপিআই(এম)।এরা এদের ধূর্তবুদ্ধি দিয়ে বুঝেছিল এদেশের বেশিরভাগ মানুষ ভূমিহীন, ক্ষেতমজুর, যাদের জীবন জীবিকা যুক্ত হয়ে আছে জমির সঙ্গে। এদের নিজের গোয়ালে ঢোকাতে পারলে ভোটের বাকসো উপছে পড়বে। তাই এদের সামনে টোপ হিসাবে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল একটা মনোলোভা শ্লোগান-লাঙল যার, জমি তার। শ্লোগানে বেশ কাজ দেয়, সংগঠন বেড়ে যায় চড়চড় করে।
একদল সরল সোজা মানুষ এদের উপর বিশ্বাস করেছিল, ভেবেছিল এরা ক্ষমতায় এলে সত্যি সত্যি আমরা, যে জমিতে আমাদের লাঙল চলে, ঘাম ঝরে, আর সেই ঘাম ঝরানো ফসল দখল নেয় জোতদার-জমিদারদের লোকজন, সেই জমির মালিকানা-দখলি স্বত্ব পেয়ে যাব। ফলে তারা উত্তরবঙ্গের বীর সিং জোতে নকশাল বাড়িতে শুরু করে দিয়েছিল জোতদারদের ধানের গোলা জমি দখল অভিযান। আর তখনইসিপিএম নেতাদের মুখ থেকে সরে গেল সব জনদরদী-কৃষক দরদীর রঙ বেরঙ-এর মুখোস। তারা তো শুধু ভোটের বাসো ভরাবার জন্য লাঙল যার জমি তার, বলে ছিল। সেটা তো সত্যিকারে চায়নি। কী করে চাইবে? বড় বড় কত জোতদার নেতা হয়ে বসে আছে এই দলে।
তাই তারা পুলিশ নামাল। আর পুলিশ, সেই পুলিশ যাকে চাকরি দেবার পর শেখানো হয়েছিল লাঠি কেমন করে চালাতে হয়, কেমন করে গুলি চালিয়ে ফুটো করে দিতে হয় বুক, মাথার খুলি। কেমন করে ঘর পোড়াতে হয়, ধর্ষণ করতে হয়, কঁচা কঁচা খিস্তি দিতে হয় মা বোন তুলে। শুধু শেখানো হয়নি জনগণের কারোর টাকায় টাকায় মাইনে নিলে জনগণের সেবক হতে হয়, বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াতে হয় বন্ধুর মতন। সেই পুলিশ, যাদের বিবিধ প্রশিক্ষণ দ্বারা ব্রিটিশ শাসকরা বানিয়ে তুলত মনহীন মস্তিষ্কহীন এক একটি যন্ত্র দানব। যাদের পরবর্তীকালে কংগ্রেস সরকারও অনুরূপ অপরিবর্তিত রেখে ব্যবহার করে গেছে, এই সরকারও ব্যবহার করল।
সেদিন গরিব দরদী শ্রমিক কৃষক দরদী’সরকারের পক্ষে একদল না খাওয়া গরিব আদিবাসী চাষি ক্ষেতমজুরের দিকে গুলি চালাল তারা। বুকে পেটে মাথায় গুলি লেগে শুয়ে পড়ল সাতজন মহিলা একজন যুবক একটি শিশু। পল্লী কবি গান বাঁধল, তরাই কান্দেরে, কান্দে আমার হিয়া, নকশাল বাড়ির মাঠ কান্দে সপ্ত কন্যার লাইগ্যা।
সিপিএম দল, যার পতাকার রঙ মানুষের রক্তের মতো লাল, যার গায়ে আঁকা থাকে কাস্তে হাতুড়ি তারা। যে পতাকা বাঁধা থাকে মোটা শক্তপোক্ত লাঠির মাথায়, যে লাঠির এক আঘাতে মাথা ফেটে ঘিলু ছিটকে পড়ে পাশের দেওয়ালে, পথের ধুলায়, তাদের কর্মী সমর্থকের সংখ্যা যাদবপুর অঞ্চলে অনেক। সেই যে যখন জবরদখল কলোনির পত্তন শুরু হয়েছিল, যখন চারখানা খুঁটি আর একখানা লাঠির জোরে স্থাপনা হচ্ছিল জনবসতির, তারা সেই লাঠির আগায় লালঝাণ্ডা বেঁধে নিয়েছিল।
যাদবপুর অঞ্চলে প্রায় গোটা তিরিশ-চল্লিশ এমন জবরদখল কলোনি রয়েছে। শুধু যাদবপুরই নয়, বলতে গেলে শহর কলকাতার আশে পাশে যেখানে যত উদ্বাস্তু কলোনি আছে–শোনা যায় এর সংখ্যা নাকি একশো উনপঞ্চাশ-এর প্রত্যেকটাই সিপিএম দলের এক একটা শক্ত ঘাঁটি। প্রথমদিকে এই উদ্বাস্তুদের নিয়ে আন্দোলন করেইসিপিএম পশ্চিমবঙ্গে নিজেদের পরিচয় গড়েছিল। রাজনৈতিক জমি পেয়েছিল পায়ের তলে। তার আগে এই দলে নেতা ছিল, কর্মী ছিল না।
তবে একমাত্র ব্যতিক্রম ঘটেছিল বিজয়গড়ের বেলায়। পশ্চিমবঙ্গে এটাই সর্বপ্রথম সর্ববৃহৎ জবরদখল কলোনি। যখন এই কলোনির পত্তন হয় একে সর্বতো সহযোগিতা দান করেন তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়। যার নেতৃত্বে বিজয়গড় কলোনির স্থাপনা হয় সেই সন্তোষ দত্ত ছিলেন বিধান রায়ের অতি পরিচিত এক কংগ্রেস নেতা। স্বাধীনতা আন্দোলনে তিনি জেলও খেটেছিলেন। এ কারণে এখানে প্রথম থেকেই একটা কংগ্রেসি ধ্যান-ধারণা রাজনীতির প্রচার প্রসার কেন্দ্র ছিল। এখানে দুর্গাপূজার সময় দেবী দুর্গার আদলে যে মূর্তির নির্মাণ এবং আরাধনা করা হতো এরা তাকে বলত ভারতমাতা। ধূমধামে পালন করা হতো নেতাজির জন্মদিন। পনেরোই আগস্ট পতাকা তোলা, প্রভাতফেরি এসব হতো।
এই মেরুকরণের ফলে বিজয়গড় এবং মে দিবস, নভেম্বর বিপ্লব পালন করা কলোনির মধ্যে একটা মতবিরোধ ছিল। তারা দেশ ভাগের জন্য কংগ্রেসকে দায়ী মনে করত, আর বিজয়গড়কে কংগ্রেসের দালাল। প্রতিক্রিয়াশীল, বুর্জোয়াদের তল্পিবাহক, সি.আই.-এর এজেন্ট। এই বিরোধ সত্তরের দশকে এসে বদলে যায় খুনোখুনিতে।
তরকারিতে যেমন নুন, রাজনীতিতে তেমনই খুন। নুন ছাড়া যেমন তরকারিতে স্বাদহয় না, লাশ না পড়লে গরম হয়না রাজনীতির আখড়া। রাজনীতির অঙ্গন উত্তপ্ত না হলে ভাষণে সে আগুন ঝরে না। জনগণ তেমন একটা তেতে-তেড়ে ফুড়ে ওঠে না। মার-কা-বদলা মার হ্যায়, খুন কা বদলা খুন হ্যায়, কেমন ম্যাড় মেড়ে শোনায়।
ধ্বনির যেমন প্রতিধ্বনি, আঘাতের যেমন প্রত্যাখ্যান, লাশেরও তেমনই পাল্টা লাশ। যত লাশ তত বক্তৃতা, মিটিং মিছিল শ্লোগান। তত হরতাল, ভাঙচুর বাস পোড়ানোতখন ঘরকুনো সাধারণ শান্তিবাদী মানুষের মধ্যেও আলোড়ন ওঠে, উৎসাহ দেখায় রাজনীতি চর্চায়, পক্ষপাত গ্রহণে এবং সক্রিয় সহযোগিতায়। দলের বাড়বাড়ন্ত ঘটে।
মোটামুটিভাবে উনসত্তর সালের প্রথম দিক থেকে সিপিএম যাদবপুর এলাকায় লাশ ফেলা কার্যক্রম শুরু করে দেয়। তারা প্রথম যে খুনটা করে সেটা রাজাপুরে। পরিমল দে নামে একটি ছেলেকে নকশাল রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকার অপরাধে বল্লম কুঁড়ে মেরে ফেলা হয়। “রক্ত বড়ই সংক্রামক”। এরপর তো লাশের পরে লাশ পড়েই যেতে থাকে। এদিক থেকে ওদিক থেকে সেদিক থেকে যে দল যেদিকে বলবান যেমন ভাবে পারে শুধু লাশ গাদায় লাশ জমা করে চলে।
শোনা যায় হত্যা নিয়ে, মৃত্যু নিয়ে সর্বপ্রথম গবেষণা করেছিলেন হিটলার। একটা মানুষ কত কষ্টের পরে মারা যায় তার পরীক্ষা করার জন্য পরীক্ষাগার ছিল। একটা লোককে হাত পা বেঁধে বরফ জলে ফেলে ঘড়ি ধরে দেখা হতো কতক্ষণ বাঁচে।
এই নারকীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা পশ্চিমবঙ্গে আমদানি করে সিপিএম। খুনটা যেন শুধু মাত্র একটা খুন হয়ে রয়ে না যায়, যেন সেটা চায়ের দোকানে, রাস্তার মোড়ে, স্টেশনে বাজারে একটা জনচর্চার বিষয় হয়ে ওঠে, সেটা যেন একটা বীভৎস রসের মৃত্যু শিল্প হয়, যে মৃত্যু দেখে, যে মৃত্যুর কথা শুনে মানুষের বুক আতঙ্কে হিম হয়ে ওঠে, নড়বড়ে হয়ে যায় সাহসের ভিত। সিপিএম পার্টির বিরুদ্ধে কিছু বলা বা করার কথা ভাবলে চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই নৃশংস নির্মমভাবে নিহত শবদেহটির কথা।
এটা তারা বস্তুবাদী বিচার বুদ্ধি দিয়ে আবিষ্কার করে যে, চাকু বোমা গুলি নয়, মানুষকে মারতে হবে আরও ক্রুরভাবে, হাজার চোখের সামনে প্রকাশ্য দিনের আলোয়। তবেই একটা স্থায়ী ভয় গেঁথে বসে যাবে জনগণের মনে, যা স্থায়ী ফল দেবে। একটা জীবন্ত মানুষের দেহে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া এটা তাদের গভীর চিন্তার ফসল। একজন দুজন নয়, একের পর এক আঠারো জন। শহর কলকাতার বক্ষস্থলে দিনের আলোয়, হাজার হাজার মানুষের চোখের সামনে পুলিশ ফাড়ি থেকে দুশো গজ দুরে–গায়ে আগুন নিয়ে মানুষ দৌড়াচ্ছে, এ দৃশ্য যে দেখছে চিরদিনের জন্য মনের মধ্যে গাঁথা হয়ে যাচ্ছে হিমশীতল মৃত্যু ভয়। বিরোধ করার সাহস উড়ে যাচ্ছে কর্পূরের মতো। ভোটের বাক্সের কাছে গিয়ে বুক শুকাচ্ছে যদি ওদের ভোট না দিই জেনে ফেললে আমার কী হবে।
যাদবপুরে সর্বপ্রথম রাজনৈতিক কারণে যাকে খুন করা হয় সে সময় ওটা করার খুব একটা দরকার ছিল না। সেই সময় সবে নকশালবাড়ি থেকে একটা ভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক মতবাদ কলকাতা শহরে অনুপ্রবেশ করেছে। একদল তরুণ, যুবক, ছাত্র আবেগের নৌকায় সওয়ার হয়ে গলার শিরা ফুলিয়ে শ্লোগান দিচ্ছে আর দেওয়ালে দেওয়ালে মাও-সে-তুং-এর ছবি আঁকছে। আর কিছু নয়। তবু পরিমল দে-কে মরতে হল। মারা হল বিনা প্ররোচনায়, স্রেফ এলাকাকে উত্তপ্ত করে তোলার প্রয়োজনে।
সব মৃত্যুই দুঃখের, সব হত্যাই বিভৎস। তবে সিপিএমের কাছে পরিমলের মৃত্যু ততটা বিভৎস নয় যতটা তারা চায়। তাই কিছুদিন পরে এই রাজাপুরে মনুয়া নামে আর একটি ছেলেকে মারা হল সারা শরীরে আঠারোটা গজাল পেরেক পুতে। একটা ছয় ইঞ্চিগজাল ঠোকা হয় ব্রহ্মতালুতে।
এর কিছুদিন পরে কৃষ্ণা গ্লাস ফ্যাক্টরির পিছনে একজনকে মারা হয় পায়ুদ্বারে কঁচি ঢুকিয়ে, একজনকে মারা হয় বস্তায় ঢুকিয়ে ইট দিয়ে থেতলে। এসব ছাড়া আরও নানা ধরনের হত্যার খবর পাওয়া যাচ্ছিল গ্রামবাংলা থেকে। জ্যান্ত কইমাছ গিলিয়ে, অ্যাসিড খাইয়ে কত কষ্ট দিয়ে মানুষ মারা যায় তার একটা পৈশাচিক পরীক্ষা সর্বত্র চালানো হচ্ছিল পরিকল্পিতভাবে। জনগণকে ভীত এস্ত করার লক্ষ্যে।
এখন আমার একটা পুরাতন দিনের ঘটনা মনে পড়ছে। আমি সেই সময় কিছুদিনের জন্য নকশাল দলের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েছিলাম। কেন হয়েছিলাম সেটা সবিস্তারে এই বইয়ের প্রথম ভাগে লেখা রয়েছে। সেই সময় একরাতে অনেকে মিলে রাত পাহারা দিচ্ছিলাম যাতে এলাকায় পুলিশ না ঢুকতে পারে। ওখানে একটা ভাড়াটে বাড়ি ছিল যেটায় আট-দশঘর ভাড়াটে বাস করত। সবই দরিদ্র শ্রেণির। এক ঘরে থাকত এক রিকশাঅলা তার যুবতী স্ত্রীকে নিয়ে। সে ভোর চারটেয় রোজ রিক্সা নিয়ে মাছের ট্রিপ মারতে চলে যেত। সেদিনও সে রোজকার মতো চলে গেছে। আর পাশের ঘরের এক ভাড়াটে খোলা দরজা পেয়ে চুপিসারে ঢুকে পড়েছে অন্ধকার ঘরে। আর শুয়ে থাকা বউটার শরীরে শুয়ে পড়েছে আসঙ্গ লিপ্সায়। বউটা প্রথমে ভেবেছিল হয়ত স্বামী ফিরে এসেছে, পরে বুঝতে পারল এই স্পর্শ আলিঙ্গন পেষণ অপরিচিত। অবাঞ্ছিত কেউ দখল নিতে চাইছে তার দেহকে। তাই সে বাধা দিল। চিৎকার আর জাপটে ধরল অপরাধীকে। অপরাধী ভেবে রেখেছিল এই রকম পরিস্থিতির তৈরি হলে তখন কী করবে। একটা চাকু নিয়ে গিয়েছিল সে। সেই চাকুটা দিয়ে মহিলার গলায় আঘাত করে মহিলার বাহুর বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে ছুট দিল। কপাল খারাপ তার, পালাতে পারল না, ধরা পড়ে গেল আমাদের হাতে।
এরপর যা হয়, শুরু হল শাস্তিদান পর্ব। আমাদের কেউ ব্লেন্ড দিয়ে চিরে চিরে নুন দিতে লাগল তার গায়ে, কেউ সিগারেটের ছ্যাকা। কেউ নখে সেপটিপিন ঢোকাল, কেউ ভাঙল আঙুল। সেই ভোর চারটে থেকে সাতটা তিনঘন্টা চলল অমানুষিক অত্যাচার। তারপর তাকে আধমরা অবস্থায় ছেড়ে দেওয়া হল।
এখানে আমাদের নেতা ছিলেন আশু মজুমদার। খবর পেয়ে বেলা ন’টা নাগাদ তিনি এলেন। মহিলাকে দেখলেন, তার মুখে সব শুনলেন এরপর আমাদের ডাকলেন। খুব শান্ত গলায় বললেন–আমরা কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী। আমাদের প্রতিটা আচার-আচরণ-কর্মে সেই কমিউনিস্ট পরিচিত থাকা বাঞ্ছনীয়। যেভাবে লোকটাকে তোমরা মেরেছে সেটায় একটা ফ্যাসিস্ট সুলভ হিংস্রতার প্রকাশ ঘটেছে। এটা কাম্য নয়। তোমরা লোকটার উপর অত্যাচারের মধ্য দিয়ে একটা বিকৃত আনন্দ উপভোগ করেছো এসব তো ফ্যাসিস্টরা করে, আমরা কেন করব। তাহলে আমাদের সাথে এক সাধারণ অত্যাচারীর কী তফাৎ রইল।
তাহলে কী অপরাধীকে আমরা ছেড়ে দেব? না ছেড়ে দেব না। যদি দেখা যায় অপরাধীর অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য, অপরাধী একেবারে সংশোধনের বাইরে সেক্ষেত্রে হয়ত গলার নলিটা কেটে দেব কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে যন্ত্রণা দেব না। এই মনোভাব আমাদের মানুষের কাছে ঘৃণ্য বলে প্রতিপন্ন করে তুলবে। কমিউনিস্ট না ভেবে কসাই বলে ভাবতে শেখাবে।
ফ্যাসিজম কী? একদিন আমাদের এক নেতা ননীদা বলেছিলেন–ফ্যাসিজম হচ্ছে একটা প্রবৃত্তি। জনগণের উপর নিজের মত বল প্রয়োগ দ্বারা চাপিয়ে দেওয়া এবং তাকে মেনে নিতে বাধ্য করা। মানুষের সমস্ত মানবাধিকারকে খর্ব করে তাকে দাসানুদাসে পরিণত করা। যে ব্যবস্থার বিরুদ্ধে টু-শব্দ করবে তার উপর চরম অত্যাচার নামিয়ে আনা এবং নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। এটাই হচ্ছে ফ্যাসিবাদ। নামে কমিউনিষ্ট হলেওসিপিএম পার্টির মধ্যে এই প্রবণতা তার জন্মলগ্ন থেকেই বিদ্যমান ছিল। যা পরবর্তীকালে ব্যাপক আকারে বৃদ্ধি পায়।
এরপর এল সেই ঐতিহাসিক সাতাত্তর সালের নির্বাচন। পঁচাত্তর সালে ইন্দিরাগান্ধি সারাদেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে দেশ জুড়ে একটা দমন-পীড়ন-হত্যালীলার মধ্য দিয়ে শাসন ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখার অপচেষ্টায় জনগণের শত্রু হিসাবে চিহ্নিত হয়ে যান। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে জয়প্রকাশ নারায়ণ সমস্ত বিরোধী দলকে এক মঞ্চে নিয়ে আসতে সমর্থ হন, গড়ে ওঠে একটা নতুন দল-জনতা দল। সেই দল নির্বাচনে জয়লাভ করে। সেই প্রথম দিল্লিতে গঠিত হয় এক অকংগ্রেসি সরকার।
পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসে বামফ্রন্ট। না, তারা যে সেই সময় শুধু ছলচাতুরি বা ভয় দেখিয়ে ভোটে জিতেছিল এটা বলা অন্যায় হবে। সে পদ্ধতি গ্রহণ করেছে কিছু পরে। তখন মানুষ সত্যিই তাদের বহুমূল্য ভোট এদের পক্ষেই দিয়েছিল। একদিকে তারা যেমন কংগ্রেসের অপশাসন থেকে মুক্তি খুঁজছিল, সিপিএম বা অন্য বাম দলগুলো কিছু জনহিত কাজ করেছিল।
যার প্রথম এবং প্রধান–’অপারেশন বর্গা’।তখন জোতদার জমিদারদের দখলে রাখা সিলিং বহির্ভূত হাজার হাজার বিঘে জমি লাল ঝাণ্ডা পুতে দখল করে ভূমিহীনদের মধ্যে বিলিবন্টন করে বলে দেওয়া হচ্ছিল যদি তুমি আমাদের দলে থাকো দল শক্তিশালী থাকবে। যদি তুমি ভোট দাও দল ক্ষমতায় যাবে। দল ক্ষমতায় থাকলে কারও বাপের ক্ষমতা নেই তোমাদের জমি কেড়ে নেবার। যদি দল ক্ষমতায় না থাকে জানিনা কী হবে। এই দুয়ের যোগফল রাইটার্স দখল এবং দীর্ঘকাল দখল করে রাখা।
সেই যে তারা এসে গেল–আর যাবার নাম নিল না। অজগরের মতো কুণ্ডলি পাকিয়ে আরাম কেদারার উপর পড়ে রইল চৌত্রিশটা বছর। এদের বিষ নিঃশ্বাসে বিষাক্ত হয়ে গেছে। বঙ্গের বাতাস, পুড়ে গেছে কত শান্ত গ্রাম, কতো মায়ের কোল খালি হয়েছে, মুছে গেছে কত সিথির সিদূর। কেউ এদের ঠেলে ফেলতে পারেনি ক্ষমতা কেন্দ্র থেকে। কারণ তারা তখন শিখে গেছে ক্ষমতাকে ধরে রাখার চাণক্য কৌশল শিখে গেছে ভোট বাসো ভরাবার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি।
এই সময় এদের দ্বারা সংঘটিত হয় এই শতাব্দীর সবচেয়ে ক্রুর জঘন্য নির্মম হত্যাকাণ্ডের সেই ঘটনা–যার নাম ‘মরিচঝাঁপি’। কত হাজার মানুষকে হত্যা করে পেট চিরে নদীগর্ভে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে, কত আহত নিহতকে জঙ্গলে ফেলে আসা হয়েছে বাঘের খাদ্য হিসাবে, কেউ তা জানে না। কতশত গরিব গৃহবধু, যুবতী নাবালিকা শিকার হয়েছে বর্বর বলাৎকারের কেউ কোনোদিন তার হিসাব পাবে না।
বস্তুত, এক সময় সারা বাংলায় সিপিএম দল যে ধর্ষণ সংস্কৃতি দ্বারা প্রতিবাদী কণ্ঠ স্তব্ধ করে দিতে উদ্যোগ নেবে তার প্রথম সূচনা হয় এই নির্জন দ্বীপ মরিচ ঝাপিতেই। এরপর তো বানতলা, ধানতলা, সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম–শত শত ঘটনা।
সেদিন মানুষ আক্ষেপে মাথার চুল ছিঁড়বে। বুঝবে, যে দৈত্যকে একদিন তারা বোতলের ছিপি খুলে দিনের আলোয় এনেছিল, মুক্তি দিয়ে দিয়েছিল বন্দিদশা থেকে, কী তার আসল চরিত্র।
তবে মানুষ–খালি গায়ের মানুষ, খালি পায়ের মানুষ খালি পেটের মানুষ চোখের কোণে জল চিকচিক করা মানুষ, জন্মদ্বারে রক্ত দাগ বহন করা মানুষ, ফুটো হয়ে যাওয়া মানুষ। মানুষ…মানুষ…মানুষ…।এরাই সংঘবদ্ধ হলে মহাশক্তিমানও ভয়ে কেঁচো হয়ে যায়। এরাই আবার সেই বোতলের দৈত্যকে বোতলে ঢুকিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আসবে মহাসমুদ্রের অতল জলে।
তবে তার কিছু বিলম্ব আছে এটা তো সবে ১৯৯৭ সাল। অত্যাচারীর সূর্য এখন মধ্য গগনে। কী তার তাপ কী তার তেজ। চারদিক যেন ঝলসে যাচ্ছে সেই তাপে তেজে।
***