০৭. নারী সমাজের উপর হিংসাত্মক উপদ্রব

নারী সমাজের উপর হিংসাত্মক উপদ্রব

কনসাইজ অক্সফোর্ড ডিকসনারি অনুসারে ‘হিংসাত্মক উপদ্রব’ হল কোনও ব্যক্তি বা সম্পত্তির ওপর আঘাত বা ক্ষতিসাধন। প্রাচীন ভারতে মেয়েদের সম্পত্তির অধিকার তো ছিলই না, বরং তারা নিজেরাই (অন্যের) সম্পত্তি গণ্য হত। তাই তাঁদের প্রসঙ্গে হিংসা বলতে তাঁদের ওপর শারীরিক-মানসিক নির্যাতনই বোঝাত। অধুনাতন ইংরেজি ভাষায় person শব্দটি শুধু শরীর বোঝায় বটে, তবে আলোচ্য প্রসঙ্গে তা শরীর ছাড়িয়ে মনকেও বোঝাবে।

নারীবাদী পরিস্থিতিতেও যদি ধরে নেওয়া যায় যে, উপদ্রবকারী অবশ্যই কোনও পুরুষ, কিন্তু আমরা জানি, অন্য কোনও নারীও প্রায়শ তেমন করতে পারে, সে কথায় পরে আসছি। আক্রমণকারী যেই হোক, আক্রান্ত মহিলাটির দুর্দশা ঘটবেই এবং আরও সরাসরি ও শোচনীয় ভাবে সে পাশবিকতার শিকার হবেনই।

বেদে এ কথা স্পষ্ট আছে যে, নারীর শরীর তার নিজস্ব নয় এবং এতটুকু ওজর-আপত্তি না করে পতির কাছে আত্মসমর্পণ করা তার বিধেয়। মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য বলেছেন, কোনও স্ত্রী যদি তার পতির শয্যায় আসতে অসম্মতি জানায়, (প্রথমে) মিষ্টি কথায় তাকে আদর ও অনুনয় করা যেতে পারে; তাতে কাজ না হলে গয়নাপত্রের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাকে ‘কিনে নেওয়া’ও যেতে পারে; আর তার পরও যদি রাজি না হয় তাহলে পতির উচিত লাঠৌষধি কিংবা চড় থাপ্পড় প্রয়োগ।[১] মৈত্রায়নী সংহিতা-য় অনেক বার বলা আছে, নারীশরীর নারীর নিজের নয়, তাই যৌন নিপীড়ন থেকে তার নিজেকে বাঁচানোর সুযোগ নেই।[২] কোনও নারী পরপুরুষের শয্যাসঙ্গী হলে তার নির্দিষ্ট অঙ্গে কাঁকড়াবিছে ঢুকিয়ে শাস্তি দেওয়া হবে।[৩] তার ওই প্রেমিককে মারবার জন্য অভিচারমন্ত্র ও আচারক্রিয়া তো আছেই, যা নিঃসন্দেহে মানসিক নির্যাতন বৈকি।

নারীমাত্রই অশুভ প্রতীক গণ্য হতেন, যেমনটা ছিল কুকুর, শকুনির মতো অশুভ পাখি, বেজি ইঁদুরের মতো প্রাণী ও শূদ্রের বেলায়। এদের মধ্যে যে কোনও একটির হত্যাজনিত পাপের প্রায়শ্চিত্ত ছিল সমান।[৪] তৈত্তিরীয় সংহিতা স্পষ্ট ভাষায় লিখেছে, নারী কেবলমাত্র যৌনসম্ভোগের বিষয়;[৫] গরু, জমি এবং নারীকে অতিমাত্রায় ব্যবহার করা ঠিক নয়— অন্যথায় তারা হয় মরবে নয়তো রুগ্ন হয়ে পড়বে।[৬] অগ্নি পত্নীবৎ অনুষ্ঠানে একটা লাঠি দিয়ে ঘিয়ের ওপর আঘাত করা হত। নির্মম স্পষ্টতায় এই প্রতীক ব্যাখ্যা করে জানানো হচ্ছে— স্ত্রীকেও এই ভাবে মারা দরকার, যাতে তার শরীর কিংবা সম্পত্তির ওপর তার কোনও অধিকার না বর্তায়।[৭]

মানসিক নির্যাতনও অবশ্যই ছিল এবং তা সেই বৈদিক যুগেও। প্রায় সব বেদগ্রন্থই দেখিয়েছে, নারী শুধু অধম জীব তাই নয়, অকল্যাণকরও বটে। সমাজে তার একমাত্র পরিচয় কর্তব্যনিষ্ঠ স্ত্রী, গৃহিণী ও ছেলেদের মা হিসেবে। বারো বছর ধরে পুত্র প্রসব করতে না পারলে সে স্ত্রীকে পরিত্যাগ করা শাস্ত্রসম্মত, ঠিক যেমন মৃতবৎসা হলে পনেরো বছর আর বন্ধ্যা হলে দশ বছর পর তাকে ত্যাগ করা যায়।[৮] এমনকী নববিবাহিত দম্পতি যখন তাদের নতুন ঘরে প্রবেশ করতে যাচ্ছে, তখন বর নববধূর সামনে প্রার্থনা করত— ‘এস, আমরা সঙ্গত হই, যাতে আমরা (অনেক) পুত্র, পৌত্র, দাস, বস্ত্র, কম্বল, ধাতুরাজি, সুশাসক, শিষ্যকুল, প্রচুর খাদ্য ও বহু স্ত্রী পেতে পারি।[৯] ‘শিক্ষিত নারী পুরুষ বৈ তো নয়।[১০] যাবতীয় বড় ধরনের দানের অন্যতম উপকরণ ছিল নারী, মাদি গোড়ার সঙ্গে নারী ও শিশু (দেয়বস্তু হিসেবে থাকা উচিত।[১১] কোনও অশুভ পাখি, শকুনি, বেজি, ইঁদুর, কুকুর ও শূদ্রের হত্যা ও নারীহত্যার প্রায়শ্চিত্ত ব্যবস্থা যে অভিন্ন তাতেই নারীর সামাজিক মর্যাদা বোঝা যায়।[১২] পত্নীকে স্বামীর উচ্ছিষ্ট গ্রহণ করতে হত।[১৩] খ্রিস্টপূর্ব নবম-অষ্টম শতাব্দীতে লেখা একটি প্রাচীন গ্রন্থ জানাচ্ছে, সর্বগুণান্বিত শ্রেষ্ঠ মহিলাও সব দিক দিয়ে অপদার্থ কোনও পুরুষের অধম।[১৪] নারী ও শূদ্র (বলতে গেলে) অশুভ ও অসত্য-র মূর্তি। স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকেদের দীনহীন ভাবে সেবা করবেন মেয়েরা, এটাই ধরে নেওয়া হত। একটি গ্রন্থে তার পক্ষে যুক্তি দেখানো হয়েছে— মেয়েকে (বিয়ে) দেওয়া হয় (বরের) পরিবারে।[১৫]

বরুণপ্রঘাস অনুষ্ঠানে সমবেত জনসমাজের মধ্যেই যজমানের পত্নীকে পুরোহিত জিজ্ঞাসা করতেন— কার সঙ্গে তোমার অবৈধ যৌন সম্পর্ক আছে?[১৬] কোনও পুরুষকে কিন্তু কোনও অনুষ্ঠানে কদাচ এ কথা জিজ্ঞাসা করা হত না। সামাজিক নির্বাসন ও মানসিক নির্যাতনের আর এক দৃষ্টান্ত হল, কঠোর বাক্য ব্যবহার করলে তৎক্ষণাৎ কোনও নারীকে পরিত্যাগ করা হত।[১৭]

এ সব থেকে ধরা যায় যে, হয় সমাজ বুঝে ছিল মেয়েদের মন বলে কিছু নেই, নয়তো বা তা ছিল পুরুষের উদ্ধত নিয়ন্ত্রণে; পুরুষ সচেতন ভাবে নারীবিদ্বেষী ও ধর্ষকাম।

জাতক-এর গল্পগুলোতে এমন একটি সমাজের ছবি আঁকা হয়েছে যা মূলত মেয়েদের প্রতি নির্মম। এর বেশির ভাগ গল্পেই আছে শারীরিক নির্যাতনের দৃষ্টান্ত; কয়েকটিতে মানসিক নিপীড়নের ছবিও আছে। যেমন, একটি তরুণীকে প্রেমে পড়ার অপরাধে অগ্নিপরীক্ষায় বাধ্য করা হয়েছিল। সে যে একটা কৌশলে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছে তা একজন ব্রাহ্মণ দেখে ফেলে এবং তাকে ধাক্কা মেরে প্রেমিকের কাছ থেকে সরিয়ে আগুনে ফেলে দেয়।(৬২) এক বণিকের এক বদমেজাজী কন্যা ছিল। তার দাসেদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করায় তারা তাকে কুয়োর মধ্যে ফেলে দেয়। বুদ্ধ তাকে উদ্ধার করে তার সঙ্গে বাস করেছিলেন। একদিন চোরের দল তাকে তাদের সর্দারের বউ করবে বলে চুরি করে নিয়ে যায়। বুদ্ধ উপস্থিত হলে চোরেদের সর্দার তাকে আঘাত করে। বুদ্ধ তাকে নারীহরণের অপরাধের কথা শোনান। সর্দার তখন মেয়েটিকে দু’ টুকরো করে কেটে ফেলে।(৬৩)

এক রাজা রানিকে খেতে দিতেন না। বুদ্ধ তাঁকে ভিক্ষা করতে বলেন, তিনিও সব কথা রাজাকে জানান। বুদ্ধ তখন তাঁকে সমস্ত ব্যাপারটা রাজসভায় পুনরাবৃত্তি করতে বলেন। অতঃপর বুদ্ধ তাঁকে স্বামীকে ত্যাগ করার পরামর্শ দেন। ততদিনে রাজা কিন্তু উচিত শিক্ষা পেয়েছেন।(২২৩)

কোনও এক জন্মে বুদ্ধ চোর হয়েছিলেন। শ্যামা তাঁর প্রেমে পড়েন। তাঁর আর একজন প্রেমিক বুদ্ধের জন্য নিজের জীবন দেয়। তিনি তাঁর বিশ্বাসঘাতকতার কথা জানতে পেরে তাঁকে হত্যা করতে চেষ্টা করেন, কিন্তু তিনি বেঁচে যান। বুদ্ধের কাছে ভৃত্যদের মাধ্যমে তিনি বলে পাঠান— শ্যামা তোমার জন্য কাতর হয়ে প্রতীক্ষায় রত।’ কিন্তু বুদ্ধ আর আসেননি।(৩১৮)

বিপন্ন অবস্থায় এক রাজদম্পতি ঘরে ফিরছিলেন, ব্যাধের দল তাঁদের একটা পোড়া গিরগিটি দিলে রাজা তাই খেয়ে ফেলেন। রাজার বিদূষক বুদ্ধ ভিক্ষাদানে নারীর কুণ্ঠার অভিযোগ করলে তিনি তার কারণ বুঝিয়ে বলেন। বুদ্ধ বলেন— তাঁকে ত্যাগ করুন; তখন রাজার অনুশোচনা জন্মায়।(৩৩৩) এক ক্রীতদাসকন্যা দেখে ফেলে যে রাজপুত্র তার পিতাকে হত্যা করতে উদ্যত। (রাজপুত্র) তখন তাকে দু’টুকরো করে কেটে পুকুরের জলে ফেলে দেয়। রাজা (স্বয়ং) তা খুঁজে পান। তবে রাজপুত্র অনুশোচনা করায় তাকে ক্ষমা করা হয়।(৩৭৩)

নাগরাজ তাঁর রানিকে এক জলচর সাপের সঙ্গে খেলা করতে দেখে বাঁশের লাঠি দিয়ে তাঁকে পেটান। শারীরিক নিপীড়নের আর একটা দৃষ্টান্ত— রানি একটি মন্ত্র লিখতে চাইছিলেন, যার মূল্য একশো ঘা বেত (সহ্য করা)। তিন নম্বর ঘা পড়তেই রানি চেঁচিয়ে ওঠেন আর তখনই তাঁকে মারধর করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়।(৩৮৬) বিখ্যাত বেশান্তর গল্পে আছে কী ভাবে নির্বাসিত রাজা স্ত্রীপুত্রদের নিয়ে গিয়ে ইন্দ্রের ছদ্মবেশে মারধর করেছিলেন। মানসিক নির্যাতনের একটা আশ্চর্য গল্প দেখি সুজাত জাতকে। সেখানে এক রাজা ফলের পসারিণী সুন্দরী কন্যাকে বিয়ে করেছিলেন। একদিন রাজা যখন সোনার পাত্রে ফল খাচ্ছেন, তখন সরল মনে মেয়েটি জিজ্ঞাসা করে রাজা কী ফল খাচ্ছেন। তাতেই চটে গিয়ে রাজা তাকে কটুবাক্য বলে উপহাস করেন এবং তাড়িয়ে দেন। এমন অনেক উদাহরণই দেওয়া যায়। তবে একটা জিনিস স্পষ্ট— মেয়েরা তখন সম্পূর্ণ ভাবে পুরুষের দয়ায় বেঁচে থাকত। তাকে মারধর করা, হত্যা করা, অপমান করা এবং কোনও তোয়াক্কা না করে তাড়িয়ে দেওয়া যেত।

রামায়ণ-এ অহল্যার সঙ্গে গৌতমের দুর্ব্যবহার আমরা দেখেছি। যৌন অসংযমের জন্য কদাচ কোনও পুরুষকে শাস্তি পেতে হয়নি। বালী মৃত ভেবে সুগ্রীব বালীর পত্নী তারাকে গ্রহণ করেছিলেন। বালী সশরীরে ফিরে এলে তাঁর সঙ্গেই তারা ঘর করতে যান এবং তাঁর মৃত্যুর পর আবার সুগ্রীবের ঘরণী হন। এ সব ক্ষেত্রে বাস্তব হিংসা ছিল না বটে, তবে সমাজ অনুমোদিত মানসিক নিষ্ঠুরতা তো ছিলই, যাতে করে পুরুষের হাতে ফেলার সামগ্রী হিসেবে কোনও নারীকে এ-হাত থেকে ও-হাতে ফিরতে হয়েছে।

সীতাকে তো অন্যায় ভাবে সন্দেহ করা হয়েছে এবং প্রকাশ্যে কঠোর বাক্য বলে অপমান পর্যন্ত করা হয়েছে। প্রতিবাদ না করে রামের সে ক্ষেত্রে নীরবতা পালন সীতাকে অগ্নিদাহের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। অযোধ্যায় তাঁকে নির্দয় ভাবে প্রবঞ্চিত করে অরণ্যে নির্বাসন দেওয়া হয়। অথচ তিনি গর্ভিনী হিসেবে একবার অরণ্যভ্রমণের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন মাত্ৰ। (রাজসভায় সীতার) যমজ পুত্র (লব ও কুশ) বাল্মীকির শেখানো গান গাইবার পর সীতাকে রাজসভায় এসে নিজের সতীত্ব প্রমাণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয় এবং সীতা যে নির্দোষ তা বোঝাতে বাল্মীকি তাঁর হাজার হাজার বছরের তপস্যাবলে সঞ্চিত পুণ্যফল ত্যাগ করার বাজি রাখার পরও এমন ঘটনা ঘটে। এ বার অবশ্য সীতা কার্যকর ভাবে প্রতিবাদ করে অন্তর্ধান করেন। একজন সম্পূর্ণ সতীসাধ্বী ও আন্তরিক ভাবে অনুগত পত্নীর সঙ্গে রামের এই ব্যবহার মানসিক নিপীড়নের ঊর্ধ্বসীমা স্পর্শ করেছে সন্দেহ নেই।

নারী সমাজের ওপরে পুরুষের শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে নির্দয় আচরণ মহাভারতে এত বেশি সংখ্যায় আছে যে বলে শেষ করা যাবে না। আমি তার অল্প কয়েকটি এখানে উল্লেখ করতে চাই। ধৃতরাষ্ট্রের রাজসভায় দ্রৌপদীর প্রকাশ্য লাঞ্ছনা তার মধ্যে সবচেয়ে সাংঘাতিক ঘটনা এবং মূল গল্পের নির্ধারক বৃত্তান্ত। এ ঘটনায় যে শারীরিক ও মানসিক নির্দয়তা প্রকাশ পেয়েছে, তা দেখিয়ে দিচ্ছে মেয়েরা কতটা দীনহীন অসহায় যার জন্য তারা নিষ্ঠুরতার শিকার হলেও সমাজ সে অত্যাচার ক্ষমা করে দিচ্ছে, এমনকী অনুমোদন করছে। সারাটা মহাকাব্য জুড়ে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মেয়েদের উপর বলাৎকারের নানা বৃত্তান্ত ছড়ানো। ধর্ষণকারীকে অপরাধী হিসেবে ঘৃণা করা দূরে থাক, বিজয়ী বীরের মর্যাদা পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। মেয়েদের উপর উপদ্রব করার জন্য কেউ গর্ববোধ করলেও তাকে সংযত করার দৃষ্টান্ত বিরল। পুরাণ গ্রন্থগুলো তো ধর্ষণ, অত্যাচার, মানসিক নিপীড়নের গল্পে পরিপূর্ণ।

এই যে নিজের মনে শুধু অর্জুনকে কামনা করলেও পাঁচ পাঁচটি ভাইকে বিয়ে করতে বাধ্য হন দ্রৌপদী, তাতে খুব সূক্ষ্ম ভাবে তাঁর মনের ওপর নিষ্ঠুর অত্যাচার ঘটেছিল বৈকি। স্ত্রীকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে যযাতি কৌশলে দেবযানীতে উপগত হয়েছিলেন। আচার্য গালবকে গুরুদক্ষিণা হিসেবে তিনি তাঁর নিজের তরুণী কন্যাকে দান করেন। প্রতি বছর একজন হিসেবে তিনজন রাজার কাছে ওই রাজকন্যাকে ভাড়া দেওয়া হয়, যতদিন না তাঁদের জন্য এক একটি পুত্রসন্তান তিনি প্রসব করেন। তাঁর ইচ্ছা, সম্মতি, পছন্দ সম্পূর্ণ ভাবে উপেক্ষিত থেকেছে। এ গল্পটির একটি উপযুক্ত চূড়ান্ত পর্যায় আছে। রাজকন্যা কঠোর কৃচ্ছ্রসাধন ও তপস্যাবলে যে পুণ্য অর্জন করেছিলেন, তাঁর বাবা তার দখল নেন, কেননা তাঁর নিজের পুণ্য স্বর্গলাভের থেকে কিঞ্চিৎ ন্যূন ছিল।

শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের আরও দৃষ্টান্ত: কুনিগর্গের তরুণী কন্যা সুদীর্ঘকাল তপস্যা করেছিলেন। বৃদ্ধ বয়সে জরাগ্রস্ত অবস্থায় যখন তাঁর মৃত্যু আসন্ন এবং বহু প্রচেষ্টায় অর্জিত স্বর্গসুখ লাভও প্রায় নিশ্চিত, নারদ তখন তাঁকে জানালেন যে কোনও নারী কদাচ স্বর্গে যেতে পারেন না! চন্দ্র বৃহস্পতির পত্নী তারাকে অপহরণ করেছিলেন। এই চন্দ্রের ঔরসে তারার গর্ভে বুধের জন্ম। পরে বৃহস্পতি ওই স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনেন। আরও একবার দেখা গেল যার মন বলে কিছু নেই নারী এমন এক জড়বস্তু ও হাতফেরতযোগ্য খেলার সামগ্রী ছাড়া আর কিছু নয়।

এই গল্পে এবং আরও নানা গল্পে যে সূক্ষ্ম ভাবে নারী নির্যাতন সম্ভব হয়েছে তার একমাত্র কারণ নারীকে ভাগ্যবস্তু হিসেবে মনে করার মধ্যে নিহিত। সুতরাং নির্বিচারে তাঁর ওপর অত্যাচার করা যায়! সমাজ নারীকে এমন এক ভাবে দেখতে চেয়েছে যাতে অন্য ভাবে তার সামাজিক প্রয়োজন প্রমাণ করতে না পারায় পিতা, স্বামী বা পুত্র কোনও এক পুরুষের উপরেই তাঁকে নিতান্ত দীন ভাবে নির্ভর করে থাকতে হয়। এমনটা হওয়ার কারণ হল, দুঃখের সঙ্গে তাকে সচেতন থাকতে হত যে তার ভূমিকা পরনির্ভর অস্তিত্ব পদানত এবং তা কাম্যবস্তু হিসেবে নিজের স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের অনুগ্রহে। তাঁরাও জানতেন স্বামীর সম্পত্তির আইনসঙ্গত উত্তরাধিকারী হিসেবে পুত্র উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবে মেয়েটির পরনির্ভরতার কথা।

এই ভূমিকা সম্বন্ধে নারী যে শুধু সচেতনই ছিল তাই নয়, তা অন্তরেও বুঝেছিল। ফলে তার উপর দৈহিক ও মানসিক নিপীড়ন চিরস্থায়ী করা সম্ভব হয়েছিল। বস্তুত আরিস্তোফানিস, ডেরেন্স ও প্লাউতুস-এ বর্ণিত নারীদের অবস্থার কথা আমাদের ভাবা উচিত যাতে হেলেনীয় গ্রিসে ও রোম সাম্রাজ্যে মেয়েদের অগ্রগামী পুনর্মূল্যায়ন ও আইন সংশোধন দেখে পার্থক্যটা ধরা যায়।

এ রকম স্বনির্ভর অবস্থা ভারতীয় সমাজেও লালিত হওয়া সম্ভব ছিল, কিন্তু এখানে মেয়েদের একত্র হয়ে নিজেদের দূরবস্থা আলোচনা করার কোনও মঞ্চ ছিল না। সুতরাং প্রতিটি ঘটনাই বিচ্ছিন্ন ভাবে একক ঘটনা বলে গণ্য হত। বেশ্যাদের বাদ দিলে মেয়েদের ঘটনা নিয়ে কোনও ব্যবস্থারীতিও ছিল না। সুতরাং পুরুষের অত্যাচারজনিত দুঃখকষ্ট মাঝে মধ্যেই সর্বত্র ঘটত এবং তা নিন্দনীয়ও ছিল না, শাস্তিযোগ্যও ছিল না। হাজার বছরের পুরোনো এই কদাচারের অবসান ঘটতে পারে কেবলমাত্র মেয়েদের সংঘবদ্ধ চেষ্টায়, আর যদি তার পিছনে থাকে দ্ব্যর্থহীন স্পষ্ট নীতি ও স্বচ্ছ ভাবে নির্ধারিত আইন।

কুন্তী, গান্ধারী, দ্রৌপদীর মতো নারীব্যক্তিত্ব কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রতিবাদ করেছিলেন সত্য, তবে সমাজ মোটামুটি ভাবে সে প্রতিবাদ উপেক্ষা করার সুযোগ পেয়েেেছ। সুতরাং মেয়েদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন কোনও শাস্তি ভয় ছাড়াই চলে এসেছে।

মেয়েদের নাগরিকত্বের কোনও আইন ছিল না, আইনের চোখে তাদের মর্যাদা ছিল নিচের দিকে। উচ্চ তিন বর্ণের পুরুষরা শূদ্র ও নারীদের ওপর ধর্ষণ, অপহরণ, নিপীড়ন, ইত্যাদি অত্যাচার চালিয়ে যেত, অথচ তার জন্য কোনও শাস্তি পেতে হত না। শুধু বারাঙ্গনার কিছুটা অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতা ছিল এবং বিনা শাস্তিতে তার উপর অত্যাচার কিংবা তার শারীরিক বিকৃতি ঘটানো সম্ভব হত না। মর্যাদাপুরুষোত্তম অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ মানব বলে কথিত রামচন্দ্রের নির্দেশে তাঁরই অনুগত ভাইয়ের হাতে শূর্পণখার শারীরিক বিকৃতি সংঘটিত হওয়ার কথা আমরা জানি। রীতিনীতি এমনই ছিল: সামাজিক ভাবে দুর্বল মানুষ, বিশেষত স্ত্রীলোকও শূদ্রদের ওপর অত্যাচার অনুমোদিত আচরণবিধির মধ্যেই পড়ত এবং তা সম্ভব ছিল এই জন্যই যে পুরুষ ও নারী উভয়পক্ষই তা মেনে নিয়েছিল।

খ্রিস্টপূর্ব নবম শতাব্দীর লেখা তৈত্তিরীয় সংহিতা জানাচ্ছে, নারীর শরীর তার নিজস্ব অধিকারে নয়; সুতরাং চিরটা কাল ধরে নারীদেহ স্বচ্ছন্দে ভোগ করা চলে, ইচ্ছেমতো তার ওপর অত্যাচার করা চলে এবং পুরুষ খুশিমতো তাকে ত্যাগ করতেও পারে। খুব প্রাচীনকাল থেকেই মেয়েদের মন ও অনুভূতির কথা সমাজ গ্রাহ্য করেনি। সুতরাং পুরুষের ধর্ষকামিতা যতক্ষণ না কিছুটা পরিতৃপ্ত হচ্ছে, ততক্ষণ মানসিক নিপীড়ন মেনে নেওয়া হয়েছে। যেটা আরও খারাপ এ ক্ষেত্রে পুরুষদের সচেতনতার ব্যাপারে সার্বিক ঔদাসীন্য কাজ করেছে। এই জন্যই নববিবাহিত স্ত্রীর সামনে বহু পত্নীর প্রার্থনা সম্ভব। এই জন্যই সম্পূর্ণ নির্দোষ স্ত্রী হলেও রামের হাতে সীতার অপমান ও নিষ্ঠুর আচরণের পুনরাবৃত্তি।

প্রাচীন ও মধ্যযুগের ভারতে সামাজিক সত্তা হিসেবে মেয়েদের কোনও রাজনৈতিক আইনগত মর্যাদা ছিল না। নারীর ওপর শারীরিক ও মানসিক নিপীড়নের ব্যাপারটা সমাজের উচ্চকোটির লোকেদের পক্ষে তাই সহজতর হয়েছিল। নারী ও স্ত্রী হিসেবে তার কর্তব্যকর্ম আগেই নির্ধারিত ছিল; সে কাজে ব্যর্থতা বা ত্রুটি হলে তৎক্ষণাৎ নির্যাতন ছিল অবধারিত। এমনকী কর্তব্যহানি হয়নি এমন ক্ষেত্রেও বলাৎকার, যৌন নির্যাতন এবং দুর্ব্যবহার ঘটতে পারত। উদারচেতা ব্যক্তিবিশেষের নৈমিত্তিক মহানুভবতা ছাড়া প্রতিকারের প্রার্থনা করার কোনও জায়গা ছিল না। তার প্রার্থনায় কান না দেওয়াও তাদের পক্ষে অসম্ভব ছিল না। যেমনটা দ্রৌপদীর আবেদনে কুরুবৃদ্ধদের ক্ষেত্রে দেখেছি।

মেয়েদের ওপর বলাৎকার ও নিপীড়নের ঘটনা প্রায়শ তাদের সমাজের পুরুষদের কোনও কাজের প্রতিশোধ হিসেবে সংঘটিত হত। বলতে গেলে, পুরুষদের কোনও বাস্তব বা কাল্পনিক অপরাধের মূল্য দিতে হত সম্পূর্ণ নিরাপরাধ মেয়েদের এবং অন্যান্য দুর্বলদের। এটাকে বাধা দেওয়াও সমাজনীতির অংশবিশেষের বিরুদ্ধাচারণ করা বোঝাত। মেয়েদের পরিকল্পিত ভাবে অসহায় ও পরাশ্রিত হিসেবে ধরে নিয়ে পালন ও রক্ষা করা হত। আর তারাও এই মূল্যবোধ অন্তরে গ্রহণ করে আত্মসমর্পণ করত। একমাত্র কার্যকর প্রতিবাদের মধ্য দিয়েই অত্যাচারের এই কাহিনিগুলোর পুনরাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব ছিল। আজকের দিনেও এই প্রতিবাদ সমান জরুরি।

***

সূত্রাবলি

১. বৃহদারণ্যকোপনিষদ ৬:৪:৭

২. মৈত্রায়নীসংহিতা ৩:৬:৩; ৪:৬:৭; ৪:৭:৪; ১০:১০:১১

৩. আপস্তম্ব ধর্মসূত্র ২৩:৪; হিরণ্যকেশি গৃহ্যসূত্র ১:১৪:২

৪. খাদির গৃহ্যসূত্র ১:৯; ২৩:৪৫

৫. তৈত্তিরীয় সংহিতা ২:৩; ১০:৭

৬. প্রাগুক্ত ১২:৩৯

৭. শতপথব্রাহ্মণ ৪:৪:২:১৩

৮. আপস্তম্ব ধর্মসূত্র ২:১১-১৪; বৌধায়ন ধর্মসূত্র ৪:৬; মনুসংহিতা ৯:৪

৯. হিরণ্যকেশি গৃহ্যসূত্র ১:৬:১২:১৪

১০. তৈত্তিরীয় আরণ্যক ১:১১:৪

১১. সারসস্বতানাময়ন অনুষ্ঠানের জন্য; শাঙ্খায়ন শ্রৌতসূত্র ১২:২৯:২১

১২. শতপথব্রাহ্মণ ১:৯:২৩:৪৫

১৩. খাদির গৃহ্যসূত্র ১:৪:১১

১৪. তৈত্তিরীয় সংহিতা ৬:৫:৮:২

১৫. আপস্তম্ব ধর্মসূত্র ২:১০:২৭:৩

১৬. তৈত্তিরীয় সংহিতা ২:৫:২:২০

১৭. আপস্তম্ব গৃহ্যসূত্র ২:১১:৪]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *